আমার ছেলেবেলা – ২৫

বুদ্ধদেব বসু

আমার ঢাকা-বাসের প্রথম তিন-চার বছরের মধ্যে আমার জীবন বহুদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো— তার কারণ সেই নানান ধরনের নতুন মানুষেরা, যাদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ চেনাশোনা হচ্ছে, এবং সেই আরো বিচিত্র কল্পনার মানুষেরাও, যাদের কথা রুদ্ধশ্বাসে পড়ছি বইয়ের পাতায়। এক-একটা বছর, এক-একটা বাড়ি— তা আমার মনে জড়িত হয়ে আছে কোনো-না-কোনো বইয়ের সঙ্গে, লেখকের সঙ্গে : সেগুলোই আমার নিশানা, আমার পথের চিহ্ন। চোদ্দ নম্বর যুগীনগর : ডিকেন্স, বর্নার্ড শ, আমার চোদ্দ বছরের জন্মদিনে উপহার-পাওয়া একটি লাল মলাটের অক্সফোর্ড-সংস্করণ শেলি; ‘লিপিকা’ ‘ঘরে-বাইরে’, ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠায় ধারাবাহিক ‘রমলা’। ওয়াড়িতে অন্য একটি বাড়ি, দাদামশাই মৃত্যুশয্যায় : আমাকে সাড়াশির মতো আঁকড়ে ধরেছে ‘কাউন্ট অব মন্টি ক্রিস্টো’ উপন্যাসটা। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা কাবার : দল বেঁধে সদর-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমাদের গলা থেকে অনর্গল বেরোচ্ছে ‘ক্ষণিকা’,’অভ্র-আবীর’, ‘বিদায়-আরতি’– আর সদ্য-বেরোনো ‘আবোল তাবোল’ যার কবিতাগুলো ‘সন্দেশ’ থেকেই আমার কণ্ঠস্থ। পুরানা পল্টন : রাতের অন্ধকারে মশারির তলায় শুয়ে-শুয়ে আমি পাগলের মতো আউড়ে যাচ্ছি ‘পূরবী’ থেকে কবিতার পর কবিতা। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ : তুর্কি ধরনের জাফরি চুড়ো খিলান-ওলা লাল-রঙের দোতলা বাড়ি— দুটো ক্লাশের ফাঁকে ঝুলন্ত একটি ব্যাল্কনিতে বসে আমি নির্বিষ্ট হয়ে আছি চেখত্বের ছোটোগল্পে— মাঝে-মাঝে সংস্কৃত ক্লাশে পিছনের বেঞ্চিতেও সেটাই পড়ে যাই— শুধু দৃশ্যত ‘রঘুবংশ’ খোলা থাকে, একদিন পণ্ডিতমশাই তা নিয়ে মন্তব্য করে আমাকে লজ্জা দিয়েছিলেন। লালবাগ, শীত ঋতু চলছে, আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি। আমার নড়বড়ে গণিত-বিদ্যাকে মজবুত করে তোলার জন্য সকালে আসেন একচক্ষু, শ্মশ্রুধারী, কঠোরদর্শন, শিক্ষাপটু এক প্রৌঢ়; দুপুর ভরে কুস্তি চালাই জ্যামিতির জটিলতর হেঁয়ালিগুলোর সঙ্গে, যা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকতে চায় না; খুলে বসি লংম্যান্স-গ্রীনের ভূগোলবৃত্তান্ত, যার রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্যের গুণে পৃথিবীর নদীগুলোকেও মরুভূমির মতো নীরস বলে মনে হয় আমার; –কিন্তু বিকেলবেলা টুনু নিয়ে আসে তার জগন্নাথ কলেজ লাইব্রেরি থেকে টুর্গেনি, কখনো হয়তো রুট হামসুন, য়োহান বোইয়ার— আমার বুকের মধ্যে আনন্দ দুলে ওঠে। আনন্দ আমার— যখন পড়ন্ত রোদে সুরকির রাস্তায় লাল ধুলো উড়িয়ে পোস্টাপিশের টকটকে লাল এক্কাগাড়িটা আমাদের দরজায় এসে থামে, আর খাকি-পোশাক-পরা কাঁধে-ব্যাগ-ঝোলানো ডাকপিওন আমার হাতে দিয়ে যায় আশ্চর্য সব তৈজস— নিয়মিতভাবে, প্রতি সোমবার

প্রভুচরণের প্রবাসকালে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিলো নিরবচ্ছিন্ন। অবিরাম আমি লিখে যাচ্ছি, অবিরাম তাঁর চিঠি পাচ্ছি। যাওয়া-আসায় মাস তিনেক সময় কেটে গেলে ঠিক উত্তর-প্রত্যুত্তর চলে না, চলে শুধু যার-যার উপস্থিত মুহূর্তের বিবরণ, আক্ষরিক অর্থে পত্রালাপ। সুখের বিষয়, পত্ররচনায় উভয় পক্ষেরই আগ্রহ ও দ্রুতি অসামান্য, দু-জনেই— যাকে বলে একটু উচ্ছ্বাসী ধরনের মানুষ, এবং এমন বিষয়েরও অভাব নেই যাতে দু-জনেই সমানভাবে উৎসাহী। বস্টন থেকে, লস এঞ্জেলিস থেকে, সান্টা ফে থেকে— পুলম্যান-ট্রেনের কামরা থেকে কখনো— তারপর লণ্ডন রোম প্যারিস বার্লিন স্টকহম থেকে আসছে তাঁর চিঠির পর চিঠি—আর সেই সঙ্গে নানা দেশের বই, আর মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা— রাশি-রাশি—বিচিত্র। তাঁর চিঠি হাতে পাওয়ার মুহূর্ত থেকে আমার সম্ভোগ শুরু হয়ে যায় সারি-সারি বিদেশী ডাকটিকিট, ইস্ত্রি-করা কাপড়ের মতো কড়কড়ে কাগজ; কত অচেনা ভাষায় রাস্তার নাম, হোটেলের নাম— আর ভিতরে কত গল্প, কত নতুন খবর, কত স্নেহ-সম্ভাষণ! বই আসে ইবসেন, ম্যাটারলিঙ্ক, গোর্কী, আঞ্জীয়েহু, অস্কার ওয়াইল্ড, শ্যন ও’কেইসি, সমকালীন মার্কিন কবিতার সংকলন, আসে ন্যুয়র্কে মস্কো আর্ট থিয়েটারের অভিনয়- ঋতুর চিত্রময় অনুষ্ঠানলিপি, চিঠির মধ্যে সংবাদপত্রের কর্তিকা— পাভলোভার নৃত্য, ডুজ়ের অভিনয়, শোপ্যার সংগীত বিষয়ে আলোচনা। এর মধ্যে যা-কিছু আমি ঠিকমতো বুঝি না সেগুলিরও কিছু দেবার থাকে আমাকে— বইগুলোর গায়ে উন্মাদক এক গন্ধ, মুদ্রণের প্রসাধন, ছবি, আর অনেক দূর দেশের বাতাসের ছোঁওয়া। পুরো পাশ্চাত্ত্য জগৎ, ক্যালিফর্নিয়া থেকে রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ, সেখানকার শিল্প সাহিত্য জীবনযাত্রা, প্রাণবন্ত ভূগোল, আমার চোখে-না-দেখা কিন্তু মনের মধ্যে বাস্তব হয়ে- ওঠা কত নদী নগর নর-নারী—এ-ই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন প্রভুচরণ, আমার চোদ্দ থেকে ষোলো বছরের মধ্যে, আমি যখন একটি চারাগাছের মতো মাটির তলা থেকে উদগত হচ্ছি, চাচ্ছি আমার সরু-সরু ডালগুলোকে জগৎ-জোড়া আকাশের দিকে তুলে ধরতে।

বিদেশে যাবার আগে বুদ্ধু-দা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ব্যবহৃত একখানা পলগ্রেভ তাঁর হাতে মার্জিনে লেখা নোটগুলোর জন্য আমার কাছে দ্বিগুণ মূল্যবান। সেই বইটি থেকে শেলি, কীটস, বায়রন, ব্রাউনিঙের অনেক কবিতা আমি ব্লটিং- কাগজের মতো শুষে নিয়েছিলাম; এঁদের যে-ক’টি লাইন এখনো আমার ক্ষীয়মাণ স্মরণশক্তিতে আটকে আছে, তার অধিকাংশই তখনকার সঞ্চয়। এমনও বলা যায় আমার বয়ঃসন্ধির জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে এঁরাই আমাকে উদ্ধার করেছিলেন— পলগ্রেভের এই রোমান্টিক কবিরা—আর অবশ্য আমাদের রবীন্দ্রনাথ।

২৬

ঢাকার স্থানীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন পরিমলকুমার ঘোষ। ইংরেজির অধ্যাপক তিনি, কবিখ্যাতিও আছে কিছুটা। মানুষটি স্নিগ্ধ স্বভাবের, গাল দুটি সুগোল ও চিক্কণ, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, খুব পান-জর্দা খান। মৃদু তাঁর কথা বলার ধরন, চলাফেরার তাল মন্থর। তাঁকে আমি প্রথম দেখেছিলাম বালক বয়সে— আমাকে নিয়ে এসেছিলেন দাদামশাই— আমরা ঢাকায় বসবাসের জন্য চলে আসার পর সেই পরিচয় সহজেই পুনরুজ্জীবিত হলো। তিনি যখন আমাকে প্রকাশ্যে সাহিত্যিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তখনও আমি স্কুল থেকে বেরোইনি। ঢাকা থেকে বেরোলো পূর্ববাংলার পক্ষে অভূতপূর্ব পত্রিকা ‘প্রাচী’– ‘প্রবাসী’ ছাঁদের পরিপুষ্ট ও সচিত্র মাসিক; পরিমল ঘোষ তাতে প্রকাশ করলেন আমার কবিতা, আর দুই-কিস্তি-জোড়া একটা গল্প। কবিতাটায় একটা লাইন ছিলো— ‘মনের মধ্যে শাসন ওঠে জেগে’—সম্পাদক-মণ্ডলীর একজন ঐ ‘মধ্যে’ কথাটায় আপত্তি তুলেছিলেন, তাঁর মতে ‘মাঝে’ আরো শ্রুতিমধুর হবে— কিন্তু পরিমল ঘোষ বললেন, ‘ঐ যুক্তাক্ষর হলো ঝর্নার জলে পাথরের মতো—ওটা থাক। খুব সম্ভব তাঁরই প্ররোচনায় বা পরামর্শে, বাংলাবাজারের এক পাঠ্যপুস্তক-বিক্রেতা আমাকে এমনকি গ্রন্থকারের মর্যাদা দিলেন—গাঁটের কড়ি খসিয়ে, একটি কপিও বিক্রির আশা না-রেখে। চটি কবিতার বই— আমি নাম দিয়েছিলাম ‘মর্মবাণী’, তখন-পর্যন্ত-জীবিত দাদামশায়ের নামে একটি বাগ্হুল উৎসর্গলিপি লিখেছিলাম। বালি-কাগজে ছাপা, চেহারা যতদূর সম্ভব আটপৌরে, আমার পক্ষে খেদজনকভাবে ‘হাতছানি’ কথাটা ছাপা হয়েছে ‘হাতসানি’– তবু যা-ই হোক একটা বই তো। মুন্সিগঞ্জে যেবার বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো— আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরে লম্বা ছুটি চলছে তখন— আমি অনেকগুলো কপি সঙ্গে নিয়ে গেলাম।

আমার সাহিত্যসম্মেলনে যাওয়াটাও পরিমল ঘোষেরই জন্য ঘটেছিলো। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন সঙ্গে করে, তাঁর পক্ষপুটের তলায় আশ্রয় দিয়ে, তাঁর সঙ্গে একই বাড়িতে রাখলেন আমাকে, আর তারপরে দাঁড় করিয়ে দিলেন স্বরচিত কবিতা- পাঠের জন্য— সেই মঞ্চে, যেখানে বসে আছেন শরৎচন্দ্র আর নাটোরের জগদিন্দ্রনাথ, আর কলকাতা ও পূর্ববাংলার অনেক সাহিত্যিক ও বিদ্বজ্জন— হল-ভর্তি বহু ভদ্রমহোদয় আর সামনের সারিতে কতিপয় ভদ্রমহিলারও দৃষ্টির সামনে। আমি চোখে ঝাপসা দেখলাম, আমার পা কাঁপতে লাগলো— কবিতাটা পড়তে শুরু করে মধ্যপথে হঠাৎ আক্রান্ত হলাম আমার পুরাতন বাবিলোপকারী রসনাবৈকল্যে— আমার হাত থেকে পাণ্ডুলিপি টেনে নিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে কবিতাটা পড়ে দিলেন খুব সম্ভব মৈমনসিংহের কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে যে- ছন্দোবদ্ধ প্রশস্তিটি আমি রচনা করলাম, সেটি সভায় দাঁড়িয়ে পড়ার ভার দিলাম সুধীশ ঘটককে— মণীশ ঘটকের ছোটো ভাই সে, আমার নবলব্ধ বন্ধু।

রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম চোখে দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার উপর নোঙর-ফেলা একটি স্টিম-লঞ্চে, যেখানে, নিমন্ত্রণকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রেষারেষি করে, ঢাকার নাগরিকেরা তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। উপরের ডেক্-এ ইজিচেয়ারে বসে আছেন তিনি, ঠিক তাঁর ফোটোগ্রাফগুলোর মতোই জোব্বা-পাজামা পরনে— আরো কেউ-কেউ উপস্থিত ও সঞ্চরমাণ, রেলিঙে হেলান দিয়ে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মুখ-চেনা একটি ব্রাহ্ম যুবক আমার কাছে এসে বললেন, ‘আপনাকে ইনট্রোডিউস করিয়ে দেবো? অমি ত্রস্তে বলে উঠলাম, ‘না, না— সে কী কথা!’ একজন সাহিত্য ঘেঁষা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে এসে বললেন, “আমি ব্যস্ত ছিলাম—আগে আসতে পারিনি—’ আমি ভাবলাম : এঁর আসা না আসায় রবীন্দ্রনাথের কি সত্যি কিছু এসে যায়? অসহযোগের কথা উঠলো; রবীন্দ্রনাথের মুখের শুধু একটা কথা আমার মনে আছে— ‘নিগেশন অব কালচার। এলেন হাসি ছিটিয়ে, ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে, অক্সনিয়ান অঙ্গভঙ্গি ও শ্রবণসুভগ সিলেটি টানের উচ্চারণ নিয়ে, ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা অপূর্বকুমার চন্দ— আমার কলেজের অধ্যক্ষ তিনি, রমনার অধ্যাপকমহলে রমণীয়তম মানুষ। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কবিতা-পাঠ আমি প্রথম শুনেছিলাম তাঁরই বাড়িতে এক রবীন্দ্র-সন্ধ্যায়, সবান্ধবে রবাহূতভাবে উপস্থিত হয়ে। অন্য দু-একটা কারণেও তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ; তাঁরই জন্য সেই ক্ষুদ্র ইন্টারমিডিয়েট কলেজের লাইব্রেরিটি আধুনিক য়োরোপীয় সাহিত্যে পরিপুষ্ট ছিলো, আসতো ‘লণ্ডন মার্কারি’, আমেরিকার ‘ডায়াল’ পত্রিকা; ছাত্রদের কমন রুমে সাজানো থাকতো থরে- থরে সচিত্র বিলেতি সাপ্তাহিক, যার একটির পাতায় আমি প্রথম পড়েছিলাম চেস্টার্টনের ‘লণ্ডন নোটবুক’— পত্রিকার ঠিক এক-পৃষ্ঠা-জোড়া এক-একটি মনোমুগ্ধকর প্রবন্ধ বা ছোটোগল্প। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকেও অপূর্বকুমার আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন এক ভল্যুম আন্তন চেখত্বের পত্রাবলি, আর অল্ডাস হাক্সলির প্রথম উপন্যাস ‘ক্রোম ইয়েলো’। আমি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে বেরোবার আগেই অপূর্বকুমার ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন, কিন্তু পরবর্তী জীবনেও তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটেছিলো।

২৭

আমরা প্রথম যখন পুরানা পল্টনে এলাম তখন এবড়ো-খেবড়ো মাঠের মধ্যে ছড়ানো- ছিটোনো তিনটি মাত্র বাড়ি উঠেছে, আরো দু-একটা নির্মীয়মাণ। সবগুলোই পশ্চিম বাংলার ভাষায় কোঠাবাড়ি— পূর্ববাংলায় বলে দালান— শুধু আমাদেরটাই নয়। উত্তরে অনেকখানি জমি ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ ঘেঁষে লম্বা একটি টিনের ঘর তুলেছেন দিদিমা, ইটের পাঁচিলে ঘিরে দিয়েছেন। ঘরটি তিন কামরায় বিভক্ত, সামনেরটায় আমি থাকি। মেঝে মাটির, শুধু আমারটায়—প্রথম বর্ষায় মেঝে ফুঁড়ে কেঁচো বেরোবার পরে— দিদিমা সিমেন্টের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের পুবে-উত্তরে বনজঙ্গল— অনির্ণেয় গ্রাম—আর দক্ষিণে তাকালে চোখ চলে যায় রেল-লাইন পেরিয়ে নবাবপুরের প্রথম কয়েকটা বাড়ি পর্যন্ত—ঝাপসা- দুপুরবেলার রোদ্দুরে যেন কাঁপছে। আমার ঘরের বাইরে তুলসীমঞ্চ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা তাকিয়ে থাকে। শরৎকালে উঠোনে ফোটে স্থলপদ্ম, পায়ের ছোঁওয়ায় লজ্জাবতী কুঁকড়ে যায়, ঘাসের সবুজে লাল কেন্নো জ্বলজ্বল করে। শীতের দিনে শুকনো তুলসীমঞ্জরীর গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চৈত্র মাসে বাতাস ছুটে আসে দুদ্দাড়— আমার টেবিলের কাগজপত্র উড়িয়ে নেয়, নিবিয়ে দেয় আমার সন্ধেবেলার কেরোসিন-ল্যাম্প। খোলা মাঠের মধ্যে একলা সেই টিনের ঘরটা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে উনুন হয়ে ওঠে, আর মাঘের রাত্রে বরফের বাক্স– দিদিমা দেয়ালগুলোতে খবর কাগজ এঁটে কিঞ্চিৎ শীত ঠেকিয়েছিলেন। ঘরে বসে শুনি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঝর্ঝর, কোনো স্তব্ধ রাতে আঁতুড়ের শিশুর গলায় কান্না—বটগাছে কোনো পক্ষীশাবক ডেকে উঠলো। কখনো শুনি সারা দুপুর ছাদ পেটানো গান— সারেঙ্গি বাজে একটানা, তালে-তালে মুগুর পড়ে ধ্রাম-গ্রাম, সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে চলে কুড়ি-পঁচিশটি মুগুর-পেটানো বাচ্চা ছেলে— উব-হাঁটু হয়ে বসে, সারা গায়ে-মাথায় রোদ্দুর নিয়ে, অক্লান্ত। বর্ষা নামে বিশাল— আকাশ ছেয়ে, প্রান্তর ছেয়ে, পৃথিবী জুড়ে, ধোঁয়াটে নীল কালো মেঘের ভিড়ে নিবিড়— আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যেন হাজার সেতারের রিমঝিম বাজনা। বাইরে কাঁচা রাস্তায় কাদা, মাঠে-মাঠে ঘাস আরো লম্বা, সব ফোকর ডোবা হয়ে উঠলো, ব্যাঙেদের ফূর্তি কিন্তু টুনুকে সাইকেল ঘাড়ে করে অনেক কষ্টে আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে হয়। কখনো কোনো বৃষ্টি-থেমে-যাওয়া মধ্যরাতে মেঘ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে জ্যোছনা, মাঠের উপরে রাত্রি হয়ে ওঠে নীলাভ, আর সবুজ, আর রহস্যময়। কখনো সারারাত বৃষ্টির পরে সূর্য উঠে আসে উজ্জ্বল, নতুন উৎসাহে দখল করে নেয় জগত্‍টাকে।

আবার কখনো কোনো মেঘলা সকালে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গান— কনক দাশের কণ্ঠে— ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে—পিছু ডাকে—’ আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সম্মোহন— কোনো সুখ, যা মুখে বলা যায় না, কোনো দুঃখ, যা সুখে চেয়েও ভালো। কখনো কোনো নির্জন পথে চলতে চলতে আমি কী যেন ভেবে হেসে উঠি হঠাৎ বা ঠোট নেড়ে নেড়ে কবিতার লাইন বানাতে থাকি। দিন, রাত্রি, ঋতুর হেরফের— যা-কিছু জীবনে এমনি পাওয়া যায়— মেঘের খেলা, চাঁদের ভাঙা-গড়া রোদ্দুরের রং-বদল, আর স্বপ্ন, কিছু স্বপ্ন— এই সব নিয়ে পুরানা পল্টনে আমার দিন কেটেছিলো— সেই প্রথম একটা-দুটো বছর, কিন্তু শুধু এ-সব নিয়েই নয়। ততদিনে আমার বাইরের জীবনটাও দুরন্ত।

রাত হয়েছে, আমি শহর থেকে বাড়ি ফিরছি। অনেক রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে বেড়িয়ে, অনেক হাসি গল্প আড্ডার পরে, চীনেবাদাম চায়ের পেয়ালা গোকুল নাগ আর সেন্মা লাগেরলফ-এর পরে— এখন আমি একলা। চলেছি পায়ে হেঁটে— ঐ একটি দৈহিক ব্যায়ামে আমি ওস্তাদ। আমি সাইকেল চালাতে পারি না— চেষ্টা করেও শিখতে পারিনি— আর ঘোড়ার গাড়ির পিছনে দু-আনা পয়সাও আমার মতে স্রেফ বাজে খরচ। নবাবপুর ধরে উত্তরে যত এগোচ্ছি, তত কমে আসছে লোকজন, আমি আস্তে হাঁটছি, আমার পা দুটো ক্লান্ত— কিন্তু রেল-লাইনের কাছাকাছি এসে আমি চলার বেগ বাড়িয়ে দিয়েছি, পাছে লেভেল-ক্রসিঙে আটকে যেতে হয়। কিন্তু, যেমন প্রায়ই হয়ে থাকে— ঠিক আমারই চোখের সামনে, যেন দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই ঘুন্টিওলাটি গেট নামিয়ে দিলো— এখন একটা মালগাড়ি আসার সময়, অন্তত পনেরো মিনিটের ধাক্কা। অগত্যা একটু কসরৎ করতে হয় আমাকে, তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলে লাইন টপকে বেরিয়ে আসি। এখানেই রমনার আরম্ভ- বলা যায় এক অন্য দেশ।

একটি লোক নেই রাস্তায়। দোকানপাট নেই। বাতাসে নেই ধুলোয় মেশা অশ্বমলের গন্ধ। বাতাস অনেক বেশি স্বাদু, রাত্রি অনেক বেশি গভীর। পুরোনো ঢাকার রাস্তাগুলি সব নিবৃক্ষ, কিন্তু এখানে গাছ সারি-সারি, প্রতিটি বাড়িতে বাগান। আমার ডাইনে একটার পর একটা খেলার মাঠ—ঐ দূরে অন্ধকারে মিশে আছে ক্বচিৎ- ব্যবহৃত গবর্মেন্ট-হাউসের অস্পষ্ট অবয়ব— আর বাঁয়ে আলো-জ্বলা দোতলা ডাকবাংলোটি, যার সীমানা পেরিয়ে বাঁয়ে বেঁকেছে রেল-কলোনির ফিরিঙ্গি পাড়া। সেটা ছেড়ে দিয়ে আমি এগিয়ে যাই সামনে, সোজা উত্তরে—আর তক্ষুনি আমার পদাতিকবৃত্তির বহুকালের সঙ্গী ছায়াটিকে আমি হারিয়ে ফেলি, যা ল্যাম্পোস্টের আলোয় ছোটো- বড়ো হয়ে, সামনে-পিছনে লুকোচুরি খেলে, আমাকে অনেক কৌতুক জাগিয়েছে অনেকদিন। অন্ধকার এখানে— পুরানা পল্টনের পুরো চৌহদ্দি বিদ্যুৎহীন। আমার ডাইনে মাঠ চলেছে এখনো, কিন্তু বাঁয়ে একটা রহস্যময় বন অথবা বাগিচা— ভিতরে কোনো খ্রিষ্টধর্মীর কবর, ফটকের মাথায় আমার পক্ষে অবোধ্য একটি লিপি উৎকীর্ণ অক্ষরগুলি খুব সম্ভব গ্রীক। এই বনটুকু পেরোনোমাত্র আমার দু-দিকেই প্রান্তর খুলে যায়, আর অন্ধকারে ভেসে ওঠে একটি আলোর দ্বীপ, সারি-সারি খরোজ্জ্বল জানলা— যেন নৈশ নদীর কালো জলের উপর স্টিমারের সার্চলাইট, স্টিমারের মতোই ধ্বকধ্বক এঞ্জিনের শব্দে জীবন্ত। বিদ্যুৎ-কোম্পানির পাওয়ার হাউস এটা— সারা রাত আলো জ্বলে এখানে, দিনে-রাত্রে এঞ্জিন থামে না। সেই উজ্জ্বলতা থেকে চোখ ফেরালে আমার সামনে আমি অন্য একটি আলো দেখতে পাই— ক্ষীণ, ম্লান, ঘোলাটে একটি বিন্দু, কিন্তু আমার সেটাকে মনে হয় যেন আমন্ত্রণ, যেন অভ্যর্থনা। লণ্ঠন জ্বলছে পরম-ভবনের বারান্দায়, পুরানা পল্টনের প্রথম বাড়ি এটি— ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক দুই অর্থেই— সে-বাড়ির ছেলে পরিমল আমার বন্ধু।

কিন্তু পরম-ভবনের পাশ দিয়ে গেলে একটু ঘুর হয়; –আমি নেমে আসি পাকা বাঁধানো শড়ক ছেড়ে মাঠে, পাওয়ার-হাউসের দিকে পিঠ ফিরিয়ে। অন্ধকার অনেক আগেই আমার চোখে সয়ে গেছে, তারার আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পাই গাঁয়ের লোকেদের পায়ে-পায়ে তৈরি আঁকাবাঁকা পথ, কিন্তু সেই রেখাটুকু আমার পায়ের পক্ষে বড়ো সংকীর্ণ; –আমি মাড়িয়ে চলি বুনো ঘাসের জমি, চোরকাঁটার চুলকোনি টের পাই, মাটির ঢেলায় ঠোক্কর খাই কখনো বা। মস্ত গোল মিশকালো আকাশ তারায়- তারায় ফেটে পড়ছে, আমার মাথার উপরে কালপুরুষ, রুপোলি একটি স্রোতের মতো ছায়াপথ আমার চোখের সামনে। আমি চলে এসেছি বটগাছ ছাড়িয়ে, ডাইনে দেখছি দিগন্তরেখার আব্রুর মতো গাছপালাগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে একটা তামাটে রঙের ঝিলিমিলি— চাঁদ উঠছে। ঐ আমার টিনের বাড়ির ঝাপসা রেখা, এই পৌঁছলাম। সারা গায়ে ঘুমের গন্ধ নিয়ে দরজা খুলে দেন দিদিমা; আমার খাবার জালিতে ঢেকে তুলে রেখেছেন তিনি, অতি যত্নে আমার বিছানা পেতে মশারি গুঁজে দিয়েছেন। খোলা হাওয়ায় ঘাসের গন্ধে অতক্ষণ পথ চলার পর আমার মনে হয় ঘরের মধ্যে গুমোট, লণ্ঠনের আলোয় চোখে ধাক্কা দেয় মশারিটা— কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সেই চৌখুপিটার মধ্যেই লুকোতে হয় আমাকে, শিয়রের টেবিলে লণ্ঠনটাকে আরো উশকে দিয়ে। শুয়ে-শুয়ে পড়ি যে-কোনো একটা উপন্যাস, যতক্ষণ না ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে— কখনো-কখনো হঠাৎ বড়ো ব্যর্থ লাগে নিজেকে; মনে হয় এত পড়েও, এত ঘোরাঘুরি মেলামেশা করেও আমি যা চাই তা পাচ্ছি না এখনো, আমার ইচ্ছেগুলো আমার চাইতে বড়ো।

কী ছিলাম আমি সেই সময়ে? একটা আবেগের পিণ্ড, বাস্তবে-কল্পনায় জট-পাকানো একটা বাণ্ডিল— অগোছালো, অস্থির, দোলায়মান— মনের এক অংশে নেহাৎ ছেলেমানুষ, আর অন্য অংশে অনেক বয়স্কের চেয়েও অধিক বয়স্ক। কাঁপছি আমি সারাক্ষণ, যে-কোনো হাওয়ায়, যে-কোনো ইঙ্গিতে, যেন আমি বড্ড বেশি খুলে যাচ্ছি, যেন আমার ভিতর-মহলে অনেকের জন্য জায়গা থাকলেও আমার নিজেরই কোনো আশ্রয় নেই। আমার শাসনহীন উদ্দেশ্যহীন অনুভূতিগুলো মুচড়ে দেয় আমার স্নায়ুতন্ত্র, আমার বুদ্ধিকেও বিভ্রান্ত করে। আমি বুঝতে পারি না যে মিলিয়ন-কাটতির ‘ইফ উইন্টার কাস’ উপন্যাসটা নেহাৎ বাজে, উপন্যাসটা নেহাৎ বাজে, রোমাঞ্চকর মারী করেলি অন্তঃসারহীন—এমনকি রবীন্দ্রনাথ আর সত্যেন্দ্র দত্তের মধ্যে জাতের তফাৎটাও মাঝে-মাঝে মুছে যায় আমার ধারণা থেকে। যা-কিছু আমার মনটাকে নিয়ে যে- কোনোরকম তোলপাড় করে তা-ই আমার কাছে ‘ভালো’–এবং প্রায় একই ভাবে মূল্যবান। আমার বেড়ে-চলা বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে এমন কেউ নেই যে আমার চোখে অসাধারণ নয়, বা অন্তত ‘চমৎকার ছেলে’ নয়’; আমি তাদের মধ্যে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে বিলিয়ে দিচ্ছি নিজেকে— হরিলুঠের বাতাসার মতো অজস্র। প্রেমে পড়ে আছি যে- কোনো মেয়ের, বছরের মধ্যে যে-কোনো তারিখে—যাকে চিনি অথবা চিনি না, যাকে দেখেছি অথবা দেখিনি, অথবা শুধু নাম শুনেছি হয়তো :—যে-কোনো একটা ছুতো পেলেই আমার নাড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠে, মনের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু এত অপব্যয়ের পরেও আমার আবেগ আমি ফুরোতে পারি না; তা উপচে পড়ে আমার লেখার খাতায়, ‘প্রগতি’র পাণ্ডুলিপি-সংখ্যাগুলিতে— পদ্যে গদ্যে অদম্য ও ফেনিল। যেমন ছাপার বইয়ের অক্ষরগুলোর উপর দিয়ে বুনো ঘোড়ার বেগে দৌড়ে চলি আমি, তেমনি আমার কলম চলে চিন্তাহীন ও মসৃণ— শব্দ, মিল, ছন্দ, সবই আমাকে অতি সহজে ধরা দেয়। যতক্ষণ লিখি, মৌজে থাকি; লেখার পরেও মনটা বেশ খুশি লাগে—কিন্তু কয়েকটা দিন বা দু-একটা মাস যেতে-না-যেতে সেই রং-বেরঙের বেলুনগুলো আমারই চোখের সামনে চুপসে যায়। আর আমার সেই ‘মর্মবাণী’ বলে বইটা—এই সেদিনমাত্র যেটা উপহার দিয়েছিলাম জনে-জনে মুন্সিগঞ্জের সাহিত্যসভায়—সেটা কবে যে শব্দহীন ও নিঃশোকভাবে কবরস্থ হয়ে গিয়েছিলো আমি তা টেরও পাইনি—সেটাকে আমি এখন বলি ছেলেমানুষি, কিন্তু আমার টাটকা-গজানো লেখাগুলিও দু-একবার হাত-পা ছুঁড়েই শিটিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই লেখালেখি ব্যাপারটাই কেমন আটকে রেখেছে আমাকে—বাইরের সব টানা-হেঁচড়ার মধ্যেও আমাকে বার-বার সেখানেই ফিরতে হয়। আমি তাই মানতে পারি না যে আমার এখন থেকেই আই. সি. এস. পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া উচিত (যে-পরামর্শ আমার গুরুজনদের মধ্যে কেউ-কেউ আমাকে দিয়ে থাকেন মাঝে-মাঝে); – আমার কেবলই মনে হয় আমি একটি ছাড়া অন্য কোনো কাজের যোগ্য নই, এবং সেই একটিকে নিয়েই সারা জীবন আমাকে কাটাতে হবে। আমার সব অস্থিরতার তলায় এই একটি বিশ্বাস নিষ্কম্প্র।

২৮

আমার ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলো, এখন গ্রীষ্মের ছুটি। ছুটির শুরুতে ঘুরে এসেছি কলকাতায়–এই প্রথম দূর-পথে এস্কর্টহীন, বাংলাদেশের রাজধানীতে এই প্রথম স্বাধীনভাবে পর্যটক। সেখানে আমাকে চুম্বকের মতো টানছিলো দশের-দুই পটুয়াটোলা লেন; সেই অভিযান ব্যর্থ হয়নি, আমি জেনে এসেছি আমি ‘কল্লোলে’রই একজন, ‘রজনী হলো উতলা’ নামে আমার একটা গল্প দীনেশরঞ্জন গ্রহণ করেছেন। সেটা অচিন্ত্যকুমারের হাতে দিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘গল্পটা একটু মডি।’ অচিন্ত্য হেসে বলেছিলেন, ‘আমরা মর্বিড লেখাই পছন্দ করি। বাজারে তখন ‘মর্বিড’ কথাটা নতুন উঠেছে।

কলকাতায় আমার দিন কেটেছিলো নিত্য-নতুন উত্তেজনার মধ্যে, কিন্তু দৈবদোষে বাসা পেয়েছিলাম ভবানীপুরের এক ঘিঞ্জি গলিতে— যেখানে রাত্রে আমাকে ফিরতেই হয়, এক বাসিন্দাবহুল অবরুদ্ধ আবহাওয়ায়। তাছাড়া মহানগরী তখন আমার টিনের চালার চেয়েও উত্তপ্ত ছিলো, আর ‘কল্লোল’ আপিশে অনেকের সঙ্গে চেনাশোনা হয়ে থাকলেও আমাকে তখন পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে কাছে টেনেছিলেন শুধু অচিন্ত্য। তাই, কলকাতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ সত্ত্বেও, ঢাকায় ফিরে স্বস্তি পেয়েছিলাম সেবার; নতুন করে ভালো লেগেছিলো পুরানা পল্টনের উন্মুক্ত মাঠ, নির্জনতা, আমার অভ্যস্ত আরাম, আমার অবকাশে ভরা অন্তরঙ্গ দিন-রাত্রিগুলি। এই যে আমি বেঁচে আছি বইয়ে এবং বন্ধুবান্ধবে পরিবৃত হয়ে, ভালোবাসা দিয়ে এবং পেয়ে, রৌদ্র এবং নক্ষত্রের আলোয় ঘুরে-ঘুরে— কোনো-কোনো মুহূর্তে আমার মনে হয় এই জীবন বড়ো সুন্দর, বড়ো আশ্চর্য, যেন ভেবে পাই না মানুষের মনে কেন থাকে মালিন্য, ঈর্ষা, বিদ্বেষ— যার প্রমাণ পেয়েছিলাম একবার যখন সন্ধ্যার আবছায়ায় দুটি মুখে রুমাল- বাঁধা যুবক প্রহার করেছিলো আমাকে আর পরিমলকে—ভেবে পাই না কেন কুৎসিত বাসনা-কামনা আমাকেও দংশন করে মাঝে-মাঝে— যে-আমি কবিতায় এত ভাবের কথা লিখছি। আমার এই সব ভাবনা অবশ্য খুবই অস্পষ্ট—অথবা সেগুলি ভাবনাই নয়, অনুভব মাত্র—যার মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা বা পারম্পর্য নেই— কিন্তু এরই তলা থেকে হঠাৎ একদিন দুটো লাইন ভেসে উঠলো—

যৌবনের উচ্ছ্বসিত সিন্ধুতটভূমে
বসে আছি আমি।

ধীরে-ধীরে, অসমমাত্রিক লইনের পর লাইনে, মিলছুট, চলন একটু ভারি, বেরিয়ে এলো এক যুবকের জবানবন্দি, এক শাপভ্রষ্ট দেবশিশুর আত্মঘোষণা। ‘অমাবস্যা-পূর্ণিমার পরিণয়ে আমি পুরোহিত! -এই শেষ উক্তিটি কাগজে লিখেই আমার অনুভূতি হলো— এটা ঠিক, এটা হয়েছে, এটা সত্যি। মানে, এটা বানানো নয়, আওয়াজের কুচকাওয়াজ নয়, নয় রবীন্দ্রনাথে বা সত্যেন্দ্র দত্তে বদহজমজনিত উদগার—এখানে আমার কিছু বলার ছিলো, এই প্রথম আমি নিজের গলায় কথা বলতে পারলাম। তথ্যের খাতিরে বলতেই হয় যে এর পরেও আমি অনেক ঠুনকো দ্রব্য বানিয়েছিলাম, সেগুলো নিয়ে বেসাতি করিনি তাও নয়; কিন্তু কয়েক মাস পরেই “বন্দীর বন্দনা” কবিতাটা লেখা হয়ে গেলো। এতদিন শূন্যে ঝুলে থাকার পর আমি পায়ের তলায় মাটি পেলাম এবার—অন্তত একটু দাঁড়াবার মতো জায়গা। আমার বয়স তখন সতেরো পেরিয়ে আঠারো চলছে; আমার ছেলেবেলার এখানেই সমাপ্তি।

***

অধ্যায় ৬ / ৬

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন