বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপবাগ ক্যাম্পাস। আমার আইনের স্নাতকোত্তরের প্রথম বর্ষ। দুর্গাও তখন পরিবেশ বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তরের প্রথম বর্ষ। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর সঙ্গে আলাপ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ছিল অনুষ্ঠান। পরিবেশ সচেতনতার ওপর বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য দুর্গাকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। আমি পেয়েছিলাম ক্লাসে সর্বোচ্চ উপস্থিতির জন্য বিশেষ পুরস্কার।
ও ঠিক আমার সামনের সারিতে বসেছিল। বছর বাইশ-তেইশের মাঝারি উচ্চতা, ফর্সা, তন্বী, পাপড়ি মেলা সুন্দরী মেয়ে। মাঝে মাঝে পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিল। আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল। ওর মুখের দিকে সোজা তাকাতে পারছিলাম না।
ঠিক মনে পড়ছে না কে প্রথম আলাপ করেছিল। সে নিজে নাকি দুর্গা? কিন্তু আড়ষ্টতা কাটিয়ে আমি যখন দুর্গার চোখে চোখ রেখেছিলাম তখনই মনে হয়েছিল মেয়েটির চোখে কোনো মায়া আছে। গোলাপের নরম পাপড়ি দিয়ে কে যেন তার মুখমন্ডলটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। তার মাথার দু-দিকে সর্পিল বেণী দু-টি কোমর ছাড়িয়ে গেছে, হাল্কা লাল রঙের সালোয়ার কামিজে দুধের মতো ফর্সা মুখখানি যেন অপ্সরীর অবয়ব মূর্তি।
তারপর থেকে আমি সেই নিষ্পাপ চোখের গভীর দৃষ্টির প্রতি কেমন দুর্বল হয়ে পড়ি। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই তাকিয়ে থাকা। আমার প্রথম ভালোলাগা, আমার প্রথম হৃদয় জাগানো অনুভূতি।
অনুষ্ঠানের শেষে আমি বললাম—আপনি ব্যস্ত আছেন?
কেন?
এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই।
চলুন না, ক্যান্টিনে গিয়ে বসি।
একটু দূরে ও বসেছিল। মাঝে আকাশসম ব্যবধান। সূর্যালোকের ভাঙা-চোরা অংশ ক্যান্টিনের জানালার ফাঁক গলে আমাদের শরীরের ওপর গড়িয়ে পড়ছিল। চা খেতে খেতে ওনার কাজলকালো চোখের গভীর অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
আলাপ পরিচয়ে জানলাম ওঁর নাম দুর্গা সামন্ত। হলদিয়ার কাছে বৃন্দাবনচক গ্রাম। মাটির সোঁদা গন্ধে ওঁর জন্মানো, বড়ো হওয়া। গ্রামের সাদাসিধে জীবনযাত্রার সঙ্গে উনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। প্রকৃতির সাজানো গ্রামবাংলার রূপ-রস উনি অঢেল পান করেছে।
আমি বললাম—আপনি প্রকৃতি খুব ভালোবাসেন, তাই না?
কী করে বুঝলেন?
আপনি পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন।
তাহলে যারা সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করছে, সবাই সংস্কৃতে পন্ডিত হয়ে যেত।
তবু নিজের ভালোলাগার ব্যাপারটা আছে।
উনি কথা না বাড়িয়ে বললেন—প্রকৃতি আমার ভালোলাগে, ছোটোবেলা থেকে কাদা-মাটি মেখে বড়ো হয়েছি। আমি অনায়াসে বুঝতে পারি মেটে রাস্তার দু-ধারে ছড়ানো ছিটোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বাবলা, খেজুর, শিরিষের হাজার ইশারা। রাস্তার পাশে চোরকাঁটা গাছগুলি দুষ্টুর মতো শাড়ির ভাঁজে ঢুকে নরম পায়ে কামড়ে কামড়ে অস্থির করে তোলে। আমি জানি গ্রামের মাটির কুঁড়েঘরগুলিতে রাম-রহিম-বনানীরা কী কঠোর পরিশ্রম আর দারিদ্র্যতার মধ্যে দিনাতিপাত করে।
এইসব জীবনসংগ্রামেই তো ইতিহাসের পাতা সমৃদ্ধ হয়। সমাজের এই পিছিয়ে থাকা বড়ো অংশের মানুষের জীবনযাত্রা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, হাসি-কান্না না বুঝলে অনেক কিছুই জীবনে অজানা থেকে যায়।
বা! আপনি তো দারুণ কথা বলেন।
হৃদয় দিয়ে প্রতিটি জিনিস বোঝার চেষ্টা করি, বলার চেষ্টা করি।
তাও ভালো। এতদিনে একজন হৃদয়বান মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল।
বিদ্রূপ করছেন?
একদম না। ভালোকে ভালো তো বলতেই হবে। তা আপনি থাকেন কোথায়?
হষ্টেলে?
বাড়ি?
কাঁথি।
কাঁথি। আগে বলবেন তো। বালিয়াড়ি আর বাদামের জন্য বিখ্যাত।
আগের মতো সেই ঐতিহ্যপ্রাচীন বালিয়াড়ি আর নেই। মানুষের থাবা সেখানে বসেছে। তবে বাদামগাছ এখনও বেশ আছে।
বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, প্রশান্ত নদী, প্রশস্ত গিরিখাত ফিসফিস করে কত কথা বলে! গাছের পাতাগুলো কী দীর্ঘশ্বাস ফেলে! ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে যে কী সুখ! মরসুমের প্রথম বর্ষায় ভিজে শরীরে যে শান্তি আসে তা সবাই অনুভব করতে পারে না। তারা বুঝতে পারে না নি:সঙ্গ নদীর কলকল শব্দে, কোজাগরী রাতের কুয়াশায় গাছে গাছে কত কথা হয়! যারা সে ভাষা বোঝে তারাই কেবলমাত্র এসব অনুভব করতে পারে।
অনেকের সাধ থাকে, ইচ্ছে থাকে, কিন্তু কঠিন বাস্তব তার সামনে দুর্গম প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। তার কোমল অনুভূতিগুলি কঠিন পাথরের আঁচড়ে আঘাত খেতে খেতে একসময় অনুভূতিহীন মৃতপ্রায় জড় পদার্থের মতো হয়ে যায়। ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা, সংসারী হাতে শয্যা, তার নরম হৃদয়ের অনুভূতিগুলোর অকালমৃত্যু ঘটিয়ে তাকে গতানুগতিক জীবনযাত্রার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে।
আঘাত ছাড়া তো মানুষের প্রকৃত প্রতিভার বিকাশ ঘটে না। নদী যেমন চড়াই উতরাই পথে ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতেই ছুটে চলে সমুদ্রসঙ্গমে, মৌসুমি বায়ু যেমন পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ে সমতলভূমিতে; তেমনি মানুষের জীবনে আঘাত এসে তার সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে, বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করতে শেখায়।
কিন্তু সেই আঘাত যদি করালগ্রাসী বন্যার মতো এসে মানুষের হৃদয়কে ধাক্কা মারে, তার উঠে দাঁড়াবার শক্তিকে পঙ্গু করে দেয়?
তবুও তাকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হবে। তা না করে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।
আপনি বোধহয় জীবনে অনেক আঘাত পেয়েছেন?
আঘাত কমবেশি সবাই পায়। কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না।
এই পৃথিবীটা বিরাট। বিপুল তার জনসংখ্যা। বিস্তৃত তার আয়োজন। কিন্তু কয়জনই বা পৃথিবী সম্পর্কে ভাবে, মানুষ সম্পর্কে বোঝবার চেষ্টা করে, প্রকৃতি সম্পর্কে ভাবে?
হয়তো আমার-আপনার মতো কিছু মানুষ আছে বলেই সেজেগুজে চাঁদ আকাশে ওঠে, নদী স্রোতস্বিনী হয়, পাখিরা গলা ছেড়ে গান গায়।
এক মুঠো হালকা হাওয়া জানালা দিয়ে ঢুকে আমাদের গায়ে এসে লাগল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেলগাছ থেকে কয়েকটি হলুদ পাতা বাতিল পোশাকের মতো ঝরে পড়ল।
আমি বললাম—চলুন, এখান থেকে উঠি।
চলুন।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে রেল স্টেশনের দিকে যেতে লাগলাম। আমাদের কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল ছিল না। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি জানি না। মনে হচ্ছে গল্প করতে করতে যেদিকে মন চায়, সেদিকে চলে যাব। কোনো নিষেধ নেই, কোনো বেড়াজাল নেই, কোনো চোখরাঙানি নেই।
দেখলাম রেললাইনের ধার ঘেঁসে একটা বস্তি গড়ে উঠেছে। কী নিদারুণ কষ্ট আর অভাবের সাথে লড়াই করে এরা বেঁচে থাকে! এদের একটাই চিন্তা—আজকে খেলাম, কাল কী খাব? এরা মন্ত্রী, আমলা, সরকার বোঝে না, ভোর হতে-না-হতেই পেটের তাগিদে ছোটে কাজের সন্ধানে। এরা বছর-শতাব্দী-যুগের রঙ্গ-তামাশা দেখে।
আমি বললাম—যারা রেললাইনে কাজ করে, পাথরের পর পাথর ভেঙে, উদয়-অস্ত পরিশ্রম করে রাস্তা বানায়, লোহার পাত ফেলে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করে, সেই সমস্ত হাজার হাজার কারিগরকে ক-জন মনে রাখে?
কেউ মনে রাখে না।
অথচ এরা না থাকলে দেশের কাজ স্তব্ধ হয়ে যাবে।
এই চাষিদের কথা ভাবুন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে অমানবিক পরিশ্রম করে মাঠে মাঠে শস্য ফলায়, মানুষের বেঁচে থাকার রসদ উৎপাদন করে, অথচ এরা কী পায়? কতটা পায়?
—ঠিক বলেছেন।
আমরা কথায় কথায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। একটি বাস একেবারে আমার গা ঘেঁসে বেরিয়ে গেল। দুর্গা আমার হাতটা ধরে রাস্তার ধারে টেনে নিয়ে বলল—তুমি এদিকে চলে এসো।
তুমি!
হ্যাঁ, তোমাকে ‘তুমি’ বলেই ডাকব। আমাকেও ‘তুমি’ বলেই ডেকো। আপনি বলতে ভালো লাগে না।
ঠিক আছে তুমি বলেই ডাকব।
দুর্গার হাতের স্পর্শ তখনও শরীরের কোষে কোষে রক্তের কণায় কণায় অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল এই পরম পরশের জন্যই কি মানুষের হৃদয় হাহাকার করে ওঠে? এই পরশেই মানুষের হৃদয় দুয়ার উথাল-পাতাল করে ওঠে?
মনে হল জীবনের একাকীত্ব দূর করার জন্য একজন মানুষ পেলাম যাকে মনের সমস্ত কথা প্রাণখুলে বলা যায়। পৃথিবীর সব জানা-অজানা, চেনা-অচেনার মাঝে সেই বিশেষ মানুষটি তার কথা ভাববে, যত্ন নেবে, পাশে দাঁড়াবে, ছোটো-বড়ো সমস্যার উত্তর খুঁজে বের করবে, নিজেদের দুঃখ-আনন্দকে ভাগ করে নেবে।
মনে হল জীবনের আলাদা বর্ণ আছে, আলাদা গন্ধ আছে। জ্যোৎস্নার বর্ণচ্ছটায়, গাছে গাছে, ঝরা ফুলে, মাটির উদারতায়, নারীর হৃদয় পরশে তা নতুনভাবে হাজির হয়। আজ মনে হল এ পৃথিবী উর্বরা, এ প্রকৃতি উদার, এ জগৎ সৌন্দর্যের পূজারি; এ হৃদয় ভালোবাসায় সম্পৃক্ত হয়, তৃপ্ত হয়। মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে যা বেমানান, বেসুরো জীবনে ছন্দ আনে, গতি আনে। চারপাশের লোকজন খুব কাছের মনে হয়। অজানা পথ, অচেনা রং কেমন জানা হয়ে যায়। ধু-ধু তৃষ্ণাতুর মরুজীবনে ছায়াঘেরা মরুদ্যানের মতো হৃদয়ের আমন্ত্রণ নিয়ে হাজির হয় সম্পূর্ণ অপরিচিতা কিংবা অর্ধ-পরিচিতা কেউ।
ও বলল—রিকশায় যাবে?
রিকশায়? কোথায় যাবে?
যেকোনো একটা দিকে।
একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল বলতে হবে তো।
স্টেশনেই যাব।
চলো।
দুর্গা একটা রিকশা দাঁড় করাল। আমরা রিকশায় উঠে পাশাপাশি বসলাম। কীরকম একটা আলাদা অনুভূতি, আলাদা অভিব্যক্তি!
রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল—বাবু খুচরো আছে তো?
আমি বেশ ভাব নিয়ে বললাম—সে চলো, দেখা যাবে।
প্রতিদিনের চেনা রাস্তা, চেনা শহরকে আজ বেশ তারিয়ে তারিয়ে দেখছিলাম। দেখছিলাম ব্যস্ত মানুষজন হাতে, কাঁধে, মাথায় মালপত্র নিয়ে কেমন দৌড়ে চলেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দড়ি টানাটানিতে মাঝে মাঝে এই মানুষজনের মাঝে গোল বাধে, আবার নিজেরা মিটিয়েও নেয়।
রিকশাওয়ালা বলল—বাবু, গাংপুরের দিকে আজ বড়ো গন্ডগোল হয়েছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—কেন?
—দুই ভাইয়ের মধ্যে। সম্পত্তির ভাগ নিয়ে গন্ডগোল। পাড়াপড়শিরা একে অন্যের বিরুদ্ধে কান ভাঙানি দিয়েছে। তারপর আছে পার্টি।
—ওদের তো পারিবারিক ঝামেলা।
—ওসব আর নেই বাবু। সব জায়গায় এখন দলাদলি। বলুন তো বাবু, নিজের মায়ের পেটের ভাই। মারামারি করবি?
দুর্গা বলল—ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য মানুষ বাবা-মা-ভাই-বোন মানছে না। অর্থের জন্য, সম্পত্তির জন্য সম্পর্ককে অস্বীকার করছে।
আমি বললাম—ঘাত-প্রতিঘাত, অনিশ্চয়তায় ভুগতে ভুগতে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসটা কেমন হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ বড়ো কমার্শিয়াল। তোমার সঙ্গে কথা বলার আগে দেখে নেয় তোমার ভাঁড়ারে কী আছে, কতটা আছে।
বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীর সংসারকে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে কোনো অপূর্ণতাই ধরা পড়ে না। মনে হয় সেখানে দুঃখ, কষ্টের কোনো স্থান নেই। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়—বাইরে থেকে যে সংসারকে সুখী বলে মনে হয়, তার অন্তরালে রয়েছে অশান্তির চোরাস্রোত, মনের অভাব, বোঝাপড়ার অভাব ঘুন পোকার মতো বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। বাইরের প্রলেপ দেওয়া সুখী সংসারের ঢাকনাটা অন্তঃসারশূন্য।
রিকশাওয়ালা বলল—সবই অধঃপতন। ছেলে-মেয়ে-বউ—কেউ কাউকে মানে না।
আমি বললাম—মানে, আজও মানে। হয়তো ব্যতিক্রম আছে, এবং সেই সংখ্যাটা ইদানীং বেড়েছে। তবু বলব মানুষ মানুষকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।
দুর্গা বলল—তুমি তো আমাদের দেখেও বুঝতে পারছ না।
আমি বললাম—এসব কী হচ্ছে। কাকে কী বলছ?
রিকশাওয়ালা বলল—সব বুঝতে পারি বাবু। স্কুল পড়ুয়া, কলেজ পড়ুয়া ছেলে- মেয়েরা ছেলেবন্ধু-মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে দিল্লি, মুম্বাই বেড়াতে চলে যাচ্ছে। দিন-রাত একসঙ্গে থেকে ভদ্র ছেলে-মেয়ে সেজে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আমরা সব বুঝতে পারি। স্যুট-বুট পরলেই ভালো হওয়া যায় না।
আমি বললাম—হল তো! জবাব পেয়ে গেলে! কী দরকার ছিল ওঁকে শুনিয়ে বলা।
দুর্গা বলল—তো খারাপ কিছু বলেনি, যা দেখছে, যা শুনছে, যা ঘটছে, তাই বলেছে।
আমি চুপ করে গেলাম। যে সত্যিগুলো জেনে, বুঝে, দেখেও আমরা না দেখার, না বোঝার ভান করে এড়িয়ে যাই; অপ্রিয় সত্যি কথাটা সামনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি বলার সাহস রাখি না; নিজেকে বুদ্ধিমান বা চিন্তাশীল মানুষ প্রতিপন্ন করে সমাজের অনেক অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস নিয়ে সমালোচনা করি না; সেই সহজ-সরল-সত্যি কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলে ফেলল এই রিকশাওয়ালা।
মনে মনে রিকশাওয়ালাটিকে বললাম—তুমিই স্পষ্টবাদী, সমাজ সচেতন, চিন্তাশীল মানুষ। যারা তথাকথিত ভদ্রপোশাক পরে তোমার রিকশায় চেপে ‘তুই এখানে নিয়ে চল’, ‘তোরা খুব বেড়েছিস’ বলে চোখ রাঙায়, তাদের অনেকেই তোমার মতো স্পষ্টবাদী, সমাজ সচেতন মানুষ নন।
ইন্দ্র সাইকেলে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। আমাদের দেখে হাত নেড়ে বলল—কোথায় যাচ্ছিস?
এই তো স্টেশনের দিকে।
তুই?
টিউশন পড়াতে।
এখন?
সন্ধ্যায় অন্য প্রোগ্রাম আছে, তাই এখনই পড়িয়ে দেব।
কোন ক্লাস?
ফার্স্ট ইয়ার।
কোন সাবজেক্ট?
জিওগ্রাফি অনার্স।
তুই জিওগ্রাফি পড়াস নাকি?
না রে, কম্পালসারি ইংলিশ।
ছেলে না মেয়ে?
কিছু একটা হবে। এই বলে হাসতে লাগল।
বুঝেছি বৎস, তাড়াতাড়ি যা। হয়তো তোর জন্য জানালার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
সেরকম কিছু নয়।
কিছু হলেই বা কী?
যাই রে, কালকে ক্লাসে দেখা হবে।
ইন্দ্র চলে যেতেই দুর্গা বলল—ছেলেটি তোমার বন্ধু?
বন্ধু ঠিক নয়, সহপাঠী। তবে ছেলেটি ভালো।
ভালো না ছাই।
এমন বলছ কেন?
তুমি যখন ওর সঙ্গে কথা বলছিলে তখন ও আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল।
তাকালেই খারাপ হয়ে গেল?
তাকানোর ধরনটা ভালো ছিল না।
কোনোদিন আমাদের এভাবে দেখেনি তো।
ওর বাড়ি এখানে?
না মেসে থাকে। সকাল-সন্ধ্যায় টিউশনি করে।
শুনলাম। ছাত্রীর সঙ্গে…। এই বলে দুর্গা হেসে উঠল। আমিও হেসে উঠলাম।
স্টেশনে এসে রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ও চলে গেল। দুর্গা বলল—চলো, কোথাও গিয়ে বসি।
কোথায় বসবে?
তুমি বলো।
প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে যাত্রীদের বসার জন্য যে সিটগুলি থাকে।
তাই চলো।
আমরা একটি প্ল্যাটফর্মের মাথার দিকে শেডের নীচে গিয়ে বসলাম। এদিকটা বেশ ফাঁকা। যখনই কোনো ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকে, তখনই কিছু যাত্রী এদিক থেকে ওঠানামা করে। এক একটি ট্রেন ঢুকছে, প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়াচ্ছে, চলে যাচ্ছে। এই চলমান যন্ত্রযানের ওপরেই এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকাংশে নির্ভরশীল।
একটি মেল ট্রেন ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। কয়েকটি পাখি চক্রাকারে আকাশের নীল সীমানায় পাক খেতে খেতে আরও দূরে চলে গেল। একমুঠো উত্তাল হাওয়া আমাদের চোখে মুখে এসে লাগল। দেখলাম দুর্গা চোখ বন্ধ করে গভীর ঘ্রাণ নিল। একটা দমদমমুখী এরোপ্লেন আকাশকে ভেদ করে দূর-আকাশে মিলিয়ে গেল।
সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুর্গা বলল—একদিন তুমি যখন বড়ো চাকরি করবে, এই প্লেনে করেই দেশ-বিদেশ যাতায়াত করবে।
তুমিও করবে।
আমার ওসব হবে না। তোমাদের আইন-টাইনের ব্যাপার। হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। তোমাদের তো এদিক-ওদিক যেতেই হবে।
তোমার তো আরও বড়ো ব্যাপার। পরিবেশ রক্ষার জন্য, গবেষণার জন্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দৌড়োতে হবে। সেখানে আমরা চুনো-পুঁটি।
প্ল্যাটফর্মের অন্য প্রান্ত থেকে একটি বউ হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। বয়স আঠারো-কুড়ি হবে। সঙ্গে দুটো বাচ্চা। একটা কোলে, আর একটা হাত ধরে দাঁড়িয়ে। পরনে হালকা হলুদ রঙের মলিন শাড়ি। লাল ব্লাউজ। ফর্সা মুখে বিষণ্ণতা, শরীরে অপুষ্টির ছাপ। মনে হল অনাদরে, অবহেলায় বাগানের একটি ফুল তার নিজস্ব সৌন্দর্য হারিয়ে জীবনযন্ত্রণায় নীরবে বিদীর্ণ হচ্ছে। একটু সোহাগ আর একটু ভালোবাসা পেলে ওই ফুলটিও অনেককে আকর্ষণ করত, বাগানে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে শোভা বর্ধন করত।
দুর্গা বলল—দেখো, কত কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে দুটো বাচ্চা।
আমাদের দেশে এখনও নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। দরিদ্র, অসহায় বাবা-মা, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনোক্রমে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেই তারা ‘নিজেদের কর্তব্য যথাসময়ে পালন করেছে’ বলে মনে করে।
অনেকে আবার প্রলুব্ধ হয়ে, কেউ-বা বাবা-মাকে কন্যাদায়ের মতো পর্বতপ্রমাণ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।
আজকের দিনে অনেক নাবালিকা মেয়ে আবার বিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। নিজেরাই থানায় গিয়ে প্রশাসনের সাহায্য চাইছে।
অনেকে আবার বাবা-মার কথায় রাজি হয়ে বিয়ে করেও নিচ্ছে।
বউটি আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল—দাদা, মেল ট্রেন কখন আসবে?
আমি বললাম—একটু পরেই আসবে। ওখানে দাঁড়ান।
দুর্গা জিজ্ঞেস করল—আপনি কোথায় যাবেন?
বউটি বলল—কোথাও না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
এই বলে বউটা আরও বেশ কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
দুর্গা বলল—কিছু একটা সমস্যা আছে। বউটা কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। একবার এদিকে, একবার ওদিকে হাঁটছে।
আমিও বউটিকে বেশ অস্থির দেখলাম।
একটি চাওয়ালা চা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করছিল। দুর্গা ওকে কাছে ডেকে দুটো চা দিতে বলে। একটা বারো চোদ্দো বছরের ছেলে প্ল্যাটফর্মে হেঁটে হেঁটে আলুর চিপস বিক্রি করছিল—চিপস চাই চিপস। আলুর চিপস, কচুর চিপস।
আমি হাত নেড়ে ডাকতেই ও কাছে এল। বললাম—তোর চিপস কত করে।
ছেলেটির চোখমুখ প্রত্যাশায় জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল—কটা দেব দাদা?
আগে কত করে বল?
কোনটা—আলুর চিপস না কচুর?
কোনটা কত দাম?
আলু একটা দুই, তিনটে পাঁচ টাকা।
কচু?
একটা পাঁচ, তিনটে দশ।
দুর্গা বলল—দুটো আলু আর একটা কচুর চিপস দে।
ছেলেটি বলল—এতে তো তোমার লোকসান, দিদি তুমি তিনটে আলু, একটা কচুর চিপস নাও। আমি কাউকে ঠকাই না দিদি। দু-বছর এই ব্যবসায় আছি। কেউ বলতে পারবে না যে আমি কাউকে ঠকিয়েছি।
ওর কথাবার্তায় চোখেমুখে গভীর প্রত্যয় ফুটে উঠল। দুর্গা বলল—ঠিক আছে তাই দে।
আমরা বসে চা আর চিপস খাচ্ছিলাম।
একটি মেয়ে হন হন করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। স্লিম, ফর্সা। কপালে লাল টিপ, ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপস্টিক। বেশ দামি ঘড়ি। চোখে একটি সুন্দর ফ্রেমের সানগ্লাস। কাঁধে লেদারের ব্যাগ।
দুর্গাকে উদ্দেশ্য করে বলল—তুই এখানে?
আরে ইলা, তুই! বাড়ি যাবি?
বাড়ি ঠিক নয়, আত্মীয়ের বাড়িতে যাব। বাবার পিসতুতো দাদার নাতির অন্নপ্রাশন। বাবা যেতে পারবে না, কোনো একটা কাজে আটকে গেছে। অগত্যা ফোন। আমাকেই যেতে হচ্ছে।
আজকে তো ছুটি আছে, ঘুরে আয়।
গেলে কি আর সঙ্গে সঙ্গে ছাড়বে ভেবেছিস।
আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল। এই হাসির অর্থ যে কী তা আমার মতো গবেটের পক্ষে বোঝা মুশকিল। নারীর যে কত ভাষা—মুখের ভাষা, চোখের ভাষা, শরীরের ভাষা, হাসির ভাষা, তা স্বয়ং ঈশ্বর বুঝতে পারেন কিনা কে জানে!
আমি বললাম—আপনি বসুন না।
দুর্গা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল—ও হল ইলা হালদার, আমার সহপাঠী বন্ধু। আর ও হল প্রিয়ব্রত, আইনের লোক, আমার বন্ধু।
ইলা দুর্গার পাশে বসল।
একটা চিপসের ঠোঙা ওর হাতে দিয়ে দুর্গা বলল—এটা টেস্ট করে দেখ। বেশ ভালো লাগবে।
আমরা তিন জনে বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় একটা মেলট্রেন হর্ন দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছিল। গতিটা তেমন ছিল না।
হঠাৎ ওই বউটা বাচ্চা দুটো নিয়ে রেললাইনে ঝাঁপ দেয়। দুর্গা সর্বপ্রথম দেখতে পায়। সে চিৎকার করে ওঠে—ট্রেন থামাও, ট্রেন থামাও, ট্রেন রুখ দো, ট্রেন রুখ দো। তারপর নিজের রুমালটা নাড়িয়ে ট্রেনের ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে।
আমরাও সেখানে দৌড়ে যাই। প্ল্যাটফর্মে এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরাও সেখানে দৌড়ে আসে। ড্রাইভার ব্যাপারটা আন্দাজ করে ট্রেনটা দাঁড় করিয়ে দেয়।
সকলে ধরাধরি করে বউটিকে এবং বাচ্চা দু-টিকে ট্রেনলাইন থেকে তুলে প্ল্যাটফর্মে রাখল। ট্রেনলাইনে পাতের ওপর পড়ে বাচ্চা দু-টোর মাথা ফেটে গেছে। বউটি অজ্ঞান হয়ে গেছে।
দুর্গা বলল—ইলা তুই কোথায় যাবি বললি চলে যা, আমরা হাসপাতালে যাব।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল—চলো, আমরা এদের হাসপাতালে নিয়ে যাই।
আমি বললাম—আমরা? রেলের লোকজন আছে তো।
ওরা যতক্ষণে ব্যবস্থা করে নিয়ে যাবে, ততক্ষণে কোনো লাভ হবে না।
দুর্গা, আমি আর কয়েকজন যাত্রী মিলে ওদেরকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দেখলাম দুর্গার সে কী আত্মবিশ্বাস আর ধৈর্য।
অনেক চেষ্টার পর ডাক্তারেরা বউটিকে বাঁচাতে পারলেও বাচ্চাদু-টিকে বাঁচাতে পারেনি।
সেদিন বাড়ি ফিরে আমি গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি, বার বার দুর্গার মুখটা আমার সামনে ভেসে ওঠে। আজ বুঝলাম দুর্গার হৃদয়ের উঠোনটা এত বড়ো, তার মনের পরিসর এত বিস্তীর্ণ, তার চিন্তাভাবনা এত সমৃদ্ধ যে তাকে আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে পরিমাপ করা যায় না, তুলনা করা চলে না।
মনে মনে বললাম—দুর্গা, আজ তুমি যা করলে, তার জন্য ঈশ্বরের অপরিমেয় আশীর্বাদ তোমার ওপর ঝরে পড়ুক, মানুষের ভালোবাসায় তোমার উদার হৃদয় আরও সমৃদ্ধ হোক, আমার হৃদয়ে মন্দিরে তুমি সারাজীবন বিরাজ করো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন