আমার ছেলেবেলা – ১

বুদ্ধদেব বসু

আমি জন্মেছিলাম কুমিল্লায়, আমার দাদামশায়ের তৎকালীন কর্মস্থলে, বঙ্গাব্দ ১৩১৫, ১৫ অগ্রহায়ণ, খ্রিষ্টাব্দ ১৯০৮, ৩০ নভেম্বর তারিখে। পিতার নাম ভূদেবচন্দ্র বসু, মাতা বিনয়কুমারী—কন্যাবস্থায় তাঁর পদবি ছিলো সিংহ। ‘বিনয়কুমারী’ নামটি আমি কারো মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি, ‘মুকুল’ পত্রিকার একটি পুরোনো খণ্ডে কাঁচা হস্তাক্ষরে লেখা দেখেছিলাম—কেমন করে সেটিকে আমার মায়ের নাম বলে শনাক্ত করেছিলাম তা আমার মনে নেই। আমি বিনয়কুমারীর প্রথম ও শেষ সন্তান—আমার জন্মের পরে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই প্রসবোত্তর ধনুষ্টংকার রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুই আমার নামকরণের কারণ।

আমার জন্মের ও তাঁর মৃত্যুর সময় বিনয়কুমারীর বয়স ছিলো ষোলো—আমাদের এ-কালের হিশেবে তিনি তখনও বালিকা। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার একমাত্র সন্তান এবং ভূদেবচন্দ্র পত্নীকে হারিয়ে বছরখানেকের জন্য পরিব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন। এই দুই কারণে আমি আমার মাতামহ-মাতামহীর ঘরেই মানুষ হয়েছিলাম— কার্যত তাঁরাই ছিলেন আমার পিতামাতা।

তাঁদের নাম চিন্তাহরণ সিংহ ও স্বর্ণলতা (পৈতৃক পদবি ঘোষ)। চিন্তাহরণ ছিলেন বোধহয় এফ. এ.-পাশ বা বি. এ.-ফেল-করা মানুষ; প্রথম বয়সে স্কুলমাষ্টারি করতেন, পরে পুলিশ-বিভাগে কর্ম নেন। পুলিশে ঢোকার পর তিনি দু-একটা অনুচিত ব্যসনে মেতেছিলেন, উৎকোচগ্রহণেও তাঁর দ্বিধা ছিলো না— এ-সব কথা আমাদের পারিবারিক মহলে ঘূর্ণিত হতো মাঝে-মাঝে। আর সেই সঙ্গে এ-কথাটাও অনেকবার আমার কানে এসেছে যে তাঁর কন্যার মৃত্যুর পরে সব কদভ্যাস তিনি পরিত্যাগ করেন; আমি তাঁকে যখন দেখেছি তখন তিনি নিতান্তই গৃহপালিত জীব। নিশ্চিন্তে বলা যায় পুলিশের চাকুরে হবার মতো কোনো যোগ্যতাই তাঁর ছিলো না— অত্যন্ত ভীরু ও শঙ্কাপরায়ণ মানুষ তিনি, দেহ তেমন বলিষ্ঠ নয়; মাসের মধ্যে যেদিন তাঁকে রাত্তিরে ‘রাউণ্ড’ দেবার কাজে বেরোতে হয় সেদিন সন্ধে নামলেই তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়; রাস্তায় বেরিয়ে দূর থেকেও কোনো ঊর্ধ্বতন রাজপুরুষকে দেখলে তিনি যেন অজানা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে পালাবার পথ খুঁজে পান না; কোনো কল্পিত বিপদেও অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়েন। সন্দেহ নেই, কর্তৃপক্ষও তাঁকে অযোগ্য বলেই জানতেন, কেননা তাঁর বয়স যখন প্রায় পঞ্চাশ, তখনও তিনি ক্ষুদ্র দারোগামাত্র, গরীয়ান ইন্সপেক্টর-পদে উন্নীত হতে পারেননি।

স্বামী-স্ত্রীতে স্বভাবের মিল ছিলো না। স্বর্ণলতা ছিলেন স্বাস্থ্যবতী ও প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী; ঘরোয়া পার্লামেন্টের বৈঠকে তিনি যেমন তীক্ষ্ণভাষিণী হতে পারতেন, তেমনি হাস্য-পরিহাসমুখর পারিবারিক আড্ডা জমানোতেও তাঁর দক্ষতা ছিলো চারদিকের আত্মীয়বর্গকে আকর্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো ক্ষমতা তিনি ধারণ করতেন; পিতৃকুল ও শ্বশুরকুলের অনেকেই ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে আসতেন তাঁর কাছে, আসতেন ভারমুক্ত হতে গর্ভবতীরা— অনেক নবজাতক ও নবজামাতার পরিচর্যা তাঁকে করতে দেখেছি। তিনি স্কুলে কতদূর পড়েছিলেন জানি না, কিন্তু তাঁর পোস্টমাষ্টার- পিতার গৃহে বাংলা লেখাপড়া ভালোই শিখেছিলেন মনে হয়; চিঠিপত্র বেশ গুছিয়ে লিখতেন, বাড়িতে ছিলো অনেককালের পুরোনো চামড়ায়-বাঁধাই বঙ্কিমের ভল্যুম, সন্ধেবেলা কখনো-কখনো মাসিকপত্র থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন আমাদের— সেটা আমার খুব ভালো লাগতো, তাঁর কণ্ঠস্বর মন্দ্রিত ও উচ্চারণ স্পষ্ট ছিলো।

চিন্তাহরণ ও স্বর্ণলতা— এঁরাই আমার বাল্যজীবনকে পরিবৃত করে রেখেছিলেন। বিশেষত আমার দাদামশায়ের সঙ্গে আমি এমন এক ধরনের স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম, যার বুনোনটা খুব ঘন, প্রায় কোথাও ফাঁক নেই— পিতাপুত্রের সম্বন্ধের চেয়ে অনেকটাই বড়ো তার আয়তন। কেননা তিনি ছিলেন আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক, প্রথম বন্ধু, ও প্রথম ক্রীড়াসঙ্গী— চাকুরির সময়টুকু বাদ দিয়ে তিনি আমাকেই তাঁর জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে অল্প বয়সে স্কুলে ভর্তি করেননি— সেজন্যে আমি অন্তহীনভাবে কৃতজ্ঞ; যে-রকম যত্নে আমাকে তিনি ইংরেজি শিখিয়েছিলেন তার কোনো তুলনা হয় না। শীতের ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছি তাঁর সঙ্গে— আমার পরনে কান-ঢাকা টুপি আর আলস্টার— তিনি চলতে-চলতে জিগেস করছেন : ‘Do you see what I see?” আর আমি তাঁর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে উঠছি, ‘A tree!’, ‘A dog!’, ‘A bullock-cart!’—এমনি সারাটা সময়। রবিবার বিকেলে তাঁর সঙ্গে আমার খেলা জমে শব্দরচনা ও শব্দহরণের চৌকো এ বি সি ডি-গুলো নিয়ে- সেটাও ইংরেজি চর্চারই একটা উপায়; তিনি ইচ্ছে করে আমার কাছে হেরে গেলেন বুঝেও আমি খুশি না-হয়ে পারি না। পারিবারিক ছোটো ছোটো চিঠিপত্র তিনি আমাকে দিয়েই লেখান; আমার সাত বছরের জন্মদিন থেকে আমাকে একটি রোজনামচা লেখার কাজে লাগিয়ে দিলেন— সবই ইংরেজিতে। শুরুতে তিনি বাক্যগুলো বলে দিতেন আমাকে, বা সাহায্য করতেন : অল্পদিনের মধ্যে আমার কলম স্বাধীনভাবে সচল হয়ে উঠলো।

আমার ইংরেজির জন্য দাদামশাই যে এত বেশি যত্ন নিয়েছিলেন, তার কারণ কি তাঁর কলোনিয়েল মনোভাব? হয়তো তা-ই— বাড়িতে দিল্লি-দরবারের মস্ত রঙিন ছবিও দেখেছি, রৌপ্যমুদ্রার উপরে অঙ্কিত মহারানীর মূর্তিটিকে মহিলারা বলতেন ‘সাক্ষাৎ ভগবতী’। তবু বলবো যে এখনকার স্বাধীন ভারতের বিত্তশালী সমাজে যে- ইঙ্গোন্মাদনার জোয়ার ডেকেছে (যেন ছেলেমেয়েরা ফিরিঙ্গি টানে এক ধরনের খিচুড়ি- ইংরেজি বলতে পারলেই শিক্ষার চূড়ান্ত হলো!), সে-রকম কিছুই আমার পরিবেশের মধ্যে ছিলো না তখন। ইংরেজি ছিলো আমাদের কাছে বইয়ের ও স্কুল-কলেজের ভাষা— জীবনের ভাষা বাংলা। আমার বাংলার জন্য চিন্তাহরণকে কোনো শ্রম করতে হয়নি, আমার শিক্ষক ছিলেন শুধু লেখকরা— যোগীন্দ্রনাথ উপেন্দ্রকিশোর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত জাদুকরগণ।

দাদামশাই আমাকে সংস্কৃত টাও ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর উৎসাহে আমি ‘নরঃ নরৌ নরাঃ’ ও ‘তি তস্ অন্তি’র প্রথম সিঁড়িগুলো ভেঙেছিলাম, মুখস্থ করেছিলাম কিছু চাণক্যশ্লোক, কয়েক পৃষ্ঠা ‘হিতোপদেশ’ চর্বণ করেছিলাম। আরো দুটো সংস্কৃত কবিতা আমরা কণ্ঠস্থ ছিলো, মনে পড়ে— একটার নাম ‘মোহমুদগর, গভীর বৈরাগ্যবোধক সমিল একটি পদ্য, শঙ্করাচার্যের রচনা বলে কথিত, প্রথম লাইন ‘মূঢ় জহিহি ধনজনতৃষ্ণাম্; বিষয়টা ঠিক শিশুর পক্ষে উপযোগী না-হলেও তার শব্দঝংকার আমার ভালো লেগেছিলো। অন্যটা এর ঠিক উল্টো পিঠের ব্যাপার, ‘ধনং দেহি জনং দেহি’ ধরনের চীৎকারসর্বস্ব এক সুদীর্ঘ দুর্গাস্তোত্র; আমার মুখে আবৃত্তি শুনে দাদামশাই খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু আমি তা থেকে কোনো আনন্দ পাইনি। এই পর্যন্ত— আমার ছেলেবেলার সংস্কৃত শিক্ষা; পরে স্কুলে-কলেজে— ব্যাকরণের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়েও— আমি আরো কয়েকটি পদক্ষেপ এগোতে পেরেছিলাম। একে বুড়ি- ছোঁয়ার বেশি কিছু বলা যায় না, কিন্তু এখন বুঝতে পারি ঐ স্বল্প তহবিলও আমার সাহিত্যিক জীবনে কাজে লেগেছিলো— এখনো লাগছে।

আমার ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ে আর-একটা কথা বলতে চাই। দাদামশাই আমাকে ব্যাকরণের বালুডাঙায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত ও ক্লিষ্ট করেননি, কোনো নেসফীল্ড ছুঁয়ে দেখতেও হয়নি আমাকে; কাকে বলে জেরাণ্ড বা ইনফিনিটিভ, ক্রিয়াপদের মধ্যে কোনগুলো ট্র্যানজ়িটিভ আর কোনগুলো নয়— এ-সব তত্ত্ব অনেক বয়স পর্যন্ত আমি জানতাম না। আর তাই ঐ বিদেশী ভাষা অতি সহজে তার আনন্দের উৎসটি আমার জন্য খুলে দিয়েছিলো। আমার বয়স যখন ছয় থেকে আটের মধ্যে সেই সময়েই আমি ইংরেজি কবিতায় স্পষ্ট ও দৃষ্ট হয়েছি; ‘Break, break, break On thy cold gray stones, O sea!— এই লাইনটার অফুরন্ত অনুরণন আমি শুনতে পাই মনে-মনে, তুষার-ঝড়ে হারিয়ে-যাওয়া লুসি গ্রে-র কথা ভেবে আমার রৌদ্রতপ্ত দুপুরগুলি উদাস হয়ে ওঠে। তারপর— আমি তখন আরো একটু বড়ো হয়ে উঠেছি— শীতের সন্ধ্যায় দাদামশাই আমাকে পড়ে শোনাতেন শার্লক হোমস-এর কাহিনী-পর্যায়, শেক্সপিয়র থেকে কোনো-কোনো দৃশ্য; পোর্শিয়া ও শাইলকের সঙ্গে, রজ়ালিও আর মিরাণ্ডার সঙ্গে, ব্রুটাস কেশিয়াস মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে তাঁরই মধ্যস্থতায় আমার প্রথম পরিচয় হয়। আর এমনি করেই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি আমার অন্তরঙ্গ করে তুলেছিলেন; তার মধ্যে কোথাও কোনো ভার বা পীড়ন আছে, তা আমাকে অনুভব করতে দেননি। আমার প্রায় মনেই পড়ে না আমি কী-ভাবে ইংরেজি পড়তে ও লিখতে শিখেছিলাম; সেজন্যে আমার স্বাভাবিক উন্মুখতা যতটা দায়ী দাদামশায়ের প্রাণবন্ত শিক্ষকতাও ততটাই। স্পষ্টত, স্কুলমাষ্টারিটাই তাঁর স্বাভাবিক বৃত্তি ছিলো, পুলিশে ঢুকে দু-দিক থেকেই ভুল করেছিলেন।

বাড়িতে একটি গ্রামোফোন ছিলো, মনে পড়ে। শুনেছি, আমার অজ্ঞান বয়সে, যখন পর্যন্ত পড়তে শিখিনি, আমি বলামাত্র যে-কোনো রেকর্ড বের করে দিতে পারতাম— এতে বোঝা যায় ঐ চোঙ-লাগানো ধ্বনিযন্ত্রটি আমাকে কতদূর পর্যন্ত মুগ্ধ করেছিলো। সেই মুগ্ধতাবোধ আমার সাত বছর বয়স পর্যন্ত কাটেনি; আমি বাক্সের পাল্লা খুলে উঁকি দিয়ে দেখি ভিতরে কোনো মানুষ লুকিয়ে আছে কিনা; কুকুর অথবা ডানাওলা পরির ছবি বসানো চকচকে গোল শব্দপ্রসবী চাকতিগুলোকে এক অপার রহস্য বলে মনে হয় আমার। প্রায়ই শুনতাম, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমার মনে আছে একটিমাত্র রেকর্ড— কোনো গান নয়, অসমমাত্রিক অমিত্রাক্ষর পয়ারে লেখা একটি নাটকের অংশ। তার প্রথম লাইন— ‘দ্যাখো, দ্যাখো, মধ্যম পাণ্ডব’ আর শেষ লাইন— ‘আর কৃষ্ণনাম আনিবো না মুখে!— এও আমি আজ পর্যন্ত ভুলিনি। খুব সম্ভব গিরিশচন্দ্রের কোনো নাটক, প্রধান অভিনেতা দানীবাবু*। আমার দিদিমা কলকাতায় থিয়েটার দেখেছিলেন; তাঁর মুখে অমর দত্ত কুসুমকুমারীর নাম শুনতাম; মনে-মনে ভাবতাম— না জানি সেই মানুষেরা কেমন, কত আশ্চর্য!

[*এই লেখাটা ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরোবার পরে দু-জন পাঠক আমাকে জানান যে রেকর্ডটা ছিলো গিরিশচন্দ্রের ‘পাণ্ডবগৌরব’ নাটকের একটি অংশ, প্রধান ভূমিকায় ছিলেন অমর দত্ত।]

গ্রামোফোনটি একদিন বেচে দেয়া হলো— পাছে আমার পড়াশুনো বিঘ্নিত হয়। আমার মনে কোনো অভাববোধ জাগলো না, ততদিনে বই পড়াই আমার প্রধান আনন্দ হয়ে উঠেছে।

আমি আমার দাদামশাইকে ডাকতাম ‘দা’, দিদিমাকে ‘মা’ বলতাম। শুধু যে মুখে মা বলতাম না নয়, তাঁকে মা ছাড়া অন্য কিছু আমি ভাবিনি কখনো, ভাবতে পারিনি। অথচ আমি খুব অল্প বয়সেই জেনেছিলাম আমার ‘আসল’ মা মরে গিয়েছেন, আমার বাবার সঙ্গেও আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছে। মা নেই, মা আছেন; আমার ‘মা’-র সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক শাশুড়ি-জামাইয়ের, আমার ‘মা’-র স্বামীকে আমি ‘বাবা বলে ডাকি না—এ-সব উল্টোপাল্টা ব্যাপার নিয়ে আমি কখনো বিব্রত বোধ করিনি, আমার কাছে এই অবস্থাই ছিলো সংগত এবং স্বাভাবিক। মা নেই— এটা হলো অস্পষ্ট এক প্রবচন, যাকে বলে ‘কথার কথা’ ঠিক তা-ই; আর মা আছেন— এটা অতি নিবিড় এক সত্য, যা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি স্নেহে যত্নে আদরে আবদারে, অসুখের সময় পরিচর্যায়। মাতৃহীন শিশুর মনোকষ্ট আমার জীবনের ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারেনি।

আমার দিদিমার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে একটি ফোটোগ্রাফ ছিলো— অনেক বাসা-বদল, বাসস্থান-বদল, ও অবস্থার বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে তিনি সেটিকে রক্ষা করেছিলেন। ক্ষীণাঙ্গ এক যুবক, তার কাঁধে মাথা রেখেছে এক তরুণী― তরুণীটির মুখখানা গোল ছাঁদের, পিঠ-ছাপানো একঢাল চুল, কিন্তু চোখ তার বোজা, যুবকটি তাকে কোমরে জড়িয়ে ধরে আছে। মৃতা পত্নীকে নিয়ে আমার পিতা এই ছবি তুলিয়েছিলেন, তা জেনেও ছবিটির প্রতি কোনো আকর্ষণ বা আগ্রহ আমি অনুভব করিনি। আমি যখন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা, আছি রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাটে, তখনও সেটি চোখে পড়েছে আমার— কিন্তু শুধু চোখেই পড়েছে, আমি সত্যি কখনো ছবিটির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম এমন আমার মনে পড়ে না। বৈধব্যপ্রাপ্ত দিদিমার ঠাকুরপুজোর কোণটিতে প্রথমে থাকতো সেটি— ততদিনে হলদে এবং ঝাপসা হয়ে গিয়েছে—এদিকে যত দিন যায় তত বেড়ে চলে আসবাব এবং বইপত্র, সন্তানেরা বড়ো হতে থাকে, কিন্তু ফ্ল্যাটের মাপজোক একই থেকে যায়, বর্তমানের চাপে অতীতকে লুকোতে হয় কোণে-ঘুপচিতে, খাটের তলায় কোনো জীর্ণ তোরঙ্গে হয়তো। খুব স্বাভাবিকভাবেই ছবিটা হারিয়ে গেলো একদিন— কবে, আমি তা লক্ষ করিনি, তা নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ অথবা অবকাশ আমার ছিলো না। কিন্তু এখন আমার ষাট-পেরোনো প্রান্তিক নির্জনতায় বসে আমার মাঝে-মাঝে মনে পড়ে ছবিটিকে, সেটি হারিয়ে গেছে বলে ঈষৎ যেন দুঃখও হয়। আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য কেউ যখন আর বেঁচে নেই, তখনই আমার জানতে ইচ্ছে করছে সে কেমন ছিলো— আমার নানির বয়সী না-দেখা ঐ মেয়েটি; কেমন ছিলো সে দেখতে, কেমন পছন্দ-অপছন্দ ছিলো তার, বই পড়তে ভালোবাসতো কিনা, আমার মধ্যে তার কোনো-একটি অংশ কি কাজ করে যাচ্ছে? মনে হয়, আমাকে জন্ম দেবার পরিশ্রমে যে-মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিলো, তার কিছু প্রাপ্য ছিলো আমার কাছে; তা দেবার সময় এখনো হয়তো পেরিয়ে যায়নি।

সেকালের বাঙালিরা ছিলেন পল্লীপ্রাণ, জীবিকার দায়ে বারো মাসের মধ্যে দশ মাস তাঁরা শহরে কাটাতেন, কিন্তু মন তাঁদের পৈতৃক গ্রামে পড়ে থাকতো। কোনো মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ এলে তাঁদের মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে পাত্রপক্ষের আদিবাসভূমি কোথায়; কোনো ছুটির সময় কাছে আসামাত্র তাঁরা তল্পি বাঁধেন দেশে — অথবা পূর্ববাংলার ভাষায় ‘বাড়ি’ যাবার জন্য। ঘটনাচক্রে, অথবা আমার স্বভাবেরই নির্বন্ধে, আমি এই পল্লীকেন্দ্রিক অর্থে ‘দেশের টান’ কখনো অনুভব করিনি, যে-গ্রাম বা পরগনা বা জেলায় আমার পূর্বপুরুষ অনেককাল আগে ভিটে তুলেছিলেন, সেটাকেই বিশেষভাবে আমার ‘দেশ’ বলে ভাবতে ছেলেবয়সেও পারিনি আমি। তবু তথ্যের দিক থেকে হয়তো বলা দরকার যে আমার মাতৃকুল ও পিতৃকুল দুয়েরই আদিনিবাস ছিলো বিক্রমপুরে- গ্রামের নাম যথাক্রমে বহর ও মালখানগর। পরবর্তী কালে যে-কন্যাকে বিবাহ করলাম তাঁর পিতৃভূমিও বিক্রমপুরেরই অন্তর্ভূত।

আমাদের পরিবারে স্থায়ী সদস্য ছিলো চারজন : আমি, দাদামশাই-দিদিমা, আর তাঁদের এক বৃদ্ধা বিধবা আত্মীয়া। কিন্তু আমার ছেলেবেলার অনেকটা অংশ কেটেছে এক বৃহৎ যৌথ পরিবারের মধ্যে, নানা দিক থেকে সম্পৃক্ত নানা বয়সের মামা মাসি দাদু দিদিমার সংসর্গে। তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো, কিন্তু যৌথ পরিবারের ভোজননির্ভর জটলামুখর আলস্যাশ্রিত আমোদপ্রমোদে আমি যোগ দিতে পারতাম না— আমার দিন কাটতো নিরিবিলি, আপন মনে, অধিকাংশ সময় শব্দহীনভাবে ব্যাপৃত। আমি অসময়ে কিছু খেতে চাই না, অচেনা লোকের মধ্যে পড়ে গেলে আড়ষ্ট হয়ে থাকি, কোনো নিমন্ত্রণ-বাড়িতে যেতে হলে আমার মুখ শুকিয়ে যায়— এইসব কারণে বর্ষীয়সীরা আমাকে বলেন ‘বুড়ো কত্তা’, আর গুরুজনদের মধ্যে কেউ-কেউ আমাকে একাচোরা বলে নিন্দে করেন।

একবার ঢাকায় বেড়াতে এসে আমি তাসের নেশায় খুব মেতেছিলাম— আমার বয়স তখন সাত হবে কি আট। আছি আধো-পাড়াগেঁয়ে গেণ্ডারিয়ায় একটা গাছপালা- পুকুরওলা একতলা বাড়িতে, আমার বয়সী আরো কয়েকটি ছেলেমেয়েও আছে; তাদেরই একজন আমাকে দীক্ষা দিয়েছিলো। ব্রে খেলা চলে, যে হেরে যায় তাকে গাধার আওয়াজে ডেকে উঠতে হয় : ভারি মজা। একদিন দুপুরে খাওয়ার পরেই জমিয়ে বসা হলো। আমার ভাগ্য ভালো ছিলো না সেদিন : কেবলই হেরে যাচ্ছি হাতের পর হাত; যত হারছি ততই রোখ চেপে যাচ্ছে, আর ততই অনিবার্য হয়ে উঠছে আমার হেরে যাওয়া। খেলা যখন থামলো তখন দিনের আলো নিবু-নিবু আমি ছড়ানো তাস কুড়িয়ে নিয়ে বাইরে এলাম— আমার মনে হলো আকাশ, বাতাস, গাছপালা সব মরে গিয়েছে, আমিও আর বেঁচে নেই। কাকে বলে বি-চ্ছি-রি, কাকে বলে বিস্বাদ— না-তেতো না-টক না-ঝাল না-?ি ) এমনি একটা কিছু-না-গোছের মনের অবস্থা, তা আমি সেদিন যেমন বুঝেছিলাম আমার এই দীর্ঘ জীবনে আর কখনো ঠিক তেমনভাবে বুঝিনি। উঠোনে ছিলো মস্ত একটি কালোজাম গাছ; আমি আস্তে-আস্তে তার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে একটি-একটি করে সমস্ত তাস ছিঁড়ে ফেললাম, মনে-মনে বললাম— ‘জীবনে আর না। এই প্রতিজ্ঞা আমি আক্ষরিক অর্থে পালন করতে পারিনি; কৈশোরে, তরুণীদের টান কাটাতে না-পেরে, আবার জুটেছিলাম ব্রে অথবা টোয়েন্টি-নাইনের আসরে; কিন্তু সেই ঝোঁকটা অল্পেই কেটে গিয়েছিলো— তারপর থেকে তাসের সঙ্গে আমার মুখ-দেখাদেখি নেই। আমার স্মৃতির উপর কালো ছায়ার মতো ঝুলে আছে জামতলার সেই সন্ধেবেলাটা— আমি এখনো ভুলতে পারিনি— এখনো তাস ভাবতে আমার প্রায় ভয় করে।

অধ্যায় ১ / ৬

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন