তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য – চতুর্থ সর্গ

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
চতুর্থ সর্গ

সুবর্ণ বিহঙ্গী যথা, আঙ্গরে বিস্তারি
পাখা,—শত্রু-ধনু-কান্তি আভায় যাহার
মলিন,—যতনে ধনী শিখায় শাবকে
উড়িতে, হে জগদম্বে, অম্বর-প্রদেশে;—
দাসেরে করিয়া সঙ্গে রঙ্গে আজি তুমি
ভ্রমিয়াছ নানা স্থানে; কাতর সে এবে,
কুলায়ে লয়ে তাহারে চল, গো জননি!
সফল জনম মম ও পদ-প্রাসাদে,
দয়াময়ি! যথা কুন্তী-নন্দন-পৌরব,
ধীর যুধিষ্ঠির, সশরীরে মহাবলী
ধর্ম্মবলে প্রবেশিলা স্বর্গ, তব বরে
দীন আমি দেখিনু, মানব-আঁখি কভু
নাহি দেখিয়াছে যাহা; শুনিনু ভারতী,
তব বীণা-ধ্বনি বিনা অতুলা জগতে!
চল ফিরে যাই যথা কুসুম-কুন্তলা
বসুধা। কল্পনা,—তব হেমাঙ্গী সঙ্গিনী,
দান করিয়াছে যারে তোমার আদেশে
দিব্য-চক্ষু, ভুল না, হে কমল-বাসিনি,
রসিতে রসনা তার তব সুধা-রসে!
বরষি সঙ্গীতামৃত মনীষী তুষিবে,
এই ভিক্ষা করে দাস, এই দীক্ষা মাগে
যদি গুণগ্রাহী যে, নিদাঘ-রূপ ধরি,
আশার মুকুল নাশে এ চিত্তকাননে,
সেও ভাল; অধমে, মা, অধমের গতি!—
ধিক্‌ সে যাচ্‌ঞা,—ফলবতী নীচ কাছে!
মহানন্দে মহেন্দ্র সসৈন্যে মহামতি
উত্তরিলা যথা বসে বিন্ধ্য গিরিবর

কামরূপী,—হে অগস্ত্য, তব অনুরোধে
অ্যাপি অচল! শত শত শৃঙ্গ শিরে,
বীর বীরভদ্র-শিরে জটাজূট যথা
বিকট; অশেষ দেহ শেষের যেমনি!
দ্রুতগতি শূন্যপথে দেবরথ, রথী,
মাতঙ্গ, তুরঙ্গ, যত চতুরঙ্গ-দল
আইলা, কঞ্চুক তেজঃপুঞ্জে উজ্জ্বলিয়া
চারি দিক্‌! কাম্য নামে নিবিড় কানন—
খাণ্ডব-সম, (পাণ্ডব ফাল্গুনির গুণে
দহি হবির্ব্বহ যাহে নীরোগী হইলা)—
সে কাননে দেবসেনা প্রবেশিলা বলে
প্রবল। আতঙ্কে পশু, বিহঙ্গম আদি
আশু পলাইল সবে ঘোরতর রবে,
যেন দাবানল আসি, গ্রাসিবার আশে
বনরাজী, প্রবেশিল সে গহন বনে!—
কাতারে কাতারে সেনা প্রবেশিল আসি
অরণ্যে, উপাড়ি তরু, উপাড়ি ব্রততী,
ঝড় যথা, কিম্বা করিযূথ, মত্ত মদে।
অধীর সত্রাসে ধীর বিদ্ধ্য মহীধর,
শীঘ্র আসি শচীকান্ত-নমুচিসূদন-
পদতলে নিবেদিল। কৃতাঞ্জলিপুটে—
“কি কারণে, দেবরাজ, কোন্ অপরাধে
অপরাধী তব পদে কিঙ্কর? কেমনে
এ অসহ ভার, প্রভু, সহিবে এ দাস?
পাঞ্চজন্য-নিনাদক প্রবঞ্চি বলিরে
বামনরূপে যেরূপ, হায়, পাঠাইল।
অতল পাতালে তারে, সেই রূপ বুঝি
ইচ্ছা তব, সুরনাথ, মজাইতে দাসে
রসাতলে!” উত্তরিলা হাসি দেবপতি
অসুরারি;—“যাও, বিন্ধ্য, চলি নিজ স্থানে

অভয়ে; কি অপকার তোমার সম্ভবে
মোর হাতে? ভূজবলে নাশিয়া দিতিজে
আজি, উপকার, গিরি, তোমায় করিব,
আপনি হইব মুক্ত বিপদ্ হইতে;—
তেঁই হে আইনু মোরা তোমার সদনে।”
হেন মতে বিদাইয়া বিন্ধ্য মহাচলে,
দেব-সৈন্য-পানে চাহি কহিলা গম্ভীরে
বাসব; “হে সুরদল, ত্রিদিব-নিবাসি,
অমর! হে দিতিসুত-গর্ব্ব-খর্ব্বকারি।
বিধির নির্ব্বন্ধে, হায়, নিরানন্দ আজি
তোমা সবে! রণ-স্থলে বিমুখ যে রথী,
কত যে ব্যথিত সে তা কে পারে বর্ণিতে?
কিন্তু দুঃখ দূর এবে কর, বীরগণ!
পুনরায় জয় আসি আশু বিরাজিবে
এ দেব-কেতনোপরে। ঘোরতর রণে
অবশ্য হইবে ক্ষয় দৈত্যচয় আজি।
দিয়াছি মদনে আমি, বিধির প্রসাদে,
যে শর,—কে সম্বরিবে সে অব্যর্থ শরে?
লয়ে তিলোত্তমায়—অতুলা ধনী রূপে—
ঋতুপতি সহ রতিপতি সর্ব্ব-জয়ী
গেছে চলি যথায় নিবাসে দেব-অরি
দানব! থাকহ সবে সুসজ্জ হইয়া।
সুন্দ উপসুন্দ যবে পড়িবে সমরে,
অমনি পশিব মোবা সবে দৈত্যদেশে
বায়ুগতি, পশে যথা মদকল করী
নলবনে, নলদলে দলি পদতলে।”
শুনি সুরেন্দ্রের বাণী, সুরসৈন্য যত
হুহুঙ্কারি নিষ্কোষিলা অগ্নিময় অসি
অযুত, আগ্নেয় তেজে পূরি বনরাজী!
উচ্চারিলা ধনু ধনুর্দ্ধর-দল বলী

রোষে; লোফে শূল শূলী,—হায়, ব্যগ্র সবে
মারিতে মরিতে রণে—যা থাকে কপালে!
ঘোর রবে গরজিলা গজ; হয়ব্যূহ
মিশাইলা হেষারব সে রবের সহ!
শুনি সে ভীষণ স্বন দনুজ দুর্ম্মতি
হীনবীর্য হয়ে ভয়ে প্রমাদ গণিল
অমরারি, যথা শুনি খগেন্দ্রের ধ্বনি,
ম্রিয়মাণ নাগকুল অতল পাতালে!
হেন কালে আচম্বিতে আসি উত্তরিলা
কাম্যবনে নারদ, দীদিবি রবি যেন
দ্বিতীয়। হরষে বন্দি দেব-ঋষিবরে,
কহিলেন হাসি ইন্দ্র—দেবকুলপতি—
“কি কারণে এ নিবিড় কাননে নারদ
তপোধন, আগমন তোমার গো আজি?
দেখ চারি দিকে, দেব, নিরীক্ষণ করি
ক্ষণকাল; খরতর-করবাল-আভা,
হবির্বহ নহে যাহে উজ্জ্বল এ স্থলী;—
নহে যজ্ঞধূম ও,—ফলক সারি সারি
সুবর্ণমণ্ডিত,—অগ্নিশিখাময় যেন
ধূমপুঞ্জ, কিম্বা মেঘ,—তড়িত-জড়িত!”
আশীষি দেবেশে, হাসি দেব-ঋষিবর
নারদ, উত্তরছলে কহিলা কৌতুকে;—
“তোমা সম, শচীপতি, কে আছে গো আজি
তাপস? যে কাল-অগ্নি জালি চারি দিকে
বসিয়াছ তপে, দেব, দেখি কাঁপি আমি
চিরতপোবনবাসী! অবশ্য পাইবে
মনোনীত বর তুমি; রিপুদ্বয় তব
ক্ষয় আজি, সহস্রাক্ষ, কহিমু তোমারে।”
সুধিলা সুরসেনানী সুমধুর স্বরে
অগ্রসরি;— “কপা করি কহ, মুনিবর,

ভ্রাতৃভেদ ভিন্ন অন্য পথ কি কারণে
রুদ্ধ শমনের পক্ষে নাশিতে দানব-
দল-ইন্দ্র সুন্দ উপসুন্দ মন্দমতি!
যে দম্ভোলি তুলি করে, নাশিলা সমরে
বৃত্রাসুরে সুরপতি; যে শরে তারকে
সংহারিনু রণে আমি;—কিসের কারণে
নিরস্ত সে সব অস্ত্র এ দোঁহার কাছে?
কার বরবলে, প্রভু, বলী দিতি-সুত?”
উত্তর করিলা তবে দেবর্ষি নারদ;—
“ভকত-বৎসল যিনি, তাঁর বলে বলী
দৈত্যদ্বয়। শুন দেব, অপূর্ব্ব কাহিনী।
হিরণ্যকশিপু দৈত্য, যাহারে নাশিলা
চক্রপাণি নরসিংহ-রূপে, তার কুলে
জন্মিল নিকুম্ভ নামে সুরপুররিপু,
কিন্তু, বজ্রি, তব বজ্র-ভয়ে সদা ভীত
যথা গরুত্মান্ শৈল। তার পুত্ত্র দোঁহে
সুন্দ উপসুন্দ—এবে ভুবন-বিজয়ী,
এই বিন্ধ্যাচলে আসি ভাই দুই জন
করিল কঠোর তপঃ ধাতার উদ্দেশে
বহুকাল। তপে তুষ্ট সদা পিতামহ;
“বর মাগ” বলি আসি দরশন দিলা।
যথা সরঃসুপ্তপদ্ম রবি দরশনে
প্রফুল্লিত, বিরিঞ্চিরে হেরি দৈত্যদ্বয়
করযোড়ে মৃতস্বরে কহিতে লাগিল;—
“হে ধাতঃ, হে বরদ, অমর কর, দেব,
আমা দোঁহে! তব বর-সুধাপান করি,
মৃত্যুঞ্জয় হব, প্রভু, এই ভিক্ষা মাগি।”
হাসি কহিলেন তবে দেব সনাতন
অজ,—“জন্মে মৃত্যু, দৈত্য! দিবস রজনী—
এক যায় আর আসে, সৃষ্টির বিধান।

অন্য বর মাগ, বীর, যাহা দিতে পারি।”
“তবে যদি,”—উত্তর করিল দৈত্যদ্বয়—
“তবে যদি অমর না কর, পিতামহ,
আমা দোঁহে, দেহ ভিক্ষা, তব বরে যেন
ভ্রাতৃভেদ ভিন্ন অন্য কারণে না মরি।”
“ওম্” বলি বর দিলা কমল-আসন।
একপ্রাণ দুই ভাই চলিল স্বদেশে
মহানন্দে। যে যেখানে আছিল দানব,
মিলিল আসিয়া সবে এ দোঁহার সাথে,
পর্ব্বত-সদন ছাড়ি যথা নদ যবে
বাহিরায় হুহুঙ্কারি সিন্ধু-অভিমুখে
বীরদর্পে, শত শত জল-স্রোত আসি
মিশি তার সহ, বীর্য্য বৃদ্ধি তার করে।—
এইরূপে মহাবলী নিকুম্ভ-নন্দন-
যুগ, বাহু-পরাক্রমে লভিয়াছে এবে
স্বর্গ; কিন্তু ত্বরা নষ্ট হবে দুষ্টমতি।”
এতেক কহিয়া তবে দেবর্ষি নারদ
আশীষিয়া দেবদলে, বিদায় মাগিয়া,
চলি গেলা ব্রহ্মপুরে ধাতার সদনে।
কাম্যবনে সৈন্য সহ দেবেন্দ্র রহিলা,
যথা সিংহ, হেরি দূরে বারণ-ঈশ্বরে,
নিবিড় কানন মাঝে পশি সাবধানে,
একদৃষ্টে চাহে বীর ব্যগ্রচিত্ত হয়ে
তার পানে। এই মতে রহিলেন যত
দেববৃন্দ কাম্যবনে বিন্ধ্যের কন্দরে।
হেথা মীনধ্বজ সহ মীনধ্বজ রথে,
বসন্ত-সারথি—রঙ্গে চলিলা সুন্দরী
দেবকুল-আশালতা। অতি-মন্দগতি,
চলিল বিমান শপথে, যথা ভাসে
স্বর্ণবর্ণ মেঘবর, অম্বর-সাগরে

যবে অস্তাচল-চূড়া উপরে দাঁড়ায়ে
কমলিনী পানে ফিরে চাহেন ভাস্কর
কমলিনী-সখা। যথা সে ঘনের সনে
সৌদামিনী, মীনধ্বজে তেমনি বিরাজে
অনুপমা রূপে বামা—ভুবন-মোহিনী।
যথায় অচলদেশে দেব-উপবনে
কেলি করে সুন্দ উপসুন্দ মহাবলী
অমরারি, তিন জন তথায় চলিলা।
হেরি কামকেতু দূরে, বসুধা সুন্দরী,
আইলা বসন্ত জানি, কুসুম-রতনে
সাজিলা; সুবৃক্ষশাখে সুখে পিকদল
আরম্ভিল কলস্বরে মদন-কীর্তন।
মুঞ্জরিল কুঞ্জবন, গুঞ্জরিল অলি
চারি দিকে; স্বনস্বনে মন্দ-সমীরণ,
ফুলকুল-উপহার সৌরভ লইয়া,
আসি সম্ভাষিল সুখে ঋতুবংশ-রাজে।
“হে সুন্দরি”—মৃদু হাসি মদন কহিলা—
“ভীরু, উম্মীলিয়া আঁখি, নলিনী যেমনি
নিশা অবসানে মিলে কমল-নয়ন—
চেয়ে দেখ চারি দিকে; তব আগমনে
সুখে বসন্তের সখী বসুন্ধরা সতী
নানা আভরণে সাজি হাসেন কামিনী,
নববধূ বরিবারে কুলনারী যথা।
ত্যজি রথ চল এবে—এই দৈত্যবন।
যাও চলি, সুহাসিনি, অভয় হৃদয়ে।
অন্তরীক্ষে রক্ষা হেতু ঋতুরাজ সহ
থাকিব তোমার সঙ্গে; রঙ্গে যাও চলি,
যথায় বিরাজে দৈত্যদ্বয়, মধুমতি।”
প্রবেশিলা কুঞ্জবনে কুঞ্জর-গামিনী
তিলোত্তমা, প্রবেশয়ে বাসরে যেমতি

শরমে, ভয়ে কাতরা নবকুল-বধূ
লজ্জাশীলা। মৃদুগতি চলিলা সুন্দরী
মুহুর্মুহু: চাহি চারি দিকে, চাহে যথা
অজানিত ফুলবনে কুরঙ্গিণী; কভু
চমকে রমণী শুনি নূপুরের ধ্বনি;
কভু মরমর পাতাকুলের মর্ম্মরে;
মলয়-নিশ্বাসে কভু; হায় রে, কভু বা
কোকিলের কুহুরবে! গুঞ্জরিলে অলি
মধু-লোভী, কাঁপে বামা, কমলিনী যথা
পবন-হিল্লোলে! এইরূপে একাকিনী
ভ্রমিতে লাগিলা ধনী গহন কাননে।
সিহরিলা বিন্ধ্যাচল ও পদ-পরশে,
সম্মোহন-বাণাঘাতে যোগীন্দ্র যেমতি
চন্দ্রচূড়! বনদেবী—যথায় বসিয়া
বিরলে, গাঁথিতেছিলা ফুল-রত্ন-মালা,
(বরগুঞ্জমালা যথা গাঁথে ব্রজাঙ্গনা
দোলাইতে কুঞ্জবিহারীয় বরগলে)—
হেরি সুন্দরীরে, ত্বরা অলকান্ত তুলি,
রহিলেন একদৃষ্টে চাহি তার পানে
তথায়, বিস্ময় সাক্ষী মানি মনে মনে।
বনদেব—তপস্বী—মুদিলা আঁখি, যথা
হেরি সৌদামিনী ঘনপ্রিয়ায় গগনে
দিনমণি। মৃগরাজ কেশরী সুন্দর
নিজ পৃষ্ঠাসন বীর সঁপিলা প্রণমি—
যেন জগদ্ধাত্রী আ্যাশক্তি মহামায়ে!
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দূতী—অতুলা জগতে
রূপে—উতরিলা যথা বনরাজী মাঝে
শোতে সর, নভস্তল বিমল যেমতি।
কলকল স্বরে জল নিরন্তর ঝরি
পর্ব্বত-বিবর হতে, সৃজে সে বিরলে

জলাশয়। চারি দিকে শ্যাম তট তার
শত-রঞ্জিত কুসুমে। উজ্জ্বল দর্পণ
বনদেবীর সে সর—খচিত রতনে!
হাসে তাহে কমলিনী, দর্পণে যেমনি
বনদেবীর বদন! মৃদু মন্দ রবে
পবন-হিল্লোলে বারি উছলিছে কূলে।
এই সরোবর-তীরে আসি সীমন্তিনী
(ক্লান্তা এবে) বসিলা বিরামলাভ-লোভে,
রূপের আভায় আলো করি সে কানন।
ক্ষণকাল বসি বামা চাহি সর পানে
আপন প্রতিমা হেরি—ভ্রান্তি-মদে মাতি,
একদৃষ্টে তার দিকে চাহিতে লাগিলা
বিবশে! “এ হেন রূপ”—কহিলা রূপসী
মৃদু স্বরে—“কারো আঁখি দেখেছে কি কভু?
ব্রহ্মপুরে দেখিয়াছি আমি দেবপতি
বাসব; দেবসেনানী; আর দেব যত
বীরশ্রেষ্ঠ; দেখিয়াছি ইন্দ্রাণী সুন্দরী;
দেব-কুল-নারী-কুল; বিদ্যাধরী-দলে;
কিন্তু কার তুলনা এ ললনার সহ
সাজে? ইচ্ছা করে, মরি, কায় মন দিয়া
কিঙ্করী হইয়া ওঁর সেবি পা দুখানি!
বুঝি এ বনের দেবী,—মোরে দয়া করি
দয়াময়ী—জল-তলে দরশন দিলা।”
এতেক কহিয়া ধনী অমনি উঠিয়া
নমাইলা শির—যেন পূজার বিধানে,
প্রতিমূর্ত্তি প্রতি; সেও শির নমাইল!
বিস্ময় মানিরা বামা কৃতাঞ্জলিপুটে
মৃদু স্বরে সুধিলা—“কে তুমি, হে রমণি?”
আচম্বিতে “কে তুমি? কে তুমি, হে রমণি—
হে রমণি?” এই ধ্বনি বাজিল কাননে!

মহা ভয়ে ভীতা দূতী চমকি চাহিলা
চারি দিকে। হেন কালে হাসি সকৌতুকে,
মধু সহ রতি-বঁধু আসি দেখা দিলা।
“কাহারে ডরাও তুমি, ভুবন-মোহিনি?”
(কহিলেন পুষ্পধনু) “এই দেখ আমি
বসন্ত-সামন্ত সহ আছি, সীমন্তিনি,
তব কাছে। দেখিছ যে বামা-মূর্ত্তি জলে,
তোমারি প্রতিমা, ধনি; ওই মধুধ্বনি,
তব ধ্বনি প্রতিধ্বনি শিখি নিনাদিছে!
ও রূপ-মাধুরী হেরি, নারী তুমি যদি
বিবশা এত, রূপসি, ভেবে দেখ মনে
পুরুষকুলের দশা! যাও ত্বরা করি;—
অদূরে পাইবে এবে দেবারি দানবে!”
ধীরে ধীরে পুনঃ ধনী মরালগামিনী
চলিলা কানন-পথে। কত স্বর্ণ-লতা
সাধিল ধরিয়া, আহা, রাঙা পা দুখানি,
থাকিতে তাদের সাথে; কত মহীরুহ,
মোহিত মদন-মদে, দিলা পুষ্পাঞ্জলি;
কত যে মিনতি স্তুতি করিল। কোকিল
কপোতীর সহ; কত গুণ্ গুণ্ করি
আরাধিল অলি-দল, কে পারে কহিতে?
আপনি ছায়া সুন্দরী—ভানুবিলাসিনী—
তরুমূলে, ফুল ফল ডালায় সাজায়ে,
দাঁড়াইলা—সখীভাবে বরিতে বামারে;
নীরবে চলিলা সাথে সাথে প্রতিধ্বনি;
কলরবে প্রবাহিণী—পর্ব্বত-দুহিতা—
সম্বোধিলা চন্দ্রাননে; বনচর যত
নাচিল হেরিয়া দূরে বন-শোভিনীরে,
যথা, রে দণ্ডক, তোর নিবিড় কাননে,
(কত যে তপস্যা তোর কে পারে বুঝিতে?)

হেরি বৈদেহীরে—রঘুরঞ্জন-রঞ্জিনী!
সাহসে সুরভি বায়ু, ত্যজি কুবলয়ে,
মুহুর্মুহুঃ অলকান্ত উড়াইয়া কামী
চুম্বিলা বদন-শশী! তা দেখি কৌতুকে
অন্তরীক্ষে মধু সহ মদন হাসিলা!—
এইরূপে ধীরে ধীরে চলিলা রূপসী।
আনন্দ-সাগরে মগ্ন দিতিসুত আজি
মহাবলী। দৈববলে দলি দেব-দলে—
বিমুখি অমরনাথে সম্মুখ-সমরে,
ভ্রমিতেছে দেববনে দৈত্যকুলপতি।
কে পারে আঁটিতে দোঁহে এ তিন ভুবনে?
লক্ষ লক্ষ রথ, রথী, পদাতিক, গল্প,
অশ্ব; শত শত নারী—বিশ্ব-বিনোদিনী,
সঙ্গে রঙ্গে করে কেলি নিকুম্ভ-নন্দন
জয়ী। কোন স্থলে নাচে বীণা বাজাইয়া
তরুমূলে বামাকুল, ব্রজবালা যথা
শুনি মুরলীয় ধ্বনি কদম্বের মূলে।
কোথায় গাইছে কেহ মধুর সুস্বরে।
কোথায় বা চর্ব্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় রসে
ভাসে কেহ। কোথায় বা বীরমদে মাতি,
মল্ল সহ যুঝে মল্ল ক্ষিতি টলমলি।
বারণে বারণে রণ—মহা ভয়ঙ্কর,
কোন স্থলে। গিরিচূড়া কোথায় উপড়ি,
হুহুঙ্কারি নভস্তলে দানব উড়িছে
ঝড়ময়, উথলিয়া অম্বর-সাগর—
যথা উপলয়ে সিন্ধু দ্বন্দ্বি তিমিঙ্গিল
মীনরাজ—কোলাহলে পুরিয়া গগন।
কোথায় বা কেহ পশি বিমল সলিলে,
প্রমদা সহিত কেলি করে নানা মতে
উম্মদ মদন-শরে। কেহ বা কুটীরে

কমল-আসনে বসে প্রাণসখী লয়ে,
অলঙ্কারি কর্ণমূল কুবলয়-দলে।
রাশি রাশি অসি শোভে, দিবাকর-করে
উদগীরি পাবক যেন। ঢাল সারি সারি—
যথা মেঘপুঞ্জ—ঢাকে সে নিকুঞ্জবন।
ধমু, তূণ অগণ্য; ত্রিশূলাকার শূল
সর্ব্বভেদী। তা সবার নিকটে বসিয়া
কথোপকথনে রত যোধ শত শত।
যে যারে সমরক্ষেত্রে প্রচণ্ড আঘাতে
বিমুখিল, তার কথা কহে সেই জন।
কেহ কহে—সেনানীর কাটিনু কবন্ধ;
কেহ কহে—মারি গদা ভীম যমরাজে
খেদাইনু; কেহ কহে—ঐরাবত-শুঁড়ে
চোক্‌ চোক্‌ হানি শর অস্থিরিনু তারে!
কেহ বা দেখায় দেব-আভরণ; কেহ
দেব-অস্ত্র; দেব-বস্ত্র আর কোন জন।
কেহ দুষ্ট তুষ্ট হয়ে পরে নিজ শিরে
দেবরথী-শিরচূড়।—এইরূপে এবে
বিহরয়ে দৈত্য-দল—বিজয়ী সমরে।
হে বিভো, জগতযোনি, দয়াসিন্ধু তুমি;
তেঁই ভবিতব্যে, দেব, রাখ গো গোপনে।
কনক-আসনে বসে নিকুম্ভ-নন্দন
সুন্দ উপসুন্দাসুর। শিরোপরি শোভে
দেবরাজ-ছত্র, তেজে আদিত্য-আকৃতি।
বীতিহোত্র-মূর্ত্তি বীর বেড়ে শত শত
দৈত্যদ্বয়ে, ঝক্‌মকি বীর-আভরণে,
বীর-বীর্য্যে পূর্ণ সরে, কালকূটে যথা
মহোরগ! বসে দোঁহে কনক-আসনে
পারিজাত-মালা গলে, অনুপম রূপে,
হায় রে, দেবেন্দ্র যথা দেবকুল-মাঝে!

চারি দিকে শত শত দৈত্য-কুল-পতি
নানা উপহার সহ দাড়ায় বিনত-
ভাবে, সুপ্রসন্ন মুখে প্রশংসি দুজনে,
দৈত্য-কুল-অবতংস। দূরে নৃত্য-করী
নাচে, নাচে তারাবলী যথা নভস্তলে
স্বর্ণময়ী। বন্দে বন্দী মহানন্দ মনে,
“জয়, জয়, অমরারি, যার ভুজ-বলে
পরাজিত আদিতেয় দিতিসুত-রিপু
বজ্রী! জয়, জয়, বীর, বীর-চূড়ামণি,
দানব-কুল-শেখর! যার প্রহরণে,
করী যথা কেশরীর প্রচণ্ড আঘাতে
ত্যজি বন যায় দূরে,—স্বরীশ্বর আজি,
ত্যজি স্বর, বিশ্বধামে ভ্রমিছে একাকী
অনাথ! হে দৈত্য-কুল, উজ্জ্বল গো এবে
তুমি! হে দানব-বালা, হে দানব-বধূ,
কর গো মঙ্গল-ধ্বনি দানব-ভবনে!
হে মহি, হে মহীতল, তুমিও, হে দিব,
আনন্দ-সাগরে আজি মজ, ত্রিভুবন!
বাজাও মৃদঙ্গ রঙ্গে, বীণা, সপ্তস্বরা—
দুন্দুভি, দামামা, শৃঙ্গ, ভেরী, তূরী, বাঁশী,
শঙ্খ, ঘণ্টা, ঝাঁঝরী। বরিষ ফুল-ধারা!
কস্তুরী, চন্দন আন, কেশর, কুমকুম!
কে না জানে দেব-বংশ পর-হিংসাকারী?
না জানে দুষ্টমতি ইন্দ্র সুরপতি
অসুরারি? নাচ সবে তার পরাভবে,
মড়ক ছাড়িলে পুরী পৌরজন যথা।”
মহানন্দে সুন্দ উপসুন্দাসুর বলী
অমরারি, তুষি যত দৈত্যকুলেশ্বরে
মধুর সম্ভাষে, এবে, সিংহাসন ত্যজি,
উঠিলা,—কুসুমবনে ভ্রমণ প্রয়াসে,

একপ্রাণ দুই ভাই—বাগর্থ যেমতি!
“হে দানব,” আরম্ভিলা নিকুম্ভ-কুমার
সুন্দ,—“বীরদলশ্রেষ্ঠ, অমরমর্দ্দন,
যার বাহু-পরাক্রমে লভিয়াছি আমি
ত্রিদিব-বিভব; শুন, হে সুরারি রথী-
ব্যূহ, যার যাহা ইচ্ছা, সেই তাহা কর।
চিরবাদী রিপু এবে জিনিয়া বিবাদে
ঘোরতর পরিশ্রমে, আরাম সাধনে
মন রত কর সবে।” উল্লাসে দমুজ,
শুনি দনুজেন্দ্র-বাণী, অমনি নাদিল।
সে ভৈরব-রবে ভীত আকাশ-সম্ভবা
প্রতিধ্বনি পলাইলা রড়ে; মূর্ছা পায়ে
খেচর, ভূচর সহ, পড়িল ভূতলে
থরথরি গিরিবর বিন্ধ‍্য মহামতি
কাঁপিলা, কাঁপিলা ভয়ে বসুধা সুন্দরী।
দূর কাম্যবনে যথা বসেন বাসব,
শুনি সে ঘোর ঘর্বর, ত্রস্ত হয়ে সবে,
নীরবে এ ওঁর পানে লাগিলা চাহিতে।
চারি দিকে দৈত্যদল চলিলা কৌতুকে,
যথা শিল্পীমুখ-বৃন্দ, ছাড়ি মধুমতী
পুরী, উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আনন্দে গুঞ্জরি
মধুকালে, মধুভূষা তুষিতে কুসুমে।
মঞ্জু কুঞ্জে বামাব্রজরঞ্জন দুজন
ভ্রমিলা, অশ্বিনী-পুত্র-যুগ সম রূপে
অনুপম; কিম্বা যথা পঞ্চবটী-বনে
রাম রামানুজ,—যবে মোহিনী রাক্ষসী
সূর্পণখা হেরি দোঁহে, মাতিল মদনে!
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দৈত্য আসি উত্তরিলা
যথায় ফুলের মাঝে বসি একাকিনী
তিলোত্তমা। সুন্দ পানে চাহিয়া সহসা

কহে উপসুন্দাসুর,—“কি আশ্চর্য, দেখ—
দেখ, ভাই, পূর্ণ আজি অপূর্ব্ব সৌরভে
বনরাজী! বসন্ত কি আবার আইল?
আইস দেখি কোন্ ফুল ফুটি আমোদিছে
কানন?” উত্তরে হাসি সুন্দাসুর বলী,—
“রাজ-সুখে সুখী প্রজা; তুমি আমি, রথি,
সসাগরা বসুধারে দেবালয় সহ
ভূজবলে জিনি, রাজা; আমাদের সুখে
কেন না সুখিনী হবে বনরাজী আজি?”
এইরূপে দুই জন ভ্রমিলা কৌতুকে,
না জানি কালরূপিণী ভুজঙ্গিনী রূপে
ফুটিছে বনে সে ফুল, যার পরিমলে
মত্ত এবে দুই ভাই, হায় রে, যেমতি
বকুলের বাসে অলি মত্ত মধুলোভে!
বিরাজিছে ফুলকুল-মাঝে একাকিনী
দেবদূতী, ফুলকূল-ইন্দ্রাণী যেমতি
নলিনী! কমল-করে আদরে রূপসী
ধরে যে কুসুম, তার কমনীয় শোভা
বাড়ে শতগুণ, যথা রবির কিরণে
মণি-আভা! একাকিনী বসিয়া ভাবিনী,
হেন কালে উত্তরিলা দৈত্যদ্বয় তথা।
চমকিলা বিধুমুখী দেখিয়া সম্মুখে
দৈত্যদ্বয়ে, যথা যবে ভোজরাজবালা
কুন্তী, দুর্ব্বাসার মন্ত্র জপি সুবদনা,
হেরিলা নিকটে হৈম-কিরীটী ভাস্করে।
বীরকুল-চূড়ামণি নিকুম্ভ-নন্দন
উভে; ইন্দ্রসম রূপ—অতুল ভুবনে।
হেরি বীরদ্বয়ে ধনী বিস্ময় মানিয়া
একদৃষ্টে দোঁহা পানে লাগিলা চাহিতে,
চাহে যথা সূর্য্যমুখী সে সূর্য্যের পানে!

“কি আশ্চর্য্য! দেখ, ভাই,” কহিল শূরেন্দ্র
সুন্দ; “দেখ চাহি, ওই নিকুঞ্জ-মাঝারে।
উজ্জ্বল এ বন বুঝি দাবাগ্নিশিখাতে
আজি; কিম্বা ভগবতী আইলা আপনি
গৌরী! চল, যাই ত্বরা, পূজি পদযুগ!
দেবীর চরণ-পদ্ম-সদ্মে যে সৌরভ
বিরাজে, তাহাতে পূর্ণ আজি বনরাজী।”
মহাবেগে দুই ভাই ধাইলা সকাশে
বিবশ। অমনি মধু, মন্মথে সম্ভাষি,
মৃদু স্বরে ঋতুবর কহিলা সত্বরে;—
“হান তব ফুল-শর, ফুল-ধনু ধরি,
ধনুর্দ্ধর, যথা বনে নিষাদ, পাইলে
মৃগরাজে।” অন্তরীক্ষে থাকি রতিপতি,
শরবৃষ্টি করি, দোহে অস্থির করিলা
মেঘের আড়ালে পশি মেঘনাদ যথা
প্রহারয়ে সীতাকান্তু ঊর্মিলাবল্লতে।
জর জর ফুলশরে, উভয়ে ধরিলা
রূপসীরে। আচ্ছন্নিল গগন সহসা
জীমূত! শোণিতবিন্দু পড়িল চৌদিকে!
ঘোষিল নির্ঘোষে ঘন কালমেঘ দূরে;
কাপিলা বসুধা; দৈত্য-কুল-রাজলক্ষ্মী,
হায় রে, পুরিলা দেশ হাহাকার রবে।
কামমদে মত্ত এবে উপসুন্দাসুর
বলী, সুন্দাসুর পানে চাহিয়া কহিলা
রোষে; “কি কারণে তুমি স্পর্শ এ বামারে,
ভ্রাতৃবধূ তব, বীর?” সুন্দ উত্তরিলা—
“বরিনু কন্যায় আমি তোমার সম্মুখে
এখনি! আমার ভার্য্যা গুরুজন তব;
দেবর বামার তুমি; দেহ হাত ছাড়ি।”
যথা প্রজ্বলিত অগ্নি আহুতি পাইলে

আরো জ্বলে, উপসুন্দ—হায়, মন্দমতি—
মহা কোপে কহিল—“রে অধর্ম্ম-আচারি,
কুলাঙ্গার, ভ্রাতৃবধূ মাতৃসম মানি;
তার অঙ্গ পরশিস্ অনঙ্গ-পীড়নে?”
“কি কহিলি, পামর? অধর্ম্মাচারী আমি?
কুলাঙ্গার? ধিক্ তোরে, ধিক্, দুষ্টমতি,
পাপি! শৃগালের আশা কেশরীকামিনী
সহ কেলি করিবার, ওরে রে বর্ব্বর!”
এতেক কহিয়া রোষে নিষ্কোষিলা অসি
সুন্দাসুর, তা দেখিয়া বীরমদে মাতি,
হুহুঙ্কারি নিজ অস্ত্র ধরিলা অমনি
উপসুন্দ,—গ্রহ-দোষে বিগ্রহ-প্রয়াসী।
মাতঙ্গিনী-প্রেম-লোভে কামার্ত্ত যেমতি
মাতঙ্গ বুঝয়ে, হায়, গহন কাননে
রোষাবেশে, ঘোর রণে কুক্ষণে রণিলা
উভয়, ভুলিয়া, মরি, পূর্ব্বকথা যত!
তমঃসম জ্ঞান-রবি সতত আবরে
বিপত্তি! দোঁহার অস্ত্রে ক্ষত দুই জন,
তিতি ক্ষিতি রক্তস্রোতে, পড়িলা ভূতলে!
কতক্ষণে সুন্দাসুর চেতন পাইয়া,
কাতরে কহিল চাহি উপসুন্দ পানে;
“কি কর্ম্ম করিনু, ভাই, পূর্ব্বকথা ভুলি?
এত যে করিমু তপঃ ধাতায় তুষিতে;
এত যে যুঝিনু দোঁহে বাসবের সহ;
এই কি তাহার ফল ফলিল হে শেষে?
বালিবন্ধে সৌধ, হায়, কেন নির্ম্মাইমু
এত যত্নে? কাম-মদে রত যে দুর্ম্মতি,
সতত এ গতি তার বিদিত জগতে।
কিন্তু এই দুঃখ, ভাই, রহিল এ মনে—
রণক্ষেত্রে শত্রু জিনি, মরি অকালে,

মরে যথা মৃগরাজ পড়ি ব্যাধ-ফাঁদে।”
এতেক কহিয়া, হায়, সুন্দাসুর বলী,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, শরীর ত্যজিলা
অমরারি, যথা, মরি, গান্ধারীনন্দন,
নরশ্রেষ্ঠ, কুরুবংশ ধ্বংস গণি মনে,
যবে ঘোর নিশাকালে অশ্বত্থামা রথী
পাণ্ডব-শিশুর শির দিলা রাজহাতে!
মহা শোকে শোকী তবে উপসুন্দ বলী
কহিলা; “হে দৈত্যপতি, কিসের কারণে
লুটায় শরীর তব ধরণীর তলে?
উঠ, বীর, চল, পুনঃ দলিগে সমরে
অমর! হে শূরমণি, কে রাখিবে আজি
দানব-কুলের মান, তুমি না উঠিলে?
হে অগ্রজ, ডাকে দাস চির অনুগত
উপসুন্দ; অল্প দোষে দোষী তব পদে
কিঙ্কর; ক্ষমিয়া তারে, হে বাসবজয়ি,
লয়ে এ বামারে, ভাই, কেলি কর উঠি!”
এইরূপে বিলাপিয়া উপসুন্দ রথী,
অকালে কালের হস্তে প্রাণ সমর্পিলা
কর্ম্মদোষে। শৈলাকারে রহিলা দুজনে
ভূমিতলে, যথা শৈল—নীরব, অচল।
সমরে পড়িল দৈত্য। কন্দর্প অমনি
দর্পে শঙ্খ ধরি ধীর নাদিলা গম্ভীরে।
বহি সে বিজয়নাদ আকাশ-সম্ভবা
প্রতিধ্বনি, রড়ে ধনী ধাইলা আশুগা
মহারজে। তুঙ্গ শৃঙ্গে, পর্ব্বতকন্দরে,
পশিল স্বর-তরঙ্গ। যথা কাম্যবনে
দেব-দল, কতক্ষণে উত্তরিলা তথা
নিরাকারা দূতী। “উঠ,” কহিলা সুন্দরী,
“শীঘ্র করি উঠ, ওহে দেবকুলপতি!

ভ্রাতৃভেদে ক্ষয় আজি দানব দুর্জ্জয়।”
যথা অগ্নি-কণা-স্পর্শে বারুদ-কণিক-
রাশি, ইরম্মদরূপে, উঠয়ে নিমিষে
গরজি পবন-মার্গে উঠিলা তেমতি
দেবসৈন্য শূন্যপথে! রতনে খচিত
ধ্বজদণ্ড ধরি করে, চিত্ররথ রথী
উম্মীলিলা দেখকেতু কৌতুকে আকাশে।
শোভিল সে কেতু, শোভে ধুমকেতু যথা
তারাশির,—তেজে ভস্ম করি সুররিপু!
বাজাইল রণবাদ্য বাদ্যকর-দল
নিক্কণে। চলিলা সবে জয়ধ্বনি করি।
চলিলেন বায়ুপতি, খগপতি যথা
হেরি দূরে নাগবৃন্দ-ভয়ঙ্কর গতি;
সাপটি প্রচণ্ড দণ্ড চলিলা হরষে
শমন; চলিলা ধনুঃ টঙ্কারিয়া রথী
সেনানী; চলিলা পাশী; অলকার পতি,
গদা হস্তে; স্বর্ণরথে চলিলা বাসব,
ত্বিষায় জিনিয়া ত্বিষাম্পতি দিনমণি।
চলে বাসবীয় চমূ জীমূত যেমতি
ঝড় সহ মহারড়ে; কিম্বা চলে যথা
প্রমথনাথের সাথে প্রমথের কুল
নাশিতে প্রলয়কালে, ববম্বম রবে—
ববম্বম রবে যবে রবে শিঙ্গাধ্বনি!
ঘোর নাদে দেবসৈন্য প্রবেশিল আসি
দৈত্যদেশে। যে যেখানে আছিল দানব,
হতাশ তরাসে কেহ, কেহ ঘোর রণে
মরিল! মুহূর্ত্তে, আহা, যত নদ নদী
প্রস্রবণ, রক্তময় হইয়া বহিল!
শৈলাকার শবরাশি গগন পরশে।
শকুনি গৃধিনী তব—বিকট মূরতি—

যুড়িয়া আকাশদেশ, উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে
মাংসলোভে। বায়ুসখা সুখে বায়ু সহ‌
শত শত দৈত্যপুরী লাগিলা দহিতে।
মরিল দানব-শিশু, দানব-বনিতা।
হায় রে, যে ঘোর বাত্যা দলে তরু-দলে
বিপিনে, নাশে সে মূঢ় মুকুলিত লতা,
কুসুম-কাঞ্চন-কান্তি! বিধির এ লীলা।
বিলাপী-বিলাপধ্বনি জয়নাদ সহ
মিশিয়া পূরিল বিশ্ব ভৈরব আরবে!
কত যে মারিলা যম কে পারে বর্ণিতে?
কত যে চূর্ণিলা, ভাঙ্গি তুঙ্গ শৃঙ্গ, বলী
প্রভঞ্জন;—তীক্ষ্ণ শরে কত যে কাটিলা
সেনানী; কত যে যূথনাথ গদাঘাতে
নাশিলা অলকানাথ; কত যে প্রচেতা
পাশী; হায়, কে বর্ণিবে, কার সাধ্য এত?
দানব-কুল-নিধনে, দেব-কুল-নিধি
শচীকান্ত, নিতান্ত কাতর হয়ে মনে
দয়াময়, ঘোর রবে শঙ্খ নিনাদিলা
রণভূমে। দেবসেনা, ক্ষান্ত দিয়া রণে
অমনি, বিনতভাবে বেড়িলা বাসবে।
কহিলেন সুনাসীর গম্ভীর বচনে;—
“সুন্দ-উপসুন্দাসুর, হে শূরেন্দ্র রথি,
অরি মম, যমালয়ে গেছে দোঁহে চলি
অকালে কপালদোষে। আর কারে ডরি?
তবে বৃথা প্রাণিহত্যা কর কি কারণে?
নীচের শরীরে বীর কভু কি প্রহারে
অস্ত্র? উচ্চ তরু—সেই ভস্ম ইরম্মদে।
যাক্ চলি নিজালয়ে দিতিসুত যত।
বিষহীন ফণী দেখি কে মারে তাহারে?
আনহ চন্দনকাষ্ঠ কেহ, কেহ ঘৃত;

আইস সবে দানবের প্রেতকর্ম্ম করি
যথা বিধি। বীর-কুলে সামান্য সে নহে,
তোমা সবা যার শরে কাতর সমরে!
বিশ্বনাশী বজ্রাগ্নিরে অবহেলা করি,
জিনিল যে বাহু-বলে দেবকুলরাজে,
কেমনে তাহার দেহ দিবে সবে আজি
খেচর ভূচর জীবে? বীরশ্রেষ্ঠ যারা,
বীরারি পুজিতে রত সতত জগতে!”
এতেক কহিলা যদি বাসব, অমনি
সাজাইলা চিতা চিত্ররথ মহারথী।
রাশি রাশি আনি কাষ্ঠ সুরভি, ঢালিলা
ঘৃত তাহে। আসি শুচি—সর্ব্বশুচিকারী—
দহিলা দানব-দেহ। অনুমৃতা হয়ে,
সুন্দ-উপসুন্দাসুর-মহিষী রূপসী
গেলা ব্রহ্মলোকে, দোঁহে পতিপরায়ণা।
তবে তিলোত্তমা পানে চাহি সুরপতি
জিষ্ণু, কহিলেন দেব মৃদু মন্দস্বরে;—
“তারিলে দেবতাকুলে অকুল পাথারে
তুমি; দলি দানবেন্দ্রে তোমার কল্যাণে,
হে কল্যাণি, স্বর্গলাভ আবার করিনু।
এ সুখ্যাতি তব, সতি, ঘুষিবে জগতে
চিরদিন। যাও এবে (বিধির এ বিধি)
সূর্য‍্যলোকে; সুখে পশি আলোক-সাগরে,
কর বাস, যথা দেবী কেশব-বাসনা,
ইন্দুবদনা ইন্দিরা—জলধির তলে।”
চলি গেলা তিলোত্তমা—তারাকারা ধনী—
সূর্য্যলোকে। সুরসৈন্য সহ সুরপতি
অমরাপুরীতে হর্ষে পুনঃ প্রবেশিলা।

ইতি শ্রীতিলোত্তমাসম্ভবে কাব্যে বাসব-বিজয়ো নাম
চতুর্থ সর্গ।
গ্রন্থ সমাপ্ত।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন