বুদ্ধদেব বসু
কুমিল্লা আমার জন্মস্থান, কিন্তু আমার স্মৃতির শুরু নোয়াখালিতে। মনে পড়ে ফেরুল- সাহেবের বাগান নামে একটি বাড়ি— উঠোন ঘিরে খানচারকে ঘর, দর্মার বেড়ার ফাঁকে-ফাঁকে সোনালি রোদ ঝিলমিল করে ভোরবেলা, খড়ের চালে মাটির মেঝেতে দুপুরবেলাগুলো ঠাণ্ডা। লাগোয়া এক মস্ত বড়ো বাগিচা— রোদের দিনে নীল সবুজ ঝাপসা এক আভার মতো। ফল এত প্রচুর যে মহিলারা ডাবের জলে পা ধোন, পাখিরা ঠুকরে-ঠুকরে জামরুল-কালোজাম শেষ করতে পারে না। কাছেই গির্জে— সেখানে মসৃণ ঘন ঘাসের বিছানায় হলদের উপর লাল-ছিটেওলা বড়ো-বড়ো কলাবতী ফুল ফুটেছে, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও শান্ত। কিন্তু আমি সেদিকে পা বাড়াতে লুব্ধ হই না— রবিবার সকালে শাদা প্যান্ট অথবা রঙিন ঘাঘরা-পরা যেসব কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের সেখানে দেখা যায় তাদের কেমন কিম্ভূত বলে মনে হয় আমার— না- বাঙালি, না-সাহেব, বড্ড বিজাতীয়।
কিন্তু আমার প্রথমতম স্মৃতি আরো আগেকার। পঞ্চাশ বছর আগে দেখা কোনো স্বপ্নের মতো, ধূসর অতীতে ট্রেনের কামরায় হঠাৎ-চোখে-পড়া কোনো মুখের মতো, কয়েকটা ছবি আটকে আছে আমার মনে— সুদূর কিন্তু স্পষ্ট, যেন স্টিরিয়োস্কোপের মধ্য দিয়ে দেখা। আমি দুলে-দুলে পড়ছি— ‘আমি কেমন নাইতে পারি। মণি পারে না, টুনিও পারে না। তারা বলে, “আমরা গায়ে দল্ দেবো না।” তারা জলকে বলে দল। ছেলেমানুষ কিনা, তাই। কথাগুলোকে নিয়ে আমার জিভ যেন খেলা করছে, ‘ছেলেমানুষ কিনা, তাই’ বলতে গিয়ে আমি হেসে উঠছি খলখল করে, বেগনি কালিতে ছাপা বড়ো-বড়ো অক্ষরগুলিতে কত যে খুশি পোরা আছে আমি যেন তার তল পাচ্ছি না। দুপুরবেলা কোনো-একটা ঘরে একলা আছি আমি; উঁচু করে উল্টে- রাখা রাতের বিছানায় ঠেশান দিয়ে টকটকে লাল মলাটের মস্ত বড়ো সাইজ়ের ‘বালক’ পত্রিকা পড়ছি— বা হয়তো শুধু কাঠের ব্লকে ছাপা জীবজন্তুর ছবিগুলো দেখছি— ঝিরঝির হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে— আমার খুব ভালো লাগছে। বিকেলে বেড়াচ্ছি পেরাম্বুলেটরে চড়ে, আমার হিন্দুস্থানি দাই যশোদা আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, রাস্তার ধারে মাঠে চলছে টেনিস খেলা, একটা বল্ লাফাতে-লাফাতে আমার কোলে এসে পড়লো— খেলোয়াড় ভদ্রলোকেরা সেটি আমাকে দিয়ে দিলেন, আমি দু-হাতে আঁকড়ে ধরলাম সেই ধূসর-শাদা আঁটো নিটোল গোলকটিকে, মুখের কাছে তুলে নিলাম— বিকেলের রোদে রবারের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। সন্ধেবেলার আবছা আলোয় উঠোন জুড়ে আলপনা দিচ্ছেন আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা বিধবা, আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছি। উঠোনে জ্যোছনা ফুটলো, চালের গুঁড়োর ফ্যাকাশে লাইনগুলোকে চকচকে শাদা দেখাচ্ছে এখন— বড্ড ঘুম পাচ্ছে আমার, দিদিমা আমাকে ডাল আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। আমার মাথা ঢুলে পড়ছে ঘুমে, লণ্ঠন থেকে দশটা আলোর তীর আমার অর্ধেক-বোজা চোখের মধ্যে বিধছে— আমার নাক টের পাচ্ছে মুসুর- ডালে তেজপাতার সুগন্ধ, সেদ্ধ ডিমের সরল কোমল মসৃণতা আমার জিহ্বাকে আদর করছে। এই স্মৃতিগুলির সময় আলাদা, ঘটনাস্থলও নিশ্চয়ই এক নয়— কোন বছরে, কোন শহরে এ-সব সুখ আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিলো, সে-বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই— কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে আমার চেতনার প্রথমতম মিলনের চিহ্ন এগুলোই।
বৃদ্ধা বিধবাটির বিষয়ে আরো কথা বলার আছে। তিনি সম্পর্কে ছিলেন আমার দাদামশায়ের মামিমা— বারদির নাগ-পরিবারে বাল্যবয়সে তাঁর বিবাহ হয়, বিবাহের স্বল্পকাল পরেই স্বল্পদৃষ্ট স্বামীকে হারান। কেমন করে, ভাশুর দেওর ভাই ইত্যাদি নিকটতর সম্ভাবনা ছাড়িয়ে, তিনি তাঁর স্বামীর ভগিনীপুত্রের সংলগ্ন হয়ে পড়েন, সে- ইতিহাস আমি জানি না; কিন্তু আমার সুদূরতম স্মৃতিতেও তাঁকে উপস্থিত দেখতে পাই। শ্বশুরকুল বা পিতৃকুলের অন্য কোনো আত্মীয়ের কথা তাঁর মুখে আমি কখনো শুনিনি, ভবসংসারে তাঁর আপন জন বলতে তিনি চিন্তাহরণ-স্বর্ণলতাকেই বুঝতেন। শুধু একটিমাত্র ক্ষীণসূত্রে শ্বশুরকুলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি; নাগ-পরিবারের সম্পত্তি থেকে বাৎসরিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি তাঁর বরাদ্দ ছিলো। সেই টাকা কখনো আসে, প্রায়ই আসে না; সেটা নিয়মিত পাবার জন্য, এমনকি টাকার অঙ্ক বাড়াবার জন্য তিনি চেষ্টা করেন মাঝে-মাঝে— একে ধরে, তাকে ধরে করুণ সুরে বলেন তাঁর পাওনাটা যে করে হোক আদায় করে দিতে। এর বেশি তাঁর সাধ্য নেই, কেননা বৈষয়িক ব্যাপার তিনি কিছুই বোঝেন না, লেখাপড়াও খুব অল্পই জানেন। প্ৰায় কেউই কানে তোলে না তাঁর কথা— সকলেই জানে তাঁর টাকার কোনো দরকার নেই, তিনি এ-সব বলেন শুধু নিয়মরক্ষা হিশেবে, বা অন্য কেউ উস্কে দিয়েছে বলে। আর সেই সব বিরল দিনে, হঠাৎ তাঁর নামে মনি-অর্ডার এসে পৌঁছয় যখন, তিনি আঁকাবাঁকা অক্ষরে ‘বামাসুন্দরী নাগ’ সই করে, এক গাল হেসে তাঁর বহুপ্রার্থিত পঞ্চাশটি টাকা ভাগনে-বৌয়ের হাতে তুলে দেন।
ছোট্ট মানুষ বামাসুন্দরী, গড়নটি ছিপছিপে পাৎলা— বা হয়তো তাঁর সুদীর্ঘকালের উপবাসবহুল জীবনযাত্রা তাঁর দেহে এক ফোঁটা চর্বি জমতে দেয়নি। মাথার কাঁচা-পাকা চুল চাঁদি-সমান ছোটো করে ছাঁটা, থান-ধুতির আঁচলটাই তাঁর গায়ের আবরণ। আমি তাঁকে দেখেছিলাম অন্তত বাইশ বছর ধরে একটানা— প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় একই রকম। অতগুলো বছরের মধ্যে তাঁর বার্ধক্য যেন বৃদ্ধি পায়নি, চুল ধবল হয়নি, লোল হয়নি চামড়া, তাঁর দেহ ছিলো সচল আর মন ভ্রান্তিহীন। শুধু শেষের দিকে একটু বেশি নুয়ে পড়েছিলেন হয়তো, আর ছুঁচে সুতো পরাতে হলে আমার কাছে নিয়ে আসতেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো আমারই কাছে— কলকাতায়–বিনা রোগে, বিনা যন্ত্রণায়, অল্প কয়েকদিন শুয়ে থাকার পরে। তাঁর বয়স তখন কত হয়েছিলো আমি জানি না— নিশ্চয়ই আশি পেরিয়েছিলো, নব্বুই হলেও হতে পারে।
আজকের দিনে বামাসুন্দরীর কথা ভাবলে আমার মনে হয় তিনি তাঁর বৈধব্যজনিত বঞ্চনার উপর চেষ্টাহীনভাবে জয়ী হয়েছিলেন। অন্য অনেক বিধবার মধ্যে যে-মানসিক মালিন্য বা অম্লতা বা দীনতা আমি লক্ষ করেছি, তার সংক্রাম তাঁকে ছুঁতে পারেনি কখনো। মৃদু ও স্নিগ্ধ তাঁর স্বভাব, কোনো কারণেই তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কটু কথা বেরোয় না, সর্বদাই তিনি প্রসন্ন ও অভিযোগহীন। তাঁকে দিনমান দেখি কোনো-না- কোনো কাজ নিয়ে ব্যাপৃত— বাধ্য হয়ে নয়, তাঁর নিজেরই গরজে। ভোরে উঠে গোবর-ছড়া দেন সারা উঠোনে— বাঁ হাতে কোমরের কাছে পাত্রটি ধরে ডান হাতে গোবর-জল ছিটোতে-ছিটোতে এগিয়ে যান— তালে-তালে পা ফেলে, মুহূর্তের জন্য না-থেমে— তাঁর হাত পা কোমরের ভঙ্গি নর্তকীর মতো সাবলীল। সরু করে লাউ কুটতে, সুপুরি কাটতে তিনি ওস্তাদ; তাঁর হাতের নিরামিষ রান্না আমার মনে হয় অমৃতের মতো সুস্বাদু। ডালের বড়ি, কাসুন্দি আচার আমসত্ত্ব, আস্কেপিঠে আর পাটিসাপটা, তিলের নাড়ু, চিঁড়ের মোয়া, নারকোলের মিষ্টি— ঋতু অনুসারে এ-সব দ্রব্য তিনি নিখুঁতভাবে রচনা করেন, আর অন্য সব কাজ ফুরিয়ে গেলে বসে যান কাঁথা-সেলাই নিয়ে। তাঁকে আমি কখনো দেখিনি অসুস্থ হতে, কখনো দিনে ঘুমোতেও দেখিনি। উপন্যাস পড়ার মতো বিদ্যে নেই তাঁর, যাকে বলে ‘ধর্মকর্ম’ সেদিকেও তেমন অভিনিবেশ নেই; কিন্তু যেহেতু তাঁর কাজ এত প্রচুর, আর কাজেই তিনি সুখ পান, তাই তাঁর হাতে সময় কখনো ভারি হয়ে ওঠে না— তাঁর প্রতিটি দিন ভরপুর।
বামাসুন্দরী কোনো গুরুর ভজনা করেননি, তীর্থদর্শনের জন্য কাঙাল হয়নি তাঁর মন, সংসার ছেড়ে কাশীবাসী হতেও ইচ্ছে করেননি কখনো। কিন্তু বাড়ির মধ্যেই কয়েকটি নিরভিমান অনুষ্ঠান-পালনে তাঁর আগ্রহ ছিলো। রোজ সকালে মাটি দিয়ে একটি শিবলিঙ্গ গড়েন, বেলা হলে ফুল বেলপাতা কমণ্ডলুর জলে পুজো করে বিসর্জন দেন সেটিকে, একটা অদ্ভুত কায়দায় জিভ নেড়ে নেড়ে ববম্ববম্ শব্দ করেন পুজোর শেষে। আমরা যখন যে-বাড়িতে থাকি সেখানেই তাঁর যত্নে একটি তুলসী-গাছ লালিত হয়, সন্ধেবেলা তিনি মাটির দীপ জ্বেলে দেন সেখানে; মাঝে-মাঝে, ছোটো ছেলেমেয়ের দল জুটিয়ে হরিলুঠের আসর জমাতেও তাঁর ভুল হয় না। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার তিনি মঙ্গলচণ্ডী ব্রত করেন— আমার পক্ষে অতি সুখের সেই ঘটনা, কেননা পুজো-আর্চার শেষে বামাসুন্দরী মঙ্গলচণ্ডী-ব্রতকথা শোনান। তিনি বলেন কথকতার ঢঙে সুর করে, প্রতিদিন একই সুরে, অবিকল এক ভাষায় প্রতিদিন। কোনো পুঁথির সাহায্য নেয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে, তা নেবার কোনো প্রয়োজনও হয় না— কেননা সবই তাঁর কণ্ঠস্থ, তিনি যাঁর মুখে শুনে-শুনে শিখেছিলেন তাঁরও নিশ্চয়ই কণ্ঠস্থ ছিলো। এক গৃহিণী মঙ্গলচণ্ডীর কৃপায় ধনে-জনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেন, কিন্তু অত সুখ তাঁর সহ্য হলো না; তিনি চাইলেন কোনো দারুণ দুঃখ, দুঃসহ ক্ষতি, কিন্তু ছেলেকে বিষের নাড় পাঠিয়েও পারলেন না নিজের কোনো অনিষ্ট ঘটাতে— যতদিন না, স্যাঙানির পরামর্শে, তিনি মঙ্গলচণ্ডীকে পরিত্যাগ করলেন। এ-ই হলো কাহিনীর চুম্বক, যদিও এর সমাপ্তি অবশ্য সুখের— মঙ্গলচণ্ডী ব্রত নতুন করে শুরু করামাত্র ভদ্রমহিলা তাঁর লুপ্ত ঐশ্বর্য ফিরে পেলেন, মৃতেরা সুদ্ধ বেঁচে উঠলো আবার। এই রূপকথা— যা কোনো বইতে আমি পড়িনি— তা আমার বয়ঃপ্রাপ্ত জীবনে বারে-বারেই মনে পড়েছে আমার; নিরবচ্ছিন্ন সুখভোগ যে ক্লান্ত ও জীর্ণ ও নির্জীব করে দেয় মানুষকে, আমাদের জীবনে দুঃখও যে জরুরি একটি উপাদান— আমার মনে হয়েছে এই কথাটাই এর বার্তা।
অন্য একটি ঘটনা মনে পড়ে। আমার দাদামশায়ের এক তরুণবয়সী ভ্রাতৃবধূ তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত বৈধব্য ও বালক-পুত্রকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তাঁর সান্ত্বনার জন্য এক পূজারি ব্রাহ্মণকে ডাকা হলো; তিনি গীতা থেকে পড়ে শোনালেন— প্রথমে সংস্কৃতে, তারপর বাংলায় ব্যাখ্যা করে-করে। ‘লোকেরা যেমন পুরোনো কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরে, তেমনি …’ এ-সব কথা ঐ শোকার্তাকে শোনানো সেই বালকবয়সেই আমার প্রহসন বলে মনে হয়েছিলো, কিন্তু ‘বাসাংসি জীর্ণানি’র শব্দসমাবেশ কেমন যেন কাঁপিয়ে দিয়েছিলো আমাকে—উপমা কাকে বলে তা না-জেনেও উপমাটিকে আমি ভালোবেসেছিলাম। সংস্কৃত কবিতার ধ্বনিকল্লোলের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়— এমন একটা সময়ে, যখন সংস্কৃত বলে যে আলাদা একটা ভাষা আছে তাও হয়তো আমি জানি না।
ক্ষুদ্র এক মফস্বল শহর, নোয়াখালি। কোনো ঐতিহাসিক স্মৃতির সঙ্গে জড়িত নয়, ইসলামধর্মের প্রাধান্য সত্ত্বেও মোগলপাঠানের কোনো পদচিহ্ন নেই এখানে, নেই কোনো সাবেক কালের মসজিদ না মঞ্জিল, যা লোককে ডেকে দেখানো যায়। আঞ্চলিক ভাষায় উর্দুর অনুপ্রবেশ ঘটেনি, কিন্তু মগ শব্দ অজস্র, আর বাচনভঙ্গি ও ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ এত অদ্ভুত যে আমরা কাঠবাঙালরাও সব কথা বুঝতে পারি না। এককালে পর্তুগীজ বোম্বেটেরা এই পূর্বতটরেখায় দাপাদাপি করে বেড়িয়েছে— সেই সব দুর্ধর্ষ পুরুষের এক শেষ বংশধরকে আমি চোখে দেখেছিলাম। তাম্রবর্ণ খর্বকায় এক প্রৌঢ়, সারাদিন শুধু পথে-পথে ঘুরে বেড়ায় সে, রাস্তার লোক ধরে-ধরে খাশ নোয়াখালির বুলিতে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে কথা বলে। বালক আমাকেও সে তার শ্রোতা করে নিয়েছিলো একদিন, হয়তো তার জীবনবৃত্তান্ত শুনিয়েছিলো—তা থেকে শুধু এই কথাটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ‘তামুক’ খেতে সে ভালোবাসে।
পূর্ব-দক্ষিণ বাংলায় মেঘনা যেখানে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে সেখান থেকে নোয়াখালি খুব কাছেই। কিন্তু এই ভৌগোলিক সংস্থানের জন্য কোনো মর্যাদা পায়নি এই শহর— নদীটি নাব্য নয় বলে হতে পারেনি কোনো বাণিজ্য-কেন্দ্র, চট্টগ্রাম অদূরে বলে কোনো সামরিক আস্তানাও হলো না। যেন পড়ে আছে ভারতবর্ষ ও বঙ্গভূমির এক প্রান্তে— অখ্যাত এবং প্রায়-অজ্ঞাত— বৃটিশ সাম্রাজ্যের দুর্নিরীক্ষ্য এক বিন্দু, কাচারি আদালত থানা পুলিশ জেলখানা নিয়ে বিশাল প্রশাসন-যন্ত্রের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অংশ মাত্র। এখানে শিক্ষিতেরা সকলেই প্রায় সরকারি চাকুরে, বা উকিল মোক্তার স্কুলমাষ্টার— অন্যেরা দোকান চালায় বা শহরে আসে মামলার দায়ে বা বেচাকেনা করতে। ছেলেদের জন্য হাইস্কুল আছে তিনটি, কিন্তু একটিমাত্র মেয়েদের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর উপরে পড়ানো হয় না। হাটে-বাজারে মাছ দুধ শাকসব্জি ওঠে প্রচুর, কিন্তু অন্য সব দ্রব্য নেহাৎই আটপৌরে গোছের— আর শুধু একটি দ্রব্যেই নোয়াখালির কোনো বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। বিরাট স্তূপে পড়ে থাকে রাশি-রাশি কী-একটা জিনিশ— শুকনো এবং বিবর্ণ এবং আকৃতিহীন— আমি ভাবতাম জ্বালানি-কাঠ হবে বুঝি, একদিন শুনলাম সেগুলোই শুঁটকি মাছ।
জীবন চলে মন্থর, বিশ-শতকী ব্যস্ততা থেকে সুদূর, দিনের পর দিন একই বৃত্তে ঘুরে-ঘুরে। লোকেরা কর্মস্থলে যায় এবং ফিরে আসে, দোকান খোলে এবং দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে— সবই পান-চিবোনো মৃদু ছন্দে, প্রতিযোগিতার সুযোগ নেই বলে কোনো তীব্র সুর কখনো বেজে ওঠে না। শহরের মধ্যে এমন কোনো দূরত্ব প্রায় নেই যা অক্লেশে হেঁটে পেরোনো না যায়, তবু যাঁরা অতিমাত্রায় দ্রুতিপ্রেমিক তাঁরা সাইকেল চালান। কোনো-এক আবদুল করিম বা রহমৎ খাঁর পরিচালিত একটি কি দুটি ঘোড়ার গাড়ি আছে— বাবুরা তা ব্যবহার করেন শুধু মালপত্র নিয়ে সপরিবারে রেল-স্টেশনে যাবার জন্য, আগের দিন বলে রাখলে তবে সময়মতো পাওয়া যায়। বিকল্প যান— গোরুর গাড়ি, সেটা অনেক বেশি জনপ্রিয়। একটি যাত্রী-ট্রেন আসে চাঁদপুর থেকে ভোরবেলা, সন্ধের আগে আবার চাঁদপুরের দিক রওনা হয়ে যায়— বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় সেই ট্রেন। রাত্রে রাস্তায় আলো জ্বলে না, বা জ্বললেও কেরোসিনের কালিমার তলায় প্রচ্ছন্ন থাকে— লোকেরা বেরোয় লণ্ঠন আর কেউ-কেউ সাপের ভয়ে লাঠি হাতে নিয়ে। আর বেরোবার মতো উপলক্ষও যে লোকেদের খুব বেশি জোটে তা নয়, এবং অন্য এক কারণেও রাতের ঘণ্টাগুলোকে ছাঁটাই করার প্রয়োজন ঘটে। সন্ধে নামতেই মশারা এমন বিস্তীর্ণভাবে দখল করে নেয় শহরটিকে, তারা গর্জনে এত প্রবল আর দংশনে এত সুতীক্ষ্ণ ও অপ্রতিহত, যে ন-টার মধ্যে আহারাদি সেরে মশারির তলায় পলায়ন ছাড়া নিরীহ ভদ্রলোকের আর-কোনো উপায় থাকে না।
কয়েকটা মনোরম ছবিও চোখে আছে আমার। গাছপালা অজস্র, যেখানে-সেখানে পুকুর, সারা শীত গৃহস্থের উঠোন আলো করে রেখেছে লাল আর হলদে রঙের গাঁদাফুল, ফুটে আছে পথের ধারে ধারে পাতার ফাঁকে রক্ত-লাল জবা আর হলুদ- রাঙা ঘণ্টার মতো টগর, কোনো-এক সরকারি আপিশের বাগানে রঙে-রং-মেশানো বিচিত্র সব পাতাবাহার, চৈত্রমাসে আগুন-লাল শিমুল ফেটে গিয়ে ছোটো ছোটো তুলোর বল হাওয়ায় ভাসে। হলুদ আর টকটকে লাল শুকনো পাতার উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায় গোসাপ— মানুষের সঙ্গে দেখা হলে চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকে। আছে রৌদ্রের জীব প্রজাপতি অনেক, অন্ধকারে ঝকঝকে সবুজ জোনাকির ঝাঁক। আছে আকাশ-জোড়া ঝিমঝিম জ্যোৎস্না, আর শীতের জ্যোৎস্নায় ঘন কুয়াশার আস্তরণ, যাতে চেনা জিনিশ রহস্যময় হয়ে ওঠে, হঠাৎ তাকালে মানুষ বা মানুষের মতো আকৃতি দেখা যায়। আর অবশ্য নদীও আছে— কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেটা মনোরম নয়।
নোয়াখালির মেঘনার মতো এমন হতশ্রী নদী পৃথিবীর অন্য কোথাও আমি দেখিনি। রুক্ষ পাড়ি, ঘাট নেই কোথাও, কেউ নামে না স্নান করতে, কোনো মেয়ে জল নিতে আসে না। তরণীহীন, রঙিন পালে চিহ্নিত নয়, জেলে-ডিঙির সঞ্চরণ নেই— একটিমাত্র খেয়া-নৌকো দেহাতি ব্যাপারিদের নিয়ে সকালে-সন্ধ্যায় পারাপার করে। শহরের এলাকাটুকু পেরোলেই নদীর ধারে-ধারে ঘন বনজঙ্গল, নয়তো শুধু বালুডাঙা, মাঝে- মাঝে চোরাবালিও লুকিয়ে আছে— শীতে গ্রীষ্মে বিস্তীর্ণ চরের ফাঁকে-ফাঁকে শীর্ণ জলধারা বয়ে যায়। বর্ষায় স্ফীত হয়ে ওঠে নদী— বিশাল— অন্য তীর অদৃশ্য; কিন্তু তখনও চোখ খুশি হতে পারে না, বরং আমার ভয় করে সেই কালচে-ব্রাউন বিক্ষুব্ধ জলরাশির দিকে তাকাতে— যার উপর দিয়ে, বর্ষার ক-মাস, একটি নিঃসঙ্গ স্টিমার যাতায়াত করে হাতিয়া-সন্দ্বীপে— পৃথিবী-ত্যক্ত দুই দ্বীপ, যেখান থেকে প্রায়ই ভেসে আসে সর্পদংশনের ভীষণ সব কাহিনী। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ঝড়ের সংকেত আসে মাঝে-মাঝে, ঘূর্ণি হাওয়ায় এঁকে-বেঁকে পাৎলা বৃষ্টি পড়ে সারাদিন বারো-শো ছিয়াত্তর বা অন্য কোনো দূর- বছরের বন্যার স্মৃতি লোকেদের বুকের মধ্যে দুরুদুরু করে*। আর এই সব-কিছুর উপরে আছে— ভাঙন, অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য ভাঙন। প্রতি বর্ষায় নদী এগিয়ে আসে শহরের মধ্যে— প্রায় লাফিয়ে-লাফিয়ে— বিরাট বুড়ো বটগাছ আর অগুনতি পাখির বাসা নিয়ে মস্ত বড়ো মাটির চাঁই ধ্বসে পড়ে হঠাৎ, ধোঁয়া ওঠে জলের মধ্যে কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই নদী আবার নির্বিকার। আমি একাধিকবার এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলাম- একবার কিছুটা বিপজ্জনকভাবে। শোনা গেলো অমুক সাহেবের বাংলোকে নদী ধরে ফেলেছে, তিনি সব জিনিশপত্র শস্তায় বেচে দিয়ে চলে যাচ্ছেন— রোববার সকালে দাদামশাই আমাকে নিয়ে হাজির হলেন সেখানে, আমার পড়ার মতো কোনো বই যদি বা পাওয়া যায়। আমরা যখন একমনে বই দেখছি, ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে পাশের ঘরটি ধ্বসে পড়লো— একটি ফিরিঙ্গি যুবক জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচালো, বরাতজোরে সে-ঘরে তখন আর কেউ ছিলো না। মুহূর্তের মধ্যে সব লোক বেরিয়ে এলো রাস্তায়, দাদামশাই কাঁপতে-কাঁপতে আমার হাত ধরে বাড়ির পথ ধরলেন, কিন্তু তার আগেই তিনি জুটিয়ে ফেলেছিলেন আমার জন্য এক বাণ্ডিল বাছা-বাছা বই।
[*এক পাঠক আমাকে রাজকুমার চক্রবর্তী প্রণীত ‘সন্দ্বীপের ইতিহাস’ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করে পাঠিয়েছেন; তাতে জানা যায় সন্দ্বীপ দু-বার বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছিলো— বঙ্গাব্দ ১২৩২ ও ১২৮৩ সালে— শেষেরটি ‘তিরাশি সনের ঢল’ নামে নোয়াখালি জেলায় কথিত হয়ে থাকে।]
এই বাংলোটি ছিলো শহরের দক্ষিণ প্রান্তে— আমার ছেলেবেলার নোয়াখালির সেটাই অভিজাত পল্লী। সুন্দর বেড়াবার রাস্তা, ঊর্ধ্বতন সরকারি চাকুরেদের জন্য বড়ো- বড়ো কম্পাউণ্ডওলা বাড়ি, পানীয় জলের জন্য সুরক্ষিত চোখ-জুড়োনো ‘বড়ো দিঘি’— এই সব ছিলো সেখানে, আর আমি কিছুটা বড়ো হয়ে উঠতে-উঠতে এই সবই জলের তলায় অদৃশ্য হয়েছিলো। আমরা যখন নোয়াখালি ছেড়ে চলে আসি তখন নদী প্ৰায় শহরের মধ্যিখানে এসে পড়েছে। যে-নোয়াখালিতে আমি ছিলাম, যার মানচিত্রের একটি রেখাও আমার মনে ঝাপসা হয়নি এখনো, সেটিকে এখন অবলুপ্ত বলে ধরে নিলে আমি বোধহয় ভুল করবো না। তথ্য হিশেবেও সেটাই ঠিক বলে জানি।
কিন্তু এই ধ্বংসপরায়ণ মেঘনাই নোয়াখালিকে দিয়েছিলো তার সংবৎসরের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য, বৃহত্তম ঘটনা— তার ডার্বি, তার রথের মেলা, তার মোহনবাগান-ঈস্টবেঙ্গল ফাইনেল। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের অমাবস্যায়, মধ্যাহ্নের কোনো-এক লগ্নে সমুদ্র থেকে বান আসে নদীতে— স্থানীয় ভাষায় বলে ‘শর’। ঘরে-ঘরে সেদিন সকাল থেকে চাঞ্চল্য, একটা উৎসবের ভাব। আমার যতদূর মনে পড়ে, স্কুলগুলোতে ছুটি থাকতো কিছুক্ষণ, কাচারি-আদালতেও কাজকর্ম স্থগিত— সেই সময়টুকুর জন্য সকলেই সেদিন নদীর ধারে, অন্তঃপুরিকা মহিলারাও ভালো কাপড় পরে দিনের আলোয় বেরিয়ে এসেছেন। যতদূর মনে পড়ে, দিনটি থাকতো প্রতি বছরই রৌদ্রোজ্জ্বল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি পূর্বদিগন্তে তাকিয়ে— শান্তাসীতার মোহানার দিকে— যেখানে ম্লান-সবুজ বনরেখার পরে মস্ত একটা দুয়ার যেন খুলে গেছে, আকাশ নুয়ে পড়েছে জলের উপর— তাকিয়ে আছি সেই ঝাপসা-ধোঁয়াটে অগ্নিকোণের দিকে, যেখান থেকে অগ্নিবর্ণ সূর্যের উদয় শীতের ভোরে অনেকবার আমি দেখেছি, আর যেখান থেকে, একটু পরেই, যে-কোনো মুহূর্তে, সমুদ্রের ঢেউ ছুটে আসবে আমাদের চোখের সামনে। ঐ আসছে।
দুধের মতো শাদা একটি ফেনিল রেখা প্রথমে, তারপর শোঁ-শোঁ শব্দে সমুদ্র এলো ঝাঁপিয়ে— মস্ত বড়ো নদীটা যেন দুলে, ফুলে, গর্জে উঠে আরো অনেক প্রকাণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়লো— তার বিস্তার জুড়ে হাজার ঘোড়ার দাপাদাপি, হাজার স্টিমারের এঞ্জিন যেন পাকে-পাকে ছিটিয়ে দিচ্ছে তার ফেনা, তার ঘূর্ণি, তার সব নীল কালো বেগনি বাদামি শাদা রঙের ঝলক— দুপুরবেলার রোদ্দুরে আরো উজ্জ্বল— এক বিপুল রঙ্গ ঢেউ তুলে-তুলে পশ্চিম দিকে ছুটে চলে গেলো। দৃশ্যটির মেয়াদ হয়তো পাঁচ মিনিটের বেশি হবে না, কিন্তু লোকেরা তা নিয়ে বলাবলি করে অনেকক্ষণ— কেমন হলো এবার, আগের বছরের চাইতে ভালো, না কি এবারে তেমন জমলো না?
জীবনে আমি প্রথম যে-কবিতাটি লিখেছিলাম, সেটি এই নদীর সঙ্গেই সম্পৃক্ত।
একবার আমরা ছিলাম এমন একটি বাড়িতে, যা নোয়াখালির সবচেয়ে ভালোর মধ্যে একটি— পূর্বোল্লিখিত দক্ষিণপ্রান্তিক অভিজাত পাড়াতেই। নোয়াখালিতে এটা আমাদের চতুর্থ বাসা, পাকা বাড়ি এটাই প্রথম ও একমাত্র। আমাদের সঙ্গে থাকতে এলেন আমার দিদিমার দুই সন্তানবতী ও অন্তঃসত্ত্বা ভ্রাতৃবধূ— একজনের স্বামী টুরের চাকরিতে ভ্রাম্যমাণ, অন্যজনের ডাক্তার-স্বামী যুদ্ধের অফিসার হয়ে মিশরে গেছেন— তখন প্রথম-মহাযুদ্ধ চলছে। সেইজন্যে বড়ো বাড়ির দরকার হলো।
কিন্তু ‘বড়ো বাড়ি’ বলতে মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে যে-ছবি ফোটে এটি ঠিক সে- রকম নয়; এর মাপজোক গড়নপেটনের সঙ্গে আমাদের তখনকার বা এখনকার ধারণার কোনো মিল নেই। যাকে বলা হয় ‘কলোনিয়েল স্টাইল’, যার দুটি-চারটি জীর্ণ নমুনা কলকাতার চৌরঙ্গি পাড়ায় বা মফস্বলের পুরোনো কোনো ডাকবাংলোতে এখনো দেখা যায়, সেই ছাঁদের বাড়ি— লোকেরা বলে ডেলনি-হাউস— আদি যুগে খুব সম্ভব কোনো হার্মাদ— মানে, পর্তুগীজ়ের কুঠি ছিলো। মস্ত উঁচু প্লিথের একতলা, দশ- বারো ধাপ দীর্ঘাকার সিঁড়ি উঠে চওড়া একটি বারান্দা পাওয়া যায়, সামনে দুটো প্রকাণ্ড হল্-ঘর পাশাপাশি, দু-পাশে আরো দুটো ঘর যেগুলিকে সংসর্গের জন্য ছোটো দেখালেও আসলে বেশ হাত-পা-ছড়ানো, প্রায় সেই মাপেরই হাত-কমোড-বসানো বাথরুম, খাবার ঘরটির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে কাউকে ডাকলে অন্য প্রান্ত থেকে সে শুনতে পায় না। এ ছাড়া আর-একটি বারান্দা আছে পিছন দিকে, টালির ছাদের আলাদা রান্নাবাড়ি, গোসলখানা— আর পশ্চিমে আরো দুটো ঘর যেগুলো আমাদের অধিকারভুক্ত নয়, সেখানে এক জমিদারের শেরেস্তা বসে। শোনা যায় এর প্রথম মালিক লবণের ব্যাবসায় পয়সা করেন, বাড়ির তলায় মস্ত বড়ো আস্তাবল ছিলো তাঁর- প্লিন্থ-এর গায়ে সারি-সারি তোরণাকৃতি ফোকরগুলো ছিলো ঘোড়াদের যাওয়া-আসার দরজা।
আমরা যখন প্রথম এলাম, তখন দক্ষিণের বারান্দা থেকে নদী দেখা যায়, কিন্তু প্রথম বর্ষা কেটে যাবার পরেই নদী অনেক এগিয়ে এলো, দ্বিতীয় বর্ষায় বড়োদের মুখে বলাবলি শুনলাম এ-বাড়িতে আর বেশিদিন থাকা যাবে না। একদিন সন্ধেবেলা দক্ষিণের ছোটো ঘরে বসে হঠাৎ একটা কবিতা লিখে ফেললাম— ইংরেজিতে। ছ-সাত স্ট্যাজ়ার কবিতা— প্রথমটা আমার মনে আছে এখনো।
Adieu, adieu, Deloney House dear,
We leave you because the sea is near,
And the sea will swallow you, we fear.
Adieu, adieu.
ইংরেজিতে কেন? আমি জানি না— ইংরেজিতে এসেছিলো, এ ছাড়া আমার কোনো উত্তর নাই। কিন্তু ইংরেজিতে কেন ‘এসেছিলো, তারও কোনো কারণ আছে নিশ্চয়ই? আমার বয়স তখন নয় হবে বা কিছু বেশি, হেম নবীন মধুসূদনের সঙ্গে চেনাশোনা হচ্ছে, আমি জানি এবং মানি এঁরা ‘বড়ো’ কবি, ‘মহাকবি’— কিন্তু আসলে হয়তো অনেক বেশি ভালো লাগছে ‘ওয়ান থাউজ়েও অ্যাণ্ড ওয়ান জেম্স অব ইংলিশ পোইট্রি’ নামে লাল মলাটের মোটা বইটা— আমার পুরোনো এক সঙ্গী যার ছোটো-ছোটো অক্ষরে আমি প্রথম পড়েছিলাম ওঅর্ডস্বার্থ, কৃপার, টমাসগ্রে-র এলিজি, এরিয়েল-এর গান। আসলে আমার জীবনে তখনও রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব হয়নি, শৈশবোত্তর বাংলা কবিতার অমৃতস্বাদ আমি পাইনি তখনও। হয়তো সেইজন্যেই এই বিদেশী ভাষায় ডেলনি-হাউসকে বিদায় জানিয়েছিলাম।
ঐ ইংরেজি পদ্যটা বিশুদ্ধ এক দৈব ঘটনা। ‘হাসিখুশি’ ‘হাসিরাশি’র আমল থেকেই ছন্দোবদ্ধ রচনা আমি ভালোবেসেছি, নামতা অথবা সংস্কৃত শব্দরূপের চেয়ে অনেক সহজে তা মুখস্থ হয়ে গেছে আমার— কিন্তু আমি নিজে ঐ জাতীয় কিছু রচনা করবো, এমন ইচ্ছে বা কল্পনা এর আগে আমার মনে জাগেনি কখনো। কিন্তু প্রথম পাপটি করে ফেলার পর, আমি কবিতাকে আর ছাড়তে পারলাম না, অথবা কবিতাই আর নিস্তার দিলো না আমাকে— কিন্তু এর পর থেকে যা-কিছু লিখি, সবই বাংলায়। কেন ইংরেজি ছেড়ে বাংলা ধরলাম সেটাও আমি বলতে পারবো না— কেউ আমাকে পরামর্শ দেননি, বলে দেননি বাংলায় লিখতে, আর ভেবে-চিন্তে বেছে নেবার মতো বুদ্ধি যে আমার তখনও হয়নি, তা অবশ্য না-বললেও চলে।
প্রায় রোজই লিখি একটি-দুটি পদ্য, রুল-টানা বাঁধানো খাতায় আসমানি রঙের জে. বি. ডি. কালিতে, খাগের বা পালকের বা স্টিল-নিবের কলম চালিয়ে— লিখি নিয়ম করে, মাষ্টারমশাই যেমন স্কুলের ছেলেকে হোম-ওঅর্ক দেন, তেমনি আমি নিজেই নিজেকে টাস্ক দিয়েছি। বিষয়গুলি খুব গতানুগতিক— ‘নদী’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রভাত’, ‘সূর্যাস্ত’— এই ধরনের, আমার চলন টলোমলো, ছন্দ ভাঙাচোরা, আমার মডেল বোধহয় ‘সম্ভাবশতক’ বা মানকুমারী বসুর কবিতা। কিন্তু ক্রমশ এই ছেলেমানুষি চেষ্টা আমাকে সুখ দিতে লাগলো, আমার কলম হয়ে উঠলো দ্রুত-সচল, ডেলনি-হাউস ছেড়ে যাবার আগেই আমি পয়ারে-ত্রিপদীতে একটা সপ্তকাণ্ড রামায়ণও লিখে ফলেছিলাম, মনে পড়ে— খুব খুশি হয়েছিলাম লিখে উঠে- কিন্তু সম্ভবত সেটা ছোট্ট রামায়ণে’রই চর্বিতচর্বণ।
এই সময়কার আর-একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন