মাইকেল মধুসূদন দত্ত
তিলোত্তমা সম্ভব।
(পুনর্লিখিত অংশ)
মধুসূদন “তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য আদ্যন্ত সংশোধিত করিবার…মানস করিয়াছিলেন; কিন্তু সময়াভাবে.. শেষ করিতে পারেন নাই, … কিয়দংশ মাত্র লিখিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন।” (‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি’ ১ম সংস্করণের “প্রকাশকদিগের বিজ্ঞাপন” পৃঃ ৷৴৹)। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র প্রথম সংস্করণের শেষ ভাগে “অসমাপ্ত কাব্যাবলি” শিরোনাম দিয়া “তিলোত্তমাসম্ভবে”র এই অংশ সংযোজিত হয়। সেখান হইতেই ইহা পুনর্মুদ্রিত হইল।
প্রথম সর্গ
ধবল নামেতে খ্যাত হিমাদ্রির শিরে
দেবাত্মা, ভীষণ-মূর্তি, অস্ত্র-ভেদী গিরি,
অটল, ধবল-কায়; ব্যোমকেশ যেন
উর্দ্ধ্ববাহু শুভ্র-বেশে, মজি চিরযোগে
যোগী-কুলে পূজ্য যোগী!—কি নিকুঞ্জ-রাজী,র
কি তরু, কি লতা, কিবা ফল-ফুলাবলী,
আর আর শৈল-শিরে শোভে যা, মুঞ্জরী
মরকত-ময় স্বর্ণ-কিরীটের রূপে;
না পরেন অচলেন্দ্র অবহেলি সবে,
বিমুখ ভবের সুখে ভব-ইন্দ্র যেন ১০
জিতেন্দ্রিয়! সুনাদিনী বিহঙ্গিনী যত,
বিহঙ্গম সু-নিনাদী, অলি মধু-লোভী,
কভু নাহি ভ্রমে তথা; সিংহ— বনরাজা,—
বন-লণ্ডভণ্ড-কারী গুপ্তধর করী,—
গণ্ডার, শার্দ্দুল, কপি,—বন-বাসী পশু—
সুলোচনা কুরঙ্গিণী, বন-কমলিনী,—
ফণিনী কুন্তলে মণি, ফণী বিষ-তরা,
না যায় নিকটে তাঁর—বিকট-শেখরী!
সতত, তিমিরময়, গভীর গহ্বরে,
কোলাহলে জল-দল মহা কোলাহলে,
ভোগবতী স্রোতস্বতী পাতালে যেমতি
কল্লোলিনী! বহে বায়ু ভৈরব আরবে,
মহা কোপে লয়-রূপে, পূর্ণ তমোগুণে,
নিশ্বাস ছাড়েন যেন সর্ব্ব-নাশ-কারী!
কি দানব, কি মানব, যক্ষ, রক্ষঃ বলী,
কি দানবী, কি মানবী, কিবা নিশাচরী,
সকলেরি অগম্য— দুর্গম দুর্গ যেন!
দিবা নিশি মেঘ-রাশি উড়ে চারি দিকে,
ভূতেশের সঙ্গে ভূত নাচে রঙ্গে যেন।
এহেন বিজন স্থানে দেব-কুল-পতি
বাসব বসিয়া কেন একাকী, তা কহ,
পঙ্কজ-বাসিনি দেবি, এ তব কিঙ্করে?
সুরাসুর সহ অহি অনন্ত, যে বলে
আনন্দে মন্দরে বাঁধি, সিন্ধুরে মথিলা
অমৃত-রসের আশে,—সেই বল-সম
যাচি কৃপা, কর দয়া আজি অকিঞ্চনে,
বাগ্দেবি! যতনে মথি বাক্যের সাগরে,
কবিতার সুধা যেন পাই তব বলে!
কর দয়া অভাজনে, বিশ্ব-বিমোহিনি!
অসীম মহিমা তব, হায়, দীন আমি,—
কিন্তু যে চন্দ্রের বাস চন্দ্রচূড়-চূড়ে,—
জননি, শিশির-বিন্দু ক্ষুদ্র ফুল-দলে
লভে না কি আভা কভু তাঁর শোভা হতে?
কোথা সে ত্রিদিব, যার ভোগ লভিবারে,
কঠোর তপস্যা নর করে যুগে যুগে,
কত শত নরপতি রত অশ্বমেধে,
সগর রাজার বংশ ধ্বংস, মা, যে লোভে?
কোথা সে অমরাবতী—পূর্ণ চির-সুখে?
কোথা বৈজয়ন্ত-ধাম, রত্নময়ী পুরী,
মলিন প্রভার যার প্রভাকর ভানু
কোথায় সে রাজ-ছত্র, রাজাসন কোথা,
রবি-পরিধির আভা মেরু-শৈলোপরি!
কোথায় নন্দন-বন, বসন্ত যে বনে
বিরাজেন নিত্য সুখে? পারিজাত কোথা,
অক্ষয়-লাবণ্য ফুল? ঋষি-মনোহরা
কোথা সে ঊর্ব্বশী, কহ? কোথা চিত্রলেখা,
জগত-জনের চিত্তে লেখা বিধুমুখী?
অলকা, তিলকা, রম্ভা, ভুবন-মোহিনী?
মিশ্রকেশী, যার চারু কেশ দিয়া গড়ি
নিগড়, বাঁধেন কাম স্বর্গ-বাসী জনে?
কোথায় কিন্নর, কোথা বিদ্যাধর যত?
গন্ধর্ব্ব, মদন-গর্ব্ব খর্ব্ব যার রূপে,—
গন্ধর্ব্ব-কুলের রাজা চিত্ররথ রথী,
কামিনীর মনোরথ, নিত্য অরি-দমী
দৈত্য-রণে? কোথা, মা, সে ভীষণ অশনি,
যার দ্রুত ইরম্মদে, গম্ভীর গর্জ্জনে,
দেব-কলেবর কাঁপে থর থর করি,
ভূধর অধীর ভয়ে, ভুবন চমকে
আতঙ্কে? কোথা সে ধনুঃ, ধনুঃ-কুল-মণি
আভাময়, যার চারু রত্ন-কান্তি-ছটা
নব নীরদের শিরে ধরে শোভা, যথা
শিখীর পুচ্ছের চূড়া রাখালের শিরে?
কোথায় পুষ্কর, কোথা আবর্ত্তক, দেবি,
ঘনেশ্বর? কোথা, কহ, সারথি মাতলি?
কোথা সে সুবর্ণ-রথ, মনোরথ-গতি,
যার স্থিরপ্রভা দেখি ক্ষণ-প্রভা লাজে
অস্থিরা, লুকায় মুখ, ক্ষণ দিয়া দেখা,
(কাদম্বিনী স্বজনীর গলা ধরি কাঁদি)
অম্বরে? কোথায় আজি ঐরাবত বলী,
গজেন্দ্র? কোথায় হয় উচ্চৈঃশ্রবা, কহ,
হয়েশ্বর, আশুগতি যথা আগুগতি?
কোথায় পৌলোমী সতী অনন্ত-যৌবনা,
দেবেন্দ্র-হৃদয়-সরে প্রফুল্ল নলিনী,
ত্রিদিব-লোচনানন্দ, আয়ত-লোচনা
রূপসী? কোথায় এবে স্বর্গ-কল্পতরু,
কামদা বিধাতা যথা; যে তরুর পদে
আনন্দে নন্দন-বনে দেবী মন্দাকিনী
বহেন, বিমল আভা, কল কল রবে?
কোথা মূর্ত্তিমান্ রাগ, ছত্রিশ রাগিণী
মূর্ত্তিমতী—নিত্য যারা সেবিত দেবেশে?
সে দেব-বিভব সব কোথা, কহ এবে,
কোথা সে দেব-মহিমা—দেবি বীণাপাণি?
দুরন্ত দানব-দ্বয়, দৈব-বলে বলী,
বিমুখি সমুখ রণে দেব দেব-রাজে,
পুরি দেবরাজ-পুরী ঘোর কোলাহলে,
লুটি দেবরাজ-পুর-বৈভব, বিনাশি
(দ্বেষ-বিষে জ্বলি) হায়, দেব-রাজ-পুরে
সে পুরের অলঙ্কার, অহঙ্কারে আজি
বসিয়াছে রাজাসনে দেব-রাজ-ধামে
পামর! যেমতি শ্বাস রুদ্রের, প্রলয়ে
বাতময়, উথলিলে জল-সমাকুলে,
প্রবল তরঙ্গ-দল, অবহেলি রোধে,
ধরার কবরী হতে ছিঁড়ি লয় কাড়ি
সুবর্ণ কুসুম-দাম; যে সুন্দর বপুঃ
আনন্দে মদন-সখা সাজান আপনি
দিয়া নানা ফুল-সাজ; সে সুন্দর বপুঃ
ফুল-সাজ-শূন্য বন্যা করে অনাদরে,—
গভীর হুঙ্কারে পশে রম্য বন-স্থলে!
দ্বাদশ বৎসর যুঝি দিতিজারি যত,
দুর্জ্জয় দিতিজ-ভুজ-প্রতাপে তাপিয়া
(হীন-বল দৈব-বলে) ভঙ্গ দিলা রণে
আতঙ্কে। দাবাগ্নি যথা, সঙ্গে সখা বায়ু,
হুহুঙ্কারে প্রবেশিলে গহন কাননে,
হেরি ভীম শিখা-পুঞ্জে ধূম-পুঞ্জ মাঝে,
চণ্ড মুণ্ড-মালিনীর লোল জিহ্বা যেন
(রক্ত-বীজ-কুল-কাল!) আক্ত রক্ত রসে;
পরমাদ গণি মনে পলায় কেশরী
মৃগেল; করীন্দ্র-বৃন্দ পলায় তরাসে
ঊর্দ্ধশ্বাস; মৃগাদন ধায় বায়ু-বেগে;
কুরঙ্গ সুশৃঙ্গধর, ভুজঙ্গ চৌদিকে
পলায়; পলায় শূন্যে বিহঙ্গম উড়ি;
পলায় মহিষ-দল, রোষে রাঙা আঁখি,
কোলাহলে পূরি দেশ ক্ষিতি টলমলি;
পলায় গণ্ডার, বন লণ্ডভণ্ড করি
পলায়নে; ধায় বাঘ; ধায় প্রাণ লয়ে
ভল্লুক বিকটাকার; আর পশু যত
বলবন্ত, কিন্তু ভয়ে বলশূন্য এবে;—
অব্যর্থ কুলিশে ব্যর্থ হেরি সে সমরে,
পলাইয়া পরিহরি সমর কুলিশী
পুরন্দর; পলাইলা জল-দল-পতি
পাশী, সর্ব্বনাশী পাশে হেরি (দৈব-বলে)
ম্রিয়মাণ, মহোরগ যেন মন্ত্র-তেজে!
পলাইলা ঝড়াকারে বায়ু-কুল-পতি;
পলাইলা শিখি-পৃষ্ঠে শিখিধ্বজ রথী
সেনানী; মহিষাসনে সর্ব্ব-অন্ত-কারী
কৃতান্ত, কৃতান্ত-দূতে হেরিলে যেমতি
সহসা, পলায় প্রাণী প্রাণ বাঁচাইতে!
পলাইলা গদাধারী অলকার পতি,
ব্যর্থ গদা হাতে, হায়, দুর্য্যোধন যথা
মিত্র ক্ষত্র-শূন্য দেখি কুরুক্ষেত্রে, গেলা
(বিষাদে নিশ্বাসি ঘন!) জলাশয় পানে,
একাকী, সহায়-হীন!—পলাইলা এবে
দেবগণ, রণভূমি ত্যজি অভিমানে;
পুরিল জগত দৈত্য জয় জয় নাদে,
বসিল দেবারি দুষ্ট দেব-রাজাসনে,
হর-কোপানল যেন, মদনে দহিয়া,
বিরহ-অনল-রূপে, ভৈরবে বেড়িল
রতির কোমল হিয়া, হায়, পোড়াইতে
সে হিয়া, কেন না রতি স্থাপি সে মন্দিরে
নিত্যানন্দ মদনের মুরতি, সুন্দরী
পূজেন আদরে, প্রেম-ফুলাঞ্জলি দিয়া!
সুন্দ উপসুন্দাসুর, দ্বন্দ্বি সুর সহ
লণ্ডভণ্ড করিল অখিল ভূমণ্ডলে।
ইত্যাদি—
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন