বুদ্ধদেব বসু
দিদিমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছি চট্টগ্রামে, তাঁর দেবর সেখানে টেলিগ্রাফ-মাষ্টার— আমাদের এস্কর্ট এসেছেন দিদিমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সত্যেন্দ্র, ইতিহাসে অনার্স নিয়ে টাটকা বি. এ. পাশ করেছেন তিনি। চট্টগ্রামে আমি প্রথম দেখলাম পাহাড় বা অন্তত পাহাড়ের কাছাকাছি কোনো আকৃতি, কোনো উচ্চভূমি— আর মনে পড়ে চারদিকে সবুজের আভা, সময়টা বর্ষা ছিলো, দিন মেঘলা। কিন্তু যে-কারণে সেই ক্ষণদৃষ্ট শহর আমার পক্ষে স্মরণীয় হয়ে আছে তার কারণ একজন মানুষ— একটি মেয়ে— আমাদের গৃহস্বামীর কিশোরী কন্যা, ছানা। তার সঙ্গে সত্যেন্দ্রর দেখা হওয়ামাত্র দু-জনের মধ্যে কী-যেন একটা ঘটে গেলো, আমি সেটা অনুভব করলাম— চোখে দেখলাম বললেও অত্যুক্তি হয় না।
দিদিমা এসেছিলেন দু-এক সপ্তাহ কাটিয়ে যাবেন বলে, কিন্তু তিন দিন পরেই নোয়াখালি থেকে টেলিগ্রাম এলো এক আত্মীয়ার হাত ভেঙে যাওয়ার খবর নিয়ে— অবিলম্বে ফিরে যেতে হলো আমাদের। কিন্তু মনের কোনো-কোনো বিশেষ অবস্থায় তিন দিন খুব অল্প সময় নয়— সেটুকুর মধ্যেই সত্যেন্দ্র ছানা অনেক-কিছু বিনিময় করলেন, আমি রইলাম সাক্ষী। দু-জনে দু-জনের দিকে তাকান অথবা তাকান না, মেয়েটি পান হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ায়, লাল হয়ে ওঠে, চলে যাবার সময় আঁচলে একটা ঢেউ খেলে তার— তার শাড়ির নীল রঙের পাড়টিকে আমি লক্ষ করি, যেন বাইরের সবুজের মধ্যে তা মিশে যাচ্ছে; আমার চোখে পড়ে তার সুন্দর চোখ— তরল ও গভীর ও শান্ত— কিন্তু মাঝে-মাঝে চঞ্চল এক-একটি চাউনি ছুটে আসে, সত্যেন্দ্ৰ যখন কাছাকাছি কোথাও আছেন হয়তো— ছুটে আসতে-আসতে মধ্যপথে মিলিয়ে যায়। যাবার আগে সত্যেন্দ্র মেয়েটির হাতে এনে দিলেন একখানা লাল রঙের সিল্ক-বাঁধাই বই, মলাটের উপর সোনালি অক্ষরে লেখা ‘সাবিত্রী-সত্যবান’– আমি বুঝে নিলাম এই উপহারের মধ্যে একটি ইশারা আছে : ‘সত্যবান’ থেকে ‘সত্যেন্দ্ৰ’ এক পা মাত্র দূরে।
ট্রেন চলছে, আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি, চুপচাপ। আমি চাটগাঁর কথা ভাবছি না, ছানার কথা ভাবছি না— তাকে ছেড়ে আসার জন্য কষ্ট পাচ্ছি তাও নয়। না— কষ্ট নয়, এক আশ্চর্য সুখ— সুখ নয়, এক নতুন, নামহীন অনুভূতি। আমি শুনছি এক সুর, এক গান— ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে সুর, আকাশ জুড়ে কারা যেন গান গাইছে— ভেসে আসছে আমার কানে সারাক্ষণ, ট্রেনের চাকার শব্দ ছাপিয়ে, বাইরের সব দৃশ্য মুছে দিয়ে— সারাক্ষণ। চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালি পর্যন্ত সারাটা পথ আমার যেন মোহের মধ্যে কেটে গেলো। সে-ই আমার প্রথম প্রেমে পড়া।
কাচারি-ময়দানের মোড় থেকে একটি রাস্তা সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে—দু-দিকে মস্ত উঁচু ঝাউগাছের সারি ডালে-ডাল মেলানো, সারাদিন ছায়া কাঁপছে শিরশির, ইংরেজ আমলের চকচকে নতুন টাকার মতো বা লম্বা সোনালি বর্শার মতো রোদ্দুরের সঙ্গে চিকরি-কাটা ছায়ার খেলা চলছে। এই রাস্তারই কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে ডরিক ছাঁদের স্তম্ভ-শোভিত টাউন-হল, আর তার মুখোমুখি পরিচ্ছন্ন পোস্টাপিশটি— দুটোই আমার বিশেষ প্রিয় স্থান।
সেই অল্প বয়সেই ডাকবিভাগের সঙ্গে আমার নিবিড় লেনদেন শুরু হয়েছিলো। যেহেতু পারিবারিক চিঠিপত্র আমাকে দিয়েই লেখানো হয়, তাই আত্মীয়রাও বেশির ভাগ চিঠি আমারই নামে পাঠান; মাসে-মাসে আসে অনেকগুলো ছোটো-বড়ো পত্রিকা, দাদামশাই আমাকে কলকাতা থেকে ভি. পি. ডাকে বই আনিয়ে দেন মাঝে-মাঝে, আমি তাঁর সঙ্গে পার্সেল ছাড়াতে গিয়ে ডাকঘরের অন্দরমহলে প্রবেশ করি। সেই থেকে আমি এমন ধারণাও পোষণ করেছিলাম যে সেখানে সব ভালো-ভালো বই কিনতে পাওয়া যায়, আর এই ভুল ভেঙে যাবার পরেও আমার পোস্টাপিশ-প্রীতি ক্ষুণ্ণ হয়নি, বরং আরো বেড়েই গিয়েছিলো, কেননা ততদিনে আমি দিগ্বিদিকে লেখা পাঠাতে শুরু করেছি— অনবরত ফেরৎ আসছে সেগুলো, আর বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো এক-আধটা কখনো ছাপা হচ্ছে না তাও নয়। সকাল থেকেই ডাকের আশায় আমি আনচান, কিন্তু একবার আমাদের এমন এক হরকরা জুটলো যার নাম ‘সাধু’ হলেও কর্তব্যপালনে তেমন নিষ্ঠা নেই। আধ-বুড়ো অলস প্রকৃতির মানুষ— পোস্টাপিশ থেকে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে সে তার বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করে অনেকক্ষণ, তামাক টানে, হয়তো একটু ঝিমিয়েও নেয়, অবশেষে কাজে বেরিয়ে পথ চলে মৃদুমন্দ তালে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে গালগল্প করে মাঝে-মঝে, বেলা এগারোটার আগে আমাদের দোরে তার পায়ের ধুলো পড়ে না। আমি এক-একদিন সটান তার ঘরের মধ্যে গিয়ে হানা দিই : ‘সাধুচরণ, আমাদের কোনো চিঠি আছে?’ সে হুঁকোয় দুটো টান দিয়ে আধ-বোজা চোখে জবাব দেয়, ‘বাড়ি যান, কত্তা, আমি এই এখনই আইতেছি—’ অর্থাৎ চিঠি খোঁজার জন্যও গা-টুকু এখন নাড়তে রাজি নয়। অগত্যা আমি ডাকঘরের জানলায় হাজিরা দিতে শুরু করলাম— নিয়ম করে রোজ সকালে সাতটা নাগাদ— সরকারি তকমা-আঁটা চাপরাশিদের মধ্যে মিশে গিয়ে আমার কিছুক্ষণ সময় কাটে চমৎকার। এখানে আমার খুশির উপাদান অনেক— চুনকাম-করা নির্মল দেয়াল, টকটকে লাল পাতের উপরে উজ্জ্বল শাদা অক্ষরে আঁকা নোটিসগুলো— যার উপর আমার জিভ ছোঁওয়াতে ইচ্ছে করে; দেয়ালে-আঁটা হাঁ-করে-থাকা ডাকবাক্স–যার তলায় চিঠি যাবার জন্য অগুনতি সুরঙ্গ আছে বলে এই সেদিনও আমার ধারণা ছিলো— আর ভিতরে কত ক্রিয়াকর্ম, চিঠিতে ছাপ দেবার দুমদুম শব্দ, সর্টারবাবুর হাতের দক্ষতা, গালার গন্ধ, তুঁত-মেশানো ময়দার আঠার গন্ধ, রাশি-রাশি কাগজপত্রের কেমন একটা থমথমে ভোঁতা জমাট গন্ধ, আর ক্যাম্বিসের বস্তা থেকে উগরে-বেরোনো চিঠির স্তূপ— নানা রঙের নানা ছাঁদের এনভেলাপ, ছোটো-বড়ো নানা রকম পার্সেল, আর কেমন মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেগুলির সিজিলমিছিল হয়ে যায়— এই সবই আশ্চর্য বলে মনে হয় আমার, পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময়। আমাকে প্রায় একদিনও খালি হাতে ফিরতে হয় না, কিন্তু চিঠি পাওয়া যেমন সুখের, আমার পক্ষে সেই অপেক্ষার সময়টুকুও তেমনি।
এই সূত্রেই একটি মুসলমান যুবকের সঙ্গে আমার একবার বন্ধুতা হয়— পোস্টাপিশে নিচু দরের চাকুরে সে, লেখাপড়া বেশি শেখেনি, কিন্তু অন্তঃকরণ ভারি সরল ও স্নেহশীল। একদিন তার সঙ্গে হেঁটে-হেঁটে আমি তার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম— চারদিকে গাছপালার ভিড়, হালকা গোলাপি আভা ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে— সে কিছু খেতে দিয়েছিলো আমাকে, বোধহয় তালশাঁস বা ডাবের শাঁস বা কালোজাম— জিনিশটা ঠিক কী তা বলতে পারছি না, শুধু তার আতিথ্যের ভঙ্গিটা আমার মনে আছে।
ইতিমধ্যে আরো একবার বাসা-বদল করেছি আমরা, ডেলনি-হাউস ছেড়ে উঠে এসেছি শহরের মধ্যে দশাচল একটা বাড়িতে, আমাদের সসন্তান আত্মীয়ারা যে যার গৃহে ফিরে গেছেন। এ-রকম সময়ে আমি কিছুদিন সরস্বতী ঠাকরুনকে নিয়ে মেতেছিলাম— সেটাও বোধহয় দাদামশায়েরই মস্তিষ্ক-ঢেউ।
শীতের শেষে আমি আমার বিবিধ চাকুরে আত্মীয়দের নামে-নামে পোস্টকার্ড পাঠাই; উত্তরে আসে এক-টাকা দু-টাকা মনি-অর্ডার। এটা আমার সরস্বতী পুজোর জন্য চাঁদা। অনেক আগে থেকেই আমি উত্তেজিত, প্রতিমার ফরমাশ আমিই দিয়ে এসেছি, মাঝে-মাঝে গিয়ে দেখেও আসি কতদূর এগোলো— আর তারপর সেই শুভদিনের প্রত্যুষে দাদামশাই আমাকে রাত থাকতে ডেকে দেন, এক পেয়ালা চা খাইয়ে দেন দিদিমা (তাতে নাকি উপোশের গুণ নষ্ট হয় না।) —তারপর দুপুর পর্যন্ত আনন্দ অবিরাম। শীতে কাঁপতে-কাঁপতে স্নান— বোধহয় হলুদ আর নিমপাতা-বাটা গায়ে মেখে— প্রতিমা নিয়ে আসা, আমার নতুন পাওয়া সমবয়সী কয়েকটি বন্ধুর উৎসাহ, পুজোর খুঁটিনাটি আয়োজন যা আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা বিধবাটি করে দেন— সবই আমার মনে হয় বিশেষ-কিছু, প্রতি মুহূর্তে আমি অনুভব করি আজকের দিনটি অন্য কোনো দিনের মতো নয়। আমি সাজিয়ে রেখেছি প্রতিমার পায়ের কাছে স্তূপীকৃত গাঁদাফুল আর খইয়ের মোয়ার ফাঁকে-ফাঁকে— আমার সব পড়ার বই, লেখার খাতা, দোয়াত কলম পেন্সিল; পুরুঠাকুর এসেছেন, আমি তাঁর মুখে-মুখে অন্যদের সঙ্গে সমস্বরে আওড়াচ্ছি—’টং টং সরস্বতী নির্মলবর্ণে/রত্নে বিভূষিতা কুণ্ডল কর্ণে’— তখন অবশ্য আমি জানি না যে পুরুটি এত অশিক্ষিত যে ‘ত্বম্’ শব্দকে টংকারে পরিণত করে নিয়েছেন; বুঝি না যে এই তথাকথিত পুরোহিত ও তথাকথিত মন্ত্রের লেখক সরস্বতীর ধারে-কাছে ঘেঁষার যোগ্য নন;- আমার মনের সুখবোধ তাই ভরপুর থেকে যায়। অঞ্জলিদান, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম, খইয়ের মোয়া খেয়ে উপবাসভঙ্গ— এই সব অনুষ্ঠানের শেষে মধ্যাহ্নভোজন পরিবেশিত হয় : শুধু হলুদ দিয়ে রাঁধা নতুন ইলিশের পাৎলা ঝোল রসনা থেকে হৃদয় পর্যন্ত পুলকের সঞ্চার করে— মনে হয় যেন অপূর্ব এক আস্বাদ, কেননা তখনকার দিনে হেমন্তে শীতে ইলিশভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিলো— বোধহয় বাজারেও বেশি উঠতো না— বাৎসরিক ইলিশ-উৎসবের তারিখও ছিলো শ্রীপঞ্চমী।
কিন্তু আমি আমার সরস্বতী পুজোকে সেখানেই শেষ হতে দিই না। প্রতিমাটিকে বিসর্জন না-দিয়ে তুলে রাখি বারান্দায় তাকের উপর, সেখানেই আমার নিত্যকর্ম নিয়ে ব্যাপৃত থাকি কোনো-কোনো দিন। আমার মনের ভাবটি অবশ্য এই যে মূর্ত বাগ্দেবীর পায়ের তলায় বসে লেখাপড়া করলে আমি আরো দ্রুত বিদ্বান হতে পারবো।
এই সময়কার অন্য একটি ঘটনা না-বললে আমার ছেলেবেলার কথা সম্পূর্ণ হবে না। সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়েছে, ‘সন্দেশ’ আর বেরোচ্ছে না। ততদিনে আমি যদি ও ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ ইত্যাদি নিয়ে মাতোয়ারা, তবু ‘সন্দেশের ফাঁক ভরানো সহজ হতো না আমার পক্ষে, যদি না ‘মৌচাক’ আসতো নতুন মধুর গন্ধে ভরপুর। ‘ঝরছে রে মৌচাকের মধু, /গন্ধ পাওয়া যায় হাওয়ায়’— এই দিয়ে প্রথম সংখ্যাটির আরম্ভ, তার পরেই গুনগুন ভোমরার মতো একটা গদ্য লেখা : ‘রিদয় নামে ছেলেটা নামেই হৃদয়, দয়ামায়া তার একটুও ছিলো না, আর তারপর আরো অনেক গল্প কবিতা পেরিয়ে শেষ পাতায় একটি ধাঁধা—’তিনটি হরফে নাম, শক্ত জবাব, / চিনতো তাদের শুধু বাদশা নবাব’— জবাব শক্ত নয়, কিন্তু পদ্য ভালো :- সব মিলিয়ে নানান রসে সুস্বাদু। মাস-পয়লায় আমি তেমনি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি ‘মৌচাকে’র জন্য, যেমন থাকতাম ‘সন্দেশে’র আশায়— কিন্তু আমারই দোষে ‘মৌচাকে’র সঙ্গে আমার সম্পর্কটি বিশুদ্ধ আনন্দের হলো না।
‘সন্দেশে’র আমি ছিলাম নিছক ভোক্তা, তার কারিগরদের লিস্টিতে ঢুকবো এমন কল্পনা কখনোই করিনি, কিন্তু— যেহেতু ততদিনে আমি নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে ফেলেছি, আমার বয়সও একটু বেড়েছে—তাই ‘মৌচাকে’ লেখা ছাপাবার এক অদম্য ইচ্ছে আমাকে পেয়ে বসলো। আমি ছুঁড়ছি তীরের পর তীর— অনবরত— কিন্তু সবগুলোই সম্পাদকের দপ্তরে ঠোক্কর খেয়ে অবিলম্বে আমারই গায়ে এসে বিঁধছে। অবশেষে একদিন লম্বা একখানা চিঠি লিখে পাঠালাম সম্পাদকমশাইকে— তিনি ‘পক্ষপাতদোষে দুষ্ট’, ‘দলের লোকের বাইরে’ লেখা নেন না, এমনি নানারকম অভিযোগ করে, যা চিরকাল দুর্বলের মুখে শোনা গিয়েছে। বলতে দোষ নেই, চিঠিখানা আমি ঠিক নিজের বুদ্ধিতে লিখিনি, লিখেছিলাম আমার বিষয়ে স্নেহান্ধ দাদামশাইয়ের নির্দেশমতো, যদিও— সন্দেহ নেই—আমারই বিক্ষোভ দেখে তিনি মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছিলেন। ‘মৌচাকে’র পরের সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সেই চিঠির তীব্র নিন্দা বেরোলো, প্রায় আস্ত একটা পৃষ্ঠা জুড়ে, পত্রলেখকের নামটি অবশ্য উহ্য রেখে। আমি মাথা পেতে নিলাম সেই শাস্তি, কাজটা খুব অন্যায় হয়েছিলো তা বুঝে নিতে আমার দেরি হলো না। তেমনি রইলাম ‘মৌচাকে’র দ্বারা মুগ্ধ হয়ে—যতদিন না, আমার যৌবনের শুরুতে, সেই শিশু-পত্রিকাটি আমার জীবন থেকে খসে পড়লো— কিছুকালের মতো।
এই কাহিনীর একটি সুখের উপসংহার আছে। আমার সাহিত্যিক জীবনে যে-কটি মানুষকে আমি সত্যিকার শুভানুধ্যায়ী বন্ধু হিশেবে পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সুধীরচন্দ্র সরকার— সেই সম্পাদকমশাই, যিনি আমার ছেলেবেলার অশিষ্টতাকে সুযোগ্যভাবে শাসন করেছিলেন। আমার কুড়ি বছর বয়স থেকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার প্রীতির সম্বন্ধ অটুট ছিলো।
ডরিক-স্তম্ভযুক্ত টাউন-হটি ছিলো নোয়াখালির সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, প্রমোদভবন দক্ষিণের ঘরে বিলিয়ার্ডস, তাসের টেবিল, অন্য দিকে লাইব্রেরি। মাঝের মস্ত হলঘরটির দেয়াল ঘেঁষে, বুক সমান উঁচু ডেস্কের উপর পড়ে থাকে সাপ্তাহিক বা অর্ধসাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’, ‘বঙ্গবাসী’ ইত্যাদি— এক-একটার কাগজ এত বড়ো মাপের যে পত্রিকাটি বিছিয়ে একজন সাবালক মানুষ শুয়ে থাকতে পারে। অনেকগুলো দৃশ্যপট-সমেত একটি পাকা স্টেজও আছে, হলঘরটি অডিটোরিয়ামের কাজ করে, মেয়েদের বসার ব্যবস্থা দেড় তলায়। স্থানীয় কয়েকটি যুবক কলকাতায় কলেজে পড়েন, ছুটির সময়ে বাড়ি এসে নাটক নিয়ে মেতে ওঠেন তাঁরা, চাকুরেদের মধ্যেও কেউ-কেউ উৎসাহী। শহরের সব ভদ্রলোক ও অনেক ভদ্রমহিলার পক্ষে এই নাট্যাভিনয়গুলি এক প্রধান অনুষ্ঠান—আর আমার পক্ষে, প্রায় অলৌকিক এক ঘটনা।
কনসার্ট চলছে তখনও, পর্দা ওঠেনি, আমি মুগ্ধ চোখে ড্রপসীনটির দিকে তাকিয়ে আছি। উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি, ধাপে-ধাপে ঘন-সবুজ গাছ—তারই তলায় বেঁকে গিয়েছে রেল-লাইন, লম্বা একটি ট্রেন চলেছে। পাশে নদী, নদীতে এক দোতলা স্টিমার, জলের মধ্যে আবির-গোলা রং ছড়িয়ে সূর্য উঠছে অথবা অস্ত যাচ্ছে। চিৎপুরের কোনো-এক পটুয়ার আঁকা এই স্থূল দৃশ্যটিকে স্বপ্নের মতো মনে হয় আমার, যেন ঐ স্থানটি একটি ভূস্বর্গ, ঐ ট্রেনে বা স্টিমারে যারা যাত্রী তাদের মতো সুখী মানুষ আর নেই। আর পর্দা ওঠার পরমুহূর্ত থেকে আরো বিচিত্র এক সম্ভোগে আমি ডুবে যাই— গ্যাসের বাতির উগ্র শাদা আলোয় দেখা মানুষগুলো—আমি চিনি তাঁদের অনেককে, নাম জানি, কথাও বলেছি কারো কারো সঙ্গে— কিন্তু এখন তাঁরা রূপান্তরিত; তাঁদের পাগড়ি, তাঁদের নাগরা, তাঁদের লম্বা পোশাকে রাংতা-জরির ঝলমলানি, তাঁদের গর্জন আর আস্ফালন আর চোখের ঘূর্ণন নিয়ে তাঁরা কেউ রাজপুত বীর, আর কেউ বা মোগল সেনাপতি। তাঁরা যখন তলোয়ার চালিয়ে ঝন্ঝন্ শব্দে যুদ্ধে মাতেন, আমার বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়; দুই নির্বাসিত ভাই বিজয়-বসন্ত যখন করুণ সুরে বিলাপ করতে-করতে উইং দিয়ে বেরিয়ে যায়, আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে তাদের জন্য। তথ্য হিশেবে আমি জানি যে মঞ্চের দু-পাশে আছে সাজঘর—আমি নিজেও গিয়েছি সেখানে, তবু আমি মানতে পারি না যে দুঃখী ভাই দুটি এতক্ষণে এক ঘোর অরণ্যে গিয়ে পড়েনি, যে মঞ্চ থেকে বেরোবার ঐ গলি-পথটি চলে যায়নি দূরে-দূরান্তে দেশান্তরে। জানি, এইমাত্র-নিহত ঐ বীর যোদ্ধাটির সঙ্গে কালই আমার দেখা হতে পারে রাস্তায়, তবু, তাঁর রক্তাক্ত দেহটির দিকে তাকিয়ে তাঁকে জীবিত বলে আমি কিছুতেই ভাবতে পারি না। এমনি, আমার মনের মধ্যে আবেগের ঢেউ তুলে-তুলে এগিয়ে চলে নাটক; রাত বাড়ে, ঘুমে ঢুলে পড়ে আমার মাথা, আমি চোখ টান করে তাকিয়ে থাকি; পরে কয়েকদিন ধরে দৃশ্যগুলির মিছিল চলে আমার মাথার মধ্যে।
শুধু একটি জিনিশ আমার ভালো লাগে না। স্টেজে কোনো স্ত্রী-চরিত্র এলেই বিরক্তি বোধ করি— কেন, তা কিছুদিন পরে বুঝেছিলাম। বলা বাহুল্য, পুরুষেরাই দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে মেয়ে সাজতেন, আর বোধহয় শিশুকাল থেকেই নারীর নারীত্ব বিষয়ে আমার অনুভূতি একটু তীক্ষ্ণ ছিলো।
আমাদের নোয়াখালিবাসের শেষ পর্যায়ে আমার সময়টা তেমন ভালো কাটেনি। আমি আত্মসচেতন হয়ে উঠছি, নিজের অনেক প্রকৃতি-দত্ত ত্রুটি আবিষ্কার করে ক্ষুণ্ণ হয়ে আছি মনে-মনে। সমবয়সী অন্য ছেলেদের তুলনায় আমি বেঁটে, আমি রোগা এবং দুর্বল ফুটবল দূরে থাক, ব্যাডমিন্টনেও আমার অল্পেই দম ফুরিয়ে যায়। আমার স্বাস্থ্য ভালো নয়—ঘুরে-ঘুরে ভুগি জ্বরে, সর্দিতে, দাঁতব্যথায়, আমাকে গিলতে হয় বিস্বাদ বার্লি, আর তীব্র তেতো কবরেজি পাঁচন— পর-পর দুটো শীত ঋতু ভরে চর্মরোগে কুৎসিত কষ্ট পেলাম। তার উপর আমি তোৎলা; হঠাৎ কোনো অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমার যন্ত্রণা দুঃসহ হয়ে ওঠে, কোনো তর্ক উঠলে আমার চোখা-চোখা যুক্তিগুলোকে কণ্ঠনালী থেকে টেনে বের করার ব্যর্থ চেষ্টায় আমি হাঁপাতে থাকি। কিন্তু, প্রায় একই সময়ে, আমি এও বুঝেছি যে আমার হাতে এ- সব বঞ্চনার একটি উত্তর এসে গিয়েছে— একটি ক্ষতিপূরণের উপায়, হয়তো বা এমন কোনো ক্ষমতা যা সকলের থাকে না। ততদিনে আমি এক-ঝুড়ি-ভর্তি কবিতা আর গল্প-প্রবন্ধ লিখে ফেলেছি; ‘বিকাশ” অথবা ‘পতাকা নামে একটি হাতে লেখা মাসিকপত্রের আমি সম্পাদক, প্রধান লেখক ও লিপিকার; ঢাকার শিশুপাঠ্য পত্রিকা ‘তোষিণী’তে আমার লেখা বেরিয়েছে, আর বর্জইস অক্ষরে কলকাতার ‘অর্চনা’য়, এমনকি শ্বেত-পীত মলাটধারী সম্ভ্রান্ত চেহারার ‘নারায়ণে’ও। আমার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা নোয়াখালি শহরে, এবং অন্য একটি কারণেও বয়স্করা আমাকে সমাদর করছেন। আমি হঠাৎ একজন অভিনেতা হয়ে উঠেছি, এমনকি গড়ে তুলেছি আমার সমবয়সী বা আমার চাইতে অল্প-বড়ো কয়েকটি ছেলেকে জুটিয়ে একটা নিজস্ব নাটুকে দল; কোনো রাজপুরুষের বিদায় অথবা অভ্যর্থনা-সভায় এবং অন্যান্য উপলক্ষেও অভিনয় বা আবৃত্তির জন্য ডাক পড়ে আমাদের— জোড়াতালি-দেয়া তক্তাপোশ-পাতা, স্টেজ থেকে সাক্ষাৎ টাউনহল্-মঞ্চে প্রোমোশন পেয়েছি আমরা। আশ্চর্যের বিষয়, মঞ্চে নামলে আমার তোলামির চিহ্নমাত্র থাকে না— আমাকে সাহায্য করে আমার উৎসাহ, শ্রোতাদের প্রীতি, আর সবচেয়ে বেশি কবিতার ছন্দ। আমাদের রেপেরতোয়ারে এমন-কোনো পালা নেই যা পদ্যে লেখা নয়—’মেঘনাদবধ কাব্য’ আর নবীন সেনের ‘কুরুক্ষেত্র’ থেকে সংকলিত কোনো-কোনো দৃশ্য আমাদের বিশেষ প্রিয়— স্থানীয় এলিটবৃন্দও সেগুলির তারিফ করে থাকেন। দূরস্থ আত্মীয়দের কাছেও প্রশংসা পাই— বিশেষত কোনো বিয়ের সময়, যখন আমি তাঁদের ফরমাশ মাফিক পরিণয়-পদ্য বানিয়ে ফেলি বিদ্যুৎবেগে — রঙিন ফুলের পাড়-বসানো পাৎলা ফুরফুরে জাপানি কাগজে লাল অথবা সোনালি অথবা বেগনি রঙে ছাপা হয়ে বিয়ের আসরে বিলোনো হয় সেগুলো। আত্মীয়েরা, নোয়াখালির বিশিষ্ট নাগরিকেরা, সকলেই একটু বিশেষ চোখে দ্যাখেন আমাকে, যে-সব বই উপহার দেন তার মধ্যে থাকে এক- ভল্যুমে সমগ্র শেক্সপিয়র, এমনকি বাল্মীকি-রামায়ণ পর্যন্ত। এমন নয় আমার জীবনের কাছে খুশি হবার মতো আমি কিছুই পাচ্ছি না।
কিন্তু আমার এই ছোটো ছোটো সাফল্যগুলোয় আমার ঠিক মন উঠছে না। আমি যা, আমি তার চেয়ে বড়ো, ভালো, যোগ্য হতে চাই— কবে, কতদিনে, কেমন করে তা হতে পারবো আমি ভেবে পাই না। অতৃপ্তি আমাকে পীড়ন করে মাঝে-মাঝে— নিজের বিষয়ে, এবং আমি যেখানে এবং যে-ভাবে আছি সে-সব নিয়েও অতৃপ্তি। আমি পড়ছি জ্বল ভের্ন, ‘সুইস ফ্যামিলি রবিন্সন’, ভিক্তর উগোর উপন্যাস — আমার মন ঘুরে বেড়ায় দূর দেশে, নীলতর অন্য সব আকাশের তলায়— পর্বতে, অরণ্যে, সমুদ্রে, – ভাসে গন্দোলায় চাঁদের আলোয় সন্ধেবেলা, অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামে কোনো নতুন শহরে ক্যাথিড্রেল-পাড়ায় সরাইখানায়। কিন্তু স্বপ্ন— শুধু স্বপ্ন এগুলো—যেখানে আছি সেখানে বাঁশবনে সন্ধ্যা নামে ঝামরে, মশাদের কোরাস বাজে উঁচু পর্দায়, সবুজ পুকুরে কচুরিপানা আরো এগিয়ে আসে, আর পাশের বাড়িতে এক পুলিশ-ইন্সপেক্টর তাঁর ভাইপোকে হান্টার দিয়ে পেটাতে থাকেন— প্রায় নিয়ম করে। ছেলেটা ষণ্ডাগোছের, আমি তাকে একটুও ভালোবাসি না, কিন্তু তার আর্তনাদ যেন গাঢ়তর এক কালিমা ছড়িয়ে দেয় হাওয়ায়, আমি উঠে গিয়ে লণ্ঠনের আলোয় আবার কোনো বই খুলে বসি— হয়তো সেই বইটার নাম ‘চয়নিকা’।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন