বুদ্ধদেব বসু
এক শীতের সকালে— আমরা তখন ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছি— আমার এক আত্মীয় ঘরে ঢুকে আমাকে বললেন, ‘এই যে, তোমার বই। গলাবন্ধ কোটের পকেট থেকে বের করে দিলেন এক কপি ‘চয়নিকা’। ডবল-ক্রাউন ষোলো-পেজি আকার, ইণ্ডিয়ান প্রেসে পাইকা অক্ষরে ছাপা; লেখক— ‘শ্রী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সম্পাদকের নাম ‘শ্রী’ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বই হাতে পাবার পর আমি হারিয়ে ফেললাম হেম নবীন মধুসূদনকে, এর আগে যত বয়স্কপাঠ্য বাংলা কবিতা আমি পড়েছিলাম, তার অধিকাংশ আমার মন থেকে ঝরে পড়ে গেলো। এখনো, অর্ধশতাব্দী পরেও, আমি যখনই ভাবি রবীন্দ্রনাথের কোনো-কোনো লাইন— ‘ধন্য তোমারে, হে রাজমন্ত্রী, /চরণপদ্মে নমস্কার’, বা ‘হাজার-হাজার বছর কেটেছে কেহ তো কহেনি কথা’, বা ‘আমার যৌবন-স্বপ্নে যেন ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ’, বা ‘ঐ শোনো গো অতিথ বুঝি আজ/এলো আজ—’ তখনই আমার চোখে ভেসে ওঠে সেই ডবল-ক্রাউন ষোলো-পেজি সাইজ়ের পৃষ্ঠা, সেই পাইকা অক্ষর— নিখুঁত একটি ফোটোস্টাট কপি যেন— অথবা, আরো অবিকল— পৃষ্ঠাটি ডাইনের না বাঁয়ের তা পর্যন্ত আমি ভুলিনি। পরবর্তী ভোট- কুড়োনো পরিস্ফীত ‘চয়নিকা’ বা এখনকার চলতি বই ‘সঞ্চয়িতা’, এগুলোকে আমি কখনোই ভালোবাসতে পারিনি— এদের আকার, মুদ্রণ, পঙক্তিসজ্জা, স্তবকবিন্যাস, কিছুই আমার পছন্দ হয় না, এই একটি বিষয়ে বর্তমানের উপর আমার অতীতকাল জয়ী হয়ে আছে।
কিন্তু ‘চয়নিকা’ চোখে দেখার আগেই রবীন্দ্রনাথে আমার প্রবেশিকা ঘটে। আর, খুব সম্ভব, প্রথম অভিঘাত বই পড়ারও নয়, কানে শোনার। একবার গিয়েছিলাম নোয়াখালির মেয়েদের স্কুলের পুরস্কার-বিতরণ অনুষ্ঠানে, দাদামশায়ের সঙ্গে। একটি বেশ বড়োশড়ো মেয়ে (অন্তত আমার চোখে তা-ই) সাধারণ শাড়ি-জামা পরে এসে দাঁড়ালো, দর্শকদের নমস্কার করে যে-কবিতাটা বললো তার প্রথম লাইন ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থে/জাগো রে ধীরে। তারপর চার-পাঁচটি মেয়ে সেজে-গুজে এসে অভিনয় করলো মিনিট দশেকের একটা নাটক। শ্রাবস্তীপুরে দুর্ভিক্ষ লেগেছে, ধনীর গৃহেও অন্ন নেই, কেউ কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না—শুধু একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো সে সকলকে অন্নদান করবে। আমার কানে লেগে রইলো সেই আবৃত্তি, সেই রচনা, ‘জয়সেন’ ও ‘করিছেন’ শব্দের অসাধারণ মিল, ‘চিত্ত’, ‘তীর্থ’, ‘নিত্য’ প্রভৃতি সমস্বর শব্দের অনুরণন—মেয়েদের বলা ছন্দ, ভাষা, অনুপ্রাস আমার মনে এক নতুন ও অদ্ভুত স্বাদ ছড়িয়ে দিলো। আমি অস্পষ্টভাবে অনুভব করলাম যে ‘কৃতান্ত আমি রে তোর, দুরন্ত রাবণি! / মাটি কাটি দংশে সর্প আয়ুহীন জনে’ ইত্যাদি লাইনগুলো পড়ে, শুনে, বা নিজে আবৃত্তি করে, ঠিক এ-রকম সুখ আমি কখনো পাইনি।
এই মেয়েদের স্কুলের ঘটনাটুকু কোন সময়কার, তখন আমরা কোন বাড়িতে আছি, সে-সব কিছুই আমার মনে নেই। এমনও হতে পারে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাও আমি পড়িনি তখনও, অথবা লেখকের নাম লক্ষ করে পড়িনি, কিন্তু কোনো-এক সময়ে— বেশিদিন পরেও হয়তো নয়— আমার বয়স বোধহয় তখন এগারো চলছে— ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নামটি আমার কাছে স্পষ্ট এবং প্রিয় হয়ে উঠলো।
আমার নামে যে-সব পত্রিকা আসে, তার মধ্যে আমাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয় ‘প্রবাসী’, কেননা সেখানে প্রতি মাসে বেরোয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা, আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নামে আর-একজনেরও— কখনো-কখনো একই সংখ্যায় চার-পাঁচটি করে। নোয়াখালিতে বেড়াতে এলেন কলকাতার একটি ভদ্রলোক, শোনা গেলো কোনো মাসিকপত্রের তিনি সব-এডিটর বা ম্যানেজার বা অন্য কিছু— দাদামশাই ব্যস্ত হয়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে এলেন বাড়িতে, আমার কারণে সাহিত্যের ছিটেফোঁটা সংস্রবও তাঁর কাম্য হয়ে উঠেছে। এই অতিথির মুখেই আমি প্রথম শুনেছিলাম ‘রবিবাবু’র গান— হার্মোনিয়ম বাজিয়ে অনেকগুলো গেয়েছিলেন তিনি— যতদূর মনে পড়ে, তাঁর গাওয়াতে তেমন মাধুর্য ছিলো না, কিন্তু আমি সুরের চাইতে অনেক বেশি শুনছিলাম কথাগুলো। কয়েকটা গান আমার আগেকার চেনা : ‘চয়নিকা’র আগেই ‘গীতাঞ্জলি’ আমি হাতে পেয়েছিলাম।
রবীন্দ্রনাথের গদ্য বই আমি প্রথম পড়ি ‘ডাকঘর’ আর ‘ছিন্নপত্র’— দুটোই টাউন- হল্ লাইব্রেরি থেকে ধার করে। ‘ডাকঘরের দৃশ্যপট আমাকে বেশ ভাবিয়েছিলো, মনে পড়ে : নীল পাহাড়, লাল রঙের রাস্তা, ঝর্নার জল— এ-সব আমার কল্পনায় থাকলেও চোখের পক্ষে অচেনা ছিলো, যতদিন না, আমার পনেরো বছর বয়সে, দাদামশায়ের চিকিৎসার কারণে আমাকে কিছুদিন রাঁচিতে কাটাতে হয়েছিলো। তিন বছর পরে প্রথম দেখলাম শান্তিনিকেতন— দেখামাত্র ‘ডাকঘর’ মনে পড়ে গেলো। কিন্তু ‘ছিন্নপত্রের ভূগোল শনাক্ত করতে আমার একটা দিনও দেরি হয়নি— তার সঙ্গে দৈবের একটি যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিলো।
কুমিল্লা জেলার এক গ্রামে যাচ্ছি দাদামশায়ের সঙ্গে— উপলক্ষ : এক মাসির বিয়ে। যাচ্ছি নৌকোতে, সারাটা পথ নৌকোতে, পুরো একটা দিন কেটে গেলো জলের উপর। আমি সঙ্গে নিয়েছি ‘ছিন্নপত্র’– মোটা অ্যান্টিকে ছাপা কালো চামড়ায় বাঁধানো বই— বইটার মধ্যেই ডুবে আছি। হাউসবোট নয়— গোল-ছইওলা অতি সাধারণ দিশি নৌকোয় চলেছি আমরা, পদ্মা আত্রাই ইছামতীর বদলে সরু-সরু-খালের মধ্য দিয়ে— আমাদের দু-পাশে বনজঙ্গল ঘন, কোথাও-কোথাও দিনের আলোতেও প্রায় অন্ধকার, কোথাও-কোথাও বৈঠা রেখে দিয়ে লগি ঠেলতে হচ্ছে মাল্লাকে, জল থেকে একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ উঠছে, দৃশ্য বলতে উলঙ্গ শিশু আর বাসন-ধুতে-আসা বৌ-ঝিরা ছাড়া আর-কিছু নেই। কিন্তু আমি যেন সেই সব দৃশ্য দেখতে-দেখতেই চলেছি, ‘ছিন্নপত্রে’ যেগুলোর কথা লেখা আছে—সেই জ্যোছনা, রোদ্দুরে ঝলকে-ওঠা নদীর স্রোত, সেই শান্ত বালুচর, অবাধ নির্জনতা। বিয়ে-বাড়িতে দিন দুয়েক মাত্র কাটিয়ে আমরা সেই নৌকোতেই ফিরে এলাম, বাড়ি এসে আমার কেবলই মনে হতে লাগলো আমার সারা শরীর টলছে— বুঝতে পারলাম না সে কি নৌকোর দুলুনির জন্য, না কি বইটা আমাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের কোনো-কোনো বই, যা ছেলেবেলায় ঝড়ের মতো বয়ে গিয়েছিলো আমার উপর দিয়ে— যেমন ‘গোরা’, ‘বলাকা, কয়েক বছর পরে ‘পূরবী’— তা এখন আর তেমন নাড়া দেয় না আমাকে কিন্তু সেই নৌকোতে-পড়া বইটি আমার কাছে এখনো প্রথম দিনের মতোই তরতাজা। রবীন্দ্রনাথের গদ্য-বইয়ের মধ্যে আমি জীবন ভরে সবচেয়ে বেশি বার পড়েছি ‘ছিন্নপত্র’, আমার প্রথম বিদেশভ্রমণের সময় আমি ওটি অতি যত্নে সর্বদা সঙ্গে রেখেছিলাম— বারো হাজার মাইল দূরে বসে মাঝে-মাঝে বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ পাবার জন্য। আজ পর্যন্ত, কোনো কারণে পাতা ওল্টাতে হলে— হাতে যতই না কাজ থাক সে-মুহূর্তে—বেদরকারে দু-চার পৃষ্ঠা পড়ে ফেলার লোভ আমি সামলাতে পারি না।
এখানে আমার অন্য একটি নৌকাভ্রমণ স্মরণীয়।
আমার দাদামশায়ের দেশ বহর গ্রামে আমরা সাধারণত যাই পুজোর সময়, দিন দশ- বারো কাটিয়ে ফিরে আসি; কিন্তু সেবারে— কী কারণে আমার মনে নেই— আমরা একটানা মাস দুয়েক ছিলাম। পাশের গ্রাম তেলিরবাগ কলকাতার বিখ্যাত দাশবংশের আদিবাসভূমি; আমরা রটনা শুনলাম চিত্তরঞ্জন আসছেন তাঁর পৈতৃক ভিটে চোখে দেখার জন্য। তখন তিনি ব্যারিস্টারি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন সারা বাংলার নয়নের মণি—কিন্তু তখন পর্যন্ত ‘দেশবন্ধু’ উপাধিটি অর্পিত হয়নি তাঁর উপর, বাঙালিরা তাঁকে তখনও বলে সি. আর. দাশ— কেউ-কেউ দাশ-সাহেব।
সত্যি একদিন তেলিরবাগে এসে পৌঁছলেন চিত্তরঞ্জন— সপরিবারে। দাদামশাই উদ্যোগী হলেন তাঁর বালক-দৌহিত্রটিকে সেই যশস্বী পুরুষের কাছে উপস্থিত করার জন্য— তিনি লোকনায়ক বলে নয়, তিনি কবি বলেই। আমি জানি না সেটি কেমন করে ঘটানো হয়েছিলো— কিন্তু একদিন আমি তাঁর গৃহে মধ্যাহ্নভোজনে নিমন্ত্রিত হলাম। যেতে হলো নৌকোতে, ভরা ভাদর বা শরতের আরম্ভ তখন— চারদিকে থৈ- থৈ জল। একটি হলদে রঙের দোতলা বাড়ির ঘাটে নৌকো বাঁধা হলো, আমি দুরুদুরু বুকে ডাঙায় নামলাম।
দক্ষিণ-মুখো দোতলার বারান্দায় তিনটি মহিলা বসে আছেন— কেউ চেয়ারে, কেউ আলসেতে হেলান দিয়ে তকতকে মেঝের উপর। ফ্যাকাশে রঙের পাড়ওলা শাদা খদ্দরের শাড়ি তাদের পরনে; তাঁদের মুখ, চোখ, নড়াচড়ার ভঙ্গি, কথা বলার ধরন— সবই আমার মনে হলো আশ্চর্য, অসাধারণ। ফাউন্টেন-পেন দিয়ে চিঠি লিখছেন তাঁরা, হাতের কাছে অনেকগুলো কাগজ লেফাফা ছড়ানো। শুভ্র চাদরে জড়ানো দীর্ঘকায় চিত্তরঞ্জন কয়েক মুহূর্তের জন্য সেখানে এসে দাঁড়ালেন, উল্টে-পাল্টে দেখলেন আমার কবিতার খাতা, বিশেষ কিছু না-বলে চলে গেলেন। তারপর মহিলাদের সঙ্গে টেবিলে বসে ভোজন, ভোজনের পরে নৌকোয় করে বাড়ি ফেরা এই পর্যন্ত।
সেদিন বাসন্তী দেবী, বা তাঁর দুই কন্যা, অথবা উপস্থিত অন্য কেউ আমাকে কী- কথা বলেছিলেন, আমিই বা কী উত্তর দিয়েছিলাম, খাবার থালায় কোন-কোন দ্রব্য পরিবেষিত হয়েছিলো, সেই সবই আমার বিস্মরণে তলিয়ে গেছে। ভুলিনি শুধু একটি লাইন, যেটি তাঁদের চিঠির কাগজের মাথায় ছাপানো ছিলো— ‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরম্’— মহিলাদের মধ্যে কোনো-একজন আমাকে পুরো শ্লোকটি শুনিয়েছিলেন, বিশুদ্ধ সংস্কৃত ধরনে, স্বরের হ্রস্বতা ও দৈর্ঘ্যকে উচ্চারণে পরিস্ফুট করে। তাঁরা আমাকে এও বলেছিলেন যে বোধিবৃক্ষের তলায় তপস্যায় বসার পূর্ব মুহূর্তে এই শ্লোকটি শাক্যমুনির মুখ থেকে বেরিয়েছিলো— ‘ইহা— সনে শুষ্যতু মে শরী— রম্! এই আসনে আমার শরীর শুষ্ক হোক। লাইনটি আমি অন্য কোথাও উদ্ধৃত দেখিনি, এখনো কোনো গ্রন্থেও পড়িনি— এর উৎস কী, আমি তা জানি না*;– কিন্তু সময়ের তরঙ্গ থেকে যে-ক’টি মুক্তো আমার হাতে উৎক্ষিপ্ত হয়ে আবার সেই মহাসমুদ্রেই ফিরে যায়নি— যে-ক’টি অজর অক্ষর কবিতার লাইন আমার মনের মহার্ঘতম সঞ্চয়— তার মধ্যে এটিও একটি।
[* এই বাক্যটি লেখার কয়েক সপ্তাহ পরে আমি ছাপার অক্ষরে পুরো শ্লোকটির দেখা পেয়ে যাই— এখানে সেটি উদ্ধৃত করছি :
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীর
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মেতৎ চলিষ্যতি।।
—এই আসনে আমার শরীর শুষ্ক হোক, ধ্বংস হোক ত্বক, অস্থি, মাংস; [যতদিন] বহুকল্পদুর্লভ জ্ঞান অপ্রাপ্ত থাকবে [ততদিন] এই আসন থেকে দেহ সঞ্চালিত হবে না।’
আমার দৃষ্ট পুস্তকটি হলো রাধাকৃষ্ণণ সম্পাদিত ধম্মপদ, মূল উৎস ‘ললিতবিস্তর’।
বইয়ের প্রেস-কপি যখন তৈরি করছি, এক বন্ধু আমকে মনে করিয়ে দিলেন যে অবনীন্দ্রনাথের ‘নালক’-এও এই শ্লোক উদ্ধৃত আছে।]
.
তেলিরবাগ ছেড়ে চলে যাবার দিন দাশ-পরিবার আবার আমাকে স্মরণ করলেন।
বিক্রমপুরের ভূগোল বরিশাল জেলারই মতো; এক-মাইল-পরিমাণ রেল-পথ ও নেই, ভ্রমণের একমাত্র উপায় জলযান। গ্রাম থেকে বেরোতে হয় নৌকোয়, স্টিমার পাওয়া যায় লোহজং বন্দরে। তাঁরা চলেছেন একটি আসবাবসম্পন্ন হাউসবোটে— বাসন্তী দেবী, তাঁর দুই কন্যা অপর্ণা ও কল্যাণী, চিত্তরঞ্জন ছিলেন না—ছিলেন একটি যুবক, খুব সম্ভব হেমন্ত সরকার। আমাকেও তাঁরা কিছুটা পথ সঙ্গে নিয়ে চলেছেন, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের বাড়ির নৌকো পিছন পিছন আসছে। রুপোলি পদ্মার উপর দিয়ে তীরে ঘেঁষে চলেছে হাউস-বোট। সকালবেলাটি উজ্জ্বল ও রৌদ্রময়, তীরে-তীরে পল্লীর মুখ প্রফুল্ল। বোটের গতি মন্থর, আন্দোলন ক্ষীণ, বসার ব্যবস্থা সুখদায়ক—জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। হেমন্ত সরকারের অনুরোধে কল্যাণী আবৃত্তি করলেন ‘সোনার তরী’ কবিতাটা— তাঁর কণ্ঠে লাইনগুলোর মাধুর্য যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে বাসন্তী দেবী কামরার বাইরে এসে দাঁড়ালেন, তীরভূমির দৃশ্য দেখতে-দেখতে বলে উঠলেন— ‘নমো নমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!/ গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি—’ এই লাইন দুটো হাতে-হাতে ঘুরে চিটচিটে হয়ে যায়নি তখনও, টাকশাল থেকে টাটকা বেরিয়েছে, আর আমারও তখন বয়সটা ছিলো সবুজ। আমি শুনলাম মন দিয়ে প্রতিটি কথা—টেনে-টেনে পুরো স্তবকটি বললেন বাসন্তী দেবী, মৃদু হাওয়ায় আস্তে- আস্তে মিলিয়ে গেলো তাঁর কণ্ঠস্বর, জলের ছলছল-শব্দ আবার স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অনেক-কিছু উপহার নিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম সেদিন, কিন্তু কাউকে তা দেখানো গেলো না, বলা গেলো না আমি কী উপহার পেয়েছি।
নোয়াখালি থেকে বার-বার বহরে আর মাঝে-মাঝে ঢাকায় যাওয়া-আসার জন্য পূর্ববাংলার জলপথের সঙ্গে আমার খুব চেনাশোনা হয়ে গিয়েছিলো— এখানে তার উল্লেখ অবান্তর হবে না।
সন্ধেবেলা যাবার ট্রেন ছাড়ে, দুপুর-রাতে দিদিমা আমাকে ঠেলে তোলেন, আমার ঘুমে-ভরা ঝাপসা চোখে দেয়ালি জ্বেলে দেয় লাকশাম জংশনের গ্যাসের বাতিগুলো। অন্য ট্রেন, চাঁদপুরে ভোর— নদী— নোয়াখালির নদীর মতো অবন্ধু নয়, বন্দরের ব্যস্ততায় সজীব। টাটকা হাওয়ায় জেটির দিকে হাঁটছি আমরা— জলের উপরে কাঁচা রোদের ঝলক, কুমিরের মতো কালো এবং হাঁ-করে-থাকা ফ্ল্যাটগুলো, একটু দূরে দাঁড়ানো তিনটে-চারটে স্টিমারের মধ্যে কোনটা আজ আমাদের — Afghan, না Goorkha, না Buzzard, না Condor? – সবগুলো নাম আমার মুখস্থ। ফ্ল্যাটের মধ্যে চটের আর ধুলোর গন্ধ, রাশি-রাশি বস্তাঝুড়ির কোনো-এক ফাঁকে একটি কেরানি লাল চোখে ঢুলছে—আমরা তক্তার উপর দিয়ে দুলে-দুলে এক ফালি জল পেরোলাম, এই উঠলাম স্টিমারে।
আমরা অবশ্য ডেক্-এর যাত্রী— আমাদের জন্য ক্যাবিন দূরে থাক বেঞ্চিও নেই, আমাদের বসতে হয় পাটাতনের উপর কম্বল অথবা শতরঞ্চি বিছিয়ে— ভাগ্য ভালো থাকলে দোতলায় কোনো পরিষ্কার কোণে, বা ভিড়ের দিনে একতলাতেই, হয়তো ঝুড়ি-ভর্তি-ভর্তি ভোঁটকা গন্ধের চালানি মুর্গির গা ঘেঁষে। কিন্তু কোথায় বসা হলো তাতে আমার কিছু এসে যায় না; আমি স্টিমারে চাপতে পেরেছি বলেই খুশি। এখানে মস্ত সুবিধে এই যে ট্রেনের কামরার মতো একই জায়গায় বসে থাকতে হয় না সারাক্ষণ। আমি ভালোবাসি একতলা-দোতলায় টহল দিতে, নিষিদ্ধ ফার্স্ট-ক্লাশ- মহলের সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে খানশামার হাতের চা খাই কখনো—একবার দাঁড়াই শস্তা চায়ের স্টলটির সামনে, যেখানে এক মজার বিজ্ঞাপন লটকানো : ‘যাহাতে নাহিকো মাদকতাদোষ / কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতোষ’— ঘন-নীল টিনের পাতের উপর শাদা অক্ষরে লেখা এই সরল পদ্যটি আমাকে কৌতুক-মেশানো আনন্দ দেয়। দেখি নদী রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে— রৌদ্রে মেঘে রকমারি রং ধরে জলে, ওপারের হালকা লাইন কখনো নীল কখনো আবছায়া, হঠাৎ এক-একটা গাংচিল আমার পক্ষে অদৃশ্য মাছ উপড়ে তুলে নিয়ে উড়ে যায়। আর অবশ্য আছে এঞ্জিন- ঘর— আমার ছেলেবেলার মহৎ এক আকর্ষণ।
ঠিক ঘর নয়, একতলায় লোহার রেলিঙে ঘেরা খানিকটা জায়গা—এক আশ্চর্য দৃশ্য চলছে যে-কোনো লোকের চোখের সামনে, কিন্তু দর্শকের ভিড় নেই। অনেক নল পাইথনের মতো মোটা আর প্যাঁচালো, অদ্ভুত চেহারার যন্ত্রপাতি অনেক, ছোটো-বড়ো অনেকগুলো ঘড়ি—ঘড়ি নয়, অন্য কিছু, কোন কাজে লাগে আমি জানি না, শুধু একটাতে দেখি SE, SEE, NW, NWW ইত্যাদি সব অক্ষর আঁকা, সেগুলির অর্থ আমি আন্দাজে বুঝে নিয়েছি— ওটাই তাহলে কম্পাস? দিকচিহ্ন- যন্ত্রের একটি কাঁটা অতি ধীরে নড়ছে অথবা নড়ছে না, কোনো নলের মুখ থেকে ফোঁশফোঁশ বাষ্প বেরোচ্ছে মাঝে-মাঝে, বেজে উঠছে ধারালো শব্দে ঘণ্টা, তিনটে পিস্টন ঘূর্ণিত হচ্ছে অনবরত— আমার মনে হয় কেশর-ফোলানো সিংহের মতো প্রচণ্ড। পিছন ফিরে দাঁড়ালে আমি দেখতে পাই ঘুলঘুলির ফাঁকে অন্য এক ঘূর্ণন, জলটাকে মুচড়ে-মুচড়ে ঘুলিয়ে তুলে প্রকাণ্ড বড়ো চাকা চলছে। আমার মুখে লাগে জলের ছিটে, তপ্ত ধোঁয়া ছিটকে আসে গালের উপর; –আমি আবিষ্ট হয়ে যাই জলের গন্ধে, বাষ্পের গন্ধে, গরমে, গর্জনে, কম্পনে, ঢোলা-প্যান্ট-পরা টান-চেহারার মাল্লাদের কাজেকর্মেও—সরু সিঁড়ি বেয়ে কেমন দ্রুত ওঠা-নামা করে তারা, এক চিলতে কানার উপর দিয়ে রেলিং না-ধরেই হেঁটে-চলে বেড়ায়— কাঠবিড়ালির মতো নির্ভয় ও স্বচ্ছন্দ। আর এদেরও মধ্যে অসাধারণ এক যুবক— মাথায় ফেট্টি বাঁধা, গা নগ্ন, হাতে শাবল— এঞ্জিন- ঘরের তলায় নেমে গিয়ে চুল্লির দোর খুলে কয়লা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ঢেলে দেয়, তার বুক-পিঠ ঘামের স্রোতে চকচকে, তার মুখের উপর লকলকে-জিভ আগুনের লাল, তাকে দেখায় প্রায় অলৌকিক ধরনে সুন্দর, কোনো আদিম দানোর মতো গা-ছমছম-করা—এই রহস্যপুরীতে সবচেয়ে সে রহস্যময়।
ফিরতি পথে অন্য এক দৃশ্যের জন্য আমি উৎসুক। সূর্য তখনও ডোবেনি কিন্তু সন্ধ্যার ছায়া নামছে— এমনি সময়ে পদ্মা পড়ে মেঘনায়; আমাদের সামনে জল নীল অথবা ধূসর, আমাদের পিছনে জল রুপোলি— আসার পথে উজ্জ্বল রোদে এই তফাৎটি ঠিক ধরা পড়ে না— কিন্তু এখন একেবারে স্পষ্ট, কে যেন একটি পরিষ্কার লাইন টেনে ধূসর-শাদাকে ভাগ করে দিয়েছে। ঠিক মোহানার মুখে দুই রঙের মেশামেশিটা দেখতে কী-রকম আমি তা চোখ টাটিয়ে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারি না; কেবলই মনে হয় শাদা নদীর রং অকস্মাৎ লেখার কালির মতো কালো হয়ে গেলো। ক্রমে রাত নামে, অন্ধকারে হারিয়ে যায় নদী, আমি গুটিগুটি পায়ে পোস্টাপিশের সামনে গিয়ে দাঁড়াই— স্টিমারেও একতলার কোণে একটি পোস্টাপিশ থাকে, এটা আমার এক প্রধান আবিষ্কার। একটি আলো-জ্বলা ছোট্ট কামরায় যে-একলা মানুষটি খোপে-খোপে চিঠি ছুঁড়ে দিচ্ছে, আমি তাকে দেখামাত্র ভালোবেসে ফেলি, সে আমার দিকে একবার তাকালেও আমি কৃতার্থ হয়ে যাই— কিন্তু সে তার কাজ থেকে চক্ষু তোলে না। আমি কয়েক পা এগিয়ে চলে যাই একেবারে সামনের ডেক্-এ- স্টিমারের এই শেষ প্রান্তটিও আমার দ্রষ্টব্যের তালিকাভুক্ত। এখানে উঁচু করে সাজানো আছে সেই তক্তাগুলো, যা দিয়ে বন্দরে অস্থায়ী সাঁকো তৈরি হয়, আছে বিড়ে- পাকানো মস্ত মোটা দড়িদড়া, আরো কত কী সরঞ্জাম, সার্চলাইটটিও এখানেই, আর নদী এত কাছে যে বড়ো ঢেউগুলো পাটাতন ভিজিয়ে দিয়ে যায়। যাত্রীদের এখানে আসা বারণ, কিন্তু মাল্লারা আমার ক্ষুদ্র উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করে না, – শুধু তক্তার স্তূপে বসতে গেলে আপত্তি জানায়। আমি সরে এসে গলিপথটুকুতে দাঁড়িয়ে থাকি, হু-হু হাওয়ার ঝাপট আমার গায়ে, কানে একটানা ছলছল শব্দ, চোখ জুড়ে অন্ধকার ছড়ানো, আমার একটু-একটু শীত করছে এবং ঘুম পাচ্ছে— কিন্তু হঠাৎ দেখি কুচকুচে জলে তীব্র আলোর চাবুক পড়লো, ধবল ফেনা ধবলতর উচ্ছ্বাসে ছুটে যায়, ক্ষণিক- দৃষ্ট টলোমলো কোনো জেলে-ডিঙির জন্য ভয় করে আমার, আর তক্ষুনি ভেঁপু বেজে ওঠে বিরাট গম্ভীর সর্দি-বসামতো গলায়— অনেকক্ষণ ধরে একটানা, আরো অনেকক্ষণ রেশ লেগে থাকে বাতাসে— আমার ইচ্ছে করে দূরে কোথাও চলে যাই, অনেক দূর কোনো অচেনা আর আশ্চর্য দেশে—যদিও সে-দেশ কোথায় বা সত্যি আছে কিনা আমি জানি না।
স্টিমার থেকে নেমে নৌকো, পদ্মায় ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে নৌকো ঢোকে বহরের খালে— তারই পাড়ে বাজার, গঞ্জ, বেচাকেনা— য়োরোপের যে-কোনো দেশে বিখ্যাত নদী হতো সেটি। সেই খালের সরু-সরু আঙুলগুলো চলে গেছে গ্রামের মধ্যে ঘর- গেরস্তর উঠোনের ধার দিয়ে-দিয়ে— একেবারে বাড়ির ঘাটে নৌকো বাঁধা হয়। সেগুলিতে পাশাপাশি দুটোর বেশি নৌকো চলে না, জল মন্থর এবং সবুজ, পাঁচ গ্রামের মলে-মূত্রে আবিল— পল্লীবাসীদের ‘সবচেয়ে ছোটো ঘরগুলি বাঁশের খুঁটিতে জলের প্রান্তে ঝুলে থাকে। কখনো গিয়েছি সেই জলপথে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে; অনেক অলিগলি খাল পেরিয়ে হঠাৎ একটা বিলে এসে পড়লাম— চওড়া বোবা আকৃতিহীন ছড়ানো জল, থিকথিকে কচুরিপানার জন্য ডাঙা বলে ভুল হয় কখনো, মাঝে-মাঝে কোমর-জলে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে নৌকো ঠেলে নেয় মাল্লারা— আমি ভাবি, বইয়ে যে-সব হ্রদের কথা পড়ি সেগুলি নিশ্চয়ই এ-রকম নয়? না— এই ভ্রমণগুলিকে কোনোমতেই মনোরম রঙে আঁকা যাবে না— কেননা সঙ্গী নেই ‘ছিন্নপত্র’ বা অন্য কোনো মায়াবী বই, জলে-স্থলে দুর্বারভাবে গজিয়ে ওঠা জঙ্গল দেখে-দেখে আমার দম আটকে আসছে। কিন্তু এইসব মালিন্যের দায় তিনগুণ শোধ করে দেয় পদ্মা— বিশাল নদী, ঢেউয়ে-ঢেউয়ে নৃত্যশীল, প্রখর স্রোতে নিত্যযৌবনা— আমি তখনও জানতাম না এত রূপ নিয়েও ইনি নোয়াখালির মেঘনার মতোই ভাঙতে ভালোবাসেন। পদ্মার উপর দিয়ে ধীরে চলেছি গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে— দূর থেকে দেখছি বলে ভিতরকার কোনো কুশ্রীতা চোখে পড়ে না; নাটকের দৃশ্যপটের মতো কোনো জমিদার-বাড়ি, কোনো মন্দির-চূড়ায় ত্রিশূল, কখনো ঝাঁ-ঝাঁ রোদে বালির উপর দিয়ে মাল্লারা গুণ টেনে চলে, কখনো বিকেলের খেলোয়াড় বাতাসে রঙিন একটি পাল তুলে দেয়। পেরিয়ে যাই অনির্বচনীয়-নির্মল চর মাঝে-মাঝে, কোনো-কোনোটা এতই ছোটো যেন জলের উপর চিকনপাটি বিছোনো। হঠাৎ মাঝে-মাঝে কাদা-রঙের গোলাকার কিছু ভেসে ওঠে জল থেকে, তক্ষুনি আবার মিলিয়ে যায়— শুশুক ওরা—আমার দাদামশাই বলেন ‘শুশুম’— আমার মনে হয় ওরা নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে, শুধু পিঠটুকু দেখিয়ে, নাক-চোখ-মুখ অদৃশ্য রেখে— এক ফূর্তিবাজ ছেলেমানুষের দল। একবার নৌকো থেকে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছিলাম— বিকেল তখন, পদ্মার বুক রুপোতে-সোনায় বার্ণিশ-করা— হঠাৎ একটা বিশাল বেড়াজাল উঠলো জলের তলা থেকে, ঝলক দিলো অগুনতি ইলিশের উজ্জ্বল ধবলতা— একখানা প্রকাণ্ড নীল আকাশের তলায়, পড়ন্ত বেলার অফুরান রৌদ্রে— আমার চোখ দুটো যেন ধাঁধিয়ে গেলো।
গ্রাম সম্বন্ধে আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তা বহর থেকেই আহৃত। সেখানকার তালগোল- পাকানো অতি সরব অতি প্রকাশ্য জীবনযাত্রার মধ্যে অনেক-কিছুই আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু দুটো-একটা সুখস্মৃতি নেই তাও নয়।
রান্নাঘরের কোণে দেয়ালহীন একটি একচালা—আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, মুগ্ধ। এক মহিলা ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছেন, অন্য একজন গর্ত থেকে চাল তুলে নিয়ে তক্ষুনি আবার ঢেলে দিচ্ছেন ধান— ঢেঁকির মাথাটি উঠে গিয়ে আবার পড়তে যেটুকু সময় নেবে ঠিক সেই ক-টি মুহূর্তের মধ্যে : এমনি বার-বার। আমি শুনছি ছন্দে- বাঁধা দুম্-দুম্ শব্দ, দেখছি এঁদের অঙ্গচালনার মেয়েলি দক্ষতা; আমার অবাক লাগছে যে প্রথম মহিলার ভুল হচ্ছে না কখনো, দ্বিতীয় মহিলার হাতের উপর একবারও ঢেঁকি পড়ছে না— মুহূর্তের জন্যও না-থেমে কী-দ্রুত এঁরা কাজ করে যাচ্ছেন — আমার চোখে প্রায় ম্যাজিকের মতো ব্যাপার, কিন্তু এঁদের বাহবা দেবার কেউ নেই। শিউলিতলায় পাগল-পাগল গন্ধ—শরতের কোনো শেষরাত্রে, হয়তো লক্ষ্মীপূর্ণিমা সেদিন— উঠোনে এমন অঢেল জ্যোছনা যে শুধু লাল বোঁটার জন্য শিউলিগুলোকে চেনা যাচ্ছে : আমি মেয়েদের দলের মধ্যে জুটে ফুল কুড়োচ্ছি। রোজ চণ্ডীপাঠ হয় বাড়িতে, যেতে-আসতে আমার চোখে পড়ে তার আয়োজন : ক্ষয়ে-যাওয়া শানের উপর কত কী বানানো হচ্ছে, সাজানো হচ্ছে, পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ জ্বলছে আধো-আলোয়। ঠাকুরঘরটি গন্ধে ম-ম করে— ধূপের গন্ধ, ছেঁড়া ফুলের, ঘষা চন্দনের, ঘি, দুধ, নারকোল ইত্যাদির পাঁচমিশোলি গন্ধ একটা— আর ফাঁকে-ফাঁকে প্রাচীনতার সেই ঠাণ্ডা সোঁদা মিষ্টি-মিষ্টি ঝাপসা গন্ধ, যা জীর্ণ দালানটিতে ঢোকামাত্ৰ টের পাওয়া যায়। দুপুরবেলা আসেন রক্তাম্বরধারী পুরুঠাকুর, তাঁর গমগমে গলার আওয়াজ দেয়ালে-দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় ঘণ্টাখানেক ধরে— একটি বর্ণ না-বুঝেও দূর থেকে শুনতে আমার মন্দ লাগে না। অন্য এক শব্দে শীতের ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেলো—খিড়কি-পুকুরের দিক থেকে ভেসে আসছে গান, মেয়েদের কাঁচা গলায় ঘুরে-ফিরে : ‘ওঠো ওঠো সূ-য্যি ঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া/ মাঘমণ্ডলের ব-র্ত করুম এর পরে আমার ঠিক মনে পড়ছে না—’আমরা যতেক মাইয়া’ বা ‘তোমার দিমু বিয়া’ বা ঐ রকম কিছু হবে। শুনতে-শুনতে আমার শরীরে-মনে সুখ ছড়িয়ে পড়ে; আমি যেন শুয়ে-শুয়েই দেখতে পাই আমার আইবুড়ো কিশোরী মাসিরা পুকুর-পাড় ধরে সার বেঁধে ঘুরছে গান গাইতে-গাইতে, ফলের বাগিচার ঘন ডালপালার ফাঁকে এইমাত্র ঝিকিমিকি রোদ ফুটলো।
আমার বালকবয়সে ভারতভূমিতে যে-বৃহৎ ঘটনাটি ঘটেছিলো, তার কথা বলার সময় হলো এবার।
প্রথম-মহাযুদ্ধ আমার স্পষ্ট মনে আছে। বাড়িতে আসে ‘স্টেটসম্যান’ দৈনিকপত্র—তাতে দেখি পাতা-জোড়া-জোড়া যুদ্ধের ছবি : হেলমেট-পরা সৈনিকের দল, বড়ো-বড়ো কামান, মানোয়ারি জাহাজ। লোকেদের মুখে-মুখে ফেরে লয়ড জর্জ, মার্শাল ফশ, লর্ড কিচনার, হিণ্ডেনবুর্গ-এর নাম। আমাদের বাড়িতে যাঁদের আসা- যাওয়া চলে তাঁদের মধ্যে দু-একজন আছেন যুদ্ধ-ঘটনার বিশ্লেষক ও ব্যাখ্যাতা : তাঁরা কাগজ পড়েন খুঁটে-খুঁটে, ম্যাপ দ্যাখেন, হিশেব রাখেন কোন পক্ষ কতদূর এগোলো বা পেছোলো, কোন ধরনের কামান কত শক্তিশালী, জলযুদ্ধে জর্মানরা কখনো নেলসনের গুষ্টিকে হারাতে পারবে কিনা তা নিয়ে তাঁরা বিস্তর গবেষণা করেছেন। এঁরা সকলেই হিজ় ম্যাজেস্টির অনুগত ভৃত্য— কর্মজীবনে তা-ই— কিন্তু ঘরে বসে মুণ্ডপাত করেন ইংরেজদের— খুবই নিচু গলায় অবশ্য— তবু দাদামশাই তাঁর নিবে-যাওয়া বর্মা চুরুট টানতে-টানতে ত্রস্ত চোখে ইতি-উতি তাকান, পাছে কোনো টিকটিকি কোথাও আড়ি পেতে শুনে ফ্যালে। ভারতসমুদ্রে ‘এমডেন’ যখন হুলুস্থুল টর্পেডো চালাচ্ছে তখন তাঁরা হর্ষ লুকোতে পারেননি, ‘ব্যাটারা নিপাত যাবে এবার! উচ্ছন্নে যাবে!’ – বলতে-বলতে এমনভাবে হেসেছেন যেন তাঁরাই ঘায়েল করলেন ব্রিটিশ সিংহকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খবর এলো ‘গড সেইভ দি কিং’ মহামন্ত্রটি ব্যর্থ হয়নি, ভগবান ইংলণ্ডেশ্বরকে সত্যিই রক্ষা করেছেন। জয়োৎসবে যোগ দেবার জন্য দাদামশাই আমাকে জিলা স্কুলে নিয়ে গেলেন— সেখানে ছেলেদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে আউড়ে যেতে হলো হেডমাষ্টার মশায়ের শেখানো কয়েকটা ইংরেজি বুলি, তিনি নিজেও একটি ছোটো বক্তৃতা করলেন- তার সার কথা এই যে ইংরাজ-রাজের জয়লাভে আমরা আনন্দিত। তারপর শীতের রোদ্দুরে ছেলের দল ঘুরে বেড়াতে লাগলো, সকলেরই হাতে স্কুল থেকে বিলোনো কমলালেবু, জামায় আঁটা ছোটো-ছোটো য়ুনিয়ন জ্যাক— স্কুল ছুটি বলে সত্যি খুশি।
কিন্তু এই সুদূর যুদ্ধ আমাদের জীবনে কোনো ছায়াপাত করেনি। মাঝে কিছুদিন আমাকে কাঠপেন্সিলের বদলে কাগজের পেন্সিল ব্যবহার করতে হয়েছিলো, আর শাদার বদলে বালি-কাগজ, আর দিদিমা মাঝে-মাঝে উদ্বিগ্ন হতেন পাছে এবার বালামের বদলে রেঙ্গুনি চাল খেতে হয়— এটুকু ছাড়া আর কোনো ফলাফল আমার মনে পড়ে না। কিন্তু আমিস্টিসের অল্প দিন পরেই অন্য এক যুদ্ধ শুরু হলো— একেবারে নতুন ধরনের—আর তা আমাদেরই দেশে, আমাদেরই চোখের সামনে, আমাদেরই জীবনের মধ্যে তোলপাড় তুলে।
নন-কো-অপারেশন। অসহযোগ। সত্যাগ্রহ। এই নোয়াখালি শহর— দৈবাৎ যেখানে ছিটকে পড়েছি আমি, আর সে-সময়ে আমার যেটাকে মনে হচ্ছিলো দরিদ্র এবং মলিন এবং দম-আটকানো— সেখানেও তরঙ্গ এসে পৌঁছলো। মেঘনার শরের চেয়েও উত্তাল, বারো-শো ছিয়াত্তরের বন্যার চেয়েও কূল-ভাসানো।
প্রায় অজ্ঞান বয়স থেকেই আমি চা-খোর, ততদিনে এমন বয়সে পৌঁচেছি যখন সকালবেলায় আধো-ঘুমের মধ্যে লোহার কেটলির ঘণ্টাধ্বনি শুনেও আনন্দ পাই, পিঙ্গলবর্ণ চায়ের রসে ধবল দুধ যখন ঘন মেঘের মধ্যে হালকা মেঘের মতো মিশে যায়, আমার মনে হয় একটি সচল রঙিন ছবি দেখছি। আর তার স্বাদ— গোলাপফুল-আঁকা ধোঁয়া ওঠা পেয়ালায় প্রথম চুমুক— তুলনা হয় না! সেই চা, যার নতুন নাম হয়েছে ‘কুলির রক্ত’, আমি এক দমকে ছেড়ে দিয়েছি। ঘামছি সারা দুপুর চটের মতো মোটা খদ্দরে : নিয়মিত পড়ছি ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’, ‘বাংলার বাণী’; লিখছি নবযুগের বন্দনা, দেশপ্রেমের উচ্ছ্বাস, একটা গল্পের আকারে লিখে ফেলেছি পল্লীজীবনের প্রশস্তি— যে-জীবন আমি আসলে কখনো ভালোবাসতে পারিনি— নজরুল ইসলাম নামে এক সৈনিক-কবির বীররসাত্মক কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ। একটি চরকাও আছ আমার, চালাই মাঝে-মাঝে— কিন্তু আমার হাতে যে-সুতো উৎপন্ন হয় তা দড়ির মতো মোটা আর সন্নেসির জটার মতো গুলতি-পাকানো। কোনো অনুষ্ঠান বাদ দিইনি আমি—অনেকগুলো স্বরাজ-টিকিট কিনে ফেলেছি; ঘরে ঝুলছে ভারত-মাতা ক্যালেণ্ডার, যাতে ভারতের ভাগ্যতরণীর হাল ধরে বসে আছেন মহাত্মা গান্ধী, আর দাঁড় টানছেন চিত্তরঞ্জন, মতিলাল, লজপৎ রায়, পণ্ডিত মালব্য আর দুই ভাই মহম্মদ আলি শৌকত আলি— আর উপর থেকে স্মিতহাস্যে তাকিয়ে দেখছেন পদ্মধারিণী লক্ষ্মীরূপিণী ভারত-মাতা। একবার, এমনকি, স্বরাজের তারিখ এগিয়ে আনার জন্য, বাড়ির মহিলাদের কিছু শাড়ি-জায়া নিয়ে বহ্ন্যুৎসবও করলাম। আমার দুঃখ শুধু এই যে এত করেও গ্রেপ্তার হবার এবং জেলে যাবার যোগ্য হতে পারছি না। আমার চেয়ে মাত্র চার-পাঁচ বছরের বড়ো কয়েকটি ছেলে— তারাও দিনসাতেক কাটিয়ে এলো সেই গরীয়ান স্থানে, বেরোনোমাত্র অভিনন্দন পেলো ফুলের মালা, গান গাইতে-গাইতে টহল দিলো সারা শহর— আর আমি, শুধু কয়েকটি বছর দেরিতে জন্মেছিলাম বলে, নেহাৎই একজন দর্শক হয়ে বাইরে পড়ে রইলাম। আমি যে বেঁটে, আমি যে তোলা আমার লেখাগুলো যে সম্পাদকেরা অনবরত ফেরৎ পাঠাচ্ছেন— এই সব দোষের যেন রাতারাতি খণ্ডন হয়ে যেতো, শুধু একবার ইংরেজের কয়েদখানার ভিতরটা যদি দেখে আসতে পারতাম!
এক বছর কেটে গেলো, দু-বছর কেটে গেলো, স্বরাজ এলো না। জেল-ফেরতা ছেলেরা গুটি-গুটি পায়ে স্কুলে ঢুকেছে আবার, কোনো-কোনো উকিল-মোক্তার নতুন করে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন, ঘরে-ঘরে চলছে আগের মতোই টাট্টু-মার্কা ল্যাঙ্কাশিয়র- বস্ত্র। কিন্তু আমার পরনে এখনো খদ্দর, চা আমার অস্পৃশ্য।
নোয়াখালিতে আমাদের সর্বশেষ দিনগুলি আমার স্মৃতিতে বড়ো অস্পষ্ট, প্রায় অন্ধকার। এমনকি, আমার আশৈশব চেনা শহর ছেড়ে চলে আসার দিনটিও আমার মনে পড়ে না। এর পরে পর্দা উঠলো ঢাকায়, দাদামশাই লম্বা ছুটি নিয়ে চলে এলেন। আমার বয়স তখন তেরো পার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন