মাইকেল মধুসূদন দত্ত
তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
প্রথম সর্গ
ধবল নামেতে গিরি হিমাদ্রির শিরে—
অভ্রভেদী, দেব-আত্মা, ভীষণদর্শন;
সতত ধবলাকৃতি, অচল, অটল;
যেন উর্দ্ধ্ববাহু সদা, শুভ্রবেশধারী,
নিমগ্ন তপঃসাগরে ব্যোমকেশ শূলী—
যোগিকুলধ্যেয় যোগী! নিকুঞ্জ, কানন,
তরুরাজি, লতাবলী, মুকুল, কুসুম—
অন্যান্য অচলভালে শোভে যে সকল,
(যেন মরকতময় কনককিরীট)
না পরে এ গিরি, সবে করি অবহেলা,
বিমুখ পৃথিবীপতি পৃথ্বীসুখে যেন
জিতেন্দ্রিয়! সুনাদিনী বিহঙ্গিনীদল,
সুনাদী বিহঙ্গ, অলি মত্ত মধুলোভে,
কভু নাহি ভ্রমে তথা! মৃগেন্দ্র কেশরী,—
করীশ্বর,—গিরীশ্বরশরীর যাহার,—
শার্দ্দুল, ভল্লুক, বনচর জীব যত—
বনকমলিনী কুরঙ্গিণী সুলোচনা,—
ফণিনী মণিকুন্তলা, বিষাকর ফণী,—
না যায় নিকটে তার—বিকট শেখর
অদূরে ঘোর তিমির গভীর গহ্বরে,
কলকল করে জল মহাকোলাহলে,
ভোগবতী স্রোতস্বতী পাতালে যেমতি
কল্লোলিনী; ঘন স্বনে বহেন পবন,
মহাকোপে লয়রূপে তমোগুণান্বিত,
নিশ্বাস ছাড়েন যেন সর্ব্বনাশকারী!
দানব, মানব, যক্ষ, রক্ষ, দানবারি—
দানবী, মানবী, দেবী, কিবা নিশাচরী
সকলেরি অগম—দুর্গম দুর্গ যেন!
দিবানিশি মেঘরাশি উড়ে চারি দিকে,
ভূতনাথসঙ্গে রঙ্গে নাচে ভূত যেন।
এ হেন নির্জ্জন স্থানে দেব পুরন্দর
কেন গো বসিয়া আজি, কহ পদ্মাসনা
বীণাপাণি? কবি, দেবি, তব পদাম্বুজে
প্রণমি, জিজ্ঞাসে তোমা, কহ, দয়াময়ি!
তব কৃপা-মন্দর দানব-দেব-বল,
শেষের অশেষ দেহ—দেহ এ দাসেরে;
এ বাক্সাগর আমি মথি সযতনে,
লভি, মা, কবিতামৃত—নিরুপম সুধা!
অকিঞ্চনে কর দয়া, বিশ্ববিনোদিনি!
যে শশীর স্থান, মাতঃ, স্থাণুর ললাটে,
তাঁহারি আভায় শোভে ফুলকুলদলে
নিশার শিশিরবিন্দু, মুক্তাফলরূপে!—
কহ, সতি;—কি না তুমি জান, জ্ঞানময়ি?—
কোথা সে ত্রিদিব, যার ভোগ লভিবারে
কঠোর তপস্যা নর করে যুগে যুগে,
কত শত নরপতি রত অশ্বমেধে—
সাগর বিপুলবংশ যে লোভেতে হত?
কোথা সে অমরাপুরী কনকনগরী?
কোথা বৈজয়ন্ত-ধাম, সুবর্ণ আলয়,
প্রভায় মলিন যার ইন্দু, প্রভাকর?
কোথা সে কনকাসন, রাজছত্র কোথা,
রবির পরিধি যেন মেরু-শৃঙ্গোপরি—
উভয় উজ্জ্বলতর উভয়ের তেজে?
কোথা সে নন্দনবন, সুখের সদন।
কোথা পারিজাত-ফুল, ফুলকুলপতি?
কোথা সে উর্ব্বশী, রূপে ঋষি-মনোহরা,
চিত্রলেখা—জগৎজনের চিত্তে লেখা,
মিশ্রকেশী—যার কেশ, কামের নিগড়,
কি অমরে, কিবা নরে, না বাঁধে কাহারে?
কোথায় কিন্নর? কোথা বিদ্যাধরদল?
গন্ধর্ব্ব—মদনগর্ব্ব খর্ব্ব যার রূপে?
চিত্ররথ—কামিনীকুলের মনোরথ—
মহারথী? কোথা বজ্র, ভীমপ্রহরণ!
যার দ্রুত ইরম্মদে, গভীর গর্জ্জনে,
দেব-কলেবর কাপে করি থর থর;
ভূধর অধীর সদা, চমকে ভুবন
আতঙ্কে? কোথা সে ধনুঃ, ধনুঃকুলরাজা
আভাময়, যার চারু-রত্ন-কান্তিছটা
শোভে গো গগনশিরে (মেঘময় যবে)
শিখিপুচ্ছচূড়া যেন হৃষীকেশকেশে!
কোথায় পুষ্কর, আবর্ত্তক—ঘনেশ্বর?
কোথায় মাতলি বলী? কোথা সে বিমান,
মনোরথ পরাজিত যে রথের বেগে—
গতি, ভাতি—উভয়েতে তড়িৎ লাঞ্ছিত?
কোথায় গজেন্দ্র ঐরাবত? উচ্চৈঃশ্রবাঃ
হয়েশ্বর, আশুগতি যথা আশুগতি?
কোথায় পৌলোমী সতী, অনন্ত-যৌবনা,
দেবেন্দ্র-হৃদয়-সরোবর-কমলিনী,
দেব-কুল-লোচন-আনন্দময়ী দেবী,
আয়তলোচনা? কোথা স্বর্ণ কল্পতরু,
কামদ বিধাতা যথা, যার পূত পদ
আনন্দে নন্দনবনে দেবী মন্দাকিনী
ধোন্ সদা প্রবাহিণী কলকল কলে?—
হায় রে, কোথায় আজি সে দেববিভব!
হায় রে, কোথায় আজি সে দেবমহিমা!
দুর্দান্ত দানবদল, দৈববলে বলী,
পরাভবি সুরদলে ঘোরতর রণে,
পুরিয়াছে স্বর্গপুরী মহাকোলাহলে,
বসিয়াছে দেবাসনে পামর দেবারি।
যথা প্রলয়ের কালে, রুদ্রের নিশ্বাস
বাতময়, উথলিলে জল সমাকুল,
প্রবল তরঙ্গদল, তীর অতিক্রমি,
বসুধার কুস্তুল হইতে লয় কাড়ি
সুবর্ণকুসুম-লতা-মণ্ডিত মুকুট;—
যে সুচারু শ্যামঅঙ্গ ঋতুকুলপতি
গাঁথি নানা ফুলমালা সাজান আপনি
আদরে, হরে প্লাবন তার আভরণ।
সহস্রেক বৎসর যুঝিয়া দানবারি,
প্রচণ্ড দিতিজ ভুজ প্রতাপে তাপিত,
ভঙ্গ দিয়া বিমুখ হইলা সবে রণে—
আকুল! পাবক যথা, বায়ু যাঁর সখা,
সর্ব্বভুক্, প্রবেশিলে নিবিড় কাননে,
মহাত্রাসে উর্দ্ধশ্বাসে পালায় কেশরী;
মদকল নগদল, চঞ্চল সভয়ে,
করভ করিণী ছাড়ি পালায় অমনি
আশুগতি; মৃগাদন শার্দ্দুল, বরাহ,
মহিষ, ভীষণ খড়্গী—অক্ষয়শরীরী,
ভল্লুক বিকটাকার, দূরন্ত হিংসক
পালায় ভৈরবরবে, ত্যজি বনরাজি;—
পালায় কুরঙ্গ রঙ্গরসে ভঙ্গ দিয়া,
ভুজঙ্গ, বিহঙ্গ, বেগে ধায় চারি দিকে;—
মহাকোলাহলে চলে জীবন-তরঙ্গ,
জীবনতরঙ্গ যথা পবনতাড়নে!
অব্যর্থ কুলিশে ব্যর্থ দেখি সে সমরে,
পালাইলা পরিহরি সংগ্রাম কুলিশী
পুরন্দর; পালাইলা পাশী দেখি পাশে
ম্রিয়মাণ, মন্ত্রবলে মহোরগ যেন!
পালাইলা যক্ষনাথ ভীম গদা ফেলি,
করী যেন করহীন! পালাইলা বেগে
বাতাকারে মৃগপৃষ্ঠে বায়ুকুলপতি;
জরজর-কলেবর, দুষ্টাসুর-স্পরে
পালাইলা শিখি-পৃষ্ঠে শিখিবরাসন
মহারথী; পালাইলা মহিষ বাহনে
সর্ব্বঅন্তকারী যম, দন্ত কড়মড়ি,
সাপটি প্রচণ্ড দণ্ড—ব্যর্থ এবে রণে।
পালাইলা দেবগণ রণভূমি ত্যজি;
জয় জয় নামে দৈত্য ভুবন পুরিল।
দৈববলে বলী পাপী, মহা অহঙ্কারে
প্রবেশিল স্বর্গপুরী—কনক নগরী,—
দেবরাজাসনে, মরি, দেবারি বসিল!
হায় রে, যে রতির মৃণাল-ভুজপাশ,
(প্রেমের কুসুম-ডোর,) বাঁধিত সতত
মধুসখে, স্মরহর-কোপানল যেন
বিরহ-অনল রূপ ধরি, মহাতাপে
দহিতে লাগিল এবে সে রতির হিয়া।
সুন্দ উপসুন্দাসুর, সুরে পরাভবি,
লণ্ড ভণ্ড করিল অখিল ভূমণ্ডল;
ঔর্ব্বঋষি ক্রোধানল পশি যেন জলে,
জ্বালাইলা জলেশ্বরে, নাশি জলচরে।
তোমার এ বিধি, বিধি, কে পায়ে বুঝিতে,
কিবা নরে, কি অমরে? বোধাগম্য তুমি
ত্যজি দেববলদলে দেবদলপতি
হিমাচলে মহাবল চলিলা একাকী;—
যথা পক্ষরাজ বাজ, নির্দ্দয় কিরাত
লুটিলে কুলায় তার পর্ব্বত-কন্দরে,
শোকে অভিমানে মনে প্রমাদ গণিয়া,
আকুল বিহঙ্গ, তুঙ্গ-গিরি-শৃঙ্গোপরি,
কিম্বা উচ্চশাখ বৃক্ষশাখে বসে উড়ি;—
ধবল অচলে এবে চলিলা বাসব।
বিপদের কালজাল আসি বেড়ে যবে,
মহতজনভরসা মহত যে জন।
এই সুরপতি যবে ভীষণ অশনি-
প্রহারে চূর্ণিয়াছিলা শৈল-কুল-পাখা
হৈম, শৈলরাজস্থত মৈনাক পশিলা
অতলজলধিতলে—মান বাঁচাইতে!
যথা ঘোরতর বাত্যা, অস্থিরি নির্ঘোষে
গভীর পয়োধি নীর, ধরি মহাবলে
জলচর-কুলপতি মীনেন্দ্র তিমিরে,
ফেলাইলে তুলে কূলে, মৎস্যনাথ তথা
অসহায় মহামতি হয়েন অচল;
অভিমানে শিলাসনে বসিলা আসিয়া
জিষ্ণু-অজিষ্ণু গো আজি দানব-সংগ্রামে
দানবীরি! মহারথী বসিলা একাকী;
নিকটে বিকট বজ্র, ব্যর্থ এবে রণে,
কমল চরণে পড়ি যায় গড়াগড়ি,
প্রচণ্ড আঘাতে ক্ষতশরীর কেশরী
শিখরী সমীপে যথা—ব্যথিত হৃদয়ে!
কনক-নির্ম্মিত ধনু—রতন-মণ্ডিত,
(কাদম্বিনী ধনী যারে পাইলে অমনি
যতনে সীমন্তদেশে পরয়ে হরষে)
অনাদরে শোভে, হায়, পর্ব্বতশিখরে,
ধবল-ললাট-দেশ উজলি সুতেজে,
শশিকলা উমাপতি-ললাট যেমতি।
শুন্য তূণ—বারিশূন্য সাগর যেমনি,
যবে ঋষি অগস্ত্য শুষিলা জলদলে
ঘোর রোষে! শঙ্খ, যার নিনাদে আকুল
দৈত্যকুল—করী-অরি-নিনাদে যেমতি
করিবৃন্দ—নিরানন্দে নীরব সে এবে!
হায় রে, অনাথ আজি ত্রিদিবের নাথ!
হায় রে, গরিমাহীন গরিমা-নিধান!
যে মিহির, তিমিরারি, কর-রত্ন-দানে
ভূষেন রজনী-সখা, স্বর্ণতারাবলী,
গ্রহরাশি,—রাহু আসি গ্রাসিয়াছে তাঁরে!
এবে দিনমণি দেব, মৃদু-মন্দ-গতি,
অস্তাচলে চালাইলা স্বর্ণ-চক্ররথ,
বিশ্রাম বিলাস আশে মহীপতি যথা
সাঙ্গ করি রাজ্য কার্য্য অবনীমণ্ডলে।
শুধাইল নলিনীর প্রফুল্ল আনন,
দুরূহ বিরহকাল কাল যেন দেখি
সমুখে! মুদিলা আঁখি ফুলকুলেশ্বরী।
মহাশোকে চক্রবাকী অবাক্ হইয়া,
আইলো তরুর কোলে ভাসি নেত্রনীরে,
একাকিনী—বিরহিণী—বিষণ্ণবদনা,
বিধবা দুহিতা যেন জনকের গৃহে।
মৃদুহাসি শশী সহ নিশি দিলা দেখা,
তারাময় সিঁথি পরি সীমন্তে সুন্দরী;
বন, উপবন, শৈল, জলাশয়, সরঃ,
চন্দ্রিমার রজঃকান্তি কান্তিল সবারে।
শোভিল বিমল জলে বিধুপরায়ণা
কুমুদিনী; স্থলে শোভে বিশদবসনা
ধুতুরা চির যোগিনী, অলি মধুলোভী
কভু না পরশে যারে। উত্তরিলা ধীরে,
বিরাম-দায়িনী নিদ্রা—রজনীর সখী—
কুহকিনী স্বপ্নদেবী স্বজনীর সহ।
বসুমতী সতী তাঁর চরণকমলে,
জীবকুল লয়ে নমি নীরব হইলা।
আইলা রজনী ধনী ধবল-শিখরে
ধীরভাবে, ভীমা দেবী ভীম পাশে যথা
মন্দগতি। গেলা সতী কৌমুদীবসনা
শিলাতলে দেবরাজ বিরাজেন যথা।
ধরি পাদপদ্মযুগ করপদ্মযুগে,
কাঁদিয়া সাষ্টাঙ্গে দেবী প্রণাম করিলা
দেবনাথে। অশ্রু-বিন্দু, ইন্দ্রের চরণে,
শোভিল, শিশির যেন শতদল-দলে,
জাগান অরুণে যবে ঊষা সাজাইতে
একচক্ররথ, খুলি সুকমল-করে
পূর্ব্বাশার হৈম দ্বার! আইলেন এবে
নিদ্রাদেবী, সহ স্বপ্ন-দেবী সহচরী,
পুষ্পদাম সহ, আহা, সৌরভ যেমতি।
মৃদু মন্দ গন্ধবহ-বাহনে আরোহি,
আসি উত্তরিলা দোঁহে যথা বজ্রপাণি;
কিন্তু শোকাকুল হেরি দেবকুলনাথে,
নিঃশব্দে বিনতভাবে দূরে দাঁড়াইলা,
সুকিঙ্করীবৃন্দ যথা নরেন্দ্র সমীপে
দাঁড়ায়,—উজ্জ্বল স্বর্ণপুতলীর দল।
হেরি অসুরারি দেবে শোকের সাগরে
মগ্ন, মগ্ন বিশ্ব যেন প্রনয়সন্সিলে,—
কাঁদিতে কাঁদিতে নিশি নিদ্রা পানে চাহি,
সুমধুর স্বরে শ্যামা কহিতে লাগিলা;—
“হায় সখি, এ কি লীলা খেলিলা বিধাতা?
দেবকুলেশ্বর যিনি, ত্রিদিবের পতি,
এই শিলাময় দেশ—অগম, বিজন,
ভয়ঙ্কর—মরি! এ কি সাজে লো তাঁহারে?
হায় রে, যে কল্পতরু নন্দনকাননে,
মন্দাকিনী তটিনীর স্বর্ণতটে শোভে
প্রভাময়, কে ফেলে লো উপাড়ি তাহারে
মরুভূমে? কার বুক না ফাটে লো দেখি
এ মিহিরে ডুবিতে এ তিমির-সাগরে!”
কহিতে কহিতে দেবী শর্ব্বরী সুন্দরী
কাঁদিয়া তারাকুন্তলা ব্যাকুলা হইলা!
শোকের তরঙ্গ যবে উথলে হৃদয়ে,
ছিন্ন-তার বীণা সম নীরব রসনা;—
অরে রে দারুণ শোক, এই তোর রীতি!
শুনি যামিনীর বাণী, নিদ্রাদেবী তবে
উত্তর করিলা সতী অমৃতভাষিণী,
মধুপানে মাতি যেন মধুকরীশ্বরী
মধুর গুঞ্জরে, আহা, নিকুঞ্জ পূরিলা;—
“যা কহিলে সত্য, সখি, দেখি বুক ফাটে;
বিধির নির্ব্বন্ধ কিন্তু কে পারে খণ্ডীতে?
আইস এবে, তুমি, আমি, স্বপ্নদেবী সহ,
কিঞ্চিৎ কালের তরে হরি, যদি পারি,
এ বিষম শোকশেল, যতন করিয়া।
ডাক তুমি, হে স্বজনি, মলয় পরনে;
বল তারে স্বসৌরভ আগু আনিবারে;
কহ তব সুধাংশুরে শুধা বরষিতে।
যাই আমি, যদি পারি, মুদি, প্রিয়সখি,
ও সহস্র আঁখি, মন্ত্রবলে কি কৌশলে।
গড়ুক স্বপনদেবী মায়ায় পৌলোমী—
মৃগাক্ষী, পীবরস্তনী, সুবিম্ব-অধরা,
সুশোভিত কবরী মন্দারে, কৃশোদয়ী;
বেড়ুক দেবেন্দ্রে সৃজি মায়ার নন্দন;
মায়ার উর্ব্বশী জাসি, স্বর্ণবীণা করে,
গায়ুক মধুর গীত মধু পঞ্চস্বরে;
রম্ভা-উরু রম্ভা আসি নাচুক কৌতুকে।
যে অবধি, নলিনীর বিরহে কাতর,
নলিনীর সখা আসি নাহি দেন দেখা
কনক উদয়াচল-শিখরে, উজলি
দশ দিশ, হে স্বজনি, আইস তোমা দোঁহে,
সাধিতে এ কার্য্য মোরা করি প্রাণপণ।”
তবে নিশি, সহ নিদ্রা, স্বপ্ন কুহকিনী,
হাত ধরাধরি করি, বেড়িলা বাসবে—
সুবর্ণ চম্পকদাম গাঁথি যেন রতি
দোলাইলা প্রাণপতি মদনের গলে!
ধীরভাবে দেবীদল, বেড়িয়া দেবেশে,
যাঁর যত তন্ত্র, মন্ত্র, ছিটা, ফোঁটা ছিল,
একে একে লাগাইলা; কিন্তু দৈবদোষে,
বিফল হইল সব; যামিনী অমনি,
চঞ্চল বিস্ময়ে দেবী, মৃদু, কলস্বরে,—
একাকিনী, সুনাদিনী কপোতী যেমতি
কুহরে নিবিড় বনে—কহিতে লাগিল;—
“কি আশ্চর্য, প্রিয়সখি, দেখিলাম আজি!
কেবা জিনে ত্রিভুবনে আমা তিন জনে?
চিরবিজয়িনী মোরা যাই লো যে স্থলে!
সাগর মাঝারে, কিম্বা গহন বিপিনে,
রাজসভা, রণভূমে, বাসরে, আসরে,
কারাগারে, দুঃখ, সুখ, উভয় সদনে,
করি জয় স্বর্গে, মর্ত্ত্যে, পাতালে, আমরা;
কিন্তু সে প্রবল বল বৃথা হেথা এবে।”
শুনি স্বপ্নদেবী হাসি—হাসে শশী যথা—
কহিলা শ্যামা স্বজনী রজনীর প্রতি;
“মিছে খেদ কেন, সখি, কর গো আপনি?
দেবেন্দ্ররমণী ধনী পুলোমদুহিতা
বিনা, আর কার সাধ্য নিবাইতে পারে
এ জ্বলন্ত শোকানল? যদি আজ্ঞা দেহ,
যাই আমি আনি হেথা সে চারুহাসিনী।
হায়, সখি, পতিহীনা কপোতী যেমতি,
তরুবর, শৃঙ্গধর সমীপে, বিলাপি
চাহে কাস্তে সীমন্তিনী, বিরহবিধুরা,
ভ্রান্তি-দূতী সহ সতী ভ্রমেন জগতে,
শোকে! শুন মন দিয়া, রজনি স্বজনি,
যদি আজ্ঞা কর তবে এখনি যাইব।”
যাও বলি আদেশিলা শশাঙ্করঙ্গিণী।
চলিলা স্বপনদেবী নীলাম্বর-পথে—
বিমল তরলতর রূপে আলো করি
দশ দিশ; আশুগতি গেলা কুহকিনী,
ভূপতিত তারা যেন উঠিল আকাশে।
গেলা চলি স্বপ্নদেবী মায়াবী সুন্দরী
দ্রুতবেগে; বিভাবরী নিদ্রাদেবী সহ
বসিলা ধবল শৃঙ্গে; আহা, কিবা শোভা!
যুগল কমল, যেন জগৎ মোহিতে,
ফুটিল এক মৃণালে ক্ষীর-সরোবরে!
ধবল শিখরে বসি নিদ্রা, বিভাবরী,
আকাশের পানে দোঁহে চাহিতে লাগিলা,
হায় রে, চাতকী যথা সতৃষ্ণ নয়নে
চাহে আকাশের পানে জলধারা-আশে!
আচম্বিতে পূর্ব্বভাগে গগনমণ্ডল
উজ্জ্বলিল, যেন দ্রুত পাবকের শিখা,
ঠেলি ফেলি দুই পাশে তিমির-তরঙ্গ,
উঠিল অম্বর-পথে; কিম্বা ত্বিষাম্পতি
অরুণ সারথি সহ স্বর্ণচক্র রথে
উদয় অচলে আসি দরশন দিলা।
শতেক যোজন বেড়ি আলোক-মণ্ডল
শোভিল আকাশে, যেন রঞ্জনের ছটা
নীলোৎপল-দলে, কিম্বা নিকষে যেমতি
সুবর্ণের রেখা—লেখা বক্র চক্ররূপে।
এ সুন্দর প্রভাকর পরিধি মাঝারে,
মেঘাসনে বসি ওগো কোন্ সতী ওই?
কেমনে, কহ, মা, শ্বেতকমলবাসিনি,
কেমনে মানব আমি চাব ওঁর পানে?
রবিচ্ছবি পানে, দেবি, কে পারে চাহিতে?
এ দুর্ব্বল দাসে কর তব বলে বলী।
চরণ যুগল শোভে মেঘবর-শিরে,
নীল জলে রক্তোৎপল প্রফুল্লিত যথা,
কিম্বা মাধবের বুকে কৌস্তুভ রতন।
দশ চন্দ্র পড়ি রে রাজীব পদতলে,
পূজা ছলে বসে তথা—সুখের সদন।
কাঞ্চন-মুকুট শিরে—দিনমণি তাহে
মণিরূপে শোভে ভানু; পৃষ্ঠে মন্দ দোলে
বেণী,—কামবধূ রতি যে বেণী লইয়া
গড়েন নিগড় সদা বাঁধিতে বাসবে!
অনন্ত-যৌবন_দেব, বসন্ত যেমনি
সাজায় মহীর দেহ, সুমধুর মাসে,
উল্লাসে ইন্দ্রাণী পাশে বিরাজে সতত
অনুচর, যোগাইয়া বিবিধ ভূষণ!
অলিপংক্তি,—রতিপতি ধনুকের গুণ,—
সে ধনুরাকার ধরি বসিয়াছে সুখে
কমল নয়ন-যুগোপরি, মধু আশে
নীরব!—হায় রে মরি! এ তিন ভুবনে
কে পারে ফিরাতে আঁখি হেরি ও বদন!
পদ্মরাগ-খচিত, পদ্মের পর্ণ সম
পট্টবস্ত্র; সু-অঞ্চলে জ্বলে রত্নাবলী,
বিজলীর ঝলা যেন অচঞ্চল সদা!
সে আঁচল ইন্দ্রাণীর পীনস্তনোপরি
ভাতে, কামকেতু যথা যবে কামসখা
বসন্ত, হিমান্তে, ভারে উড়ায় কৌতুকে!
ভূবনমোহিনী দেবী, বসি মেঘাসনে,
আইলা অন্বয়পথে মৃদুমন্দগতি,—
নীলাম্বু সাগর-মুখে নীলোৎপল-দলে
যথা রমা সুকেশিনী কেশবাসনা,
সুরাসুর মিলি যবে মথিলা সাগরে!
হায়, ও কি অশ্রু কবি হেরে ও নয়নে?
অরে রে বিকট কীট, নিদারুণ শোক,
এ হেন কোমল ফুলে বাসা কি রে তোর—
সর্ব্বভুক্ সম, হায়, তুই দুরাচার
সর্ব্বভুক্? শূন্যমার্গে কাঁদেন বিষাদে
একাকিনী স্বরীশ্বরী! চল, ঘনপতি!
ঘন-কুলোত্তম তুমি, উড় দ্রুতবেগে।
তুমি হে গন্ধমাদন, তোমার শিখরে
ফলে সে দুর্লভ স্বর্ণলতিকা, পরশে
যাহার, শোকের শক্তি-শেলাঘাত হতে
লভিবেন পরিত্রাণ বাসব সুমতি!
আইলা পৌলোমী সতী মেঘাসনে বসি,
তেজোরাশি-বেষ্টিতা; নাদিল জলধর;
সে গভীর নাদ শুনি, আকাশসম্ভবা
প্রতিধ্বনি সপুলকে বিস্তারিলা তারে
চারি দিকে; কুঞ্জবন, কন্দর, পর্ব্বত,
নিবিড় কানন, দূর নগর, নগরী,
সে স্বর-তরঙ্গ রঙ্গে পুরিল সবারে।
চাতকিনী জয়ধ্বনি করিয়া উড়িল
শূন্য পথে, হেরি দূরে প্রাণনাথে যথা
বিরহবিধুরা বালা, ধায় তার পানে।
নাচিতে লাগিল মত্ত শিখিনী সুখিনী:
প্রকাশিল শিখী চারু চন্দ্রক-কলাপ;
বলাকা, মালায় গাঁথা, আইলা ত্বরিতে
যুড়িয়া আকাশপথ; সুবর্ণ কন্দলী—
ফুলকুলবধূ সতী সদা লজ্জাবতী,
মাথা তুলি শূন্যপানে চাহিয়া হাসিল;
গোপিনী শুনি যেমনি মুরলীর ধ্বনি,
চাহে গো নিকুঞ্জপানে, যবে ব্রজধামে,
দাঁড়ায়ে কদম্বমূলে যমুনার কূলে,
মৃদুস্বরে সুন্দরীরে ডাকেন মুরারি।
ঘনাসন ত্যজি আশু নামিলা ইন্দ্রাণী
ধবলের পদদেশে। এ কি চমৎকার?
প্রভাকীর্ণ, তেজোময় কনকমণ্ডিত
সোপান দেখিলা দেবী আপন সম্মুখে—
মণি মুক্তা হীরক খচিত শত সিঁড়ি
গড়ি যেন বিশ্বকর্ম্মা স্থাপিলা সেখানে।
উঠিলেন ইন্দ্রপ্রিয়া মৃদু মন্দ গতি
ধবল শিখরে সতী। আচম্বিতে তথা
নয়ন-রঞ্জন এক নিকুঞ্জ শোভিল।
বিবিধ কুসুমজাল, স্তবকে স্তবকে,
বনরত্ন, মধুর সর্ববস্ব, স্মরধন,
বিকশিয়া চারি দিকে হাসিতে লাগিল—
নীল নভস্তলে হাসে তারাদল যথা।
মধুকর-নিকর আনন্দধ্বনি করি
মকরন্দ-লোভে অন্ধ আসি উত্তরিলা;
বসন্তের কলকণ্ঠ গায়ক কোকিল
বরষিলা স্বরসুধা; মলয় মারুত—
ফুল-ফুল-নায়ক প্রবর সমীরণ—
প্রতি অনুকূল-ফুল-শ্রবণ-কুহরে
প্রেমের রহস্য আসি কহিতে লাগিলা;
ছুটিল সৌরভ যেন রতির নিশ্বাস,
মন্মথের মন যবে মখেন কামিনী
পাতি প্রণয়ের ফাঁদ প্রণয়কৌতুকে
বিরলে! বিশাল তরু, ব্রততী-রমণ,
মঞ্জরিত ব্রততীর বাহুপাশে বাঁধা,
দাঁড়াইল চারি দিকে, বীরবৃন্দ যথা;
শত শত উৎস, রজস্তম্ভের আকারে
উঠিয়া আকাশে, মুক্তাফল কলরবে
বরষি, আর্দ্রিল অচলের বক্ষঃস্থল।
সে সকল জলবিন্দু একত্র মিশিয়া,
সৃজিল সত্বর এক রম্য সরোবর
বিমল-সলিল-পূর্ণ; সে সরে হাসিল
নলিনী, ভুলিয়া ধনী তপন-বিরহ
ক্ষণকাল! কুমুদিনী, শশাঙ্ক-রঙ্গিণী,
সুখের তরঙ্গে রঙ্গে ফুটিয়া ভাসিল!
সে সরোদর্পণে তারা, তারানাথ সহ,
সুতরল জলদলে কান্তি রজতেজে,
শোভিল পুলকে—যেন নূতন গগনে!
অবিলম্বে শন্বরারি-সখা ঋতুপতি
উতরিলা সম্ভাষিতে ত্রিদিবের দেবী।—
কার সঙ্গে এ কুঞ্জের দিব রে তুলনা?
প্রাণপতি সহ রতি ভূঞ্জে রতি যথা,
কি ছার সে কুঞ্জবন এ কুঞ্জের কাছে।
কালিন্দী আনন্দময়ী তটিনীর তটে
শোভে যে নিকুঞ্জবন—যথা প্রতিধ্বনি,
বংশীধ্বনি শুনি ধনী—আকাশদুহিতা—
শিখে সদা রাধানাম মাধবের মুখে,
এ কুঞ্জের সহ তার তুলনা না খাটে।
কি কহিবে কবি তবে এ কুঞ্জের শোভা?
প্রমদার পাদপদ্ম-পরশে অশোক
সুখে প্রসূনের হার পরে তরুবর;
কামিনীর বিধুমুখ-শীধু-সিক্ত হলে,
বকুল, ব্যাকুল তার মন রঞ্জাইতে,
ফুল-আভরণে ভূষে আপনার বপু
হরষে, নাগর যথা প্রেমলাভ আশে;—
কিন্তু আজি ধবলের হের বাজি-খেলা।
অরে রে বিজন, বন্ধ্য, ভয়ঙ্কর গিরি,
হেরি এ নারীন্দু-পদ-অরবিন্দ-যুগ,
আনন্দ সাগর-নীরে মজিলি কি তুই?
স্মরহর দিগম্বর, স্মর প্রহরণে,
হৈমবতী-সতী-রূপ-মাধুরী দেখিয়া,
মাতিলা কি কামমদে তপ যাগ ছাড়ি?
ত্যজি ভস্ম, চন্দন কি লেপিলা দেহেতে?
ফেলি দূরে হাড়মালা, রত্ন কণ্ঠমালা
পরিলা কি নীলকণ্ঠে, নীলকণ্ঠ ভব?—
ধন্য রে অঙ্গনাকুল, বলিহারি তোরে!
প্রবেশিলা কুঞ্জবনে পৌলোমী সুন্দরী;
অলিকুল ঝঙ্কারিয়া ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ি,
মকরন্দ-গন্ধে যেন আকুল হইয়া,
বেড়িল বাসব-হৃৎ-সরসী-পদ্মিনীরে,
স্বর্গের লভিতে মুখ স্বর্গপুরী যথা
বেড়ে আসি দৈত্যদল! অদূরে সুন্দরী
মনোরম পথ এক দেখিলা সম্মুখে।
উভয় পারশে শোভে দীর্ঘ তরুরাজী,
মুকুলিত-সুবর্ণ-লতিকা-বিভূষিত,
বীর-দেহে শোভে যথা কনকের হার
চকমকি! দেবদারু—শৈলশৃঙ্গ যথা
উচ্চতর; লতাবধূ-লালসা রসাল,
রসের সাগর তরু; মৌল—মধুদ্রুম;
শোভাঞ্জন—জটাধর যথা জটাধর
কপর্দ্দী; বদরী—যার স্নিগ্ধ তলে বসি,
দ্বৈপায়ন, চিরজীবী যশঃসুধা পানে,
কহেন মধুর স্বরে, ভুবন মোহিয়া,
মহাভারতের কথা! কদম্ব সুর—
করি চুরি কামিনীর সুরভি নিশ্বাস
দিয়াছে মদন যার কুসুম-কলাপে,
কেন না মন্মথ-মন মখেন যে ধনী,
তাঁর কুচাকার ধরে সে ফুল-রতন!
অশোক—বৈদেহি,_হায়, তব শোকে, দেবি,
লোহিত বরণ আজু প্রসূন যাহার
যথা বিলাপীর আঁখি! শিমূল—বিশাল
বৃক্ষ, ক্ষত-দেহ যেন রণক্ষেত্রে রথী
শোণিতার্দ্র! সইঙ্গুদী, তপোবনবাসী
তাপস; শল্মলী; শাল; তাল, অভ্রভেদী
চূড়াধর; নারীকেল, যার স্তনচয়
মাতৃদুগ্ধসম রসে তোষে তৃষাতুরে!
গুবাক; চালিতা; জাম, সুভ্রমররূপী
ফল যার; উর্দ্ধশির তেঁতুল; কাঁঠাল,
যার ফলে স্বর্ণকণা শোভে শত শত
ধনদের গৃহে যেন! বংশ, শতচূড়,
যাহার দুহিতা বংশী, অধর পরশে,
গায় রে ললিত গীত সুমধুর স্বরে!
খর্জ্জুর, কুম্ভীরনিভ ভীষণ মুরতি,
তবু মধুরসে পূর্ণ! সতত থাকে রে
সুগুণ কুদেহে ভবে বিধির বিধানে!
তমাল—কালিন্দীকূলে যার ছায়াতলে
সরস বসন্তকালে রাধাকান্ত হরি
নাচেন যুবতী সহ! শমী—বরাঙ্গনা,
বন-জ্যোৎস্না! আমলকী—বনস্থলী-সখী;
গাম্ভারী—রোগান্তকারী যথা ধন্বন্তরি—
দেবতাকুলের বৈদ্য! আর কব কত?
চলিলা দেব-কামিনী মরাল-গামিনী;
রুণুরুণু ধ্বনি করি কিঙ্কিণী বাজিল;
শুনি সে মধুর বোল তরুদল যত,
রতিভ্রমে পুষ্পাঞ্জলি শত হস্ত হতে
বরষি, পুজিল স্তব্ধে রাঙা পা দুখানি।
কোকিল কোকিলা সহ মিলি আরম্ভিল
মদন-কীর্ত্তন-গান; চলিলা রূপসী—
যেখানে সুরাঙাপদ অর্পিলা ললনা,
কোকনদকুল ফুটি শোভিল সেখানে!
অদূরে দেখিলা দেবী অতি মনোহর
হৈম, মরকতময়, চারু সিংহাসন;
তাহার উপরে তরুশাখাদল মিলি,
আলিঙ্গিয়া পরস্পরে, প্রসারে কৌতুকে,
নবীন পল্লবছত্র, প্রবালে খচিত,
বেষ্টিত মাণিকরূপী মুকুলঝালরে;
সুপ্ত পীতাম্বর-শিরে অনন্ত যেমতি
(ফণীন্দ্র) অযুত ফণা ধরেন যতনে!
চারি দিকে ফুটে ফুল; কিংশুক, কেতকী
স্মর-প্রহরণ উভে; কেশর সুন্দর—
রতিপতি করে যারে ধরেন আদরে,
ধরেন কনকদণ্ড মহীপতি যথা;
পাটলি—মদন-তূণ, পূর্ণ ফুল-শরে;
মাধবিকা—যার পরিমল-মধু-আশে,
অনিল উম্মত্ত সদা; নবীনা_মালিকা—
কানন-আনন্দময়ী; চারু গন্ধরাজ—
গন্ধের আকর, গন্ধ-মাদন যেমতি;
চম্পক—যাহার আভা দেবী কি মানবী,
কে না লোভে ত্রিভুবনে? লোহিতলোচনা
জবা—মহিষমর্দ্দিনী আদরেন যারে;
বকুল—আকুল অলি যার সুসৌরভে;
কদম্ব—যাহার কান্তি দেখি, সুখে মজি,
রতির কুচ-যুগল গড়িলা বিধাতা;
রজনীগন্ধা—রজনী-কুন্তল-শোভিনী,
শ্বেত, তব শ্বেতভুজ যথা, শ্বেতভুজে!
কর্ণিকা—কোমল উরে যাহার বিলাসী
(তপন-তাপেতে তাপী) শিলীমুখ, সুখে
লভে সুবিরাম, যথা বিরাজেন রাজা
সুপট্ট-শয়নে; হায়, কর্ণিকা অভাগা
বরবর্ণ বৃথা যার সৌরভ বিহনে,
সতীত্ব বিহনে যথা যুবতীযৌবন!
কামিনী—যামিনী-সখী, বিশদ-বসনা
ধুতুরা যোগিনী যথা, কিন্তু রতি-দূতী,
রতি কাম সেবায় সতত ধনী রত!
পলাশ—প্রবালে গড়া কুণ্ডলের রূপে
ঝলকে যে ফুল বনস্থলী-কর্ণ-মূলে;
তিলক—ভবানী-ভালে শশিকলা যথা
সুন্দর! ঝুমুকা—যার চারু মূর্ত্তি গড়ি
সুবর্ণে, প্রমদা কর্ণে পরে মহাদরে!—
আর আর ফুল যত কে পারে বর্ণিতে?
এ সব ফুলের মাঝে দেখিলা রূপসী
শোভিছে অঙ্গনাকুল, ফুলরুচি হরি,
রূপের আভায় আলো করি বনরাজী;—
পর্ব্বতদুহিতা সবে—কনক-পুতলী,
কমলবসনা, শিল্পে কমলকিরীট,
কমল-ভূষণা, কমলায়ত-নয়না,
কমলময়ী যেমনি কমল-বাসিনী
ইন্দিরা! কাহার করে হৈম ধূপদান,
তাহে পুড়ি গন্ধরস, কুন্দুরু, অগুরু,
গন্ধামোদে আমোদিছে মুনিকুঞ্জবন,
যেন মহাব্রতে ব্রতী বসুন্ধরা-পতি
ধবল, ভূধরেশ্বর! কার হাতে শোভে
স্বর্ণথালে পাদ্য অর্ঘ্য; কেহ বা বহিছে
মণিময় পাত্রে ভরি মন্দাকিনী-বারি,
কেহ বা চন্দন, চুয়া, কস্তুরী, কেশর,
কেহ বা মদারদাম—তারাময় মালা!
মৃদঙ্গ বাজায় কেহ রঙ্গরসে ঢলি;
কোন ধনী, বীণাপাণি-গঞ্জিনী, পুলকে
ধরি বীণা, বরিষিছে সুমধুর ধ্বনি;
কামের কামিনী সমা কোন বামা ধরে
রবাব, সঙ্গীত-রস-রসিত অর্ণব;
বাজে কপিনাশ—দুঃখনাশ যার রবে;
সপ্তস্বরা, সুমন্দিরা, আর যন্ত্র যত;—
তম্বুরা—অম্বরপথে গম্ভীরে যেমতি
গরজে জীমূত, নাচাইয়া ময়ূরীরে।
দেখিয়া সতীরে, যত পার্ব্বতী যুবতী,
নৃত্য করি মহানন্দে গাইতে লাগিলা,
যথা যবে, আশ্বিন, হে মাস-বংশ-রাজা,
আন তুমি গিরি-গৃহে গিরীশ-দুহিতা
গৌরী, গিরিরাজ-রাণী মেনকা সুন্দরী,
সহ সহচরীগণ, তিতি নেত্রনীরে,
নাচেন গায়েন সুখে! হেরিয়া শচীরে
অচিয়ে পার্ব্বতীদল গীত আরম্ভিলা।
“স্বাগত, বিধুবদনা, বাসব-বাসনা!
অমরাপুরী-ঈশ্বরি! এ পর্ব্বত-দেশে
স্বাগত, ললনা, তুমি! তব দরশনে,
ধবল অচল আজি অচল হরষে।
শৈলকুল-শত্রু শত্রু, তব প্রাণপতি;
কিন্তু যূথনাথ যুঝে যূথনাথ সহ—
কেশরী কেশরী সঙ্গে যুদ্ধ-রঙ্গে রত।
আইস, হে লাবণ্যবতি, দুহিতা যেমতি,
আইসে নিজ পিত্রালয়ে নির্ভয় হৃদয়ে,
কিম্বা বিহঙ্গিনী যথা বিপদের কালে,
বহুবাহু তরু-কোলে! যাঁর অন্বেষণে
ব্যগ্র তুমি, সে রতনে পাইবা এখনি—
দেখ তব পুরন্দরে ওই সিংহাসনে!”
নীরবিলা নগবালাদল, অরবিন্দ-
ভূষণা। সম্মুখে দেবী কনক-আসনে,
নন্দনকাননে যেন, দেখিলা বাসবে।
অমনি রমণী, হেরি হৃদয়-রমণে,
চলিলা দেবেশ-পাশে সত্বর গামিনী,
প্রেম-কুতূহলে; যথা বরিষার কালে,
শৈবলিনী, বিরহ-বিধুরা, ধায় রড়ে
কল কল কলরবে সাগর উদ্দেশে,
মর্জিতে প্রেমতরঙ্গ-রঙ্গে তরঙ্গিণী।
যথা শুনি চিত্ত-বিনোদিনী বীণাধ্বনি,
উল্লাসে ফণীন্দ্র জাগে, শুনিয়া অদূরে
পৌলোমীর পদ-শব্দ—চির পরিচিত—
উঠিলেন শচীপতি শচী-সমাগমে!
উম্মীলিমা আখণ্ডল সহস্র লোচন,
যথা নিশা-অবসানে মানস-সুসরঃ
উম্মীলে কমল-ফুল; কিম্বা যথা যবে
রজনী শ্যামাঙ্গী ধনী আইসে মৃদুগতি,
খুলিয়া অযুত আঁখি গগন কৌতুকে
সে শ্যাম বদন হেরে—ভাসি প্রেম-রসে!
বাহু পসারিয়া দেব ত্রিদিবের পতি
বাঁধিলা প্রণয়পাশে চারুহাসিনীরে
যতনে, রতনাকর শশিকলা যথা,
যবে ফুল-কুল-সখী হৈমময়ী ঊষা
মুক্তাময় কুণ্ডল পরান ফুলকুলে!
“কোথা সে ত্রিদির, নাথ?”—ভাসি নেত্রনীরে
কহিতে লাগিলা শচী—“দারুণ বিধাতা
হেন বাম মোর প্রতি কিসের কারণে?
কিন্তু এবে, হে রমণ, হেরি বিধুমুখ,
পাশরিল দাসী তার পূর্ব্বদুঃখ যত!
কি ছার সে স্বর্গ? ছাই তার সুখভোগে!
এ অধীনী সুখিনী কেবল তব পাশে!
বাঁধিলে শৈবলবৃন্দ সরের শরীর,
নলিনী কি ছাড়ে তারে? নিদাঘ যদ্যপি
শুখায় সে জল, তবে নলিনীও মরে!
আমি হে তোমারি, দেব!”—কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
নীরবিলা চন্দ্রাননা অশ্রুময় আঁখি;—
চুম্বিলা সে সাশ্রু আঁখি দেব অসুরারি
সোহাগে,—চুম্বয়ে যথা মলয়-অনিল
উজ্জ্বল শিশির-বিন্দু কমল-লোচনে!
“তোমারে পাইলে, প্রিয়ে, স্বর্গের বিরহ
দুরূহ কি ভাবে কভু তোমার কিঙ্কর?
তুমি যথা, স্বর্গ তথা!”—কহিলা সুস্বরে,
বাসব, হরষে যথা গরজে কেশরী
কৃশোদর, হেরি বীর পর্ব্বত-কন্দরে
কেশরিণী কামিনীরে;—কহিলা সুমতি,—
“তুমি যথা, স্বর্গ তথা, ত্রিদিবের দেবি!
কিন্তু, প্রিয়ে, কহ এবে কুশল বারতা!
কোথা জলনাথ? কোথা অলকার পতি?
কোথা হৈমবতীসুত তারকসূদন,
শমন, পবন, আর যত দেব-নেতা?
কোথা চিত্ররথ? কহ, কেমনে জানিলা
ধবল আশ্রয়ে আমি আশ্রয়ী, সুন্দরি?”
উত্তর করিলা দেবী পুলোম-দুহিতা—
মৃগাক্ষী, বিম্ব-অধরা, পীনপয়োধর।
কৃশোদরী;—“মম ভাগ্যে, প্রাণ সখা, আজি
দেখা মোর শূন্য মার্গে স্বপ্নদেবী সহ!
পুষ্করের পৃষ্ঠে বসি, সৌদামিনী যেন,
ভ্রমিতেছিনু এ বিশ্ব অনাথা হইয়া,
স্বপ্ন মোরে দিল, নাথ, তোমার বারতা!
সমরে বিমুখ, হায়, অমরের সেনা,
ব্রহ্ম-লোকে স্মরে তোমা; চল, দেবপতি,
অনতিবিলম্বে, নাথ, চল, মোর সাথে!”
শুনি ইন্দ্রাণীর বাণী, দেবেন্দ্র অমনি
স্মরিলা বিমানবরে; গম্ভীর নিনাদে
আইল রথ, তেজঃপুঞ্জ, সে নিকুঞ্জবনে।
বসিলা দেবদম্পতী পদ্মাসনোপরে।
উঠিল আকাশে গর্জ্জি স্বর্ণ ব্যোমযান,
আলো করি নভস্তল, বৈনতেয় যথা
সুধানিধি সহ সুধা বহি সযতনে।
ইতি শ্রীতিলোত্তমাসম্ভাবে কাব্যে ধবল-শিখরো নাম
প্রথম মর্গ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন