বাংলার শাসক ঈসা খাঁর জীবনে যত বাঁকবদল আছে, উপন্যাসের কোনো চরিত্রের জীবনে তত বাঁকবদল থাকলে সমালোচকেরা তাকে অতিনাটকীয় বলে বাতিল করে দিতেন। কিন্তু মধ্যযুগের এই শাসনকর্তার জীবনের নাটক শুরু হয়েছে তাঁর জন্মেরও আগে।
তাঁর বাবা কালিদাস ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজপুত। কালিদাস তাঁর বাবা ভাগীরথ গজদানির সঙ্গে অযোধ্যা ছেড়ে চাকরি খুঁজতে গৌড়ে চলে আসেন। ভাগীরথ প্রশাসনের কাজে দক্ষতা দেখিয়ে নসরত শাহের আমলে দরবারে দেওয়ান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর নসরত শাহ ভাগীরথের যোগ্য ছেলে কালিদাসকেই দিওয়ানের পদ দিলেন। নসরত শাহের ভাই আবদুল বদরের মেয়ে মোমেনা খাতুন কালিদাসের গুণপনার কথা শুনে তাঁর প্রেমে পড়লেন। রাজকন্যার রূপে মুগ্ধ হয়েই হোক, কিংবা রাজধর্ম ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই হোক, কালিদাস ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাঁর নতুন নাম হলো সুলাইমান খান। সুলতান নসরত শাহ তাঁর হাতে ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুটি পরগনা অর্পণ করলেন। একটি পরগনার নাম পূর্ব ময়মনসিংহ (এখন কিশোরগঞ্জ), আরেকটির নাম সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)। সুলাইমানের প্রতি আদেশ হলো, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে নিজের পরগনায় গিয়ে থাকতে হবে। তিনি সে আদেশ মেনে নিলেন।
সরাইলের জমিদারবাড়িতেই ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খাঁর জন্ম। তিনি বেশ আদরেই বড় হয়ে উঠছিলেন বলে মনে হয়। তাঁর জন্মের দুই বছর আগেই তাঁর নানা আবদুল বদর গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ নামে সিংহাসনে বসেন, সে কথা তো আগেই বলেছি। সুলতানের জামাই হিসেবে সুলাইমান খান আরও কিছু পরগনার মালিক হয়েছিলেন।
সবকিছু ভালোই চলছিল, কিন্তু এরপর প্রথমে শের খান ও পরে জালাল খান সূরি গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের পরিবারের ওপর দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া হয়ে এলেন। জালালের আক্রমণে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় ও বাংলা ধ্বংস হয়ে গেল, ঈসা খাঁর দুই মামা নিহত হলেন। সেই শোকে ঈসা খাঁর নানা সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদও কহলগ্রামে মারা গেলেন।
জালাল খান সূরি বাংলা থেকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের আত্মীয়দের উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রথমে হুমায়ুনের সঙ্গে লড়াই, পরে শের খান সম্রাট হয়ে যাওয়ার পর রাজপুতানা অভিযানে ব্যস্ত থাকায় জালাল খান এই উচ্ছেদ অভিযান শেষ করে যেতে পারেননি। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাবার মৃত্যুর পর তিনি যখন ইসলাম শাহ নামে সম্রাট হয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসলেন, তাঁর আবার এই অসমাপ্ত কাজের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর হুকুমে গৌড়ের প্রশাসক মুহাম্মদ খান সূর সুলাইমান খানকে নিজের পরগনা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ পাঠালেন। সুলাইমান খান এই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করায় একদল সৈন্য গিয়ে আলোচনার নামে প্রাসাদে ঢুকে তাঁকে হত্যা করল। প্রাসাদ লুট করা হলো। তাঁর দুই ছেলে ঈসা আর ইসমাইল খাঁকে ধরে নিয়ে ইরানি বণিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হলো।
সুলতানের নাতি থেকে এক ক্রীতদাস-জীবনের এই নিষ্ঠুর আঘাত ঈসা খাঁ কেমন করে সহ্য করেছিলেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস কিছু বলে না। তবে ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম শাহ যখন যৌনরোগে ভুগে অকালে মারা পড়লেন, তখন বাংলার প্রয়াত সুলতানের আত্মীয়দের ওপর অত্যাচার বন্ধ হলো। গৌড়ের শাসক মুহাম্মদ খান সূর নিজেকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা দিয়ে শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ নাম গ্রহণ করলেন। বাংলায় খুব অল্পকালের জন্য মুহাম্মদ শাহি নামের এক সুলতান বংশ প্রতিষ্ঠিত হলো। তাঁর ছেলে গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহ হয় বাবার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে কিংবা সুলতান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার লোভে ঈসা খাঁর চাচা (ইনিও ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন) কুতব খানকে নিজের দরবারে চাকরি দিলেন, ক্রীতদাসত্ব থেকে ঈসা খাঁ ও ইসমাইল খাঁকে ছাড়িয়ে আনার অনুমতিও দিলেন। ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে কুতব খান মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে মৃত ভাইয়ের দুই ছেলেকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করলেন। ঈসা খাঁ তত দিনে ২৭ বছরের তরুণ।
১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মোগলদের তাড়া খেয়ে বিহার থেকে এসে শেরশাহের এককালের সেনাপতি তাজ খান কররানি গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহকে হত্যা করে নিজেকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা করলেন। আগের আমলের সুলতানদের অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে তিনি ঈসা খাঁকে তাঁর বাবার পরগনাগুলোর অধিকারও ফিরিয়ে দিলেন। এই সময়ে ঈসা খাঁ সম্ভবত প্রথমবার বিয়ে করেন, স্ত্রীর নাম ফাতিমা। ফাতিমা বিবির বাবা সৈয়দ ইব্রাহিম দানিশমন্দ সুবর্ণগ্রাম ও শ্রীহট্টের দুটি পরগনার জমিদার ও সুফিসাধক ছিলেন। ঈসা খাঁর বাবা সুলাইমান খানকে ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মনে হয়, সুলাইমান খান সৈয়দ ইব্রাহিমের সঙ্গে বন্ধুত্বকে আত্মীয়তার বন্ধনে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। ঈসা খাঁ দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং নিজের পরগনার অধিকার ফেরত পাওয়ার পর সৈয়দ ইব্রাহিম তাঁর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়ে মৃত বন্ধুর ইচ্ছা পূরণ করেন।
দাসজীবনের কঠোর নিগ্রহের অভিজ্ঞতা থেকে ঈসা খাঁ শিক্ষা নিয়েছিলেন। হারানো পরগনাগুলো ফিরে পাওয়ামাত্র তিনি সেখানে গিয়ে প্রজাদের সুবিধার দিকে নজর দিলেন। একই সঙ্গে আত্মরক্ষার জন্য এক দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন। মোগলদের হাতে মার খাওয়া বহু আফগান সৈন্য তখন পালিয়ে এসে বাংলায় আশ্রয় নিচ্ছিল। এদের দলভুক্ত করে ঈসা খাঁ ক্রমেই নিজের শক্তি বাড়িয়ে তোলেন, তবে কররানি শাসকদের বিরুদ্ধাচরণ করেননি।
তাজ খানের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সুলায়মান খান কররানি নিজেকে আর সুলতান বলে দাবি করেননি, মোগল সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েই রাজ্যের সীমা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যখন ওড়িশার রাজা মুকুন্দ দেবের বিরুদ্ধে নিজের ছেলে বায়েজিদ এবং সেনাপতি কালাপাহাড়ের (এককালে তাঁর নাম ছিল রাজীবলোচন রায়, ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি হিন্দুবিদ্বেষীতে পরিণত হন) নেতৃত্বে এক বাহিনী পাঠালেন, তখন ঈসা খাঁও এই কররানিদের পক্ষে এই অভিযানে যোগ দেন। অভিযানে ঈসা খাঁর বীরত্ব কররানিদের সম্ভ্রম আদায় করেছিল।
এরপর কালাপাহাড়ের কামতা অভিযানেও ঈসা খাঁ যোগ দিয়েছিলেন, সেখানেও বিপুল বীরত্ব ও রণকৌশলের পরিচয় দেন। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে সুলায়মান খান কররানির যখন মৃত্যু হলো, তখন ঈসা খাঁ আর সাধারণ কোনো জমিদার নন, বাংলার অন্যতম ক্ষমতাশালী নেতাদের একজন হয়ে উঠেছেন। সুলায়মানের বড় ছেলে বায়েজিদ ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পর ছোট ছেলে দাউদ খান কররানি বাংলার সিংহাসনে বসতে ঈসা খাঁর সাহায্য নিয়েছিলেন। দাউদ খান কররানি চাইছিলেন শেরশাহের মতো দিল্লির ক্ষমতা দখল করতে। তিনি ঈসা খাঁকেও মোগলবিরোধী জোটে শামিল হতে বলেন। বুদ্ধিমান ঈসা খাঁ পরিস্থিতি বিচার না করে তড়িঘড়ি বিদ্রোহ করেননি, তবে ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা উদয়মাণিক্য যখন চট্টগ্রাম আক্রমণ করলেন, তখন ঈসা খাঁ চট্টগ্রামে গিয়ে কররানিদের হয়ে ত্রিপুরার রাজাকে বিতাড়িত করেন। তাঁর বীরত্ব দেখে ত্রিপুরার রাজা তাঁর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেছিলেন।
দাউদ খান স্বাধীনতা ঘোষণা করে বিপদ ডেকে আনলেন। আকবর সসৈন্য বাংলায় এলেন। দাউদ খান কররানিকে ওড়িশার দিকে সরে যেতে হলো। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এভাবে পাঠানদের সাময়িকভাবে দমন করে মুনিম খানকে সুবাদার নিযুক্ত করে মোগল সম্রাট আকবর আগ্রায় ফিরে গেলেন। কররানিদের আমলে বাংলার রাজধানী গৌড়ের পশ্চিমে তান্ডায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। মুনিম খান রাজধানী গৌড়ে ফিরিয়ে আনলেন। ঈসা খাঁ মুনিম খানের কাছে আনুগত্য স্বীকার করে নিজের জমিদারি ও সৈন্যবাহিনী অটুট রাখলেন।
এই সময়ে ঈসা খাঁর জীবনে প্রেম এল। বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সঙ্গে ঈসা খাঁর বন্ধুত্ব ছিল। চাঁদ রায়ের আদরের মেয়ে স্বর্ণময়ী অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। চাঁদ রায় মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন, বিধবা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে লেখাপড়া, ঘোড়ায় চড়া, অস্ত্রচালনা—সবই শিখিয়েছিলেন। স্বর্ণময়ী ঈসা খাঁকে দেখে (এবং সম্ভবত তাঁর বীরত্বের সুখ্যাতি শুনে) প্রেমে পড়ে গেলেন। ধর্মপরায়ণ চাঁদ রায়ের পক্ষে মেয়েকে ঈসা খাঁর হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্বর্ণময়ী বাড়ি থেকে পালিয়ে ঈসা খাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তাঁর সাহসে (সম্ভবত রূপেও) মুগ্ধ হয়ে ঈসা খাঁ তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হলেন। স্বর্ণময়ী ইসলাম গ্রহণ করলেন, তাঁর নাম হলো সোনা বিবি। ঈসা খাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলো। ক্ষিপ্ত চাঁদ রায় যুদ্ধ করে মেয়েকে কেড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, ভাওয়ালের জমিদার ফজল গাজির হস্তক্ষেপে নিরস্ত হন। তবে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সঙ্গে ঈসা খাঁর স্থায়ী শত্রুতা তৈরি হলো।
ঈসা খাঁ নিজের জমিদারিতে নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু ছয় মাস পরে মড়ক লাগল। মড়কে আক্রান্ত হয়ে মুনিম খান, খান-ই-খানানের মৃত্যু হলো। এই সুযোগে ওড়িশা থেকে এসে দাউদ খান কররানি মোগল সৈন্যদের হটিয়ে গৌড় দখল করে নিয়ে আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ঈসা খাঁ এবার দাউদ খান কররানির কথামতো মোগলবিরোধী ঐক্যে যোগ দিলেন। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজের নৌবহর নিয়ে আক্রমণ করে সুবর্ণগ্রামের কাছে অবস্থান নেওয়া মোগল নৌবহর ধ্বংস করে ফেললেন।
সম্রাট আকবর বাংলা ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি খান জাহান কুলির নেতৃত্বে বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালেন। বিহার থেকে মোগল প্রশাসক মুজাফফর খান তুরবাতির বাহিনীও যোগ দিল। দাউদ খান কররানি তাঁর আফগান বাহিনী নিয়ে রাজমহলে মোগল বাহিনীর মুখোমুখি হলেন। ঈসা খাঁকে সুবর্ণগ্রাম রক্ষার দায়িত্বে রেখে যাওয়া হয়েছিল। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে দাউদ খান কররানি পরাজিত হলেন, মোগলরা তাঁকে প্রাণদণ্ড দিল।
১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর মুজাফফর খান তুরবাতিকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করায় মোগল প্রশাসনে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিল। মোগল সেনাপতি মাসুম খান কাবুলি বিদ্রোহ করলেন, তান্ডায় মুজাফফর খান তুরবাতিকে হত্যা করলেন। ঈসা খাঁ বুঝলেন, এ-ই সুযোগ। তিনি মাসুম খান কাবুলির সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে নিজেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা দিলেন, উপাধি নিলেন মসনদ-এ-আলা। সুবর্ণগ্রামকে তিনি রাজধানী বানালেন। মাসুম খান কাবুলি নিজেকে বাদবাকি বাংলার শাসক হিসেবে ঘোষণা করে বিহার ও পশ্চিম বাংলায় মোগলদের সঙ্গে লড়তে লাগলেন। মোগল আমলে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় পৃথক শাসনের এটাই প্রথম উদাহরণ।
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঈসা খাঁ নিজে মোগলদের সঙ্গে সরাসরি লড়াই এড়িয়ে যেতে লাগলেন, তবে মাসুম খান কাবুলিকে মোগলদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে নৌবহর দিয়ে সাহায্য করেছেন। বিরক্ত মোগল সুবাদার শাহবাজ খান কাম্বো বক্তারপুরে ঈসা খাঁর নৌঘাঁটি আক্রমণ করলেন। প্রথমে ঈসা খাঁ পিছু হটে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তাঁর বাহিনী এগারসিন্দুর আর ভাওয়ালের যুদ্ধে মোগল বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলার বিরাট অঞ্চলজুড়ে দখল প্রতিষ্ঠা করল।
১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সুবাদার শাহবাজ খান ঈসা খাঁর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন, কিন্তু সে মৈত্রী টেকেনি।
১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মোগলদের ইন্ধনে পুরোনো পারিবারিক অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের বাহিনী ঈসা খাঁকে আক্রমণ করল। কিন্তু শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সোনাকান্দায় (নারায়ণগঞ্জে এক যুদ্ধে বিক্রমপুরের সৈন্যরা ঈসা খাঁর নৌবহরের কাছে পর্যুদস্ত হলো। পরের ছয় বছর বাংলায় আর কেউ ঈসা খাঁর নেতৃত্বকে টক্কর দিতে সাহস করেনি। ঈসা খাঁ পুরো বাংলার অর্ধেক অঞ্চলজুড়ে রাজত্ব করতে লাগলেন।
এক সামান্য জমিদারের স্বাধীনচেতা আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে তাঁকেই ঈসা খাঁকে উৎখাতের দায়িত্ব দিলেন। তিন বছর চেষ্টার পর মানসিংহের ছেলে কুমার দুর্জন সিংহ বিক্রমপুরে ঈসা খাঁর মুখোমুখি হতে পারলেন। কিন্তু ঈসা খাঁর নৌবহর মোগল বাহিনীকে আবার পর্যুদস্ত করে ফেলল। দুর্জন সিংহ মারা গেলেন, প্রচুর রাজপুত ও মোগল সৈন্য বন্দী হলো। ঈসা খাঁ বন্দী রাজপুত সৈন্যদের সাহায্যে যথাযথ মর্যাদায় দুর্জন সিংহের মৃতদেহের সৎকার করান। এই খবর পেয়ে মানসিংহ নিজে এসে সন্ধি করে মোগল বন্দীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এই সময়েই ঈসা খাঁ মানসিংহকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুতার অবসান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে কিংবদন্তি চালু আছে। সেটা হোক, আর না-ই হোক, সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল। ঈসা খাঁ আগ্রায় গিয়ে সম্রাট আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসেন। সম্রাট আকবর ঈসা খাঁর মসনদ-এ-আলা উপাধি স্বীকার করে নেন, তাকে বাংলায় দিওয়ান নিয়োগ করেন। প্রায় স্বাধীন অবস্থায় নামমাত্র কর দিয়ে ঈসা খাঁ বাংলার বাইশটি পরগনার ওপর নিজের অধিকার বজায় রাখেন।
১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এগারসিন্দুর দুর্গ থেকে ঈসা খাঁ বক্তারপুরে (কালীগঞ্জ, গাজীপুর) তাঁর নৌঘাঁটি পরিদর্শনে আসেন। এখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। বক্তারপুরে তাঁর সমাধিটি দীর্ঘদিন অচিহ্নিত থাকার পর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ তা চিহ্নিত করেছে।
ঈসা খাঁর স্বাধীনতার চেতনা তাঁর মৃত্যুর পরপরই নিভে যায়নি। তাঁর ছেলে মুসা খাঁ মোগলদের আনুগত্য অস্বীকার করে সুবর্ণগ্রাম থেকে লড়াই চালিয়ে যান। দশ বছর ধরে এই লড়াই চলে। ঈসা খাঁর বিধবা স্ত্রী সোনা বিবিও এসব লড়াইয়ের কোনো কোনোটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশেষে মোগল সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মুসা খাঁকে পরাজিত করে তাঁর স্বাধীনতা কেড়ে নেন। এরপরের সুবাদার ইব্রাহিম খান ফতেহ-ই-জঙ্গ (ইনি ছিলেন মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই) মুসার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে তাঁকে মোগল বাহিনীর ত্রিপুরা অভিযান ও কামরূপ অভিযানে কাজে লাগিয়েছিলেন।
মুসা খাঁ ঢাকায় একটি সুন্দর মসজিদ স্থাপন করেছিলেন। ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে এই মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোনেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এখন তাঁর সমাধিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পেছনে পড়েছে, শহীদুল্লাহ ছাত্রাবাসের কাছেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মেধাবী তরুণ-তরুণীদের খুব অল্পসংখ্যক এই সমাধির সঙ্গে জড়িত ইতিহাসের কথা জানেন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়।
ঈসা খাঁ, স্বর্ণময়ী, আর মুসা খাঁর স্বাধীনচেতনার উত্তরাধিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের সঙ্গে বহন করেছে—ইতিহাসের ঋণ শোধ হয়েছে তাতেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন