১৭. ঝুমকা

কোয়েল তালুকদার

মধ্য কার্তিকের এক মৌন অপরাহ্ণে  বাড়ির পুকুরপাড়ে একাকী বসেছিলাম। পুকুরপাড় থেকে একটি মেঠো পথ  চলে গেছে দক্ষিণ দিগন্তের দিকে। যতদূর দৃষ্টি যায়  চোখ মেলে চেয়ে দেখছিলাম আদিগন্ত । পথের দুপাশে আধাপাকা ধানগাছ ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। সরিষার ক্ষেতগুলো দেখতে লাগছিল হলুদ গালিচার মতো। হঠাৎ দেখতে পাচ্ছিলাম- দিগন্ত ভেদ করে ছায়ার মতো কেউ একজন মেঠো পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। একটু পর দেখি, একজন নয় দুজন। আরও একটু পরে দেখি, দুজনের একজন পুরুষ আর একজন  মেয়ে। ওরা আস্তে আস্তে  আমাদের বাড়ির  দিকে এগিয়ে আসছে। যখন কাছে চলে আসে- তখন ছেলেটিকে দেখে চিনতে পারি। ও আমাদের গায়েরই ছেলে। ওর নাম আমজাদ।  পশ্চিম পাড়ায় থাকে। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারছিলাম না। ওকে এর আগে কখনও দেখিনি। 

আমজাদ একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছিল। তারপর আর পড়ে নাই। সংসারে ওর মন ছিল না। ওরা খুব গরীব। ছোনের চালা আর পাট সোলার বেরার ছোট দুটি ঘর ওদের। কোনো চাষের জমি নেই । আমজাদের আরও তিনটি ছোট  ভাই বোন আছে। বাবা শারীরিক অক্ষম। কোনো কাজ করতে পারে না। মা অন্য বাড়িতে ঝীয়ের কাজ করে দুঃখে কষ্টে  কোনো মতো সংসার চালায়।

আমজাদ ছোটবেলা থেকেই উড়নচণ্ডী স্বভাবের । কাউকে না বলে প্রায়ই উধাও হয়ে কোথাও চলে যেত। ছয় মাস একবছর নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে। কখনও আরও বেশি। দুই তিন বছর ওর কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যেত না। 

শুনেছি আমজাদ যাত্রা দলে যোগ দিয়েছে। গ্রামে গঞ্জে হাটে বাজারে সে ঘুরে বেড়ায়। যাত্রা দলের লোকজনদের ফয়ফরমাশ করে। মাঝে মাঝে যাত্রা পালায় ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয়ও করে। 

ওর বয়স  উনিশ কুড়ি হবে। দেখতে সুঠাম ও সুূদর্শন। সাথের মেয়েটিকে আমজাদ পরিচয় করে দিয়ে বলে – ‘ওর নাম পাপিয়া। আমার স্ত্রী’। বয়স ওর চেয়ে তিন চার বছরের বড় হবে। মেয়েটিকে দেখতে বেশ রূপবতী  লাগছিল। একটি সুতি শাড়ি পরে আছে। কানে ইমিটেশনের ঝুমকা দুল। দু’হাত ভরা চুড়ি। চোখ দুটো মায়া করা। বেশভূষা দেখে  বোঝা যাচ্ছিল – মেয়েটি যাত্রা দলের সহশিল্পী কেউ একজন হবে।

পুকুরপাড়ে আমজাদ বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। পাপিয়াকে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে চলে যায় । যাওয়ার সময় আমাকে বলে যায়- ‘কাল তুমি আমাদের বাড়িতে এসো। তখন নাহয় গল্প করা যাবে ।’ আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম –  মুখে ছিল তার  অদ্ভুত রহস্যময়  হাসি।  মনে হলো,  এই বুঝি আমাকে ‘ ভ্রূ পল্লবে ডাক দিয়ে নিয়ে যাবে চন্দনের বনে।’ মনে হলো মেয়েটি আমার সাথে অনেক কথা বলতে চায়। আমারও খুব ইচ্ছে করছিল ওর সাথে কথা বলতে।

রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা  –  আমজাদ বাউণ্ডুলে একটি ছেলে, সে কিছু করে খায় না , ওদের থাকার ঘরটাও জরাজীর্ণ। দু’বেলা ঠিকমতো ভাত জোটেনা। আর সেই কী না সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে । মেয়েটিই বা কী দেখে ওর ঘরে এল! ওকে কোথায় থাকতে দেবে, কী খাওয়াবে? আমার উঠতি তরুণ মন উদ্বেগে ভাবছিল সেই সব কথা।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কী না, জানিনা। আমি চেতনে না অবচেতনে আছি, তাও বুঝতে পারছিলাম না। রাত অনেক হবে। হঠাৎ  মনে হলো কে যেন আমার ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। আমি উঠে দরজা খুলে দিই। দেখি পাপিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সে আমার  কাছে চলে আসে। এবং  বলে – চলো পুকুর পাড়ে। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। 

রাতের গায়ে নিঝুম নীরবতা তখন।। পুকুর পাড় নির্জন, কেউ নেই।  আকাশভরা তারার আলোছায়া পড়েছে জলের উপর । পাপিয়া  আমাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভিতর মুখ রেখে আবিষ্ট হয়ে বলে — আমি তোমার হতে চাই। আমাকে তুমি তোমার করে নাও।

মধুৃময় কিছু মুহূর্ত আসে স্বপ্নের ভিতর। মানুষ কত সুখানুভুতিই না পায় সেই স্বপ্ন থেকে। আমিও সেই সুখই পেলাম পাপিয়ার কাছে থেকে।  ভালোলাগার এই স্বপ্নের ঘোর সারা জীবনকালেও কাটবে না। 

আমি পাপিয়াকে বুঝিয়ে বলি – তুমি আমজাদের কাছে ফিরে যাও। ও বাউণ্ডুলে হলেও খুব ভালো ছেলে। ওকে তুমি  মনঃকষ্ট দিও না। তুমি চলে যাও। পাপিয়া মনখারাপ করে চলে যায়।

সকালে ঘুম ভাঙে একটু দেরীতে। বিছানায় স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। মনে পড়ছিল রাতের ঘটনাটির কথা। যা পেয়েছিলাম তা কী স্বপ্নে পাওয়া ছিল? নাকি বাস্তবে পেয়েছিলাম অনুপম মণিরত্নম! কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না।  খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল পাপিয়াকে। ইচ্ছে করছিল ওকে গিয়ে আর একবার নতুন করে দেখে আসি।

পূর্ব আকাশের উজ্জ্বল  সূর্যকে পিছনে রেখে হেঁটে হেঁটে চলে যাই আমজাদদের বাড়ি। গিয়ে দেখি – আমজাদ বারান্দার খুটিতে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। খুবই বিষাদে ভরা ওর মুখখানি।  আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি – মনখারাপ কেন তোমার? ও বলে –

—  পাপিয়া নেই। 

—  নেই মানে? 

— সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, পাপিয়া চলে গেছে। 

আমি আমজাদকে বলি – কী হয়েছিল তোমাদের ভিতর? একটা দিনও পাপিয়া থাকল না।

– কিছু হয়নি। 

– তাহলে পাপিয়া চলে গেল কেন? 

– আমাদের দারিদ্র ও অভাব অনটন দেখে হয়তো 

সে চলে গেছে। 

ওদের বাড়িটিতে যা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। ঘরের চালের ছোনপাতা জায়গায় জায়গায় ছিন্ন। শোবার জন্য  কাঠের চোকি নেই। ঘরের মেঝেতে ও বারান্দার  ইঁদুর মাটি তুলে ঢিঁবি করে রেখেছে। একটি নেড়ি কুকুর উঠোনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াচ্ছে। চালহীন রান্না ঘরে খালি দুটো হাড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে। একটি মা মুরগী কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে উঠোনে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় ছেঁড়া মাদুরের উপর শুয়ে ওর ছোট ভাইটি কাঁদছে। 

আমি  বাড়ির দিকে ফিরে চলে আসি। পথে আসতে আসতে পূর্ব আকাশের সূর্যের আলো আমার চোখে মুখে এসে পড়ছিল। কিছুই ভালো লাগছিল না । বাড়িতে এসে ঘরের ভিতর না গিয়ে পুকুর পাড়ে চলে যাই। ভাবছিলাম, পুকুরপাড়ে বসে মেঠো পথটির দিকে একটু চেয়ে থাকব। যদি ভ্রম করেও দেখতে পাই – 

ঐ  পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাপিয়া আবার  ফিরে চলে আসছে। 

এইসব ভাবতে ভাবতে পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর গিয়ে বসি। বসতে গিয়েই ঘাসের উপর দেখতে পাই একটি ঝুমকা পড়ে আছে। আমি চিনতে পারি ঝুমকাটি। এই ঝুমকাটিই যে গতকালকে পরা দেখেছিলাম পাপিয়ার কানে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন