আমার ছেলেবেলা – ২০

বুদ্ধদেব বসু

ঢাকায় আমি আগেও কয়েকবার এসেছিলাম, তার মধ্যে একবারের কথা খুব মনে পড়ে।

উপলক্ষ ছিলো এক জোড়া-বিয়ে। প্রথমটি সত্যেন্দ্র- ছানার, সেই যাঁদের চট্টগ্রামে চারিচক্ষে মিলন হয়েছিলো, অন্যটি দিদিমার এক ভাই-ঝির। দেওর-ঝি-ভাইয়ের ব্যাপারটিতে ঘটকালি করেছিলেন স্বর্ণলতা, মৃত দাদার মেয়ের বিয়েতে ও তিনিই প্রধান কর্মকর্ত্রী— আমরা অনেকটা আগেই চলে এসেছি। যে-বাড়িটা ভাড়া নেয়া হয়েছে সেটার নাম মোতি-মহল, অবস্থান মুসলমানবহুল উর্দু পাড়ায়, গড়নপেটনও মুসলমানি। প্রকাণ্ড চক-মিলানো বাড়ি— মধ্যিখানে শান-বাঁধানো মস্ত আঙিনা, দোতলায় তিন দিক জুড়ে উঠোন-মুখো বারান্দা চলে গেছে, রাস্তার দিকে চওড়া আর- একটা বারান্দা। ঘর অনেকগুলো, প্রতিটি নায়র-নায়রীতে গুলজার। কোথাও জোর তাস-পেটানো চলছে, কোথাও শালী-ভগ্নীপতি শালাজ-ননদাইদের হাসি-মশকরা, কোথাও তর্ক বেধে গেছে কুলীন ভঙ্গ-কুলীন ও বঙ্গজের তারতম্য নিয়ে, কোথাও কয়েকটি মহিলা গোল হয়ে বসে, পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে, অসাধারণ একঘেয়ে সুরে যৌথকণ্ঠে বিয়ের গান গাইছেন। অন্য ধরনের গানও আছে অনেক : কোনো খুকি মেয়ে, যেন আট বছর বয়সেই পরলোকের ডাক শুনতে পেয়ে, হার্মোনিয়মের চাবি টিপে-টিপে কাঁদুনি গাইছে যেহেতু ‘শরীর-পিঞ্জরে জীবন-বিহঙ্গ চিরকাল বসে থাকবে না’; গ্রামোফোনে যখন-তখন বেজে উঠছে একেবারে উল্টোভাবের ‘তুমি কাদের কুলের বৌ, ‘আধো-আঁচরে বোসো’, ইত্যাদি। দিদিমার পিতৃকুল সংগীতপ্রিয়, মেজো ভাই নগেন্দ্রনাথ ভালো হার্মোনিয়ম বাজান— তাঁর পাল্লায় পড়ে আমিও দু-একটা গৎ বাজাতে শিখে ফেলেছি। শোনা যাচ্ছে শিশুর কান্না মাঝে-মাঝে, গঞ্জিকাসেবী পাচক-ভৃত্যদের ভাঙা গলার চ্যাঁচামেচি, কোথায় যেন ঝনঝন শব্দে এক পাঁজা কাঁসার বাসন পড়ে গেলো। যাকে বলে হিন্দু বিয়ে-বাড়ি—ফেলাছড়া, হৈ-চৈ, গণ্ডগোল, আত্মীয়ের আত্মীয় ও কুটুম্বের কুটুম্ব নিয়ে এক বিরাট পারিবারিক সম্মেলন যার মেয়াদ এক মাসেও ফুরোতে চায় না— তারই একটি সর্বলক্ষণযুক্ত নমুনা আমি মোতি-মহলে দেখেছিলাম সেবার।

বিয়ের পরদিন সত্যেন্দ্র- ছানা বেরোলেন কোনো জমিদারের সৌজন্যে প্রাপ্ত একটি ল্যাণ্ডোগাড়িতে, গাঁটছড়া-বাঁধা অবস্থায়; আমি, বোধহয় নিতবর হিশেবে, সঙ্গী হয়েছিলাম। কেন যাওয়া, কোত্থেকে কোথায়, সে-সব আমার কিছুই মনে নেই, কিন্তু ভ্রমণের মুহূর্তগুলো ভুলিনি। আমি বসে আছি উল্টো দিকের সরু আসনটায়, বর-বধুর মুখোমুখি; গদির চামড়ার গন্ধ নতুন বৌয়ের গা-থেকে-বেরোনো সুঘ্রাণ, পট্টবস্ত্রের খশখশানি, প্রকাণ্ড দুটো ঘোড়ার সমতালে পড়া খুরের শব্দ, রঙিন কাচের জানলা-দিয়ে-দেখা লালচে অথবা সবজে রঙের শহর— সব মিলিয়ে আমার মনটাতে যেন ঝিমুনি এনে দিয়েছিলো, আমি যেন আশ্চর্য এক জগতের আভাস পেয়েছিলাম— খুব ঝাপসাভাবে, কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের অন্য একটা ছবি— ক্ষণিক নয়, ঝাপসা নয়— এখনো আমার চোখে লেগে আছে।

সেদিন ছিলো ছানার পাকস্পর্শ, সন্ধে পেরিয়ে গেছে। দোতলায় রাস্তার দিকের চওড়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ছিপছিপে হালকা চেহারার মেয়েটি— একটা আলপনা-আঁকা হলুদ-রঙা পিঁড়ির উপর পা রেখে; আর সামনের সিঁড়ি দিয়ে একে-একে উঠে আসছেন সত্যেন্দ্রর বন্ধুরা — ঢাকা কলেজে তাঁর সহপাঠীর দল— নববধূর হাতে দিয়ে যাচ্ছেন টুকটুকে লাল রিবনে বাঁধা বইয়ের প্যাকেট— পাঁচ-টাকা-দামের টয়লেট-বাক্স বেরোয়নি তখনও, তাই শুধু বই। এক-একবার দু-হাতে ধরা বইয়ের ভারে নুয়ে পড়ছে মেয়েটি, অন্য কেউ তার হাত থেকে নিয়ে তুলে রাখছেন। কিন্তু, খুব স্বাভাবিক কারণেই, নববধূর তখন বইয়ে মন নেই, অন্যেরাও দৃকপাত করছেন না সেদিকে— পরদিন থেকে পুরো সম্ভারটি আমারই অধিকারভুক্ত হয়ে গেলো। তখনকার দিনের গরম-কাটতির সব বই— একখানাও রবীন্দ্রনাথ নয় : তুলোর প্যাডে বাঁধাই ‘বাণী’, ‘কল্যাণী’, সিল্কে বাঁধাই ‘হিমালয়’, ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’; শরৎচন্দ্র, অনুরূপা, নিরুপমা; গুরুদাস কোম্পানির আট-আনা-সিরিজ় একরাশি; প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের গল্প, যতীন্দ্রমোহন সিংহের ‘ধ্রুবতারা’– এ-সব পেরিয়ে ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘কুললক্ষ্মী’, ‘পাক-প্রণালী’ পর্যন্ত কিছুই আমি বাকি রাখলাম না। সে-যাত্রায় আমার হার্মোনিয়ম-শিক্ষা ‘কে রে হৃদয়ে জাগে’-র পরে আর এগোয়নি— এবং সেখানেই জীবনের মতো সমাপ্ত হয়েছিলো— কিন্তু বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে সেই আমার উপনয়ন বলা গায়; এক টানে অতগুলো বাংলা উপন্যাস আমি পরেও আর কখনো পড়িনি।

২১

আমি ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় ছিলাম মাত্র সাড়ে-নয় বছর, কিন্তু ছিলাম ঠিক সেই বয়সটায় যেটা মানুষের জীবনে সবচেয়ে সগর্ভ ও প্রভাবশালী। ভাবলে মনে হয়— আমার মধ্য-তিরিশ থেকেই তা-ই মনে হচ্ছে— যেন কতকাল ছিলাম আমি সেখানে, ঢাকার বছরগুলো ভরে যেন অনেক-কিছু ঘটেছিলো, আমি অনেক-কিছু করেছিলাম- মনে হয় যেন দিন রাত্রি ঋতু বৎসর অমন বিচিত্রভাবে ও প্রগাঢ়ভাবে আমার চেতনায় আর প্রবিষ্ট হয়নি। এই অনুভূতি সবচেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে ঢাকায় আমার প্রথম পাঁচ বছরের কথা ভাবলে— যখন পর্যন্ত আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিনি, ‘প্রগতি’ পত্রিকা প্রস্ফুট হয়নি ছাপার অক্ষরে। আমার এই মনে-হওয়ার সঙ্গে তথ্যের কোনো সংগতি নেই তা না-বললেও চলে : আসল কথা, আমি তখন উত্তীর্ণ হচ্ছি বাল্য থেকে কৈশোরে আর কৈশোর থেকে নবযৌবনে; আসল কথা, আমি তখন আমি হয়ে উঠছি, আবিষ্কার করছি নিজেকে। আস্তে-আস্তে, বা দ্রুতবেগে, আমার শরীর-মনের এনভেলাপে পোরা অস্তিত্বটাকে বদলে দিচ্ছিলেন প্রকৃতি দেবী; তাঁর নেপথ্যকর্মের সহযোগী ছিলেন আমার সৌভাগ্যলব্ধ বন্ধুরা। তাঁদের মধ্যে সকলের আগে আমার মনে পড়ে বুদ্বু-দাকে— পোশাকি নাম প্রভুচরণ, পদবি গুহ-ঠাকুরতা।

আমরা ঢাকায় আসার পরে একমাসও কাটেনি। আছি ওয়াড়িতে তেইশ নম্বর র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে— পাঁচিল-ঘেরা কম্পাউণ্ডওলা পরিচ্ছন্ন একটি একতলায়। একদিন বেলা দশটা নাগাদ বাইরে কড়া নড়ে উঠলো; আমি দরজা খুলে দেখি, একটি অচেনা যুবক সাইকেলের হাতল ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পরনে ধবধবে খদ্দরের ধুতি, গায়ে খদ্দরের ফতুয়া আর চাদর, শেল্-ফ্রেমের চশমার পিছনে চোখ দুটি ব্রাউন এবং উজ্জ্বল, গালের হাড় উঁচু, গায়ের রং লাল-মেশানো ফর্শা, ঠোঁটের হাসি মনোমুগ্ধকর। আমার মনে হলো এমন একটি সুন্দর মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি, মনে হলো এক দেবদূত আমার সামনে দাঁড়িয়ে। দু-একটা কথার পরে বোঝা গেলো তিনি আমারই কাছে এসেছেন।

কয়েকদিনের মধ্যেই নিবিড় হয়ে উঠলো যোগাযোগ। প্রায়ই যাই লক্ষ্মীবাজারে তাঁদের বাড়িতে—আমার জীবনে আড্ডার স্বাদ সেখানেই প্রথম। জনবহুল বাড়ি, আবহাওয়া খোলামেলা ও দরাজ; কে বাসিন্দা আর কে আগন্তুক তা ঠিকমতো ঠাহর করা শক্ত। অনেক ভাই-বোন বুদ্ধু-দার, সকলেই বয়সে তাঁর ছোটো : ভাইয়ের চাইতে বোনের সংখ্যা বেশি, বোনেদের মধ্যে কয়েকটি আমার কাছাকাছি বয়সের তরুণী। তারা সকলেই সুন্দরী এবং তাজা, ইডেন-স্কুলের কৃতবিদ্য ছাত্রী, সুভাষিণী ও সপ্রতিভ। পুরো পরিবারটি খুব সহজে আমাকে কাছে টেনে নিলেন; আমি স্বচ্ছন্দে অন্তঃপুরে বিচরণ করি, বোনেরাও আমাকে স্নেহের চোখে দেখছেন, বড়ো বোন গায়ত্রীর সঙ্গে আমি বিশেষভাবে মনের মিল খুঁজে পাই। আমাকে বলা হয়েছে আমি তাঁদের আত্মীয়, কিন্তু আমার মন বলছে আত্মীয়তাটা কিছু নয়, বন্ধুতাই আসল। আর এই বন্ধুতার ভিত্তি হলেন প্রভুচরণ— বোনেদের উজ্জ্বল উপস্থিতি সত্ত্বেও এ- বাড়িতে তিনিই আমার কেন্দ্র।

গুহ-ঠাকুরতা-বাড়ির আর একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য— তা হলো গান। বুদ্ধু-দা নিজে, তাঁর বোনেরা, আর দৈবক্রমে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও—এমন কেউ নেই যাঁর গলায় সুর না আছে, এবং যিনি মনের আনন্দেই যে-কোনো সময় গেয়েও না থাকেন— বিনা সাধ্য-সাধনায়, বিনা হার্মোনিয়মে। আর সেই গান কোনো ধর্মসংগীত বা ব্ৰহ্মসংগীত নয়—’ফাল্গুনীর, ‘প্রবাহিণীর গান, বর্ষার ও শরতের, বা রবীন্দ্রনাথের এমন কোনো রচনা যা এই সেদিনমাত্র ‘প্রবাসী’তে বা ‘সবুজপত্রে’ ছাপার অক্ষরে পড়েছিলাম। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে পরিবারটির সংযোগ ছিলো : ‘কাব্যপরিক্রমা’র লেখক অজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রভুচরণের এক পিসিমার বিবাহ হয়, বন্ধুদের মধ্যেও অনেকে ছিলেন বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রাক্তন ছাত্র। দল বেঁধে রাস্তায় চলতে-চলতে এঁরা গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠেন, বাড়ির মধ্যে মেয়ে-পুরুষের গলায় ডুয়েট চলে মাঝে-মাঝে, কখনো ওঠে হাসি-ঠাট্টার হিল্লোল— গানে গল্পে কৌতুকে আনন্দে বাড়িটি একেবারে ভরপুর।

প্রভুচরণ কিন্তু বাড়ির ঘেঁষাঘেঁষির মধ্যে থাকেন না, রাস্তা পেরিয়ে আলাদা একটি ঘর আছে তাঁর—সেখানে কিছু বই আর শাদাশিধে টেবিল চেয়ার তক্তাপোশ নিয়ে তিনি রাত্রে ঘুমোন আর দিনের বেলাতেও থাকেন বেশির ভাগ। বাড়িতে তাঁর জন্য লবণহীন আলাদা ব্যঞ্জন রান্না হয়— সবই নিরামিষ কিনা সেটা আমার ঠিক মনে পড়ছে না। অশনে-বসনে তাঁকে বলা যায় গান্ধীবাদী, কিন্তু তাঁর মন যে-সব রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তার একটিও সবরমতীর অভিমুখী নয়। তাঁর কাছে মাঝে-মাঝে দেখি ‘ভ্যানগার্ড’ নামে একটি পত্রিকা— খুব সম্ভব সরকারি হিশেবে নিষিদ্ধ, ট্রটস্কিবাদের কোনো মুখপত্র হয়তো— রুশীয় বিপ্লবের ঢেউ ততদিনে ভারতের তট ছুঁয়েছে— এবং ঢাকাও সেই সময়ে ছিলো বঙ্গীয় সন্ত্রাসবাদের রাজধানী। কিন্তু প্রভুচরণকে বিপ্লব-ঘেঁষা মানুষ বলেও মনে হয় না— তাঁর চরিত্রের প্রধান লক্ষণ প্রকাশ্যতা ও প্রফুল্লতা, তাঁর চিত্তবৃত্তি রসগ্রাহী ও নান্দনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে এম. এ. পড়ছেন তিনি, কিন্তু কলেজি গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে তাঁর আগ্রহ নানান দিকে বিস্তীর্ণ। দেশ- বিদেশের সাহিত্য নিয়ে তিনি কথা বলেন আমার সঙ্গে; আমাকে পড়তে দেন হুইটম্যান, আর এমন অনেক লেখকের উপন্যাস ও গল্পের বই যাঁদের নামগুলো অদ্ভুত এবং অনিংরেজ। তাঁর বন্ধুসম্প্রদায়টি বিচিত্র— কেউ বর্ণিলবেশী চিত্রকর, কেউ রসিকতায় দক্ষ, কেউ বা ফুটবল-খেলোয়াড়, কেউ ডিগ্রিধারী উচ্চাভিলাষী পরিপাটি যুবা, আর কেউ বা জীবনটাকে হেসে-খেলে উড়িয়ে দিতে চান— নানা ভিন্ন ধরনের মানুষকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছেন প্রভুচরণ। তাঁরই মধ্যস্থতায় আমার নবযৌবনের প্রথম সমবয়সী সাহিত্যিক বন্ধুকে আমি পেয়েছিলাম— তাঁর পিসতুতো ভাই টুনু, অজিত দত্ত— অতি সুদর্শন একটি ছেলে, যার দিকে, বুড়ি গঙ্গার ধারে বেড়াবার সময় আমার চোখ আর মন আগেই আকৃষ্ট হয়েছিলো।

বন্ধু-দা হঠাৎ একদিন ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন— কাছাকাছি কোথাও নয়, একেবারে সাত সমুদ্রের ওপারে, সুদূর ও অস্পষ্ট দেশ আমেরিকায়। অন্য অনেকের মতো আমিও তাঁর সঙ্গে এলাম নারায়ণগঞ্জের স্টিমার-ঘাট পর্যন্ত, স্টিমার ছেড়ে যাবার পরেও তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ : বস্টনে পৌঁছে তিনি দেশ থেকে প্রথম যে-চিঠিখানা পেয়েছিলেন, সেটি আমার লেখা। ফিরে এলেন তিন বছর পরে হার্ভার্ড আর লন্ডনের ডিগ্রি নিয়ে, বিলাসী এক যুবক — সিল্কের পাঞ্জাবি ছাড়া পরেন না, রোজ একটিন করে গোল্ড ফ্লেক ওড়ান, তাঁর পায়ে দেখা যায় এক-একদিন এক-এক ফ্যাশানের স্যান্ডেল— এদিকে তাঁর আড্ডার ঝোঁক, সাহিত্যচর্চার ঝোঁক যেন আগের চেয়েও প্রবল। তিনি বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছেন অনেকগুলো চলতি-কালের ইংরেজ- মার্কিন উপন্যাস, তাঁর সান্ধ্য আসরে পড়ে শোনান সেগুলো থেকে— দানাদার গলায়, সুন্দর উচ্চারণে। বাড়ির হালচালও কিছু বদলে গেছে তাঁর জন্য— আগেকার মতো পিঁড়িতে বসে কাঁসার থালায় আর খাওয়া হয় না, শাদা-চাদর-পাতা টেবিলের উপর ঝকঝক করে কাচের আর চীনেমাটির বাসন; সম্প্রতি তাঁরা সদরঘাটের কাছে যে- বাড়িতে উঠে এসেছেন সেটিও বেশ রমণীয়। এই সবই খুব মনোমতো হলো আমার, কেননা ততদিনে আমি হারিয়ে ফেলেছি নোয়াখালির সেই খদ্দর-পরা কুঁকড়ে-থাকা ছেলেটাকে— আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, মাথায় বেশি না-বাড়লেও মুখে-চোখে জেল্লা ধরেছে কিছুটা : চা খাচ্ছি অঢেল, চুল রেখেছি কপাল-ছাপানো ঝাঁকড়া, খদ্দরের সঙ্গে এখন আর আমার সম্পর্ক নেই। আমি জানি না কবে এবং কেমন করে এই পরিবর্তনগুলো ঘটেছিলো, তবে এটুকু জানি এর পিছনে আমার কোনো সংকল্প ছিলো না— কোনো দ্বিধা আমাকে বিব্রত করেনি, কারো দৃষ্টান্ত আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি— আমার শরীর-মনের সাধারণ পরিবর্তনের মতো এও যেন ‘এমনি-এমনি’ হয়ে গিয়েছিলো। আর— যদিও গলার আওয়াজ লজ্জাকরভাবে তিন টুকরো হয়ে যাচ্ছে— তবু আমার সেই উৎপীড়ক তোলামিও যেন নিজে-নিজে ছেড়ে গিয়েছে আমাকে— পুরোপুরি নিস্তার দিয়েছে তা নয়, কিন্তু অন্তত সেটাকে চাপা দিয়ে রাখার কায়দাগুলো আমি অনেকটা রপ্ত করে নিয়েছি। প্রভুচরণকে বিদায় দেবার সময় আমি নতুন ভর্তি হয়েছি কলেজিয়েট স্কুলে নয়ের ক্লাশে, আর এখন আমি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র, সিগারেট আমার অস্বাদিত নেই, আর্মানিটোলার পিকচার-হাউসে আমি নিয়মিত দর্শক। আছি বিধবা দিদিমার সঙ্গে শহর থেকে দূরে, একটি টিনের বাড়িতে। কষ্টে আছি বলা যায় না।

২২

প্রাক-ম্যাট্রিক শেষ ক্লাশ দুটো আমি স্কুলে পড়েছিলাম— ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। আগে কখনো ক্লাশ-ঘরে আটক থাকিনি, কিন্তু সেখানকার শৃঙ্খলা মেনে নিতে আমার অসুবিধে হলো না, কেননা আমি বাড়ির মধ্যেও এক ধরনের নিয়মে-বাঁধা দিন কাটিয়েছি—সেটাই আমার ভালো লাগতো বলে। তাছাড়া, আমার দাদামশাই আমাকে অনেক আগে থেকেই স্কুলের জন্য তৈরি করে তুলেছিলেন; আমার সাহিত্যিক ঝোঁকটাকে ষোলো আনা প্রশ্রয় দিয়েও অন্য কোনো জরুরি বিষয়ে আমাকে পেছিয়ে থাকতে দেননি।

গণিতে আমি স্বাভাবিকভাবে নির্বোধ— যে-বয়সে ওঅর্ডস্বার্থের পল্লীবালিকারা আমাকে উন্মন করে দিচ্ছে, সেই বয়সে অঙ্কে আমার হাতে-খড়ি। মনে পড়ে একক- দশক-শতক-সহস্র রপ্ত করতে আমি নাকের জলে চোখের জলে ভেসেছিলাম, দু- একটা চড়-চাপড়ও সইতে হয়েছিলো। কিন্তু সেই প্রথম কাঁটাবনটুকু পেরোবার পর আস্তে-আস্তে যেন সহজ হয়ে এলো সব; দাদামশাই আমাকে যখন একশো-পেরোনো মৌখিক যোগ অভ্যাস করান আমি বড়ো একটা ঠেকি না; ল.সা.গু, গ.সা.গু.-তে পৌঁছে এমনকি খানিকটা মজাও লাগলো— আমি সেগুলোকে বলি ‘সিঁড়ির অঙ্ক’– পুনরাবৃত্ত দশমিকটাও এক কৌতুক। নোয়াখালি-বাসের শেষের দিকে, যখন আমার কলম থেকে ফিনকি দিয়ে গদ্য-পদ্যের ধারা ছুটছে, সেই একই সময়ে আমি তোড়ে কষে যাচ্ছি পর-পর অনেকগুলো পাটিগণিত আর বীজগণিত বইয়ের প্রশ্নমালা, বীজগণিতটা উপাদেয় লাগছে রীতিমতো। সংখ্যা, অক্ষর ও নানান ধরনের চিহ্নযুক্ত এক-একটা বিরাট ও বিদঘুটে চেহারার ব্যূহ যখন আমার পেন্সিলের খোঁচায় কুঁকড়ে যেতে-যেতে অবশেষে একটি একাক্ষরে এসে ঠেকে, আমার মনে হয় আমি যুদ্ধে নেমে দুশমনগুলোকে কচু-কাটা করে দিলাম। এতে অবশ্য আমার অঙ্কের মাথা খুলে যায়নি—সেটা কখনো হবার ছিল না— ম্যাট্রিকের পরেই জীবনের মতো বিদায় দিয়েছিলাম গণিতকে, আর আজ আমার এমন অবস্থা যে দশমিক মুদ্রার সুবিধে সত্ত্বেও, অতি সাধারণ একটা বাজার-হিশেবেও হিমশিম খাই। তবু মনে হয়, এই চর্চায় আমি অন্য ভাবে উপকৃত হয়েছিলাম— তা আমাকে সাহায্য করেছিলো মানসিক আলস্য কাটিয়ে উঠতে, অপ্রিয় কাজে পরিশ্রমী হতে শিখিয়েছিলো। যে-সব মানুষের কল্পনার দিকে টান বেশি, তাদের জীবনে এই শিক্ষাটি মূল্যবান।

ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলটি অনেককালের নামজাদা— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমল থেকেই মর্যাদাবান। দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার প্রধান নাগরিক অঞ্চলে সগৌরবে, গোল মোটা রোমক-থামওলা উন্নতশির অট্টালিকা— পূর্বযুগে এটাই ছিলো ঢাকা কলেজ। সামনে ভিক্টরিয়া পার্ক, আশে-পাশে অনেকগুলো বড়ো রাস্তার মোড়, এক মিনিট দূরে সুন্দর গড়নের হলুদ-রঙা একটি গির্জে, যার মস্ত গোল ঘড়িটার দিকে আমি সতৃষ্ণ চোখে তাকাই মাঝে মাঝে— যখন শুক্কুরবারে ক্লাশের ঘণ্টা চারটে পেরিয়ে যায়, বিকেলের রোদে জ্বলজ্বল করে গির্জের চুড়ো, আর ঘড়ির কাঁটা যেন নড়ে না। নিচু পাঁচিলে ঘেরা মস্ত ছড়ানো চৌহদ্দির মধ্যে স্কুল, সুরকির পাড়-বসানো হরতন- আকৃতির ছোটো একটি বাগানও আছে— সেখানে ফোটে রং-বেরঙের বিলেতি ফুল। সিঁড়ি, মেঝে, বারান্দা সব তকতকে পরিষ্কার; ক্লাশ-ঘরগুলোতে আলো-হাওয়া প্রচুর খেলে, কিন্তু কম্পাউন্ড পেরিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ লেশমাত্র পৌঁছয় না। এ-পর্যন্ত সবই ভালো;- কিন্তু এই ধরনের শান্ত পরিবেশে যতটা শিক্ষা দত্ত ও প্রাপ্ত হতে পারে, দুঃখের বিষয়, তার অর্ধভাগও হয়ে ওঠে না।

ভূগোলের ক্লাশ আমার খুব মনে পড়ে। স্কুলে আছে ভূগোলের জন্য আস্ত একটি আলাদা ঘর–অনেকগুলো বড়ো-ছোটো গ্লোব, মডেল, আর নানা রকম কৌতূহলজনক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো; কিন্তু আমাদের অজানা কোনো-এক কারণে সেই ঘরে কখনো নিয়ে যাওয়া হয় না আমাদের, কোনো যন্ত্রের ব্যবহার হয় না কখনো। কেন ঋতুগুলো ঘুরে-ঘুরে আসে আর যায়, কেন ছোটো-বড়ো হয় দিন- রাত্রি, কেন মেরু-অঞ্চলে শীতে সূর্য অদৃশ্য থাকে আর গ্রীষ্মে অন্ধকার প্রায় নামেই না— এ-সব রহস্য, যা কল্পনাকে চনবনে করে তোলে, আর জুল ভের্ন আর জগদানন্দ রায়ের সুস্বাদু পাতায় অনেক আগেই যার বিবরণ আমি পড়েছিলাম— স্কুলে তা বুঝে নিতে হয় নেহাৎই কতগুলো নির্জীব অক্ষর থেকে, বুঝে নেবার ব্যর্থ চেষ্টায় হাঁপিয়ে উঠতে হয়— কেননা ছাপার অক্ষরে যা লেখা আছে তার উপর মাষ্টারমশাই নিজে বিশেষ-কিছু যোগ করেন না। তিনি আদেশ দেন : ‘পরের দিন সমস্ত সাউথ আমেরিকা পড়ে আসবে!, আদেশ দিয়ে বাড়ি চলে যান, কিন্তু আমরা ভেবে পাই না ঐ বিপুল মহাদেশকে কেমন করে এক গণ্ডূষে গ্রাস করা যায়। তিনি পড়া নেন : আর্জেন্টিনায় কী-কী দ্রব্য উৎপন্ন হয়, পাম্পাস অঞ্চলের কত বর্গ-মাইল আয়তন, পেরুর জলবায়ু কোন ধরনের—আমরা উত্তর দিয়ে যাই যার যেটুকু সাধ্য; কিন্তু যে- মহাদেশের ম্যাপটি অমন বিচিত্র আর শহরগুলোর নাম যেন পাখির গলার কলরব করে, তার কোনো মূর্তি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে না—মনেই হয় না সেটা একটা সত্যিকার দেশ যেখানে সত্যিকার মানুষ থাকে। তেমনি, অঙ্কের ক্লাশেও মাস্টারমশাই চেয়ারে বসেই পড়িয়ে যান, আঙুল নেড়ে-নেড়ে শূন্যে আঁকেন জ্যামিতির চিত্র–ফিটফাট মানুষ, চকখড়ির গুঁড়োয় হাত ময়লা করার ইচ্ছে নেই—অদৃশ্যের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে সারি-সারি তরুণ চোখে ঝিমুনি নামে, মসৃণ কপাল কুঁচকে যেতে থাকে ক্রমশ। কিন্তু এ-সবের চেয়েও যে-গলতিটা বড়ো—বিশেষ কোনো স্কুলের বা শিক্ষকের নয়, মৌলিক—সেটা ঘটেছিলো এই কারণে যে চতুর ইংরেজ পুরো দেশটাকে বেকুব বানিয়ে রেখেছিলো। আমাদের ইংলণ্ডের ইতিহাস বইটা রঙিন-ছবি-ওলা ঝকঝকে—হাতে নিলেই পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে আর পড়তেও মন্দ লাগে না; আর ‘হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া’র চেহারাটা যেমন হতশ্রী লেখাও তেমনি জবড়জং, তার সঙ্গে আবার জুড়ে দেয়া হয়েছে একটা ‘ইংল্যান্ড’স ওঅর্ক ইন ইন্ডিয়া’—ভারতেশ্বর ইংরেজ জাতির গুণকীর্তন। ভূগোলের বইয়ের তিনবার-দাগানো দুটি প্রশ্ন হলো : ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যায় না, আর ‘বৃটিশ মুকুটের উজ্জ্বলতম মণি ভারতবর্ষ’;– এই সূত্র দুটোকে, বছরের পর বছর, যারা ভারতবর্ষেরই নিরীহ বালকবালিকাদের গলা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলো, তাদের গভীর বুদ্ধির তারিফ না-করে উপায় নেই।

কিন্তু এ-সবও তুচ্ছ হয়ে যায় যখন রাজভাষার সঙ্গে মাতৃভাষার বিস্তীর্ণ ব্যবধানের কথা মনে পড়ে। সপ্তাহের মধ্যে ইংরেজি ক্লাশ সবচেয়ে বেশি, সেগুলির জন্য প্রথম ঘণ্টাটি বরাদ্দ আর বাংলা আসে বিকেলের দিকে গড়িমসি করে, আর দিনের শেষ ক্লান্ত ক্লাশটিতে সংস্কৃত। ইংরেজিতে আমাদের পাঠ্যসূচিতে আছে সংক্ষেপিত ‘আইভ্যানহো’, এক ক্যান্টো ‘মার্মিয়ন’, কনান ডয়লের ‘দি লস্ট ওঅলড’ নামে একটা বিজ্ঞানোপন্যাস— কোনোটাই শুকনো কাঠ নয়, শেষেরটা এমনকি ক্লাশঘরেও সুখদায়ক;– এদিকে বাংলায় আমাদের চিবোতে হয় ‘প্রভাত-চিন্তা’র পাথর-কুচি, জিভে না-ছুঁইয়ে গিলে ফেলতে হয় চলৎ-শক্তিহীন চলিত ভাষায় লেখা উটকো এবং অখাদ্য এক ‘উন্নত জীবন’— এ-সবের সঙ্গে ‘কথা ও কাহিনী’টাও আছে বলে বাংলা ক্লাশে আমাদের প্রাণপক্ষী শুকিয়ে মরে না। সপ্তাহে একটি করে ইংরেজি রচনা আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেন হেডমাষ্টারমশাই— বিরলদর্শন রাশভারি মানুষ, পড়াবার ধরনটি চমৎকার— কিন্তু বাংলায় সে-রকম রেওয়াজ নেই, বা কাগজে-পত্রে নিয়ম থাকলেও কাজে হয়ে ওঠে না। স্কুলের লাইব্রেরিটি নেহাৎ ফ্যালনা নয়, সেখানে থ্যাকারের উপন্যাস পর্যন্ত পড়তে পাওয়া যায়— মাষ্টারমশাইরা তা অনুমোদনও করেন— কিন্তু তুলনীয় কোনো বাংলা বই আছে কি নেই সেই খবরটুকুও আমরা জানতে পারি না। মোদ্দা কথাটা এই যে ইংরেজি ভাষাটাই আসল এবং মুখ্য এবং প্রধান— মাষ্টারমশাইরা তা জানেন আর ছাত্ররাও তা মেনে নিয়েছে— এটাকে কোনো অস্বাভাবিক অবস্থা বলে কারো মনে হচ্ছে না। তবু এও সত্য যে আমার স্কুলে- কাটানো সবগুলো ঘণ্টা ব্যর্থ হয়নি, আর তা শুধু এজন্যেই নয় যে সেখানে আমার আবাল্য-চেনা ইংরেজিতে আমার কিছু বানান ভুল শুধরেছিলো। সংস্কৃত ব্যাকরণে যেটুকু কাণ্ডজ্ঞান আমার আজ পর্যন্ত সম্বল তা সেখানকার হেডপণ্ডিতের কাছেই কুড়িয়ে-পাওয়া, তাঁরই সাহায্যে সমাস জিনিশটার বিপুল ক্ষমতা আবিষ্কার করে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম, এও বুঝেছিলাম কেমন অল্প হেরফেরেই বাংলা বিশেষ্য থেকে নিটোল এক-একটি বিশেষণ বেরিয়ে আসে। মন করলে স্কুলের দু-বছরে আমি আরো একটু তৈরি হতে পারতাম সংস্কৃতে, কিন্তু সেই অজ্ঞান বয়সে সেটাকে তেমন জরুরি বলে মনে হয়নি।

কলেজিয়েট স্কুলের ঠিক পিছনেই ধবলবর্ণ জগন্নাথ কলেজ। তার কম্পাউণ্ডের মধ্য দিয়ে আমি কয়েক মিনিটের হাঁটা-পথ সংক্ষেপ করি— তখন থাকি অনেক দূরে লালবাগে, আমার টেস্ট পরীক্ষার দেরি নেই, শীত পড়ি-পড়ি। যেতে-আসতে মাঝে- মাঝে দেখি একদল ছেলেকে— যুবক তারা, কলেজে পড়ে, চলাফেরার ধরন বেপরোয়া ফূর্তিবাজ—ওদের মধ্যে এক-মাথা কোঁকড়া চুলের শ্যামলবর্ণ একটি ছেলেকে বিশেষভাবে চোখে পড়ে আমার। মনে-মনে আমি তাদের ভালোবাসি, তাদের দেখলে আমার দুঃখ হয় আমি এখনো নেহাৎ স্কুল-পড়য়া আছি বলে। পরে অবশ্য, মাত্র বছর দেড়েকের মধ্যে, আমি এই পুরো দলটিকে যেন অনিবার্যভাবেই ধরে ফেললাম, তারা কেউ-কেউ আমার নিবিড় বন্ধু হয়ে উঠলো—কিন্তু ততদিনে সেই কোঁকড়া চুলের ছেলেটি আর ঢাকায় ছিলো না। থাকলে আরো সুখের হতো— কেননা তারই নাম প্রেমেন— প্রেমেন্দ্র মিত্র—যার গল্পে-কবিতায় ‘কল্লোল’ তখন বোলবোলাও।

২৩

স্কুলে পড়ার সময় আমার জীবনে যে-নতুন একটি সুখ যুক্ত হয়েছিলো আগে তার উল্লেখ করেছিলাম, এখানে কিঞ্চিৎ বিবরণ লিখলে অবান্তর হবে না।

চলচ্চিত্র আমি প্রথম দেখেছিলাম নোয়াখালির টাউন-হল্-এ, নেহাৎই আক্ষরিক অর্থে চলৎ-চিত্র। দুটো জোয়ান লোক ঘুষোঘুষি করছে, তীরে এসে লাগছে সমুদ্রের ঢেউ, তিনটি খড়ের-টুপি পরা মেমসাহেব সাইকেল চেপে হুশ করে ছুটে চলে গেলো। টুকরো ছবি, শুধু নড়ছে, বড্ড বেশি নড়ছে : ভুতুড়ে, ঝাপসা, অবাস্তব। এই টাউন-হল্ মঞ্চেই অন্য যা-সব দেখেছি— নাট্যাভিনয়, ম্যাজিকের খেলা, একই মুখ থেকে দুই গলায় বেরোনো কণ্ঠ-কসরৎ, অথবা একবার কাচারি-ময়দানে যে-সার্কাস দেখে আমি ট্র্যাপিজ-নাচুনি মেয়েটাকে আর ভুলতে পারিনি, সে-সবের তুলনায় এই নতুন তামাশা ‘বায়োস্কোপ’টাকে আমার মনে হয়েছিলো বিতিকিচ্ছিরি কোনো মাথামুণ্ডু নেই। দ্বিতীয় নমুনাও নোয়াখালিতে, সেটাতে ছিলো ইংরেজ-জর্মান লড়াইয়ের দৃশ্য—ছবিগুলো অনেক পরিষ্কার, কিন্তু এত বেশি ট্যাঙ্ক বন্দুক কামানের ধোঁয়া আর জর্মান-দলের নৃশংসতাগুলো এত স্পষ্টভাবে বানানো, যে আমি হাড়গোড়সুদ্ধু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, চলচ্চিত্র বিষয়ে আর কৌতূহল অনুভব করিনি। কিন্তু ঢাকায় আসার পর কিছুদিনের মতো—আমি হয়ে উঠেছিলাম বিলকুল একজন সিনেমাখোর, আমার একটি প্রধান প্রিয় স্থান আর্মানিটোলার পিকচার হাউস, শহরের একমাত্র ছবিঘর সেটি।

অর্ধচন্দ্রাকৃতি সাইনবোর্ড, সন্ধের পরে একটি বালবে আলো জ্বলে। ভিতরটা খুব খোলামেলা— জমি, বাগান, গাড়ি চলার রাস্তা, একপাশে টবের গাছ অনেকগুলো— সেখানে বেতের চেয়ারে বসে মাঝে-মাঝে আড্ডা দেন মালিক ও তাঁর বন্ধুরা। চিত্রশালাটি চটকদার নয়— লম্বা ছাঁদের গুদোমের মতো গড়ন, দেয়ালগুলো শাদামাটা চুনকাম-করা, টিনের ছাদের তলায় কোনো সীলিং নেই— বসার জন্য চেয়ার মাত্র একসারি, আর আছে তক্তাপোশের উপর গদি-আঁটা চেয়ারে দুটি ‘বক্স’— অত্যধিক মূল্যবান বলে খালি পড়ে থাকে সেগুলো, অথবা পাশ নিয়ে ভাগ্যবানেরা আসেন। পালা-বদল হয় বুধবারে আর শনিবারে; সে-দু’দিন সকালে একটি ঘোড়ার গাড়ি বেরোয় যার ছাদের উপরে চলে ব্যাগপাইপ আর ঢাকের বাদ্যি, আর ভিতরে বসে দুটি লোক মুঠো-মুঠো ছড়িয়ে যায় বাংলায় আর ইংরেজিতে ছাপা হলদে লাল সবুজ কাগজে হ্যাণ্ডবিল। ঢাকের শব্দে ছুটে যাই আমি রাস্তায়, বিজ্ঞাপনের রগরগে বিশেষণগুলোয় আমার মন নেচে ওঠে—আমি পারতপক্ষে একটা পালাও বাদ দিই না, প্রয়োজনীয় সিকিটি জোটাতে এক-এক সময় বেশ বেগ পেতে হয়। আর সেই সিকির বিনিময়ে যেখানে ঢুকি, সেটা এক আজব দেশ।

প্রায়ই চলে ধারাবাহিক ছবির পালা, ডনকুস্তি, লম্ফঝম্পে জমজমাট। বীর এডি পলো, বলবান এল্মো লিঙ্কন, আর অবশ্য অরণ্যবাসী মহান টার্জান—এঁদের হাজার- বিজয়ী রোমাঞ্চ-সিরিজ় আমি অনেক দেখেছি লম্বা টুলে ঘেঁষাঘেঁষি বসে, কখনো বা দেয়ালে ঠেশান দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে— আমার কানে অর্গ্যান আর বেহালার বাজনা, আমার নাকে বিড়ির ধোঁয়ার ঘন গন্ধ— যার উৎস আমার চার আনা মহলের প্রতিবেশীরা, ঢাকার চলতি ভাষায় যাদের বলা হয় ‘কুট্টি’—গাড়োয়ান, ফেরিওলা, বাখরখানিওলা, রাজমিস্ত্রি, এমনি সব। তারা ইংরেজি অক্ষর চেনে না, জানে না কোথায় আফ্রিকা বা আমেরিকা, কিন্তু সবচেয়ে সহৃদয় আর সরব দর্শক তারাই—ঠিক বুঝে নেয় কোথায় কী হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে; সারাক্ষণ মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় ফিল্মের লোকগুলোর দিকে, সময় বুঝে ‘আবে! মার্দিস!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে, যৌথভাবে হাততালি দেয়, নায়কের শত্রুপক্ষীয় ষণ্ডাগুলোর মুণ্ডপাত করে—আর শেষ ক্লোজ়- আপ চুম্বনের সময় তাদের শিসের শব্দে তীক্ষ্ণ উল্লাস আলো জ্বলার পরেও থামতে চায় না। পিকচার-হাউসের ভিতরটার কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে এই ‘কুট্টি’-সম্প্রদায়কে— লুঙ্গি আর রঙিন গেঞ্জি পরনে, মুখে রসিকতার ফুলঝুরি, শপথ-বুলিতে চ্যাম্পিয়ন, ভাঙা উর্দু আর খাশ-ঢাকাই বাংলা মেশানো যাদের মুখের ভাষা গাড়োয়ানের হাতে চাবুকের শব্দের মতোই কনকনে— আর বাইরে থেকে যাদের দেখে মনে হয় জাত-বোহেমিয়ান, কালকের জন্য কোনো মাথা-ব্যথা নেই, ফূর্তির ফেনা ছিটোতে-ছিটোতে ভেসে চলেছে সারাক্ষণ।

কিন্তু এমন নয় যে পালোয়ানি ফিল্ম ছাড়া আর-কিছু দেখানো হয় না পিকচার- হাউসে। কখনো আসেন মেক-আপ-জাদুকর লন চ্যানি তাঁর কারুণ্য নিয়ে, আবির্ভূত হন বিশ্বমোহিনী ম্যারি পিকফোর্ড, ক্যাথিড্রেলের ঘড়ির কাঁটা ধরে হ্যারল্ড লয়ডকে শূন্যে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। আর মাঝে-মাঝে, ‘তৎসহ দুই খণ্ড কমিক’ বলে বিজ্ঞাপিত ছোটো ছবিতে আমি দেখতে পাই অসাধারণ এক মুখ—এক মানুষ, এক চরিত্র—ছোট্ট গোঁফ, বেঢপ জুতো, ঢোলা পালুন আর হাতে একটা ছড়ি নিয়ে যিনি চোখে ঠোঁটে গালে কাঁধে চলার ভঙ্গিতে কথা বলেন, ছড়িয়ে দেন বেদনা- মেশানো কৌতুক, নিজেকে নিজে ঠাট্টা করে যেন হাসির অছিলায় হৃদয় ছুঁয়ে যান। আর তারপর একদিন ছোট্ট ছেলে জ্যাকি কুগানের সঙ্গে একটা লম্বা ফিল্মে দেখলাম তাঁকে; তিনি আমাকে জয় করে নিলেন।

চ্যাপলিনের প্রথম যুগের সেই চিত্র-কথিকাগুলি আমি আরো একবার দেখেছিলাম— বহুকাল পরে, ন্যুয়র্কের এক বিশাল ও বিলাসী রঙ্গালয়ে— সঙ্গে ছিলো চ্যাপলিনের স্বকণ্ঠে বলা ধারা-মন্তব্য। হলিউডের জন্মকথা বলছিলেন তিনি—সেই যখন দিগন্ত- জোড়া শূন্য জমি পড়ে আছে ক্যালিফর্নিয়ায় : কেউ এলো, একটা যে-কোনোরকম ছাউনি তুলে ক্যামেরা খাটিয়ে শুরু করে দিলো ছবি তুলতে— সরঞ্জাম বেশি কিছু নেই, পূর্বরচিত কোনো গল্পাংশ নেই, নটনটীদের বিশেষ-বিশেষ আঙ্গিক দক্ষতা জোড়া দিয়ে-দিয়েই ‘প্লট’ তৈরি হচ্ছে। আমার ঝাপসা-স্মৃতির দৃশ্যগুলি একের পর এক দেখতে-দেখতে, সিনেমার ছেলেবেলার গল্প শুনতে-শুনতে, আমিও কিছুক্ষণের জন্য আমার ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম।

২৪

আমার দাদামশায়ের রোগদুঃখভোগ ও মৃত্যুর বর্ণনা আমি দু-বার লিখেছি— ‘অন্য কোনখানে’ উপন্যাসে, সম্প্রতি ‘পাতাল থেকে আলাপ’-এ। ঢাকায় আসার স্বল্পকাল পরেই তাঁর কণ্ঠনালীতে ক্যানসার ধরা পড়লো— প্রথমে তিনি চেষ্টা করলেন আয়ুর্বেদ, তারপর স্যুট-প্যান্ট-পরা ডাক্তারদের পরামর্শে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো রেডিয়ম- চিকিৎসার জন্য রাঁচিতে— ঢাকায় ফিরে আসার পরে ডাক্তাররা তাঁকে অনিবারে হাতে সঁপে দিলেন, গলার মধ্যে লুকিয়ে-থাকা নিত্য-বেড়ে ওঠা সেই শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁরা অসহায়। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দিদিমা আনান হরিদ্বার থেকে মহামূল্য মৃগনাভি, পুরুৎ ডেকে স্বস্ত্যয়ন করান বাড়িতে, রোগীকে খাওয়ান ঘড়ির কাঁটায় তাঁদের সনাতন স্বর্ণসিন্দূর, বেদানার রস— তাঁর চেষ্টা বিরামহীন, তাঁর সেবা দিনে- রাত্রে অক্লান্ত : সবই নিষ্ফল। এক আউন্স তরল পদার্থ গলাধঃকরণ করতে দাদামশাইয়ের প্রাণ বেরিয়ে যায়, আর যেটুকু বা গিলতে পারেন তাও তাঁর শরীরটাকে মুচড়ে-দুমড়ে বেরিয়ে আসে কিছুক্ষণ পরে, রক্ত কফ পিত্তের সঙ্গে মিলে- মিশে। শেষের ক-মাস তাঁর বাকশক্তি রহিত হয়েছিলো, কাগজে লিখে-লিখে কথাবার্তা চালাতেন— সবচেয়ে বেশি লিখতেন আমার উদ্দেশে, পুরোনো অভ্যেস- মতো ইংরেজি ভাষায়— প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর চেতনায় কোনো বিকার ঘটেনি। অকথ্য সেই যন্ত্রণা, যা দু-বছর ধরে তিনি ভোগ করেছিলেন— দিনের পর দিন— যতদিন-না তাঁর চর্মাবৃত কঙ্কাল থেকে অবশেষে প্রাণবায়ু নিঃসৃত হয়েছিলো।

মৃত্যুর সঙ্গে প্রাণীর সেই ভয়াবহ সংগ্রাম আমি চোখে দেখেছিলাম, সব অনুপুঙ্খসমেত আজকাল আমার মনে পড়ে মাঝে-মাঝে— এবং এও মনে পড়ে যে সেই সময়ে আমি ঘটনাটিকে ভালো করে লক্ষ করিনি, অনুভব করিনি। রোগ, অবক্ষয়, মৃত্যু— যা-কিছু নিরানন্দ, অসুন্দর, জীবন-বিরোধী, সে-দিক থেকে আমি যেন নিজের অজান্তেই চোখ ফিরিয়ে রেখেছিলাম, বা চোখে দেখেও মনের মধ্যে গ্রহণ করতে পারিনি। আমার দাদামশাই, সেই ‘দা’— মাত্র কয়েক বছর আগেও আমি যাঁকে চোখে হারিয়েছি, কোনো রবিবার সকালে বাজার থেকে যাঁর ফিরতে দেরি হলে আমার কান্না পেয়ে গেছে, যাঁর গায়ের জামায় বর্মি চুরুটের গন্ধটাও খুব ভালো লাগতো আমার—সেই তাঁর মৃত্যুতে আমি যেটুকু কষ্ট পেয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি কেঁদেছিলাম লিটল নেল-এর মৃত্যুর বিবরণ পড়ে— কেননা কল্পনায় কান্নাও সুখের। প্রকৃতি, আমাদের আদিমাতা, যাঁকে সাধারণত স্নেহময়ী বলে ভেবে থাকি আমরা, অথচ যাঁর নিষ্ঠুরতারও অন্ত নেই, তাঁরই খেলার পুতুল আমি তখনও; –আমি উন্মীলমান, আমাকে হাজার হাতে টেনে নিচ্ছে জীবন— ভালো, নিষ্ঠুর, অতীতহন্তা, ভবিতব্যময়, নীতিজ্ঞানহীন জীবন— সেই গতিবেগ ব্যাহত করার মতো শক্তি আমার নেই।

দাদামশাইয়ের মৃত্যু হয়েছিলো আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাস ছয়েক আগে; অবিলম্বে আমাদের আশ্রয় দিলেন দিদিমার মেজো ভাই নগেন্দ্রনাথ, যিনি আমাকে মোতি-মহলে হার্মোনিয়ম বাজাতে শিখিয়েছিলেন। তিনিও পুলিশ বিভাগে কর্ম করেন, থাকেন নগরপ্রান্তিক লালবাগে একটি সুন্দর বাড়িতে, পুলিশ-লাইনের ময়দানের মুখোমুখি : তাঁকে, তাঁর স্ত্রী ঊষাবালাকে আমি ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি— দু-জনেই আমার প্রতি খুব স্নেহশীল। দোতলার দক্ষিণ-খোলা সেরা ঘরটি তাঁরা ছেড়ে দিলেন আমাকে, আমি সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশনের পাট চুকোলাম। লম্বা গ্রীষ্মের ছুটিতে দু-একমাস কাটলো আর্মানিটোলায়, দিদিমার ডাক্তার-ভাইয়ের বাড়িতে, যুদ্ধ- ফেরতা বলে যাঁকে সবাই বলে ক্যাপটেন ঘোষ— তাঁর ছিলো আমার প্রতি ঈষৎ কঠিন সমালোচকের দৃষ্টি, সেই সঙ্গে ভালোবাসাও ছিলো। এর পরে, আমি যখন আই. এ. ক্লাশে ভর্তি হয়েছি বা হবো হবো, তখন আমরা চলে এলাম পুরানা পল্টনে— যাকে তখন পর্যন্ত অনেকেই বলে সেগুনবাগান। আমার সেই সদ্য- পেরোনো কৈশোর- সীমায়, অপর্যাপ্ত আলো হাওয়া আকাশের মধ্যে, ঐ স্থানটিকে আমি কত বিচিত্রভাবে দেখেছিলাম ও অনুভব করেছিলাম, আমার ‘আমরা তিনজন’ গল্পটায় তার নিদর্শন আছে।

ঢাকা শহরের উত্তর প্রান্তে, রেল-লাইন পেরিয়ে দূরে, বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়া রমনার পূর্ব সীমান্তে একটি মস্ত বড়ো সেগুনের বন প্রথম ঢাকায় এসে আমিও দেখেছিলাম। কবে উচ্ছিন্ন হলো সেই বন, সরকারি চাকুরেদের জন্য নতুন একটি পল্লীর পত্তন হলো সেখানে, সে-সব আমি কিছুই জানি না— কিন্তু এ-কথা ঝাপসাভাবে শুনেছিলাম আমার দাদামশাই সেখানে একটি প্লটের জন্য বায়না দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তার পরেই অসুখে পড়লেন তিনি, কিস্তি চালানো আর সম্ভব হলো না; তাঁর টেলিগ্রাফ- মাষ্টার মেজো ভাই সেটি কিনে নিলেন। ততদিনে তাঁদের বহরের বাড়ি পদ্মার জলে তলিয়ে গেছে— তার ধ্বংসাবশিষ্ট কিছু করগেট-করা টিন ছিলো দিদিমার প্রাপ্য; তা-ই দিয়ে স্বামীর স্মৃতিরঞ্জিত জমির উপর একটি বাড়ি তুললেন তিনি— সেই আমাদের সাতচল্লিশ নম্বর পুরানা পল্টন, ক্ষণজীবী ‘প্রগতি’ মাসিকপত্রের কার্যালয়। ঢাকার মধ্যে অনেকবার ঠাঁই নাড়ার পরে সেখানে কাটলো একটানা আমার জীবন— যতদিন না, কলেজি পড়াশুনো সাঙ্গ, কপর্দকহীন, জীবিকার নির্ভর লেখনী, আমি চলে এলাম সেই মহানগরে, যেটাকে ততদিনে আমি আমার পক্ষে একমাত্র সম্ভবপর বাসস্থান বলে চিনে নিয়েছিলাম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন