৭. রিনি আন্টি

কোয়েল তালুকদার

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। রেজাল্টও বের হয়নি। অনেকটা না চাইতে বৃষ্টির মতো একটি সরকারি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকুরি পেয়ে যাই। চাকুরিটা ভালো লেগেছিল এইজন্য যে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পকাজের মূল্যায়নের জন্য সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াতে হবে। আমরা কুড়িজন গ্রাজুয়েট ছেলেমেয়ে একসাথে যোগদান করেছিলাম ঐ প্রকল্পে কাজে। একটি আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, যোগদানকৃতদের মধ্যে আমরা ছিলাম দশজন ছেলে এবং দশজন মেয়ে। 

সম্ভবত অফিসের তৃতীয় দিন হবে। অফিসে গিয়ে দেখি- একজন স্মার্ট ও সফিসটিকেটেড মেয়ে হালকা ঘিয়ে রঙের একটি টাংগাইলের শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথার চুল বয়কাট করা। সিঁথি করা নেই। কিন্তু সিঁথির চুলের কাছে সিঁদুর লাগানো। হাতে শাখাপলা পরা। বয়স আমার চেয়ে দুতিন বছরের বড়ো হবে। লাবণ্যভরা মুখশ্রী তার। এক ধরণের কোমল সৌন্দর্য সারা মুখোয়বে ছড়িয়ে আছে। কেমন দেবী দেবী লাগছিল মেয়েটিকে।

সবার সাথে ওর পরিচয় হলো। ঐ মেয়েটি যখন ওর নাম পরিচয় বলছিল — তখন জানলাম, মেয়েটির নাম আয়েশা নূর।

একটু বিস্মিতই হলাম। মেয়েটির মুসলিম নাম। অথচ হাতে তার শাখা পলা পরা, সিঁথিতে সিঁদুর। আমার মতো সবাই অবাক হলো ব্যাপারটি দেখে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ কেউ কিছু বললো না। ভাবলাম, সবকিছুই পরে জানা যাবে।

আমাদের নতুন সহকর্মীদের ভিতর প্রথম থেকেই একটি ‘তুমি’ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যেহেতু আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ  থেকে সদ্য পাশ করা তরুণ তরুণী, তাই হয়তো এমনটি হয়ে উঠেছিল। সহকর্মী নয়, আমরা সবাই যেন বন্ধু বান্ধবীর মতো। শিক্ষা সফরের ন্যায় ছোট ছোট গ্রুপে অফিসিয়াল ট্যুরে সারা বাংলাদেশে শহর গঞ্জ ঘুরে বেড়াতাম। বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই থাকতে হতো।

আয়েশা নূরের সাথে আমার বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটি ছিল একদম নিরহংকারী, অমায়িক ও স্বল্পভাষী । ওর বাবা ছিল অনেক বড়ো ব্যবসায়ী। ধানমণ্ডিতে ওদের বাড়ি। এত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে কেন যে একটি অস্থায়ী চাকরি করতে এল! এই কথাটাই ভাবতাম। 

আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে। কেমন যেন সরল পাগলামি ছিল ওর ভিতর। সম্পূর্ণ একটা আলাদা ধরণ। পরিবারের সাথে একটু মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আমরা পরে জেনেছিলাম — আয়েশা নূর একটি হিন্দু ছেলেকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি। কী কারণে এই বিচ্ছেদ — তাও জানা যায়নি। 

ওকে একদিন কী মনে করে বললাম — তুমি তো আমার বয়সে বড়ো। আমার এক ছোট খালার নাম আয়েশা।  তোমাকে আমি খালা বলে ডাকব। মেয়েটি আমার প্রস্তাব লুফে নিল — বললো, আজ থেকে তুমি আমাকে রিনি আন্টি বলে ডাকবে। উল্লেখ্য — মেয়েটির ডাক নাম ছিল রিনি। ঐদিন থেকে আয়েশা নূর আমার রিনি আন্টি হয়ে গেল।

অফিসে এবং অফিসের বাইরে আমি ওর সহকর্মীর চেয়ে একজন ভাগ্নে হিসাবে মর্যাদা পেতে থাকলাম। প্রায় প্রতিদিন আমাকে অফিসে লাঞ্চ করাতো। সে বাসা থেকে বেশি করে খাবার নিয়ে আসতো। আমাকে বাইরে খেতে দিত না।

অফিসে হঠাৎ কখনও কখনও রিনি আন্টিকে খুব মন খারাপ দেখতাম — বলতাম, ‘তোমার কী হয়েছে আজ? মনখারাপ করে আছ যে!’ সে বলতো, না, কিছুই হয়নি আমার।’ মাঝে মাঝে আন্টিকে বলতে ইচ্ছে করতো — তুমি সিঁথিতে সিঁদুর পরে থাকো কেন?  কিন্তু বলতে সাহস হতো না। কারণ, সে ছিল দারুণ জেদি ও অভিমানী মেয়ে। ওর সাথে মিশে এই ব্যাপারটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

একবার অফিস থেকে আমরা  কয়েকজন অফিসমেট ট্যুরে পটুয়াখালী যাচ্ছিলাম। সেই টিমে রিনি আন্টিও ছিল। একটি বড়ো লঞ্চ  সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর ছেড়েছিল। আমরা সেই লঞ্চের যাত্রী ছিলাম। কেবিনে কেউ কেউ সময় কাটানোর জন্য তাস খেলছিল, কেউ কেউ গল্প করছিল। লঞ্চটি তখন চাঁদপুর পার হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করছিল। রিনি আন্টি কারোর সাথে কথা বলছিল না। আমমনা হয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার মন খারাপ দেখে আমারও মনটা ভালো লাগছিল না। 

রিনি আন্টি আমাকে ডাকে — রঞ্জন। 

— জ্বি। 

— চলো, বাইরে গিয়ে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে মেঘনার জল দেখি।

— চলো। 

বাইরে রেলিঙের কাছে এসে দেখি — আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ।  সারা আকাশ ছেয়ে আছে তারায় তারায়। আমরা দুজন রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে শুনছি মেঘনার ছলাৎছলাৎ জলের শব্দ। জলের উপর পড়া চাঁদের প্রতিবিম্ব ঢেউ লেগে ভেঙে যাচ্ছে। তারাদের কোনও ছায়া নেই। ওদের কোনো প্রতিবিম্বও নেই।  দূরে চাঁদপুর শহরের জ্বলে থাকা নিওন বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে।  আমি রিনি আন্টিকে ডাকি —

— রিনি আন্টি। 

— বলো রঞ্জন। 

— তুমি এত মনখারাপ করে আছ কেন? 

— এখন রাত্রি কয়টা বাজে? 

আমি আমার ঘড়ি দেখে বললাম — রাত দেড়টা। 

রিনি আন্টি কিছুক্ষণ জলের দিকে নীরব হয়ে চেয়ে রইল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে নেয় কমলা রঙের বিশালাক্ষি চাঁদ। আমি চেয়ে দেখলাম আন্টির চোখ ছলছল করছে। চোখে জল ভরে আছে কী না আঁধারে বুঝতে পারলাম না। খুব ভেজা কণ্ঠে সে বলছিল —

‘ জানো রঞ্জন, আজ এই চন্দ্রতারার পবিত্র রাতে, মেঘনার ঐ জলের দিকে চেয়ে জল ছুঁয়ে বলছি — প্রতিদিন এইরকম মধ্যরাত পর্যন্ত আমি জেগে থাকি, ঘুম আসে না চোখে। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে একটি প্রদীপ জ্বালাই। তারপর অন্য আলোগুলো নিভে দেই। প্রদীপের আলোর দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে যাই।

অন্ধকারে প্রদীপের আলো ক্রমে নিস্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। আলোর মধ্যে কেমন যেন শূন্যতা দেখতে পাই। সেই শূন্যতার ভিতর একটা মুখ ছবির মতো ফুটে উঠে। একদম জীবন্ত মুখ, চোখের দৃষ্টিতে তার প্রাণপূর্ণ সজীবতা। সেই মুখখানার দিকে আমি মগ্ন হয়ে চেয়ে থাকি। নির্মল সেই  মুখখানি দেখতে দেখতে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। একসময় প্রদীপের সলতে পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। প্রদীপ নিভে যায়। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে ওঠে। সেই নিস্তব্ধ আঁধারের ভিতর সেই মুখটি আর দেখতে পেতাম না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। এবং কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে যাই।

জানো রঞ্জন, প্রদীপের আলোয় যে মুখখানি আমি দেখি- সেই মুখটি আমার প্রদীপের। সেই অবয়বটি প্রদীপ দেব বর্মনের। 

— সে এখন কোথায় আছে?  আমাকে বলবে? 

— সে নেই। কোথায় আছে, তাও জানিনে। 

— আমি বেশি কিছু জানতে চাইলাম না।  শুধু বললাম, তুমি সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে শাখাপলা পরে থাকো কেন? 

— এমনি, তাকে স্মরণ করে পরে থাকি।

আমরা পটুয়াখালীর ট্যুর শেষ করে  ঢাকায় চলে আসি।  লঞ্চে ফিরতে ফিরতে রিনি আন্টি  বলেছিল — ‘আমার জীবনের কিছু গোপন ব্যাথার কথা এই তরঙ্গ নিনাদের জলপথে চলতে চলতে কেবল তোমাকেই বললাম। এই কথা আর কাউকে বলো না।’

— না, বলব না।

দিনের পর দিন আমি রিনি আন্টির অবিসংবাদিত একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। আমিও তাকে সময় দেই। আমি চাইতাম, আমার এই রিনি আন্টি মনের দিক থেকে ভালো থাক। সে ভুলে যাক, একজন প্রদীপ দেব বর্মনকে। সে ভুলে যাক তার বিষণ্ণ অতীতকে। নতুন কোনও জীবনের গান সে শুনুক। 

কতো বিকেলে রিনি আন্টি আমাকে নিয়ে গেছে এই শহরের  কত জায়গায়, কত রেস্টুরেন্টে। নিয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। কত সন্ধ্যা অবধি বসে থেকেছি রবীন্দ্র সরোবরে। কড়োই গাছের কত শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে, শুনেছি কত পাখিদের কিচিরমিচির।  কত বিমল সন্ধ্যা নেমেছে ছায়ার মতো অন্ধকারে। তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই পংক্তিগুলো ধ্বনিশ্রুত হতো কানে —

‘…মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব

বেদনার গন্ধ ভাসে….

কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি 

বুঝেছি এই সব;

সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি

ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি 

এইসব…।’

একবার  কী এক অসুখ হলো আমার। ঠাণ্ডা জ্বর ও কাশি।  কয়েকদিন অফিসে যেতে পারিনি। আবার অফিসে খবরও দিতে পারিনি। থাকতাম আমি আমার নির্জন বাড়িতে একা। তখন বিকাল হয়ে এসেছিল। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে রয়েছিলাম। হঠাৎ ঘরের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আধো অন্ধকারে  চোখ মেলে দেখি — একটি মেয়ে আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করে দেখলাম, রিনি আন্টি।  বললাম — ‘  তুমি হঠাৎ এখানে ? চিনলে কীভাবে বাড়ি?’

— হ্যাঁ আমি। পথ চিনে চিনেই এলাম তোমার ঘরে। তা তোমার কী হয়েছে ? কোনও অসুখ হয়েছে? অফিসে যাও না কেন? 

— সামান্য অসুখ হয়েছে। ভালো হয়ে যাব। দুএক দিনের মধ্যে অফিসে যাব।

— ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালওনি যে। 

— এখানে নিওন বাতি এখনও আসেনি। হারিকেন জ্বালাতে হয়।

সেদিনের সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে রিনি আন্টি আমার ঘরে  আলো জ্বালালো।  তার আঙ্গুলের করস্পর্শ পড়লো আমার কপালে। ক্ষিণ মায়াকণ্ঠে বললো– ‘এইভাবে কোনকিছু না জানিয়ে কেউ কখনও থাকে? কারোর বুঝি দুশ্চিন্তা হয় না?’ 

রিনি আন্টি  আমাকে খাবার খাওয়ালো। ঔষধপথ্য কী খেয়েছি, না খেয়েছি সবকিছুর খোঁজ নিলো। 

আর একবার আমরা বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে  ট্যুরে গিয়েছিলাম যশোরের ঝিকরগাছায়। আমরা ছিলাম ওখানকার একটি ডাকবাংলোয়। অফিসিয়াল এ্যাসাইনমেন্টে আমাকে আর রিনি আন্টিকে যেতে হবে গদখালি ইউনিয়নের একটি গ্রামে। 

তখন ছিল জৈষ্ঠ্যের তপ্ত দুপুর। বাংলো থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকি।  ভালোই লাগছিল পাকা রাস্তার উপর বড় বড় রেইনট্রির ছায়া। কী সুন্দর রোদ্দুর এসে পড়ছিল আমাদের গায়ে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় মেঠো আলপথে নেমে পড়ি। 

হেঁটে যেতে যেতে পথের দুপাশে দেখেছিলাম গ্লাডিওলাস ফুলের প্রান্তর। রঙ বেরঙের ফুলের ফাঁকে ফাঁকে গ্রীষ্মের ফালি ফালি রোদ খেলা করছে ঝাড়ে । কখনও গ্লাডিওলাসের সৌরভের সাথে কেমন যেন মৌ মৌ সুর ধ্বনিত হচ্ছিল বাতাসে। কেমন যেন মর্মর মায়া হিল্লোলিত হচ্ছিল মেঠো পথের ধূলির উপরে। বাঁশি বেহালা আর পিয়ানো যেমন করে অ্যাকর্ডিয়নে একের পর এক মায়া জড়িয়ে যায়, তেমন করে নির্জন ফুলের প্রান্তরে ভালবাসার পাখিরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।

এখানে কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে এত ফুল, এত সৌরভ, উপর থেকে ঝুলে পড়া এমন নির্জন নীল  আকাশ, ফুলের বনে ফড়িং আর হলুদ প্রজাপতিদের এত গান। মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাাগছিল। আমি রিনি আন্টিকে বললাম — দেখো, চারিদিকে চেয়ে। আমরা এসেছি ফুলের দেশে।  দেখো চেয়ে পথের দুপাাশের আচ্ছাদিত ফুলের প্রাান্তর।  চলো আমরা এই ফুলের পাশ দিয়ে ওদের সুগন্ধি নিয়ে হাঁটতে থাকি। আমরা যাব এখন কৃষ্ণপুর গ্রামে। যদি ক্লান্তি লাগে ফুলের বনে ঝাড়ের পাশে জিরিয়ে নিও। 

আমরা হাঁটছি। দেখলাম– গ্লাডিওলাসের পর শুরু হলো হলুদ গাঁদা ফুলের প্রান্তর।  অফুরন্ত সেই ফুলের পথ!  হাঁটতে হাঁটতে রিনি আন্টি যেন আর পথ চলতে পারছিল না। সে বসে পড়লো। রিনি আন্টি বলছিল, রঞ্জন, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে একটু ঘুমাই? 

– আচ্ছা ঘুমাও্।

সেইদিন সেই দুপুরে ফুলের ক্ষেতের পাশে  ক্লান্তিতে আমার কাঁধে মাথা রেখে  ঘুমিয়ে গিয়েছিল রিনি আন্টি। 

ঘুমঘোর নাকি স্বপ্ন? জানিনা। দেখলাম- রিনি আন্টি নীল রঙের একটি গোলাপ ফুল হয়ে লক্ষ লক্ষ গাঁদা ফুলের মাঝে হারিয়ে গেল। তার শরীরময় গাঁদা ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু লেগে আছে। চেয়ে দেখি – আমার সর্বশরীরেও গাঁদা ফুলের অসংখ্য হলুদ জখমের দাগ। 

রিনি আন্টি একসময় জেগে ওঠে। চারদিকে ছিল তখন অসীম মৌনতা। হঠাৎ সেই মৌনতা ভঙ্গ করে আন্টি আমাকে বলে– ‘এবার ঢাকা গিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেবো।’

আমার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। আমি বললাম — কী হয়েছে তোমার রিনি আন্টি? 

— কিছু না। 

— তা চাকুরি ছেড়ে দেবে কেন? 

— এমনই। চাকুরি করতে আর ভালো লাগছে না। 

আমি সেইদিন সেই ক্লান্ত দুপুরে রিনি আন্টিকে কিছুই বললাম না।  আমি জানি, রিনি আন্টি খুব জেদি মেয়ে। সে যা বলে তাই করে। 

যশোর ট্যুর শেষ করে আমরা ঢাকায় চলে আসি। দুইদিন বাড়িতে রেস্ট নিয়ে তৃতীয় দিনের দিন অফিসে যাই। অফিসে গিয়ে দেখি — রিনি আন্টি আসেনি। পরের দিনও এল না। তারপরের দিনও এল না। রিনি আন্টি আর কোনদিন অফিসে আসেনি। এ্যাকনোলজমেন্ট করা একটি রেজিস্ট্রি ডাকে সে তার পদত্যাগ পত্র অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

অফিসটা কেন জানি আর ভালো লাগছিল না। কোথাও কী এক গভীর শূন্যতা আঁকড়ে ধরতো আমাকে। রিনি আন্টির সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম দেখা করতে , কিন্তু তার দেখা পাইনি।  ওনাদের বাড়িতে আগে থেকেই কাউকে নিত না সে। আমাকেও না।  হয়তো পারিবারিক কোনো অসুবিধা ছিল। 

আমি এই অফিসটা ছেড়ে দিয়ে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে যাই। ইতোমধ্যে জীবনে আরও কতগুলো ওলট-পালট হয়ে গেল। বছর তিনেক পর বিয়ে করলাম। রিনি আন্টির শূন্যতায় এই পৃথিবী কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। জীবনটা বিস্বাদ হয়ে থাকতো, আশা-আনন্দের কোনও অনুভবই অনুভূত হতো না। 

তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেল। নতুন জীবনে আনন্দের স্বাদ পেলাম। জীবনটাকে আর আনন্দহীন করে রাখলাম না। কত বড় বড় সুখের আতিশয্যে জীবনকে ব্যাপৃত করে রাখলাম। কবেকার সেই একজন  রিনি আন্টির স্নেহ ভালোবাসা অন্তর থেকে মুছে যেতে লাগলো। একদিন যে স্নেহ মমতা পরম বলে মনে হতো, তা একদিন তুচ্ছ হয়ে গেল।  

অনেক বছর পর একটি ব্যাবসায়িক কাজ শেষ করে ফরিদপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। ফেরীতে পার হচ্ছিলাম পদ্মা নদী। ফেরীটি যখন আরিচা ঘাটে ভীড়ছিল, তখন দেখি — একটি মধ্যবয়সী রমণী পদ্মা তীরে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় আধো ঘোমটা দেওয়া। চিনলাম তাকে। এ যে আমার সেই রিনি আন্টি।  আমি ফেরী থেকে নেমে তার কাছে যাই। ডাক দেই — রিনি আন্টি।

রিনি আন্টি  স্থিরদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে দেখলো কতক্ষণ । তারপর বললো — তুমি কেমন আছো রঞ্জন? 

বললাম — ভালো আছি। তবে তুমি এখানে কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি ? 

 —  আমার জীবনের কত কথাই তোমাকে বলা হয়নি। তুমি হয়তো আমাকে ভুল বুঝেছিলে — কেন সেদিন অফিস ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে অমন আচম্বিতে চলে এসেছিলাম। তুমি চেয়ে দেখো – আমার সিঁথিতে এখনও সিঁদুর লাগানো আছে, হাতে এখনও শাখাপলা পরে থাকি।  আজ এই পদ্মাতীরে দাঁড়িয়ে তোমাকে একটি  কঠিন সত্য বলছি — কেন জানি আমার মনে হয়েছিল — আমার সিঁথির সিঁদুর তুমি মুছে ফেলবে একদিন, হাতের এই শাখাপলা তুমি খুলে ছুড়ে ফেলে দেবে কোনও অতল দিঘিতে। তাই সেদিন তোমাকে ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম।  আর… 

— বললাম, আর কী? 

রিনি আন্টিকে বহন করা গাড়িটা তখন ফেরীতে উঠার জন্য বারবার হুইসেল দিচ্ছিল। রিনি আন্টি গিয়ে গাড়িতে বসে। গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি বলেছিল — ‘আমি একটি স্মরণ কাজে বের হয়েছি। মনে আছে কী তোমার…..।’

তার কথাটি ছিল অসমাপ্ত। শেষ শুনতে পারিনি।

ফেরীটি ততক্ষণে কর্কশ হুইসেল বাজিয়ে কালো ধূয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছেড়ে চলে যায়। আমি চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ পদ্মার আলোড়িত জলের দিকে।

পুনশ্চঃ–

যদি কোনদিন এই পৃথিবীর কোথাও  রিনি আন্টির সাথে আবার দেখা হয়, তবে তার সেই অসমাপ্ত কথা ও তার জীবনের আরও কিছু কথা জেনে এই আখ্যানের বাকিটুকু পূর্ণ করে দেবো।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন