কোয়েল তালুকদার
তখনও মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়নি। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতো প্রাপ্তি। চাকুরির আবেদন পাঠাতে না পাঠাতেই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদে আমার চাকুরি হয়ে যায়।
মতিঝিলে অফিস। নতুন চাকুরিস্থলে ভালই লাগছে আমার। সবাই আমাকে খুব সহযোগিতা করছে। সবাই আমাকে ভালোবাসে।
একদিন এক সিনিয়র সহকর্মীর সাথে আমি পুরনো ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার ও ইসলামপুরে গিয়েছিলাম ওখানকার কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে। আমরা মতিঝিল থেকে একটি রিকশা নিয়ে প্রথমে চানখাঁর পুল গিয়ে নামি। ওখান থেকে হেঁটে নাজিমুদ্দিন রোড ধরে সেন্ট্রাল জেল পর্যন্ত যেতেই আমার সিনিয়র সহকর্মী মাহবুব ভাই বললেন — বেগমবাজারে আমার এক মামাত ভাই থাকেন। শুনেছি দীর্ঘদিন ধরে উনি বেশ অসুস্থ। এদিকে যেহেতু আসলামই। ওনাকে একটু দেখে তারপর আমাদের কাজ শুরু করব।’
আমরা হেঁটে হেঁটেই বেচারাম দেউরি পার হয়ে একটি সরু গলিতে ঢুকি। গলির একদম শেষ মাথায় অনেক পুরানো একটি আধাপাকা টিনসেড বাড়ি। সেই বাড়িতে ওনারা থাকেন। বাড়িটার বাইরে পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে। ফাটলের ফাঁক দিয়ে প্রচুর লতাগুল্ম জন্মেছে। গলির সাথে সদর দরজা। এই দরজা দিয়েই সরাসরি রুমে ঢুকতে হয়।
মাহবুব ভাই দরজায় কড়া নাড়তেই একজন পয়ত্রিশ-উর্ধ্ব বয়সী লোক দরজা খুলে দেন। বুঝতে পারলাম, ইনিই আমার সহকর্মী মাহবুব ভাইয়ের আত্মীয়।
ঘরখানা দেখে মনে হলো- দুটো রুম এখানে। পাশে একটা ছোট বারান্দার মতো আছে , সেটাও রুমের মতোই, রান্নাঘর হবে। আমরা প্রথম রুমটাতেই বসলাম। ঘরের আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিস সামগ্রী দেখে মনে হলো, এরা হতদরিদ্র।
মাহবুব ভাই, লোকটির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওনার নাম জাকির হোসেন মন্টু। উনি একজন ভালো হারমোনিয়াম ও তবলাবাদক। গানও গান। গানের শিক্ষকও তিনি। পুরনো ঢাকার একটি গানের স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ওনাকে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কেমন রোগক্লিষ্ট। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হলো, উনি একসময় সুদর্শন ছিলেন। চোখ কোটরে গেলেও চোখদুটো দেখতে বেশ টানা টানা। লম্বা দেহগড়ন, কণ্ঠস্বর অপূর্ব মাধুর্যময়। পুরুষও এত সুন্দর হয়!
ওনার সাথে আলাপচারিতার মধ্যেই উনি পরপর দুটি সিগারেট খেয়ে ফেললেন। আমি অবাক হলাম, এমন একজন রোগা মানুষ এত সিগারেট খায়? ওনাকে বললাম – ভাই আপনি এত সিগারেট খান কেন? আপনার শরীরের যে অবস্থা, এত সিগারেট খাওয়া ঠিক নয়।’ উনি ম্লান হেসে বললেন — ‘আমি সব ছেড়ে দিতে পারি- আমার গান, হারমোনিয়ামের সুর, তবলার ঝংকার, ঘর, সংসার, স্ত্রী, স্বজন সব। কিন্তু সিগারেট ছাড়তে পারব না। সিগারেট ছাড়া আমি বাঁচতে পারব
না।’
— আপনি তো সিগারেট খেতে খেতে মরে যাবেন।
— মরে গেলে মরে যাব। তবুও।
জীবনে অনেক সিগারেটখোর মানুষ দেখেছি। কিন্তু এমন মৃত্যুর সাথে জুয়া ধরে সিগারেট খেতে কাউকে দেখিনি। লোকটিকে দেখে রাগও হলো, আবার মায়াও হলো। জানিনা, জীবনের কোন্ পরাজয়ে তার এই অধপতন!
আমরা যখন কথা বলছিলাম — তখন পাশের রুম থেকে আধো ঘোমটা দিয়ে একজন স্ত্রীলোক চলে আসেন আমাদের বসার ঘরে। গায়ের রং ফর্সা তার, কালো চুল, মায়া জড়ানো দুটো চোখ, হ্যাংলা পাতলা দেহগড়ন, বয়স কতই হবে- সাতাশ আটাশ। কী অপূর্ব সুন্দর সে দেখতে। একদম ছবির মতোন!
মাহবুব ভাই পরিচয় করে দিলেন ইনি আমাদের রোজী ভাবী। আমাকে দেখিয়ে বললেন — ও আমার জুনিয়র কলিগ – আরিফ রহমান। মাহবুব ভাই ওনাকে রসিকতা করে বললেন, ভাবী, তুমি ওকে দেবরও ভাবতে পারো, ছোট ভাইও মনে করতে পারো। খুব ভালো ছেলে। একদম সহজ সরল।
মনে মনে কামনা করছিলাম, আমি এই অপূর্ব সুন্দর মেয়েটির দেবর হতে চাই না। ছোট ভাই হতে চাই। কেমন যেন দিদি দিদি সরল মুখোয়ব তার। কিন্তু উনি আমার এই আশাকে হতাশ করে দিয়ে সহাস্যে বললেন — ‘ এ আমার নবীন দেবর’।
মন্টু ভাই ওনাকে বললেন, ‘ রোজী, তা তোমার এই দেবরদ্বয়কে নাস্তাপানি কিছু খেতে দাও।’ এ কথা শুনে রোজী ভাবীর মুখটা মলিন হয়ে যায়। বুঝতে পারলাম, খেতে দেওয়ার মতো ঘরে হয়তো তেমন কিছু নেই। মন্টু ভাইও বুঝতে পেরে বললেন – ‘বাইরে থেকে কিছু কিনে নিয়ে আসো’। এবারও ভাবীর মুখটা আরও বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল। বুজতে পারলাম, ঘরে হয়তো টাকাও নেই।
ভাবী চলে গেলেন।
এরই ফাঁকে অনেক কথাই হচ্ছিল মন্টু ভাইয়ের সাথে। একসময় তিনি রেডিওতে তবলা ও হারমোনিয়াম বাজাতেন। বড়ো বড়ো গানের অনুষ্ঠানে যেতেন যন্ত্রীদলের সাথে। অসুখের কারণে এখন আর যেতে পারেন না।
আলাপের মাঝেই মন্টু ভাই আরও দুটো সিগারেট খেয়ে ফেললেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, ওনার নানাবিধ রোগ। ডায়বেটিস, ফুসফুসে ইনফেকশন। লিভার ও কিডনির অবস্থাও ভালো নেই। রোগগুলো ক্রনিক হয়ে গেছে। কয়েকটি গানের টিউশনি করত। অসুখের জন্য তা কমিয়ে দু-তিনটি করে এখন। গানের স্কুলেও যেতে পারে না। হঠাৎ করেই যে কোনো সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নেবুলাইজার নিতে হয়। শ্বাস কষ্টের কারণে আগের মতো সুর তুলতে পারে না কণ্ঠে। আঙুলও ঠিক মতো চালাতে পারেন না হারমোনিয়ামের রীডে, তবলায়ও তাল তুলতে পারেনা আগের মতো। হাত কাঁপে।
একটু পর রোজী ভাবী পুরানো ঢাকার বাকরখানি ও দুধের ছানা খেতে দিলেন। চা বানিয়েও খাওয়ালেন। আমাদের খাওয়া শেষ হলে মাহবুব ভাই বললেন- আমরা আজ আসি। মন্টু ভাই বললো, তোমরা আবার এসো।
এতক্ষণ রোজী ভাবী আমার সাথে একটি কথাও বলেনি। বিদায়কালীন সময়ে আমার দিকে আনত চোখে চেয়ে বললেন- ‘নবীন দেবর, তুমি ভুলে যেওনা এই ভাবীকে। এসো আবার।’
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম – আসব।
এর মধ্যে প্রায় দেড় মাস চলে গেছে, মন্টু ভাই ও রোজী ভাবীকে দেখতে যাওয়া হয়নি। এর কারণও ছিল, ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে পুরনো ঢাকার ঐদিকটায় আর যাওয়া পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল– মাহবুব ভাই আমাদের অফিস ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে চাকুরি নিয়ে চলে গেছে। তাও ঢাকায় নয়, একেবারে চট্টগ্রামে। উনি থাকলে হয়তো যাওয়া হতো।
এর মাঝে রোজী ভাবীদের কথা মনে পড়েছে আমার। প্রায়ই ইচ্ছে হতো আমি একাই যেয়ে ওনাদের দেখে আসব। কিন্তু কেমন যেন সংকোচ অনুভব করতাম। আমি ওনাদের তেমন কেউ না। কোনও আত্মীয়ও নই – হঠাৎ এমনি করে চলে যাব? কী মনে করবে তারা? যদি ভাবে রোজী ভাবীর প্রতি আমি দূর্বল। যদি মনে করে কার জন্য এত টান? গায়ে পড়ে কেন দেখতে যেতে চাও? কার জন্য তুমি যেতে চাও?
রোজী ভাবীর জন্যই আমার যেতে ইচ্ছে করে। ওনার প্রতি কেন জানি আমার মায়া জন্মে গেছে। এই মায়াটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারিনা। তারা গরীব! অসহায়! এই জন্য? তাহলে তো করুণা হয়ে গেল। কিন্তু এ যে করুণাও নয়। সেদিনের বিদায়কালীন সময়ে ভাবীর সেই কথা এখনও কানে বাজে — ‘নবীন দেবর, তুমি ভুলে যেওনা এই ভাবীকে। এসো আবার।’
সব দ্বিধা দূর করে একদিন ছুটির দিনে আমি রোজী ভাবীর বাসায় আবার যাই। ভাবী আমায় দেখে খুশি হলেন। মন্টু ভাই খাটের উপর শুয়ে আছে। শরীরটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে দেখে উনি উঠে বিছানায় বসলেন। এবং বললেন – খুশি হলাম তুমি এসেছ।
মন্টু ভাই সিগারেট ধরালেন। আজও ওনাকে বললাম – আপনি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন মন্টু ভাই।
ভাবীকে বললাম – আপনি সিগারেট খাওয়া ছাড়াতে পারেননি?
— পারিনি। ওর আরও অনেক খারাপ অভ্যাস ছিল। যেমন, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা। সুরা পান করা। সময় মতো আহার না করা। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করা। এই সবগুলো ছাড়াতে পেরেছি। শুধু সিগারেট খাওয়া বাদ দেওয়াতে পারিনি।
ভাবী বলছিল – ‘তুমি এসেছ ভালোই করেছ। আমরা এখানে আর বেশি দিন থাকব না। তুমি না এলে তোমাকে আর হয়তো দেখতে পেতাম না।’
বললাম – কোথায় চলে যাবেন?
— তোমার মন্টু ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি নাগরপুরে।
ভাবী আরও বললেন — এখানে আমরা আর থাকতে পারছি না। তোমার মন্টু ভাইয়ের আয় রোজগার আর নেই বললেই চলে। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনা। দেশের বাড়িতে কিছু জমিজমা আছে, তাই থেকে জীবন চলবে। ওখানে কুমুদিনী হাসপাতালে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসাও করানো যাবে।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এরা আমার আপন ভাই ভাবী নয়, তাই বলে কী এদের জন্য আমি কিছু করতে পারি না? কিন্তু কতটুকুই বা করতে পারব? সাময়িক দানে এদের কী চিরদিনের করে ঢাকায় রাখতে পারব? আর আমার দান ওনারা গ্রহণও করবে না।
সেদিন রোজী ভাবীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় ভাবীর হাতে জোর করে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম — ‘মন্টু ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য রাখেন।’ রোজী ভাবী গ্রহণ করতে চাননি। আমি বললাম- ‘আপনি না আমাকে দেবর ডেকেছেন। আমি মন্টু ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের মতো।’ দেখলাম, ভাবীর চোখদুটো জলে ছলছল করে উঠেছে।
অফিসের কাজের চাপে বেশ কিছুদিন রোজী ভাবীর ওখানে যাওয়া হয়নি। সেদিন অফিস থেকে একটু আগেই বের হই। একটি রিকশা নিয়ে চলে যাই জেলখানা পর্যন্ত। ওখান থেকে হেঁটে ভাবীর বাসায়। গিয়ে দেখি, সব জিনিসপত্র তারা গুছিয়ে বেঁধে রেখেছে। ভাবী নিজ থেকেই বললো – কাল সকালে চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি। তুমি একবার নাগরপুরে চলে এসো আমাদের দেখতে। ভুলে যাবে না।
ভাবীকে বললাম – ভুলব না।
মন্টু ভাইয়ের হারমোনিয়ামটা দেখলাম বিছানার উপরে পড়ে আছে। তবলা দুটোও আছে একপাশে। মনটা এত খারাপ লাগছিল যে কান্না পাচ্ছিল খুব। মন্টু ভাইকে বললাম, মন্টু ভাই একটা গান গেয়ে শোনান না!
মন্টু ভাই সিগারেট ধরালেন, বললেন- আমার কণ্ঠ নষ্ট হয়ে গেছে, গাইতে পারি না। তোমার ভাবীও গান জানে। সেই শোনাক তোমাকে গান।
মন্টু ভাই ভাবীকে বললো – তুমি আরিফকে একটা গান গেয়ে শোনাও।
মন্টু ভাই বলছিল, জানো আরিফ, আমার গান শুনেই তোমার ভাবী আমাকে ভালবেসেছিল। আর আমিও তোমার ভাবীর গান শুনে তাকে ভালবেসেছিলাম। দুজন একসাথে বসে কত রাঙা ভোরে হারমোনিয়ামে কণ্ঠ সেধেছি। কত বৃষ্টির দিনে গেয়েছি বর্ষার গান। কত হেমন্ত রাত্রি নিদ্রাহীন করে কাটিয়ে দিয়েছি গুনগুন করে গানে গানে। গেয়েছি দুজন যুগল কণ্ঠে –
আমরা এমনি এসে ভেসে যাই
আলোর মতন, হাসির মতন
কুসুমগন্ধ রাশির মতন
হাওয়ার মতন, নেশার মতন
ঢেউয়ের মতন ভেসে যাই।
আমি জানতাম না রোজী ভাবীও গান গাইতে পারে। আমিও ওনাকে বললাম, গেয়ে শোনান না ভাবী একটি গান। ভাবী নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলেন-
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি আরো আরো আরো দাও তান ॥
ভাবী এমন করে গানটি গাইলেন যেন সহসা বেগম বাজারের একটি সরু গলির জীর্ণ পলেস্তারা খসে পড়া একটি কক্ষ বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মন্টু ভাই তবলায় তাল দিচ্ছিল, তার হাতটাও তবলার উপর হিম হয়ে থেমে গেল। গান শেষে রোজী ভাবীর চোখ কেমন আদ্র হয়ে উঠল। তার সেই নিমীলিত চোখের তারায় জগতের অনেক অশ্রু যেন টলমল করছে। ঘরের ভিতরকার স্বল্প আলোয় তা সে লুকাতে পারল না।
সেদিনের সেই স্তব্ধবাকের বিকালে একটা কথাই ভাবছিলাম, মানুষের কত অজানা বিস্ময় অজানা থাকে অন্য কারোর কাছে। এমন কত জীর্ণ কুটিরে কত বিস্ময়কর প্রতিভা আলোহীন হয়ে পড়ে থাকে নিবিড় আঁধারে। কেউ তাকে হাত ধরে আলোতে নিয়ে আসেনা।
ভাবী ক্ষীণ কণ্ঠে আঁধার নেমে আসা সেই সন্ধ্যায় বলেছিল– ‘এসো ভাই তুমি আমাদের বাড়ি। এসো তুমি। ধলেশ্বরীর তীরে ঘুরতে ঘুরতে তোমাকে শোনাব আরও গান। নৌকায় ভেসে ভেসে চলে যাব দূর বালুচরে। ওখানে ফুটে থাকে অজস্র কাশফুল। উড়ে সেখানে ধবল বক, পানকৌড়ি। দেখব আকাশ জুড়ে শরতের শুভ্র মেঘমালা।’
আমি রোজী ভাবীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সরু গলি ধরে হাঁটতে থাকি। পা চলছিল না মোটেই। পিছনে ফিরিয়ে দেখার কিছু নেই। খালি মনে হতে লাগল – কেউ মনে হয় গোপনে টপটপ করে চোখের জল ফেলছে। ল্যাম্পপোস্টে একটি বাতিও তখন জ্বলেনি। কেমন আঁধার হয়ে আছে গলিটা। নেড়ি কুকুর ভুগ ভুগ করছিল অপরিচিত আমাকে দেখে। বেগম বাজারের মোড়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কতকগুলো ছেলে বলছে — ” নীল ছবি, নীল ছবি, ব্লু, ব্লু, সুইডিশ-সুইডিশ, ইতালিয়ান- ইতালিয়ান।” বুঝতে পারলাম এখানে বিভিন্ন বাড়িতে ভিসিআরে নীল ছবি দেখানো হয়। আমি ওদিকে কান দিলাম না। একটি টং দোকান থেকে একটি সিগারেট কিনে ধরাই। কোথাও না দাঁড়িয়ে সিগারেটটি টানতে টানতে হেঁটে চলে আসি চানখাঁর পুল। ওখান থেকে রিকশায় আমার মেসে।
কদিন খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কী এক যাতনা হতো বুকের ভিতর। অফিসে মনমরা হয়ে থাকতাম। লেখার সময় কলম চলত না। খিদে পেলেও খেতে মন চাইত না। মানুষ তার বর্তমান দুঃখকেই মনে হয় বড় করে দেখে। আমিও তাই দেখতাম। এমনি এমনি চোখ থেকে জল ঝরে পড়ত।
তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাই। সময় বহিয়া যায়। অতীতের স্মৃতি চাপা পড়তে থাকে মধুময় বড়ো কোনো প্রাপ্তিতে। কর্মক্ষেত্রে সুনাম বাড়তে থাকে আমার। ভালো জায়গায় ভালো অফারে নতুন চাকুরি নিলাম। অনেক বড়ো কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠলাম। ঘরে অসম্ভব সুন্দরী মায়াবতী বউ এল। সন্তান এল। কবেকার এক মন্টু ভাই ও একজন রোজী ভাবী মনের অতল গহীনে চাপা পড়ে গেল। যে রোজী ভাবী একসময় আমার মনকে এমন করে আলোড়িত করেছিল, সময়ের বিবর্তনে তাকে কী নিমিষেই ভুলে গেলাম। যদিও মাঝে মাঝে মনে হতো – একবার চলে যাই ধলেশ্বরীর তীরে, খুঁজে দেখে আসি হতভাগী রোজী ভাবীকে। যখনই ভাবতাম এইসব কথা, তখনই ছায়ার মতো সামনে এসে দাঁড়াত আমার মায়াবতী স্ত্রী। তার মুখের ঔজ্জ্বল্যের কাছে রোজী ভাবীর মুখখানি নিষ্প্রভ হয়ে যেত। নিমগ্ন আঁধারে হারিয়ে যেত রোজী ভাবীর ধূসর মুখ।
বছর সাতেক পরের কথা। একবার বাসে করে সিরাজগঞ্জে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। বাসটি একসময় মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে। আমি জানালার কাছের সিটে বসা ছিলাম। বাইরে পথের উপর তাকিয়ে দেখি, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার সাদা সুতি শাড়ি। অনাড়ম্বর তার বেশভূষা। মুখে কোনো প্রসাধনী মাখা নেই। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটিকে। চিনতে পারলাম তাকে। এ যে আমার রোজী ভাবী। আমি বাস থেকে নেমে পড়ি। কাছে গিয়ে ডাক দেই – ‘ভাবী’।
রোজী ভাবী আমাকে চিনতে পারে। সে বললো – তুমি এখানে!
– বাসে বাড়িতে যাচ্ছিলাম, আপনাকে দেখে নেমে পড়ি। তা আপনি এখানে?
– হ্যাঁ, আমি এখানে আসি প্রতি বছর এইদিনে।
কুমুদিনী হাসপাতালটি দেখিয়ে রোজী ভাবী বললেন– আজ থেকে ছয় বছর আগে এই হাসপাতালের একটি বেডে তোমার মন্টু ভাইয়ের প্রাণ চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি আসি এখানে এইদিনে। হাসপাতালের একটি প্রকোষ্ঠে সেই বেডটির কাছে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই তোমার মন্টু ভাইকে। দেখি, কী সুন্দর করে সে ঘুমিয়ে আছে। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখি। তার হিম হয়ে যাওয়া শরীরের স্পর্শ অনুভব করি। আমি কান পেতে শুনি তার আত্মার স্পন্দন!
— খুব খারাপ লাগছে মন্টু ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে। আল্লাহ ওনাকে বেহেশতে রাখুন।’ ভাবীকে বললাম – আপনি এখন কোথায় থাকেন?
— নাগরপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ছায়া ঘেরা একটি গ্রামে। তোমার মন্টু ভাইয়ের সমাধি সেখানে। ওখানেই আমি থাকি। ওখানকার একটি স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাদের গান শিখাই। সময় কেটে যায়। প্রথম প্রথম খুব একাকী লাগত। তোমার কথা খুব মনে হয়েছে। তা তুমি বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই।
— জ্বী।
— বউ দেখতে কেমন?
— আপনার মতো। ওর মুখে আপনার ছায়া দেখতে পাই।
— নাম কী?
— মহুয়া।
— বাচ্চা হয়েছে?
— জ্বী। একটা মেয়ে ।
— কার মতো দেখতে হয়েছে ?
— মায়ের মতো।
— নাম কী?
– রোজ।
– খুশি হলাম।
আমি রোজী ভাবীকে বললাম — ‘ঢাকায় আর স্থায়ী হবেন না কখনও ? আসবেন না?
— না। এখানেই ভালো লাগে। মনখারাপ হলে চলে যাই ধলেশ্বরীর তীরে। কী অপরূপ রূপে ধলেশ্বরী বহমান। শীতল বাতাস বয়ে আসে চরাচরের কাশফুলের সুবাস মেখে। সে বাতাস এসে লাগে আমার গায়ে। দেখি, দিগন্ত জুড়ে খোলা আকাশ। কী যে ভালো লাগে তখন। ভুলে যাই সব বঞ্চনার কথা।
বাসটি এতক্ষণ অতিরিক্ত বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছিল আমার জন্য। চালক ভেঁপু বাজাচ্ছিল বারবার। রোজী ভাবীকে বললাম – যেতে হবে। আসি ভাবী।
— এসো।
আমি দ্রুত এসে বাসে উঠি। জানালার কাছে সিটে বসতে না বসতে বাসটি অনেকদূর চলে আসে। জানালা দিয়ে তাকাই বাইরের দিকে। কিন্তু রোজী ভাবীকে আর দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে সে আড়াল হয়ে গেছে।
***
ডিসক্লেইমার —
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসী মামি’ গল্পটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখাটা লিখেছি ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন