যোদ্ধা আর মহাত্মা

যোদ্ধা আর মহাত্মা

কর্তব্যক্ষেত্রে দেখলুম তোমার যে পরিণতি, তার থেকে পেয়েছি তোমার প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ। এই শক্তির কঠিন পরীক্ষা হয়েছে কারাদুঃখে, নির্বাসনে, দুঃসাধ্য রোগের আক্রমণে, কিছুতে তোমাকে অভিভূত করেনি; তোমার চিত্তকে করেছে প্রসারিত, তোমার দৃষ্টিকে নিয়ে গেছে দেশের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসের দূরবিস্তৃত ক্ষেত্রে।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু বিষয়ে লেখা, জানুয়ারি ১৯৩৯

.

১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার বিপ্লবী নেতা গুজরাতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চান্নতম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে এলেন। অহিংসার পূজারির নিজের প্রদেশে সে দিন সুভাষের এই আগমনের প্রতীকী অর্থ ছিল বিরাট। এর মধ্য দিয়ে যেন মিলিত হল দুই প্রজন্ম, মিলিত হল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের দুটি আলাদা ধারা, যে দুটি ধারাকে আগে বেশ কয়েক বার রীতিমতো সংঘর্ষরত দেখা গিয়েছে। হরিপুরার গ্রামীণ পটভূমিতে কংগ্রেসের নির্বাচিত স্থানটিতে রথে করে নিয়ে যাওয়া হল সুভাষচন্দ্র বসুকে, রথটি টেনে নিয়ে গেল একান্নটি সাদা গোরু। এই আশ্চর্য দৃশ্যের মধ্য দিয়ে যেন কৃষি-ভারত ও নাগরিক ভারতের মিলন দেখা গেল, প্রাচীন ভারতের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছবিটির সঙ্গে মিলে গেল চলিষ্ণু ভবিষ্যতের ছবি। কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে মঞ্চের উপর গাঁধী ও সুভাষকে মগ্ন হয়ে কথা বলতে দেখে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর মন ভরে গেল, বহু দিন ধরে তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী মঞ্চ দেখতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছিলেন। তিন দশক আগে অরবিন্দ ঘোষ “বয়কটের নৈতিকতা” প্রবন্ধে লেখেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে একই সঙ্গে প্রয়োজন মহাত্মার মহত্ত্ব ও যোদ্ধার তরবারি। অরবিন্দের মতোই সুভাষও স্বীকার করতেন, হিংসার পথ অগ্রহণযোগ্য, রাজনৈতিক নৈতিকতার কারণে না হলেও স্ট্র্যাটেজি হিসাবেই অগ্রহণযোগ্য। সুতরাং, যোদ্ধা ও মহাত্মা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধতায় এক মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন সে দিন, অন্তত কিছু সময়ের জন্য।

সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গত পথ কী হবে, সুভাষ ও গাঁধীর মতপার্থক্য কিন্তু কেবল সেটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আসল কথা, স্বাধীন ভারতের কথা ভাবতে গিয়ে সুভাষ যে শিল্পসমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ছবিটি দেখতেন, তার সঙ্গে গাঁধীর ‘ইউটোপিয়া’র কোনও যোগ ছিল না, যোগ ছিল না গাঁধীর ‘রামরাজ্য’র সঙ্গে, যেখানে মহাকাব্যিক রাজার অনুসরণে স্বশাসন ও স্বনির্ভর গ্রামজীবনের ছবি ফুটে উঠত। তবে এ সব সত্ত্বেও তাঁদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার প্রয়াসের মধ্যে যে সাদৃশ্য ছিল, এবং সব দূরত্ব অতিক্রম করেও তাঁদের দু’জনের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল, তার উপর ভিত্তি করেই হয়তো তাঁদের পক্ষে একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি খুবই জটিল তখন। গাঁধীর পথের পন্থীরা তখন কংগ্রেস দলের উচ্চ সারিতে অধিষ্ঠিত, কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তাঁরাই বিরাজমান, দেশের ধনতন্ত্রের মুরুব্বিরাই কংগ্রেসের প্রধান আর্থিক ভরসা। সুভাষ যদি-বা গাঁধীকে পাশে পাওয়ার জন্য তাঁর যাবতীয় নিহিত ইচ্ছা মেনে দিতে রাজি ছিলেন, মহাত্মার বিশ্বস্ত অনুচরের দল কিছুতেই এই বাঙালি বিপ্লবী নেতাকে মেনে নিতেন না। আসলে সে দিন অনেক কিছুই নির্ভর করছিল জওহরলাল নেহরু কোন দিকে ঝোঁকেন তার উপর— বাম দিকে, সুভাষের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সাদৃশ্যের কারণে? না কি, গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধাবশত, ডান দিকে? কিছু কাল যাবৎ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল যাঁদের মধ্যে একটা বিপ্লবী ঝোঁক থাকলেও তাঁরা নিজেরা কোনও দল তৈরি করেননি। এঁদেরই মুখপাত্র হয়ে উঠছিলেন জওহরলাল ও সুভাষ। আবার জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো কেউ কেউ এই বৃহৎ জাতীয় সংগঠনের অন্তর্গত একটি অন্যতম ‘লবি’ হিসেবেই ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি তৈরি করে ফেলছিলেন। কমিউনিজমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে এম এন রায় আরও এক ভিন্ন বামপন্থী ধারা তৈরি করলেন, নাম দিলেন ‘র‌্যাডিকাল হিউম্যানিজম’ বা বিপ্লবী মানবতাবাদ। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া তৈরি হয় সেই ১৯২০ সালে, কিন্তু তারাও এ বার ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ অভিধার আশ্রয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত হল— ঠিক যেমন ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলিও সে সময়ে তাদের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক মিত্রগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘পপুলার ফ্রণ্ট’ তৈরি করছিল, সে ভাবেই। সুতরাং সম্ভাবনার বিস্তার সে সময়ে বিপুল।

কংগ্রেসের এই বামবাদ-প্লাবন রোধ করার জন্য গাঁধী মহারাজ অবশ্য মধ্যযুগীয় অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজা কানিউটের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন না। তিনি বরং প্রথমে জওহরলাল নেহরু ও তার পর সুভাষ বসুকে প্রেসিডেন্ট করে ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করলেন। প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধানকে তত দিনে রাষ্ট্রপতি বলে অভিহিত করার চল হয়েছে, এবং সেই অভিধার তুল্য শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে দেখাও শুরু হয়েছে। ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালে বার বার কংগ্রেসের মূল সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী গোষ্ঠী পনেরো সদস্যের কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে নেহরু সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন, বার-কয়েক পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত গাঁধীর অনুরোধে আবার দলীয় পথে ফিরে এসেছেন। সুভাষের পক্ষে অবশ্য পিতৃপ্রতিম ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্বের প্রতি এতটা প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখানো অসম্ভব। পনেরো বছর বয়স থেকেই তিনি সর্ব রকমের ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এসেছেন। সুতরাং সন্দেহ নেই, এই বিদ্রোহী সন্তানটিকে সামলানো অনেক বেশি কঠিন ছিল মহাত্মার পক্ষে।

ভারতের স্বাধীনতার অর্থ মানবতার পরিত্রাণ

ইউরোপ থেকে ফেরার কিছু পরেই, ১৯৩৮ সালের ২৮ জানুয়ারি সুভাষকে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে বাংলার প্রাদেশিক সম্মিলনে যোগ দিতে ছুটে আসতে হল। তারকাখচিত সেই সমাবেশে সুভাষের দেখা হল এম এন রায়, তাঁর স্ত্রী এলেন রায় ও সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে। ৩১ জানুয়ারি তিনি ওয়ার্ধা চললেন— গাঁধীর ডেরায়, সেখানে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের প্রস্তুতিকল্পে বসবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। কলকাতায় ফিরে ১১ ফেব্রুয়ারি হরিপুরা কংগ্রেসের জন্য ট্রেন ধরার আগে হাতে মাত্র দু’দিন সময়— সভাপতির ভাষণ লেখার জন্য। ৩৮/২ এলগিন রোডের বেডরুমে দু’দিন নিজে সম্পূর্ণ আবদ্ধ থেকে একটিমাত্র ড্রাফ্টেই বিশাল ভাষণটি লিখে ফেললেন তিনি। টাইপের জন্য শরৎচন্দ্র বসুর সেক্রেটারির কাছে ১ উডবার্ন পার্কে সে লেখা পাঠিয়ে দেওয়া হল। শরতের মেধাবী অ্যাসিস্ট্যান্ট নীরদ সি চৌধুরি টাইপ-করা ভাষণটি দেখে দেওয়ার পর সেটি প্রিন্টারে পাঠানো হল। প্রিন্ট অবশ্য সুভাষ কলকাতা ছাড়ার আগে প্রস্তুত হল না, হরিপুরায় সেটি পৌঁছল পরের দিন। সুভাষের সঙ্গে গেলেন তাঁর বৃদ্ধা মা, কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এবং কয়েক জন রাজনৈতিক সহকর্মী। মাতৃপ্রতিম বাসন্তী দেবীকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন সুভাষ, কিন্তু তাঁর যাওয়া হল না। সি আর দাশের বিধবা স্ত্রীকে লিখলেন সুভাষ, “যাঁর চরণে বসে রাজনীতি শিক্ষা করেছি— তিনি আজ নেই থাকলে কত আনন্দ করতেন।” ১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসে দেশবন্ধু সভাপতিত্ব করার পর এই প্রথম বাংলার কোনও নেতা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

দেশের পুব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিয়ে সুভাষ ট্রেন থেকে নামলেন বারদৌলি স্টেশনে। গুজরাতের কৃষক অভ্যুত্থানের অন্যতম তুফানকেন্দ্র এই বারদৌলি। এখান থেকে গাড়িতে হরিপুরার উদ্দেশে রওনা হলেন, সেখানে পৌঁছে এক সুসজ্জিত রথে চেপে চললেন কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য নির্মিত সভাস্থানে। দুই মাইল যেতে লাগল দুই ঘণ্টা, এত বড় শোভাযাত্রা, গুজরাতের গ্রামীণ মানুষের এত আন্তরিক অভ্যর্থনা তাঁর জন্য। সাময়িক ভিত্তিতে বানানো এই সভাস্থানে ৫০,০০০ অভ্যাগতর থাকার ব্যবস্থা, ২০০,০০০ দৈনিক মানুষের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা। বল্লভভাই প্যাটেলের বড় ভাই, যাঁর সঙ্গে ইউরোপে সুভাষ ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁর নামের অনুসরণে জায়গাটির নাম বিঠল-নগর। বাঁশের তৈরি কাঠামো, কাঠের থাম, মাদুর-বিছানো স্থানটিতে সব রকমের আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে, জল, নিকাশিব্যবস্থা, বিদ্যুত্সংযোগ, টেলিফোন, ডাক-যোগাযোগ। কংগ্রেসের আম-দরবার ও খাস-দরবার আলাদা করে কয়েকশো হাতে-আঁকা পোস্টার দিয়ে সাজানো, সেগুলির সকলেরই বিষয়বস্তু: ভারতের গ্রামজীবন। তার মধ্যে ছিয়াশিটি ছবি নন্দলাল বসুর আঁকা। গণ-জাতীয়তাবাদের যে নতুন সংস্কৃতি, শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে সেটাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা এই প্রদর্শনে। “পট স্টাইল অনুসরণ করে প্রচুরসংখ্যক অঙ্কনচিত্র তৈরি করেছিলাম আমরা, সব জায়গায় সেগুলি ঝুলিয়ে দিলাম, সামনের সদরে, স্বেচ্ছাসেবক ক্যাম্পগুলির ভিতরে, এমনকী যে ঘরগুলিতে বাপুজি আর প্রেসিডেন্ট সুভাষবাবু থাকবেন, সেখানেও,” অনেক পরে স্মরণ করেছিলেন নন্দলাল বসু। বিঠল-নগরে পৌঁছে সুভাষ তেরঙা পতাকা উত্তোলন করে ঘোষণা করলেন: “পৃথিবীর কোনও শক্তি ভারতকে আর পদানত রাখতে পারবে না। ভারত স্বাধীন হবেই।”

কংগ্রেসে সভাপতির পদটি সুভাষ গ্রহণ করামাত্র তাঁর পূর্বসূরি জওহরলাল নেহরু এসে রাষ্ট্রপতির জন্য নির্দিষ্ট সবুজের মধ্যে সাদা ও গেরুয়া বর্ণরঞ্জিত বস্ত্রখণ্ডটি তাঁর গলায় জড়িয়ে দিলেন। স্পষ্ট ইংরেজি ও খানিক বাধো-বাধো হিন্দুস্তানিতে বেশ কয়েকটি বক্তৃতা দিলেন সুভাষ— কয়েকটি আনুষ্ঠানিক, কয়েকটি তত আনুষ্ঠানিক নয়— এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক দক্ষতার সঙ্গে কংগ্রেসের মুক্ত অধিবেশনটি সঞ্চালন করলেন। দীর্ঘ ওজনদার ভাষণটির মধ্যে পাওয়া গেল তাঁর আদর্শের ছবি: জানা গেল কী ভাবেন তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব বিষয়ে, কিংবা স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে। ভারতে যত বক্তৃতা তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে এটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বক্ততা, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ এখানেই সবচেয়ে বিশদে আলোচিত। ব্রিটেনের যে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ, তার শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলির গভীর আলোচনা দিয়ে শুরু এই বক্তৃতা। ব্রিটিশের হাতে যিনি এত লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, তাঁর ভাষণে কিন্তু ঔপনিবেশিক কর্তাদের বিষয়ে তীব্র তিক্ততার কোনও জায়গা ছিল না সে দিন। বরং “স্বাধীন দেশসমূহের ফেডারেশন” তৈরির লক্ষ্যে তাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল— বাস্তবিক, ১৯৪৭ সালের পর যে কমনওয়েলথ তৈরি হবে, তার সঙ্গে সুভাষের এই ধারণার কিন্তু খুব একটা বৈসাদৃশ্য পাওয়া মুশকিল। লেনিনকে উদ্ধৃত করে তিনি বললেন, “ব্রিটেনের নিজের ক্ষমতা কী ভাবে উত্তরোত্তর বর্ধিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে কেবল অন্যান্য দেশকে শোষণ করে,” বললেন, ভারতের স্বাধীনতার জন্য কিংবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পদানত অন্য দেশগুলিতে যারা লড়াই করছে, তারা আসলে “ঘটনাচক্রে ব্রিটিশ নাগরিকদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও লড়ছে।” বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর ঘোষণা, “যখন আমরা সত্যিকারের আত্ম-শাসনের অধিকার লাভ করব, ব্রিটিশদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনে আমাদের আর কোনও রকম বাধা থাকবে না।”

সুভাষ যখন তাঁর সহযোদ্ধাদের সতর্ক করছিলেন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন থামানোর কিংবা তাকে বিভক্ত করার কোনও সাম্রাজ্যবাদী ছক গ্রহণ না করার অনুরোধ করছিলেন, তিনি বুঝতেই পারছিলেন যে “ডিভাইড অ্যান্ড রুল-এর নীতিটি” “শাসক শক্তির জন্যও ঠিক অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়।” তাঁর মতে, ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে এক দিকে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি, আর অন্য দিকে স্বৈরতন্ত্রী রাজন্যবর্গের পাশাপাশি অস্তিত্বের মধ্যেই আসলে নিহিত রয়েছে “বিভাজনের নীতি”। এই জন্যই কংগ্রেস-এর প্রাদেশিক মন্ত্রীদের “ব্যুরোক্র্যাসির চেহারা চরিত্র পাল্টানোর” অনুরোধের সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটিরও বিরোধিতা করতে বলেন তিনি। ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্যের যুক্তরাষ্ট্র তৈরির প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেলে ব্রিটিশরা হয়তো “ভারত-বিভাজনের অন্য কোনও সাংবিধানিক পথ বার করার চেষ্টায় থাকবে, যাতে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের গুরুত্বকে যথেষ্ট হ্রাস করা যায়”, তাঁর সন্দেহ। আবার, একই সঙ্গে এও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে ভারত, প্যালেস্তাইন, মিশর, ইরাক ও আয়ার্ল্যান্ডে ধর্মীয় ও অন্যান্য গোষ্ঠী-পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজনের নীতি চালু করে ব্রিটেন কিন্তু “নিজের রাজনৈতিক দ্বিচারিতায় নিজেই ফেঁসে যেতে বসেছে”। আর ঠিক এই কারণেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের উচিত দেশের সংখ্যালঘুদের কথা আগে থেকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। “এই ধরনের ধর্মীয় বিষয়ে এবং আর্থিক ও রাজনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে বাঁচো এবং বাঁচতে দাও”— এটাই সুভাষের নীতি। আশ্চর্য, ধর্মীয় ভেদাভেদের ক্ষেত্রে এত উদার পথ নিতে বললেও তিনি কিন্তু কোথাও “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটি ব্যবহার করলেন না। ধর্মবিশ্বাস যে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে কতটা জরুরি, সে কথা তিনি ভালই জানতেন, আর তাই ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে শক্ত পাঁচিল তুলে দেওয়ার পরিবর্তে তাঁর পছন্দ ছিল, সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পথ। অনগ্রসর জনজাতি অর্থাৎ ভারতের এ যাবৎ কালের অস্পৃশ্য জাতের মানুষের জন্য সুবিচারও অত্যন্ত জরুরি বিষয় বলে মনে করতেন তিনি।

“ভাষাভিত্তিক অঞ্চলগুলির জন্য সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা” প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের সঙ্গে তিনি এও বলেন যে, হিন্দি ও উর্দু ভাষার মিশ্রণে যে হিন্দুস্তানি ভাষা তৈরি হয়েছে, এ দেশের ক্ষেত্রে সেটিই সর্বজনীন ভাষা হতে পারে। দেবনাগরী ও আরবি-ফার্সি, দুই বর্ণমালার ক্ষেত্রেই “সম্পূর্ণ স্বাধীনতা” দেওয়ার প্রস্তাব করেন, বলেন, রোমান হরফ গ্রহণই অবশ্য “শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে সুবুদ্ধির কাজ” হবে। ১৯৩৪ সালে তুরস্ক ভ্রমণের সময় তাঁর এই ধারণা জন্মায়। একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে ভারতে ঐক্যসাধনের উচ্চাশা যদি থাকে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সংখ্যালঘু সমাজকে সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে বড় রকমের অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তাদের নিশ্চিন্ত রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি। নেহরু বা প্যাটেল-সহ কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে সেই সময়ে যে একশৈলিক বা একমাত্রিক জাতির ধারণা দেখতে পাওয়া যেত, নানা ধরনের ভাবনাধারা থেকে এসেও যাঁরা সকলেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রশ্নে রীতিমতো অসহনশীল ছিলেন, তাঁদের থেকে স্বাভাবিক ভাবেই সুভাষের এই দৃষ্টিভঙ্গির বহু যোজন দূরত্ব ছিল। সুভাষচন্দ্র বসুর প্রথম থেকেই দৃঢ় বিশ্বাস, সংখ্যালঘুর সম্মানরক্ষার প্রশ্নটির উপরেই ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। নানা রকম বিচিত্র আইডেন্টিটি বা সত্তা-পরিচয় শেষ পর্যন্ত মোটেই কোনও বৃহত্তর জাতি-সত্তা পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

ভারতীয়রা যদি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত থাকে, তবে সে দিন আর বেশি দূরে নেই, সুভাষ নিশ্চিত। স্বাধীনতা অর্জনের পর “স্বাধীন দেশের জন্য দীর্ঘ-কালীন ভিত্তিতে” একটি কর্মপন্থা তৈরির প্রস্তাব ছিল হরিপুরা কংগ্রেসের বক্তৃতায়। “প্রথম কাজই” হল “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ”। বাস্তবিক, ভারতের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনিই এক মাত্র, যাঁর মুখ দিয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উচ্চারিত হয়। এর আগের বছরই তরুণ ডাক্তার সীতা ধর্মবীরের কাছে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “শিশুদের বিষয়ে তোমার লেখা আমায় গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। আমারও মনে হয়, ভারতীয়রা বড্ড বেশি সংখ্যায় শিশুর জন্ম দেয়। কিন্তু কীসের জন্য এত কিছু? বেশির ভাগ শিশু তো বাল্যেই মারা যায়, মাত্র সামান্য অংশই বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষ হতে পারে। এ জন্যই জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার, ভারতের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। মহাত্মা গাঁধী তো স্ব-নিয়ন্ত্রণের কথা বলেই দিয়েছেন, এখন মানুষজন তাঁর কথায় কান দিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে কি না সেটাই দেখার।”১০ “ভারতের জনসংখ্যা সত্যিই অত্যধিক কি না”, হরিপুরায় “সেই সব তাত্ত্বিক আলোচনায়” তিনি যেতে চাননি। কেবল বলেন, “যত দিন না আমরা বর্তমান জনসংখ্যার জন্য ঠিকমতো খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছি, তত দিন পর্যন্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবাটাই বাঞ্ছনীয়।” সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির উপর জোর দেন তিনি, এ বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থার কথা বলেন।১১

সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের “পুনর্গঠন”-এর “প্রধান সমস্যাই” হবে “দেশ থেকে দারিদ্র দূর করা”। তার জন্য “আমাদের জমিব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার চাই, জমিদারি প্রথার অবসান চাই।” আর্থিক মন্দার দশকটিতে এ দেশে গ্রামীণ পুঁজি নিঃশেষিত হয়ে যায়, তার সঙ্গে যুক্ত হয় কৃষকের ঋণের বোঝা। সুভাষের মতে, “কৃষি-ঋণের বিষয়টির একটা হেস্ত-নেস্ত দরকার, কৃষক-সমাজের জন্য সুলভে ধার নেওয়ার বন্দোবস্ত চাই।” তবে কেবল কৃষির দিকে লক্ষ্য নিবদ্ধ রাখলে হবে না। “অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে” কেবল কৃষির উন্নতি ঘটালেই “চলবে না”, সরকারের নেতৃত্বে শিল্প-স্থাপনের বন্দোবস্তও জরুরি। “আমরা যতই আধুনিক শিল্পসভ্যতার সমালোচনা করি না কেন, যতই তার সঙ্গে যুক্ত অনাচারের বিরোধিতা করি না কেন,” — গাঁধীর ভাবনাধারাকে লক্ষ্য করে বলেন সুভাষ— “চেষ্টা করলেও আমরা শিল্পবিপ্লবের আগের যুগে ফিরে যেতে পারব না।” স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র “কোনও যোজনা কমিশনের উপদেশ অনুযায়ী” “সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গোটা দেশের কৃষি ও শিল্পের উত্পাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে একটা সার্বিক রূপরেখা তৈরি করুক।”১২

এই জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে কংগ্রেসের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে, এমনটাই মনে করতেন সুভাষ। গাঁধীর মতো করে তিনি মোটেও ভাবতেন না যে স্বাধীনতার পর এই দলটির ক্রমে উঠে যাওয়া উচিত। “অনেক রকম দলের একত্র অস্তিত্ব ও কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক সংগঠনের” ফলে “ভবিষ্যৎ ভারতীয় রাষ্ট্র একটা কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারবে না।” দলের মধ্যেকার গণতন্ত্রের ফলে “নেতারা উপর থেকে চেপে বসবেন না, বরং মানুষই নেতাদের নির্বাচন করতে পারবেন।”১৩ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করবে, কংগ্রেসের আন্তঃ-দলীয় গণতন্ত্র বিষয়ে সুভাষচন্দ্র একটু বেশিই আশাবাদী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলিকে কংগ্রেসের সরাসরি সদস্য গোষ্ঠী করে নেওয়া উচিত। তাঁর বহু সতীর্থ যাঁরা শ্রেণিগত পরিচয়ে জমিস্বত্বভোগী কিংবা শিল্পপতি ছিলেন, তাঁদের কিন্তু এতে একেবারেই মত ছিল না।১৪

মাত্র দুই জন নেতারই আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিতে সে দিন খানিক উত্সাহ ছিল: সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল। কোনও পরাধীন দেশের বিদেশনীতি কী হওয়া উচিত, কংগ্রেসের যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার কথা বিবেচনা করা উচিত, হরিপুরা বক্তৃতার শেষাংশে এ সব কথার উল্লেখ করেছিলেন সুভাষ। তাঁর যুক্তি, “ভারতের বিদেশনীতি কখনওই অন্য কোনও দেশ বা কোনও বিশেষ রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুসৃত নীতি দিয়ে নির্ধারিত হবে না।” ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে সমব্যথী মানুষ সব দেশেই অল্পবিস্তর মিলবে, আর তাঁদের সেই সমর্থনকে আস্তে আস্তে কাজে লাগাতে হবে, ভাবেন সুভাষ। জোরদার সাংস্কৃতিক দৌত্যের মাধ্যমে ভারতের ‘সফ্ট পাওয়ার’ কাজে লাগানোর জন্য ওকালতি করেন তিনি। ‘প্রোপাগ্যান্ডা’ শব্দটি তাঁর অপছন্দ, এর মধ্যে যেন একটা অসত্যভাষণের গন্ধ আছে; বরং তাঁর ইচ্ছা, দুনিয়ার চার দিকে ভারত বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হোক। কংগ্রেসের বিশ্বস্ত প্রতিনিধিরা কাছে দূরে সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ুন— মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষের ভারত বিষয়ে এত গভীর উত্সাহ, অথচ সেখানকার বিষয়ে ভারতীয়রা এ পর্যন্ত কিছুই ভাবেননি, এটা কি দুর্ভাগ্যজনক নয়? তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ভারতের স্বাধীনতার মধ্যে কিন্তু বৃহত্তর দুনিয়ারও স্বার্থ জড়িত: “আমাদের সংগ্রাম তো কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়, বিশ্বের সব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। প্রথমটি অবশ্যই দ্বিতীয়টির প্রধান অংশ। সুতরাং, আমরা কেবল ভারতের স্বার্থের জন্যই লড়াই করছি না, বৃহত্তর মানবতার জন্যও লড়ছি। ভারতের স্বাধীনতার অর্থই সেই বৃহত্তর মানবতার পরিত্রাণ।”১৫

হরিপুরায় সুভাষচন্দ্র যা করলেন, তাতে তাঁর জয়জয়কার পড়ে গেল। নিখাদ বাঙালি ধরনে খাদির দুধসাদা ধুতি পাঞ্জাবি, তার উপরে সূক্ষ্ম কাজের কাশ্মীরি শাল— মানুষটির আত্মপ্রত্যয় যেন ঝরে পড়ছিল, শান্ত কর্তৃত্বময় ভঙ্গিতে সকলকে মুগ্ধ করে ফেললেন। অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়ে সাদা গাঁধীটুপি পরে নিতেন তিনি। দুই মাস আগে বাডগাস্টাইনে এ কে চেট্টিয়ারকে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ক্যামেরার জন্য পোজ দিয়ে হাসতে বললে তিনি মোটেও হাসতে পারেন না; অথচ হরিপুরায় কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হাসতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। দরিদ্র পশ্চাত্পর মানুষদের যখন সুভাষ তাদের দারিদ্র, পশ্চাত্পরতা নিয়েই মাতৃভূমির সেবায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, একটি আন্তরিক কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন তাঁরা, সাড়া দিতে উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন।১৬ সুভাষের সঙ্গে ভারতীয় সংগ্রামের সাধারণ পায়ে-হাঁটা সৈনিকরাও হরিপুরা থেকে সারা দেশে স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি হরিপুরা থেকে ফিরে আসার পর সুভাষকে নিয়ে প্রথম যে শহরটি উত্তাল হয়ে উঠল, সেটি হল ভারতের পশ্চিম উপকূলের মহানগরী, দশ দিন তিনি সেখানে রইলেন। “অসাধারণ অভ্যর্থনা পেলাম বম্বেতে,” খুশি মনে এমিলিকে জানিয়েছিলেন তিনি।১৭ বাকি বছরটাও সারা দেশে ঘুরে বেড়ালেন, কখনও ট্রেনে কখনও প্লেনে। গাঁধীর সুবিধার্থে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ওয়ার্ধায় প্রতি দুই মাস অন্তর বৈঠক করত। কংগ্রেসের প্রধান কার্যনির্বাহী দফতরটি জে বি কৃপালনি চালাতেন, সেটা ছিল নেহরুর নিজের শহর এলাহাবাদে। সুভাষচন্দ্র অবশ্যই কলকাতায়। গোটা দেশ জুড়ে সে দিন তাঁর কর্মক্ষেত্র।

সুভাষের আন্তর্জাতিক খ্যাতিও তখন মধ্যগগনে। ইউরোপ ও আয়ার্ল্যান্ডে খ্যাতিলাভের পর কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদগ্রহণের আগেই ইংল্যান্ডে গিয়ে বেশ কিছু মানুষজনকে কথা বলে মুগ্ধ করেছেন তিনি। কোনও দিন আমেরিকা না যাওয়া সত্ত্বেও ১৯৩৮ সালের ৭ মার্চ টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়েছে। গলায় মালা পরা রঙিন ছবিটির নীচে তাঁরই বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, “অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ব্রিটেন ভারতবর্ষকে ধ্বংস করেছে।” লেখাটির নাম ছিল “স্বাধীনতার রথ” (“Chariot of Freedom”)। গাঁধী ও সুভাষ দুই জনেরই আলোচনা ছিল সেখানে, আলোচনার সুরটি অবশ্য বেশ উদ্ধত। টাইম-এর রিপোর্ট জানায়, কেম্‌ব্রিজ ইউনিভার্সিটির “প্রাক্তনী বসু” কী ভাবে সতেরো বছর আগে “সন্তসুলভ গাঁধী”-র কথাবার্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দেন, এবং তার পর জেলেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, লন্ডনের এক সভায় তিনি একটি “স্পষ্ট রাজদ্রোহাত্মক” বক্তৃতা দেন, কিন্তু “ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দুই লক্ষ সদস্যের একত্র বৈঠকের ঠিক আগে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টকে লন্ডন পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ রাজ আর নিজের ঝামেলা বাড়াতে চাননি।” জাতীয় কংগ্রেস সভায় সুভাষের আবির্ভাবেরও একটা বর্ণনা আছে রিপোর্টে— স্বর্ণপত্র ও স্বর্ণঘণ্টায় সুসজ্জিত একান্নটি গোরু কেমন ভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল “কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষ বোসের রথ, সরু ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল তাঁর চোখ।” তবে টাইম-এর রিপোর্ট কিন্তু একটি কথা স্বীকার না করে পারেনি, “ক্ষমতা ও মর্যাদার জন্য লালায়িত, চকচকে চেহারার উচ্চবর্গের কংগ্রেস রাজনীতিকদের মধ্যে সুভাষ বসু কিন্তু একেবারেই আলাদা গোত্রের নেতা।”১৮

হরিপুরা অ্যাজেন্ডার প্রস্তাবগুলি কার্যকর করার লক্ষ্যে ১৯৩৮ বছরটা জুড়ে ব্যস্ত রইলেন সুভাষ। ভারতের আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের ব্লুপ্রিন্ট তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে মে মাসে বম্বে-তে সাতটি প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রধানকে একটি সভায় আহ্বান করলেন। এই নেতাদের সঙ্গে, আহূত হলেন বেশ কিছু মন্ত্রী, এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কয়েক জন সদস্য। সভায় আলোচিত হল নানা সমস্যা: শিল্প পুনর্বিন্যাস, বিদ্যুত্শক্তি উত্পাদন, এবং বিভিন্ন কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয়। ওই সভা চলাকালীনই বম্বে মিউনিসিপ্যালিটি-তে সুভাষের আর একটি বক্তৃতায় স্পষ্ট হল, তিনি নিজে কী কী চাইছেন। যেমন, বম্বের তুলনায় উন্নত, সম্পন্ন এলাকাগুলি পৃথিবীর তাবড় শহরগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলেও সুভাষের মতে এখনই দৃষ্টিপাত দরকার গরিব বস্তি-অঞ্চলগুলির উপর। তাঁর বক্তব্য, আধুনিক পুরসভার কাজ হবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ, শিশুমৃত্যু বা মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে থাকবে বিশেষ নজর। কেন্দ্রে ব্রিটিশের কাছ থেকে ক্ষমতার লড়াই-এর পাশাপাশি প্রদেশ ও শহরগুলিতে কংগ্রেস সরকারকে দুর্বল ও পশ্চাত্পর সমাজের দিকে যথাসাধ্য কাজ করে যেতে হবে।১৯

ভারতীয়রা যখন দেশের ক্ষমতায় আসীন হবে, সেই সময়ের জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা ছকে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন সুভাষ। বিজ্ঞান-সমাজের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন তিনি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তাঁর বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন, সুভাষচন্দ্র তাঁর উপদেশ চাইলেন। ১৯৩৮ সালের অগাস্ট মাসে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন-এর সভায় সুভাষচন্দ্র “বিজ্ঞান ও রাজনীতির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা”র আহ্বান করেন। মেঘনাদ সাহা অবশ্য তাঁকে চেপে ধরে একটি গুরুতর প্রশ্ন তোলেন: “ভবিষ্যতের ভারত ঠিক কেমন হতে চলেছে? সেই প্রাচীন গ্রামজীবনের দর্শন, সেই গোরুর গাড়ি, সেই দাসত্বদশা? নাকি নিজের প্রাকৃতিক সম্ভারকে কাজে লাগিয়ে সে একটি আধুনিক শিল্পনির্ভর রাষ্ট্র হতে চায়, যে নিজেই নিজের দারিদ্র, অশিক্ষা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদির দায়িত্ব নিতে পারবে, জগত্সভায় নিজের আসন করে নিতে পারবে, সভ্যতার নতুন যুগের সূচনা করবে?” সত্যাশ্রয়ী উত্তর দেন সুভাষ: কংগ্রেসের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর মতভেদ রয়েছে, তবে “নবীন প্রজন্ম” শিল্পায়নেরই পক্ষে। বেকারসমস্যার সমাধান, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, জনগণের জীবনযাপনের মান উন্নয়ন, এই সবের জন্যই তাঁরা শিল্প জরুরি মনে করেন। মেঘনাদ সাহার পত্রিকা “সায়েন্স অ্যান্ড কালচার”-এর প্রশংসা করেন সুভাষ, সেখানে বিদ্যুত্শক্তি সরবরাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীসমস্যার আলোচনা আছে যে সব প্রবন্ধে, সেগুলির কথা উল্লেখ করেন। একটি স্থায়ী ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল তৈরি, এবং ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন-এর জন্য তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি প্রামাণ্য অর্থনৈতিক সমীক্ষা শুরুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন তিনি।২০

কংগ্রেসে ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে সুভাষ এ বার ১৯৩৮-এর ২ অক্টোবর দিল্লিতে কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশগুলির শিল্পমন্ত্রীদের একটি কনফারেন্স আয়োজন করেন। কংগ্রেসের লক্ষ্য ধার্য করেন, দেখতে হবে যাতে “সকলে— মহিলা, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবাই, ভাল কাপড় পান, ভাল শিক্ষা লাভ করেন, এবং বিনোদন বা সাংস্কৃতিক কাজকর্মের জন্য যথেষ্ট অবসর পান।” তাঁর মন্তব্য, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যেমন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, ভারতও তাই।” জাতির উন্নয়নের স্বার্থে দরকার কেবল এই সম্পদের ঠিকঠাক বণ্টন, যার মধ্যে থাকবে বুদ্ধির ছাপ, সাম্যবোধের স্বাক্ষর। কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্পের মধ্যে বিরুদ্ধতা থাকবেই, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। গাঁধী ও গাঁধীবাদীদের আশ্বাস দিতেন, কুটির শিল্পের প্রসারে তাঁর আদ্যন্ত উত্সাহ, কিন্তু শিল্পায়নের প্রয়োজনও তিনি পুরোপুরি সমর্থন করেন।২১ এক জন মানুষ এই তর্কে তাঁর পাশে থাকতে পারতেন— জওহরলাল নেহরু। নেহরু কিন্তু এই সময়ে ১৯৩৮ সালে ছয় মাসের জন্য ইউরোপে রয়েছেন। “এই কয়েক মাস তোমার অভাব যে কতখানি বোধ করেছি, ভাবতেও পারবে না,” ১৯৩৮-এর ১৯ অক্টোবর স্পেনবাসী জওহরলালকে চিঠিতে লেখেন সুভাষ। ইউরোপে যে কাজ জওহরলাল করছেন, তা যে কতখানি মূল্যবান সুভাষ জানতেন— এই কাজই তো তিনি এক দিন করেছেন ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের সপক্ষে বিদেশে সমর্থন সংগ্রহের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে এও ঠিক, ভারতে সে দিন জওহরলালকে সুভাষের খুব দরকার ছিল, কেননা তিনি সবে তখন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি ঘোষণা করতে চলেছেন। “আশা করছি প্ল্যানিং কমিটি-র সভাপতির পদটি তুমি গ্রহণ করবে,” সুভাষ লিখলেন, “ব্যাপারটাকে সফল করে তুলতে হলে তোমাকে চাই-ই চাই।”২২

নভেম্বরে জওহরলাল যখন ইউরোপ থেকে ফিরলেন, সুভাষচন্দ্র ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি শুরু করতে একেবারে প্রস্তুত। ১৯৩৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর-এর প্রথম মিটিং হল বম্বে-তে। কমিটির কাজের উদ্বোধন করে সুভাষ যুক্তি দিলেন, রাষ্ট্রীয় প্রযোজনায় ভারী শিল্প ও বেসরকারি উদ্যোগে লঘু শিল্প তৈরি ও কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবনের একটা যৌথ পরিকল্পনা খুবই সম্ভব। কমিটিকে পরিকাঠামো তৈরির দিকে এখনই মনোযোগ দিতে বললেন তিনি, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে। কমিটির গঠন বিষয়ে তিনি খুবই দরাজ। শিল্পদুনিয়া, শ্রমদুনিয়া, জীবনের নানা ক্ষেত্রের নানা বড় বড় প্রতিনিধিকে এক জায়গায় করার চেষ্টা করে চলেছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে নির্বাচন করলেন, আবার ডেকে নিলেন ভারী শিল্পের কট্টর বিরোধী গাঁধীভক্ত জে সি কুমারাপ্পাকেও। “ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি-র যে কাজ গত বছর তুমি আমায় দিয়েছ, সমানেই তা বেড়ে চলেছে, প্রচুর সময় আর শ্রম দরকার হচ্ছে,” কয়েক মাস পর জওহরলাল সুভাষকে লিখলেন। “ব্যাপারটা ভয়ানক পরিশ্রমের।”২৩ জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র, দুই জনই অবশ্য এই গঠনমূলক কাজ হাতে পেয়ে উত্সাহে উদ্বেল, তা যতই পরিশ্রমসাধ্য হোক। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বিশেষ দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক আবিষ্কারে নেতৃত্ব দিলেন সুভাষচন্দ্র, যে ধরনের প্রতিষ্ঠান পরবর্তী কালে অনেকগুলি দশক ধরে স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল দিশারী হয়ে উঠবে।

“বম্বেতে আমার কিছু জরুরি কাজ আছে,” ১৯৩৮-এর ৯ মে লিখেছিলেন সুভাষ। “(১) মিস্টার জিন্না-র সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম সমঝোতা নিয়ে কথাবার্তা। (২) সাত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে কনফারেন্স-এ সভাপতিত্ব। (৩) কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ সভাপতিত্ব।”২৪ ১৯৩৮ সালে তাঁর কর্মসূচিতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি সাধনের প্রশ্নটি ছিল একেবারে শীর্ষস্থানে। সুভাষের চিরকালের বিশ্বাস, কেবল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের জন্যই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জরুরি নয়, পরবর্তী স্বাধীন ভারতেও ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ক্ষমতার সঙ্গত বণ্টন প্রয়োজন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৮ সালের ১৪ মে মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে তাঁর মালাবার হিল-এর সুন্দর বাড়িটিতে গিয়ে দেখা করলেন। বই-এর তাকের সামনে সোফায় বসে বাঙালি-পোশাক পরিহিত সুভাষচন্দ্র যেন জিন্নার ঠিক বিপরীত গ্রহের মানুষ, জিন্নার গায়ে ‘স্যাভিল রো’ স্যুট, পায়ে ‘অক্সফোর্ড শু’। নতুন ভাবে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছিলেন সুভাষচন্দ্র— যথেষ্ট শোভন, আন্তরিক হল তাঁদের আলোচনা।

তবে সুভাষচন্দ্র ক্রমে আবিষ্কার করলেন, বন্ধু জওহরলাল নেহরু তাঁর জন্য ব্যাপারটা একটু বেশিই জটিল করে রেখেছেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন ঘটে যাওয়ার পর পূর্বসূরি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রীতিমত স্পর্ধিত ঘোষণা করে গিয়েছেন যে ভারতে মাত্র দুটি রাজনৈতিক পক্ষ: ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস। মুসলিম লিগ নেতাকে বলে রেখেছেন যে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান তিনি “দূরবিন দিয়ে খুঁজে দেখেছেন”, কিন্তু “যদি তেমন কিছু কোথাও না-ই থাকে, কী বা দেখতে পাওয়া সম্ভব?”২৫ জিন্না এখন ভারতীয় মুসলিম সমাজের “একক মুখপাত্র” হয়ে উঠতে চান।২৬ তিনি জেদাজেদি করছেন যাতে মুসলিম লিগকেই ভারতের মুসলিমদের সর্বক্ষমতাময় প্রতিনিধির স্থানটি দেওয়া হয়, কংগ্রেস যেন তা স্বীকার করে নেয়। একমাত্র তা হলেই কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে অন্তঃসারপূর্ণ আলোচনা হওয়া সম্ভব। এ দিকে কংগ্রেস কিছুতেই মানতে রাজি নয় যে কংগ্রেস “সাম্প্রদায়িক”, অর্থাৎ কেবল বিশেষ একটি সম্প্রদায়েরই প্রতিনিধিত্ব করছে সে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৮ সালের ২৫ জুলাই সুভাষ জিন্নাকে অনুরোধ জানালেন, “কংগ্রেস যে লিগের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এবং কণ্টক-জর্জরিত হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নের একটা সম্মানজনক উত্তরে পৌঁছতে কেবল ইচ্ছুক নয়, রীতিমতো আগ্রহী— এটাই কি যথেষ্ট নয়?” ২ অগস্ট জিন্নার উত্তর এল: সমাধানের খোঁজে মুসলিম লিগও “একই রকম উদ্বিগ্ন”, তবে কিনা যেহেতু জওহরলাল নেহরু ইতিমধ্যে লিগের “অস্তিত্ব”ই অস্বীকার করে বসেছেন, তাই “কোন ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে দুটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় আসতে পারে, সেটাও কংগ্রেসকে জানানো উচিত” বলে লিগ মনে করে। ১৯৩৮-এর আলোচনার ব্যর্থতার কারণটাই লুকিয়ে আছে এই “ভিত্তিভূমি” নিয়ে কংগ্রেস ও লিগের মতের বৈষম্যের মধ্যে। ১১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি-তে বিষয়টি আলোচনার পর সুভাষচন্দ্র জিন্নাকে লিখলেন যে, ১৪ মে তিনি যে প্রয়াস শুরু করেছিলেন, তা আপাতত পরিত্যক্ত হল।২৭ খুবই দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনা। ঠিকমতো কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ হলে হয়তো জিন্না বুঝতে পারতেন সুভাষচন্দ্র এমন এক জন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট যিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলিতে, এবং ভবিষ্যতে সর্বভারতীয় স্তরেও, লিগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে যথেষ্টই ইচ্ছুক। মাঝখান থেকে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই রকম: ভারতীয় মুসলিমদের তরফে কে কথা বলতে পারে, কে কার প্রতিনিধিত্ব করছে, এই নিয়ে বিসংবাদ এমন জায়গায় চলে গেল যে দুই দলের মধ্যে বহু যোজন ফারাক তৈরি হয়ে উঠল।

কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র গাঁধীর সঙ্গে সহযোগিতার প্রচুর চেষ্টা করেছিলেন, গুরুতর বিষয়গুলিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলেন। সমাজবাদীদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের আদর্শগত নৈকট্য সত্ত্বেও তিনি দলের বাম ও দক্ষিণপন্থীদের প্রতি নিরপেক্ষ, সমভাবাপন্ন থাকার প্রয়াস করেছিলেন। ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি-তে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ তর্কবিতর্ক হয়। গাঁধীর সমর্থকরা একটি প্রস্তাব আনেন যাতে বলা হয়, নাগরিক স্বাধীনতার নামে কিছু বাম-ভাবাপন্ন কংগ্রেসি শ্রেণিযুদ্ধ উসকাতে চাইছেন, কংগ্রেস যে সর্বান্তঃকরণে জীবন ও সম্পদের অধিকারে বিশ্বাস করে, তাও বলা হয়। সুভাষ সভাপতির আসনে বসে সবাইকে স্বাধীন ভাবে তাঁদের নিজের নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিলেন— গাঁধীও সুভাষের এই নিরপেক্ষতা খেয়াল করলেন। যে সব চরমবাদী সম্পদের সমবণ্টনের তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন এই প্রস্তাবের সংশোধনী আনলেন, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্যরা নাটকীয় ভাবে ওয়াক-আউট করলেন। গাঁধী অত্যন্ত বিরক্ত হলেন, বললেন, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত স্বীকার করার মৌলিক নীতিটিই না মানা হয়, তবে যাঁরা ওয়াক-আউট করেছেন তাঁরা স্থায়ী ভাবে কংগ্রেসের বাইরেই থাকুন। সুভাষচন্দ্রও গাঁধীর পাশে দাঁড়ালেন, যদিও অবশ্য তাঁকে এ জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে মধ্যপন্থা গ্রহণ করতে হল, পরবর্তী কালে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীরা সেটা ভাল চোখে দেখলেন না।২৮

একই ভাবে, ১৯৩৮ সালের জুলাই ও অগস্ট মাসে মধ্য প্রদেশে (সেন্ট্রাল প্রভিন্স) মন্ত্রিসভার যে সংকট উপস্থিত হল, সেখানেও গাঁধীর মতই গ্রহণ করলেন সুভাষচন্দ্র। ভারতের একেবারে মধ্য ভাগের এই বিরাট প্রদেশটিতে মরাঠিভাষী ও হিন্দিভাষী দুই রকম অঞ্চল। এন বি খারে নামক এক মরাঠিভাষী সেখানে ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১৯৩৮-এ তিনি অভিযোগ আনলেন যে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা, হিন্দিভাষী দলের প্রধান ডি পি মিশ্রকেই আসলে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সমর্থন জোগাচ্ছে। খারে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটানোর চেষ্টায় ব্রিটিশ গভর্নরের সঙ্গে দারুণ ঘনিষ্ঠতা শুরু করলেন, এবং সম্ভবত সেই কারণেই সুভাষ গাঁধীর দিকটা বেছে নেওয়াই মনস্থ করলেন। খারে অবশ্য পরে দাবি করেছিলেন যে তাঁর প্রতি সুভাষচন্দ্র প্রসন্নই ছিলেন। সেই সময়কার তথ্যপ্রমাণ অবশ্য বলছে, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র কিন্তু গাঁধী ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে একত্রে খারেকে রাজনৈতিক শৃঙ্খলার শিক্ষা দিতে এক নতুন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নতুন কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনেরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রাদেশিক অধিকার বিষয়ে তাঁর যে মতই থাকুক না কেন, ভারতীয় প্রদেশগুলিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিস্থানীয়দের জায়গা দিতে তিনি একেবারেই রাজি ছিলেন না।২৯

ক্ষমতা হাতে রাখার লক্ষ্যে এই ধরনের ব্রিটিশ সাংবিধানিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তাঁর আন্তরিক বিরুদ্ধতার কারণেই সুভাষকে দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তি ও যুক্তরাষ্ট্র গঠন বিষয়ে কয়েকটি কড়া অবস্থান নিতে হয়। এ দিকে ব্রিটিশ সংবাদদুনিয়ার খবর: কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে নাকি কিছু নেপথ্য বোঝাপড়া চলছিল সে সময়ে। সুভাষের মতে, কোনও প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা যে কংগ্রেসকে না জানিয়ে এমন করতে পারেন, তা তিনি বিশ্বাসই করেন না। এও বলেন যে, কংগ্রেসের কোনও মহল যদি এমন কোনও দুর্বলতার পরিচয় দেয়, তবে “তা হবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা।” কায়মনোবাক্যে তিনি “এই অত্যন্ত বিপজ্জনক যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রস্তাবটির বিরোধী— প্রত্যক্ষ, সর্বান্তঃকরণ, সামগ্রিক তাঁর বিরোধিতা”। যদি “কোনও অভাবিত পরিস্থিতিতে” কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ এই প্রস্তাব পাশ করে দেয়, সে ক্ষেত্রে তাঁর “নিজের পদের দায়িত্ব” থেকে তিনি নিষ্কৃতি চাইবেন। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী সদস্যরা এমন একটি চরম আক্রমণমূলক বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার কারণ জানতে চাইলেন, মনে করলেন, কংগ্রেসে থেকে ওয়াক-আউট করার হুমকি রয়েছে এর মধ্যে। সুভাষের মতে, এই বক্তব্য পেশ করা ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না, তিনি “কেবল জোরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে কংগ্রেসের মতটি প্রকাশ করেছেন” এর মধ্যে। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না তাঁর ক্ষেত্রে, এই প্রতিষ্ঠান তাঁর জীবনের “শ্বাসবায়ু-সমান”, তাঁর আশা যে কংগ্রেসি নেতারা “দেশের জাতীয় স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে” নিজেরা নিছকই “সংসদে সময়-কাটানো হর্তাকর্তা”য় পরিণত হবেন না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর কোনও ভাবেই ঐক্যবদ্ধ, নবজাগ্রত ভারতবর্ষের দাবিকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না।৩০

ব্রিটিশের কাছে কংগ্রেসকে যদি একটা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় দাবি তুলে ধরতে হয়, সে ক্ষেত্রে দুটি শর্তের অন্তত একটি পূরণ করা খুব জরুরি বলে সুভাষচন্দ্র মনে করতেন: হয় সর্বভারতীয় স্তরে মুসলিম লিগের সঙ্গে বোঝাপড়া, নয়তো সব কয়টি বা অন্তত অধিকাংশ মুসলিমপ্রধান প্রদেশে কোআলিশন মন্ত্রিসভা তৈরি করে তাতে কংগ্রেসের অংশগ্রহণ। কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করার সময় ভারতের এগারোটি প্রদেশের মধ্যে সাতটি কংগ্রেস-শাসিত ছিল। চারটি ব্যতিক্রমের মধ্যে ছিল: উত্তর-পশ্চিমে পঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশ, পূর্বে বাংলা এবং অসম। ১৯৩৭ সালের শাসনভারগ্রহণের নীতির ক্ষেত্রে সুভাষের মত গৃহীত হয়নি। তবে সেই সময়ে যেহেতু কোনও সাধারণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছিল না, এবং সাতটি প্রদেশে মন্ত্রিসভা তৈরির সিদ্ধান্তও নেওয়া হল, সুভাষ ভেবেছিলেন, বাকি প্রদেশগুলিতে কোআলিশন মন্ত্রিসভা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করবে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দৃঢ়তর করবে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সুভাষের হস্তক্ষেপেই অসমে মহম্মদ সাদুল্লাহ্-র নেতৃত্বে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভা ক্ষমতাচ্যুত হয়, তার বদলে গোপীনাথ বরদলই-এর নেতৃত্বে কংগ্রেস-প্রধান কোআলিশন মন্ত্রিসভা শাসনভার গ্রহণ করে। অর্থাৎ এর ফলে এগারোটির মধ্যে আটটি প্রদেশে কংগ্রেস পার্টি নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। পঞ্জাবে জমিদার ও ধনী কৃষক গোষ্ঠীর নির্বাচনী সমর্থনের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ-অনুরক্ত ইউনিয়নিস্ট পার্টির সরকার প্রতিষ্ঠিত, তার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের করার কিছুই ছিল না। সিন্ধুপ্রদেশে কংগ্রেস মুসলিম লিগ কেউই ভাল করেনি। এই ক্ষেত্রে সুভাষ ঠিক করলেন, আল্লাহ্ বক্স নামে এক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পরিচালিত সরকারকে সমর্থন জোগানোই কংগ্রেসের পক্ষে বুদ্ধির কাজ হবে।

তবে কোআলিশন সরকার তৈরির ব্যাপারে কত সমস্যা তৈরি হতে পারে, সেটা আসলে দেখা গেল বাংলায়, বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের ঘরের প্রদেশটিতে, যেখানে তাঁরা দু’জনেই একটা মধ্যস্থতায় আসার বিস্তর চেষ্টা করছিলেন। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব, যার চলতি নাম কংগ্রেস হাইকম্যান্ড, এবং গাঁধী নিজে, সুভাষ ও শরৎচন্দ্র বসুর সমস্ত চেষ্টা বিফল করে দিতে সমর্থ হলেন। গাঁধী তখন শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লা এবং নলিনীরঞ্জন সরকার নামে আর এক রাজনৈতিক “দালাল”-এর গোলমেলে প্রভাবে ভীষণ ভাবে চালিত হচ্ছেন। এঁরা দু’জনেই বড় শিল্প স্বার্থের মুখপাত্র। ১৯৩৭ সালে যখন মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির সরকার স্থাপন করেছিলেন, তাঁর এগারো সদস্যের মন্ত্রিসভার আটটি পদই দিয়েছিলেন আট জমিদারকে। চার জন মুসলিম লিগ সদস্য তিন অকংগ্রেসি বর্ণহিন্দু এবং দুই জন অকংগ্রেসি তফশিলি জাতির প্রতিনিধির পাশে হক নিজে ছাড়া আর মাত্র এক জন কে পি পি প্রতিনিধি ছিলেন সেখানে।৩১ শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে বাংলা কংগ্রেসে তখন প্রজাস্বত্ব আইনের একের পর এক বড় বড় সংশোধনী আনা হচ্ছে, যার মাধ্যমে কৃষিসমাজের নীচের স্তরের মানুষদের নানা রকম অধিকার লাভের চেষ্টা চলছে, এবং তারই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে মুসলিম কৃষকসমাজের দৃঢ় সমর্থনে পুষ্ট কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের আঁতাত নির্মাণের ভিত্তি। ১৯৩৭ সালে অগস্টে, জওহরলাল নেহরুকে চিঠিতে জানালেন শরৎ, কুড়ি থেকে পঁচিশ জন কে পি পি প্রতিনিধির সমর্থন তিনি ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছেন। একটাই জিনিস তখন তাঁর তত্কালীন কংগ্রেস সভাপতির কাছ থেকে পাওয়া দরকার— একটা ঘোষণা যে সমমনস্ক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত তৈরিতে ওয়ার্কিং কমিটি তার সিলমোহর দিতে রাজি। নলিনীরঞ্জন সরকারের দুর্বুদ্ধির কথাও উল্লেখ করলেন শরৎ, জানালেন তিনি কেমন “উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভাবে গুজব ছড়াচ্ছেন যে ওয়ার্কিং কমিটি কোনও অবস্থাতেই এমন আঁতাতের অনুমোদন দেবে না, অথচ এর ফলে কিন্তু কংগ্রেসেরই প্রদেশগুলিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।”৩২ ১৯৩৮-এর মার্চে দেখা গেল, বাংলার মন্ত্রিসভায় কে পি পি-র ছত্রিশ জন সদস্যের চৌত্রিশ জনই শরৎ বসুর নেতৃত্বে বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে বসতে প্রস্তুত। সেই বছর অনেক বারই ভোটাভুটির সময়ে শাসক দল সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তেইশ জন ইউরোপীয় সদস্যের জোরেই কেবল সরকারের হার ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল।৩৩

সে বছরের শেষ দিকে, বাংলায় হিন্দু ও মুসলিম যুগ্ম সমর্থনে ব্যাপকতর একটি কোআলিশন তৈরির জন্য বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের একান্ত প্রয়োজন ছিল— একটি বারের জন্য গাঁধীর মুখ থেকে সবুজ সংকেত। তাই ১৯৩৮-এর ১৮ ডিসেম্বরে সুভাষকে লেখা গাঁধীর চিঠিটি যখন এসে পৌঁছল, প্রায় একটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটল। গাঁধী এই চিঠি লিখেছিলেন বিড়লা, নলিনীরঞ্জন এবং আবুল কালাম আজাদের উপস্থিতিতে। ওয়ার্ধা থেকে বিড়লাই চিঠিটি কলকাতায় নিয়ে এলেন। গাঁধীর বক্তব্য: “মন্ত্রিসভায় কংগ্রেস যদি অংশগ্রহণ করে, তবে আমাদের খুব বড় ক্ষতি।” তাঁর স্পষ্ট কথা, বাংলায় যে পরিস্থিতি চলছে, তাই যেন থাকে। সুভাষ উত্তর দিলেন, “আপনার চিঠি থেকে একটা সংকট তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে এখনই আমার খোলাখুলি কথা বলাটা অত্যন্ত জরুরি, সে জন্য আগেভাগেই আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।” ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকেও বাংলায় কোআলিশন মন্ত্রিসভার ব্যাপারে গাঁধী স্পষ্ট সমর্থন জানিয়েছিলেন। এখন যে তিনি “এই তিন ভদ্রলোকের (আজাদ, বিড়লা, নলিনী সরকার) কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, আর যাঁরা বাংলায় প্রাত্যহিক ভাবে কংগ্রেস নামক প্রতিষ্ঠানটিকে চালাচ্ছেন, তাঁদের মতের উপর এঁদের মতকে স্থান দিচ্ছেন,” এতে সুভাষ প্রবল ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। গাঁধীর কংগ্রেসের এক জন বড় সহায়ক বিড়লা— তাঁর আর্থিক অনুদান বিপুল এবং অন্যান্য প্রতিপত্তিও প্রবল। গাঁধীর চিঠির উত্তরে সুভাষ লিখলেন, “এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগে আপনি যে আমার সঙ্গে এক বার আলোচনা করার প্রয়োজনও অনুভব করলেন না, এটা আমায় আশ্চর্য করেছে।” বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে গাঁধীকে অনুরোধ জানালেন তিনি, বললেন যে বাংলার পক্ষে এমন একটি “আত্মঘাতী” নীতি তিনি কিছুতেই সমর্থন করতে পারবেন না।৩৪

সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলিতে কোআলিশন মন্ত্রিসভায় যদি কংগ্রেস যোগ দেয়, তবে ব্রিটিশের সঙ্গে দর-কষাকষির লড়াইয়ে কংগ্রেসের অবস্থানই আরও শক্তপোক্ত হবে। গাঁধীকে তিনি লিখে জানিয়েছিলেন ঠিক কোন পথে এগোনো উচিত বলে তিনি মনে করছেন:

অবশিষ্ট তিনটি প্রদেশে কোআলিশন মন্ত্রিসভা তৈরির দিকে এগোতে হলে আর সময় নষ্ট না করে আমাদের জানানো দরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের আলোচনায় যে সব হিন্দু-মুসলিম সমস্যা উঠে এসেছে, সেগুলি বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত ঠিক কী। এর পাশাপাশি, কংগ্রেস-চালিত সরকারগুলির বিরুদ্ধে মুসলিমদের কী কী ক্ষোভ, সে বিষয়েও আমাদের একটা তদন্ত করা দরকার। যে সব মুসলিমরা যুক্তিপরায়ণ, এই দুটি পদক্ষেপ তাঁদের সন্তুষ্ট করবে, বোঝাবে যে তাঁদের অভিযোগ আমরা বুঝতে পারছি, কোনও মানুষের পক্ষে যতটা প্রতিকার সম্ভব, আমরা তার চেষ্টা করছি।৩৫

হিন্দুপ্রধান প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি তৈরির প্রস্তাবে পার্টির নিশ্চিন্ত সুবিধাভোগী দক্ষিণপন্থীরা একেবারে বেঁকে বসলেন। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ভাষাগত সম্প্রদায়ের যে জটিল সম্পর্ক, সুভাষচন্দ্র যে ভাবে তার বিচার-বিবেচনা করতেন, তার সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের অধিকাংশের ভাবনারই কোনও সাদৃশ্য ছিল না, এ বিষয়ে সুভাষের নীতির ঔদার্যের সঙ্গেও বাকিদের মিল ছিল না।

ইউরোপে নির্বাসনকাল থেকে সুভাষ আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিতে যে গভীর ঔত্সুক্য বোধ করতেন, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনও তার ব্যত্যয় ঘটল না। আক্রমণাত্মক জাপানের চিনের দুরবস্থার প্রতি প্রতীকী সহমর্মিতা জানাতে তিনি চিনে একটি কংগ্রেস মেডিক্যাল মিশন পাঠালেন। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরির লক্ষ্যে ইউরোপে নানা সাংস্কৃতিক দল পাঠাতে শুরু করলেন, তার মধ্যে উদয়শংকর-অমলাশংকরের নাচের দলও ছিল। ‘থার্ড রাইখ’ তখন নানা দেশে তাদের সদস্যদের ক্ষমতা বিস্তার করছে— আর সুভাষ মনোযোগী নজর রাখছেন কী কী ঘটছে ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে। ১৯৩৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় ফরাসি ও ব্রিটিশ বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র প্রতিবাদ করলেন। সে বছরের নভেম্বরে তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক-এর মৃত্যু হলে সুভাষ আধুনিক তুরস্কের পিতৃপ্রতিম মানুষটির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন, “স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করে, যারা তা অর্জন করে, যুদ্ধ শেষ হলে দেশগঠনের কাজটিও তাদেরই হাতে নেওয়া উচিত— এই কথাটির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ” কামাল আতাতুর্ক।৩৬ বছর শেষ হয়ে আসতে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, ভারতে আর একটি ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলন শুরু হওয়ার পক্ষে আদর্শ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এখন। ইউরোপের উত্তপ্ত পরিস্থিতির অভিঘাতে ব্রিটেনের অবস্থা রীতিমত সঙ্গিন, ফলে সুভাষের মতে— স্বাধীনতার লক্ষ্যে ভারতের আবার ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এই তো প্রকৃষ্ট সময়।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রবল কাজকর্মের মধ্যেও ১৯৩৮ সালে সুভাষকে বেশ স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, মানসিক ভাবে প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। বছরের মাঝে ওয়ার্ধায় মহাত্মার মনে হয়েছিল, “সুভাষ যেন সাক্ষাৎ সুস্বাস্থ্যের প্রতিমূর্তি”। “ওর দরকার একেবারে নিজের মনের মতো কাজ,” গাঁধী লেখেন। “ও তা পেয়েছে। তাই ও খুশি।”৩৭ সুভাষের তখনকার অবস্থা বিষয়ে এই বক্তব্য সত্যি, কিন্তু অংশত সত্যি। মধ্য-বিশের দশকে তাঁর স্বাস্থ্যের যা দশা ছিল, তার চেয়ে তিনি নিঃসন্দেহে এখন অনেক ভাল, যদিও মাঝে এক বার ইনফ্লুয়েঞ্জা, আর এক বার অক্টোবরে ম্যালেরিয়ায় কাবু হন তিনি। মার্চে সীতা ধর্মবীর যাতে তাঁর পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে করতে পারেন, তার জন্য সীতার হয়ে তাঁর বাবা-মার কাছে ওকালতি করে আসেন।৩৮ তাঁর নিজের ভালবাসার জীবন অবশ্য সেই অস্ট্রিয়ার নির্বাসন-প্রহর থেকেই পিছনে পড়ে রয়েছে। কখনও কখনও উদাসী থাকেন সুভাষ, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে ট্রেনের মধ্যেই এমিলিকে নিয়মিত চিঠি লেখেন। অনেকগুলি চিঠিতে লেখা হয় একই কথা: দিন রাত কী ভাবে তার কথা ভাবেন তিনি। তাঁর “লিবলিং”-এর জন্য আরও যে গভীর ব্যক্তিগত সম্বোধন, আদরের কথা, সেগুলি লেখা হয় জার্মান ভাষায়, ইংরিজি চিঠির ফাঁকে গুঁজে রাখা হয় সেই বাক্যগুলি। ১৭ অক্টোবর, ১৯৩৮— ওয়ার্ধা থেকে লিখলেন, “দিন-রাত কাজ করে গেলেও” “সব সময় ভীষণ একা লাগে”। ২৬ ডিসেম্বর বম্বেতে থেকেও বাডগাস্টাইন ভুলতে পারলেন না। এমিলিকে লিখলেন, “আজ তোমার জন্মদিন, দুনিয়ার সব শুভকামনা তোমার জন্য জমা রইল, প্রার্থনা রইল মানুষের সেবায় যেন তুমি সুখ আর শান্তি খুঁজে পাও— তোমার মনের সব ইচ্ছা যেন পূর্ণ হয়।”৩৯

ভারতের জাতীয় সংগ্রামের পুরোভাগে সে দিন দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্র; এমিলি আর এমিলির জন্য তাঁর হৃদয়ের ভালবাসা পড়ে আছে নেপথ্যে, পশ্চাত্পটে। কোনটা কতটা জরুরি, কোনটার জায়গা কোথায়, এ নিয়ে মানুষটির মনে দ্বিধা ছিল না কোনও। সব কিছুর আগে ভারতের স্বাধীনতা। একমাত্র তার পরেই নিজের যা কিছু আবেগ-অনুভূতির জায়গা হতে পারে। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে এমিলিকে লিখলেন সুভাষ, তাঁর অনুমান, সামনে বড় ধরনের একটা রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসছে।

পথ এ বার আলাদা

১৯৩৮-এর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সুভাষ যুক্তপ্রদেশ, পঞ্জাব ও সিন্ধুতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। “পরের বছর আবার আমার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম,” করাচি থেকে কলকাতা আসার পথে যোধপুরে একটি রাত্রিযাপনের অবকাশে এমিলিকে লিখলেন, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৮-এ। “অনেক লোকই দেখছি আমার প্রতি বেশ ঈর্ষাপরায়ণ।”৪০ ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ছাড়াও, তাঁর রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি— আপসহীন সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা এবং স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠনের সমাজতান্ত্রিক পথ— গাঁধী এবং ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশেরই না-পসন্দ্ ছিল। বল্লভভাই প্যাটেলের অনুসরণে তাঁরা সুভাষকে বড্ড বেশি রকম আক্রমণাত্মক, উদ্ধত বলে মনে করতেন। ১৯৩৫-এ চুক্তির যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটি সম্পূর্ণত বর্জনের বিষয়ে তিনি অত্যন্ত অনমনীয় ছিলেন, ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় আসার প্রশ্নে একেবারে তীব্র ভাবে নারাজ ছিলেন। স্বভাবতই, দ্বিতীয় বার তাঁর কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাবে কংগ্রেস দক্ষিণপন্থীরা প্রবল বেঁকে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাঁধী ও নেহরুকে চিঠি লিখলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে পুনর্নির্বাচিত করার সুপারিশ জানিয়ে। তাঁর মনে হয়েছিল, কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে দুই জনকেই মাত্র “আধুনিকতাবাদী” বলা যায়: জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র। জওহরলাল যেহেতু ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান, তিনি সুভাষকেই আরও এক বার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদে আসীন দেখতে চান।৪১ রাজনীতিতে কবির এমন নাক-গলানো একেবারে পছন্দ করলেন না গাঁধী, এবং তাঁর সুপারিশ অগ্রাহ্য করাই স্থির করলেন।

প্রধান নেতাদের চোখে সে দিন আবুল কালাম আজাদই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম পছন্দ, তবে আজাদ কিন্তু অন্তরালেই থাকার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিলেন। সুভাষের বিরুদ্ধে মঞ্চে অবতীর্ণ হতে তিনি অনিচ্ছুক হওয়ায়, গাঁধীর সঙ্গে আলোচনা করে ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যেকার একটি ছোট গোষ্ঠী হাইকম্যান্ডের আর এক সদস্য অন্ধ্রের পট্টভি সীতারামাইয়াকে তাঁদের প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে দিলেন। সুভাষচন্দ্র সমানেই বলতে লাগলেন কোনও বামপন্থীর কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত, যেমন আচার্য নরেন্দ্র দেব। কিন্তু যে হেতু কোনও সর্বজনসম্মত নাম তিনি খুঁজে পেলেন না, নির্বাচনে নিজে দাঁড়াতেই মনস্থ করলেন। সেপ্টেম্বরে এআইসিসি বৈঠক থেকে সমাজবাদীরা বেরিয়ে গেলেন, তবে সেই সময়ে দেখা গেল সুভাষের নিরপেক্ষতায় গাঁধী বেশ তুষ্ট। বল্লভভাই প্যাটেল বরং এ ব্যাপারে অনেক বেশি বিক্ষুব্ধ, তাঁর অভিযোগ, সুভাষ ওই সব বিশৃঙ্খল সমাজবাদীদের সমর্থক। সুভাষ এই সময়ে গাঁধীর মতের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে গিয়ে বাংলার জন্য কোআলিশন সরকার প্রস্তাব করলেন। প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন জি ডি বিড়লা, গাঁধীবাদী কংগ্রেস-এর প্রধান অর্থ-দাতা তিনি, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বেশি চরম কোনও পদক্ষেপেই তাঁর সায় নেই। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির সমাজবাদী অ্যাজেন্ডাই কংগ্রেসের এই দক্ষিণপন্থীদের চটিয়ে দিয়েছিল। প্যাটেল-এর ঘনিষ্ঠ কে এম মুন্সি গাঁধীর কাছে অভিযোগ জানালেন, সুভাষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জার্মান সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ডিসেম্বরে কিছু জার্মান ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপচারিতাকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হল জার্মান কনসালের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হিসেবে, সেখানে নাকি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছিল। ঘটনাচক্রে, সেই বিশেষ আলাপচারিতায় সুভাষচন্দ্র জার্মান নীতি নিয়ে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন বলেই জানা যায়।৪২

আরও এক বার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন কি না, ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনায় সে বিষয়ে সুভাষের কোনও হেলদোলই দেখা গেল না। ১৯৩৯ সালে ৪ জানুয়ারি লিখলেন, “আমার পুনর্নির্বাচনের বিষয়ে যদিও বেশ একটা বড় জনমত রয়েছে, মনে হয় না আমি আবার সভাপতি হব। এক দিক দিয়ে সভাপতি না হলেই ভাল। অনেক স্বাধীন থাকা যাবে তা হলে, নিজের জন্য সময় পাওয়া যাবে।”৪৩ ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, কলকাতায় কোনও জনসভা আয়োজন করে সুভাষকে সেখানে সম্মানজ্ঞাপনের জন্য। শীতের মেলার হইচই কেটে যাওয়ার পর শান্ত কোনও সময়ে সুভাষ শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলে ভারী খুশি হলেন তিনি।৪৪ ১৯২০ থেকে সুভাষ এক অভাবনীয় কাণ্ড করে যাচ্ছেন: কংগ্রেসের কাজকর্মে গাঁধীর প্রশ্নাতীত ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এতে আদৌ বিচলিত নন। ১৯৩৯ সালের ২১ জানুয়ারি কংগ্রেসের এই বিপ্লবী সভাপতিকে তাঁর শান্তির নিকেতনে আম্রকুঞ্জে বরণ করলেন। তাঁর স্বাগত বক্তব্যের উত্তরে সুভাষ বললেন, “আমরা যারা রাষ্ট্রীয় জীবনে বেশি শক্তি ও সময় ব্যয় করি, আমরা মর্মে মর্মে আমাদের অন্তরের দৈন্য অনুভব করি। প্রাণের দিক দিয়ে যে সম্পদ না পেলে মানুষ বা জাতি বড় হতে পারে না, সেই সম্পদ, সেই প্রেরণা আমরা চাই। আপনার কাছ থেকে সে প্রেরণা আমরা চাই।”৪৫ পরের দেড় বছরে সুভাষের নানা ওঠাপড়ার মধ্যেও তাঁর অন্যতম দৃঢ় সমর্থক রয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। কংগ্রেস রাজনীতি থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্রমিক আশ্রয়ে এই সাময়িক মুক্তি সুভাষকে আরাম দিল, নন্দলাল বসুর শিল্পকলার ছাত্রদের সঙ্গে প্রফুল্লমনে আলাপ করতে গেলেন তিনি।

জানুয়ারির শেষ নাগাদ সভাপতি নির্বাচন বিতর্ক বেশ কদর্য হয়ে উঠল। প্যাটেল তাঁর তিন বছরের ওয়ার্কিং কমিটির সহকর্মী শরৎচন্দ্র বসুকে তারযোগে জানালেন, তাঁর ভাই-এর পুনর্নিবার্চিত হওয়ার কোনও কারণ নেই, এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা সীতারামাইয়ার সমর্থনে একটি প্রস্তাব প্রকাশ করতে চলেছেন। শরতের উত্তর, ওয়ার্কিং কমিটির সহকর্মীদের কোনও পক্ষ না নেওয়াই উচিত। তিনি এও বললেন, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে আগামী দিনের সংগ্রামে সীতারামাইয়া যথেষ্ট প্রত্যয় জোগানোর মতো প্রার্থী নন। বসু ভ্রাতৃদ্বয়কে অত্যন্ত ব্যথিত করে প্যাটেল-এর প্রত্যুত্তর, “সুভাষের পুনর্নির্বাচন দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।” নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রেস স্টেটমেন্ট এবং পাল্টা স্টেটমেন্টের মূল বক্তব্য দাঁড়াল দুটি: দেশীয় রাজন্যদের সঙ্গে ফেডারেশন তৈরির ব্রিটিশ প্রস্তাব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া কী, এবং কংগ্রেসের মধ্যে আন্তর্দলীয় গণতন্ত্রের বিষয়ে কী মত। সুভাষ যখন বললেন, “ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেস দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে ফেডারেল প্রস্তাব বিষয়ে একটা বোঝাপড়ার সম্ভাবনা” দেখছেন তিনি, সেই উক্তির মধ্যে বহু-আলোচিত বাস্তবতা থাকলেও অভিযোগ উঠল, সুভাষ তাঁর সহকর্মীদের বিষয়ে “কুত্সা” রটাচ্ছেন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশের সংশোধিত বয়ান মেনে নেওয়ার বিষয়ে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তি ও প্যাটেলের ঘনিষ্ঠ কিছু কংগ্রেসি নেতার মধ্যে যে তলে তলে কথাবার্তা চলছে , তাঁর এই সন্দেহ কিন্তু সঙ্গত। কংগ্রেসি দক্ষিণপন্থীদের অতি ঘনিষ্ঠ শিল্প-কুবের জি ডি বিড়লার ইঙ্গিত— এমন বোঝাপড়া খুবই সম্ভব। কিন্তু সুভাষ যেহেতু অভিযোগের সপক্ষে যথেষ্ট শক্তপোক্ত প্রমাণ জোগাড় করতে পারলেন না, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও “কুত্সা রটানোর” অভিযোগটি রয়েই গেল। সুভাষ দাবি করলেন, প্যাটেল চান কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট যেন ওয়ার্কিং কমিটির হাতের পুতুলমাত্র হয়ে থাকেন। আন্তর্দলীয় গণতন্ত্র বিষয়ে তাঁর মত: “কংগ্রেস ডেলিগেটদের যথাযথ ভাবে নির্বাচন করে আনতে হবে, ওয়ার্কিং কমিটির ভিতরের কোনও গোষ্ঠীর পছন্দের লোকজন ঢোকালে চলবে না।” “ডেলিগেটদের মুক্ত অবাধ পথ নির্বাচনের অবকাশ দিতে হবে।” এই স্বাধীনতা যদি তাঁদের না দেওয়া যায়, তবে “কংগ্রেস সংবিধানের গণতান্ত্রিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই,” সতর্ক করলেন তিনি।৪৬

অভূতপূর্ব নির্বাচনী প্রতিযোগিতার পর প্রদেশের ডেলিগেটদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত জানা গেল ১৯৩৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। শরতের বড় পুত্রের বিবাহসভায় সুভাষ তখন আরাম করে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, এবং দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে টুকরো টুকরো ফলাফলের খবর ভেসে আসায় ঘটনার গতি সম্পর্কে পূর্বাভাস করছেন। ফল যখন স্পষ্টতর হতে শুরু করল, ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতে ঢুকে গেলেন তিনি। যাঁরা দেখা করতে এসেছেন, যাঁরা টেলিফোন করছেন, সবাইকে “আমি জিতছি”-র বদলে বললেন, “আমরা জিতছি”।৪৭ সম্পূর্ণ ফল বার হলে দেখা গেল সুভাষচন্দ্র জয়ী, তাঁর নামে ১৫৮০টি ভোট, পট্টভি সীতারামাইয়ার নামে ১৩৭৫টি। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, বাংলার প্রায় সব ভোটই সুভাষের পক্ষে, এবং গুজরাত ও অন্ধ্র সীতারামাইয়ার পক্ষে। অন্যান্য বড় প্রদেশগুলির মধ্যে সুভাষ জিতে নিয়েছেন উত্তরে যুক্তপ্রদেশ, পঞ্জাব, অসম, এবং দক্ষিণে কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ু।৪৮ যে ভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভোট এসেছে, সেটা রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। সুভাষ-শরতের হেডকোয়ার্টার্স ভেসে যেতে শুরু করেছে সারা দেশের অভিনন্দনবার্তায়।৪৯ দুই দশকের মধ্যে এই প্রথম বার, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে গাঁধীর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে সফল ভাবে।

মহাত্মা এই অঘটনে অপ্রসন্ন। “ড. পট্টভি যাতে প্রার্থী হিসেবে নাম প্রত্যাহার না করেন সেটা নিশ্চিত করেছিলেন” তিনিই, আর তাই ৩১ জানুয়ারি তিনি স্বীকার করলেন, “তাঁর পরাজয়ের চেয়ে এতে আমার পরাজয়ই বেশি।” তাঁর কাছে স্পষ্ট, তাঁর প্রস্তাবিত “আদর্শ বা নীতি সমর্থন করেননি” ডেলিগেটরা। তাঁর উচ্চারণ, “এই পরাজয়ে আমি আনন্দ অনুভব করছি।” আর তার পরই, চরিত্রবিরোধী ভাবে বেশ বিরক্তি-সহকারে মন্তব্য: “আর যা-ই হোক, সুভাষবাবু তো তাঁর দেশের শত্রু নন। দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি।” ৪ ফেব্রুয়ারি সুভাষ তাঁর প্রকাশ্য উত্তর জানালেন, বললেন মহাত্মা গাঁধী যে এই নির্বাচনের ফলাফলকে “ব্যক্তিগত পরাজয়” হিসেবে নিয়েছেন, এতে তিনি খুবই ব্যথিত। তিনি অবশ্য এ বিষয়ে “শ্রদ্ধাসহকারে দ্বিমত পোষণ” করেন। কখনও কখনও কিছু বিষয়ে গাঁধীর সঙ্গে তিনি একমত না হতে পারলেও মহাত্মার প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা, তা “কোনওমতেই আর কারও চেয়ে কম নয়”। তাঁর প্রতিশ্রুতি, “আমার সর্বক্ষণের আদর্শ ও উদ্দেশ্য— তাঁর আস্থা অর্জনের চেষ্টা। কারণ খুব সহজ, যদি অন্য সকলের আস্থা লাভ করেও আমি ভারতের মহত্তম মানুষটির আস্থা না অর্জন করতে পারি, তা হলে আমার পক্ষেই সেটা দুর্ভাগ্যজনক।”৫০

এত বড় একটা স্বতঃস্ফূর্ত, খেলোয়াড়োচিত প্রতিযোগিতার পর এই সব সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে গিয়ে হাত মিলিয়ে চলতেই চাইছিলেন সুভাষ। নির্বাচনী লড়াই-এর আঁচে এত সব বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, আজ কিন্তু সেগুলি পিছনে ফেলে গাঁধীর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া সম্ভব বলেই মনে করছিলেন তিনি। গাঁধী তো আর গাঁধীর সাঙ্গোপাঙ্গদের মতো নন, সুভাষ ভাবতেন। মহাত্মার মেজাজ বিষয়ে এম এন রায়ের উপলব্ধি বরং অনেক বেশি যথার্থ ছিল, সুভাষকে তিনি লেখেন যে গাঁধীর বক্তব্য দেখে এ বার তাঁর মনে হয়েছে, “গাঁধীর নিজস্ব ধরন অর্থাৎ অসহযোগের মাধ্যমেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে— কংগ্রেসের ভেতরকার অবস্থা বিচার করলে যে যুদ্ধের একটাই অর্থ, আপনাকে এবং আপনার সমর্থকদের নিশ্চিত ভাবে বিনাশ করার প্রয়াস।” কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় স্তরে যে সুভাষ এবং সুভাষের বিরোধীদের একই সঙ্গে স্থান হতে পারে না, পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন গাঁধী। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মনে হয়েছিল, “এই অযৌক্তিক আচরণের একটাই সহজ যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত”, গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ঐক্য অটুট রাখার যে মহৎ লক্ষ্য, তার জন্যে সুভাষকে আত্মত্যাগে বাধ্য করা।৫১

“আমার জয়ের খবরে আনন্দ পেয়েছ তুমি?” ১৯৩৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এমিলির কাছে জানতে চাইলেন সুভাষ। গাঁধী ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা সুভাষের “বিরোধিতা” করছেন, আর নেহরু আগাগোড়া “উদাসীন” থেকেছেন। “নির্বাচনের ফল আমার কাছে একটা বিরাট বিজয়সংবাদ,” লিখছেন সুভাষ। “গোটা দেশ এই নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনায় ভরপুর, কিন্তু আমার কাঁধে এসে পড়েছে একটা ভয়ানক দায়িত্ব।” কতখানি কাঁধ দিয়ে এই দায়িত্ব সামলাবেন, সেই সিদ্ধান্তই নিতে হবে তাঁকে অনেক ভাবনাচিন্তা করে। কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যাক— এটা কখনওই তাঁর কাম্য নয়, সম্ভব হলে তিনি এই ঘটনা যাতে না ঘটে সেটাই চান, গাঁধীর সমর্থন ছাড়া এগোতেও তিনি অনিচ্ছুক। সাধারণত যিনি যথেষ্ট দৃঢ় ভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত, নিজের পথ বেছে নিতে সিদ্ধহস্ত, এখন তাঁর মধ্যেই দেখা গেল প্রবল দ্বিধা: “কী করা উচিত জানি না,” লিখলেন এমিলিকে, “বলো না, কী করা উচিত।”৫২

গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে ওয়ার্ধা রওনা হলেন তিনি। মুখোমুখি কথা বললে ধোঁয়া কাটবে এমন একটা আশা নিয়ে। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের যে কথা হল, তাতে জট কাটার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। পরের দিন ট্রেনে কলকাতা ফেরার পথে প্রবল জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ২২ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা, সুভাষ তারিখটা একটু পিছোনোর আর্জি জানাতে বল্লভভাই প্যাটেল-এর নেতৃত্বে সব সদস্য (জওহরলাল নেহরু ও শরৎচন্দ্র বসু বাদে) পদত্যাগ করলেন। জওহরলাল আলাদা ভাবে একটি বক্তব্য পেশ করলেন, বেশ ধোঁয়াটে, যাতে অনেকেরই মনে হল তিনিও যেন প্যাটেল-এর সঙ্গে যোগ দিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি ছাড়ছেন। যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত: এক দিকে নির্বাচিত সভাপতি, অন্য দিকে গাঁধী— এই ক’দিন আগেও যিনি ছিলেন পার্টির প্রাণস্বরূপ— এঁদের মধ্যে কে নতুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করবেন তা স্থির হবে এ বার।

দুই ফুসফুসে নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র তবু ডাক্তারদের কথা অমান্য করে সেন্ট্রাল প্রভিন্স-এর ত্রিপুরীতে কংগ্রেসের বার্ষিক বৈঠকে যোগ দিতে চললেন। কলকাতা থেকে জব্বলপুর গেলেন ট্রেনে, ৬ মার্চ সেখানে স্ট্রেচারে করে তাঁকে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হল, সে ভাবেই পৌঁছলেন কংগ্রেস বৈঠকের অকুস্থলে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তীব্র শ্লেষভরে গুজব ছড়ানো শুরু করলেন যে সুভাষ অসুস্থতার ভান করছেন, এতই জোরদার সে গুজব যে ত্রিপুরীর ডাক্তাররাও তাঁকে সত্যিই অসুস্থ দেখে বিস্মিত হয়ে পড়লেন।৫৩ ১০৩ ডিগ্রির বেশি জ্বর নিয়ে সুভাষ মিশর থেকে আসা এক প্রতিনিধি-দলকে স্বাগত জানাতে পারলেন, সাবজেক্টস কমিটির মিটিং-এ সভাপতিত্বও করলেন। সভাপতির ভাষণ দেওয়ার অবস্থা ছিল না, তাই শরৎ সে ভাষণ পড়ে দিলেন। হরিপুরার ভাষণের থেকে সে ভাষণ আকারে অনেকটাই সংক্ষিপ্ত।

ত্রিপুরীর সেই ভাষণে সুভাষ কংগ্রেসের উদ্দেশে আহ্বান জানালেন— ভারতের জাতীয় দাবিগুলিকে একটি চরমপত্রের আকারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করা হোক এবং কোনও সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়া না মিললে বড় আকারে গণ আইন-অমান্য আন্দোলন শুরু করা হোক। ছয় মাসের মধ্যে ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হবে বলে তাঁর ধারণা। কংগ্রেসের উচিত, দেশীয় রাজ্যগুলিতেও “টুকরো টুকরো ভাবে” পদক্ষেপ না করে বরং “ব্যাপক ও সংহত আকারে” জন-আন্দোলন তৈরি করা। ত্রিপুরীর কংগ্রেস বৈঠকে গাঁধী আসেননি, পশ্চিম ভারতের একটি ছোট্ট রাজ্য রাজকোটের রাজনীতি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত করে রেখেছিলেন। সেখানকার নাগরিক স্বাধীনতার দাবিতে রাজগোষ্ঠীর ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি এমনকী অনশনও শুরু করে দিয়েছিলেন। সেখানকার শাসক এবং সংখ্যালঘুদের প্রবল বিরোধিতার মধ্যেই তিনি ব্রিটিশ ভাইসরয় লিনলিথগোকে অনুরোধ জানালেন সেখানে কোনও ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসনের সূচনা করতে। বল্লভভাই-এর সমর্থকরা যখন ক্ষমতার লড়াই-এ অবতীর্ণ, সেই সময়ে ছোট্ট একটি সামন্ততান্ত্রিক রাজ্য নিয়ে গাঁধীর এতখানি মনোযোগ দেখে দুঃখপ্রকাশ করলেন সুভাষ। তাঁর মতে, এই যে ছোট ছোট ৫৬৫টি রাজ্য ব্রিটিশ রাজের অধীনতা স্বীকার করে অস্তিত্বশীল, এদের সর্বত্র একই সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রচলন জরুরি। দ্বিধাহীন ভাবে তাঁর বিশ্বাস, এখন দরকার “দেশের সব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ, বিশেষত কিষাণ আন্দোলন এবং শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনগুলির সঙ্গে।”৫৪

সভাপতি নির্বাচনে হার মানতে হয়েছে, এ বার ত্রিপুরীতে হিসেব কষে সেই হারের যোগ্য জবাব দিল কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী। প্রস্তাব আনল তারা— যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ সে প্রস্তাব পেশ করলেন— “কংগ্রেসের এক্সিকিউটিভদের গাঁধীর প্রচ্ছন্ন আস্থা থাকতে হবে, সভাপতিকে তাঁরা অনুরোধ জানাবেন গাঁধীর ইচ্ছানুসারে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মনোনয়ন করতে।” কংগ্রেসের যে বামপন্থী গোষ্ঠীগুলি, যেমন এম এন রায়ের র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং “ন্যাশনাল ফ্রন্ট” উপাধিধারী কমিউনিস্টরা— সকলেই এই পন্থ প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি অবশ্য কোনও পক্ষেই যোগ দিল না। সুতরাং প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। ফল দাঁড়াল, গাঁধীর মতামতের কাছে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বাঁধা পড়ে গেলেন, যদি অবশ্য গাঁধী আদৌ কোনও মতামত দেন। এই বিশেষ প্রস্তাব পাশের ঘটনাটি ছাড়াও, এমনই তীব্র প্রতিহিংসার হাওয়া ছড়িয়ে ছিল ত্রিপুরীতে চতুর্দিকে যে সুভাষ শেষ পর্যন্ত “রাজনীতির প্রতি একরাশ ঘৃণা ও বিরক্তি” নিয়ে সেই জায়গা ছাড়লেন।৫৫

ত্রিপুরী থেকে স্বাস্থ্যোদ্ধারের লক্ষ্যে সুভাষ গেলেন বিহারে ধানবাদের কাছে জামাডোবা বলে এক জায়গায়। ১৯৩৯ সালে ২৯ মার্চ মহাত্মাকে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ “কংগ্রেসের বিগত অধিবেশনে কিছু মানুষের রূঢ়তা আর অভব্য জেদ আহত করেছে বাংলাকে। অনুগ্রহ করে অবিলম্বে আপনার সদয় হাতে সেই ক্ষতে প্রলেপ লেপন করুন, একে বাঁচান তিক্ততার হাত থেকে।” গাঁধীর উত্তর: কবি খুবই কঠিন একটি সমস্যার কথা তুলেছেন।৫৬ এই সময়ে তিনি দিল্লিতে বিড়লার বাড়িতে থাকছেন, ভীষণ ভাবে রাজকোট সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছেন। “আমার প্রস্তাব, তুমি এখানে এসে আমার সঙ্গে থাকো। তোমার স্বাস্থ্যের যত্নও হবে, ধীরেসুস্থে আলোচনাও হবে।” সুভাষ বিড়লার বাড়ি থাকতে রাজি হলেন না, আর এমনিতেও গাঁধী ক’দিন পরেই রাজকোট রওনা হয়ে গেলেন। ১৯৩৯-এর মার্চের শেষে ও এপ্রিলের গোড়ায় চিঠিপত্রের মাধ্যমে নতুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তৈরির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনার কাজটা শুরু হল। সুভাষ তাঁকে লিখলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি ঠিক প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ নই, মনের মধ্যে ক্ষোভ পুষে রাখতে পারি না। এক অর্থে আমার মানসিকতাটা কুস্তিগীরের মতো— অর্থাৎ খেলা শেষ হলেই হাসিমুখে হাত মিলিয়ে নেওয়া, আর যা-ই ফল হোক না কেন, সেটাকে খেলার স্পিরিটেই গ্রহণ করা।” মহাত্মা যে ভাবে হোক স্বরাজ-এর লক্ষ্যে আবার লড়াই শুরু করুন, এটাই তাঁর চাওয়া। রাজকোট নিয়ে যদি তিনি ব্রিটিশ রাজকে চরমপত্র দিতে পারেন, তবে ভারতের জাতীয় দাবিটি নিয়ে তিনি সেই একই কাজ কেন করতে পারবেন না? সুভাষের মত, দেশে এতখানি অহিংসার আবহাওয়া আগে কখনও দেখা যায়নি। গাঁধী তাঁর সঙ্গে দ্বিমত। তিনি “হাওয়ায় হিংসার গন্ধ পান”। স্বীকার করলেন, সুভাষের যেমন “যৌবনের বাঁধভাঙা আশাবাদ”, তিনি এখন “বৃদ্ধ হয়েছেন, হয়তো আগের চেয়ে ভীতু এবং বেশি সাবধানীও হয়েছেন।” তবে তাঁর বিশ্বাস, কংগ্রেস “সত্যিকারের আইন অমান্য শুরু করার মতো অবস্থায় নেই।” সুভাষের বক্তব্য যদি ঠিক হয়, দেশ যদি একটি নতুন আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়েও থাকে, গাঁধীর মনে হয় তিনি নিজে এখন “অপ্রস্তুত, সত্যাগ্রহের সেনাপতি হিসেবে অকেজো হয়ে যাওয়া” নেতা।৫৭

সুভাষ কিন্তু দমতে রাজি নন। গাঁধী যেমন ইতিমধ্যেই শরতের কাছে প্রস্তাব করেছেন, সেই পথে দলের দুই অংশের নেতাদের মধ্যে এ রকম “সোজাসুজি আলাপচারিতা” চালানোটাই তাঁর কাছে “দারুণ আশাপ্রদ ব্যাপার” বলে মনে হল। সুভাষের মনে হল, তাঁদের মতৈক্যের পরিমাণ মতানৈক্যের পরিমাণের থেকে বেশি। তা ছাড়া, গাঁধীর কাছে তিনি আরও একটা প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, “আপনার আর আপনার সমর্থকদের মধ্যে, এমনকী আপনার নিজের হাতে নির্বাচন করা সমর্থকদের মধ্যেও বিরাট বড় পার্থক্য রয়েছে। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা আপনার জন্য সব কিছু করতে রাজি আছেন— কিন্তু তাঁদের জন্য নয়।” সরল ভাবে যোগ করলেন, “আপনার আর আমার মধ্যে কিন্তু কোনও ঝগড়া নেই।” গাঁধী যে লিখেছিলেন, যা-ই হোক, তাঁদের “ব্যক্তিগত সম্পর্কে চিড় ধরবে না”, এতে সুভাষ সত্যিই খুশি হয়েছিলেন। দেশবন্ধুর সেই কথাটিতে বিশ্বাস করতেন সুভাষ: “রাজনীতির চেয়ে জীবন অনেক বড়।”৫৮

রাজনীতির ক্ষেত্রে, সুভাষের পছন্দ— জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নানা ধারা থেকে প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি “মিশ্র” ক্যাবিনেট গঠন। গাঁধী তাঁকে বলে যাচ্ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের থেকেই প্রতিনিধি নিয়ে “সমসত্ত্ব” (homogeneous) ক্যাবিনেট তৈরির কথা। অসহযোগের এক মোক্ষম চাল দিলেন তিনি: ওয়ার্কিং কমিটির জন্য নিজে কারও নাম প্রস্তাব করতে চাইলেন না, সুভাষকেই নিজের এক্সিকিউটিভ কমিটি তৈরি করতে বললেন। সুভাষ স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে এই কাজে “গাঁধীর ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে” তিনি রাজি কিন্তু, পন্থ প্রস্তাবের দাবি অনুসারে, গাঁধীর “সম্পূর্ণ ভরসা” যাঁদের উপর, কেবল তাঁদের নিয়েই এক্সিকিউটিভ তৈরি করার নির্দেশ আছে। “যতই আমি এটা (পন্থ প্রস্তাব) পড়ছি, ততই খারাপ লাগছে,” গাঁধী বললেন, বানিয়ে বানিয়ে। সুভাষের যদিও ইচ্ছে ছিল, দলের দুই অংশের থেকে অর্ধেক অর্ধেক সদস্য নেওয়া হোক, সংকট মেটানোর জন্যে এপ্রিলের মাঝামাঝির মধ্যে তিনি গাঁধীকেই সম্পূর্ণ ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতে দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। গাঁধী যদি তাতে রাজি না হন, তবে কি সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিই ওয়ার্কিং কমিটিকে নির্বাচিত করবে, ভাবতে শুরু করলেন তিনি।৫৯ কংগ্রেসের মধ্যে আর একটু বেশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাকে যে সেই সংকট-মুহূর্তে গাঁধীর অনুচররা সাড়া দেবেন না, সেটা নিশ্চিতই ছিল। কোনও নির্বাচন তাঁদের নিজেদের অবস্থানের গুরুত্ব খাটো করে দেবে, তা কি হতে দেওয়া যায়!

মহাত্মার প্রতি যথাসাধ্য সম্মান দেখিয়েও যোদ্ধা এ বার হাতে তুলে নিলেন তাঁর কলম। তাঁর বামপন্থী সুহৃদ্ জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে সেই কলম তরবারির মতো চালনা শুরু করলেন তিনি। ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ সুভাষ তাঁর বন্ধুকে “নিষ্ঠুর রকম স্পষ্ট” ভাষায় একটি চিঠি দিলেন, ছোট ছোট টাইপ-অক্ষরে সাতাশ পাতা জুড়ে কঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন। বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই নেহরুকে তিনি “অসম্ভব শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন, সামনাসামনি তো বটেই, আড়ালেও,” “রাজনীতি ক্ষেত্রে তাঁকে বড় ভাই ও নেতার” জায়গা দিতেন, বহু বিষয়েই তাঁর উপদেশ চাইতেন। অথচ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যখন কলুষতা শুরু হল, “শুরু হল প্রতিহিংসার খেলা”, “বড় ভাই” কিন্তু তখন শত্রুপক্ষের হয়েই যোগ দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। এই সংকটকালের গোটা সময়টা জুড়েই জওহরলাল মধ্যস্থের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেন, বল্লভভাই-এর নেতৃত্বে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নানাবিধ ফন্দিফিকিরের থেকে অন্তত কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করেই চলেন। সুভাষের তীব্র ভর্ত্সনা ধাবিত হল তাঁর দিকে: “যখন সংকটের সময় উপস্থিত হয়, তখন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল স্থির করতে তুমি অক্ষম, তাই মানুষ কিন্তু ভেবে নেবে তুমি দুটি ঘোড়ায় একই সঙ্গে আরোহী হতে চাইছ।” গাঁধী-সহ বিপক্ষের তাবড় নেতাদের এবং কিছু প্রাদেশিক সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে “শয়তান” নির্বাচিত হয়েছে, “এতগুলি ভোট পাওয়ার মতো” নিশ্চয়ই দু’-চারটি গুণ তার রয়েছেই, নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের কিছু সেবা সে করেছে। কংগ্রেসে বাম বনাম দক্ষিণের রাজনৈতিক তর্ক তুলে আনার জন্য নেহরু সুভাষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, তবে সেই একই তত্ত্ব-বক্তব্য অবশ্য তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনও আলোচিত হয়েছিল। সুভাষের স্পষ্ট নীতি: “ব্রিটিশ সরকারকে স্বরাজের বিষয়ে প্রবল চাপে রাখা”, জওহরলালের তেমন কোনও নীতি নেই। জওহরলাল এও বলেছিলেন যে রাজকোট ও জয়পুরের স্বৈরতন্ত্রের বিষয়টি অন্য সব সমস্যাকে পিছনে ফেলে দিতে চলেছে। সুভাষের মতে, কংগ্রেস যদি দেশীয় রাজ্যের বিষয়ে এ ভাবে “টুকরোটাকরা ঘটনার ঠুকঠাক মেরামতি নীতি” গ্রহণ করে চলে, তা হলে রাজ্যগুলির সামাজিক স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীন সরকার পেতে তাদের আড়াইশো বছর লেগে যাবে। অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে জওহরলালের এই অস্বচ্ছতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিষয়েও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বেশ “ধোঁয়াটে”, বলেন সুভাষ। “ফাঁপা আবেগ আর ভক্তি-আপ্লুত প্রশংসাবাক্য দিয়ে বৈদেশিক নীতি হয় না”, জওহরকে অবজ্ঞাভরে জানালেন তিনি। শরিকি সরকার সম্পর্কে অনমনীয় অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ আনলেন “বড় ভাই”-এর বিরুদ্ধে, আবার এ বিষয়ে বক্তব্য পেশ করার আগে এক বার অসম ঘুরে আসতে বললেন। আর “বাংলা বিষয়ে, আমার মনে হয় তুমি কিছুই জানো না,” সুভাষের মন্তব্য। কংগ্রেসের ওপরের সারির নেতা যেমন বল্লভভাই প্যাটেল ও অন্যান্যরা নেহরুর প্রতি আচরণের একটা কায়দা জানতেন: “ওঁরা তোমাকে কথা বলিয়ে যাবেন,” সুভাষের অভিযোগ, “এবং শেষ পর্যন্ত ওঁদের বক্তব্যই তোমাকে দিয়ে লিখিয়ে খসড়া তৈরি করে নেবেন।” সুভাষের কঠোর সমালোচনা এখানেও শেষ নয়, তাঁর সিদ্ধান্ত: “আমরা যে ঐক্যের দিকে এগোনো কিংবা ধরে রাখার চেষ্টা করি, সেই ঐক্য নিশ্চয়ই কাজের ঐক্য, কাজহীনতার ঐক্য নয়।”৬০ এই সংকট-মুহূর্তে জওহরলালের দোলাচল নিয়ে সুভাষ যে বড্ডই বেশি কঠোর, অতিরিক্ত তিক্ত তাঁর সমালোচনা, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে বেশ কয়েক বছর পর, তায়া জিনকিন-এর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে জওহরলাল স্বীকার করেছিলেন যে ১৯৩৯ সালে সুভাষ যা করতে চাইছিলেন, তার সঙ্গে “একমত হয়েও” তিনি “তাঁকে ডুবিয়েছিলেন”।৬১

তখনকার মতো কিন্তু, গাঁধীর প্রতি অনুরোধ-উপরোধের থেকে জওহরলালের সঙ্গে স্পষ্টকথনেই সুভাষের বেশি উপকার হল। লম্বা পত্রবাণে বিদ্ধ জওহরলাল তড়িঘড়ি ৩ এপ্রিল উত্তর দিতে বসলেন। সুভাষ তাঁর ব্যর্থতার যে তালিকা দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিশেষ কিছুই তাঁর বলার নেই। “আমি দোষ স্বীকার করছি,” তিনি লিখলেন, “বুঝতে পারছি নিজেরই কপালদোষে এত সব আমি ভুল করে থাকি।” সুভাষ যে তাঁর বিষয়ে বন্ধুবৎসল, “সেই সত্য কথাটা” তিনি উপলব্ধি করেন, নিজেকে তার জন্য কৃতজ্ঞ মনে করেন। ব্যক্তিগত ভাবে তাঁরও সুভাষের প্রতি “অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা”, যদিও কখনও কখনও তাঁর এই বয়ঃকনিষ্ঠ সহকর্মী যা যা করেন আর যে ভাবে করেন, সেগুলি তিনি পছন্দ করে উঠতে পারেন না। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ও অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রভূত চেষ্টা করলেন জওহরলাল, শেষ করলেন খানিক হতাশার সুরে: নিজে “মানুষ হিসেবে কোনও কাজের নই,” এমন মানুষ “যার নিজেকে নিয়ে, গোটা বিশ্বজগৎ নিয়ে অনেক অসন্তোষ, আবার উল্টো দিকে পৃথিবীও তাকে পছন্দ করে না বিশেষ।”৬২ সুভাষের ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে সম্ভবত তিনি নড়ে গিয়েছিলেন। এই কথোপকথনের পরই সুভাষের বিষয়টি নিয়ে গাঁধীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন তিনি। “সুভাষের অনেক ব্যর্থতা থাকতে পারে, কিন্তু বন্ধুত্বের সুরে কথা বলে তাকে সত্যিই বোঝানো যায়,” বলার চেষ্টা করলেন গাঁধীকে। স্পষ্টই বললেন— তাঁর মত, গাঁধী সুভাষকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করুন। গণতান্ত্রিক আদর্শের কথাটি মাথায় রেখে তাঁর ধারণা “সুভাষকে ঠেলে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটা হবে ভয়ানক ভুল পদক্ষেপ।” ওয়ার্কিং কমিটিতে কে কে থাকবেন সেটা গাঁধীই না হয় স্থির করুন, কিন্তু মহাত্মা যে “সমসত্ত্ব সংগঠনের ধারণাটির” বিষয়ে জোর দিচ্ছেন, “তাতে শান্তিও আসবে না, ঠিক ভাবে কাজও করা যাবে না।”৬৩

জওহরলাল দুই নৌকোয় পা দিয়ে চললেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সে দিন ঠিক করে ফেলেছিলেন কোন নৌকোটি তিনি বেছে নিতে চান। মার্চের শেষে ও এপ্রিলের গোড়ায় তিনি কলকাতায়, দেশবাসীর “মানসিক অবস্থা” মাপার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সে সময়ে। ৩ এপ্রিল তিনি সুভাষকে কিছু আন্তরিক রাজনৈতিক উপদেশ লিখে পাঠান:

সমস্ত দেশ তোমার প্রত্যাশায় আছে— এমন অনুকূল অবসর যদি দ্বিধা করে হারাও তা হলে আর কোনো দিন ফিরে পাবে না। বাংলাদেশ থেকে তুমি যে শক্তি পেতে পার, তার থেকে বঞ্চিত হবে, অন্য পক্ষও চির দিন তোমার শক্তি হরণ করতে থাকবে। এত বড়ো ভুল কিছুতেই কোরো না। তোমার জন্য বলছিনে, দেশের জন্য বলছি। মহাত্মাজি যাতে শীঘ্রই তাঁর শেষ বক্তব্য তোমাকে জানান দৃঢ় ভাবে সেই দাবি করবে। যদি তিনি গড়িমসি করেন তাহলে সেই কারণ দেখিয়ে তোমরা পদত্যাগ করতে পারবে।৬৪

১৫ এপ্রিল সুভাষ জওহরকে জানালেন যে তিনি “গাঁধীজির সঙ্গে একান্ত আলাপের মাধ্যমে বোঝাপড়ার একটা শেষ চেষ্টা করতে চলেছেন।” সাম্প্রতিক কালের সেই চিঠির ম্যারাথনে দুই জনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ সত্ত্বেও, কী ভাবে এগোবেন তা নিয়ে জওহরেরই উপদেশ চাইলেন সুভাষ। “তোমার পক্ষে কি কয়েক ঘণ্টার জন্য এখানে আসা সম্ভব?” জামাডোবা থেকে তাঁকে লিখলেন। ১৭ এপ্রিল জওহর জানালেন, “তোমাকে না বলার সাধ্য আমার নেই।” ১৯ এপ্রিল দু’জনের দেখা হতে বোঝা গেল, কোনও তিক্ততা নেই দুই তরফে। ২০ এপ্রিল সুভাষ মহাত্মাকে লিখলেন, “কাল জওহর এসেছিল, বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে দীর্ঘ কথাবার্তা হল। খুশি হলাম দেখে যে আমাদের দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি মিলল।”৬৫

গাঁধীর জেদ অবশ্য নরম হল না। রাজকোটে পরাজিত হয়ে ২৭ এপ্রিল কলকাতার কাছে সোদপুরে পৌঁছলেন মহাত্মা। সুভাষের সঙ্গে দুই দিন ধরে তাঁর সরাসরি কথোপকথন চলল। বুদ্ধি করে গাঁধী বল্লভভাইকে কলকাতায় আসতে বারণ করে দিয়েছিলেন। নেহরু প্রতি বারের মতো এ বারও শরতের ১ উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন, তিনিও যোগ দিলেন কথাবার্তায়। ওয়ার্কিং কমিটির নাম প্রস্তাব করতে গাঁধী আবারও অরাজি হলেন, সেটা করলে নাকি সুভাষের উপর “জবরদস্তি” করা হবে।৬৬ যখন বোঝা গেল কোনও বোঝাপড়ার দিকেই এগোচ্ছে না কথাবার্তা, ১৯৩৯ সালের ২৯ এপ্রিল কলকাতার অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে সুভাষ কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে তাঁর পদত্যাগপত্রটি ধরিয়ে দিলেন, “খুবই সহযোগিতাপূর্ণ ভঙ্গিতে।”৬৭ সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করার জন্য এআইসিসি-র প্রতি আর্জি নিয়ে একটি প্রস্তাব আনলেন জওহরলাল; সুভাষকে পুরনো ওয়ার্কিং কমিটিকেই আবার নিয়ে এসে তার সঙ্গে দুইটি শূন্য আসনে তাঁর পছন্দের দু’জন সদস্যকে বসাতে অনুরোধ করলেন। সুভাষ যেহেতু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক ওয়ার্কিং কমিটি চাইছিলেন, জওহরলাল শেষে তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলেন, সুভাষের পদত্যাগপত্র বহাল রইল। রাজেন্দ্র প্রসাদ এক গাঁধীবাদী সদস্য— তাঁকেই অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট করা হল। মধ্য কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে সভাস্থলের বাইরে তখন প্রবল উত্তেজনা। তাঁর সমর্থনে ভিড় করে আসা বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রোধের আগুন থেকে বাঁচিয়ে সহকর্মীদের কোনও ক্রমে বার করে নিয়ে গেলেন সুভাষই।

১৯৩৯ সালের সেই বসন্তে কংগ্রেস রাজনীতির অঙ্গনে গাঁধী সে দিন সুভাষকে সর্ব রকমে পরাস্ত ও পর্যুদস্ত করতে পেরেছিলেন। ত্রিপুরী এবং তার পরবর্তী ঘটনায় স্পষ্টতই সুভাষের একটা বিশাল পরাজয় ধ্বনিত হল, সেই সুভাষ— ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও যিনি মানসিক ভাবে কিংবা সাংগঠনিক ভাবে, গাঁধী ও তাঁর সহচরদের রাজনৈতিক কূটবুদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যই ছিলেন না। তবুও ১৯৩৯-এর এই লড়াই থেকে গাঁধী যখন বেরিয়ে এলেন, তাঁর মাথার পিছনের আলোকবৃত্তটি কালিমালিপ্ত। তারুণ্যের চ্যালেঞ্জের সামনে বেরিয়ে এসেছে তাঁর সাধারণত্ব, তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণতা। সুভাষের আচরণ সেই তুলনায় অনেক প্রশংসার্হ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষও মনে করলেন। সুভাষকে উষ্ণ বার্তা পাঠালেন তিনি: “নিদারুণ গ্লানিজনক পরিস্থিতির মধ্যেও যে-রকম ধৈর্য আর মর্যাদাবোধ তুমি দেখিয়েছ, তোমার নেতৃত্বের প্রতি তা আমার শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস এনে দিয়েছে। নিজের আত্মমর্যাদারক্ষার জন্য বাংলাকে এই একই রকম শোভনতা বজায় রাখতে হবে, এবং এই ভাবেই তোমার আপাত-পরাভবকে পৌছে দিতে হবে চিরন্তন জয়ে।”৬৮

মহাত্মার হাতে পরাস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদ খোয়ানোর পর দেশবন্ধুর এই রাজনৈতিক শিষ্য অজান্তেই “গুরুদেব”-এর হাতে লাভ করলেন “দেশনায়ক” উপাধিটি। কেবল সাধারণ মানুষই নয়, গাঁধীও কিন্তু এঁকে গুরুদেব বলেই ডাকতেন। যদিও ফেব্রুয়ারিতে সুভাষের জন্য যে জনসংবর্ধনার আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা স্থগিত করতে হল, ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতেই কবি তাঁর “দেশনায়ক” শীর্ষক বক্তৃতাটি লিখে ফেলেছিলেন। “বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি। গীতায় বলেন, সুকৃতের রক্ষা ও দুষ্কৃতের বিনাশের জন্য রক্ষাকর্তা বারংবার আবির্ভূত হন। দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয়, তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের অধিনায়ক।” স্বীকার করেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রের “রাষ্ট্রিক সাধনা”র আরম্ভক্ষণে তাঁর সম্পর্কে “কঠিন সন্দেহ” জেগেছিল তাঁর মনে। কিন্তু তার পর যখন তিনি আজ “মধ্যদিনের” “আলোকে” প্রকাশিত, আর তাতে সংশয়ের আবিলতা নেই। রবীন্দ্রনাথ এই যোদ্ধা নেতাকে মহাত্মার বিপরীতে দাঁড় করাতে চান না। “এমন ভুল যেন কেউ না করেন যে, বাংলাদেশকে আমি প্রাদেশিকতার অভিমানে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই, অথবা সেই মহাত্মার প্রতিযোগী আসন স্থাপন করতে চাই রাষ্ট্রধর্মে যিনি পৃথিবীতে নূতন যুগের উদ্বোধন করেছেন।” তবু সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁর আস্থা: “দুঃখকে তুমি করে তুলেছ সুযোগ, বিঘ্নকে করেছ সোপান।… কোনো পরাভবকে তুমি সত্য বলে মানো নি। তোমার এই চারিত্রশক্তিকেই বাংলাদেশের অন্তরের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার প্রয়োজন সকলের চেয়ে গুরুতর।” আটাত্তর বছর বয়সী কবি তাঁর কথা শেষ করেন এই বলে যে, “দেহে মনে কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারব আমার সে সময় আজ গেছে, শক্তিও অবসন্ন।… আশীর্বাদ করে বিদায় নেব এই জেনে যে, দেশের দুঃখকে তুমি তোমার আপন দুঃখ করেছ, দেশের সার্থক মুক্তি অগ্রসর হয়ে আসছে তোমার চরম পুরস্কার বহন করে।”৬৯

রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ তো এলই, সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ আরও একটা জিনিস লাভ করলেন, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের “আন্তরিক সহানুভূতি ও ভালবাসা”। “আমার আশ্চর্য অসুখ” এই নামের একটি প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করলেন কত চিঠি, টেলিগ্রাম, পার্সেল, ওষুধের প্যাকেট, ফুল এবং মাদুলি তিনি এই সময় পেয়েছিলেন:

এই সব লেখক ও প্রেরকের নাম বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম এঁদের ধর্মবিশ্বাস কী প্রকারের, দেখলাম সব রকমের ধর্মের মানুষই এঁদের মধ্যে রয়েছেন। কেবল সব ধর্মই নয়, চিকিৎসাবিদ্যার সব রকমের ধারার ওষুধ (বলতে গেলে সব রকম ‘প্যাথি’-ই) রয়েছে, আছে নারী ও পুরুষ দুই গোত্রেরই দৃষ্টান্ত! হিন্দু, মুসলিম, ক্রিস্টান, পার্সি ইত্যাদি— অ্যালোপ্যাথ, হোমিয়োপ্যাথ, বৈদ্য, হাকিম, নেচারোপ্যাথ, জ্যোতিষ-কবিরাজ— সকলেই লিখেছেন, উপদেশ দিয়েছেন, মাঝেমধ্যে ওষুধবিষুধ মাদুলিও পাঠিয়েছেন।

“ত্রিপুরীর ওই নৈতিক অসুস্থতার আবহের” পর ভালবাসা আর শুভেচ্ছার এই অঝোর বর্ষণ আবার ফিরিয়ে আনল সুভাষের আস্থা। “এই হল ভারতবর্ষ,” নিজেকে বোঝালেন তিনি, “যে ভারতের জন্য এত ঘাম ঝরানো, এত কষ্ট স্বীকার করা। এই সেই ভারত যার জন্য এমনকী (নিজের) জীবনও দিয়ে দেওয়া যায়। এই সেই সত্যকারের ভারত যার প্রতি অনিঃশেষ বিশ্বাস থেকে যায়, ত্রিপুরী যা-ই বলুক আর যা-ই করুক না কেন।”৭০

আমার বিবেক আমারই নিজের

“ভারতবর্ষ একটা আশ্চর্য দেশ,” সুভাষ এমিলিকে লিখলেন ১৯৩৯ সালের জুনে— “এখানে ক্ষমতার জন্য কেউ কাউকে ভালবাসে না, ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই ভালবাসা মেলে। তাই গত বছর কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাহোরে গিয়ে আমি যে অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম, এবারকার অভ্যর্থনা হল তার থেকে উষ্ণতর।” পদত্যাগ করে যে কিছুই হারাননি, বরং জনপ্রিয়তা তাঁর বেড়েই গিয়েছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত তিনি। এই জনপ্রিয়তার মূল্য হিসেবেই খোয়ালেন নিজের মানিব্যাগটি, যাতে ছিল এমিলির শেষ চিঠি আর ছবি। লাহোরের ভিড়ে ঘেরা অবস্থায় কেউ তাঁর পকেট থেকে তুলে নিয়েছিল সেটি।৭১

পদত্যাগের এক সপ্তাহের মধ্যে কংগ্রেসের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরির প্রস্তাব আনলেন সুভাষ। পার্টির মধ্যে যাঁদের চিন্তাভাবনা র‌্যাডিক্যাল ধরনের, তাঁদের জন্য এই দল। তাঁর ভাবনায়, এই দল কংগ্রেসেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য— কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠকে এই র‌্যাডিক্যাল ভাবনার শরিক করা। জাতীয় স্তরে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড যে পুরনো নেতাদের প্রতিনিধিত্ব করে, সে সব নেতার বিকল্প হিসেবে জনসাধারণের জন্য একটা অন্য নেতৃত্ব তৈরি করার ইচ্ছা তাঁর। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে অনমনীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা এবং স্বাধীনতালাভের পর দ্ব্যর্থহীন সমাজতন্ত্র— এই হবে সেই বিকল্প নেতৃত্বের ভিত্তি।

জাতীয় কংগ্রেসকে কী ভাবে আরও জঙ্গি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করা যায়, সে বিষয়ে কিন্তু এম এন রায়ের মতো বামপন্থী নেতাদের থেকে সুভাষের চিন্তার একটা তফাত ছিল। এঁরা মনে করতেন, কংগ্রেস থেকে একেবারে বেরিয়ে আসা উচিত। যে সব স্বঘোষিত বামপন্থী আবার ঐক্য রক্ষার লক্ষ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর কোনও চাপ দিতে রাজি ছিলেন না, এমনকী আরও বেশি গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যও না, তাঁদের সঙ্গেও তাঁর পার্থক্য ছিল। সুভাষের প্রাথমিক বাসনা ছিল, সব ক’টি বামভাবাপন্ন রাজনৈতিক ধারাকেই ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাতার তলায় নিয়ে আসা। কিন্তু দ্রুতই বোঝা গেল যে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির দু’টি ধারার প্রতিনিধি জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং মিনু মাসানি, এম এন রায়ের প্রতিনিধিত্বে র‌্যাডিক্যাল লিগ, এবং ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামের আভরণে কমিউনিস্টরা কেউই তাঁদের নিজস্বতা ছেড়ে আসতে আগ্রহী নন। যেটুকু করতে তাঁরা তেমন আপত্তি দেখালেন না— সেটা হল একটা বাম সমন্বয় কমিটি তৈরির প্রস্তাব, যেখানে সুভাষচন্দ্র বসু হবেন চেয়ারপার্সন। নিজেদের ভিতরকার আদর্শগত বিভেদ-বিসম্বাদের কারণেই বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠী একত্র হয়ে একটি সত্যিকারের শক্তপোক্ত শক্তি হয়ে উঠতে পারল না।

এই পরিস্থিতিতে সুভাষ স্থির করলেন, সোজা মানুষের দরবারে গিয়ে তাঁর র‌্যাডিক্যাল মতামত প্রচার করবেন। বাংলায় নিজের রাজনৈতিক ভিত পোক্ত করার জন্য দ্রুত সফর সেরে এলেন ঢাকা জেলায়। ১৯৩৯ সালের মে থেকে জুলাই, একের পর এক ভ্রমণ করলেন যুক্তপ্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বম্বে, কর্নাটক। যেখানেই গেলেন, পথের মধ্যে স্টেশনে কিংবা রাজধানী শহরে সর্বত্র বিরাট ভিড় তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল, সভাগুলিতে কৌতূহলী মানুষ ভিড় করে এলেন তাঁর কথা শুনতে। কংগ্রেসের বড় নেতারা সরেই রইলেন, তবে সুভাষ কিন্তু অনেক যোগ্য সহকর্মীর সঙ্গেই যোগাযোগ স্থাপন করলেন, যেমন পঞ্জাবের শার্দূল সিংহ কাভিশার, সীমান্তের মিঞা আকবর শাহ, বম্বের কে এফ নরিম্যান ও হরি বিষ্ণু কামথ। কৃষক নেতাদের সমর্থনও পেলেন তিনি, যাঁদের মধ্যে ছিলেন বিহারের স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী (অল ইন্ডিয়া কিষান সভার সভাপতি), অন্ধ্রের এন জি রঙ্গ, গুজরাতের ইন্দুলাল যাজ্ঞিক। কর্নাটকের এস কে হোসমানি ওই প্রদেশের কার্যকরী প্রেসিডেন্ট— তিনিও যখন জায়গা পাল্টে ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দিলেন, ভারী বিস্মিত ও খুশি হলেন সুভাষ।৭২

১৯৩৯ সালের জুনের শেষে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে দক্ষিণপন্থীরা পার্টি ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাগুলির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করার জন্য দুটি প্রস্তাব আনলেন, এক, দলের অনুমতি ছাড়া কংগ্রেস সদস্যদের সত্যাগ্রহ করা নিষিদ্ধ করলেন, এবং দুই, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাগুলিকে মুক্ত করে দিয়ে তাদের আর প্রাদেশিক দলগুলির সিদ্ধান্ত অনুসারে চলার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে ঘোষণা করলেন। সুভাষের পরিচালনায় বাম সমন্বয় কমিটি ৯ জুলাই গোটা দেশে আন্দোলন আহ্বান করল, কেননা এই সব নীতির মধ্যে তারা দেখছিল আন্তর্দলীয় গণতন্ত্রকে টুঁটি টিপে মারার প্রয়াস। দুই প্রস্তাবের নিন্দা করে অনেক সভা হল অনেক জায়গায়, বম্বের ফ্রানজি কাওয়াসজি হল-এর ভিতরে বাইরে জমা বিশাল ভিড়ের সামনে সুভাষও বক্তৃতা দিলেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগ আনলেন তাঁর বিরুদ্ধে, ১৯৩৯-এর অগস্ট থেকে শুরু করে তিন বছরের জন্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী আসন গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দিলেন।

কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের এই ‘ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন’-এর বিরাট বড় প্রভাব পড়ল বাংলার রাজনীতি-অঙ্গনে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করার পরও সুভাষ বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন, কংগ্রেসের সদস্য-সদস্যাদের বড় অংশটিই ছিল তাঁর সঙ্গে। রাজেন্দ্রপ্রসাদ যেই কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করলেন, বাংলার সুভাষ-বিরোধী সংখ্যালঘু অংশটির দুই জন প্রতিনিধি বিধানচন্দ্র রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ওয়ার্কিং কমিটিতে নিযুক্ত হলেন। তবে বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতিত্ব থেকে সুভাষের অপসারণের ফলে এই অঞ্চলে তাঁর প্রতি সমর্থন যেন আরওই দৃঢ় হল। নির্বাচিত বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেহেতু সুভাষের সঙ্গেই রইল, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড বাংলার জন্য একটি ছোট অস্থায়ী বা অ্যাড হক কমিটি তৈরি করল, যার শীর্ষে রইলেন আবুল কালাম আজাদ। এই সবের মধ্যে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলার জাতীয়তাবাদী সমাজের বেশ ভাল রকম একটা দূরত্ব তৈরি হল, কংগ্রেস লেজিসলেটিভ পার্টিতেও একটা ভাঙন ধরল। বাংলার আইনসভায় সুভাষপন্থীদের নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন শরৎচন্দ্র বসু, আর অস্থায়ী কমিটির প্রতি বিশ্বস্ত দলটির প্রতিনিধি নিযুক্ত হলেন কিরণশংকর রায়। ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে শরতের উদ্দেশেও ধাবিত হল শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি বা ‘ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন’।৭৪

১৯২১ সালে যে দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, সেই দল থেকে বিতাড়িত হওয়ার প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন-এর খবরটা শুনে ১৯৩৯-এর ১৯ অগস্ট লিখলেন:

আগের চেয়েও বেশি ভক্তির সঙ্গে আমি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকব, জাতির সেবক হিসেবে কংগ্রেস ও দেশের সেবা করে যাব। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ, আসুন, লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে কংগ্রেসে যোগ দিন, আর ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্য হোন। একমাত্র এই ভাবেই কংগ্রেসের উপর থেকে নীচ আমরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পাল্টাতে পারব, সাংবিধানিকতা ও সংস্কারের বর্তমান নীতি পাল্টিয়ে ফেলে ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতীয় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব।৭৫

ওই একই দিনে কলকাতায় মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বাগত জানালেন তিনি। তাঁর আশা, “এই সদন এক দিন ব্যক্তি ও জাতির মুক্তির লক্ষ্যে সর্ব রকমের শুভকর্মের প্রাণবান কেন্দ্র হয়ে উঠবে।” ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভবন হিসেবে এই বাড়িটির পরিকল্পনা হয়। ১৯৩৭ সালের মার্চে খোলা হয় সুভাষ ফান্ড, এই ভবন তৈরির লক্ষ্যে শুভার্থীরা এতে দরাজ হাতে অর্থ দান করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের স্মারক-স্থাপত্য হয়ে উঠুক এই সদন, এখানে জাতির ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলি গৃহীত হোক, এমনই ইচ্ছা ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথকে “বিশ্বকবি” বলে উল্লেখ করে সুভাষ তাঁকে এই “জাতীয় যজ্ঞে পৌরোহিত্যের পদে আহ্বান করেন।”৭৬

“মহা জাতি”র এই ধারণাটিকে আধুনিকতার আলোয়, পূর্ণ মর্যাদাসহকারে প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে এও বললেন, তাঁরা যে জাতির সংকল্প নিয়েছেন, তা কিন্তু সেই রাষ্ট্রশক্তি নয় যা শত্রু মিত্র সকলের মধ্যে ভয় ও সংশয়ের কাঁটা জাগিয়ে তোলে। এই বক্তৃতা তিনি শেষ করলেন আবারও সেই অনবদ্য “প্রার্থনা-মন্ত্র” দিয়ে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে যেটি লেখেন তিনি:

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,

বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা,

সত্য হউক— সত্য হউক— সত্য হউক হে ভগবান!

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,

বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন,

এক হউক— এক হউক— এক হউক হে ভগবান!

আর সব শেষে বললেন, “সেইসঙ্গে এ কথা যোগ করা হোক— বাঙালির বাহু ভারতের বাহুকে বল দিক, বাঙালির বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক।”৭৭

কবিতা ও দেশভক্তি যখন এই ভাবে মিশে যাচ্ছে কলকাতায়, ঠিক সেই সময়ে ইউরোপের আকাশে জমছে যুদ্ধের মেঘ। যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “জার্মানি ও পোল্যান্ডের মধ্যে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তবে ভারতীয় মানুষের সহানুভূতি কিন্তু থাকবে পোল-দের প্রতিই।” তবে তার পর তাঁর প্রশ্ন: “এই আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের ব্যাপারে আমাদের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, সমগ্র জাতি হিসেবে আমাদের ঠিক কী করণীয়?” তিনি চাইলেন, ইউরোপের যুদ্ধকালীন ন্যাশনাল ক্যাবিনেট-এর অনুসরণে কংগ্রেসও সমসত্ত্ব কমিটির বদলে একটি বহুমাত্রিক ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করুক। যুদ্ধের সময়ে জাতীয় নেতৃত্বের ভূমিকা বিষয়ে সুভাষ দ্বিধাহীন:

গ্রেট ব্রিটেন ও তার সমর্থকরা এখন পোল-দের আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, যদি সে যুদ্ধে যায়, ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’-এর ধুয়ো তুলেই সে যুদ্ধ করবে। এই কি আমাদের ব্রিটিশ শাসকদের মনে করিয়ে দেওয়ার সময় নয় যে, সুয়েজ ক্যানালের পূর্ব দিকে কিন্তু একটি দেশ আছে, প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ জাতির দেশ, যে তার সেই জন্মগত মুক্তি হারিয়েছে, ব্রিটিশের বাঁধনে জর্জরিত হয়ে কাতরাচ্ছে? এই কি ব্রিটিশ জনসাধারণ ও তাদের সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়ার সময় নয় যে, যারা তাদের নিজেদের ঘরে বন্দি দশায় দিন কাটায়, তারা কিন্তু অন্যদের মুক্তির জন্য লড়াই করতে পারে না?

মহাত্মা গাঁধীকেও তিনি অনুরোধ করলেন জোরালো নীতি গ্রহণের জন্য, যাতে তিনি নিজেও গাঁধীর অনুগত শিষ্যদের এক জন হয়ে যেতে পারেন।৭৮

ইউরোপে যুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে, তবু সুভাষ অস্ট্রিয়ায় তাঁর প্রিয় স্থানটিতে ছুটি কাটাতে যাবেন মনস্থ করলেন। ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগেরও আগে এমিলিকে এক বার লিখেছিলেন, “যদি বাডগাস্টাইনে যেতে পারতাম!” কুরহউস হখল্যান্ডের মালকিনের কাছে জেনে নিতে বলেছিলেন ওখানে কত খরচ পড়বে। জানতে চেয়েছিলেন, “আর আমি যদি বায়ুপরিবর্তনের জন্য ওখানে যাই, তুমি আসতে পারবে তো?” ২১ জুন রাজনৈতিক সফর করার সময় আবার লিখলেন, না, এটা কাজের সময়, বিশ্রামের সময় নেই। “অগস্ট অবধি অপেক্ষা করো প্লিজ,” এমিলিকে লিখলেন, “হয়তো তখন যেতে পারব গাস্টাইন-এ। এমিলি কখন ভারতে আসতে পারবেন, তাও জানতে চাইলেন সুভাষ। তাঁকে তো কাজ করতেই হবে, “এত মানুষের উত্সাহ চার দিকে।” তার পর, ৬ জুলাই-এ জব্বলপুর থেকে বম্বের ট্রেনে বসে চিঠিতে লিখলেন, “অন্তত এক মাসের ছুটি নিতেই হবে, কিন্তু সেই ছুটি কি অগস্টের মাঝামাঝি নেওয়া উচিত, না কি সেপ্টেম্বরের গোড়ায়, সেটাই ঠিক বুঝতে পারছি না।” সারা ক্ষণ এমিলির কথা ভেবে চলেছেন, আশ্বাস পাঠাচ্ছেন, ভালবাসা জানাচ্ছেন।৭৯

সেপ্টেম্বরের গোড়ায় তখনও তিনি ভারতেই। ১৯৩৯-এর ৩ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজের মারিনা বিচে দুই লক্ষ মানুষের বিশাল সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন, এমন সময় কেউ তাঁর হাতে একটা খবরের কাগজ গুঁজে দিয়ে চলে গেল। পোল্যান্ডে জার্মানির আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ ইউরোপের এই যুদ্ধকে জাতির জীবনে একটি দুর্লভ মুহূর্ত বলে বর্ণনা করলেন, এমন মুহূর্ত যা ভারতের পক্ষে হারানো একেবারেই উচিত নয়।৮০ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এই নতুন বাঁকটিকে তিনি কেবলমাত্র ভারতের জাতীয় সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখলেন। এমনিতেই যে কোনও জরুরি সিদ্ধান্তগ্রহণের সময় যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা আর আবেগের অন্তর্বোধকে মেলানোর চেষ্টা করতেন সুভাষ। বলতেন, “যুক্তি যেখানে ব্যর্থ হয়, আবেগ পথ দেখায়। আবার যেখানে আবেগ যেন কুয়াশা তৈরি করে ফেলে, যুক্তির সাহায্যেই পথ খুঁজে পাওয়া যায়।” ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর দেশ এফোঁড় ওফোঁড় করে ঘুরে বেড়ালেন তিনি, তাঁর ভাষায় যা ব্যক্তি-মন আর সমষ্টি-মন, সেই দুয়ের মিলন ঘটানোর চেষ্টায়।৮১

ভারতের রাজনীতির সব হিসেব ওলোটপালট করে দিল এই যুদ্ধ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার এগারোটি প্রদেশের মধ্যে আটটিতেই অধিষ্ঠিত, এ দিকে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতকে অন্যতম অংশগ্রহণকারী দেশ বলে ঘোষণা করে দিলেন। যদিও এক মাস আগেই সুভাষের বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে, ওয়ার্ধার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির তিন দিনের বৈঠকে সুভাষকেই আবার বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হল। ৯ সেপ্টেম্বর বৈঠক শুরু হল। কংগ্রেসকে তিনি অনুরোধ করলেন ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য একটি গণ-আন্দোলন এখনই শুরু করতে।৮২ কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য তখনও এ প্রস্তাবে রাজি নন, বরং ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাঁরা যুদ্ধের লক্ষ্য বিষয়ে জানতে চাইছেন। প্রস্তাবে পোল্যান্ডের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করা হল, এও বলা হল যে জার্মানির সঙ্গে কোনও ঝগড়ার জায়গা অবশ্য নেই, ব্রিটিশদের কাছে জানতে চাওয়া হল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নীতির সঙ্গে ভারতের কী যোগ থাকবে বলে তাঁরা মনে করেন।

প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সুভাষকে ১০ অক্টোবর লর্ড লিনলিথগোর বক্তব্য শুনতে ডাকা হল। মিটিং-এর পর সুভাষ স্পষ্ট করে দিলেন যে তিনি দ্বিচারিতার মানুষ নন, সামনাসামনি এক রকম পিছনে আর এক রকম কথা বলার লোক তিনি নন। হিজ ম্যাজেস্টি-র প্রতিনিধিকে জানালেন ভারতের জাতীয় দাবিটি। যুদ্ধের লক্ষ্য বিষয়ে কংগ্রেসের প্রশ্নের যে উত্তর লিনলিথগো দিলেন, কংগ্রেসকে তা বিপুল ভাবে হতাশ করল। ব্রিটেনের হিজ ম্যাজেস্টি-র সরকারের ইচ্ছা প্রকাশ করার ভার ভাইসরয়ের উপর, সেই ভাইসরয় সে দিন যা বললেন, তার অর্থ এই, সরকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এবং দেশীয় রাজ্যগুলির দল ও সম্প্রদায়গুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনা করবেন কী ভাবে যথাযথ সাংবিধানিক পরিবর্তন আনা যায়— কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই সেই আলোচনা হবে। কংগ্রেস নেতৃত্বকে চূড়ান্ত রকম বিব্রত করে দিল এই উত্তর, কেননা এত কাল কংগ্রেস সমানেই বলে আসছিল সংকটের সময়ে তারা ব্রিটিশদের কোনও ভাবে বিব্রত করতে চায় না। হতাশায়, রাগে, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড সমস্ত প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাগুলিকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিল। ব্রিটিশ গভর্নররা আর তাঁদের সিভিল সার্ভেন্টরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আটটি প্রদেশের দেখভাল করবেন।৮৩

১৯৩৯ সালের এই যুদ্ধ-সংকটের সময়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের বাকি অংশের ভাবটা হল ঠিক হিজ ম্যাজেস্টি-র ‘বিরোধী’ দলের মতো; আর, সুভাষ, একা, ঔপনিবেশিক শাসনের সমস্ত বাধা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন হিজ ম্যাজেস্টি-র ‘প্রতিপক্ষ’ হয়ে।৮৪ ১৯৩৯-এর ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ গাঁধীকে আর্জি জানালেন সুভাষের উপর থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে, “জাতীয় স্বার্থরক্ষার মহান লক্ষ্যে” তাঁকে সহযোগিতা করতে আহ্বান করতে। গাঁধী মানলেন না। সি এফ অ্যান্ড্রুজকে দিয়ে বলে পাঠালেন, ব্যাপারটা আসলে “গুরুদেব-এর বোঝার পক্ষে বড়ই বেশি জটিল।” এই উত্তরের মধ্যে যে সুরটি ছিল, তাতে আহত বোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ, যদিও গাঁধী ওই কথার সঙ্গে আর একটি কথাও জুড়ে দিয়েছিলেন, “তাঁকে বিশ্বাস রাখতে বলুন, কমিটির কারওই সুভাষের বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। আমার কাছে তো সে পুত্রসম।” সুভাষের জন্য একটাই সান্ত্বনা রইল: তাঁর প্রতি বাপু যে ব্যবহারই করে থাকুন না কেন, বাপুর নিজের বড় ছেলে হরিলালের প্রতি শাস্তির তুলনায় তা কিছুই নয়। এক জায়গায় গাঁধী লেখেন: “আমার ভালবাসার ধরন যেমন গোলাপের পাপড়ির মতো নরম, তেমনই পাথরের চেয়েও দৃঢ়। আমার স্ত্রীকে সেই দৃঢ় দিকটি সহ্য করতে হয়েছে। আমার জ্যেষ্ঠপুত্র এখনও তা সহ্য করছে। সব সময় ভাবতাম, সুভাষবাবুকে আমি পুত্র হিসেবে পেয়েছি। কিন্তু না, আমার স্খলন হল। যে শাস্তি নির্ধারিত হল সুভাষের জন্য, সেই শাস্তির সঙ্গে নিজেও সম্পূর্ণ ভাবে জড়িয়ে পড়লাম, যন্ত্রণা ভোগ করলাম।”৮৫ চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক এই নেতার বিদ্রোহী পুত্রটি কিন্তু তবুও তাঁর কাছে নত হতে অস্বীকার করলেন।

১৯৩৯-এর ডিসেম্বরে কংগ্রেস নেতৃত্বের দোদুল্যমান নীতি বর্জন করলেন সুভাষ। “সাম্রাজ্যবাদী সরকারের ছত্রছায়ায় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্ব্লি”-র যে প্রস্তাব দিল কংগ্রেস, লয়েড জর্জের আইরিশ কনভেনশনের সঙ্গে তার তুলনা করে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র সতর্কবার্তা উচ্চারণ করলেন তিনি। এ আসলে “লড়াই বন্ধ করার” “অজুহাত” মাত্র, কেননা কংগ্রেসের ভিতরকার আপাত পার্টি-সংগ্রামের পিছনে প্রকৃতপক্ষে সর্বক্ষণই চলছে শ্রেণিসংগ্রাম।”৮৬ একমাত্র নিজেদের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার পরই সত্যিকারের কোনও কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্ব্লি গঠন করা সম্ভব জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে। দিল্লিতে ১৯৪০-এর জানুয়ারিতে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস কনফারেন্স-এর সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে পঞ্জাবের মুসলিম গোষ্ঠী আহরারদের প্রশংসা করলেন সুভাষ সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য— কংগ্রেস নেতারা এ দিকে তখনও কেবলই ভাবছেন। “তবুও এমন লোকও আছে, ঘরের কাছেও আছে, ভারতীয় মুসলিম সমাজের দেশাত্মবোধ নিয়ে যারা সমানেই প্রশ্ন তুলতে এতটুকু ইতস্তত করে না।” আর, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড— তাঁর অভিযোগ— “ফ্যাসিস্ট ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গেও সমঝোতায় আসতে পারে” কিন্তু বামপন্থী সহকর্মীদের ক্ষেত্রে “তিক্ততার চরম স্তর অবধি লড়াই” করে যেতে তাদের বাধে না। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সময়ে মহাত্মা গাঁধীর যে অসামান্য আহ্বানে কেঁপে উঠেছিল দেশ, সেই আহ্বানের উল্লেখ করে ছাত্রশ্রোতাদের তিনি “আমাদের এ যাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ বামভাবাপন্ন নেতাদের অন্যতম সেই নেতা এক দিন “তরুণ ভারত”কে যে বার্তা দিয়েছিলেন,” তা মনে করিয়ে দিলেন। তিনি বলেছিলেন: “যারা সাহসভরে এগিয়ে যায়, লড়াই করে, স্বাধীনতা তাদেরই প্রাপ্য।”৮৭

ব্রিটিশ রাজের বিরোধিতা করে ‘ফ্যাসিস্ট’ বিশেষণটি ব্যবহার করলেও সুভাষ নিশ্চয়ই অবহিত ছিলেন ব্রিটেনের ফ্যাসিস্ট শত্রুরা কী ভয়ানক বিপদ ডেকে আনছে গোটা পৃথিবীতে। তাঁর মেজদাদা শরতের বক্তৃতায় ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে প্রসঙ্গক্রমে দেখা গেল এই নৈতিক দ্বন্দ্বের উত্তর খোঁজার প্রয়াস। তাঁর যুক্তি, “বিশ্ব জুড়ে মানুষের স্বাধীনতালাভের স্বপ্ন মুছে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্রীয় একচ্ছত্রবাদের চেয়েও বেশি তীব্র তার বিপদ।” মানলেন, সাম্রাজ্যবাদ পুরনো পাপী, তার কিছু শক্তি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে হারিয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় একচ্ছত্রবাদ এসেছে তার “নবাগতের উদ্দীপনা ও শক্তি” নিয়ে। ভারত ও ভারতীয়দের প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে গেলে দুই “-বাদ”-এর “বিপদই ভয়ঙ্কর”। “একচ্ছত্রবাদ যদি ঘৃণার বস্তু হয়, সাম্রাজ্যবাদকে আরও বেশি ঘৃণা করা উচিত,” বললেন শরৎ। শেক্সপিয়রের স্পর্শ জুড়ে দিয়ে বললেন, নিজের দেশে কোনওক্রমে জীবনধারণ করার জন্য “দমচাপা ফিসফিসে মিনতি” করে যেতে পারবেন না তিনি। “নিজেদের জন্মগত অধিকার দাবি করা যদি হাতে-কলমে বিদ্রোহের সমান হয়,” তাঁর সিদ্ধান্ত, “এক জন মহান আইরিশম্যানের কথা ধার করে বলব ‘আমি এক গর্বিত বিদ্রোহী, শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি আমার বিদ্রোহ ধরে রাখব।’”৮৮

সুভাষচন্দ্র ওদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরলেন লয়েড জর্জের আইরিশ কনভেনশনকে সিন ফেইন কী ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই উদাহরণ, কিংবা ১৯১৭-য় রাশিয়ার কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্ব্লি থেকে বলশেভিকদের সরে যাওয়ার ঘটনা।৮৯ সমঝোতার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যালঘুদের ব্রিটিশরা স্বভাবত যে ভাবে “কংগ্রেসের বিরুদ্ধ শক্তি” হিসেবে তুলে ধরতে চায়, সেই প্রয়াস— খেয়াল করেন তিনি। তবে তাঁর এও মনে হয়, কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সঙ্গে একটা সমঝোতায় যদি সত্যিই পৌঁছনো যায়, সে ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা “মুসলিম লিগ-এর সঙ্গ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে”। ১৯৪৭ সালে শেষ পর্যন্ত যা ঘটবে, তার একটা আভাস সুভাষ তখনই পেয়েছিলেন ঠিকই। তবে ব্রিটিশরা সত্যিই তাদের মুসলিম ও রাজন্য সঙ্গীদের শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিলেও, ব্রিটিশ ও কংগ্রেস দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে সমঝোতা হলে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ, দুয়ের ভেতরই ভাঙন ধরবে, এই ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার সময় তখনও আসেনি। এমন ঘটনা ঘটলে মুসলিম লিগের রাজভক্ত নেতারা সুভাষচন্দ্রের মতে সমঝোতার পক্ষে থাকবেন এবং “এই মুহূর্তে যাঁরা লিগ কাউন্সিলে প্রবল ক্ষমতাধর, সেই মিস্টার জিন্না ও মুসলিম লিগের অন্যান্য প্রগতিশীল নেতাদের ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন।” অন্য দিকে, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড যদি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়ায় যায়, তবে সুভাষের আশা, “সেই বোঝাপড়া-ওয়ালাদের কংগ্রেস থেকে স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।” তাঁর প্রশ্ন, “কেন আমরা কংগ্রেস ছাড়ব, সমঝোতাপন্থীদের হাতে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার কেন তুলে দেব?”৯০

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোনও সমঝোতা চলবে না: ১৯৪০ জুড়ে এই ছিল সুভাষের নীতি ও মূল বক্তব্য। মার্চ মাসে আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রামগড়ে তার বার্ষিক বৈঠকে বসল, সুভাষ সেই বৈঠকের কাছেই তাঁর বিপুলাকার সমঝোতা-বিরোধী কনফারেন্স আয়োজন করলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও কংগ্রেসের অনুষ্ঠানের জমায়েতের থেকে আকারে কিছু কম হল না তাঁর সমান্তরাল কনফারেন্স-এর ভিড়। স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর কৃষক স্বেচ্ছাসেবীরা বিহারে সুভাষের এই কনফারেন্স আয়োজনের মূল ভারটি বহন করল। তিনি বললেন, “সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়ে আসছে, আর স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের সময় আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ভারতবর্ষ এখন ইতিহাসের অন্যতম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।” সেই গুরুতর সময়ে জাতীয় নেতৃত্বের দোদুল্যমান সিদ্ধান্তহীনতার অসুখের প্রতি অগ্নিবর্ষী আক্রমণ হানল এই রামগড় বক্তৃতা। সব সত্যিকারের বামভাবাপন্নদের প্রতি তাঁর আহ্বান, রাজনৈতিক ভাবে সংহত হতে হবে। “আমাদের আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে, একমাত্র বামপন্থীরাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমঝোতাহীন লড়াই-এ যেতে পারে,” বললেন তিনি। “আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে, বামপন্থা আর সমাজতন্ত্র একার্থক হয়ে উঠবে।”৯১

প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে লড়াই হিসেবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে দেখছিলেন সুভাষ। ১৯৪০ সালের এপ্রিল থেকে যখন পুরনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জার্মানির কাছে পর্যুদস্ত হচ্ছে, সেই সময়ে সুভাষ মুখ ঘুরিয়ে আবার নতুন করে মন দিয়েছেন বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য-আনয়নের চেষ্টায়।৯২ ১৯৪০-এর মার্চে রামগড়ে কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি বৈঠকই হল না, সে বছরই লাহোরে বসল মুসলিম লিগের ঐতিহাসিক বৈঠক। লিগের নেতা হিসেবে মহম্মদ আলি জিন্না দাবি করলেন, ভারতীয় মুসলিমরা কেবল সংরক্ষণ-সন্ধানী সংখ্যালঘু নয়, তাঁরা একটা পৃথক জাতি, ভারতের হিন্দুদের ক্ষমতার সমান ক্ষমতা তাঁদের প্রাপ্য। মুসলিম লিগ লাহোরে প্রস্তাব নিয়ে এল, উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে ও পূর্বে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে একত্র একটি গ্রুপে বিন্যস্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা হোক। এই প্রস্তাবে একটি (একবচনেই) সংবিধানের কথাও বলা হল, যাতে সর্বভারতীয় ব্যবস্থাগুলি বিধৃত থাকবে, সঙ্গে থাকবে সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা। একেবারেই বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল না সে দিনের এই লাহোর প্রস্তাব, পাকিস্তান বা দেশভাগ কোনও শব্দই এখানে উচ্চারিত হয়নি। কংগ্রেস গরিষ্ঠতার চ্যালেঞ্জের সামনে, এবং এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতাসন্ধানের সামনে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু প্রদেশগুলিতে মুসলিমদের প্রয়োজন ও উচ্চাশার মধ্যে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টাই ছিল এই প্রস্তাবের মূল কথা।৯৩

“সাম্প্রদায়িকতা” শব্দটি এর মধ্যে যথেষ্ট মন্দ সংজ্ঞার্থ লাভ করেছে, যা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে সংকীর্ণ ধর্মীয় বিভেদকামিতা— এই সাম্প্রদায়িকতার তীব্র সমালোচক ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কংগ্রেসের মূলস্রোতের একক-জাতীয়তার ভাবনাধারা যার মূল প্রবক্তা জওহরলাল নেহরু, তাতে বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। জনৈক বাঙালি মুসলিম নেতা আবুল মনসুর আহমদ তাঁকে বোঝালেন যে লাহোর প্রস্তাব কিন্তু মূলগত ভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব নয়।৯৪ ১৯৪০ সালের ৪ মে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল, যাতে সুভাষ লিখলেন, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, “যখন কংগ্রেসের প্রধান নেতারা হিন্দু মহাসভা কিংবা মুসলিম লিগ-এর মতো সম্প্রদায়-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও নেতা হতে পারতেন।” পঞ্জাবে প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা লালা লাজপত রায় একই সঙ্গে কংগ্রেস ও মহাসভার নেতা ছিলেন, আবার আলি ভ্রাতৃদ্বয় শওকত ও মহম্মদ একই সময়ে কংগ্রেস ও লিগের নেতা ছিলেন। ১৯২০ সালের আগের সময়ের প্রসঙ্গে সুভাষ জিন্নার নামটিও উল্লেখ করতে পারতেন দুই দলেরই প্রথম সারির নেতা হিসেবে। আক্রম খাঁ-এর দৃষ্টান্তও দিলেন তিনি, যে আক্রম খাঁ মুসলিম লিগের নেতৃত্বে থাকার সময়েই বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সুভাষ তাই ভাবতে রাজি নন যে “সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান” মাত্রেই অচ্ছুত।৯৫

এও বললেন সুভাষ— কংগ্রেসের মধ্যে যে গোষ্ঠীতে তিনি বিচরণ করতেন সেই গোষ্ঠী যখন কলকাতা কর্পোরেশনে মুসলিম লিগের সঙ্গে একটি চুক্তি সাধন করেছিল, হিন্দুদের একটি সাম্প্রদায়িক বিভেদ-কামী অংশ কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মুসলিম লিগ নেতা এম এ এইচ ইস্পাহানির সঙ্গে আলোচনার পর বসু গোষ্ঠীর সমর্থনে মুসলিম লিগের আবদুর রহমান সিদ্দিকি কলকাতার মেয়র হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। গত তিনটি বছর ধরে যে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরির সব প্রয়াসই ব্যর্থ হয়েছে সে কথাও উল্লেখ করলেন তিনি। ১৯৩৮ সালে তিনি যখন জিন্না ও মুসলিম লিগের সঙ্গে দাবি-প্রতিদাবির আলোচনায় বসেন, তাঁর পিছনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ও গাঁধীর আশীর্বাদ ছিল। “সেই প্রয়াস সার্থক হয়নি, কিন্তু তখন যাঁরা তাতে আপত্তি করেননি, এখনকার প্রয়াসে তাঁরাও বাধা দিচ্ছেন, কেননা এ বারের প্রয়াস সফল হয়েছে,” লিখলেন সুভাষ। কলকাতার মুসলিম লিগের সঙ্গে বসু গোষ্ঠীর চুক্তি সম্বন্ধে সব মিলিয়ে তাঁর অভিমত ছিল এই রকম:

মুসলিম লিগের সঙ্গে এই বর্তমান চুক্তিটিকে আমরা একটি বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছি। এই চুক্তি যা অর্জন করেছে, তার দিকে না তাকিয়ে বরং এই চুক্তির মধ্যে যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেটা খেয়াল করলেই আমরা এ কথা বুঝতে পারব। গত তিনটি বছর ধরে কেবলই অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমরা, সাফল্যের দিশা মিলছে না। প্রতি বার সাম্প্রদায়িক সংস্কার ও আবেগের বদ্ধ দেওয়াল আমাদের আটকে দিচ্ছে, সব চেষ্টা বানচাল হয়ে যাচ্ছে। এই বার আমরা সেই দেওয়াল ভাঙতে পেরেছি, সেই ভাঙনপথে প্রবেশ করেছে আশার আলোকরেখা। একটা আশাময়তার সঞ্চার হয়েছে যে, অন্যদের কাছে যে সমস্যার সমাধান মেলা অসম্ভব, আমরা কিন্তু তার সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছেছি। ক্ষুদ্র ধাপ থেকেই অনেক সময়ে বড় সাফল্যের ভিত্তি তৈরি হয়ে ওঠে।৯৬

কোনও একটা বোঝাপড়ার আশাতেই বম্বেতে জিন্নার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র দেখা করেছিলেন। জানা যায় যে মুসলিম লিগ নেতা কংগ্রেসের এই বিদ্রোহী নেতাটিকে বলেছিলেন, সুভাষচন্দ্র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ পেলে তবেই তিনি তাঁর সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বোঝাপড়ার কাজে নামবেন।৯৭

১৯৪০-এর মে মাস, যুদ্ধে তখন ব্রিটেনে বেহাল অবস্থা। সুভাষের মনে হল “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংঘর্ষ” থেকে ভবিষ্যতে “অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সংহতি”র প্রশ্নটির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা। “আজ আমাদের সামনে ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন, অনিশ্চিত। তবে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে যদি আমরা দুটি লক্ষ্যে সফল হতে পারি— কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং হিন্দু-মুসলিম বোঝাপড়া।”৯৮ দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ ভারত কোনও ভাবেই ব্রিটেনকে সাহায্য করতে পারবে না। তিনি জোর দিয়ে বললেন, “ভারতকে প্রথমে নিজের ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেই নিজের ব্যবস্থা তখনই করা সম্ভব যখন হিন্দু মুসলিম সব পক্ষ মিলে সাময়িক জাতীয় সরকার গঠনের জন্য একটি সম্মিলিত দাবি করা হবে, যে সরকারের কাছে সমস্ত ধরনের ক্ষমতা অতিসত্বর হস্তান্তর করা হবে।” যখন “নিজেকে রক্ষা করার শক্তি অর্জন করবে” ভারত, তখনই একমাত্র তার পক্ষে “অন্যান্য বন্ধুত্বমূলক দেশগুলির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।” তবে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ কি ঔপনিবেশিক কর্তাদের কাছে এই ভাবে একটা সম্মিলিত হিন্দু-মুসলিম দাবি পেশ করে উঠতে রাজি হবে?৯৯ এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে তাঁর মনে হয় ভারতের প্রয়োজন ছিল চিত্তরঞ্জন দাশের মতো এক জন নেতা, যাঁর “অপার স্নেহ তাঁকে আপামর জনসাধারণের বন্ধু করে তুলেছিল, মুসলিম ও অন্য সব পশ্চাত্পর শ্রেণিকেও কাছে টানতে পেরেছিল।”১০০

১৯৪০ সালের জুন মাসে নাগপুরে দ্বিতীয় অল-ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে যে বক্তৃতাটি দিলেন তিনি, তাতে এই “প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে মহাযুদ্ধের” প্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের কর্তব্য সম্বন্ধে সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া গেল। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের কাজটির উপরেই সবচেয়ে জোর দিলেন সেখানে। ঘোষণা করলেন, “জাতীয় ঐক্যের আগের পদক্ষেপ হিসেবে সংগ্রামের ধারাবাহিক রূপরেখার উপর ভিত্তি করে কংগ্রেসের মধ্যে ঐক্য আনা চাই, আর চাই কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতো অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে ঐক্য স্থাপন।” একটি নাগরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী তৈরির জন্য সব দলকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানালেন, যে বাহিনী দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি, সম্প্রীতি ও শুভচেতনা বজায় রাখার দিকে নজর রাখবে। কোনও বিদেশি শক্তির কাছ থেকে কী ভাবে পরাধীন ভারতকে রক্ষা করা যাবে, সে চিন্তা সরকার একাই করুক, সে চিন্তা সাধারণ মানুষের নয়। “আমাদের দাসত্বের মেয়াদ বাড়ানোর যুদ্ধে লড়াই করে আমাদের কোন স্বার্থ সিদ্ধ হবে? পরাধীন ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য লড়াই করার কী অর্থই বা থাকতে পারে।”১০১ ১৯৪০ সালের জুনের শেষে আবার বললেন কেন্দ্রে ও প্রদেশে জাতীয় মন্ত্রিসভা তৈরির কথা, যাতে “এই পরিবর্তনের সময়কালটা জুড়ে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা সম্ভব হয়, যাতে দীর্ঘমেয়াদি হিন্দু-মুসলিম বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত হয়।” ব্রিটেনের মতোই ভারতেও তখন যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা, যে পরিস্থিতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলিকে একসঙ্গে হাত মেলাতে হয়। সোজা পথে জাতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা যদি অসম্ভব হয়, তবে অন্তত প্রদেশগুলিতে তো সেই চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে— সুভাষের বক্তব্য। অর্থাৎ, এর আগে ১৯৩৭ সালে যুক্তপ্রদেশ ইত্যাদি জায়গায় মুসলিম লিগকে যেমন সর্বতো ভাবে পরিত্যাগ করার নীতি গ্রহণ করেছিল কংগ্রেস, সেই নীতিটিকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে দিতে চাইছিলেন সুভাষ। হিন্দুপ্রধান ও মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলিতে একই ভাবে সর্বাত্মক জাতীয় সহযোগিতা চাইছিলেন তিনি। “বর্তমানের এই পরিবর্তনশীল সময়ে প্রদেশের জাতীয় ক্যাবিনেটগুলি বিরাট সাহায্য করবে, কেবল অভ্যন্তরীণ ঐক্যরক্ষার বিষয়েই নয়, কেবল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনের লক্ষ্যেও নয়— কেন্দ্রে ক্ষমতাদখলের পথে বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার পথে যদি কোনও বাধা আসে, সেই বাধা সরাতেও তারা সাহায্য করবে।”১০২

বাংলার হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সন্ধানে সুভাষচন্দ্র বসু সিরাজ-উদ্-দৌলা দিবস পালন করবেন স্থির করলেন ১৯৪০ সালের ৩ জুলাই। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি প্রস্তাব করলেন, কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়্যারে রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনে যে হলওয়েল মনুমেন্ট, সেটিকে উত্খাত করার একটি আন্দোলন সে দিন থেকে শুরু হোক। সুভাষের মতে ওই স্থাপত্য “একে তো নবাবের স্মৃতিতে একটি অবাঞ্ছিত কলঙ্ক যোগ করে,” তার সঙ্গে “আমাদের দাসত্ব ও অসম্মানের প্রতীক” হয়ে বিরাজ করে।১০৩ আন্দোলন যদিও সফল হল, সরকার ওই আপত্তিকর মনুমেন্টটিকে জনসমক্ষ থেকে সরিয়ে দিল, এই সুযোগটি লুফে নিয়ে ব্রিটিশ রাজ সুভাষকে আন্দোলন শুরুর আগেই আবার জেলের ভিতরে পুরে দিল। ১৯৪০ সালের ২ জুলাই— এই হল ভারতের মাটিতে স্বাধীন মানুষ হিসেবে সুভাষের শেষ দিন। সেই দিন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে জোড়াসাঁকোর বাড়ি গিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর, তাঁর নিজের বাড়ি থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল, প্রেসিডেন্সি জেলে চালান করে দিল।১০৪

৩ জুলাই থেকে ৫ ডিসেম্বর ১৯৪০— এই শেষ বন্দিত্বের সময়কাল জুড়ে সুভাষ যে কত চিঠি আর প্রবন্ধ লিখলেন! শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিগুলিতে কংগ্রেস নেতাদের নৈতিক ব্যর্থতা বিষয়ে স্পষ্ট নির্দ্বিধ মন্তব্য করে গিয়েছেন তিনি। একটি চিঠিতে বলেছেন “গাঁধীবাদ পবিত্রতার মুখোশে ভণ্ডামি” এবং “গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ”। আর একটিতে বলেছেন, “যতই কংগ্রেস রাজনীতি বিষয়ে ভাবি, ততই নিশ্চিত হই, ভবিষ্যতে আমাদের আরও শক্তি ও সময় নিয়ে হাইকম্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার। স্বরাজলাভের পর ক্ষমতা যদি এই রকম নীচমনা, প্রতিশোধপরায়ণ, অসৎ ব্যক্তিদের হাতে জড়ো হয়, দেশের কী দশা হবে। এখন আমাদের কাজ কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সঙ্গে লড়াই-এর উপর জোর দেওয়া(,) এবং সেই লক্ষ্যে যখন যেখানে যে ভাবে সম্ভব অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গেও আমাদের হাত মেলানো উচিত।”১০৫ বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি জারি করেছিলেন যে আবুল কালাম আজাদ, তাঁর বিষয়ে তিনি বিশেষ ভাবে আক্রমণাত্মক। কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলার অর্থ যদি হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস নেতৃত্ব স্পষ্টতই দ্বিচারিতার খেলা খেলে থাকে। সর্বভারতীয় স্তরে তারা সংখ্যালঘু বামপন্থীদের দক্ষিণপন্থী সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মানতে বাধ্য করে, আবার উল্টো দিকে বাংলায় বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের সমর্থক যাঁরা বিপুল ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁরা যেন অ্যাড হক বা অস্থায়ী কমিটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করে থাকে, এও তারা দাবি করে যায়। এই দিক দিয়ে দেখলে আজাদই শৃঙ্খলাভঙ্গের দোষে দোষী, সুভাষ বা শরৎ নন।১০৬

কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের বদলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর দৃঢ় সংকল্পের কারণেই সুভাষচন্দ্র অনশন আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, যাতে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন তিনি, জেলে বসে সময় নষ্ট করতে আর রাজি নন। এ দিকে সুভাষ অনশন শুরু করার আগের দিন শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি নিয়ে গাঁধী তাঁর এক বন্ধুকে টেলিগ্রাম করলেন, তাতে সংক্ষেপে জানালেন: “দুঃখিত, ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা ও মিত্রতা সত্ত্বেও হস্তক্ষেপে অক্ষমতা এমনকী অনিচ্ছা। শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য তাঁদের ক্ষমাপ্রার্থনা ছাড়া নিষেধাজ্ঞা তোলা যাবে না।” অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কংগ্রেস এই সময়ে শৃঙ্খলাভঙ্গের সমতুল্য মনে করত।

সুভাষচন্দ্র কিন্তু এই সব রাজনৈতিক মতপার্থক্য পেরিয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ধরে রাখার ইচ্ছাই প্রকাশ করলেন, স্বীকার করলেন মহাত্মা গাঁধীর প্রতি নিজের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কথা। সুইটজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় নায়ক উইলিয়াম টেল বিষয়ে জে এইচ গুয়ের্নের একটি কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে যোদ্ধা মানুষটি মহাত্মার প্রতি তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করলেন:

My knee shall bend, he calmly said,
To God and God alone,
My life is in the Austrians’ hands,
My conscience is my own.

“রাজনৈতিক জীবনে আমি কোনও ভুল করেছি বলে আমার জানা নেই,” বললেন সেই অদম্য প্রতিবাদী। “সুতরাং, মহাত্মার প্রতি এই আমার উত্তর, এই কয়টি পঙ্ক্তি, দু’-একটি শব্দের অদলবদল-সহ।”১০৭

.

১. অরবিন্দ ঘোষ (শ্রীঅরবিন্দ), “দ্য মর‌্যালিটি অব বয়কট,” তদেব, দ্য ডকট্রিন অব প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স (কলকাতা: আর্য পাবলিশিং হাউস, ১৯৪৮), পৃ: ৮৭-৮৮।

২. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮, সুভাষচন্দ্র বসু, লেটারস্ টু এমিলি শেঙ্কল: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, সপ্তম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৪), পৃ: ১৮১-১৮২।

৩. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৮৫), পৃ: ৭৯-৮১।

৪. সুভাষচন্দ্র বসু, বাসন্তী দেবীকে লেখা চিঠি, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮, সুভাষচন্দ্র বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, নবম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৪), পৃ: ২৫৭।

৫. নন্দলাল বসু, ভিশন অ্যান্ড ক্রিয়েশন (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৯৯), পৃ: ২৩৫।

৬. ভিডিয়ো এবং অডিয়ো রেকর্ডিং (এন আর বি)।

৭. “দ্য হরিপুরা অ্যাড্রেস,” বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ৩-৬।

৮. তদেব, পৃ: ৬-১৫।

৯. তদেব, পৃ: ১৫-১৬।

১০. সুভাষচন্দ্র বসু, সীতা ধর্মবীরকে লেখা চিঠি, ৭ জুলাই, ১৯৩৭, সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৪), পৃ: ২০৯-২১০।

১১. “দ্য হরিপুরা অ্যাড্রেস,” বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ১৫-১৬।

১২. তদেব, পৃ: ১৬।

১৩. তদেব, পৃ: ১৩।

১৪. তদেব, পৃ: ২৪-২৫।

১৫. তদেব, পৃ: ২৭-৩০।

১৬. ফটোগ্রাফ, অডিয়ো রেকর্ডিং এবং ভিডিয়ো রেকর্ডিং (এন আর বি)। এ কে চেট্টিয়ার, “আই মিট সুভাষ-বাবু,” দি ওরাকল, ৩০, ১ নম্বর (জানুয়ারি ২০০৮), ৫৮।

১৭. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৬ মার্চ, ১৯৩৮, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৮২-১৮৩।

১৮. টাইম, ৭ মার্চ, ১৯৩৮।

১৯. “মিউনিসিপ্যাল সোশ্যালিজম,” বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ৩১-৩৫।

২০. “সায়েন্স অ্যান্ড পলিটিক্স,” তদেব, পৃ: ৪৩-৪৮।

২১. “দি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রবলেমস্ অব ইন্ডিয়া,” তদেব, পৃ: ৪৮-৫৩।

২২. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ১৯ অক্টোবর, ১৯৩৮, তদেব, পৃ: ১৮৩।

২৩. জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২১ জুন, ১৯৩৯, জওহরলাল নেহরু, সিলেকটেড ওয়ার্কস্, নবম খণ্ড (নয়া দিল্লি: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭২-১৯৮২), পৃ: ৩৯৭।

২৪. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৯ মে, ১৯৩৮, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৮৬-১৮৮।

২৫. জওহরলাল নেহরু, এম এ জিন্নাহ্কে লেখা চিঠি, ১৭ মার্চ, ১৯৩৮, জওহরলাল নেহরু, আ বাঞ্চ অব ওল্ড লেটারস্ (দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৯), পৃ: ২৭৮।

২৬. আয়েশা জালাল, দ্য সোল স্পোকস্ম্যান: জিন্নাহ্, দ্য মুসলিম লিগ অ্যান্ড দ্য ডিমান্ড ফর পাকিস্তান (কেমব্রিজ: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৫)।

২৭. সুভাষচন্দ্র বসু, এম এ জিন্নাহ্কে লেখা চিঠি, ১৫ মে, ১৯৩৮; তদেব, ২১ জুন, ১৯৩৮; তদেব, ২৭ জুন, ১৯৩৮; তদেব, ২৫ জুলাই, ১৯৩৮; তদেব, ১৬ অগস্ট, ১৯৩৮; তদেব, ২ অক্টোবর, ১৯৩৮; তদেব, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৮; এম এ জিন্নাহ্, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৬ মে, ১৯৩৮; তদেব, ৬ জুন, ১৯৩৮; তদেব, ২ অগস্ট, ১৯৩৮; তদেব, ৯ অক্টোবর, ১৯৩৮; প্রতিটি রয়েছে বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ১১২-১২২।

২৮. এম কে গাঁধী, “দ্যাট আনফরচুনেট ওয়াকআউট,” হরিজন, ৬ (১৫ অক্টোবর, ১৯৩৮)।

২৯. এন বি খারে, মাই পলিটিক্যাল মেময়্যারস্ (নাগপুর: জে আর জোশি, ১৯৫৯), পৃ: ৪৮-৪৯।

৩০. “অন দ্য ফেডেরাল স্কিম,” বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ৩৯-৪৩।

৩১. সুগত বসু, অ্যাগ্রেরিয়ান বেঙ্গল: ইকনমি, সোশ্যাল স্ট্রাকচার অ্যান্ড পলিটিক্স, ১৯১৯-১৯৪৭ (কেমব্রিজ: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৬), পৃ: ২০৬।

৩২. শরৎচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ১৪ অগস্ট, ১৯৩৭, এ আই সি সি-র কাগজপত্র, ফাইল পি-৫, ১৯৩৭ (এন এম এম এল)।

৩৩. বসু, অ্যাগ্রেরিয়ান বেঙ্গল, পৃ: ২০৬-২১০।

৩৪. মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৮, মহাত্মা গাঁধী, কালেকটেড ওয়ার্কস্, আটষট্টিতম খণ্ড (দিল্লি: গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, ১৯৫৮-১৯৮৩), পৃ: ২১৮; সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৮, বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ১২২-১২৬।

৩৫. সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৮, বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ১২৫।

৩৬. “কংগ্রেস মেডিক্যাল মিশন টু চায়না”; সুভাষচন্দ্র বসু, অমলা নন্দীকে (শংকর) লেখা চিঠি, ১১ নভেম্বর, ১৯৩৮; এস সি বসু, “দি ইউরোপিয়ান ক্রাইসিস: অ্যানালিসিস অব দ্য ডিবাকল”; তদেব“, অন কামাল আতাতুর্ক”; প্রতিটি আছে বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ৩৬-৩৯, ৫৮-৬১, ২৭৯।

৩৭. মহাত্মা গাঁধী, অমৃত কাউরকে লেখা চিঠি, ২৫ জুন, ১৯৩৮, গাঁধী, কালেকটেড ওয়ার্কস্, সাতষট্টিতম খণ্ড, পৃ: ১৩৭।

৩৮. সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীমতী জে ধর্মবীরকে লেখা চিঠি, ২২ মার্চ, ১৯৩৮, বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ২৬০-২৬১।

৩৯. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ২৮ মার্চ, ১৯৩৮; তদেব, ৫ এপ্রিল, ১৯৩৮; তদেব, ৯ এপ্রিল, ১৯৩৮; তদেব, ৯ মে, ১৯৩৮; তদেব, ২০ মে, ১৯৩৮; তদেব, ২৪ মে, ১৯৩৮; তদেব, ২৬ মে, ১৯৩৮; তদেব, ৮ জুন, ১৯৩৮; তদেব, ২৬ জুন, ১৯৩৮; তদেব, ২৭ জুন, ১৯৩৮; তদেব, ৮ জুলাই, ১৯৩৮; তদেব, ১৪ জুলাই, ১৯৩৮; তদেব, ২৭ জুলাই, ১৯৩৮; তদেব, ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮; তদেব, ১৩ অক্টোবর, ১৯৩৮; তদেব, ১৭ অক্টোবর, ১৯৩৮; তদেব, ১৯ অক্টোবর, ১৯৩৮; তদেব, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৮; তদেব, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৩৮; তদেব, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৮; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৮৩-২০৬।

৪০. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৮, তদেব, পৃ: ২০৩-২০৪।

৪১. নেপাল মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: সারস্বত লাইব্রেরি, ১৯৬৮), পৃ: ৯৩-১০৭; গাঁধী, কালেকটেড ওয়ার্কস্, আটষট্টিতম খণ্ড, পৃ: ১৪৪, ১৬১।

৪২. মিলান হাউনার, ইন্ডিয়া ইন অ্যাক্সিস স্ট্র্যাটেজি: জার্মানি, জাপান অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্টস্ ইন দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার (স্টুটগার্ট: ক্লেট-কট্টা, ১৯৮১), পৃ: ৬৪৪-৬৫৩।

৪৩. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৪ জানুয়ারি, ১৯৩৯, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ২০৬-২০৭।

৪৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ নভেম্বর, ১৯৩৮; তদেব, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৮; তদেব, ১৪ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৮; সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠি, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৮; প্রতিটি রয়েছে বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ২৩৬-২৩৯।

৪৫. “টেগোর’স্ কল টু বোস” এবং “বোসে’স রেসপন্স টু টেগোর,” তদেব, পৃ: ২৪০-২৪৬।

৪৬. “দ্য ত্রিপুরী প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন ডিবেট,” তদেব, পৃ: ৬৭-৮৭।

৪৭. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৮৬-৮৭।

৪৮. নৃপেন্দ্রনাথ মিত্র, দি ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার জানুয়ারি টু জুন ১৯৩৯ (কলকাতা: অ্যানুয়াল রেজিস্টার অফিস, ১৯৩৯), পৃ: ৪৫-৪৬।

৪৯. এই টেলিগ্রামগুলি নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো-র মহাফেজখানায় রয়েছে। গুজরাত থেকে আসা একটি টেলিগ্রামে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছিল বিপ্লবী স্রোতে যোগদানে এই প্রদেশের অপারগতার জন্য।

৫০. “স্টেটমেন্ট অব মহাত্মা গাঁধী,” ৩১ জানুয়ারি, ১৯৩৯; “স্টেটমেন্ট অব সুভাষ চন্দ্র বোস, ফেব্রুয়ারি ৪, ১৯৩৯”; দুই-ই আছে বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ৮৭-৯০।

৫১. এম এন রায়, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯, তদেব, পৃ: ২৮০-২৮৩।

৫২. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ২০৮-২০৯।

৫৩. “মাই স্ট্রেঞ্জ ইলনেস,” বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ৯৫-১০১।

৫৪. “দ্য ত্রিপুরী অ্যাড্রেস,” তদেব, পৃ: ৯০-৯৪।

৫৫. “মাই স্ট্রেঞ্জ ইলনেস,” তদেব, পৃ: ১০৩।

৫৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ২৯ মার্চ, ১৯৩৯; মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠি, ২ এপ্রিল, ১৯৩৯; দুই-ই উদ্ধৃত হয়েছে মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র, পৃ: ১৩৩।

৫৭. মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৪ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ২৫ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ২৬ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ৩০ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ৩১ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ১ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ২ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ৪ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ৫ এপ্রিল, ১৯৩৯; সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ২৪ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ২৫ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ২৬ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ২৯ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ৩১ মার্চ, ১৯৩৯; তদেব, ১ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ৩ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ৫ এপ্রিল, ১৯৩৯; প্রতিটি রয়েছে বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ১২৬-১৪৯।

৫৮. সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ৬ এপ্রিল, ১৯৩৯, তদেব, পৃ: ১৪৯-১৫৫।

৫৯. সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ৭ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ১০ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ১৩ এপ্রিল, ১৯৩৯; মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৭ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ১০ এপ্রিল, ১৯৩৯; প্রতিটি তদেব, পৃ: ১৫৬-১৭২।

৬০. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ২৮ মার্চ, ১৯৩৯, তদেব, পৃ: ১৯৩-২১৬।

৬১. তায়া জিনকিন, রিপোর্টিং ইন্ডিয়া (লন্ডন: চাট্টো অ্যান্ড উইন্ডাস, ১৯৬২), পৃ: ২১৭।

৬২. জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৩ এপ্রিল, ১৯৩৯, বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ২১৭-২৩২।

৬৩. জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ১৭ এপ্রিল, ১৯৩৯, নেহরু, সিলেকটেড ওয়ার্কস্, নবম খণ্ড, পৃ: ৫৫৩-৫৫৪।

৬৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৩ এপ্রিল, ১৯৩৯, বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ২৫০।

৬৫. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ১৫ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ২০ এপ্রিল, ১৯৩৯; জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৭ এপ্রিল, ১৯৩৯; সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ১৫ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ২০ এপ্রিল, ১৯৩৯; প্রতিটি তদেব, পৃ: ১৭৩-১৭৬, ১৭৮-১৮০, ২৩৩-২৩৬।

৬৬. সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ২২ এপ্রিল, ১৯৩৯; মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৯ এপ্রিল, ১৯৩৯; দুই-ই তদেব, পৃ: ১৮০-১৮১।

৬৭. “স্টেটমেন্ট অন রেজিগনেশন ফ্রম কংগ্রেস প্রেসিডেন্টশিপ,” তদেব, পৃ: ১০৭-১০৯।

৬৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৩০ এপ্রিল, ১৯৩৯, তদেব, পৃ: ১০৯।

৬৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “দেশনায়ক,” তদেব, পৃ: ২৪৭-২৪৯।

৭০. “মাই স্ট্রেঞ্জ ইলনেস,” তদেব, পৃ: ১০১-১০৬।

৭১. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৪ মে, ১৯৩৯; তদেব, ১৬ জুন, ১৯৩৯; তদেব, ২১ জুন, ১৯৩৯; তদেব, ৪ জুলাই, ১৯৩৯; বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ২১১-২১৫।

৭২. “গ্লিম্পসেস্ অব মাই ট্যুর”; ডা. সত্যপাল, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪০; মিঞা আকবর শাহ্, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০; তদেব, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০; এন জি রঙ্গ, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০; ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০; তদেব, ২ মার্চ, ১৯৪০; স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০; প্রতিটি রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসু, দি অলটারনেটিভ লিডারশিপ: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দশম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৪), পৃ: ২০-৩১, ২০৬-২০৯, ২১১-২১৪।

৭৩. “গ্লিম্পসেস্ অব মাই ট্যুর,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ৩০-৩১।

৭৪. বেঙ্গল প্রভিনশিয়াল কংগ্রেস কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি অ্যান্ড বেঙ্গল কংগ্রেস (কলকাতা: বি পি সি সি, ১৯৪০), পৃ: ১-২০; মিত্র, ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৩৯, পৃ: ২২৪-২২৫, ২৭১-২৭৫; এ আই সি সি-র কাগজপত্র, ফাইল পি-৫, ১৯৩৯-১৯৪০ (এন এম এম এল)।

৭৫. “স্টেটমেন্ট অন ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ৭-৮।

৭৬. “দ্য হাউস অব দ্য নেশন: মহাজাতি সদন,” তদেব, পৃ: ৮-১০।

৭৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতার অডিয়ো এবং ভিডিয়ো রেকর্ডিং (এন আর বি)।

৭৮. “দ্য নিড অব দি আওয়ার,” ২৬ অগস্ট, ১৯৩৯, বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ১৩-১৫।

৭৯. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৯ এপ্রিল, ১৯৩৯; তদেব, ২১ জুন, ১৯৩৯; তদেব, ৬ জুলাই, ১৯৩৯; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ২০৯-২১১, ২১৩-২১৬।

৮০. সুভাষচন্দ্র বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দ্বিতীয় খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ৩৭৯।

৮১. “হার্ট সার্চিং,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ১৮-২০।

৮২. বসু, ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল, পৃ: ৩৮১।

৮৩. মিত্র, ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার, জুন-ডিসেম্বর ১৯৩৯, পৃ: ৪০-৪৫।

৮৪. “প্রেসিডেনশিয়াল অ্যাড্রেস,” ফণিভূষণ চক্রবর্তী (পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত রাজ্যপাল), হরি বিষ্ণু কামাথ-এর নেতাজি-বক্তৃতার পর, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৬৩, বুলেটিন অব দ্য নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, জানুয়ারি ১৯৬৪।

৮৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গাঁধীকে লেখা চিঠি, ডিসেম্বর ১৯৩৯; মহাত্মা গাঁধী, সি এফ অ্যান্ড্রুজকে লেখা চিঠি, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৪০; গাঁধী, ‘দ্য চরখা,” হরিজন, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪০; প্রতিটি আছে গাঁধী, কালেকটেড ওয়ার্কস্, একাত্তরতম খণ্ড, পৃ: ৫০, ৯৪, ১১৩-১১৪।

৮৬. “দ্য কারেক্ট লাইন,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ৫০-৫৩।

৮৭. “অ্যান অ্যাড্রেস টু স্টুডেন্টস্ অব ইন্ডিয়া,” তদেব, পৃ: ৫৮-৬৪।

৮৮. প্রোসিডিংস্ অব দ্য বেঙ্গল লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলি, ৫৫, ৩ নম্বর (১৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৯), ৭১-৮০। শরৎ বসু এখানে রজার কেসমেন্টকে উদ্ধৃত করছেন।

৮৯. “ডেঞ্জার অ্যাহেড,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ৬৪-৬৮।

৯০. “স্টেম দ্য রট,” তদেব, পৃ: ৭২-৭৫।

৯১. “দ্য রামগড় অ্যাড্রেস, ”তদেব, পৃ: ৮৩-৮৮।

৯২. “দ্য নিউ প্যারেড,” তদেব, পৃ: ৯৬-৯৮।

৯৩. আয়েশা জালাল, সেল্ফ অ্যান্ড সভরেনটি: ইন্ডিভিজুয়াল অ্যান্ড কমিউনিটি ইন সাউথ এশিয়ান ইসলাম সিন্স ১৮৫০ (নিউ ইয়র্ক: রটলেজ, ২০০০), পৃ: ৩৯৬-৩৯৯।

৯৪. আবুল মনসুর আহমেদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা: খিশরোজ, ১৯৮৪), পৃ: ১৪৭-১৫০।

৯৫. “কংগ্রেস অ্যান্ড কম্যুনাল অর্গানাইজেশনস্,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ৯৮-১০০।

৯৬. তদেব। আরও দ্রষ্টব্য, সুভাষচন্দ্র বসু, এম এ এইচ ইস্পাহানিকে লেখা চিঠি, ১৪ অক্টোবর, ১৯৪০, তদেব, পৃ: ২২১।

৯৭. আবুল মনসুর আহমেদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃ: ১৫০-১৫৪।

৯৮. “অ্যাক্ট কুইকলি,” বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ১০৩-১০৪।

৯৯. “আ প্রভিশনাল ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট,” তদেব, পৃ: ১০৯-১১১।

১০০. “লং লিভ দেশবন্ধু,” তদেব, পৃ: ১১১-১১২।

১০১. “দ্য নাগপুর অ্যাড্রেস,” ১৮ জুন, ১৯৪০, তদেব, পৃ: ১১৫-১২৬।

১০২. “টাস্ক বিফোর দ্য কান্ট্রি,” ২৯ জুন, ১৯৪০, তদেব, পৃ: ১২৬-১২৮।

১০৩. “হলওয়েল মনুমেন্ট,” তদেব, পৃ: ১২৮-১২৯।

১০৪. কৃষ্ণা বসু, প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৯৩), পৃ: ১৬৭-১৭১।

১০৫. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৪ অক্টোবর, ১৯৪০; তদেব, ৩১ অক্টোবর, ১৯৪০; দুই-ই আছে বসু, অলটারনেটিভ লিডারশিপ, পৃ: ১৫৮-১৬১।

১০৬. “অন দ্য বেঙ্গল কংগ্রেস ট্যাঙ্গল,” তদেব, পৃ: ১৪৪-১৫২।

১০৭. “মাই কনসায়েন্স ইজ মাই ওন,” তদেব, পৃ: ১৪৩-১৪৪।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন