তারুণ্যের স্বপ্ন
কোনও ভাব বা ধারণা নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করে নেয়। আমরা তো মাটির পুতুলমাত্র, ভগবানের তেজোরাশির কয়েকটি স্ফুলিঙ্গমাত্র আমাদের মধ্যে নিবদ্ধ। আমাদের এই ধারণার কাছে আত্মোত্সর্গ করতে হবে।
—সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে ইনসিন জেল থেকে লেখা চিঠি, ৬ মে ১৯২৭
.
কেম্ব্রিজ থেকে দর্শনে ডিগ্রি শেষ করে, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশের দিকে যাত্রা করলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯২১ সালের ১৬ জুলাই তিনি বম্বে এসে নামলেন। সে দিন বিকেলেই গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে ছুটলেন তিনি মণি ভবনে, বম্বে এসে সাধারণত যেখানে গাঁধী থাকতেন।
ভারতীয় কার্পেটে মোড়া বিরাট ঘরের মাঝখানে বসে আছেন গাঁধী। আর তাঁকে ঘিরে রয়েছেন ঘনিষ্ঠ ভক্তবৃন্দ। সকলেরই পরনে হাতে-তৈরি হাতে-বোনা খাদির পোশাক। গাঁধী তত দিনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতীক হিসেবে চরকাকে গ্রহণ করেছেন। সুভাষ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে নিজের সাহেবি পোশাক বিষয়ে দুঃখপ্রকাশ করে কথোপকথন শুরু করলেন। খানিক পরই অবশ্য মহাত্মার ‘স্বভাবগত আন্তরিক হাসি’ আর উষ্ণ সাহচর্য তাঁকে সহজ করে দিল। বয়সে দ্বিগুণেরও বেশি বড় নেতাকে যেন একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলল কৌতূহলোদ্দীপ্ত অধৈর্য তরুণটির একরাশ প্রশ্ন। কত রকম প্রশ্ন: ১৯২০ থেকে গাঁধী যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কী ভাবে তা ক্রমে গতি বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছবে? কখন সরকারকে সব রকম কর দেওয়া বন্ধ হবে? এই আন্দোলনের সঙ্গে আইন অমান্য যুক্ত হয়ে কী ভাবে বিদেশি শাসকদের ভারতকে স্বাধীনতাদানে বাধ্য করবে? কী ভাবে গাঁধী দেশবাসীর কাছে তাঁর এক বছরের মধ্যে ‘স্বরাজ’ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন?
গাঁধীর কাছ থেকে প্রথম প্রশ্নের উত্তর যা পাওয়া গেল, সুভাষ তাতে সন্তুষ্টই হলেন: শুনলেন কী ভাবে গাঁধী আন্দোলনের গতি বাড়ানোর কথা ভাবছেন। তবে অন্য প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রে ভাসা-ভাসা উত্তর মিলল তাঁর কাছ থেকে, সুভাষ খুশি হতে পারলেন না। নিজেকে বোঝালেন, হয়তো অহিংস আন্দোলনের অধিনায়ক চাইছেন না তাঁর তূণ থেকে সব রকম গোপন অস্ত্রের হদিশ দিয়ে দিতে। নেতৃবরকে সংশয়ের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টায় সুভাষ এমনকী এও ভাবলেন যে তিনি নিজেই হয়তো-বা বুঝতে ভুল করে থাকবেন। তাঁর যুক্তিবুদ্ধি অবশ্য কোথাও তাঁকে বলছিল, গাঁধীর রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে কোথাও একটা ‘দুর্ভাগ্যজনক অস্পষ্টতা’ রয়ে গিয়েছে।১ গাঁধী ও সুভাষের এই প্রথম সাক্ষাৎ থেকেই একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার: মহাত্মার সম্মোহনী ক্ষমতায় অন্যরা যে ভাবে মুগ্ধ হতেন, যে ভাবে ‘গাঁধী মহারাজ কি জয়’ বলে সম্মিলিত ধ্বনি তুলতেন, সুভাষের উপর কিন্তু সেই সম্মোহন ততটা কার্যকর হল না।
আরও এক জন সংশয়বাদী ছিলেন সে দিন, যাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাস্তবিক, রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষ একই জাহাজে ইউরোপ থেকে ভারতে ফিরেছিলেন। যাত্রাপথে কবি ও দেশপ্রেমিক একত্র বসে কংগ্রেসের অসহযোগ নীতি আলোচনা করেছিলেন। ১৯০৫-৮ সালের স্বদেশী আন্দোলনের পর রবীন্দ্রনাথ আর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হননি। সে সময় তিনি দেখেছিলেন, কী ভাবে কোনও সত্যিকারের বিকল্প পথের অভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বয়কট নীতিতে তরুণ কিশোর-সমাজের এক বিরাট অংশের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। এই ভাবে আর কোনও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট না হয়, সেটাই চাইছিলেন তিনি। তা ছাড়া তাঁর এও মনে হয়েছিল, গাঁধীর এই যান্ত্রিক চরকা চালানো চরকা বোনার নীতিতে মানুষের ভাবনা-চিন্তার ক্ষমতা রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলে সুভাষের মনে হল, কবি অসহযোগের ভাবনাটির বিরোধী নন, কিন্তু “কী ভাবে আরও গঠনমূলক কাজের দিকে মন দেওয়া যায়, সেটাই তাঁর উদ্বেগের জায়গা।” সুভাষ ভাবলেন, কবির এই ভাবনার সঙ্গে “আয়ার্ল্যান্ডের সিন ফেইন আন্দোলনের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের সাদৃশ্য আছে”, এমনকী তাঁর নিজের মতামতের সঙ্গেও “তা সম্পূর্ণ ভাবে মিলে যায়।”২ ভারতে আসার পর, রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, গাঁধী যেমন ব্যক্তিগত ভাবে আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের বিরোধী, তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেও সেই বিরোধিতার সুরের প্রভাব পড়ছে। সুভাষের মনে হয়েছিল, এরই উত্তরে রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে ‘শিক্ষার মিলন’ নামে কলকাতায় সেই বিখ্যাত বক্তৃতাটি দেন— শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বয়কট-নীতির বিষয়ে কবি তাঁর গভীর হতাশা প্রকাশ করে বলেন যে, তাঁর মতে এই নীতি বিশ্ব-দুনিয়াময় ভাবনাচিন্তার আদানপ্রদান থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
মহাত্মা গাঁধীর উপদেশ অনুযায়ী, বাংলার শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরলেন সুভাষ। কেম্ব্রিজে থাকতেই সুভাষ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ প্রথমে গাঁধীর অসহযোগের পথ বিষয়ে খানিক সন্দিহান ছিলেন, তবে পরে কংগ্রেস পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোভাব বুঝে এই পথই গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় তিনি বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাই সুভাষকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে হল। ৩৮/২ এলগিন রোডে তাঁর পিতৃভবনের ঠিক পাশে ৩৮/১ নম্বরের ভাড়া বাড়িটিতে মেজদাদা শরৎ, ভ্রাতৃবধূ বিভাবতী এবং তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন সুভাষ। সিভিল সার্ভিসের কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর শরতের অকুণ্ঠ আর্থিক ও মানসিক সমর্থনের উপরই ছিল তাঁর নির্ভর। চিত্তরঞ্জন কলকাতায় ফিরতেই সুভাষ তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। চিত্তরঞ্জন সুভাষের মতো আই সি এস পরীক্ষায় সফল হতে পারেননি, কিন্তু পরবর্তী কালে লন্ডনের ইনার টেম্পল্-এ ওকালতি শুরু করতে পেরেছিলেন। কোনও একটিমাত্র গুণ দিয়েই যদি চিত্তরঞ্জনকে বর্ণনা করতে হয়, তা হলে বলতেই হবে তাঁর অসামান্য উদারতার কথা। কলকাতা হাইকোর্টের রাজকীয় অঙ্কের টাকার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। গাঁধীর মতো তিনিও তরুণদের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারতেন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারতেন। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে কথা বলে সুভাষের মনে হয়েছিল, “এই মানুষটি জানেন তিনি ঠিক কী করতে চান।” কথাবার্তার শেষে সুভাষ “এক জন নেতাকে খুঁজে পেলেন” আর স্থির করলেন, “তিনি এঁরই পদানুসারী হবেন।”৩
১৯২০ সালের ডিসেম্বরের বার্ষিক অধিবেশনে ঘোষিত হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চূড়ান্ত লক্ষ্য: স্বরাজ। ‘শান্তি ও ন্যায়ের পথে’ অর্জন করতে হবে এই স্বরাজ। গাঁধীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, স্বরাজের অর্থ, “সম্ভব হলে সাম্রাজ্যের ভেতরে থেকেই স্বশাসনের অধিকার, অথবা প্রয়োজনে সাম্রাজ্যের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া।” ‘সত্যাগ্রহ’-র সদর্থক ধারণার সঙ্গে ‘অহিংসা’-র নেতিবাচক ধারণা মিলিয়ে তিনি এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ব্রিটিশবিরোধিতার পথ তৈরি করলেন। গাঁধীবাদী কংগ্রেসের এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে পড়ত আইনসভা, বিচার আদালত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ত্রিমুখী বয়কট।
তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট এবং ভাইসরয়ের নাম অনুসারে ১৯১৯-এর সংস্কারের নাম হয় মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার। এই সংস্কারের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় প্রতিবাদ আন্দোলনগুলিকে শান্ত করা এবং ভারতের রাজনীতিকে স্থানীয় ও প্রাদেশিক ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা, যাতে কেন্দ্রীয় স্তরে ব্রিটিশের পক্ষে শক্ত হাতে ক্ষমতা ধারণ করতে অসুবিধা না ঘটে। কেবল তা-ই নয়, এই সংস্কারের মাধ্যমে প্রাদেশিক স্তরেও চালু করা হল ‘ডায়ার্কি’ নামে এক ধরনের দ্বৈত শাসনব্যবস্থা, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলি থাকবে ব্রিটিশ গভর্নর আর তাঁর সিভিল সার্ভেন্টদের হাতে। যে সব ভারতীয় মন্ত্রী প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচিত সদস্যদের থেকে আসবেন, তাঁদের দেওয়া হবে অনুল্লেখযোগ্য কিছু দায়দায়িত্ব। কংগ্রেস এই প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন বয়কট করল, উঠে-পড়ে লাগল যাতে রাজনীতির প্রাদেশিকীকরণের এই সাম্রাজ্যবাদী চালটিকে অকেজো করে দেওয়া যায়। একটি সর্বভারতীয় আন্দোলন তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশের তৈরি এই সব প্রতিষ্ঠানের সীমানা ছাড়িয়ে দেশীয় রাজনীতিকে আরও নানা দিকে প্রসারিত করা সম্ভব হবে।
শাসন-সংস্কারের মূল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ১৯১৯ সালের মার্চে পাশ হল রাউলাট অ্যাক্ট। এই আইনেই শোনা গেল তখনকার যুদ্ধকালীন একটি বিশেষ প্রশাসনিক পদক্ষেপকে শান্তিকালীন আইনে পরিণত করা হচ্ছে, আর সেই আইনের জোরে এখন থেকে যে কোনও ভারতীয়কে বিচার ছাড়াই বন্দি করে রাখা যাবে। এই অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্তাল হয়ে উঠল, আর সেই প্রতিবাদ ঠেকানোর জন্য সে বছরেরই ১৩ এপ্রিল ঘটল পঞ্জাবের অমৃতসর হত্যাকাণ্ড— যাতে অন্তত ৩৭৯ জন নিরীহ পুরুষ, মহিলা, শিশু নিহত হলেন, আহত হলেন ১২০০-রও বেশি। এ হেন অত্যাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলল অসহনীয় অপমান, সরকারি কমিটি অব এনকোয়্যারি এমন অমানুষিক অপরাধের হোতা যাঁরা, তাঁদের শাস্তিবিধান তো করলেনই না, রেজিনাল্ড ডায়ার নামে যে সামরিক অফিসার সেই গুলিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, হাউস অব লর্ডস তাঁকে অভিনন্দনও জানাল। তার উপর, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ তুরস্ক দখল না করা এবং হেজাজ-এর পবিত্র ভূমি অধিকার না করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাও রক্ষিত হল না। ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন ভারতীয় মুসলিমরা। একই সঙ্গে পঞ্জাব অন্যায় ও খিলাফত অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিন্দু ও মুসলিম সমাজে একই সঙ্গে নামল প্রতিবাদের ঢল, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এই তীব্র ক্ষোভকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন গাঁধী।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আর্থ-সামাজিক অসন্তোষের মধ্যে, চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে দ্রুত নিয়ে এলেন তরুণ সুভাষকে। বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রচারের কাজে লাগিয়ে দিলেন তাঁকে, একটি নবগঠিত ‘ন্যাশনাল কলেজে’র প্রিন্সিপালও করে দিলেন তাঁকে। শীঘ্রই দেখা গেল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লেখালেখিতে সুভাষ কতটাই পারঙ্গম, লেখক ও সম্পাদক দুই ভূমিকাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। তবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছাত্রদের বার করে এনে জাতীয় শিক্ষার অঙ্গনে যুক্ত করার লক্ষ্য ততটা সফল হল না। ১৯২১ সালের গ্রীষ্ম ও শরত্কাল জুড়ে বিলিতি কাপড়ের বহ্নিযজ্ঞের আগুন যত তীব্র শিখায় জ্বলল, সুভাষ এবং অন্যান্য জাতীয় নেতাদের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও জাতীয় শিক্ষার দীপটি তত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলল না। শীতকাল কাছে আসতে শোনা গেল প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ভারত সফরে আসার খবর। সংঘর্ষের আগুনে আরও খানিকটা ইন্ধন জোগাল। হরতালের ডাক দিল কংগ্রেস, সাধারণ ধর্মঘটের দিন স্থির হল ১৭ নভেম্বর, ১৯২১, মুম্বই-তে যে দিন ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারের এসে পৌঁছনোর কথা। মুম্বই-এর রাস্তায় সে দিন বিরাট সংঘর্ষ বেধে গেল দুই দলের মধ্যে, এক দিকে যাঁরা যুবরাজকে স্বাগত জানাতে চাইছিলেন, আর এক দিকে যে সব মানুষ যুবরাজকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে কংগ্রেস ভলান্টিয়াররা গোটা কলকাতা শহর স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হলেন। সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। প্রত্যাঘাত হিসেবে সমস্ত জাতীয় ভলান্টিয়ার গোষ্ঠীগুলি বেআইনি বলে ঘোষিত হল।
অসহযোগীরা স্থির করলেন, এই সরকারি নিষেধাজ্ঞার দৌড় খতিয়ে দেখতে কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় গাঁধীর আন্দোলনের প্রতীক খাদির কাপড় বিক্রি করার জন্য ছোট ছোট ভলান্টিয়ার দল তৈরি হবে, এক এক দলে থাকবে জনা-পাঁচেক লোক। আন্দোলনে গতি আনার জন্য চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর স্ত্রী-কে এমনই একটি দলের নেত্রী করে দিলেন, সরকারি গ্রেফতার আহ্বান করার জন্যই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। সুভাষ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু সে প্রতিবাদ মান্য করা হল না। দেশবন্ধুর সম্মানিতা সহধর্মিণীকে ধরে জেলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে উদ্বেল হয়ে উঠল সারা শহর, এমনকী নরমপন্থী নেতারা আর পুলিশ কনস্টেবলরাও মহা বিচলিত হয়ে পড়লেন। মধ্যরাত্রের মধ্যেই অবশ্য বাসন্তী দেবীকে ছেড়ে দেওয়া হল, আবেগ-অভিভূত সুভাষ শান্ত হলেন। বাসন্তী দেবী ছিলেন তাঁর মায়ের সমান।৪ তাঁকে গ্রেফতার করে সাম্রাজ্যবাদী সরকার যে ভুল করে, তার মাসুল হিসেবে পরের দিন গোটা শহর একেবারে ভরে গেল ভলান্টিয়ারের ভিড়ে। শহরের বড় দুটি জেলখানায় তিলধারণের স্থান রইল না। অস্থায়ী বন্দিশিবিরগুলিরও একই অবস্থা হল। ১০ ডিসেম্বর ১৯২১-এ আশঙ্কিত সরকার চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করল। এই প্রথম সুভাষ জেলে প্রবেশ করলেন, তাঁর এগারোটি জেলযাত্রার প্রথম যাত্রা এটাই।
“সুভাষের জন্য আমরা গর্বিত, তোমাদের সকলের জন্যই গর্বিত,” ১৯২১-এর ১২ ডিসেম্বর জানকীনাথ বসু শরত্কে লিখলেন। ছেলের আই সি এস চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে যে বাবা ভয়ানক বিরোধিতা করেছিলেন, সেই বাবাই এ বার ‘আত্মত্যাগের আদর্শে’ আস্থা জানালেন।৫ সেই প্রথম জেলবাসের গোড়ার আটটি মাস সুভাষ অত্যন্ত ভক্তি-সহকারে তাঁর পিতৃসম চিত্তরঞ্জন দাশের সেবাযত্ন করলেন। অন্যান্য জেলবাসীরা রসিকতা শুরু করল যে, সি আর দাশ জেলের মধ্যে এক জন আই সি এস রাঁধুনি পর্যন্ত নিজের জন্য নিয়োগ করে ফেলেছেন। একত্র জেলবাসের এই ঘনিষ্ঠ সংযোগের সুযোগে সুভাষ দেশবন্ধুকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারলেন। এক জন উদারহৃদয়, অনুপ্রেরণাময় নেতাকে খুঁজে পেলেন। ১৯২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলস-এর কলকাতা সফরে আসার কথা। তার ঠিক আগেই ভারতের ভাইসরয় লর্ড রিডিং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য জেলে তাঁর এক দূতকে পাঠালেন। বললেন, যদি বয়কট তুলে নেওয়া হয়, তা হলে তার পরিবর্তে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে, এবং ভারতের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক আলোচনার গোলটেবিলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তরুণ অগ্নিপুত্র বিপ্লবীরা, সুভাষও, এই সন্ধিচুক্তিতে আপত্তি জানালেন। চিত্তরঞ্জন দাশ অবশ্য তাদের বোঝালেন, গাঁধী বছরের শেষের মধ্যে যে স্বরাজ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার চিহ্ন কিন্তু আপাতত কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বরং আলোচনার টেবিলে বসতে যদি কংগ্রেস রাজি হয়, তা হলে স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে যে তারা এগোতে বদ্ধপরিকর, সেই কথাই প্রমাণিত হবে। জেল থেকেই চিত্তরঞ্জন ভাইসরয়ের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অনুরোধ করে গাঁধীকে এক বার্তা পাঠালেন। গাঁধী কিন্তু টললেন না।৬ বছর শেষ হয়ে এল। সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে নিয়ে আসার বিরাট সাফল্য দেখাতে পেরেছিল সেই বছরটি। কিন্তু স্বাধীনতা তখনও কেবল বহুদূরবর্তী স্বপ্ন-মাত্র।
১৯২২-এর গোড়ায় গাঁধী ঘোষণা করলেন, ফেব্রুয়ারির শেষে আন্দোলনের চরম পর্ব শুরু করবেন তিনি: সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করা হবে। তাঁর নিজের প্রদেশ গুজরাতের বারদৌলি জেলা থেকে শুরু হবে সেই কার্যক্রম। কিন্তু ১৯২২-এর ৫ ফেব্রুয়ারি এল উত্তর ভারতের যুক্তপ্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম চৌরি চৌরার সেই খবর, বিদ্রোহী মানুষ একটি পুলিশ থানায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ২১ জন পুলিশ। এই হিংসাকাণ্ডের জেরে গাঁধী তত্ক্ষণাৎ একার সিদ্ধান্তে অসহযোগ আন্দোলনের অবসান ঘোষণা করলেন। অন্যান্য নেতারা তখন জেলে, তারা অসম্ভব হতাশ হয়ে পড়লেন। চিত্তরঞ্জন একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন, তাঁর মনে হল বিনিময়ে কিছু আদায় না করেই গাঁধী তাড়াহুড়ো করে আন্দোলনে দাঁড়ি টানলেন। এত দিন ব্রিটিশ সরকার গাঁধীকে গ্রেফতার করার সাহস দেখায়নি। এ বার, ১৯২২ সালের ১০ মার্চ গাঁধীজিকে আমদাবাদের জেলে নিয়ে যাওয়া হল, তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনা হল, অভিযোগের ভিত্তি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ— সুভাষের মতে যে প্রবন্ধগুলি “তাঁর এ যাবৎ কালের মধ্যে শ্রেষ্ঠ লেখা, ভবিষ্যতেও যা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনার মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হবে।”৭
যে প্রবন্ধাবলি সুভাষকে এতখানি মুগ্ধ করেছিল, আর ঔপনিবেশিক প্রভুদের এতখানি চটিয়ে দিয়েছিল, কী বক্তব্য ছিল তার? সেই সময়ে মহম্মদ আলি ও শওকত আলি ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ না করার জন্য ভারতীয় সৈন্যদের যে ডাক দিয়েছিলেন, গাঁধী তার সমর্থন জানান এই লেখাগুলিতে। ১৯২১-এ সেপ্টেম্বরে গাঁধী ঘোষণা করেন, “আমার এ কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই— এই যে সরকার ভারতের মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, পঞ্জাবে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সেই সরকারের হয়ে যে কোনও রকম কাজ করাই পাপ, সে সাধারণ নাগরিকদের জন্যই হোক, আর সেনাবাহিনীর জন্যই হোক।” সময় এলে তিনি এও বলবেন, গুলি “খেয়ে মরতে হলেও আমি প্রতিটি ভারতীয় সিপাহীকে এই চাকরি ছেড়ে দিতে বলছি, তার বদলে চরকা কেটে দিনযাপন করতে বলছি।” কেন এ কথা বলছেন তারও ব্যাখ্যা দিলেন তিনি,
এই সিপাহীদের ব্যবহার করেই কি ভারতকে পদানত রাখা হয়নি? এদের দিয়েই কি জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরীহ মানুষদের নিধন করা হয়নি? চাঁদপুরের সেই কালান্তক রাতে এদের ব্যবহার করেই কি সাধারণ পুরুষ, মহিলা, শিশুদের হটিয়ে দেওয়া হয়নি? এই সিপাহীদের সাহায্য নিয়েই কি মেসোপটেমিয়ার মর্যাদাসম্পন্ন আরবদের অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করা হয়নি? মিশরীয়দের পরাজিত করা হয়নি? যে কোনও ভারতীয়ের মনে যদি এতটুকুও মনুষ্যত্ব থাকে, কোনও মুসলমানের মনে যদি তার ধর্ম নিয়ে এতটুকুও গর্ব থাকে, তবে তার পক্ষে কি আলি ভাইরা যেমন বলছেন, তার থেকে আদৌ আলাদা রকম ভাবা সম্ভব? দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রাণরক্ষা বা মানরক্ষার কাজে না লাগিয়ে ভারতীয় সিপাহীদের যেন ভাড়াটে খুনির মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।৮
প্রায় ছয় মাস ধরে ক্রমাগত এই তীব্র সমালোচনা সহ্য করতে বাধ্য হল ব্রিটিশরা। “এই সরকারের ক্ষমতাকে আমরা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি কারণ আমরা মনে করি এই সরকারের কাজকর্ম অন্যায় অপরাধের পর্যায়ে চলে গিয়েছে,” আর একটি প্রবন্ধে লিখলেন গাঁধী। “এই সরকারকে আমরা ফেলে দিতে চাই।” আরও একটি লেখায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বর্ণনা দিলেন এই ভাবে: “বিশ্বের যে সব জাতি শারীরিক ভাবে দুর্বল, তাদের নিষ্পেষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই সাম্রাজ্য, পশুশক্তির অবিশ্রান্ত প্রদর্শনের উপরই এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি।” “বিশ্বপৃথিবীতে যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন” তা হলে এমন বস্তু বেশি দিন টিঁকতে পারে না।৯ এই তীব্র স্পষ্ট সমালোচনার দাম গাঁধীকে দিতে হল। ব্রিটিশ বিচারক তাঁকে জেলে পাঠালেন, পুণার ইয়েরাভদা জেলে তাঁর ঠাঁই হল।
এ দিকে জাতীয়তাবাদীদের পরবর্তী কার্যপদ্ধতি বিষয়ে চিত্তরঞ্জন দাশ যে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন, কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে সুভাষও তাতে অংশ নিচ্ছিলেন। চিত্তরঞ্জনের বক্তব্য, গাঁধী গণ-আন্দোলন এ ভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পর আইনসভা বয়কট করার আর কোনও অর্থ হয় না। কেবল ব্রিটিশ-ভক্ত রাজনীতিকরাই তা হলে আইনসভার আসনে থেকে যাবেন। সুতরাং, তিনি রণকৌশলের পথটা পাল্টানোর কথা ভাবলেন, প্রস্তাব দিলেন, তার চেয়ে বরং আইনসভায় প্রবেশ করে ভিতর থেকে অসম্পূর্ণ সংস্কারগুলির ভণ্ডামির মূলে আঘাত হানা দরকার। কিন্তু সুভাষ সে কাজ নিয়ে এগোনোর আগেই উপস্থিত হল আর এক সংকট, রাজনীতি তাঁর কাছে তখন অপ্রধান হয়ে গেল। জেলবাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুভাষ আর তাঁর চারপাশে জড়ো-হওয়া তরুণ কর্মীরা ছুটলেন উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে: সেপ্টেম্বরের শেষে ভয়ানক বন্যায় সেখানে তীব্র দুরবস্থা দেখা দিয়েছে। সমাজসেবার কাজে সব সময়েই সুভাষ সবচেয়ে আগে ছুটে যেতেন। এক হাজার কংগ্রেস ভলান্টিয়ার জোগাড় করে তিনি বন্যা-কবলিত জেলাগুলিতে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে ত্রাণকর্ম পরিচালনা করলেন। যে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা দুর্দশাগ্রস্ত গ্রামবাসীদের বাঁচালেন, বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনও তার প্রশংসা না করে পারলেন না।১০
১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ গয়া বার্ষিক সম্মেলনে তাঁর রাজনৈতিক পথ-পরিবর্তনের প্রস্তাবটি পেশ করলেন। ‘নো-চেঞ্জার’দের অনেকেই তাঁর আইনসভার ভিতর থেকে কাজ করার পরিকল্পনা নাকচ করে দিল, তাঁদের মতে গাঁধী যেমন চাইছেন সেই ভাবে প্রতিষ্ঠানগুলির বয়কটই শ্রেষ্ঠ পথ। কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে চিত্তরঞ্জন পদত্যাগ করলেন। তার কিছু পরেই, উত্তর ভারতের কংগ্রেসের নেতা মোতিলাল নেহরু ও তিনি একত্রে তাঁদের সক্রিয় রাজনীতির পথে চলার আদর্শ নিয়ে নতুন স্বরাজ পার্টি তৈরি করলেন। ১৯২৩ বছরটি ধরে চিত্তরঞ্জন আস্তে আস্তে কংগ্রেসের কিছু সমর্থন ফিরে পেলেন, এবং সে বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ‘প্রো-চেঞ্জার’ ও ‘নো-চেঞ্জার’দের মধ্যে সমঝোতা তৈরি হল। স্থির হল, সি আর দাশ ও মোতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে স্বরাজ পার্টির ব্যানারের তলায় কংগ্রেস সদস্যরা আইনসভার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। আর গাঁধীর সমর্থকরা চরকা চালনাতেই মনোনিবেশ করলেন, গ্রামে গ্রামে সাংগঠনিক কাজ করতে লাগলেন।
১৯২৩ সালে বাংলার আইনসভার যে নির্বাচন হল, তাতে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই সমর্থন-পুষ্ট স্বরাজিরা খুব ভাল ফল করলেন। সি আর দাশের নেতৃত্বে তাঁরা সমালোচনার ঝড় বওয়াতে লাগলেন, প্রধান বিষয়ে ভোটাভুটিতে সরকারকে হারিয়ে দিতে পারলেন। আইনি সিলমোহর ছাড়া যে সব সংস্কার চলছিল, ব্রিটিশ গভর্নর আদেশ জারি করে সেগুলি পাশ করিয়ে নিতে বাধ্য হলেন, যার ফলে ১৯১৯ সালের গোটা সংস্কার-পদ্ধতিটিই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। স্বরাজি এবং কংগ্রেসি, দুই পরিচয়েই সুভাষ প্রবল উত্সাহের সঙ্গে কাজ করতে লাগলেন। ‘বাংলার কথা’ নামে পত্রিকাটি সম্পাদনা করা ছাড়াও তিনি একটি নতুন ইংরেজি সংবাদপত্রিকা শুরু করলেন, নাম দেওয়া হল ‘ফরোয়ার্ড’। ১৯২৩-এর শরৎকালে এই পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতার জগতে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেল। একই সময়ে তিনি বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার বিশেষ পরিচয় মিলল এই নতুন দায়িত্বের মধ্যে।
সংশোধিত কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন (১৯২৩) অনুসারে কলকাতা কর্পোরেশন নামক নগর-প্রশাসনের নির্বাচনী ভিত প্রস্তুত হল। ১৯২৪ সালে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রসার বাড়ানো হল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার পরিমাণও বাড়ল। স্বরাজিরা নির্বাচনে লড়ার জন্য প্রতিনিধির খোঁজ করতে লাগলেন, হাজার হোক ভারতের সবচেয়ে বড় মিউনিসিপ্যালিটির ভোট বলে কথা। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনই তাঁদের দখলে এল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হলেন, আর এক প্রতিশ্রুতিমান তরুণ মুসলিম রাজনীতিক হুসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি হলেন ডেপুটি মেয়র। শরৎচন্দ্র বসু অল্ডারম্যান নির্বাচিত হলেন। আর সাতাশ-বছর বয়সী সুভাষকে চিত্তরঞ্জন সমগ্র মিউনিসিপ্যাল প্রশাসনের প্রধান এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিয়োগ করলেন। প্রথমে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধাবোধ করলেও সুভাষ শেষ পর্যন্ত তাঁর নেতার আদেশই শিরোধার্য করে নিলেন, তবে শর্ত হল, তাঁর মাইনের অর্ধেক তিনি দান করবেন সমাজসেবার কাজে।
প্রবল ঐকান্তিকতার সঙ্গে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুভাষ। তবে এত দিনে সেটা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিলেন, সারা শহরে অনেকগুলি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন, প্রতিটি অঞ্চলে তৈরি হল স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট বলে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার পরিকল্পনা করলেন, সেই বছরেরই শেষের দিকে তার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল। পরিকাঠামো নির্মাণে দেখা গেল তাঁর সক্রিয় উৎসাহ— জল, আলো, রাস্তা— আর এই সব নাগরিক প্রশাসনের ব্যাপারে যে ভারতীয়রাই নিজেদের সরকার নিজেরা চালাতে অত্যন্ত বেশিমাত্রায় পারদর্শী, সেটা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন তিনি। তাঁর দায়িত্বের গুরুত্বটা যে তাঁর কাছে কেবলই প্রতীকী নয়, ব্রিটিশ ভাইসরয় কিংবা গভর্নরদের বদলে জাতীয়তাবাদী নেতাদের সংবর্ধনা জ্ঞাপনের ব্যবস্থাপনার বাইরে অন্যান্য কাজেও সেটা বেশ বোঝা গেল।
তবে কলকাতার এই জাতীয়তাবাদী জয়ের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এই জয়ের নেপথ্যে থাকা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। বাংলার জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের কিছু বেশি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা, পেশাগত জীবন, সরকারি চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও সুযোগের দিক থেকে তারা হিন্দুদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। এই অসাম্য দূর করাটা যেন চিত্তরঞ্জন দাশের একটা ব্রত ছিল। ব্রিটিশদের কাছ থেকে জাতীয়তাবাদীরা যতটুকু ক্ষমতা ও প্রতিনিধিত্ব ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে তার একটা সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে তিনি একটি প্যাক্ট বা চুক্তির প্রস্তাব আনলেন। ১৯২৩-এর ডিসেম্বরে কোকনদে কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় তাঁর সেই চুক্তির প্রস্তাব বাতিল হল। কিন্তু সিরাজগঞ্জে বাংলার প্রাদেশিক কনফারেন্স-এ ১৯২৪ সালের মে মাসে সেই প্রস্তাব গৃহীত হল। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর নেতার সেই প্রস্তাব কার্যকর করতে শুরু করলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে অনুপাতের অধিক সংখ্যক মুসলিমকে চাকরি দিয়ে রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দু সমাজের যথেষ্ট বিরাগভাজন হলেন। সমালোচনার জবাবে তিনি বললেন, অতীতে হিন্দুরা এই সব চাকরির ক্ষেত্রে “প্রায় এককাট্টা অধিকার” কায়েম করে ফেলেছিল, এখন হিন্দুদের চিত্তদাহ উপস্থিত হলেও কিছু করার নেই, তিনি যে করে হোক মুসলিম, খ্রিস্টান ও অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত মানুষের “ন্যায্য অধিকার” সমর্থন করবেন।১১ চিত্তরঞ্জন দাশ এবং গাঁধীজি দু’ জনেই ত্বরিতে তাঁকে সমর্থন জানালেন। ইয়ং ইন্ডিয়া-র পাতায় গাঁধী লিখলেন, “দেখতে পাচ্ছি, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান এক্সিকিউটিভ অফিসারের দিকে বেশ ভাল রকম আক্রমণাত্মক সমালোচনা বর্ষিত হচ্ছে, কেননা তেত্রিশটি পদের পঁচিশটিই তিনি মুসলমানদের দিয়েছেন। প্রধান এক্সিকিউটিভ অফিসারের বক্তব্য আমি পড়েছি। এটা একটা প্রশংসনীয় কাজ হয়েছে বলতে হবে। হিন্দুরা যদি ভারতকে স্বাধীন করতে চায়, তবে তাদের মুসলমান ও অন্যান্য ভ্রাতৃসম সমাজের জন্য অনেকখানি আত্মত্যাগ করতে হবে।”১২ অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি ন্যায়বিচারের বোধ সুভাষের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, পরবর্তী কালে রাজনৈতিক জীবনে এই কারণেই সংখ্যালঘুদের বিশেষ আস্থা তিনি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯২৪-এর গ্রীষ্ম ও শরৎ কাল জুড়ে সুভাষ রাজনীতি ও প্রশাসনিক কাজে মগ্ন হয়ে থাকলেন। তত দিনে তাঁর বাবা-মাও তাঁর জীবনপথ নির্বাচন সমর্থন করতে শুরু করেছেন। মেজ দাদা শরতের পরিবারের সঙ্গে থাকতে সুভাষের বেশ ভালই লাগছিল, বাকি পরিবারও কাছাকাছিই বসবাস করতেন। চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতেও তিনি আর এক আশ্রয় খুঁজে পেলেন, এবং চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে মায়ের মতো দেখতে লাগলেন। পরিশ্রান্ত ক্লান্ত দিনের শেষে রাতের দিকে তিনি তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হতেন, ভাতে-ভাত খেতে চাইতেন।১৩ তবে এত সুখ কি আর সয়, বিশেষত সেই মানুষের পক্ষে, জীবনে কেবল অনির্দিষ্ট অ্যাডভেঞ্চারের পথই যিনি বেছে নিয়েছেন।
১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে সুভাষের ঘুম ভাঙিয়ে জানানো হল, কয়েক জন পুলিশ অফিসার এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বললেন, “মিস্টার বোস, একটা খারাপ কাজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছি আমি, ১৮১৮ সালের রেগুলেশনের ৩ নম্বর ধারা অনুসারে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”১৪ একশো বছরেরও বেশি পুরনো এই আইন অনুযায়ী ঔপনিবেশিক কর্তারা প্রজাদের বিনা বিচারে অনির্দিষ্ট কাল বন্দি করে রাখতে পারতেন, কী কারণে গ্রেফতার করা হল, সর্বসমক্ষে সেটা বলার দায়ও থাকত না। অস্ত্রশস্ত্র, বোমা, বিস্ফোরক দ্রব্যের খোঁজে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হল। তেমন কিছু পাওয়া গেল না। কিছু কাগজপত্র আর চিঠি বাজেয়াপ্ত করেই পুলিশকে সন্তুষ্ট থাকতে হল। ওই একই দিনে পুলিশি গ্রেফতারের কবলে পড়লেন আরও সতেরো জন, তার মধ্যে বাংলার আইনসভার স্বরাজি সদস্যও ছিলেন। গোয়েন্দা বিভাগের গোপন তথ্য অনুযায়ী, সুভাষই “বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান সংগঠক,” তাঁর সঙ্গে নাকি “বলশেভিক প্রচারকদেরও” যোগাযোগ।১৫ কমিউনিস্ট সংযোগের এই তথ্য অবশ্যই ভিত্তিহীন। বস্তুত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে চিত্তরঞ্জন দাশ তাতে কর্ণপাত করেননি। স্বরাষ্ট্র বিভাগের নিজস্ব ফাইলপত্র অনুযায়ী, চিত্তরঞ্জনের পিছনে “সন্ত্রাসবাদী সমর্থন” ছিল, স্বরাজ পার্টির সন্ত্রাসপন্থী সদস্যরা সুভাষের কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান এক্সিকিউটিভ অফিসার হওয়ার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।১৬ তিনটি ব্রিটিশ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্রের মতে, একটি বিপ্লবী ষড়যন্ত্র পরিকল্পনার পিছনে ছিল তাঁরই “মস্তিষ্ক”। বিরক্ত সুভাষ শরত্কে তাঁর হয়ে মানহানির মামলা করতে বললেন। এবং বেশ দীর্ঘ মামলার শেষে শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন, ক্ষতিপূরণও পেলেন। সংবাদপত্রে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে স্বীকার করা হল যে সুভাষের বিরুদ্ধে এক চুলও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি, কেবল অনামা কিছু “বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী”র কথার উপর ভিত্তি করেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।১৭ সরকারের এই নগ্ন বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্তে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। “দেশকে ভালবাসা যদি অপরাধ হয়, তা হলে আমিও অপরাধী। সুভাষচন্দ্র বসু যদি অপরাধী হন, তবে আমিও অপরাধী।”১৮ চিত্তরঞ্জনের নিশ্চিত বিশ্বাস দাঁড়াল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটি যে আপাতত জাতীয়তাবাদীরাই শাসন করছে, ব্রিটিশ রাজ তা হজম করে উঠতে পারছে না বলেই এত সব কাণ্ড।
চিত্তরঞ্জন ও সুভাষ ব্যক্তিগত সন্ত্রাসপন্থার সমর্থক ছিলেন না। এই ভাবে জঙ্গি কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে স্বরাজ আনা সম্ভব, সেটাও তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। তবে, বাংলার নিজস্ব রাজনৈতিক ধারার মধ্যে প্রতিপালিত এই দু’জন মানুষই গাঁধীবাদী অহিংসাতেও প্রশ্নহীন আস্থা রাখতে পারেননি। সংগঠিত সশস্ত্র আন্দোলনে সুভাষের আপত্তি ছিল না, কিন্তু তিনি জানতেন যে উপনিবেশের শাসিত প্রজাসমাজ, যাদের কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই, তাদের পক্ষে এই পথ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। অনেক আগেই ১৯০৭ সালে, অরবিন্দ ঘোষ বলেছিলেন, কোনও শাসিত দেশকে তার পরাধীনতার পরিস্থিতি মনে রেখেই লড়াই-এর পথ খুঁজে নিতে হয়, আর তাই, ভারতবর্ষের পরিস্থিতি অনুযায়ী “প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স” বা আক্রমণহীন বিরোধিতার পথই হল সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। মহাত্মা গাঁধীর ভবিষ্যৎ নীতির বেশ কিছু ইঙ্গিতই অরবিন্দের ভাবনায় সে দিন পাওয়া গিয়েছিল, তবে মনে রাখতে হবে যে অরবিন্দ কিন্তু তাঁর যুক্তি তৈরি করেছিলেন একেবারে ভিন্ন এক নৈতিক অবস্থান থেকে। অন্যান্য সব পথকেই “সর্ব ক্ষেত্রে অপরাধমূলক ও অসঙ্গত” বলে মনে করতে তিনি কখনওই রাজি ছিলেন না। লিখেছিলেন, “সব রকম সরকারের, বিশেষত অত্যাচারী সরকারের একটা সাধারণ প্রবণতা, প্রজাদের হিংসাত্মক কাজকর্মকে ‘অপরাধমূলক কিংবা শয়তানি’ বলে ছাপ মেরে দেওয়া।” “অত্যাচারী সরকার” “হিংসার বদলে হিংসায় উত্তরের উপর নৈতিক এবং আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি করার” যে প্রয়াস দেখায়, তাকে অগ্রাহ্য করাটা “মনুষ্যত্বের বৃহত্তর বিবেকেরই অনুসারী”। তাই আক্রমণহীন বিরোধিতার নীতি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে যেখানে যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার জায়গাই থাকে না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, “যদি রক্তপাত ও হিংসা থেকে পিছিয়ে আসা হয়”, সে ক্ষেত্রে প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে “শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যেমন তীব্র ভৎর্সনা করেছিলেন”, তেমন ভৎর্সনাই প্রাপ্য।১৯ পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতায় বর্ণিত কৃষ্ণের সেই মন্ত্র— কর্মফলের দিকে না তাকিয়ে কাজ করে যাওয়ার মন্ত্র— এই সব কারণেই সে দিন বাংলার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামীদের কাছে বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
১৯২০-র শেষ দিকে চিত্তরঞ্জন বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে গাঁধীর একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। গাঁধী ব্যক্তিগত ভাবে তাদের বুঝিয়ে বললেন, হিংসার পথ অন্তত সাময়িক ভাবে ছেড়ে দিয়ে তাঁর অহিংস অসহযোগের পথকে এক বার পরখ করে দেখতে। ১৯২২ সালে যখন গাঁধী গণ-আন্দোলন থামিয়ে দিলেন, বিপ্লবীদের মনে হল, এর পর তা হলে তাঁদেরও আর সেই প্রচ্ছন্ন বোঝাপড়ার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকার দরকার নেই। তবে গাঁধী ও চিত্তরঞ্জন দাশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির যে তফাত ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে গোপীনাথ সাহাকে কেন্দ্র করে বিতর্কের মধ্যে। তরুণ বিপ্লবী গোপীনাথ কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে হত্যার চেষ্টা করেন, কিন্তু ভুলবশত তাঁর গুলিতে মারা যান মিস্টার ডে নামে জনৈক ব্যক্তি। বিচারের সময়ে আদালতে গোপীনাথ বলেন যে তিনি আসলে টেগার্টকেই হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভুল করে অন্য লোককে মেরে ফেলায় তাঁর সন্তাপের সীমা নেই, নিজের জীবন দিয়েই তিনি এই ভুলের মাসুল গুনতে চান। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হল, ফাঁসিও হল। ১৯২৪ সালের মে মাসে সিরাজগঞ্জের বাংলা প্রাদেশিক কনফারেন্সের সভাপতিত্ব করতে এসে চিত্তরঞ্জন দাশ একটি প্রস্তাব পাশ করালেন। প্রস্তাবটি হল: “এই কনফারেন্স হিংসাত্মক কার্যকলাপের সমালোচনা করে, তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখে, এবং অহিংসার পথে চলতে অঙ্গীকার করে। তবে, দেশের স্বার্থের দিক দিয়ে দেখলে গোপীনাথ সাহার আত্মদানের আদর্শ বিপথগামী হলেও সেই আদর্শের প্রতি এই কনফারেন্স শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছে, তাঁর মহৎ আত্মোত্সর্গকে সম্মান জানাচ্ছে।”২০ একই প্রস্তাব আমদাবাদের সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির বৈঠকেও আনা হল, গাঁধীর সমর্থকরা অল্প ভোটের ব্যবধানে সেটিকে পরাস্ত করে দিলেন। সিরাজগঞ্জ বা আমদাবাদ, কোনওখানেই সুভাষচন্দ্র বসু উপস্থিত ছিলেন না। তিনি তখন কলকাতার মিউনিসিপ্যালিটির কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত। তবে জেলেরই অভ্যন্তরে ফাঁসি ও শেষকৃত্য হয়ে যাওয়ার পর গোপীনাথ সাহার ভাই যখন বন্দির জামাকাপড় নিয়ে জেল থেকে বেরোচ্ছেন, সেই সময়ে গেটের সামনে সুভাষ তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন, সমবেদনা জানালেন।২১
প্রমাণ না মিললেও, মামলা না হলেও, সুভাষ কিন্তু বন্দিই থেকে গেলেন। বন্দিত্বের প্রথম ছয় সপ্তাহ কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান এক্সিকিউটিভ অফিসার কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলেই থাকলেন। জেলের সেই সেলকেই যখন তিনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজকর্মের অফিস বানিয়ে ফেললেন, ১৯২৪-এর ডিসেম্বরের গোড়ায় সরকার তাঁকে উত্তরবঙ্গের বহরমপুর জেলে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সুভাষ শরত্কে নিশ্চিন্ত করতে জানালেন, “আমি এখানে বেশ ভালই আছি। কবি ঠিকই বলেছেন, পাথরের দেওয়াল হলেই কারাগার হয় না, লোহার শিক হলেই খাঁচা হয় না।”২২ ১৯২৫-এর ২৫ জানুয়ারি হঠাৎই সুভাষকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করার অর্ডার এল, কোনও কারণ দর্শানো হল না। মধ্যরাত্রের মধ্যে তাঁকে কলকাতার পুলিশ হেডকোয়ার্টার লালবাজারের লকআপে ভরে দেওয়া হল, সুভাষের ভাষায় যে জায়গা একেবারে “নরকের সমান”। একটা “নোংরা গর্তে”র মধ্যে অজস্র মশা-মাছির সাহচর্যে রাত কাটানোর পর ভোরের আলো ফোটারও আগে তাঁকে ও আরও সাত জন কয়েদিকে ঠেলেঠুলে পুলিশ ভ্যানে চড়িয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে আসা হল। কয়েক ঘণ্টা একটা ছোট্ট মোটরবোটে অপেক্ষা করানোর পর বড় জাহাজে তাঁদের ওঠানো হল, তীরের উল্টো দিকে মুখ করিয়ে বসানো হল। এতক্ষণে স্পষ্ট হল, সুভাষকে বাংলা থেকে অনেক দূরে কোথাও চালান করে দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবিক, তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল রেঙ্গুনে— চার দিন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। সমুদ্রযাত্রার সময়টা সুভাষ পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট-জেনারেল মিস্টার লোম্যানের সঙ্গে নানা বিষয়ে গালগল্প করে কাটালেন, পুলিশি অত্যাচার নিয়েও তাঁদের নানা আলোচনা হল। প্রথমে পুলিশ অফিসারটি সম্পর্কে তীব্র অপছন্দ নিয়ে কথা শুরু করলেও কথোপকথনের শেষে “এঁর সম্পর্কে মোটের উপর ভাল ধারণাই” হল।২৩ আরও কুড়ি ঘণ্টা লাগল রেঙ্গুন থেকে ট্রেনে চড়ে মান্দালয়ে পৌঁছতে।
বার্মার শেষ স্বাধীন রাজবংশের রাজধানী মান্দালয় ব্রিটিশের দখলে আসে ১৮৮৫ সালে। বিজয়গর্বে আত্মহারা বিদেশি সৈন্যদলের ভারী বুটের শব্দে প্রাসাদ-অভ্যন্তর কলুষিত হয়, অবাধ লুঠতরাজ চলে। যে জেলখানায় সুভাষ ও তাঁর সঙ্গীদের সে দিন রাখা হল, সেটা দুর্গের একটি অংশ, দুর্গটি আবার প্রাসাদের সঙ্গে যুক্ত। ১৯২০-র দশকে মান্দালয় তখন অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর স্থান, প্লেগ আর বসন্ত রোগের মহামারী সেখানে লেগেই রয়েছে। পৌঁছনোর পরই ভাইকে লেখা চিঠিতে সুভাষ মান্দালয়ের বর্ণনা করলেন “ধুলোর রাজ্য” বলে: “এই শহরের হাওয়াতেই ধুলো— নিশ্বাসের সঙ্গে সে ধুলো তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে। খাবারে ধুলো, তোমাকে ধুলো খেতেই হবে। টেবিলে ধুলো — চেয়ারে বিছানাতেও ধুলো— তার নরম স্পর্শ তোমাকে সর্বদা পেতেই হবে। ধুলোর ঝড় উঠবে, দূরের গাছপালা পাহাড় সব তাতে ঢেকে যাবে— তোমাকে চতুর্দিকে তার সৌন্দর্য দেখতেই হবে। সত্যিই, মান্দালয়ের ধুলো সর্বত্রবিহারী, সমস্ত জায়গায় তার চিহ্ন ছড়ানো।” মান্দালয়ে জেলের সেল-গুলি ইঁটের বদলে কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি। শরত্কে লিখলেন, “যখন রাতে আমাদের এখানে ঢোকানো হল, আমাদের দেখে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন মানব-পশুর দল, আলো-জ্বালানো খাঁচায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। অদ্ভুত অনুভূতি। তবে যার একটুও রসবোধ আছে, এই অভিজ্ঞতায় তার মজা লাগবেই।”২৪
এ ভাবেই বন্দিদশার ক্লেশ রসবোধ আর উদাসীনতা দিয়ে কাটাতেন সুভাষ। অনুপ্রাণিত সুভাষ তখন ভাবছেন, পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা বালবন্ত্রাও গঙ্গাধর তিলকও তো ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সাল অবধি এই মান্দালয় জেলে বন্দি ছিলেন, সেই সময়েই তো গীতার “অসামান্য, যুগান্তকারী” ব্যাখ্যাগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। সুভাষের কাছে এই জেল তাই “তীর্থস্থানের সমান, যে তীর্থে ভারতের অন্যতম মহত্তম সন্তান একটানা ছয় বছর কাটিয়ে গিয়েছেন।”২৫ বন্দিত্ব তাঁর আত্মিক উত্তরণ ঘটাবে, তাঁর মনে হত। বন্ধু দিলীপকে লিখেছিলেন, “যখন শান্ত ভাবে ভাবতে পারি না, মনে হয় আমাদের সেই চঞ্চলতা বা হতাশার পিছনে সদা জাগ্রত রয়েছে এক স্থির সত্যের বোধ, সেই বোধ যেন এক বৃহৎ লক্ষ্যেরই অংশ।” তবে বন্ধু যখন তাঁর বন্দিত্বের তুলনা করতেন শহিদত্বের সঙ্গে, আলতো ভাবেই সে কথা খারিজ করে দিতেন সুভাষ। তাঁর মধ্যে যেহেতু “রসবোধও ছিল, পরিমিতিবোধও ছিল,” “শহিদের মহৎ শিরোপা” থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার ক্ষমতাটুকু তিনি হারাননি।২৬
১৯২৪ থেকে ১৯২৭, বার্মা জেলের ওই সময়কালের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসু সেনাপতি থেকে নেতায় পরিণত হলেন। অসহযোগ আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ে সুভাষ তাঁর রাজনৈতিক গুরু হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশকেই গ্রহণ করেছিলেন। সেই উদারহৃদয় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ভারতের স্বাধীনতা এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য প্রচুর আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন, তাই তাঁর প্রতি সুভাষ একান্ত ভক্তিমান। কিন্তু সেই শিষ্যত্বের ভূমিকায় ছেদ পড়ল, ১৯২৫-এর ১৬ জুন অকস্মাৎ মৃত্যু হল চিত্তরঞ্জন দাশের। মান্দালয়ের জেলে বসে সুভাষ ভয়ানক দুঃসংবাদটি পেয়ে “শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।”২৭ তবে নেতার প্রয়াণে দিশাহারা হয়েও একটা কাজ করতে ভুললেন না, সেই সময়ের সমস্ত কাগজপত্র সাবধানে ঠিকঠাক রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা লিখলেন। “কখনও কোনওদিন তাঁর জীবনী লেখা হবেই,” আর সেই কাজের জন্য এখনই সব কাগজ সংগ্রহ করে রাখা দরকার। ১৯২১-২২ সালে যখন তাঁরা একসঙ্গে জেলে ছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দর্শন নিয়ে একটি বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দাশ। যদি তাঁর নেতার সেই সব নোটস খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়, সুভাষ নিজেই হয়তো তার থেকে কিছু একটা দাঁড় করাতে পারবেন, ভাবলেন তিনি।২৮
দেশবন্ধুর উপর তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধটি লেখা হল ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারি। তার মধ্যে থেকে গেল তাঁর নিজের রাজনৈতিক চেতনার কয়েকটি বিশেষ দিকও। লিখলেন, “ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এত বড়ো বন্ধু আর কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি হিন্দুধর্মকে এত ভালবাসতেন যে তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন অথচ তাঁর মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না।” ভারতবর্ষের ধর্মীয় বিভিন্নতার বিষয়ে এই উদার মহানুভবতার আদর্শকেই সুভাষ তাঁর নিজের রাজনীতিতেও প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন, দেখেছিলেন ঠিক এই জিনিসটি আর কোনও জাতীয় নেতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটা ঠিক ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করার ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং ধর্মীয় বিভেদের প্রতি সম্মান ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর ভিত্তিশীল এক ধরনের রাজনীতি। “দেশবন্ধু বিশ্বাস করতেন, ভারতের স্বরাজ হবে জনসাধারণকে তাদের দুর্দশা থেকে মুক্ত করার পথ, কেবল উচ্চশ্রেণির স্বার্থরক্ষার পথ নয়।” এই ভাবনাও কিন্তু প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে সে দিন খুঁজে পাওয়া যেত না, যদিও সুভাষ নিজে সর্বতোভাবে এই আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন।
সংস্কৃতি এক না বহু: এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেন, “একও বটে, বহুও বটে।” দেশবন্ধু যেমন প্রথমত ও প্রধানত বাংলার মানুষ ছিলেন, মনে করিয়ে দেন সুভাষ— বাংলাকে তিনি চিরকাল ভালবাসতেন, কিন্তু তার জন্যে সমগ্র ভারতকে কখনওই ভুলে যেতেন না। প্রাক্-আধুনিক যুগের বাংলায় নদিয়া জেলায় ন্যায়শাস্ত্র বলে যে দর্শনতত্ত্ব তৈরি হয়ে উঠেছিল, তার প্রভাবে বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় “তর্কশাস্ত্র ও যুক্তিপরায়ণতা” এক বিশেষ আকার লাভ করে। চিত্তরঞ্জন তাঁর বুদ্ধিবলে আধুনিকমনস্ক ব্যারিস্টার হয়েছিলেন ঠিকই, তবে আর কয়েক শতাব্দী আগে জন্মালে সেই একই বুদ্ধিবলে নবদ্বীপ ঘরানার বিখ্যাত তর্কশাস্ত্রবিদও হতে পারতেন। নদিয়া তো কেবল যুক্তিতর্কের পীঠভূমি ছিল না, তীব্র ভক্তিরসও ছিল তার বৈশিষ্ট্য। বাঙালির এই “আবেগপ্রবণতা” চিত্তরঞ্জনের কাছে কিন্তু “অস্বস্তির বস্তু” ছিল না, বরং এর মধ্যে তিনি এক রকমের “অহঙ্কারের বিষয়” খুঁজে পেতেন। সুভাষ স্পষ্টতই শ্রদ্ধাভরে লিখেছিলেন, “চিত্তরঞ্জনের জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করত আন্তর্জাতিক সংযোগের মধ্যে। কিন্তু সেই বিশ্বপ্রেমের জন্য নিজের দেশের প্রতি প্রেম তিনি বিসর্জন দেননি। আবার তার সঙ্গে এও ঠিক যে, এই স্বজাতিপ্রেম তাঁর মধ্যে কোনও সংকীর্ণ আত্ম-কেন্দ্রিকতাও তৈরি করেনি।” সি আর দাশের এই অপূর্ণ স্বপ্ন এবং আশার মধ্যেই তাঁর “সর্ববৃহৎ উত্তরাধিকার” খুঁজে পাওয়া সম্ভব, মনে করতেন সুভাষ।২৯
আই সি এস পরীক্ষার জন্য যা পড়েছিলেন, মান্দালয় জেলে তার চেয়েও অনেক বেশি পড়াশোনা করে ফেললেন সুভাষ। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের থেকে বই জোগাড় করে আনিয়ে প্রবল গতিতে পড়ে ফেলতেন, সেই সব বই পড়ার পর নোট করে, বিশ্লেষণ লিখে ভরিয়ে ফেলতেন তাঁর জেলের নোটবুক। ফ্রিডরিশ নিটশের রচনাসমগ্রের নানা খণ্ডে এমন দাগ দিয়ে পড়েছিলেন তিনি, যাতে বোঝা যায় দর্শনে তখনও ভাল রকম উত্সাহ ছিল তাঁর। শিল্পবিপ্লব-উত্তর সভ্যতা ও মুক্তচিন্তার উপরে বার্ট্রান্ড রাসেল-এর লেখা পড়লেন তিনি। ইউরোপীয় সাহিত্যের পাঠ-তালিকার একদম ওপরে থাকত তুর্গেনেভ বা দস্তয়েভস্কির মতো শ্রেষ্ঠ রুশ ঔপন্যাসিকের নাম। প্রচুর বিষয়ে তাঁর উত্সাহ: ইউরোপীয় ইতিহাস, সাম্রাজ্য ও বিদ্রোহের ইতিহাস, সামাজিক নৃতত্ত্ব, রাজনৈতিক স্মৃতিকথা, ধর্মশাস্ত্রের তুলনামূলক আলোচনা, মনস্তত্ত্ব, অপরাধতত্ত্ব, শরীরচর্চা ও খাদ্যাভ্যাস, বর্ণবৈষম্যভিত্তিক সমাজতত্ত্ব।
আইরিশ ইতিহাস ও সাহিত্যে তিনি মোটামুটি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন। বইয়ের পাশে নোটে লিখলেন, এ যাবৎ কাল আয়ারল্যান্ডে যে কোনও যুদ্ধে যত মানুষ নিহত হয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ সে দেশে মারা গিয়েছেন ১৮৪০-এর দুর্ভিক্ষে। বেশ কয়েকটি আইরিশ কবিতা তাঁর ভাল লেগেছিল, সেগুলির অনুলিপি করে ফেললেন, যেমন পি এইচ পিয়ার্সের ‘রিনানসিয়েশন’, ‘দ্য রেবেল’, ‘দ্য ওয়েফেয়ারার’ এবং ডোরা সিগারসনের ‘দ্য ডেড সোলজার’। ১৯১৬ সালের ইস্টার বিদ্রোহের অন্যতম নেতা পিয়ার্সকে সে বছরেরই ৩ মে ব্রিটিশরা মেরে ফেলে। সুভাষের মনে নিশ্চয় দাগ কেটে বসে যায় পিয়ার্সের লেখা সেই পঙ্ক্তি, যেখানে বলা হয়, বিপ্লবীর জন্ম দুঃখী মানুষের বীজ থেকে।
I say to my people that they are holy,
That they are august despite their chains,
That they are greater than those that
Hold them, and stronger and purer,
That they have but need of courage, and
To call on the name of their God,
God the unforgetting, the dear God that
Loves the peoples
For whom he died naked, suffering shame.৩০
ঘরের কাছের দেশ বার্মার সংস্কৃতি নিয়েও সযত্ন পড়াশোনা শুরু করলেন সুভাষ, পড়লেন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, মধ্যযুগ, প্রাক্-আধুনিক ও আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্য। এমনও তাঁর মনে হল যে বর্মার তথ্য-ইতিহাস যা তিনি পড়েছেন, তার ভিত্তিতে প্রাচীন ভারতের উপর গবেষণারত বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তিনি বেশ কিছু অজানা তথ্য জানাতে পারেন। তাঁর মনে হল, “বর্মা এক আশ্চর্য দেশ”, “সামাজিক গণতন্ত্রের একটা সম্পূর্ণ চেহারা” পাওয়া যায় সেখানে। প্রশংসা করে নোট লিখলেন, ইউরোপের যে কোনও দেশের তুলনায় বর্মার মেয়েরা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। সেখানকার দেশজ সুলভ প্রাথমিক শিক্ষার কারণে সে দেশে সাক্ষরতার হার ভারতের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ইতিহাস, সাহিত্য ও শিল্পের আরও গভীর জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টায় থাকলেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের উপর ভিত্তি করে আধুনিক জাতীয় চরিত্র নির্মাণ সম্ভব, তাঁর মনে হল— “ঠিক যেমন ক্লাসিকাল সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক ইউরোপেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।”৩১
মান্দালয়ে পৌঁছনোর ঠিক পরেই এক বার শরত্কে দুঃখ করে লিখেছিলেন সুভাষ, “চিঠি লেখাটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তাঁর মাথার উপর সর্বক্ষণ খাঁড়া ঝুলছে, পুলিশের লাগাতার নজরদারি। “কিন্তু লিখতে আমায় হবেই,” তাঁর সিদ্ধান্ত, যদিও প্রায় কখনওই তাঁর চিঠিগুলি অক্ষত ভাবে প্রাপকের কাছে পৌঁছত না।৩২ বর্মার জেলে দুই বছর তিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি লিখেই কাটিয়েছিলেন। সরকারি সেন্সরের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও সুভাষের এই চিঠিগুলি তাঁর মনের গতিপ্রকৃতির অন্যতম সেরা সাক্ষী। কত রকম বিষয়েই না লিখতেন তিনি— শিল্প, সংগীত, সাহিত্য, প্রকৃতি, শিক্ষা, জন-সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, এবং অবশ্যই রাজনীতি।
বন্ধুত্বের এক সেরা নিদর্শন সুভাষ ও দিলীপের পারস্পরিক চিঠিপত্র। নানা বিষয়ে তর্ক চলত তাঁদের মধ্যে, বিভিন্ন মানুষের কষ্ট সহ্য করার বিভিন্ন রকম ক্ষমতা, মানুষের নানা রকমের মানসিক প্রবণতা, নানাবিধ পথে পূর্ণতার অনুভূতি। অসুবিধার সম্মুখীন হয়েই যে সুভাষ নিজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তি খুঁজে পান, সুভাষের মনের নিজস্ব দার্শনিক ধরনটিই নিশ্চয়ই তার কারণ, বলতেন দিলীপ। সুভাষের প্রত্যুত্তর: “যার নিজস্ব দর্শন নেই”, “সেই রকম মানুষেরও কোনও না কোনও ধরনের আদর্শ” থাকতেই পারে। তাঁর সঙ্গে জেলে যে সব অন্যান্য বন্দি ছিলেন, তাদের মধ্যেই সুভাষ দেখেছিলেন কিছু মানুষকে “যাঁরা চিন্তাশীল নন, দার্শনিক তো ননই,” তবুও তাঁরা অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারেন, শান্ত ভাবে, “এমনকী নায়কোচিত ভাবে”। অবশ্য দার্শনিক ধরনের যাঁরা, তাঁদের পক্ষে কষ্ট সহ্য করার একটা মহত্তর লক্ষ্য থাকে, মেনে নেন তিনি। তবে উল্টে প্রশ্নও করেন, “এটাও কি সত্যি নয় যে আসলে আমরা সকলেই ভিতরে ভিতরে দার্শনিক, আর একমাত্র যন্ত্রণার স্পর্শই পারে আমাদের ভিতরকার সেই দার্শনিক সত্তাকে ঠিকঠাক জাগিয়ে তুলতে?”৩৩
দিলীপ মনে করতেন সুভাষই হবেন তাঁদের সেই “প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক কাণ্ডারী”, বলতেন, তরুণ প্রজন্মের আস্থা সুভাষেরই উপর, তিনিই তাদের “নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত মানুষ”। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, সুভাষের মধ্যে যে আধার (“অন্তরতম সত্তা”) ও বিনয়বোধ রয়েছে, তা কোনও দিনই তাঁকে “সংকীর্ণমনা দেশপ্রেমী হতে দেবে না, কিংবা দেশের মঙ্গলের বিষয়টি উপেক্ষা করে কেবল জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠতে দেবে না।” “সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক মঙ্গল” যে পথে, সেই পথেই চলতে চান সুভাষ, তবে কেবল জাগতিক বিষয়গুলিই যে মঙ্গলের একমাত্র মানদণ্ড নয়, সে বিষয়েও তিনি অবহিত। শিল্পকর্মকে অনেক অর্থনীতিবিদ অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন, সুভাষ কিন্তু তা ভাবতেন না। ১৯২৫ সালের ৯ অক্টোবর সুভাষ লিখেছিলেন, “সময়টা কেমন পাল্টে গিয়েছে।” দিলীপকে বললেন, গানে গানে ভরিয়ে দাও দেশ, “জীবনের যে আনন্দ আমরা ভুলে পিছনে ফেলে এসেছি, তাকে আবার ফিরিয়ে আনো।” “যার লেখায় কোনও সংগীতের মূর্ছনা নেই, যার হৃদয় সংগীতে জেগে ওঠে না, তার পক্ষে জীবনে বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়,” লিখেছিলেন তিনি। উত্তরবাংলার মালদা জেলার গম্ভীরা সংগীত ও নৃত্য তাঁর মন জয় করেছিল, দিলীপকে বলেছিলেন সেখানে গিয়ে বাংলার এই সহজ স্বতঃ-উত্সারিত জনসংগীতের ধারাটিকে কোনও ভাবে উত্সাহ জোগাতে। স্বধর্ম (নিজের ভেতরকার আকুতি) যে বোঝে, তারই পক্ষে সম্ভব সত্যিকারের কাজে “নিজের অলঙ্ঘনীয় অধিকার” প্রতিষ্ঠা করা। দিলীপকে বলেছিলেন, “এমার্সনের ভাষায় বলতে গেলে, একেবারে নিজের অন্তঃস্থল থেকে সেই ভাঙাগড়ার কাজটা শুরু করা দরকার।”
বন্দিত্বের ফলে কোনও কাজ করার সুযোগ ছিল না, আর তার থেকেই ক্রমে তাঁর বিশ্বাস জন্মাল, অধিকাংশ মানুষের জন্যই সাধনার প্রধান ক্ষেত্র হওয়া উচিত “সেবামূলক কাজ।” শ্রীঅরবিন্দ তত দিনে ধ্যানী হয়ে গিয়েছেন, সাধনায় ডুবে থাকেন, সুভাষ তাঁকে ভক্তি করতেন। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও বলতেন, মানুষের থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলে কিন্তু কাজ করার তাড়নাও হারিয়ে যেতে পারে। “নানা কারণেই আমাদের জাতি ক্রমেই কর্মযোগের থেকে সমানে দূরে সরে শূন্যবিন্দুতে পৌঁছে যাচ্ছে, তাই আমাদের এখন চাই দ্বিগুণ পরিমাণে কর্মযোগের মন্ত্র, যার নাম রজঃ(স্),” তাঁর বক্তব্য। দিলীপ এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠিয়েছিলেন। কবি উত্তরে জানালেন, “সুভাষের চিঠি বড় সুন্দর। এই লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর বুদ্ধি ও হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে তৃপ্তিলাভ করেছি। সুভাষ আর্ট সম্বন্ধে যা লিখেছেন, তার বিরুদ্ধে বলবার কিছুই নাই।”৩৪
আবেগের বশে সুভাষ এক বার বিশ শতকের বাংলার আর এক জনপ্রিয় সাহিত্য-তারকা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, দেশবন্ধু বিষয়ে একমাত্র এই ঔপন্যাসিকই সত্যিকারের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একটি লেখা লিখেছিলেন, সুভাষকে সেই লেখা গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিল। সুভাষ যখন মান্দালয় জেলে ছিলেন, সেই সময়েই বাংলার এক বর্মাবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিয়ে পথের দাবী উপন্যাসটি লেখা ও প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাহিত্যসম্রাটকে তিনি লিখলেন, “এখানে না এলে বোধহয় বুঝতুম না সোনার বাংলাকে কত ভালবাসি! আমার সময়ে সময়ে মনে হয়, বোধ হয় রবিবাবু কারারুদ্ধ অবস্থা কল্পনা করেই লিখেছিলেন ‘সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’!”৩৫
একটি নোটবুকে পছন্দের গানগুলি লিখে রাখতেন সুভাষ, তার মধ্যে অবশ্যই ছিল এই গানটি, তার সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও আরও অনেক কবির লেখা অনেক গান। বাংলার বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানগুলি তাঁর বন্দিদশার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই লেখা বলে তাঁর মনে হত। দূরত্ব যেন ক্রমেই মাতৃভূমির টান বাড়িয়ে তুলছিল। কালিদাসের প্রাচীন মহাকাব্য মনে করে তিনি লিখেছিলেন, “সকালে বিকালে যখন আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসতে দেখি, মনে হয় মেঘদূতের সেই পরবাসী যক্ষের মতো আমার বাংলা মায়ের জন্য অন্তরতম কিছু অনুভূতি তাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিই, বৈষ্ণবদের মতো বলি ‘তোমারি লাগিয়া কলঙ্কের বোঝা বহিতে আমার সুখ।’”৩৬
জেলের দৈনন্দিন জীবনের কথা সবচেয়ে সুন্দর ভাবে উঠে আসত মেজোবৌদিদি বিভাবতী দেবীকে লেখা চিঠিগুলিতে। বিভাবতীর যে খুবই পছন্দ ছিল তাঁর এই সব কাহিনি, তা জেনে সুভাষও খুশি হতেন। সংস্কৃত শাস্ত্রবচন “রসো বৈ সঃ” মনে করে বলতেন, জেলজীবন তা হলে তাঁর সব রসবোধ নিঃশেষ করে দেয়নি, আর তার অর্থ তাঁর জীবনের প্রধান রসদ যে ‘আনন্দ’, তাও তিনি হারাননি! সাধারণ বন্দিদের কষ্ট বর্ণনা করতেন তিনি। এক জনের নাম মলয়, সে বর্মা দেশের গ্রাম্য রাজা, আর এক জন শ্যামলাল, সে হল বোকা চোর, যাকে ডাকা হত ‘পণ্ডিত’ বলে; চাণক্য ছিল মাদ্রাজের অশিক্ষিত অপরাধী, বাঙালি বন্দিদের সঙ্গে সে ইন্দো-বার্মার স্থানীয় ভাষায় কথা বলত। বিস্তারিত লিখতেন কেমন করে দিন কাটছে, কী করে জেলের প্রাণিজগতের সদস্যরা, যত সব পায়রা, মুরগি, টিয়া, কিংবা দুষ্টু বেড়ালগুলো যারা চতুর্দিকে অনাচার করে বেড়ায়, মাঝে মাঝে পায়রাদের ধরে খেয়ে ফেলে।
জীবনের প্রাত্যহিক উপকরণগুলি সেখানে প্রায়শই মিলত না, আর সেই নিয়ে তাঁর যত রসিক মন্তব্য। “জামাকাপড়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। আপনারা কি জানেন না যে আমরা সম্রাটের অতিথি? আমাদের কি কোনও অভাব থাকতে পারে?” বিভাবতীর প্রশ্নের উত্তরে লেখেন সুভাষ। খাবার বিষয়ে লেখেন, “আমাদের হোটেলে সবই পাওয়া যায়।”
সেদিন ম্যানেজারবাবু আমাদের গরম গরম জিলিপী খাওয়ালেন— আর আমরাও দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলাম তিনি যেন চিরকাল জেলেই থাকেন। তার পূর্বে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন, যদিও গোল্লা রসে ভাসছিল তবুও ভিতরে রস ছিল না, এবং ছুঁড়ে মারলে রগ ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু আমরা সেই লৌহবৎ রসগোল্লা নিশ্চিন্তমনে গলাধঃকরণ করে কৃতজ্ঞ চিত্তে ম্যানেজারবাবুর দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলাম।
“গন্ধ ও গানের অভাব সময় সময় বোধ করি। কিন্তু উপায় কী?” মান্দালয়ে দুই বছর কেটে যাওয়ার পর সব রাজনৈতিক বন্দিদেরই যখন সরকার থেকে জানানো হল, তাঁদের জেলবাস আপাতত চলবে, সুভাষ তখন বিভাবতী দেবীকে লিখলেন, “চাকরি বজায় থাকা উপলক্ষে এখানে ছোটখাট ভোজ হয়ে গেছে।”৩৭
রোজকার খাবার, জামাকাপড়ের অভাব, কোনও গানবাজনা শোনার ব্যবস্থা না থাকা, যে সব বিষয়ে সুুভাষ মেজবৌদিদিকে মজা করে চিঠি লিখতেন, ঠিক সেগুলি নিয়েই কিন্তু বন্দিদের সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষের গুরুতর সংঘর্ষ বাধত। “যদি কোনও মানুষের অন্তরাত্মা থাকে, তবে খাদ্য ও পানীয়ের মতোই সংগীতও তার দরকার হয়,” বর্মার গভর্নরের কাছে জেলের বন্দিদের গানবাজনা শোনার অনুমতি দাবি জানাতে গিয়ে সুভাষ বললেন। জেল কর্তৃপক্ষের “অতীব অপমানজনক, অন্যায় ব্যবহার”, খাবারদাবার, জামাকাপড়, শোওয়ার ব্যবস্থার কদর্য মান ইত্যাদি নিয়ে সেই ১৯২৫-এর মে মাসেই সুভাষ ও অন্যান্য বন্দিরা অনশন ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছিলেন।
১৯২৬-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁরা শুরু করলেন পনেরো দিনের অনশন ধর্মঘট। আগের বছরের অক্টোবরে দুর্গাপূজার জন্য সরকার অতিরিক্ত বরাদ্দ ধার্য করতে অস্বীকার করেছিল, তার ফলেই এই সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট মেজর ফিন্ডলে সহৃদয় ব্যক্তি। খ্রিস্টান বন্দিদের ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য যেমন অল্প কিছু টাকা বরাদ্দ করা হত, সে কথা মনে করে ফিন্ডলে তাই জেলে পুজো করার অনুমতিও দিয়ে দেন, ভাবেন, বড় কর্তারা পরে ঠিকই মেনে নেবেন। সরকার কিন্তু মেনে নেয় না, এবং এত বাড়াবাড়ি করার জন্য ফিন্ডলেকে যথেষ্ট ভর্ত্সনা করে। রাজনৈতিক বন্দিরা মনে করলেন, ১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া যে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় “এই অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ” তার সম্পূর্ণ বিরোধী, “বিধির বিধানেরও বিরোধী।”৩৮ যতক্ষণ না সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসে, বন্দিরা ছাড়লেন না, শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় অধিকার হিসেবে মাথাপিছু বার্ষিক ত্রিশ টাকা মঞ্জুর হল। পরে গোপনে সুভাষ শরত্কে জানান, তাঁরা মুক্তি না পাওয়া অবধি তাঁদের এই অনশন ধর্মঘটের কাহিনি বাইরে আলোচনা না করাই ভাল, তবে “অনেক ভাবনাচিন্তার পরই” এই পথ বেছে নেওয়া হয়েছে।৩৯ আসলে সে দিনের এই বিশেষ উপলক্ষটি হয়তো তত গুরুতর ছিল না— বন্দিদের বন্দি করে রাখার সিদ্ধান্তটি যাঁদের, তাঁদের উপর চাপ প্রয়োগ করার ইচ্ছাটাই ছিল আসল কথা। কর্তৃপক্ষ যদিও বন্দিদের সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার সংযোগ একেবারেই বন্ধ রাখার চেষ্টা করতেন, তাঁদের এই অনশনের কথা অনশন শুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ফরওয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গেল, ভারতে রীতিমতো শোরগোল তুলল।
অনশন শেষ হল ৪ মার্চ ১৯২৬ তারিখে, বন্দিরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেন, তবে আগের থেকে খানিকটা ভাল ব্যবহার জুটল তাঁদের কপালে। আইডস অব মার্চ-এ, অর্থাৎ ১৫ তারিখ, মান্দালয় জেলে এল ‘ঝড়’— এ বার অবশ্য প্রাকৃতিক ঝড়ই বটে। সুভাষের বর্ণনায়, “চলমান ধুলোর আচ্ছাদন আমাদের সম্পূর্ণ ভাবে আবৃত করে ফেলল”:
কাগজপত্র উড়তে লাগল, লণ্ঠনের আলো নিবু-নিবু হয়ে এল, বিভিন্ন জিনিসপত্রের যেন ডানা গজিয়ে উঠল। স্বর্গের রোষ কিন্তু চিরস্থায়ী হল না, করুণার বারিবিন্দু বর্ষিত হল উপর থেকে। দার্শনিকেরা বলেন, ঈশ্বরের করুণা গভীর অন্ধকারেও দীপ্যমান। সুতরাং স্বাভাবিক যে কৃপাবিন্দু অন্ধকারেই ঝরবে। পরিবেশের ঐকতান সম্পূর্ণ হল যখন বৈদ্যুতিক আলো যথাসময়ে নিবে গেল, মিল্টন-এর ‘Cimmerian darkness’-এ আমরা হারিয়ে গেলাম। বিদ্যুতের ভয়ঙ্কর ঝিলিক অন্ধকারকে দৃশ্যমান করে তুলল (আবারও আমি মিল্টন-কে অনুসরণ করছি, কেননা শেক্সপিয়রের অপরূপ চন্দ্রালোকের বর্ণনা যতখানি সুমিষ্ট, মিল্টনের অন্ধকারের বর্ণনাও কি তত অপরূপ নয়?) অনুরাগী ভক্তের চোখে যেন প্রকাশিত হল তমসার রানি মা কালীর হাসি আর তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। (চিন্ময় মুখমণ্ডলে শোভে অট্টহাসি)।৪০
জেলারের কাছ থেকে জোগাড় হল শুকনো বিছানার চাদর আর কম্বল। তিনি নিজের উদ্বৃত্ত রসদ থেকে সেগুলি বার করে দিলেন। বন্দিরা তখন দ্বাররক্ষীর কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করল।
এত দিনে শরৎ কিন্তু ভাই-এর কাব্য ও দর্শনে আপ্লুত হওয়া কমিয়ে দিয়েছেন, এখন তিনি সুভাষের ক্রমক্ষীয়মাণ স্বাস্থ্য নিয়ে অতিশয় উদ্বিগ্ন। জেলের মধ্যে ইতিমধ্যে তাঁর ওজন যে প্রায় ৪০ পাউন্ড কমেছে জানতে পেরে খুবই দুশ্চিন্তায় শরৎ।৪১ মনের জোর দিয়ে শারীরিক দুর্বলতাকে আর আটকানো যাচ্ছে না, এই সব অনশন ইত্যাদির ফলে আরও অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে সেই দুর্বলতা। ভাইকে মুক্ত করার আইনি পথ খুঁজে না পেয়ে শরৎ এবার রাজনীতির পথ খুঁজতে শুরু করলেন। ১৯২৬-এর শেষ দিকে বাংলার আইনসভার নির্বাচন। শরৎ ঠিক করলেন সিন ফেইন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন, রাজনৈতিক বন্দিদের নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেবেন, “ভোট দিয়ে ঢুকিয়ে জেলের বাইরে বার” করে আনবেন।
প্রথমটা শুনেই সুভাষ নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন। আইনসভার সদস্যদের দেশের জন্য কোনও কাজ না করতে দেখে তিনি ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল, পেন্ডুলামটা বোধহয় দুলছে, গাঁধীর আইনসভা-বিরুদ্ধতার পথেই বোধহয় আবার ফিরে যেতে হবে। শরৎ কিন্তু তাঁকে বোঝালেন, তাঁর নিজের প্রস্তাবের পিছনে “জোরদার যুক্তি” রয়েছে। শেষে উত্তর কলকাতায় যতীন্দ্রনাথ বসুর বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে রাজি হলেন সুভাষ। যতীন্দ্রনাথ বসু লিবারেল পার্টির এক বড়সড় নেতা, ১৯২৩ সালে স্বরাজি প্রার্থীকে হারিয়েছিলেন। “ঈশ্বরের করুণা থাকলে আমরা ওঁকে ভাল ভাবেই হারিয়ে দিতে পারব,” ছোট ভাই-এর উপর রীতিমতো আস্থা ছিল শরতের। সুভাষ নিজের ইশতাহার প্রকাশও করতে পারলেন না, রাজনৈতিক বন্দিদের পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছে কোনও অনুরোধ বা দরবার করাও সম্ভব ছিল না।৪২ ১৯২৬ সালের গোটা শরত্কালটা জুড়ে শরৎ তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনী অঞ্চলের জন্য প্রচারের পাশাপাশি সুভাষের নির্বাচনী প্রচার নিয়েও ব্যস্ত রইলেন, বোঝা গেল বেশ দক্ষ তিনি এ কাজে। শীতকালে দেখা গেল, দু’জনেই বিপুল ভাবে জিতেছেন। আতসবাজি পুড়িয়ে বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের যুগ্ম জয়ের উৎসব পালিত হল। কলকাতার আকাশে রুপোলি অক্ষরে লেখা ফুটল “সুভাষচন্দ্রের জয়!”৪৩ তবে ভারতের ঔপনিবেশিক কর্তারা তাঁদের আয়ার্ল্যান্ডের বন্ধুদের থেকে অনেক বেশি কঠোর। ভোটে জিতলেও সুভাষকে তাঁরা জেল থেকে বেরোতে দিতে রাজি হলেন না।
বন্দিত্ব ঘুচল না। সুভাষের প্রতিক্রিয়া হল খানিকটা দার্শনিক। “যে উদ্দেশ্যে ভগবান আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তা এখনও সফল হয় নাই, এবং আমার কারাবাসকালীন শিক্ষা এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে।” কিন্তু সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস অবলম্বন যেহেতু তাঁর ধরন নয়, বহির্জগতের স্মৃতি কেবলই তাঁকে বিষণ্ণ করে তোলে। তবে দেশের জন্য যদি তাঁকে চিরকাল জেলেই কাটাতে হয়, তাতেও তিনি প্রস্তুত।৪৪ এক রাজনৈতিক সহকর্মীর কাছে তিনি আবারও জানালেন, তাঁর কাছে সেবার ব্রত-র অর্থ হল, নিজের যা কিছু সব দিয়ে দেওয়া প্রতিদানে কিছুই না চাওয়া। “আমার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন— কী উত্তর দিব?” তিনি লিখলেন, রবিবাবুর একটি কবিতা আমার খুব ভাল লাগে। কবির ভাষায় প্রশ্নের উত্তর দিলে কি ধৃষ্টতা হইবে?
কবে প্রাণ খুলি বলিতে পারিব
‘পেয়েছি আমার শেষ!’
তোমরা সকলে এসো মোর পিছে
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগো রে সকল দেশ!৪৫
নিজেকে শক্তি দেওয়ার জন্য সেই রবীন্দ্রনাথের কথাই ধার করে প্রার্থনা করলেন, “তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।”৪৬
১৯২৬ বছরটা ধরে সুভাষের শারীরিক শক্তি ক্রমেই কমে আসতে লাগল। সমানেই অল্প অল্প জ্বর আসত; শীত এল যখন ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে উঠল, ধরা পড়ল ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া। পরের বছর ৭ ফেব্রুয়ারি, মেডিক্যাল বোর্ডকে দিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হল রেঙ্গুন সেন্ট্রাল জেলে। তাঁর ডাক্তার ভাই সুনীলচন্দ্র বসু অনুমতি পেলেন সুভাষের সঙ্গে দেখা করার। তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন এ কথা জেনে যে আঠারো মাস ধরে সুভাষকে এক যক্ষ্মারোগীর কাছে রাখা হয়েছিল। সুনীলের ভয় হল, সুভাষকেও হয়তো যক্ষ্মায় ধরেছে। বিখ্যাত আয়ুর্বেদ চিকিত্সক কবিরাজ শ্যামাদাস বাচস্পতি সুভাষের শারীরিক অবস্থার রিপোর্টপত্র দেখে কলকাতা থেকেই তাঁর চিকিৎসার চেষ্টা করতে লাগলেন। সরকারি ডাক্তার-সহ সবাই এক কথাই বললেন, এত অসুস্থ মানুষকে আর বর্মা জেলে না রাখাই উচিত। কিন্তু সরকার সে কথা শুনতে অরাজি। ইতিমধ্যে সুভাষ এক দিন ধৈর্য হারিয়ে রেঙ্গুন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মেজর ফ্লাওয়ারডিউ-এর সঙ্গে ঝামেলা করলেন, সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর অত্যন্ত অভব্য ব্যবহারের অভিযোগ এনে অন্য কোনও জেলে যাতে তাঁকে এখনই চালান করা হয়, সেই দাবি জানালেন।৪৭
২৫ মার্চ তাঁকে ইনসিন জেলে পাঠানো হল। সেখানে ছিলেন বন্ধুভাবাপন্ন মেজর ফিন্ডলে, মান্দালয়ে যাঁর সঙ্গে সুভাষের মোলাকাত হয়েছিল। সুভাষের শারীরিক দুর্দশা দেখে তিনি একেবারে হতবাক হয়ে পড়লেন। বন্দির স্বাস্থ্যের বিষয়ে ফিন্ডলের রিপোর্ট পেয়ে সরকার বাংলা প্রাদেশিক আইনসভার মাধ্যমে প্রস্তাব আনল যে, সুভাষকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে যদি তিনি রেঙ্গুন থেকে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য নিজের খরচে সোজা সুইটজারল্যান্ডে যেতে রাজি থাকেন। ভারত, বর্মা বা শ্রীলঙ্কায় তিনি পা রাখতে পারবেন না, যতক্ষণ না ১৯৩০ সালে বাংলার ফৌজদারি আইন সংশোধনী ধারার মেয়াদ না ফুরোয়। যে আইন অনুযায়ী তাঁকে ধরা হয়েছিল, সেই ১৮১৮ সালে আইনটির থেকে বর্তমান আইনটি আলাদা, এই আইন ব্যবহার করেই আপাতত তিনি বন্দি রয়েছেন।
এই অনিশ্চিত ইউরোপ নির্বাসনের প্রস্তাব সুভাষের একেবারেই পছন্দ হল না। এক বার বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখে আসার সুযোগও এতে নেই, অথচ তাঁদের প্রায় আড়াই বছর তিনি দেখেননি। এত দিনে ‘ত্যাগ’ ও ‘অমৃত’ একই মুদ্রার দুই পিঠ বলে তিনি উপলব্ধি করেছেন, “একশো শতাংশ অর্জন ও একশো শতাংশ ত্যাগ”-এর মাহাত্ম্যে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে রয়েছেন।৪৮ ১৯২৭-এর ৪ এপ্রিল শরত্কে চিঠিতে জানালেন কেন সরকারের প্রস্তাব মানতে তিনি নারাজ। “যদি আমার বলশেভিক এজেন্ট হওয়ার ইচ্ছে থাকত,” তবে তিনি লাফিয়ে উঠতেন, সরকার বলামাত্রই প্রথম জাহাজে ইউরোপ যাত্রা করতেন, “বলশেভিক দলে মিশে সমগ্র জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে প্যারিস থেকে লেনিনগ্রাড পর্যন্ত ছোটাছুটি করতাম।” কিন্তু তেমন ইচ্ছা তাঁর নেই। সরকার বোধহয় ভুলে গিয়েছে যে তাঁর উপর তারাই জেলবাসের কষ্ট আরোপ করেছেন, বিনা কারণে তাঁকে আড়াই বছর আটক রেখেছেন, অর্থাৎ তিনিই নির্যাতিত পক্ষ, সরকার নির্যাতিত পক্ষ নয়। নিজেকে তিনি কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না যে জন্মভূমি থেকে চিরকালের জন্য নির্বাসন “জেলে থেকে মৃত্যুবরণ করা”র থেকে কেন শ্রেয়। “কবির অনুসরণে আমি বিশ্বাস করি, ‘গৌরবের পথ শুধু মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়’।” শরত্কে বললেন বাবা—মাকে সান্ত্বনা দিতে, তবে এও বললেন যে “মুক্তির অমূল্য ধন” লাভের আগে আরও কঠোর কষ্টভোগ সামনে রয়েছে।৪৯
উত্তরে শরৎ জানালেন, সুভাষ তাঁর মতো করে ঠিকই বলছেন, তবে তাতে তিনি সরকারের সঙ্গে বর্মা থেকে ভাই-এর স্থানান্তর নিয়ে আলোচনা বন্ধ করবেন না। তাঁর ইচ্ছে, সরকার সুভাষকে উত্তর ভারতের শৈলশহর আলমোড়ায় নিয়ে যাক। সেখানে তিনি আত্মীয়দের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন, স্বাস্থ্যোদ্ধারও হবে।৫০ ১৯২৭-এর ১১ এপ্রিল, সুভাষ শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে এক হাত নিলেন। “আমার জীবন আমার কাছে যত প্রিয়, তদপেক্ষা বেশি প্রিয় সম্মানরক্ষার প্রশ্ন,” ইনসিন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে লিখলেন তিনি। “আমি আমার জীবনের বিনিময়ে এই পবিত্র ও অলঙ্ঘ্য অধিকারসমূহ ত্যাগ করিতে পারি না যা ভবিষ্যৎ ভারতের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মূল ভিত্তিস্বরূপ হবে।”৫১ ৬ মে আবারও একই মনোভাব ব্যক্ত করলেন, শরত্কে বললেন এই মনোভাব তাঁর জীবনের সাধারণ দর্শন থেকেই উদ্ভূত। “মানুষের ধারণাই মানুষকে চালিত করে থাকে।”আবেগতাড়িত হয়ে লিখলেন শরত্কে, “এই সমস্ত ধারণা নিষ্ক্রিয় নয়, সক্রিয়, সংঘর্ষাত্মক। হেগেলের Absolute Idea, হার্টমান ও শোপেনহাওয়ারের Blind Will এবং হেনরি বার্গসঁর Elan Vital-এর মতোই এই সমস্ত ধারণা ক্রিয়াশীল।” এই ধারণার কাছে উৎসর্গীকৃত যে জীবন, “তার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।” সেন্ট পল-এর বিখ্যাত মন্তব্যটি মনে করলেন তিনি: আমরা রক্তমাংসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি না, আমাদের সংগ্রাম অপশাসনের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে, অন্ধকার পৃথিবীর ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে, উচ্চপদাধিষ্ঠিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে।”৫২ যে ধারণায় তিনি নিজের আস্থার ভর রেখেছেন, তার চূড়ান্ত জয় অনিবার্য, এই ছিল সুভাষের ঐকান্তিক বিশ্বাস।
ইউরোপে নির্বাসনের প্রস্তাব খারিজ হতে সরকারের নির্দেশে সুভাষকে আলমোড়া জেলে স্থানান্তরিত করা স্থির হল। ১৯২৭ সালের ১১ মে তাঁকে ইনসিন জেল থেকে এনে রেঙ্গুনে একটি নৌকায় ওঠানো হল। বঙ্গোপসাগর ধরে চার দিনের যাত্রাশেষে পৌঁছলেন ডায়মন্ড হারবারে। সেখানে সেই আগের পরিচিত পুলিশ অফিসার মিস্টার লোম্যানের সঙ্গে আবার তাঁর দেখা। ইনিই ১৯২৪ সালে সুভাষকে সঙ্গে করে মান্দালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই যখন তীরে নামার নির্দেশ পেলেন, সুভাষ ভারী সন্দিগ্ধ হয়ে পড়লেন, তবে কি আবারও কোনও ফন্দি আছে, তবে কি তাঁকে কলকাতায় না নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও চালান করা হচ্ছে! যাই হোক, কিছু পরে আশ্বাস মিলল যে বাংলার গভর্নর স্যার স্ট্যানলে জ্যাকসন নৌকাটি তাঁর অধীনেই রেখেছেন, এখন উচ্চপদস্থ কিছু ডাক্তার দিয়ে সুভাষের পরীক্ষানিরীক্ষা করানো হবে, থাকবেন গভর্নরের নিজের ডাক্তারও। পরের দিন সকালে, মিস্টার লোম্যান হাতে একটি টেলিগ্রাম নিয়ে উপস্থিত: গভর্নর নাকি সুভাষকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। স্ট্যানলে জ্যাকসন তবে “অকপট মন” নিয়েই এসেছিলেন, ভাবলেন সুভাষ, “সুদক্ষ রাজনীতিবিদের অভ্রান্ত বিচারশক্তির সাহায্যে তিনি জনগণের অভিযোগ বুঝতে পেরেছিলেন।”৫৩ পুলিশি স্বেচ্ছাচারিতা আপাতত বন্ধ করতেই চাইছিলেন জ্যাকসন, আর তাই বিনা বিচারে আড়াই বছর বর্মার জেলে বন্দি থাকার পর সুভাষচন্দ্র আজ অকস্মাৎ আবার এক জন স্বাধীন মানুষ!
জেলে থাকার সময় বেশ খানিকটা শিক্ষানবিশি হয়েছিল ঠিকই, তবু বর্মা থেকে ফেরার পরই নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে গোড়ায় নারাজ হচ্ছিলেন সুভাষ। বরং অকালপ্রয়াত স্বামীর কাজ হাতে তুলে নেওয়ার জন্য চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী বাসন্তী দেবীকে অনুরোধ জানালেন তিনি। “বাংলার সাধনা প্রধানত মাতৃমূর্তির মধ্য দিয়ে প্রকট হয়েছে,” তাঁকে লিখলেন সুভাষ। যে লক্ষ্মীছাড়ার দলের প্রতিনিধি হয়ে তিনি এই অনুরোধ নিয়ে এসেছেন, তার কারণ আত্মবিশ্বাসের অভাব নয়, তার কারণ, “মাকে বাদ দিয়া যে কোনও পূজাই হয় না।” মাদাম জগলুল পাশা কিংবা মাদাম সান-ইয়াত-সেন-এর উদাহরণ দিলেন তিনি, এঁরা তো মিশরীয় ও চিনা জাতির সংকটের সময়ে তাঁদের বিগত কীর্তিমান স্বামীদের কাজ নিজেদের হাতে নিয়েছিলেন। বাসন্তী দেবী কিন্তু পাদপ্রদীপের আলো এড়াতে চান। তিনি পিছন থেকে তাঁর দত্তক পুত্রকে সব রকমের মানসিক সহায়তা করতে প্রস্তুত। “সন্ন্যাসের শূন্যতার মধ্যে জীবন যেন শুকাইয়া না যায়: এই শূন্যতার মধ্যে যে অমৃত লুক্কায়িত আছে, তার সংস্পর্শে জীবন যেন মঙ্গলের দিকে ফুটিয়া উঠে, সেই আশীর্বাদ চাই।”৫৪
রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে কাজ শুরু করার আগে শরীরটাকে সারানো দরকার। গভর্নরের লঞ্চ থেকে তিনি সোজা গেলেন শরতের কলকাতার বাড়িতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি শহর শিলং-এ অসুস্থ সুভাষকে গ্রীষ্মকাল থেকে বর্ষা অবধি রাখা হবে, এমনই ঠিক হল। পাহাড়যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হলেন বেশ কয়েক জন পারিবারিক সদস্য। পাহাড়ি দেশে দিনের বেলা শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলো করে, রাতের বেলায় বই পড়ে চিঠি লিখে আইনসভায় কী কী প্রশ্ন উত্থাপন করবেন সে সব তালিকা করে কেটে গেল। প্রখ্যাত ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে দেখতে এলেন, দেখে গেলেন সুভাষের সাত বছর বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকেও, তার গায়েও তখন বেশ জ্বর।৫৫ ক’দিন পরে বৌদি বিভাবতী দেবী ও তাঁর ছেলেমেয়েদের কলকাতা ফিরতে হল। শরৎ তখন কলকাতার বার কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, ৩৮/২ এলগিন রোডের পিতৃভবন থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ১ উডবার্ন পার্কে প্রাসাদোপম বাড়ি বানাতে ব্যস্ত। কলকাতার এত সব কাজকর্ম, গৃহ-পরিবর্তন সব দায়িত্ব তখন বিভাবতীরই উপর। “আপনারা সকলে হঠাৎ চলে যাওয়াতে মুশকিলে পড়েছিলাম,” সুভাষ লিখলেন বিভাবতীকে। “খালি বাড়িটা খাঁ খাঁ করতে লাগল, মনটা কেমন করে উঠল, দৈনন্দিন জীবনের খেইগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল, বেশ কষ্ট হচ্ছিল বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।” সুভাষ ভেবেছিলেন জাগতিক মায়া-মমতার বন্ধন কাটিয়ে ফেলেছেন। এখন যেন কঠিন ভাবে তাঁকে কেউ মনে করিয়ে দিল, না, এখনও মায়া কাটেনি। বাসন্তী দেবী ও বিভাবতী— এই সময়ে তাঁর জীবনে দুই উল্লেখযোগ্য মহিলা ব্যক্তিত্ব, দু’ জনকেই মাতৃ-স্থানে বসিয়েছিলেন তিনি। এত বড় বড় চিঠিতে যে তিনি তাঁদের কাছে বক্তৃতা করে চলেছেন, সে দায় চাপাতেন বিলিতি শাসকদের উপর। বিলিতি সাহেবদের সঙ্গে তর্ক করতে করতে তাঁর মতো “লাজুক, ভীরু মানুষও” কবে যেন “বাচাল হয়ে উঠেছেন।” কয়েক দিন সময় লাগল আবার শান্ত চতুষ্পার্শ্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। বৌদিদিকে আশ্বাস দিয়ে লিখলেন, “নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, চারি দিকে পাহাড়ের সারি, বনের মধ্যে আলোছায়ার লুকোচুরি, ঝরনার অবিরাম কলকল স্বর, এ সব নিয়ে বেশ আছি।” বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এলে তিনি বাইরে বেরিয়ে পড়েন, সেই যেমন করতেন কটকে থাকতে, শেক্সপিয়রের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’-এর পঙ্ক্তি মনে পড়ে যায় তাঁর:
And this our life, exempt from public haunt
Finds tongues in trees , books in running brooks
Sermons in stones, and good in everything.৫৬
লোকচক্ষুর বাইরে থাকা অবশ্য খুব বেশি দিন সম্ভব হল না। পাহাড় থেকে সমতলে নামতেই বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হল সুভাষকে। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজের বার্ষিক অধিবেশনে জওহরলাল নেহরু এবং শোয়েব কুরেশির সঙ্গে তাঁকেও সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক করে দেওয়া হল। কয়েক বছরের নীরবতার পর ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যেন আবার তখন উদ্দীপিত হয়ে উঠছে সাইমন কমিশন তৈরির ঘোষণায়— স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে সাত জন শ্বেতকায় সদস্য নিয়ে গঠিত সেই কমিটি নাকি দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান নির্ধারণ করতে চলেছে। ব্রিটেনে তখন স্ট্যানলে বল্ডউইনের কনজারভেটিভ সরকার। পরের নির্বাচনে লেবার পার্টির কাছে হেরে যাওয়ার আশঙ্কাতেই সরকারের তড়িঘড়ি এই কমিশন তৈরির ঘোষণা।
সাইমন কমিশন যেন ভারতের জাতিত্বকেই খারিজ করতে বসেছিল, এ দেশকে কেবল সংঘর্ষরত নানা গোষ্ঠী ও স্বার্থের সমাহার বলে মনে করেছিল, একমাত্র ব্রিটিশ সংসদীয় নেতারাই যেন এই যুযুধান স্বার্থদের কোনওভাবে একত্র রাখতে সক্ষম, এমনটা ভেবে নিয়েছিল। যাদের নিয়ে এই কমিশন গঠিত হয়, এবং যে বার্তা তারা দিতে চায়, তাতে কেবল কংগ্রেসই ক্ষিপ্ত হয়নি, তেজবাহাদুর সাপ্রুর নেতৃত্বে লিবারেলরা, এবং মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগও এতে অসন্তুষ্ট হয়। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাইমন কমিশন ভারতে পা রাখার সময়ে সব দল মিলে একত্রে তাকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিল। সাইমনের সাত সদস্য শুনলেন “ফিরে যাও!” চিত্কার, যেখানে তাঁরা গেলেন, কালো পতাকা-সহ আন্দোলন চলল সর্বত্র। অল-পার্টি কনফারেন্স আহ্বান করে সর্বসম্মত ভাবে একটি সংবিধান তৈরির চেষ্টায় ১৯২৮ সালের মে মাসে কংগ্রেস একটি ছোট কমিটি তৈরি করল। মোতিলাল নেহরু এর প্রধান দায়িত্বে রইলেন। সুভাষচন্দ্র বসু আমন্ত্রিত হলেন অন্যতম সদস্য হিসেবে।
কংগ্রেসের এই কেন্দ্রীয় দলে অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ প্রবল ভাবে উঠেপড়ে লাগলেন ছাত্র ও যুব সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন তৈরির কাজে, নারী আন্দোলন তৈরির চেষ্টায়। আট বছরের বড় জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে যুগ্ম ভাবে সুভাষ হয়ে দাঁড়ালেন প্রগতিশীল বামপন্থী তরুণ জাতীয়তাবাদীদের নেতা। বর্মা জেলে থাকার অভিজ্ঞতার ফলে তাঁর যে বিশেষ গৌরব তৈরি হয়, তার জোরে এর মধ্যেই তিনি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের উদীয়মান তারকা। ১৯২৮-এর মে মাসে সবরমতী আশ্রমে গিয়ে গাঁধীর সঙ্গে দেখা করলেন, নতুন গণআন্দোলন শুরু করার অনুরোধ জানালেন। সারা দেশে ঘুরে ঘুরে অসংখ্য ছাত্র ও যুব গোষ্ঠী কিংবা শ্রমিক সভার সঙ্গে যোগ স্থাপন করলেন। মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মিলনে বক্তৃতায় বললেন, “গণতন্ত্র পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠান নয়, মানবিক প্রতিষ্ঠান।” জাতীয়তাবাদের সমালোচকদের কাছে জাতীয়তাবাদের যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দিলেন। সংস্কৃতির অঙ্গনে জাতীয়তাবাদ বিশ্ববাদকে ব্যাহত করে, এ কথা তিনি মানতে রাজি নন। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা দিলেন, তা কোনও ভাবেই সংকীর্ণ বা স্বার্থপরায়ণ বা আক্রমণাত্মক নয়, বরং তার বিশেষত্ব “সেবার ব্রত”, জাতির প্রতি সদস্যের মধ্যে “সৃষ্টিশীলতা” স্ফুরণের ক্ষমতা। “শ্রমিকদুনিয়া ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংযোগ” ঘটানোর কথা বললেন তিনি, যেখানে “শ্রমিক” কথাটি বৃহত্তর অর্থে কৃষককেও বোঝায়। তাঁর কল্পনায়, ভারত হবে “এক স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র”। দেশের জাতীয়তাবাদীদের সাবধান করলেন সুভাষ, “রাজনৈতিক দিক দিয়ে গণতন্ত্র আর সামাজিক দিক দিয়ে রক্ষণশীলতার বিচিত্র মিশেল”-এ যেন তাঁরা পরিণত না হন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর ঘোষণা:
আমরা যদি সত্যিই ভারতকে মহান করে তুলতে চাই, গণতন্ত্রবাদী সমাজের উপর ন্যস্ত রাজনৈতিক গণতন্ত্র আমাদের তৈরি করতেই হবে। জন্মপরিচয় বা জাতিধর্মপরিচয় নিঃসৃত সব রকম সুবিধা সরিয়ে রেখে জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সুযোগ দিতে হবে। নারীর অবস্থার উন্নতি করতে হবে, সব রকম কাজে আরও বড়, আরও অর্থপূর্ণ ভূমিকায় নিয়ে আসার জন্য তাদের তৈরি করতে হবে।
“সাম্প্রদায়িক ক্ষত সারানোর” “চটজলদি পদ্ধতিতে তিনি যে একেবারেই বিশ্বাস করতেন না তা নয়, তবে তাঁর মতে “সাংস্কৃতিক ঐক্যসাধনের” “গভীরতর নিরাময়ের” পথ সন্ধান আরও জরুরি। আক্ষেপ করতেন, ভারতে যত সব সম্প্রদায়ের বসবাস, তারা সকলেই পরস্পরের “বড় দূরে দূরে” থাকে। “সাংস্কৃতিক ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় মৌলবাদ”, তিনি বলতেন, “এবং সেই মৌলবাদকে আটকানোর একমাত্র পথ ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিস্তার।” এই প্রথম বার সুভাষ “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দটি ব্যবহার করলেন। তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সত্তার বিরোধিতা নয়, বরং ভারতের বিচিত্র বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে “সংস্কৃতির সেতু” নির্মাণের একমাত্র পথ। নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে ধর্মীয় ভাবের প্রতি যেন এক রকম বিদ্বেষ প্রোথিত ছিল, আর গাঁধী চেয়েছিলেন নানা ধর্মবিশ্বাসকে একত্র করে এনে গণ-আন্দোলন তৈরি করতে। সুভাষ যেন এই দুয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন। পরবর্তী কালে ভারতের সংবিধানে যে তিনটি নীতি প্রধান স্থান অধিকার করবে, সুভাষ যেন সেই তিনটি বিষয়ের দিকেই মনোযোগ দিতে চাইলেন: দেশবাসীর সার্বভৌমতা, সমান নাগরিক অধিকার, এবং বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর জন্য পৃথক নির্বাচনমণ্ডলীর বদলে সাধারণ নির্বাচনমণ্ডলী।৫৭
১৯২৮-এর জুলাইতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদে মোতিলাল নেহরু প্রার্থী হলে সুভাষ অত্যুত্সাহে তাঁকে সমর্থন জানালেন।৫৮ তবে মোতিলাল নেহরু কমিটির মতের সঙ্গে তিনি নিজেকে মেলাতে পারলেন না। ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য যে সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন বা ডোমিনিয়ন স্টেটাস, এ কথা তিনি মানতে পারলেন না। অগস্টে মোতিলাল নেহরুর পুত্র জওহরলাল এবং অন্যান্য তরুণ তুর্কির সঙ্গে লখ্নৌ-তে এক বৈঠকে বসলেন সুভাষ, পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য তাঁরা ইনডিপেন্ডেন্স ফর ইন্ডিয়া লিগ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। নভেম্বরে দিল্লিতে এই লিগের শুভ সূচনা হল, দেশের নানা প্রান্তে তার শাখা তৈরি হল, কংগ্রেস যাতে আরও কড়া অবস্থান নেয়, তার জন্য চাপ প্রদান শুরু হল। কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেস বার্ষিক অধিবেশনে বসল ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে। কংগ্রেসের এত দিনের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ দেখা গেল এই অধিবেশনেই, দেখা গেল বিপুল বিশাল ব্যবস্থাপনা।
এর মধ্যে সুভাষ থাকতে শুরু করেছেন ১ উডবার্ন পার্কে, শরতের নতুন বাড়িতে। সেখানেই এখন তাঁর সাংগঠনিক কাজকর্মের কেন্দ্র। কংগ্রেস অধিবেশনের কাজ যাতে ঠিকমতো চলে, তার দেখভালের জন্য তৈরি করেছেন কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক দল। নিরস্ত্র, শান্তিরক্ষক এই দলের মধ্যে আছে ঘোড়সওয়ার বাহিনী, আছে মোটরসাইকেল বাহিনী, মহিলাবাহিনী: সকলকেই দেওয়া হয়েছে সামরিক শৃঙ্খলার শিক্ষা, ইউনিফর্ম দেওয়া হয়েছে সবাইকে। ঝকঝকে ইউনিফর্ম পরিহিত সুভাষ যখন বাহিনীর জেনারেল কম্যান্ডার হিসেবে এসে দাঁড়ালেন, যেন ভবিষ্যতের একটি ঝলক দেখা গেল সে দিন। তরুণ সুভাষের ভক্তরা ভক্তিতে উদ্বেল হয়ে উঠলেন। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট দিয়ে এগিয়ে চলল শোভাযাত্রা, সামনে গাড়িতে দাঁড়ানো নেতার অনুপ্রেরণাময় মূর্তি দেখে এক জন মা তাঁর বালক সন্তানকে (যিনি পরবর্তী কালে এক জন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হবেন) বললেন, “দেখো, সুভাষ বসু চলেছেন, হাত জোড় করে নমো করো বাবা।”৫৯ এ হেন শোভাযাত্রা দেখে একেবারে প্রসন্ন হলেন না মহাত্মা গাঁধী, তাঁর মনে হল স্বেচ্ছাসেবকরা সব যেন বার্ট্রাম মিলস্-এর সার্কাস পার্টি। এতটুকুও না দমে সুভাষ গাঁধীর রাজনৈতিক কর্মসূচির একটা বিকল্প কর্মসূচি, সাহসী কর্মসূচি প্রস্তাব করলেন।
কলকাতা কংগ্রেসের মুক্ত অধিবেশনে মহাত্মা গাঁধীর বিরুদ্ধতা করে সংশোধনী আনলেন সুভাষ, ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’-এর বদলে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ দাবি করলেন। মূল প্রস্তাবে যেমন চাওয়া হয়েছিল, ব্রিটিশদের যে বারো মাসের মধ্যে সেই ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’ দেওয়ার “কোনও সম্ভাবনাই” নেই, এ ছিল সুভাষের স্পষ্ট বিশ্বাস। ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র প্রস্তাব একটা নতুন মানসিকতার জন্ম দেবে, ভারতের রাজনৈতিক দুর্ভাগ্যের পিছনে যে “দাসত্বের মানসিকতা” রয়েছে, তার থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। মহাত্মা গাঁধী বা মোতিলাল নেহরুর মতো বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি অশ্রদ্ধা না দেখিয়েও সুভাষ ঠিক করলেন, অগ্রাধিকার দিতে হবে “নীতির প্রতি শ্রদ্ধা”কেই।৬০ তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব অবশ্য হেরে গেল ১৩৪০ বনাম ৯৭৩ ভোটে। গাঁধী প্রতিশ্রুতি দিলেন, যদি ১৯২৯ বছরটার মধ্যেও ভারতের জন্য হোম রুল না আনা যায়, তিনি নিজেও এক জন পূর্ণ স্বাধীনতা-পন্থী “ইনডিপেন্ডেন্স-ওয়ালা” হয়ে যাবেন।
১৯২৯-এর গোটা বছরটা ধরে সুভাষচন্দ্র বসু ব্যক্তি ও জাতির পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করে বেড়ালেন। ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য তরুণরা তাঁর উন্মুখ শ্রোতা। ১৯২৯-এ হুগলি জেলা ছাত্র সভায় কথা বলতে গিয়ে তিনি যুক্তি দিলেন, ‘এক’ ও ‘বহু’-র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমেই মানবজীবনের বহু বৈচিত্র্যের মধ্যে ব্যক্তিগত ও জাতিগত পূর্ণতা লাভ করা সম্ভব। ছাত্রদের মনে করিয়ে দিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ “বহু সংস্কৃতি-র মুক্ত ঐক্যে” বিশ্বাস করতেন, এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে, তিনি ভারতের জন্য “কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধরনের কাঠামোই বেশি পছন্দ করতেন।” তরুণদের বলতেন, তারা যেন পিছিয়ে-থাকা দরিদ্র সামাজিক গোষ্ঠীগুলিকে পাশে টেনে নেয়। “আমাদের দেশে তিনটি সমাজ এখনও সম্পূর্ণ নিদ্রিত: নারীসমাজ, অনগ্রসর জাতি-জনজাতি সমাজ এবং শ্রমজীবী সমাজ। চলো আমরা তাদের কাছে যাই, তাদের বলি, ‘তোমরাও মানুষ, মানবজাতির সমস্ত অধিকার তোমাদের সকলের প্রাপ্য। সুতরাং উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত, প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’”৬১
১৯২৯-এ এই সামাজিক গোষ্ঠীগুলি অনেকেই, বিশেষ করে শ্রমিক সম্প্রদায়, কিন্তু সত্যিই জেগে উঠেছিল, নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বেশ কিছু ধর্মঘট সংগঠন করেছিল। গাঁধী বম্বে এবং অন্যত্র এই সব বিক্ষুব্ধ শ্রমিক ধর্মঘটের চেহারা-চরিত্র দেখেই স্থির করলেন, ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে যে কোনও ধরনের সম্মুখ-সংঘর্ষ আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। গাঁধী সর্বশ্রেণির মিলনে আস্থাবান ছিলেন, শ্রেণিভিত্তিক জঙ্গিপনা যখন উত্তাল হয়ে উঠছে, তেমন কোনও সময়ে জাতীয়তাবাদী গণ-আন্দোলন আরম্ভ করার কথা ভাবতেই পারতেন না। সুভাষচন্দ্র বসুর পথ কিন্তু অন্য রকম। জামশেদপুরের টাটা লৌহ-ইস্পাত কোম্পানির কর্তাদের বিরুদ্ধে শিল্পশ্রমিক বিক্ষোভে তিনি নেতৃত্ব দিতে ছুটলেন। বম্বের শ্রমিক আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা যখন মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হলেন, আইনি সহায়তা দিতে গেলেন সুভাষ।
এক দিকে ব্রিটিশ অত্যাচার, আর এক দিকে গাঁধীর এই সময়-কেনার কৌশল: আরও একটি ঘটনা ঘটে গেল এর ফলে। সশস্ত্র বিপ্লবীরা আরও এক বার সক্রিয় হয়ে ওঠার রাজনৈতিক অবকাশ পেয়ে গেলেন, বিশেষত পঞ্জাব প্রদেশে। লাহোরে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে লালা লাজপত রায় ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর পুলিশের হাতে বেধড়ক মার খেলেন। ১৭ নভেম্বর মারা গেলেন পঞ্জাবের এই বরেণ্য জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী। ঠিক এক মাস পরে, ১৭ ডিসেম্বর, তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে কুড়ি বছর বয়সের শিখ তরুণ ভগত সিংহ লাহোরের পথে এক পুলিশ অফিসারকে গুলি করে মারলেন। আর ১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভার অভ্যন্তরে কয়েকটি ছোট আকারের বোমা ছোড়া হল, ছুড়ে দেওয়া হল কয়েকটি পুস্তিকাও। পুস্তিকাগুলিতে লেখা “কানে যারা কম শোনে তাদের শোনানোর জন্য চাই বড় মাপের আওয়াজ”। ঘটনাটা ঘটালেন সেই ভগত সিংহ ও বটুকেশ্বর দত্ত। সরকার উত্তরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহুসংখ্যক তরুণকে গ্রেফতার করল, এবং ১৯২৯-এর মধ্যভাগে শুরু হল তাঁদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। বন্দিদের যে কুত্সিত অবস্থায় জেলে রাখা হয়েছিল, তার প্রতিবাদে জেলেই অনশন শুরু করলেন বেশ কিছু অভিযুক্ত। ফল দাঁড়াল এই যে, কেন্দ্রীয় আইনসভায় ফৌজদারি আইন সংশোধনের চেষ্টা শুরু করল সরকার, যাতে অনশনরত বন্দিদের হাজির না করেই বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়।
ফৌজদারি বিচারের মৌলিক নীতি ভঙ্গের এমন প্রয়াসের তীব্র বিরুদ্ধতা করলেন কেন্দ্রীয় আইনসভার বেশ কয়েক জন ভারতীয় সদস্য, যাঁদের মধ্যে কয়েক জনের নাম এম এ জিন্না, মোতিলাল নেহরু, এম আর জয়াকর। বিশেষ করে জিন্নার মুখে শোনা গেল “সরকারের এই আসুরিক ব্যবস্থার” বিরুদ্ধে “সার্বিক বিরোধিতার” জোরালো প্রতিজ্ঞা। বিচারাধীন বন্দিদের প্রতি মানবিক ব্যবহারের দাবি জানালেন তিনি। শোনা গেল তাঁর অভ্রান্ত যুক্তি, “অনশনকারীরও অন্তরাত্মা আছে,” এবং “সেই অন্তরাত্মার নির্দেশেই সে নিজের কর্মপথে প্রবৃত্ত হয়েছে: যে কোনও সাধারণ শীতল-হৃদয় অন্যায়কারী অপরাধীর সঙ্গে তাকে কোনও ভাবে এক করে দেখা সম্ভব নয়।”৬২ সরকারের অবশ্য এতে কোনও হেলদোল দেখা গেল না। কয়েক দিন পর, সপ্তাহ কাটতে না কাটতে যখন অনেক অপরাধীই অনশন ভঙ্গ করতে শুরু করেছেন, বাংলার এক পঁচিশ বছর বর্ষীয় যুবক— যতীন্দ্রনাথ দাশ— তেষট্টি দিন পর্যন্ত দৃঢ় ভাবে চালিয়ে গেলেন অনশন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর জীবনদীপ নিবে গেল। বাংলায় বসে রবীন্দ্রনাথ যখন এই শোকসংবাদ পেলেন, রচনা করলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গানটি:
সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ—
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্তপানে চাহো।
দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ যাহা ক্ষুদ্র—
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উত্সাহ।
দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত।
শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত,
তব দীপ্ত রৌদ্রতেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে
প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ।৬৩
১৯২০ সালে একই ভাবে ব্রিক্সটন জেলে মারা গিয়েছিলেন কর্কের মেয়র টেরেন্স ম্যাকসুইনি। তাঁর পরিবার টেলিগ্রাম করে জানালেন, যতীন দাশের সংবাদ পেয়ে তাঁরা একই সঙ্গে “শোক ও গর্ব” অনুভব করছেন, জানালেন “স্বাধীনতা আসবেই”। লাহোর থেকে কলকাতায় যতীন দাশের মরদেহ নিয়ে আসার সময় রেলওয়ে স্টেশনে ভেঙে পড়ল জনস্রোত, শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন তাঁরা। ১৯২৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক দলে কাজ করতেন যতীন দাশ, আর আজ সেই সুভাষই তাঁর শেষকৃত্যের দায়িত্ব নিলেন। কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে হাতে একটা কাগজের ছোট মোড়ক নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সুভাষ, ১ উডবার্ন পার্কে বাড়ির মার্বলের সিঁড়ির কাছে মার্বলের মূর্তির মতোই স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিভাবতী দেবীকে বললেন, “যতীন দাসের অস্থি, যত্ন করে রেখে দেবেন।”৬৪
১৯২৯ সালের অক্টোবরে সুভাষ কলকাতা থেকে লাহোর গেলেন। পঞ্জাবি ছাত্র সমাবেশে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতার বক্তব্য পেশ করলেন। স্বাধীনতার লক্ষ্যে যতীন দাশের আত্মোত্সর্গের মহিমা তুলে ধরলেন। “যতীনকে মৃত কী করে বলব, স্বর্গের ‘পবিত্রতম’ তারা হয়ে সে যে এখন উত্তরপ্রজন্মকে পথ দেখাচ্ছে।” ছাত্র আন্দোলনকে “ভবিষ্যতের নাগরিক তৈরির পাঠশালা” বলে মনে করতেন সুভাষ। তাঁর মনে হয়েছিল, “কংগ্রেস যদি নিজের শক্তি, প্রভাব বা ক্ষমতার প্রসার চায়, তবে তাকে অবশ্যই এই সব আন্দোলনের উপর নির্ভর করতে হবে: শ্রমিক আন্দোলন, যুব আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন।” ছাত্রদের বললেন, তারা যেন মনে রাখে তাদের পাথেয় হবে “স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রাণদান”-এর বাণী।৬৫ পরে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন সুভাষ, পঞ্জাবের মানুষের কাছ থেকে তিনি “অপর্যাপ্ত পরিমাণ ভালবাসা, দয়া আর শ্রদ্ধা পেয়েছেন।” তবে ভিড়ের মধ্যেও একাকিত্ব ঘোচেনি। “আমি শৈশব হইতে স্বভাবতঃ বড় লাজুক— এখনও তাই— সভাসমিতিতে বক্তৃতা করা সত্ত্বেও। লোকে মনে করে আমি অহঙ্কারী। আমি আর যাহা হই না কেন, অহঙ্কারী নহি,” বলেছিলেন তিনি।৬৬
১৯২৯ সালের ৩১ অক্টোবর ভাইসরয় লর্ড আরউইন ঘোষণা করলেন যে লন্ডনের লেবার সরকারের নির্দেশক্রমে তিনি জানাচ্ছেন: ভারতের সাংবিধানিক পথে এ ভাবে অগ্রসর হওয়ার অর্থই হল শেষ পর্যন্ত ডোমিনিয়ন স্টেটাস প্রাপ্তি, এবং সাইমন কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হলেই একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করা হতে চলেছে। কংগ্রেস নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সঙ্গে সঙ্গে একটি ম্যানিফেস্টো তৈরি করে ফেললেন, ভারতের ডোমিনিয়ন কেমন হতে চলেছে তার একটা খসড়া বানানোর পরিকল্পনা শুরু করলেন। জওহরলাল নেহরু প্রথমটায় একটু দ্বিধান্বিত থাকলেও পরে তিনিও এই মতেই মত দিলেন। গাঁধী তাঁকেই নির্বাচন করলেন জাতীয় কংগ্রেসের লাহৌর অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে। “মহাত্মার প্রভাবে জওহরলাল এখন স্বাধীনতার দাবি ছেড়ে দিয়েছেন,” বাসন্তী দেবীকে জানালেন সুভাষ।৬৭ সুভাষ ও আরও দুই জন— লাহোরের সাইফুদ্দিন কিচলু ও পাটনার আবদুল বারি— একত্রে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি ম্যানিফেস্টো বানালেন, গোলটেবিল বৈঠক বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলেন। আয়ার্ল্যান্ডের ক্ষেত্রে লয়েড জর্জ-এর যে সাংবিধানিক কনভেনশন সিন ফেইন সঙ্গত ভাবেই অস্বীকার করেছিল, এও যেন তেমনই আর একটা ফন্দি। গাঁধী এবং আরউইনের পরবর্তী কথাবার্তা থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হল, ডোমিনিয়ন স্টেটাস বিষয়ে এ রকম কোনও আশ্বাস দেওয়ার অধিকারই নেই ভাইসরয়ের। সব মিলিয়ে, বছর শেষ হওয়ার আগেই ইরাবতী নদীর তীরের শহর লাহোরে ইতিহাসের মঞ্চ প্রস্তুত হতে লাগল।
কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন লাহোরে শুরু হতেই মহাত্মা গাঁধী তাঁর এক বছর আগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন, স্বাধীনতা-পন্থী বা “ইনডিপেন্ডেন্স-ওয়ালা” হয়ে গেলেন। পূর্ণ স্বরাজ, অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদই যে এখন থেকে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক লক্ষ্য হবে, এই মর্মে ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করলেন। এই পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রেখে কংগ্রেসের সংবিধানও পাল্টানো হল। সুভাষচন্দ্র বসু আর একটি প্রস্তাব পেশ করলেন, যার বক্তব্য, কংগ্রেসের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশে একটি সমান্তরাল সরকার তৈরি করা— এবং সে কাজে শ্রমিক, কৃষক ও যুব সংগঠনের সাহায্য নেওয়া। এই প্রস্তাব অবশ্য পাশ হল না। আর এখানেই প্রমাণ থেকে গেল, কেমন ভাবে তাঁর সমসাময়িকদের থেকে সর্বদাই এক কদম এগিয়ে থাকতেন সুভাষ। তবে, কংগ্রেস যে সরাসরি ভারতকে বিদেশি সৈন্যের পদানত দেশ বলে বর্ণনা করল, তাতে তিনি সন্তুষ্ট হলেন।
কংগ্রেস ঘোষণা করল, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস বলে পালন করা হবে। দুর্ভাগ্যবশত সুভাষ সে দিনটি পালন করতে পারলেন না। লাহোর থেকে কলকাতায় ফেরামাত্র আবার তিনি গ্রেফতার হলেন। ২৩ জানুয়ারি তেত্রিশ বছরে পা দিলেন তিনি, আর সে দিনই জন্মদিনের উপহার হিসেবে পেলেন এক বছরের জেলবাসের শাস্তি। অভিযোগ? দেশদ্রোহিতা, বেআইনি মিছিলে অংশগ্রহণ। বাসন্তী দেবীকে লিখলেন তিনি, “আমরা সকলে ভাল আছি, বেশ আনন্দের সঙ্গে জয়যাত্রা করব— রাজমন্দিরের দিকে।”৬৮ কারাগারের অভ্যন্তর থেকেই সুভাষ প্রশংসার চোখে দেখতে লাগলেন, গাঁধী কেমন ভাবে তাঁর পরবর্তী আন্দোলন আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করলেন। “তাঁর নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের কয়েকটি মুহূর্ত দেখা গেল” সেই সময়েই, দেখা গেল সংকটের সময়ে কোন উচ্চতায় উঠতে পারে “তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা।”৬৯ গাঁধী তাঁর অনুগামীদের বললেন, নির্বাক অহিংসা ছেড়ে বেরিয়ে এসে “সবচেয়ে সক্রিয় ধরনের অহিংসায়” আত্মনিয়োগ করতে হবে এ বার। নুন তৈরির কাজে সরকারের একচেটিয়া অধিকার ভঙ্গ করে ১৯৩০ সালের মার্চে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলেন তিনি। আটাত্তর জন সত্যাগ্রহীর একটি ছোট দল-সহকারে তাঁর সমুদ্রতীর যাত্রা গোটা দেশকে একেবারে শিহরিত করে তুলল। একটি অসম্ভব শক্তিশালী প্রতীক দিয়ে তিনি শুরু করলেন ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে তাঁর এই আর একটি গণ-আন্দোলন। লবণ আইন অমান্যের পর শুরু হল ব্রিটিশপণ্যের বয়কট, বিলিতি মদের দোকানে সরকারি শুল্ক বর্জনের পিকেটিং, কিংবা গ্রামেগঞ্জে কর না দেওয়ার আন্দোলন। ব্রিটিশ রাজও প্রত্যাঘাতে দেরি করল না: রাস্তায় নামল পুলিশ, গ্রেফতার শুরু হল।
জেলে ঢুকে প্রথম কয়েক মাস শান্ত ভাবে পড়াশোনা আর ধ্যানে কাটিয়ে দিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩০ সালের এপ্রিলে এক কাণ্ড হল: অন্য বন্দিদের উপর জেলরক্ষীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি এবং আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের আরও কয়েক জন কংগ্রেস নেতা বেধড়ক লাঠির মার খেলেন। সুভাষের মাথায় ভাল রকম চোট লাগল, প্রায় আধ ঘণ্টা তাঁর জ্ঞান রইল না।৭০ বাংলায় ব্যাপক হারে আইন অমান্য শুরু হল, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদও তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। সে বছরের ইস্টারের ছুটিতে সূর্যকুমার সেন-এর নেতৃত্বে আয়ার্ল্যান্ডের ১৯১৬ সালের বিপ্লবকে স্মরণ করে এক দল বিপ্লবী চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ করলেন, বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সেই জেলায় চলল বিপ্লবীদের সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর রক্তাক্ত সংঘর্ষ। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অভিযুক্ত বিপ্লবীদের বিচারের সময় শরৎচন্দ্র বসু তাদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে তিন তরুণ বাঙালি বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দিনেশ গুপ্ত কলকাতায় ব্রিটিশ রাজের সদর দফতর রাইটার্স বিল্ডিং-এ আক্রমণ হানলেন, সেখানকার জেলের যে ইন্সপেকটর জেনারেল, তাঁকে গুলিতে হত্যা করলেন। বিল্ডিং-এর বারান্দা থেকে বিস্মিত ক্রুদ্ধ পুলিশের উপর গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগোলেন তাঁরা যত ক্ষণ না তাঁদের বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে যায়। বিনয় বসু ও বাদল গুপ্ত মারাত্মক আহত অবস্থায় সেখানেই প্রাণ হারালেন, দিনেশ গুপ্তর বিচার ও ফাঁসি হল। মেদিনীপুর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডি কর দিতে নারাজ চাষিদের উপর গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিলেন, বিপ্লবীদের হাতে তাঁর প্রাণ গেল। আরও দুই জন ব্রিটিশ অফিসারেরও একই দশা হল। স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা নতুন পর্বের সূচনা হল, সে পর্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি চরমভাবাপন্ন।
প্রবল আবেগের জোয়ারের মধ্যে জেলে বসেই সুভাষচন্দ্র বসু এ বার কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হলেন তত্কালীন মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে হারিয়ে। দু’জনেই কংগ্রেসের সদস্য, ফলে ব্যাপারটা একটা আন্তর্দলীয় সংঘর্ষের চেহারা নিল। তবে সুভাষচন্দ্র ও যতীন্দ্রমোহনের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে কেবল বাংলা কংগ্রেসের দুই শিবিরের লড়াই-ই টের পাওয়া গেল না, দেখা গেল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরের নেতৃত্বের মধ্যেকার সম্পর্কের জটিলতাও। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর গাঁধী নিজেই যতীন্দ্রমোহনকে এই পদে অভিষিক্ত করেছিলেন, কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের আদেশনির্দেশ শিরোধার্য করতেই তিনি মোটের উপর অভ্যস্ত ছিলেন। উল্টো দিকে, সুভাষের মধ্যে ফুটে উঠছিল বাংলার বিদ্রোহী ঘরানা, কেবল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নয়, কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ লক্ষিত হত সেই ঘরানায়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যে অল্প সময়ের জন্য মেয়র হিসেবে তিনি কাজ করতে পেরেছিলেন, পৌর কার্যপ্রণালীতে তিনি তাঁর গুরুর ভাবধারা অনুসরণের প্রয়াস করেছিলেন। ১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণ ভাবে স্বাধীনতা দিবসের শোভাযাত্রা চালনা করার সময়ে তাঁর উপর অশ্বারোহী পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে, নির্মম প্রহারে তাঁকে টেনে নিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কলকাতার লালবাজারে। পরের দিন কলকাতার মেয়রকে রক্তাক্ত বস্ত্রে স্থানীয় আদালতে হাজির করা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গাহাঙ্গামার অভিযোগ। আবারও জেলে চালান হন তিনি। ঔপনিবেশিক শাসকরা বিলক্ষণ জানতেন, সুভাষ তাঁদের কাছে কত বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারেন, সুতরাং তাঁকে আটকাতে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
সাইমন কমিশনের রিপোর্ট বার হল ১৯৩০-এর জুলাই-এ। ভারতের সব বড় দলগুলি তা প্রত্যাখ্যান করল। লন্ডনের প্রথম গোলটেবিল বৈঠক বয়কট করল কংগ্রেস, স্বভাবতই কোনও লাভ হল না সেই গোলটেবিল থেকে। তাই ১৯৩১-এর গোড়ায় ভাইসরয় লর্ড আরউইন মহাত্মা গাঁধীকে ডেকে পাঠালেন কথাবার্তার জন্য। ‘অর্ধনগ্ন ফকির’টি ভাইসরয়ের প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সম্রাটের প্রতিনিধির সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলছেন, এই দৃশ্য দেখে উইনস্টন চার্চিলের ‘বিবমিষা’র উদ্রেক হলেও মানতেই হবে যে, ভারতের কৃষক জনসাধারণের কাছে গাঁধী তখন সম্রাটেরই সমতুল্য। চেহারার দিক দিয়েই হোক, আশা-আকাঙ্ক্ষার দিক দিয়েই হোক, নেতা ও নেতার অনুসারী সমাজ সে দিন যেন একেবারে অভিন্ন। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, দখলিকৃত জমির কিছু অংশ প্রত্যর্পণ, উপকূলবাসী মানুষের লবণ তৈরির উপর করের বোঝা না চাপানো— এই সব দাবি পূরণের পরিবর্তে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করতে রাজি হলেন গাঁধী, রাজি হলেন লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে।
জেলে যে সব স্বাধীনতা সংগ্রামী সে দিন বন্দি, তাঁদের আবারও মনে হল, ১৯৩১-এর মার্চে গাঁধী-আরউইন চুক্তিতে তাঁদের নেতা বড্ড অল্পের জন্য বড্ড বেশি কিছু ছেড়ে দিলেন। সুভাষও খুবই হতাশ হয়ে পড়লেন, তবে মহাত্মার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ না পাওয়া অবধি তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করবেন না সিদ্ধান্ত নিলেন। মুক্তি পাওয়া মাত্র গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে বম্বে দৌড়লেন তিনি, নিশ্চিন্ত হলেন জেনে যে নেতৃবর কিন্তু স্বাধীনতার বিষয়ে তাঁর অবস্থানে কোনও পরিবর্তন ঘটাননি। বম্বে থেকে দিল্লি একসঙ্গে গেলেন তাঁরা দু’জন, পথেও কথা চলতে লাগল, নিজের চোখে দেখলেন প্রতিটি স্টেশনে কী বিপুল উদ্দীপনা গাঁধীকে নিয়ে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করেছেন তিনি তখন। দিল্লি পৌঁছনোর পর কিন্তু সুভাষের জন্য অপেক্ষা করছিল প্রবল আঘাত: তিনি জানতে পারলেন পঞ্জাবি বিপ্লবী ভগত সিংহ ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের ফাঁসির হুকুম দিয়েছে সরকার। মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহৃত হতে পারে, এমন একটা গুজব চলছে চতুর্দিকে। ভাইসরয় যখন বুঝতে পারলেন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গাঁধী চুক্তি ভেঙে দেওয়ার কথা ভাববেন না, ভগত সিংহ, রাজগুরু ও সুখদেবকে সোজা ফাঁসিকাঠে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
এই ভয়ঙ্কর শোচনীয় ঘটনার মধ্যেই করাচিতে আরম্ভ হল কংগ্রেসের বার্ষিক বৈঠক। জওহরলাল নেহরু ১৯৩১ সালে খেয়াল করলেন, অসামান্য জনপ্রিয়তার নিরিখে ভগত সিংহ তখন প্রায় গাঁধীর সমকক্ষ। লালা লাজপত রায়ের সম্মানের রক্ষক হিসেবে তাঁকে দেখা হত। তাঁকে ঘিরে যে সব গান বাঁধা হয়েছিল, সেগুলি লোকসংগীতের স্তরে উন্নীত হয়ে গিয়েছিল।৭১ মৃত্যুর পর এই তেইশ বছরের যুবক যেন যুব-ভারতের নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন— লক্ষ করলেন সুভাষচন্দ্র। হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে, তার সত্যতা যাচাই করার প্রশ্নই নেই কারও মনে; বরং বন্দিত্বের সময়ে তাঁর নির্ভীকতা, তাঁর পঞ্জাবের ধর্মীয় সংঘর্ষের ঊর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতাই মুগ্ধ করল সকলকে। করাচি কংগ্রেসে ভগত সিংহ ও তাঁর সঙ্গীদের সাহস ও ত্যাগের প্রশংসায় একটি প্রস্তাব পাশ হল, যদিও তার মধ্যে রইল সব রকমের হিংসার পথের সমালোচনাও। ১৯২৪-এ যে গোপীনাথ সাহা প্রস্তাব আনীত হয়েছিল, এই প্রস্তাবটিও প্রায় তেমনই, তবে গাঁধী প্রথমটির ক্ষেত্রে যেমন বিশেষ আপত্তি জানিয়েছিলেন, ১৯৩১ সালে দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে কিন্তু অহিংসা-মতাবলম্বীদের এ বারের প্রস্তাব হজম করা ছাড়া গত্যন্তর রইল না।৭২ দলের বামভাবাপন্ন অংশ গাঁধী-আরউইন চুক্তি নিয়ে কোনও প্রতিবাদ না করলেও অসন্তুষ্ট হলেন, এবং কংগ্রেসের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন যে ভারতীয় জনসাধারণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে।
করাচি বৈঠক চলাকালীনই সুভাষচন্দ্রকে সর্বভারতীয় নওজওয়ান ভারত সভার দ্বিতীয় বার্ষিকী সভায় সভাপতিত্ব করতে আহ্বান করা হল। ভগত সিংহের আদর্শে উদ্বুদ্ধ জঙ্গি তরুণ গোষ্ঠী পরিচালিত এই সংগঠনটি। তাবড় কংগ্রেস নেতাদের থেকে এই র্যাডিক্যাল তরুণসমাজের সান্নিধ্যেই সুভাষ বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করলেন, স্পষ্ট ভাবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করতে পারলেন। “আমাদের যৌথ জীবনের ভিত্তি” যে যে নীতির উপর দাঁড়িয়ে— সুবিচার, সাম্য, স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা এবং ভালবাসা— সেই নীতিগুলিকে পরিষ্কার করে আলোচনা করলেন। “বলশেভিজম-এর মধ্যে মানবতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ রয়েছে,” তাঁর বিশ্বাস, কিন্তু “সব দেশে, বা সব জাতির ক্ষেত্রে এই সব বিমূর্ত আদর্শ একই ভাবে বা একই উপায়ে বা একই পরিমাণে প্রয়োগ সম্ভব নয়” বলে তিনি মনে করেন। ভারতের জন্য একটা “নতুন ধরনের সমাজতন্ত্র” চাইতেন তিনি। যুবসমাজের জন্য তাঁর বার্তা, “বিদেশ থেকে গতিনির্দেশ বা অনুপ্রেরণা নেওয়া যেতে পারে,” তবে “আমরা ভুলে যেতে পারি না যে অন্ধ ভাবে অন্য কোনও জাতির অনুসরণ করা উচিত নয় এবং যা আমরা অন্যদের কাছ থেকে শিখেছি, নিজেদের জাতির প্রয়োজন বুঝে, নিজেদের জাতির শক্তিমত্তার জায়গাটা অনুধাবন করে সে সব আমাদের আত্মস্থ করা উচিত।”৭৩
ছাত্র ও তরুণদের পাশাপাশি সুভাষচন্দ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আর একটি ধারা তৈরির চেষ্টা করলেন শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে। অর্থনৈতিক মন্দার জন্য তাঁদের তখন অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। ১৯২৯-এর শেষ দিকে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস-এর সভাপতি নির্বাচিত হলেন সুভাষ। ১৯৩১ সালের শ্রমিক সভার সভাপতির ভাষণে তিনি বিশেষ কতগুলি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন, বেকারত্ব, কর্মী ছাঁটাই, এবং বিশ্বময় মহা-মন্দার প্রেক্ষিতে মাইনেপত্রের অবস্থা। ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের মধ্যে যে দক্ষিণপন্থী ধারা, এবং “মস্কোর মতবাদে বিশ্বাসী ও অনুসারী” “কমিউনিস্ট বন্ধু”দের মধ্যে একটা মধ্যপন্থা তৈরি করার চেষ্টাও করছিলেন তিনি। বার বার “সামগ্রিক সমাজতন্ত্রে” তাঁর আস্থার কথা বললেন, চাইলেন ভারত যেন “তার নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক ধারা ও তার নিজস্ব পথপ্রকরণ তৈরি করে নেয়।”৭৪
সুভাষচন্দ্র বসুর বিশ্বাস, লন্ডনের দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে মহাত্মা গাঁধীকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো জাতীয় কংগ্রেসের একটা বড় রাজনৈতিক ভুল। একশো আমন্ত্রিত অতিথি, যাঁদের অধিকাংশই “অনামা অখ্যাত স্বঘোষিত নেতা”, তাঁদের মধ্যে গিয়ে পড়ে গাঁধীর পক্ষে জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলিতে মন দেওয়াই তো কঠিন ব্যাপার, তার ওপর ব্রিটিশরা যখন নানাবিধ সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের উপর জোর দেওয়ারই চেষ্টা করে চলেছে। যা হোক, সুভাষ অবশ্য গাঁধীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলেন, তিনি লন্ডনে রওনা হওয়ার আগে একটি বার্তা পাঠালেন— ভারতের সম্মান যে গাঁধীর হাতে কতখানি নিরাপদ, সে বিষয়ে আস্থা জানাল তাঁর সেই বার্তা।৭৫ তবে ঘটনা হল, সভাকক্ষের বাইরে ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষকে গাঁধী তাঁর ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধি দিয়ে যতখানি প্রভাবিত করতে পারলেন, সভার মধ্যে কিন্তু স্বাধীনতা লাভের বিষয়টি নিয়ে এতটুকুও সাফল্য অর্জন করতে পারলেন না। ১৯৩১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সেই গোলটেবিল বৈঠকে গোটা-বারো বক্তৃতা দিলেন, কিন্তু তবু, ব্রিটিশরা সে দিন টেবিলে যত ক্ষুদ্রতর সংগঠনকে আহ্বান করে এনেছে তাদের থেকে ভারতের প্রধান জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের পার্থক্য ঠিক কোথায়, সেটা বোঝাতে তাঁকে আগাগোড়া প্রবল বেগ পেতে হল। মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিংবা পশ্চাত্পর জাতিগুলির কিছু দাবি সত্যিই সঙ্গত, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় ঐক্যের দফা রফা করবে, এই আতঙ্ক প্রথম থেকেই তাঁকে তাড়া করছিল। সুতরাং শেষ পর্যন্ত শূন্য হাতেই লন্ডন থেকে ফিরলেন তিনি— প্যারিস, জেনিভা এবং রোম হয়ে। জেনিভায় দেখা হল ফরাসি পণ্ডিত, ভারতবন্ধু রোম্যা রোল্যাঁর সঙ্গে। রোমে বেনিটো মুসোলিনি গাঁধীকে বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা দিলেন। ১৯৩১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এস এস পিলস্না-র ডেক থেকে বম্বের মাটিতে পা রাখলেন মহাত্মা গাঁধী।
লর্ড উইলিংডন তখন ভাইসরয়। যুদ্ধং দেহি তাঁর ভঙ্গি, জাতীয়তাবাদীদের কোনও রকম ছাড় দিতে তাঁর একান্ত অনীহা। ফলে গাঁধী ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে ১৯৩২-এর জানুয়ারি থেকে আবার আইন অমান্য আন্দোলনে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর কোনও পথ খোলা রইল না। আবার শুরু হল ব্রিটিশ পণ্য ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বয়কট, যে সব আইন অত্যন্ত অন্যায্য বলে মনে হল, অহিংস সত্যাগ্রহীরা আবার সেগুলি ভঙ্গ করে গ্রেফতার হতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার কিন্তু এই নতুন প্রতিবাদী আন্দোলনের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ার জন্য মোক্ষম সব পরিকল্পনা করে রেখেছে। কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে সব কংগ্রেসি নেতাদের জেলে পোরা হয়েছে। তাই, ১৯৩০-এর তুলনায় ১৯৩২ সালে যদিও অনেক বেশি সংখ্যায়, প্রায় লক্ষেরও বেশি আইন অমান্যকারী গ্রেফতার হলেন, তাতে অবশ্য আন্দোলনের তীব্রতার থেকে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির কার্যকারিতাই প্রমাণিত হল। ১৯৩০-এ গাঁধীর পদক্ষেপের মধ্যে, তাঁর লবণ আইন লঙ্ঘনের সিদ্ধান্তের মধ্যে যে বিস্ময়-উদ্রেককারী নতুনত্ব ছিল, এই দ্বিতীয়বার আর সেটা রইল না, সরকারের পক্ষে আন্দোলনের মোকাবিলা করা সহজ হল। গ্রেফতার-হওয়া কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে স্বভাবতই সুভাষও ছিলেন। তাঁকে পাঠানো হল সেন্ট্রাল প্রভিন্স-এর প্রত্যন্তে, সেওনি জেলে। একটাই ভাল ব্যাপার এ বার, কিছু দিনের মধ্যেই ওই একই জেলে তাঁর সঙ্গী হিসেবে এলেন মেজদাদা শরৎ। শরৎ তাঁর আইন-ব্যাবসা বন্ধ রেখে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ বার চার-চারটি দীর্ঘ বছর ব্রিটিশ জেলে কাটিয়ে তিনি তার দাম চোকালেন।
জেলে বসে আঁরি বার্গসঁ-র “ক্রিয়েটিভ ইভোলিউশন” এবং অন্যান্য দর্শন-গ্রন্থ পড়ায় মন দিলেন সুভাষ। এক বন্ধুকে বললেন কিছু বই পাঠিয়ে দিতে— লেনিন আর ট্রটস্কির সাম্প্রতিক জীবনী, আলেকজান্ডার হের্জেন-এর চার খণ্ড স্মৃতিকথা এবং থোরো বিষয়ক আলোচনা-গ্রন্থ। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে হঠাৎ পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হল, মে মাসের মাঝামাঝির মধ্যে দেখা গেল প্রায় আটাশ পাউন্ড ওজন কমেছে। ছিন্দওয়ারা-র ডাক্তার সিভিল সার্জেন বললেন, গলব্লাডারের সমস্যাই হয়তো তাঁর যন্ত্রণার কারণ, তবে ডাক্তাররা অসুখটা ঠিকঠাক নির্ণয় করতে পারলেন না।৭৬ শরতেরও অল্প বয়সেই ডায়াবিটিস— দুই ভাই-এর স্বাস্থ্য একই সঙ্গে খারাপ হতে শুরু করল। দু’জনকেই জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিছু কালের মধ্যেই অবশ্য সুভাষকে পর পর মাদ্রাজের পেনিটেনশিয়ারি, ভোওয়ালি স্যানাটরিয়াম এবং লখনউ জেল যেতে হল, বাংলা থেকে যত দূরে সম্ভব তাঁকে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা। ভোওয়ালি স্যানাটরিয়াম, লখনউ-এর বলরাম হাসপাতাল এবং মাদ্রাজ পেনিটেনশিয়ারি-র সুপারিন্টেন্ডেন্টদের কাছে সরকারি তরফে জরুরি নির্দেশ গেল “রাজবন্দি” সুভাষচন্দ্র বসুর বিষয়ে। কী ধরনের আসবাব, কাপড়চোপড়, খাওয়াদাওয়া তাঁর জন্য বরাদ্দ হবে, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রইল তাতে, কোন অবস্থায় পরিবারের কোন সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন, কী ধরনের চিঠিপত্র তাঁর কাছে আসবে বা তিনি লিখতে পারবেন, কী কী বই কিংবা সংবাদপত্র তিনি পড়লেও পড়তে পারেন, রইল তার নির্দেশও।৭৭ শরৎও জেলে, সুতরাং বন্দি দেবরের অসুস্থতা সম্পর্কে কর্তাব্যক্তিদের কাছে খোঁজখবর করার ভার তখন বিভাবতীর উপরেই। শেষ পর্যন্ত, সরকার তাঁকে নিজের খরচে ইউরোপে চিকিৎসার কারণে যেতে দিতে রাজি হল। টাকাপয়সার ব্যাপারে সুভাষ সাধারণত শরতের উপরই নির্ভর করতেন। এ বার শরতের বন্ধুরা টাকা ধার দিতে এগিয়ে এলেন, কলকাতায় তাঁর পরিবারের খরচও সামলানো দরকার, আবার সুভাষকে ইউরোপে পাঠানোও দরকার। এই বন্ধুরা প্রধানত কলকাতা আইনজীবী সম্প্রদায়ের এক এক জন তারকা— নৃপেন্দ্রনাথ সরকার, প্রভাসচন্দ্র বসু, নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র। আবার এঁদের মধ্যে ছিলেন মেদিনীপুর জেলার জাতীয়তাবাদী নেতা দেবেন্দ্রলাল খাঁ। ১৯৩৬ সালে নিজের কাজে ফিরে গিয়ে শরৎ এই ধার শোধ করবেন।৭৮
ভারতের মাটিতে সুভাষকে মুক্ত করে দেওয়া কিংবা ইউরোপে রওনা হওয়ার আগে বাংলায় গিয়ে বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া— ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে প্রশ্নাতীত। বাবাকে আর তিনি দেখতে পাবেন না কোনও দিন। তবে জব্বলপুর জেলে শরতের সঙ্গে আরও কিছুটা সময় কাটানোর অনুমতি পাওয়া গেল। বাসন্তী দেবী, বিভাবতী এবং তাঁর সন্তানরা সেখানে দুই ভাই-এর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।৭৯ ১৯৩৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে সুভাষকে বম্বে বন্দরে নিয়ে আসা হল, ইউরোপ-অভিমুখী ইতালীয় জাহাজ এস এস গ্যাঙ্গে-তে ওঠার পর তাঁকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হল।
জাহাজ ভারতের উপকূল ছেড়ে যাওয়ার পর বাঙালিদের জন্য একটি বিদায়বার্তা লিখতে বসলেন তিনি। এক বছরেরও বেশি হল বাংলা ছেড়ে দূরে আছেন, যে যাত্রা শুরু করেছেন তার ফলে এখন আরও তিন বছরেরও বেশি তাঁকে ভারত থেকে নির্বাসনে থাকতে হবে। লিখলেন, “যে যে স্বপ্ন আমায় অনুপ্রাণিত করে, জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য এনে দেয়, তার মধ্যে একটি হল মহান অবিভক্ত বাংলার ছবি, যে বাংলা ভারতের সেবা আর মনুষ্যত্বের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত, যে বাংলা সব গোষ্ঠী সব ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিম হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকলের গৃহ। এই সেই বাংলা— আমার স্বপ্নের বাংলা— ভবিষ্যতের সেই বাংলা এখনও জন্ম নেয়নি— একেই আমি পুজো করি, রোজকার জীবনে এরই সেবার চেষ্টা করি।”৮০
.
১. সুভাষচন্দ্র বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, ১৯২০-১৯৪২: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দ্বিতীয় খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ৫৮-৫৯।
২. তদেব, পৃ: ৬৪-৬৫।
৩. তদেব, পৃ: ৬০।
৪. কৃষ্ণা বসু, “বাসন্তী দেবীর কাছে শোনা কাহিনি,” প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৩), পৃ: ৫৮-৫৯।
৫. জানকীনাথ বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১২ ডিসেম্বর, ১৯২১ (এন আর বি)।
৬. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ৭৩-৭৫।
৭. তদেব, পৃ: ৮২।
৮. মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, “ট্যাম্পারিং উইথ লয়ালটি,” প্রথম প্রকাশিত ইয়ং ইন্ডিয়া, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২১, পুনর্মুদ্রিত দ্য কালেকটেড ওয়ার্কস্ অব মহাত্মা গাঁধী, একবিংশ খণ্ড (দিল্লি: গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, পাবলিকেশনস্ ডিভিশন, ১৯৫৮), পৃ: ২২১-২২৩।
৯. গাঁধী, “আ পাজ্ল্ অ্যান্ড ইটস্ সলিউশন” এবং “শেকিং দ্য মেনস্,” প্রথম প্রকাশিত ইয়ং ইন্ডিয়া, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯২১, এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ (যথাক্রমে), এবং পুনর্মুদ্রিত দ্য কালেকটেড ওয়ার্কস্ অব মহাত্মা গাঁধী, দ্বাবিংশ খণ্ড, পৃ: ২৮-২৯, ৪৫৭-৪৫৮।
১০. তদেব, পৃ: ৯০-৯১; হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: জ্যোতি প্রকাশালয়, ১৯৪৬), পৃ: ৫৫।
১১. অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৭ জুলাই, ১৯২৪।
১২. মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, দ্য কালেকটেড ওয়ার্কস্ অব মহাত্মা গাঁধী, চতুর্বিংশ খণ্ড (দিল্লি: গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, পাবলিকেশনস্ ডিভিশন, ১৯৫৮), পৃ: ৪৭৯।
১৩. কৃষ্ণা বসু, “বাসন্তী দেবীর কাছে শোনা কাহিনি,” পৃ: ৬৩।
১৪. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ১৪১।
১৫. গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, ফাইল ২৫৭/২৫।
১৬. তদেব, ফাইল ৮৪০/৩২।
১৭. শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৪ নভেম্বর, ১৯২৪; তদেব, ১২ ডিসেম্বর, ১৯২৪; সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৮ ডিসেম্বর, ১৯২৪; শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১০ জুলাই, ১৯২৬, রে নাইট, সঙ্গে জে এ জোন্সকে লেখা চিঠি, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯২৪; প্রতিটি রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসু, ইন বার্মিজ প্রিজনস্: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, তৃতীয় খণ্ড, শিশিরকুমার বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৯), পৃ: ২১-২৬, ৩১৫-৩২২। সংবাদপত্র তিনটি— ক্যাথলিক হেরাল্ড, ইংলিশম্যান, এবং স্টেটসম্যান। সুভাষচন্দ্র প্রথম দু’টির বিরুদ্ধে মামলা জিতেছিলেন। তৃতীয়টি ব্রিটিশ বিচারপতি খারিজ করে দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, এটিতে তথ্যের উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র রাজ্যপালের একটি বক্তৃতার ওপর মন্তব্য করা হয়েছে।
১৮. চিত্তরঞ্জন দাশের বক্তৃতা, ২৯ অক্টোবর, ১৯২৪, প্রকাশিত ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট, ১, ৭ নম্বর (১৯২৪-১৯২৫)।
১৯. শ্রীঅরবিন্দ, দ্য ডকট্রিন অব প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স (কলকাতা: আর্য পাবলিশিং হাউস, ১৯৪৮), পৃ: ২৭-৩০।
২০. ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার, ১ (১৯২৪), ৬৭১।
২১. দাশগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র, পৃ: ৬৬-৬৭।
২২. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯২৪, বসু, ইন বার্মিজ প্রিজনস্, পৃ: ২৬-২৯।
২৩. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ১৪২-১৪৩।
২৪. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫; তদেব, ১৪ মার্চ, ১৯২৫; তদেব, ২৮ মার্চ, ১৯২৫; প্রতিটি রয়েছে বসু, ইন বার্মিজ প্রিজনস্, পৃ: ৩৯-৪১, ৪৬-৪৯, ৫১।
২৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এন সি কেলকারকে লেখা চিঠি, ২০ অগস্ট, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ১১২-১১৫।
২৬. সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপকুমার রায়কে লেখা চিঠি, ২ মে, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ৫৫-৫৯।
২৭. সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপকুমার রায়কে লেখা চিঠি, ২৫ জুন, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ৮২-৮৪।
২৮. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৯ জুন, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ৭১-৭২।
২৯. “দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ,” সুভাষচন্দ্র বসু, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে লেখা চিঠি, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬, সুভাষচন্দ্র বসু, দি এসেনশিয়াল রাইটিংস্ অব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ৬১-৭৬।
৩০. প্যাট্রিক পিয়ার্স, “দ্য রেবেল” থেকে উদ্ধৃত, উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে বসু, “অ্যানালিসিস অব বুকস্ রেড,” সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, পঞ্চম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৮৫), পৃ: ৩৩-৭০।
৩১. সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপকুমার রায়কে লেখা চিঠি, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫; সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৭ মে, ১৯২৬; তদেব, ১৪ মে, ১৯২৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, ইন বার্মিজ প্রিজনস্, পৃ: ৮৫-৮৭, ২৮৭-২৯৬।
৩২. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৪ মার্চ, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ৪৭-৪৯।
৩৩. সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপকুমার রায়কে লেখা চিঠি, ২৫ জুন, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ৮২-৮৪।
৩৪. দিলীপকুমার রায়, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫; ২১ নভেম্বর, ১৯২৫; তদেব, ২৮ নভেম্বর, ১৯২৫; সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপকুমার রায়কে লেখা চিঠি, ৯ অক্টোবর, ১৯২৫; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিলীপকুমার রায়কে লেখা চিঠি, নভেম্বর ১৯২৫; প্রতিটি তদেব, পৃ: ৮৮-৯১, ১২৯-১৩৮, ৩৪৫-৩৪৭।
৩৫. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, ১২ অগস্ট, ১৯২৫, তদেব, পৃ: ১০৭-১১১।
৩৬. সুভাষচন্দ্র বসু, অনাথবন্ধু দত্তকে লেখা চিঠি, ডিসেম্বর ১৯২৫, বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ১৩০-১৩৩।
৩৭. সুভাষচন্দ্র বসু, বিভাবতী বসুকে লেখা চিঠি, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫; তদেব, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯২৫; তদেব, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬; তদেব, ২৮ জুলাই, ১৯২৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, ইন বার্মিজ প্রিজনস্, পৃ: ১১৮-১২৩, ১৬৮-১৭৪, ২১৬-২১৯, ৩৪৩-৩৪৪। সুভাষচন্দ্র বসু, বিভাবতী বসুকে লেখা চিঠি, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭, বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওর্য়াকস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ১৬৩-১৬৪।
৩৮. সুভাষচন্দ্র বসু এবং অন্যান্য রাজবন্দি, সুপারিন্টেন্ডেন্টকে লেখা চিঠি, মান্দালয় জেল, ৭ অগস্ট, ১৯২৫; তদেব, চিফ সেক্রেটারি, গভর্নমেন্ট অব বার্মা-কে লেখা চিঠি। ১০ অগস্ট, ১৯২৫; সুভাষচন্দ্র বসু, গভর্নর অব বার্মা-কে লেখা চিঠি, ১৯২৫; সুভাষচন্দ্র বসু এবং অন্যান্য রাজবন্দি, চিফ সেক্রেটারি, গভর্নমেন্ট অব বার্মা-কে লেখা চিঠি, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, ইন বার্মিজ প্রিজনস্, পৃ: ১০১-১০৪, ১৮৫-১৮৭, ২২১-২২৬।
৩৯. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৬ মার্চ, ১৯২৬, তদেব, পৃ: ২৬৯-২৭১।
৪০. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৭ মার্চ, ১৯২৬, তদেব, পৃ: ২৫৮-২৬১।
৪১. শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ মার্চ, ১৯২৬, তদেব, পৃ: ২৫৫-২৫৭।
৪২. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৩ অগস্ট, ১৯২৬; তদেব, ১ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ৯ অক্টোবর, ১৯২৬; তদেব, ৬ নভেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ১৩ নভেম্বর, ১৯২৬; শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৬ অগস্ট, ১৯২৬; তদেব, ২১ অগস্ট, ১৯২৬; তদেব, ২৭ অগস্ট, ১৯২৬; তদেব, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ২ অক্টোবর, ১৯২৬; তদেব, ১১ অক্টোবর, ১৯২৬; তদেব, ১৮ অক্টোবর, ১৯২৬; তদেব, ১ নভেম্বর, ১৯২৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ২৩-৩৩, ৩৯-৪০, ৫২-৫৮, ৬২-৬৪, ৭৭-৮৪, ৮৭-৯১।
৪৩. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৫), পৃ: ৩৩।
৪৪. সুভাষচন্দ্র বসু, বাসন্তী দেবীকে লেখা চিঠি, ২০ ডিসেম্বর, ১৯২৬; তদেব, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯২৬; দুই-ই রয়েছে বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ১১৮-১২১।
৪৫. সুভাষচন্দ্র বসু, ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, ১৯২৬, তদেব, পৃ: ১৩৩-১৩৮।
৪৬. সুভাষচন্দ্র বসু, গোপাললাল স্যান্যালকে লেখা চিঠি, ৫ এপ্রিল, ১৯২৭, তদেব, পৃ: ২০৪-২০৫।
৪৭. সুভাষচন্দ্র বসু, গভর্নর অব বার্মা-কে লেখা চিঠি, ১৯ মার্চ, ১৯২৭; তদেব, ২১ মার্চ, ১৯২৭; সুভাষচন্দ্র বসু, ইনস্পেকটর জেনারেল অব প্রিজনস্-কে লেখা চিঠি, ২১ মার্চ, ১৯২৭; প্রতিটি তদেব, পৃ: ১৭৪-১৮১।
৪৮. সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ২ এপ্রিল, ১৯২৭, তদেব, পৃ: ১৯৩-১৯৫।
৪৯. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৪ এপ্রিল, ১৯২৭, তদেব, পৃ: ১৯৬-২০৩।
৫০. শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৬ এপ্রিল, ১৯২৭; এ এন মবারলি, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৫ এপ্রিল, ১৯২৭; ও এম মার্টিন, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৬ এপ্রিল, ১৯২৭; প্রতিটি তদেব, পৃ: ২০৯-২১২, ৩২৫-৩২৭।
৫১. সুভাষচন্দ্র বসু, ইনসিন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে লেখা চিঠি, ১১ এপ্রিল, ১৯২৭, তদেব, পৃ: ২১৩-২১৫।
৫২. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৬ মে, ১৯২৭, তদেব, পৃ: ২২৪-২২৬।
৫৩. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ১৫৫।
৫৪. সুভাষচন্দ্র বসু, বাসন্তী দেবীকে লেখা চিঠি, ১৭ জুলাই, ১৯২৭; তদেব, ৩০ জুলাই, ১৯২৭; তদেব, ১৫ অক্টোবর, ১৯২৭; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ২৩১-২৩৪, ২৩৮-২৪০, ২৬২-২৬৫।
৫৫. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৩৩-৩৪।
৫৬. সুভাষচন্দ্র বসু, বিভাবতী বসুকে লেখা চিঠি, ১৯২৭, বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ২৫৩-২৫৫।
৫৭. বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, পঞ্চম খণ্ড, পৃ: ২৪২-২৫৪।
৫৮. সুভাষচন্দ্র বসু, মোতিলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ১৮ জুলাই, ১৯২৮, বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ২৬৮-২৬৯।
৫৯. অধ্যাপক রণজিৎ গুহ’র স্মৃতিচারণ, দি ওরাকল, ১৫, ১ নম্বর (জানুয়ারি ২০০৩), ১৩।
৬০. বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, পঞ্চম খণ্ড, পৃ: ২৭৫-২৭৮।
৬১. সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, ষষ্ঠ খণ্ড (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৮৭), পৃ: ১০-১৩।
৬২. এ জি নুরানি, দ্য ট্রায়াল অব ভগৎ সিং: পলিটিক্স অব জাস্টিস (দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮), পৃ: ৮৪-৮৯; নীতি নায়ার, ‘ভগৎ সিং অ্যাজ সত্যাগ্রহী: দ্য লিমিটস্ টু নন-ভায়োলেন্স ইন লেট কলোনিয়াল ইন্ডিয়া,” মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ, ৪৩, ৩ নম্বর (২০০৯), ৬৪৯-৬৮১।
৬৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান, বিশ্বভারতী, ১৯৯৯, পৃ: ১০২-৩।
৬৪. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৪০।
৬৫. বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪২-৫৩।
৬৬. সুভাষচন্দ্র বসু, কল্যাণী দেবীকে লেখা চিঠি, ২৬ অক্টোবর, ১৯২৯, বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ২৭২-২৭৩।
৬৭. সুভাষচন্দ্র বসু, বাসন্তী দেবীকে লেখা চিঠি, ৫ নভেম্বর, ১৯২৯, তদেব, পৃ: ২৭৩-২৭৪।
৬৮. সুভাষচন্দ্র বসু, বাসন্তী দেবীকে লেখা চিঠি, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৩০, তদেব, পৃ: ২৭৬।
৬৯. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ১৯০।
৭০. তদেব, পৃ: ২০৫-২০৬।
৭১. জওহরলাল নেহরু, অ্যান অটোবায়োগ্রাফি (দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২; প্রথম প্রকাশিত ১৯৩৬), পৃ: ১৭৪-১৭৬।
৭২. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ২২৭-২২৯।
৭৩. বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ১৪৯-১৬২।
৭৪. তদেব, পৃ: ১৯০-১৯৬।
৭৫. তদেব, পৃ: vii; বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, পৃ: ২৩৬-২৩৭।
৭৬. সুভাষচন্দ্র বসু, এক বন্ধুকে লেখা চিঠি, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২; তদেব, ২২ এপ্রিল, ১৯৩২; তদেব, ২৯ এপ্রিল, ১৯৩২; তদেব, ১৪ মে, ১৯৩২; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, চতুর্থ খণ্ড, পৃ: ২৭৭-২৮৫।
৭৭. স্বরাষ্ট্র দফতরের ফাইল ৪৪/৮/১/১৯৩৩-পোল। (এন এ আই)।
৭৮. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৪৯, ৫৪।
৭৯. তদেব, পৃ: ৪৯-৫১।
৮০. বসু, নেতাজি, কালেকটেড ওয়ার্কস্, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ২৬২-২৬৩।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন