আমার দুর্গা – ২.১১

সপ্তাহ খানেকের পর দুর্গা বাসায় ফিরল। আমার এক বন্ধুর মারফত ওর আগমন বার্তা পেলাম। সংবাদটা পাওয়ামাত্র আমি দুর্গার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওর কাছে গেলাম।

ওর মেসের উলটো দিকে রাস্তার উপর সারা বিকেল দাঁড়িয়ে থাকলাম। তবু দুর্গার দেখা পেলাম না। ভাবলাম সন্ধ্যেবেলায় ও নিশ্চয়ই টিউশন পড়াতে বেরোবে। তখন দেখা হবে। রাত আটটা বাজল। তবু ওর দেখা নেই।

রাত যত বাড়ছে ততই আমি উদবিগ্ন হয়ে পড়ছি। তবে কি কোনো সমস্যায় পড়েছে দুর্গা? কাকাবাবুর অসুখটা বাড়ল কি? আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আমি কি আরও অপেক্ষা করব? নাকি বাড়ি ফিরে যাব?

আজকে সত্যিই মনটা খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় কোনো গন্ডগোল হয়েছে। সুর কেটে যাচ্ছে, তাল মিলছে না। এক অজানা অশনিসংকেত পাচ্ছি।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দুর্গার দেখা না পেয়ে বাসায় ফিরে এলাম। রাতে ঘুমোতে পারলাম না। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না। সারারাত এপাশ-ওপাশ হলাম। কয়েকবার উঠে বাথরুমে গেলাম। ভোর হতে-না-হতেই উঠে হাত-মুখ ধুয়ে স্নান করলাম। কিছু মুখে না দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম দুর্গার উদ্দেশ্যে।

যাদবপুর থেকে হাঁটতে লাগলাম। কাঁধে ইনস্টিটিউট যাবার ব্যাগ, পায়ে চপ্পল। মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ অথচ মনে হচ্ছে রাস্তা ফুরোয় না। মনে হচ্ছে কতটা সহস্র মাইল। সারাশরীর থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। রুমাল দিয়ে বারবার ঘাম মুছছি, আর দেখছি কতটা পথ বাকি।

গোলপার্কের কাছে এসে একটা শেডের নীচে দাঁড়ালাম। ঘামটা মুছে দুর্গার মেসের দিকে পা বাড়ালাম। গলির মোড়ে আসতেই দেখলাম দুর্গা হন হন করে হেঁটে আসছে। ঠিক সময়ে এসেছি। আর কয়েক মিনিট দেরি হলেই ওর সঙ্গে দেখা হত না।

আমাকে দেখে দুর্গা কিছুটা বিস্মিত হল। বলল—তুমি এখানে? আমি বললাম—তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আমার সঙ্গে?

হ্যাঁ। এতে অবাক হওয়ার কী আছে?

আমার মতো সাধারণ মেয়ের সঙ্গে দেখা করে কি লাভ?

তুমি এভাবে বলছ কেন? কাকাবাবু কেমন আছে?

এখন একটু ভালো আছেন।

কী হয়েছিল কাকাবাবুর?

তেমন কিছু নয়, টাইফয়েড।

আমি খুব চিন্তায় ছিলাম।

চিন্তায়?

তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না, কাকাবাবুর খোঁজ নিতে পারছি না, আমি প্রচন্ড উদবেগের মধ্যে ছিলাম।

কেন? তোমার উদবেগের কোনো কারণ আছে কি?

কী বলছ তুমি? তোমার বিপদে আমি উদবিগ্ন হব না?

শুনে খুশি হলাম।

উপহাস করছ?

একদম না। তোমাকে উপহাস করব আমি? তুমি হচ্ছ ‘ল’ ডিপার্টমেন্টের সোনার টুকরো ছেলে। বহুলোক এখন তোমার কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ।

এরা হল বসন্তের কোকিল। মানুষের স্বভাবই তাই।

আর তুমি?

আমি আবার কী করলাম?

কিছু না, তোমাকে কনগ্রাচুলেশন।

কীজন্য?

নেট পাওয়ার জন্য।

তোমার তো একটুর জন্য হল না। দেখো, পরের বারে নিশ্চয়ই নেট পাবে।

আমি বর্তমান নিয়ে বলছি। ভবিষ্যতে কে কী হবে, তার জন্য কেউ কি অপেক্ষা করে? বর্তমান যেখানে হাত বাড়িয়ে দেয়, ভবিষ্যতের জন্য কেউ কি অপেক্ষা করে?

তুমি এভাবে হতাশ হোয়ো না। তোমাকে তো আমি জানি। তোমার মনের দৃঢ়তা, জেদ আর আত্মবিশ্বাসই তোমাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে।

মহাপুরুষদের বাণীর মতো শোনাল না?

তোমাকে এখন যা বলব তাই তোমার কাছে উপদেশ মনে হবে।

তাই?

তুমি কি এখন ডিপার্টমেন্টে যাবে?

হ্যাঁ।

চলো, আমিও ডিপার্টমেন্টে যাব।

তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

হ্যাঁ, একসঙ্গে কথা বলতে বলতে যাব।

ইশিতা রাগ করবে না?

ইশিতা!

কোনোদিন নাম শোননি মনে হচ্ছে।

তা কেন? এই তো সেদিন সবাই মিলে ডায়মণ্ড হারবার ঘুরে এলাম।

সবাই মিলে না তুমি আর ইশিতা?

কী বলছ তুমি?

খুব ভুল কিছু বলেছি?

তুমি ভুল বুঝছ।

কিছুই ভুল বুঝিনি। তুমি বরং ভুল বোঝাচ্ছ।

আমি আর তর্ক করলাম না। যতক্ষণ-না ও নিজে থেকে বুঝবে, ওকে বোঝাব কী করে? বুঝতে পারলাম দুর্গা আর যাই হোক আমার ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আমার ওপর অন্য কারুর বিন্দুমাত্র অধিকার ও মেনে নিতে পারে না।

হয়তো এটাই ঠিক। কাউকে ভালোবাসলে এক-শো শতাংশই ভালোবাসা উচিত। আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো মন থেকে কেই-বা মেনে নিতে পারে?

তবু ওকে বোঝানো দরকার যে ইশিতার সঙ্গে যা হয়েছে তা ইশিতার একপ্রকার ছেলেমানুষি। এতে আমার কোনো সায় ছিল না। ওর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই।

আমি বললাম—তুমি ডিপার্টমেন্ট থেকে কখন বেরোবে?

ও বলল—কেন?

তাহলে ওইখান থেকে বেরিয়ে কোথাও একটু ঘুরে, খেয়ে-দেয়ে বাসায় ফিরতাম।

আমার একটু কাজ আছে।

কী কাজ?

পড়ানো আছে।

একদিন না পড়ালে কিচ্ছু ক্ষতি হবে না। কালকে পড়িয়ে দিয়ো।

কাল অন্য কাজ আছে।

তবে অন্য কোনোদিন ঠিক করো যেদিন কোথাও বেড়িয়ে আসব।

পরে ভেবে দেখব।

পরে নয়, আজ, এখনই।

এই বলে আমি দুর্গার দুটো হাত ধরে বললাম—তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। তুমি ভুল বুঝলে আমি সত্যি ঘটনা কার কাছে গিয়ে বলব?

ও বলল—সত্যি ঘটনা?

হ্যাঁ, অনেক কথাই আমার তোমাকে বলার আছে, তোমাকে সব শুনতে হবে।

হাত ছাড়ো, রাস্তায় লোকে দেখলে কী ভাববে?

তুমি বলো, আমার সব কথা শুনবে?

কী পাগলামি করছ?

পাগলামি নয়। তুমি আগে কথা দাও।

আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার সব কথা শুনব।

আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। দুর্গা আমার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শোনার পর নিশ্চয়ই আর রাগ করবে না। ও নিশ্চয়ই আবার আগের মতো ব্যবহার করবে। আমি আমার দুর্গাকে ফিরে পাব।

ডিপার্টমেন্টে গিয়ে শুনলাম ইউনিভার্সিটির একজন সিনিয়র টিচার মারা গেছেন। ডিপার্টমেন্টের কোনো কাজই আজ হবে না। আমি ভাবলাম—ভালোই হল, দুর্গার সঙ্গে আজ একটু বেরোতে পারব।

আমি ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, ইশিতা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল—ও তুমি আছ। আমি চিন্তা করছিলাম, তোমার দেখা পাব কিনা? তুমি ফিরে গেছ কিনা?

আমি বললাম—স্যারের সঙ্গে কথা বলছিলাম, একটু পরেই ফিরব।

ভগবান যখন যা করেন মঙ্গলের জন্য।

কেন কী হয়েছে?

ও আমার হাত ধরে খানিকটা দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল—চলো না, আজ আমরা সিনেমায় যাই।

আমি বললাম—আমি যেতে পারব না।

কেন পারবে না?

আমার ভালো লাগছে না।

সেই জন্যই তো সিনেমায় যেতে বলছি। দেখবে শরীর-মন সব ঠিক হয়ে গেছে। আর পাশে আমি থাকব কিনা। দেখবে দ্বিগুণ চাঙ্গা হয়ে যাবে।

সত্যিই আমি যেতে পারব না। আমার অন্য কাজ আছে।

লাইব্রেরিয়ান স্যার আমাদের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলেন। ও ইশিতাকে চিনত। ডায়মণ্ড হারবারে বেড়াতে গিয়ে ইশিতা আর আমার ব্যাপারে একটা রটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাকে বিকৃত করে আরও অনেক নোংরা কল্প কাহিনি রচিত হচ্ছে।

উনি বললেন—প্রিয়ব্রত যাও না একটু আনন্দ উপভোগ করো। নাটক, সিনেমা দেখো। সারাক্ষণ ডিপার্টমেন্ট আর নিজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? তা ছাড়া ইশিতা খুব ভালো মেয়ে। ওর সঙ্গে গল্প করে কাটালে তোমার ভালো লাগবে।

আমি বললাম—স্যার, আসলে আমার অন্য কাজ আছে।

স্যার বললেন—আজ ডিপার্টমেন্ট ছুটি না থাকলে কী করতে?

সেটা অন্য কথা স্যার।

ইশিতা স্যারের কাছে এসে প্রণাম করে বলল—ঠিক বলেছেন স্যার। ‘ও’ কিছুতেই বুঝতে চায় না।

স্যার বললেন—ও নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে যাবে।

আমি স্যারের কথা ফেলতে পারলাম না। আমাকে খুব স্নেহ করেন। বহুপ্রয়োজনে ওঁর কাছে ছুটে গেছি। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও আমার জন্য কিছু একটা করবেনই। সেই পিতৃতুল্য মানুষটার কথা আমার কাছে আদেশ বলে মনে হল।

আমরা হাজরা মোড়ের কাছে একটা সিনেমা হলে গেলাম। দুপুর দুটোয় প্রথম শো। তখন প্রায় বারোটা বাজে। এতক্ষণ কী করব? কোথায় বসে সময় কাটাব?

ইশিতা বলল—ওখানে-এখানে না ঘুরে বরং চলো কালীঘাটে পুজো দিয়ে আসি। নেট পাশ করার পর ভাবছিলাম একবার আসব। আজ যখন সময় পেয়েছি চলো একবার যাই।

আমিও মনে মনে তাই চাইছিলাম। ওর সঙ্গে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করার চেয়ে মায়ের মন্দিরে পুজো দেওয়া ঢের ভালো। অনেকদিন আমিও মায়ের মন্দিরে আসিনি।

হাজরা মোড় পেরিয়ে কালীঘাটের দিকে যাচ্ছি, দেখলাম রাস্তার ওপারের ফুটপাথ দিয়ে দুর্গা রাসবিহারী কানেক্টারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। ইশিতাকে পেছনে ফেলে একটু সামনের দিকে এগিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

ইশিতা বলল—তুমি একটু আস্তে আস্তে হাঁটো।

আমি বললাম—তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো। মন্দিরে খুব ভিড় থাকে। তার উপর পান্ডাদের উপদ্রব।

আমরা ফুটপাথ ছেড়ে একটা গলি রাস্তা ধরলাম। মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেখি প্রচুর মানুষ পুজো দিতে এসেছেন। লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যা অবস্থা তাতে ঘণ্টা খানেকের আগে পুজো দিতে পারব বলে মনে হয় না।

ইশিতা পুজোর ডালি নিয়ে আমার সামনে, আমি পেছনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে ইশিতা লাইন থেকে বেরিয়ে আমাকে বলল—তুমি আমার সঙ্গে এসো।

আমি ওর পেছন পেছন গেলাম। একজন পান্ডা আমাদের পেছনের গেট দিয়ে মন্দিরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিল।

একেবারে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ইশিতার চোখে-মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। পান্ডা ব্রাহ্মণ আমাদের গোত্র, পূর্বপুরুষদের নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম।

তারপর উনি ইশিতাকে জিজ্ঞেস করলেন—ও কি তোমার হবু স্বামী?

ইশিতা কিছু বলল না। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, ইশিতা আমার চোখে চোখ রাখতেই আমি চুপ করে গেলাম।

পান্ডা ব্রাহ্মণ ইশিতাকে বললেন—আমি বুঝতে পেরেছি মা। তোমাদের জীবন সুখের হোক। খুব শিগগিরই তোমরা সংসারী হও।

এই বলে উনি আমার আর ইশিতার মাথায় সিঁদুর আর চন্দনের টিপ পরিয়ে দিলেন। আমি ইশিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সিঁদুর আর চন্দনের টিপে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। এক শুভ্র কোমলতায় ওকে নিষ্পাপ শিশুর মতো দেখাচ্ছিল।

ও মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে ধূপ জালালো। ভিখিরিদের দু-টাকা এক টাকা করে সাহায্য করল। আমার মাথায় ফুল ছোঁয়ালো। তারপর আমার হাতে এক টুকরো প্রসাদ দিয়ে বলল—মাকে প্রণাম করে প্রসাদ খাও। আমি মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রসাদ খেলাম। ইশিতাও তাই করল।

মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা হাজরা মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। হাতে তখনও মিনিট চল্লিশ সময় রয়েছে। ইশিতা বলল—কিছু একটা টিফিন করলে হত না?

আমি বললাম—টিফিন তো সঙ্গে আছে।

তাই তো। তাহলে চলো, কোথাও বসে খেয়ে নিই।

তাই চলো।

আমরা একটা পার্কে বসে টিফিন ভাগাভাগি করে খেলাম। বহুমানুষ রাস্তা দিয়ে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। অনেক প্রবীণ-প্রবীণাও রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।

আমার বেশ অস্বস্তি লাগছে। যদি পরিচিত কেউ ইশিতা আর আমাকে একসঙ্গে দেখে ফেলে, তাহলে আমার চরিত্রের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। অথচ ইশিতার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনো জড়তা নেই, কোনো ইতস্ততবোধ নেই।

আমি ইশিতাকে বললাম—আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তোমাকে অনেক বলার আছে।

ইশিতা বলল—তোমার সব কথা শুনব। তবে আজ নয়। অন্য কোনোদিন। আজ আর সময় নেই। সিনেমার শো শুরু হয়ে যাবে।

কথাগুলো খুব জরুরি। তোমার এখনই শোনা দরকার।

বললাম তো তোমার সব কথা শুনব। এখন নয়।

যদি দেরি হয়ে যায়?

কি আবোলতাবোল বলছ? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি?

যদি কথাগুলো শুনে কষ্ট পাও।

তোমার কোনো কথাতেই আমি কষ্ট পাব না।

পরে আফশোস করবে না তো?

আফশোসের কিছু নেই, যা হবার তাই হবে।

আমরা সিনেমা হলে গেলাম। প্রচুর মানুষ। টিকিটের জন্য মারপিট। সিনেমা দেখার জন্য এমন উন্মাদনা, বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটা এমন দৃশ্য এর আগে আমি দেখিনি।

আমি অবশ্য সিনেমা তেমন দেখি না। মাঝে-মধ্যে একা একা সিনেমা দেখতে গেছি। ভালো না লাগলে শো শেষ হওয়ার আগেই হল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।

একবার শিয়ালদহ এলাকায় একটা হলে একা একা সিনেমা দেখতে গেছি, টিকিট কাউন্টারে মনোতোষদার সঙ্গে দেখা। সঙ্গে ওর বান্ধবী। এই দাদাটি পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকত। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করত।

আমাকে দেখে বলল—তুমি এখানে? একা একা সিনেমা দেখতে এসেছ?

আমি বললাম—তুমি?

দুপুর পর্যন্ত অনেক কাজ করেছি। আজ আর ভালো লাগছে না। ভাবলাম হলেই ঢুকে পড়ি।

আর সঙ্গে কে? তোমার বান্ধবী বুঝি?

হুঁ। কাউকে বলিস না।

আমাকে অন্যমনস্ক দেখে ইশিতা বলল—তুমি কী ভাবছ শুনি?

আমি বললাম—কই, কিচ্ছু না।

আমরা আগে থেকেই টিকিট কেটে রেখেছিলাম। কাজেই লাইনে দাঁড়াতে হল না। ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম।

একটা প্রেমের কাহিনিই ছিল। নায়িকা-নায়ককে ভুল বুঝে যখন দূরে চলে যাচ্ছে সেই সময় দেখি ইশিতার চোখের কোণে জল চলে এসেছে।

আমি ইশিতার হাতে হাত রেখে বললাম—এটা সিনেমা।

ইশিতা আমার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল—প্রেমের বিরহ সবাই সহ্য করতে পারে না। আমি তো পারবই না।

—এত নরম মনের মানুষ হলে চলে?

—আমি মনকে কিছুতেই শক্ত করতে পারি না।

—শক্ত করতে হবে। শুধু কান্না দিয়ে তো বাস্তবকে জীবনের চড়াই-উৎরাই বন্ধুর পথ অতিক্রম করা যায় না।

হয়তো আঘাত পেতে পেতে আমার মনও শক্ত হয়ে যাবে।

ইন্টারভ্যালের সময় দুটো চিপসের প্যাকেট আর দুটো বাদামের প্যাকেট কিনলাম। চিপস খেতে খেতে ইশিতা আমার কানের কাছে চুপিচুপি বলল—দেখো, সামনের সিটের ছেলে-মেয়ে দুটো কেমন বসে আছে।

আমি বললাম—ওদের রুচি এরকম।

সব দর্শক তো একরকম হয় না।

অনেকে আবার হলের মধ্যে কে কী করছে, কীভাবে বসে আছে তা দেখছে।

তুমি কার কথা বলছ?

আমি নির্দিষ্ট করে কারুর কথা বলছি না।

তুমি আমাকে বলছ?

তোমাকে কখন বললাম?

না, তুমি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললে।

আমি এমনিই বললাম।

সিনেমার শেষ অঙ্কে যখন নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে নায়ক-নায়িকা কাছাকাছি হল, তখন ইশিতার মুখ প্রসন্নতায় ভরে গেল।

ও বলল—দারুণ হয়েছে সিনেমাটা।

আমি বললাম—বেশ ভালো।

আজকে মনটা খুশিতে ভরে গেল।

তোমার মনটা কি খারাপ ছিল?

খারাপ নয়, তবে ভালোও লাগছিল না।

মন ভালো না লাগলে ভালো কোনো উপন্যাস, গল্প কিংবা কবিতার বই পড়বে, অথবা গান শুনবে, দেখবে মনটা বেশ চনমনে হয়ে গেছে।

তুমি বুঝি তাই কর?

মাঝে মাঝে করতে হয়।

কার কার বই পড়?

রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, শেক্সপিয়র, শেলি, কিটস, শার্লক হোমস। নেতাজি, বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা বইও পড়ি।

গোয়েন্দা রহস্যের বই ভালো লাগে।

তাই পড়বে।

দেবদাস ভালো লাগে না।

কেন? এ তো বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস।

বিরহ সহ্য করতে পারি না। প্রেমে ত্যাগ আমি মেনে নিতে পারি না।

কেন তোমার জীবনে এমন হয়েছে নাকি?

ইশিতা কিছু না বলে অভিমান করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

আমি বললাম—তোমাকে আঘাত করার জন্য একথা বলিনি। আমি ইয়ার্কি করে বলেছি।

ইশিতা বলল—তুমি এ নিয়ে ইয়ার্কি কোরো না।

ঠিক আছে, আর কোনোদিন বলব না।

আমার কথায় ইশিতা বেশ খুশিই হল। ও বলল—এখন তো বিকেল। সন্ধ্যে হতে এখনও বেশ বাকি আছে। চলো, কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করি।

আমি বললাম—খিদে নেই।

অল্প কিছু খাবে।

খেতে হবে?

খেলে আমার ভালো লাগবে।

আমরা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম।

আমি খাচ্ছি আর রেস্টুরেন্টের এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। দেখছি চেনা পরিচিতরা কেউ কোথাও আছে কিনা।

আমি খাচ্ছি আর মাঝে মাঝে ইশিতার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। ‘ও’ বেশ তৃপ্তিতে খাচ্ছে।

ওর দিকে তাকিয়ে আমার দুর্গার কথা মনে পড়ে। দুর্গার তেজি, প্রতিবাদী, আপাত কঠিন হৃদয়ের ভিতরে যে-নরম হৃদয় আছে, তা শিশুসুলভ পবিত্র আর সততায় ভরা। সেই হৃদয় ছুঁতে পারলে ওর ভালোবাসার কাঙালিপনা, হৃদয়ের ছটফটানি স্পষ্ট বোঝা যায়।

আমি যখন হৃদয়ের শুষ্ক মরুপ্রান্তরে একাকী দিশাহীনভাবে হাঁটছিলাম, যখন আমার দুর্বল, আত্মবিশ্বাসহীন হাহাকারময় জীবন শূন্যে ভাসছিল, তখন সে নিজের হৃদয়-পরশে আমাকে সাহস জুগিয়েছে, আত্মবিশ্বাস এনে জীবনে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছে, জীবনে বেঁচে থাকার অর্থই পালটে দিয়েছে। ওর পরশে আমি আবার পথ চলতে শুরু করেছি, অনেকটা কঠিন কাঁকরময় পথ পেরিয়ে সাফল্যের সিঁড়িতে এসে পৌঁচেছি।

আমাকে অন্যমনস্ক দেখে ইশিতা বলল—তোমার খেতে ভালো লাগছে না?

আমি আমতা আমতা করে বললাম—হ্যাঁ, ভালো লাগছে তো। বেশ ভালো লাগছে।

তবে একটু একটু করে খাচ্ছ কেন?

তোমাকে বললাম না, আমার তেমন খিদে নেই।

তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

কই না তো। আমি তো তোমার দিকে তাকিয়ে আছি।

আমাকে বুঝি প্রথম দেখছ?

এই রঙিন আলোয় তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।

আর এমনি আলোয়?

তখনও ভালো দেখায়।

তুমি রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কার কথা ভাবতে থাক?

আমি ঘুম পেলে কিছুই ভাবতে পারি না।

আমি শুধু তোমার কথা ভাবি। তোমার ছবিই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

এটা ঠিক নয়।

কেন ঠিক নয়?

একটি সুন্দরী মেয়ের পক্ষে বিছানায় শুয়ে পরপুরুষের কথা ভাবা কি সুরুচির পরিচয় বহন করে?

কী আমার পরপুরুষ রে?

পরপুরুষই তো।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আমরা ফুটপাথ বরাবর হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি জানি না। শুধু ভাবছি ভালোয় ভালোয় ইশিতাকে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে দিলেই বাঁচি। তারপর সোজা গোলপার্ক। দুর্গার সঙ্গে দেখা করে তবেই বাসায় ফিরব।

বেশ কিছুটা হাঁটার পর ইশিতা বলল—আর পারছি না। চলো একটা ট্যাক্সি করে বাড়ি চলে যাই।

আমি বললাম—গড়িয়াহাটে আমার একটু কাজ আছে, তা সেরে বাসায় ফিরব, তোমাকে বরং ট্যাক্সিতে তুলে দিই।

ইশিতা নাছোড়বান্দা। বলল—তুমি আমার সঙ্গে যাদবপুর যাবে। ওখানে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরব।

তাহলে গড়িয়াহাট দিয়ে চলো। আমাকে গড়িয়াহাটে নামিয়ে দিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাবে। এতেই রাজি হল ইশিতা।

গড়িয়াহাটের আগের মোড়ে ট্যাক্সি থেকে নামছি, দেখি দুর্গা সেখানে দাঁড়িয়ে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে।

দুর্গাকে দেখে ইশিতা ট্যাক্সির ভেতর থেকে বলল—তুমি এখানে থাক?

দুর্গা বলল—না, এখানে একটা দরকারে এসেছি।

ঠিক আছে আসছি।

এই বলে ইশিতা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমাকে দেখে দুর্গা হন হন করে হেঁটে চলে গেল। আমি পেছন থেকে ডাকছি—দুর্গা, তুমি দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। একটিবার দাঁড়াও প্লিজ।

দুর্গা আরও জোরে হাঁটতে হাঁটতে কোন গলির মধ্যে ঢুকে গেল। আর খুঁজে পেলাম না।

তারপর ওকে অনেক খুঁজেছি, পাগলের মতো খুঁজেছি। ওর বাসায় গেছি, ইনস্টিটিউটে গেছি। কোথাও খুঁজে পাইনি। এক অজ্ঞাতবাসে ও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। অনেক রাত ঘুম হয়নি, অনেক দিন না খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। দুর্গার খোঁজ আর পাইনি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন