তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য – তৃতীয় সর্গ

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
তৃতীয় সর্গ

হেথা তুরাসাহ সহ ভীম প্রভঞ্জন—
বায়ুকুল-ঈশ্বর,—প্রচেতাঃ পরন্তপ,
দণ্ডধর মহারথী—তপন-তনয়—
যক্ষদল-পতি দেব অলকার নাথ,
সুরসেনানী শূরেন্দ্র,—প্রবেশ করিলা
ব্রহ্মপুরী। এড়াইয়া কাঞ্চন-তোরণ
হিরণ্ময়, মৃদুগতি চলিলা সকলে,
পদ্মাসনে পদ্মযোনি বিরাজেন যথা
পিতামহ। সুপ্রশস্ত স্বর্ণ-পথ দিয়া
চলিলা দিক্পাল-দল পরম হরষে।
দুই পাশে শোভে হৈম তরুরাজী, তাহে
মরকতময় পাতা, ফুল রত্ন-মাল,
ফল,—হায়, কেমনে বর্ণিব ফল-ছটা?
সে সকল তরুশাখা-উপরে বসিয়া
কলস্বরে গান করে পিকবরকুল
বিনোদি বিধির হিয়া! তরুরাজী-মাঝে
শোভে পদ্মরাগমণি-উৎস শত শত
বরষি অমৃত, যথা রতির অধর
বিম্বময়, বর্ষে, মরি, বাক্য-সুধা, তুষি
কামের কর্ণকুহর! সুমন্দ সমীর—
সহ গন্ধ,—বিরিঞ্চির চরণ-যুগল—
অরবিন্দে জন্ম যার—বহে অনুক্ষণ
আমোদে পূরিয়া পুরী! কি ছার ইহার
কাছে বনস্থলীর নিশ্বাস, যবে আসি
বসন্তবিলাসী আলিঙ্গয়ে কামে মাতি
সে বনসুন্দরী, সাজাইয়া তার তজু
ফুল-আভরণে। চারি দিকে দেবগণ

হেরিলা অযুত হর্ম্ম্য রম্য, প্রভাকর,
সুমে নগেন্দ্র যথা—অতুল জগতে!
সে সদনে করে বাস ব্রহ্মপুরবাসী,
রমার রম-উরসে যথা শ্রীনিবাস
মাধব! কোথায় কেহ কুসুম-কাননে,
কুসুম-আসনে বসি, স্বর্ণবীণা করে,
গাইছে মধুর গীত; কোথায় বা কেহ
ভ্রমে, সদানন্দ_সম সদানন্দ মনে
মঞ্জু কুঞ্জে, বহে যথা পীযূষ-সলিলা
নদী, কল কল রব করি নিরবধি,
পরি বক্ষস্থলে হেম-কমলের দাম;—
নাচে সে কনকদাম মলয়-হিল্লোলে,
উর্ব্বশীর বক্ষে যথা মন্দারের মালা?
যবে নৃত্য-পরিশ্রমে ক্লান্তা সীমন্তিনী
ছাড়েন নিশ্বাস ঘন, পূরি সুসৌরভে
দেব-সভা! কাম—হায়, বিষম অনল
অন্তরিত!—হৃদয় যে দহে, যথা দহে
সাগর বাড়বানল! ক্রোধ রাতময়,
উথলে যে শোণিত-তরঙ্গ ডুবাইয়া
বিবেক! দুরন্ত লোভ—বিরাম-নাশক,
হায় রে, গ্রাসক যথা কাল, তবু সদা
অশনায় পীড়িত! মোহ—কুসুমডোর,
কিন্তু তোর শৃঙ্খল, রে ভব-কারাগার,
দৃঢ়তর! মায়ার অজেয় নাগপাশ!
মদ—পরমত্তকারী, হায়, মায়া-বায়ু,
ফাঁপায় যে হৃদয়, কুরস যথা দেহ
রোগীর! মাৎসর্য্য—যার দুখ, পরদুখে,
গরলকণ্ঠ!—এ সব দুষ্ট রিপু, যারা
প্রবেশি জীবনফুলে, কীট যেন, নাশে
সে ফুলের অপরূপ রূপ, এ নগরে

নারে প্রবেশিতে, যথা বিষাক্ত ভুজগ
মহৌষধাগারে। হেথা জিতেন্দ্রিয় সবে,
ব্রহ্মার_নিসর্গধারী, নদচয় যথা
লভয়ে ক্ষীরতা বহি ক্ষীরোদ সাগরে!
হেরি সুনগর কান্তি, ভ্রান্তিমদে মাতি,
ভুলিলা দেবেশ-দল মনের বেদনা
মহানন্দে! ফুলবনে প্রবেশিয়া, কেহ
তুলিলা সুবর্ণফুল; কেহ, ক্ষুধাতুর,
পাড়িয়া অমৃতফল ক্ষুধা নিবারিলা;
কেহ পান করিলা পীযূষ-মধু সুখে;
সঙ্গীত-তরঙ্গে কেহ কেহ রঙ্গে ঢালি
মনঃ, হৈম তরুমূলে নাচিলা কৌতুকে।
এইরূপে দেবগণ ভ্রমিতে ভ্রমিতে
উত্তরিলা বিরিঞ্চির মন্দির-সমীপে
স্বর্ণময়; হীরকের স্তম্ভ সারি সারি
শোভিছে সম্মুখে, দেবচক্ষু যার আভা
ক্ষণ সহিতে অক্ষম! কে পারে বর্ণিতে
তাঁহার সদন, বিশ্বম্ভর সনাতন
যিনি? কিম্বা কি আছে গো এ ভবমগুলে
যার সহ তাহার তুলনা করি আমি?
মানব-কল্পনা কভু পারে কি কল্পিতে
ধাতার বৈভব—যিনি বৈভবের নিধি?
দেখিলেন দেবগণ মন্দির-দুয়ারে
বসি সুকনকাসনে বিশদবসনা
ভক্তি—শক্তি-কুলেশ্বরী, পতিতপাবনী,
মহাদেবী। অমনি দিক্‌পাল-দল নমি
সাষ্টাঙ্গে, পূজিলা মার রাঙা পা দুখানি!
“হে মাতঃ,”—কহিলা ইন্দ্র কৃতাঞ্জলিপুটে—
“হে মাতঃ, তিমিরে যথা বিনাশেন ঊষা,
কলুষনাশিনী তুমি! এ ভবসাগরে

তুমি না রাখিলে, হায়, ডুবে গো সকলে
অসহায়! হে জননি, কৈবল্যপারিনি,
কৃপা কর আমা সবা প্রতি—দাস তব।”
শুনি বাসবের স্তুতি, ভক্তি শক্তীশ্বরী
আশীষ করিলা দেবী যত দেবগণে
মৃদু হাসি; পাইলেন দিব্য চক্ষু সবে।
অপর আসনে পরে দেখিলা সকলে
দেবী আরাধনা,—ভক্তিদেবীর স্বজনী,
একপ্রাণা দোঁহে। পুনঃ সাষ্টাঙ্গে প্রণমি
কহিতে লাগিলা শচীকান্ত কৃতাঞ্জলি-
পুটে,—“হে জননি, যথা আকাশমণ্ডলী
নিনাদবাহিনী, তথা তুমি, শক্তীশ্বরি,
বিধাতার কর্ণমূলে বহ গো সতত
সেবক-হৃদয়-বাণী। আমা সবা প্রতি
দয়া কর, দয়াময়, সদয় হইয়া।”
শুনিয়া ইন্দ্রের বাণী, দেবী আরাধনা—
প্রসন্নবদনা মাতা— ভক্তিপানে চাহি,
—চাহে যথা সূর্য্য-মুখী রবিচ্ছবি পানে—
কহিলা,—“আইস, ওগো সখি বিধুমুখি,
চল যাই লইয়া দিক্‌পাল-দলে যথা
পদ্মাসনে বিরাজেন ধাতা; তোমা বিনা
এ হৈম কপাট, সখি, কে পারে খুলিতে?”-
“খুলি এ কপাট আমি বটে; কিন্তু, সখি,”
(উত্তর করিলা ভক্তি) “তোমা বিনা বাণী
কার শুনি, কর্ণদান করেন বিধাতা?
চল যাই, হে স্বজনি, মধুর-ভাষিণি—
খুলিব দুয়ার আমি; সদয় হৃদয়ে,
অবগত করাও ধাতারে, কি কারণে
আসি উপস্থিত হেথা দেবদল, তুমি।”
তবে ভক্তি দেবীশ্বরী সহ আরাধনা

অমৃত-ভাষিণী, লয়ে দেবপতিদলে
প্রবেশিলা মন্দগতি ধাতার মন্দিরে
নতভাবে। কনক-কমলাসনে তথা
দেখিলেন দেবগণ স্বয়ম্ভূ লোকেশে!
শত শত ব্রহ্ম-ঋষি বসেন চৌদিকে,
মহাতেজা, তেজোগুণে জিনি দিননাথে,
কাঞ্চন-কিরীট শিরে! প্রভা আভাময়ী,—
মহারূপবতী সতী,—দাঁড়ান সম্মুখে—
যেন বিধাতার হাস্যাবলী মূর্ত্তিমতী!
তাঁর সহ দাড়ান সুবর্ণবীণা করে,
বীণাপাণি, স্বরসুধা-বর্ষণে বিনোদি
ধাতার হৃদয়, যথা দেবী মন্দাকিনী
কলকল-রবে সদা তুষেন অচল-
কুল-ইন্দ্র হিমাচলে—মহানন্দময়ী!
শ্বেতভুজা, শ্বেতাজে বিরাজে পা দুখানি,
রক্তোৎপল-দল যেন মহেশ-উরসে;—
জগৎ-পূজিতা দেবী——কবিকুল-মাতা।
হেরি বিরিঞ্চির পাদ-পদ্ম, সুরদল,
অমনি শচী-রমণ সহ পঞ্চ জন—
নমিলা সাষ্টাঙ্গে। তবে দেবী আরাধনা
যুড়ি কর কলস্বরে কহিতে লাগিলা;—
“হে ধাতঃ, জগত-পিতঃ, দেব সনাতন,
দয়াসিন্ধু! সুন্দ-উপসুন্দাসুর বলী,
দলি আদিতেয়-দলে বিষম সংগ্রামে,
বসিয়াছে দেবাসনে পামর দেবারি,
লণ্ডভণ্ড করি স্বর্গ,—দাবানল যথা
বিনাশে কুসুমে পশি কুসুমকাননে
সর্ব্বভুক্! রাজ্যচ্যুত, পরাভূত রণে,
তোমার আশ্রয় চায় নিরাশ্রয় এবে
দেবদল,—নিদাঘার্ত্ত পথিক যেমতি

তরুবর পাশে আসে আশ্রম-আশায়।—
হে বিভো জগৎযোনি, অযোনি আপনি,
জগদত্ত নিরন্তক, জগতের আদি
অনাদি! হে সর্ব্বব্যাপি, সর্ব্বজ্ঞ, কে জানে
মহিমা তোমার? হায়, কাহার রসনা,—
দেব কি মানব,—গুণকীর্ত্তনে তোমার
পারক? হে বিশ্বপতি, বিপদের জালে
বদ্ধ দেবকুলে, দেব, উদ্ধার গো আজি।”
এতেক নিবেদি তবে দেবী আরাধনা
নীরব হইলা, নমি ধাতার চরণে
কৃতাঞ্জলিপুটে। শুনি দেবীর বচন—
কি ছার তাহার কাছে কাকলী-লহরী
মধুকালে?—উত্তর করিলা সনাতন’
ধাতা; “এ বারতা, বৎসে, অবিদিত নহে।
সুন্দ উপসুন্দাসুর দৈব-বলে বলী;
কঠোর তপস্যাফলে অজেয় জগতে।
কি অমর কিবা নর সমরে দুর্ব্বার
দোঁহে! ভ্রাতৃভেদ ভিন্ন অন্য পথ নাহি,
নিবারিতে এ দানবদ্বয়ে। বায়ু-সখা
সহ বায়ু আক্রমিলে কানন, তাহারে
কে পারে রোধিতে,—কার পরাক্রম হেন?”-
এতেক কহিলা দেবদেব প্রজাপতি।
অমনি করিয়া পান ধাতার বচন-
মধু, ব্রহ্ম-পুরী সুখতরঙ্গে ভাসিল!
শোভিলা উজ্জ্বলতরে প্রভা আভাময়ী,
বিশাল-নয়না দেবী! অখিল জগত
পূরিল সুপরিমলে, কমল কাননে
অযুত কমল যেন সহসা ফুটিয়া
দিল পরিমল-সুধা সুমন্দ অনিলে!
যথায় সাগর-মাঝে প্রবল পবন

বলে ধরি পোত, হার, ডুাইতেছিলা
তারে, শান্তি-দেবী তথা উতরি সত্বরে,
প্রবোধি মধুর ভাষে, শান্তিলা মারুতে।
কালের নশ্বর শ্বাস-অনলে যেখানে
ভস্মময় জীবকুল (ফুলকুল যথা
নিদাঘে) জীবনামৃত-প্রবাহ সেখানে
বহিল, জীবন দান করি জীবকূলে,—
নিশির শিশির-বিন্দু সরসে যেমতি
প্রসূন, নীরস, মরি, নিদাঘ-জ্বলনে!
প্রবেশিলা প্রতি গৃহে মঙ্গল-দায়িনী
মঙ্গলা! সুশস্যে পূর্ণা হাসিলা বসুধা;—
প্রমোদে মোদিল বিশ্ব বিস্ময় মানিয়া!
তবে ভক্তি শক্তীশ্বরী সহ আরাধনা,
প্রফুল্লবদনা যথা কমলিনী, যবে
ত্বিষাম্পত্তি দিননাথ তাড়াই তিমিরে,
কনক-উদয়াচলে আসি দেন দেখা,—
লইয়া দিক্‌পালদলে, যথাবিধি পূজি
পিতামহে, বাহিরিলা ব্রহ্মালয় হতে।
“হে বাসব,” কহিলেন ভক্তি মহাদেবী,
“সুরেন্দ্র, সতত রত থাক ধর্ম্মপথে।
তোমার হৃদয়ে, যথা রাজেন্দ্র-মন্দিরে
রাজলক্ষ্মী, বিরাজিব আমি হে সতত।”
“বিধুমুখী সখী মম ভক্তি শক্তীশ্বরী,”—
কহিলেন আরাধনা মৃদু মন্দ হাসি—
“বিরাজেন যদি সদা তোমার হৃদয়ে,
শচীকান্ত, নিতান্ত জানিও আমি তব
বশীভূতা! শশী যথা কৌমুদী সেখানে।
মণি, আভা, একপ্রাণা; লভ এ রতনে,
অযতনে আভা লাভ করিবে, দেবেশ!
কালিন্দীরে পান সিন্ধু গঙ্গার সঙ্গমে।”

বিদায় হইলা তবে সুরদল, সেবি
দেবীদ্বয়ে। পরে সবে ভ্রমিতে ভ্রমিতে,
উত্তরিলা পুনঃ যথা পীযূষ-সলিলা
বহে নিরবধি নদী কলকল কলে—
সুবর্ণ-তটিনী; যথা অমরী ব্রততী,
অমর সুতরুকুল; স্বর্ণকান্তি ধরি
ফুলকুল ফোটে নিত্য সুনিকুঞ্জবনে,
ভরি সুসৌরভে দেশ। হৈম বৃক্ষমূলে,
রঞ্জিত কুসুম-রাগে,—বসিলেন সবে।
কহিলা বাসব তবে ঈষৎ হাসিয়া,—
“দিতিজ-ভুজ-প্রতাপে, রণ পরিহরি,
আইলাম আমা সবে ধাতার সমীপে
ধায়ে রড়ে,—বিধির বিধান বোধাগম!
ভ্রাতৃভেদ ভিন্ন অন্য নাহি পথ; কহ,
কি বুঝ সঙ্কেত-বাক্যে, কহ, দেবগণ?
বিচার করহ সবে: সাবধানে দেখ
কি মর্ম্ম ইহার! দুধে জল যদি থাকে,
তবু রাজহংসপতি পান করে তারে,
তেয়াগিয়া তোয়ঃ! কে কি বুঝ, কহ, শুনি।”—
উত্তর করিলা যম:—“এ বিষয়ে, দেব
দেবেন্দ্র, স্বীকারি আমি নিজ অক্ষমতা।
বাহ-পরাক্রমে কর্ম্ম-নির্ব্বাহ যেখানে,
দেবনাথ, সেথা আমি। তোমার প্রসাদে
এই যে প্রচণ্ড দণ্ড, ব্রহ্মাণ্ডনাশক,
শিখেছি ধরিতে এরে; কিন্তু নাহি জানি
চালাইতে লেখনী, পশিতে শব্দার্ণবে
অর্থরত্ন-লোভে—যেন বিদ্যার ধীবর।”
“আমিও অক্ষম যম সম”—উত্তরিলা
প্রভঞ্জন—“সাধিবারে তোমার এ কাজ
বাসব! করীর কর যথা, পারি আমি

উপাড়িতে তরুবর, পাষাণ চূর্ণিতে,
চিরধীর শৃঙ্গধরে বজ্রসম চোটে
অধীরিতে; কিন্তু নারি তুলিতে বাছিয়া
এ সূচি, হে নমুচিসূদন শচীপতি।”—
উত্তর করিলা তবে স্কন্দ তারকারি
মৃদু স্বরে;—“দেহ, ওহে দেবকুলপতি,
দেহ অনুমতি মোরে, যাই আমি যথা
বসে সুন্দ উপসুন্দ,—দুরন্ত অসুর।
যুদ্ধার্থে আহ্‌বানি গিয়া ভাই দুই জনে।
শুনি মোর শঙ্খধ্বনি রুষিবে অমনি
উভয়; কহিব আমি—‘তোমাদের মাঝে
বীরশ্রেষ্ঠ বীর যে, বিগ্রহ দেহ আসি।’
ভাই ভাই বিরোধ হইবে এ হইলে।
সুন্দ কহিবেক আমি বীর-চূড়ামণি;
উপসুন্দ এ কথায় সায় নাহি দিবে
অভিমানে। কে আছে গো, কহ, দেবপতি,
রথীকুলে, স্বীকারে যে আপন ন্যূনতা?
ভাই ভাই বিবাদ হইলে, একে একে
বধিব উভয়ে আমি বিধির প্রসাদে—
বধে যথা বারণারি বারণ-ঈশ্বরে।”
শুনি সেনানীর বাণী, ঈষৎ হাসিয়া
কহিতে লাগিলা দেব যক্ষকুলরাজা
ধনেশ;—“যা কহিলেন হৈমবতীসুত,
কৃত্তিকাকুলবল্লভ, মনে নাহি লাগে।
কে না জানে ফণী সহ বিষ চিরবাসী?
দংশিলে ভুজঙ্গ, বিষ-অশনি অমনি
বায়ুগতি পশে অঙ্গে—দুর্ব্বার অনল।
যথায় যুঝিবে সুন্দাদুর দুষ্টমতি,
নিষ্কোষিবে অসি তথা উপসুন্দ বলী
সহকারী; উভয়ের বিক্রম উভয়।

বিশেষত, কূট-যুদ্ধে দৈত্যদল রত।
পাইলে একাকী তোমা, হে উমাকুমার,
অবশ্য অন্যায়যুদ্ধ করিবে দানব
পাপাচার। বৃথা তুমি পড়িবে সঙ্কটে,
বীরবর! মোর বাণী শুন, দেবপতি
মহেন্দ্র; আদেশ মোরে, ধনজালে বেড়ি
বধি আমি—যথা ব্যাথ বধয়ে শার্দ্দুল,
আনায়-মাঝারে তারে আনিয়া কৌশলে—
এ দুষ্ট দনুজ দোঁহে! অবিদিত নহে,
বসুমতী সতী মম বসু-পূর্ণাগার[১],
যথা পঙ্কজিনী ধনী ধরয়ে যতনে
কেশর,—মদন[২] অর্থ। বিবিধ রতন—
তেজঃপুঞ্জ, নয়নরঞ্জন, রাশি রাশি,
দেহ আজ্ঞা, দেব, দান করি দানবেরে।
করি দান সুবর্ণ—উজ্জ্বল বর্ণ, সহ
রজত, সুশ্বেত যথা দেবী শ্বেতভুজা।
ধনলোভে উন্মত্ত উভয় দৈত্যপতি,
অবশ্য বিবাদ করি মরিবে অকালে—
মরিল যেমতি দ্বন্দ্বি, হায়, মন্দমতি!
সহ সুপ্রতীক ভ্রাতা লোভী বিভাবসু!”—
উত্তর করিলা তবে জলেশ বরুণ
পাশী;—“যা কহিলে সত্য, যক্ষকুলপতি,
অর্থে লোভ; লোভে পাপ; পাপ—নাশকারী
কিন্তু ধন কোথা এবে পাবে, ধনপতি?
কোথা সে বসুধা শ্যামা, সুবসুধারিণী
তোমার? ভুলিলে কি গো, আমরা সকলে
দীন, পত্রহীন তরু হিমানীতে যথা,
আজি! আর আছে কি গো সে সব বিভব?
আর কি—কি কাজ কিন্তু এ মিছা বিলাপে?
কহ, দেবকুলনিধি, কি বিধি তোমার?”

কহিতে লাগিলা তবে দেব পুরন্দর
অসুরারি;—“ভাসি আমি অজ্ঞাত সলিলে
কর্ণধার, ভাবনায় চিন্তায় আকুল,
নাহি দেখি অনুকূল কূল কোন দিকে!
কেমনে চালার তরী বুঝিতে না পারি?
কেমনে হইব পার অপার সাগর?
শূন্যতূণ আমি আজি এ ঘোর সমরে।
বজ্রাপেক্ষা তীক্ষ্ণ মম প্রহরণ যত,
তা সকলে নিবারিল এ কাল সংগ্রামে
অসুর। যখন দুষ্ট ভাই দুই জন
আরম্ভিলা তপঃ, আমি পাঠানু যতনে
সুকেশিনী উর্ব্বশীরে; কিন্তু দৈববলে
বিফলবিভ্রমা বামা লজ্জায় ফিরিল,—
গিরিদেহে বাজি যথা রাজীব! সতত
অধীর সুধীর ঋষি যে মধুর হাসে,
শোভিল সে বৃথা, হায়, সৌদামিনী যথা
অন্ধজন প্রতি শোভে বৃথা প্রজ্বলনে!
যে কেশে নিগড় সদা গড়ে রতিপতি;
যে অপাঙ্গবিষানলে জ্বলে দেব-হিয়া;—
নারিল সে কেশপাশ বাঁধিতে দানবে!
বিফল সে বিষানল, হলাহল যথা
নীলকণ্ঠ-কণ্ঠদেশে! কি আর কহিব—
বৃথা মোরে জিজ্ঞাসহ, জলদলপতি।”
এতেক কহিয়া দেব দেবেন্দ্র বাসব
নীরবিলা, আহা, মরি, নিশ্বাসি বিষাদে!
বিষাদে নীরব দেখি পৌলোমীরঞ্জনে,
মৌনভাবে বসিলেন পঞ্চ দেব রথী।
হেন কালে—বিধির অদ্ভুত লীলাখেলা।
কে পারে বুঝিতে গো এ ব্রহ্মাণ্ডমগুলে?—
হেন কালে অকস্মাৎ হইল দৈববাণী।

“আনি বিশ্বকর্ম্মায়, হে দেবগণ, গড়
বামায়,—অঙ্গনাকুলে অতুলা জগতে।
ত্রিলোকে আহরে যত স্থাবর, জঙ্গম,
ভূত, তিল তিল সবা হইতে লইয়া,
সৃজ এক প্রমদারে—ভব-প্রমোদিনী।
তা হতে হইবে নষ্ট দৃষ্ট অমরারি।”—
তবে দেবপতি, শুনি আকাশ-সম্ভবা
ভারতী, পবন পানে চাহিয়া কহিলা,—
“যাও তুমি, আন হেথা, বায়ুকুল-রাজা,
অবিলম্বে বিশ্বকর্ম্মা, শিল্পীকুলরাজে!”
শুনি দেবেন্দ্রের বাণী, অমনি তখনি
প্রভঞ্জন শূন্যপথে উড়িলা সুমতি
আণ্ডগ;—কাঁপিল বিশ্ব থর থর করি
আতঙ্কে, প্রমাদ গণি অস্থির হইলা
জীবকুল, যথা যবে প্রলয়ের কালে,
টঙ্কারি পিনাক রোষে পিনাকী ধূর্জ্জটি
বিশ্বনাশী পাশুপত ছাড়েন হুঙ্কারে।
চলি গেলা পবন, পবনবেগে দেখ
শূন্যপথে! হেথা ব্রহ্মপুরে পঞ্চ জন
ভাসিলা—মানস সরে রাজহংস যথা—
আনন্দ-সলিলে সদানন্দের সদনে!
যে যাহা ইচ্ছিলা তাহা পাইলা তখনি।
যে আশা, এ ভবমরুদেশে মরীচিকা,
ফলবতী নিরবধি বিধির আলয়ে!
মাগিলেন সুধা শচীকান্ত শান্তমতি;
অমনি সুধালহরী বহিল সন্মুখে
কলরবে। চাহিলেন ফল জলপতি;
রাশি রাশি ফল আসি সুবর্ণ-বরণ—
পড়িল চৌদিকে। যাচিলেন ফুল দেব-
সেনানী; অযুত ফুল, স্তবকে স্তবকে

বেড়িল শুরেন্দ্রে যথা চন্দ্রে তারাবলী।
রত্নাসন মাগি তাহে বসিল। কুবের—
মণিময় শেষের অশেষ দেহোপরি
শোভিলেন যেন পীতাম্বর চিন্তামণি।
ভ্রমিতে লাগিলা যম মহাহৃষ্টমতি,
যথা শরদের কালে গগনমগুলে,
পবন-বাহনারোহী, ভ্রমে কুতূহলী
মেঘেন্দ্র, রজনীকান্ত-রজঃকান্তি হেরি,—
হেরি রত্নাকারা তারা,—সুখে মন্দগতি!
এড়াইয়া ব্রহ্মপুরী, বায়ুকুল-রাজা
প্রভঞ্জন, বায়ুবেগে চলিলেন বলী
যথায় বসেন বিশ্বোপান্তে মহামতি
বিশ্বকর্ম্মা। বাতাকারে উড়িলা সুরথী
শূন্যপথে, উথলিয়া নীলাম্বর যেন
নীল অম্বুরাশি। কত দূরে ত্বিষাম্পতি
দিনকান্ত রবিলোকে অস্থির হইলা
ভাবি দুষ্ট রাহু বুঝি আইল অকালে
মুখ মেলি। চন্দ্রলোকে রোহিণীবিলাসী
সুধানিধি, পাণ্ডুবর্ণ আতঙ্কে স্মরিয়া
দুরন্ত বিনতাসুতে,—সুধা-অভিলাষী!
মুদিলা নয়ন হৈম তারাকুল ভয়ে,
ভৈরব দানবে হেরি যথা বিদ্যাধরী,
পঙ্কজিনী তমঃপুঞ্জে; বাসুকির শিরে
কাঁপিলা ভীরু বসুধা; উঠিলা গর্জ্জিয়া
সিন্ধু, দ্বন্দ্বে রত সদা, চির-বৈরি হেরি;—
সাজিল তরঙ্গ-দল রণ-রঙ্গে মাতি।
এ সবে পশ্চাতে রাখি আঁখির নিমিষে
চলি গেলা আশুগতি। ঘন ঘনাবলী
ধায় আগে রড়ে ঝড়ে, ভূত-দল যথা
ভূত-নাথ সহ। একে একে পার হয়ে

সপ্ত অব্ধি, চলিলা মরুৎকুলনিধি
অবিশ্রান্ত, ক্লান্তি, শান্তি, সবে অবহেলি
চলে যথা কাল। কত দূরে যমপুরী
ভয়ঙ্করী দেখিলেন ভীম সদাগতি।
কোন স্থলে হিমানীতে কাঁপে থরথরি
পাপি-প্রাণ, উচ্চৈঃস্বরে বিলাপি দুর্ম্মতি;—
কোন স্থলে কালাগ্নেয়-প্রাচীর-বেষ্টিত
কারাগারে জ্বলে কেহ হাহাকার রবে
নিরবধি; কোথাও বা ভীম-মূর্ত্তি-ধারী
যমদূত প্রহারয়ে চণ্ড দণ্ড শিরে
অদয়; কোথাও শত শকুনি-মণ্ডলী
বজ্রনখা, বিদরিয়া বক্ষঃ মহাবলে,
ছিন্ন ভিন্ন করে অন্ত্র; কোথাও বা কেহ,
তৃষায় আকুল, কাঁদে বসি নদী-তীরে,
করিয়া শত মিনতি বৈতরণী-পদে
বৃথা,—না চাহেন দেবী দুরাত্মার পানে,
তপস্বিনী ধনী যথা—নয়নরমণী—
কভু নাহি কর্ণদান করে কামাতুরে—
জিতেন্দ্রিয়া! কোথাও বা হেরি লক্ষ লক্ষ
উপাদেয় ভক্ষ্যদ্রব্য, ক্ষুধাতুর প্রাণী
মাগে ভিক্ষা ভক্ষণ—রাজেন্দ্র-দ্বারে যথা
দরিদ্র,—প্রহরী-বেত্র আঘাতে শরীর
জরজর। সতত অগণ্য প্রাণিগণ
আসিতেছে দ্রুতগতি চারি দিক্ হতে,
ঝাঁকে ঝাঁকে আসে যথা পতঙ্গের দল
দেখি অগ্নিশিখা,—হায়, পুড়িয়া মরিতে!
নিস্পৃহ এ লোকে বাস করে লোক যত।
হায় রে, যে আশা আসি তোষে সর্ব্বজনে
জগতে, এ ছরম্ভ অনন্তকপুরে গতি-
রোধ তার! বিধাতার এই সে বিধান

মরুস্থলে প্রবাহিণী কভু নাহি বহে।
অবিরামে কাটে কীট; পাবক না নিবে।
শত-সিন্ধু-কোলাহল জিনি, দিবানিশি,
উঠয়ে ক্রন্দনধ্বনি কর্ণ বিদরিয়া।
হেরি শমনের পুরী, বিস্ময় মানিয়া
চলিলা জগৎপ্রাণ পুনঃ দ্রুতগতি
যথায় বসেন দেব-শিল্পী। কতক্ষণে
উত্তরমেরুতে বীর উত্তরিলা আসি।
অদূরে শোভিল বিশ্বকর্মার সদন।
ঘন ঘনাকার ধূম উড়ে হর্ম্ম‍্যোপরি,
তাহার মাঝারে হৈম গৃহাগ্র অযুত
দ্যোতে, বিদ্যুতের রেখা অচঞ্চল যেন
মেঘাবৃত আকাশে, বা বাসবের ধনু
মণিময়! প্রবেশিয়া পুরী বায়ুপতি
দেখিলেন চারি দিকে ধাতু রাশি রাশি
শৈলাকার; মূর্ত্তিমান্ দেব বৈশ্বানরে।
পাই সোহাগায় সোণা গলিছে সোহাগে
প্রেম-রসে; বাহিরিছে রজত গলিয়া
পুটে, বাহিরায় যথা বিমল-সলিল-
প্রবাহ, পর্ব্বত-সানু-উপরি যাহারে
পালে কাদম্বিনী ধনী; লৌহ, যার তনু
অক্ষয়, তাপিলে অগ্নি, মহারাগে ধাতু
জ্বলে অগ্নিসম তেজ,—অগ্নিকুণ্ডে পড়ি
পুড়িছে,—বিষম জ্বালা যেন ঘৃণা করি,—
নীরবে শোকাগ্নি যথা সহে বীর-হিয়া।
কাঞ্চন-আসনে বসি বিশ্বকর্ম্মা-দেব,
দেব-শিল্পী, গড়িছেন অপূর্ব্ব গড়ন,
হেন কালে তায় আইলা সদাগতি।
হেরি প্রভঞ্জনে দেব অমনি উঠিয়া
নমস্কারি বসাইলা রত্ন-সিংহাসনে।

“আপন কুশল কহ, বায়ুকুলেশ্বর,”—
কহিতে লাগিলা বিশ্বকর্ম্মা—“কহ বলি,
স্বর্গের বারতা। কোথা দেবেন্দ্র কুলিশী?
কি কারণে, সদাগতি, গতি হে তোমার
এ বিজন দেশে? কহ, কোন্ বরাঙ্গনা—
দেবী কি মানবী—এবে ধরিয়াছে, তোমা
পাতি পীরিতের ফাঁদ? কহ, যত চাহ,
দিব আমি অলঙ্কার, অতুল জগতে!
এই দেখ নূপুর; ইহার বোল শুনি
বীণাপাণি-বীণা, দেব, ছিন্ন-তার, খেদে!
এই দেখ সুমেখলা; দেখি ভাব মনে,
বিশাল নিতম্ববিম্বে কি শোভা ইহার!
এই দেখ মুক্তাহার; হেরিলে ইহারে
উরজ-কমলযুগ-মাঝারে, মনোজ
মজে গো আপনি! এই দেখ, দেব, সিঁথি;
কি ছার ইহার কাছে, ওরে নিশীথিনি,
তোর তারাময় সিঁথি! এই যে কঙ্কণ
খচিত রতনবৃন্দে, দেখ, গন্ধবহ।
প্রবাল-কুণ্ডল এই দেখ, বীরমণি;—
কি ছার ইহার কাছে বনস্থলী-কাণে
পলাশ, রমণী-মনোরমণ ভূষণ!
আর আর আছে যত, কি কব তোমারে?”
হাসিয়া হাসিয়া যদি এতেক কহিলা
বিশ্বকর্ম্মা, উত্তর করিলা মহামতি
শ্বসন, নিশ্বাস বীর ছাড়িয়া বিষাদে;—
“আর কি আছে গো, দেব, সে কাল এখন?
বিশ্বোপান্তে তিমির-সাগর-তীরে সদা
বস তুমি, নাহি জান স্বর্গের দুর্দ্দশা!
হায়, দৈত্যকূল এবে, প্রবল সমরে,
লুটিছে ত্রিদশালয় লণ্ডভণ্ড করি,

পামর! ধরেন তোমা দেব অসুরারি,
শিল্পিবর; তেঁই আমি আইনু সত্বরে।
চল, দেব, অবিলম্বে; বিলম্ব না সহে।
মহা ব্যগ্র ইন্দ্র আজি তব দরশনে।”
শুনি পবনের বাণী, কহিতে লাগিলা
দেব-শিল্পী—“হায় দেব, এ কি পরমাদ!
দিতিজকুল উজ্জ্বলি, কোন্ মহারথী
বিমুখিলা দেবরাজে সম্মুখ-সমরে
বলে? কহ, কার অস্ত্রে রোধ গতি তব,
সদাগতি? কে ব্যথিল তীক্ষ্ণ প্রহরণে
যমে? নিরস্তিল কেবা জলেশ পাশীরে?
অলকানাথের গদা—শৈল-চূর্ণ-কারী?
কে বিঁধিল, কহ, হায়, খরতর শরে
ময়ূর-বাহনে? এ কি অদ্ভুত কাহিনী!
কোথায় হইল রণ? কিসের কারণে?
মরে যবে সমরে তারক মন্দমতি,
তদবধি দৈত্যদল নিস্তেজ-পাবক,—
বিষহীন ফণী; এবে প্রবল কেমনে?
বিশেষ করিয়া কহ, শুনি, শূরমণি।
উত্তরমেরুতে সদা বসতি আমার
বিশ্বোপান্তে। ওই দেখ তিমির-সাগর
অকূল, পর্ব্বতাকার যাহার লহরী
উথলিছে নিরবধি মহা কোলাহলে।
কে জানে জল কি স্থল? বুঝি ছুই হবে।
লিখিলা এ মেরু ধাতা জগতের সীমা
সৃষ্টিকালে; বসে তমঃ, দেখ ওই পাশে।
নাহি যান প্রভাদেবী তাহার সদনে,
পাপীর সদনে যথা মঙ্গল-দায়িনী
লক্ষ্মী। এত দূরে আমি কিছু নাহি জানি;
বিশেষ করিয়া কহ সকল বারতা।”

উত্তর করিলা তবে বায়ু-কুলপতি—
“না সহে বিলম্ব হেথা, কহিনু তোমারে,
শিল্পিবর, চল যথা বিরাজেন এবে
দেবরাজ; শুনিবে গো সকল বারতা
তাঁর মুখে। কোন্ সুখে কব, হায়, আমি,
সিংহদল-অপমান শৃগালের হাতে?
স্মরিলে ও কথা দেহ জ্বলে কোপানলে!
বিধির এ বিধি তেঁই সহি মোরা সবে
এ লাঞ্ছনা। চল, দেব, চল শীঘ্রগতি!
আজি হে তোমার ভার উদ্ধার করিতে
দেব-বংশ,—দেবরিপু ধ্বংসি স্বকৌশলে!”
এতেক কহিয়া দেব বায়ু-কুলপতি
দেব দেব-শিল্পী সহ উঠিলা আকাশে
বায়ুবেগে। ছাড়াইয়া কৃতান্ত-নগরী,
বসুধা বাসুকি-প্রিয়া, চন্দ্র সুধানিধি,
সূর্য্যলোক, চলিলেন মনোরথগতি
দুই জন; কত দূরে শোভিল অম্বরে
স্বর্ণময়ী ব্রহ্মপুরী, শোভেন যেমতি
উমাপতি-কোলে উমা হৈমকিরীটিনী
শত শত গৃহচূড়া হীরক-মণ্ডিত
শত শত সৌধশিরে ভাতে সারি সারি
কাঞ্চন-নির্ম্মিত। হেরি ধাতার সদন
আনন্দে কহিলা বায়ু দেব-শিল্পী প্রতি;—
“ধন্য তুমি দেবকুলে, দেব-শিল্পি গুণি!
তোমা বিনা আর কার সাধ্য নির্মাইতে
এ হেন সুন্দরী পুরী—নয়ন-রঞ্জিনী।”
“ধাতার প্রসাদে, দেব, এ শক্তি আমার”—
উত্তরিলা বিশ্বকর্ম্মা—“তাঁর গুণে গুণী,
গড়ি এ নগর আমি তাঁহার আদেশে।
যথা সরোবর জল, বিমল, তরল,

প্রতিবিম্বে নীলাম্বর তারাময় শোভা
নিশাকালে, এই রমা প্রতিমা প্রথমে
উদয়ে ধাতার মনে,—তবে পাই আমি।”
এইরূপ কথোপকথনে দেবদ্বয়
প্রবেশিলা ব্রহ্মপুরী-মন্দগতি এবে।
কত দূরে হেরি দেব জীমূতবাহন
বজ্রপাণি, সহ কার্ত্তিকেয় মহারথী,
পাশী, তপনতনয়, মুরজা-বল্লভ
যক্ষরাজ, শীঘ্রগামী দেব-শিল্পী দেব
নিকটিয়া, করপুটে প্রণাম করিলা
যথা বিধি। দেখি বিশ্বকর্ম্মায় বাসব
মহোদয় আশীষিয়া কহিতে লাগিলা,—
“স্বাগত, হে দেব-শিল্পি! মরুভূমে যথা
তৃষাকুল জন সুখী সলিল পাইলে,
তব দরশনে আজি আনন্দ আমার
অসীম! স্বাগত, দেখ, শিল্পি-চূড়ামণি!
দৈববলে বলী দুই দানব, দুর্জ্জয়
সমরে, অমরপুরী গ্রাসিয়াছে আসি
হায়, গ্রাসে রাহু যথা সুধাংশু-মণ্ডলী।
ধাতার আদেশ এই শুন মহামতি।
‘আনি বিশ্বকর্ম্মায়, হে দেবগণ, গড়
বামায়, অঙ্গনাকুলে অতুলা জগতে।
ত্রিলোকে আছয়ে যত স্থাবর, জঙ্গম,
ভূত, সবা হইতে লইয়া তিল তিল,
সৃজ এক প্রমদারে—ভবপ্রমোদিনী।
তাহা হতে হবে নষ্ট দুষ্ট অমরারি’।”
শুনি দেবেন্দ্রের বাণী শিল্পীন্দ্র অমনি
নমিয়া দিক্‌পালদলে বসিলেন ধ্যানে;
নীরবে বেড়িলা দেবে যত দেবপতি।
আরম্ভিলা মহাতপঃ, মহামন্ত্রবলে

আকর্ষিলা স্থাবর, জঙ্গম, ভূত যত
ব্রহ্মপুরে শিল্পিবর! যাহারে স্মরিলা
পাইলা তখনি তারে। পদ্মদ্বয় লয়ে
গড়িলেন বিশ্বকর্ম্মা রাঙ্গা পা দুখানি।
বিদ্যুতের রেখা দেব লিখিলা তাহাতে
যেন লাক্ষারস-রাগ। বনস্থল-বধূ
রম্ভা উরুদেশে আসি করিল। বসতি;
সুমধ্যম মৃগরাজ দিল। নিজ মাঝা
খগোল নিতম্ব-বিম্ব; শোভিল তাহাতে
মেখলা, গগনে, মরি, ছায়াপথ যথা!
গড়িলেন বাহু-যুগ লইয়া মৃণালে।
দাড়িম্বে কদম্বে হৈল বিষম বিবাদ;
উভয়ে চাহিল আসি বাস করিবারে,
উরস-আনন্দ-বনে; সে বিবাদ দেখি
দেব-শিল্পী গড়িলেন মেরু-শৃঙ্গাকারে
কুচযুগ। তপোবলে শশাঙ্ক সুমতি
হইলা বদন দেব অকলঙ্ক ভাবে;
ধরিল কবরীরূপ কাদম্বিনী ধনী,
ইন্দ্রচাপে বানাইয়া মনোহর সিঁথি।
জ্বলে যে তারা-রতন ঊষার ললাটে,
তেজঃপুঞ্জ, দুইখান করিয়া তাহারে
গড়াইলা চক্ষুদ্বয়, যদিও হরিণী
রাখিলেক দেবপদে আনি নিজ আঁখি।
গড়িলা অধর দেব বিম্বফল দিয়া,
মাখিয়া অমৃতরসে; গজ-মুক্তাবলী
শোভিল রে দস্তরূপে বিশ্ব বিমোহিয়া!
আপনি রতি-রঞ্জন নিজ ধনু ধরি
ভুরুছলে বসাইলা নয়ন উপরে;
তা দেখিয়া বিশ্বকর্ম্মা হাসি কাড়ি নিলা
তুণ তাঁর; বাছি বাছি সে তূণ হইতে

খরতর ফুল-পর, নয়নে অর্পিলা
দেব-শিল্পী। বসুন্ধরা নানা রত্ন-সাজে
সাজাইলা বরবপু, পুষ্পলাবী যথা
সাজায় রাজেন্দ্রবালা কুসুমভূষণে।
চম্পক, পঙ্কজপর্ণ, সুবর্ণ চাহিল
দিতে বর্ণ বরাঙ্গনে; এ সবারে ত্যজি,—
হরিতালে শিল্পিবর রাগিলা সুতনু!
কলরবে মধুদূত কোকিল সাধিল
দিতে নিজ মধু-রব; কিন্তু বীণাপাণি,
আনি সঙ্গে রঙ্গে রাগ-রাগিণীর কুল,
রসনায় আসন পাতিলা বাগীশ্বরী!
অমৃত সঞ্চারি তবে দেব-শিল্পি-পতি
জীবাইলা কামিনীরে;—সুমোহিনী-বেশে
দাড়াইলা প্রভা যেন, আহা, মূর্ত্তিমতী!
হেরি অপরূপ কান্তি আনন্দ-সলিলে
ভাসিলেন শচীকান্ত; পবন অমনি,
প্রফুল্ল কমলে যেন পাইয়া, স্বনিলা
সুস্বনে! মোহিত কামে মুরজামোহন,
মনে মনে ধন-প্রাণ সঁপিলা বামারে!
শান্ত জলনাথ যেন শান্তি-সমাগমে!
মহাসুখী শিখিধ্বজ, শিখিবর যথা
হেরি তোরে, কাদম্বিনি, অনম্বরতলে!
তিমির-বিলাসী যম হাসিয়া উঠিলা,
কৌমুদিনী-প্রমদায় হেরি মেঘ যথা
শরদে! সাবাসি, ওহে দেব-শিল্পি গুণি।
ধাতাবরে, দেখবর, সাবাসি তোমারে!
হেন কালে,—বিধির অদ্ভুত লীলাখেলা
কে পারে বুঝিতে গো এ ব্রহ্মাণ্ড-মণ্ডলে!—
হেন কালে পুনর্ব্বার হৈল দৈববাণী;
“পাঠাও, হে দেবপতি, এ রমা বামারে,

(অনুপমা বামাকুলে)—যথা অমরারি
সুন্দ উপসুন্দাসুর; আদেশ অনঙ্গে
যাইতে এ বরাঙ্গনা সহ সঙ্গে মধু,
ঋতুরাজ। এ রূপের মাধুরী হেরিয়া
কাম-মদে মাতি দৈত্য মরিবে সংগ্রামে!
তিল তিল লইয়া গড়িলা সুন্দরীরে
দেব-শিল্পী, তেঁই নাম রাখ তিলোত্তমা।”—
শুনিয়া দেবেন্দ্রগণ আকাশ-সম্ভবা
সরস্বতী-ভারতী, নমিলা ভক্তিভাবে
সাষ্টাঙ্গে। তৎপরে সবে প্রশংসা করিয়া
বিদায় করিলা বিশ্বকর্মা শিল্পী-দেবে।
প্রণমি দিক্‌পাল-দলে বিশ্বকর্ম্মা দেব
চলি গেলা নিজ দেশে। সুখে শচীপতি
বাহিরিলা, সঙ্গে ধনী অতুলা জগতে,—
যথা সুরাসুর যবে অমৃত-বিলাসে
মথিলা সাগরজল, জলদলপতি
ভুবন-আনন্দময়ী ইন্দিরার সাথে!

ইতি প্রতিলোত্তমাসম্ভবে কাব্যে সম্ভবো নাম
তৃতীয় সর্গ।

.

[১] বসু-পূর্ণাগার—ধনপুর্ণাগার।
[২] মদন—বিভ্রমকারী।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন