কোষমুক্ত দীপ্ত তরবারি

The enemy has already drawn the sword, He must, therefore, be fought with the sword.

—SUBHAS CHANDRA BOSE, ১৯৪৩

.

“ভারতের জাতীয়তাবাদীরা দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বোস-কে ভারতের জর্জ ওয়াশিংটন বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন,” ১৯৪৬ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস কাগজে লেখা হয়। “বিশেষ করে কংগ্রেস পার্টির বিপ্লবী সদস্যরা সমানেই প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন, এক জলজ্যান্ত ‘বোস-লেজেন্ড’ তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। নেতাজির যাবতীয় বক্তব্য ও বিশ্বাসকে তাঁরা অত্যন্ত মহান বলে দাবি করছেন।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একনাগাড়ে লড়াই চালিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন গোটা ভারতবর্ষেই বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যে চরমপন্থী সদস্যরা ব্রিটিশ রাজের কাছে তখন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলছেন, কেবল তাঁরাই এই নেতাজি-ভক্তির ধারক ও বাহক নন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য নেতাজির সশস্ত্র সংগ্রামের গুরুত্ব সবচেয়ে ভাল করে বুঝতে পারেন মহাত্মা গাঁধী নিজেই। দিল্লির লাল কেল্লায় এই সশস্ত্র সংগ্রামের কয়েক জন নেতার বিচার চলছে তখন, আর সেই সূত্রে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি এবং নেতাজির আশ্চর্য সব কাহিনি। গাঁধী সেই সময় বলেন, “গোটা দেশ জেগে উঠছে, এমনকী সাধারণ সৈনিকরাও নতুন রাজনৈতিক চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে উঠছে, সকলেরই মুখে মুখে ফিরছে একটিই শব্দ: স্বাধীনতা।” এই গাঁধীকে সুভাষ এক দিন ‘জাতির জনক’ বলে প্রণতি জানিয়েছিলেন, আর আজ সেই গাঁধীই নিজের বিপ্লবী সন্তানটিকে সবার সেরা দেশপ্রেমিক বলে উল্লেখ করলেন সর্বসমক্ষে। বললেন, “নেতাজির নামটি যেন মুহূর্তে জাদু তৈরি করে… তাঁর দেশভক্তি অতুলনীয়।” “নেতাজি ও তাঁর সৈন্যদল আমাদের শেখালেন কী ভাবে শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আত্মত্যাগ ও ঐক্য তৈরি করতে হয়, শেখালেন কাকে বলে শৃঙ্খলা,” ১৯৪৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হরিজন পত্রিকায় লিখলেন তিনি।

ইউরোপ ও এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র বেগে। ১৯৪২-এর জুনে মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন মার্কিন সাংবাদিক লুই ফিশার। ভারী অবাক হয়ে গেলেন তিনি এই দেখে যে এমন কঠিন সময়েও ভারতীয়রা কিন্তু মোটেই সব দ্বিধা ভুলে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির হাত শক্ত করার জন্য ব্রিটিশের পাশে দাঁড়াতে রাজি নন! পশ্চিম ভারতের সেবাগ্রামে গাঁধীর গেস্ট হাউস অর্থাৎ বাঁশের চালা দেওয়া এক-ঘরের মাটির বাড়িটিতে ক’দিনের অতিথি হয়ে ছিলেন ফিশার। মহাত্মার সঙ্গে তখন তাঁর অনেক খোলাখুলি কথাবার্তা হয়। গাঁধী তাঁকে বলেন, “ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেও ঠিক একই রকমের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা রয়েছে,”— সেই প্রবণতার সঙ্গে প্রতি দিন যুঝতে হয় ভারতীয়দের। “তোমাদের প্রেসিডেন্ট তো চার রকমের মুক্তির কথা বলেন। কিন্তু তার মধ্যে মুক্ত হতে পারার মুক্তির কথাটা কি বলা হয়? আমাদের বলা হচ্ছে জার্মানি, ইতালি, জাপানের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে। অথচ আমরা নিজেরাই তো সেই গণতন্ত্র পাইনি। তা হলে কেন আমরা লড়াই করব?” কথোপকথনের সময়ে কথাগুলি বললেন নিচু গলায়, কিন্তু ফিশারের প্রশ্নের লিখিত উত্তর যখন দিতে হল তাঁকে, বেরিয়ে এল তীব্রতম উচ্চারণ: “ফ্যাসিস্ট বা নাত্সি শক্তি এবং মিত্রশক্তির মধ্যে কোনও তফাত আছে বলে আমি মনে করি না।” তাঁর ঘোষণা, “সকলেই অত্যাচারী, সকলেই নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য একই রকম নিষ্ঠুর। আমেরিকা ও ব্রিটেন মহান জাতি হতে পারে, কিন্তু এশিয়া বা আফ্রিকার মূক জনসভ্যতার সামনে যখন তারা এসে দাঁড়ায়, তাদের সেই ‘মহত্ত্বে’র এক কণাও অবশিষ্ট থাকে না।” জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ব্রিটেন যতই যুদ্ধ করুক, গাঁধী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, তাঁর যুদ্ধ চলবে উপনিবেশ দেশগুলিকে মুক্ত করার জন্যই।

দুই মাস পর, ১৯৪২-এর ৮ অগস্ট, গাঁধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করল: ব্রিটিশ ‘ভারত ছাড়ো’। সকলকে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ মন্ত্র নিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বললেন মহাত্মা। প্রধান নেতাদের প্রায় সবাইকে জেলে পোরা হল, শহরে গ্রামে সর্বত্র আন্দোলনের উপর চলল কঠোর দমননীতি। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তো ছিলই, এ বার সেই অজুহাত ব্যবহার করে পুলিশের লাঠি একেবারে ভয়াবহ আকার ধারণ করল। রাজনৈতিক অত্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হল মাত্রাছাড়া অর্থনৈতিক শোষণ, ভারতীয় সম্পদের নির্লজ্জ লুণ্ঠন। ১৯৪৩-এর বসন্তকালের মধ্যে দেখা গেল, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শিরদাঁড়া প্রায় ভেঙে পড়েছে, আর জাপানের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির যুদ্ধের একেবারে সামনের সারিতে থাকা পুব ভারতের বাংলা প্রদেশটিতে দেখা দিয়েছে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।— মনুষ্যসৃষ্ট বিশাল এই দুর্ভিক্ষে ধ্বংস হয়ে গেল বাংলার প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ।

এরই মধ্যে এক জাতীয় নেতা কিন্তু ১৯৪১ সালে ব্রিটিশের শেকল ছিঁড়ে পালাতে পেরেছিলেন। এত দিনে তিনি বিদেশের মাটিতে ভারতের স্বাধীনতার পতাকা তুলে ধরার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন। গাঁধীর সঙ্গে কথোপকথনের সময়ে লুই ফিশার গাঁধীকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন এই মানুষটি সম্পর্কেও: যাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। আর এরই উত্তরে গাঁধী সুভাষকে ‘সেরা দেশপ্রেমিক’ বলে উল্লেখ করেন, অবশ্য সঙ্গে এও বলেন যে সুভাষ ‘ভ্রান্তপথগামী’ দেশপ্রেমিক। অতিথির দেখাশোনা করার জন্য গাঁধী নিযুক্ত করেছিলেন কুরশেদ বেন বা ‘সিস্টার কুরশেদ’-কে। এই কুরশেদ হলেন দাদাভাই নওরোজির নাতনি, যে নওরোজি ঊনবিংশ শতকের শেষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক হিসেবে পরিচিত, ব্রিটিশ হাউস অব কমনস্-এর প্রথম ভারতীয় সদস্য। এঁর কাছ থেকে নেতাজি বিষয়ে ফিশার আরও কিছু কৌতূহলপ্রদ তথ্য জানতে পারেন। পনেরো বছর ধরে অহিংস-নীতির প্রধান ধারক গাঁধীজির একনিষ্ঠ শিষ্যা সেই কুরশেদ ফিশারকে বলেছিলেন, “ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতা হিসেবে বোস যদি দেশে প্রবেশ করেন, গোটা দেশ তাঁর পিছনে গিয়ে দাঁড়াবে।” চল্লিশ বছরের এই তেজী ভদ্রমহিলার ভাষায় “নেহরুর থেকেও জনপ্রিয় নেতা বোস, কোনও কোনও দিক থেকে দেখলে গাঁধীর থেকেও জোরদার তাঁর আকর্ষণ।”

১৯৪৩ সালের ৪ জুলাই ভারতের এই ‘ভাবী’ জর্জ ওয়াশিংটন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। পরনে হালকা রঙের স্যুট, গলায় টাই, মাথায় সাদা গাঁধীটুপি— সুভাষচন্দ্র বসুকে দেখে তখন মিলিটারি কম্যান্ডার-এর বদলে বরং কোনও দার্শনিক বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সিঙ্গাপুরে জাপানি-অধিকৃত ক্যাথে থিয়েটারে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ-এর দুই হাজার প্রতিনিধির সামনে যখন তিনি ভাষণ দিতে উঠলেন, তাঁর উচ্চারিত শব্দাবলি যেন মনে করিয়ে দিল ইতালির ঐক্য-আন্দোলনের নায়ক জিয়োসিপ্পি গ্যারিবল্ডি-কে। সুললিত কণ্ঠস্বরে সুকথিত হিন্দুস্থানিতে বললেন তিনি: যাঁরা তাঁকে অনুসরণ করতে প্রস্তুত, তাঁদের তিনি দিতে পারেন কেবল “ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লেশ, বাধ্যতামূলক যুদ্ধযাত্রা এবং মৃত্যু।” তিনি কথা বলে যাচ্ছেন, আর তাঁর আবেগময় কণ্ঠস্বরকে ক্ষণে ক্ষণে ডুবিয়ে দিচ্ছে শ্রোতাদের তীব্র সাড়ার ঢেউ। “দিল্লির লাল কেল্লায় যখন পৌঁছব আমরা, যখন সেখানে চলবে আমাদের বিজয়-কুচকাওয়াজ..” কথা শুরু করেও সুভাষকে থেমে যেতে হল উল্লাসের বজ্রনির্ঘোষের সামনে… ক্রমে উল্লাস কমলে, আবার বাক্যের খেই ধরলেন তিনি, “.. কেউ বলতে পারে না আমাদের মধ্যে কে কে সেখানে থাকবে, ভারতকে স্বাধীন দেখার জন্য আমরা কে কে রইব সে দিন।” “বাঁচি বা মরি, কিছু আসে যায় না,” মনে করিয়ে দিলেন বিপ্লবী নেতা, “একমাত্র যাতে কিছু আসে যায়, আমাদের এগিয়ে চলার একমাত্র লক্ষ্য— ভারতবর্ষের স্বাধীনতা!”

পর দিন সিঙ্গাপুর বন্দরে আবার যখন ভোরের সূর্য উঁকি দিল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের সেটাই “সবচেয়ে গর্বের দিন”। ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই, সাদাসিধে খাকি মিলিটারি ইউনিফর্ম-পরিহিত সুভাষ এসে দাঁড়ালেন সিঙ্গাপুরের স্তম্ভ-সজ্জিত সবুজ-গম্বুজ-শোভিত মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং-এর বারান্দায়। ঝকঝক করছে তাঁর আপাদমস্তক। সামনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সেনারা তখন সারে সারে দাঁড়িয়ে ‘পাদাং’-এর উপর, সিটি হল থেকে যে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ নেমে গেছে সমুদ্রের দিকে, সেখানে। বিশ্বপৃথিবীর সামনে ভারতের এই স্বাধীনতার বাহিনী যে তিনি এনে দিতে পারলেন, এ তাঁর অসীম সৌভাগ্য: বললেন তিনি। ভারতের স্বাধীনতার দিশারীদের উদ্দেশে বললেন, “এমন সেনাবাহিনীর জোরেই আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটন লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন। এমন অস্ত্রসজ্জিত স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল বলেই গ্যারিবল্ডি ইতালিকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন।” ইতিহাস শিখিয়েছে, সাম্রাজ্যের পতন ও ধ্বংস অনিবার্য। তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আই এন এ) নিয়ে তিনি তখন দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল ভূখণ্ডে, যা ক্রমে সাম্রাজ্যের গোরস্থানে পরিণত হবে। সেখান থেকে ভেসে এল অমোঘ সতর্কবাণী: “ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের ক’জন এই স্বাধীনতার যুদ্ধের শেষে প্রাণে বেঁচে থাকব জানি না। কিন্তু এটা জানি যে আমরা শেষ পর্যন্ত জিতব, আর যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের অবশিষ্ট যোদ্ধারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর এক কবরস্থান দিল্লির লাল কেল্লায় গিয়ে বিজয়-কুচকাওয়াজ করছে, ততক্ষণ আমাদের কোনও ছুটি নেই।”

১৮৫৭ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহের সময় ভারতীয় সেনারা দিল্লির শেষ মুঘল বাদশাহের নেতৃত্বে যে ডাক দিয়েছিল, সুভাষও তাঁর সৈন্যদের মুখে সে দিন সেই স্লোগান তুলে দিলেন: ‘চলো দিল্লি’। তাদের অনুপ্রাণিত করতে জাতীয় শুভৈষাবার্তা তৈরি করলেন, ‘জয় হিন্দ্’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী লক্ষ লক্ষ ভারতীয় সাধারণ্যের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তিনি চান “টোট্যাল মোবিলাইজেশন ফর আ টোট্যাল ওয়ার”, সম্মুখসমরের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি। অর্থাৎ মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে অক্ষশক্তির হাত শক্ত করাটাই তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তাঁর উদ্দেশ্য ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করা। এ ভাবে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে যোদ্ধা সংগ্রহ, অর্থ ও অন্যান্য রসদ সংগ্রহের একটিই প্রতিদান তিনি দিতে পারেন: “ভারতের সংগ্রামের একটি সত্যিকারের দ্বিতীয় ফ্রন্ট!” ১৯৪৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রেঙ্গুনে শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধির সামনে প্রতীকী প্যারেড ও প্রার্থনার মাধ্যমে দিল্লির লাল কেল্লা পুনর্দখলের প্রতিজ্ঞা নিল আই এন এ। বাদশাহের একটি উর্দু শায়েরি ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দের: গাজীও মে বু রহেগি যব তলক ইমান কি/ তখ্ত লন্ডন তক চলেগি তেঘ হিন্দুস্তান কি।১০

সে বছরের ২১ অক্টোবর নেতাজি সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের সাময়িক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। ঘোষণাপত্রটি নিজেই লিখলেন, ১৯৪৩ সালের ১৯-২০ অক্টোবর গভীর রাতে। সেই লেখায় ব্যবহৃত হল আইরিশ ও মার্কিন স্বাধীনতা ঘোষণার নানা অংশ।১১ সাময়িক সরকারের হেডকোয়ার্টার সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনে নিয়ে আসা হল ১৯৪৪-এর জানুয়ারির গোড়ায়। ফেব্রুয়ারিতে আরাকান ফ্রন্টে প্রথম বার খানিক লড়াই-এর অভিজ্ঞতার পর আই এন এ প্রবেশ করল উত্তর-পূর্ব ভারতে। ইম্ফল ও কোহিমার দিকে যাত্রা শুরু হল ১৯৪৪ সালের ১৮ মার্চ। মুখে মুখে ‘চলো দিল্লি’ হুঙ্কার নিয়ে আই এন এ-র সেনারা পেরিয়ে এল ইন্দো-বর্মা সীমান্ত। ভারতের মাটিতে অবতীর্ণ হল স্বাধীনতার সশস্ত্র বাহিনী।

দিল্লিমুখী যাত্রা অবশ্য প্রথমেই ধাক্কা খেল ইম্ফলে। ব্রিটিশ সেনা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভারতীয় সেনা, সঙ্গে মার্কিন বিমান-বাহিনী একজোটে প্রায় সাড়ে তিন মাসের চেষ্টায় ভেঙে ফেলতে পারল ইম্ফলে আই এন এ-র ঘেরাও। কোহিমার চারপাশ থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হল জাপানি বাহিনী এবং আই এন এ। ১৯৪৪ সালের অগস্ট মাসের মধ্যে ইম্ফলে যে বিপর্যয় ঘটল, তার ফলে শুরু হল পশ্চাদপসরণের পালা। সেই পশ্চাদপসরণের মধ্যেই আই এন এ-র পশ্চাৎ-বাহিনী বর্মায় কয়েক বার প্রবল আক্রমণ তৈরি করল ১৯৪৪-এর শেষাশেষি আর ১৯৪৫-এর প্রথম ভাগে। নেতাজি নিজে আই এন এ-র সেনাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে পিছনপানে বর্মা থেকে তাইল্যান্ডে পৌঁছলেন। সহযাত্রীদের মধ্যে রইলেন মহিলা যোদ্ধারাও, যাঁদের বাহিনীকে তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের বীরাঙ্গনা রানি লক্ষ্মীবাঈ-এর নামে নামকরণ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে উল্টো পক্ষের ক্রমাগত গোলাবর্ষণের মধ্যে এই হণ্টন অভিযানই বুঝিয়ে দিল কতটাই স্বার্থলেশহীন নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন তিনি। এ দিকে ১৯৪৫-এর অগস্টের শেষ দিকে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পরমাণু বোমায় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল পূর্ব এশিয়ার মহাযুদ্ধ। ভারতের স্বাধীনতালাভের ঠিক দুই বছর বাকি তখন। নেতাজি তাঁর শেষ বার্তা পাঠালেন— তার মধ্যে রইল পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের প্রতি একটি বিশেষ বার্তাও। “দিল্লির রাস্তা এক নয়, অনেক। এখনও দিল্লিই আমাদের লক্ষ্য,” সেনাদের বললেন তিনি। নিজের অসামরিক অনুগামীদের বিশেষ ভাবে মনে করিয়ে দিলেন ভারতের ভবিষ্যৎ জয়ের প্রতি বিশ্বাস না হারাতে, বললেন “ভারত স্বাধীন হবেই, আর সে দিনটি আসবে খুব শিগগিরই।”১২

লাল কেল্লার সেই বিজয়-কুচকাওয়াজ কিন্তু হল। হল ভারী অদ্ভুত ভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম কেমন যেন অসংবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গাঁধী যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা আগেই নিষ্পেষিত করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতের বাইরে থেকে যাত্রারত নেতাজির সশস্ত্র বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করা হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের এই চরম দুঃসময়ে, হাজার হাজার নেতাজির সেনা বন্দি হয়ে এসে পৌঁছলেন দিল্লির লাল কেল্লায়। বিজয়গর্বে প্রজ্বলিত ব্রিটিশ ঠিক করল, এদের মাধ্যমে পরাজিত ভারতীয়দের বেশ একটা শিক্ষা দিতে হবে। শুরু হল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির তিন অফিসারের সরকারি বিচার। মজার ব্যাপার, যে তিন জনকে বেছে নেওয়া হল, নেতাজির নিজের হাতে ছেড়ে দিলেও কিন্তু এই লাল কেল্লা-ত্রয়ীর থেকে ভাল তিন জন প্রতীকী প্রতিনিধি তিনি বাছতে পারতেন না: ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মহাপরাধে বিচার শুরু হল এক হিন্দু, এক মুসলিম এবং এক শিখ যোদ্ধার, যাঁদের নাম প্রেম কুমার সহগল, শাহনওয়াজ খান এবং গুরবক্স সিংহ ধিলোঁ। নেহরু লিখলেন, “এই বিচারের মাধ্যমে সেই চির-পুরাতন সংঘাত যেন নাটকীয় ভাবে মূর্ত হয়ে উঠল: ব্রিটেন বনাম ভারত! আইনকানুনের জটিলতা কিংবা উকিলি দক্ষতা ইত্যাদি কিছুরই কোনও অভাব ছিল না সে দিনের বিচারে, কিন্তু তবু সে সবের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেল এই বিচার। শুরু হল ভারতীয় জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তি আর ভারতের শাসকদের ইচ্ছাশক্তির মধ্যে এক পরোক্ষ যুদ্ধ।”১৩

১৯৪৫ সালের শীত আর ১৯৪৬ সালের বসন্ত জুড়ে চলল এই বিচার-নাট্য। নেপথ্য নায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই যেন সেই নাট্য-কাহিনির চালক। সকলের মুখে মুখে বিজয়ী নায়কের নাম, কিন্তু এই অন্তিম চূড়ান্ত পর্বে কোথাও দেখা গেল না তাঁকে। জানা গেল, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইপে শহরে এক জাপানি বোমারু বিমানের দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিনি। ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার লিখলেন, “নিশ্চয়ই কল্পনা করা যাচ্ছে কী ভয়ঙ্কর উদ্বেগে আমরা রয়েছি, আমরা কেবল যে কোনও প্রকারে নিশ্চিত হতে চাই যে বোস সত্যিই চিরতরে মারা গিয়েছেন!”১৪ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যখন মনেপ্রাণে চাইছিলেন ‘বোস’ যেন ‘চিরতরে মারা’ গিয়ে থাকেন, বেশির ভাগ ভারতীয়ের মনের কথাই তখন উল্টো, তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাইছেন যে তিনি যেন চিরতরে জীবিত থাকেন! ভারতের স্বাধীনতা-প্রাপ্তির সময় আসন্ন, সেই সময়ে সম্পূর্ণ দুই বিপরীতধর্মী আবেগ এত তীব্র ভাবে জ্বালিয়ে দিতে পেরেছিলেন সেই মানুষটি, যাঁর নাম নেতাজি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অতি সাধের ঐশ্বর্য ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর উপর আঘাত হেনেছিলেন তিনি: যে স্পর্ধার জন্য কোনও দিন তাঁকে ক্ষমা করেনি সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে তিনি জার্মানি আর ইতালিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন, ব্রিটেনের শত্রুরা যে সব যুদ্ধবন্দি ধরে এনেছিল, তাদের ভেতর থেকে নিজের বাহিনীর জন্য যোদ্ধা সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৩-এর গোড়ায় জার্মান ও ইতালীয় সাবমেরিনে সুদীর্ঘ সমুদ্র-অভিযানে এসে পৌঁছেছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। মহাযুদ্ধের সময়ে এমন ভাবে অক্ষশক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করায় ও যুদ্ধবিরোধী প্রোপাগ্যান্ডা করায় সমগ্র পশ্চিমি দুনিয়ায় তাঁর ভাবমূর্তি প্রবল ভাবে কলুষিত হয়। উল্টো দিকে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূখণ্ডে নেতাজি হয়ে দাঁড়ান এক অত্যন্ত জনপ্রিয় নায়ক: অন্ধ, অবুঝ ভাবাবেগ তৈরি হয় তাঁকে ঘিরে, প্রায় মহাত্মা গাঁধীর সমকক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ইমেজ।

এক দিকে যোদ্ধা নেতার প্রতি আনুগত্য, অন্য দিকে মহাত্মা সাধুজনের প্রতি শ্রদ্ধা— ভারতীয় মানসিকতায় এই দু’টি আবেগ বড় সহজেই মিলেমিশে যায়। সেই আদি মহাকাব্যের যুগেও, বিশেষত মহাভারতের সময়ে, আমরা দেখেছি কী ভাবে অর্জুনের মতো যে সব মহাযোদ্ধা কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করছিলেন, কত উচ্চ সম্মান তাঁদের দেওয়া হত। বিশ শতকের গোড়ায় এক জাতীয়তাবাদী বলেছিলেন, “ন্যায় ও ধর্মের লক্ষ্যে যুদ্ধে মহাত্মার মহত্ত্বও যতটা প্রয়োজন, যোদ্ধার যুদ্ধ-তরবারিও কিন্তু ততটাই দরকারি।”১৫ ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহে পরাজয়ের পর থেকে ভারতীয়দের বাধ্য হয়ে অস্ত্রত্যাগ করতে হয়, ১৯১৯ থেকে তাঁরা লাভ করেন গাঁধীর অহিংসা ও অসহযোগের অস্ত্র। কিন্তু ১৯৪০-এর দশকে বিশ্বযুদ্ধকালীন সংকটের সময়ে নেতাজি যখন অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র নীতির কথা বললেন, প্রবল উত্সাহ দেখা যায় দেশবাসীর মনে। যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশরা ভারতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বিষয়ে যে কোনও রকম সংবাদের উপর কড়া সেন্সরশিপ চালু করে। কিন্তু লাল কেল্লায় আই এন এ-র সরকারি বিচার শুরু হতে না হতেই জাতীয়তাবাদী খবরের কাগজ ও পত্রপত্রিকা ভরে যায় আই এন এ-র বিজয়গাথায়। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশরা বাধ্য হল প্রায় এগারো হাজার আই এন এ বন্দিকে মুক্তি দিতে। তাঁরা সকলে নিজের নিজের গাঁ-গঞ্জে ফিরে গিয়ে নিজেদের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা চার দিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। বিচারের নামে কয়েক জন আই এন এ বন্দিকে খামোখা সমস্ত ভারতবাসীর চোখের সামনে নিয়ে এসে সাংঘাতিক ভুল করলেন সাম্রাজ্যের শাসকরা।

সুভাষচন্দ্র বসু দুই বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে। প্রথম বার গাঁধীর আশীর্বাদ তাঁর সঙ্গে ছিল, দ্বিতীয় বার গাঁধীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ১৯৩৯ সালে গাঁধীর দেখানো পথ ছেড়ে নিজের পথে হাঁটতে শুরু করলেও ১৯৪২ সালে মহাত্মা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ ডাক দেওয়ার পর থেকে কিন্তু তাঁর সর্বান্তঃকরণ সমর্থন ছিল গাঁধীর প্রতি। এ বার ১৯৪৫-এর নভেম্বরে, ভারতীয় কংগ্রেস স্থির করল লাল কেল্লার বিচারে আই এন এ-কে তারা পুরোদস্তুর সমর্থন করবে। বস্তুত, কংগ্রেসের পক্ষে এই ভাবে নিজের হারিয়ে ফেলা রাজনৈতিক জমির কিছুটা পুনরুদ্ধার করাও সম্ভব হল। কংগ্রেসের হয়ে আইনি নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন দক্ষ অভিজ্ঞ আইন-বিশেষজ্ঞ ভুলাভাই দেশাই, উদারপন্থী রাজনীতির আদর্শের জন্য যাঁর খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। সিকি শতক পরে নেহরুও নিজের গায়ে চড়ালেন ব্যারিস্টারি পোশাক, স্থির করলেন তাঁর বহু কালের কমরেড ও প্রতিদ্বন্দ্বীর (যদিও নেতাজির যুদ্ধকালীন কার্যক্রমের উপযোগিতা বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন) সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন জানাবেন। মামলায় আসামি পক্ষের যুক্তিতে সামরিক বিচারকদের মন গলল না ঠিকই, কিন্তু বিপুল স্বীকৃতি ও উদ্দীপনা দেখা গেল জনতার মধ্যে।

ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন সহগল, শাহনওয়াজ এবং ধিলোঁ। বাদী পক্ষের উকিল যুক্তি দিলেন, “যখন কেউ নামেই রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রকৃতপক্ষে নিজের দেশকে স্বাধীন করার লড়াই লড়ছেন, তখন আনুগত্যের বিষয়টি আদৌ উঠতে পারে কি না, এটাই আসল প্রশ্ন। নিজের আত্মাকে বিক্রি করে না দিলে কি দেশের জন্য লড়াই-কে কেউ অন্য কোনও আনুগত্যের কারণে থামিয়ে রাখতে পারে? আর যদি তা রাখা যায়ও— তাকে চিরস্থায়ী দাসত্ব ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।” দেশাই দাবি করলেন, আই এন এ কিন্তু নেতাজির যথার্থ ভাবে সংগঠিত সরকারের অধীনেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, আন্তর্জাতিক আইন মেনেই যুদ্ধে নেমেছিল।১৬

কেম্‌ব্রিজ-শিক্ষিত সুভাষচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে গাঁধীর স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন ১৯২১ সালে। পরের দুই দশকে যখন দেশ জুড়ে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ, ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয় সেনাবাহিনীর গায়ে কিন্তু তার আঁচ লাগেনি। পৃথিবীতে যেখানে যেমন ভাবে ব্রিটিশ শক্তি তাদের ব্যবহার করতে চাইছে, সেই ভাবেই লড়াই করে যাচ্ছে তারা। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুদ্ধের চরম সমাপ্তিক্ষণে নেতাজি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেন যে ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতি বিশ্বস্ত এই ভারতীয় যোদ্ধাদের আনুগত্যের জায়গাটায় একটা পরিবর্তন আনতে হবে, দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তেমন একটা সুযোগ তাঁর সামনে এনে দিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটেনের শত্রুদেশগুলি তাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে যে সব ভারতীয়কে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হল। সুভাষের বিশ্বাস, দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলনের সঙ্গে যদি দেশের বাইরে থেকেও একটা জোরালো আক্রমণ শানানো যায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তিম ক্ষণ ঘনিয়ে আসবেই।

লাল কেল্লার বিচারে শাহনওয়াজ বলেছিলেন, “নেতাজি যখন সিঙ্গাপুরে এলেন, আমি তাঁকে মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম। আগে তাঁর বক্তৃতা শুনেছি, গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছি। এমন বললেও ভুল হবে না যে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও বক্তৃতা আমাকে প্রায় সম্মোহিত করে ফেলেছিল। আমাদের সকলের সামনে ভারতের একটা সত্যিকারের ছবি তুলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি, জীবনে প্রথম বার যেন আমি এক জন ভারতীয়ের চোখে ভারতবর্ষের রূপটিকে দেখতে পেলাম।” রাওয়ালপিন্ডির জানজুয়া রাজপুত ঘরানার এক পঞ্জাবি মুসলিম পরিবার থেকে এসেছিলেন শাহনওয়াজ, তাঁদের সমাজের ঐতিহ্যই ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে যুদ্ধ করা। তাঁর বাবা ব্রিটিশের চাকরি করেছিলেন তিন দশক ধরে, তাঁর বংশের অন্তত আশি জন সদস্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনা অফিসার ছিলেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই-এ নেতাজির সান্নিধ্যে আসার আগে তাঁর নিজের ভাষাতেই তিনি ছিলেন “রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রায় অশিক্ষিত”, কেবল যুদ্ধবিগ্রহ আর খেলাধুলায় ছিল তাঁর আসক্তি। নেতাজি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন: তাঁর আনুগত্য কি “সম্রাটের প্রতি না কি নিজের দেশের প্রতি?” বিচারসভার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল, “আমি আমার নিজের দেশবাসীর প্রতি অনুগত হব বলেই স্থির করলাম, নেতাজিকে কথা দিলাম, দেশের জন্যই প্রাণ দিয়ে লড়ব।”১৭ ১৯৪৩-এ নেতাজি আই এন এ-কে সম্মোহিত করেছিলেন; আর ১৯৪৬-এ গাঁধী লিখলেন, “আই এন এ যেন আমাদের সকলকে সম্মোহিত করে ফেলল।”১৮

১৯৪৫ সালের ৫ নভেম্বর সহগল, শাহনওয়াজ এবং ধিলোঁর বিচার আরম্ভ হয়ে পরের দিনই দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত হল। এর মধ্যবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল নেতাজির নানা বক্তৃতা, আই এন এ-র সদস্য ও সদস্যাদের বীরত্বের কাহিনি। ২১ নভেম্বর আবার বিচার আরম্ভ হতেই চার দিকে শুরু হল তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন: কলকাতা, বম্বে, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, এলাহাবাদ, বেনারস, পটনা, আরও অনেক শহরে। নেতাজির নিজের শহর কলকাতায় ২১ থেকে ২৪ নভেম্বরের মধ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনা ও পুলিশের উপর চলল যদৃচ্ছ আক্রমণের পালা। এক জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হলেন। ১৮৮ জন আহত হয়েছেন শোনা গেল। ৪৯টি মার্কিন-ব্রিটিশ গাড়ি বিনষ্ট হল। ৯৭টি গাড়ি ভাঙচুর হল। পুলিশের পাল্টা গুলিতে অন্তত ৩২ জন ভারতীয় প্রতিবাদী মারা গেলেন, ১৫০ থেকে ২০০ জন আহত হলেন। রাজনৈতিক নেতারা বার বার জোর দিতে থাকলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বিষয়টির উপর। দেখা গেল একটার পর একটা ট্রাক ভর্তি করে চলেছেন রাজনৈতিক কর্মীরা, তাঁদের পাশাপাশি হাতে ধরা রয়েছে কংগ্রেসের তেরঙা পতাকা আর মুসলিম লিগের সবুজ পতাকা।১৯

অবশ্য, চতুর্দিকের এই নাগরিক বিক্ষোভের থেকেও ব্রিটিশদের বেশি ভাবিয়ে তুলছিল তাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর ভারতীয় অফিসারদের আই এন এ-র বিচার সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া। কলকাতার রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স দৃঢ় ভাষায় ব্রিটিশ সরকারের চরম স্বৈরাচারিতার নিন্দা করল, বিচারাধীন বন্দিদের ভারতের ‘উজ্জ্বলতম রত্ন’ বলে বর্ণনা করল, যাদের ‘মহৎ আদর্শ’ এবং কর্মপন্থা অত্যন্ত প্রশংসার্হ, দেশবাসীর অনুপ্রেরণা-স্বরূপ। বম্বে ও করাচির রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক বিরাট বিদ্রোহের সূচনা করল। ১৯৪৫-৪৬ সালের শীতকালে, উচ্চপদস্থ অফিসাররা গাঁধীর প্রার্থনাসভায় হাজির হলেন, এবং নেতাজির বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর আবাসে গিয়ে দেখা করলেন।

১৯৪৫ সালের শেষ দিনটিতে শেষ হল সেই বিচার। তিন আই এন এ অফিসারকে আদালত যাবজ্জীবন দেশান্তর শাস্তি দিল— ঠিক যে শাস্তিটি দেওয়া হয়েছিল ১৮৫৮ সালে, শেষ মুঘল বাদশাহকে। এই বার অবশ্য সেই শাস্তি বলবৎ করা গেল না। ১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি, ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর কম্যান্ডার-ইন-চিফ ক্লড অকিনলেক সব শাস্তি বাতিল করে তিন বন্দিকে মুক্ত করে দিলেন। আদালতের বাইরে অপেক্ষমাণ জনতা উদ্বেল হয়ে উঠল তিন জনকে বেরিয়ে আসতে দেখে। ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর সিনিয়র অফিসারদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন অকিনলেক, “ওঁদের সত্যিই শাস্তি দিলে গোটা দেশ জুড়ে প্রবল অশান্তি শুরু হয়ে যেত, হয়তো সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হত, সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাঙন ঘটত, ভাঙনের চোটে গোটা বাহিনীকেই হয়তো বানচাল করে দিতে হত।”২০

নেতাজি সম্পর্কে এই যে ধারণা— এক জন যোদ্ধা নায়ক যিনি নিজের বাহিনীর সামরিক পরাজয় সত্ত্বেও দেশের জন্য রাজনৈতিক জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন— এটা কিন্তু তাঁর বহুবর্ণরঞ্জিত ব্যক্তিত্বের কেবল একটিমাত্র দিক। লড়াই-এর ফাঁকে ফাঁকে এই যোদ্ধা স্থিত হয়ে লেখালেখি করতে বসেছেন, কখনও ব্রিটিশের জেলের মধ্যেই লেখার অবকাশ খুঁজে নিয়েছেন, সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন ভারত বিষয়ে তাঁর স্বপ্ন, বলেছেন, স্বাধীন দেশকে তিনি বিশ্বপৃথিবীতে কোন ভূমিকায় দেখতে চান, সেই সব কথা। হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের বাণীতে দীক্ষিত হয়ে প্রথম জীবনেই সুভাষ দরিদ্রসাধারণের জন্য সেবার ধর্মে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের শিক্ষায় সব রকম ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। এই সব বিশেষত্বের কারণেই মহাত্মা গাঁধী তাঁকে এতখানি পছন্দ করতেন, এবং এই বিশেষত্বের জন্যই নেতাজি আজও ধর্মভেদক্লিষ্ট এই দেশের কাছে প্রত্যহ এত প্রাসঙ্গিক। গাঁধী লিখেছিলেন, “আই এন এ তার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলেও গর্ব করার মতো অনেক কৃতিত্বই দেখিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব— দেশের সব ধর্মের সব জাতের মানুষকে এক পতাকার তলায় নিয়ে আসতে পারা, সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে তাদের মধ্যে একত্রতা ও অভিন্নতার বোধ জাগ্রত করা।” অহিংসার আধুনিক দিশারী নেতা চাইলেন, এই উদাহরণ অনুসৃত হোক। ঐক্য যদি কেবল “সশস্ত্র সংগ্রামের রোম্যান্স ও আকর্ষণের” জন্যই অর্জিত হয়ে থাকে, তবে তিনি হতাশ বোধ করবেন। তিনি চান ঐক্যের অনুভূতি “স্থায়ী হোক শান্তির মধ্যে।”২১

ভারতের সমাজ যে ধর্মভেদ ছাড়াও জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ, সব রকমের ভেদে কত প্রবল ভাবে দীর্ণ, নেতাজি তা ভালই জানতেন। জেনেশুনেই তিনি ঠিক করেছিলেন, যারা পশ্চাদ্পর, তিনি থাকবেন তাদেরই সঙ্গে: নিচু জাত, শ্রমিক শ্রেণি, মহিলা— এই তিন নির্যাতিত গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ছিল তাঁর লক্ষ্য। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি কৃষক ও শ্রমিকদের টেনে আনতে চাইতেন, তার জন্য কিছু পরিমাণ শ্রেণি-সংগ্রামেও তাঁর আপত্তি ছিল না।— এইখানেই গাঁধীর সর্বশ্রেণিসমন্বয়ের স্বপ্নের সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের পার্থক্য ঘটে যায়। নিজেকে সাম্যবাদী বলে অভিহিত করতেন নেতাজি: প্রাচীন ভারতের সাম্যের আদর্শের মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্যের ধারণার যে সহাবস্থান, তাতেই ছিল তাঁর বিশ্বাস। ভাবগত দিক দিয়ে তিনি এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক দর্শনে আকৃষ্ট ছিলেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের যে তাত্ত্বিক কাঠামোয় বাস্তবানুগ পরিবর্তনের কোনও অবকাশ নেই, সেই কাঠামোর বদলে ভারতের মাটিতে সমাজতন্ত্রের দেশীয় রূপায়ণের আদর্শে বিশ্বাস করতেন তিনি। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ঘুরে ফিরেছেন বহু বিচিত্র পথ। সেই সব পথে সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ আর কমিউনিজম-এর সাম্যবাদের নানা ঘাত-প্রতিঘাত তখন চলছে ক্রমাগত। সেই দিক দিয়ে দেখলে, বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্ব-ইতিহাসের যত রকম নাটকীয় বৈপরীত্য, সেই সব কিছুর সমাহার ঘটতে দেখা যায় তাঁর একারই জীবনে।

সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যোদ্ধা হিসেবে নেতাজি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তবু তাঁকে অন্ধ জাতীয়তাবাদী বলা যাবে না। জাতীয়তাবাদের অদ্ভুত দু’মুখো রূপটি বুঝতে তাঁর ভুল হয়নি। যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিশীলতা জাগিয়ে তোলে, জনসেবার ব্রতে দীক্ষিত করে তোলে, সেই জাতীয়তাবাদেরই ভক্ত ছিলেন তিনি। ঘৃণা করতেন সেই অন্য জাতীয়তাবাদকে, যা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, স্পর্ধা ও ধ্বংসের মন্ত্রে পরিণত হয়। নাত্সি জার্মানির জাতিবিদ্বেষ কিংবা ১৯৩০-এর জাপানের সামরিক মতবাদ তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ বর্জনীয়, যদিও ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার একমুখী লক্ষ্যে ১৯৪১ সালে তাদেরই সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছিলেন তিনি। মানবসভ্যতার নীতিদর্শন নিয়ে যিনি সর্বদা কথা বলে যেতেন, সেই মানুষটিই আবার ব্রিটেনের শত্রুদেশগুলির নিষ্ঠুরতম অপরাধ বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করতে চাইলেন না, কেননা তাঁর নিজের দেশবাসীর উপর কোনও প্রভাব ফেলেনি সেই সব অপরাধমূলক কাজকর্ম। যে প্রখর আদর্শবাদ সারা জীবন তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, সেই আদর্শবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনীতির বাস্তববাদী বিশ্লেষণ যেন কিছুটা অস্বস্তিকর ভাবে পাশাপাশি বিরাজ করত তাঁর মধ্যে। সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, দেশকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিতে পারবেন, আর তাই দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন বিষয়ে পরিকল্পনাতেও ছিল তাঁর আগ্রহ। ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতবর্ষ হবে শিল্পনির্ভর একটি আধুনিক শক্তি, দারিদ্র ও নিরক্ষরতার অবসান ঘটিয়ে যেখানে আসবে সর্বাঙ্গীণ ব্যবহারিক ও আত্মিক উন্নতি: এই ছিল তাঁর স্বপ্ন।

বিরাট ঝুঁকির পদক্ষেপ করতে যেন সাহসী মানুষটি বিশেষ পছন্দ করতেন। ঠিক যেমন দেখা গিয়েছিল ১৯৪১ সালে ভারত ছেড়ে তাঁর পালানোর মধ্যে, অথবা ১৯৪৩ সালে সাবমেরিন চড়ে ইউরোপ থেকে এশিয়া যাত্রার মধ্যে, অথবা ১৯৪৫-এ জাপানি বম্বার প্লেনে চড়ে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র সন্ধানের সর্বশেষ সিদ্ধান্তটির মধ্যে। নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে তাঁর সম্পূর্ণ উদাসীনতার পরিণাম হল এই যে, যখন তাঁর দেশের তাঁকে সবচেয়ে প্রয়োজন, সেই সময়েই দেশ তাঁকে হারিয়ে ফেলল। সাম্রাজ্যবাদের অবসানের সময়ে যখন দেশভাগের সংকটে গোটা উপমহাদেশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল, সেই সময়ে বোধহয় তাঁর অভাব সবচেয়ে বেশি করে অনুভূত হল। দেশের স্বাধীনতার সেই বিখ্যাত মধ্যরাত্রির মুহূর্তে তিনি উপস্থিত থাকতে পারলেন না। ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার বেইলি ও টিম হার্পার ২০০৪ সালে লিখলেন, “পঞ্চাশ বছর পরে এত দিনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের আধুনিক ইতিহাসে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছেন, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক নেতা হিসাবে অতিবিতর্কিত উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি।”২২ ১৯৯৭ সালের ১৫ অগস্ট, ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে ভারতের সংসদে একটি বিশেষ মধ্যরাত্রি অধিবেশন বসে, যেখানে তিনটি কণ্ঠস্বর বাজানো হয়: গাঁধী, নেহরু ও নেতাজির কণ্ঠস্বর। সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে দীর্ঘ করতালি শোনা যায় নেতাজির কথা ধ্বনিত হওয়ার পরই। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগের হতাশা, ব্যর্থতা তাঁর ভাবমূর্তিকে কলুষিত করতে পারেনি, জনগণের স্মৃতিতে আজও তিনি থেকে গিয়েছেন বিকল্প আশার উৎস হিসেবে।

দেশের সব রকম ধর্মগত, ভাষাগত, জাতিগত বিভেদ অতিক্রম করে যায় তাঁর ভাবমূর্তি, আর সেখানেই নেতাজি-রূপকথার সত্যিকারের ভিত্তি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, যে স্বাধীনতার জন্যই কেউ লড়াই করুন না কেন, সকলেই তাঁর উত্তরাধিকার দাবি করেন, এমনকী যাঁরা ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান, তাঁরাও। ভারতের থেকে আলাদা হতে চান যে সব কাশ্মীরি কিংবা নাগা জঙ্গিরা, তাঁদেরও কেউ কেউ বিশ্বাস করেন তাঁদের দাবির যাথার্থ্য নেতাজি বুঝতে পারতেন।২৩ বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানও উদাত্ত ভাষায় বলে গিয়েছেন নেতাজির “ত্যাগ ও তিতিক্ষার আদর্শের” কথা, কী ভাবে স্থান-কাল-নির্বিশেষে তা স্বাধীনতার পূজারিদের অনুপ্রাণিত করে যাবে, সেই কথা।২৪ নেলসন ম্যান্ডেলা যখন ১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম বারের জন্য ভারতে আসেন, ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধের নেতাদের প্রতি তিনি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। ভারতীয় শ্রোতাদের তিনি বলেন, “আপনাদের সে দিনের নায়করা আমাদের আজকের নায়ক। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্যতম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে আমরা কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররা মনে করতাম, তিনি যেমন আপনাদেরও নেতা, তিনি আমাদেরও নেতা। উপনিবেশ দেশগুলির লড়াকু যুবসম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমরা তাঁর মহান উত্তরাধিকারকে গর্বের সঙ্গে স্মরণে রাখতে চাই, ঠিক যেমন মহাত্মা ও পণ্ডিত নেহরুর উত্তরাধিকারও আমাদের গর্বের ধন।”২৫

১৯৪৩ সালের অক্টোবরে নেতাজি যখন স্বাধীন ভারতের সাময়িক সরকার বা ‘প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট’ তৈরি করছিলেন, সেই সময় একটি প্রতীকী জাপানি তরবারি লাভ করেন তিনি, যাতে খোদাই করা ছিল কয়েকটি শব্দ: “অশুভ বিনাশ করো, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করো।” স্বাধীনতার কুড়ি বছর পর, সেই তরবারি ভারতে নিয়ে আসা হয়। নিয়ে আসেন জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মেজর হিসেবে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। কলকাতায় যখন তরবারিটিকে স্বাগত জানানো হয়, এক মননশীল ব্যক্তি খেয়াল করতে ভোলেন না যে গোটা বিষয়টির মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের এক বহু-দৃষ্ট আশ্চর্য বিশিষ্টতা: ‘আত্মিক সাধনার পথে উদ্বুদ্ধ’ মানুষরা কী ভাবে এখানে সততই জড়িয়ে পড়েন ‘তরবারি সংস্কৃতি’র সঙ্গে।২৬ নেতাজির সেই তরবারি চলল কলকাতা থেকে দিল্লি। হাওড়া স্টেশনের ভিড় বিদীর্ণ করে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল নেতার উদ্দেশে প্রত্যাবর্তনের আর্ত ডাক। রওনা হল ট্রেন। মোগলসরাই, এলাহাবাদ, কানপুর, গাজিয়াবাদ, ছোট ছোট জনপদ— গাঙ্গেয় অববাহিকা ধরে এগিয়ে চলল নেতাজির স্মৃতিচিহ্ন, প্রতিটি জায়গায় দেখা গেল মানুষের বিশাল জমায়েত। দিল্লি স্টেশন থেকে দীর্ঘ শোভাযাত্রা সেই তরবারিটিকে নিয়ে চলল লাল কেল্লার অভিমুখে, মানুষের ভিড় উপচে পড়ল সব ক’টি রাস্তায়। গোটা যাত্রাপথ জুড়ে পথপার্শ্বে বাড়ির বারান্দা কিংবা গাছের উপর থেকে পুষ্পবর্ষণ হল। “আমরা যারা যারা জানতাম নেতাজিকে, আজ সকলে আবেগবিহ্বল হৃদয়ে এখানে সমবেত হয়েছি,” লাল কেল্লার ভাষণে বললেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। বললেন, “তাঁর স্লোগান ছিল ‘দিল্লি চলো’। নিজে তিনি দিল্লি পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু তাঁর তরবারি আজ এখানে এসে পৌঁছেছে, আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন সেই তরবারিকে। ভারতবর্ষের সাহসিকতার মূর্ত রূপ নেতাজি। স্পষ্ট মনে পড়ে, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তাঁর উদ্দীপিত চোখদুটির দিকে তাকালে আমাদের বুকও আশ্চর্য অনুপ্রেরণায় ভরে উঠত। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোন্ অনুপ্রেরণায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করে তুলেছিলেন।”২৭

অবশ্য তরবারির সূত্রেই অনেক সময় নেতাজির জাতীয়তাবাদে বাহুবলের গুরুত্ব বিষয়ে বিভিন্ন রকম অতিসরল ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাঁর চরিত্রের অন্যান্য নরম দিকগুলিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীটিতে “আমার বিশ্বাসের দর্শন” নামক একটি অধ্যায়ে তিনি বলে গিয়েছেন, “মানবজীবনের প্রধান ভিত্তি ভালবাসা।”২৮ অনুগামীরা তাঁকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু ভয় পেত না: এমনই দৃষ্টান্তযোগ্য নেতৃত্ব ছিল তাঁর। সীমাহীন ভালবাসার বিভিন্ন উচ্চারণ দিয়ে তৈরি করতে পারতেন সেই শ্রদ্ধা আর তীব্র বিশ্বস্ততা। যাদের জীবন তিনি স্পর্শ করে গিয়েছেন, তাঁর তিরোধানের বহু দশক পরেও সেই শ্রদ্ধা আর বিশ্বস্ততা তাঁদের মধ্যে ঠিক একই রকম থেকে যায়। ১৯৪৫ সালে মেহবুব আহমেদ ছিলেন নেতাজির তরুণ মিলিটারি সেক্রেটারি— পরবর্তী জীবনে গাঁধী ও নেহরুর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্যও তাঁর হয়েছিল। মহাত্মা ও পণ্ডিতজির মহত্ত্ব স্বীকার করেও তিনি কিন্তু কেবল এক জনের আহ্বানেই নিজের জীবন উৎসর্গ করতে রাজি ছিলেন: যাঁর নাম নেতাজি।২৯ নিজের সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর সময়ে নেতাজি কেঁদে ফেলতেন, তাদের যন্ত্রণা দেখতে গিয়েও তাঁর চোখের জল বাঁধ মানত না। বিদীর্ণচিত্ত আব্রাহাম লিঙ্কনের বিবরণ দিতে গিয়ে কার্ল স্যান্ডবার্গ এক বার লিখেছিলেন “অনেক সময়েই তাঁকে কাঁদতে দেখা যেত, যে কান্নাকে বলা যায় যথার্থ, সুভদ্র, রাজোচিত।”৩০ ঠিক একই কথা নেতাজি সম্পর্কেও বলা সম্ভব।

নেতাজির ট্র্যাজেডির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেক ভারতীয়ই শেষে তাঁর মৃত্যুকেই অস্বীকার করে বসেছেন। রহস্য ও রূপকথায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছে তাঁর জীবনকাহিনির অনেক অংশ। আবার অনেক অংশই গিয়েছে হারিয়ে: আসল মানুষটি কেমন ছিলেন, কোথায় তাঁর সত্যিকারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সে সব উপলব্ধি আজও তৈরি হয়ে ওঠেনি। অথচ তাঁর বিষয়ে যত রূপকথা, তার চেয়ে তাঁর সত্যিকারের জীবনটা কিন্তু অনেক বড়, অনেক রোমাঞ্চকর। যুক্তিবাদী মানুষরা তাঁর মৃত্যু মেনে নিয়েছেন, বোধগম্য কারণেই তাঁরাও মৃত্যুহীন নেতার জন্মদিবস পালনেই বেশি মন দিয়েছেন। নেতাজি নিজে কিন্তু নিজের জন্মদিনটি প্রায়শই ভুলে যেতেন। তবে ১৯৪৫ সালের ২৩ জানুয়ারি তাঁর আটচল্লিশতম জন্মদিনটি তাঁকে ভুলে যেতে দেওয়া হয়নি, অনেক কুণ্ঠার পাহাড় পেরিয়ে তাঁকে সে দিন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে মত দিতে হয়েছিল। কর্মকর্তাদের বলেছিলেন যে “নিজের জন্মদিন পালন করার বিরুদ্ধে তিনি”, জানিয়েছিলেন, “ব্যক্তিবিশেষের বদলে বরং কোনও আদর্শ বা উদ্দেশ্য উদ্যাপন করা উচিত।”৩১ কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভক্তরা যখন মনের মাধুরী মিশিয়ে নেতাজির মূর্তি রচনা করে পুজো করতে বসলেন, সে দিন আর তিনি সেখানে রইলেন না, বাধা দিতে পারলেন না। যে রহস্য-ঘনঘটা তৈরি হল তাঁকে ঘিরে, তাঁর মানবিক গুণাবলি, তাঁর আদর্শের তীব্র মহত্ত্ব যেন ডুবে যেতে বসল তার মধ্যে। নেতাজির অনুপস্থিতিতে ১৯৪৬ সাল থেকে শুরু হল তাঁর জন্মদিবসকে গণ-উৎসবের দিন হিসেবে পালনের ঐতিহ্য, দুপুরে বারোটার একটু পরে শাঁখ বাজিয়ে বাজি পুড়িয়ে জন্ম-মুহূর্তটি স্মরণের ঐতিহ্য, আজও যা একই ভাবে চলছে। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি আততায়ীর হাতে গাঁধীজি নিহত হয়েছিলেন। তার ঠিক সাত দিন আগে নেতাজির জন্মদিন খেয়াল করে তিনি প্রফুল্ল বোধ করেছিলেন, “যদিও সাধারণত এ ধরনের দিনতারিখ তাঁর মনে থাকত না”, “যদিও প্রয়াত দেশনেতা ছিলেন হিংসাপথের পথিক, আর মহাত্মা ছিলেন অহিংসার পূজারি।” মহাত্মার মতে, “সুভাষের মধ্যে কোনও আঞ্চলিকতাবাদ ছিল না, কোনও ধর্ম-সম্প্রদায়-ভেদবোধ ছিল না, কোনও বাছবিচার না করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পুরুষ ও নারীকে নিয়ে এসে অসাধারণ সৈন্যবাহিনী বানাতে পেরেছিলেন তিনি, তাদের মধ্যে প্রেমভাব ও বিশ্বস্ততা জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। খুব কম লোকই এতটা করতে পারত।”৩২

নেতাজির জন্ম হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রখর মধ্যাহ্ন তখন। সাম্রাজ্যের সেই সূর্য যাতে দ্রুত অস্তাচলের দিকে যাত্রা করে, নিজের সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করে তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি।

.

১. নিউ ইয়র্ক টাইমস্, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬।

২. ডি জি তেন্ডুলকর, মহাত্মা: লাইফ অব মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, সপ্তম খণ্ড, ১৯৪৫-১৯৪৭ (নিউ দিল্লি: পাবলিকেশনস্ ডিভিশন, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, ১৯৬২), পৃ: ১১৩।

৩. তদেব, পৃ: ৬৮।

৪. লুই ফিশার, আ উইক উইথ গাঁধী (লন্ডন: জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, ১৯৪৩), পৃ: ৭, ৫৮-৫৯, ৬৩; হরিজন, ১৪ জুন, ১৯৪২।

৫. সুগত বসু এবং আয়েশা জালাল, মডার্ন সাউথ এশিয়া: হিস্ট্রি, কালচার, পলিটিক্যাল ইকনমি (লন্ডন: রটলেজ, ২০০৪), পৃ: ১২৮-১৩২।

৬. ফিশার, আ উইক উইথ গাঁধী, পৃ: ৭, ২৮-২৯, ৫৭।

৭. “যব হাম ফির লাল কিলে দিল্লি পে যা কর ওয়াহা হমারে ভিক্টরি প্যারেড করেঙ্গে…,” ভিডিয়ো এবং অডিয়ো রেকর্ডিং (এন আর বি), সুভাষচন্দ্রর বক্তৃতা, ৪ জুলাই, ১৯৪৩। সুভাষচন্দ্র বসু, “হাঙ্গার, থার্স্ট, প্রাইভেশন, ফোর্সড মার্চেস অ্যান্ড ডেথ,” শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু (সম্পাদিত), বসু, চলো দিল্লি: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দ্বাদশ খণ্ড (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৭), পৃ: ৩৯-৪৪।

৮. “টু দিল্লি, টু দিল্লি,” বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪৫-৪৮।

৯. “হোয়াই আই লেফট হোম অ্যান্ড হোমল্যান্ড,” তদেব, পৃ: ৫১-৫৪।

১০. “অ্যাট বাহাদুর শাহ’জ টুম্ব” এবং “দ্য গ্রেট পেট্রিয়ট অ্যান্ড লিডার,” তদেব, পৃ: ৯৭-৯৯, ২৪৯-২৫৩।

১১. “প্রোক্ল্যামেশন অব দ্য প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট অব ফ্রি ইন্ডিয়া,” তদেব, পৃ: ১১৭-১২০।

১২. “দ্য রোডস্ টু দিল্লি আর মেনি” এবং “ইন্ডিয়া শ্যাল বি ফ্রি,” তদেব, পৃ: ৪০৭-৪১০।

১৩. জওহরলাল নেহরু, “ফোরওয়ার্ড,” মোতি রাম, টু হিস্টোরিক ট্রায়ালস্ ইন রেড ফোর্ট (নিউ দিল্লি: রক্সি প্রিন্টিং প্রেস, ১৯৪৬), পৃ: iii.

১৪. ডব্লিউ ম্যাক রাইট, নয়া দিল্লি, মেজর কোর্টনি ইয়াংকে লেখা চিঠি, ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন, সি.আই.সি.বি, এইচ.কিউ. এস এ সি এস ই এ, সিঙ্গাপুর, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬, নম্বর সি-৫, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, হোম ডিপার্টমেন্ট, নয়া দিল্লি, ফাইল ২৭৩, আই এন এ (এন এ আই)।

১৫. শ্রীঅরবিন্দ, দ্য ডকট্রিন অব প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স (কলকাতা: আর্য পাবলিশিং হাউস, ১৯৪৮; ১৯০৭ সালে রচিত), পৃ: ৮৭-৮৮।

১৬. ভুলাভাই দেশাই, “অ্যাড্রেস অব কাউন্সিল ফর ডিফেন্স, রেড ফোর্ট ট্রায়াল, ১ ডিসেম্বর ১৯৪৫,” দি ওরাকল, ১৫, ৪ নং (অক্টোবর ১৯৯৩), ৩১-৫৫।

১৭. মোতি রাম, টু হিস্টোরিক ট্রায়ালস্ ইন রেড ফোর্ট, পৃ: ১০৯-১১০।

১৮. তেন্ডুলকর, মহাত্মা, সপ্তম খণ্ড, পৃ: ৭৭-৭৮।

১৯. কে কে ঘোষ, দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি: সেকেন্ড ফ্রন্ট অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স মুভমেন্ট (মিরাট: মীনাক্ষী প্রকাশন, ১৯৬৯), পৃ: ২১৫-২১৬।

২০. তদেব, পৃ: ২২৯, ২৩২। শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৮৫), পৃ: ২০০-২০১।

২১. তেন্ডুলকর, মহাত্মা, সপ্তম খণ্ড, পৃ: ১০৭-১০৮।

২২. ক্রিস্টোফার বেইলি এবং টিম হারপার, ফরগটন্ আর্মিজ (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেট্স্ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪), পৃ: ২৯।

২৩. জম্মু এবং কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট-এর ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা, যেমন— আমানুল্লাহ্ খান এবং ইয়াসিন মালিক, সুভাষচন্দ্রর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধার কথা বার বার বলেছেন। একই কথা শোনা যায় ফিজো এবং মুইবাহ্-এর মতো নাগা নেতৃবৃন্দ এবং শ্রীলঙ্কার কিছু তামিল বিদ্রোহীর মুখেও।

২৪. অডিয়ো রেকর্ডিং, শেখ মুজিবুর রহমান, জানুয়ারি, ১৯৭২ (এন আর বি)।

২৫. অডিয়ো এবং ভিডিয়ো রেকর্ডিং, নেলসন ম্যান্ডেলা’র বক্তৃতা, ইডেন গার্ডেনস্ ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কলকাতা, ১৯৯০ (এন আর বি)।

২৬. পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু, সভাপতির ভাষণ, তরবারি উৎসব, ১৯ মার্চ, ১৯৬৭, বুলেটিন অব নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ৯-১০ (১৯৬৮-১৯৬৯), ৬।

২৭. ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী’র বক্তৃতা, লাল কেল্লা, দিল্লি, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬৭, তদেব, পৃ: ১৮।

২৮. সুভাষচন্দ্র বসু, অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, প্রথম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ১২২।

২৯. অডিয়ো এবং ভিডিয়ো রেকর্ডিং, মেহবুব আহমেদ-এর সঙ্গে সাক্ষাত্কার, মে ১৯৯১ (এন আর বি)।

৩০. কার্ল স্যান্ডবার্গ, “লিঙ্কন ডে অ্যাড্রেস টু আ জয়েন্ট সেশন অব কংগ্রেস, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯ (আব্রাহাম লিঙ্কন-এর দেড়শোতম জন্মদিন), রবার্ট সি টোরিসেল্লি এবং অ্যান্ড্রু ক্যারল (সম্পাদক), ইন আওয়ার ওন ওয়ার্ডস্: এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্পিচেস্ অব দি আমেরিকান সেঞ্চুরি (নিউ ইয়র্ক: কোডান্শা, ১৯৯৯), পৃ: ২১৪।

৩১. এস এ আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস্: দ্য স্টোরি অব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ইন সাউথইস্ট এশিয়া (মুম্বই: থ্যাকার, ১৯৫১), পৃ: ১২।

৩২. ডি জি তেন্ডুলকর, মহাত্মা: লাইফ অব মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, অষ্টম খণ্ড, ১৯৪৭-১৯৪৮ (দিল্লি: পাবলিকেশনস্ ডিভিশন, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, ১৯৬৩), পৃ: ২৭৭।

অধ্যায় ১ / ৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন