নসরত শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। ইনি দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ, প্রথম আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহের ছেলে। দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ মাত্র এক বছর রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। তাঁরই আদেশে দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। নসরত শাহের আমলে বাংলার সুলতানের সঙ্গে অহোমরাজ সুহুংমংয়ের যুদ্ধ চলছিল। আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সে যুদ্ধ চালাতে থাকেন। কিন্তু তাঁর শত্রু সীমান্তের ওপারে ছিল না, ছিল তাঁর বাড়ির কাছেই। তাঁর চাচা, নসরত শাহের ভাই ও আলাউদ্দিন হোসেন শাহের ছেলে আবদুল বদর ষড়যন্ত্র করছিলেন। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করে তিনি গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ নামে ক্ষমতা দখল করেন। তিনিই প্রথম বাংলায় পর্তুগিজদের ঘাঁটি গড়ার অনুমতি দেন এবং নিজের সেনাবাহিনীতে পর্তুগিজ সৈনিকদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ চেষ্টা করেছিলেন আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের আত্মীয়দের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে। ফলে আলাউদ্দিনের বোনের স্বামী মখদুম-ই-আলম, যিনি ত্রিহুতের শাসনকর্তা ছিলেন, তিনি শঙ্কিত হয়ে তাঁর আফগান বন্ধুদের সাহায্য চাইলেন। এই বন্ধুদের একজন ছিলেন শের খান।
দাবার ছকের মতো ইতিহাসের খেলাতেও বোড়ে কখনো কখনো সামনে এগিয়ে যেতে যেতে শেষ ঘরে গিয়ে মন্ত্রী হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এই বিশেষ মুহূর্তে শের খান বোড়ে হিসেবে সপ্তম ঘরে ছিলেন। তাঁর বয়স তখন ৪৭ বছর।
শের খানের বাবা হাসান খান সূরি আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসে দিল্লির সুলতান বাহলুল খান লোদির আনুকূল্য পেয়েছিলেন, তাঁকে বিহারের সাসারাম, খাবাসপুর আর তান্ডা পরগনা তিনটির জমিদারি দেওয়া হয়েছিল। কিশোর বয়সেই শের খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখে বোঝা গেল, বাবার তিনটি পরগনার জমিদারি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মানুষ তিনি নন। বাবার জমিদারিতেই তিনি নিজের একটি ছোট সৈন্যদল গড়ে তুললেন। বাবা হাসান খান যখন মারা গেলেন, তত দিন শের খান বিহারের শাসনকর্তা বাহার খান লোহানির সেনাদলে অধিনায়ক হিসেবে কাজ করছেন। একবার শিকারে গিয়ে বাহার খান লোহানির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়া একটা বাঘকে একাই হত্যা করে শের খান তাঁর নামের ‘শের’ অংশটুকু লাভ করেন, তার আগে সবাই তাঁকে ফরিদ খান সূরি নামেই চিনত।
কিন্তু লোহানিদের দীর্ঘদিন সেবা করার পরও শের খান রাজনীতির কূটচালে পড়ে গেলেন। বাহার খানের মৃত্যুর পর নতুন শাসনকর্তা সুলতান মহম্মদ শের খানের বাবার জমিদারি ভাগ করে দিলেন তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে। ক্ষুব্ধ শের খান ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট বাবরের কাছে আশ্রয় নিতে গেলেন। শের খানের দুঃসাহস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাবরের চোখ এড়ায়নি। তিনি চেয়েছিলেন শের খানকে বন্দী করে রাখতে। কিন্তু অন্য সভাসদদের পরামর্শে তাঁকে গ্রেপ্তার করেননি। অবস্থা বেগতিক দেখে শের খান বাবরের অনুমতি নিয়ে নিজের জমিদারিতে ফিরে গেলেন, দুই ভাইকে উৎখাত করে জমিদারির অধিকার ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু মোগল সম্রাটের দরবারের কাজকর্ম দেখে তাঁর এই প্রতীতি জন্মেছিল যে, ভারতে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা আফগানদের একত্র করে তিনি অনায়াসেই মোগলদের সাম্রাজ্য থেকে উৎখাত করতে পারবেন। তাঁর মুখে এই কথা শুনে মোগল তো বটেই, আফগানরাও বিদ্রূপ করে।
জমিদার হিসেবে শের খান মোগল বাহিনীর বিহার অভিযানে সাহায্য করে সম্পদ আর ক্ষমতা দুটোই বাড়িয়েছিলেন। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মোগল সম্রাটের হয়ে বিহারের অল্পবয়সী শাসনকর্তা জালাল খান লোহানির অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই সময়েই বাংলার সুলতানের প্রতিনিধি ও হাজিপুরের শাসনকর্তা মখদুম-ই-আলমের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নতুন সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ যখন মখদুম-ই-আলমকে অপসারণের জন্য কুতব খানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠালেন, বন্ধুকে বাঁচাতে শের খান বাংলার সুলতানের কাছে অনুরোধ করেন সৈন্যবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। সে অনুরোধ বাংলার সুলতান গ্রাহ্য করেননি। বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শের খান তাঁর সেনাদল নিয়ে কুতব খানের সঙ্গে যুদ্ধে নামলেন। কুতব খান পরাজিত ও নিহত হলেন। বাংলার সুলতানের বহু হাতি-ঘোড়া শের খানের দখলে এল, তাঁর শক্তি আরও বাড়ল।
বাংলার সুলতান এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। তিনি আরও বড় সেনাদল পাঠালেন। শের খান বন্ধু মখদুম-ই-আলমকে আবার সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোহানিরা এবার শের খানকে বাধা দিলেন। শের খান গোপনে মখদুম-ই-আলমকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু সে সাহায্য যথেষ্ট ছিল না। বাংলার সুলতানের বাহিনী মখদুম-ই-আলমকে পরাজিত করে হত্যা করল। মখদুম-ই-আলম পরাজয়ের কথা আগেই আঁচ করে তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ শের খানের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। এবার শের খানের সম্পদের পরিমাণও অনেক বাড়ল।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী শের খান সম্পদ ও সৈন্যসংখ্যা বাড়ার পর লোহানিদের কর্তৃত্ব মানতে খোলাখুলি অস্বীকার করলেন। ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে জালাল খান লোহানি ভয়ে বাংলার সুলতানের কাছে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সুলতান মাহমুদ শাহ সেনাপতি ইব্রাহিম খানের নেতৃত্বে (ইনি কুতব খানের ছেলে) বিশাল এক সেনাদল পাঠালেন। শের খান নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে ইব্রাহিম খানের মুখোমুখি হলেন। ইব্রাহিম খান শের খানকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলেন, তাঁকে ঘেরাও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু কূটনৈতিক চাতুর্য আর রণকৌশল ব্যবহার করে শের খান নিশ্চিত পরাজয় থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন। ইব্রাহিম খান পরাজিত ও নিহত হলেন। এবার বিস্তর হাতি-ঘোড়ার সঙ্গে শের খানের দখলে এল ভারী কিছু কামান।
শের খান নিজেই বাংলা আক্রমণ করতে চললেন। বিপদ বুঝে সুলতান মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের সাহায্য কামনা করলেন। সুলতানের সৈন্য ও পর্তুগিজরা তেলিয়াগড়ি (এখন সাহেবগঞ্জ, সাঁওতাল পরগনা) আর সিক্রিগলি (এখন মহারাজপুর, সাঁওতাল পরগনা) সীমান্ত ঘাঁটিতে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেও শের খানের কাছে হার মানল। শের খান গৌড়ের কাছে এসে হাজির হলেন।
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ যদি ইলিয়াস শাহ বা সিকান্দর শাহের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একডালা দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিতেন, কিংবা গৌড়েই শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন, তা হলে হয় তো শের খানকে পিছু হটতে হতো। বর্ষা আসতে আর বেশি বাকি ছিল না, গঙ্গা নদীতে বাংলার সুলতানের নৌবহর টহলও দিচ্ছিল। কিন্তু ভীত সুলতান সেই পথে না গিয়ে শের খানকে তেরো লাখ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ফেরত পাঠালেন। শের খান স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বিহারে ফেরত গেলেন এবং নিজের সেনাদলকে আরও শক্তিশালী করে পরবর্তী সময়ে বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর ছেলে জালাল খান আর সেনাপতি খাওয়াস খানকে বাংলা অভিযানে পাঠালেন। এবার আর সন্ধি হলো না। জালাল খান গৌড় আক্রমণ করে দখল করে নিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পালালেও তাঁর দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হলো। শের খানের বাহিনী গৌড় থেকে ছয় কোটি স্বর্ণমুদ্ৰা লুট করল।
জালাল খান মাহমুদ শাহকে কেন গ্রেপ্তার করতে পারেননি, সেটা একটা রহস্য। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ দক্ষিণে সাতগাঁও বা পুবে সুবর্ণগ্রামের দিকে না গিয়ে গিয়েছিলেন উত্তর-পশ্চিমে, শের খানের বাড়ির প্রায় পাশ দিয়ে, মনেরে (পাটনার কাছেই, গঙ্গার ধারে)। তিনি গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন সেই সময় ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাবান পুরুষ মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের কাছে।
১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে ২২ বছর বয়সে হুমায়ুনের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে বাবর মারা যাওয়ায় হুমায়ুন তাঁর বাবার মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবেই দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন। বিহারে শের শাহের প্রতিপত্তি ক্রমশ বাড়ছে, সে খবর তিনি পেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে বাবর তাঁকে শের শাহের ব্যাপারে যে সাবধানবাণী দিয়ে গিয়েছিলেন, হুমায়ুনের তা মনে ছিল। কিন্তু একই সময়ে গুজারাতের সুলতান কুতবউদ্দিন বাহাদুর শাহ বিদ্রোহ করে বসলেন। পর্তুগিজদের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি প্রচুর কামান ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় হুমায়ুন প্রথম সাত বছর শেরশাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন গুজারাতের সুলতানকে পরাজিত করলেন। এবার তিনি পূর্বে নজর ফেরানোর অবকাশ পেয়েছেন। কিন্তু গুজারাতের সুলতানের বাহিনীর অবশিষ্ট আফগান সৈন্যরা পালিয়ে এসে শের খানের বাহিনীতে যোগ দিল।
১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে হুমায়ুন বিহারের দিকে যাত্রা করেছিলেন। তিনি যদি সরাসরি গৌড়ে চলে যেতেন, তা হলে জালাল খান সূরি গৌড় দখলের সুযোগ পেতেন না। কিন্তু ভাগ্য শেরশাহের পক্ষে। হুমায়ুন আগে গঙ্গাতীরের চুনার দুর্গ (এখন তাম্মানপট্টি, উত্তর প্রদেশ) দখল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, শেরশাহ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। খবর পেয়ে শের খান চুনার দুর্গ ছেড়ে রোহতাস গেলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করে আশ্রয়দাতা রাজা হরিকৃষ্ণ রাইকে হত্যা করে তিনি রোহতাসগড় দুর্গের দখল নিলেন। শের খানের দুই সেনাপতি বুলাকি আর গাজি শূর প্রাণপণ লড়াই করে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত চুনার দুর্গের দখল বজায় রাখলেন। এরই মধ্যে জালাল খান সূরি গৌড় দখল করে নিলেন।
চুনার দুর্গের পতনের পর শের খান হুমায়ুনের কাছে এক সন্ধি প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি বিহারের অধিকার ছেড়ে দেবেন, বাংলায় গিয়ে শাসন করবেন। হুমায়ুনকে তিনি সম্রাট হিসেবে মেনে নেবেন, বছরে দশ লাখ মুদ্রা কর পাঠাবেন। কেবল বাংলা শাসনের অধিকার তিনি চান।
হুমায়ুন এই প্রস্তাব মেনেই নিতেন, এমন সময়ে বাংলার পরাজিত সুলতান মাহমুদ শাহ তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি হুমায়ুনকে বললেন, গৌড় নগর দখল হলেও বাংলার এক বিশাল অঞ্চল তাঁর হাতেই আছে। শের খানের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে হুমায়ুন যেন নিজের বাহিনী নিয়ে বাংলায় আসেন। হুমায়ুন যখন বুঝলেন, গৌড় দখল করে শের খান বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছেন, তখন ভবিষ্যতের বিপদের কথা চিন্তা করে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে গৌড়ের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
ভাগলপুরের কাছে কহলগ্রামে মোগল বাহিনী সীমান্ত ফেলল। তত দিনে জালাল খান সূরির বাহিনী এসে তেলিয়াগড়ি সীমান্ত ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছে। প্রথম প্রয়াসে মোগল বাহিনী তাদের হারাতে ব্যর্থ হলো। কহলগ্রামে ফিরে এসে মোগল সেনারা তাদের ব্যর্থতার খবর জানাল। তারা এ-ও জানাল, জালাল খান বাংলার সুলতানের দুই ছেলেকে গৌড়ে খুন করেছেন। সুলতান মাহমুদ শাহ এ কথা শুনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কহলগ্রামেই প্রাণত্যাগ করলেন। ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করে যিনি সিংহাসন দখল করেছিলেন, নিজের ছেলেদের অকালমৃত্যুর খবর তিনি সহ্য করতে পারলেন না।
বাংলার দুই শ বছরের স্বাধীন সুলতানদের যুগ এখানেই শেষ হলো। তিন মাস হুমায়ুনের সৈন্যদের ঠেকিয়ে রেখে জালাল খান সূরি নিশ্চিত করলেন, গৌড়ে লুট করা ছয় কোটি স্বর্ণমুদ্রার প্রতিটি শের খানের কাছে রোহতাস দুর্গে পৌঁছানো গিয়েছে। তারপর তিনি অবস্থান ত্যাগ করলেন।
হুমায়ুন বিনা বাধায় মোগল বাহিনী নিয়ে গৌড়ে গেলেন। গৌড় তখন প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। অনেক বাড়ি ভাঙা, রাস্তায় ছড়িয়ে আছে মানুষের দেহাবশেষ। তবু গৌড়কে হুমায়ুনের ভালো লেগে গেল। তিনি নির্দেশ দিলেন, গৌড়কে ‘জান্নাতাবাদ’ বলে ডাকতে হবে। শহর থেকে তিনি মৃতদেহ আর যুদ্ধের জঞ্জাল অপসারণ করালেন। গৌড়ের প্রাসাদ হুমায়ুনের খুব ভালো লেগেছিল। প্রাসাদের দেয়ালের কারুকাজ, ভেতরের উদ্যান ব্যবস্থাপনা, পাথরের নালা, চৌবাচ্চা, এসব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নয় মাস তিনি গৌড় নগরে থাকলেন। বাংলায় আর কোনো অভিযান করলেন না। শের খান ক্রমেই বারানসি, জৌনপুর, কনৌজ দখল করে নিচ্ছেন শুনেও তাঁর কোনো বিকার হলো না। কোনো দর্শনার্থীর সঙ্গেও তিনি দেখা করলেন না। গৌড়ের পুরো সময় কেবল কাছের সভাসদ আর আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তিনি ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বাংলা থেকে বিহারের দিকে যাত্রা করলেন। ভাই কামরান মির্জার বিদ্রোহের খবর না এলে বোধ হয় আরও কিছুদিন বাংলার আতিথেয়তা উপভোগ করতেন।
জুন মাসে বক্সারের কাছে চৌসায় হুমায়ুনের ৪০ হাজার সৈন্যের বাহিনী শের খানের ২৫ হাজার সৈন্যের মুখোমুখি হলো। শের খান জানতেন, বর্ষাকালে যুদ্ধের জন্য কী রকম প্রস্তুতি নিতে হয়। তিনি শিবির করেছিলেন উঁচু জায়গায়, হুমায়ুন শিবির করলেন নদীর ধারে। বর্ষায় হুমায়ুনের শিবিরের এক অংশ ভেসে যেতেই শের খান মোগল সম্রাটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রবল যুদ্ধে হুমায়ুনের পরাজয় হলো। গঙ্গা পার হয়ে পশ্চিম তীরে যাওয়ার সময় তাঁর বহু সৈন্য ডুবে মারা গেল। হুমায়ুন নিজে প্রথমে এক ভিস্তিওয়ালার সাহায্য নিয়ে, পরে এক হাতির পিঠে চড়ে গঙ্গা নদী পার হলেন। হুমায়ুনের হারের এখানেই শুরু। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কনৌজের যুদ্ধেও শেরশাহের কাছে হেরে আগ্রা-দিল্লি-লাহোর হয়ে ভারত ছাড়লেন। তাঁকে পনেরো বছর পারস্যের রাজা শাহ তামসপের আশ্রয়ে থাকতে হলো। শের খান ফরিদউদ্দিন শেরশাহ নাম নিয়ে সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসলেন।
দিল্লির সিংহাসনে বসেও বাংলার গুরুত্বের কথা শেরশাহ ভুলে যাননি। তিনি শুনতে পেলেন, তাঁর নিয়োগ করা বাংলার শাসনকর্তা খিজির খান প্রয়াত সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের মেয়েকে বিয়ে করেছেন এবং খানিকটা স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছেন। ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে শেরশাহ দ্রুত গৌড়ে এসে উপস্থিত হলেন। খিজির খানকে প্রাণদণ্ড দিয়ে তিনি কাজী ফজিলতকে অসামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিলেন। তিনি বাংলায় শেরপুর নামে দুটি ও শেরগঞ্জ নামে দুটি নগর স্থাপন করলেন। পুরো বাংলায় প্রথম ভূমি জরিপ তিনিই করান। তিনি সুলতানি আমলের জমিদারদের উচ্ছেদ করে বাংলায় বহু আফগানকে জমিদারির অধিকার দেন, পুরো বাংলাকে বহু প্রশাসনিক একক বা ‘সরকার’-এ বিভক্ত করেন, যাতে প্রত্যেক জমিদারের একক ক্ষমতা হ্রাস পায়। বাংলার নৌবহরকে তিনি আরও শক্তিশালী করেন। সুলতানি আমলের সড়কগুলো মেরামত ও সংস্কার করেন।
তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো সড়ক-ই-আজম, ব্রিটিশরা যেটিকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে বিখ্যাত করেছে। বস্তুত সম্রাট অশোকের আমলে পাটলিপুত্ৰ থেকে লাহোর পর্যন্ত এই রাস্তা প্রথম নির্মাণ করা হয়েছিল। শেরশাহ এই সড়কের গুরুত্ব বুঝে এই রাস্তাকে পাথরের রাস্তায় পরিণত করেন। পূর্ব দিকে তিনি এই রাস্তা গৌড়, সুবর্ণগ্রাম হয়ে রামু (এখন কক্সবাজার) পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেন। পশ্চিমে লাহোর থেকে সড়ক নিয়ে যান পেশাওয়ার পর্যন্ত। ভারতের উত্তর-দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর কিছু রাস্তাও তিনি তৈরি করেছিলেন। ব্যবসায়ী ও তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য এসব রাস্তায় প্রতি দুই মাইল অন্তর সরাইখানা ছিল, ছিল ঘোড়া বদলানোর ব্যবস্থা। এই রাস্তায় সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল দিত। এই রাস্তাগুলোর ওপর দিয়ে শেরশাহ ঘোড়ায় টানা ডাকের প্রচলন করেন। আগে যে খবর দিল্লি থেকে গৌড়ে আসতে দুই মাস লাগত, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে গৌড়ে এসে পৌঁছাতে শুরু করে। যোগাযোগের এই ঘনিষ্ঠতা বাংলার ওপর দিল্লির কর্তৃত্বকে দৃঢ়তর করে তোলে।
১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডে কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে এক বিস্ফোরণে শেরশাহ প্রাণ হারান। তাঁর ছেলে জালাল খান সূরি ইসলাম শাহ নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। নয় বছর রাজত্ব করে তিনিও ১৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। দিল্লির সিংহাসন নিয়ে সংঘাত শুরু হয়, এরই সুযোগে হুমায়ুন খান ও তাঁর সেনাপতি বৈরাম খান ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে সূরি বংশের শেষ প্রতিনিধি সিকান্দর শাহ সূরিকে পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্য আবার স্থাপন করেন। সিকান্দর শাহ সূরি পালিয়ে বাংলায় চলে আসেন, এখানেই ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
সম্রাট হুমায়ুনও বাঁচেননি বেশি দিন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই প্রাণত্যাগ করেন।
বাংলায় যুদ্ধ করে যাওয়া এই দুই ভারত-সম্রাটের আয়ু যতই অল্প হোক, বাংলা তাঁদের সময় থেকেই নিজের স্বাধীন অবস্থান হারিয়ে মোগল বা সূরি সাম্রাজ্যের প্রদেশের পরিণত হয়। নিজের চোখে বাংলার ঐশ্বর্য দেখে তাঁরা সাম্রাজ্যের জন্য বাংলা অধিকারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। একই সঙ্গে পর্তুগিজ বণিক বা অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে উন্নত মানের আগ্নেয়াস্ত্র ও কামান পেয়ে যাওয়ার ফলে এই সম্রাটদের পক্ষে বাংলায় অভিযান চালানোও আগের চেয়ে সহজ হয়ে পড়েছিল।
তা সত্ত্বেও বিদ্রোহভূমি বাংলাকে পুরোপুরি বশ করা শেরশাহ, হুমায়ুন, আকবর কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। স্বাধীন সালতানাত না-ই থাক, বাংলার ছোট জমিদারেরাও সাম্রাজ্যের বশ্যতা অস্বীকার করতে প্রায় এক শ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
স্বাধীনতাহীনতায় বাংলা কখনো বাঁচতে চায়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন