এই কাহিনির শুরু দিল্লিতে।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক যখন দিল্লির সুলতান, তখন তাঁর চাচাতো ভাই ফিরোজ-বিন-রজব প্রভাবশালী অমাত্যদের একজন ছিলেন। ফিরোজের এক বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন আলী মুবারক। আলী মুবারক একদিন ফিরোজের কাছে এক তরুণকে চাকরি দেওয়ার আরজি জানালেন। তরুণের নাম ইলিয়াস, তাঁর মা আলী মুবারকের ধাত্রী ছিলেন। আলী মুবারককে জামিনদার রেখে ইলিয়াসকে চাকরি দিলেন ফিরোজ।
ইলিয়াসের চাকরি কী ছিল, তা লেখা নেই। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে অনুমান করতে পারি, ইলিয়াস ফিরোজের অন্দরমহল পর্যন্ত যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছিলেন। সে সময় ধনাঢ্য পুরুষেরা উপপত্নী রাখতেন। ইলিয়াস সম্ভবত ফিরোজের কোনো উপপত্নীর প্রেমে পড়ে যান। প্রেমের খবর চাপা থাকেনি। ফিরোজ ঘটনা জানতে পেরে ইলিয়াসের জামিনদার আলী মুবারককেই বলেন তাঁকে ধরে নিয়ে আসতে। বুদ্ধিমান ইলিয়াস জানতেন, ধরা পড়লে মাথা কাটা যাবে। তিনি মাকে নিয়ে দিল্লি থেকে পালান। সম্ভবত এই সময়েই তিনি মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন। কারণ, পরবর্তী জীবনে দেখছি, তিনি হাজি ইলিয়াস নামে পরিচিত হয়েছেন। তাঁর প্রেমিকার কী হলো, তা নিয়ে ইতিহাস মাথা ঘামায়নি। অনুমান করি, বেচারীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
আলী মুবারক যখন ইলিয়াসকে ধরে আনতে ব্যর্থ হলেন, তখন ফিরোজ-বিন-রজব সাংঘাতিক রেগে গেলেন। আলী মুবারকের চাকরি গেল। দিল্লিতে হেনস্তা-অসম্মানের শিকার হয়ে আলী মুবারক নতুন জীবন-জীবিকার খোঁজে লখনৌতি চলে এলেন।
আলী মুবারক সৎ, পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। লখনৌতির প্রশাসক কদর খান তাঁকে সৈন্যবাহিনীর বেতন দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। তিনিও এই দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করছিলেন। হজ থেকে ফিরে আলী মুবারকের সাফল্যের কথা শুনে লখনৌতিতে এসে হাজির হলেন ইলিয়াস। তিনি একটা চাকরি চান।
ইলিয়াসকে দেখে খুশি হননি আলী মুবারক। তাঁকে প্রথমে বন্দী করে রেখেছিলেন। কিন্তু ইলিয়াসের আপন মা আর আলী মুবারকের ধাত্রী-মা ছেলের হয়ে আলী মুবারকের কাছে মাফ চাইলেন। আলী মুবারক কৃতজ্ঞ স্বভাবের মানুষ, ধাত্রী-মায়ের অনুরোধে ইলিয়াসকে ক্ষমা করলেন। তাঁর সুপারিশে ইলিয়াস সপ্তগ্রামে আজম-উল-মুলকের সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়ে গেলেন। বুদ্ধিমান, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইলিয়াস ক্রমেই সেনাবাহিনীতে উন্নতি করতে লাগলেন, দুই বছরের মধ্যেই সপ্তগ্রামের সেনাপতিতে পরিণত হলেন।
আগেই বলেছি, ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুবর্ণগ্রামের বিদ্রোহী সুলতান ফখরউদ্দিনকে দমন করতে গিয়ে লখনৌতির প্রশাসক কদর খান নিহত হন। কদর খানের মৃত্যুর পর ফখরউদ্দিন মুখলিস নামের এক ব্যক্তিকে লখনৌতির প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আলী মুবারক আইনের এই লঙ্ঘন মেনে নেননি, তিনি মুখলিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন। লখনৌতি এবং ফিরোজাবাদের (পান্ডুয়া) মানুষ আলী মুবারককেই অস্থায়ী শাসনকর্তা হিসেবে মেনে নেয়।
আলী মুবারককে লখনৌতির শাসক হতে অনুরোধ করেছিলেন ইলিয়াস। নিয়মনিষ্ঠ আলী মুবারক তাতে রাজি হননি। তিনি দিল্লিতে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের কাছে কদর খানের মৃত্যুর খবর পাঠিয়ে নতুন প্রশাসক নিয়োগ করার অনুরোধ জানালেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক ইউসুফ নামের এক ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগ করলেন। কিন্তু কপালের ফের, লখনৌতিতে এসে পৌঁছানোর আগে পথেই রোগে (সম্ভবত বিউবোনিক প্লেগ) আক্রান্ত হয়ে ইউসুফের মৃত্যু হলো। পাগলাটে মুহাম্মদ বিন তুঘলক এই খবর শুনে ‘ধুত্তোর’ বলে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইলেন। লখনৌতির নতুন প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগ নিলেন না। লখনৌতির লোকজন তখন সুবর্ণগ্রাম থেকে পাঠানো ফখরউদ্দিনের সেনাদের হামলায় ব্যতিব্যস্ত। নেতৃত্বহীনতায় সামাজিক শৃঙ্খলা আর অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছিল। তিন বছর ধরে দিল্লির সুলতানের আদেশের বিফল অপেক্ষার পর সভাসদদের অনুরোধে আলী মুবারক ১৩৪১ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন আলী শাহ নামে সিংহাসনে বসলেন। রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন পান্ডুয়ায়।
ওদিকে সপ্তগ্রামে আজম-উল-মুলকের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন আলী শাহ আর ফখরউদ্দিনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ইলিয়াস নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করলেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে কৃতজ্ঞতার দায় দ্রুত মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। ইলিয়াস খোলাখুলি উপকারী বন্ধু আলাউদ্দিন আলী শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেন। এই যুদ্ধের একপর্যায়ে সম্ভবত ইলিয়াসের ইন্ধনে আলাউদ্দিনের দেহরক্ষীরা তাঁকে হত্যা করেন। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লখনৌতি-সপ্তগ্রামের শাসক হয়ে নতুন রাজধানী পান্ডুয়ার সিংহাসনে বসলেন।
ইলিয়াস প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রদবদল ঘটালেন। আগের এক শ বছরে মুসলমান শাসকেরা বাহিনী সাজিয়েছিলেন মূলত মুসলমান ঘোড়সওয়ার সৈন্যের ওপর নির্ভর করে। ইলিয়াস এই নীতি থেকে সরে এলেন। তিনি বাঙালি হিন্দুকে প্রশাসনে এবং সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করলেন। বাঙালি সৈন্য নিয়ে বিশাল আকারের পাইক বাহিনী গড়ে তুললেন। বাঙালি মাল্লা ব্যবহার করে বড় নৌবহর গড়ে তুললেন, যাতে ফখরউদ্দিনের আক্রমণ সামাল দিতে পারেন।
মাত্র দুই বছরে নিজের সামরিক শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে ১৩৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ প্রথমে সপ্তগ্রাম থেকে বেরিয়ে ওডিশায় অভিযান চালান। ওড়িশার রাজা নরসিংহ দেব আর তাঁর ছেলে ভানুদেব ইলিয়াসের আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকেন। ইলিয়াস শাহ জয়পুর, কটক হয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত পৌঁছে ভাবলেন, যথেষ্ট হয়েছে। লুট করা ধনরত্ন এবং হাতি-ঘোড়া নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন। পুরী রক্ষা পেল। তবে ওড়িশার ওপর বাংলার রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখান থেকেই শুরু হলো।
ওড়িশার সফল অভিযান ইলিয়াসের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ইলিয়াস উত্তর সীমান্তের পার্বত্য দেশগুলোতে চোখ দিলেন। এক শ বছর আগে ইখতিয়ার উদ্দিন তিব্বত অভিযানে গিয়ে সদলে বিনষ্ট হয়েছিলেন। সেই কথা মাথায় রেখেও ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস সেনাবাহিনী নিয়ে নেপাল অভিযানে গেলেন। নেপালের সৈন্যরা তাদের রণকুশলতা আর সাহসের জন্য বিখ্যাত ছিল। অপরিচিত পার্বত্য এলাকায় তাদেরই চেনা গিরিপথে যুদ্ধ করে ইলিয়াস সফল হলেন। তিনি কাঠমান্ডু পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। যাওয়া-আসার পথে ব্যাপক লুটতরাজ করলেন, কাঠমান্ডুর কাছেই বিখ্যাত পশুপতিনাথের মন্দির ধ্বংস করলেন। তবে তিনি বুঝেছিলেন, এই পার্বত্য অঞ্চলে দখল ধরে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি সময়মতো বাহিনী নিয়ে সরে এলেন।
১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু অভিযানে গিয়ে দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের উদরাময় হয়েছিল। হেকিমদের যত্নে সেই রোগ থেকে সেরে উঠে তিনি সিন্ধু নদে নৌকাভ্রমণ করছিলেন। জেলেরা জাল ফেলে পাল্লা মাছ ধরছিল (পশ্চিম ভারতের ইলিশ, বাংলার ইলিশের চেয়ে আকারে বড় হলেও স্বাদে কিছু কম)। মুহাম্মদ বিন তুঘলক বায়না ধরলেন, তিনি পাল্লা মাছের ভাজা খাবেন। তাঁর হেকিমরা নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু পাগলাটে সুলতান কারও উপদেশ শোনার পাত্র ছিলেন না। তাঁকে পাল্লা মাছ ভেজে দেওয়া হলো, তিনি খেয়ে আবার উদরাময়ে পড়লেন। এ যাত্রা তাঁর জীবন রক্ষা করা গেল না। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের উত্তরাধিকারী ছিল না। দিল্লির সভাসদেরা ভেবেচিন্তে তাঁর চাচাতো ভাই ফিরোজ-বিন-রজবকেই সুলতান হিসেবে বেছে নিলেন। ইনিই সেই ফিরোজ, যিনি একসময় ইলিয়াসকে ধরে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফিরোজ শাহ নামে তিনি দিল্লির মসনদে বসলেন।
দিল্লির ক্ষমতাকেন্দ্রে এই আকস্মিক পটপরিবর্তনের কথা ইলিয়াসের কানে এসে পৌঁছাল। তিনি নিশ্চিতভাবেই বিপদ টের পেলেন। ফিরোজ শাহ এখন বহুদিন আগের অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। ইলিয়াস ঠিক করলেন, তিনি আক্রমণের মাধ্যমেই প্রতিরক্ষা করবেন। ছেলে সিকান্দরের হাতে রাজধানী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে তিনি বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
উত্তর বিহারে দিল্লির সুলতানের করদ রাজ্য তীরভুক্তি (ত্রিহুত) দিল্লি-লখনৌতির পথ কৌশলগত কারণে একটু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ইলিয়াস প্রথমেই রাজা শক্তি সিংহ ও রাজা কামেশ্বরকে পরাজিত করে ত্রিহুত দখল করে নেন। দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে গণ্ডক নদীর তীরে নিজের নামে ‘হাজিপুর’ নামে এক শহর নির্মাণ করতে শুরু করেন। দিল্লির নতুন সুলতান তখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত না থাকলে ইলিয়াসকে এর সমুচিত জবাব দিতেন বলেই মনে হয়। কিন্তু দিল্লি থেকে কোনো বাহিনী এল না। বিহারে দিল্লির প্রশাসক মালিক ইব্রাহিম বাইয়ু ইলিয়াসকে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হলেন। স্বাধিকারপ্রমত্ত ইলিয়াস পশ্চিমে এগিয়ে উত্তর প্রদেশের চম্পারন, গোরখপুর, বেনারস পর্যন্ত জয় করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল দিল্লি যাবেন, কিন্তু সম্ভবত পরামর্শদাতারা তাঁকে নিবৃত্ত করেন। তাঁরা বিচক্ষণতার কাজ করেছিলেন।
বিহার অভিযান থেকে ফিরে ইলিয়াস শাহ সুবর্ণগ্রামে অভিযান চালিয়ে ফখরউদ্দিনের ছেলে ইখতিয়ার উদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। তিনি এখন লখনৌতি-পান্ডুয়া-সপ্তগ্রাম-সুবর্ণগ্রামসমেত পুরো রাজ্যের অধীশ্বর। তিনি এই পুরো রাজ্যের নাম দিলেন বাঙ্গালা, নিজেকে শাহ-ই-বাঙ্গাল বলে ঘোষণা করলেন। এই বাঙ্গালা বা বাংলা বঙ্গ থেকে আলাদা। বঙ্গ ছিল আজকের বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, নদীয়া অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠা জনপদ। ইলিয়াস যে বাঙ্গালার রাজা হলেন, তার উত্তরে নেপাল-কামরূপ, দক্ষিণে ওড়িশা আর বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ত্রিপুরা-আরাকান, পশ্চিমে বিহার। বঙ্গ তো বটেই, গৌড়-সমতট-হরিকেল-রাঢ়-তাম্রলিপ্ত-চন্দ্রদ্বীপ সব জনপদই এই বাংলার অংশ। মোগলরা পরে এরই নাম দেয় সুবা-বাংলা, ইংরেজরা এর নাম দেয় বেঙ্গল। ইলিয়াস শাহ মানচিত্র আঁকার কাজ শেষ করে রেখে গেলেন।
ফিরোজ শাহ ইলিয়াসের দুঃসাহসের কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁর সাম্প্রতিক উত্থানে একেবারেই খুশি হতে পারেননি। দিল্লিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ইলিয়াসকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজেই সৈন্য পরিচালনা করলেন। ইলিয়াস শাহ তখন বিহার-উত্তর প্রদেশে রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত। ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দের শীতকালে দিল্লির বাহিনী ইলিয়াসের বাহিনীকে ধাওয়া করতে শুরু করল। ইলিয়াসের পেছন পেছন গোরখপুর, ত্রিহুত হয়ে ফিরোজ শাহ বাংলার রাজধানী পান্ডুয়াতে এসে পৌঁছালেন। ইলিয়াস পান্ডুয়ায় না ঢুকে পূর্ব দিকে আরও সরে এসে দিনাজপুরের একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। এই দুর্গের দুই পাশে চিরমতি আর বালিয়া নদী প্রাকৃতিক পরিখা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আরেক পাশে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দুর্গের প্রাচীর পুরু এবং মাটির, আরাদা (অনেজারের প্রাচ্য সংস্করণ) দিয়ে গোলা মেরে দেয়াল ধসিয়ে দিলেও রাতারাতি মেরামত করে নেওয়া সম্ভব। একডালার বিশাল দুর্গে ইলিয়াসের বিশাল সৈন্যবাহিনীর বড় অংশই আশ্রয় নিতে পারল।
ফিরোজ শাহ পান্ডুয়া দখল করে বুঝলেন, ইলিয়াস শাহ সেখানে আসেননি। তিনি ধাওয়া করে একডালা দুর্গ পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু বারবার আক্রমণ করেও দুর্গ জয় করতে পারলেন না। এক মাস তিনি দুর্গ অবরোধ করে রইলেন। তাঁর সৈন্যরা গরমে, খাবারের অভাবে, মশার কামড়ে ভুগল। দুই পক্ষে কিছু ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হলো। দিল্লির অশ্বারোহীরা খুব বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল, কিন্তু বাংলার পাইকরাও সমানে লড়েছে। ইলিয়াসের পাইক-ই-মুকাদ্দম সহদেব যুদ্ধে প্রাণ দেন। দিল্লির ইতিহাসবিদেরা এই অকুতোভয় বীরের নাম লিখে রেখেছেন।
এক মাস পার হয়ে যাওয়ার পর বর্ষা শুরু হলো। একডালার চারপাশের এলাকা নিচু। ফিরোজ শাহ বুঝলেন, এভাবে বর্ষাকালে বাংলায় অপেক্ষা করলে তাঁকে বহু ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতে হবে। তিনি পশ্চাদপসরণের ভান করে কয়েক মাইল পিছিয়ে গেলেন। ফিরোজ আশা করেছিলেন, ইলিয়াস তাঁর পেছনে ধাওয়া করে আসবেন। কিন্তু ইলিয়াস ঝুঁকি নেননি। তিনি একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠালেন। ফিরোজ শাহের বাহিনী অগ্রবর্তী বাহিনীকে কচুকাটা করলেও ইলিয়াস শাহ কিংবা তাঁর মূল বাহিনীর ক্ষতি করতে পারল না। ফিরোজ শাহ বাধ্য হয়ে সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন। পান্ডুয়া থেকে দখল করা হাতি-ঘোড়া-রত্নভান্ডার তিনি রাখবেন। ইলিয়াস শাহ দিল্লির সুলতানের সাম্রাজ্যে ভাগ বসাবেন না, তিনি বাংলার সুলতান হয়েই খুশি থাকবেন।
ইলিয়াস শাহ সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হলেন। সম্ভবত ফিরোজ শাহের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তিনি বুঝেছিলেন, বড় রাজ্যের অধীশ্বর হতে গেলে যে অন্তহীন লড়াইয়ের মধ্যে তাঁকে থাকতে হবে, তাঁর বয়সী শরীর ক্রমেই সে ক্ষমতা হারাচ্ছে।
ফিরোজ শাহ ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দের বর্ষায় দিল্লিতে ফিরে গেলেন। নিজের ইতিহাসবিদদের কঠোর আদেশ দিলেন, বাংলা বিজয়ের কাহিনি যেন ঠিকমতো লেখা হয়। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা বুদ্ধিমান। বাংলায় যে সমানে সমানে লড়াই হয়েছিল, প্রকারান্তরে তাঁরা সেটার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। ফিরোজ শাহ সারা জীবনেই সামরিক অভিযানে খুব একটা সফল হতে পারেননি। দিল্লির কাছে ফিরোজাবাদ নামের একটা শহর স্থাপন করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে ক্রিকেটের নিয়মিত দর্শকেরা দিল্লির ‘ফিরোজ শাহ কোটলা’ স্টেডিয়ামের নামে এখনো তাঁর নামকে টিকে থাকতে দেখেন।
ইলিয়াস শাহ ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে স্বাভাবিক মৃত্যু পেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর রাজ্যবিস্তার অব্যাহত ছিল। কামরূপের কিছু এলাকা তিনি দখল করে নেন। প্রশাসক হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সুযোগ্য ছেলে সিকান্দর শাহ সিংহাসনে বসেন।
ইলিয়াস মুসলিম সুফিসাধকদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। আখি সিরাজউদ্দিন, আলাউল হক, রাজা বিয়াবানির মতো সুফিসাধকদের তিনি মসজিদ এবং খানকাহ বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও রাজ্য-প্রশাসন বা পরিচালনায় হিন্দু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। এই দূরদর্শী শাসক বুঝেছিলেন, বাংলায় রাজ্য পরিচালনা করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর মতামত উপেক্ষা করা চলবে না, তাদের সাহায্য নিয়েই কেবল সালতানাতের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ইলিয়াস শাহ বাংলার নাম যেমন ভারতে পরিচিত করে তুলেছিলেন, তেমনি বাংলার লোককে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বও তাঁর। ২ লাখ ৩২ হাজার বর্গকিলোমিটারের এক এলাকাকে তিনি একক রাজনৈতিক পরিচয়ে বেঁধেছেন, এমন এক জাতিকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পার হয়ে যাওয়ার আগেই যাদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩০ কোটির কাছাকাছি। ধর্মীয় আর মতাদর্শগত বিভেদ সত্ত্বেও, এমনকি রাষ্ট্রীয় বিভক্তি সত্ত্বেও তাদের অভিন্ন কিছু উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবেন পরবর্তী যুগের উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকেরা।
বাংলার ইতিহাসে এটাই শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উত্তরাধিকার, তাঁর বংশধরদের ১৪০ বছরের স্বাধীন শাসনের চেয়েও এর গুরুত্ব বেশি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন