উর্দু গজল

অজিত রায়

পুনরুক্তি হবে, তবু বর্তমান অধ্যায়ের সূচনায় গোপীচাঁদ নারঙ্গের কথাটাই রিপিট করতে হচ্ছে ‘The ghazal is a marvel of the magnetic dynamism of husn o i’shq (beauty and live) in highly charged metaphoric idiom. It is a celebration of love and freedom in an ambience of pure ecstasy and unremitting joy as well profound capacity for enduring pain and suffering. The ghazal is the soul of Urdu poetry and the play of creativity at its peak.’১৫

 উর্দু কাব্যসাহিত্য এক বিরাট মহীরূহ। তার শাখা-প্রশাখাগুলিকে পল্লবিত করেছে গজল, কাশিদা, রুবাই, নজম, মসনবি, মর্সিয়া, গজল প্রভৃতি বিভিন্ন শৈলী। গজলই এদের মধ্যে সবচেয়ে ফ্রেশ বা তাজা। তাজা হলেও আদৌ নবজাত বা কচি নয়। উর্দু শায়রির সর্বাপেক্ষা অনুপম ও নিটোল শৈলী বললেও অত্যুক্তি হয় না। পারস্য দেশে গজলের জন্ম ঘটেছে ঠিক কথা, কিন্তু একে সুন্দর ও সুঠাম অলঙ্কার দিয়ে সালঙ্করা করেছেন ভারতবর্ষের উর্দু কবিরাই।১৬ গজল আজ উর্দু কাব্যসাহিত্যের আত্মা রূপে পরিজ্ঞাত এবং উর্দু কবি-শায়রদের মননবিশ্বে সরাসরি শীর্ষে তার অবস্থান। উর্দু অদবের গুলবাগিচায় সবচেয়ে নাজনীন ফুলটির নামই গজল।

 উর্দু গজলের উদ্ভবকালটিকে চিহ্নিত করা অতিশয় দুরূহ। ভাষা হিশেবে পরিগণিত হবার১৭ অনেক আগে থেকেই উর্দুতে গজল লেখা হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কখন থেকে তার প্রামাণিক হদিশ দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, এ কথা অবশ্যই উল্লেখ্য যে গজলের সূচনা পারস্যের ‘কাশিদা’ থেকে, যা কালক্রমে ‘গজলে’ রূপান্তরিত হয়। আব্বাসীয় জমানায় আরবীয় সংস্কৃতি ফার্সি সংস্কৃতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল। কাব্যসাহিত্যে, বিশেষত কাশিদায় সেই প্রভাব সুদূরপ্রসারী বদল আনতে সহায়ক হয়েছিল। ফার্সি ভাষায় তখন এক বিশেষ ছন্দে কবিতা লেখা হতো, তারই নাম গজল। এর বিষয় ছিল প্রেম ও সৌন্দর্য, যা আরবীয় শায়রদের অতি সহজেই আকৃষ্ট করেছিল। তাঁরা ঐ ছন্দ ব্যবহার করলেন কাশিদায় এবং তারই মোহে পড়ল রাউর-সম্প্রদায়।১৮ পেশাগত ভাবে গাইয়ে হওয়ার দরুন কাশিদাকে তারা গান হিশেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অর্জিত হয় এর জনপ্রিয়তা। গানগুলিতে এমন জাদু ছিল যা শুনলে শ্রোতার মন কখনও ভক্তিতে বিগলিত, কখনও করুণায় আদ্র, কখনও-বা উৎসাহে উদ্দীপ্ত, আবার কখনও হয়ত বেদনায় দ্রাবিত হয়ে উঠত। আরবীয় ধর্মপ্রচারক কবিরা ঐ গানকেই বয়ে আনলেন ভারতবর্ষে।

 আরবে উৎপত্তি হলেও ফার্সি ভাষায় এই বিশেষ জঁরটির যথাযথ বিকাশ ঘটে। যদিও জন্মলগ্নে এই ভ্রূণটির নাম ছিল ‘কাসিদা’ বা ‘কাশিদা’। কাশিদার শাব্দিক অর্থ এমব্র্যাসি বা হেম স্টিচ। বাংলায় যাকে বলে, ঝুলপি-সেলাই; আর হিন্দীতে কাপড়ে বেল-বুটি বসানোর কাজ, যেমন ‘কসিদা কাঢ়না’। অথচ এখানে যে অর্থে ‘কাশিদা’, তার সঙ্গে সূচীকর্ম বা বোনাবুনির কোনো যোগ নেই। আরবি শব্দ ‘কাসাদ’ থেকে এর উৎপত্তি। কাসিদা একটি পুংলিঙ্গবিশিষ্ট বিশেষ্য পদ এবং এটি শায়রির এমন একটি জঁর বা রূপ, যার মাধ্যমে কারও প্রশস্তি বা প্রশংসা করা হয়। মূলত বাদশা-শাহেনশাদের প্রশস্তি গাওয়ার জন্যই লেখ্য-মাধ্যমে এর স্ফুরণ ঘটেছিল। এর সঙ্গে ঈশ্বরের স্তুতি গাওয়ার কোনও যোগ নেই। ইসলাম আগমনের বহু আগে থেকেই আরবে কাসিদা লেখা ও গাওয়া হতো। গোড়ার দিকে ফার্সি-উর্দু কাসিদা লেখা হতো সতেরো চরণে, যাতে থাকত প্রশংসা, নিন্দা অথবা উপদেশের ভাব। কাসিদা লেখকদের বলা হতো ‘কাসিদাগো’ আর যাঁরা কাসিদা পাঠ করতেন, তাঁরা ছিলেন ‘কাসিদাখাঁ’। গোড়ার দিকে ইমাম গজালী, মৌলানা জালালুদ্দিন রুমী, হাফিজ সিরাজী, ফারুখউদ্দিন আত্তার, হাকিম শানাঈ প্রমুখ এই নবপ্রসূত জঁরটির অনুশীলন করে বেশ সুনাম অর্জন করেন।

 সেটা হিজরীর নবম শতক। ভারতবর্ষের ধর্মভূমিতে তখন সুফিমতের১৯ জল সপ-সপ করছে। বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের চিন্তাধারা মিলেছে সুফিবাদে। এ ধর্ম কোনও মুদ্রাঙ্কিত মতবাদ নয়, তা অনাদিকালের, আত্মজ্ঞান উপলব্ধির আশ্রয়। সুফিসাধকেরা সেই ঈশ্বরের উপাসক নন যে থাকে মসজিদে মন্দিরে গির্জায়। ঈশ্বরকে এঁরা ‘প্রিয়তমা’ রূপে বরণ করেছেন। বস্তুত, কোরানের ওপর ভর করে, ভারতীয় ও গ্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে গাঁঠছড়া বেঁধে এঁরা এক নতুন ইসলামিক সমাজের ভগীরথ হতে চেয়েছিলেন। ফলে বেধেছিল শরিয়তী চিন্তার সঙ্গে সংঘাত। ঠিক এই পৃষ্ঠভূমিতে সংস্কৃতির আসরে গজলের অনুপ্রবেশ ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। সংস্কৃতি যেহেতু ধর্মেরও একটি বাহন, তাই গজলকে সুফি প্রভাব থেকে অচ্ছুৎ রাখা সম্ভব হয়নি। সুফিবাদীরাই গজলকে সাহিত্যিক রূপ প্রদান করেন।

 ভারতবর্ষে এত-এত ভাষা থাকতে শুধুমাত্র উর্দুর গুলবাগিচাতেই কেন এমন বিপুল পরিমাণ গজলের ফুল ফুটেছে? জবাব ঢুঁড়তে গিয়ে আমরা পাচ্ছি, তখন এদেশে প্রধান কথ্যভাষা ছিল খড়ীবোলি। খড়ী থেকেই সাহিত্যিক হিন্দী আর উর্দুর জন্ম। হিন্দী কাব্যজগতে তখন কবিত্ত, সবৈয়া, সোরঠা, দোহা প্রভৃতি ছন্দ সুপ্রতিষ্ঠিত। হিন্দী তার সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ভুলতে পারেনি বহুকাল। বিশেষত, অওধি ও ব্রজভাষা কাব্যসাহিত্য এমন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে তার মায়া কাটিয়ে ওঠা একরকম দুষ্করই ছিল, অধিকন্তু অসম্ভব। তাই পুরাতনী ভাষা ও ধারার ছন্দকে পাশ কাটিয়ে হিন্দী এই নতুন কাব্যরীতি বা ছন্দকে আবাহন জানাতে পারেনি। আর উর্দু যেহেতু তখনও তেমন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি, তাই গজল পেলো তার কাছে উষ্ণ আমন্ত্রণ। শুধু আমন্ত্রণ বললে ভুল হবে; বলা উচিত, উর্দু নিজস্ব সাম্রাজ্যের পঞ্চাশ শতাংশই ছেড়ে দিল গজলের অধিকারে।

 আর-একটি লেজুড়-প্রশ্ন পাঠকের মনে জাগতে পারে। যে, উর্দুতে এত-এত অপরূপ ছন্দ থাকতে শেষাবধি গজলই কেন এমন মঞ্জরিত হয়ে উঠল! রুবাই, নজম, মসনবী, কাশিদা ইত্যাদির তুলনায়, বরং সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক মর্যাদা গজলের ভাগ্যেই জুটল কীভাবে? এর একটা বড়ো কারণ, গজল পারস্য দেশেও জনপ্রিয় কাব্যরূপ হিশেবে পরিগণিত ছিল আগে থেকেই। সে দেশে খাজা হাফিজ সিরাজীর (১৩২৫-১৩৯০) নামডাক গজলেরই জন্য। আনুমানিক ১৩৩০ খৃস্টাব্দে হাফিজ ইরানের সাংস্কৃতিক রাজধানী সিরাজ শহরে জন্মেছিলেন। ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়া সত্বে সিরাজ ছিল কবিদেরই শহর, পুষ্পবাগিচার শহর, ফুল আর কোয়েলের শহর, আর মদের শহর। হয়ত এই সেই অমোঘ কারণ, যার দরুন সত্তর বছর বয়স অবধি হাফিজ নিরন্তর ও অসংখ্য গজল লিখতে পেরেছিলেন। এমনকি, তাঁর গজলে বঙ্গদেশেরও উল্লেখ মেলে : ‘সুদূর ভারতের তোতাপাখি’, ‘রূপসী বাঙলায় আনা পারসি মিঠাই’ ইত্যাদি।২০ পারস্যের সময়টা ছিল অপরিমেয় উত্তপ্ত, অশান্ত ও কঠিন। লাঠালাঠি, রক্তারক্তি লেগেই থাকত। বাকবিতণ্ডা আর রাষ্ট্রদ্রোহের দরুণ রাজারাজড়ারা কেউই গুছিয়ে রাজপাট চালাতে পারেননি। সংঘাত আর বিসংবাদ হাফিজের চক্ষুশীল ছিল। তাঁর অন্বিষ্ট ছিল সত্য, সততা ও ঐক্য। সিসৃক্ষায় সেই আকাঙ্খাকে টেনে এনে তিনি তাঁর কবিতাকে দিয়েছেন স্বতন্ত্র দীপ্তি। দ্ব্যর্থকতা, পাশাপাশি সমান্তরাল প্রয়োগ, অনুপ্রাস, উপমা, রূপক ইত্যাদির মধ্যে বিশেষ জোর দিয়েছেন দ্ব্যর্থকতায়। তাঁর কবিতায় ও গজলে রহস্যময় প্রেম ও ভক্তির সমন্বয়, যা মূলত সুফিবাদের অন্যতম স্তম্ভ। এছাড়া তাঁর মধ্যে ছিল লোকশ্রুতি আর লৌকিক প্রবাদের প্রতি অগাধ আনুগত্য। হাফিজের গজলগুলি আকারে ছোটো এবং গীতোপযোগী। ‘ইশকে’র পাশাপাশি ‘শরাব’ও তাঁর উপজীব্য। বলা যায় পারস্যে গজলের রাজত্বই শুরু হয়েছিল হাফিজ সিরাজী থেকে। ইতিপূর্বে সে-দেশে খৃস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে লেখ্য-গজল প্রথম তার প্রায় নিখুঁত রূপটি খুঁজে পেয়েছিল সমকালের আর-এক প্রকাণ্ড ইরানী কবি শেখ সাদীর মাধ্যমে। পরবর্তী কালে হাফিজ সিরাজী তাকে ভিন্ন ছাঁচে গড়ে নিয়ে প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। পারস্যের মানুষ যখন শ্লোক-দোহার দেশে, অর্থাৎ ভারতের ভূমিতে পদার্পণ করল তখন খুঁজে পেলো তার উপযুক্ত উর্বরা জমি।

 উর্দু কাব্যসাহিত্যে গজল সর্বাপেক্ষা বেশি বিকশিত হওয়ার দ্বিতীয় কারণ, নজম কিংবা কাশিদায় যে-কথা বলতে খরচ হয় বিশ-পঁচিশ লাইন, তা গজলের মাত্র একটি শেরেই ব্যক্ত করা অতি সহজসিদ্ধ। গজলের দুনিয়া এমন এক সুউচ্চ চূড়া যার নাগাল পাওয়া উর্দুর অন্য কোনো কাব্যশৈলীর পক্ষে অসম্ভব। ওয়লি দখিনির (১৬৬৭-১৭০৭) ভাষায় : ‘বিন নিঁদ উন অঁখিয়োঁ কো পকড় কৌন সকেগা?’ বাংলায় বলব, ‘গগন নহিলে তোমায় ধরিত কেবা?’ এ উপমাও বিন্দুমাত্র অসংগত হবে না যে গজল এমনই এক ব্যারোমিটার যাতে উর্দু কাব্য-পরিমণ্ডলের সব ক’টি মেজাজ ও ঋতুচক্রের খুঁটিনাটি ধরা পড়ে।

বস্তুত, ভারতীয় সাহিত্যরাজ্যে গজলের সংবৃত্তি বা সূচনা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে যখন এই উপমহাদেশে ভাষা ও সাহিত্য তথা সংস্কৃতি ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক রাহুর যাদুটোনায় হয়ে পড়েছিল একুনে মোহাচ্ছন্ন। গজল সেই জীয়নকাঠি যা মানুষের প্রাণনে নিষেক করল নতুন আস্তিত্বিক চেতনা, প্রেমময় দৃষ্টি এবং অন্তঃস্যন্দী মানবতার তরস্বান তোড়।

 খানিক পেছনে ফিরে যাই। ইতিহাসের যে-লগ্নে ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ও আগ্রাসন শুরু হয়েছিল এবং যার ফলস্বরূপ এই উপমহাদেশে কম্পোজিট কালচারের সূচনা, সেই একই কালপটে আমরা হিন্দু ভক্তি আন্দোলনের মূর্তিটিকে অদূরে দণ্ডায়মান দেখতে পাই, যা ক্রমশ ভারতীয় হিন্দু মানসে বাসাও বাঁধতে শুরু করেছিল। ভারতীয় বহুত্ববাদী ও সমন্বয়ী ঐতিহ্যের এক প্রোজ্জ্বল প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ভক্তি ও সুফি আন্দোলনের মধ্যে। দুটি আন্দোলনই বেশ কয়েক শতাব্দী জুড়ে সৃষ্টিশীল কবি, চিন্তাবিদ এবং ভারতীয় আম জনতাকে প্রভাবিত করে রেখেছিল এবং উভয়েরই একটি সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল।

 যদিও সুফি মতবাদের উদ্ভব আরবে, কিন্তু এর জন্মলগ্নেই এই মতাদর্শের ওপর যোগ, উপনিষদ ও বৌদ্ধ ধর্ম এবং বিভিন্ন ভারতীয় দার্শনিক প্রস্তাবের গভীর প্রভাব পড়েছিল। ভারতে খৃষ্টীয় নবম-দশম শতকে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে যে প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটিই ছিল এখানকার সুফি আন্দোলন। যারা সুফ বা পশমের বস্ত্র পরিধান করে, তারাই সুফি। অর্থাৎ সুফি শব্দটির সঙ্গে ‘সাফা’ বা ‘শুচিতা’ অথবা ‘পবিত্রতা’র কোনো যোগ নেই। সুফিদের মধ্যে মতাদর্শ ও তত্বগত বৈভিন্ন্যের দরুন তাঁদের পারস্পরিক বিরোধও ছিল। ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্য পত্তনের ফলে মুসলিমদের মধ্যে ভোগবিলাস তথা ঐশ্বর্যে দাপ ও উন্মাদনা তথা নৈতিক অধঃপতন চাগিয়ে উঠলে কতিপয় ধর্মপ্রাণ মুসলমান সুফি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন এবং গোঁড়া মুসলমানদের উষ্মা ও রোষের কোপে পড়েন। গোঁড়ারা সুফিদের সরাসরি ইসলাম-বিরোধী দাগা দিয়েছিলেন। ফলে সুফিরা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে জনৈক পীর বা শেখের অধীনে নিজস্ব ধর্মমঠ গড়ে তুলে নির্জনে ধর্মচর্চা শুরু করেন এবং তাঁরা হয়ে ওঠেন ফকির বা দরবেশ।

 সুফিদের মূল তত্ব হলো, প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বরলাভের একমাত্র পথ। এঁরা কোনও বিপ্লবের প্রত্যাশা করেননি, কেবল বিশ্বাস করতেন এমন এক দিন আসবে যেদিন আল্লাহ স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে ইসলামের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন। ভারতবর্ষে বিখ্যাত সুফি সন্তদের মধ্যে গোড়ার দিকে, অর্থাৎ একাদশ শতকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন শাহ রুমি, নথর শা, গনজ বকশ প্রমুখ। রুমি বাঙলায় এসেছিলেন ১০৫৩ সালে। ময়মনসিংহের নেত্রকোণায় তাঁর মকবরা আছে। শেষোক্ত জনকে অনেকে ভারতের প্রথম সুফি সাধক বলে মান্য করেন। ভারতের দাক্ষিণাত্যে সুফি মতবাদ নিয়ে যান নথর শা। চেন্নাইয়ের ত্রিচিনপল্লীতে তাঁর সমাধিভূমি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দ্বাদশ শতক থেকে ভারতবর্ষে সুফি সন্তদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। আসমুদ্রহিমাচল সুফি সাধকরা ছড়িয়ে পড়েন। যাঁরা এই সময় ভারতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন চিশতি ও সুরাবর্দি সম্প্রদায়। ভারতবর্ষে সুফিদের প্রধানত তিনটি সম্প্রদায় প্রভাবশালী ছিল—দিল্লি ও দোয়াব অঞ্চলে চিশতি; সিন্ধু, পাঞ্জাব ও মুলতানে সুরাবর্দি; এবং বিহারে ফিরদৌসি। এছাড়া আরও একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে, সেটি হলো মদানি সম্প্রদায়। চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা খাজা মইনউদ্দিন চিশতি, যিনি তিনি মহম্মদ ঘুরির সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন এবং আজমিরে বসবাস শুরু করেন। চিশতি সাধকদের মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত কবি আমির খুসরো এবং ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বরানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাঙলায় প্রভাবশালী ছিলেন। এঁদের মধ্যে শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগরি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই সম্প্রদায়ের সুফিরা চিশতিদের মতো কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন না, এঁরা এমনকি রাষ্ট্রের অধীনে ধর্মীয় উচ্চপদও গ্রহণ করতেন। এই তিন-চারটি ধারা ব্যতিরেকে সুফিদের আরও কতিপয় উল্লেখযোগ্য ধারা ছিল, এবং কতকগুলি এখনও বিদ্যমান। একাদশ শতকে বাগদাদের সৈয়দ আবদুল কাদির প্রতিষ্ঠা করেন কাদেরিয়া সম্প্রদায়। চতুর্দশ শতাব্দে উদ্ভব হয় বদিউদ্দিন শাল মদারের নেতৃত্বে মদারি সম্প্রদায়। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে তুর্কিস্তানের খাজা বাহাউদ্দিন নক্কশ বনদ গঠন করেন নকশাবন্দি সম্প্রদায়।

 সুফি আর ভক্তি মতবাদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সাদৃশ্য থাকলেও ভক্তি আন্দোলন আসলে সুফি আন্দোলনের চেয়েও প্রাচীন। উপনিষদে এর দার্শনিক ও তাত্বিক লক্ষণ সমূহের প্রতিপাদন রয়েছে। ভক্তি আন্দোলন বস্তুত হিন্দুদের সংস্কারবাদী আন্দোলন। ঈশ্বরে অগাধ ভক্তি, মানুষের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, যাবতীয় ধর্মের সমানতার প্রচার তথা জাতি ও কর্মকাণ্ডের ভর্ৎসনা করা হয়েছে। বাস্তবত, ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দের মাঝামাঝি সময়ে, যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নায়ম্মার তথা আলওয়ার গোষ্ঠীদ্বয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও মনোমালিন্য দূরীভূত করা। কথিত আছে, এই আন্দোলনের প্রথম প্রচারক নাকি শঙ্করাচার্য। ধর্মভিত্তিক হলেও, ভক্তি আন্দোলন অচিরেই গণচরিত্র অর্জন করেছিল। এই চরিত্র অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল সংগীত তথা সহায়ক বাদ্যযন্ত্র। ধর্মপ্রচারক সন্তদের অধিকাংশই ছিলেন কবি ও গায়ক।

 পরবর্তীকালে ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রসারের ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে উদ্বেগ ও অস্থিরতা দেখা দিলে এই আন্দোলন পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মুসলিম শাসকেরা গদি জাঁকিয়ে বসলে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম বরণের ব্যাপক হিড়িক দেখা দেয়। ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। যদিও এই ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব কখনোই বিপন্ন করেনি, তবু এটি হিন্দুদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। আত্মরক্ষা ও সমালোচনার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু ধর্মনেতারা অন্ধ ছিলেন না। তাঁরা নিজেদের ধর্ম ও সমাজের কিছু কিছু কুপ্রথা ও রীতিনীতির বিরোধীই ছিলেন। অন্যদিকে ইসলামের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভ্রাতৃত্ববোধও তাঁদের চোখ এড়ায়নি। ফলে হিন্দু নেতাদের একটি শ্রেণী উদারনৈতিক ধর্ম আন্দোলনের সূচনা করেন। শতাব্দীব্যাপী বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক জনগণের মধ্যে প্রেম, মৈত্রী ও ভক্তির বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদের পূর্ণবিকাশ ঘটেছিল। অর্থাৎ ভক্তিবাদের আদর্শ সুলতানি সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের আগেই উত্থান ঘটেছিল। তবে ইসলামের সংস্পর্শে আসার দরুন ভক্তিবাদ এক নতুন মাত্র পায়। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ভক্তিবাদের প্রসার তার সাক্ষ্য দেয়। বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক এই শুভকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে রামানন্দ, নামদেব, কবীর, গুরুনানক, শ্রীচৈতন্য, মহন্ত শঙ্করদেব, বল্লভাচার্য, মীরাবাঈ, দাদু প্রমুখের নাম সবিশেষ উচ্চার্য।

যে-কথা আগেও বলেছি, ‘উর্দু’ নামকরণের আগে, এবং পরেও, এই ভাষা স্থানবৈভিন্ন্যে নানান উপনামে চিহ্নিত ছিল। হিন্দী আর উর্দুর সংমিশ্রণ ঘটেছিল যেসব জায়গায় সেখানে এটি হিন্দুয়ী, হিঁদয়ী, হিন্দভী, জবান-এ-হিন্দ, জবান-এ-হিন্দুস্তান, হিন্দুস্তানী বোলি, রেখতা ও হিন্দী নামে পরিচিত ছিল; যা পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতে চিহ্নিত হয় জবান-এ-দখিনি, গুজরাতে জবান-এ-গুজারি, এবং দিল্লিতে জবান-এ-দেহলভী, তথা সমগ্র দিল্লি পরিমণ্ডলে সরাসরি উর্দু নামেই ছিল পরিচিত। বস্তুত উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা যার উৎসমূলে রয়েছে দিল্লির জনবুলি বা ডায়লেক্ট পশ্চিমা হিন্দী। ঐ হিন্দী-উর্দু আবার খড়িবোলি নামেও সমধিক খ্যাত। সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে, ভাষার রয়েছে দুটি স্রোতধারা। কথাটি আগেও বলেছি। প্রথমটি প্লুরিসেন্ট্রিক বা পলিসেন্ট্রিক, যা আসলে একাধিক ভাষার সংমিশ্রণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ চাইনিজ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জারমান, কোরিয়ান, পোর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং তামিল। দ্বিতীয়টি মোনোসেন্ট্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ, যার দৃষ্টান্তে স্থান পায় জাপানিজ ও রাশিয়ান ভাষা। হিন্দুস্তানীও বস্তুত দুটি স্ট্যান্ডার্ড ভাষাপদ্ধতি, আধুনিক মান্য হিন্দী এবং আধুনিক মান্য উর্দুর সংমিশ্রশে গঠিত একটি প্লুরিসেন্ট্রিক বা পলিসেন্ট্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ।

যাই হোক, বাদশাহী আমলেই উর্দু গজলের প্রকৃত তাজপোশি সাঙ্গ হয়। হিজরীর নবম শতকে গুজরাট আর দাক্ষিণাত্যে গজলের ভ্রূণটি সাহিত্যের অন্তঃকুটিকে সংবৃত্তি লাভ করে। ভারতে এর বাহক উর্দুভাষী সুফিকবিরা একে সুন্দর ও সুঠাম কাব্যরূপ প্রদান করে একে পরিপুষ্ট করেছিলেন। বলতে পারি বাদশাহী আমলটাই ছিল রুমানিয়ৎ গজলের প্রতিপত্তির যুগ। বাদশাহরা গজলেরও বাদশা ছিলেন। সুরা, সাকি আর গজল—এই ছিল বাদশাহী ঠাটের লক্ষণ। তখনকার মাইনর ঘড়ি জন্ম দিয়েছিল একটি মেজর টাইমকে। যদিচ অতি অর্বাচীন কিছু ক্রিটিক বামনোচিত অপচেষ্টায় শিল্পের সেই অমোঘ মহাকালের মধ্যেও ঘুণ আবিষ্কার করে আত্মতুষ্টির স্বাদ উপভোগ করেন।

‘তুজ লব কী সিফৎ লালে বদকশাঁ সুঁ কহুঙ্গা

জাদু হ্যয় তেরে নয়ন গজলা সুঁ কহুঙ্গা।’

ওয়লি দখিনীর এই শেরের মায়াও শেষাবধি বাদশাহী গজলের ‘চক্রান্ত’ ঢেকে রাখতে পারেনি উনিশ-বিশ শতকীয় সমালোচকদের কাছে। দরবারী গজলকে ‘নীম ওহশী’ অর্থাৎ অর্দ্ধসত্য কাব্যরূপ অবধি বলতে দ্বিধা করেন নি কলীম উল্লাহ। আবার অনেকে বাদশাহী গজলকে মুমূর্ষু সামন্তসমাজের অঙ্গ হিশেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে বিষোদগারণ করেছেন। এঁদের দাবি অনেকটা অনুমোদন সাপেক্ষ। বাদশাহী গজল যে সামন্তবাদের প্রশস্তি রচনা করেছে তার প্রমাণই হলো সেইসব বাদশারা, যাঁরা গজলকে নিছক ব্যক্তিগত বিনোদনের সস্তা উপকরণ হিশেবে ব্যবহার করেছিলেন।

 কিন্তু সমস্ত বাদশাই যে এমত মনোভাবের ছিলেন, বা, সমস্ত বাদশাহী গজলই সামন্তপন্থী—এ অপবাদ মেনে নেওয়া যায় না। বাদশারা বাঈজী আর গজল-ঠুংরির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ঠিক কথা, কিন্তু গজলের কাছ থেকে শায়রদের একাধিপত্য কেড়ে নেননি। যে মুঘলরা একদা হামলাবাজের বেশে এসেছিল, তারাই একসময় ‘ভারতীয়’ বলে নিজেদের পরিচয় জাহির করেছে। সুফিকবিদের অনেকেই শরিয়তী ইসলামের খড়গাঘাতে বলি হয়েছিলেন, একমাত্র মুঘল সম্রাটদের বশংবদ ও বেতনভুক দরবারী কবিরাই আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা যা-কিছুই লিখেছেন সবই সামন্তবাদী, এ-অভিযোগ অতিশয় অযৌক্তিক। কতিপয় সমালোচক মীর-গালিবের মত কাব্য-মহীরূহদেরও বর্জনের জন্য কম্বুক কণ্ঠে দাবি জানিয়েছিলেন, তা একেবারেই হাস্যকর। এঁরা যে নির্দিষ্ট যুগের মাপকাঠিতে গজলকে বিচার করছেন, সে-যুগেই তো মীর গালিব জিগর য়্যাগানা প্রমুখ নিজ-নিজ সৃষ্টিকে ভিন্ন-ভিন্ন সুরব্যঞ্জনায় পরিস্ফুট করে তুলেছিলেন, এতদাবস্থায় এই অভিযোগ আদৌ ধোপে টেকে? এ-কথা ঠিক যে গজলের জন্ম সামন্তযুগের প্রথমার্ধে, কিন্তু সে-যুগেও সামন্ত-প্রভাব-বহির্ভূত এবং সামন্তবিরোধী গজলও অজস্র লেখা হয়েছে।

 আধুনিক উর্দু গজল নিয়েও সমালোচকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। হিন্দীভাষার যুগনায়ক আচার্য পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন একদা বলেছিলেন : ‘উর্দু গজল আরব-ইরানীয় তহজীবের প্রতীক। তাতে বীরের উপমা দেওয়া হয় রুস্তম, সোহরাব, অফ্রসিয়াবকে; কখনও ভীম-অর্জুনের উল্লেখ দেখতে পাই না। উর্দু গজলে নদী মানেই আরব-মেসোপটেমিয়ার নদী, গঙ্গ-যমুনা নয়। সেখানে ফুল মানে নার্গিস। পাখি মানে বুলবুল, ভারতের ময়ূর নয়। ওরা লখনউকে ইরানের অশবাঁ বানাতে চায়।’২১ এটি ছিদ্রান্বেষী দ্রষ্টার কথা। মুসলিম ভারতবিজেতারা ‘হিন্দুয়ানাইজড’ হননি বলে ট্যান্ডনজীর এই ক্ষোভ।

 কিন্তু হিন্দুত্বপ্রাপ্তির সঙ্গে গজলের এইসব প্রতীকী শব্দ ব্যবহারের কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না। মুসলমানেরা এ দেশে এসেছিল তাদের একটি উন্নততর সভ্যতাকে সঙ্গে নিয়েই। থেকেছে তারই ক্রোড়ে। এবং তারা ‘আমরাও ভারতীয়’ বলে যতই ঘোষণা করুক ‘বিলায়েৎ’-চিন্তা (স্বাদেশিকতা) ততই তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। তুর্কি, আফগান, মোগল, পারসিক—কোনো মুসলিম শাসকই নিজেদের বিলায়েতি রীতি-সংস্কার বা ধর্ম-ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করে হিন্দুত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন না। ‘মুসলিম বিজেতারা হিন্দু সংস্কৃতি বা সভ্যতা সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মনোভাব পোষণ করতেন না। তাঁদের হিন্দুত্বপ্রাপ্তির প্রশ্ন তো একেবারেই উদ্ভট।’২২ ট্যান্ডনজীর ধারণা ইসলমা ও বিলায়েৎ অবচেতনারই প্রকাশ ঘটেছে উর্দু গজলে, সাকী শরাব জাম গুলোগুলিস্তাঁ রেগিস্তান উট কাফেলা খর্জুরবীথি আঙুর শিরিণচাঁদ নওয়াজ সওগাত প্রভৃতি প্রতীক সমূহের মাধ্যমে। এই কারণে উর্দু গজলকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন : ‘রাষ্ট্রবিরোধী’। এতদসত্বেও, সেই ট্যান্ডন সাহেবই যখন বলেন, ‘আমি উর্দু গজল ভালোবাসি’, তখন জানতে ইচ্ছে করে এই ‘রাষ্ট্র-বিরোধী’ কাব্যশৈলীতে এমন কী কুসুমাসব আছে যা তাঁর ভালো লাগে!!

 উর্দু গজল যে রাষ্ট্রবিরোধী বা হিন্দুবিদ্বেষী নয়, তার অজস্র প্রমাণের মধ্যে একটি এখানে উদাহৃত করছি। পাঠকের সম্ভবত জানা আছে, হালি আর ইকবাল ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উপাসক। হিন্দু-মুসলমানের বিচ্ছিন্নতার বেদনা রূপ পেয়েছে হালির এই কবিতায়,—

‘অয় বতন অয় মেরে বহিশতে বরীঁ
ক্যা হুয়ে তেরে আসমাঁ ঔ জমীঁ
রাত অওর দিন কা উও সমাঁ ন রহা
উও জমীঁ অওর আসমাঁ ন রহা।’

এর পরেও যাঁরা উর্দু গজলের স্বাদেশিকতায় সন্দেহ প্রকাশ করেন তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই স্যর ইকবালের সেই বিখ্যাত পংক্তি : ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা হিন্দোস্তাঁ হমারা’। যাঁরা উর্দু গজলকে আরব-ইরানের সাংস্কৃতিক প্রতীক বলে চিহ্নিত করতে চান তাঁদের জ্ঞাতার্থে বিখ্যাত শায়র নজীরের একটি কৃষ্ণলীলা বর্ণনার উদ্ধৃতি তুলে ধরি—

‘য়্যারী সুনো য়ে দধি কে লুটৈয়া কা বালপন
ঔ মধুপুরী নগর কে রসইয়া কা বালপন,
মোহনস্বরূপ নৃত্য করইয়া কা বালপন
ক্যা-ক্যা কহুঁ ম্যঁয় কৃষ্ণ-কনহইয়া কা বালপন।’

 বস্তুত, উর্দু গজল ভারতবর্ষের খিলাফৎ কখনো করেনি। পরিবর্তন সাহিত্য-শিল্পের প্রাকৃতিক ধর্ম। গজলেও এই প্রকৃতি বিদ্যমান। উর্দু গজলের ক্ষেত্রে দেশীয়-অন্তর্দেশীয় চেতনা সহ রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তত্ববোধ, বিচিত্র মানসিক জটিলতার সহাবস্থান দুর্লক্ষ্য নয়। পলাশীর যুদ্ধ, ক্রিপসের আগমন, দেশবিভাগ, গান্ধী হত্যা, ইন্দিরা-রাজীব হত্যা, কৃষক-মজদুর আন্দোলন—ইত্যাদি সমস্ত ঘটনার ছবিই গজলে ফুটেছে। এগুলিকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে বহিষ্কারের দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, অপরাধও।

 শায়রে-আজম ফিরাক গোরখপুরী উর্দু গজলের জগৎকে বলেছেন : ‘সদা বহার সদা সোহাগের দুনিয়া’। গজলসম্রাট প্রাচীন বা গোড়ার দিকের গজলের রূপক ও কল্পনা প্রবণতাকে লক্ষ্য করেই হয়ত এই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু আজকের গজল-বিশ্বে নিছক সদা স্ফুর্তি সদা বসন্ত নেই। আছে জীবনের জীবনের রুক্ষতাও—নদীনালা, খেতখামার, আছে শোষণবিরোধী স্লোগানও। এ যুগের গজল শুধুই ইশক (প্রেম) আর হুসনের (রূপ) তহজীব নয়। বিশ শতকের উর্দু সাহিত্যে ফিরাকের যে স্থান, সেখান থেকে কেউ ব্যক্তিগত অভীপ্সায় তাঁকে চ্যুত করতে করতে পারবে না। তাই সম্রাটের আসনে বসে তিনি যে আশ্চর্য সুন্দর ভাষায় গজলের কপালে কলঙ্কের কৃষ্ণতিলক এঁকে দিয়েছিলেন, তা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে বইকি! কিন্তু সত্য চির-সমুজ্জ্বল। তার আলোকস্পর্শে সম্রাটের উক্তির তলায় পূজার ফুল চিরকাল দলিত মথিত হয়ে পড়ে থাকতে পারে না। বস্তুত, যে বিচিত্রমুখী গজল উর্দু সাহিত্যকে গতিমুক্ত করেছে, যার প্রাণরসে সে অভাবিত সমৃদ্ধিতে পূর্ণ বিকশিত হয়েছে, সেই সাহিত্যের ধারায় তাকে সম্বর্ধিত না করে উপায় নেই।

 যাই হোক। আমরা আবার মূল আলোচনায় ফিরে আসি।গোড়ার দিকে যাঁরা গজলকে উন্নীত হতে মদত যোগান তাঁরা কিন্তু প্রায় সকলেই ছিলেন দাক্ষিণাত্যের, অর্থাৎ দখিনি ভাষার কবি। যেমন হায়দরাবাদের কুতুব বংশের খ্যাতিমান অধীশ্বর সুলতান মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ (১৫৬৫-১৬১২), মোলা ওজহী (১৭ শতকের গোড়ার দিকে), মৌলা নুসরতী, দায়েম গওয়াসি (উভয়েই ১৭ শতকের), ওয়লি মোহম্মদ ওয়লি (ওয়লি দখিনি; ১৬৬৭-১৭০৭) এবৎ সিরাজ অওরঙ্গাবাদী (১৭১৫-১৭৬৩)।

 দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজদরবারে মুহম্মদ কুলি কুতুব শাহ, মুহম্মদ কুতুবশাহ, আবদুল্লাহ কুতুবশাহ, আলি আদিলশাহ সানি প্রমুখ প্রাচীনতম গজলকার হিশেবে অভিনন্দিত। মুহম্মদ কুলি কুতুব শাহ ছিলেন দক্ষিণ ভারতের গোলকুণ্ডার কুতুবশাহী বংশের পঞ্চম সুলতান। তিনি তাঁর শাসনকালে (১৫৮০-১৬১১) হায়দরাবাদ শহর এবং সুপ্রসিদ্ধ চারমিনার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ভাইপো ও জামাতা সুলতান মুহম্মদ কুতুব শাহ কুতুবরাজবংশের অধীন গোলকুণ্ডার ষষ্ঠতম শাসক (১৬১১-১৬২৫) ছিলেন। তাঁর পুত্র আবদুল্লা কুতুবশাহ (১৬২৬-১৬৭২) ছিলেন পরবর্তী শাসক। কুলি কুতুব শাহ আরবি, ফার্সি ও তেলুগু ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। উর্দু, ফার্সি ও তেলুগু ভাষায় তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করে ‘সাহেব-এ-দিওয়ান’ খেতাবের মালিক হন। ফার্সি-উর্দু কবিতার প্রচলিত ধারায় নতুন সংবেদনা নিয়োগ তাঁরই কীর্তি। তবে কুলি কুতুবশাহ উর্দু গজলের প্রবর্তক কিনা বলা দুরূহ। বহু পণ্ডিত তাঁর ভাষাকে ‘দখিনি হিন্দীর অমর কবি’ বলার পক্ষপাতি। কিন্তু জ্ঞাত গজলকারদের মধ্যে তিনি যে সবচেয়ে প্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর কবিতায় মেলে সহজ ও স্বাভাবিক ভাব। ভাষাও অত্যন্ত সহজ সরল। তাঁর ভাষায় দেশজ শব্দের প্রাধান্য থাকায় অনেকে তাঁকে হিন্দীকবি বলে চিহ্নিত করেছেন। একশ্রেণীর সমালোচক তাঁকে আদিরসের কবি বলেছেন, আবার তাঁর গীতধর্মী কবিতায় অশ্লীলতারও হদিশ পেয়েছেন। তৎকালীন গজলের সাংগীতিক রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচিত হবার উপায় নেই। কিন্তু গানের স্তর অতিক্রম করে সাহিত্যরাজ্যে গজলে এলে কুলি কুতুবশাহর আদিমরস বা অশ্লীলতার আরোহ বোধকরি তেমন উচ্চগ্রামের নয়। নরনারীর প্রেম ও যৌনবিলাসের কথা যে তাঁর গজলে শালীনতার সীমা লংঘন করেনি তা বলছি না, বরং সেখানে স্থূল রুচির পরিচয় অতিমাত্রায় প্রকট। তথাচ, অশ্লীলতা-কলঙ্কের বাইরে শুচিস্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার যে প্লাবন তাঁর শায়রিতে উচ্চকিত, তার তুলনা তৎকালীন উর্দু সাহিত্যে বিরল। হিন্দীরঙে রঞ্জিত তাঁর একটি গজল উদাহৃত করছি :

‘তু প্যারী ইশক ভী তেরা প্যারা
লগয়া হ্যয় বহুত তুজ জো দিল হমারা।
সখি কুছ ভী সমঝ তু দিল মেঁ অপনে
কিত্তা মিন্নত করে আশিক বেচারা।।
ছবিলী সোঁ লগয়া হ্যয় মন হমারা
কি উস বিন নই হমেঁ য়ক পল করারা।
বসন্ত খেলেঁ ইশক কে আ প্যারা
তুমহেঁ হ্যয় চাঁদ ম্যঁয় হুঁ জো সিতারা।।’

 কুলি কুতুবশাহর কবিতায় সুফি মতাদর্শেরও চিহ্ন দুর্লক্ষ্য নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে, তাঁর গজল গানে আদিরসের ছোঁয়া নেই, বরং রয়েছে পবিত্র শুচিতা। এটি বিরহের আর্তি, মিলনের আকুতি। সেই সঙ্গে একটি উদাসভাব সুরের মধ্যে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে। সমস্ত লালসা ছাপিয়ে আধ্যাত্মিক ভাব স্বয়ং উদ্দীপিত। আসলে, লালসার ভাব এমন স্থায়ী হতে পারে না যে নিছক তাকে অবলম্বন করে শত শত বছর পরেও একটি সাহিত্য বেঁচে থাকতে পারে। কুলি কুতুবশাহর আর একটি বিখ্যাত গজলের প্রথম দুটি শের এরকম :

‘পিয়া বাজ প্যায়ালা পিয়া জায়ে না,
পিয়া বাজ য়ক তিল জিয়া জায়ে না।
কহতে পিয়া বিন সবুরী করুঁ,
কহয়্যা জায়ে অম্মা কিয়া জায়ে না।।’

 যেমন পারেনি মুহম্মদ কুতুবশাহ ও আবদুল্লাহ কুতুবশাহর গজল। অনেকের মতে এঁদের গজলেও আধ্যাত্মিকতা আছে। কিন্তু আমি এঁদের যে-ক’টি রচনা পড়েছি, কোথাও সেই ছাপ খুঁজে পাইনি। মোটা ভজনের ঢঙে লেখা বা স্থূল আদিরসের ক্ষুদ্রাকৃতি রচনাকে ‘গজল’ বলব কোন যুক্তিতে? এঁদের কলমে শুচিস্নিগ্ধ মাধুর্যের অমৃতধারায় গজলের দেহ সিক্ত না হয়ে আরব্যরজনীর তত্বগন্ধী স্থূলত্ব সন্নিবেশিত দেখতে পাই। দৃষ্টান্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম। বরং দাক্ষিণাত্যের তৎকালীন দরবারী কবি মুল্লা ওজহী (মৃত্যু ১৬৫৯) আমদের অভিনিবেশ দাবি করেন। মোল্লা ওজহীর গজলের বিষয়—অপ্রাকৃত প্রেম ও জ্বালা, যা পাঠকের বুকে গভীর আঁচড় কেটে দেয় :

”জিস য়্যার কো ম্যঁয় মংতী হুঁ য়্যার ওহ কহাঁ হ্যয়
সরসোঁ সকী চল জাতী বলে ঠার কহাঁ হ্যয়।
দিল রাত মেঁ থে ছীন লেকর নাট গয়া হ্যয়
উও য়্যার দগাবাজ ঘুঁটে মার কহাঁ হ্যয়।
আশিক তো মুজ এ্যয়সে সকী লাখোঁ হ্যঁয় লেকিন
মাশুক সে ইস দওর মেঁ ইস সার কহাঁ হ্যয়।’

 মুল্লা ওজহীর সমীপকালীন কবি মুল্লা গওয়াসি। তখনকার দক্ষিণী দরবার সমূহে অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই দুই কবির গজলের প্রতিযোগিতা। একজন চাপান গাইতেন, অন্যজন উতোর। এই আরোহন-অবরোহণের ব্যাপারটা অনেকটা বাংলা কবিগানের মতো। ওজহী ও গওয়াসির মধ্যে এই ধরনের সওয়াল-জবাব চলত। গওয়াসি সেই সময় সবচেয়ে সফল, সিদ্ধহস্ত, সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ কবি রূপে চিহ্নিত ছিলেন। তিনি মূলত কাশিদার কবি, কিন্তু গজলেও অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন—

‘ইশক কী আগ মেঁ জলকর খাক হোনা
ইশকবাজী মেঁ চাক-চাক হোনা,
খান হোনা তো সচ হ্যয় আখির কো
খাক ন হুয়ে বীচ খাক হোনা।
উস সজ্জন কী বিসাল কী খাতির
আরজু দিল মেঁ লাক-লাক হোনা,
হ্যয় গওয়াসি য়ো আশিকানা গজল
য়ো গজল সুনে দর্দনাক হোনা।’

 পরবর্তী কালে দাক্ষিণাত্যে বিখ্যাত হন কবি নুসরতী দখিনী, হিন্দী গীতে নারীর যে রূপ ও স্বরূপ, নুসরতী তাকেই নিয়ে এসেছেন গজলে :

‘বিরহী কে নস মেঁ গম জলতা হুঁ শমা নমনে
দিখলা মিয়া দরস এয় খাতর জমালী।
চন্দ্রবদন কহিয়া তো কভী মুঁ সঁভালো বোল
সূরজমুখী কহয়্যা তো কহী য়্যুঁ ন বাত জমালী।’

দখিনি হিন্দীর ঐ সময়ের অন্যান্য বিশিষ্ট গজলকারের মধ্যে আবদুল রজ্জাক মুনশি, মুহম্মদ হুসৈনি মুজ্জঅম, খাস খাঁ, বাবা শাহ হুসৈনী, মীরাঁ ইয়াকুব, গোহরী, মির্জা দাউদ, সিরাজ অওরঙ্গাবাদী প্রমুখের নাম উল্লেখ্য।

 দক্ষিণী গজল রাজাশ্রয়ে পল্লবিত হয়েছে। তাই এর ওপর দরবারী সংস্কৃতির ছাপ খুব স্পষ্ট। দাক্ষিণাত্যের কবিদের মধ্যে প্রাজ্ঞ থেকে চতুর, ঋষি থেকে মনীষী, বাদশা থেকে ফকির সমস্ত ধরনের বুদ্ধিমত্তর সমস্ত স্তরই পরিলক্ষিত। সকলের গজলেই বর্ণিতব্য বিষয় প্রেম ও প্রিয়তমা। কিন্তু শিল্পদৃষ্টিতে অভিনন্দিত হবার মতো সৃষ্টি অল্পই আছে। তবে, আরও একজনের নাম না করলে দখিনি গজলের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি হলেন ওয়লি মোহম্মদ ওয়লি ওরফে ওয়লি দখিনি (১৬৬৭-১৭০৭)। বলে রাখি, তিনটি লাক্ষণিক বৈশিষ্ট্য—স্থানীয় ভাষা ও শব্দ, উপমা তথা রূপকের সাজুয্য প্রয়োগ, এর দরুন দখিনি ভাষার ধরিত্রপুত্র কবিরা কালক্রমে রাজ-অনুগ্রহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সুদূর দক্ষিণ ভারত অবধি বিস্তৃত হওয়াও দখিনি কবিতার জনগ্রাহ্যতার আর একটি বড়ো কারণ। ওয়লি মহম্মদ ওয়লি ওরফে ওয়লি দখিনি, যিনি ওয়লি গুজরাতি এবং ওয়লি অওরঙ্গাবাদী নামেও সমধিক খ্যাত, জন্মসূত্রে ছিলেন মহারাষ্ট্রের অওরাঙ্গাবাদ নিবাসী। তিনি ছিলেন উর্দুর ধ্রুপদী ঘরানার কবি এবং তাঁকে বলা হতো ‘ফাদার অফ উর্দু পোয়েট্রি’। ওয়লির আগে অবধি দক্ষিণ এশিয়ার উর্দু কবিতা এবং গজল ফার্সীতে রচিত হতো এবং তাতে সাদদি, জামী তথা রুক্কানি প্রমুখ ফার্সি পণ্ডিতদের ধরন-ধারণ ও শৈলী অনুসৃত ও পুনরাবৃত্তি একধরনের একঘেয়েমি এনে দিয়েছিল। ওয়লিই সেখানে প্রথম আনলেন বদল। তাঁর কবিতা দখিনির লাক্ষণিক আভায় আলোকিত। ওয়লি কেবল একটি বিশুদ্ধ ভারতীয় ভাষাই ব্যবহার করেননি, উপরন্তু তাঁর কবিতায় ভারতীয় বিষয়, প্রতিমা এবৎ চিত্রকল্পের সমন্বিত ও সফল প্রয়োগ পরিলক্ষিত। ওয়লি ঘন-ঘন দিল্লি থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ থেকে দিল্লি পাড়ি জমাতেন। দিল্লিতে বসবাসকালে তিনি দিল্লি বলয়ের কবিদের মজলিশে সেগুলি পাঠ করে শোনাতেন এবং দিল্লির কবিরা বিমুগ্ধ চিত্তে সেই শৈলী নিজেদের কবিতায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেন। এভাবে, দিল্লির উর্দু ভাষা ও কাব্যসাহিত্যে ওয়লির পরোক্ষ অবদান সংযোজিত হয়েছিল। ওয়লির কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান’ সেসময় দিল্লি বৃত্তে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং এবং সমকালীন ফার্সি কবিরা তাঁর মতো কবিতা সৃষ্টির অনুশীলন আরম্ভ করেন। ওয়লি মহম্মদ ওয়লির হাত ধরেই উর্দু গজলের প্রকৃত সূচনা। যদি বলি ওয়লি অগ্রগামীর ভূমিকা পালন করেছিলেন বলেই পরবর্তীতে জৌক, সওদা তথা মীরের মতো শক্তিশালী কবির উদভব সম্ভবপর হয়েছিল, তৃণমাত্র অতিরঞ্জন হবে না।

 দিল্লির একগুচ্ছ কবি যাঁরা তখনও আমির খুসরোর ধারানুসরণ করে সমকালে চিহ্নিত ‘সবকে-হিন্দী’ (অর্থাউ ইন্ডিয়ানাইজড ফার্সি) ভাষাতেই তাঁদের সিসৃক্ষা জারি রেখেছিলেন; ওয়লি মহম্মদ আলি তাঁদের খালিস উর্দুতে টেনে আনেন, যদিও তখন পর্যন্ত সেটি মূলত দখিনি নামেই পরিজ্ঞাত ছিল। অতঃপর গজলের এক নতুন উত্তরণ-পর্বের সূচনা ঘটে নর্দান প্লেনে, অর্থাৎ উত্তর সমভূমির কবিদের প্রযত্নে। অর্থাৎ দেহলভী এবং লখনভী ভাষার মাধ্যমে। এভাবে আমির খুসরো, যিনি গজলের ভ্রূণ সৃষ্টি করে তাকে হিন্দভী ভাষার গর্ভে লালিত করেছিলেন, তাঁর সেই হিন্দভী ভাষাপ্রযুক্তির মোহজাল বিলুপ্ত হতে সময় লাগল সুদীর্ঘ তিনটি শতাব্দী। এরই সঙ্গে গজলের প্রথম যুগটির পরিসমাপ্তি ঘটল ঠিকই, কিন্তু এর পরপরই গজলের জীবনের অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর-একটি অধ্যায়ের সূচনা ঘটল। সেই নয়াল যুগের প্রবর্তক ওয়লি দখিনী।

হিন্দীতে একটি বাগধারা চালু আছে—’শ্রীগণেশ করা’। কথাটি ‘সূচনা’ অর্থে ব্যবহৃত। হিন্দু পরিবারে কোনো কাজ শুরু করার আগে গণেশপুজোর রীতি আছে। গণেশ তাদের কাছে ‘মঙ্গল ও সিদ্ধির জনক’ বলে সকল দেবতার আগে পূজিত হন। উর্দুতে একেই বলেছে বিসমিল্লাহ বা মহরত। উর্দু গজলের আলোচনার শুরুতে তাই কুলি কুতুব শাহ ও সহ দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য ভিত্তিপ্রস্তর সমূহের পুজো অনিবার্য ছিল। কিন্তু যাকে বলে প্রকৃত সূচনা, সেটা ঘটেছে দিল্লি দরবারে। সে-গজল আত্মপ্রকাশ করেছে দাক্ষিণাত্যের শায়র ওয়লি মোহম্মদ ওয়লি ওরফে ওয়লি দখিনীর হাতে। গঙ্গার জন্ম নাকি বিষ্ণুর দেহ থেকে এবং তাকে ব্রহ্মলোক থেকে ভূতলে আনয়ন করেছিলেন দিলীপরাজার পুত্র ভগীরথ। উর্দু গজলের ভগীরথ ওয়লি দখিনী। গুজরাত ও দক্ষিণ ভারতের সংকীর্ণ পরিসর থেকে গজলের উত্তরণ ঘটেছে দিল্লি ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এদিক থেকে ওয়লি একটি সেতুর কাজ করেছেন। তিনি শুধু উর্দু গজলের সফল ভগীরথই নন, বর্ষীয়ান প্রতিপালকও। তাঁর প্রয়াণ ১৭০৭ সনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাশিদা, মসনবী, কতএ, নজম, রুবাই ইত্যাদি রচনার পাশাপাশি তিনি সমান কিংবা অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব সহকারে উর্দু সাহিত্যের এই নবীন শৈলীর চর্চা করেছেন এবং তাঁকে সাবালকত্ব প্রদান করেছেন।

 তো, গজলের দ্বিতীয় যুগের সূচনা ঘটেছে ওয়লি দখিনীর হাতে। তাঁর নামের পেছনে ‘দখিনী’ কথাটা জুড়ে আছে নিছক দাক্ষিণাত্যে জন্ম বলে। কিন্তু গজলকার হিশেবে দক্ষিণের সঙ্গে তাঁর যোগ অতি সামান্য। তিনি মূলত দিল্লির কবি। দিল্লি দরবারেই অতিবাহিত হয়েছে গজলের স্বর্ণযুগ। লেখা বাহুল্য, এই স্বর্ণযুগ ‘ইশকিয়া শায়রি’র যুগ। যে উর্দু কাব্যসাহিত্যের চোদ্দো আনাই গড়ে উঠেছে মোহব্বতকে কেন্দ্র করে, তারই পরিক্রমা হয়েছে এই যুগে। যাঁদের লেখনী এই দিকটা তুলে ধরেছে তাঁরা হলেন ওয়লি, মুবারক, মজহর, ওয়াকিফ, অসর, দাগ, শেফতা, মীর, গালিব, মোমিন, জাফর, নিজামী প্রমুখ।

 উনিশ শতক ছিল একটি ঘটনাবহুল যুগ, যার ফলসমষ্টিতে সৃষ্ট হয়েছিল বাঙলার পুনরুজ্জীবন। কিন্তু তার প্রস্তুতিপর্ব হিশেবে চিহ্নিত আঠারো শতকও কম ঘটনাবহুল ছিল না। সে-ইতিহাস চিহ্নিত হয়ে আছে দুটি বৃহৎ ঘটনার দ্বারা—মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং বৃটিশ শক্তির প্রসার। এর আগে-পরে অসংখ্য ছোটোবড়ো ঘটনার ঘনঘটা আঠারো শতককে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেমন, পানিপথের লড়াই, নাদির শাহর কৎল-এ-আম, কর্ণাটের যুদ্ধ, মীর জাফরের মসনদপ্রাপ্তি, বাঙলায় ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার, বর্গী-হাঙ্গামা, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, কোম্পানির দেওয়ানি সনদ লাভ, ক্লাইভের দ্বৈতশাসন, ইঙ্গ-মারাঠা লাঠালাঠি, নর্থের রেগুলেটিং অ্যাক্ট, চার্টার অ্যাক্ট, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইত্যাদি। বাইরের ঘটনার আবর্তে যে মানস-রসায়ন হয় তারাই পরিচায়ক সাহিত্য। ওয়লি দখিনীর কাব্য এর উর্দ্ধে থাকেনি। তাঁর শায়রীও দেশকালের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

 কিন্তু ওয়লির খ্যাতি প্রেমের গজলের জন্য। বলা বাহুল্য, তা দেশকালের বাইরে নয়। মানুষের মনের এই সূক্ষ্মতম প্রবৃত্তির এমন নির্মল প্রকাশ ইতিপূর্বের কোনো লেখনীতে ঘটেনি :

‘ওয়লি উস গৌহরে-কানে-হয়া কা বাহ ক্যা কহনা
মেরে ঘর ইস তরহ আওয়ে হ্যয় জ্যোঁ সীনে মেঁ রাজ আয়ে।’

 উর্দু গজলের নবজ বা ধমনীই হলো এই ধরনের ইশকিয়া শের। ওয়লির সুফিয়ানা রঙ তাকে আরও গভীর ও নিবিড় করেছে। এই নিবিড়তা ভাষায় নয়, ভাবে। ভাষাবিচারে তিনি গজলে লঘু তরল অর্ধনাটকীয় ভঙ্গির পক্ষপাতি। হৃদয়াবেগ যেটুকু, তাও সংযত। গজলে তিনি গাঢ়বদ্ধ, কিন্তু আতিশয্য-বর্জিত। নিচের গজলাংশটি তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এখানে ছন্দে কলাচাতুর্য সহ হৃদয়মাধুর্য মিলেমিশে একাকার :

‘দেখা হর সুবহ তুজ রুখাসর কা
হ্যয় মুতালা মুতলউল অনওয়ার কা
মোহ কে সীনে উপর অয় শমা রো
দাগ হ্যয় তুঝ হুসন কী ঝলকার কা।’
কিন্তু কিংবা, আর একটি পড়া যাক—
‘জিসে ইশক কা তীর কারী লগে
উসে জিন্দগী ক্যুঁ ন ভারী লগে
ন ছোড়ে মোহব্বত দম-এ-মর্গ তক
জিসে য়্যার-এ-জানী সুঁ য়্যারী লগে
ন হোওয়ে উসে জগ মেঁ হরগিজ করার
জিসে ইশক কী বে-করারী লগে
হর ইক ওয়ক্ত মুঝ আশিক-এ-পাক কুঁ
প্যারে তিরী বাত প্যারী লগে
‘ওয়লি’ কুঁ কহে তু অগর য়ক বচন
রকীবাঁ কে দিল মেঁ কটারী লগে’

 কুলি কুতুবশাহ থেকে গজলের যে প্রবাহ চলে আসছিল তা ওয়লিতে এসে একটি স্থির বিন্দুতে পরিণতি পেলো। সেই বিন্দুর নাম প্রেম। গজলের সেই উদ্ভিদ প্রেমের সলিলে সিঞ্চিত হয়ে ক্রমে ক্রমে পল্লবিত হয়ে উঠল। কিন্তু প্রেমের যে একটা আলাদা বা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাষা আছে তা ওয়লির গজলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু ওয়লি কেন, মীরের আগে অবধি সমগ্র উর্দুসাহিত্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও সেই ভাষা-ব্যবহারে সাফল্য বা কুশলতা কিছুই মেলে না।

 কিন্তু বিকাশের স্তর বহুবিধ। তা অবহেলার নয়। ওয়লির সমসাময়িক সদরুদ্দিন খান ওরফে ফয়েজ দেহলভীর (১৬৯০-১৭৩৭) কথাই ধরা যাক। এঁর গজলকে আঁকড়ে ছিল ওয়লির কাব্যনির্মাণ ও চিত্রকল্পের গৎ। তবুও স্বাতন্ত্র্য অস্পষ্ট নয়। এই স্বাতন্ত্র্য মানসিক তারতম্যে, গভীরতর চিন্তনে। ফয়েজের গজলের বিষয় লৌকিক সৌন্দর্য ও ভৌতপ্রেম। ভাষা সরল, শান্ত অথচ গতিশীল। সরাসরি কথ্য :

‘তিরী গালি মুঝ দিল কো প্যারী লগে
দুয়া মেরী তুঝ মন মেঁ ভারী লগে
তদী কদ্র-এ-আশিক কী বুঝ সজন
কিসী সাথ অগর তুঝ কুঁ য়্যারী লগে
ভুলা দেওয়ে ওহ সীঁ এ্যশ-ও-আরাম সব
জিসে জুলফ সীঁ বে-করারী লগে
নহীঁ তুঝ সা অওর শোখ এয় মন হিরন
তিরী বাত দিল কো ন্যারী লগে …
… ওহী কদ্র ‘ফায়েজ’ কী জানে বহুত
জিসে ইশক কা জখম কারী লগে’

 এই যে গতিময়তা, তা অস্থির অথবা সঞ্চরমাণ। কাব্য যেখানে ইতিহাস ও সমাজের অন্তঃপাতী ও নিগূঢ় নির্যাস, কবির ভাষা সেখানে সেতুর সঙ্গে উপমায়িত। এখানে আমরা যদি যুগ-প্রতিনিধি গজলকারদের রচনা নিয়ে আলোচনা করি তাহলে গজলের ভাষিক-ক্রমোন্নতি ও বিবর্তনের ছবিটিও ধরা পড়বে। এঁদের মধ্যে প্রথমেই উচ্চার্য আবরু শাহ মুবারক দেহলভীর (১৬৮৫-১৭৩৩) নাম। মুবারকের গজলও প্রেমমূলক। ভাষা ঠিক প্রেমের নয়, কেননা তাতে বেদনা থাকলেও তা শ্রদ্ধা-মিশেল :

‘তু জন্নত কী পরী হ্যয় তুঝে ম্যঁয় ক্যয়সে পাউঁ
জিন্দগী বসর জায়ে তেরী হী খুরবট মেঁ।’

অথবা—

‘আজ য়্যারোঁ কো মুবারক হো কি সুবহ-এ-ইদ হ্যয়
রাগ হ্যয় ময় হ্যয় চমন হ্যয় দিলরুবা হ্যয় দীদ হ্যয়।’

 নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও দরদ এই যুগের প্রথমার্দ্ধের গজলের বিশিষ্ট লক্ষণ। শ্রদ্ধায় দেবীপূজা হয়, মানবীপূজা হয় কি? আর দরদ বা সহানুভূতিতেও প্রেমের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরিত হয় না। তাই ইশকিয়া গজলের কথা উঠতেই আমরা মীর ও গালিবের নামই প্রথম উচ্চারণ করি। তৎপূর্বের অজস্র অবিরল সৃষ্টি-সমুচ্চয়ের একটি ভাষণান্তরে অন্য একটির পুনরাবৃত্তি ব্যতিরেকে কিছু না। এই সুদীর্ঘ কালাবধিতে প্রেমের গজল-সাহিত্য যতখানি উন্নীত হয়েছে, একা মীরের অবদান-পরম্পরায় তদাপেক্ষা ঢের বেশিদূর এগিয়ে গেছে। মজহর দেহলভীর একটি মিসরা ঋণ নিয়ে বলতে পারি : ‘হর রঙ লায়ে লেকিন সব বেরঙ হো গয়ে।’

তবে প্রেমের মুক্তির আকুতি পাখনা ঝাড়তে শুরু করেছিল এর পরপরই। গজলের প্রধান বিষয় প্রেম ও প্রেয়সীর প্রতিমা গড়ার কাজ খানিক ঢিমেচালে হলেও শুরু হয়ে গেছিল। উর্দু গজলের ইতিহাসে নতুন যুগের বিজয়মর্দল দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। এই নতুন যুগের ভগীরথ ছিলেন দিল্লির স্বনামধন্য শায়র মির্জা মুহম্মদ রফি ‘সওদা’ (১৭১৩-১৭৮১), যিনি মূলত গজল ও কাশিদার জন্য প্রসিদ্ধি হাসিল করলেও মাসনভী, মার্সিয়া তর্জীহবন্দ, মুখম্মাস, রুবাই, হিজো এবং কাতাতেও অনুরূপ পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু দিল্লি হয়ে উঠেছিল আহমদ শাহ আবদালি এবং নাদির শাহর উল্লাসমঞ্চ। একাধারে আক্রমণ, লুণ্ঠন ও দাওয়াত যুদ্ধের নিরবচ্ছিন্ন নামতা। এর ফলে দিল্লি বৃত্তের বেশির ভাগ কবি সেখান থেকে সরে এসে শরণ নিয়েছিলেন অওধ নবাবের দরবারে, অর্থাৎ লখনউয়ে। স্বাভাতই, তাঁদের সৃজনশীলতায় দেহলভীর ছাল খসে লখনভীর নির্যাস চুইতে শুরু করেছিল। সওদার সমীপকালীন খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৫) ছিলেন নকশবাদী-মুজাদ্দাদি সুফি সন্ত। জন্ম দিল্লিতে। তিনি নিজস্ব শায়রানা ও সুফিয়ানা প্রতিভা রক্তসূত্রে পিতা ফার্সীর গণ্যমান্য কবি খাজা মুহম্মদ নাসিরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এবং, যে-কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, দিল্লি সেসময় আবদালি আর মারাঠাদের হামলায় ছারখার হয়ে গেছিল ঠিকই, এবং মীর ও সওদার মতো বড় মাপের কবিরা দিল্লি থেকে সরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন লখনউয়ে; কিন্তু দর্দ কখনও দিল্লি পরিত্যাগ করেননি। প্রসঙ্গত এও উল্লেখ থাক, মীর, সওদা এবং দর্দ না জন্মালে উর্দু অথবা উর্দু শায়রির রাজত্ব এতখানি বিসারিত হতে পারত না।

 ঐ কালবৃত্তে মীর মুহম্মদ তকী মীর (১৭২৩-১৮১০) একাধারে দিল্লি আর লখনউয়ের সর্বাগ্রগণ্য শায়র হিশেব পরিগণিত ছিলেন। জন্মেছিলেন আগ্রায়, উদিত ও প্রদীপ্ত হন দিল্লিতে, কিন্তু আবদালির দিল্লি আক্রমণের পর চলে আসেন লখনউ এবং আসাফ-উদ-দৌলার দরবারেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেন, এমনকি অন্তশয্যাও গ্রহণ করেন লখনউয়ে। মীর তকী মীর যেন এক সুউচ্চ গিরিচূড়া, যা থেকে বিগলিত হয়েছে শতযুগের উপজীব্য বহু বিচিত্র কাব্যধারা। টীকাকার মল্লিনাথ প্রণয়ের দশটি দশার উল্লেখ করেছেন—চক্ষু:প্রীতি, মন:প্রীতি, সঙ্গসংকল্প, অনিদ্রা, কৃশতা, অবসাদ, হ্রীত্যাগ, উন্মাদনা, মূর্চ্ছা ও মৃত্যু। মীরের কাব্যই বা কোন অংশে কম? হুসন, ইশক, তসব্বুফ, হকীকী, মতাজী, মজনুয়াত, জুদাই, মওত—কী নেই মীরে?২৩

 উর্দু কাব্যসাহিত্যের একটা বড়ো অংশ প্রেমমূলক গজলের দখলে। ফিরাক গোরখপুরীর ভাষায় : ‘উর্দু ইশকিয়া শায়রীর আসল রস মেলে গজলেই। প্রেমিক হতে গেলে শুধু হৃদয়বান হলেই চলে না, প্রয়োজন উদার ও বৃহৎ মস্তিষ্কের। যে কখনও প্রেমে ঘা খায়নি সে বঞ্চিত অতিশয়।’২৪ ওয়লি আর মীরের ফারাকটা এখানেই। ওয়লি যে-অংশে কবি, সেই অংশেই সুফিকবি। তাই প্রেম-বর্ণনায় সুফি প্রভাবকে কাটিয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্যপক্ষে মীর আপাদমস্তক প্রেমের রঙে রাঙানো। তাঁর ধারণা ছিল, হৃদয়ে প্রেম না থাকলে কবিত্ব আসে না :

‘দূর ব্যয়ঠা গুবার-এ-‘মীর’ উস সে
ইশক বিন য়ে অদব নহীঁ আতা।’

 ভাষার সারল্য মীরের শায়রীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর গজলের প্রাণমূল উত্থিত হয়েছে প্রেমময় নিষ্পাপ হৃদয়যাতনা থেকে, যা সুগভীর করুণা, মানবিক সৌন্দর্য এবং প্রেমের বিবশিতার ফসল :

‘হম কো তো দর্দ-এ-দিল হ্যয়, তুম জর্দ ক্যুঁ হো এ্যয়সা
ক্যা ‘মীর’ জী তুমহে কুছ বিমারী হো গঈ হ্যয়।’

 কিংবা—

‘রাহ-এ-দূর-এ-ইশক মেঁ রোতা হ্যয় ক্যা
আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যয় ক্যা।’

 কিংবা নিচের শেরটি ধরা যাক। এই দুটি পংক্তি জীবনের কোনো একান্ত মুহূর্তে আবৃত্তি করেনি, এমন মাশুক বা প্রেমিক বিরল :

‘দিল কে ফফোলে জল উঠে সীনে কে দাগ সে
ইস ঘর কো আগ লগ গঈ ঘর কে চিরাগ সে।’

 এহেন স্বচ্ছ ও সাবলীল ভাষাই মীরকে ক্লাসিক করেছে। ক্লাসিকের লক্ষণই এই—সরলতা। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সরাসরি স্থান করে নেওয়া—

‘রাত মজলিস মেঁ তেরী হম ভী খড়ে থে চুপকে
জ্যয়সে তসবীর লগা দে কোঈ দিওয়ার কে সাথ।’

 মীর নিজেকে সমর্পিত রেখেছেন প্রেমে। শুধুই কি প্রেমে? হৃদয়ে অন্তস্তল থেকে যা নিঃসৃত হয়েছে তা বেদনাপ্রবাহ—

‘আম আদমী জব রোতে হ্যঁয় প্যার বিন
তেরে দর পে আ জাতা হুঁ প্যার কে লিয়ে।’

 প্রেম নিজের বৃত্তেই ঘুরে মরে না, তার মিলনবিন্দু আছে। সেই মিলনবিন্দুর সন্ধান পাওয়া এবং তাতে লক্ষ্যভেদ করা মীর তকী মীরের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। মীর সেই চক্ষুষ্মাণ কবি যাঁর কাছে প্রেমের রীতিপ্রকৃতি কিছুই ঢাকা থাকে না। তিনি জানেন প্রেমে বুদ্ধি চেতনা সমস্ত পুড়ে ছারখার হয়ে যায় এবং প্রেমিক সেখানে নিঃসঙ্গ, একাকী—

‘সব গয়ে—দিল, দিমাগ, তাব-ও-তওয়াঁ
ম্যঁয় রহা হুঁ, সো ক্যা রহা হুঁ ম্যঁয়!’

বিরহানলে পুড়ে যায় প্রেমিক-হৃদয়। তবুও তার প্রতীক্ষা, তবুও তার প্রত্যাশা—

‘আগে করেঁ কসু কে য়ে দস্তে-তমা দরাজ
য়ে হাথ সো গয়া হ্যয় সিরহানে ধরে ধরে’

 পাঠক মীরের এক-একটি শের পড়া শেষ করেন আর তাঁর মনে জন্মায় অপার বিস্ময়,—এই যে এইমাত্র একটা জিনিশ পড়লাম, এটা তো আমারই উপলব্ধি, কবি সেটা জানতে পারলেন কীভাবে!! এই ধরনের শেরের মাধ্যমেই মীরের গজলসৃষ্টির মৌল স্বরূপটি চিনে নিতে ভুল হয় না আমাদের। বস্তুত, মীরের গজলের বিচরণভূমি প্রেম হলেও, তা বিরাট ও ব্যাপক এক বিশ্ব। এই বিচরণভূমি কেবল বৈচিত্র্যের প্রকাশে নয়, একই প্রেরণার ঐশ্বর্যরঙিন বিভার প্রকাশ।

‘দিদনি হ্যয় শিকস্তগী দিল কী
ক্যা ইমারত গমোঁ নে ঢাঈ হ্যয়
দেখ তো দিল কি জাঁ সে উঠতা হ্যয়
য়ে ধুঁয়া সা কহাঁ সে উঠতা হ্যয়
বজহে-বেগানগী নহীঁ মালুম
তুম জহাঁ কে হো ওহাঁ কে হম ভী হ্যঁয়’

 মহম্মদ হসন অস্করী লিখেছেন : ‘মীর কাব্য করেন না, নিজের অন্তস্থিত মানুষটির অনুসন্ধান করে তাকে বাইরের মানুষটির সঙ্গে যুক্ত করেন। এই যুক্ত করার ব্যাপারে তাঁর কোনো আড়ষ্টতা নেই। এই অর্থে মীর অতিশয় আধুনিক। তাঁর গজলে যে ‘আমি’ কথা বলছে সে ভিতরকার সেই ‘আমি’। বাইরের মীর ভিতরকার মীরের সাথে একাত্মবোধ করে নিজেকে এই ‘আমি’র মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন।’২৫

‘ইশক মীর এক ভারী পৎথর হ্যয়
কব য়ে তুঝ না-তওয়াঁ সে উঠতা হ্যয়।’

 মীর দুর্বোধ্য নন। তাঁকে বোঝবার জন্য মল্লিনাথ লাগে না। হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় তাঁর সহজ সরল ভাব। মীরের গজলে এমন কিছু শের আছে যেগুলি একবার পাঠে তৃপ্তি হয় না। কবির কাজ যেখানে চুকেবুকে যায়, সেখান থেকেই আমাদের কর্মের শুরুয়াৎ—

‘ঝুটপুটা শাম কা, বহতা হুয়া দরিয়া ঠহরা
সুবহ সে শাম হুঈ, দিল ন হমারা ঠহরা।’

 মীর যে আজও কিংবদন্তী হয়ে যাননি, কালিদাসের মতোই চির-আধুনিক রয়ে গেছেন২৬, তার অন্যতম প্রধান কারণ তাঁর ভাষা দুরূহ অথচ দুর্বোধ্য নয়। ভাষার দুরূহতা আরবি-ফার্সি শব্দের জন্য, ভাবের জাটিল্য সেখানে নেই। উদাহরণত ধরা যাক নিচের গজলটিকে যেখানে আছে এক দেহপসারিণীর প্রণয়চিত্র :

‘এয় নুকীলে য়ে থী কহাঁ কী অদা
খব গয়ী জী মেঁ তেরী বাঁকী অদা
জাদু করতে হ্যঁয় ইক নিগাহ কে বীচ
হায় রে চশমে দিলবরা কী অদা
বাত কহনে মেঁ গালিয়াঁ দে হ্যয়
সুনতে হো মেরে বদজুবাঁ কী অদা
খাক মেঁ মিল কে ‘মীর’ হম সমঝো
বেঅদাঈ থী আসমাঁ কী অদা’

 ফারুক জানম খাঁ যথার্থ বলেছেন, মীরের প্রেম লিবিডো-ভারাতুর জৈবিক আকর্ষণ নয়, তা শাশ্বত, সুন্দর ও চির-আকাঙ্খিত। এই কারণে তাঁর গজলও চির-অম্লান থাকবে—

‘ছাতী জলা কর হ্যয় সোজ-এ-দরুঁ বলা হ্যয়
ইক আগ সী রহে হ্যয় ক্যা জানিয়ে কি ক্যা হ্যয়’

 মীরের ভাষা সরল, কিন্তু তার অনুশীলনে নেশা ধরে। তিনি ঔদাস্যের কবি, কিন্তু গজলে হরেক রঙের ফোয়ারা তুলে মাতোয়ালা করে দেন তিনি। মীরের জীবন ও গজলের বহুরঙা ভাষা দ্বন্দ্বময় চৈতন্যে আকীর্ণ, অথচ তীব্র আস্তিক্যবোধের আলোয় উজ্জ্বল। এরই প্রমাণ মিলবে নিম্নোদ্ধৃত গজলটিতে :

‘হস্তী অপনী হবাব কী সী হ্যয়
য়ে নুমাইশ সরাব কী সী হ্যয়
নাজুকী উস কে লব কী ক্যা কহিয়ে
পংখুড়ী ইক গুলাব কী সী হ্যয়
চশম-এ-দিল খোল ইস ভী আলম পর
য়াঁ কী অওকাত খোয়াব কী সী হ্যয়
বার বার উস কে দর পে জাতা হুঁ
হালত অব ইজতিরাব কী সী হ্যয় ….
…. ‘মীর’ উন নীম-বাজ আঁখোঁ মেঁ
সারী মস্তী শরাব কী সী হ্যয়’

 আবদালি আর নাদিরশাহর হামলায় ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দিল্লিকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন মীর। দিনদাহাড়ে খুন আর লুটপাটের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। সেই ত্রাস ও বিভীষিকার ছায়া তাঁর রচনায় পড়েছিল। নিজের গজল সম্পর্কে বলেছিলেন,

‘হমকো শায়র ন কহো মীর কি সাহিব হমনে
দর্দ-ও-গম কিতনে কিয়ে জমা তো দিওয়ান কিয়া।’

 অথচ সেই মীরকে বলা হয়েছে ‘খুদা-এ-সুখন’, অর্থাৎ কাব্যের ভগবান। কথিত আছে, মির্জা গালিব একদা যখন এক দরবেশের মুখে প্রথম মীরের নজম শ্রবণ করেন, সবিমুগ্ধ শ্রদ্ধায় তিনি বলে উঠেছিলেন :

‘দেখতে কে তুমহী নহীঁ হো উস্তাদ গালিব
কহতে হ্যঁয় পিছলে জমানে কোঈ মীর ভী থা!’

ভালো কথা। সারস্বত ক্ষেত্রে ‘উর্দু’ নামটিকে কিন্তু কয়েনড বা মুদ্রিত করেছিলেন, মীর অথবা গালিব নয়,—তাঁর নাম মাসহফি গুলাম হমদানি (১৭৫১-১৮৪৪)। তৎপূর্বে উর্দু পরিজ্ঞাত ছিল ‘জবান-ই-ওর্দু’ নামে, যেটি সাধারণভাবে হিন্দুস্তানী, হিন্দভী, হিন্দী, দখিনি বা রেখতার উপনাম ছিল এবং যার সম্মিলিত ডাকনাম ছিল লশকরি জবান, অথবা নিছক ‘লশকরি’। মীরের সমীপকালীন হমদানি আঠারো শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শায়র। ঝরঝরে উর্দু ভাষায় অজস্র শের এবং গজল লিখেছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাঁর একটি বিখ্যাত গজলের কতিপয় শের পেশ করি :

‘ইস কদর ভী তো মিরী জান ন তরসায়া কর
মিল কে তনহা তু গলে সে কভী লগ জায়া কর
দেখ কর হম কো ন পর্দে মেঁ তু ছুপ জায়া কর
হম তো অপনে হ্যঁয় মিয়াঁ গ্যয়র সে শরমায়া কর ….
…. হম ভী এয় জান-এ-মন ইতনে তো নহীঁ নকারা
কভী কুছ কাম তু হম কো ভী তো ফরমায়া কর
তুঝ কো খা জায়েগা এয় ‘মুসহফি’ য়ে গম ইক রোজ
দিল কে জানে কা তু ইতনা ভী ন গম খায়া কর’

 সমকালে আরও দুই মহীরূহপ্রতিম শায়রের অবদানও আমরা বিস্মৃত হতে পারি না—গালিব আর মোমিন, যাঁদের পুণ্যস্পর্শে ইতিহাসের দরবারে উর্দুর তাজপোশি সমাধা হয়েছিল। দুজনেই ছিলেন দিল্লির কবি।

 আমি ভাষার সারল্যে বিশ্বাসী, ভাবের সারল্যে নয়। সেখানে আমি দুরূহতার পক্ষপাতি। বন্ধুমহলে আমার এই বিশ্বাস ধিকৃত হলেও পাকে-প্রকারে তাঁরাও কবিতার দূরবগাহের অনুমোদন না করে পারেননি। কোনও কবিতা পড়ামাত্র তার সমস্তটা যদি বুঝে ফেলি, কবিতার তবে আর রইল কী? দুর্বোধ্য না হয়ে যেসব কবিতা দুরূহ হয় তাদের অনুশীলন শ্রমসাপেক্ষ হতে পারে কিন্তু তা এক জায়গায় এসে থামতে বা ঠোর পেতে বাধ্য। এদের মূলে থাকে একটি কৌতূহল; যত দফা পড়ি, প্রত্যেক বারই দ্রৌপদীর শাড়ির মতো অফুরন্ত রহস্যের উন্মোচন ঘটতে থাকে। পক্ষান্তরে বলা যায়, কবিতার আত্মা হলো সেই জিনিশ যা যুক্তির অতীত, বুদ্ধিতে যার তৌল হয় না, যা কেবল ধ্যানযোগ্য। কবিতা বিধিবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, ব্যাকরণ-সম্মত এবং বিশ্লেষণ উপযোগী না-ও হতে পারে। কিন্তু তার গভীরে মননশীলতায় আচ্ছাদিত যে এক রসরহস্য, তাকে অস্বীকার করি কোন যুক্তিতে? দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যেও হতে পারে, কিন্তু তার জন্যে কবিকে দোষারোপ করাটা অন্যায়।২৭ কবি কেবল একটি গাছ—তাকে ঘিরে যে বিস্ময়, রহস্যময়তা—তাই কবিতা। সেহেন এক প্রোচ্চ মহীরূহের নাম অসদ উল্লা খাঁ গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯)। যিনি তাঁর কবিতায় ফার্সি শৈলী এবং তখল্লুসের সাজুয্য প্রয়োগের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাঁর আসল নাম মির্জা অসদউল্লাহ বেগ খান, কিন্তু মূলত তাঁর ছদ্মনাম ‘গালিব’ এবং ‘অসদ’ নামেই সবিশেষ বিখ্যাত। মির্জা গালিবের জন্ম তৎকালীন আকবরাবাদ বা আধুনিক আগ্রায়। কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভার সমগ্র বিচ্ছুরণ ঘটে দিল্লিতে। ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় সুদক্ষ হলেও তাঁর সৃষ্টিকর্ম সবই উর্দুতে। মাত্র এগারো বছর বয়সে গালিবের কাব্যযাত্রার সূচনা ঘটেছিল এবং তেরো বছর বয়স থেকে তিনি দিল্লিতে বসবাস শুরু করে নিজস্ব কাব্যপ্রতিভা আদিগন্ত বিস্তৃত করেন। তিনি ছিলেন মুঘল দরবারে সর্বোৎকৃষ্ট কবি। গজল, কাশিদা, রুবাই, কিতা এবং মার্সিয়ায় ছিলেন সমান সিদ্ধহস্ত। অধিকন্তু, উর্দু শায়রি ও গজলের দুনিয়ায় মীরের পর গালিবই আর-এক অভ্রংলিহ চূড়া যা থেকে বিগলিত হয়েছে শত-শতকের উপজীব্য অমৃত রসের নিরবচ্ছিন্ন সুধা, যার সেবনে কেবলমাত্র পাঠক ও শ্রোতার মনের তৃষ্ণাই নিবৃত হয় না, ভাষারও বাচ্চাদানি উপর্যুপরি স্ফীত হয়।

 অবশ্য উর্দুসাহিত্যে গালিব সেই অর্থে ক্লাসিক নন, যে-অর্থে গ্রীসে হোমারকে বাদ দিয়ে ভার্জিল এবং সংস্কৃতে বাল্মীকির পরিবর্তে কালিদাস স্বীকৃত। দুর্বোধ্যহীনতা এঁদের কাব্য-বৈশিষ্ট্য। ঐ প্রচলিত নিয়মে উর্দু সাহিত্যের একান্ত প্রতিভূ গালিব নন,—মীর। কিন্তু ভাববিচারে গালিবকে ধ্রুপদী চত্তরের বাইরে স্থান দেওয়া অসম্ভব। শের-শায়রীর লক্ষণই হলো যা চট করে বুঝে উঠতে পারব না বলেই শেষাবধি একটা চাপা আনন্দের রেশ আমাদেরকে তার প্রতি উন্মুখ করে রাখবে।

‘কর্জ কে পীতে থে ময় লেকিন সমঝতে থে কি হাঁ
রঙ লাওয়েগী হমারী ফাকা-মস্তী এক দিন
নগমা-হা-এ-গম কো ভী এয় দিল গনীমৎ জানিয়ে
বে-সদা হো জায়েগা য়ে সাজ-এ-হস্তী এক দিন’

 মির্জা গালিবের গজলে আমরা শব্দের দুটি রূপ পাই। একটি তার ক্ষরিক, অন্যটি আক্ষরিক। একটি মায়িক, অন্যটি কায়িক। অর্থাৎ ক্ষর ও অক্ষর এই দুয়ে মিলে শব্দরূপ। শব্দ, অর্থাৎ যা কাব্যকথার দেহ ও আত্মা গড়ে তোলে। যা স্থির, রূপান্তরহীন, নিরন্তর বহমান তাই অক্ষর। তার অর্থও নির্দিষ্ট, বিকল্পহীন ও সুস্পষ্ট। আর ক্ষর ঠিক এর উলটো। যা ক্ষরিত, বিচ্ছুরিত ও রূপান্তরিত। এর কোনো অর্থ নেই, আছে কেবল উপলব্ধি। তাই গজলের কোনো অর্থ বা সংজ্ঞা হয় না—তা ‘অপরিভাষিত’। এ-কথা গূঢ় অর্থে সত্যি। মহৎ গজল কোনো মানে বা অর্থে আটকে অনড় হয়ে থাকে না। বরং তার অন্তর্বাহিত ধারাটি ব্যঞ্জিত ও প্রবাহিত হয়ে আমাদের উপলব্ধিতে, বোধে এক ভাব-মৌচাক রচনা করে। জীবনানন্দের বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতার মগ্ন অন্তর্লীন রূপের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো প্রাবন্ধিক যে পন্থা অবলম্বন করেছেন২৮, সেই পন্থা বা পদ্ধতি অনুসরণ করলে আমরা গালিবের গজলেও সেই দ্বিমাত্রিক ধারাটি খুঁজে পাবো। পাঠকের কাছে গালিবের শায়রী অনেকসময় কষ্টপাঠ্য ঠেকতে পারে, কিন্তু কোনোটি অনাবশ্যক মনে হয় না। পাঠান্তে পাঠক বুঝতে পারেন, তার অন্তর্নিহিত অর্থটি এমনভাবে ধরা পড়ত না যদি-না তা অরূপতার সন্ধানে তাঁদেরকে ব্যাপৃত রাখত। জটিল অথচ দুর্বোধ্য নয়, আছে জঙ্গমতার সাদ—যা গজলের গতি। এই গতিই আমাদের শেষাবধি দূর থেকে দূরতরে নিয়ে যায়—

‘হমকো মালুম হ্যয় জন্নত কী হকীকৎ লেকিন
দিল কে খুশ রখনে কো ‘গালিব’ য়ে খ্যয়াল অচ্ছা হ্যয়
উনকো দেখে সে আ জাতী হ্যয় মুঁহ পর রওনক
উও সমঝতে হ্যঁয় কি বীমার কা হাল অচ্ছা হ্যয়’

 মির্জা গালিবের গজলের প্রতিটি শেরে একটি করে অদৃশ্য শের আছে, যেন ভাসমান শেরের তলায় আর একটি মগ্ন শের। একটির সঙ্গে অন্যটি পৃথক নয়, বরং লগ্ন—কিন্তু নিমজ্জিত, অতএব অদৃশ্য। একটি আরেকটি হতে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং যুক্ত—একে-অপরের পরিপূরক। ডুবরির মতো ডুব দিয়েই, গজলে নিমগ্ন হয়ে, এই দ্বিতীয় শেরটিকে, অন্য গজলটিকে ধরা সম্ভব। মুদ্রিত গজলের আড়ালে এই যে আরেকটি গজল, যেটি গালিবের মগ্ন গজল, সেটিই তাঁর আসল গজল।

‘ন থা কুছ তো খুদা থা, কুছ ন হোতা তো খুদা হোতা
ডুবোয়া মুঝকো হোনে ন হোতা ম্যঁয় তো ক্যা হোতা’

 যে কবির সৃষ্টি এমন বিস্ময় উৎপাদন করে তিনি ক্লাসিক নন সেটাই বা বলি কেমন করে? গালিবের গজলের এক-একটি শের, যেগুলি আজ প্রবাদবাক্যের মতো বিশ্বময় মানুষের মুখে-মুখে ফেরে, সেগুলি উর্দুসাহিত্যের অমূল্য সম্পদই নয়, আত্মাও বটে : ‘ওহী হোতা হ্যয় জো মঞ্জুর-এ-খুদা হোতা হ্যয়’, ‘ইশক পর জোর নহীঁ হ্যয় য়ে উও আতিশ গালিব’, ‘তু অগর মেরা নহীঁ বনতা, ন বন, অপনা তো বন’, ‘সাফ ইধর সে উধর নজর আতা হ্যয়’, ‘কভী হম উনকো কভী অপনে ঘর কো দেখতা হুঁ’, ‘তুঝে অঠখেলিয়াঁ সুঝী হ্যয় হম ব্যয়ঠে হ্যঁয়’, ‘সাফ ছুপতে নহীঁ সামনে ভী আতে নহীঁ’, ‘শোলা সা লপকে জায়ে হ্যয়, আওয়াজ তো দেখো’, ‘ক্যা বনে বাত জহাঁ বনায়ে ন বনে’, ‘আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যয় ক্যা’ ইত্যাদি এ দাবির প্রোজ্জ্বল প্রমাণ। গালিবের অথৈ ভাবসমুদ্রে হানা দিয়ে আজকের বহু কবি নিজেদের রচনায় উদ্ধৃরণ দিচ্ছেন। এখনও কি বলতে হবে তিনি ক্লাসিক নন! উর্দু গজলে মীরের জবাব নেই, এ-কথা নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেখানে গালিবের যে সিংহাসন, তা কেড়ে নেবো বললেই কেড়ে নেওয়া যায়? মীর প্রেমমূলক গজলের বাদশা, গালিব বেদনামূলক গজলের শাহেনশা। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দুজনেই অনন্য। মীর যেখানে আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত, গালিব সেখানে বাইরের মানুষটিকে খুঁজে ফিরছেন, সেই মানুষটির মধ্যেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছেন—

‘হ্যয় কুছ এ্যয়সি হী বাত জো চুপ হুঁ
‘বরনা ক্যা বাত কর নহীঁ আতী’

 গালিব সংক্রান্ত অ্যানেকডোট সমুহ এবং তাঁর চিঠিগুলি তাঁর গজলের ‘টীকা’-স্বরূপ। চিঠিগুলি পড়লে বোঝা যাবে তিনি দুঃখ ও বেদনাকে কবিতার নিয়তি হিশেবে মেনে নিয়েছিলেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন :

‘মুশকিলেঁ মুঝপর পড়ীঁ ইতনী কি আসাঁ হো গঈ
দর্দ কে হদ সে গুজরা হ্যয় দওয়া হো জানা।’২৯

 এধরনের নানান শের বিশ্লেষণ করে দেখানো যায়, মানুষের বেদনার সঙ্গে গালিব নিজের হৃদস্পন্দনকে এক করে ফেলেছিলেন। গজলের দুনিয়ায় গালিব যে বেদনার রঙ ছড়িয়েছেন তার নকলেও আজগের কবি ব্যর্থ। গালিব এমনই বস্তু যা আমাদের ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে। যাকে কেবল ধ্যান করা যায়, লাভ করা যায় না। মীরের খ্যাতি যেখানে ইশকিয়া গজলের জন্য অবিসংবাদিত, গালিব সেখানে কষ্টপ্রিয়তা বা মুশকিল-পসন্দিগীর জন্য মশহুর—

‘দিল-এ-নাদাঁ তুঝে হুয়া ক্যা হ্যয়
আখির ইস দর্দ কী দওয়া ক্যা হ্যয়।…
ম্যঁয় নে মানা কি কুছ নহীঁ গালিব
মুফত হাথ আয়ে তো বুরা ক্যা হ্যয়।’

 গালিবের গজলে নারী বেদনারসে সিক্ত। এমনকি, যেখানে চিত্রিত হয়েছে নারীর মমতাস্নিগ্ধ হরিণীর মতো চোখ—সেখানেও গালিবের ভাষা ও ছন্দ এমনই মমতাময়ী যে তার বারংবার অনুশীলনে হৃদয় দ্রাবিত হয়ে ওঠে—

‘রঙো মেঁ দওড়নে ফিরনে কে হম নহীঁ কায়ল
জব আঁখ হী সে ন টপকা তো ফির লহু ক্যা হ্যয়
বহুত দিনোঁ মেঁ তগাফুল নে পয়দা কী
উও ইক নিগেহ, জো ওজাহির নিগাহ সে কম হ্যয়’

 দ্বিতীয় শেরটির মোহে পড়ে সেটিকে অক্ষয় করে রেখেছেন উর্দুর বিতর্কিত উপন্যাস ও গল্প লেখিকা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ইসমৎ চুগতাই ((১৯১৫-১৯৯১) তাঁর নিজের আঁকা একটি তৈলচিত্রে। সমগ্র ছবিটিতে একটি নারীর অবগুণ্ঠনের ভেতর দেবীপ্রতিমা সদৃশ একটি মাত্র স্থির নিশ্চল অথচ উজ্জ্বল চোখ। মুখের একপাশে সরীসৃপের ফণার মতো একগাছি চিকুর, অঞ্জনঘন ভ্রূলেখায় কামধেনুনন্দিত কান্তি, ঘন কৃষ্ণ ভ্রূযুগ এবং সেই গভীরকৃষ্ণ নিশ্চল অথচ চঞ্চল নয়নতারাটি দেখে মনে হয় যেন পদ্মবনে কতকগুলি ভ্রমর যূথভ্রষ্ট ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে—বসছে না, উড়ছে কেবল। এমন অনিন্দ্যসুন্দর চোখেও পৃথিবীর সকল নারী-নয়নের প্রতি কোনো অবজ্ঞার ভাব নেই, আছে বন্দীদশার অসহায়তা—বেদনা, অন্তর্জ্বালা আর মুক্তির মুক আকুতি। এই অক্ষিপাত সহৃদয়ের বুকে কারুণ্যের মেঘ ঘনিয় তোলে—

‘করনে গয়ে থে উসসে তগাফুল কা হম গিলা
কী এক হী নিগাহ কি বস খাক হো গয়ে।’

 গালিবের অন্য একটি শেরের ওপর চুগতাইয়ের আর-একটি ছবি আছে। বিষয় : ‘কেশদাম’। ছবিতে নারীটির কানের দু-পাশে চুলের ঢাল ঘন হয়ে পিঠে ভাঙা-খোঁপার মতো ভেঙে ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি, নদীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে মুঠোর বাঁধন মাড়িয়ে। এতেও বন্দিনীর বেদনা মুখ্য ভাব, যদিও তা অপেক্ষাকৃত হালকাভাবে ব্যক্ত :

‘নীঁদ উসকী হ্যয় দিমাগ উস কা হ্যয় রাতেঁ উস কী হ্যয়
তেরী জুলফেঁ জিস কে বাজু পর পরেশাঁ হো গঈ।’

 ‘গালিব অফুরন্ত’—মহম্মদ ইকবালের এই উক্তির পর আর কোনো বিশ্লেষণই গালিব সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। তিনি যে দরদের গজল লিখেছেন, তার সুরে সংযোজিত হয়েছে হৃদয়ের আকুলতা, অব্যক্ত ব্যথা,—আর প্রতিধ্বনিত হয়েছে হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে। আজও গালিবের সঙ্গে আমাদের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়নি তার কারণ, তাঁর লেখনী চুঁইয়ে যে বেদনাধারা নির্গত হয়েছে তা আমাদেরই বুকের জ্বালা, তা সর্বজনীন। মীরে আছে ঔদাস্য, গালিবে বৌদ্ধিক সংশয়। বলা যায়, উর্দু গজল যদি একা মীরের কীর্তিতেই সমৃদ্ধ থাকত তাহলে আমরা আনন্দের মধ্যেও বিষাদ অনুভব করতাম। কেননা কেবল দরদ নয়, গালিবে রয়েছে হাজারো রঙ—

‘হজারোঁ খোয়াহিশেঁ এ্যয়সি কি হর খোয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে মিরে অরমান লেকিন ফির ভী কম নিকলে।’

কালিদাসের নিরন্তর অনুকবণে যেমন ‘বর্ষা’ ও ‘বিরহ’ সংস্কৃতকাব্যে প্রধান বিষয় হয়ে আছে, তেমি উর্দু গজলে ‘প্রেম’ ও ‘বেদনা’ এখনও প্রধান হয়ে আছে মীর ও গালিবের আবহমান প্রতিপত্তির কারণেই। মীর সহজ ভাব ও ভাষার কবি, গালিব জটিলতার। মীর একটি শের লিখে দশটা শের পাঠককে দিয়ে লিখিয়ে নেন আর গালিব একটি শেরেই পাঠককে ডুবিয়ে রেখে চলে যান পরবর্তী শেরে। মীর সুখের কবি, গালিব দুঃখের। মীর বিরহে কাতর, গালিব মিলনেও অসুখী। মীর প্রেমকে সার বলে জেনেছেন, গালিব বিরহের ইমারৎ গড়েছেন। মীরের যেখানে ঔদার্য, গালিবের সেখানে সংশয়।

 মোমিন খাঁ মোমিন (১৮০০-১৮৫১) এঁদের সন্ধিস্থল। ‘মোমিন’ একটি আরবি ঐস্লামিক শব্দ, যার অর্থ আস্তিক বা সাচ্চা মুসলমান। যদিও জন্মসূত্রে মোমিন ছিলেন কাশ্মিরী এবং তাঁর কৌলিক পেশা ছিল উনানি চিকিৎসা, অর্থাৎ তিনি ছিলেন হাকিম; কিন্তু তাঁর মননবিশ্বটি ছিল দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার। মোমিনের জন্ম দিল্লিতে এবং ঐসময় শাহ আলম দিল্লির বাদশা ছিলেন। বাদশার দরবারে হাকিমী পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁর পিতামহ এবং পরে তিনি নিজেও ঐ পদে বহাল হন। অবশ্য পরবর্তী জীবনে মোমিন শায়র হিশেবেই প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন অতিশয় সুদর্শন, প্রেমিক ভাবাপন্ন এবং সর্বদা সেজেগুজে থাকতেন। তাঁর স্বভাবে ছিল প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের প্রতি আসক্ত। মোমিন বেশ কিছু সুন্দর ওয়াসোখত রচনা করেছিলেন, যেগুলি আসলে উর্দু দীর্ঘ কবিতা। কিন্তু তাঁর গজলগুলিই শ্রেষ্ঠ। গজল সমূহে শাদা-সরল শব্দের বাহার থাকলেও গাঠনিক দিক থেকে খানিক ক্লিষ্টও। মোমিন মীর বা গালিবের মতো অমন বড়ো মাপের কবি নন, কিন্তু অবশ্যই বড়ো শিল্পী। কবি জন্মায়, আর শিল্পী ক্রমে গড়ে ওঠে। মোমিন নিজেকে গড়েছেন ওই দুই মহান উৎসধারার রসে। কিন্তু তবু তিনি মীর আর গালিবের থেকে স্বতন্ত্র। সংযুক্তিকরণেই ফুটেছে তাঁর বিযুক্তিকরণ—

‘ম্যঁয় ভী খুশ নহীঁ ওয়ফা করকে
তুমনে অচ্ছা কিয়া, নিবাহ ন কী
তুম মেরে পাস হোতে হো-গোয়া
জব কোঈ দুসরা নহীঁ হোতা’

 শেষের শেরটি পড়ে গালিব বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন, ‘মোমিন যদি এই একটি শের আমাকে ভিক্কে দেন, বিনিময়ে আমি আমার সমস্ত সৃষ্টি তাঁকে দান করে দেবো।’ জবাবে মোমিন বলেছিলেন, ‘গালিব সাহেব আমার শের নিলেও নিতে পারেন, অন্যের সৃষ্টি আমার চাই না।’৩০ প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, মোমিনের স্বভাবে অহংকারের প্রাচুর্য ছিল। রাজা কপুরথলা তিনশো টাকা মাসোয়ারা দিতে চেয়ে যখন তাঁকে নিজস্ব দরবারে আমন্ত্রণ জানান, তিনি ঐ প্রস্তাব এই বলে ফিরিয়ে দেন যে ওটুকু বেতন তো গাইয়েরা পায়।

 যাই হোক। মোমিনের দুটি শেরের মধ্যে তৃতীয় আরও-একটি শের সংগুপ্ত, যা আমাদের অভিভূত করে। গজলের প্রথমে শেরেই তিনি একটি পথনির্দেশিকা পাঠকের হাতে তুলে দেন, পাঠক তাতেই মশগুল হয়ে কবির প্রলোভনে শূন্য গগনে হাঁটার জন্য তৈরি হয়ে পড়েন এবং আসল গজলটি বা তার মর্ম সহস্র আলোকবর্ষ দূরে পাঠিয়ে দেন। গজলের প্রথম চরণে বা শের-এ-মিতলায় শিল্পী যে-পথ আকীর্ণ করে দিয়েছেন তা যে একটা মিথ্যা বা ভুয়ো পথ—ছলনা, গোলোকধাঁধা বা প্যারাডক্ত—সেটাই পাঠক ভুলে যান। এটাই মোমিনের শিল্পত্ব।

 গালিব ছিলেন বেপরিমাপ মদিরাসক্ত, প্রডিগাল এবং তথাকথিত কাফির বা নাস্তিক। তদ্দণ্ডে তাঁর সমীপকালীন মৌলানা সৈয়দ আলতাফ হুসেন হালি (১৮৩৭-১৯১৪) ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর আর-এক প্রখ্যাত শায়র। জন্ম উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত বা আধুনিক হরিয়ানার ঐতিহাসিক শহর পানিপতে, এবং প্রয়াণও সেখানেই। বাল্যবয়সেই পিতা-মাতার মৃত্যুর দরুন তাঁর পড়াশোনার গুটি অচিরেই কেঁচে যায়। কিন্তু ধর্মের প্রতি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান, পাক্কা মুসলমান এবং পাখণ্ডীদের কড়া সমালোচক। তবুও তিনি ঐ কাফের গালিবের প্রতি ছিলেন একান্ত সশ্রদ্ধচিত্ত। ‘য়্যাদগার-এ-গালিব’ নামে গালিবের জীবনীও লিখেছিলেন। আসলে, গোঁড়া মুসলিম বংশে জন্ম হলেও, এবং শরীয়তী রীতির ভাবধারায় বাল্যাবস্থা লালিত হলেও, পরবর্তী কালে হালি ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক ভাব-জগতের সংস্পর্শে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন সংস্কারমুক্ত এবং ‘অখণ্ড ভারতের সেবক’ হিশেবে। নবজাগরণের অগ্রনায়ক এবং ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন হালি, এবং পরবর্তী কালে, দিল্লির ইঙ্গ-আরবীয় স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়েই তাঁর কবি-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং নিজাম বাহাদুরের কাছ থেকে ৭৫ টাকা মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৬০ থেকে হালি আমৃত্যু সক্রিয় থেকেছেন শের-ও-শায়রির দুনিয়ায়। ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান’ প্রকাশিত হয়, যাতে গালিবের প্রভাব পরিলক্ষিত। ‘শের-শায়রী’ গ্রন্থে তিনি সমালোচক। পরে প্রকাশিত ‘বরখুরত’ ঋতু বিষয়ক কবিতার সংকলন, যা কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ এবং টমসনের ‘সিজনস’কে স্মরণে আনে। ‘নিশাত-ই-উমিদ’ কাব্যে হালি আশাবাদী। ‘হুববি-ওয়াতন’-এ যুগপৎ প্রবাসীর দেশানুরাগ ও হৃদয়যাতনা ব্যঞ্জিত : ‘স্বর্গ পেলেও চাই না আমি একমুঠো তোর ধূলির বিনিময়ে’। কবিকে প্রেরণা যুগিয়েছে দেশের আদিম জনগোষ্ঠী। আর্যদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েও তারা দেশের মাটি ছাড়েনি। এই দার্ঢ়্য হালির কল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করেছে :

‘কাহারেও তুমি ভাবিও না পর হিন্দু-মুসলমান
ব্রহ্ম বৌদ্ধ যে-ই হোক সে যে স্বদেশেরই সন্তান।
প্রীতির নয়ানে চাহ সবা-পানে, তাহারা নয়নমণি
স্বদেশের শুভ চাহ যদি, লহ সবারে আপনা গণি।’৩১

 হালির গজল উর্দু সাহিত্যের পরম সম্পদ। সমীপকালীন উর্দু সাহিত্যের প্রচল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন তাঁর সাহিত্য, কিন্তু পাঠকের কাছে তাঁর গজল, নজম, রুবাই এবং মার্সিয়ার সমাদর কম ছিল না। উপরন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে হালির সুযোগ্য নেতৃত্বেই উর্দু শায়রি ও গজলের সমুচিত উন্নতি ঘটেছিল। উর্দু গজলে নবযুগের তিনিই উদগাতা। গজলে প্রকৃতি ও মানবকে তিনি গেঁথেছেন একই মালার ডোরে। তাঁর স্বদেশবন্দনার একটি গজল এরকম—

‘অয় বতন অয় মেরে বহিশতে বরীঁ

ক্যা হুয়ে তেরে আসমাঁ ঔ জমীঁ

রাত অওর দিন কা উও সমাঁ ন রহা

উও জমীঁ অওর উও আসমাঁ ন রহা’

 হালি নির্দলীয় শায়র, গজলেও তাঁর ওপর অন্য কোনো কবির প্রভাব ছিল না। ড. এহতেমাম হুসেন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘হালি বদলায়মান যুগের প্রতিনিধি। তিনি না পুরনো রীতিপ্রযুক্তিকে আঁকড়ে থাকার পক্ষপাতি ছিলেন, আর না নতুন শৈলীকে ভাবনাচিন্তা বিনাই নিজের মধ্যে প্রবিষ্টি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।’ হালি উর্দু কাব্যসাহিত্যের নানান জঁরের রেওয়াজ করেছেন, কিন্তু গজলেই তিনি শ্রেষ্ঠ। তাঁর একটি মশহুর গজলের কয়েকটি শের এখানে পেশ করছি :

‘জীতে জী মৌত কে তুম মুঁহ মেঁ ন জানা হরগিজ
দোস্তী দিল ন লগানা ন লগানা ন লগানা হরগিজ
বজম-এ-মাতম তো নহীঁ বজম-এ-সুখন হ্যয় ‘হালী’
য়াঁ মুনাসিব নহীঁ রো রো কে রুলানা হরগিজ’

 পুরনো দিনের উর্দু শের-শায়রীর আবহাওয়ার প্রতি নস্টালজিয়া ছিল হালির। উপরোক্ত গজলে সেটি প্রকাশ পেয়েছে কিছুটা আক্ষেপ আর নৈরাশ্যের অভিব্যক্তিতে। তাঁর আর একটি গজলের কয়েকটি শের :

‘গালিব’ ও ‘শোফতা’ ও ‘নৈয়র’ ও ‘আজুর্দা’ ও ‘জৌক’
অব দিখায়েগা য়ে শকলেঁ ন জমানা হরগিজ
‘মোমিন’ ও ‘অলভী’ ও ‘সহবাঈ’ ও ‘মমনুঁ’ কে বাদ
শের কা নাম ন লেগা কোঈ দানা হরগিজ
‘দাগ’ ও ‘মজরুহ’ কো সুন লো কি ফির ইস গুলশন মেঁ
ন সুনেগা কোঈ বুলবুল কা তরানা হরগিজ
রাত আখির হুই অওর বজম হুই জের-ও-জবর
অব ন দেখোগে কভী লুৎফ-এ-শবানা হরগিজ’

 হালির এই ক্ষোভ বা হতাশা কিছু-অংশে সত্য প্রমাণিত হলেও, পরবর্তী কালে উর্দু গজলের জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণই থেকেছে। সমসাময়িক উর্দু গজলের উন্নয়ন প্রকল্পে দিল্লির শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম জৌকের (১৭৯০-১৮৫৪) অবদানও কম নয়। তিনিও ছিলেন গালিবের সমকক্ষ এক প্রকাণ্ড দরবারি কবি। মুঘল দরবারে বিশিষ্ট কবি হিশেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন মাত্র উনিশ বছর বয়সেই। জৌকের আর-এক পরিচয়, তিনি ছিলেন আখেরি মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের (১৭৭৫-১৮৬২) উস্তাদ বা গুরু। জৌকের জন্ম দিল্লিতে। কাব্যক্ষেত্রে তাঁর মূল বিষয় প্রেম। জৌকের গজলের সমাদর আজও রয়ে গেছে উর্দু সাহিত্যের পাঠকের কাছে। গজল, কাশিদা, মুখম্মস সবেতেই তাঁর পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। জৌকের একটি জনপ্রিয় গজলের দুটি শের হাজির করছি, যাতে প্রেমের আদলে মৃত্যুর প্রতিমা গড়েছেন তিনি :

‘মর্জ-এ-ইশক জিসে হো উসে ক্যা য়্যাদ রহে
ন দওয়া য়্যাদ রহে অওর ন দুয়া য়্যাদ রহে
তুম জিসে য়্যাদ করো ফির উসে ক্যা য়্যাদ রহে
ন খুদাঈ কী হো পরওয়া ন খুদা য়্যান রহে’

 পর্যায়ক্রমে দাগ দেহলভী (১৮৩১-১৯০৫) নামটিও উচ্চার্য। পুরো নাম নবাব মির্জা খান দাগ দেহলবী। এঁর জন্ম পুরানী দিল্লির চাঁদনি চৌকে। পিতা নবাব সামসুদ্দিন আহমদ খান ছিলেন যুগপৎ লোহারু এবং ফিরোজপুর ঝিরকার শাসক এবং মাতা ওয়াজির খানুম দিল্লিবাসী এক জহুরির কন্যা। দাগের বয়স যখন সবে চার, এবং মায়ের চৌত্রিশ, গভর্নরের এজেন্ট উইলিয়াম ফ্রেজারের হত্যা-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার দরুন সামসুদ্দিনের ফাঁসি হয়। অতঃপর দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ওয়ারিস মুঘল ক্রাউন প্রিন্স মির্জা মুহম্মদ ফাকরুর সঙ্গে মায়ের নিকাহ হলে দাগেরও সৌভাগ্যের তোরণ বারদিগর খুলে যায়। দিল্লির লাল কেল্লা থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন এবং পাশাপাশি শের ও শায়রির দুনিয়াতেও তাঁর আসনটি পাকা হয়ে যায়। পুরানী দিল্লিই ছিল দাগের সৃষ্টিপরিসর, যদিও তিনি হায়দরাবাদেও জীবনের শেষ অংশটি বাহিত করেন। মৃত্যুও ঘটে হায়দরাবাদে। গজল, কাশিদা, মুখম্মসের দরুন যশস্বী হয়েছিলেন। ‘গুলজার-এ-দাগ’ এবং ‘দিওয়ান-এ-দাগ’ বইদুটির জন্য তিনি আজও স্মর্তব্য। রোমান্টিক ও সেনসুয়াস লেখনীতে দাগের জুড়ি ছিল না—

‘অভী হমারী মোহব্বত কিসী কো ক্যা মালুম
কিসী কে দিল কী হকীকৎ কিসী কো ক্যা মালুম
য়্যকীঁ তো য়ে হ্যয় উও খত কা জবাব লিকখেঙ্গে
মগর নবিশতা-এ-কিসমৎ কিসী কো ক্যা মালুম
অভী তো ফিত্রে হী বরপা কিয়ে হ্যঁয় আলম মেঁ
উঠায়েঙ্গে উও কয়ামৎ কিসী কো ক্যা মালুম
জনাব-এ-‘দাগ’ কে মশরব কো হম সে তো পুছো
ছুপে হুয়ে হ্যঁয় য়ে হজরত কিসী কো ক্যা মালুম’

 মীর-ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন দাগ দেহলভী। দাগের গজল স্বচ্ছ সরল, জটিলতা বা কৃত্রিমতায় আবিল নয়। শুধু ভাষা নয়, মীরের ভাবধারার সঙ্গে দাগের যোগসূত্র এমনই ঘনিষ্ঠ যে দাগের গজলকে অনেক সময় মীরের রচনা বলে ভ্রম হয়—

‘অজব অপনা হাল হোতা জো বিসাল-এ-য়্যার হোতা
কভী জান সদকে হোতী কভী দিল নিসার হোতা’

 উর্দু গজলের আর এক রৌশন সিতারা ছিলেন হায়দর আলি আতিশ (১৭৭৮-১৮৪৭) মীরের সমকালীনও ছিলেন, আবার তাঁর অনুগামীও। আতিশের দুটি মীর-গন্ধী শেরের নমুনা দেখুন—

১. ‘সফর হ্যয় শর্ত, মুসাফির নওয়াজ বেতেহার
 হজারহা শজরে-সায়াদার রাহ মেঁ হ্যঁয়।’

২. ‘বুত-খানা তোড় ডালিয়ে মসজিদ কো ঢাইয়ে
 দিল কো ন তোড়িয়ে য়ে খুদা কা মকাম হ্যয়।’

 অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের লখনউয়ের কবি মীর অনীস (১৮০৩-১৮৭৪) ছিলেন মর্সিয়ার মহান শায়র, আবার গজলে মীরের অনুগামী। শুধু নামেই নয়, অনীসের কবিতাতেও মীরের প্রতিধ্বনি অবিকল শুনতে পাই—

১. ‘আশিক কো দেখতে হ্যঁয় দুপট্টে তান কর
 দেতে হ্যঁয় হম শর্বত-এ-দীদার ছান কর’

২. ‘অনীস’ দম কা ভরোসা নহীঁ ঠহর জাও
 চরাগ লে কে কহাঁ সামনে হওয়া কে চলে’

 শাদ অজীমাবাদী (১৮৪৬-১৯২৭) এই স্বরকেই আরও মধুময় করে তুলেছেন,

১. ‘দিল-এ-মুজতর সে পুছ এয় রৌনক-এ-বজম
 ম্যঁয় খুদ আয়া নহীঁ লায়া গয়া হুঁ।’

২. ‘অব ভী ইক উম্র পে জীনে কা ন অন্দাজ আয়া
 জিন্দগী ছোড় দে পীছা মিরা ম্যঁয় বাজ আয়া।’

 এবং, তাঁর কাব্যশিষ্য সুপ্রসিদ্ধ শায়র, লেখক ও শিল্পী ইয়াগানা চঙ্গেজীর (১৮৮৪-১৯৫৬) মধ্যেও মীরের ছাপ দুর্লক্ষ্য নয়—

১. ‘সমঝতে থে ক্যা, মগর সুনতে থে ফসানা-এ-দর্দ
 সমঝ মেঁ আনে লগা জব তো ফির সুনা ন গয়া’

২. ‘ক্যুঁ কিসী সে ওযফা করে কোঈ
 দিল ন মানে তো ক্যা করে কোঈ
 গালিব অওর মিরজা ‘ইয়াগানা’ কা
 আজ ক্যা ফ্যয়সলা করে কোঈ’

 গজলের এই ধারারই অনুগামী নজীর, হালি, ইকবাল এবং ফিরাক। প্রভাবিতদের সূচীতে আছেন ফানি, চকবস্ত, সরুর জহাঁবাদী, অসগর, হসরত, মোহানী, জিগর প্রমুখ।

 অবশ্য, উর্দু শের-শায়রীর দুনিয়ায় মীর-অনুগামীদের সংখ্যা তুলনায় বেশি হলেও, শুধুমাত্র গজলের কথা যদি বলি, তখনকার বহু শায়র গালিব-পরম্পরায় গজল লিখেও এই জঁরকে উত্তুঙ্গু চূড়ায় নিয়ে গেছেন। গজলে গালিবের সার্থক উত্তরসুরী ছিলেন শেষ মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফর (১৭৭৫-১৮৬২)। অধিকন্তু, জাফরের গজল নিয়ে খাস কথাও রয়েছে। বুড়ো বয়সে মসনদে বসেছিলেন ঠিক কথা, জাফর কিন্তু নিজ দেশকে মেহবুবার মতো ভালোবাসতেন। ১৮৫৭-এর ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করে বৃটিশের কোপ কটাক্ষে পড়েন জাফর এবং তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। মেজর হাডসন যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হুমায়ুনের মকবরায় প্রবেশ করেন, যেখানে জাফর তাঁর দুই পুত্রকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন, মেজর, যিনি অল্প-আধটু উর্দু জানতেন, বলেছিলেন, ‘দমদমে মেঁ দম নহীঁ হ্যয় খ্যয়র মাঁগো জান কী, এয় জাফর ঠণ্ডী হুই অব তেগ হিন্দুস্তান কী।’ তখন জাফর জবাবে হুঙ্কার সহ বলেছিলেন, ‘গজিয়োঁ মেঁ বু রহেগী জব তলক ঈমান কী, তখত এয় লন্দন তক চলেগী তেগ হিন্দুস্তান কী।’

 বাহাদুর শাহ জাফর কেবলমাত্র দেশভক্ত মুঘল বাদশাই ছিলেন না, উর্দুর একজন মহান কবি হিশেবেও তিনি সুপরিচিত। দেশাত্মবোধক কবিতায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি মূলত ‘গালিবের ঘরানা’র ভাবাবেগ ও বেদনার শায়র। তাঁর গজলে সহৃদয়তা, ভাবালুতা ও চিত্রাঙ্কনী ক্ষমতার স্বাক্ষর স্পষ্ট। নিচের গজলটিতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শ-গত স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পাওয়া যাবে :

‘বাত করনী মুঝে মুশকিল কভী এ্যয়সী তো ন থী
জ্যয়সী অব হ্যয় তিরী মহফিল কভী এ্যয়সী তো ন থী
লে গয়া ছীন কে কৌন আজ তিরা সব্র ও করার
বে-করারী তুঝে এয় দিল কভী এ্যয়সী তো ন থী
চশম-এ-কাতিল মিরী দুশমন থী হমেশা লেকিন
জ্যয়সী অব হো গঈ কাতিল কভী এ্যয়সী তো ন থী
ক্যা সব্ব তু জো বিগড়তা হ্যয় ‘জফর’ সে হর বার
খুঁ তিরী হুর-শমাইল কভী এ্যয়সী তো ন থী’

 সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনেতিহাস স্বয়ং একখানি ট্র্যাজেডি-কাব্য। কবিবর সুমিত্রানন্দন পন্ত লিখেছেন : ‘বিয়োগী হোগা পহলা কবি, আহ সে উপজা হোগা গান।’ জাফর সম্পর্কে একেবারে খাঁটি উক্তি। কবি হরিবংশ রায় বচ্চনের মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য—’জাফরের আন্তরিক বেদনার স্বর তাঁর শায়রীতে মুখর।’ জাফর বাল্যবয়স থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের সমাসন্ন ধ্বংসের ইঙ্গিত বুঝেছিলেন। তাঁর বাল্যকালে গুলাম কাদির দিল্লি আক্রমণ করে। জাফর সেই হৃদয়বিদারক স্মৃতি মসীলিপ্ত করেছেন এমত ভাষায়—

‘কোঈ আঁখ ন থী জো আঁসুয়োঁ সে পুরে নম ন থী
কোঈ দিল ন থা জো গম সে খালী থা,
করুঁ ইস সিতম কা ম্যঁয় ক্যা বয়াঁ
মেরা গম সে সীনা ফিগার হ্যয়।’

 ৩০ ডিসেম্বর ১৮৩৭ আকবর শাহর (দ্বিতীয়) মৃত্যুর পর তাঁর বৃদ্ধ পুত্র বাহাদুর শাহ জাফর ‘বাদশাহ’ তথা ‘গাজীর’ উপাধি গ্রহণ করেন। কার্যত তিনি ছিলেন বৃটিশসিংহের হাতের পুতুল। লালকেল্লা ব্যতিরেকে আর কোনও অঞ্চল তাঁর অধীনে ছিল না। এরপর আসে সেই মহাপ্রলয়, যাকে বহু ঔপনিবেশিক মনোভাবাপন্ন ইতিহাসবিদ নিছক ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বলে দেগে রেখে দিয়েছেন, আবার কারও-কারও চোখে যেটি ছিল ‘ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’। তখন বাংলা পত্রিকাসমূহে বিদ্রোহের বিরূপ সমালোচনা করে যেভাবে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য বিদেশী প্রভুর কাছে মাথা খুঁড়েছিল, ‘বৃটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির রয় যেন’ বলে বাঙালি ভীরুতা ও পদলেহনের যে প্রকাশ তাতে আমরা আজও লজ্জিত হয়ে আছি।৩২ যাই হোক, ১৮৫৭ সনের ১১ মে বিদ্রোহীরা মেরঠ থেকে দিল্লি পৌঁছলে তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জরাজীর্ণ বয়স্বী সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। পরিণামে কারাবাস এবং স্ব-পুত্রের ছিন্নমুণ্ড দর্শন।৩৩ পরে মোকর্দমায় হেরে গিয়ে আজীবন কারদণ্ড ভোগের জন্য রেঙুন যেতে হয়েছিল তাঁকে। দিল্লি ত্যাগের আগে যে অরন্তুদ গজলটি তিনি লিখেছিলেন, তার কিয়দংশ উদ্ধৃত করি :

‘জলায়া য়্যার নে এ্যয়সা কি হম বতন সে চলে
বতৌর শমা কে রোতে ইস অঞ্জুমন সে চলে
ন বগবাঁ নে ইজাজৎ দী সয়র করনে কী
খুশি সে আয়ে থে, রোতে হুয়ে চমন সে চলে।’

 জাফরের কাব্য স্রেফ তাঁর আত্মাভিব্যক্তি নয়, তাঁর আত্মজীবনীও বটে। তাঁর সমস্ত জীবনগাথা চমৎকার বাণীরূপ লাভ করেছে এই ক্ষুদ্র গজলটিতে—

‘পসে-মর্গ মেরী মাজার পর জো দিয়া কিসী নে জলা দিয়া
উসে আহ! দামন-এ-বাদ নে সরেআম হী বুঝা দিয়া
মুঝে দফন করনা তু জিস ঘড়ী, তো য়ে উসসে কহনা কি এয় পরী
উও জো তেরা আশিক-এ-জার থা, তহ-এ-খাক উসকো দবা দিয়া’

 দিল্লির ইশকিয়া গজল লখনউয়ে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হলো। দিল্লির দরবারী কবিরা গজলকে ভারতের সাহিত্য করে তুলেছিলেন, আর লখনউয়ে এসে তা পেলো বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা। ‘বিশ্ব’ কথাটা শুধু ভৌগোলিক নয়, কালিকও।

 শক্তিহ্রাস হওয়া সত্বেও মুঘলরা দারুল-ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলেন বহুকাল। দারুল-ইসলমা, অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত জায়গা সমূহে ঐস্লামিক হুকুমত কায়েম করার খোয়াব। খোদ অওরঙ্গজেব অন্তশয্যায় শুয়েও (মৃত্যু ১৭০৭) জিজিয়া কর উসুল করার ডিলিরিয়াম আউড়েছেন। তার পরেও মুঘলরা ভারতবর্ষকে ‘স্বদেশ’ বলে মেনে নিতে পারেনি। তারা বিলায়েৎ, অর্থাৎ স্বদেশ বলে জানত যে-যে দেশ থেকে তারা এসেছিল, সেই-সেই দেশকে।৩৪ এ-প্রসঙ্গে সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি লিখেছেন, ‘স্বভাবত ওই শাসকদের সমর্থক উলেমা-ওমরাহ-এলিট এবং তাঁদের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে ভারতীয় মুসলিম সমাজে পবিত্র বিলায়েত অবচেতনা গড়ে উঠেছিল।….. মুসলিম শাসকদের ভারতীয় হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক বাস্তবতা নয়।…. তুর্কি, আফগান, মোগল, পারসিক প্রমুখ সব মুসলিম শাসকই নিজ-নিজ বিলায়েতি রীতি ও ঐতিহ্য আঁকড়ে জীবনযাপন করেছেন।’৩৫

 কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতির দুনিয়ায় এই ধারানুবাহিকতার কিঞ্চিৎ ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায়। এ-কথা ঠিক যে ভারতে বারবার অনুপ্রবেশকারী শক্তি এসে তার সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। ভারতীয় সমাজের মূল কাঠামো, যে বৈশিষ্ট্যই তার থাক, বহিরাগত নব্যনতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশে অনিবার্যত আনুষঙ্গিক প্রযুক্তি, আর্থনীতিক উপাদান, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার ও সম্পর্কঘটিত নতুন বিন্যাসের আঘাতে তা অবিকৃত থাকতে পারেনি। কিন্তু এর বিপরীতে, বহিরাগতরাও এদেশীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত থাকেনি। গালিব লিখেছেন হিন্দুদের পবিত্র ধর্মস্থান বারণসীকে নিয়ে প্রশংসাসূচক কবিতা, নজীর আকবরাবাদী লিখেছেন ‘শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা’, সাগর নিজামী গোপালকে নিয়ে মধুর গীত রচনা করেছেন, হালি ও ইকবাল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের গান গেয়েছেন। সুতরাং গজলের ভারতীয়ত্বে কারও দ্বিমত থাকার যুক্তি নেই।

 বিশেষত উর্দু গজলের ইতিহাস ঘেঁটে আমরা দেখতে পেয়েছি যে এর উদ্ভব ঘটেছে গুজরাত ও দাক্ষিণাত্যে, সংস্কার ও বিকাশ ঘটেছে দিল্লিতে এবং পরবর্তী বিকাশ ও পরিণতি লাভ করেছে লখনউ ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলসমূহে। প্রথম পর্বের গুরু ওয়লি দখিনী, দ্বিতীয় পর্বের নেতা মীর ও গালিব এবং তৃতীয় পর্বের সম্রাট ফিরাক গোরখপুরী। তিনটি পর্বে গজলের চিরায়ত রূপ অক্ষুণ্ণ থাকলেও, বলা বাহুল্য, পারিপার্শ্বিকতায় বিষয়গত অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

 এই পরিবর্তন সুস্পষ্ট অবয়ব গ্রহণ করেছে ১৮৫৭-এর পর। সৈয়দ আলতাফ হুসেন হালির সময় থেকেই সংস্কারবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাঁর পূর্ববর্তী কালে যেসব কবি গজলের পরম্পরাগত ভাবধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে নজীর আকবরাবাদীর (১৭৩৫-১৮৩০) নাম সর্বাগ্রগণ্য। অতীব বিস্ময়কর ও দুঃখজনক, যে, যাঁকে ‘ফাদার অফ নজম’ শিরোপা দেওয়া হয়েছে, সেই মহান শায়র নজীর আকবরাবাদী উর্দুসাহিত্যের ইতিহাস-লেখকদের কাছে চিরকাল উপেক্ষিত থেকেছেন। নজীরের মূল নাম ওয়লি মুহম্মদ। তাঁর জন্ম দিল্লিতে হলেও কর্মজীবন আগ্রায়। যেসময় হিন্দুস্তানের বাদশা ছিলেন মহামহীম আকবর, তখন থেকেই আগ্রা পরিচিত ছিল আকবরাবাদ নামে। ১৭৩৯ সনে নজীর যখন অতিশয় শিশু, নাদিরশাহর আক্রমণে দিল্লি তছনছ হয়ে যায় এবং নজীরের পিতা মুহম্মদ ফারুক কারাবন্দী হন। চতুর্দিকে লুঠতরাজ আর খুনোখুনির আতঙ্কে অনেকের মতো নজীরের মা আর ঠাকুমা আকবরাবাদে পালিয়ে আসেন। এই আকবরাদেই নজীরের উত্থান। সত্যি বলতে কী, নজীর আকবরাবাদী মীরের সমকালীন শায়রদের মধ্যে অগ্রগণ্য, যিনি ভারতীয় সংস্কৃতি ও পালা-পার্বন, হোলি, দেওয়ালি, শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে নজম রচনা সূত্রেও শ্রদ্ধেয়। নজীরই উর্দুতে প্রাকৃতির কবিতার ভিত্তিশিলা পুঁতেছিলেন, যা পরবর্তী কালে আলতাফ হুসেন হালি এবং মুহম্মদ হুসেন আজাদের হাতে ইমারতের রূপ পরিগ্রহ করে। নজীর মূলত লোককবি। সাধারণের কথাই তাঁর কথা। তাঁর ভাষা সম্পর্কে ড. ব্রজরত্ন দাস লিখেছেন, ‘এঁর ভাষা ছিল দেশী আর তাকে বিলেতি বানানোর চেষ্টা কখনও করেননি। চলতি ভাষায় ষোলো আনা দখল ছিল, তাই ফার্সি কিংবা আরবি অভিধান থেকে শব্দ নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। যেমন বিষয়, তেমনি ভাষা, আর তেমনি বাস্তবধর্মী চিত্রণ।’৩৬

 নজীরের বাস্তবপ্রিয়তা তাঁর গজলকে জনপ্রিয়তা দান করেছে। নমুনা স্বরূপ তাঁর দারিদ্র বিষয়ক একটি গজলের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। অনেক কবিই দারিদ্রের গুণগান করেছেন। আমাদের বিদ্রোহী কবিকে দারিদ্র ‘মহান’ করেছে। ইংরেজ কবির ভাষায় : ‘Sweet are the uses of adersity.’ অর্বাচীন কবি লিখছেন : ‘আমি চাই ছোটঘর বড় মন লয়ে, নিজের দুখের অন্ন খাই সুখী হয়ে।’ কিন্তু নজীর দারিদ্র বা মুফলিসীকে দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে :

‘জব আদমী কে হাল পে আতী হ্যয় মুফলিসী
কিস-কিস তরহ সে সতাতী হ্যয় মুফলিসী
প্যায়াসা তমাম রাত রোজ বিঠাতী হ্যয় মুফলিসী
ভুখা তমাম রাত সুলাতী হ্যয় মুফলিসী।’

 অওধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর (১৮২২-১৮৭৩) প্রকৃত নাম ছিল অবুল মনসুর মির্জা মুহম্মদ ওয়াজিদ আলি শাহ। তিনি ছিলেন একাধারে সংগীতবেত্তা, নর্তক, গায়ক ও শায়র। পারফর্মিং আর্টের প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্বলতা থাকলেও, ওয়াজিদ আলি শাহ স্বয়ং একজন উঁচু মাপের গজলকার ও ঠুমরি রচয়িতা ছিলেন। তিনি তাঁর দরবারে বেশ কিছু লেখক ও কবিকে সংরক্ষণ প্রদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বরাক, আহমদ মির্জা সবীর, মুফতি মুনশি এবং আমির আহমন আমির সবিশেষ উল্লেখনীয়। উর্দু, আরবি এবং ফার্সিতে সুশিক্ষিত তথা শিল্পকলার জহুরি ওয়াজিদ আলি শাহ স্বয়ং অসংখ্য বেহেত্রিণ ঠুমরি ও গজল সৃষ্টি করেছেন। তাঁর লেখা একটি দুর্লভ গজল এরকম :

‘সাকী কী নজর সাকী কা করম
সও বার হুই সও বার হুয়া
য়ে সারী খুদাঈ য়ে সারা জহাঁ
ম্যয়খরার হুই ম্যয়খরার হুয়া
জব দোনোঁ তরফ সে আগ লগী
রাজী-ও-রজা জলনে কে লিয়ে
তব শম্মা উধর পরওয়ানা ইধর
তৈয়ার হুই তৈয়ার হুয়া’

অবশেষে এলো বিংশ শতক। উনিশ শতকী বিশ্বাসের কেল্লা চুরমার হলো বিশ শতকী বাস্তবানুভূতিতে। প্লাটোনিক প্রেম আর ভাবালুতার জোলো মনোভূমি নিমেষে বদলে গেল ধূ ধূ মরুস্থলে। স্বপ্ন ও কল্পনার গজদন্তমিনার ভেঙে গেছে, পড়ে আছে নিছক স্মৃতির চুনসুরকি। বস্তুত, বিদায়মান উনিশ শতকী প্রাণনে ফুটেছিল ব্যক্তিত্ব বিকাশ, যা চূর্ণ হলো বিশ শতকী রাষ্ট্রিক অখণ্ডতায়। মধ্যবিত্ত ও বিধ্বস্ত কবি-শায়রদের মনেও তীব্র উচাটন ও অস্থিরতা। তাঁরা পড়লেন মহা ফাঁপরে, প্রশ্নের বেষ্টনে। পরাধীনতা, বঞ্চনা ও নির্যাতনের বোঝ অসহ্য হয়ে উঠছে। জাগছে চেতনার দিগ্বাহী চোরাস্রোত। প্রসুপ্ত আক্রোশ ও দ্রোহ দাবাগ্নির মতো ধিকিয়ে ধিকিয়ে ফুঁসে উঠছে কেবল। দিকে দিকে লৌহকপাট ভাঙার আকুলতা ও গণজাগরণের জোয়ার। এবার তাঁদের, কবি-শায়ীদের পালা। গজল লিখিয়েদের মধ্যে, যাঁরা ছিলেন অগ্রভাগে, তাঁদের মননে ও সৃজনে দানা বাঁধল জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার আকাঙ্খা, প্রগতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। প্রসঙ্গত এখানে নথি হতে পারে কীভাবে গজলকাররা সমকালীন বিপ্লবকামী প্রগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যার দরুন গজলবিশ্বে তিনটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথমটি অবশ্যই কালচারাল ল্যান্ডস্কেপে এলো নতুন জোয়ার যা ভারতীয় মিশ্রসংস্কৃতিকে আরও মজবুত হতে মদত যোগালো। দ্বিতীয়ত, উর্দু গজলের ধ্রুপদী অন্বেষনের বাতায়ন খুলে রূপক, প্রতীক এবং চিত্রকল্পে এলো নতুনতর অভিব্যক্তি। এবং, তৃতীয়ত, বিশ্বভুবনে জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে চতুরায়তনিক আবিষ্কার গজলকারদের মধ্যে গড়ে তুলল নিও-ক্লাসিসিস্ট, প্রগ্রেসিভ, মডার্নিস্ট এবং পোস্ট-মডার্নিস্টদের এক অফুরন্ত কাতার।

 প্রসঙ্গত এখানে আমি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করব, বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালেই যিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুজ অ্যান্ড মুসলিমস আর টু আইজ অফ দ্য বিউটিফুল ব্রাইড দ্যাট ইজ হিন্দুস্তান।’ এই সজাগ ও বেবাক উচ্চারণ বিশ শতকের। কিন্তু সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ছিলেন উনিশ শতকের প্রখ্যাত ইস্লামিক প্র্যাগমাটিস্ট, ধর্মসংস্কারক, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। ইনিই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। রাজনৈতিক মঞ্চে খান সাহেব ছিলেন সেসময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। প্রকৃত ইসলাম ও মুসলিম দরদী হয়েও যে তিনি হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্বের পক্ষপাতি ছিলেন, তা ছিল তাঁর আস্থা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। উর্দু গজল লিখিয়েদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আকাঙ্খা, কিছুটা-হলেও, তিনিই চাগিয়েছিলেন। মুসলিম ভাবের জগতে এহেন মস্ত মাপের মনবদল কিংবা বাঁকবদল ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।

 আগেই বলেছি, মৌলানা সৈয়দ আলতাফ হসেন হালি ছিলেন প্রথম উর্দু জাতীয়তাবাদী কবি এবং সৃজনের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতের সেবা করাই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই মনোধারাই উত্তরণ দেখি ইকবালের (১৮৭৭-১৯৩৮) লেখনীতে, যদিও উভয়ের জাতীয়তাবাদ দুই বিপরীত মেরুর। ইকবালের পুরো নাম স্যর মুহম্মদ ইকবাল মসৌদী। জন্ম পাঞ্জাবের (অধুনা পাকিস্তানের অংশ) সিয়ালকোটে, এক কাশ্মিরী পণ্ডিতবংশে। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে এম এ করার পর কিছুকাল লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে এবং পরে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা, এবং তারও পরে বিলেতযাত্রা তথা কেমব্রিজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে উপাধি লাভ এবং জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর’ উপাধি লাভ কবির যৌবন-বয়সের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরবর্তী জীবনে ইনি একাধারে কবি, নেতা ও দার্শনিক। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকবি রূপে পূজিত এবং ‘অলামা ইকবাল’ (বিদ্বান ইকবাল), ‘মুফফকির-এ-পাকিস্তান’ (পাকিস্তানের ভাবুক), ‘শায়র-এ-মশর্রিফ’ (পূর্বের শায়র) এবং ‘হাকিম-উল-উম্মৎ’ (উম্মা বিদ্বান) শিরোপায় ভূষিত। ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যপনার সময়েই তাঁর ইকবালের কাব্যচর্চার সন্নিধাপন। উর্দু ও ফার্সিতে তাঁর শায়রি আধুনিক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শায়রি হিশেবে পরিগণিত। মুসলিম-হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের কাছেই তাঁর শায়রি অতিশয় প্রিয়। ইকবালই প্রথম বৈদিক গায়ত্রীমন্ত্রের উর্দু তর্জমা করেন। ‘মঙ্গলময় ঈশ্বর সকলের ঈশ্বর’—এই ছিল তাঁর প্রত্যয়—

‘একই মাটিতে জলে আমি বানালাম বিশ্ব,
তুমি ভিন্ন ক’রে না দিলে ইরান, তাতার, জাঞ্জিবার;
মৃত্তিকার অনুকণা দিয়ে আমি বানালাম লোহা,
তুমি তাই দিয়ে তৈরি করেছো তরোয়াল, তীর আর বন্দুক।’৩৭

 প্রকৃতপক্ষে ইকবাল ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী কবি। গোড়ার দিকে, ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতা হাসিলের আগে, ইকবালের মন্ত্র ছিল—’হিন্দোস্তাঁ হমারা’। তিনি সেসময় ‘তরানা-এ-হিন্দ’ (ভারতবর্ষের গীত) লিখেছিলেন, যার প্রথম পংক্তিটি ছিল : ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা, হিন্দোস্তাঁ হমারা।’ ঐসময় তিনি ‘হিন্দী হ্যয় বতন হমারা’ স্লোগানের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতের মানুষকে মিলেমিশে থাকার পাঠ দিতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই গানের শব্দকলাপ পালটে যায়। তিনি তখন লিখলেন, ‘চীন-ও-অরব হমারা, হিন্দোস্তাঁ হমারা, মুসলিম হ্যয় বতন হমারা সারে জহাঁ সে অচ্ছা।’ ইকবালই প্রথম যিনি পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার প্রান্ত, সিন্ধ আর বেলুচিস্তানকে মিশিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এনেছিলেন। ১৯৩০ সনে ইকবালের নেতৃত্বেই মুসলিম লীগ প্রথমদফা ভারতের বিভাজন ও পাকিস্তান গঠনের দাবি পেশ করেছিলেন। যে-প্রস্তাব জিন্নাকে নিয়ে আসে মুসলিম লীগের ব্যানারে।

 এতদসত্বেও, উর্দু সাহিত্যে ইকবালের অবদান অবিস্মরণীয়। পরবর্তী কালে তাঁর কৃত্যের প্রায়শ্চিত্য তিনি হয়ত করে যেতে পারেননি, কিন্তু তার বেদনার অশ্রুও গোপন থাকেনি। ‘আসরার-এ-খুদি’ (আত্মতত্ব) গ্রন্থে তাঁর একটি গজল এইরকম :

‘আ গয়রিয়ত কে পর্দে ইক বার ফির উঠা দেঁ
বিছুড়োঁ কো ফির মিলা দেঁ, নকশোঁ দুই মিটা দেঁ
সুনী পড়ী হুই হ্যয় মুদ্দত সে দিল কী বস্তী
আ ইক নয়া শিবালা ইস দেশ মেঁ বসা দেঁ
দুনিয়া কে তীরথোঁ মেঁ উঁচা হো অপনা তীরথ
দামন-এ-আসমাঁ মেঁ উসকা কলম মিলা দেঁ
হর সুবহ উঠকে গায়োঁঁ মন্তর উও মিঠে মিঠে
সারে পূজারিয়োঁ কে ময় পীত মেঁ হ্যয়
ধরতী কে বাসিয়োঁ কী মুক্তি পিরোত মেঁ দেঁ’

 এতদসত্বেও, যখনই আমরা ‘উর্দু গজল’ শব্দ দুটি একত্রে উচ্চারণ করি, আমাদের মনে আরও কিছু শব্দের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়—কমনীয়তা, মননশীতা, এক সংগুপ্ত বা পুশিদা রহস্যের অনুভূতি, ভাবনার ঘনত্ব, কাঠামোগত বা স্বরলিপির বাঁধন ও অভিপ্রায়, আবিষ্ট কল্পনা, সহজাত সুরময়তা, এবং অর্থের প্রোচ্চ সৌন্দর্য। গজলের দুই পংক্তিবিশিষ্ট প্রতিটি শের পাঠকের মনে এক-একটি কাল্পনিক ছবি এঁকে চলে, যা মূলত প্রেম,—আস্তিত্বিক ও সর্বজনীন, উভয়ত। গজলের দুনিয়া কল্পনা আর রূপকের খড়কাঠি দিয়েই গড়া। সিংহভাগ উর্দু শায়রের গজলে এই মূলগত বৈশিষ্ট অবশ্য বিশ শতকেও অক্ষুণ্ণ থেকেছে। কেননা, এই বৈশিষ্ট্যই তার প্রাণশক্তি।

 ইকবালের পরে হাফিজ জালন্ধরীর (১৯০০-১৯৮২) নাম স্মর্তব্য।জলন্ধর শহরে জন্মেছেন বলে তাঁর নামের পেছনে জালন্ধরী কথাটা যুক্ত। জালন্ধরের প্রতি ভালোবাসা তাঁর গজলে ব্যক্ত।ইসলামের প্রতি ষোলো আনা শ্রদ্ধা সত্ত্বেও হিন্দু পুরাণ থেকে রস নিয়ে তিনি অনেক গজলের শের লিখেছেন—

‘রাধা য়্যু নাচে বেকটক দরিয়া কিনারে
চলো মঝধার গোরী কালে কিষণ সঙ।’

 আঙ্গিক ও ভাবের এই ঐক্যসাধনই হাফিজকে বিশিষ্ট করেছে।তাঁর গজলে একটি শব্দের সঙ্গে অন্য একটি শব্দের, একটি মিসরার সঙ্গে আর একটি মিসরার এবং একটি শেরের সঙ্গে দ্বিতীয় শেরের যে অনন্যাশ্রয়ী সম্বন্ধ, তাতে এক নতুন অর্থ, নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়।‘বসন্ত’ এবং ‘অভী তো ম্যঁয় জওয়ান হুঁ’ গজল দুটি তার প্রমাণ। ‘জলওয়ায়ে সহর’ কাব্যগ্রন্থের গজলগুলিতেও এই বৈশিষ্ট্য দুর্লক্ষ্য নয়।

উনিশ শতকীয় গজলের ভাবধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেখানে যে প্রেম প্রতিবাহিত হয়েছে তা নরনারীর নয়, পুরুষ ও নারী নির্বিশেষের—অর্থাৎ মানুষের।সেই কবে চণ্ডীদাস বলেছিলেন—‘শুনহ মানুষ ভাই—সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ আর সেই সত্যই পুনরাবিষ্কৃত হল উনিশ শতকে। এ-যুগের গজলেও দেখি উর্দু গজলকারেরা মানুষের জীবন ও ধর্মকর্মের ওপর ঐকান্তিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অর্থাৎ পরম-পুরুষার্থকে স্বীকার করেছেন। এটাই ছিল সে-যুগের মানববাদ বা হিউম্যানিজম। আর বিশ শতকের দাপাদাপি নিও-হিউম্যানিজম নিয়ে। উনিশের বিশ্বাসের দুর্গ চুরমার হলো বিশশতকী বাস্তবানুভূতিতে। ভাবালুতার জোলো জমি শুকিয়ে দেখা দিল ধু ধু মরু।কল্পনার ইমারত ভেঙে গিয়ে পড়ে রইল স্মৃতি চুনসুরকি। মধ্যবিত্ত-মানস এগিয়ে এল প্রশ্নের খড়্গ নিয়ে। কবিদের কাঁধে পড়ল দায়িত্বের বোঝা। আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মচেতনা আর আত্মঅভিজ্ঞানের সন্ধানী আলো ফেলে শুরু হল আধুনিক গজলের পথচলা। প্রবল সময়ানুভূতিই জন্ম দিয়েছিল নজীর হালি ইকবালকে, এবং নতুন বাঁকের মুখে আবির্ভূত হলেন সুফি মুর্শীদ ওরফে হসন নিজামী।

 কবির পুরো নাম শামসুল উলেমা খ্বাজা হসন নিজামী (জন্ম ১৮৮০, মৃত্যু ১৯৫৫)। ইনি একাধারে কবি, লেখক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। ‘দিল্লিতে উর্দুর প্রসার ও ব্যাপকতায় যে ক’জন লেখকের ভূমিকা স্মরণীয়, হুসন নিজামী তাঁদের একজন।’৩৮  গজলে হসন ছিলেন আশ্চর্যভাবে সৃষ্টিশীল। কলমই ছিল তাঁর সমস্তরকমের প্রতিবাদের হাতিয়ার—

‘অচ্ছী অওর বুরী মওত ক্যা ফর্ক
কলম কী বিজলী সে দিখা দিয়া।’

গজলের ক্ষেত্রে হসন নিজামী ছিলেন বলী, মীর, গালিব ও সওদার সার্থক উত্তরসূরি। হিন্দির সঙ্গে ফারসির কষ্টলব্ধ সমন্বয়ে তিনি গজলের বিকাশকে অনেকটা তরান্বিত করতে পেরেছেন।—

‘ভুলে ন ইশক পে ডুবো বদকশাঁ হালিম মুঁ
দিল ন ঠহরা গুলো-গুলিস্তাঁ-এ-মহম্মদ।’

 জোশ মলিহাবাদী প্রাক-‘স্বাধীনতা’ যুগের উর্দু গজলকারদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। নিজের ‘জোশ’ উপন্যাসটির মতোই তিনি বহু বিতর্কিত। এই বিতর্ক তাঁর স্ববিরোধকে ঘিরে।একদিকে তিনি সাম্যবাদকে মুক্তির একমাত্র উপায় মনে করেন, অন্যদিকে যন্ত্রের সাহায্যে সমস্যায় সমাধান তথা নগরজীবনে গ্রামীণতার প্রাধান্যকে আহ্বান করেন। একদিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিকে অর্থসাহায্য করে লেখেন—‘নিশ্চিত জানি জয় আপনাদের মুহূর্তে মুহূর্তে’৩৯ অন্যদিকে সদস্যতা গ্রহণ করেছেন কংগ্রেসের। শববীর হসন খাঁ ‘জোশে’র (১৮৯৫-২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২) এই স্ববিরোধিতা তাঁর সৃষ্টির সর্বত্র। নমুনাস্বরূপ নিচের রুবাইটি পড়া যাক—

‘ঝুঁকতা হুঁ কভী রগে-খাঁ কী জানিব
উড়তা হুঁ কভী কহকশাঁ কী জানিব,
মুঝ সে দো দিল হ্যয় এক মামল-ব-জমী
অওর এক কা রূখ হ্যয় আঁসমাঁ কী জানিব।’

 ইংরেজদের যেমন ভারতীয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল, জোশ মলিহাবাদীর শের সেই সব অস্ত্রের মধ্যে একটি—

‘ক্যা হিন্দ কা জিন্দাঁ কাঁপ রহা হ্যয় গুজ রহী হ্যঁয় তকবীরে
উকতায়েঁ হ্যঁয় শায়দ কুছ কয়দী অওর তোড় রহে হ্যঁয় জঞ্জীরে।’

 ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পনী কে ফরজল’ নামে যে কবিতাটি পড়ে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে, তার শেষ শেরটি ছিল এইরকম—

‘বক্ত লিখেগা কহানী ইক নয়ে মজমুন কী
জিসকী সুর্খী কো জরুরত হ্যয় তুমহারে খুন কী।’

আর একটি কবিতায় জোশ লিখেছিলেন—

‘উঠো, চৌকো, বঢ়ো, মুঁহ হাথ ধো, আঁখো কো মল ডালো
হওয়ায়েঁ ইনকলাব আনে কো হ্যয় হিন্দোস্তাঁওয়ালোঁ।’

 দেশ-বিভাজনের পর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধে, তখন জোশের বুক ভেঙে বেদনাধারা গড়িয়ে পড়ে এই গজলে—

‘বুজহল কী শরাব সে ছবকা কে জাম কো
বট্টা লগা দিয়া হ্যয় মুহম্মদ কে নাম কো।
বখশা হ্যয় তাজ রাওনে দোজখ মুকাম কো
জিল্লত কী ঘাটিয়াঁ মেঁ গিরায়া হ্যয় রাম কো।’

 দেশবিভাগ এবং উর্দু ‘আজকাল’ পত্রিকার সম্পাদনা—জোশ মলিহাবাদী সম্পর্কে নিছক সংবাদ নয়, জোশের রচনা ও জীবনদর্শনের মূল্যায়নে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। দেশবিভাগের পর জোশ কী আকাঙ্ক্ষায় পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন জানি না, কিন্তু সেখান থেকে ফিরে ভারত সরকারের উর্দু মাসিক ‘আজকাল’-এর সম্পাদক পদে যোগ দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রগতিবিমুখ হয়ে পড়েন, যা আমাদের ক্ষোভের কারণ। তাঁর কাব্যচর্চার ধারাই আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। আসলে, ‘কবিদের যা সবচেয়ে শত্রু তা দারিদ্র্য নয়, অবহেলা নয়, উৎপীড়ন নয়—তা অত্যধিক সাফল্য, তা বহুবিস্তৃত বিজ্ঞাপন।’৪০ এই কারণে জোশকে ঠিক ‘বিপ্লবের কবি’ বলা যায় না। অথচ তিনি যে একসময় বিপ্লবেরই কবি ছিলেন, সেই স্মৃতি ভোলা যায় না—

‘আনেওয়ালা কভী নহীঁ আতা
জানেওয়ালে কী য়্যাদ আতী হ্যয়।’

রঘুপতি সহায় ওরফে ফিরাক গোরখপুরী (২৮ আগস্ট ১৮৯৬- ৩ মার্চ ১৯৮২) থেকে শুরু হয়েছে উর্দু গজলের নতুন যুগ। শুধু গজল নয়, নজম কিংবা রুরাইয়েই নয়, কতএ কিংবা অদবেই নয়, ফিরাক সর্বোতভাবে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন দেশ ও দশের নানা উন্নয়ন মূলক কাজে।ব্যক্তিস্বাধীনতায়, বাকস্বাধীনতায়, গণতন্ত্র রক্ষায়, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারে তাঁর ভূমিকা ছিল পুরোদমে। সবের মধ্যে তাঁর সঞ্চরণ-বিচরণে ছিল না কোনো তালগোল পাকানো ভুয়োদর্শী ব্যাপার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ ছিল ক্ষমাহীন। জীবনের আদর্শ ও দর্শনের দিক থেকে কোন অদৃশ্য শক্তি তাঁকে আমরণ ‘লড়াকু’ করে রেখেছিল জানি না, কিন্তু তাঁর বিপুল সৃষ্টিসম্পদ আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে। আরও বিচিত্র তাঁর জীবনেতিহাস।৪১ পিতা ও সহোদরের মৃত্যু, কংগ্রেসে যোগদান, কারাবাস, বিভিন্ন পুরস্কার ও খেতাব লাভ, সর্বোপরি হিন্দুধর্মের প্রভাব কুত্রাপি তাঁর কাব্যকে স্পর্শ করতে পারেনি। ধর্মীয় ধ্যানধারণায় তিনি হিন্দুজাত হয়েও, ছিলেন নিরপেক্ষ।কবিতাকে তিনি নিয়ে গেছেন জনবোধের বাঁধানো পথে এবং যিনি ছিলেন শায়র-এ-শবাব (রূপের কবি) তিনি হয়েছেন শায়র-এ-ইনকলাব (বিপ্লবের কবি)।

 বাহারউদ্দীন লিখেছেন, ‘মধ্যযুগীয় সামন্ত চেতনা থেকেই ফিরাকের কবিস্বভাবের যাত্রা—আর এই উত্তরণ ঘটল আধুনিক কালে, এলিয়ট, পাউণ্ডের বুদ্ধিবাদী জগতে।’ ফিরাক ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির পুরোহিত, হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রতীক। তিনি হিন্দু মিথের তামাম প্রতীকগুলিকে দিয়েছেন শৈল্পিক অমরতা। ঘুংঘট, চিরাগা, রুহে কায়নাত, শব্দমিস্তা, অন্দাজেঁ, রমজো-কায়নাত, গুলিস্তাঁ প্রভৃতি সংকলনে ইশক আর মোহব্বতের বুদবুদ যে পাত্রে তুলছেন, সেই পাত্রেই ঘটেছে উপনিষদের মন্থন—

‘ফিতরৎ কী খনওতোঁ মেঁ ডালে ফেরে
পেচোখম জীস্ত কে লগায়ে ফেরে।’

 গতিজ বিবর্তনে বিশ্বাসী ফিরাকের গজলে তাই আমরা দেখতে পাই অরব-ইরানের সহবর্ণনা। এই বাঁকের মুখেই কাব্যকৃতি বা বিষয়ানুগত্যের প্রশ্নে ফিরাকের বিপ্লব। আমার মতে উর্দু গজলকারদের মধ্যে গালিবের পরেই ফিরাকের স্থান। মীর আর গালিবের পর শ্রেষ্ঠ গজল-রচয়িতা ফিরাক। তাঁর গজল দর্দে-দিল দর্দে-জিগরের অভিব্যক্তি—

‘রাজ কো রাজ হী রখা হোতা
ক্যা কহনা গর এ্যয়সা হোতা।
য়ে নির্জন বন য়ে সন্নাটা
গর কোই পত্তা খড়কা হোতা।
ম্যঁয় হুঁ দিল হ্যয় তনহাই ভী
তুম জো হোতে তো অচ্ছা হোতা।’

 ফিরাক ইশকিয়া গজলকে নতুন চরিত্র প্রদান করেছেন। প্রথম দিকের রচনায় মীর, গালিব, দাগ, জিগর, দর্দ, ফয়েজ প্রমুখের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। পরে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কিটস, কোলারিজের প্রভাবও পড়েছিল। এবং তারও পরে বাল্মীকি, ব্যাস ও কালিদাসের। কোনো রংই কিন্তু চড়া হয়ে ওঠেনি, বৃদ্ধ বয়সের রচনাতে তো নয়ই—

‘কিস লিয়ে সে নহীঁ হ্যয় দর্দ ফিরাক
অব তো ওহ ধ্যান সে উতর হী গয়ে।’

 ফিরাক খেয়ালি শায়র,—লিবারেল কবি বললেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি বলেছেন—‘আমি সারা জীবন বুলন্দ-তরীন, পাকিজা-তহীন ও খঁরু-ও-বরকত দিয়ে গজলকে সাল, কারা করে তোলার চেষ্টা করেছি। ইনসানিয়ৎকে গভীর ও বলিষ্ঠ ভাবে দেখেছি। গজলই তো একমাত্র মাধ্যম, যা আমার হৃদয়ের জ্বালাকে হালকা করে আমাকে শান্তি দেয়।’—

‘য়হ জিন্দগী কে কড়ে কোস য়্যাদ আতা হ্যয়
তেরী নিগাহেঁ-কর্ম কা ঘনা-ঘনা সায়া।’

 ফিরাকের গজল আন্তর্দেশীয় খ্যাতি পেয়েছে, লোকের মুখে মুখে ফিরছে তাঁর শের—

‘অল ফিরাক অল বিদা হে অহলে বতন
ইক অনসুনী আওয়াজ বুলাতী হ্যয়।
অব তুম সে রুখসৎ হোতা হুঁ
নয়ে তরানে ছেড়ো, মুঝে নীঁদ আতী হ্যয়।।

 ফিরাক আজ চিরনিদ্রায় শায়িত, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর ফিরাক-সমুদ্র।তার জলে অবগাহন করেই আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি এই অদ্বয় স্রষ্টাকে—

‘য়্যাদ আতী হ্যঁয় উসকী বাতেঁ লেকিন দিল পর য়ে নহীঁ খুলতা

কিন বাতোঁ পর অশক বহায়েঁ, কিন বাতোঁ সে জী বহলায়েঁ।’

 ফিরাক একবার বলেছিলেন—‘কোনো দেশের ওজিরে-আজমের (রাষ্ট্রপ্রধান) সিংহাসন এক মুহূর্তের জন্যেও খালি পড়ে থাকে না। কিন্তু শায়রে-আজমের সিংহাসন একবার শূন্য হলে তা যুগ যুগ ধরে শূন্যই পড়ে থাকে।’ গালিবের পর ফিরাক নিজেই ছিলেন আর এক ‘শায়র-এ-আজম’, যাঁর মৃত্যুর পর এযাবৎ কেউ আবির্ভূত হননি যিনি সেই সিংহাসন দাবি করতে পারেন। আত্মবিশ্বাসী ফিরাক জীবনসায়াহ্নে তাই বলে গিয়েছেন—

‘আনেওয়ালী নসলেঁ তুম পর ফখ্র করেঙ্গী হম অসরো
উনকো জব মালুম য়ে হোগা, তুমনে ফিরাক কো দেখা থা।’

 তবুও উর্দু গজল-ক্ষেত্রে তৎপরতার অভাব ঘটেনি। গজলের রীতি-প্রকৃতি-ভঙ্গি নিয়ে চর্চায় এবং নতুন ভাবধারার সন্ধানে ব্রতী আছেন অনেকে। এঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করব মহম্মদ সমর য়্যার খাঁ ওরফে সাগর নিজামীর (১৯০৫-২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪)। সাগর নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে—

‘ম্যঁয় হুঁ অপনে বতন কে পূজারী
বগাওত জওয়ানোঁ কা মজহব হ্যয় সাগর
গুলামী হ্যয় পীরী বগাওত জওয়ানী।’

 সাগর নিজামী স্বভাবতই বিপ্লবকামী ও দেশহিতৈষী। তাঁর ‘ওয়াদা-এ-মশরিকে’ সংকলিত কবিতাগুলির ভূমিকা লিখতে গিয়ে সরোজিনী নাইডু লিখেছিলেন—‘কবিতাগুলি নবযুবকদের প্রেরণা হোক।’ এটিই সাগরের সর্বাধিক বিক্রীত বই (প্রায় ৫০টি সংস্করণ)। ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর ‘মশাল-এ-আজাদী’ নজরুলের ‘অগ্নিবীনা’র সমকক্ষ। সাতচল্লিশের আগে উর্দু গজলে সাগর যে প্রাণচাঞ্চল্য এনেছিলেন, তার জন্যে তাঁকে জোশের পাশে স্থান দিতে আমাদের কুণ্ঠা নেই। উর্দু গজলে ‘ইনকলাব’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার জোশের হাতে, আর তা ব্যঞ্জিত হয়েছে সাগরের কলমে—

‘ইস ইনকলাব নে কতরে কো শয়লে আব কিয়া
ইস ইনকলাব নে জর্বে কো আফতাব কিয়া।’

 আশাবাদী শায়র সাগর নিজামীর গজলে আছে আলমগীর মোহব্বত, অর্থাৎ সার্বভৌম প্রেম—

‘জিস কদর কতরে হ্যঁয় কতরো কো ফির দরিয়া করেঁ
আ কি ময়খানে মেঁ পয়দা ফির নই দুনিয়া করেঁ।’৪২

 ভারতীয় প্রগতিক মহলে অজীম শায়র ফয়েজ আহমদ ‘ফয়েজে’র গজল শ্রদ্ধেয় ঐতিহ্য পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্যবাদীদের মধ্যে ফয়েজের আবেদন অবিসংবাদিত। দলিত-মর্দিত মানবতার পীড়াকে রক্তভেজা হৃদয়ে আঙুল ডুবিয়ে অভিব্যক্ত করেছেন ফয়েজ (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১১-১৯ নভেম্বর ১৯৮৫)। উর্দু সাহিত্য ফয়েজে পেয়েছে মহোত্তরণ। মুক্ত, মহান, ডালপালা মেলা বিকশিত, পল্লবিত ও ঋদ্ধ মানুষ ও মানবিকতার কথাই ফয়েজের শায়রীচর্চার সারাৎসার।তাঁর মাধ্যমে উর্দু গজল পেয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। মাহমুদ আল জামানের ভাষায়—‘ফয়েজ কবিতায় মানুষের দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির নন্দিত চৈতন্যে একবার পালটে দেন। উর্দু সৃজনশীল কবিতার ওপুস্রোত। ভাঙেন না বটে তিনি গীতিস্রোত, কিন্তু প্রচল ছিঁড়ে তিনি প্রেম আর প্রকৃতি, সুরাপাত্র আর প্রেয়সীর মুখ ছন্দে আনেন বাস্তবতার আদল। এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা। শুধুই কি দেশপ্রেম আর মানববন্ধন? মোটেই না। একই সঙ্গে আত্মীকরণ করিয়েছেন তিনি মানবজীবনের অনুপুঙ্খ ঘটনাস্রোত। যেখানে বঞ্চনা আর শোষণ, নিরাশা আর আশা, জীবনের সংগ্রাম, তৃষ্ণা, ক্লান্তি আর আনন্দ, কুৎসিত আর সুন্দরের জন্য, সৃষ্টির পথ সন্ধান, অপরাজেয় শক্তিতে সেখানে দীপ্যমান। ফয়েজ উর্দু কবিতার বিস্তৃত ভূমিতে এ-ক্ষেত্রেই অনন্য।’

ব্যক্তি ফয়েজ আর কবি ফয়েজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রগতিশীল লেখক সংঘে যোগদান, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কাজকর্ম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদের ভার, পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার সম্পাদনা, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের জন্য তিন দফায় কারাদণ্ড ভোগ—ইত্যাদি নানান ঘটনা ফয়েজের কবিতায়ও প্রভাব ফেলেছিল। রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় দীর্ঘ চার বছর বন্দি থাকার সময় তাঁকে কালি কলম দেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তখন তিনি ইটের টুকরোর ওপর বহু কবিতা লিখেছেন। তারই একটি কবিতার উদ্ধৃতি (পরে যেদি ‘দস্ত-এ-সেবা’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়) এখানে দেওয়া হল—

‘মতা-ই-লৌহো কলম ছিন গয়ে তে ক্যা গম হ্যয়
কি খুন-এ দিল মেঁ ডুবো লী হ্যঁয় উংলিয়াঁ ম্যঁয়নে
অনগিনত সদিয়োঁ কে তাবিক বহীমানা তলিসম
জুবান পে মোহর লগী হ্যয় তো ক্যা কি রাখ ভী হ্যয়

হরেক হলকা-ই-জঞ্জির মেঁ জুবান ম্যঁয়নে।’

 দার-ও-রসন (ফাঁসি মঞ্চ), জনুন (পাগলামি), ম্যয়খানা (মধুশালা), শরাব, পেয়ালা, বুলবুল প্রভৃতি রোমান্টিক প্রতীকগুলিও ফয়েজের গজলে সুন্দরভাবে এসেছে—

‘য়্যহী জুনুন য়্যহী তৌক-ও-দার কা মওসম
য়্যহী হ্যয় জব্র, য়্যহী অখতিয়ার কা মওসম।
কসম হ্যয় বস মেঁ তুমহারে,তুমহারে বস মেঁ নহীঁ
চমন মেঁ আতিশ-এ-গুল কে নিখার কা মওসম।
সবা কী মস্ত খিরামী তহ-এ-কমন্দ নহীঁ
অসীর-এ-দাম নহীঁ হ্যয় বহার কা মওসম।’

 শেষ শেরটি অনুপম—

‘বলা সে হমনে ন দেখা তো অওর দেখেঙ্গে
ফরোগ-এ গুলশন-এ মওত-এ হজার কা মওসম।’

 ফয়েজের এই ধারারই উত্তরসাধক সাহির লুধিয়ানভী (১৯২৩-২৫ অক্টোবর ১৯৮০)। যাঁরা পুরোনো হিন্দি ফিল্মের দরদভরা গান শুনতে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে সাহিরের জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত। কলেজে পড়ার সময় তাঁর প্রথম নজম-সংকলন ‘তলখিয়াঁ’ প্রকাশ পায়। আজও সেই গ্রন্থ থেকে কলি হরণ করে প্রেমপত্র লেখে যুবক-যুবতিরা। সাহিরের আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ আছে—‘গাতা জায়ে বনজারা’, ‘আও কি কোই খ্বাব বুনেঁ’ এবং ‘পরছাইয়াঁ’। সাহির ফিল্মেই গজল লিখেছেন বেশি। প্রথম ছবি ‘নওজওয়ান’ চল্লিশ দশকে নির্মিত। তারপর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্যাসা, ধুল কা ফুল, সাধনা প্রভৃতি ছবিতে তাঁর গজল ঔৎকর্ষ ও ভাবপ্রবণতার জন্যে বিখ্যাত। সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদ ছিল সাহিরের চক্ষুশূল। তাজমহল সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন—

‘এক শাহংশাহ নে দওলৎ কা সাহারা লেকর
হম গরীবোঁ কী মুহব্বত কা উড়ায়া হ্যয় মজাক।’

 সংগীত পিপাসুদের কাছে আর একটি প্রিয় নাম মজরুহ সুলতানপুরী। এঁর গজল মূলত মানবীয় সমস্যা ও প্রেম। জনৈক সমালোচকের মতে—‘মজরূহ গজলের কদীম শিসে (পুরোনো বোতলে) নতুর শরাব ঢেলেছেন।’ কথাটি এক অর্থে সত্য; প্রমাণত—

‘জবীঁ পর তাজে-জর, পহলু মেঁ জিন্দা ব্যাঙ্ক ছাতী পর
উঠেগা বেকফন কব য়হ জনাজা হম ভী দেখেঙ্গে।’

আর গজলে জমি, লাঙল, যবের দানা, কারখানা, শ্রমিক প্রভৃতি প্রতীকী শব্দের ব্যবহারে মজরুহ যে কুশলতা দেখিয়েছেন, তা-ও কি আমাদের বিস্মিত করে না?—

‘জব জমীন গায়েগী, হল কে সাজ পর নগমে
ওয়াদিওঁ মেঁ নাচেঙ্গে হর তরফ তরানে-সে।
অহলে দিন উগায়েঙ্গে খাক সে মহো-অনজুম
অব গুহর সুবক হোগা জৌ কে এক দানে সে।
মনচলে বুনেঙ্গে অব রঙো-বু কে পয়রাহন
অব সঁওর কে নিকলেগা হুসন কারখানে সে।’

 রচনার পরিচ্ছন্নতা, পারিপাট্য ও অনবদ্যতা সাধন আজকের গজলের সুলক্ষণ। মজাজের রচনা এই লক্ষণাক্লান্ত। শিল্পী মজাজের অনেক গজল হৃদয়াবেগের গভীর আন্তরিকতায় রসঘন হয়ে উঠেছে। তুলনামূলক অধ্যয়নে দেখা যাবে আখতার শীরানী ও মজাজের শায়রীর পৃষ্ঠভূমি প্রায় একই। দুজনেই মূলত রোমান্টিক ও গীতিময় কবিতা লিখেছেন—উভয়ের গজলেই আছে মাদকতা, যা নেশা ধরায়। শীরানীর রচনায় ‘সলমা’ ও ‘অজরা’ আছে, মজাজে আছে ‘জোহরাজবীঁ’। উভয়ের গজলেই গালিব, মোমিন, হাফিজ এবং খৈয়ামের অনুষঙ্গ উপস্থিত। শীরানী ও মজাজের মধ্যে একটি মাত্র স্থলে দারুণ বৈষম্য, সেটা হল—সামাজিক পরিবর্তনের জন্য শীরানী যেখানে চিৎকার করেন, মজাজ সেখানে গান করেন উদাত্ত কণ্ঠে। নিচের গজলটিতে ফুটেছে মজাজের সুর—

‘অয় মোহব্বত সাকী ক্যুঁ পরদে মেঁ রহী
গালিব কে দর্দ ক্যুঁ মেরে দিল মেঁ রহা!
বদলা নহীঁ চেহরা তো ক্যা বদলা
আখির দিল কা দর্দ দিল হী মেঁ রহা।’

 আধুনিক উর্দু গজলে দুটি ধারা পাশাপাশি চলেছে। একটা ধারা শাশ্বত প্রেম, অন্যটি সাম্যচেতনা। প্রথমটি গজলের জন্মজাত প্রসঙ্গ, দ্বিতীয়টির জন্ম অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে—যা ফয়েজের সময় থেকে সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে।দ্বিতীয় ধারারই বিকাশ ঘটেছে সরদার জাফরির গজলে। জাফরি আক্ষরিক অর্থেই জনকবি—

‘মুঝে ন সতাও লোগো ম্যঁয় আমফহম গজলগো হুঁ
ঝন্ডা ওহাঁ ফওরায়ো জহাঁ তুমহারী জমীন হ্যয়।’

 ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের কথা সরস বাণীরূপ পেয়েছে হসমুখ বিজনৌরীর গজলে—

‘বহুত সুনতে চলে আয়ে হ্যঁয় চর্চে বেওফাই কে
পতা ক্যা থা ধোখা য়হ খুদ খায়েঙ্গে একদিন।’

 অবদুল মালিক খান উচ্চস্তরের হৃদয়াবেগের কবি। তাঁর একটি বিখ্যাত গজলের দুটি শের নিচে দেওয়া হল, এতে সন্ধান পাওয়া যাবে তাঁর রচনার গাঢ়বদ্ধতার—

‘বাত কী বাত মেঁ বীততী জিন্দগী।
রোজ দিন রাত মেঁ বীততী জিন্দগী।
বক্ত কে দওর মেঁ ধূল বনকর উড়ে।
বাঢ়-বরসাত মেঁ বীততী জিন্দগী।’

 পরিশেষে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক সাম্যবাদী কবি মনমোহন তলখের একটি অনল-শের

‘গজলোঁ সে রেভ্যুলেশন হোতী নহীঁ কভী
সচ্চে ইরাদোঁ সে উঠা লো রিভলবর।’

ওপরে উর্দু গজল সাহিত্যের উদ্ভবকাল থেকে এযাবৎ প্রাপ্ত নির্বাচিত নিদর্শনগুলি যথাসম্ভব কালানুক্রমে আলোচিত হল। বলা বাহুল্য, জীবিত অনেক কবির রচনার নিদর্শন এই ক্ষুদ্র পরিসরে সমাবেশিত করা সম্ভব হয়নি। এবং বলা আরও বাহুল্য, উর্দু গজল সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আজ যেখানে এসে পড়েছে এটাই তার শেষ অবস্থা নয়—আরও বিকশিত হবে। সেই বিকাশ ভবিষ্যতে কোন পথে ধাইতে পারে তার আভাস ওপরের আলোচনায় দেওয়া হয়েছে।

 একথা সর্বমান্য যে শিল্প-সাহিত্য সামাজিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে উদর্তিত হয়। গজল এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাক-জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যুগ পর্যন্ত স্থৈর্য স্থিতিবোধ বিশ্বাসের বলয়ে জীবনকে সংবৃত রেখেছিল, চতুষ্পার্শ্বস্থ মসৃণ জীবনযাত্রায় জীবনপ্রীতির একটা স্থির অবিকল্পিত উপলব্ধি গজলকারদের চিত্তে সদাজাগ্রত ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত উর্দু গজল কল্পনার রঙিন ভাববিলাস থেকে বেরিয়ে রূঢ় বাস্তবের বন্ধুর ভূমি অবধি এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। খুবই সূক্ষ্ণভাবে। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে এল—জীবনজিজ্ঞাসা ও সত্যনিষ্ঠ মননের অতন্দ্র সাধনা। অতঃপর স্বাধীনোত্তর কালে বাস্তব জীবনদর্শন, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সত্যোদঘাটনের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা উর্দু গজলে যেভাবে রূপলাভ করেছে, জগৎ ও জীবনে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ-যুগের গজল ব্যক্তিচেতনা-কেন্দ্রিক, প্রকরণও হয়েছে নিতান্তই ব্যক্তি-আশ্রয়ী। আত্মপ্রসারণকামী মানুষের পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে দ্বান্দ্বিক চেতনার বাণী, ললাটে তার যুদ্ধোত্তর যুগের ভস্মটীকা। অর্থ-বৈষম্য, সামাজিক অনৈক্য ও বিকৃতির অজস্র তরঙ্গাঘাতে গজল আজ প্রাচীন ভাবস্রোতের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত। মার্কসীয় বৈপ্লবিক সমাজতত্ত্ববাদ, ফ্রয়েডীয় ঈডিপাস ইলেকট্রো-ট্রো কমপ্লেক্স—ঐতিহ্যনুসারী উর্দু গজলের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে।

 শুধু পরিবর্তন বললে ঠিক বোঝানো যায় না। বলা উচিত, আশানুরূপ পরিবর্তন ঘটেছে। শুদ্ধ নির্মোহ বাস্তবতার অকুণ্ঠ প্রতিষ্ঠা, শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ—এ-যুগের গজলে আছে জীবনানুভবের যন্ত্রণা; চৈতন্যের উর্ধ্ব-বিহার নয়—বস্তুতান্ত্রিক ও শ্রেয়োবাদী ভাবনা। উর্দু গজল চলেছে সেই আকাঙ্ক্ষিত উজ্জ্বল উত্তরণের দিকে।

.

তথ্যসূত্র

১৫. Gopichand Narang : ‘The Urdu Ghazal : A Gift of India’s Composite Culture’

১৬. অজিত রায়, ‘সন্দর্ভ হিন্দী গজল’, দিগন্ত, ১৯৮৪

১৭. বিশদ বিবরণ পড়ুন এই গ্রন্থেই।

১৮. এক বিশেষ গাইয়ে-সম্প্রদায়।

১৯. সুফিমত নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থেই।

২০.  হাফিজ সিরাজী, ‘রুমানিয়া শায়রী’

২১. পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, নির্বাচিত বক্তৃতা থেকে

২২. পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, ঐ

২৩. মাজদা অসদ, ‘গজল : উত্তর অওর দক্ষিণ মেঁ’, আজকল, মে ১৯৮১

২৪. ফিরাক গোরখপুরী, ‘উর্দু কী ইশকিয়া শায়রী’, পৃষ্ঠা ৬১

২৫. মোহম্মদ হসন অস্করী, ‘মীর কী শায়রী’, পৃ. ২৫৬

২৬. বুদ্ধদেব বসু, ‘কালিদাসের মেঘদূত’

২৭. সুধীন্দ্রনাথা দত্ত, ‘স্বগত’, পৃ. ৩৮

২৮. জগন্নাথ চক্রবর্তী, ‘জীবনানন্দ বনলতা রবীন্দ্রনাথ’, দেশ, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪

২৯. ড. খানিক আনজুম, ‘গালিব কে খত’, পৃ. ৫-২৫

৩০. ড. খানিক আনজুম, ঐ

৩১. ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘কুটীরের গান’, ১ম সংস্করণ

৩২. Benoy Ghosh : ‘The Bengali Intelligentia and the Revolt in Rebellion’, 1857

৩৩. ঊষা উর্বেশ, ‘জফর অওর উনকী শায়রী’, আজকল, মে ১৯৮৩

৩৪. Dr. Shaikh Maksud Hali : ‘Perso-Arabic Element in Bengali’, p.111

৩৫. সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, চিঠিপত্র, দেশ, ১৮ অগাস্ট ১৯৮৪

৩৬. ড. ব্রজরতল দাস, ‘উর্দু সাহিত্য কা ইতিহাস’, পৃ. ১৮২

৩৭. অমিয় চক্রবর্তী, ‘ইকবালের কবিতা’, ‘ঈশ্বর’, ‘কবিতা সংগ্রহ’, পৃ. ৩০৮

৩৮. যুথিকা তলাপাত্র, ‘হসন নিজামী’, আজকাল, ১৪ অগাস্ট ১৯৮৪

৩৯. যীশু চৌধুরী, ‘গণনাট্য আন্দোলনের ইতিবৃত্ত’, শারদীয় পরিবর্তন, ১৯৮৩

৪০. বুদ্ধদেব বসু, ‘প্রবন্ধ সংকলন’, পৃ. ৭৮

৪১. অজিত রায়, ‘জীবন ও কবিতায় ফিরাক গোরখপুরী’, গোধূলি মন, মে ১৯৮৩

৪২.  মোহনচন্দ্র মন্থন, ‘সাগর নিজামী : ব্যক্তিত্ব অওর কৃতিত্ব’, আজকল, জুন ১৯৮৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন