আমার দুর্গা – ২.৬

বিকেলের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই গরমভাব ততটা নেই। রাস্তার নীচু অংশগুলোতে তখনও বৃষ্টির জমা জল। মাঝে মাঝে এক-একটা গাড়ি যাচ্ছে আর তাতেই সেই জল দু-দিকে ছিটকে পড়ছে। রাস্তার দু-দিকে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর গায়ে তখনও জল লেগে আছে।

দুর্গা আজ ইউনিভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসে। চিঠির বাক্স খুলতেই দেখে তার নামে একটা চিঠি। সকালে তো বাক্সে কোনো চিঠি ছিল না, তাহলে দুপুরেই ডাকপিয়োন এটা দিয়ে গেছে।

চিঠিটা হাতে নিয়েই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। হওয়ারই কথা। এ যে প্রিয়ব্রতর চিঠি।

সে কোনোরকমে জুতো খুলে ব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পোশাক ছাড়া, হাত-মুখ ধোয়া এসব এখন চুলোয় যাক। এক ঘণ্টা দেরি হলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

তারপর চিঠিটা খুলে আগাগোড়া পড়তে থাকে। সে চিঠি পড়ছে নাকি চিঠির প্রতিটি কমা, পূর্ণচ্ছেদ পর্যন্ত গিলছে তা নিজেই বুঝতে পারছে না। তার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি অনেকটা বেড়ে গেছে।

দুর্গাকে লেখা তার চিঠির বয়ান বেশ বড়ো।

প্রিয়ব্রত লিখেছে—

কাঁথি

মেদিনীপুর

দুর্গা,

আজ দুপুরে আমাদের এখানে এক ঝড় বয়ে গেছে। কালবৈশাখী তার রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দুপুরে সকলের আয়েশি ঘুমের সুযোগে চুপিচুপি এসেছিল। যাওয়ার সময় সে কী কান্না! মাঠ, ঘাট সব অশ্রুকণায় ভরিয়ে দিয়ে গেছে। তার সেই অভিমানী রূপ দেখে যুঝবার সাহস কারুরই হয় না। তার সেই অঝোর কান্নার রব শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই।

যখন ঘুম ভাঙে দেখি কোথায় সেই কাজল কালো মেয়ে?

চারদিক রোদে ঝলমল। আকাশের বুকে জমে থাকা ধুলো ময়লা সব সাফ হয়ে গেছে। কতগুলো ‘বউ কথা কও’ পাখি গাছের ডালে আনন্দে গলা ছেড়ে গান ধরেছে। বাগানের আনাচেকানাচে একটু একটু করে জল জমেছে।

পশ্চিমের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনটা বড়ো উদাস হয়ে গেছিল। আকাশটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তার কোনো কূলকিনারা নেই। আর শস্যশ্যামলা পৃথিবী? একটা ঘুড়ির মতো ঝুলে আছে। লাটাইটা রয়েছে সূর্যের হাতে। কী সুন্দর সিস্টেম! কী শৃঙ্খলাবোধ সূর্যের সংসারে! একটু অনিয়ম হলেই সব ওলটপালট হয়ে যাবে।

বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে ক্যানেলপাড়ে গেছিলাম। বৃষ্টিসিক্তা প্রকৃতিকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। রাস্তার আনাচেকানাচে জমে থাকা নোংরা জল হাঁটার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে আমার পায়ে এসে পড়ছিল।

রাস্তার পাশে লাল রঙের একটা দোতলা বাড়ি। শুনেছি বাড়িটি প্রায় দেড়-শো বছরের পুরোনো। আমার বিশ্বাস হয়নি। দেড়-শো বছরের পুরোনো বাড়ি কী সুন্দরভাবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অনেক জায়গায় বহু প্রাচীন গুহা, মন্দির, মসজিদ, স্মৃতিস্তম্ভ তো আজও তাদের লাবণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাড়িটা বেশ পুরোনো, মাঝে মাঝে পলেস্তারা খসা। দোতলার সিঁড়িটা ভাঙা ভাঙা, সিমেন্ট ওঠা। মন্দিরের চূড়ার মতো চিলেকোঠা। এই বাড়িতে নাকি ইংরেজ সৈন্যরা বেশ কয়েকবছর তাঁবু ফেলেছিল। এখন সেখানে পায়রা, ঘুঘু, কাঠবিড়ালিরা নিশ্চিন্তে বাসা বেঁধেছে। উঠোন বলতে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। আগাছায় আগাছায় সব ভরে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। এই পৃথিবীতে একা একা হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ ভালোলাগে। সব কিছু ভুলে থাকা যায়। কিন্তু তারপর যখন নি:সঙ্গতা ঘুটঘুটে কালো আঁধারের মতো নেমে আসে, তখন কেমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা মনে হয়।

আশ্চর্য আমাদের জীবন চলা। আমরা যে যার একার মতো করে ভেবে চলেছি। কেউ কাউকে চিনি না, জানি না। এই পথ চলার সিঁড়ি বেয়ে কেউ কেউ সাফল্যের দরজায় পৌঁছে যায়। কেউ-বা হোঁচট খেয়ে সারাজীবনের জন্য নীচে পড়ে যায়, আর ওঠা হয় না।

কলকাতা থেকে বাবার বন্ধু, সুজিত মেসো, সাবিত্রী মাসিমা ও তাদের মেয়ে অর্ণা এসেছিল। অর্ণার সঙ্গে রিয়ার বন্ধুত্বও আছে। সকলে মিলে কাল আমরা দীঘা বেড়াতে গেছিলাম। আমি যেতে চাইনি। রিয়া গোঁ ধরে বসল। যেতে বাধ্য হলাম।

আজকাল তুমি ছাড়া আর কারুর সঙ্গে বেড়াতে যেতে ভালো লাগে না। সামান্য কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে গল্প করা যায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠি। আমি উঠে অন্য জায়গায় চলে যাই।

ঘাটের কাছে বাঁধানো সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ একা একা বসেছিলাম। সমুদ্রের পাড় বরাবর একটি রাস্তা কোন সুদূরে চলে গেছে। চারদিকে শুধু ঝাউ আর ঝাউ গাছ।

তখন সবে জোয়ার শুরু হয়েছে। ভ্রমণার্থীরা কেউ স্নান করছে, কেউ সি-বিচে হাঁটছে, কেউ-বা প্রিয়জনের ছবি তুলছে। কেউ কেউ আমার মতো পাড়ে বসে নীল সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে।

দুটো বিপরীত দৃশ্য চোখে পড়ল। প্রমোদ ভ্রমণে বেড়ানো অর্থবহুল মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, আর পাশাপাশি জেলে মাঝিদের জীবনপণ সংগ্রাম। কোমরের কাছে একটা লুঙিকে জড়িয়ে খালি গায়ে কাদা-বালি মেখে কুইন্টাল কুইন্টাল ভারী মাছের ঝুড়ি, বরফ, তেলের ড্রাম, ওঠানো-নামানো করছে। সমুদ্রের মৎস্যকন্যাদের সঙ্গে এই অনিশ্চিত জুয়া খেলায় যখন সাদা-বাদামি রঙের মাছে তাদের ঝুড়ি ভরে ওঠে, তখন তাদের মুখে হাসি ফোটে, হাসি ফোটে তাদের স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের মুখে।

দুর্গা, তুমি থাকলে দেখতে পেতে জোয়ারের জল কীভাবে বাড়তে বাড়তে একেবারে পাড়ে এসে ধাক্কা মারে। তারপর সেগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছোটো ছোটো ফেনার সৃষ্টি করে।

রং-বেরঙের গাংচিল পাখিগুলো দল বেঁধে উড়ছিল। এগাছ থেকে ওগাছে উড়ে গিয়ে তারা কী যেন বলাবলি করছিল। তারা কি বুঝতে পারছিল যে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

দুর্গা, ঘাটের কাছে ‘ভোলা’ বলে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বয়স চৌদ্দো-পনেরো হবে। ভোর হওয়ার সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোহনার কাছে লঞ্চঘাটে চলে আসে। সেখানে সারাদিন ধরে লঞ্চ থেকে মাছের ঝুড়ি নামানো, বরফ নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি কাজ করে। বিনিময়ে যা পায় তাতেই তার কালো কুচকুচে মুখে দুধের মতো সাদা দাঁতগুলো বের করে যখন হেসে ওঠে তা যতই বিসদৃশ লাগুক না কেন তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা থাকে না, কোনো ভণিতা নেই।

আমি অবাক হয়ে গেছিলাম যখন ‘ভোলা’ আমাকে বলেছিল বাড়িতে তার মা আছে, ছোট্ট ভাই আর বোন আছে। তাদের পেটের ভাত আর পড়াশোনার ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হয়। বাপটা নাকি তাদের ছেড়ে আর একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। সে আমাকে বলেছিল—‘দাদা, ভাইটা পড়াশোনা করলে তাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিও।’ আমি বলেছিলাম—‘পড়াশোনা ভালোভাবে করতে বলিস। একদিন ভাইকে নিয়ে আমার কাছে আসবি। কী রে, আসবি তো?’

দুর্গা, এইসব ভোলারা কত সহজ, সরল! এরা বোঝে না তথাকথিত শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত কত মানুষই এদের নিয়ে বেআইনি কাজে লাগায়। আমরা শুধু বাইরে থেকে মানুষের মুখগুলো দেখি। মুখোশের আড়ালে যে বহু কদাকার চেহারা লুকিয়ে থাকে, তা এরা বুঝতে পারে না।

ভারতবর্ষের হাজার হাজার মানুষের এইসব করুণ-কাহিনি যদি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা যায়, যদি তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা লেখনী দিয়ে চিত্রিত করা যায়, তবে তাদের চোখের জলের ইতিহাস যে কত বড়ো হতে পারে, তা ভাবা যায় না। সীমা-পরিসীমা হারিয়ে তা যদি হাজার হাজার পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

পশ্চিমাকাশে ভেসে বেড়ানো পাখিদের দেখে তোমার কথা খুব মনে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল তুমি থাকলে সি-বিচে হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকদূর চলে যেতাম। সমুদ্রের ঢেউয়ের কুলু-কুলু ডাক আর ঝাউয়ের সোঁ-সোঁ স্বরে আমরা হারিয়ে যেতাম। দুর্গা, তুমি আমার ফুটিফাটা হাহাকারময় মরুজীবনে ছায়াঘেরা মরুদ্যানের মতো এসেছ। একটি নীড়হীন পাখিকে খড়-কুটো-লতা-পাতা দিয়ে ভালোবাসার বাসা বানাবার স্বপ্ন দেখিয়েছ। তুমি গ্রীষ্মের দাবদাহে তাকে শুধু ছায়া দিয়ে যাবে, বর্ষায় ছাতার মতো আগলে রাখবে আর প্রবল শীতে উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে রাখবে।

যারা একজন প্রতিষ্ঠিত স্বামীর তাঁবেদার হয়ে, বাক্স ভরতি গয়না আর পোশাকের পসরা সাজিয়ে জীবন কাটায়, তুমি তাদের যে পছন্দ কর না, তা আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি।

দুর্গা, জীবনে চড়াই-উতরাই আসবে, আলো-আঁধারি দিন আসবে, তাই বলে আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না। পাহাড়ি বরফাবৃত পথে এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে কত অভিযাত্রীকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে, তাই বলে কি এভারেষ্ট বিজয় থেমে গেছে? স্বাধীনতার জন্য বিদেশি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে কত শহিদ মৃত্যুবরণ করেছেন, তবু কি সেই যুদ্ধ থেমে গেছে?

আমরা যখন স্নান করছিলাম, মনে হচ্ছিল মনের ভেতর জমে থাকা সমস্ত দুশ্চিন্তা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। এই জন্যেই বোধ হয় হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রের এই অপরিমেয় জলরাশিতে স্নান করে তৃপ্ত হয়, ক্লান্তিমুক্ত হয়।

মনে হচ্ছিল সমুদ্রের এই সীমাহীন জলরাশিতে আমরা ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীর মতো লাফাচ্ছি, খেলছি, মাতামাতি করছি। এর পেশিশক্তির সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে কে?

রিয়া বলছিল—দাদা, সমুদ্রের পাড়ে একটা বাড়ি থাকলে বেশ হয়। প্রতিদিন সমুদ্রস্নান সেরে তবেই কলেজে বের হতাম। বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের শীতল হাওয়ায় শরীর জুড়োতাম।

অর্ণা বলছিল—তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে পাকাপাকিভাবে থেকে যেতাম।

মেয়েটি বড়ো ডেঁপো হয়েছে। আমি ওকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলি।

বাবা বলছিল—সপ্তাহান্তে একবার ঘুরে যেতে পারলে বেশ হয়।

দুর্গা, এতদিন সব কিছু একা-একাই খুঁজেছি, চেনার চেষ্টা করেছি। নেহাত বন্ধুত্বের খাতিরে কারুর কারুর সাথে অল্প-স্বল্প মিশেছি। এর বেশি নয়। তেমন করে ভাবার মতো কাউকে পাইনি, যাকে পাশে বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করা যায়। তুমি এসে আমার জীবনে সুরের ছন্দ এনেছ, জীবনের গতি এনেছ, নতুন করে জীবন চলার স্বপ্ন দেখিয়েছ।

ঘাটের কাছে রাস্তার দু-দিকে শৌখিন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বেশ কয়েকজন হকার, দোকানদার ব্যবসা পেতেছে। সমুদ্রের মৃত শামুক নিয়ে মালা, চাবির রিং ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করছে। প্রায় প্রত্যেকে কিছু-না-কিছু কিনছে নিজের জন্যে, পরিবারের লোকেদের জন্যে, নিজের প্রিয়জনের জন্যে।

আমি তোমার জন্যে একটা পেন স্ট্যাণ্ড কিনেছি। তুমি পড়ার সময় ওটা সামনে রেখে পড়তে বসবে, দেখবে ভালো লাগবে। মনে হবে ধারে কাছে কোথাও আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার পড়া শুনছি। তুমি একদম ফাঁকি দিতে পারবে না।

রিয়া জিজ্ঞেস করেছিল—দাদা, তুই এটা নিজের জন্য কিনেছিস, না অন্য কাউকে দিবি?

কেন, সুন্দর দেখাচ্ছে?

খুব সুন্দর, ইচ্ছে করছে ওটা নিয়ে নিই।

ওটা দেওয়া যাবে না। আরও অনেক আছে। তোর পছন্দ মতো বেছে নে, আমি দাম দিয়ে দিচ্ছি।

বা বা! যেন ওটা হবু বউদির জন্য কিনেছিস।

ঠিক বলেছিস।

রিয়া বিস্ময়াচ্ছন্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে—এই দাদা, তুই সত্যি বলছিস?

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ওর কথায় গুরুত্ব না দেওয়ার ভান করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।

রিয়া আমায় জোর করতে থাকে। বলতে থাকে—বল না দাদা, বল।

কী বলব?

এটা কি বিশেষ কারুর জন্যে?

কাউকে বলবি না তো?

বলব না।

প্রমিশ?

প্রমিশ।

হ্যাঁ, ওটা বিশেষ কারুর জন্যেই।

কে? ক্লাসমেট?

না, অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করে।

কোন বিষয়ে?

পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছে।

বাড়ি কি বর্ধমানে?

না, হলদিয়ায়।

তুই পরিচয় করাবি না?

নিশ্চয়ই।

ফোনে তো কথা হতে পারে।

ও মেসে থাকে, ফোনে কথা বলা যাবে না।

যখন দেশের বাড়ি আসবে।

ওদের বাড়ি একটু গ্রামের দিকে। ফোন নেই।

ও!

এই বলে রিয়াকে থামানো গেছে। আমাকে এমন জেরা করছিল যেন আমি চুরি, ডাকাতি কিংবা অন্য কোনো অপরাধ করেছি।

তবু রিয়া আমায় বোঝার চেষ্টা করে। ওকে বুঝিয়ে বললে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে। সহসা উত্তেজিত হয় না। তুমি পরে কথা বলে দেখো, ভালো লাগবে। আমি তো বোনের সঙ্গে সমস্ত বিষয়ে গল্প করি। তোমার কথাটা অবশ্য আজই প্রথম বললাম।

দুর্গা, মানুষ অনেক কিছু চায়। কিন্তু সব পায় না, পাওয়া সম্ভবও নয়। তবু জীবনে একটু সুখ, একটু শান্তি, একটু ভালোবাসা চাওয়া কি নিতান্তই বাড়াবাড়ি? একটুখানি ভালোবাসার জন্য মানুষ পাগলের মতো শুধু শুধু প্রিয়জনকে খুঁজে বেড়ায়?

সীমাহীন গভীর সমুদ্রে জাহাজে করে কিংবা অজানা-অচেনা গভীর জঙ্গলে ছায়াঘেরা বনানীর মাঝে বন্য জন্তুর দুর্গম বিচরণভূমি বেয়ে ঝরা পাতার বিছোনো পাপোশের ওপর দিয়ে আমরা শুধু হেঁটেই চলেছি। আধো-আলো, আধো-আঁধারি ছায়াযুদ্ধে প্রতীকী সৈনিকের মতো আমাদের এই পথসংগ্রাম, কখনো অস্পষ্ট কুয়াশাঘেরা ভোরে, কখনো নরম বিকেলের সরলতায়, কখনো নিশুতি রাতের নি:শব্দ আমন্ত্রণে।

দুর্গা, তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি এখানে অস্থিকঙ্কালসার রক্তমাংসের দেহখানি নিয়ে বসে আছি, আর মন পড়ে আছে তোমার কাছে। কিছুই ভালো লাগছে না। তুমি পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললে শান্তি আসে। যদি পাখির মতো আমার দুটো ডানা থাকত তাহলে এখুনি উড়ে গিয়ে তোমার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে তোমার মাথার কাছে বসে থাকতাম। যদি মেঘ হতাম, তাহলে সোঁ-সোঁ করে উড়ে গিয়ে ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

রাত্রিবেলা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে পৃথিবীটাকে কেমন রোমাঞ্চকর বলে মনে হয়। মাথার ওপর আকাশটা কেমন অদ্ভুতভাবে ঝুলে আছে। তারকার দল জালিকাকারে সারা আকাশ জুড়ে বিরাজমান। তুমি পাশে থাকলে বলে দিতে কোনটা কোন গ্রহ।

আমার বিশ্বাস মানুষের অনুভূতির মধ্যেই তার প্রকৃত প্রকাশ। মানুষের চেনা-জানা গন্ডি পেরিয়ে যদি তার মনের দরজায় পৌঁছোনো যায়, তাহলে তাকে নি:স্ব, রিক্ত হাতে কিছুতেই ফিরতে হয় না।

আমি সুখে-দুঃখে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়, আনন্দ-বিরহে তোমার পাশে থাকতে চাই। যখন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হবে, নির্দ্বিধায় আমাকে বোলো আমি সাধ্য মতো সাহায্য করব। তুমি কষ্ট পেলে আমারও কষ্ট হয়, তুমি সমস্যায় পড়লে আমিও উতলা হয়ে পড়ি।

কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে ভেঙে পড়বে না। নিজের মনকে শক্ত করে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে, দেখবে সমস্যা কেটে গেছে। অন্ধকারের পর যেমন আলো আসে, ঘুটঘুটে কালো রাত্রির অবসান ঘটে যেমন ভোরের শুভ্রতা এসে হাজির হয়, উত্তরের কনকনে শীতল হাওয়া বিদায় নিয়ে যেমন বসন্ত এসে কড়া নাড়ে তেমনি সমস্ত দুঃখ-কষ্ট সমস্যার সমাধান হয়ে সুখের দিন আসবেই।

ভিক্ষে নয়, করুণা নয়, যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিজেদের সত্ত্বাকে তুলে ধরতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, নিজের কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে হবে। দেখবে সাফল্য আসবেই।

এতক্ষণ অনেক কথাই বললাম। তুমি এখন কী করছ? মেসে শুয়ে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছ? নাকি বই খুলে রেখে আমার কথা ভাবছ?

পড়াশোনার সময় এসব ঠিক নয়। আমি তো সবসময় তোমার পাশে আছি। এত চিন্তা কীসের? তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো। তোমার প্রজেক্ট পেপারগুলি ঠিক সময়ে তৈরি করে নাও।

আর সর্বদা শরীরের দিকে খেয়াল রেখো। তুমি তো মাঝে মাঝে বাইরের এটা-ওটা কিনে খাও আর পেটের গন্ডগোল বাধিয়ে বসো। এসব বন্ধ করো।

বেশি রাত জেগে শরীরের ওপর চাপ বাড়িও না। শরীর সুস্থ থাকলে, মন ভালো থাকলে তুমি অনেক বেশি কাজ করতে পারবে।

কাকু, কাকিমা নিশ্চয়ই ভালো আছেন। তুমি ওনাদের খেয়াল রেখো।

ভালো থেকো।

ইতি

তোমার প্রিয়ব্রত

দুর্গা প্রিয়ব্রতের চিঠিটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে। ভাঁজ করে রেখে দেয়। আবার ওটা খুলে পড়তে থাকে। কয়েকপাতার চিঠির মধ্যে এমন কী আছে যে বারবার পড়তে ইচ্ছে করছে? তার হৃৎপিন্ডটার শব্দ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জানালা দিয়ে সে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সে কি দেখছে—আকাশ, গাছপালা, ঘরবাড়ি? নাকি কি সে এই পার্থিব শরীর নিয়ে বসে আছে, আর তার কল্পনাবিলাসী মন বাসন্তী হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে উড়ে গেছে প্রিয়ব্রতদার হৃদয় আঙিনায়?

দুর্গা ভাবে জীবনে সে এমন একটা মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় যার তাকে প্রয়োজন আছে, কারুর ওপর বোঝা হয়ে সে চাপতে চায় না। প্রিয়ব্রতের মতো একটি প্রতিভাবান ছেলের সঙ্গে জীবন চলা সেদিক থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জের। জীবনে সাঁতার কাটতে হলে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছোও, তাতে আলাদা মজা আছে।

এত বছর পথ চলার পর, এতদিন একা একা হাঁটার পর এই প্রথম কাউকে সঙ্গে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাবার কথা ভাবছে। মাধবীলতার মতো তাকে আঁকড়ে ধরে শাখা-প্রশাখা, ফুল-ফল ছড়িয়ে বাগান আলো করে বাঁচতে চাইছে।

সে ভাবে এখন বাবা-মা তার কোনো অভাব বুঝতে দেয় না। কিন্তু একদিন যখন বাবা-মা তাকে ছেড়ে চলে যাবে, তার নিজের শরীরের লাবণ্য যখন ম্লান হয়ে আসবে, যখন সব পাখিগুলো বয়সের ভারে নুয়ে পড়া পুরোনো বাসা ছেড়ে উড়ে যাবে, তখন সে একাকী বাঁচতে পারবে তো? পরিত্যক্ত ঘোড়ার মতো জীবনরেসে সে সঙ্গীহারা হয়ে দলছুট হয়ে হারিয়ে যাবে না তো?

প্রিয়ব্রতের সেই দীপ্তময় চোখ, সম্ভাবনাময় মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যুগযুগ ধরে পুরুষ তার ইচ্ছাগুলোকে একটার পর একটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। আর নারী তার কোমল হাতের ছোঁয়ায়, ভালোবাসার পরশে পুরুষের সাজানো বীণায় ঝংকার তোলে, তাতেই রিনঝিন সুরে সেই বীণা বেজে ওঠে।

দুর্গা মনে করে পুরুষ মানুষের পরিচয় তার কাজে, তার ব্যক্তিত্বে। যারা পরিশ্রম আর ইচ্ছাকে ফাঁকি দিয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছে, তারা জীবনযুদ্ধে হেরে গেছে, বাতিল হয়ে গেছে। যে সব পুরুষ মানুষ ‘অসম্ভব কাজ’, ‘আমার দ্বারা হবে না’ বলে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে তাদের দেখলে কেমন হ্যাংলা-হ্যাংলা, বোকা-বোকা লাগে।

আর প্রিয়ব্রত? ও কোনো দুর্বল সৈনিক নয়। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। প্রদীপের সলতের মতো শুধু জ্বলতে চায়।

এই সব টুকরো টুকরো ঘটনা ভাবতে ভাবতে দুর্গা এক অজানা ভালোলাগায় আপ্লুত হয়ে পড়ে। জবা আর রক্তকরবী ফুল হাওয়ায় দুলতে দুলতে মাঝে মাঝে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখে। উঠোনে দাঁড়ানো নারকেল গাছের পাতা ইশারা করে ডাকে। ফর্সা আকাশ তার মনটাকে বারবার কাছে টানে।

বড়ো রাস্তা থেকে মোটর গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসে। কয়েকজন লোক উচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। ওপারের মাঠটায় বেশ কয়েকজন কিশোর ক্রিকেট খেলছে। দুটো কুকুর গোঙাতে গোঙাতে রাস্তার ওপারে দৌড়ে গেল।

দুর্গার মনে পড়ে—রেল লাইনের ধারে শস্যখেতে কয়েকজন নারী-পুরুষ মাটি কোপাচ্ছিল। তাদের দেখে প্রিয়ব্রত বলেছিল—এরা সারাদিন কায়িক পরিশ্রম করে ফুল ফোটায়, শস্য ফলায়। কিন্তু এরা কতটুকু পায়? শহর থেকে কোনো এক ব্যবসায়ী এসে নামমাত্র পয়সার বিনিময়ে সেই শস্যগুলি কিনে মুনাফা লোটে।

প্রিয়ব্রত নিজে ভাবে, অপরকে ভাবায়। সমাজের টুকরো টুকরো বৈষম্যকে রং-তুলি দিয়ে আঁকবার চেষ্টা করে। ও অন্যদের চেয়ে আলাদা।

দুর্গা ভাবে—প্রিয়ব্রতের পাশে কোমল উষ্ণতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ভালোবাসার অনুপ্রেরণায় তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। হৃদয়ের শক্ত ভিতের ওপর একটি মজবুত বাসা বাঁধলে সহজে তা ভাঙবে না।

একদিন গল্পের সময় প্রিয়ব্রত বলেছিল—মানুষ যদি তার নিজস্বতাকে আবিষ্কার করতে পারে, তার মধ্যে যে আমিত্ব লুকিয়ে আছে তা জানতে পারে, তবে যেভাবেই হোক না কেন সে উঠে দাঁড়াবেই।

পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে গোধূলির রহস্যঘন আঁধার নেমে এসেছে সেদিকে দুর্গার খেয়ালই নেই। এইভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যে আসে, ঘরে ঘরে সাঁজবাতি জ্বলে ওঠে, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে, একসময় গভীর রাত্রি এসে নামে। চারদিকে নিস্তব্ধতা আছড়ে পড়ে। তারারা আকাশে সারারাত কথা বলে।

দুর্গা ভাবে—এভাবেই দিন কাটে, বছর ঘোরে, জীবন ফুরোয়। ব্যাস, সব হিসেব নিকেষ চুকিয়ে এবার কেটে পড়ো।

মৈত্রী ঘরে ঢুকে লাইটের সুইচ দিতেই দুর্গা তড়িঘড়ি করে উঠে চিঠিটাকে ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে।

মৈত্রী দুর্গার রুমমেট। ইংরেজিতে এম. এ. পড়ছে। অত্যন্ত গরিব বাড়ির মেয়ে। টিউশন পড়িয়ে নিজের খরচ চালায়, কোনো কোনো সময় তা থেকে বাঁচিয়ে বাড়িতেও টাকা পাঠায়।

দুর্গাকে এ অবস্থায় দেখে বলে—কীরে দুর্গা, তুই তো সেই কখন ফিরেছিস। এখনও পোশাক পালটাসনি। তুই অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কী করছিলি?

শরীরটা ভালো লাগছিল না। এসে শুয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম একটু বিশ্রাম নিয়ে পরে ড্রেসটা চেঞ্জ করব। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি।

তোকে তো দেখে ঘুমিয়েছিলি বলে মনে হচ্ছে না।

মনে হচ্ছে না? কী যে বলিস। না হলে এই সন্ধ্যাবেলা লাইট না-জ্বেলে অন্ধকারে একা একা কেউ শুয়ে থাকে?

সেটাই তো কথা। অন্য কিছু নয় তো?

অন্য কিছু মানে?

আমাকে দেখে তুই যেভাবে লাফিয়ে উঠে ব্যাগপত্র গুছোতে শুরু করলি, তা কেমন অস্বাভাবিক মনে হল।

তুই ভুল বুঝেছিস। বাইরে থেকে এসে হঠাৎ ঢুকেছিস তো। তাই এমন মনে হয়েছে।

কোনো চক্করে পড়িসনি তো?

চক্করে মানে?

একটু বেশি হেঁয়ালি করছিস না? সত্যিকথা বলে ফেল। নাহলে কখন কোথায় ফেঁসে যাবি ঠিক নেই।

আরে না রে, তেমন হলে তোকে বলব না?

ছেলেদের বিশ্বাস নেই। আজকে একজনের সঙ্গে ঘুরছে তো কালকে আর একজনের সঙ্গে।

তোর সঙ্গে এমন হয়েছে নাকি?

দেখ, আমি যথেষ্ট কষ্ট করে, পরিশ্রম করে পড়াশোনা করছি। এইসব বেলেল্লাপনা করে ঘুরে বেড়াবার কোনো ইচ্ছে নেই।

এটা তো তোর বাইরের কথা। মনের কথা কি একই?

আমার পেছনে লাগিস না, ভালো হবে না বলছি।

ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। রাগ করিস না। তুই তো এখন আবার টিউশনে বেরোবি?

ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে বেরোবো।

মৈত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রিয়ব্রতের চিঠিটা আবার বের করে মুখে-গালে ছোঁয়ায়। তারপর ওটা বুকে চেপে বলে—‘আমি তোমায় খুব ভালোবাসি, প্রিয়ব্রত। তুমি চাইলে আমি আমার সব কিছু তোমায় দিতে রাজি।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন