তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য – দ্বিতীয় সর্গ

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
দ্বিতীয় সর্গ

কোথা ব্রহ্মলোক? কোথা আমি মন্দমতি
অকিঞ্চন? যে দুর্ল্লভ লোক লভিবারে
যুগে যুগে যোগীন্দ্র করেন মহা যোগ,
কেমনে, মানব আমি, ভব-মায়াজালে
আবৃত, পিঞ্জরাবৃত বিহঙ্গ যেমতি,
যাইব সে মোক্ষধামে? ভেলায় চড়িয়া,
কে পারে হইতে পার অপার সাগর?
কিন্তু হে সারদে, দেবি বিশ্ববিনোদিনি,
তব বলে বলী যে, মা, কি অসাধ্য তার
এ জগতে? উর তবে, উর পদ্মালয়া
বীণাপাণি! কবির হৃদয়-পদ্মাসনে
অধিষ্ঠান কর উরি। কল্পনা-সুন্দরী—
হৈমবতী কিঙ্করী তোমার, শ্বেতভুজে,
আন সঙ্গে, শশিকলা কৌমুদী যেমতি।
এ দাসেরে বর যদি দেহ গো, বরদে,
তোমার প্রসাদে, মাতঃ, এ ভারতভূমি
শুনিবে, আনন্দার্ণবে ভাসি নিরবধি,
এ মম সঙ্গীতধ্বনি মধু হেন মানি!
উঠিল অম্বরপথে হৈম ব্যোমযান
মহাবেগে, ঐরাবত সহ সৌদামিনী
বহি পয়োবাহ যথা; রথ-চূড়া-শিরে
শোভিল দেব-পতাকা, বিদ্যুৎ আকৃতি,
কিন্তু শান্তপ্রভাময়; ধাইল চৌদিকে—
হেরি সে কেতুর কান্তি, ভ্রান্তি-মদে মাতি,
অচলা চপলা তারে ভাবি, দ্রুতগামী
জীমূত, গম্ভীরে গর্জ্জি, লভিবার আশে
সে সুরসুন্দরী,—যথা স্বয়ম্বরস্থলে,

রাজেন্দ্রমণ্ডল, স্বয়ম্বরা-রূপবতী-
রূপমাধুরীতে অতি মোহিত হইয়া,
বেড়ে তারে,—জরজর পঞ্চশর-শরে!
এইরূপে মেঘদল আইল ধাইয়া,
হেরি দূরে সে সুকেতু রতনের ভাতি;
কিন্তু দেখি দেবরথে দেবদম্পতীরে,
সিহরি অম্বরতলে সাষ্টাঙ্গে পড়িল
অমনি! চলিল রথ মেঘময় পথে—
আনন্দময়-মদন-স্যন্দন যেমনি
অপরাজিতা-কাননে চলে মধুকালে
মন্দগতি; কিম্বা যথা সেতু-বন্ধোপরে
কনক-পুষ্পক, বহি সীতা সীতানাথে!
এড়াইয়া মেঘমালা, মাতলি সারথি
চালাইলা দেবযান ভৈরব আরবে;
শুনি সে ভৈরবারব দিগ্বারণ যত—
ভীষণ মূরতিধর—রুষি হুঙ্কারিল
চারি দিকে; চমকিল জগত! বাসুকি
অস্থির হইলা ত্রাসে! চলিল বিমান;—
কত দূরে চন্দ্র-লোক অম্বরে শোভিল,
রজদ্বীপ নীলজলে। সে লোকে পুলকে
বসেন রতনাসনে কুমুদবাসন,
কামিনী-কুলের সখী যামিনীর সখা,
মদন রাজার বঁধু, দেব সুধানিধি
সুধাংশু। বরবর্ণিনী দক্ষের দুহিতা-
বৃন্দ বেড়ে চন্দ্রে যেন কুমুদের দাম
চির বিকচিত, পূরি আকাশ সৌরভে—
রূপের আভায় মোহি রজনীমোহনে।
হেম হর্ম্ম‍্যে—দিবানিশি যার চারি পাশে
ফেরে অগ্নিচক্ররাশি মহাভয়ঙ্কর—
বিরাজয়ে সুধা, যথা মেঘবর-কোলে

চপলা, বা অবরোধে যথা কুলবধূ —
ললিতা, ভুবনস্পৃহা, প্রফুল্ল-যৌবনা;
নারী-অরবিন্দ সহ ইন্দু মহামতি,
হেরি ত্রিদিবের ইন্দ্রে দূরে, প্রণমিলা
নম্রভাবে; যথা যবে প্রলয়-পবন
নিবিড় কাননে বহে, তরুকুলপতি
ব্রততী-সুন্দরীদল শাখাবলী সহ,
বন্দে নমাইয়া শির অজেয় মারুতে।
এড়াইয়া চন্দ্রলোকে, দেবরথ দ্রুতে
উতরিল বসে যথা রবির মণ্ডলী
গগনে। কনকময়, মনোহর পুরী,
তার চারি দিকে শোভে, মেখলা যেমতি
আলিঙ্গয়ে অঙ্গনার চারু কৃশোদরে
হরষে পসারি বাহু,—রাশিচক্র; তাহে
রাশি-রাশির আলয়। নগর মাঝারে
একচক্র রথে দেব বসেন ভাস্কর।
অরুণ, তরুণ সদা, নয়নরমণ
যেন মধু কাম-বঁধু,—যবে ঋতুপতি
বসন্ত, হিমান্তে, শুনি পিককুলধ্বনি,
হরষে তুষেন আসি কামিনী মহীরে,
কাতরা বিরহে তাঁর,—বসেছে সম্মুখে
সারথি। সুন্দরী ছায়া, মলিনবদনা,
নলিনীর সুখ দেখি দুঃখিনী কামিনী
বসেন পতির পাশে নয়ন মুদিয়া,—
সপত্নীর প্রভা নারী পারে কি সহিতে?
চারি দিকে গ্রহদল দাড়ায় সকলে
নতভাবে, নরপতি-সমীপে যেমতি
সচিব। অন্বরতলে তারাবৃন্দ যত—
ইন্দীবর-নিকর—অদুরে হাসি নাচে,
যথা, রে অমরাপুরি, কনক-নগরি,

নাচিত অপ্সরাকুল, যবে শচীপতি,
স্বরীশ্বর, শচী সহ দেবসভা-মাঝে,
বসিতেন হৈমাসনে! নাচে তারাবলী
বেড়ি দেব দিবাকরে, মৃদু মন্দপদে;
করে পুরস্কারেন হাসিয়া প্রভাকর
তা সবারে, রত্নদানে যথা মহীপতি
সুন্দরী কিঙ্করীদলে তোষে—তুষ্ট ভাবে!
হেরি দূরে দেবরাজে, গ্রহকুলরাজ
সসম্ভ্রমে প্রণাম করিলা মহামতি।—
এড়াইয়া সূর্যালোক চলিল বিমান।
এবে চন্দ্র সূর্য্য আর নক্ষত্রমণ্ডলী
—রজত কনক দ্বীপ অম্বর-সাগরে—
পশ্চাতে রাখিয়া সবে, হৈম ব্যোমযান
উতরিল যথা শত দিবাকর জিনি,
প্রভা—স্বয়ম্ভুর পাদপদ্মে স্থান যাঁর—
উজ্জ্বলেন দেশ ধনী প্রকৃতিরূপিণী,
রূপে মোহি অনাদি অনন্ত সনাতনে!
প্রভা—শক্তিকুলেশ্বরী, যাঁর সেবা করি,
তিমিরারি বিভাবসু তোষেন স্বকরে
শশী তারা গ্রহাবলী, বারিদ যেমতি
অম্বুনিধি সেবি সদা, তোষে বসুধারে
তৃষাতুরা, আর তোষে চাতকিনী-দলে
জলদানে। ইন্দ্রপ্রিয়া পৌলোমী রূপসী—
পীনপয়োধরা—হেরি কারণ-কিরণে,
সভয়ে চারুহাসিনী নয়ন মুদিলা,
কুমুদিনী, বিধুপ্রিয়া, তপন উদিলে
মুদয়ে নয়ন যথা। দেব পুরন্দর
অসুরারি, তুলি রোষে দম্ভোলি যে করে
বৃত্রাসুরে অনায়াসে নাশেন সংগ্রামে,
সেই কর দিয়া এবে প্রভার বিভাসে

চমকি ঢাকিলা আঁখি! রথ-চূড়া-শিরে
মলিনিল দেবকেতু, ধূমকেতু যেন
দিবাভাগে; যান-মুখে বিস্ময়ে মাতলি
সূতেশ্বর অন্ধভাবে রশ্মি দিলা ছাড়ি
হীনবল; মহাতঙ্কে তুরঙ্গম-দল
মন্দগতি, যথা বহে প্রতীপ গমনে
প্রবাহ। আইল এবে রথ ব্রহ্মলোকে।
মেরু,—কনক-মৃণাল কারণ-সলিলে;
তাহে শোভে ব্রহ্মলোক কনক-উৎপল;
তথা বিরাজেন ধাতা—পদতল যাঁর
মুমুক্ষু কুলের ধ্যেয়—মহামোক্ষধাম।
অদূরে হেরিলা এবে দেবেন্দ্র বাসব
কাঞ্চন-তোরণ, রাজ-তোরণ-আকার,
আভাময়; তাহে জ্বলে আদিত্য আকৃতি,
প্রতাপে আদিত্যে জিনি, রতননিকর।
নর-চক্ষু কভু নাহি হেরিয়াছে যাহা,
কেমনে নররসনা বর্ণিবে তাহারে—
অতুল ভব-মণ্ডলে? তোরণ-সম্মুখে
দেখিলা দেবদম্পতী দেবসৈন্য-দল,—
সমুদ্র-তরঙ্গ যথা, যবে জলনিধি
উথলেন কোলাহলি পবন-মিলনে
বীরদর্পে; কিম্বা যথা সাগরের তীরে
বালিবৃন্দ, কিম্বা যথা গগনমণ্ডলে
নক্ষত্র-চয়—অগণ্য। রথ কোটি কোটি
স্বর্ণচক্র, অগ্নিময়, রিপুভস্মকারী,
বিদ্যুত-গঠিত-ধ্বজ-মণ্ডিত; তুরগ—
বিরাজেন সদাগতি যার পদতলে
সদা, শুভ্র-কলেবর, হিমানী-আবৃত
গিরি যথা, স্কন্ধে কেশরাবলীর শোভা—
ক্ষীরসিন্ধু-ফেনা যেন—অতি মনোহর।

হস্তী, মেঘাকার সবে,—যে সকল মেঘ,
সৃষ্টি বিনাশিতে যবে আদেশেন ধাতা,
আখগুল পাঠান ভাসাতে ভূমণ্ডলে
প্রলয়ে; যে মেঘবৃন্দ মন্দ্রিলে অম্বরে,
শৈলের পাষাণ-হিয়া ফাটে মহা ভয়ে,
বসুধা কাঁপিয়া যান সাগরের তলে
তরাসে! অমরকুল—গন্ধর্ব্ব, কিন্নর,
যক্ষ, রক্ষ, মহাবলী, নানা অস্ত্রধারী—
বারণারি ভীষণ দশনে, বজ্র-নখে
শস্ত্রিত যেমতি, কিম্বা নাগারি গরুড়,
গরুত্মন্ত-কুলপতি! হেন সৈন্যদল,
অজেয় জগতে, আজি দানবের রণে
বিমুখ, আশ্রয় আসি লভিয়াছে সবে
ব্রহ্ম-লোকে, যথা যবে প্রলয়-প্লাবন
গভীর গরজি গ্রাসে নগর নগরী
অকালে, নগরবাসী জনগণ যত
নিরাশ্রয়, মহাত্রাসে পালায় সত্বরে
যথায় শৈলেন্দ্র বীরবর ধীর-ভাবে
বজ্রপদপ্রহরণে তরঙ্গ নিচয়
বিমুখয়ে; কিম্বা যথা, দিবা অবসানে,
(মহতের সাথে যদি নীচের তুলনা
পারি দিতে) তমঃ যবে গ্রাসে বহুধারে,
(রাহু যেন চাঁদেরে) বিহগকুল ভয়ে
পূরিয়া গগন ঘন কূজন-নিনাদে,
আসে তরুবর পাশে আশ্রমের আশে!
এ হেন দুর্ব্বার সেনা, যার কেতুপরি
জয় বিরাজয়ে সদা, খগেন্দ্র যেমতি
বিশ্বম্ভর-ধ্বজে, হেরি ভগ্ন দৈত্যরণে,
হায়, শোকাকুল এবে দেবকুলপতি
অসুরারি! মহৎ যে পরদুঃখে দুঃখী,

নিজ দুঃখে কভু নহে কাতর সে জন।
কুলিশ চূর্ণিলে শৃঙ্গ, শৃঙ্গধর সহে
সে যাতনা, ক্ষণমাত্র অস্থির হইয়া;
কিন্তু যবে কেশরীর প্রচণ্ড আঘাতে
ব্যথিত বারণ আসি কাঁদে উচ্চস্বরে
পড়ি গিরিবর-পদে, গিরিবর কাঁদে
তার সহ! মহাশোকে শোকাকুল রথী
দেবনাথ, ইন্দ্রাণীর করযুগ ধরি,
(সোহাগে মরাল যথা ধরে রে কমলে!)
কহিলা দুমৃদু স্বরে;—“হায়, প্রাণেশ্বরি,
বিধির অদ্ভুত বিধি দেখি বুক ফাটে!
শৃগাল-সমরে, দেখ, বিমুখ কেশরী-
বৃন্দ, সুরেশ্বরি, ওই তোরণ-সমীপে
ম্রিয়মাণ অভিমানে। হায়, দেব-কুলে
কে না চাহে ত্যজিবারে কলেবর আজি,
যাইতে, শমন, তোর তিমির-ভবনে,
পাসরিতে এ গঞ্জনা? ধিক্, শত ধিক্‌
এ দেব-মহিমা! অমরতা, ধিক্ তোরে।
হায়, বিধি, কোন্ পাপে মোর প্রতি তুমি
এ হেন দারুণ! পুনঃ পুনঃ এ যাতনা
কেন গো ভোগাও দাসে? হায়, এ জগতে
ত্রিদিবের নাথ ইন্দু, তার সম আজি
কে অনাথ? কিন্তু নহি নিজ দুঃখে দুঃখী।
সৃজন পালন লয় তোমার ইচ্ছায়;
তুমি গড়, তুমি ভাঙ, বজায় রাখহ
তুমি; কিন্তু এই যে অগণ্য দেবগণ,
এ সবার দুঃখ, দেব, দেখি প্রাণ কাঁদে।
তপন-তাপেতে তাপি পশু পক্ষী, যদি
বিশ্রাম-বিলাস-আশে, যায় তরু-পাশে,
দিনকর খরতর-কর সহ্য করি

আপনি সে মহীরুহ, আশ্রিত যে প্রাণী,
ঘুচায় তাহার ক্লেশ;—হায় রে, দেবেন্দ্র
আমি, স্বর্গপতি, মোর রক্ষিত যে জন,
রক্ষিতে তাহারে মম না হয় ক্ষমতা?”
এতেক কহিয়া দেব দেবকুলপতি
নামিলেন রথ হতে সহ সুরেশ্বরী
শূন্যমার্গে। আহা মরি, গগন, পরশি
পৌলোমীর পাদপদ্ম, হাসিল হরষে!
চলিলা দেব-দম্পতী নীলাম্বর-পথে।
হেথা দেবসৈন্য, হেরি দেবেশ বাসবে,
অমনি উঠিলা সবে করি জয়ধ্বনি
উল্লাসে, বারণ-বৃন্দ আনন্দে যেমতি
হেরি যূথনাথে। লয়ে গন্ধর্ব্বের দল—
গন্ধর্ব্ব, মদনগর্ব্ব খর্ব্ব যার রূপে—
গন্ধর্ব্বকুলের পতি চিত্ররথ রথী
বেড়িলা মেঘবাহনে, অগ্নি-চক্ররাশি
বেড়ে যথা অমৃত, বা সুবর্ণ-প্রাচীর
দেবালয়; নিষ্কোষিয়া অগ্নিময় অসি,
ধরি বাম করে চন্দ্রাকার হৈম ঢাল,
অভেদ্য সমরে, দ্রুত বেড়িলা বাসবে
বীরবৃন্দ। দেবেন্দ্রের উচ্চ শিরোপরি
ভাতিল,—রবিপরিধি উদিলেক যেন
মেরু-শৃঙ্গোপরি,—মণিময় রাজছাতা,
বিস্তারি কিরণজাল; চতুরঙ্গ দলে
রঙ্গে বাজে রণবাদ্য, যাহার নিক্বণে—
পবন উথলে যথা সাগরের বারি—
উথলে বীর-হৃদয়, সাহস-অর্ণব।
আইলেন কৃতান্ত, ভীষণ দণ্ড হাতে;
ভালে জ্বলে কোপাগ্নি, ভৈরব-ভালে যথা
বৈশ্বানর, যবে, হায়, কুলগ্নে মদন

ঘুচাইয়া রতির মৃণাল-ভুঞ্জ-পাশ,
আসি, যথা মগ্ন তপঃসাগরে ভূতেশ,
বিঁধিলা (অবোধ কাম!) মহেশের হিয়া
ফুলশরে। আইলেন বরুণ দুর্জ্জয়,
পাশ হস্তে জলেশ্বর, রাগে আঁখি রাঙা—
তড়িত-জড়িত ভীমাকৃতি মেঘ যেন।
আইলা অলকাপতি সাপটিয়া ধরি
গদাবর; আইলেন হৈমবতী-সুত,
তারকসূদন দেব শিখীবরাসন,
ধনুর্ব্বাণ হাতে দেব-সেনানী; আইলা
পবন সর্ব্বদমন;—আর কব কত?
অগণ্য দেবতাগণ বেড়িলা বাসবে,
যথা (নীচ সহ যদি মহতের খাটে
তুলনা) নিদ্রাস্বজনী নিশীথিনী যবে,
সুচারুতারা মহিষী, আসি দেন দেখা,
মৃদুগতি, খদ্যোতের ব্যূহ প্রতিসরে
ঘেরে তরুবরে, রত্ন-কিরীট পরিয়া
শিরে,—উজলিয়া দেশ বিমল কিরণে!
কহিতে লাগিলা তবে দেব পুরন্দর;—
“সহস্রেক বৎসর এ চতুরঙ্গ দল
দুর্ব্বার, দানব সঙ্গে ঘোরতর রণে
নিরন্তর যুঝি, এবে নিরস্ত সমরে
দৈববলে। দৈববল বিনা, হায়, কেবা
এ জগতে তোমা সবা পারে পরাজিতে,
অজেয়, অমর, বীরকুলশ্রেষ্ঠ? বিনা
অনন্ত, কে ক্ষম, যম, সর্ব্ব-অস্তকারি,
বিমুখিতে এ দিক্‌পালগণে তোমা সহ
বিগ্রহে? কেমনে এবে এ দুর্জ্জয় রিপু—
বিধির প্রসাদে দুষ্ট দুর্জ্জয়,—কেমনে
বিনাশিবে, বিবেচনা কর, দেবদল?

যে বিধির বরে বসি দেবরাজাসনে
আমি ইন্দ্র, মোর প্রতি প্রতিকূল তিনি,
না জানি কি দোষে, এবে! হায়, এ কাম্মু ক
বুথা আজি ধরি আমি এই বাম করে;
এ ভীষণ বজ্র আজি নিস্তেজ পাবক!”
শুনি দেবেন্দ্রের বাণী, কহিতে লাগিলা
অন্তক, গম্ভীর স্বরে গরজে যেমতি
মেঘকুলপতি কোপে, কিম্বা বারণারি,
বিদরি মহীর বক্ষ তীক্ষ্ণ বজ্র-নখে—
রোষী;—“না বুঝিতে পারি, দেবপতি, আমি
বিধির এ লীলা? যুগে যুগে পিতামহ
এইরূপে বিড়ম্বেন অমরের কুল;
বাড়ান দানবদর্প, শৃগালের হাতে
সিংহেরে দিয়া লাঞ্ছনা। তুষ্ট তিনি তপে;—
যে তাঁহারে ভক্তিভাবে ভজে, তার তিনি
বশীভূত; আমরা দিক্‌পালগণ যত
সতত রত স্বকার্য্যে,—লালনে পালনে
এ ভব-মণ্ডল, তাঁরে পূজিতে অক্ষম
যথাবিধি! অতএব যদি আজ্ঞা কর,
ত্রিদিবের পতি, এই দণ্ডে দণ্ডাঘাতে
নাশি এ জগৎ, চূর্ণ করি বিশ্ব, ফেলি
স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল—অতল জলতলে।
পরে এড়াইয়া সবে সংসারের দায়,
যোগধর্ম্ম অবলম্বি, নিশ্চিন্ত হইয়া
তুষিব চতুরাননে, দৈত্যকুলে ভুলি,
তুলি এ দুঃখ, এ সুখ। কে পারে সহিতে—
হায় রে, কহ, দেবেন্দ্র, হেন অপমান?
এই মতে সৃষ্টি যদি পালিতে ধাতার
ইচ্ছা, তবে বৃথা কেন আমা সবা দিয়া
মথাইলা সাগর? অমৃত-পানে মোরা

অমর; কিন্তু এ অমরতার কি ফল
এই? হায়, নীলকণ্ঠ, কিসের লাগিয়া
ধর হলাহল, দেব, নীল কণ্ঠদেশে?
জ্বলুক জগত! ভস্ম কর বিশ্ব! ফেল
উগরিয়া সে বিষাগ্নি! কার সাধ হেন
আজি, যে সে ধরে প্রাণ এ অমরকূলে?”
এতেক কহিয়া দেব সর্ব্ব-অন্তকারী
কৃতান্ত হইলা ক্ষান্ত; রাগে চক্ষুদ্বয়
লোহিত-বরণ, রাঙা জবাযুগ যেন!
তবে সর্ব্বদমন পবন মহাবলী
কহিতে লাগিলা, যথা পর্ব্বত-গহ্বরে
হুহুঙ্কারে কারাবদ্ধ বারি, বিদরিয়া
অচলের কর্ণ; “যাহা কহিলা শমন,
অযথার্থ নহে কিছু। নিদারুণ বিধি
আমা সবা প্রতি বাম অকারণে সদা।
নাশিতে এ সৃষ্টি, প্রলয়ের কালে যথা
নাশেন আপনি ধাতা, বিধি মম। কেন?—
কেন, হে ত্রিদশগণ, কিসের কারণে
সহিব এ অপমান আমরা সকলে
অমর? দিতিজ-কুল প্রতি যদি এত
স্নেহ পিতামহের, নূতন সৃষ্টি সৃজি,
দান তিনি করুন পরম ভক্তদলে।
এ সৃষ্টি, এ স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল—আলয়
সৌন্দর্য্যের, রত্নাগার, মুখের সদন,—
এত দিন বাহুবলে রক্ষা করি এবে
দিব কি দানবে? গরুড়ের উচ্চ নীড়
মেঘাবৃত,—খঞ্জন গঞ্জন মাত্র তার।
দেহ আজ্ঞা, দেবেশ্বর; দাড়াইয়া হেথা—
এ ব্রহ্ম-মণ্ডলে—দেখ সবে, মুহূর্ত্তেকে,
নিমিষে নাশি এ সৃষ্টি, বিপুল, সুন্দর,

বাহুবলে,—ত্রিজগৎ লণ্ডভণ্ড করি।”
কহিতে কহিতে ভীমাকৃতি প্রভঞ্জন
নিশ্বাস ছাড়িলা রোষে। থর থর থরে
(ধাতার কনক-পদ্ম-আসন যে স্থলে,
সে স্থল ব্যতীত) বিশ্ব কাঁপিয়া উঠিল!
ভাঙ্গিল পর্ব্বতচূড়া; ডুবিল সাগরে
তরী; ডরে মৃগরাজ, গিরিগুহা ছাড়ি,
পলাইলা দ্রুতবেগে; গর্ভিণী রমণী
আতঙ্কে অকালে, মরি, প্রসবি মরিলা!
তবে ষড়ানন স্কন্দ, আহা, অনুপম
রূপে! হৈমবতী সতী কৃত্তিকা যাঁহারে
পালিলা, সরসী যথা রাজহংস-শিশু,
আদরে; অমরকুল-সেনানী সুরথী,.
তারকারি, রণদণ্ডে প্রচণ্ড-প্রহারী,
কিন্তু ধীর, মলয় সমীর যেন, যবে
স্বর্ণবর্ণা ঊষা সহ ভ্রমেন মারুত
শিশিরমণ্ডিত ফুলবনে প্রেমামোদে;—
উত্তর করিলা তবে শিখীবরাসন
মৃদু স্বরে, যথা বাজে মুরারির বাঁশী,
গোপিনীর মন হরি, মঞ্জু কুঞ্জবনে;—
“জয় পরাজয় রণে বিধির ইচ্ছায়।
তবে যদি যথাসাধ্য যুদ্ধ করি, রথী
রিপুর সম্মুখে হয় বিমুখ সুমতি
রণক্ষেত্রে, কি শরম তার? দৈববলে
বলী যে অরি, সে যেন অভেদ্য কবজে
ভূষিত; শতসহস্র তীক্ষ্ণতর শর
পড়ে তার দেহে, পড়ে শৈলদেহে যথা
বরিষার জলাসার। আমরা সকলে
প্রাণপণে যুঝি আজি সমরে বিরত,
এ নিমিত্তে কে ধিক্কার দিবে আমা সবে?

বিধির নির্ব্বন্ধ, কহ, কে পারে খণ্ডাতে?
অতএব শুন, যম, শুন সদাগতি,
দুর্জ্জয় সমরে দোঁহে, শুন মোর বাণী,
দূর কর মনস্তাপ। তবে কহ যদি,
বিধির এ বিধি কেন? কেন প্রতিকূল
আমা সবা প্রতি হেন দেব পিতামহ?
কি কহিব আমি—দেবকুলের কনিষ্ঠ
সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় যাঁহার ইচ্ছাক্রমে;
অনাদি, অনন্ত যিনি, বোধাগম্য, রীতি
তাঁর যে, সেই সুরীতি। কিসের কারণে,
কেন হেন করেন চতুরানন, কহ,
কে পারে বুঝিতে? রাজা, যাহা ইচ্ছা, করে;
প্রজার কি উচিত বিবাদ রাজা সহ?”
এতেক কহিয়া দেব স্কন্দ তারকারি
নীরবিলা। অগ্রসরি অম্বুরাশি-পতি
(বীর-কম্বু নাদে যথা) উত্তর করিলা;—
“সম্বর, অম্বরচর, বৃথা রোষ আজি!
দেখ বিবেচনা করি, সত্য যা কহিলা
কার্ত্তিকেয় মহারথী। আমরা সকলে
বিধাতার পদাশ্রিত, অধীন তাঁহারি;
অধীন যে জন, কহ, স্বাধীনতা কোথা
সে জনের? দাস সদা প্রভু-আজ্ঞাকারী।
দানব-দমন আজ্ঞা আমা সবা প্রতি;
দানব দমনে এবে অক্ষম আমরা;—
চল যাই ধাতার সমীপে, দেবগণ।
সাগর-আদেশে সদা তরঙ্গ-নিকর
ভীষণ নিনাদে ধায়, সংহারিতে বলে
শিলাময় রোধঃ; কিন্তু তার প্রতিঘাতে
ফাঁফর, সাগর-পাশে যায় তারা ফিরি
হীনবল! চল মোরা যাই, দেবপতি,

যথা পদ্মযোনি পদ্মাসন পিতামহ।
এ বিপুল বিশ্ব নাশে, সাধ্য কার হেন,
তিনি বিনা? হে অন্তক বীরবর, তুমি
সর্ব্ব-অন্তকারী, কিন্তু বিধির বিধানে।
এই যে প্রচণ্ড দণ্ড শোভে তব করে,
দণ্ডধর, যাহার প্রহারে ক্ষয় সদা
অমর অক্ষয়দেহ, চূর্ণ নগরাজা,
এ দণ্ডের প্রহরণ, বিধি আদেশিলে,
বাজে দেহে,—সুকোমল ফুলাঘাত যেন,—
কামিনী হানয়ে যবে মৃদু মন্দ হাসি
প্রিয়দেহে প্রণয়িনী, প্রণয়-কৌতুকে,
ফুলশর! তুমি, দেব, ভীম প্রভঞ্জন,
ভগ্ন তরুকুল যার ভীষণ নিশ্বাসে,
তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গ, বলী বিরিঞ্চির বলে
তুমি, জলস্রোতঃ যথা পর্ব্বত-প্রসাদে।
অতএব দেখ সবে করি বিবেচনা,
দেবদল। বাড়বাগ্নি-সদৃশ জ্বলিছে
কোপানল মোর মনে! এ ঘোর সংগ্রামে
ক্ষত এ শরীর, দেখ, দৈত্য-গ্রহরণে,
দেবেশ, কিন্তু কি করি? এ ভৈরব পাশ,
ম্রিয়মাণ—মন্ত্রবলে মহোরগ যেন।”
তবে অলকার নাথ, এ বিশ্ব যাঁহার
রত্নাগার, উত্তরিলা যক্ষদলপতি;—
“নাশিতে ধাতার সৃষ্টি, যেমন কহিলা
প্রচেতা, কাহার সাধ্য? তবে যদি থাকে
এ হেন শকতি কারো, কেমনে সে জন,
দেব কি মানব, পারে এ কর্ম্ম করিতে
নিষ্ঠুর? কঠিন হিয়া হেন কার আছে?
কে পারে নাশিতে তোরে, জগৎজননি
বসুধে, রে ঋতুকুলরমণি, যাহার

প্রেমে সদা মত্ত ভানু, ইন্দু—ইন্দীবর
গগনের! তারা দল যার সখী-দল!
সাগর যাহারে বাঁধে রজভুজ-পাশে!
সোহাগে বাসুকি নিজ শত শিরোপরি
বসায়! রে অনন্তে, রে মেদিনি কামিনি,
শ্যামাঙ্গি, অলক যার ভূষিতে উল্লাসে
সৃজেন সতত ধাতা ফুলরত্নাবলী
বহুবিধ! আলিঙ্গয়ে ভূধর যাহারে
দিবানিশি! কে আছয়ে, হে দিক্‌পালগণ,
এ হেন নির্দ্দয়? রাহু শশী গ্রাসিবারে
ব্যগ্র সদা দুষ্ট, কিন্তু রাহু,—সে দানব।
আমরা দেবতা,—এ কি আমাদের কাজ?
কে ফেলে অমূল মণি সাগরের জলে
চোরে ডরি? যদি প্রিয়জন যে, সে জনে
গ্রাসে রোগ, কাটারীর ধারে গলা কাটি
প্রণয়ী-হৃদয় কি গো নীরোগে তাহারে?
আর কি কহিব আমি, দেখ ভাবি সবে।
যদিও মতের সহ মতের বিগ্রহে
(শুষ্ক কাষ্ঠ সহ শুষ্ক কাষ্ঠের ঘর্ষণে
যেমনি) জনমে অগ্নি, সত্যদেবী যাহে
জ্বালান প্রদীপ ভ্রান্তি-তিমির নাশিতে;
কিন্তু বৃথা-বাক্যবৃক্ষে কভু নাহি ফলে
সমুচিত ফল; এ তো অজানিত নহে।
অতএব চল সবে যাই যথা ধাতা
পিতামহ। কি আজ্ঞা তোমার, দেবপতি?”
কহিতে লাগিলা পুনঃ সুরেন্দ্র বাসব
অসুরারি;—“পালিতে এ বিপুল জগত
সৃজন, হে দেবগণ, আমাসবাকার।
অতএব কেমনে যে রক্ষক, সে জন
হইবে ভক্ষক? যথা ধর্ম্ম জয় তথা।

অন্যায় করিতে যদি আরম্ভি আমরা,
সুরাসুরে বিভেদ কি থাকিবেক, কহ,
জগতে? দিতিজবৃন্দ অধর্ম্মেতে রত;
কেমনে, আমরা যত অদিতিনন্দন,
অমর, ত্রিদিব-বাসী, তার সুখভোগী,
আচরিব, নিশাচর আচরে যেমতি
পাপাচার? চল সবে ব্রহ্মার সদনে—
নির্বোদ চরণে তাঁর এ ঘোর বিপদ!
হে কৃতান্ত দণ্ডধর, সর্ব্ব-অন্তকারি,—
হে সর্ব্বদমন বায়ুকুলপতি, রণে
অজেয়,—হে তারকসূদন ধনুর্দ্ধারি
শিখিধ্বজ,—হে বরুণ, রিপু-ভস্মকর
শরানলে,হ—ে কুবের, অলকার নাথ,
পুষ্পকবাহন দেব, ভীম গদাধর,
ধনেশ,—আইস সবে যথা পদ্মযোনি
পদ্মাসনে বসেন অনাদি সনাতন।
এ মহা-সঙ্কটে, কহ, কে আর রক্ষিবে
তিনি বিনা ত্রিভুবনে এ সুর-সমাজে
তাহারি রক্ষিত? চল বিরিঞ্চির কাছে!”
এতেক কহিয়া দেব ত্রিদিবের পতি
বাসব, স্মরিলা চিত্ররথে মহারথী।
অগ্রসরি করযোড়ে নমিলা দেবেশে
চিত্ররথ; আশীর্ব্বাদি কহিলা সুমতি
বজ্রপাণি, “এ দিকপালগণ সহ আমি
প্রবেশিব ব্রহ্মপুরে; রক্ষা কর, রথি,
দেবকুলাঙ্গনা যত দেবেশ্বরী সহ।”
বিদায় মাগিয়া পুরন্দর সুরপতি
শচীর নিকটে, সহ ভীম প্রভঞ্জন,
শমন, তপনসুত, তিমিরবিলাসী,
ষড়ানন তারকারি, দুর্জ্জয় প্রচেতা,

ধনদ অলকানাথ, প্রবেশ করিলা
ব্রহ্মপুরে—মোক্ষধাম, জগত-বাঞ্ছিত।
তবে চিত্ররথ রথী গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর
মহাবলী, দেবদত্ত শঙ্খ ধরি করে,
ধ্বনিলা সে শঙ্খবর। সে গভীর ধ্বনি
শুনিয়া অমনি তেজস্বিনী দেবসেনা
অগণ্য, দুর্ব্বার রণে, গরজি উঠিলা
চারি দিকে। লক্ষ লক্ষ অসি, নাগরাশি
উদ্গারি পাবক যেন, ভাতিল আকাশে!
উড়িল পতাকাচয়, হায় রে, যেমতি
রতনে রঞ্জিত-অঙ্গ বিহঙ্গম-দল!
উঠি রথে রথী দর্পে ধনু টঙ্কারিলা
চাপে পরাইয়া গুণ; ধরি গদা করে
করিপৃষ্ঠে চড়ে কেহ, কেশরী যেমতি
চড়ে তুঙ্গ-গিরি-শৃঙ্গে; কেহ আরোহিলা,
(গরুড়-বাহনে যথা দেব চক্রপাণি)
অশ্ব, সদাগতি সদা বাঁধা যার পদে!
শূল হস্তে, যেন শূলী ভীষণ নাশক,
পদাতিক-বৃন্দ উঠে হুহুঙ্কার করি,
মাতি বীরমদে শুনি সে শঙ্খনিনাদ!
বাজিল গম্ভীরে বাদ্য, যাব ঘোর রোল
শুনি নাচে বীর-হিয়া, ডমরুর রোলে
নাচে যথা ফণিবর—দূরন্ত দংশক—
বিষাকর; ভীরু প্রাণ বিদরে অমনি
মহাভয়ে! সুর-সৈন্য সাজিল নিমিষে,
দানব-বংশের ত্রাস, রক্ষা করিবারে
স্বর্গের ঈশ্বরী দেবী পৌলোমী সুন্দরী,
আর যত স্বরনারী; যথা ঘোর বনে
মহা মহীরুহব্যূহ, বিস্তারিয়া বাহু
অযুত, রক্ষয়ে সবে ব্রততীর কুল,

অলকে ঝলকে যার কুসুম-রতন
অমূল জগতে, রাজ-ইন্দ্রাণী-বাঞ্ছিত।
যথা সপ্ত সিন্ধু বেড়ে সতী বসুধারে,
জগৎজননী, ত্রিদিবের সৈন্যদল
বেড়িলা ত্রিদিবদেবী অনন্ত-যৌবনা
শচীরে, সাপটি করে চন্দ্রাকার ঢাল,
অসি, অগ্নিশিখা যেন;—শত প্রতিসরে
বেড়িলা সুচন্দ্রাননে চতুস্কন্ধ দল।
তবে চিত্ররথ রথী, সৃজি মায়াবলে
কনক-সিংহ-আসন, অতুল, অমূল,
জগতে, যুড়িয়া কর, কহিলা প্রণমি
পৌলোমীরে, “এ আসনে বসুন মহিষী,
দেবকুলেশ্বরী; যথা সাধ্য, আমি দাস,
দেবেন্দ্র-অভাবে, রক্ষা করিব তোমারে।”
বসিলা কনকাসনে বাসব-বাসনা
মৃগাক্ষী। হায় রে মরি, হেরি ও বদন
মলিন, কাহার হিয়া না বিদরে আজি?
কার রে না কাঁদে প্রাণ, শরদের শশি,
হেরি তোরে রাহুগ্রাসে? তোরে, রে নলিনি,
বিষণ্ণবদনা, যবে কুমুদিনী-সখী
নিশি আসি, ভানুপ্রিয়ে, নাশে সুখ তোর!
হেরি ইন্দ্রাণীরে যত সুচারুহাসিনী
দেবকামিনী সুন্দরী, আসি উতরিলা
মৃদুগতি! আইলেন ষষ্ঠী মহাদেবী—
বঙ্গকূলবধূ যাঁরে পুঞ্জে মহাদরে,
মঙ্গলদায়িনী; আইলেন মা শীতলা,
দুরন্ত বসন্ততাপে তাপিত শরীর
শীতল প্রসাদে যাঁর—মহাদয়াময়ী
ধাত্রী; আইলেন দেবী মনসা, প্রতাপে
যাঁহার ফণীন্দ্র ভীত ফণিকুল সহ,

পাবক নিস্তেজ যথা বারি-ধারা-বলে;
আইলেন সুচনী—মধুর-ভাষিণী;
আইলেন যক্ষেশ্বরী মুরজা সুন্দরী,
কুঞ্জরগামিনী; আইলেন কামবধু
রতি হায়! কেমনে বর্ণিব অল্পমতি
আমি ও রূপমাধুরী,—ও স্থির যৌবন,
যার মধুপানে মত্ত স্মর মধুসখা
নিরবধি? আইলেন সেনা সুলোচনা,
সেনানীর প্রণয়িনী—রূপবতী সতী!
আইলা জাহ্নবী দেবী—ভীষ্মের জননী;
কালিন্দী আনন্দময়ী, যাঁর চারু কূলে
রাধাপ্রেম-ডোরে-বাঁধা রাধানাথ, সদা
ভ্রমেন, মরাল যথা নলিনীকাননে!
আইলা মুরলা সহ তমসা বিমলা—
বৈদেহীর সখী দোঁহে;—আর কব কত?
অগণ্য সুরসুন্দরী, ক্ষণপ্রভা-সম
প্রভায়, সতত কিন্তু অচপলা যেন
রত্নকান্তিছটা, আসি বসিলা চৌদিকে;
যথা তারাবলী বসে নীলাম্বরতলে
শশী সহ, ভরি ভব কাঞ্চন বিভাসে!
বসিলেন দেবীকুল শচীদেবী সহ
রতন-আসনে; হায়, নীরব গো আজি
বিষাদে! আইলা এবে বিদ্যাধরী-দল।
আইলা উর্ব্বসী দেবী,—ত্রিদিবের শোভা,
ভব-ললাটের শোভা শশিকলা যথা
আভাময়ী। কেমনে বর্ণির রূপ তব,
হে ললনে, বাসবের প্রহরণ তুমি
অব্যর্থ! আইলা চারু চিত্রলেখা সখী,
বিশালাক্ষী যথা লক্ষ্মী—মাধব-রমণী।
আইলেন মিশ্রকেশী,—যাঁর কেশ, তব,

হে মদন, নাগপাশ—অন্ধের জগতে!
আইলেন রম্ভা,—যাঁর উরুর বর্ত্তুল
প্রতিকৃতি ধরি, বনবধূ বিধুমুখী
কদলীর নাম রম্ভা, বিদিত ভুবনে।
আইলেন অলম্বুষা,—মহা লজ্জাবতী
যথা লতা লজ্জাবতী, কিন্তু (কে না জানে?)
অপাঙ্গে গরল,—বিশ্ব দহে গো যাহাতে!
আইলেন মেনকা; হে গাধির নন্দন
অভিমানি, যার প্রেমরস-বরিষণে
নিবারিলা পুরন্দর তপ-অগ্নি তব,
নিবারয়ে মেঘ যথা আসার বরষি
দাবানল। শত শত আসিয়া অপ্সরী,
নতভাবে ইন্দ্রাণীরে নমি দাঁড়াইলা
চারি দিকে; যথা যবে,—হায় রে স্মরিলে
ফাটে বুক!—ত্যজি ব্রজ ব্রজকুলপতি
অক্রূরের সহ চলি গেলা মধুপুরে,—
শোকিনী গোপিনীদল, যমুনা-পুলিনে,
বেড়িল নীরবে সবে রাধা বিলাপিনী॥

ইতি প্রতিলোত্তমাসম্ভবে কাব্যে ব্রহ্মপুরী-তোরণ নাম
দ্বিতীয় সর্গ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন