প্রথম নবাব : মুর্শিদ কুলি খান

১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মানো যে ছেলের নাম সূর্য নারায়ণ মিশ্র রাখা হয়েছিল, কেউ ভাবতেও পারেনি সে একদিন বাংলার নবাব হয়ে বসবে। কিন্তু বাস্তব কখনো কখনো উপন্যাসকে হার মানায়।

অভাবের তাড়নায় কিংবা ছেলেধরাদের হাতে অপহৃত হয়ে সূর্য নারায়ণকে দশ বছর বয়সে দাস-বাজারে বিক্রি হয়ে যেতে হয়। সূর্য নারায়ণের ভাগ্য মন্দের ভালো, তাঁকে কিনে নিলেন মোগল সম্রাটের এই ইরানি সভাসদ হাজি শফি ইস্পাহানি। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করলেন, সূর্য ধীমান, বিশেষ করে হিসাবের মাথা তাঁর খুব ভালো। হাজি শফি সূর্যকে পালিত পুত্রের মর্যাদা দিয়ে তাঁকে ইসলাম ধর্মের শিয়া মতে দীক্ষিত করলেন, নাম রাখলেন মুহাম্মদ হাদি। পরের কুড়ি বছর মুহাম্মদ হাদি মন দিয়ে পড়াশোনা করলেন, হাজি শফির কাছে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কাজে তালিম নিলেন। হাজি শফি মুহাম্মদ হাদিকে আরেক ইরানি সভাসদের মেয়ে নাসিরি বানু বেগমের সঙ্গে বিয়ে দেন। শোনা যায়, মুহাম্মদ হাদি, পরবর্তীকালে মোগল সম্রাটের দেওয়া উপাধি অনুযায়ী যাঁর নাম হবে মুর্শিদ কুলি খান, তিনি জীবনে কখনো অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করেননি বা উপপত্নী হিসেবে রাখেননি। সে যুগে এটা একটা বিরল ঘটনা।

হাজি শফির বয়স হয়েছিল। ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মোগল দরবারের কাজে ইস্তফা দিয়ে ইরানের ইস্পাহানে গেলেন। মুহাম্মদ হাদিকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। কিন্তু পারস্যে মুহাম্মদ হাদির মন টেকেনি। ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শফির মৃত্যুর পর তিনি ভারতে ফিরে এসে দাক্ষিণাত্যের বেরার প্রদেশের দেওয়ান আবদুল্লাহ খোরাসানির দপ্তরে কাজ নিলেন। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর হারিয়ে যাওয়া পরিবারের লোকজনকে খুঁজে বের করবেন। সে আশা পূরণ হয়নি। তবে এখানে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কাজে বিপুল দক্ষতা দেখিয়ে মুহাম্মদ হাদি সম্রাট আওরঙ্গজেবের চোখে পড়ে গেলেন। সম্রাটের আদেশে মুহাম্মদ হাদিকে সহকারী দেওয়ানের পদে বসানো হলো। তাঁর উপাধি হলো কারতলব খান। দেখা গেল তিনি শুধু হিসেবে পটু নন, মানুষ হিসেবেও সৎ ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। দ্রুতই তিনি আওরঙ্গজেবের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠলেন। আওরঙ্গজেব কারতলব খানকে সুবা বাংলার দেওয়ান হিসেবে কাজে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

১৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দে আওরঙ্গজেব তাঁর নাতি আজিম-উস-শানকে বাংলা, বিহার আর ওড়িশার সুবাদার করে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় ছেলের নাম মুয়াজ্জম। আজিম-উস-শান এই মুয়াজ্জমের দ্বিতীয় ছেলে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের বয়স তখন প্রায় ৮০ বছর। আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মুহাম্মদ সুলতান বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বন্দী অবস্থায় সালিমগড় কারাগারে মারা যান। জীবিত চার শাহজাদার প্রত্যেকেই তখন সিংহাসনের স্বপ্ন দেখছেন। বড় ছেলের অবর্তমানে মেজ ছেলে মুয়াজ্জম সিংহাসনের জোর দাবিদার, কিন্তু তাঁর আগে দুই প্রজন্ম ধরে মোগল সিংহাসনে বড় ছেলেরা বসতে পারেননি (খসরু আর দারাশিকো যথাক্রমে শাহজাহান আর আওরঙ্গজেবের হাতে মারা পড়েছেন)। শাহজাদা আজম, শাহজাদা আকবর আর শাহজাদা কামবখশ প্রত্যেকেই উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের গোপন প্রস্তুতি শুরু নিচ্ছিলেন। বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবাদার হওয়ার পর থেকে এই যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আজিম-উস-শানও নিজের কোষাগার ভরাতে শুরু করেছিলেন। তিনি জানতেন সিংহাসনের লড়াইয়ে বাবা মুয়াজ্জমকে সাহায্য করলে পরবর্তীকালে তাঁর নিজের সম্রাট হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।

আজিম-উস-শানের আগের সুবাদার ইব্রাহিম খান বাংলায় ব্যবসা করা ইংরেজ, ফরাসি, ডাচদের কাছ থেকে উপহার-উপঢৌকন নেওয়া শুরু করেছিলেন। আজিম-উস-শান সুবিধাজনক বিবেচনা করে সেই প্ৰথাই চালু রেখেছিলেন। তাঁর অনুমতিক্রমেই ইংরেজরা কলকাতায় (ফোর্ট উইলিয়াম), ওলন্দাজরা চুঁচুড়ায় আর ফরাসিরা চন্দননগরে দুর্গ স্থাপন করে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের গুপ্তচর সে খবর সম্রাটকে পাঠাল। সম্রাট আওরঙ্গজেব ভেবে দেখলেন, সৎ ও অনমনীয় কারতলব খানকে আজিম-উস-শানের পাহারায় রাখলে রাজস্ব আদায় বাড়বে, গৃহবিবাদের আশঙ্কাও কমবে।

কারতলব খান সম্রাটের আদেশ নিয়ে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখামাত্র আজিম-উস-শান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি মোগল সৈন্যদের উসকানি দিয়ে কারতলব খানকে খুন করানোর চেষ্টাও করলেন, সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। উদ্বিগ্ন কারতলব খান সম্রাট আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপ কামনা করলেন। আওরঙ্গজেব নাতিকে কঠোর হুমকি দিয়ে বললেন, কারতলব খানের কোনো ক্ষতি হলে সম্রাট নিজে আজিম-উস-শানকে তার মূল্য দিতে বাধ্য করবেন। হতাশ আজিম-উস-শান ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে প্রথমে গৌড়ের কাছে রাজমহলে, পরে বিহারের পাটনায় নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি নিজের নামে পাটনার নতুন নাম রাখলেন আজিমাবাদ।

মাথার ওপর থেকে আজিম-উস-শানের অপচ্ছায়া সরে যাওয়ার পর কারতলব খান রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও জমিদারি বণ্টনে বিপুল সাফল্য পেলেন। কিন্তু ঢাকায় মোগল সৈন্যের একাংশ তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেনি। কারতলব খানও ঢাকা থেকে সরতে চাইলেন। তিনি দেখলেন, বাংলায় নৌবাণিজ্য, বিশেষ করে বিদেশি বণিকদের নৌবাণিজ্যের পরিমাণ বিপুল হারে বাড়ছে। এই নৌবাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে ঢাকার চেয়েও সুবিধা হয় গঙ্গা বা হুগলি নদীর তীরের কোনো এলাকায় থাকলে। সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে মুখসুদাবাদ নামের যে এলাকার ফৌজদারের দায়িত্ব দেওয়ানের দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে অর্পণ করেছেন, সেই মুখসুদাবাদ ভাগীরথীর তীরে (হুগলি নদীর উত্তর অংশের নামই ছিল ভাগীরথী)। কারতলব খান দেওয়ানখানা (দেওয়ানের দপ্তর) ঢাকা থেকে সরিয়ে মুখসুদাবাদে নিয়ে গেলেন। মোগল রাজস্ব আদায় ও কোষাগারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই ঢাকার বাস গুটিয়ে তাঁর সঙ্গে মুখসুদাবাদ যেতে হলো। ঢাকার কিছু বড় ব্যবসায়ী ও কারতলব খানের কাছাকাছি থাকার আশায় নিজেদের ঢাকার ব্যবসা তুলে নিয়ে গিয়ে মুখসুদাবাদে বসালেন।

কারতলব খান পুরোনো মোগলপ্রথা জায়গিরদারির বদলে মাল-জসমানি প্রথা চালু করেন। এই প্রথা অনুযায়ী পরগনার বন্দোবস্ত নিতে ভূম্যধিকারীদের দেওয়ানখানায় আগেই টাকা বা সম্পদ জমা রাখতে হতো। এই ব্যবস্থা থেকেই বাংলায় জমিদারিপ্রথা চালু হয়।

নতুন ব্যবস্থার আওতায় মুখসুদাবাদের দেওয়ানখানায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে কারতলব খান সেটা বিজাপুরে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে দিয়ে এলেন। আগের চেয়ে বেশি রাজস্ব পেয়ে খুশি হয়ে সম্রাট কারতলব খানকে নতুন উপাধি দিলেন—মুর্শিদ কুলি জাফর খান। তাঁকে বাংলা ও ওড়িশা—দুই সুবার দেওয়ান পদের দায়িত্ব দিলেন। মুখসুদাবাদ শহরের নাম মুর্শিদ কুলি জাফর খানের নিজের নামে রাখার অনুমতিও দিলেন।

সম্রাটের দেওয়া সম্মানে অভিভূত মুর্শিদ কুলি জাফর খান মুখসুদাবাদে ফিরে এসে দ্রুত প্রাসাদ, মসজিদ, সরাইখানা তৈরি করে ছোট্ট মুখসুদাবাদকে বড় শহরে পরিণত করলেন। নিজের নতুন উপাধির নামেই শহরের নাম রাখলেন মুর্শিদাবাদ।

বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসের শেষ রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত হতে শুরু করল।

মুর্শিদ কুলি খান তিন বছর মুখসুদাবাদে শান্তিতে রাজস্ব আদায়ের কাজ চালিয়ে গেছেন। সুবাদার আজিম-উস-শানের অনুপস্থিতিতে কার্যত তিনিই ছিলেন বাংলা-ওড়িশার সুবাদার। কিন্তু ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হলো। আজিম-উস-শান বাংলার রাজস্ব লুট করে ১১ কোটি টাকা নিয়ে তাঁর বাবা শাহজাদা মুয়াজ্জমের বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করলেন। তত দিনে শাহজাদা আকবর পারস্যে নির্বাসিত অবস্থায় মারা গেছেন, সিংহাসনের লড়াইটা হলো শাহজাদা মুয়াজ্জম, শাহজাদা আজম আর শাহজাদা কামবখশের মধ্যে। জাজাউয়ের যুদ্ধে শাহজাদা আজম পরাজিত ও নিহত হলেন। শাহজাদা মুয়াজ্জম এরপর কামবখশকে পরাজিত ও নিহত করলেন, সম্রাট বাহাদুর শাহ নামে মোগল সিংহাসনে বসলেন।

আজিম-উস-শান তখন নিজেই শাহজাদা, সিংহাসনের লড়াইয়ে বীরত্ব দেখিয়ে বাবা সম্রাট বাহাদুর শাহকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। তিনি আবদার করলেন, মুর্শিদ কুলি খানকে বাংলা থেকে সরাতে হবে। সম্রাট বাহাদুর শাহ সঙ্গে সঙ্গে এই অনুরোধ মঞ্জুর করলেন।

মুর্শিদ কুলি খান বিনা প্রতিবাদে সম্রাটের হুকুম মেনে নিয়ে নবনিযুক্ত দেওয়ান জিয়াউল্লাহর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। নিজের হাতে গড়া মুর্শিদাবাদ ফেলে ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে গিয়ে দেওয়ান হিসেবে কাজ করতে লাগলেন। কিন্তু নিয়তি বড় বিচিত্র। আজিম-উস-শান মুর্শিদ কুলি খানকে বাংলা থেকে অপসারণ করে বুঝলেন, কাজটা করে তাঁর অহম তৃপ্ত হলেও আসলে লাভ হয়নি। প্রভাবশালী শাহজাদা হিসেবে তাঁকে দিল্লি-আগ্রায় থাকতে হচ্ছে, তিনি বাংলা-ওড়িশার রাজস্ব আদায় তদারক করতে পারছেন না। মোগল সাম্রাজ্যের আয় কমে যাচ্ছে। আয়-ব্যয় সমন্বয় করতে না পেরে নতুন দেওয়ান জিয়াউল্লাহ অভ্যুত্থানের মুখে পড়লেন, বিদ্রোহী সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করল। আজিম-উস-শান অনন্যোপায় হয়ে আবার বাবাকে অনুরোধ করলেন মুর্শিদ কুলি খানকে বাংলা-ওড়িশার দেওয়ান পদে বহাল করতে।

সম্রাট বাহাদুর শাহ অনুরোধ রাখলেন। মুর্শিদ কুলি খান খুশি মনে মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন, কিন্তু আজিম-উস-শানের ওপর খুব যে খুশি হতে পারলেন তা মনে হয় না।

১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট বাহাদুর শাহ লাহোরে মারা গেলেন। মোগল সিংহাসন নিয়ে আরও একবার ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হলো। আজিম-উস-শান মৃত্যুর সময়ে বাবার কাছেই ছিলেন, তিনিই সিংহাসনে বসে নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিলেন। এতে তাঁর ভাইয়েরা জোট বেঁধে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ করল। অমাত্যদের বিশ্বাসঘাতকতা ও নিজের কূটনৈতিক জ্ঞানের অভাবে আজিম-উস-শান সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও যুদ্ধে হেরে গেলেন। একটা কামানের গোলা তাঁর হাতির ওপর এসে পড়ে ইরাবতী নদীর পানিতে তাঁর অন্তিম শয়ান নিশ্চিত করল। শাহজাদা মুইজউদ্দিন জাহান্দর শাহ নাম নিয়ে মোগল সিংহাসনে বসলেন।

আজিম-উস-শানের সব ছেলেকেই সম্রাট জাহান্দর শাহ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, কিন্তু ফররুখসিয়ার নামে তাঁর এক ছেলে বাংলায় অবস্থান করছিলেন বলে তাঁকে হাতের নাগালে পাননি। ফররুখসিয়ার মুর্শিদ কুলি খানের কাছে গেলেন, তিনি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চান। মুর্শিদ কুলি খান বরাবর মোগল সম্রাটের অনুগত কর্মচারী, সে সম্রাট যে-ই হোন না কেন। তিনি ফররুখসিয়ারকে সাহায্য করলেন না।

ফররুখসিয়ার পালিয়ে বিহারে চলে গেলেন। বিহারের সুবাদার সৈয়দ হুসেন আলী আজিম-উস-শানের প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি ফররুখসিয়ারকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। ফররুখসিয়ার সসৈন্যে দিল্লির দিকে যাত্রা করলেন। যাওয়ার আগে রশিদ খান নামের এক সেনাপতিকে মুর্শিদাবাদে পাঠালেন মুর্শিদ কুলি খানকে অপসারণ করার জন্য।

রশিদ খান মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে মুর্শিদ কুলি খানের সেনাপতি মির বাঙালিকে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে মুর্শিদ কুলি খান নিজেই যুদ্ধ করতে আসেন। রশিদ খান ভেবেছিলেন, রাজস্ব আদায়ে সারা জীবন ব্যস্ত থাকা মুর্শিদ কুলি খান যুদ্ধের কিছুই জানেন না। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে মুর্শিদ কুলি বিপুল সাহস ও বীরত্ব দেখালেন। তাঁর সাহস দেখে উজ্জীবিত হয়ে মুর্শিদাবাদের সৈন্যরা আক্রমণকারী বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রশিদ খান মুর্শিদাবাদ জয়ের আশা হারালেন, তিরের আঘাতে তাঁকে প্রাণের মায়াও ছাড়তে হলো।

ফররুখসিয়ার কিন্তু সব বাধাবিপত্তি পার হয়ে জাহান্দর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সমর্থ হলেন। ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে আগ্রার কাছে সামুগড়ের যুদ্ধে তিনিই জিতলেন এবং জাহান্দর শাহকে হত্যা করে বাবার হত্যার বদলা নিলেন সম্রাট হওয়ার পর ফররুখসিয়ার আর মুর্শিদ কুলি খানকে অপসারণের চেষ্টা করেননি। তিনি জানতেন, সম্রাটের অনুগত মুর্শিদ কুলি খান এখন তাঁকেই সাহায্য করবেন। ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনিই মুর্শিদ কুলি খানকে বাংলার নাজিম পদে পদোন্নতি দেন।

রাজস্ব আদায়ে সততা ও ন্যায়বিচারের জন্য মুর্শিদ কুলি খানের সুনাম ছিল। খাজনাখেলাপি মুসলমান জমিদারের বদলে হিন্দু জমিদারকে বসাতে, কিংবা খাজনাখেলাপি হিন্দু জমিদারের বদলে মুসলমান জমিদার বসাতে তিনি দ্বিধা করেননি। মুর্শিদ কুলি খানের সময়ে বহু হিন্দু জমিদার তাঁদের জমিদারি সম্প্রসারণ করেছিলেন। তবে মোগল সম্রাটকে খুশি রাখার জন্য বছর বছর খাজনার পরিমাণ বাড়াতে গিয়ে মুর্শিদ কুলি খানের কর্মচারী নাজির আহমদ ও নাতজামাই রেজা আলী খান জমিদারদের প্রতিনিধিদের ভীষণ অত্যাচার করতে থাকেন। এতে মুর্শিদ কুলি খানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছিল।

খাজনা আদায়ে মুর্শিদ কুলি খানের যতই উৎসাহ থাকুক, তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণে সাহায্য করেননি। বরং অনেক টাকার লোভ উপেক্ষা করেই কলকাতার আশপাশে কোম্পানিকে তিনি নতুন গ্রাম কেনার অনুমতি দেননি। ইউরোপীয় বণিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ধরন তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন।

১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে এককালের বিশ্বস্ত অমাত্যরা সম্রাট ফররুখসিয়ারকে খুন করল। সে বছর আরও দুজন মোগল সম্রাট অল্পকাল রাজত্ব করে যক্ষ্মারোগে মারা পড়লেন। তারপর সম্রাট মুহাম্মদ শাহ সিংহাসনে বসে ফররুখসিয়ারের বিশ্বাসঘাতক অমাত্যদের হত্যা করেন। কিন্তু তাঁর আমলেই বিভিন্ন প্রদেশের ওপর মোগল কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। একের পর এক ভ্রাতৃঘাতী লড়াই আর অমাত্যদের বারবার পক্ষবদলের কারণে মোগল সাম্রাজ্য ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এখান থেকেই তার পতনের শুরু।

মোগল কর্তৃত্বের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে মুর্শিদ কুলি খান নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা করেন। মুর্শিদ কুলি খানের ছেলে অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, মোগল সম্রাটের অনুমতি নিয়ে মেয়ে আজিমুন্নিসা বেগমের সন্তান সরফরাজ খানকে বাংলার নবাব করে রেখে যাবেন, নাতির পর নাতির উত্তরাধিকারীরা বংশানুক্রমে বাংলার নবাব হবে। তাই নিজেকে নবাব ঘোষণার পরও তিনি নিয়মিত মোগল সম্রাটকে খাজনা পাঠাতেন। এ নিয়ে মুর্শিদাবাদের কর্মকর্তারা আপত্তি করলে তিনি বলতেন, ‘আমরা টাকা না পাঠালে দিল্লির দরবারের খরচ উঠবে কী করে?

মুর্শিদ কুলি খান নিজেকে নবাব ঘোষণার পর তাঁর কানুনগো দর্পনারায়ণকে অতীত অপরাধের শাস্তি দিতে কারাগারে আটকে রেখেছিলেন, দর্পনারায়ণ কারাগারেই মারা যান। নির্বিকার মুর্শিদ কুলি দর্পনারায়ণের ছেলে শিবনারায়ণকে ডেকে কানুনগো পদে নিয়োগ করেন। কারণ, তাঁর বিবেচনায় দর্পনারায়ণের পর শিবনারায়ণই কানুনগো পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।

নবাব হয়েও মুর্শিদ কুলি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। মুর্শিদাবাদে তাঁর প্রাসাদ, দরবার, নহবতখানায় সৌন্দর্যের ছোঁয়া ছিল, বিশালত্ব বা খুব বেশি জাঁকজমক ছিল না। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি তাঁর কর্মচারী মুরাদ ফরাসকে আদেশ করেন একটি মসজিদ ও সংলগ্ন কাটরা (সরাইখানা) বানাতে, যে মসজিদের সিঁড়ির নিচে তাঁর কবর হবে।

১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মুর্শিদ কুলি খান মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর নাতি সরফরাজ খান অল্পকালের জন্য নবাবের সিংহাসনে বসেছিলেন, কিন্তু সে সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে পারেননি।

মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যুর পরই বাংলা আর ভারতের স্বাধীনতার অন্তিম ক্ষণ ঘনিয়ে আসতে শুরু করে।

প্রকৃত অর্থে বীর যোদ্ধা না হয়েও, কেবল হিসেবি মনোভাব, বিচারবুদ্ধি আর ধৈর্য সম্বল করে মুর্শিদ কুলি খান বাংলার প্রথম নবাব হয়েছিলেন। অচিরেই যে বৈশ্য যুগ আসতে যাচ্ছে, মুর্শিদ কুলি খানের উত্থানের মধ্য দিয়ে সেই অনাগত দিনের পায়ের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তখনো কেউ তা বুঝতে পারেনি।

সকল অধ্যায়

১. তরুণ তুর্কি : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি
২. পূর্ব সীমান্তের নকশাকার : ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ
৩. বাঙ্গালার জন্ম : শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ
৪. আবেগপ্রবণ শাসক : গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ
৫. নিঃসঙ্গ যোদ্ধা : রাজা গণেশ
৬. বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক : রুকনউদ্দিন বারবক শাহ
৭. দলিতের উত্থান : মালিক আন্দিল ও বিশ্বম্ভর মিশ্র
৮. স্থিতধী : আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
৯. সম্রাটদের সাক্ষাৎ : শেরশাহ ও নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন
১০. সিংহ-পরিবার : মসনদ-এ-আলা ঈসা খাঁ, স্বর্ণময়ী, মুসা খাঁ
১১. প্রতিরোধের শেষ : প্রতাপাদিত্য
১২. চিরদুঃখীজন : শায়েস্তা খান
১৩. প্রথম নবাব : মুর্শিদ কুলি খান
১৪. সুযোগসন্ধানী : আলিবর্দি খান
১৫. হতভাগ্য : সিরাজ-উদ-দৌলা
১৬. যুগসন্ধির লড়াই : মির কাসিম
১৭. পরিশিষ্ট এবং গ্রন্থপঞ্জি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন