পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার বেশ বেলা হয়ে গেল। সূর্যের সোনাঝরা রোদ জানালা দিয়ে চুঁইয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। রাতের নীরবতা কাটিয়ে সিঙ্গাপুর সিটি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবার কেনা-বেচার প্রমোদনগরী দৈনন্দিন পসরা সাজিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি উঠে চোখে-মুখে জল দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি। আটটা বেজে দশ। এখন কী হবে? ন-টায় দুর্গার বাসায় পৌঁছোনোর কথা। নিজের ওপর নিজের রাগ হয়। কালকে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলে ঠিক হত।
আমি ব্রাশ নিয়ে দু-বার এদিক-ওদিক করে মুখ ধুতে যাচ্ছি; সৌরাংশু বলল—দাদা, তোমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল যে বেশ? কাল ঠিকমতো ঘুম হয়েছে তো?
আমি কিছু না বলে মুখ ধুয়ে বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছি, সৌরাংশু আবার বলল—দাদা কিছু বললে না যে?
হয়েছে, খুব ভালো ঘুম হয়েছে। এখন স্নান সেরে বেরোতে হবে।
তুমি এত সকালে কোথায় বের হবে?
তোর দুর্গাদির কাছে?
দুর্গাদির কাছে!
হ্যাঁ রে বোকা, ওর ওখানে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সবই করার কথা।
কই আমাকে তো বলনি?
সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি।
আমি যে এত বাজার করলাম, তার কী হবে?
কাল হবে?
তুমি আগে বললে আজ বের হতাম না।
তুইও আমার সঙ্গে যাবি।
আমার কাজ আছে।
আজ অষ্টমী। অষ্টমীতে আবার কী কাজ?
এটা তোমার কলকাতা নয়।
অতসব বুঝি না, দুর্গা বলেছে তোকেও যেতে। আমি তোকে জানিয়ে দিলাম।
এই বলে আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সৌরাংশুর মুখটা তখনও বেশ ভার হয়ে আছে। আমাকে বলল—কখন যেতে হবে শুনি?
ন-টায় পৌঁছোতে হবে।
এখনই তো সাড়ে আটটা বাজে।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে না বাবা।
বাবা!
তবে কি বলব—বাবাজীবন?
সৌরাংশু অভিমানের সুরে বলে—কাজটা তুমি ঠিক করলে না প্রিয়দা।
আমি নাক, কান মুলে বললাম—এই দেখো আমি কান মুলছি, নাক মুলছি, আমার ভুল হয়ে গেছে, আমায় ক্ষমা করে দে।
আমার বলার ভঙ্গিমায় সৌরাংশু হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকে গেল।
এতক্ষণে পরিবেশ বেশ খানিকটা স্বাভাবিক হল। অষ্টমীর সকাল। দূর থেকে ঢাকের গুড়গুড় শব্দ ভেসে আসে। বোধহয় কোনো সিডি চালানো হয়েছে। দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা। তবু বাঙালির এই সেরা উৎসবে ঢাকের শব্দ না হলে কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে।
আমি ভাবছি কী রঙের শার্ট পরব। দুর্গা কি রঙের শার্ট পছন্দ করে? ওর পছন্দের কথা মনে করতে গিয়ে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা তখন পিএইচ. ডি. করছিলাম। পুজোতে বাড়িতে না গিয়ে কলকাতায় থেকে গেছিলাম। কারণটা ঠিক মনে পড়ছে না। আমরা ঠিক করলাম—দুপুর বেলা খাওয়া-দাওয়া করেই ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়ব। সন্ধ্যাবেলা বন্ধুবান্ধবরা এসে গেলে দুর্গাকে নিয়ে আলাদা করে বেরিয়ে পড়াটা ভালো দেখায় না। সেই মতো আমি একটা চকলেট রঙের শার্ট আর অ্যাশ রঙের প্যান্ট পরে স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের উপর অপেক্ষা করছিলাম।
দুর্গা আমাকে দেখে বলছিল—তোমাকে দারুণ হ্যাণ্ডসাম দেখাচ্ছে। এই রঙটা আমার ভালো লাগে।
সৌরাংশু বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল—প্রিয়দা, তুমি এখনও তৈরি হওনি?
হ্যাঁ, এখুনি হচ্ছি।
একটা চকলেট কালারের গেঞ্জি ছিল। ওটাই পরলাম। ব্রাউন কালারের প্যান্টটা গলিয়ে দিয়ে বললাম—কই, আমি তৈরি, তোর কত দূর?
আমার এখুনি হয়ে যাবে।
এমন সময় সৌরাংশুর ফোনটা রিন রিন করে বেজে উঠল। সৌরাংশু বলল—দাদা, বউদির ফোন।
এই সময় আবার ফোন। মনে মনে বিরক্ত হলেও সৌরাংশুর কাছে তা প্রকাশ করলাম না। বললাম—দে, দে, সকালে ফোন করাই হয়নি। ঘুম থেকে উঠতেই তো বেলা হয়ে গেল।
সৌরাংশুর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বললাম—গুড মর্নিং ইশিতা।
গুড মর্নিং না বলে গুড নুন বলো।
তুমি রেগে গেছ না?
রাগ হবে না, ন-টা বাজতে চলল, অথচ তোমার কোনো খবর নেই।
আসলে ঘুম থেকে একটু আগেই উঠলাম। হাত-মুখ ধুয়ে তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
শুনে খুশি হলাম।
তুমি এভাবে বলছ কেন?
কীভাবে বলব?
তুমি কখন কনফারেন্সে বের হবে?
দশটা নাগাদ। তোমার আজকে কি প্রোগ্রাম আছে?
ওই তো একটু পরেই বের হব।
কোথায়?
সৌরাংশুর এক পরিচিত লোকের বাড়িতে। ওইখানে খাওয়া-দাওয়া হবে।
ভদ্রলোক না ভদ্রমহিলা?
সৌরাংশু সম্পর্কে এসব বলতে নেই।
সৌরাংশু সম্পর্কে বলছি না।
তবে?
তোমার সম্পর্কে বলছি।
কি যে বল তুমি?
দেখো, তুমি ওদেশে গিয়ে কোনো বিদেশিনীর পাল্লায় পড়বে না।
সৌরাংশু কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছে।
এখন রাখছি, দুটোয় আমার কনফারেন্স শেষ হবে। তখন ফোন করব।
সাবধানে থেকো, টেক কেয়ার।
ফোনটা রেখে সৌরাংশুর দিকে তাকাতে ও বলল—কী হল, বউদির কাছে ধমক খেয়েছ?
ইশিতা আমাকে ধমক দেবে? কী যে বলিস? ও খুব ভালো মেয়ে। তবে হ্যাঁ, আমার বিষয়ে একটু বেশি পজেসিভ।
এটাই তো স্বাভাবিক, দাদা।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বুকটা উত্তেজনায় একটু একটু করে কাঁপছিল। দুর্গার কাছে কতটা সহজ হতে পারব! ও কি আগের মতোই আমার সঙ্গে আচরণ করবে? নাকি দূরে থেকে আমাকে সৌজন্য দেখিয়েই ফিরিয়ে দেবে? ও আমাকে অপমান করবে না তো?
পরক্ষণেই ভাবলাম—দুর্গা আমাকে অপমান করতেই পারবে না। আর যদি করেও তাতে আমার বিড়ম্বনার কিছু নেই।
আমাকে অন্যমনস্ক দেখে সৌরাংশু বলল—তুমি দুর্গাদিকে চিনতে আমাকে আগে বলনি তো?
আমি কি জানতাম যে তোর দিদি হল সেই দুর্গা।
তুমি কিছুই জানতে না?
না রে, কিছুই জানতাম না।
একটার পর একটা সিগন্যাল পেরিয়ে আমাদের গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে। উঁচু উঁচু আকাশ ছোঁয়া টাওয়ার, সিঙ্গাপুর নদী, মিউজিয়াম—এসব কোনোকিছুর দিকেই আমার খেয়াল নেই। এখন সিঙ্গাপুর সিটি মানেই দুর্গা ও তার আবাসখানি।
পথিমধ্যে বেশ কয়েকটা দুর্গামন্ডপে পুজোর ভিড় চোখে পড়ল। অষ্টমীর সকালে হাতে ফুলের ডালি নিয়ে অনেক বাঙালি বউ-মেয়েকে পুজোমন্ডপে আসতে দেখলাম। মাঝে মাঝে আবার পুজোর মন্ত্রও কানে ভেসে আসছে।
বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে শহরের উত্তর প্রান্তে ক্রাঞ্জি এলাকায় এসে বেশ ভালো লাগল। এদিকটায় এত বড়ো বড়ো আকাশচুম্বী অট্টালিকা নেই, পাথরে বাঁধানো রাস্তাঘাট নেই, প্রমোদনগরীর ব্যস্ততা নেই, জনকোলাহল নেই। বরং এদিকটা বেশ ফাঁকা। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গাছে গাছে ভরা সবুজ গাছপালা। ধানখেত, বাঁশঝাড়, কলাবাগান দেখে নিজের দেশের কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার কথা।
সৌরাংশু গাড়ি দাঁড় করাল। সামনে এটা বড়ো গেট। সিকিউরিটির লোকজন সৌরাংশুকে আগে থেকেই চিনত, তাই ভেতরে ঢুকতে কোনো অসুবিধে হল না।
ভেতরে ঢুকেই আমি বিস্ময়াভূত হয়ে গেলাম। প্রায় চার-পাঁচ একর জুড়ে বিস্তৃত একটা ফার্ম। সেখানে পুকুর, সবজিবাগান, ধানখেত, কলাবাগান, নারকেল, বাঁশ গাছ সবই আছে। বেশ কিছুটা দূরে একটা পোলট্রি ফার্মও আছে। আছে গোরুও।
সৌরাংশুর সঙ্গে ফার্ম বাড়িতে ঢুকেই আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। পরিপাটি করে সাজানো দোতালা ঘর। মেঝেয় লাল কার্পেট। বসবার ঘরে মৃদু সুরে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত।
ড্রইংরুমে বসে ম্যাগাজিন উলটোচ্ছি, এমন সময় দুর্গা সিড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নীচে নামল। পরনে আকাশি রঙের ঢাকাই জামদানি শাড়ি, কপালে টিপ, গলায় হার। অষ্টমীর সকালে এই বেশে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হারিয়ে যাওয়া দুর্গা, আমার প্রাণের দুর্গা ঠিক আগের মতোই আছে।
আমাদের দেখে স্মীতহাস্যে দুর্গা এগিয়ে এল, বলল—কী খাবে বল? নিশ্চয়ই না খেয়ে বেরিয়েছ।
সৌরাংশু বলল—দিদি, এতে আমার কোনো দোষ নেই। প্রিয়দা, আমাকে আগে থেকে কিছুই জানায়নি। তাহলে আরেকটু আগে ঘুম থেকে উঠতাম।
দুর্গা বলল—তোমার প্রিয়দার কোনো দোষ নেই। আমিই তোমাকে জানাতে বারণ করি।
কেন?
তাহলে তুমি সকালে উঠে আমার জন্য কিছু-না-কিছু বানিয়ে আনতে।
তুমি কি তা পছন্দ করো না?
আমি কি তাই বললাম?
তাহলে?
আজ কী?
কী?
এখানে এসে সব ভুলে গেছ দেখছি।
কী বলো না?
অষ্টমী।
হ্যাঁ, তাতে কী?
আজ এখানে খেয়ে যাবে।
কিন্তু আমার তো কাজ আছে। ইনস্টিটিউটে যেতে হবে।
আমি বললাম—আজ কি তোর না গেলেই নয়?
দুর্গা বলল—এখন খেয়ে যাও। ফেরার সময় এখানে খেয়ে-দেয়ে যেও।
সৌরাংশু বলল—তাই হবে দিদি।
আমি বললাম—আমারও একটু বেরুতে হবে। সেমিনারের সার্টিফিকেটগুলো নিতে হবে।
দুর্গা বলল—সে কালকে দেখা যাবে।
দুর্গার সেই একই তেজ, সেই আত্মবিশ্বাস, সেই অনুশাসন। আমি আর কিছু বললাম না।
লুচি, ছোলার ডাল আর ফার্মের পুকুরের মাছভাজা, চিলিচিকেন। বেশ খাওয়া হল আমাদের।
সৌরাংশু বলল—বহুদিন এমন পুরোপুরি বাঙালি খাবার খাওয়া হয়নি। না খেয়ে খেয়ে এই পেটটা মজে গেছে।
দুর্গা বলল—রাতে বাকিটা খেয়ে যেও।
ঠিক আছে দিদি। এই গুরুমার আদেশ না মানলে রক্ষে আছে?
খুব পাকা হয়েছ না?
স্যরি দিদি। এই বলে সৌরাংশু বেরিয়ে গেল। সৌরাংশু বেরিয়ে যেতেই দুর্গা আমার দিকে তাকিয়ে বলল—তুমি কেমন আছ?
সময় যেভাবে কেটে যায়।
কেন, বউ-বাচ্চা নিয়ে তো বেশ আছ।
কে বলল তোমায়?
যেই বলুক, কথাটা ঠিক কিনা।
বাইরের থেকে দেখলে এমন মনে হয়। ভেতরে ভেতরে তোমার জন্য হাহাকার করে মরি।
ওদের ঠকাচ্ছ না?
একদম না। স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে যতটা যা করার করি। তবু এসবের বাইরে একটা নিজস্ব জগৎ আছে। নিতান্ত ব্যক্তিগত জগৎ। সেখানে তুমি সেই আগের মতোই রয়ে গেছ।
দুর্গা কিছু না বলে একটু হাসল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—তুমি এখানে কেমন আছ?
সাথিহারা পাখি যেমন থাকে।
মানে?
তোমাকে যতবার ভুলতে চেয়েছি, ততবারই তুমি ঘুরে-ফিরে আবার ফিরে এসেছ। এদেশে এসে ফার্ম বানালাম, বাগান বানালাম, ধানখেত বানালাম, সবসময় যত্ন নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকজন সর্বক্ষণের কর্মী রাখলাম। গবেষণায় নিজেকে সারাক্ষণ ডুবিয়ে রাখলাম। তবু তোমাকে ভুলতে পারিনি। তোমার একটা ছবি এখনও আমার শোবার ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে সবসময় রাখা থাকে। মাঝে মাঝে ওটা দেখি আর বোঝার চেষ্টা করি—তুমি সেই আগের মতো আছ কিনা, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার চেহারার কোনো পরিবর্তন হল কিনা, তুমি দাড়ি রেখেছ কিনা, তোমার চুলে পাক ধরল কিনা, আরও কত কী!
কী আশ্চর্য দেখো, আমরা দু-জনে একে অন্যের স্মৃতিকে আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করছি।
সৌরাংশু কিছু জানে?
ওকে আমি কিছু বলিনি।
আমিও কিছু বলিনি। তবে আজকের পর হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারে।
করে করুক।
তাই? এই বলে দুর্গা হঠাৎ আমার ডানহাতটা ধরে বলল—চলো, আমরা উপরে যাই।
সহসা আমার সারাশরীর দিয়ে উষ্ণ রক্তস্রোত বইতে শুরু করল। মনে হল আমি আমার কলেজজীবন, ইউনিভার্সিটির জীবনে ফিরে এসেছি। গড়িয়াহাটের ফুটপাথ বরাবর কিংবা কলেজ স্ট্রিটে দুর্গা আমার হাত ধরে গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছে। সেই হাসির ঝরনা, মুখের সামনে চলে আসা চুলগুলি হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়া, আমার কোনো একটি কথায় ‘দুষ্টু ছেলে’ বলে কান মলে দেওয়া, সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আমার সামনে স্পষ্টভাবে ধরা দিচ্ছে।
আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি আর আমার মনে হচ্ছে আমি যেন স্বপ্নের দেশে ভেসে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে দুর্গা আমাকে নিয়ে অন্য একটি জগতে পাড়ি দিয়েছে। সে-জগতে শুধু আমি আর দুর্গা। আর কেউ কোথাও নেই।
উপরে উঠে আমরা বারান্দায় গিয়ে বসলাম। শীতল হাওয়া এসে আমাদের চোখে-মুখে আলপনা এঁকে গেল। উন্মুক্ত নীল আকাশের বুকে এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল। ওদিকে সবুজ শস্যখেত। পুকুরের স্থির জলে কে যেন একটা ঢিল ছুড়ে মারল। তাতে সহস্র ছোটো ছোটো ঢেউ বৃত্তাকারে ডালিমের দানার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ওদিকে বাগানের দিকে হাত দেখিয়ে দুর্গা বলল—দেখো, ফুলগুলো কী সুন্দর দেখাচ্ছে।
তোমার সৌন্দর্যের কাছে এগুলো ম্লান।
তুমি সেই আগের মতোই আছ।
আর তুমি?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও নিজেকে পরিবর্তন করেছি।
মনটা কিন্তু সেই আগের মতোই আছে।
তোমার বাড়ির লোকজন মানে তোমার বাবা, মা—এরা কেমন আছেন?
বাবা, মা দু-জনেই মারা গেছেন।
মারা গেছেন! আর রিয়া?
ওর কথা তোমার মনে আছে?
মনে থাকবে না আবার, ওর সঙ্গে কত গল্প করতাম, কত মজা করতাম।
আর তোমার বাবা-মা?
গত বছর এখানে এসেছিল। প্রায় মাস ছয়েক ছিল। ওদের এখানে ভালো লেগেছিল, তবু দেশের মাটির, জন্মভিটের টান তো, দেশেই ফিরে গেল। ভিসারও সমস্যা ছিল।
আর তুমি? ওদেশে যাও না।
প্রথম প্রথম যেতাম, সকলের খোঁজ নিতাম। একবার ভাবছিলাম তোমার ওখানে যাব, তুমি চাইলেই আমি ফিরে যাব।
গেলে না কেন?
তারপর শুনলাম তুমি বিয়ে করে সুখে সংসার করছ, তখন ভাবলাম, তোমার সুখের সাগরে কোনো ঝড় উঠুক, আমি চাই না। বরং তুমি ভালো থেকো।
তুমি যদি আরও আগে যেতে, তাহলে আমরা তো এভাবে দূরে চলে যেতাম না।
এখানকার সরকার নানারকম সুবিধে দিল, আর যাওয়া হল না।
কিন্তু ফোনে যোগাযোগ তো রাখতে পার।
তোমার বউ কিছু মনে করবে না? ও কি কিছু জানে?
আমি ওকে সব বলেছি।
সব শুনে বউ কী বলল?
কী আর বলবে, যেই শুনল তুমি বিদেশে চলে গেছ, যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
ওপারের বাঁশঝাড় থেকে কী একটা পাখি ডেকে উঠল। একটা প্লেন আকাশ বিদীর্ণ করে ওদিকে চলে গেল। উঠোনে কয়েকটা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে কী যেন খাচ্ছিল।
এক মুঠো দমকা হাওয়া এসে ঘুরপাক দিতে দিতে চলে গেল। দুর্গা চোখটা বন্ধ করল। তারপর বলল—তুমি একটু দেখো তো, চোখে কী একটা পড়ল।
আমি উঠে ডান দিকের চোখের পাতা দুটো উপর-নীচে টেনে ধরে রুমাল দিয়ে ধীরে ধীরে নোংরাটা বের করে দিলাম।
দুর্গার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হাওয়া আমার চোখ-মুখে এসে লাগছে। ওর বুকের হৃৎপিন্ডের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ওর চোখের গভীরতায় আমি হারিয়ে যাচ্ছি।
আমি ওর মুখের সামনে উড়ে আসা চুলগুলি দু-হাতে সরিয়ে ওর কপালে চুমু খেলাম, ‘ও’ আবেগে, নিবীড়তায়, ভালোলাগায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল—তুমি আবার কিস করো।
আমি তিনবার ওর কপালে কিস করলাম।
তারপর ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল—তুমি যাও, চেয়ারে গিয়ে বোসো। খেতের লোকজন দেখতে পাবে।
আমি তখনও বিস্ময়ের মধ্যে আছি। এই প্রথমবার আমি দুর্গাকে কিস করলাম। মনে হল এক অজানা রহস্যাবৃত, মধুরতম অন্য একটা পৃথিবীর সন্ধান পেলাম। এই প্রথমবার দুর্গার সঙ্গে এতটা নিবীড় হলাম। এই প্রথম ওর হৃদয়ের ঘ্রাণ নিলাম।
আজ মনে হল দুর্গা হারায়নি। আমার হৃদয়ের প্রতিটি শিরা-ধমনীতে, প্রতিটি কোষে কোষে ওর উপস্থিতি আজ টের পেলাম। বুঝলাম আমাদের প্রেম কখনো হারিয়ে যায়নি, শুকিয়ে যায়নি, মরে যায়নি।
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে বসে থাকার পর দুর্গা বলল—কী হল, তুমি কি মাথা নীচু করে বসে থাকবে?
আমি যেন এক বিস্ময়ভরা, রোমাঞ্চকর জগৎ থেকে ঘুম ভাঙা চোখে বললাম—তোমাকে আগের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।
তুমিও আগের চেয়ে অনেক হ্যাণ্ডসাম হয়েছ।
তোমার ফার্মটা একটু ঘুরে দেখাবে না।
নিশ্চয়ই।
আমরা নীচে নামলাম। উঠোনে পা রাখলাম। বেশ সাজানো বাগান। দুর্গা হাত নেড়ে নেড়ে বোঝাচ্ছিল কোনটা কোন গাছ। বাঁশ গাছগুলো মাথা উঁচিয়ে এদিক-ওদিক দুলছিল। আর কলাবাগান! আস্ত আস্ত কলাগাছে কলা যেন ধরছে না। সিঙ্গাপুরি কলা আজ পৃথিবী বিখ্যাত। আজ সেই কলাবাগানের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি।
দুর্গা বলল—দেব নাকি এক আঁটি কলা, কলকাতায় নিয়ে যাবে।
না, বরং পাকা থাকলে খেয়ে দেখতে পারি।
বাড়িতে আছে, গিয়ে দিচ্ছি।
ধানখেতের একধারে বেশ কয়েকটি একই সাইজের গাছ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম—ওগুলো কী গাছ?
আলমণ্ড ট্রি।
এখানে এইগাছ প্রচুর দেখছি।
এটি এখানকার একটি পরিচিত গাছ।
ধানখেতের এই তত্ত্বাবধান তুমি কি নিজে কর?
আগে করতাম, এখন পারি না। লোক রেখে দিয়েছি।
আর এই সবজি খেত? সার, ওষুধ?
সবই ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে হয়। জৈব সার-ওষুধ দেওয়া হয়। কোনো অজৈব সার দেওয়া হয় না।
তাই?
হ্যাঁ। সেইজন্য এখানকার ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মটি অধিগ্রহণের অনুরোধ বার বার করা হয়েছে। আমি রাজি হইনি। নিজের হাতে পোতা গাছগুলোর উপর নিজের কোনো অধিকার থাকবে না, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। তবে গবেষণার জন্য আমি মাঝে মাঝে অনুমতি দিই।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে এলাম। বাঁধানো ঘাটে বসে ওখানকার গাছপালার সঙ্গে আলাপ করলাম। দুর্গা বলল—সুইমিং কস্টিউম পরে সে ছুটির দিনে সাঁতার কাটে।
আমি বললাম—তুমি ছিপ দিয়ে মাছ ধরো না?
ধরি। তবে এখন তেমন আর সময় হয় না।
আমি দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি—মানুষের ইচ্ছে থাকলে কিনা করা যায়? বিদেশের মাটিতে এমন একটি কর্মকান্ড একমাত্র আমার দুর্গাই করতে পারে। অথচ আমি? কলকাতায় মনের মতো একটা ফ্ল্যাটই জোগাড় করতে পারলাম না। বেঁচে থাকার জন্য সেই আটশো-হাজার বর্গফুটের মাপা ফ্ল্যাট। ডাইনেও এক ইঞ্চি বাড়তি নয়, বামেও নয়। অথচ এখানে সীমাহীন মুক্ত আকাশ, বাঁধনহীন মুক্ত হাওয়া।
দুর্গার আঁচলটা পতপত করে উড়ছে, আর সে গাইছে—
আমি তোমায় যত
শুনিয়েছিলেম গান
তার বদলে আমি
চাই নে কোনো দান।।
গানটা শুনে মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। দেখলাম, দুর্গা আঁচল দিয়ে চোখের কোণের জল মুছল।
আমি বললাম—তুমি এখনও রবীন্দ্রসংগীত চর্চা কর?
আমার ড্রইংরুমে, শোবার ঘরে প্রচুর সিডি রাখা আছে। বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ সব গানই শুনি। মাঝে মাঝে রেওয়াজ করি।
মনে মনে ভাবলাম—সত্যিই তুমি দশভুজা। সত্যিই তুমি দুর্গা। তুমিই পার সবদিক সুন্দর ভাবে সামলাতে।
দুর্গা বলল—চলো, লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। তোমার তো একটু দেরি সয় না।
তোমার এখনও মনে আছে?
খাবে চলো।
দেখলাম—মাছভাজা, পোস্ত, ডাল, মাছের ঝোল, চিকেন, চাটনি। সবই আমার প্রিয় খাবার।
আমি খাচ্ছি, দুর্গার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি—দুর্গা এখনও আমার প্রিয় খাবারের কথা মনে রেখেছে।
সন্ধ্যে বেলায় সৌরাংশু এসে বলল—প্রিয়দা, কত দেরি হবে? তারপর দুর্গার দিকে তাকিয়ে বলল—আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।
দুর্গা বলল—কেন?
একটু কাজ আছে। ইনস্টিটিউটের কাজ, বাসায় গিয়ে করতে হবে।
ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন দুর্গার বাড়ি থেকে বের হলাম তখন রাত সাড়ে ন-টা। গেট পর্যন্ত ও এসে এগিয়ে দিয়ে গেল। বলল—কাল আসতে হবে। আমি গিয়ে তোমাকে সৌরাংশুর বাসা থেকে তুলে নেব। তোমার সেমিনার সার্টিফিকেটটা নিতে হবে। তারপর নবমীর রাতে পুজো দেখে ফিরব। তৈরি থেকো।
আমি বললাম—থাকব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন