কোয়েল তালুকদার
একটি সরকারি প্রকল্প কাজের মূল্যায়নের জন্য আমরা কয়েকজন শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা ফরিদপুরের নগরকান্দায় গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল আশির দশক। আমাদের সাথে তিনজন মেয়েও ছিল। আমাদের টিম লিডার শওকত সাহেব ছাড়া আমরা বাকী ছয়জন ছিলাম নবীন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল থানা পরিষদের ডাকবাংলোয়।
রাতে ব্রিফিং সভায় শওকত সাহেব বললেন — ‘আপনি আর নাসরীন আপনারা দুজন আগামীকাল যাবেন ফুলসুতি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সকালে যাবেন, সন্ধ্যার আগেই কাজ সেরে বাংলোয় ফিরে আসবেন।’
আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে নবনির্মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পরিদর্শন করা ও সেখানকার জনসাধারণ উক্ত কেন্দ্র থেকে কেমন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া।
আমরা যথারীতি সকালে রওনা হই।
নদীর নাম ভুবনেশ্বর। আশ্বিনের স্তিমিত খরস্রোত তখন নদীটিতে। আমরা একটি রিক্সায় করে চলে আসি এর পাড়ে। ওপাড় যেতে হবে। একটি বড়ো খেয়া নৌকা ভিড়ে আছে ঘাটে। নৌকাটির দুপাশে কাঠের বেঞ্চির মতো করা। নাসরীন নৌকায় উঠে বেঞ্চিতে বসে। আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকি। নৌকা ছেড়ে দেয়। দুজনেই দেখছি নদী। নাসরীনের খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। দুজনেরই মাথার উপর শরতের শুভ্র মেঘের আকাশ। মেঘের ফাঁকে স্বচ্ছ নীল আকাশও দেখা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরেই আমরা ওপাড়ে পৌঁছে যাই। ওপাড়ে নেমে দেখি, তিনটি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। একজন ভ্যান চালককে জিজ্ঞাসা করি – ভাই আমরা ফুলসুতি গ্রামে যাব।’ ভ্যানচালক বলল – ‘খালপাড় পর্যন্ত ভ্যানে যেতে পারবেন। তারপর আবারও ছোট্ট একটি খেয়া পার হতে হবে। তারপর আধা মাইল হেঁটে অথবা ভ্যানে করে ফুলসুতি যেতে হবে।
বললাম, তাই হবে। আমাদের খালপাড় পর্যন্ত নিয়ে চলো।
আমরা ভ্যানে বসে আছি। আশ্বিনের রোদ পড়ছে আমাদের গায়ের উপর। থানা পরিষদের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে জলের মাঠ। বন্যার জল রয়ে গেছে তখনও। আমনধানের ডোগা নুয়ে পড়েছে জলের উপর। পাটের ঝাঁকের পঁচা গন্ধ আসছিল জল থেকে। কাছে ও দূরে গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়িঘর। কোথাও আবার কোনো বাড়িঘর নেই। জলে ভাসা বিজন প্রান্তর। খুব ভালো লাগছিল পথ চলতে। কত বিচিত্র মানুষ দেখছি। কত বৃক্ষ, কত খোলা জায়গা দিয়ে চলছে ভ্যান। ভালো লাগছিল আরও আমার পাশে সুন্দরী একটি তরুণী বসে আছে। নাসরীনও মুগ্ধ হয়ে দেখছে মাঠ ঘাট মানুষ, গবাদিপশু ও জলের প্রান্তর।
আমি নাসরীনকে বলি — কেমন লাগছে তোমার এই গ্রাম ও পথ?
— খুব ভালো লাগছে! এত কাছে থেকে কখনও দেখিনি এমন গ্রাম। শহরে বড়ো হয়েছি। কী যে ভালো লাগছে এই মাটির পথ। ভাবছি, এই পথ যেন শেষ না হয়।
— তাই?
— হুম।
কিন্তু পথ দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। আমরা চলে আসি খালপাড়ে। দেখলাম, জায়গাটা খুব নির্জন। খেয়াঘাটে নৌকা নেই। ওপাড়ে যাত্রী নিয়ে চলে গেছে। নৌকা আসতে মিনিট কুড়ি দেরি হবে।
আমরা ঘাটেই দাঁড়িয়ে আছি। অদূরে চেয়ে দেখলাম, একটি পাকুড় গাছ্। গাছের তলায় ছোট্ট একটি খোলা টিনের চালা। কোনও বেড়া নেই। গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কয়েকজন লোক চিতায় লাশ পোড়াচ্ছে। বুঝতে পারলাম এটি একটি শ্মশান ঘাট। যার কারণে জায়গাটা এত নির্জন। যার কারণে হয়তো এখানে কোনও জন বসতি নেই।
একটুপর ছোট ডিঙি খেয়া নৌকাটি ঘাটে এলো। আমরা গিয়ে নৌকায় উঠি। আরও তিনজন যাত্রী এলো। তারাও নৌকায় উঠলো।
আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, ওপাড়ে যেয়ে একটি ভ্যান পাই। এবং ঐ ভ্যানে করেই বেলা বারোটার মধ্যেই ফুলসুতি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে যাই।
ফুলসুতি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার, নার্স, আয়া, পিওনসহ এলাকার গণ্যমান্যরা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। কেন্দ্রটি আমরা যথাযথ ভাবে পরিদর্শন করি। দেখি এর নির্মাণ কাজ ও স্বাস্থ্য পরিসেবামূলক কার্যক্রম।
স্বাস্থ্য সেবা কেমন পাচ্ছে ঐ এলাকার মানুষ তা জানার জন্য দুপুরের পর গ্রামে বের হই। আমাদের সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল দৈব চয়নের ভিত্তিতে কিছু সাধারণ মানুষ। আমরা একজোড়া দম্পতিকে পেয়ে যাই, নাম মোহনবাঁশি মালাকার আর তার স্ত্রী দিপালী মালাকার। তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আমি ও নাসরীন চলে যাই মোহনবাঁশি’র বাড়িতে। ওনারা ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রান্তিক মানুষ। একটিমাত্র ঘর তাদের। তারা এতই সহজ সরল ও আন্তরিক ছিল যে, ওনাদের থাকার ঘরটিতেই আমাদের বসতে দেয়।
আমি আর নাসরীন সবে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হওয়া উচ্ছ্বল তরুণ তরুণী। আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তা প্রেমের কথার মতো মনে হয়। মোহনবাঁশি আর দিপালী ধরেই নিয়েছিল আমি আর নাসরীন হয়তো স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক প্রেমিকা।
তখন দুপুরঅন্ত পরন্ত বিকেল। বাইরে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর। পিছনে বাঁশ ঝাড়ে ঘুঘু ডাকছে। কেমন উদাস হাওয়া বইছে বাইরে। ঝরে পড়ছে ঝরা পাতা টিনের চালের উপর। নাসরীনের চোখে মুখে চঞ্চলতার দোলা। দেখলাম, মোহনবাঁশি আর দিপালী আমাদের দু’জনকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। বন্ধ ঘরে তখন আমি আর নাসরীন, যেন সেই হিন্দী সিনেমার গানের মতো রোমান্টিক সময় পার করছি–‘ হাম তুম এক কামরা মে বন্দি হো, আউর চাবি খো যায়….।’
নাহ্ বন্ধ ঘরে আমাদের কোনো রোমাঞ্চ হয়নি।আমরা কোনো চাবিও হারাইনি। মোহন বাঁশীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা গ্রামের আরও কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেই। সাক্ষাৎ গ্রহণ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সব কাজ শেষ করে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে আসার উদ্দেশ্যে একটি ভ্যানে করে খালপাড়ের দিকে রওনা হই।
গ্রামে আঁধার নামে খুব তাড়াতাড়ি। খালপাড়ে আসতে না আসতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ভ্যানটি আঁধার ঠেলে খালপাড়ে চলে আসে। খেয়া নৌকার মাঝি তার নৌকাটি বেঁধে বাড়িতে চলে যাচ্ছিল। তাকে অনুরোধ করে নৌকা করে আমরা খালটি পার হই। খেয়ামাঝি বলছিল — ‘আপনারা কেন এই রাতে চলে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। ওপাড়ে যদি ভ্যান না পান?’
এপাড়ে এসে দেখি সত্যি কোনো ভ্যান নেই। কোনো মানুষজন নেই। মেঘ ডাকছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। কী করব? খুব ভয় ভয় লাগছে। পিছনে ফিরে দেখি খেয়ামাঝি নৌকা ছেড়ে দিয়ে ওপাড়ে চলে যাচ্ছে।
আমরা রাস্তার উপর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করতে থাকি ভ্যানের জন্য। ইতোমধ্যে গুড়িগুড়ি করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।
আমার মনে পড়ে গেল, যাওয়ার সময় পাকুড় গাছতলায় একটি টিনের চালা দেখে গিয়েছিলাম। আমি নাসরীনকে বললাম — চলো, ঐ টিনের চালার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। নাসরীনও বলল — হ্যাঁ, তাই চলো।
আমরা দুটো মানব মানবী টিনের চালার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হয়ে যায়। চিতা থেকে লাশ পোড়ানো কাঠের উটকো গন্ধ আসছিল। বিদ্যুৎ চককানোর আলায় দেখতে পেলাম, পাকুড় গাছের ডাল ভর্তি শকুন বসে আছে। কুৎসিত স্বরে ডাকাডাকি করছে। একে অপরে কামড়াকামড়ি করছে। শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে।
নাসরীন বলছিল — আমার খুব ভয় লাগছে। কী করব! আজ মনে হয় মরেই যাব।
আমারও খুব ভয় লাগছিল কিন্তু সে কথা নাসরীনকে বুঝতে দিলাম না। ওকে বললাম, ‘ বৃষ্টি থেমে যাবে। আমরা ভ্যান পেয়ে যাব।’
আমরা প্রার্থনা করছিলাম- বৃষ্টি যেন তাড়াতাড়ি ছেড়ে যায় এবং একটা ভ্যান যেন পেয়ে যাই। নইলে দেড় মাইল রাস্তা এই রাতে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। এইসব ভাবছি, আর অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি পথের দিকে।
হঠাৎ পিছনের দিক থেকে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা দুজনেই পায়ের শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেই দিকে তাকাই। দেখি – খালের দিক থেকে একটা লম্বা গোছের লোক হেঁটে হেঁটে আসছে। সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। ভয়ে আঁৎকে উঠি। এযে মানুষ নয়! এ একটি লাশ। লাশ হাঁটে কী করে? নাসরীন ভয়ে আমার হাত চেপে ধরে। লাশ দেখতে না দেখতে দেখি — এযে একটি কঙ্কাল। কঙ্কালটি হেঁটে হেঁটে অট্টহাসি দিয়ে আমাদের দিকে আসছে! নাসরীন আমার বুকে বুক রেখে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে। ওর দুই হাত আমার দুই পাজর শক্ত করে ধরে থাকে। আমিও ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে থাকি।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলি। দেখি কঙ্কালটি নেই। পাকুড় গাছের ডালে শকুন উড়াউড়ি করছে। বৃষ্টি আরও জোরে নামা শুরু করেছে। আমি নাসরীনকে বলি – কঙ্কাল নেই। চলে গেছে। নাসরীন আমার পাঁজর জড়িয়ে ধরা ওর হাত দুটো ছাড়িয়ে নেয়।
কিছুক্ষণ ভালোই ছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ গুরুম গুরুম করছে। হঠাৎ আবার কেমন যেন একটা গোঙানির শব্দ আসছিল পিছনের দিক থেকে। শব্দটা ক্রমেই খুব কাছে থেকে শোনা যাচ্ছিল। দেখি, কালো বিদঘুটে একটি লোক দাঁড়িযে আছে খালের পাড়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখা যাচ্ছিল তার কুচকুচে শরীর। সে অনেকটা উলঙ্গ। সামান্য নেংটি পরে আছে। তার গলাটি কাটা। কাটা গলা দিয়ে রক্ত গলগলিয়ে ঝরে পড়ছে। আর গোঙাচ্ছে। ও বাবা! ঐ গলাকাটা লোকটা আমাদের দিকে হামলে আসছে গোঁ-গোঁ শব্দ করে। নাসরীন এবারও জোরে চিৎকার করে দুুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে। এবং কাঁদতে থাকে হাউমাউ করে বুকে মুখ লুকিয়ে। আমিও আর্ত চিৎকার করে আল্লাহর নাম ডেকে চোখ বন্ধ করে থাকি। বেহুশ হয়ে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলাম জানিনা।
নাহ্ ঐ লোকটা আমাদের ছোঁয় নি। দুরুদুরু বুকে চোখ খুলি। তাকিয়ে দেখি, লোকটা নেই। আমরা ভয়ে ভয়ে দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। বৃষ্টি একটু কমে গেছে। আমি নাসরীনকে ডাকি। বলি – চোখ খোলো। কিছু নেই। সব আপদ চলে গেছে। নাসরীন চোখ খোলে। বাহু বন্ধনও খুলে ফেলে আমার পাজর থেকে। বুক থেকে সরিয়ে নেয় ওর বুক।
একটু পর দেখতে পেলাম – রাস্তার দিক থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে একটি ভ্যান আসছে। পিছের আরও একটি ভ্যান যাত্রী নিয়ে খেয়াঘাটে এসে পৌঁছে। ওনারা খেয়ানৌকা ও খেয়ামাঝিকে খুঁজছে। আমরা একটি ভ্যানচালকের সাথে কথা বলে তার ভ্যানে উঠি। এবং চলে আসি ভুবনেশ্বর নদীর তীরে। তারপর খেয়া পার হয়ে রিকশায় ডাকবাংলোয়।
পরিশিষ্ট —
আমাদের চাকুরীটা ছিল খুব অস্থায়ী। কিছুদিনের মধ্যে নাসরীন অন্য জায়গায় চাকুরী নিয়ে চলে যায়। আমিও চাকুরী নিয়ে অন্যত্র চলে যাই। আমি আর নাসরীন পরবর্তীতে কেউই একে অপরের বন্ধু হতে পারিনি। তারপর কত বছর চলে গেছে! কিন্তু অনেক আগের সেই দূর্যোগময় রাতের কথা, আমাকে জড়িয়ে ধরে নাসরীনের সেই প্রগাঢ় আলিঙ্গনের কথা, আমার বুকের ভিতর তার আশ্রয় নেবার কথা মনে হলে আজও আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই।
নাসরীনের কী মনে পড়ে না দূর্যোগময় সেই রাতের কথা? মেঘগুরুগম্ভীর অদ্ভূতুরে এক ভয়ার্ত ক্ষণে একটি ছেলের বুক জড়িয়ে ধরে সে নিরাপদে ছিল কিছুক্ষণ! তার বুকের মাঝে মাথা রেখে পরম আশ্রয়ের কথা মনে করে আমার মতো তারও মন কী একটুও বিবশ হয়ে উঠে না!
হয়তো উঠে, হয়তো না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন