তরুণ তুর্কি : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি

তরুণ তুর্কি : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি

আফগানিস্তানের হেলমন্দ নদীর ধারে তোর আগা নামের এক এলাকায় খলজি উপজাতির একটি শাখা বাস করত। তোর আগার (পরে যার নাম হলো গর্মশির, মানে মাথা-তেতে-ওঠা-গরম) গ্রামগুলো নদীর ধারে, গ্রামের বাইরে গেলেই দিগন্তজোড়া ঊষর জমি। সেখানে খলজিরা প্রকৃতি এবং অন্যান্য উপজাতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকত। অসমসাহস আর প্রবল দৈহিক ক্ষমতা না থাকলে এই বৈরী পরিবেশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল। একটু নিরাপদ জীবিকার সন্ধানে তোর আগার সমর্থ পুরুষেরা প্রায়ই গজনীর সুলতানের সেনাদলে ভর্তি হতো।

এখানেই এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার অল্প বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন, জন্মভিটায় থাকলে জীবনটা কষ্টে কাটবে। তিনি সুলতানের সেনাদলে সৈন্য হিসেবে ভর্তি হতে গজনী গেলেন। কিন্তু সঙ্গে ঘোড়া নেই, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই। সেনাদলের নিয়োগকর্তারা ইখতিয়ার উদ্দিনকে ফিরিয়ে দিলেন। এমন সম্বলহীন সৈন্য তাঁরা চান না।

ইখতিয়ার উদ্দিন জানতে পেরেছিলেন, গজনীর সুলতান মুইজউদ্দিনের সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেক হিন্দুস্তানে রাজ্যবিস্তারের চেষ্টায় আছেন। হিন্দুস্তানের সহজলভ্য সম্পদের কথাও তাঁর কানে এসেছিল। তিনি মনোবল সম্বল করে গজনী থেকে দিল্লি গেলেন। দিল্লিতেও সেনাকর্তারা তাঁকে সেনাদলে নেওয়ার যোগ্য মনে করেননি। উত্তর প্রদেশের বদাউনে গেলেন, বিফল হলেন সেখানেও। শেষ পর্যন্ত অযোধ্যায় গিয়ে ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মালিক হিসাম উদ্দিনের সেনাদলে কাজ পেলেন। সেখানে তাঁর বীরত্ব আর সাহস দেখে মালিক হিসাম উদ্দিন বুঝলেন, এই অকুতোভয়, কৌশলী তরুণকে দিয়ে ভারতে সাম্রাজ্য বৃদ্ধির কাজ এগিয়ে নেওয়া যাবে। তিনি ইখতিয়ার উদ্দিনকে তাঁর রাজ্যের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে (এখন উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর জেলায়) দুটো পরগনার মালিকানা দিয়ে দিলেন।

হিসাম উদ্দিন লোক চিনতে ভুল করেননি। ইখতিয়ার উদ্দিন সামান্য দুটি পরগনার মালিকানা পেয়ে শান্ত থাকার লোক নন। তিনি সম্পদ আর সৈন্য সঞ্চয় করতে লাগলেন। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে আসা খলজি উপজাতির ভাগ্যান্বেষী বহু তরুণকে তিনি আশ্রয় দিলেন, তাদের অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ দিয়ে খুব নিবেদিতপ্রাণ এক সেনাদল গড়ে তুললেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, ঊষর এলাকা থেকে আসা সহায়-সম্বলহীন মরিয়া তরুণেরাই যুদ্ধজয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয়।

এই সেনাদল নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন নিয়মিত হানা দিতে লাগলেন দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে। ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মগধের ওদন্তপুরী বৌদ্ধ মহাবিহার সহজেই তাঁর করায়ত্ত হলো। নিরস্ত্র বৌদ্ধভিক্ষুরা তাঁর প্রশিক্ষিত সৈন্যদের সামনে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আত্মসমর্পণের পর ইখতিয়ার উদ্দিন বৌদ্ধভিক্ষুদের জেরা করে জানলেন, দুর্গসদৃশ বৌদ্ধদের এসব বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপাসনালয়ের নাম ‘বিহার’। এই নাম ইখতিয়ার উদ্দিনের পছন্দ হলো। তিনি ওই এলাকার নতুন নাম রাখলেন ‘বিহার শরিফ’। এই শহর টিকে গেল, ক্রমেই ‘বিহার’ একটি পুরো প্রদেশের নাম হয়ে দাঁড়াল।

বিহারে নানা সেনা অভিযান করে আশপাশের ছোট রাজ্যগুলো থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন প্রচুর সম্পদ সংগ্রহ করলেন। এই সম্পদের একাংশ তিনি উপহার দিলেন মালিক হিসাম উদ্দিনকে, আরেক অংশ গজনীর সুলতানদের প্রধান সেনাপতিকে ভেট দিতে দিল্লি গেলেন।

ইখতিয়ার উদ্দিনের বীরত্বের খবর কুতুবউদ্দিন আইবেকের কানে এসে পৌঁছেছিল। তাঁর আনা উপহারের পরিমাণ দেখে হয়তো একটু ঈর্ষাও জেগে থাকবে। তিনি ইখতিয়ার উদ্দিনকে একটা মত্ত হাতির সঙ্গে লড়াই করার আদেশ দিলেন। ইখতিয়ার উদ্দিন ভয় পাননি, মত্ত হাতির সঙ্গে একাই লড়াই করে তাকে পরাস্ত করলেন। কুতুবউদ্দিন আইবেক আর কী করেন, ইখতিয়ার উদ্দিনকে সসম্মানে নিজের অধিকৃত এলাকায় ফিরে যেতে দিলেন। ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকবার বদাউনে ইখতিয়ার উদ্দিন কুতুবউদ্দিন আইবেকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, সেবারও কুড়িটি হাতি এবং অনেক উপহার দিয়ে আসেন। ঈর্ষাকাতর ওপরওয়ালাকে সন্তুষ্ট রাখার উপায় ইখতিয়ার উদ্দিনের জানা ছিল।

বিহারে ১০ বছর ধরে বিস্তীর্ণ এলাকা অধিকার করে তিনি পাটনার কাছে বখতিয়ারপুর নামে এক নগরের পত্তন করলেন। সেনাদলের সংখ্যা ও শক্তি আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করলেন। ইখতিয়ার উদ্দিনের কানে এল আরও দক্ষিণে বিশাল এক উর্বর রাজ্য আছে। লক্ষ্মণ সেন নামের এক রাজা সেই সমৃদ্ধ, সম্পদশালী রাজ্য শাসন করেন। ওই রাজ্য দখল করতে পারলে তিনি আগের চেয়েও অনেক বেশি সম্পদের মালিক হতে পারবেন। সে রাজ্যের নাম গৌড়। কিন্তু গৌড় রাজ্যে যাওয়ার পথ দুর্গম। বিহার থেকে যাওয়ার পথে এক পাশে খরস্রোতা গঙ্গা, আরেক পাশে ঝাড়খন্ডের জঙ্গল প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাওয়ার পথ কেবল তেলিয়াগড়ি গিরিপথের মধ্য দিয়ে, সেখানে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সৈন্যবাহিনী সতর্ক পাহারায় আছে। ইখতিয়ার উদ্দিনের বিহার অভিযানের খবর পেয়ে রাজা লক্ষ্মণ সেন তেলিয়াগড়ি গিরিপথে সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে দেন।

ইখতিয়ার উদ্দিন ভেবে দেখলেন, গিরিপথের যুদ্ধে প্রচুর শক্তিক্ষয় হবে, অনেক সময় লাগবে। তিনি ঠিক করলেন, সৈন্যবাহিনী দিয়ে ঝাড়খন্ডের জঙ্গল কাটিয়ে ভেতর দিয়ে পথ করে নেবেন। এক বছর চেষ্টার পর তিনি তা-ই করলেন। তেলিয়াগড়ি গিরিপথে নিশ্চিন্তে পাহারায় থাকা লক্ষ্মণ সেনের সৈন্যকে পেছনে ফেলে ইখতিয়ার উদ্দিনের সেনাদল নবদ্বীপ (এখন নদীয়া) আক্রমণ করতে চলল। গুপ্তচরেরা খবর এনেছে, বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন সপারিষদ মোটামুটি অরক্ষিত এই অবকাশ-যাপনকেন্দ্রে বিশ্রাম করছেন।

ইখতিয়ার উদ্দিনের মূল সৈন্যবাহিনী শহর আক্রমণ করল। অগ্রবর্তী বাহিনীর ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য সঙ্গে নিয়ে অসমসাহসী ইখতিয়ার উদ্দিন লক্ষ্মণ সেনের প্রাসাদ আক্রমণ করতে গেলেন। রাজার দেহরক্ষীরা রুখে দাঁড়ালে কী হতো, বলা যায় না। কিন্তু ভাগ্য ইখতিয়ার উদ্দিনের পক্ষে। সেন রাজার সৈন্যরা ধরেই নিল, তেলিয়াগড়ি গিরিপথের পতন হয়েছে, মূল সৈন্যবাহিনীর পুরোটাই প্রাসাদ আক্রমণ করেছে। ‘তুরুস্ক’ সেনাদের হাতে কচুকাটা হওয়ার ভয়ে বেশির ভাগ দেহরক্ষী বৃদ্ধ রাজাকে নৌকায় তুলে নিয়ে মূল রাজধানী বিক্রমপুরের দিকে চলে গেল। রাজার পিছু পিছু উচ্চবর্ণের বহু হিন্দু, বিশেষ করে পুরোহিত ও পণ্ডিতেরা বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।

রাজ্যের বাকি অংশে সেন রাজার দিশেহারা সৈন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে সফল হলো না। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে নদীয়া জয়ের পর ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিনের সৈন্যরা গৌড়ের পুরোনো রাজধানী লক্ষ্মণাবতী (এখন গৌড়, মালদহ) দখল করে নিল। এই শহরের নাম অনুযায়ী ইখতিয়ার উদ্দিন তাঁর নবলব্ধ রাজ্যের নাম দিলেন ‘লখনৌতি’। পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে গঙ্গা, দক্ষিণে পদ্মা আর উত্তরে তিস্তা নদী দিয়ে ঘেরা এই উর্বর রাজ্য হাতে পেয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন বিশাল সম্পদের অধিকারী হলেন। আজকের বৃহত্তর পাটনা, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, মালদহ (ভারত) আর দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়াজুড়ে (বাংলাদেশ) এই রাজ্য বিস্তৃত ছিল।

ইখতিয়ার পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। সম্পদ হাতে পেয়ে জাঁকজমক করার বদলে তিনি ক্ষমতা সংহত করতে চাইলেন। হিন্দুবসতির লখনৌতি রাজ্যে একটি মুসলিম সমাজ গড়ে না উঠলে সে রাজ্যের কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ থাকবে না, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। বহু সম্পদ ব্যয় করে তিনি ইসলাম-চর্চার জন্য মসজিদ, ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাদ্রাসা আর ধর্ম প্রচারের জন্য খানকাহ স্থাপন করালেন। স্থানীয় অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণ করতে উৎসাহ দিলেন কখনো বুঝিয়ে, কখনো জমি উপহার দিয়ে, আবার কখনো বলপ্রয়োগ করে স্থানীয় হিন্দু ও বৌদ্ধদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়েছিলেন। তাঁর শাসনামলে বৌদ্ধবিহারগুলো সমূলে ধ্বংস করে বৌদ্ধভিক্ষুদের নির্যাতন করার ও বহু দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য বই নষ্ট করে ফেলার অভিযোগ আছে। আবার বর্ণাশ্রমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেতে নিম্নবর্ণের অনেক হিন্দু স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়ে ইখতিয়ারের প্রজা হয়েছিলেন, সে কথাও ঠিক। ইখতিয়ার উদ্দিনের বাহিনীর সৈন্যদের অনেকেই নতুন রাজ্যে সংসার স্থাপন করলেন।

ধনেজনে ইখতিয়ার উদ্দিনের রাজ্য ক্রমেই বাড়তে লাগল। ঘোড়সওয়ার সংখ্যায় দশ হাজারে গিয়ে দাঁড়াল। এই বিপুল শক্তির প্রয়োগ করার জন্য ইখতিয়ার উদ্দিন অস্থির হয়ে পড়লেন।

সত্যিকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটা বড় সমস্যা হলো, তা কখনো থামে না। ইখতিয়ার উদ্দিন নতুন রাজ্যে কিছুদিন রাজত্ব করতে পারতেন। বঙ্গ, রাঢ়, সমতটের অনধিকৃত অংশ দখল করে শক্তি আরও সংহত করতে পারতেন। কিন্তু বিহার ও বাংলার অনায়াস জয় তাঁকে প্রবল আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল। তিনি পরিকল্পনা করলেন, তিব্বত জয় করবেন।

তিব্বত যাওয়ার পথে কোচ আর কামরূপ রাজ্য পার হয়ে যেতে হবে। দুর্বল কোচ রাজা বাধা দিতে পারবেন না। ইখতিয়ার উদ্দিন ঠিক করলেন, কামরূপ রাজার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে তিব্বত দখল করবেন। তিব্বত দখল করতে পারলে কামরূপ রাজ্য জয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। অভিযানের সুবিধার্থে তিনি রাজধানী লখনৌতি থেকে সরিয়ে আরও উত্তরে দেবকোটে (দিনাজপুরের কাছে) নিয়ে এলেন।

কামরূপ রাজা পৃথু জানতেন, ইখতিয়ার উদ্দিনকে বাধা দেওয়ার শক্তি তাঁর নেই। আবার তিব্বত বিজয় করতে পারলে ইখতিয়ার উদ্দিন কামরূপকে স্বাধীন রাখতে চাইবেন, এমন আশাও তিনি করেননি। তিনি ইখতিয়ার উদ্দিনের মৈত্রী প্রস্তাবে রাজি হলেন, মিলিত সামরিক অভিযানের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন কিন্তু গোপনে তিব্বতের সীমান্তবর্তী উপজাতিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে লখনৌতির সীমান্ত পার হলেন। আজকের গুয়াহাটি শহরের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর একটি পাথরের সেতু দিয়ে তাঁর বাহিনী কামরূপ রাজ্যের ভেতর ঢুকে পড়ল। রাজা পৃথুর দূত এসে ইখতিয়ার উদ্দিনকে জানালেন, কামরূপ রাজা নানা অসুবিধার কারণে এ বছর অভিযানে যোগ দিতে পারছেন না। ইখতিয়ার উদ্দিন এক বছর অপেক্ষা করতে রাজি থাকলে তিনি পরের বছর মিলিত অভিযানে যেতে চান।

ইখতিয়ার উদ্দিন কামরূপ-রাজের ভীরুতা দেখে খুব বিরক্ত হলেন। তিনি ঠিক করলেন, পথপ্রদর্শকের সাহায্য নিয়ে এককভাবেই তিব্বত আক্রমণ করবেন। কামরূপ-রাজের লোকেরা পথ দেখিয়ে রাঙ্গিয়া হয়ে আজকের সিকিম-ভুটান সীমান্ত এলাকার গিরিপথ দিয়ে তাঁদের নিয়ে গেল তিব্বতের চুম্বি উপত্যকায়। চুম্বি উপত্যকায় তিব্বতের সীমান্তরক্ষীরা তৈরি ছিল। ইখতিয়ার উদ্দিনের বাহিনী প্রথম যে দুর্গটি আক্রমণ করল, সেখানে তিব্বতি তিরন্দাজ আর বর্শাধারীদের আক্রমণে ইখতিয়ার উদ্দিনের বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো। অনেক প্রাণের বিনিময়ে দুর্গ জয় করার পর বন্দী তিব্বতি সৈন্যদের কাছ থেকে জানা গেল, আরেকটি দুর্গে পঞ্চাশ হাজার তিব্বতি সৈন্য ইখতিয়ার উদ্দিনের বাহিনীর অপেক্ষা করছে।

ইখতিয়ার উদ্দিন প্রথম দিনের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে দমে গিয়েছিলেন। তিনি পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যে রাস্তায় গিয়েছেন, সে রাস্তায় পিছিয়ে আসতে গিয়ে দেখলেন, কামরূপ রাজা পৃথু কৌশলে শত্রুবধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে রাজা পৃথু ফেরার পথে পানি এবং খাবারের সম্ভাব্য সব উৎস ধ্বংস করে দিয়েছেন। গ্রামবাসী গ্রামগুলো থেকে সরে গিয়েছে। পনেরো দিনের যাত্রায় ইখতিয়ার উদ্দিনের বাহিনী কোথাও খাবার বা পানি পেল না। উপায়ান্তর না দেখে সৈন্যরা নিজেদের ঘোড়া জবাই করে খিদে মেটাতে বাধ্য হলো। রোগে ভুগে, অনাহারে, পানির অভাবে কিছু সৈন্য মারা পড়ল।

ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তিতে আধমরা অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে পাথরের সেতুর কাছে এসে দেখলেন, কামরূপ-রাজ সেতু ধ্বংস করে দিয়েছেন। সেতু পাহারায় রেখে যাওয়া তাঁর নিজের সৈন্যরা অন্তঃকোন্দলের কারণে দায়িত্বে অবহেলা করে সেতুকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে লখনৌতি রাজ্যে ফিরে গিয়েছে। শত্রুকে বাগে পেয়ে কামরূপ-রাজ সব শক্তি নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিনের বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কামরূপের সৈন্যদের হাতে কিংবা সাঁতরে ব্রহ্মপুত্র পার হতে গিয়ে বেশির ভাগ সৈন্য মারা পড়ল। মাত্র এক-দেড় শ সৈন্য নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে নতুন রাজধানী দেবকোটে এসে আশ্রয় নিলেন।

বহু বিজয়ের গৌরব ভোগ করা ইখতিয়ার উদ্দিন এই নিদারুণ পরাজয়ের গ্লানিতে খুব আহত হয়েছিলেন। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি বাড়ি থেকে বের হলেই নিহত সৈন্যের হাজার হাজার বিধবা স্ত্রী আর এতিম সন্তান দূর থেকে তাঁকে অভিশাপ দিত। ভঙ্গুর মানসিক অবস্থায় ইখতিয়ার উদ্দিন এই চাপ সামলাতে পারলেন না। তিনি শয্যাশায়ী হলেন। তাঁরই বাহিনীর এক ক্ষুব্ধ সহযোদ্ধা আলী মর্দান খলজি অসুস্থ অবস্থায় ছোরা মেরে তাঁকে হত্যা করল।

ইখতিয়ার উদ্দিন তিব্বত জয় করতে পারেননি। লখনৌতি নামের যে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, তা-ও তাঁর উত্তরসূরিদের অন্তঃকলহে দুর্বল হয়ে যায়। ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশের বাহিনী খলজিদের শেষ উত্তরসূরি গিয়াস-উদ-দিন ইওজ খলজিকে হত্যা করে লখনৌতিকে দিল্লি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।

কিন্তু তাঁর দুটি কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে গেছে।

বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের যে কাজ তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন; তা চলতে থাকে, ক্রমেই তার গতি বাড়তে থাকে। তাঁর অভিযানের ৭০০ বছর পর ব্রিটিশ সরকার আদমশুমারি করে দেখতে পায় পুরো বাংলা প্রদেশে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত বাংলার যে দুই অংশকে আমরা আজ দেখি, তার রাজনৈতিক ভিত্তি ইখতিয়ার উদ্দিন স্থাপন করে গেছেন।

দ্বিতীয়ত, দিল্লির সেনাপতি বা সুলতানের সাহায্য না নিয়েই ইখতিয়ার উদ্দিনের লখনৌতি জয় এই অঞ্চলের পরবর্তী সব শাসকের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁরা সবাই ভাবতে শুরু করেন, দিল্লির কর্তৃত্বের বাইরে বাংলায় একটি স্বাধীন সালতানাত পরিচালনা করা অসম্ভব নয়। এর মধ্যে দিয়ে বাংলার রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের যে বীজ বপন হয়ে যায়, সে বীজকে দিল্লির পাঠান-মোগল শাসন, ব্রিটিশ শাসন, দিল্লির ভারত সরকার কিংবা ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির পাকিস্তান সরকার উৎপাটন করতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই তার অকাট্য প্রমাণ।

হেলমন্দ নদীর ধার থেকে উঠে আসা এই তরুণ তুর্কি মাত্র তিন বছরের শাসনে বাংলার ইতিহাসে তাঁর অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছেন।

অধ্যায় ১ / ১৭

সকল অধ্যায়

১. তরুণ তুর্কি : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি
২. পূর্ব সীমান্তের নকশাকার : ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ
৩. বাঙ্গালার জন্ম : শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ
৪. আবেগপ্রবণ শাসক : গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ
৫. নিঃসঙ্গ যোদ্ধা : রাজা গণেশ
৬. বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক : রুকনউদ্দিন বারবক শাহ
৭. দলিতের উত্থান : মালিক আন্দিল ও বিশ্বম্ভর মিশ্র
৮. স্থিতধী : আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
৯. সম্রাটদের সাক্ষাৎ : শেরশাহ ও নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন
১০. সিংহ-পরিবার : মসনদ-এ-আলা ঈসা খাঁ, স্বর্ণময়ী, মুসা খাঁ
১১. প্রতিরোধের শেষ : প্রতাপাদিত্য
১২. চিরদুঃখীজন : শায়েস্তা খান
১৩. প্রথম নবাব : মুর্শিদ কুলি খান
১৪. সুযোগসন্ধানী : আলিবর্দি খান
১৫. হতভাগ্য : সিরাজ-উদ-দৌলা
১৬. যুগসন্ধির লড়াই : মির কাসিম
১৭. পরিশিষ্ট এবং গ্রন্থপঞ্জি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন