২. এক আশ্চর্য সন্ধ্যা

কোয়েল তালুকদার

একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষই সেই অনুষ্ঠানে এসেছিল।  আগত অতিথিদের মধ্যে কেউ খাচ্ছিল। কেউ গল্পগুজব করছিল। একজন রমণীকে দেখলাম সে একাকী এককোণে চুপচাপ সোফায় বসে আছে। কারোর সাথে কথা বলছিল না। মহিলাটির বয়স  পঁয়তাল্লিশের মতো হবে। 

ওনাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। দূর থেকে দেখলাম তার চোখ। মনে হলো এই চোখ আমি এর আগে অনেক দেখেছি। মুখ দেখে মনে হলো — এই মুখের দিকে আমি বহুবার চেয়ে থেকেছি। তার কপাল, ভ্রূ, মাথার চুল, নাক, ঠোঁট, আনত চাহনি আমার বহুদিনের চেনা।

সে একটি হালকা নীল রঙের জামদানি শাড়ি পরেছিল।  গায়ে ফিকে নীল-রঙা ব্লাউজ। চুল খোঁপা করা, টিপ পরেছে বড়ো করে। ঠিক এমন সাজে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম অনেক বছর আগে এক আশ্চর্য সন্ধ্যায় কলাকোপার কোকিল পিয়ারীর জমিদার বাড়ির দিঘির পাড়ে। সেও কপালে পরেছিল বড় করে টিপ। খোপায় ছিল চন্দ্রমল্লিকা ফুল। অনেক আগের সেই সন্ধ্যার কথা, সেই মেয়েটির কথা, সেই দিঘির পাড়ের নির্জনতার কথা, ঘাটের কথা, টলটলে জলের কথা — আমার মনমুকুরে আজও মণিদীপার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। 

আমি ঐ রমণীর একটু কাছে যাই। তার মুখের দিকে চেয়ে বলি — তুমি পল্লবী না? রমণীটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছু মুহূর্ত স্থির চোখে, তারপর বিস্মিত হলো!  তারপর বললো — তুমি রঞ্জন না? 

বললাম, হ্যাঁ আমি রঞ্জন। 

পল্লবী বলছিল — সেই কত বছর পর তোমাকে দেখলাম। জানো কত বছর? 

 — তেইশ বছর পর।

পল্লবীর সাথে কথা বলছিলাম যখন, তখন খুব  ইচ্ছে করছিল — ওর হাতটি একটু ধরি। পরক্ষণেই মনে হলো, কী ভাবছি? পল্লবী কী আর সেই পল্লবী আছে? সে এখন আর একজনের বউ।  ঘরসংসার করে। ছেলে মেয়ে আছে। ওর কী আর মনে আছে? সেই কবে শীতের এক অস্ত বিকালে কোকিল পিয়ারীর জমিদার বাড়ির দিঘির ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম টলটলে জল। জলে পড়েছিল আকাশের লাল আবীর মাখা ছায়া।  দূর অস্তাচলে ডুবতে দেখেছিলাম সূর্য। কী মায়াময় সন্ধ্যা নেমেছিল দিঘির পাড়ে ! তারপর রাত হয়েছিল। আমার খুব শীত লাগছিল। কেন জানি কাঁপছিলাম খুব। পল্লবী ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে সেদিন। 

আজ এত বছর পর ওর সাথে আমার দেখা। ওকে বললাম — তুমি কেমন আছ? কী করো, কোথায় থাকো এখন? 

—  কেমন আছি সে কথা পরে বলি। থাকি অনেক দূর। অন্য আরেক গোলার্ধে। আমেরিকার আরিজোনার এক ছোট মরু শহরে আমার বাস। সেও দেড় যুগ হয়ে গেল। দু সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলাম। কালই চলে যাচ্ছি। এই জীবনকাল তোমাকে কত যে খুঁজেছি আমি। দেখা পাইনি তোমার। সেই যে কবে কেমন করে তুমি হারিয়ে থাকলে! 

পল্লবী একটি শ্বাস ফেলে বলছিল —  সেই তোমার দেখা পেলাম। একেবারে জীবনের ক্রান্তিকাল সময়ে। কেমন করে যেন শেষ হয়ে গেল বেলা।  জীবন যখন শুকায়ে গেল, তখন তোমার দেখা পেলাম।

পল্লবী বলছিল — তোমার বউকে এখানে নিয়ে আসো নাই? 

— না। 

— কেন? 

— নেই। 

— নেই মানে! 

— ও দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে সেই যৌথ জীবনের শুরুর ঊষা লগ্নেই। 

— শুনে ব্যথিত হলাম। কী হয়েছিল ওর? 

— সে অনেক কথা। 

— তারপর আর কাউকে জীবনে আনো নাই? 

— না। ইচ্ছে করে না আর! 

আমি পল্লবীকে বললাম — তুমি কেমন আছো?  

— ভালো নেই। 

— কেন, কী হয়েছে? 

— ঐ যে বললাম, জীবন শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্বের কথা  বলে দিয়েছে — ঐ ক’দিনই নাকি বাঁচব। শেষ বারের মতো এই দেশ, এই মাটি ও প্রিয় মানুষদের দেখতে এসেছিলাম। তোমাকেও খুঁজেছি। মরে গেলে টুসন শহর থেকে দূরে কান্ট্রি সাইডে নির্জন কোনও মরু প্রান্তরে গ্রেভইয়ার্ডের বালুর নিচে শুয়ে থাকব। ওখানে দূর্বা ঘাস নেই। ব্লু বনেটও ফোটে না। কলাকোপার জমিদার বাড়ির বাগানে ফুটে থাকা চন্দ্রমল্লিকার মতো সুবাসে ভরে থাকবে না মৌন সন্ধ্যায়। মরু বাতাসে হুহু করে শুনতেও পাব না জীবনের কোনও মর্মর ধ্বনি। 

আমি পল্লবীর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ওর  চোখ জলে ভরে উঠেছে। শুধু ঝরে পড়ছে না কেবল। চারদিকে কত মানুষ কত অতিথিজন। সুরের কত মূর্ছনা। কেঁদে ফেললে লোকে কী ভাববে? আমারও খুব কান্না পাচ্ছিল। অনেকটা জোর করে জল আটকিয়ে রাখলাম।  

পল্লবীর সাথে কথা বলছিলাম যখন, তখন একজন বয়স্ক রাশভারি লোক ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং  গম্ভীর কণ্ঠে বলে – পল্লবী, তুমি কী করছো এখানে , কার সাথে কথা বলছো?  তুমি চলো। গাড়ি চলে এসেছে। 

লোকটি খুব তাড়া করছিল চলে যাবার। এরই ফাঁকে পল্লবী আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় লোকটির সাথে। বলে — ইনি আমার স্বামী। আমাকেও পরিচয় করে দেয় ওনার সাথে। বলে– ওর নাম রঞ্জন। আমরা একসময় সাংস্কৃতিক সহকর্মী ছিলাম। পল্লবী আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে  চলে যায়। 

তারও কিছুকাল পরে জেনেছিলাম– পল্লবীও চলে গেছে জীবন সীমানার ওপারে। কী যে দুঃখ আমার, কেন যে ঈশ্বর দুটো বেদনার ভার বয়ে বেড়াবার দায় আমাকেই দিলো।

মাঝে মাঝেই দিনের শেষ আলোর স্বপ্নলোকে কোনও  দূরাগত ঘন্টারধবনি  কানে বাজে, তখন নিরুদ্দেশ হয়ে দূর কোনও গন্তব্যে যেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কখনও আবার অতীতের মধুময় সুন্দর কোনও সন্ধ্যার সমস্ত আলো, শব্দ, গন্ধ এসে প্রবেশ করে সানন্ধকারে আমার ঘরে। তখন নিঃশ্চুপ চেয়ে থাকি অনিমিখ। 

আমার সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যে আমি কত অসহায়, কত নিঃস্ব।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন