দুর্গার এক কাকা আর দুই পিসি। পিসিদের কাছাকাছি বিয়ে হলেও কাকা প্রলয় সামন্ত প্রতিরক্ষা দপ্তরে চাকরি পেয়ে সেই যে দিল্লি গেল, আর ফিরল না। ওখানেই সেটেলড হয়ে গেল। তবে কাকিমার বাপের বাড়ি হলদিয়ার সূতাহাটা হওয়ায় বছরে অন্তত একবার সপরিবারে এসে দুর্গাদের বাড়িতে ওঠে। দিন পনেরো হইহুল্লোড় করে আবার দিল্লি চলে যায়। বেশ লাগে দুর্গার। আসার সময় দুর্গার জন্য শাড়ি, চূড়িদার, পারফিউম নিয়ে আসে। রেখা কাকিমার কোনো মেয়ে নেই। তাই দুর্গাকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করে। আর তাদের একমাত্র ছেলে পুলক দুর্গাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে।
পুলক সামন্ত একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে আছে। এম.বি.এ. করার পর বেশ কয়েকটি কোম্পানি পালটে এতেই থিতু হয়েছে। কোম্পানির প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমনকী বিদেশেও যেতে হয়।
কোম্পানির কলকাতা ব্রাঞ্চের নতুন ওয়ার্কশপে ট্রেনার হিসেবে পুলকের নাম যখন বিবেচিত হল তখন লোটা কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে ওর বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি। কোম্পানি থেকে থাকা-খাওয়ার সমস্ত বন্দোবস্তই করে দিয়েছিল। কিন্তু পুলক এই সুযোগ হাতছাড়া করে! সে এসে উঠল হলদিয়ায় কাকার বাড়িতেই। সঙ্গে বছর দুয়েকের ছোটো রাজা। সবে এম.বি.এ. শেষ হয়েছে। একটি কোম্পানি থেকে নিয়োগপত্রও পেয়ে গেছে। দিন কুড়ির পর কাজে যোগ দেবে। সে এসে বলল—
পুলকদা, তুমি কলকাতায় যাচ্ছ, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। হাতে দিনকুড়ি সময় আছে। এই ফাঁকে কলকাতা বেড়িয়ে আসি।
আমি কলকাতায় থাকছি না। হলদিয়ায় কাকার বাড়িতে থাকব। ওখান থেকে কলকাতা প্রায় ঘণ্টা তিনেকের পথ।
খুব মজা হবে। গ্রামে গিয়ে থাকব। গ্রাম সেইভাবে আমার দেখা হয়নি। মার মুখে শুনেছি সব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছোয়নি। হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করে। রাত্রিবেলা আঁধার নামলে চোর-ডাকাত-ভূতের ভয়ে লোকেরা রাস্তাঘাটে বের হয় না।
কত বছর আগের কথা বলছিস?
দশ-পনেরো বছর আগের কথা।
এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তবু তো খবরে দেখি, না খেতে পেয়ে লোকে মারা যায়, দেনার দায়ে কৃষক আত্মহত্যা করে।
তা ঘটে। তবে আগের চেয়ে গ্রামের মানুষের অনেক উন্নতি হয়েছে।
তাহলে যাচ্ছি।
কাকার বাড়িতে গিয়ে থাকব। আবার তুইও সঙ্গে যাবি। ওদের ঝামেলা বাড়বে।
ঠিক আছে তোমার কাকার বাড়িতে সপ্তাহ খানেক থেকে ব্যারাকপুরে মাসির বাড়ি চলে যাব।
তুই কিছু মনে করলি?
একেবারে না।
ঠিক আছে চল।
দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা। ওর বাবা পরেশ পাহাড়ি কৃষ্ণনগরের ছেলে। পড়াশোনার জন্য জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়। তখন থেকে এখানেই থেকে গেছে। পাড়ার মেয়ে সোমাকে বিয়ে করে সেই যে চলে এসেছে আর ওমুখো হয়নি।
রাজধানী এক্সপ্রেসে হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে হলদিয়া লোকাল ধরে হলদিয়া। তারপর ভ্যানরিকশা ধরে বৃন্দাবনচক। গ্রামের এই ছায়াশীতল প্রকৃতি পুলককে বার বার হাতছানি দেয়। নেতা-মন্ত্রীদের ক্ষমতার ভাগাভাগি নেই, একজনকে গদিচ্যুত করে আর একজনের গদি দখলের নগ্ন রাজনীতি নেই, নাইট ক্লাব, পার্টি নেই, মিথ্যা অহমিকা নেই, উগ্র আধুনিকতা নেই। আছে দু-বেলা ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ প্রয়াস, আছে খালি পায়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো অপুষ্ট ছেলে-মেয়েদের উৎসুক মুখ, আছে নূপুর পায়ে গ্রাম্য বালিকাবধূর পুকুরঘাটে জল আনতে যাওয়া, বুড়ো-যুবকদের তাসের আড্ডা, সবুজ খেত।
রিকশা যতই গ্রামের রাস্তা পের হচ্ছে, রাজা ততই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে—পুলকদা, এই সরু রাস্তা তো এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়ে গেছে, তারপর?
এই রাস্তা নিশ্চয়ই অন্য একটি রাস্তার সঙ্গে মিশে গেছে।
এখানে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কোথায় যায়?
কেন হলদিয়াতে। তা ছাড়া স্থানীয় ডাক্তার আছে।
সিনেমা, থিয়েটার আছে?
সবই আছে। তা তোমার মাল্টিপ্লেক্স হলগুলোর মতো নয়।
তবে?
কীর্তন শুনেছিস কোনোদিন?
সে আবার কী?
শুনলে বুঝতে পারবি। কত দরদ আর সাধনা দিয়ে এই কীর্তন গাওয়া হয়!
তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?
কাছাকাছি কোথাও হলে নিয়ে যাব।
ভ্যানরিকশা আরও কিছুটা যেতে একটা পুকুর পড়ল। সেখানে গ্রামের লোকেরা মাছ ধরছে। তা দেখে রাজা চিৎকার করে বলল—হাউ ইন্টারেস্টিং দিস ইজ! এখানে কুমির থাকে না?
না রে বোকা, গ্রামের এই পুকুরে কুমির কোথা থেকে আসবে? কুমির তো নদী-সমুদ্রে থাকে।
কিন্তু সাপ তো থাকে।
তা থাকে।
তাহলে?
ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে। ওরা জানে কোথায় সাপ থাকে। তা ছাড়া সাপেদেরও তো ভয় থাকে।
তুমি বুঝি পুকুরে স্নান করবে?
হ্যাঁ, তুইও করতে পারিস।
দারুণ মজা হবে।
সাঁতার জানিস তো?
আমাদের সুইমিং পুলে শিখেছিলাম। বেশ কয়েকবছর অবশ্য সাঁতার কাটা হয়নি।
ভেবে দেখ পারবি কিনা। জলে ডুবে মরলে আমায় জেল খাটতে হবে।
তুমি জেল খাটবে কেন?
পুলিশ এতসব বুঝবে না। বলবে আমি জেনেশুনে তোকে গভীরে ঠেলে দিয়েছি। তা ছাড়া এখানকার গ্রামের লোকেরা আমায় ছাড়বে ভেবেছিস?
জলে ডুবে আমি মরব, আর তোমার দোষ হবে কেন?
যেখানে যেমন নিয়ম।
এই গ্রামের কিছু লোক পুলককে চেনে। গতবারে পুলক এখানকার এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম নিয়ে গান গেয়েছিল। লোকজন তাতে খুব খুশি হয়েছিল। সবাই বলছিল—দিল্লিতে থাকলেও ছেলেটা একেবারে মাটির মানুষ। মাটির মানুষের গান গায়। সেবারে অনেক গুণমুগ্ধ ভক্তও জুটেছিল।
পুলককে দেখে গ্রামের ছেলেরা দৌড়ে এল। ভ্যানরিকশা থামিয়ে ঘিরে ধরে বলল—
পুলকদা, কেমন আছ?
ভালো, তোমরা কেমন আছ?
আমরা ভালো আছি। তুমি এবার কতদিন থাকছ?
মাস খানেক।
ওরা আনন্দে বলে উঠল—খুব ভালো। এবার অনুষ্ঠানটা দারুণ জমবে।
পলাশ বলল—এবার তো আমি অফিসের কাজে এসেছি। রোজ কলকাতায় যেতে হবে।
রোজ যেতে হবে? ওদের মুখগুলো কেমন শুকিয়ে গেল।
ছুটির দিনগুলোতে আমরা গল্প করব।
ঠিক?
ঠিক। এই বলে পলাশ ব্যাগ থেকে এক ডজন পেন বের করে ওদের হাতে তুলে দেয়। ওরা বলল—পলাশদা, এগুলো দিল্লির পেন বুঝি?
হ্যাঁ।
এখন বাড়ি যাও। পরে এসো কিন্তু। সঙ্গের দাদাটি কে—বন্ধু?
হুঁ।
ভ্যানরিকশা আর কিছুটা গিয়ে মোড় নিতেই একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। উঠোনের এক পাশে তুলসী মঞ্চ। একটা প্রকান্ড আমগাছ বাড়ির একপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কয়েকটা পায়রা দোতলার বারান্দায় বাসা বেঁধেছে। একটা পেয়ারা গাছ পাঁচিলের ধারে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের বাঁশঝাড় থেকে সোঁ সোঁ স্বরে বইছে বাতাস। একটা কম বয়সী সবেদা গাছ বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে আপন খেয়ালে মাথা দোলাচ্ছে।
পুলকের জেঠু প্রভাত সামন্ত বাড়িতেই ছিলেন। জেঠিমা তপতী সামন্ত পাশের প্রতিবেশীর বাড়িতে গেছিলেন। পুলকদের আসার সংবাদ পেয়ে হাতে কয়েক আঁটি কলমি শাক নিয়ে চলে এলেন।
সবাইকে প্রণাম করার পর পুলক জিজ্ঞেস করে—জেঠিমা তোমার হাতে কী?
কলমি শাক। তুই খুব পছন্দ করিস তাই পাশের প্রতিমাদের বাড়িতে গেছিলাম। তোর আসার সংবাদ পেয়ে এই ক-টি নিয়েই চলে এলাম। তারপর রাজার দিকে তাকিয়ে বলে—পুলক, এই তোর বন্ধু?
জেঠিমা, ও আমাদের পাড়ায় থাকে। বছর দুয়েকের ছোটো। বাঙালি ছেলে। কৃষ্ণনগরে ওর দেশ বাড়ি, মামার বাড়ি। সবে এম.বি.এ. শেষে করেছে। চাকরির অফারও পেয়েছে। মাস খানেকের মধ্যেই কাজে যোগ দেবে। বলল—‘গ্রাম দেখবে’। বললাম—চল। একটু বাঁদর গোছের আছে।
এসব কথা বলতে নেই পলাশ।
স্যরি, জেঠিমা।
প্রলয়, রেখা এরা সব ভালো আছে তো?
সবাই ভালো আছে।
একসঙ্গে ঘুরে যেতে পারত।
বাবার অফিসের কাজ আছে। পরে আসবে কখনো।
প্রভাত সামন্ত বলল—তপু, তুমি তখন থেকে বকবক করছ। ওরা কোন সুদূর থেকে এসেছে। ওদের কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা করো।
তপতী দেবী বলল—তোরা হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমি এখুনি জলখাবারের ব্যবস্থা করছি। পুলক বলল—জেঠিমা, আমার লক্ষ্মী বোনটি কোথায়? বাড়ি নেই?
ও তো বর্ধমানে থাকে। তোদের আসার খবর পাঠানো হয়েছে। বিকেলের মধ্যেই এসে পড়বে।
ও না থাকলে কোনো মজাই জমে না।
ও তো সবসময় তোর কথা বলে। দাদা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। খুব পড়াশোনা করত। আমার দাদা একদিন খুব বড়ো হবে।
খুব পেকেছে না।
মাঝে মাঝে চিন্তাও হয়।
চিন্তা কীসের?
মেয়ে বড়ো হলে বাবা-মার কী চিন্তার শেষ আছে, কখন কী হয়?
তুমি চিন্তা কোরো না জেঠিমা। বোন আমার খাঁটি সোনা। দেখবে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
আমি তো ভগবানের কাছে তোদের সকলের মঙ্গল কামনা করি।
এই বলে উনি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
রাজা বলল—পুলকদা, তোমার জেঠিমা খুব উদার মানুষ। এত উদারতা ভালো নয়।
বাজে বকিস না। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নে।
মুড়ি-নারকেল-কাঁচা ছোলা। নিজেদের বাগানের শশা। তেল-পিঁয়াজ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে দুই বাটি ভরতি করে জেঠিমা ওদের দিয়ে গেল। সঙ্গে চা-বিস্কুট, নারকেল নাড়ু। দু-টো করে বড়ো বড়ো রসগোল্লা। দু-বাটি গোবিন্দভোগ চালের পায়েস।
পলাশ বলল—এতসব কেন জেঠিমা? আমরা তো ট্রেনে খেয়েই এসেছি।
রাজা বলল—নিজেদের গোরুর দুধ?
জেঠিমা বলল—আগে ছিল। এখন ওসব যত্নআত্তি করতে পারি না। তবে পাশের বাড়ির থেকে আনিয়েছি। একদম খাঁটি দুধ। চালটা নিজেদের জমির ফসল।
জেঠু-জেঠিমার দিকে ইশারা করে বলল—আর দু-খানা নারকেল নাড়ু দাও। ওগুলো সব নিজেদের গাছের। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফলন আর আগের মতো হয় না। যে ক-টিই বা হয়, লোকে চুরি করে নেয়। তোরা যাওয়ার সময় কিছু নারকেল নিয়ে যাস। বাড়িতে পড়ে পড়ে এগুলো নষ্ট হচ্ছে।
রাজা বলল—এগুলো দিল্লি নিয়ে যাব?
—হ্যাঁ, নিয়ে যাবি। ভালো করে বেঁধে ব্যাগে পুরে দিলে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না।
ট্রেনে বোমা মনে করে যদি সিকিউরিটি আটকায়?
খুলে দেখিয়ে দিবি।
পলাশ বলল—জেঠু, ওসব দিল্লি-টিল্লি পাঠাতে হবে না। যে ক-দিন ও এখানে থাকবে, খেয়ে সব শেষ করে দেবে।
জেঠু হাসতে হাসতে বলল—তাহলে তো খুব ভালো। এতদিনে একজন খানেবাজ ছেলে পাওয়া গেল।
ও খুব ভালো খায় জেঠু। খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা পুকুরে মাছ ধরব। তুমি দুটো ছিপ জোগাড় করে দাও।
তোরা মাছ ধরবি?
কেন গতবারে আমি কতগুলো মাছ ধরেছিলাম। তাই না জেঠিমা?
জেঠিমা বলল—তোরা খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম কর। মাছ ধরার লোকের অভাব আছে নাকি?
রাজা বলল—না, জেঠিমা। মাছ আমরাই ধরব। আমাদের ধরা মাছেই রান্না হবে। খুব মজা তাই না?
পুলক বলল—ট্রেনের মধ্যে ও আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে যে ও ছিপ ফেলে মাছ ধরবে।
জেঠু বলল—তোরা যা পারিস কর। আমি দুটো ছিপ জোগাড় করে দিচ্ছি।
খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা দুটো ছিপ নিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরটায় গিয়ে মাছ ধরতে বসে। প্রথম প্রথম বেশ কয়েকটা রুই, জাপানি পুঁটি, কই, ট্যাংরা ধরা পড়লেও পরে আর কেউ টোপ গিলছে না।
রাজা বলল—পলাশদা, পুকুরের মাছ কি সব শেষ হয়ে গেল?
না রে, ওগুলো চালাক হয়ে গেছে। ছিপ বুঝেই ধারে কাছে ঘেঁসছে না।
ওরাও সব বুঝতে পারে?
—সমস্ত প্রাণীরই বিশেষ কিছু অনুভূতির অঙ্গ থাকে। মাঝে মাঝে বোকা বনে টোপ গিললেই কেল্লাফতে।
পুকুরপাড়ে বেশ কয়েকটি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া আম গাছ, বয়স্ক নারকেল গাছ। এক কোণে একটা জাম গাছ। বাগানে পেয়ারা, সবেদা, পেঁপে, কলা গাছ। সেই দিকে তাকিয়ে আপন খেয়ালে রাজা বলে—এত সবজি, ফল, মাছ থেকেও গ্রামে এত অভাব কেন? কেন না-খেতে পেয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে?
পলাশ বলে—সবার তো এই পুকুর, বাগান, ধানখেত নেই। অনেক পরিবারে সদস্য সংখ্যা এত বেশি যে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি থেকে যায়। তা ছাড়া চাষবাসের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজে এত বৈষম্য কেন?
পলাশ এই প্রসঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই দুর্গা পেছন দিক থেকে এসে হাতটা ধরে বলল—কী সব গুরুগম্ভীর আলোচনা হচ্ছে শুনি?
পলাশ বলল—আরে তুই কখন এলি?
এই তো এলাম। ব্যাগপত্র রেখে সোজা চলে এলাম। কী মাছ ধরেছ দেখি? রাজার দিকে ইঙ্গিত করে বলল—ওর পাল্লায় পড়ে চলে এলাম। তুই কেমন আছিস?
ভালো। আর একবছর হলেই শেষ। তারপর কলকাতায় চলে যাব। রিসার্চ করব।
খুব ভালো। জেঠু-জেঠিমাকে বলেছিলাম আমার বোন খাঁটি সোনা। ও সকলের মুখ উজ্জ্বল করবে।
দুর্গা ড্যাবড্যাব করে পলাশের দিকে তাকিয়ে বলল—দাদা, তোমাকে আর আমার গুণগান গাইতে হবে না। তোমার বন্ধুটির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দাও।
পলাশ দুর্গার সঙ্গে রাজার আলাপ করিয়ে দিল।
দুর্গা বলল—নমস্কার রাজাদা, আমাদের এখানে তোমার কেমন লাগছে?
রাজা একদৃষ্টিতে দুর্গার দিকে তাকিয়ে থাকে। লম্বা, ফর্সা, তন্বী। কাজল কালো চোখ, লাল ঠোঁট, কপালে লাল টিপ। কালো রঙের চূড়িদারে দুর্গাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।
এ এক ফুটন্ত গোলাপ—ভ্রমরেরা গুনগুন করে এই গোলাপের চারদিকে তো ঘুরবেই! ওর শরীরের অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের উচ্ছ্বল জলতরঙ্গ—প্রেমপিপাসু যুবকেরা এই জলতরঙ্গে সাঁতার কাটতে চাইবে! এ এক সুরেলা বাসন্তী হাওয়া—যার স্পর্শে মরচে ধরা পুরোনো বীণাও রিনঝিন স্বরে বেজে উঠবে।
রাজা ভাবছে—এই কাদামাটির গ্রামের উঠোনে এরকম একটি সুন্দর গোলাপ! কোনো কৃত্রিমতা নেই, ভনিতা নেই, বিউটি পার্লারের চটকদারি নেই। প্রকৃতির কোলে আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা এক অনন্য বনফুল।
রাজাকে অন্যমনস্ক দেখে দুর্গা বলল—রাজাদা, কিছু ভাবছে? কিছু বলছে না?
রাজা একটু থিতু হয়ে বলল—অসাধারণ, মনে হচ্ছে সারাজীবন এখানে থেকে যাই।
এত তাড়াতাড়ি এখানকার প্রেমে পড়ে গেলে?
বলতে পার।
বিকেলে গ্রাম ঘুরতে বেরোব। তুমি যাবে তো?
নিশ্চয়ই যাব।
দুপুরের রুদ্রতেজ আর নেই। আর কিছু পরে পশ্চিম আকাশের রহস্যময় সীমান্তরেখায় মুখ লুকোবে। সারা পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে তার লালাভ বিচ্ছুরণ। প্রান্ত খোলামাঠ থেকে গোরুর পালের ঘরে ফেরা, নীল সীমানার বুকে পাখিদের মুক্ত বিচরণ, পুকুরের স্থিরজলে হাঁসগুলোর জলক্রীড়া, কিশোর বালকদের রামসীতা-কাবাডি-ফুটবল খেলে বাড়ি ফেরা, গ্রামের মেয়ে-বউদের কাঁখে কলসি নিয়ে বড়ো রাস্তার মোড়ের নলকূপ থেকে জল নিয়ে আসা—এসব এই গ্রামের নিত্যদিনের পরিচিত দৃশ্য।
রাস্তার ওপারে ভানু কাকা উঠোনে দাঁড়িয়ে আপন খেয়ালে কী যেন বলছিল।
দুর্গা বলল—কাকু, তুমি একা একা কী বলছে?
লাউগাছটাকে যতই লাঠিতে বেঁধে ওপরে ওঠাবার চেষ্টা করি, ততই সে নেতিয়ে পড়ে। এবার বোধহয় ফলন ভালো হবে না।
তোমার পেঁপে গাছটায় এবার দারুণ পেঁপে ধরেছে। বেশ বিক্রি করতে পারবে।
ভানু শাসমলের চোখমুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল—তুই কবে এলি?
আজই এসেছি।
সঙ্গে কারা?
কাকুর ছেলে আর তার বন্ধু।
প্রলয়দার ছেলে?
হ্যাঁ কাকু। আজ সকাল এগারোটা নাগাদ এসেছে।
পলাশদের উদ্দেশ্য করে বলল—কতদিন থাকবে বাবা?
পলাশ বলল—থাকব বেশ ক-দিন।
আমাদের বাড়িতে এসো একদিন।
আসব।
ক্লাবের ছেলেরা এসে পলাশকে একপ্রকার জোর করে তুলে নিয়ে গেল। দুর্গা বলল—তুমি যাও দাদা। আমি রাজাদাকে গ্রামের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা আস্ত বটগাছ। গাছের গোড়ার চারদিকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। গ্রামের লোকেরা নিজেরাই এটা করেছে। বৈশাখের ফুটিফাটা রোদে ক্লান্ত পথিক এখানে বসে একটু জিরিয়ে নেয়। পাখিরা আপন খেয়ালে এ ডালে-ও ডালে নেচে বেড়ায়। গ্রামের বয়স্করা অনেক রাত পর্যন্ত এখানে বসে আড্ডা মারে।
পাশেই রয়েছে একটা মনসা মন্দির। প্রতিবছর এখানে বেশ ধুমধাম করে পুজো হয়। দূর দূর গ্রাম থেকে লোকজন মেলায় আসে। বেশ কয়েকদিন গ্রামের মানুষেরা আনন্দে থাকে। তারপর সারাবছর তো সেই চাষবাস, খেতের কাজ।
রাজা বলল—দুর্গা চলো না আমরা এখানে একটু বসি।
এখানে দু-জনে বসলে গ্রামের লোকেরা কিছু মনে করতে পারে। এটা তোমার দিল্লি নয়।
কে কী মনে করল তাতে বয়ে গেল।
না রাজাদা, সমাজের সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। গ্রামের সবাই আমাদের পরিবারকে সম্মান করে, বাবাকে শ্রদ্ধা করে। তা ছাড়া আমরা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে পারি।
এদিকে এখন কেউ নেই। কেউ কিচ্ছু বলবে না। এই বলে দুর্গার হাত ধরে এক প্রকার জোর করেই ওখানে বসাল।
একটা দমকা হাওয়া এসে ওদের চোখে মুখে লাগল। এই হাওয়ায় দুর্গার ওড়নাটা উড়ে বেশ কিছুদূরে গিয়ে পড়ল। দুর্গা উঠে ওড়নাটা তুলতে যাচ্ছিল, এমন সময় রাজা ওর হাতটা ধরে বলল—ওড়নার কী দরকার, এতেই তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।
দুর্গা নিজের বাবা-মা-এর সামনেও এখন ওড়না ছাড়া দাঁড়ায় না। ও বুঝতে পারে পাড়ার বখাটে ছেলেরা, কলেজের সহপাঠীরা তার উন্নত বক্ষযুগলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, তার শরীরের অণু-পরমাণুগুলি জরিপ করার চেষ্টা করে।
দুর্গা কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল—তোমার মতলব কী শুনি?
একটু কাছাকাছি এসো, কানে কানে বলব।
দুর্গা রাজার কাছে এসে ওর কানদুটো ধরে বলল, বোনের সঙ্গে দুষ্টুমি হচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে দাদাকে বলছি।
কাউকে কিচ্ছু বলতে হবে না, বোনটি আমার।
কান ধরে মাথা নীচু করে বলো।
তাই বলছি।
সেখান থেকে ফেরার পথে উমা বউদির সঙ্গে দেখা। ছেলেকে পরাণ মাষ্টারের বাড়িতে দিয়ে ফিরছিল। পড়ানো শেষ হলে রাত ন-টা নাগাদ আবার গিয়ে নিয়ে আসবে।
উমা বউদি বলল—সন্ধ্যাবেলা কোথায় গেছিলে?
বুড়ো বটগাছতলা।
কেন?
এমনিই গেছিলাম। অনেকদিন ওদিকে যাইনি।
সঙ্গে কে?
ও আমার দাদার বন্ধু। দিল্লি থেকে এসেছে।
তাই তোমরা একান্তে বসে গল্প করছিলে। এই বলে হাসতে হাসতে দ্রুতপায়ে চলে গেল। এই হাসির ইঙ্গিত বুঝতে দুর্গার কোনো অসুবিধে হয় না। এরা অন্যদের চরিত্র নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করে নিজেদের সতী-সাবিত্রী বোঝানোর চেষ্টা করে। অথচ গণেশদার সঙ্গে যখন উমা বউদি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল, তখন গণেশদার বাবা নিমাই জেঠু ওই বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না। উমাবউদিকে ওনার একদম পছন্দ নয়। তখন দুর্গার বাবাই নিমাই জেঠুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে।
ওরা দু-জনে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিল। কারুর মুখে কোনো কথা নেই। দুর্গার চোখে মুখে একটা অস্বস্তি ফুটে উঠেছিল।
রাজা বলল—এই বউদিটা কেমন অসভ্য না?
কেন?
তোমাকে আজেবাজে কথা বলল। অথচ নিজে…।
নিজে কি?
ব্লাউজ পর্যন্ত গায়ে দেয়নি।
তুমি কিন্তু খুব অসভ্য হয়েছ।
এতে অসভ্যের কী হল?
না কিছুই হয়নি।
তুমি ওঁকে কিছু বললে না কেন?
কী লাভ? পচা ফল ছুরি দিয়ে কাটলে নিজের হাতটাই কাটবে।
রাজা কথাটার অর্থ বুঝতে পারল কিনা জানা গেল না। তার আগে পলাশ এসে বলল—তোরা এতক্ষণ ওখানে কী করছিলি। সন্ধ্যে হয়ে গেল। সাপখোপ আছে।
দুর্গা রাজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল—তোমার এই বন্ধুটি বড় পাকা হয়েছে।
রাজা বলল—পলাশদা, আমি জানি না যে ওই দিকে সাপ থাকে। দুর্গাও কিছু বলল না।
দুর্গা বলল—এবার থেকে যেখানে যাব, তুমি সঙ্গে থাকবে। এই বলে পলাশদার হাত ধরে বলল—আমার ভালো দাদা, আমার মিষ্টি দাদা।
পলাশ দুর্গাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল—আমার পাগলি বোন, আমার দুষ্টু বোন।
রাজা বলল—পলাশদা তো রোজ কলকাতা যাবে। তখন তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে।
দুর্গা বলল—না, তখন আমিও আমার ইনস্টিটিউটে চলে যাব।
রাজা বলল—বর্ধমান? আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
দুর্গা বলল—একদম না, তোমাকে সঙ্গে নেব না।
পলাশ বলল—কেন রে, ভালো হবে তো। একা একা ওর বোরিং লাগবে।
দুর্গা বলল—না দাদা, অসুবিধে আছে।
পলাশ বলল—তাহলে তো কিছু করার নেই। বুঝলি রাজা, তুই সারাদিন মাছ ধরবি আর বাগানের পরিচর্যা করবি।
রাজা বলল—আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না, তোমাদের কাউকে আমার দরকার নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় গল্পগুজব করে, টিফিন করে দুর্গা নিজের ঘরে বসে খোলা জানালা দিয়ে দূর আকাশের তারকাপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ব্রতের কথা ভাবছিল। ও আকাশের কোনো সাধারণ তারা নয়। ও এক দীপ্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র। ও সাধারণের মতো হয়েও অসাধারণ, ওর পবিত্র ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, কোনো ভন্ডামি নেই।
এক মুঠো সতেজ হাওয়া এসে দুর্গার চোখে মুখে আলপনা এঁকে দিয়ে গেল। সেই হাওয়ায় ঘরের দরজাটা হাট করে খুলে গেল। দুর্গা চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে ঘ্রাণ নিল। বেশ ভালো লাগল তার। মনে মনে ভাবে,—প্রিয়ব্রত থাকলে দাদার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিতাম। দাদার নিশ্চয়ই ওকে পছন্দ হত। দাদাকে কি ওর কথা বলব? না থাক, এখন বলাটা ঠিক হবে না। দাদা বলবে—আগে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়া, তারপর এইসব ভাববি।
এমন সময় রাজা ঘরের মধ্যে ঢুকে পেছন থেকে দুর্গার চোখদুটো দু-হাত দিয়ে চেপে রেখে বলে—বলো তো, আমি কে?
দুর্গার হুঁশ ফেরে, সে বলে—রাজাদা, তুমি চোখ ছাড়ো।
রাজা বলে—না ছাড়ব না, আগে বলো তুমি আমাকে পছন্দ করো না কেন?
তুমি আগে ছাড়ো।
তুমি আগে বলো।
আমি কিন্তু চেঁচাব।
রাজা চোখ দুটো ছেড়ে দুর্গার হাত দুটো ধরে বলল—তোমাকে আমার খুব পছন্দ। তুমি কিছু বলছ না কেন?
দুর্গা বলল—রাজাদা, তুমি আমার ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নাওনি কেন? এরপরে কখনো অনুমতি না নিয়ে আমার ঘরে ঢুকবে না। তাহলে তোমার সম্মান রাখতে পারব না।
রাজা সেই যে ঘর থেকে বের হল, আর কোনোদিন ওমুখো হয়নি। যে ক-দিন দুর্গাদের বাড়িতে ছিল, কখনো একান্তে দুর্গার কাছে আসত না। দুর্গা ওকে দেখে মাঝে মাঝে মুখ টিপে হাসত আর মনে মনে বলত—বেচারা, ভুল বাগানে ঢুকে পড়েছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন