১১. নদীর নাম সুবর্ণরেখা

কোয়েল তালুকদার

সিফাত ওর বাবার পুরোনা বুকশেলফ থেকে একদিন একটি ডায়েরি খুঁজে পায়। ঠিক ডায়েরিও নয়, একটি বাঁধানো খাতার মতো অনেকটা। খাতার পাতাগুলো এত পুরোনো ও জীর্ণ হয়ে গেছে যে ধরলেই মরমর করে ছিঁড়ে যায়। 

সিফাত খুব আস্তে করে খাতার পাতা গুলো উল্টায়ে পড়তে থাকে। সে ডায়েরিটা পড়ে বুঝতে পারে এটি তার প্রপিতামহ মৃত ফয়জুর রহমানের । ঝরনা কলমে লেখা ডায়েরির অনেক শব্দ, অনেক অক্ষর ঝলসে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।     

ডায়েরিতে সিফাতের প্রপিতামহ ঐ সময়ে ঘটিত  গ্রামের বিভিন্ন ঘটনা, তার নিজের স্মৃতিকথা, আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের বিভিন্ন মানুষের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ লিপিবদ্ধ করে  রেখেছেন। ব্যক্তিগত অনেক কথাও লেখা আছে। আছে অনেক ঐতিহাসিক তথ্যও । কোথাও কোথাও কাব্যিক ভাষায় অনেক গদ্য পদ্যও তিনি  লিখে রেখেছেন।       

একজায়গায় লেখা আছে —

‘২৫ শে চৈত্র, ১৩২৮ বাং 

আজ দুপুরের পর হইতেই মনটা কেমন উতলা হইয়া উঠিল। আমগাছের শাখা হইতে এক সুমধুর কোকিলের কুহু ধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছিল। সে এক সঙ্গীত মুখরিত কলকাকলি পুষ্প সুবাসা মোদিত সুর যেন ।  প্রেমোচ্ছল আজকের এই  বসন্তদিনে—কোথায় যেন শূন্যতা অনুভব করিতে লাগিলাম।  মনে হইল অদূরে ঐ সুবর্ণরেখা নদীর কূলে চলিয়া যাই। ওখানে কদম্বতলে এই অস্ত দুপুরে  বসিয়া বাঁশি বাজাই।’     

এইটুকু পড়ে সিফাত অবাক হয়ে যায়। সেই কত বছর আগের কথা।  আজ থেকে শত বছর আগেও পৃথিবী এমনি সুন্দর ছিল, এমনি বসন্ত নামত পাড়াগাঁয়ের ঐ বন-বুকে কুঞ্জে, এমনি কোকিল ডাকত রাত্রিদিনে। সুবর্ণরেখা নদীটি না জানি কত সুন্দর ছিল ! কেমন ছিল তার জল, নদীর পাড়? তখনও কী বালুচরে কাশফুল ফুটে থাকত? নানা কৌতূহল সিফাতের মনে উঁকি দিতে থাকে।   

সিফাতের দাদা গত শতকের মাঝামাঝিতে চাকুরি উদ্দেশ্যে  গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে এসে থিতু হয়েছিল। সিফাতের বাবার জন্ম এই ঢাকাতেই। সিফাতের জন্মও ঢাকায়। মোটামুটি দুই পুরুষ ধরে তারা গ্রাম ছাড়া। পৈত্রিক ভিটা এখনো আছে কী নেই, সে কথা সিফাত জানে না। ওর বাবা এক বছর আগে মারা গিয়েছে। মা জীবিত আছেন।      

সিফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় অনার্স শেষ  করেছে। এখন মাস্টার্স করছে।  ও বরাবর অনুসন্ধিৎসু একটি ছেলে। প্রপিতামহের লেখা পুরনো এই ডায়েরিটি পড়ে তার ভিতর একটি কৌতূহল জেগেছে — সে তাদের পৈত্রিক ভিটা দেখবে। এবং দেখবে সুবর্ণরেখা নদী।      

সে তার মাকে বলে — মা, আমি আমাদের পৈত্রিক ভিটা দেখতে যাব। 

— তোদের পৈত্রিক ভিটা এখন আছে কী না আমার জানা নেই। আমিও কখনো যাইনি। আমি আমার জীবনকাল এই ঢাকা শহরের ওয়ারীর এই বাড়িটিই শ্বশুরবাড়ি হিসাবে জেনে এসেছি। তোর বাবাও কখনো সেখানে যায়নি। আমি শুনেছি — জায়গা জমি যতটুকু ছিল তা আমার শ্বশুরমশাই বিক্রি করে দিয়ে এই ঢাকা শহরে এসে স্থায়ী হয়েছিলেন।      

— তুমি কী জানো আমাদের সেই গ্রামের নাম কী ছিল? 

— আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, কুসুমপুর। বৃহত্তর পাবনা জেলায় সিরাজগঞ্জ মহুকুমায় এই গ্রামটি অবস্থিত। ট্রেনে গেলে সলোপ স্টেশনে নামতে হয়, এইটুকু জেনেছিলাম। আর তোর বাবার মুখে শুনেছিলাম তাদের বংশীয় একজন চাচীর কথা। সে সম্ভবত এখনো জীবিত আছেন, নাম হালিমা বিবি।      

এক ফাগুন মাসের শুক্লপক্ষের দিনে  সিফাত একটি ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সাথে একটি ক্যামেরা নিয়ে তাদের পৈত্রিক ভিটা দেখবার উদ্দেশ্য ঘর হতে বেরিয়ে পড়ে।

২.

ট্রেন থেকে সিফাত যখন সলোপ স্টেশনে এসে নামে তখন বিকাল হয়ে যায়।  ছোট্ট একটি স্টেশন। ট্রেন যখন এসে থামে তখন একটু জন সমাগম হয়। ট্রেন ছেড়ে চলে গেলে সারা স্টেশন নির্জন হয়ে যায়। একটি মধ্যবয়সী লোক স্টেশনে বসে ঘোল বিক্রি করছিল। সিফাত তার কাছে থেকে দুই গ্লাস ঘোল খেয়ে নেয়। তারপর ঐ লোকটিকে বলে — ‘চাচা, এখান থেকে কুসুমপুর কতদূর?’

— তা ছয় মাইল হবে। 

— কীভাবে যাব? 

— বাইস্যা মাসে তুমি আসলে নৌকায় যেতে পারতে। এখন হেঁটে যেতে হবে। তা ওখানে কার বাড়িতে যাইবা?

— ( আমি আমার দাদার নাম বললাম।)  আনিসুর রহমানের বাড়ি যাব। 

— ওনারা কেউ তো এখানে থাকে না। এই দেশ গ্রাম ছেড়ে বহু বছর আগে চলে গেছে।

— জানি। 

— ঐ বাড়িতে একজন বুড়ী থাকে তার এক নাতনিকে নিয়ে। তুমি কী হও তার? 

— আমিও তার নাতি হই। 

সিফাত ঐ লোকের কাছে থেকে কুসুমপুর যাওয়ার পথ নির্দেশনা জেনে নেয়।  তারপর সে হাঁটতে শুরু করে।             

সিফাত থানা পরিষদের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। সে এর আগে এমন নিবিড় গ্রামে কখনো আসে নাই। পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি এই দেশ। কী সুন্দর নীল আকাশ এখানে।  কেন যে এতকাল সে এখানে আসে নাই !  সে হাঁটছিল আর মনে মনে আফসোস করছিল। সে কী জানত এত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এই গ্রাম বাংলার সবুজ শ্যামল মাঠে প্রান্তরে।  এত সুন্দর করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এখানে। গাছে বাঁশ ঝাড়ে পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। কৃষক হাল গরু লাঙল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে।  একটু পর রাত্রি নামতে থাকে। ঘরে ঘরে টিম টিম করে কুপী- হ্যারিকেন জ্বলে ওঠে।  কী সুন্দর রাত্রির গন্ধ ।      

সিফাত যখন কুসুমপুর পৌঁছে তখন সন্ধ্যা রাত্রি হয়ে যায়। ওখানকার এক লোককে জিজ্ঞাসা করে হালিমা বিবির বাড়িটি চিনে নেয় সে।    

বাড়িতে পৌঁছে সিফাত দেখতে পায় একটি চারচালার টিনের ঘরে একটি হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে। সিফাত আওয়াজ করে ডাক দেয় — ‘বাড়িতে কে আছেন?’ একটি চৌদ্দ পনেরো বছরের বালিকা হ্যারিকেন নিয়ে উঠোনে এগিয়ে আসে। মেয়েটি সিফাতের মুখের উপর আলো ফেলে জিজ্ঞাসা করে — ‘আপনি কে?’   

— আমি সিফাত, হালিমা দাদিমার কাছে এসেছি। ওনার সাথে আমি দেখা করব। ওনার কাছেই আমি আমার পরিচয় দেব।  উনি আমাকে চিনতে পারবেন। 

— আসুন ঘরের ভিতর।     

ঘরে ঢুকে হালিমা বিবিকে পায়ে সালাম করে বলে– দাদিমা, আমার নাম সিফাত রহমান , বাবার নাম — আশিকুর রহমান, দাদার নাম — আনিসুর রহমান, তৎ-পিতার নাম ফয়জুর রহমান। 

বৃদ্ধা হালিমা বিবি হ্যারিকেনের আলোয় সিফাতকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলে — ওরে আমার সোনা, আমাদের কথা, এই দেশের কথা তোমার তবে মনে পড়েছে !

এতক্ষণ বালিকাটি বিস্ময়ে শহর থেকে আগত সিফাতকে দেখছিল। হালিমা বিবি মেয়েটির সাথে সিফাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে — এই মেয়েটি আমার ছেলের ঘরের নাতনি। পিতৃ-মাতৃহীন, আমি ছাড়া এই জগতে ওর আর কেউ নেই ।  সম্পর্কে তোমার চাচাতো বোন হয়। ওর নাম লিলি।                         

সেই সন্ধ্যা রাতেই লিলিকে নিয়ে হালিমা বিবি ঢাকা থেকে আগত  তার নতুন নাতির জন্য রান্না করলেন। মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে খেতে দিলেন। হলদে রঙের পেইজরা চালের ভাত, পেঁপে ভর্তা,  মুগের ডাল, কোরলা ভাজা, নন্দই মাছের তরকারি। সরপড়া গরুর দুধ, দুটো সর্বি কলা ও আখের গুড়ের পাটালি। অদ্ভুত রান্না হালিমা বিবির হাতের।    

সিফাত তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বলে — দারুণ রান্না করেছেন দাদিমা। 

সিফাত ওর দাদিমাকে বলে — ‘আমি এখানে দুই দিন থাকব। ঘুরব ফিরব আর খাব। ‘ লিলিকে বলে, ‘ তুমি আমার সাথে সাথে থাকবে। তোমাকে নিয়েই ঘুরব।      

লিলি মাথা নেড়ে বলে — আচ্ছা। 

— তুমি কোন্ ক্লাসে পড়ো? 

— ক্লাস নাইনে। কিন্তু এখন আর স্কুলে যাই না। 

— কেন যাও না?

— আমাদের স্কুল দেড় মাইল দূরে। পথে বোখাটে ছেলেরা আমাকে খুব জ্বালাতন করে। হুমকিও দেয়। ওদের ভয়ে যাই না।     

— ওহ্ আচ্ছা।       

৩.

কী সুন্দর এই বাড়িটিও। পশ্চিম পার্শ্বে বাঁশবন, আমবন।  ফলের বাগান যেন প্রাচীন অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এই বাড়িতে নির্জন দুটো মানুষ শুধু থাকে। আর যারা আছে, দুজন কামলা ও একটি কাজের মহিলা। তারা কাজ কর্ম করে সন্ধ্যা রাতেই চলে যায়। 

সকালবেলা দরজা খুলেই একঝলক সকালের রোদ্দুর এসে সিফাতের গায়ে লাগে। এত পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ, আম কাঁঠালের পাতার ফাঁক দিয়ে  ভোরের রোদের এমন ঝলমলে  বিচ্ছুরণ এর আগে সিফাত দেখেনি কখনও। 

সিফাত দাদিমার ঘরে যেয়ে দাদিকে বলে — আমি একটু পুকুরপাড়ের ওদিকে যাব। লিলিকে সাথে নেব।  

— আচ্ছা, নিয়ে যাও। 

সিফাত লিলিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যায়।  কী সুন্দর পুকুরের জল ! দিঘির জলের মতো স্বচ্ছ। পুকুরের চারপাশে নানা জাতের ঘাসের আচ্ছাদন। বিচিত্র সব ঘাসফুল ফুটে আছে। পাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নারিকেল গাছ। ফুলের গাছও আছে। রক্তজবা, বেলী গাঁদা আর পাতাবাহার। সিফাত অনেক ঘাসফুল চিনতে পারে না। পুকুর পাড় ধরে দুজন হাঁটছিল আর লিলির কাছ থেকে জেনে নেয় কোন্ ফুলটির কী নাম।   

সিফাত লিলিকে বলছিল — এত ফুলের সাথে তুমি আমাকে পরিচয় করে দিলে। কোথাও তো লিলি ফুল দেখলাম না। 

— আমার নাম লিলি। কিন্তু আমি কখনও লিলি ফুল দেখিনি। 

— আচ্ছা, এরপর আমি যদি কখনও আসি তখন ঢাকা থেকে লিলি ফুলের চারা নিয়ে এসে এখানে লাগিয়ে দিয়ে যাব। 

— আচ্ছা, ভাইয়া।  

— লিলি…. 

— জ্বী, ভাইয়া। 

— চলো, ঐ আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রান্তরের ঐ দিকে যাই। 

— চলো।       

দুজন মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকে।  লিলি আগে, সিফাত পিছে। যেন লিলিই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফাগুনের নতুন কচি আউশ আর পাটক্ষেতের পাশে দিয়ে। মাঠে রাখালেরা কাজ করছে। তারা ধান ক্ষেতে জঙ্গল হয়ে থাকা ঘাস নিরাচ্ছে, আর জারীগান 

গাইছে।    

লিলিদের পাড়ার এক বৃদ্ধ লোক যাচ্ছিল ওদের পাশ দিয়ে। সিফাতকে লিলির সাথে দেখে লিলিকে বলে — 

এত সুন্দর ছোয়ালডা কে রে লিলি? 

— আমার ভাইয়া হয়।  ঢাকা থেকে এসেছে।     

সিফাত আর লিলি পুনরায় ফিরে আসতে থাকে  বাড়ির দিকে। পথিমধ্যে দেখা হয় দুটো ছেলের সাথে। এরা বখাটে। লিলিকে পথে ঘাটে উত্যক্ত করে। একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করে এই ছোকরা কে রে লিলি? কই থেকে আমদানি হলো?  তোরে দেখে মনে হচ্ছে বেশ স্ফূর্তিতে আছিস।    

লিলি কোনো কথা বলে না।  সিফাত ওদেরকে বলে, এমন করে কথা বলছ কেন? 

— কেমন করে কথা বলব?  তুই শিখাবি? 

— আয়, শিখিয়ে দেই। 

ওদের একটারে দেয় কষে একটা থাপ্পড়।  লিলি যেয়ে সিফাতের হাত ধরে, এবং বলে — চলো ভাইয়া। লিলি সিফাতের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে বাড়িতে। বখাটে ছেলে দুটো শাসাচ্ছিল, ‘তুই কার নাতি?  তোকে আমরা দেখে ছাড়ব’।   

পথে আসতে আসতে লিলি বলছিল — তুমি ওদের সাথে আর এমন করবে না। 

— আচ্ছা। 

— আমার মাথা ছুঁয়ে বলো আর এমন করবে না। 

— এই তোমার মাথা ছুঁইয়ে বলছি  — আর এমন করব না। দেখা হলে — ওদেরকে সরি বলে দিব। আসলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তো। মাথা একটু বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল ।                        

৪.

দুপুরে সিফাত খেতে বসে তো অবাক!  নানা রকম ব্যঞ্জন। চলনবিলের বোয়াল মাছের তরকারি, ভেটকি মাছের দোপিয়াজা, টাকি মাছের ভর্তা, মুরগির ঝাল তরকারি, চালতার আচার, ডিম মামলেট, তেলে ডুবে কাঁকরোল ভাজি। সাথে ঘোষদের গাওয়া ঘী। সিফাত ওর দাদিমাকে বলে –তুমি একদিনেই আমাকে এত ভালোবেসে ফেললে দাদিমা। আমি সত্যি মুগ্ধ।     

বিকালে সিফাত লিলিকে বলছিল — এখান থেকে সুবর্ণরেখা নদীটি কতদূর? আমি ঐ নদীটা দেখতে যাব। মনে করো — ঐ নদীটা দেখতেই আমি এখানে এসেছি। 

— কাছেই।  বেশি দূরে নয়। আধা মাইল দূরে হবে। একটা মাঠের প্রান্তর পেরুলেই সুবর্ণরেখা নদী । 

— আমি আজই যাব নদী দেখতে। তুমিও যাবে আমার সাথে। 

— আচ্ছা। 

— ওখানে নদীর কূলে কদম গাছ আছে কোনো? 

— আছে। ওখানে তো বহু বছরের প্রাচীন একটা কদমবন আছে।  কিন্তু ফুল পাবে না। এখন ফাল্গুণ মাস। ফাগুনে কদম ফুল ফোটে না। পাশে শিমুল গাছ আছে। এখন শিমুল ফুটে । 

— আচ্ছা, আমি আর তুমি শিমুল তলা আর কদম তলায় বসে সুবর্ণরেখার জল দেখব। 

— আচ্ছা।          

৫.

তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। ফসলের প্রান্তরের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে দুজন চলে যায় সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। সিফাত বিমুগ্ধ হয়ে  তাকিয়ে দেখে নদীটাকে। পৃথিবীতে এত সুন্দর নদী থাকে?  নদীটি খুব বেশি চওড়া নয়।  ওপার দেখা যায় এপার থেকে। ওপারে ফসলের ক্ষেত। আছে কদম গাছ। বাবলা গাছও আছে। নদীর পাড় ধরে রাখাল গরু নিয়ে যাচ্ছে বাথানে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের রং ক্রমাগত গাঢ় কমলা রূপ ধারণ করছে।                                

সিফাত সুবর্ণরেখার পারে তার প্রপিতামহ ফয়জুর রহমানের পায়ের ছাপ খুঁজতে থাকে। পায়ের ছাপ খুঁজতে খুঁজতে সিফাত লিলিকে নিয়ে কদমতলায় যেয়ে বসে।  দুজনই বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুবর্ণরেখার জলের দিকে। স্থির পানি। স্রোত নেই। স্বচ্ছ জলের উপর পড়েছে কমলা রঙের সূর্যের ছায়া, সূর্যটি  একদম ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো লাগছে।       

সিফাত লিলিকে বলছিল তুমি গান গাইতে পারো? 

— না। তুমি পারো? 

— পারি। 

— তবে একটা গান গেয়ে শোনাও।                               

সিফাত লিলিকে গান গেয়ে শোনায় —

‘যমুনা পুলিনে কদম্ব কাননে 

কি হেরিনু সখী আজ! 

শ্যাম বংশীধারী মণিমঞ্চোপরি 

লীলা করে রসরাজ।…… 

আমি  ঘরে না যাইব বনে 

প্রবেশিব ও লীলা রসের তরে, 

ত্যাজি কুললাজ ভজ ব্রজরাজ 

বিনোদ মিনতি করে।’

সিফাত লিলিকে ডাকে — লিলি…. 

— জ্বী। 

— আমি ঢাকা যেয়ে মা বাবাকে বলে তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাব। তুমি ওখানে যেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে। পড়াশোনা করবে। 

— সত্যি তুমি নিয়ে যাবে আমাকে? 

— সত্যি বলছি।                

সন্ধ্যা নামে সুবর্ণরেখার তীরে।  আঁধার নামতে থাকে ধীরে। একসময় সত্যি বেশ রাত্রি হয়ে যায়। ওরা দুজন হেঁটে হেঁটে চলে আসে প্রান্তরের দিকে। 

কী সুন্দর রাত্রির অন্ধকার।  আকাশ ভরা নক্ষত্ররাজি। ওরা হাঁটছে আকাশের নীচে দিয়ে নক্ষত্রের আলো দেখে পথ চিনে চিনে। লিলি আগে, সিফাত পিছে। চলতে চলতে  লিলি হঠাৎ আর্তনাদ শুনতে পায়। পিছনে ফিরে সে দেখে — দুটো ছেলে মুখোশ পরে বেয়নেট দিয়ে সিফাতের বুকে পেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। 

সেই রাত্রির চরাচরে ফসলের ক্ষেতের ভিতর  নিস্তেজ দেহে শুয়ে থেকেছিল সিফাত। তার দুচোখ তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছিল নিষ্পলক। আত্মার শেষ অনুভবে হয়ত সে ভেবেছিল —  লিলি নিতান্তই একটি অনাথ বালিকা, ওর ওপর আমার এইজন্য  কি অনুকম্পা জেগেছিল?  ওর জন্য মায়া হয় আমার। ওর সকল দুঃখ, বিপদ থেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছা হয়। 

সুবর্ণরেখা নদী বয়ে চলবে আরও বহুকাল।      

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন