আমার দুর্গা – ২.৫

বেশ কয়েকদিন পরের ঘটনা। ছুটির দিন। দুর্গা একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠে। চোখে-মুখে জল দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া চাই তার। অন্যান্য দিন এত সময় থাকে না। কোনোক্রমে হেডিংগুলো দেখে নিয়ে পড়তে বসতে হয়। তারপর স্নান-খাওয়া সেরে ক্লাসে। তাই ছুটির দিনগুলোতে খবরের কাগজ কাছ ছাড়া করতে চায় না। মেসের অন্যরা রেগে যায়।

মৈত্রী বলে—একা খবরের কাগজ আঁকড়ে বসে থাকলে হবে? অন্যরা পড়বে না?

দুর্গা বলে—তুই তো সাহিত্যের লোক।

তো?

খবরের কাগজ-টাগজ পড়ে তোর কী হবে?

কী পড়ব?

গল্পের বই গিয়ে পড়।

খবরের কাগজে কি পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পাতার পর পাতা ছাপা হয়?

সবই তো পরিবেশ সংক্রান্ত আর সব কিছুর সঙ্গে রয়েছে বিজ্ঞান।

তোরা যতই বিজ্ঞান বলিস, ইতিহাস কিংবা ভূগোল বলিস না কেন, সাহিত্য ছাড়া সব মরুভূমি, সব ম্যাড়ম্যাড়ে।

যারা বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করছে, তাদের হৃদয় সব পাষাণ হয়ে গেছে?

আমার কথার অপব্যাখ্যা হচ্ছে।

ঠিক আছে, এত বিতর্কে কাজ নেই। এই নে, খবরের কাগজ পড়।

এই বলে দুর্গা উঠে পড়তে বসার আয়োজন করছিল, এমন সময় আরতিদি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল—দুর্গাদি ওই মেসে একটা বড়ো কান্ড ঘটে গেছে।

আরতিদি দুর্গাদের মেসে প্রায় বছর চারেক ধরে রান্না করছে। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশই হবে। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নিজেদের পরিবারের মতো সকলের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে। কারুর চা দরকার, কারুর ওমলেট, কারুর আলুভাজা, আরতিদি হাসিমুখে সকলের সব আবদার পূরণ করার চেষ্টা করে। কোনোদিন বিরক্ত হয় না। দুর্গারাও এখানে-ওখানে গেলে আরতিদির জন্য এটা-ওটা নিয়ে আসে।

আরতিদির এহেন গম্ভীর আতঙ্কগ্রস্ত মুখ দেখে দুর্গা বলল—কোন মেসের কথা বলছ?

—সামনের মোড়ের কাছে, তিনতলা বাড়ি, মেয়েদের মেস। কী যেন নাম…ঠিক মনে পড়ছে না।

বলাকা মেস?

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ দুর্গাদি।

ওই মেসে তো অনিন্দিতা, রূপা, ঝিমলিরা থাকে। কী হয়েছে ওখানে?

ওই মেসে বোধহয় কোনো একটি মেয়ে সুইসাইড করেছে। পুলিশ এসেছে।

কী বলছ কী তুমি! কে সুইসাইড করল?

তা বলতে পারব না দিদি। বডিটা দেখিনি। পুলিশ কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।

কী বলছ তুমি?

হ্যাঁগো দিদি। আমি এতক্ষণ ওইখানে দাঁড়িয়েছিলাম। তাই আজ এত দেরি হল। মেসের সব মেয়েরা এসে হাজির, ইলা, জয়ন্তী, মৈত্রীরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। মৈত্রী জিজ্ঞেস করল—তুমি কারুর নাম শুনেছ? মানে কে সুইসাইড করল সেরকম কিছু?

অনিন্দিতা না কী যেন নাম।

দুর্গা বিস্ময়ে-আতঙ্কে-উদ্বেগে বলল—অনিন্দিতা!

তাই তো শুনলাম। তোমরা যাওগে, দেখে এসো না।

দুর্গা বলল—অনিন্দিতা এই কান্ড করে বসল। কাল সকালেও ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তেমন কিছু বোঝা যায়নি। ও তো স্বাভাবিক কথাই বলল।

মৈত্রী বলল—ও তো আমার ক্লাসমেট। কালকে ও ডিপার্টমেন্টেই ছিল। সারাক্ষণ গল্পই করল। তবে কয়েকদিন ধরে ও একটু মনমরাই ছিল।

ও আসলে চাপা স্বভাবের। ভেতরের সমস্যাগুলো বলত না।

তা ঠিক। বাইরে থেকে দেখে সবসময় সব বোঝা যায় না।

হয়তো এমন কিছু ঘটনা আছে যা কাউকে বলতে পারেনি।

সে থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য সুইসাইড করতে হবে?

হয়তো অন্য কোনো উপায় ছিল না।

দেখ, পৃথিবীতে এমন কোনো ঘটনা থাকতে পারে না, যার জন্য সুইসাইড করতে হবে।

সকলে পারে না। আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে সবাই বেঁচে থাকতে পারে না।

ও তো চুরি-ডাকাতি বা খুন করেনি!

কিছু না জেনে কিছু বলা যাবে না।

রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে লোকজন যাচ্ছে, আসছে। সামনের পেয়ারা গাছে কয়েকটা কাক কা-কা করে ডেকে চলেছে। পাঁচিল ঘেঁসা কৃষ্ণচূড়া গাছটা পাতা নেড়ে হা-হুতাশ করছে।

আরতিদি জিজ্ঞেস করল—আজ কী রান্না হবে?

ইলা বলল—দিদি, আজ মাংস হবে। তুমি খেয়ে যাবে।

একটু পাঁপড় ভাজি?

পাঁপড় তো নেই। তাহলে সামনের মুদিখানা থেকে নিয়ে এসো।

একটু পরেই আনছি।

আরতিদি রান্নাঘরে চলে যেতেই দুর্গা মৈত্রীকে বলল—যাবি নাকি ওই মেসে?

যেতে তো ইচ্ছে করছে। কিন্তু টিউশন আছে।

সকাল বেলা টিউশন তো তোর থাকে না।

সকাল বেলা নয়, দশটা নাগাদ যাব, আজকে ছুটি আছে বলে বিকেলেরটা এবেলা করে দিচ্ছি। ওবেলা আর বের হব না।

তাহলে এখন যাবি?

তাই চল।

ইলা বলল—আমিও যাব।

দুর্গারা যখন ওখানে পৌঁছোলো তখন কয়েক-শো মানুষের জটলা। বাইরে পুলিশের দুটো জিপ দাঁড়িয়ে। পুলিশের একজন লোক কাকে যেন একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে। একটু পরেই একটা অ্যাম্বুলেন্স এল।

দুর্গারা ভেতরে ঢুকতে গেলেই পুলিশ বাধা দেয়। ‘ওখানে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, আপনারা যাবেন না।’

দুর্গা জানতে চায়—অনিন্দিতা কি এখনও বেঁচে আছে?

আপনি ওঁকে চেনেন নাকি?

ও তো আমার বন্ধু।

হ্যাঁ, এখনও বেঁচে আছে।

তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?

ব্যবস্থা হচ্ছে।

আপনারা সবচেয়ে আগে ওকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করেছেন? প্রতিটা সেকেণ্ড নষ্ট করলে বিপদ বাড়বে। আপনাদের মধ্যে সেই তৎপরতা কোথায়?

দেখুন, উনি আপনাদের বন্ধু হতে পারেন। কিন্তু মোটেই ভালো মেয়ে ছিলেন না। এখানে আসার পর যা শুনছি…।

কী শুনছেন?

একটা ছেলের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েছিলেন। ছেলেটি কোনো দায় নিতে না চেয়ে কেটে পড়েছে। এখন নিজের পাপে নিজে মর।

তাই বলে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না?

এইসব মানুষের বেঁচে না থাকাই ভালো।

কী বলছেন আপনি? মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচানোই তো মানুষের ধর্ম।

আমরা এইসব কেস ঘেঁটে ঘেঁটে বিরক্ত। ভদ্র পোশাক পরে দিনের বেলায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর রাতে এদের নিশাচর জন্তুর রূপ বেরিয়ে পড়ে।

না অফিসার, ও কিন্তু তেমন মেয়ে নয়। কোনো কারণে হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছে, তার জন্য পরে ওর শাস্তি হোক। মরে গেলে তার ডেডবডি নিয়ে কাঁটাছেড়া করে কী লাভ?

আমরা সেই চেষ্টাই করছি। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। আপনারা দু-একজন আমার সঙ্গে আসুন। আমরা এখুনি ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।

আমি যাব।

মৈত্রী আর ইলাও ভেতরে গেল।

একটা খাটের ওপর অনিন্দিতাকে শোয়ানো হয়েছে। গলাটা শুধু ফুলে গেছে। আর সব স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে অনিন্দিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে সে আজ বড়ো ক্লান্ত, অবসন্ন, তাই সে আজ বিশ্রাম নিচ্ছে।

ঝিমলি বলল—ভোর বেলা আমি বাথরুম করতে গিয়ে দেখি অনিন্দিতাদির ঘরে আলো জ্বলছে। দরজাটা ভেজানো ছিল। আমি ভাবলাম পড়তে পড়তে ও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। লাইটের সুইচ অফ করতে ভুলে গেছে। দরজা ঠেলে দেখলাম ও ডায়েরিতে কী যেন লিখছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম—অনিন্দিতাদি, তুমি এখনও ঘুমোওনি?

না, এবার ঘুমোব। গভীর ঘুমে।

তুমি কি সারারাত ধরে পড়াশোনা করেছ?

আমার কথার কোনো উত্তর দিল না, বলল—কাল সকালে রান্নার দিদি আসবে না। সকলকে বলে দিস।

তুমি তো আছ।

আমি যদি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ি, তাই।

একসময় তোমার ঘুম তো ভাঙবে।

তা কী বলা যায়। নাও ভাঙতে পারে।

আমি ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিয়ে দরজাটা টেনে চলে গেলাম। সকাল বেলা উঠে দেখি সিলিং ফ্যান থেকে ওড়না দিয়ে…।

দুর্গা বলল—তার মানে বেশিক্ষণ হয়নি। সঙ্গেসঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলি না কেন?

ঝিমলি বলল—তখন ভয়ে আমাদের হাত-পা কাঁপছিল। কী করব বুঝতে না পেরে পুলিশে খবর দিই।

তা সবমিলিয়ে কতক্ষণ হবে?

আধ ঘণ্টা বা তার একটু বেশি হবে।

তাহলে তো এখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে একটা সম্ভাবনা থাকছে।

পুলিশের দু-জন অফিসার মহিলা কনস্টেবল আর মেসের মেয়েরা ধরাধরি করে ওকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলল। তারপর বলল—আপনাদের মধ্যে কে কে সঙ্গে যাবেন?

দুর্গা বলল—আমি যাব।

মৈত্রী আর ইলা দুর্গাকে একদিকে ডেকে নিয়ে বলল—তুই এসব ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াচ্ছিস কেন?

কী বলছিস? অনিন্দিতা আমাদের বন্ধু।

ঠিক আছে। কিন্তু এখানে আমাদের বাড়ি নয়। নেহাত পড়াশোনার জন্য এখানে থাকা। এরকম অহেতুক ঝামেলার মধ্যে জড়ানো ঠিক নয়। তা ছাড়া ওদের মেসের মেয়েরা আছে। তুই আমাদের সঙ্গে ফিরে চল। তোকে আমরা কোনো ঝামেলায় জড়াতে দেব না।

স্যরি। আমি তোদের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।

তুই ভুল করছিস দুর্গা।

ভুল আমি নই, তোরা করছিস।

অবশেষে দুর্গা আর ঝিমলি অ্যাম্বুলেন্সে চেপে হাসপাতালের দিকে রওনা হল।

ঝিমলি বলল—দুর্গাদি, অনিন্দিতাদি একটা সুইসাইড নোট লিখে গেছে।

সুইসাইড নোট?

হ্যাঁ, দু-পাতার একটা সুইসাইড নোট? ডায়েরিতেও অনেক কিছু লেখা আছে।

ওগুলো কোথায়?

পুলিশ ও-দুটো নিয়ে গেছে।

কী লিখেছে ওতে?

অভিষেক দাস বলে একটা ছেলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল। অভিষেকদাকে অনিন্দিতাদি খুব ভালোবাসত। অভিষেকদা সম্প্রতি অনিন্দিতাদিকে আজেবাজে কথা বলে অপমান করেছে। অনিন্দিতাদি বোধহয় তা মেনে নিতে পারেনি।

অভিষেক ছেলেটি কে? বাড়ি কোথায়?

ওর বাড়ির কাছে, বারাসাতে। ম্যানেজমেন্ট পড়ে কয়েকমাস হল চাকরি পেয়েছে।

তোরা সব জানতিস?

সবাই না, শুধু আমি জানতাম।

অভিষেক কি এখানে আসত?

মাঝে মাঝে আসত। দু-একবার একান্তে ওরা সময় কাটিয়েছে।

মেয়েদের মেসে এটা তো হয় না। তোরা বাধা দিসনি?

দু-এক ঘণ্টা গল্প করে অভিষেকদা চলে যেত।

এটা ঠিক করিসনি। একজন ভুল করছে, আর তোরা কিছু বলিসনি।

আমার মনে হয় অন্য ব্যাপারও আছে।

অন্য ব্যাপার মানে?

ওরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেত। দু-তিনদিন পর ফিরত। জিজ্ঞেস করলেই বলত—বাড়ি গেছিলাম।

কী সর্বনাশ! অনিন্দিতাকে দেখে তো কোনোদিন এমন মনে হয়নি। কোনোদিন এসব বলেওনি।

এসব কথা কি কেউ ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়ায়?

অনেক সময় বোঝা যায়।

অনেক সময় বোঝা যায়ও না।

ছেলেটি এখন মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে কেন?

বড়োলোকের ছেলে। দু-দিন ফুর্তি করল, ঘুরে বেড়াল। তারপর অন্য গাছে, অন্য বাসায় গিয়ে বসল।

অনিন্দিতা বুঝতে পারেনি বোধ হয়।

ও খুব সহজ সরল, নরম স্বভাবের মেয়ে।

ও আগে ভালো হয়ে উঠুক, তারপর ছেলেটিকে মজা দেখাব।

অনিন্দিতাদি বাঁচবে তো?

বাঁচবে বাঁচবে। ছেলেদের ভুলের জন্য অনন্তকাল ধরে শুধু মেয়েরাই মরবে কেন? এবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে।

ভগবান যেন অনিন্দিতাদিকে বাঁচিয়ে দেয়।

দুর্গারা হাসপাতালে পৌঁছোতেই হাসপাতালের কর্মচারীরা দৌড়ে এসে স্ট্রেচারে করে ওকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের যিনি দায়িত্বে ছিলেন, সেই মেডিক্যাল সুপার দুর্গাদের বললেন—ডাক্তারবাবু এখন নেই, তা ছাড়া রক্ত লাগতে পারে, অক্সিজেন দিতে হবে।

দুর্গা বলল—ডাক্তার নেই, ডাক্তার ডাকুন। রক্ত, অক্সিজেন যা লাগবে চিকিৎসা করার জন্য তাই দেবেন। এটা আমাদের বলছেন কেন?

এ ধরনের কেসে ডাক্তারবাবুরা সহজে হাত দিতে চান না।

এ ধরনের কেস মানে? আপনাদের কাজ হচ্ছে মানুষের চিকিৎসা করে প্রাণ বাঁচানো। এধরন-ওধরন বাছার কাজ তো আপনাদের নয়।

আপনি একটু বেশি বোঝেন।

বেশি না বুঝলেও একদম বুঝি না মনে করবেন না।

আপনারা যান, দেখছি।

আমরা চলে যাব? কোথায় চলে যাব?

বাড়ি যান। বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আসুন।

বিকেলে কি ডেডবডি নিতে আসব?

একটু দূরে পুলিশ অফিসারটি দাঁড়িয়েছিলেন। তর্কবিতর্ক শুনে তিনি এগিয়ে এলেন। সুপারকে বললেন—সব কাজ ফেলে এখুনি চিকিৎসা শুরু করুন। ডাক্তার ডাকুন। দরকার হলে মেডিক্যাল বোর্ড বসান। ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। গাফিলতি হলে আপনি রক্ষা পাবেন না, আর আপনার হাসপাতালও অক্ষত থাকবে না। অকারণে চাকরিতে একটা বদনাম হবে।

মেডিক্যাল সুপার বললেন—আপনি তো সব জানেন। এখানে তেমন কোনো ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই। কেউ কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করে না। আমার হয়েছে যত জ্বালা। বিষ খাওয়া, সাপে কাটা, গলায় দড়ি দেওয়া সব রোগীদের চিকিৎসার ভার আমার ওপর। তারপর কে কখন এল, গেল, রোগীদের খাওয়ার মান ঠিক থাকল কিনা, হাসপাতালের ওষুধের তারিখ পেরিয়ে গেছে কিনা—এসব কি আমি নিজে গিয়ে দেখব, না করব?

আপনি এই কেসটা নিজে দেখুন প্লিজ।

ঠিক আছে দেখছি।

দুর্গাদের মুখে হাসি দেখা দিল ও পুলিশ অফিসারকে বলল—ধন্যবাদ, স্যার।

আপনারা থাকুন, আমি বিকেলের দিকে একবার আসব। তখন কথা হবে।—এই বলে ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

মেডিক্যাল অফিসার বললেন—আপনারা থাকবেন। কখন কী দরকার হয়।

দুর্গা বলল—আমরা আছি। আপনি নিশ্চিন্তে চিকিৎসা করুন স্যার।

মেডিক্যাল সুপার চলে যাওয়ার পর দুর্গা ঝিমলিকে বলল—দেখলি তো কেমন চুপি চুপি চলে গেল। ফোঁস না তুললে কাজ হয় না দেখছি।

ঝিমলি বলল—আমরা না থাকলে কী হত বল তো?

কত অনিন্দিতা এইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।

তবে আগের চেয়ে চিকিৎসাব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

আরও উন্নতি হবে।

জীবনের আলো-আঁধারি যুদ্ধে অন্ধকার সরিয়ে আলো আসে। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এক মুমূর্ষু মানুষ বেঁচে ওঠে। মৃতসঞ্জীবনী সুধার মতো মানুষের পরশ পেয়ে সে আবার মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ায়।

যমে-মানুষে লড়াই চলল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত অস্ত্র একের পর এক প্রয়োগ করে চিকিৎসকেরা প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকল। দুর্গা-ঝিমলিরা ঈশ্বরের কাছে বারবার অনিন্দিতার জীবনভিক্ষা করতে লাগল। অস্থিরচিত্তে পায়চারি করতে করতে তারা একে অপরের দিকে তাকায়।

জল থেকে বাষ্প হলে সে ওপরের দিকে উঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বেই, তাকে বদ্ধ জায়গার মধ্যে আটকে রাখা যায় না। অনিন্দিতার এই ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, সাংবাদিক ভিড় জমাতে থাকে। কিছু উৎসুক মানুষ নেহাতই কৌতূহল মেটানোর জন্য এখানে হাজির।

ডাক্তারবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে দুর্গা বলল—ডাক্তারবাবু, রোগীর অবস্থা কেমন?

জ্ঞান ফিরেছে। আরও কয়েক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তবে…।

কী ডাক্তারবাবু?

কতগুলো পরীক্ষা না-করালে বোঝা যাচ্ছে না।

ভয়ের কিছু?

ভয় নয়, তবে চিন্তা কিছুটা হচ্ছে।

একটু খুলে বলবেন?

আমাদের সন্দেহ ওনার স্টমাকে একটি টিউমার হয়েছে।

দুর্গা আঁতকে উঠে বলল—কী!

ঝিমলির গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। ও ঘন ঘন ঢোক গিলতে লাগল।

ডাক্তারবাবু ওদের ফ্যাকাসে মুখ দেখে বললেন—এত চিন্তার কিছু নেই। আগে ও সুস্থ হয়ে উঠুক। তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে।

ঝিমলি বলল—স্যার, ও বাঁচবে তো?

দুর্গা বলল—কীসব অলক্ষুণে কথা বলছিস? ওকে তো বাঁচতেই হবে।

ডাক্তারবাবু অভয় দিয়ে বললেন—চিন্তা করবেন না, আমরা তো আছি।

দুর্গা বলল—আমরা কি ওর সঙ্গে দেখা করতে পারি?

আজ নয়, কাল দেখা করতে পারবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ স্যার।

ডাক্তারবাবু সুপারের ঘরের দিকে চলে যেতেই ঝিমলি বলল—অনিন্দিতাদির বাড়ির লোক তো এখনও এল না।

আসবে, আসবে। তাদের বাড়ি কি এখানে? বারাসাত থেকে আসতে সময় লাগবে না? তা ছাড়া কে, কোথায় কী অবস্থায় ছিল তা তো ঠিক নেই। খবর পাওয়ার পর একটু সময় লাগবেই।

—পুলিশ অফিসারটার কী যেন নাম?

তন্ময়বাবু—তন্ময় ভট্টাচার্য।

উনি খবর পাঠিয়েছেন তো?

এতটা দায়িত্বহীন বলে তো মনে হল না।

তোমাকে আড়চোখে মাঝে মাঝে দেখছিল।

এসময় বাজে ইয়ার্কি ছাড়।

ইয়ার্কি নয়, সত্যি বলছি।

মেয়েরা পুরুষমানুষদের দিকে তাকালে দোষ হয় না, পুরুষরা মেয়েদের দিকে তাকালেই দোষ?

দোষের তো বলিনি। তোমার দিকে বারে বারে তাকাচ্ছিল, এই যা।

বলতে বলতে তন্ময়বাবু এসে হাজির। লম্বা, স্মার্ট, হ্যাণ্ডসাম। একনিষ্ঠ এবং চাকরিতে কর্তব্যপরায়ণ। হাসিখুশি মিষ্টি ব্যবহার। ওঁকে সমীহ করতেই হবে। আবার যারা অপরাধ করে থাকেন, তারা এই পুলিশ অফিসারের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন।

উনি স্মিতহাস্যে গটগট করে দুর্গার দিকে এগিয়ে এসে বললেন—ম্যাডাম, উনি কেমন আছেন?

ডক্টর তো বললেন, জ্ঞান ফিরেছে, তবে কালকের আগে দেখা করা যাবে না।

জ্ঞান ফিরেছে, গুড নিউজ। আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছি।

স্যার।

কিছু বলবেন?

অনিন্দিতাদের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন?

সে তো ওবেলার কথা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো ওঁর বাড়ির লোক এসে পড়বেন।

স্যার, ইনভেস্টিগেশনে কিছু বোঝা গেল?

এখনই কিছু বলা যাবে না, পরে এবিষয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব।

ফ্রাসট্রেশন?

ফ্রাসট্রেশন তো আছেই। তবে তার কারণটা কী আমরা খতিয়ে দেখছি।

এই বলে উনি মেডিক্যাল সুপারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

ঝিমলি বলল—কিছুদিন ধরে অনিন্দিতাদি একটু বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। ও যখন একা থাকত, বোঝা যেত কিছু একটা ভাবছে। জিজ্ঞেস করলেই স্বাভাবিক হয়েই উত্তর দিত—‘কই, কিছু ভাবছি না তো।’

এইখানে তো সমস্যা। কাউকে কিছু না বললে কী করে অন্যরা তা বুঝবে।

ও কি টিউমারের কথাটা জানত?

ডাক্তারবাবু নিজেই নিশ্চিত নন, ও কী করে জানবে?

ও হয়তো আগে ডাক্তার দেখিয়েছে।

অসুখ করলে ডাক্তার দেখাতে হবে। তার জন্য সুইসাইড করতে যাবে কেন?

ওর অন্য সমস্যা থাকতে পারে।

ফ্রাসট্রেশন অন্য যেকোনো কঠিন অসুখের চেয়েও মারাত্মক।

আর একটু হলে কী হত বল তো!

‘One false step is ne’er retrieved.’

বিকেলের গড়িমসি রোদ হাসপাতাল লাগোয়া মাঠে এসে পড়েছে। তার রক্তিম বিচ্ছুরণে বিবর্ণতা কাটিয়ে পশ্চিম আকাশ জুড়ে স্মিত হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদল কিশোর মাঠটির বিভিন্নপ্রান্তে ক্রিকেট, ভলিবল খেলছে। বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোক মাঠের এক কোণে বসে আড্ডায় মগ্ন। কখনো গুরুগম্ভীর, কখনো হাসি-ঠাট্টায় তাদের আলোচনা জমে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতবর্ষের সাধারণ নির্বাচন, দেশের-রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাশের বাড়ির নাতনির বয়সী রুমার কোনো একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া—সবই তাদের আলোচনায় উঠে এসেছে বারবার।

নিমগাছে বসে কয়েকটি পাখি লাফাচ্ছে, খেলছে। কয়েকটি হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়ে একটি ঘুড়িকে বারবার ওড়ানোর চেষ্টা করছে; বারবার ওটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। কয়েকটি রিকশা হর্ন দিতে দিতে আসছে, যাচ্ছে।

দুটো রিকশা থেকে তিন জন নামলেন। ওঁরা হাসপাতালে ঢুকে অনুসন্ধান অফিসে খোঁজ নিতেই ওখান থেকে আমাদের দেখিয়ে দিল।

অনিন্দিতার বাবা, মা আর কাকা এসেছেন। চোখে-মুখে একরাশ উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা। ওর মা কেঁদেই চলেছেন। ওর বাবা এসে বললেন—তোমরা সব অনিন্দিতার বন্ধু?

দুর্গা বলল—আমি পাশের মেসে থাকি।

ঝিমলি বলল—আমি ওর মেসেই থাকি।

ওর মা বললেন—কেমন আছে ও?

দুর্গা বলল—ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একটু আগে কথা হয়েছে। বললেন—ওর জ্ঞান ফিরেছে।

কী হয়েছিল, তোমরা কিছু জান?

আমি তো খবর পেয়েই এসেছি।

তোমরা নিশ্চয়ই জানতে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই ও এমন করেছে। আগে তো এমন ছিল না।

ঝিমলি বলল—কাকে কী বলছেন মাসিমা? দুর্গাদির জন্যই আপনার মেয়ে এ-যাত্রা বেঁচে গেল।

অনিন্দিতার কাকা বললেন—তোমরা কিছু মনে কোরো না। বউদির মাথার ঠিক নেই। কী বলতে কী বলছে।

দুর্গা বলল—আপনারা বরং ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলুন। আপনারা এসে গেছেন। আমরা এবার চলি। সারাদিন বিশ্রাম নেওয়া হয়নি।

তোমরা চলে যাবে?

চিন্তা করবেন না। যখনই প্রয়োজন হবে, খবর দিলে চলে আসব।

ধন্যবাদ দিয়ে তোমাদেরকে ছোটো করব না। তোমাদের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

এতে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই কাকু। এটা করতেই হয়। স্বার্থপর টিপিক্যাল বাঙালি হয়ে উঠতে পারিনি।

ওদের থেকে বিদায় নিয়ে দুর্গা আর ঝিমলি মেসে ফেরে। রিকশায় ফেরার সময় ঝিমলি বলে—দেখলে তো অনিন্দিতার মা কী বললেন?

দুর্গা বলে—এসময় ওসব গায়ে মাখতে নেই।

তাই বলে একথা বলবে? নিজের মেয়ে সুইসাইড করতে গেল, আর দোষ হল অন্যদের?

অপত্যস্নেহে অন্ধ হয়ে এসব কথা বলেছেন। ওর বাবা বা কাকা তো খুব ভালো ব্যবহার করল।

ওসব বাইরের কথা। কাকিমা উলটোপালটা বলেছেন, তাই উনি ম্যানেজ করলেন।

যে যাই বলুক, নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার থাকলেই মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।

ওরা যে যার মেসে ফিরে যায়।

গোধূলির রহস্যময় আলো-আঁধারি, স্বপ্ন আর বাস্তবের আকাশসম ব্যবধান, স্বার্থ আর কর্তব্যের দোদুল্যমানতা, জীবন আর মরণের দড়ি টানাটানি। এসবেরই মাঝে সন্ধ্যে আসে, রাত কেটে ভোর হয়, নতুন দিনের পথ চলা শুরু হয়।

দুর্গা বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ, রাস্তার ওপারের ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ঘরে ঘরে সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন