চলো দিল্লি
ওই দূরে— ওই নদী পেরিয়ে, ওই সব জঙ্গল পার হয়ে, ওই পর্বতমালার ওই পারে রয়েছে সেই স্বপ্নের দেশ— যে মাটিতে আমরা জন্ম নিয়েছি— যে মাটিতে আবার আমরা ফিরতে চলেছি।
—সুভাষচন্দ্র বসু, ঘোষণা, মার্চ ১৯৪৪
.
১৯৪৩ সালের ২ জুলাই দুপুর বারোটা নাগাদ, একটি দুই-ইঞ্জিনের জাপানি বিমানে আবিদ হাসানের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে এসে নামলেন সুভাষচন্দ্র বসু। মুমতাজ হুসেনের লেখা একটি হিন্দুস্তানি গান দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হল: “সুভাষজি, সুভাষজি, উয়ো জান-এ-হিন্দ্ আ গয়ে, উয়ো নাজ জিসপে হিন্দ্ কো, উয়ো শান-এ-হিন্দ্ আ গয়ে।” (একটি ইংরেজি মার্চিং সং-এর আদলে) রাম সিংহ ঠাকুরের সুরে গানটি আনন্দ-স্বাগত জানাল প্রিয় নেতাকে, ভারতের গৌরবরত্নকে। “এশিয়া কে আফতাব”— ‘এশিয়ার আলো’ এ বার এশিয়া এসে পৌঁছেছেন— এই হল গানের বক্তব্য। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরেই জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি তাইল্যান্ড ও মালয়ে গিয়ে দেখেছিলেন, “যত ভারতীয়”র সঙ্গেই পরিচয় হচ্ছে, তাঁদের সকলেরই মনে “সুভাষের প্রতি বিরাট শ্রদ্ধা, প্রায় ধর্ম-ভক্তির সামিল।”১ এর আগেই, ১৯৪২-এর ১৫ জুন ব্যাঙ্ককে ভারতের প্রবাসী দেশপ্রেমিকদের সভা থেকে তাঁর প্রতি একটি আহ্বান-পত্র প্রকাশিত হয়: সুভাষ যেন সশরীরে এসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁদের নেতৃত্ব দেন, এই তার বয়ান। সেই সময়ে তিনি কেবল এঁদের একটি বার্তা পাঠাতে সমর্থ হয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন “বিশ্ব জুড়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের এক সূত্রে গ্রথিত করার” প্রয়োজনীয়তার কথা।২ এক বছর পর, তিনি এসে পৌঁছতে পারলেন। নিজেই সেই “সূত্র” হয়ে দেখা দিলেন।
এই যে সুভাষের ভ্রমণপরিকল্পনায় ১৯৪২-এর জুন থেকে ১৯৪৩-এর জুলাই পর্যন্ত দীর্ঘ বিলম্ব ঘটে গেল, এর মধ্যে কিন্তু যুদ্ধরত দেশগুলির পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির বিরুদ্ধে সফল ভাবে অগ্রসর হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে জাপানের বিরুদ্ধে একটির পর একটি দ্বীপ দখল করে ক্রমেই সাফল্য লাভ করছে। জাপান অবশ্য তখনও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এত দিনের ইউরোপীয় উপনিবেশগুলির উপর দখল বজায় রেখে চলেছে। এই বিরাট অঞ্চলে যত ভারতীয় নাগরিক সেই সময়ে, প্রায় কুড়ি লক্ষ— সুভাষের দাবি তিরিশ লক্ষ— তাদের সহায়তায় এশিয়ায় নেতাজির পরিকল্পিত আন্দোলনের একটা বিরাট সমর্থন-ভিত্তি তখনও তৈরি হওয়া সম্ভব। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সহস্রাধিক বছরের পুরনো বন্ধন আধুনিক যুগে যেন আরও শক্ত হয়ে উঠছে তখন। মধ্য-উনিশ শতক থেকে প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় উদ্যোগপতি, শ্রমিক এবং চাকুরিজীবী পূর্ব ভারত মহাসাগর পেরিয়ে ভাগ্যান্বেষণে যেতে শুরু করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন বাগান-অঞ্চলে যত বণিক, যত শ্রমিক, প্রায় সকলেই দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর লোক। ভারতীয় ঔপন্যাসিক, কবি, শিল্পী, ধর্মযাজক, সাধুসন্ন্যাসী, সৈন্য, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী, অনেকেই বিশ শতকের প্রথম দশকগুলিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ১৯২৭-এ তাঁর বিখ্যাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তীর্থযাত্রায় রওনা হন, ভারতবর্ষের সেই সর্বত্র-প্রবেশের ইতিহাসের চিহ্ন দেখবার জন্যে।৩
সিঙ্গাপুরে জাপানি বাহিনীর কাছে ব্রিটিশের পরাজয়ের ঠিক দুই দিন পর ১৯৪২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি নির্মাণের প্রথম সূচনাটি হয়েছিল। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই তা আবার ছড়িয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সৈন্যদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার শিখাটি নতুন করে জ্বালিয়ে তাদের সংগ্রামী বাহিনী করে গড়ে তোলার ক্ষমতা ছিল সুভাষের, তাঁর নিজস্ব অবস্থান, দর্শন এবং সাংগঠনিক শক্তির সাহায্যে। ভারতের জন্য মুক্তিবাহিনী তৈরি করে তুলতে হলে অবশ্য এখন তাঁকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচুর পরিমাণ কাজ করে ফেলতে হবে। পারবেন কি তিনি, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি নিয়ে কলকাতায় পৌঁছতে, ১৯৪১ সালের ১৬-১৭ জানুয়ারি রাতের অন্ধকারে যে কলকাতা তিনি ছেড়ে চলে এসেছিলেন? এ দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তিনি যখন আজাদ হিন্দ্ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করছেন, সেই সময়েই বাংলা, তাঁর নিজের প্রদেশ, ছারখার হতে বসেছে এক ভয়ঙ্কর মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ব্যাপক প্রকোপে। বহু বছর ধরে একটি হাতে-লেখা ক্যালেন্ডারে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলি লিখে রাখার অভ্যাস তাঁর: তাতে “জুলাই ১৯৪৩” তারিখটির পাশে কেবল লিখলেন “কাজ শুরু করলাম”।৪ কাজ বলতে যা বোঝানো হল এখানে, তার অর্থ বড়ই বিশাল: ক্লান্তিহীন কর্মযজ্ঞ, বিশ্বজোড়া সামরিক প্রলয়ের প্রচণ্ডতার বিরুদ্ধে একটিমাত্র মানুষের ইচ্ছাশক্তির সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা।
সিঙ্গাপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকার অঞ্চলটিতেই বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাগুলি ঘটছিল সে দিন, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে। এই অঞ্চলে সুভাষের প্রথম বছরটি (১৯৪৩-এর মধ্যভাগ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যভাগ) কেটে গেল আশাময়তায়, প্রায় উন্মাদনার মধ্যে— আশা করতে শুরু করলেন যে জাপানি শক্তির সহায়তায় তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ করে ব্রিটিশ প্রতিরোধ ভেঙে দিতে সফল হবে, এবং দেশের অভ্যন্তরে সাম্রাজ্যবিরোধী অভ্যুত্থান জাগিয়ে তুলবে। সেই দুঃসাহসী কৌশল যখন ব্যর্থ হল, সেই দ্বিতীয় বছরটি (১৯৪৪-এর মধ্যভাগ থেকে ১৯৪৫-এর অগস্ট) দেখল মুক্তিবাহিনী আর তার নেতার তেজদীপ্তির কঠিন, কঠিনতম পরীক্ষা। নেতা কিন্তু তখনও, পশ্চাদপসরণের মধ্যেও, সমানেই দুর্বার মানসিক জোর দেখিয়ে যাচ্ছেন, আর তার সঙ্গে ক্রমাগত স্বাধীনতালাভের বিকল্প কোনও পথের সন্ধান করছেন। দিল্লি তখনও তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য: হয়তো যুদ্ধে পরাজিত নায়ক রূপেই তিনি এক দিন তাঁর পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে যাবেন সাম্রাজ্যের রাজধানীতে।
সাবাং থেকে সাবমেরিনে এসে সুভাষ টোকিয়ো চললেন— তাঁর সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য সমর্থন কুড়োতে, আর ভারতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যের প্রতি জাপানিদের স্বীকৃতি জোগাড় করতে। ১৯৪৩ সালের ১৬ মে জাপানের রাজধানীতে এসে পৌঁছলেও ১০ জুনের আগে কিন্তু হিদেকি তোজোর সঙ্গে তাঁর দেখা হল না। নানা জাপানি সূত্র থেকে জানা যায়, এই সময়ে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একের পর এক সামরিক পরাজয়ের ফলে বিমর্ষ তোজোর অগ্রাধিকার-তালিকায় ভারতের নামটি ছিল একেবারেই গৌণ। আবিদ হাসান অবশ্য বলেন, সুভাষও জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তড়িঘড়ি দেখা করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। বুঝতে পারছিলেন, তোজোর অবস্থান ঠিক ইউরোপীয় একনায়কদের মতো নয়, তাঁর দেশের রাজনীতিতে তিনি নেহাত সম-পদাধিকারীদের মধ্যে প্রথম স্থানে (‘ফার্স্ট অ্যামাং ইকুয়্যালস্’), এইটুকুই। হিটলার ও মুসোলিনি যেমন পরস্পরের সঙ্গে বারংবার যোগাযোগ করতে পারতেন, তোজো কিন্তু এঁদের কাউকেই সামনাসামনি দেখেননি। ফলে, তোজোর সঙ্গে দেখা করার আগে সুভাষ বরং টোকিয়োতে রাজনৈতিক ও সামরিক উচ্চবর্গীয় মানুষদের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে একটি লবি তৈরি করার কথা ভাবছিলেন। তোজোর অধস্তনরা হয়তো একটি ‘বোস-ফাইল’ তৈরি করবেন শীঘ্রই, সে ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই নিজের একটি পরিচিতি তৈরি করে তিনিই যাতে সেই গোপন ফাইল-এর পরোক্ষ রচয়িতা হতে পারেন, সেই চেষ্টায় থাকলেন। প্রথম কয়েকটি সপ্তাহ তিনি শীর্ষ সামরিক নেতা হাজিমে সুগিয়ামা, বিদেশমন্ত্রী মামোরু শিগেমিতসু, আরও নানা জাপানি সামরিক অফিসার যেমন জেনারেল সেইজো আরিসুয়ে, এবং কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেই খুশি রইলেন। ভারত ও ভারতের মুক্তি আন্দোলন বিষয়ে তাঁদের শিক্ষিত করার ভার যেন তাঁর নিজেরই, তিনিই শিক্ষকের ভূমিকায়। আগে কখনও জাপান আসেননি, তাই দিন-দশেক একটু দেশ দেখে বেড়ালেন, জাপানের কলকারখানা, খামার, হাসপাতাল, স্কুল, সব কিছুতেই তাঁর আগ্রহ।৫
সুভাষ এখানে পৌঁছনোর ঠিক আগেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় এবং জাপানিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে, সুতরাং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে একটু বিশেষ যত্নের দরকার ছিল। ১৯৪১ সালের অক্টোবরে ইন্দো-জাপানি সম্পর্ক বেশ প্রতিশ্রুতিপূর্ণ জায়গায় ছিল। তরুণ আদর্শবাদী জাপানি মেজর ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি ব্যাঙ্ককে জ্ঞানী প্রীতম সিংহ নামে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের জনৈক ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন সেই সময়ে। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ হল বিশাল-সংখ্যক প্রবাসী ভারতীয় সমাজের প্রধান জাতীয়তাবাদী সংগঠন। ফুজিওয়ারার একটি বাহিনী ছিল, মূলত যোগাযোগরক্ষাকারী বাহিনী। নাম— ফুজিওয়ারা কিকান। লক্ষ্য— জাপানের সামরিক কার্যক্রমের জন্য ভারতীয়দের সমর্থন সংগ্রহ। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে উত্তর মালয় অভিযানের সময়ে ফুজিওয়ারা ও প্রীতম সিংহ জাপানি বাহিনীর কাছে পরাজিত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ১/১৪ পঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপটেন মোহন সিংহের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। তাঁরা অলোর স্টার শহরে তাঁকে নিয়ে যান, আশ্বাস দেন যে জাপানিরা ভারতীয়দের যুদ্ধবন্দি করে রাখতে আগ্রহী নয়। জাপান চায় “এশিয়া হোক এশীয়দের”, তাই ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার লক্ষ্যে একটি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তৈরি করতে তারা প্রস্তুত। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন ও দৃঢ় রাজনৈতিক মূল্যবোধযুক্ত কোনও মানুষকে পেতে চেষ্টা করবেন তাঁরা— যেমন, সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি নাকি ইতিমধ্যেই ব্রিটিশদের হাত এড়িয়ে পালিয়েছেন ভারত থেকে। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরের শেষে মোহন সিংহ এই কাজে সম্মত হলেন, এবং ভারতীয় সৈন্যদের প্রভাবিত করে তাদের জাপানের পক্ষে টেনে আনতে শুরু করলেন। সামরিক অভিযান তখন দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছে আরও দক্ষিণ দিকে, মালয় উপদ্বীপের অভিমুখে।৬
১৯৪২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পতনের পর ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশ বাহিনীর বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, ব্রিটিশ কম্যান্ডিং অফিসার তাদের জাপানিদের হাতে সমর্পণ করে দিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি সব স্তরের ভারতীয় সৈন্যরা জড়ো হলেন সিঙ্গাপুরের ফারার পার্কে, আর ব্রিটিশ অফিসার ও তাঁদের দলবল জড়ো হলেন শহরের পুব দিকে চাঙ্গি অঞ্চলে। ভারতীয় সৈন্যরা এখন থেকে জাপানি কর্তৃত্বাধীন রইবে, স্বল্প কথায় এই ঘোষণা করে কর্নেল জে সি হান্ট পত্রপাঠ ফারার পার্ক থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফুজিওয়ারা উঠে দাঁড়ালেন, সতর্ক সুলিখিত একটি বক্তৃতা দিলেন, লেফটেনান্ট কাজুনোরি কুনিজুকা তাঁর জাপানি কথাগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন, ভারতীয় কর্নেল এন এস গিল হিন্দুস্তানি বয়ানটি পড়ে দিলেন। “জাপানি সামরিক বাহিনী আপনাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে দেখবে না, বন্ধু হিসেবে দেখবে,” আন্তরিক আবেগের সঙ্গে বললেন ফুজিওয়ারা। ভারতীয়দের স্বাধীনতার সংগ্রামে জাপান সাহায্যের হাত বাড়াতে প্রস্তুত, যদি তাঁরা নিজ ইচ্ছায় ভারতমাতার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে (INA) যোগ দেন। প্রবল উত্সাহের সঞ্চার হল ফুজিওয়ারার বক্তব্যে। তাঁর কথা শেষ হতেই ভারতীয় সৈন্যরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন, “হাজার হাজার টুপি উড়ল বাতাসে”। ফুজিওয়ারা বুঝলেন, যে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য আজ তাঁর কথা শুনেছেন, তাঁদের বিরাট অংশকেই তিনি ভাসিয়ে নিতে পেরেছেন।৭ ব্রিটিশ গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী অবশ্য সংখ্যাটা কিছু কমের দিকে। ব্রিটিশ মতে, সিঙ্গাপুরে আত্মসমর্পণকারী পঁয়তাল্লিশ হাজার ভারতীয় সেনার মধ্যে চল্লিশ হাজার আই এন এ-তে যোগ দিতে রাজি হন। মাত্র পাঁচ হাজার লোক, যাঁদের অধিকাংশই অফিসার গোত্রের, অরাজিদের দলে থেকে যান।৮
সিঙ্গাপুরে যুদ্ধবন্দিদের ক্ষেত্রে এই দ্রুত সাফল্যের পর কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় জাতীয় সংগ্রাম বেশ কয়েকটি ধাক্কা খেল। ১৯ মার্চ, জ্ঞানী প্রীতম সিংহ ও ব্যাঙ্ককের স্বামী সত্যানন্দ পুরী-সহ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের কয়েক জন শীর্ষ নেতা টোকিয়োতে একটি কনফারেন্সে যাওয়ার পথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলেন। প্রায় একই সময়ে কর্নেল হিদেও ইওয়াকুরো ফুজিওয়ারার জায়গায় এলেন, ভারতীয়দের সঙ্গে প্রধান সংযোগরক্ষক অফিসার হিসেবে। ফুজিওয়ারা মনে করতেন ভারতীয়দের সঙ্গে আদানপ্রদানের জন্য জাপানের দরকার কূটনৈতিক কার্যক্রম। উল্টো দিকে ইওয়াকুরো কিকান কিন্তু স্বল্পমেয়াদি সামরিক লক্ষ্য স্থির করতে করতে গোটা প্রয়াসটা প্রায় গুপ্তচর সংস্থা চালানোর পর্যায়ে নিয়ে গেলেন।৯ মধ্যশ্রেণির জাপানি অফিসারদের স্পর্ধা ও অসভ্যতা ভারতীয় সামরিক ও অসামরিক নেতৃত্বের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠল। ১৯৪২-এর জুনে অভিজ্ঞ ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের ব্যাঙ্কক কনফারেন্সে চূড়ান্ত হল বিচ্ছেদ। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় চার্লস হার্ডিঞ্জ যখন ব্রিটিশ ভারতের নতুন রাজধানী দিল্লিতে মহাসমারোহে হস্তীপৃষ্ঠে প্রবেশ করছিলেন, সেই সময় তাঁকে তাক করে বোমা ছুড়েছিলেন রাসবিহারী বসু (সুভাষের সঙ্গে এঁর কোনও আত্মীয়-সম্পর্ক নেই)। লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তিনি। কিন্তু প্রতীকী অর্থ দাঁড়ায় বিরাট, আর তার ফলস্বরূপ ১৯১৫ থেকেই রাসবিহারী জাপানে রাজনৈতিক আশ্রিত।১০ ইন্দো-জাপানি সম্পর্ক ঠিকঠাক রাখার বহু চেষ্টা করেন তিনি, তবু ১৯৪২-এর দ্বিতীয় ভাগে দুই পক্ষের অনাস্থা স্পষ্টই প্রকাশিত হয়ে পড়তে শুরু করে। শেষ অবধি ডিসেম্বরে মোহন সিংহ অধৈর্য এবং বিরক্ত হয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ভেঙে দেন। রাসবিহারী বসু ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন পরের কয়েক সপ্তাহে, আই এন এ-র সম্পূর্ণ ভাঙন রোধ করতে সমর্থ হন কোনওক্রমে। ১৯৪৩-এর ফেব্রুয়ারিতে রাসবিহারী ও জাপানি পক্ষ বারংবার আশ্বাস দিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু আসছেন এই আন্দোলনের হাল ধরতে। যাঁরা ছিলেন দোদুল্যমান তাঁরা এই আশ্বাসে বাহিনীতে রয়ে গেলেন। আর যে অফিসাররা প্রথম থেকেই যোগদানে অনিচ্ছুক ছিলেন, তাঁরাও রয়ে গেলেন। এঁদের নিয়েই তৈরি হল দ্বিতীয় আই এন এ।১১
সুভাষের এসে পৌঁছনোর আগেই এই সব অশান্তি। সুতরাং টোকিয়ো পৌঁছে সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাপানি সমর্থন সংগ্রহের কাজটা করতে তাঁর সমস্ত কূটনৈতিক ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে হল। ১৯৪৩-এর ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী তোজোর ঘরে তাঁর সঙ্গে প্রথম বার দেখা হওয়ার আগে ভাল করে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন তিনি, নিজের সম্ভ্রম-মণ্ডিত ব্যবহার ও ব্যক্তিত্বের জোরে মুহূর্তমধ্যেই তোজোর মন জয় করে নিলেন। মুক্তির লক্ষ্যে ভারতের সংগ্রামের ক্ষমতা নিয়ে যদি তোজোর মনে যেটুকু যা সংশয়, ক্ষণেকের মধ্যেই তা দূর হল।১২ দ্বিতীয় বৈঠকের দিন স্থির হল ১৪ জুন। সুভাষ তোজোকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভারতের সংগ্রামে “নিঃশর্ত সহায়তা” দিতে জাপান প্রস্তুত তো? জাপানি প্রধানমন্ত্রী সদর্থক উত্তর দিলেন। এ বার সুভাষের পরের অনুরোধ: জাপানি নেতাকে বার্মা থেকে ভারতের অভিমুখে একটি সামরিক অভিযানের ব্যবস্থা করতে বললেন তিনি— ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি যে যুদ্ধে জাপানি ইম্পিরিয়াল আর্মির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে। এই অনুরোধের উত্তর অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারলেন না তোজো, সামরিক কম্যান্ডারদের সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে হবে। দুই দিন পরে ১৬ জুন ইম্পিরিয়াল ডায়েট-এর এক সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হলেন সুভাষ। মহা সন্তোষের সঙ্গে শুনলেন তিনি: তোজো ঘোষণা করছেন, ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য সাহায্য করতে যা যা সম্ভব সব করতে প্রস্তুত জাপান।১৩
এক বার এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পর এ বার জনসমক্ষে উপস্থিত হতে মনস্থ করলেন সুভাষ। ১৯ জুন, ষাট জন সাংবাদিকের এক প্রেস কনফারেন্সে দেখা গেল তাঁকে। এই যে তিনি আজ “ভারতের কোনও জেলখানায় বন্দি হিসেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে নিপ্পন-এর বুকের উপর তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে,” এই তো প্রমাণ তাঁর দেশে কেমন করে নতুন আন্দোলন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। বিদেশি শক্তির সহায়তা চাইতে গিয়ে “নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতার দাম চোকানোর” দায়িত্বের কথাও বলতে ভুললেন না। “যে স্বাধীনতা আমাদের আত্মোত্সর্গের মাধ্যমে, আমাদের ঘাম-ঝরানো শ্রমের মাধ্যমে আমরা অর্জন করব,” তাঁর যুক্তি, “আমাদের নিজেদের সমস্ত শক্তি দিয়েই তা আমাদের রক্ষা করতে হবে।”১৪ প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে এই আলাপচারিতার পর তিনি টোকিয়ো থেকে এক ঝাঁক বেতারবার্তা পাঠাতে শুরু করলেন। স্পষ্ট ভাবে বললেন, এই যুদ্ধ পুরনো ও নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ, তাই দেশবাসীর প্রতি তাঁর অনুরোধ, যুদ্ধের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। সহযোদ্ধাদের অনুরোধ: ব্রিটিশ প্রোপাগ্যান্ডায় না ভুলতে, বরং তাঁর উপরে আস্থা রাখতে। “চালাকচতুর ও ক্রূরপ্রকৃতি এই ব্রিটিশ রাজনীতিকবিদ যখন প্রলুব্ধ বা প্রতারিত করিতে পারিল না, তখন পৃথিবীর আর কেহ তাহা করিতে পারিবে না,” আশ্বাস দিলেন তাঁদের বিশেষ সমবেদনা প্রকাশ করলেন সেই সব সহযোদ্ধাদের জন্য যাঁরা ব্রিটিশের জেলে আবদ্ধ হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি, বেশি দেরি নেই, “সকল কারাগারের লৌহকপাট উন্মুক্ত হইবে,” যাতে ভারতমাতার কৃতী সন্তানরা “কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকার হইতে মুক্তি ও আনন্দের নির্মল আলোয় বাহির হইয়া জয়মাল্যে ভূষিত হইবেন।” “সময় আগত,” ঘোষণা তাঁর কণ্ঠে, “প্রতিটি দেশপ্রেমী ভারতীয়কে এখন এগোতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। মুক্তিকামী ভারতীয়ের শোণিত প্রবাহিত হবে শতধারায়। তবেই ভারত অর্জন করবে তার স্বাধীনতা।”১৫
জুনের শেষে টোকিয়ো থেকে সিঙ্গাপুরের দিকে যাত্রা করলেন সুভাষ। সঙ্গে রইলেন বয়ঃজ্যেষ্ঠ রাসবিহারী বসু ও আবিদ হাসান। ইওয়াকুরোর বদলে টোকিয়োকে দিয়ে নিজের পছন্দের মানুষ ইয়ামামোতোকে জাপানের লিয়াজঁ এজেন্সি হিকারি কিকানের শীর্ষ নেতা হিসেবে বসাতে পেরেছেন ইতিমধ্যে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয়দের মধ্যে কৌতূহল ও প্রত্যাশা ছড়িয়ে দিয়েছেন বেতারবার্তার মাধ্যমে। ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে তাঁর আবির্ভাবের পর অভূতপূর্ব বিহ্বল অভিনন্দনে ভরে গেলেন তিনি। জে কে ভোঁসলে এবং মহম্মদ জামান কিয়ানির মতো উচ্চ সামরিক কম্যান্ডাররা বিমানবন্দরে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গার্ড অব অনার দিল। সপ্তাহ জুড়ে চলল কর্মোত্সাহের বন্যা। ১৯৪৩-এর ৪ জুলাই ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের প্রতিনিধিরা ক্যাথে থিয়েটারে জড়ো হলেন রাসবিহারী বসুর হাত থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব সুভাষের হাতে অর্পিত হওয়ার মুহূর্তটির সাক্ষী হতে। ভারতীয় তরুণীরা দেশাত্মবোধক গান ধরলেন, নেতারা মঞ্চে উঠলে পুষ্পবৃষ্টি হল তাঁদের উপর। রাসবিহারী বললেন, “আপনারা ভাবতে পারেন আমি কেন টোকিয়োতে ছিলাম, কী উপহার আনতে পেরেছি আপনাদের জন্য।” শ্রোতৃমণ্ডলীর গানে-জয়রবে বিদীর্ণ আবহের মধ্যে সুভাষের দিকে তাকিয়ে তাঁর উচ্চারণ, “এই, এই আমার উপহার আপনাদের জন্য”। “ভারতের তারুণ্যের যা কিছু সদ্গুণ, সততা, দুঃসাহস, গতিশীলতার কথা জানি আমরা,” সে সবেরই প্রতীক সুভাষ— এই কথা বলে শীলিত মর্যাদায় এক প্রজন্মের নেতা অন্য প্রজন্মের নেতার হাতে তুলে দিলেন দায়িত্বভার।১৬
সুভাষ সে ভার গ্রহণ করলেন আত্যন্তিক বিনয়ের সঙ্গে। নিম্নস্বরে বললেন, খুদা বা ঈশ্বর যেন তাঁকে এই দায়িত্ব পালনের যোগ্য শক্তি দেন। হিন্দুস্তানি ভাষায়, অসাধারণ বাগ্মিতা ও আবেগের উচ্চারণে তার পর বেরিয়ে এল তাঁর বক্তব্য। শ্রোতাদের মধ্যে তখন বাঁধভাঙা উত্সাহ, বিশেষত দিল্লির লালকেল্লার অভিমুখে বিজয়-যাত্রার ছবিটি যখন ফুটিয়ে তুলছিলেন সুভাষ, তখন যেন উদ্দীপনা তীব্রতম। সকলকে অনেক ভেবেচিন্তে এই আন্দোলনে যোগ দিতে বললেন তিনি— সামনে কিন্তু বিপদের দিন, লড়াই-এর দিন, বহু ক্লেশ, বহু মূল্য ধরে দিতে হবে দাম হিসেবে। এর সঙ্গে সুভাষ স্বাধীন ভারতের সাময়িক সরকার নির্মাণের ইচ্ছাও ঘোষণা করলেন, যে সরকার “ভারতীয় বিপ্লবকে সত্যিকারের সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।” “বিপ্লব যখন সফল হবে, ভারত থেকে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যখন বিদায় নেবে,” উপস্থিত সকলের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, “সাময়িক সরকারের কাজও শেষ হবে। তখন ভারতের স্থায়ী সরকার গঠিত হবে ভারতের অভ্যন্তরেই, ভারতের জনসাধারণের ইচ্ছানুসারে।”১৭
পরের দিন ৫ জুলাই সকাল সাড়ে দশটায় মিলিটারি ইউনিফর্ম-পরিহিত সুভাষ এসে দাঁড়ালেন ভারতের মুক্তিবাহিনীর সামনে। সিঙ্গাপুরের মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং-এর সামনে প্রশস্ত প্রসারিত সবুজের মধ্যে প্রায় বারো হাজার সৈন্যের সমারোহ। সুভাষের ঘোষণা, এই সৈন্যবাহিনী তৈরি হয়েছে ভারতীয় নেতৃত্বে, এরা যুদ্ধও করবে ভারতীয় নেতৃত্বেই। আজাদ হিন্দ্ ফৌজের মুখে তিনি তুলে দিলেন তাদের আসন্ন লড়াই-এর ধুয়ো: চলো দিল্লি! আবেগ-জর্জর কণ্ঠে বললেন, “পদদলিত জাতির জন্য তার মুক্তিবাহিনীর প্রথম সৈন্য হওয়ার থেকে বড় গৌরব, বড় সম্মান আর কিছুই হতে পারে না!” বাহিনীর সামনে তাঁর অঙ্গীকার, তিনি নিজে তাদের সঙ্গে থাকবেন “অন্ধকারে, আলোয়, বিষাদে, আনন্দে, যন্ত্রণায় কিংবা বিজয়ে।” সৈন্যদের মধ্য থেকে উচ্চৈঃরব ভেসে এল: “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!” এল মহাত্মা গাঁধী ও সুভাষচন্দ্র বসুর নামে জয়ধ্বনি। নেতৃবর সাবধান করলেন, “বর্তমানে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লেশ, বাধ্যতামূলক যুদ্ধযাত্রা এবং মৃত্যু ছাড়া আপনাদের আমার কিছুই দেওয়ার নেই। কিন্তু জীবনে মরণে আমার অনুসরণ করতে চান যাঁরা— নিশ্চিত জানি আপনারা তা করবেনই— তাঁদের কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত বিজয় আর মুক্তির পথে নিয়ে যাব।”১৮ পরের দিন আই এন এ-র আরও একটি কুচকাওয়াজ। তোজো তখন অন্য এক কারণে সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন, সে দিন কুচকাওয়াজের সময় উপস্থিত থেকে স্যালুট গ্রহণ করলেন তিনি।
পরের কয়েক মাস ধরে সৈন্য এবং সাধারণ নাগরিকদের বিশাল জমায়েতের সামনে, সুললিত হিন্দুস্থানিতে সুভাষের অসামান্য প্রণোদনাময় ভাষণ যেন তড়িত্প্রবাহ সৃষ্টি করল। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এই চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বানে উঠে এল সাড়ার ঢেউ: মানুষের ঢেউ, যুদ্ধসামগ্রীর ঢেউ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবাসী ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠই আসেন দক্ষিণ ভারত থেকে, ফলে তাঁর বক্তৃতাগুলি তত্ক্ষণাৎ তামিলে অনূদিত হতে থাকল। ৯ জুলাই সিঙ্গাপুরে প্রায় ষাট হাজার মানুষের জমায়েতের সামনে বললেন, “ভারতের বাইরে যে ভারতীয়রা থাকেন, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা সকলে একটি সংগ্রামী সৈন্যদল তৈরি করছেন, ভারতের ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা করার মতো শক্তিশালী সৈন্যদল। এই কাজ যদি আমরা করে উঠতে পারি, বিপ্লব শুরু হবে। কেবল দেশের নাগরিকসমাজের মধ্যে নয়, ব্রিটিশ পতাকার তলায় দাঁড়ানো সারিবদ্ধ ভারতীয় বাহিনীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে সেই বিপ্লব। দুই দিক থেকে যখন আক্রান্ত হয়ে পড়বে ব্রিটিশ রাজ— তার ভিত ভেঙে যাবেই, ভারতীয় জনসাধারণ এগিয়ে যাবে তাদের স্বাধীনতা পুনরর্জনের পথে”।১৯
বিপ্লবের এই তীব্র দেশাত্মবোধী আহ্বানে সে দিন প্রবাসী ভারতীয় সমাজের এক বিরাট অংশ উদ্বেল হয়ে উঠল। প্রায় আঠারো হাজার নাগরিক, যাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ ভারতীয় তামিল, ব্রিটিশ মার্শাল-ননমার্শাল বিভাজনের রূপকথা অনুসারে যাঁরা এত কাল ধরে “নন-মার্শাল” নামাঙ্কিত, তাঁরা এ বার এগিয়ে এসে নাম লেখালেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে আসা প্রশিক্ষিত সৈন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিলেন তাঁরাও। ব্রিটেনের ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর প্রায় চল্লিশ হাজার সেনা ব্রিটিশ সম্রাটের আনুগত্য ছেড়ে চলে এলেন। ১৯৪২ সালেও যাঁদের বোঝানো যায়নি, এখন তাঁরাও “নেতাজি”র ডাকে (এই নামেই তাঁরা সুভাষকে ডাকেন এখন) দলে দলে যোগ দিতে শুরু করলেন। নবগঠিত মুক্তি বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের কাজেকর্মে সহায়তা করত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ, লাখখানেকের কাছাকাছি প্রবাসী নাগরিক এসে সেই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থানীয় শাখায় যোগ দিলেন।২০
সাবমেরিন-যাত্রাপথে আবিদ হাসানকে দিয়ে একটি বক্তৃতা লিখিয়েছিলেন সুভাষ, ভেবেছিলেন আই এন এ-র পরিকল্পিত নারীবাহিনীর সামনে সেই বক্তৃতা দেবেন।২১ ১২ জুলাই সেই বক্তৃতা শোনা গেল ‘রানি ঝাঁসি বাহিনী’র প্রথম সদস্যদের সামনে, যে বাহিনীতে ক্রমে মালয় ও বর্মার প্রায় হাজারখানেক ভারতীয় তরুণী যোগ দেন। এঁদের অধিকাংশই তামিল।২২ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ঝাঁসির রানির অশ্বপৃষ্ঠেই প্রাণত্যাগ ও তাঁর অসামান্য শৌর্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন সুভাষ, তুলনা টানেন ফ্রান্সের জোন অব আর্কের সঙ্গে। তরুণী ডাক্তার লক্ষ্মী স্বামীনাথন এসে সেই বাহিনীর কম্যান্ডার হিসেবে ভার গ্রহণ করলেন। মাদ্রাজের এক বিশিষ্ট পরিবারের মেয়ে লক্ষ্মী, এই পরিবার ১৯২০-র দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯২৮-এ কলকাতা কংগ্রেসে সুভাষকে এক ঝলক দেখেছিলেন তিনি, এখন ডাক আসতেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু-ভয়হীন নারী-বাহিনী নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন নিজের হাতে। ‘নারীবাহিনী’র ভাবনা শুনে প্রথমটায় বিস্ময়ে হতবাক জাপানিরা, প্রথম দিকে তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিতেই অস্বীকার করল তারা। তবে সিঙ্গাপুরের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ-এর শাখাটির প্রধান আট্টাবর ইয়েলাপ্পা জাপানি আপত্তির বাধা টপকে তরুণী রানিদের জন্য ব্যারাক ও অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে ফেললেন। পরনে শাড়ি, হাতে অস্ত্র: এই বেশেই প্রথম বার নেতাজিকে গার্ড-অব-অনার দিলেন রানিরা। তবে দ্রুত তাঁদের জন্যও এল মিলিটারি ইউনিফর্ম, কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হল তাঁদের ক্যাম্পে। কিছু সদস্যা শিক্ষিত, সচ্ছল পরিবার থেকে এলেও অধিকাংশই ছিলেন মালয়ের রাবার-বাগানের সাধারণ মেয়ে।২৩
এই নারীবাহিনীর নিয়োগের পিছনে প্রধান অনুপ্রেরণাই ছিল নেতাজির ব্যক্তিগত ‘ক্যারিসমা’। জানকী থেবার পরে স্মরণ করেন, কিশোরী বয়সে সুভাষের বক্তৃতা শুনতে তিনি কেমন ভাবে সাইকেল চেপে চলে গেলেন কুয়ালালামপুরের সভায়। সভার শেষে দেখলেন, রাশি রাশি মানুষ এসে নেতাজিকে টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি, যার যা-কিছু, সব দিয়ে যাচ্ছেন। জানকীও নিজের কানের দুল দু’টি ও গলার হারটি খুলে নেতাজির হাতে দিয়ে এলেন। পরের দিন স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছবি দেখে তাঁর বাবা-মা জানতে পারলেন কী করে এসেছেন তিনি। লক্ষ্মী স্বামীনাথন যখন নারীবাহিনীর নিয়োগপর্ব শুরু করলেন, বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে জানকীও যোগ দিলেন তাতে। ১৯৪৪-এর জানুয়ারিতে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের পর বর্মার বাহিনীতে জায়গা পেলেন তিনি। অনেক দশক পরে, রানি ঝাঁসি বাহিনীর মহিলারা— পরে যাঁদের অনেকেরই উজ্জ্বল কর্মজগৎ তৈরি হয়েছে— শ্রদ্ধাভরে পিতৃসম সুভাষকে স্মরণ করেছেন, বলেছেন ১৯৪৩-৪৫-এর পর্বটিই নাকি তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।২৪
১৯৪৩-এর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে দ্রুত ঘুরে এলেন সুভাষ, উদ্দেশ্য, তাঁর কাজের জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের সমর্থন সংগ্রহ। দ্রুত বুঝে গেলেন যে মালয়, তাইল্যান্ড ও বর্মা তাঁর দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হতে চলেছে। টোকিয়ো থেকে সিঙ্গাপুর আসার পথে ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গন ঘুরে এসেছেন, কিন্তু দেখেছেন ভারতীয়দের সংখ্যা সেখানে নিতান্ত কম। উল্টো দিকে মালয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ভারতীয়ের বাস, কেউ কেউ বিত্তবান বণিক কিংবা মহাজন, কিন্তু বেশির ভাগই গরিব পরিযায়ী শ্রমিক। বিশেষত এই দ্বিতীয় শ্রেণিটির কাছে এই প্রথম মানুষ হিসেবে সত্যিকারের সম্মানের স্বাদ, কিংবা সমান নাগরিক অধিকারের অভিজ্ঞতা এনে দিল আজাদ হিন্দ্ আন্দোলন। তাইল্যান্ডের নেতা ফিবুল সংক্রমের সরকার নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করলেও প্রকৃত অর্থে জাপান-সমর্থকই বটে। সেই সরকারের সৌজন্যে মিলল মালয় থেকে বর্মা যাতায়াতের অত্যন্ত জরুরি যোগাযোগ-পথ। এ দেশেও প্রবাসী ভারতীয় সমাজ যথেষ্ট বড়, প্রায় ষাট হাজার মানুষ, ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের ভিত্তি তাঁরাই। তবে ভারতে যুদ্ধ অভিযানের পথে আসল গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ— বর্মা। মন্দার সময়ে প্রচুর ভারতীয় বর্মা থেকে চলে আসা সত্ত্বেও, এবং জাপানি আক্রমণের আগে প্রায় চার লক্ষ উদ্বাস্তুর পলায়ন সত্ত্বেও, তখনও আট লক্ষাধিক ভারতীয়ের বাস সেখানে— বণিক, মহাজন, শ্রমিক, পেশানিযুক্ত মানুষ সব মিলিয়ে। এরই মধ্যে আবার ঘটে গিয়েছে সায়া সান-এর নেতৃত্বে ১৯৩০-৩২-এর কৃষক মহাবিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসককুল হলেও অপ্রধান লক্ষ্য কিন্তু ছিল ভারতীয় মহাজন সম্প্রদায়। সুতরাং ইন্দো-বর্মা সম্পর্কের বিষয়টিতে সাবধানে অগ্রসর হওয়া ছাড়া গতি নেই।
১৯৪৩-এর ১ অগস্ট বর্মার স্বাধীনতা উদ্যাপনে সম্মানিত অভ্যাগত হিসেবে আমন্ত্রিত হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ২৯ জুলাই বর্মায় উপস্থিত হলেন তিনি। পরের দুই দিন প্রবাসী ভারতীয়দের উদ্দেশে শোনা গেল একের পর এক উদাত্ত বক্তৃতা, শ্রোতারা উত্সাহে উদ্বেল। ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে বর্মাকে উদ্ধার করার পর কিছু দিনের দোনামনার পর জাপানিরা বা মও’র নেতৃত্বে স্বাধীন বর্মা সরকারকেই স্বীকৃতি দিয়েছে ইতিমধ্যে। অং সান হন সেই সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। বা মও ব্রিটিশদের হাতে নিহত সায়া সান-এর মামলায় তাঁর হয়ে আদালতে লড়েছিলেন, তার পর ১৯৩৭-৩৯ নতুন সংবিধানের ছত্রচ্ছায়ায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যভার চালিয়েছেন— যদিও নামে মাত্রই, মূল ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ গভর্নরের হাতেই। সিনইয়েথা বা দরিদ্রজনের পার্টির নেতা বা মও, বর্মায় তাঁর সমর্থন-ভিত্তি খুব বড় নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব থাকিনস পার্টির, অং সান যে দলের অন্যতম প্রধান নেতা। “থাকিন” শব্দটির অর্থ “মাস্টার” বা কর্তা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তাদের ক্ষমতা অস্বীকার করতে থাকিনরা পরস্পরকে এই নাম ধরেই ডাকতেন। ১৯৩০-এর শেষ দিকে, থাকিনদের মধ্যে যাঁরা আরও চরমভাবাপন্ন, তাঁরা গঠন করলেন ফ্রিডম ব্লক। এই পার্টির যোগ ছিল সুভাষের ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে। ব্রিটিশ যুদ্ধ-অভিযানে বর্মী নেতারা যোগ দিতে অস্বীকার করলে তাঁদের সকলকে জেলে বন্দি করা হল। অং সান পালালেন। জাপানে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ও তাঁর সঙ্গী “ত্রিশ নায়কের দল” জাপানি যুদ্ধদলের সঙ্গে বর্মায় ফিরে এলেন। ব্রিটিশকে পরাস্ত করে যে জাপানি বাহিনী, তার সঙ্গেই ফেরেন অং সান।
বা মও সুভাষের সঙ্গে ৬ জুলাই সিঙ্গাপুরে দেখা করে বিশেষ মুগ্ধ হলেন। পরে আত্মজীবনীতে লেখেন তিনি, “সুভাষচন্দ্র বসু হলেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁর সঙ্গে এক বার আলাপ হলে আর কোনও দিন ভোলা যায় না, তাঁর মহত্ত্ব যে কোনও মানুষের চোখে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে।”২৫ ১ অগস্ট সুভাষ বর্মার স্বাধীনতা উদ্যাপনের সময় একটি মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিলেন: “১৯২৫ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত মান্দালয় জেলের আমার ঘরটির বারান্দা থেকে তাকিয়ে থাকতাম এই প্রাসাদের দিকে, বর্মার শেষ স্বাধীন রাজার প্রাসাদ, ভাবতাম কোনও দিন কি আবার বর্মা স্বাধীন হতে পারবে। আজ কিন্তু বর্মা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, আর আমি সেই স্বাধীন দেশের হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারছি।”২৬ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের দেওয়া অর্থসাহায্য থেকে বর্মা সরকারকে আড়াই লক্ষ টাকার ‘নজর’ বা উপহার দিতে চাইলেন তিনি, বর্মার আতিথেয়তার জন্য ভারতের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতার ছোট্ট চিহ্ন হিসেবে।
বাংলার সাহিত্যভাবনায় বহু দিন যাবৎই বর্মা হল স্বাধীনতাযুদ্ধের কল্পলোকের মঞ্চ। জনপ্রিয় বাঙালি ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬-এ লেখেন “পথের দাবী”— যে সময় মান্দালয় জেলে সুভাষ বন্দি হয়ে রয়েছেন। এই কাহিনির সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচিত ছিলেন সুভাষ, পরিচিত ছিলেন শরৎচন্দ্রের সেই অতিমানবোচিত বিপ্লবী নায়কের সঙ্গে যিনি বর্মায় বসে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন। রেঙ্গুনে বা মও-র মনে হয়েছিল সুভাষ যেন “একটু বিষণ্ণ, ভারাতুর” হয়ে আছেন, সম্ভবত “ভারতের মুক্তি অর্জন করার আগে তাঁর ও তাঁর বাহিনীর সামনে এখনও যে দীর্ঘ রক্তাক্ত যাত্রা”, সে কথাই ভাবছেন তিনি।২৭ আরও একটা কারণ থাকতে পারে তাঁর সে দিনের বিষণ্ণতার। সীমান্তের ঠিক ওপারে, তাঁর নিজের প্রদেশ বাংলায় তখন লক্ষ লক্ষ প্রাণ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভয়ানক এক মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে। ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন এই মর্মান্তিক পর্বে, প্রধানত সমাজের দুঃস্থ মানুষেরা। একে তো যুদ্ধে একাগ্র ব্রিটিশদের মনে তখন একটিই চিন্তা— কী ভাবে নিজেদের সৈন্যবাহিনীর জন্য আরও আরও রসদ সংগ্রহ করা যায়। তার উপর, কলকাতার চারদিকে শিল্পনির্ভর অঞ্চলগুলিতে রেশন-দোকানের মাধ্যমে চাল বিক্রি করে সমাজের উচ্চতর অংশকে চুপ করিয়ে রাখার কায়দাও চলছে। বিরাট সংখ্যক কৃষি-শ্রমিক, বাজারের উপর নির্ভরশীল ভাগচাষি, ছোট পাটচাষি, এঁদের পক্ষে তখন বেঁচে থাকার মতো খাবারটুকু জোগাড়ই অসম্ভব, দাম এমনই হু-হু করে বাড়ছে। এরই সঙ্গে রয়েছে ব্রিটিশের “প্রতিরোধ নীতি” (denial policy)— সমস্ত নৌকো, সাইকেল, উপকূলের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে সব রকমের পরিবহণ-যান আটক করা, যাতে এই সব অঞ্চলের মানুষও জীবনযাপনের রসদ জোগাড় করতে না পারে। ১৯৪৩ সালের মার্চে শুরু হয়ে এই দুর্ভিক্ষ সেই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্বীকৃত হওয়ার সুযোগ পেল না। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে ঊনবিংশ শতকের সেই প্রবাদপ্রতিম “দুর্ভিক্ষ বিধি”র টিকিটিও দেখা গেল না, যে বিধির মাধ্যমে অত কাল আগেও ব্রিটেনে ত্রাণ-সংস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বাইরে থেকে খাদ্যশস্য আনার কোনও চেষ্টাই হল না, কিংবা খাদ্য এলেও দুর্ভিক্ষ-ত্রাণ হিসেবে তা গণ্য হল না। অত ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সামলানোর জন্য প্রয়োজন ছিল বিরাট পরিমাণ খাদ্যশস্যের আমদানি। মার্কিন বোর্ড অব ইকনমিক ওয়ারফেয়ার-এর হিসেব অনুযায়ী, বাইরে থেকে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যশস্য না আনলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা। তা সত্ত্বেও চার্চিল ভারতীয়দের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখালেন না, এমনিতেই তো ভারতীয়রা তাঁর চোখে বর্বর প্রজাতির মানুষ ছাড়া কিছু নয়। লক্ষকোটি বুভুক্ষুর জন্য কিছু খাদ্যের বন্দোবস্ত হয়তো হতে পারত ত্রাণসামগ্রীবাহী জাহাজগুলি তীরে ভিড়তে পারলে। কিন্তু জাহাজের খাদ্য সরবরাহের অনুমতি চার্চিল দিলেন না।২৮
এই সময়ে বর্মা থেকে চাল পাঠানোর চেষ্টা করলেন সুভাষ। ভারতের ব্রিটিশ কর্তারা কিন্তু এ খবর শুনেই ঘাবড়ে গিয়ে তত্ক্ষণাৎ সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। ২০ অগস্ট, ১৯৪৩— রেঙ্গুন রেডিয়ো থেকে ভেসে এল বেতার-বার্তা: বাংলার জন্য সুভাষ এক লক্ষ টন চাল ভারতের কাছে একটি বন্দরে পাঠাতে চাইছেন। ব্রিটিশরা তাঁর প্রস্তাব স্বীকার করলেই বন্দরের নামটি তিনি জানিয়ে দেবেন, এবং কারা সেই চাল হস্তান্তর করবেন, তাও বলে দেবেন: প্রতিশ্রুতি দিলেন সুভাষ। প্রথম কিস্তির পর আরও কয়েক কিস্তি চাল পাঠানোর পরিকল্পনা তাঁর। সুভাষের ঐকান্তিক আশা, তাঁর প্রস্তাব গ্রাহ্য হবে, “লক্ষ লক্ষ পুরুষ, নারী, শিশু খাবার পেয়ে প্রাণে বাঁচবে।” তাঁর নিজের দেশের হতাশ্বাস মানুষগুলির কানে পৌঁছল এই প্রতিশ্রুতি। কিছু দিন পরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে লেখা হল, “সুভাষের বিষয়ে শেষতম গুজব— তিনি নাকি ভাইসরয়কে লিখে জানিয়েছেন দুটি জাহাজ পাঠাতে যাতে বাংলার ক্ষুধাপীড়িত মানুষের জন্য তিনি চাল পাঠাতে পারেন।” নয়া দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে সে দিন রীতিমতো দৌড়াদৌড়ি। সুভাষের প্রস্তাব আটকানোর জন্য কী ভাবে প্রেস-এর উপর কঠিনতম সেন্সরশিপ আনা যায়, তার চিন্তাভাবনা। “সুভাষ বসুকে হেয় করার যত রকম উপায় সম্ভব, উদ্বিগ্ন হয়ে আমরা সে সবই ভেবে দেখছিলাম তখন,” রিচার্ড টটেনহ্যাম লিখলেন ১৯৪৩-এর ১ সেপ্টেম্বরে।২৯
বর্মা থেকে তখন কেবল চাল পাঠানোই যে সম্ভব, তা নয়। বর্মা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংঘর্ষের প্রতীকী কেন্দ্রভূমি। ১৮৫৮ সালে শেষ মুঘল বাদশা লালকেল্লায় তাঁর তথাকথিত বিচারের পর বর্মাতেই নির্বাসিত হয়েছিলেন। ১৯৪৩-এর ২৬ সেপ্টেম্বর, রেঙ্গুনে সেই বাহাদুর শাহের সমাধির সামনে কুচকাওয়াজ করে গেল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, সেখানে প্রার্থনার সময়ে অঙ্গীকার শোনা গেল, দিল্লির লাল কেল্লা অবধি এ ভাবেই অব্যাহত থাকবে তাঁদের অভিযান। সুভাষ শ্রদ্ধা জানালেন:
ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, আমরা ভারতীয়রা সর্বদা বাহাদুর শাহের স্মৃতি বহন করে চলি। বহিরাগত শত্রুকে হটানোর জন্য দেশবাসীকে আঘাত হানার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কেবল সেই কারণেই নয়। ইনিই সেই মানুষ যাঁর পতাকার তলায় দাঁড়িয়ে সে দিন সব প্রদেশের ভারতীয়, সব ধর্মবিশ্বাসের ভারতীয় একযোগে লড়াই করেছিল, যাঁর পবিত্র পতাকার তলায় মুক্তি-প্রিয় হিন্দু, মুসলিম, শিখরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সেই যুদ্ধের নাম দেয় সিপাহী বিদ্রোহ, আমরা ভারতীয়রা অবশ্য বলি, এ-ই আমাদের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ।
কেবল যান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ নয়, এই চলমান ঐক্যবোধ, এই বিশ্বাসের উপর ভর দিয়ে তৈরি হওয়া ঐক্যবোধই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন “স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধেও।”৩০
সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুন আসা-যাওয়ার পথে তাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককেই সাধারণত নামতেন সুভাষ। ৪ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী ফিবুলের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি, জাপানি তথ্যসাবুদ অনুযায়ী “তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া তৈরি হল।” ৮ অগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকীর দিনটিতে চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটিতে একটি জনসভায় বক্তৃতা দিলেন সুভাষ। পরের দিন যত ভারতীয় তাঁর যুদ্ধ তহবিলে দানসামগ্রী দিলেন, সেই “সহস্রাধিক ভারতীয়দের তিনি কাছে টেনে নিলেন।”৩১ মালয়, তাইল্যান্ড ও বর্মায় উত্সাহের বহর দেখে সেপ্টেম্বরে নেতাজিও ভারী সন্তুষ্ট। সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, রেঙ্গুনের মতো প্রধান শহরগুলির সঙ্গে কুয়ালালামপুর, পেনাং কিংবা ইপহ্-এর মতো ছোট শহরেও বড় বড় সফল সভা হল। নেতাজির বার্তা ছড়িয়ে দিতে তাঁর প্রতিনিধিরা গেলেন ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চিনে। কোনও কোনও সময়ে যেন নিজেরই তৈরি তড়িত্প্রবাহে নিজেই তরঙ্গিত হয়ে ভেসে যেতেন তিনি। সহকর্মীদের রীতিমতো হতবুদ্ধি করে এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করে দিলেন যে বছর শেষ হওয়ার আগেই ভারতের মাটিতে পৌঁছে যাবে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি।৩২ এ যেন সেই ১৯২১-এ গাঁধীর এক বছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দেওয়ার ঘোষণা, যে উদ্দীপনাদায়ী অবাস্তব দাবিটিকে সুভাষ নিজেই সে দিন সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত, জাপানিরা ভারতের সাময়িক সরকারের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তুলে দিল ১৯৪৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর, ফলে প্রতিশ্রুতি একেবারে মিথ্যা হল না, বছর শেষ হওয়ার আগে অন্তত ভারতের মাটিতে এসে দাঁড়াতে পারলেন সুভাষ।
সুভাষ যখন সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন, জাপানিদের সঙ্গে সংঘাতের ফলে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির শক্তি কমে গিয়ে সেই সময়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র বারো হাজার অস্ত্রধারী সৈন্যে। তাঁর উপস্থিতিতে অবশ্য আবার হু হু করে বাড়তে লাগল সৈন্যসংখ্যা। পঞ্চাশ হাজারে ওঠাতে চাইছিলেন সৈন্যসংখ্যা, কিন্তু জাপানিরা জানাল, তিনটি ডিভিশনে বিন্যস্ত ত্রিশ হাজারের বেশি ভারতীয় সৈন্যের প্রশিক্ষণ কিংবা অস্ত্রদানের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে না। প্রথম বারের আলোচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাপানি বাহিনীর কম্যান্ডার ফিল্ড মার্শাল কাউন্ট হিসাইচি তেরাউচি সুভাষকে বলেন, তিনি চান আই এন এ কেবল প্রোপাগ্যান্ডার কাজেই ব্যবহৃত হোক। সুভাষ কিন্তু এই প্রস্তাবে একেবারেই অরাজি। জোর দাবি করলেন তিনি, আই এন এ-কে ভারতের দিকে অগ্রসরমাণ বাহিনীর পুরোভাগেই রাখতে হবে। তেরাউচিকে বললেন, “জাপানি ত্যাগের মাধ্যমে ভারতের মুক্তি অর্জন— দাসত্বেরও বাড়া।”৩৩ শেষ পর্যন্ত দক্ষতা ও মনের জোর পরীক্ষার জন্য আই এন এ-র একটি রেজিমেন্টকে পাঠাতে রাজি হলেন ফিল্ড মার্শাল — একটি রেজিমেন্ট মানে এক ব্রিটিশ ব্রিগেডের সমান— পরিস্থিতি বুঝে তবে বাকি বাহিনী পাঠাবেন কি না মনস্থ করবেন।
আই এন এ-র প্রথম ডিভিশন, প্রায় দশ হাজার সৈন্য মহম্মদ জামান কিয়ানির অধীন। তিনটি রেজিমেন্ট বা ব্রিগেড এতে— দেশের সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছা করেই নেতাজি তাদের নাম দিয়েছেন গাঁধী ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড। তেরাউচির চ্যালেঞ্জের সামনে আই এন এ তাদের সেরা সৈন্যদের বেছে নিল এই বিশেষ বাহিনীর জন্য, প্রথমে যুদ্ধ যাবেন তাঁরাই। উত্তর মালয়ের শহর তাইপিং-এ সেপ্টেম্বর মাসে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হল এই বাহিনীকে শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে। সেখান থেকে ২০ নভেম্বর নিয়ে যাওয়া হল বর্মায়। সৈন্যরা নিজেরা অবশ্য এই বাহিনীকে “সুভাষ ব্রিগেড” বলেই ডাকত। শাহনওয়াজ বলতেন, সুভাষের ভীষণ অপছন্দ ছিল ব্যাপারটা, “বার বার অর্ডার জারি করতেন যাতে সৈন্যরা কখনওই ‘সুভাষ ব্রিগেড’ নামটি না ব্যবহার করে, কিন্তু সৈন্যদের পক্ষে এই নির্দেশ মেনে চলা কঠিন।”৩৪
আই এন এ-র সুপ্রিম কম্যান্ডার নেতাজি তাঁর অফিসার বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে অনবরত আসা-যাওয়া করতেন এই অফিসাররা, একসঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতেন অনেক সময়। সাধারণ সৈন্যদের ব্যারাকে হানা দিতেন মাঝে মাঝে, না জানিয়েই, তাদের সঙ্গে একত্র খাবার খেতেন বসে। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান সৈন্য সকলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হত, ব্রিটিশরা যেমন আলাদা আলাদা ‘মেস হল্’ তৈরি করেছিল, তার ঠিক উল্টো প্রথায়। বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়, বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে আসা সৈন্যদের মধ্যে দ্রুত উষ্ণতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায় এর ফলে। বার বার হিন্দুদের অন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি দরাজ ব্যবহার করতে মনে করাতেন সুভাষ। সামরিক সমাজ থেকে এলেও যাতে সৈন্যরা রিক্রুটমেন্ট সেন্টারে ভিড় করে আসা মানুষ কিংবা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া অসামরিক মানুষজনের সঙ্গে সুব্যবহার করেন, সেই শিক্ষা দিতেন তাঁদের। নিজের হাতে বেছে-নেওয়া পঁয়তাল্লিশ জন তরুণকে টোকিয়োর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পাঠিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। পঁয়ত্রিশ জনকে বেছেছিলেন পদাতিক বাহিনীর জন্য, দশ জনকে ভবিষ্যৎ বিমানবাহিনীর জন্য। যেহেতু অর্থ-সংগ্রহের ব্যাপারে বিপুল সাফল্য পেয়েছিলেন, যথাসম্ভব মাইনে বাড়িয়ে দেন, প্রশিক্ষণের সময় বেশ ভাল পরিমাণে খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করেন। সঙ্গীত তাঁর প্রিয়, তাই আই এন এ অর্কেস্ট্রা দল তৈরি করলেন, তাঁরা নানা দেশাত্মবোধক গানের সংগ্রহ বানিয়ে ফেললেন, নতুন নতুন সুর বানালেন। সঙ্গীত এবং সুপ্রিম কম্যান্ডারের বক্তৃতা— যে কোনও সামরিক বাহিনীর মনের জোর বাড়াতে সক্ষম, যে কোনও বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান সম্পদ— এই ছিল তাঁর মত।৩৫
সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতির নিরিখে সময়ই এখন সবচেয়ে দামী বস্তু। সুতরাং অস্বাভাবিক পরিশ্রম করছেন সুভাষ, রাতে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোচ্ছেন না। সিঙ্গাপুরে তাঁর মেয়ার রোড-এর বাড়িতে প্রথম কয়েক মাস আবিদ হাসান তাঁর সঙ্গে মধ্যরাতেও দেখা করতে গিয়ে দেখেছেন, তখনও একনাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি, তখনও তাঁর হাতের কাছে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি, কিংবা এক কাপ কফি। পরের দিন সকালে অ্যাশট্রে-য় সিগারেটের টুকরো গুনে হাসান বলে দিতে পারতেন, কত রাত অবধি ডেস্কে বসে কাজ করেছেন সুভাষ। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে জেগে যেতেন তিনি, তখনই তাঁর প্রার্থনা করার সময়। একটি জপমালা ও একটি ছোট গীতা, এই তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী, কিন্তু নিজের ধার্মিকতা জাহির করার অভ্যেস তাঁর কস্মিনকালেও নেই। সহকর্মী এস এ আইয়ার লিখেছিলেন “জীবনে কোনও দিনও নিজের ঈশ্বর বিষয়ে একটি কথাও তিনি সর্বসমক্ষে বলেননি, তিনি শুধু তাঁর ঈশ্বরের মধ্যে বাঁচতেন।” দিনটি হয়তো কেটে যেত চ্যান্সারি লেন-এ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের হেডকোয়ার্টারে এবং সুপ্রিম কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার এবং ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে, কিংবা একের পর এক মিটিং-এ যুদ্ধের কৌশল আলোচনা করে কিংবা জনসমর্থন বাড়ানোর পরিকল্পনায়। রাতে খাওয়ার সময় কাজের কথা বলতে একেবারে পছন্দ করতেন না। বরং মন দিয়ে নানা রকম মাছের রান্না কিংবা পালংশাক বা করলা রান্নার পদ্ধতি আলোচনায় মন দিতেন। যাঁরা তাঁর কাছে কাজ করত, খুব নরম ব্যবহার করতেন তাদের সঙ্গে, (যারা বেশি ঘনিষ্ঠ, তাদের আবার বকাবকিও করতেন), তাঁর কাছাকাছি যখন তারা থাকত, চেষ্টা করতেন তাদের সহজ বোধ করাতে। বেড়াল ছাড়া সব জন্তু ভালবাসতেন, অথচ বাড়িতে বেড়ালের উপস্থিতি মেনে নিতেই হল, কেননা আবিদ হাসান বেড়ালপ্রিয় মানুষ। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ কর্মব্যস্ত দিনের শেষে, মাঝে মাঝে গাড়িতে চলে যেতেন রামকৃষ্ণ মিশনে। মিলিটারি পোশাক ছেড়ে একটি সিল্কের ধুতি পরে নিতেন সেখানে, দু’-এক ঘণ্টা ধ্যানে বসতেন, বেরিয়ে আসতেন একেবারে পুনরুজ্জীবিত হয়ে। যুদ্ধের সময় তিনিই সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে তুফান-তোলা ব্যস্ততম ব্যক্তিত্ব, অথচ ঘনিষ্ঠ জনেরা দেখতেন চুপচাপ সময়ে তিনি এক জন আশ্চর্য রকম শান্ত মানুষ, প্রায় বুদ্ধের মতো সুস্থিত।৩৬
১৯৪৩-এর অক্টোবরে নেতাজি সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ্-এর সাময়িক সরকার গঠনের ঘোষণাটি করলেন। সিবিয়ার আপ্পাদুরাই আইয়ার বর্ণনা করেছেন, নেতাজি কী ভাবে ভারতীয় ইতিহাসের উপর ভর করে, আইরিশ ও মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কিছু কিছু অংশ অনুসরণ করে, ১৯-২০ অক্টোবর বসে নিজেই ঘোষণাপত্রটি লিখলেন। সেই সন্ধেয় কিছু ক্ষণ আগে, সুভাষ আইয়ারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন আইরিশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বাক্ষরকারীদের কী গতি হয়েছিল, সে কথা কি জানেন আইয়ার?— গুলি করে মারা হয় তাঁদের। একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা এই ঘোষণাপত্রে যাঁরা সই করবেন তাঁদেরও: বলে হাসতে শুরু করলেন তিনি। রাতের শেষ অতিথিটিও চলে যাওয়ার পর, মধ্যরাতে কফি নিয়ে ঘোষণাপত্রটি লিখতে বসলেন: “এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল আমার সে দিন,” লিখছেন আইয়ার, “এক অসাধারণ মানবসন্তানকে দেখতে পেলাম চোখের সামনে, এক ঝলকের জন্য। একগোছা সাদা কাগজ হাতে নিলেন, একটি পেনসিল নিলেন, লিখতে শুরু করলেন।” একটি একটি করে পাতা নেতাজি লিখে দিচ্ছেন, আইয়ার টাইপ করে পাঠিয়ে দেবেন প্রিন্টারের কাছে। নেতাজি আরম্ভ করলেন, “ভণ্ডামি করতে করতে ভারতীয়দের তাদের সহ্যক্ষমতার শেষ সীমায় নিয়ে এসে, লুণ্ঠন-অত্যাচারে অনাহার ও মৃত্যুর দিকে তাদের ঠেলে দিয়ে ব্রিটিশ রাজ ভারতীয় সমাজে তাদের সমস্ত সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে, প্রতি মুহূর্তে এক বিপজ্জনক অস্তিত্বের মধ্যে দিনযাপন করছে। তাদের এই অর্থহীন শাসনের শেষ চিহ্নটিও মুছে ফেলতে দরকার কেবল একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ভারতের মুক্তিবাহিনীর কাজ হল— সেই স্ফুলিঙ্গটি জ্বালিয়ে দেওয়া।” সেই রাত বিষয়ে আইয়ারের বর্ণনা:
সামনের কাগজ থেকে একটি বারও চোখ তুললেন না, প্রথম পৃষ্ঠা শেষ হওয়ামাত্র নিঃশব্দে আমার হাতে সেটি ধরিয়ে দিলেন, আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম, টাইপরাইটারে বসলাম। আবিদ (হাসান) এবং (এন জি) স্বামী একে একে তাঁর ঘরে গেল, যেমন যেমন তিনি শেষ করছেন, তারাও একটি একটি পৃষ্ঠা করে আমার হাতে গোটা পাণ্ডুলিপিটিই তুলে দিল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এক বারও আগের কোনও পৃষ্ঠা দেখতে চাইলেন না তিনি। আগের পৃষ্ঠাগুলিতে কী লিখেছেন, তার প্রতিটি শব্দ কী ভাবে যে মনে রাখলেন, কী ভাবে যে কোন্ অনুচ্ছেদ কার পর আসছে সে কথা মনে রাখলেন, কে জানে। পুরো পাণ্ডুলিপিতে একটিও শব্দ কাটাকুটি হল না, সংশোধন হল না, দাঁড়ি-কমাসুদ্ধ সবটাই একেবারে গোড়া থেকে ঠিকঠাক।
শেষ অনুচ্ছেদে রইল ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে উদাত্ত ডাক: “ঈশ্বরের নামে, যে সব পূর্ব প্রজন্ম ভারতীয় জনসাধারণকে এক ও অদ্বিতীয় জাতিতে পরিণত করেছেন তাঁদের নামে, যে সব শহিদ নিজেদের প্রাণ দিয়ে সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন তাঁদের নামে— সকল ভারতীয়ের প্রতি আমার আহ্বান, আমাদের পতাকার তলায় এসে দেশের মুক্তির সংগ্রামে সামিল হোন।” এই অসামান্য ভাষাচ্ছটার নেপথ্যে রয়ে গেল পূর্বসূরি আইরিশ ঘোষণাপত্রের প্রভাবছায়া: “এই সাময়িক সরকার নিজের অধিকারবলে সকল ভারতীয়ের আনুগত্য দাবি করছে। সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সমান অধিকার, সমান সুযোগের অধিকার নিশ্চিত করা এই সরকারের কর্তব্য। অতীতে বিদেশি শাসকের দুষ্ট অভিসন্ধির ফলে যত রকম বৈষম্য আজ প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই সমস্ত বৈষম্য দূর করে সমগ্র জাতিকে সুখ ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অভীপ্সা ঘোষণা করছে এই সরকার।”৩৭
সাময়িক সরকারের ঘোষণার অনুষ্ঠানটি হল ক্যাথে থিয়েটারে, যেখানে এক দিন আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন সুভাষ। সরকারের প্রধান হিসেবে বিদেশ দফতর এবং যুদ্ধ দফতর নিজের হাতে রাখলেন। শপথ নেওয়ার সময় তাঁর গলা আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল: “ঈশ্বরের নামে এই শপথ গ্রহণ করছি-ভারতবর্ষ ও আটত্রিশ কোটি ভারতবাসীকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমি, সুভাষচন্দ্র বসু, আমার জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এই পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাব।”৩৮ এ সি চ্যাটার্জির উপর দিলেন অর্থ দফতরের ভার, এস এ আইয়ার পেলেন পাবলিসিটি ও প্রোপাগ্যান্ডার দায়িত্ব। লক্ষ্মী স্বামীনাথন নারী-বিষয়ক দফতরের দায়িত্ব নিলেন। সামরিক বাহিনীর আট জন সদস্য, আজিজ আহমেদ, এন এস ভগৎ, জে কে ভোঁসলে, গুলজারা সিংহ, মহম্মদ জামান কায়ানি, এ ডি লোগানাথান, এহসান কাদির এবং শাহনওয়াজ খান তাঁর মন্ত্রিসভায় আসন পেলেন, আনন্দমোহন সহায় মন্ত্রিত্বের সমকক্ষ ক্যাবিনেট সচিবের পদ পেলেন। রাসবিহারী বসু মহা-উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করলেন। বর্মা, তাইল্যান্ড ও মালয় থেকে আসা আরও সাত জন— করিম গনি, দেবনাথ দাস, ডি এম খান, আট্টাবর ইয়েলাপ্পা, জন থিভি, সর্দার ইশার সিংহ এবং এ এন সরকার— এঁরা রইলেন উপদেষ্টা গোষ্ঠীতে। মন্ত্রিসভা গঠন সমাপ্ত হলে দেখা গেল, সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায় থেকে বহু সদস্যের উপস্থিতি কিংবা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুষম প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ভোলেননি সুভাষ।
বাস্তবিক, নানা ধর্মসম্প্রদায় ও ভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যভাব নির্মাণে সুভাষ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। এবং এর জন্য কখনওই নিজের নিজের সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য ছেড়ে ভারতীয় জাতির প্রতি অনুগত হওয়ার নির্দেশ তাঁকে দিতে হয়নি। অবশ্য, শ্রেণিবৈষম্য দূর করার কাজটা ছিল অনেক বেশি কঠিন। দরিদ্র ভারতীয়দের মধ্যে প্রথমে নেতাজির আহ্বানে বেশ একটা সাড়া দেখা গিয়েছিল। কিছু-সংখ্যক ঐশ্বর্যশালী ভারতীয়ের কৃপণতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতেন তিনি, তবে এও ঠিক, কোটিপতি স্বেচ্ছায় ফকির হয়েছেন— এমন দৃষ্টান্তও কম ছিল না আই এন এ-র অভিজ্ঞতায়। “আই এন এ যখন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তার বিজয়-লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণে ব্যস্ত,” ১৯৪৩ সালে ২৫ অক্টোবর চেট্টিয়ার ও অন্যান্য মহাজনী বণিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, “ধনী মানুষেরা অনেকেই আমার কাছে জানতে চাইছেন, সর্বস্ব দানের অর্থ কি দশ শতাংশ না পাঁচ শতাংশ। যাঁরা এমন বলছেন তাদের প্রতি আমার পাল্টা জিজ্ঞাসা, আমি কি তবে আমাদের সৈন্যদের বলব যুদ্ধে কেবল তাদের রক্তের দশ শতাংশ খরচ করে বাকিটা জমিয়ে রাখতে?”৩৯ শেষ পর্যন্ত উত্সাহী দাতাদের কাছ থেকে ১০০ শতাংশ এবং অনুৎসাহীদের কাছ থেকে ১০ শতাংশই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করল সাময়িক সরকার। দেখা গেল অর্থ-সংগ্রাহক হিসেবে নেতাজি অত্যন্ত সফল, ১৯৪৩-এর শেষ হিসেব করে দেখা গেল, মাসে প্রায় কুড়ি লক্ষ স্থানীয় ডলার সংগৃহীত হয়েছে। অগস্টে পেনাং শহরে একটি সভা বিশেষ ভাবে সফল হল, সেখানে পনেরো হাজার ভারতীয়ের কাছ থেকে প্রায় কুড়ি লক্ষ ডলার পেলেন তিনি।৪০ তামিলনাড়ুর চেট্টিয়ার সম্প্রদায় থেকে বহু অর্থদাতা এগিয়ে এলেন আজাদ হিন্দ্ সরকারের সহায়তায়।
তবে অক্টোবরে যখন সিঙ্গাপুরের প্রধান চেট্টিয়ার মন্দির থেকে সুভাষকে একটি ধর্মীয় উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হল, তাঁদের নানা রকম বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে প্রাথমিক ভাবে প্রত্যাখ্যাত হলেন তাঁরা। শেষে অবশ্য সব জাত ও ধর্মের জন্য জাতীয় সভা করার প্রস্তাবে তারা রাজি হলে সুভাষ তাঁদের অনুরোধ রাখলেন। মন্দিরে যাওয়ার সময়ে দুই পাশে নিয়ে গেলেন দুই সঙ্গীকে, মুসলিম কমরেড আবিদ হাসান এবং মহম্মদ জামান কায়ানি। হাসান লিখেছেন, “আমরা মন্দিরে পৌঁছে দেখি কানায় কানায় ভরা, আই এন এ অফিসারের ইউনিফর্ম চতুর্দিকে, কালো টুপি পরিহিত দক্ষিণ ভারতীয় মুসলিমদের স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এ দিকে ও দিকে।” মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে দ্বিধা করছিলেন তিনি, কিন্তু এক জন পুরোহিত আলতো ঠেলায় ঢুকিয়ে দিলেন তাঁকে। হিন্দু রীতি অনুযায়ী তাঁদের কপালেও দেওয়া হল চন্দনের তিলক। মন্দির থেকে বেরিয়েই নেতাজি তা মুছে ফেললেন, সঙ্গীরাও তাই করলেন। সে দিন নেতাজি কী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, আবিদ হাসান পরে আর তা মনে করতে পারেননি। পরে কেবল লিখেছিলেন, “সে দিনের যে স্মৃতি আমার মনে আঁকা হয়ে রইল— তা যেন দেশমাতার ঐক্যের লক্ষ্যে, নিজেদের সত্তা প্রতিষ্ঠার আদর্শে উজ্জীবিত সকল দেশবাসীকে একত্রিত করার লক্ষ্যে নিবেদিত সঙ্গীতের মূর্ছনা।” পরবর্তী কালে যুদ্ধক্ষেত্রের নানা সংকটে সংঘাতের মধ্যেও সেই সঙ্গীতের স্মৃতি থেকেই মনের শক্তি লাভ করতেন তিনি।৪১
এ ভাবে ঐক্যের বোধ জাগিয়ে তুলে একটি প্রচ্ছন্ন লক্ষ্যের সন্ধান দিতে চাইত আজাদ হিন্দ্ সরকার। জয় হিন্দ্— ভারতীয়রা যখনই একে অপরকে দেখবে, সকলের জন্যই বেছে নেওয়া হয়েছিল এই সম্ভাষণ। হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণে হিন্দুস্থানি ভাষা, আর রোমান লিপি জাতীয় ভাষা ও লিপি হিসেবে নির্ধারিত হল। তবে প্রচুর সংখ্যায় দক্ষিণ ভারতীয় উপস্থিতির কারণে প্রতিটি জনসভায় এর তামিল অনুবাদও ব্যবহার হত। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাটিও হিন্দুস্থানি, তামিল, ইংরেজিতে পঠিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে” গানটিরও সহজ হিন্দুস্থানি অনুবাদ করে সেটিকে জাতীয় সঙ্গীত স্থির করা হল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মহীশূরের টিপু সুলতানের প্রতিরোধের সাহসিক দৃষ্টান্ত স্মরণ করে ইউনিফর্মের কাঁধে ত্রিবর্ণ অংশটুকুর উপরে লম্ফনরত বাঘের প্রতীক ব্যবহার শুরু হল। তবে আই এন এ-র তেরঙা পতাকার মাঝে রয়েই গেল গাঁধীর চরকা, এই পতাকা নিয়েই তারা দিল্লির দিকে অগ্রসর হবে। তিনটি উর্দু শব্দ— ইতমদ্ (বিশ্বাস), ইত্তেফাক (ঐক্য) এবং কুরবানি (ত্যাগ)— এই হল আজাদ হিন্দ্ আন্দোলনের আদর্শমন্ত্র।৪২
আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সৈন্যদের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগানোর জন্য রাজনৈতিক শিক্ষাদানের চল শুরু হল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সৈন্যদের উদ্দেশে যে সব বক্তৃতা দেওয়া হত, নেতাজি নিজেই সেগুলি লিখতেন, কিংবা অন্য কেউ লিখলে সেই বক্তৃতা আদ্যোপান্ত পড়ে নিতেন আগে। আই এন এ সেনাদের জন্য তৈরি এ রকমই একটি বক্তৃতায় “ইউনিটি অব ইন্ডিয়া, পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট”-এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা ছিল। “মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু ও মুসলমানরা ভাই-ভাই হয়ে থাকতে শুরু করলেন।” পরবর্তী কালে ভারতের জনগণের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগানোর কৃতিত্ব প্রধানত মহাত্মা গাঁধীরই। গাঁধী বিষয়ে ভূয়সী প্রশংসা করলেন সুভাষ, ১৯৩৯ সালে তাঁদের পারস্পরিক বিষমতার কথা মনে না রেখেই। ২ অক্টোবর মহাত্মার চুয়াত্তরতম জন্মদিবসে ব্যাঙ্কক থেকে যে বেতার-বার্তা প্রচারিত হল, তাতে বলা হল ভারতীয় সংগ্রামে “অসামান্য, তুলনাবিহীন” গাঁধীর অবদান। গাঁধী এ দিকে সেই মুহূর্তে ব্রিটিশ জেলে যন্ত্রণা ক্লিষ্ট দিনযাপন করছেন। “কোনও এক জন মানুষের পক্ষে এক জীবনে, এই বিশেষ পরিস্থিতিতে এর থেকে বেশি কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়,” বললেন সুভাষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়রা এর থেকে কী শিক্ষা নিতে পারে? “ভারতের পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যে সম-রক্তবাহী ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা”র শিক্ষা।৪৩ সুভাষ ও গাঁধী: দুই জনই ঐক্যসাধনের লক্ষ্যে দেশভক্তির পবিত্র শিখা জ্বালানোর কথা বলে গিয়েছেন। দুই জনের ভাবনাতেই অধিকারের ভাষার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রক্তের ভাষা, যদিও তাঁদের বক্তব্যে দুয়েরই অবকাশ ছিল। ১৯৪২-এ গাঁধীর ডাক— “স্বাধীনতার দাম” হিসেবে বইয়ে দিতে হবে “রক্তের নদী”, আর সুভাষের ১৯৪৩ সালের আহ্বান— এর মধ্যে তফাত ছিল না বেশি। দুই জনই ভারতীয়দের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, শত্রুর রক্তক্ষরণের মাধ্যমে নয়, নিজের রক্তপ্রবাহ বইয়ে দিয়েই অর্জন করতে হবে স্বাধীনতা।
সাম্রাজ্যবাদের শেষ দিনগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ বার বার ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যাগুরুবাদের দিকে চলে যাচ্ছিল সে দিন। ধর্মনিরপেক্ষ সমন্বয়ের ধারণার মধ্যে এক রকমের অধিকারের চেতনা বিধৃত ছিল, বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি সামনে এলেই তা অর্থহীন হয়ে পড়ত। উল্টো দিকে কিন্তু রক্তদান ও ত্যাগের মাধ্যমে যে ভ্রাতৃত্বের ধারণা, তার মধ্যে সেই সংকট ছিল না। সে দিক থেকে দেখলে, সুভাষের সাফল্যলাভের পথ ছিল খানিকটা সহজ, কেননা ভূমিপ্রসূত জাতীয়তাবাদে যে ভাবে ভূমির অধিকারের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত হয়ে পড়ে, ‘ভারত’-ভূমির উল্লেখ সত্ত্বেও সেই প্রশ্ন এই প্রবাসী নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে ওঠার অবকাশ ছিল না। আই এন এ-র সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতায় তাই ভূমিবাদী ও ভূমি-নিরপেক্ষ দুই রকম চরিত্রই লক্ষ করা সম্ভব। ভারতের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ যখন রাক্ষুসে আকার ধারণ করেছে, ঠিক সেই সময়ই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যনির্মাণে সুভাষ আশ্চর্য রকম সাফল্য পেলেন ভারতের বাইরে। বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে আসা প্রবাসী দেশবাসীর মধ্যে সাংস্কৃতিক নৈকট্যের সুরটি তুলে ধরলেন তিনি, এক অভিনব আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার পথ গ্রহণ করলেন। এই স্ট্র্যাটেজিই হয়তো তাঁকে ধর্মীয় সংস্কারের সঙ্গে যুঝতে সাহায্য করল, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি যেমন অবধারিত ভাবে জাতির বিরুদ্ধে ধর্মপরিচয়কে দাঁড় করিয়ে দেয়, সেই ফাঁদ থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দিল।
১৯৪৩ সালের ২৩-২৪ অক্টোবর মধ্যরাতের ঠিক পর, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল স্বাধীন ভারতের সাময়িক সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও শত্রু হিসেবে ঘোষণা করার এই সিদ্ধান্ত স্বভাবতই বিতর্কের জন্ম দিল। ২৩ অক্টোবর ক্যাবিনেট মিটিং-এ এ ডি লোগানাথন প্রশ্ন তুললেন: “আমেরিকাকে কেন টেনে আনছেন স্যর?” তাঁর এই প্রশ্ন সে দিন অনর্থক ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন ভারতের সরাসরি কোনও সংঘর্ষ নেই, তখন অন্তত ভবিষ্যতের জন্য মার্কিনিদের সঙ্গে সুসম্পর্কের আশা কেনই বা এ ভাবে নষ্ট করা। সুভাষ যুক্তি দিলেন, ভারতের মাটিতে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি “রূঢ় বাস্তব”, আর এর জন্যই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আই এন এ-এর যুদ্ধ আরও “অনেক বেশি কঠিন” হয়ে পড়ছে। মার্কিনদের উচিত ছিল, ব্রিটেনকে ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে নিতে এক্ষুনি চাপ দেওয়া। আই এন এ-কে যেহেতু ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ ও মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, নেতাজি চান তাঁর সরকারের যুদ্ধ-ঘোষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামটিও উল্লেখ করতে।৪৪ সে দিন যদি এই জেদটা ছেড়ে দিতেন তিনি, তবে কিন্তু পরের বছরই মার্কিন জনসাধারণের কাছে ভারতের স্বাধীনতার দাবি সমর্থন করার যে অনুরোধ তিনি করবেন, তা আরও অনেক বেশি মান্যতা লাভ করত।
অক্ষশক্তি ও তার সমর্থক— সব মিলিয়ে নয়টি দেশ, যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে জাপান ও জার্মানি— কূটনৈতিক স্বীকৃতি জানাল ভারতের এই সাময়িক সরকারকে। ব্যক্তিগত অভিনন্দনবার্তা এল আয়ার্ল্যান্ড থেকে। সুভাষ অবশ্য তাঁর সার্বভৌমতার এই সব আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির থেকে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন বিষয়টির বৈধতালাভের প্রশ্নে। বৈধতা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করলেন তিনি, একই সঙ্গে ভারতের মাটির উপর দাবি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রবাসী নাগরিকদের আনুগত্যও নিশ্চিত করলেন। প্রবাসী ভারতীয় দেশাত্মবোধী মানুষের কাছে যদি তিনি নির্বাসিত সরকারের স্বীকৃতি লাভ করার পর বৈধতার চিহ্ন হিসেবে ভারতীয় ভূমির প্রশ্নটিও তুললেন। ২৪ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের পাদাং-এ পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় শ্রোতাকে তিনি আবার মনে করিয়ে দিলেন ১৫ অগস্ট যে শপথ নিয়েছিলেন সেটির কথা, মনে করিয়ে দিলেন যে “বছর ফুরোনোর আগেই ভারতের পবিত্র মাটিতে” পা রাখার কথা দিয়েছেন তিনি। “সে ঘোষণা বৃথা ছিল না,” তাঁর দাবি, “কোনও মিথ্যা বড়াই ছিল না।”৪৫ তাঁর সৈন্যরা তখন উত্তরপূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হতে এবং মুক্ত অঞ্চলগুলিতে অসামরিক সরকার গঠন করতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। স্বঘোষিত সেই চূড়ান্ত প্রহর আসার আগেই তিনি অবশ্য বঙ্গোপসাগরের কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করতে পারবেন, ঠিক যেমন শার্ল দ্য’গল-এর “ফ্রি ফ্রেঞ্চ” আটলান্টিকে ফরাসি দ্বীপগুলিতে প্রথম স্বাধীন দেশের ঘোষণা করেছিল, তেমন ভাবে।
তবে ভূমিই তো সার্বভৌম স্বাধীনতার একমাত্র কথা নয়, শেষ কথা নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ তো মানুষ। ভারতের সাময়িক সরকার প্রবাসী ভারতীয়দের জানাল, ইচ্ছা করলে তাঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন। সে দিক দিয়ে “প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট অব ফ্রি ইন্ডিয়া” সে দিন উপনিবেশিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম বারের জন্য এমন নাগরিকত্ব দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এই অঞ্চলে বসবাসকারী ভারতীয়দের বলা হল, একটি নীল কার্ডে ছাপা শপথ-পত্রে স্বাক্ষর করে যেতে, যাতে লেখা ছিল:
আমি, আজাদ হিন্দ্ সঙ্ঘের সদস্য, ঈশ্বরের নামে শপথ নিচ্ছি যে আমি আজাদ হিন্দ্ সাময়িক সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত ও বিশ্বস্ত, এবং আমার দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যে কোনও ত্যাগে প্রস্তুত।
১৯৪৪-এর জুনের মধ্যে কেবল মালয়েই দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার ভারতীয় এই শপথপত্রে স্বাক্ষর করে সাময়িক সরকারের অধীনতা স্বীকার করলেন। অনেক পরে, লাল কেল্লার বিচারের সময়ে এই শপথপত্র আবার সবর্সমক্ষে নিয়ে আসা হয়। সে দিনের যুদ্ধ যে একটি যথাযথ ভাবে সংগঠিত সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ঘোষিত হয়েছিল, তার প্রমাণ হিসেবেই এই শপথপত্রটির প্রয়োজন হয় সে দিন।৪৬
অক্টোবরের শেষ দিকে সিঙ্গাপুর ছেড়ে টোকিয়োর দিকে রওনা হলেন সুভাষ। ১ নভেম্বর সাময়িক সরকারের প্রধান সমান অধিকারের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আলাপ চালালেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোজোর সঙ্গে। লিয়াজঁ এজেন্সি হিকারি কিকান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি মিলিটারি অফিসারদের আচরণ বিষয়ে নালিশ জানালেন তাঁর কাছে। ভারতের দিকে যে অভিযান হতে চলেছে, তাতে আই এন এ-র গোটা ফার্স্ট ডিভিশন-এর জন্যই জায়গা চাইলেন, চাইলেন মালয়ে আরও দুটি ডিভিশনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ভারতে তথ্যসংগ্রহের জন্য যে সব বিশেষ দূত পাঠানো হবে তার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করলেন, জাপানকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সাময়িক সরকারের হাতে তুলে দিতে বললেন, ভারতের যে সমস্ত স্থান মুক্ত হবে, সেইগুলির অধিকারও চাইলেন। স্বীকৃতি চাইলেন যাতে তাঁর সরকার মুদ্রা তৈরি করতে পারে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের পরিত্যক্ত ভূমিসম্পদের উপর স্বত্বাধিকার বজায় রাখতে পারে। সব ক’টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রস্তাব মেনে নিলেন তোজো, প্রতিশ্রুতি দিলেন সামরিক বিষয়গুলি নিয়ে তাঁর কম্যান্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।৪৭
এই বার জাপানে এসে সে দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শিবুসাওয়া শাকুরোর বাড়িতে উঠেছিলেন সুভাষ। উনিশ শতকের শেষে মেইজি জাপানের আর্থিক সংস্কারের রচয়িতাদের অন্যতম ছিলেন এঁর বাবা। ৩ নভেম্বর মেইজি সংবিধান দিবসে মেইজি স্থাপত্য ও টোকিয়োর মিউজিয়াম অব আর্ট দেখে এলেন। তবে এই সফরের প্রধান লক্ষ্য ছিল যাতে সুভাষ ১৯৪৩ সালের ৫-৬ নভেম্বর বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া কনফারেন্স-এ যোগ দিতে পারেন। জাপানের বিদেশ দফতরের মতে সুভাষ “পর্যবেক্ষক হতেই মনস্থ করলেন, কেননা তিনি নিশ্চিত, এই বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া উন্নয়ন বৃত্তে ভারত কখনওই যোগ দেবে না।” আসলে এই বৃত্তটিকে জাপানের অর্থনৈতিক প্রভাববিস্তারের গোপন মঞ্চ বলে মনে করা হত। পর্যবেক্ষকের স্থান গ্রহণ করা সত্ত্বেও সুভাষের “বিশেষ উপস্থিতি” সভার কাজকর্মে বেশ একটা প্রভাব বিস্তার করল।৪৮
দ্বিতীয় দিনে বক্তৃতা দিতে উঠে সুভাষ বললেন, এই সভার আলোচনা শুনতে শুনতে তাঁর সামনে যেন বিশ্ব-ইতিহাসের একটা দিগন্তপ্রসারী ছবি ফুটে উঠছিল:
মনে পড়ছিল নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেসের কথা, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৮৫৬-য় কংগ্রেস অব প্যারিস-এর কথা, বলকান অঞ্চলে প্রথম রুশো-তুর্কি যুদ্ধের পর কংগ্রেস অব বার্লিনের কথা, শেষ যুদ্ধটির পর ভার্সাই পিস কনফারেন্স-এর কথা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দূর প্রাচ্যে অ্যাংলো-আমেরিকান দখল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯২১-এর ওয়াশিংটন কনফারেন্স-এর কথা এবং ১৯২৫ সালে লোকার্নো কনফারেন্স-এ আশ্চর্য কায়দায় জার্মান জাতির হাতটি চিরকালের মতো বেঁধে দেওয়ার কথা। মনে এল অ্যাসেম্বলি অব দ্য লিগ অব নেশনস-এর কথাও— যে লিগ অব নেশনস-এর বারান্দায় কিংবা লবিতে আমি নিজে বহু সময় কাটিয়েছি, ভারতীয় স্বাধীনতার কথা শোনানোর বৃথা চেষ্টায় এক দরজা থেকে অন্য দরজায় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি।
টোকিয়ো কনফারেন্সটি এ সবের থেকে অন্য রকম, তাঁর দাবি। “বিজেতাদের মধ্যে জয়সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য”, কিংবা “দুর্বল শক্তিকে আরও বশংবদ করার ষড়যন্ত্রের জন্য”, কিংবা “কোনও দুর্বল প্রতিবেশীকে ঠকানোর জন্য” এই সভা আহ্বান করা হয়নি। এত দিনে সত্য ও মিথ্যা বিশ্ববাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা ভারতের হয়েছে, সত্যিকারের বিশ্ববাদ “যাতে জাতীয়তাবাদকে হেয় করা হয় না বরং তাকে শিকড় হিসেবে গ্রহণ করা হয়”, তার প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করতে পারছেন তাঁরা। “জাতিসমূহের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ব নির্মাণ” একমাত্র সম্ভব “আঞ্চলিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতি”র উপর ভিত্তি করেই।৪৯ কেবলমাত্র শ্রোতাদের শোনানোর জন্যই এই সব কথা নয়, তিনি নিজে সত্যিই এই তত্ত্বেই বিশ্বাসী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জায়গাতেও তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করতে চান। জাপানিদের উদ্দেশ্য যদিও সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য ছিল না, তবুও যুগ্ম ঘোষণায় এই যে পাঁচটি নীতির কথা বলা হল সে দিন— সুবিচার, সার্বভৌমতা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিকতা, পারস্পরিক অর্থসহায়তা এবং জাতিগত সাম্য— তার জোরে এই কনফারেন্স আরও এক যুগ পরের ১৯৫৫ সালের বান্দুং কনফারেন্স-এর পূবর্সূরি হয়ে থাকল।
জাপানি তথ্য অনুসারে, “গোটা অ্যাসেম্বলি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল” সুভাষের বক্তৃতায়। তাঁর আবেগ, দূরদৃষ্টি, জ্ঞানের বিরাট পরিধি, এবং স্পষ্টত দৃশ্যমান চারিত্রশক্তি সব মিলিয়ে “আশ্চর্য এক পরিবেশ” তৈরি হয়ে উঠল। বক্তৃতা শেষ করতেই তোজো উঠে ভারতের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানালেন, “নিকট ভবিষ্যতে” সুভাষের সাময়িক সরকারের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরের ক’দিনে সুভাষ বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেলেন হিবিয়া পার্কের জনসভায় এবং হিবিয়া হল-এ। সামরিক প্রধান জেনারেল সুগিয়ামাকে বুঝিয়ে বললেন আই এন এ-কে মিত্রপক্ষীয় সৈন্যবাহিনী হিসেবেই সমান মর্যাদা দিতে হবে। আই এন এ-র দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডিভিশন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনাও জানালেন। একটি নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী তৈরির অনুরোধ জানালেন। বললেন, জাপানের কাছ থেকে এই সমস্ত রকম সহায়তা আসলে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করছে ভারত, স্বাধীনতার পর এই ঋণ সে শোধ করে দেবে। আই এন এ-র নতুন যে সৈন্যদের গ্রহণ করা হচ্ছে অসামরিক সমাজ থেকে, তাঁদের মাইনে তিনি নিজেই তাঁর সংগ্রহ-ভাণ্ডার থেকে দিচ্ছেন, প্রবাসী ভারতীয়দের অর্থে যে ভাণ্ডারটি তৈরি হয়েছে। ভারতীয় ছাত্রদের হোস্টেলে গিয়ে সুভাষ তাদের সঙ্গে দেখা করলেন। জাপানি বিবরণে তাঁর সম্পর্কে বলা হল, “যেন মায়ের মতো করে” “তিনি তাদের উপর স্নেহ ঢেলে দিলেন, মাতৃভূমির সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করার কথা বলে অনুপ্রাণিত করলেন।” অনেক উপহার পেয়েছেন ইতিমধ্যে— পেয়েছেন একটি জাপানি তরবারিও— কিন্তু সবই শিবুসাওয়া পরিবারের কাছে রেখে যাবেন, ভারত স্বাধীন হলে আবার এসে নিয়ে যাবেন, এই তাঁর সিদ্ধান্ত। গোটা শিবুসাওয়া পরিবারকে তিনি এর মধ্যে মুগ্ধ করে ফেলেছেন, বিশেষত ছোট ছেলেমেয়েগুলি এবং ভৃত্যকুলের তখন মনে হচ্ছে, “সারা দুনিয়া খুঁজলেও সুভাষের মতো এত ভালবাসা-ময় মানুষ দু’টি মিলবে না।”৫০ সত্যিই সুভাষ জাপানিদের খুবই মোহিত করে ফেলেছিলেন, কাছের, দূরের, সব রকম পরিচিতদের।
১৯৩০-এর দশক থেকেই জাপান ও চিনের সংঘর্ষ নিয়ে সুভাষ বিপন্ন বোধ করে আসছেন। জওহরলাল চিন ঘুরে আসার পর ১৯৪০-এ তিনিও এক বার সেখানে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশরা তার অনুমতি দেয়নি। এ বার জাপান-সমর্থক চিনা নেতা ওয়াং জিং ওয়েই-এর আমন্ত্রণে জাপানের উপকূল থেকে দখলীকৃত নানজিং-এ রওনা হলেন তিনি, ১৯৪৩-এর ১৮ নভেম্বর। আসলে অবশ্য তাঁর ইচ্ছা ছিল চিয়াং কাই-শেক-এর চুংকিং সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার। নানজিং-এ এসে ১৯১১ সালের চিনা রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার পিতৃপুরুষ সান ইয়াত-সেন-এর সমাধিতে ফুল দিলেন। ২০ নভেম্বর নানজিং থেকে প্রচারিত বেতার-বার্তায় সান ইয়াত-সেনকে “এশিয়ার মুক্তি ও এশীয় ঐক্যে আদ্যন্ত বিশ্বাসী” বলে বর্ণনা করলেন। ২১ নভেম্বর, সাংহাই থেকে চুংকিং-এর উদ্দেশে সম্প্রচারিত বার্তায় বললেন, “ভারতীয় জনগণ সত্যিই চিন ও চিনের মানুষের পাশে আছেন।” চুংকিং সরকারকে মনে করিয়ে দিলেন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা হিসেবে তিনিই চিনা মানুষের প্রতি সহানুভূতির স্মারক হিসেবে ভারত থেকে চিন দেশে প্রথম মেডিক্যাল মিশন পাঠিয়েছিলেন। চুংকিং-এর কাছে অনুরোধ জানালেন, ভারতের বিরুদ্ধে সৈন্যদল না পাঠাতে, “ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে না নামতে।” বলতে চাইলেন, ১৯৪৩ তো আর ১৯৩৭ নয়, পূর্ব এশিয়ায় “এখন সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি।” সেই দিন “বেশি দূরে নেই” যখন “সম্মানজনক শান্তি”র পথে এগিয়ে চিনা ভূমি থেকে জাপান তার সেনাদল সরিয়ে নেবে। চিনে জাপানের সাম্প্রতিক বর্বরতার কথা স্মরণে রাখলে তাঁর এই নিকট ভবিষ্যতের চিন-জাপান মৈত্রী-সম্ভাবনা একটু অবাস্তব ছিল সে দিন, সন্দেহ নেই। জাতীয়তাবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বাড়ছে সমানে। আসলে এশিয়ার বিশ্ববাদের প্রতি অবিচল আস্থার ফলেই এমন কথা ভাবছেন সুভাষ। আগের বছরে গাঁধীর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেন সুভাষ: ভারত যদি স্বাধীন হত, চিন ও জাপানে সন্ধিস্থাপনে মহাত্মা গাঁধী নিজেই শান্তির দূত পাঠাতেন। সুভাষ আবিদ হাসানকে রেখে গেলেন চুংকিং সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আরও কিছু কথাবার্তা চালানোর লক্ষ্যে। ইতিমধ্যে অবশ্য রুজভেল্ট ও চার্চিলের মিত্রপক্ষীয় আলোচনা-টেবিলে চিয়াং কাই-শেক-এর জন্যও একটি আসন ধার্য হয়েছে, তাঁর আর জাপানের সহযোগী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীর বার্তা শোনার সময় নেই।৫১
এশীয় ইতিহাসের একটি দুর্ভাগ্যের পর্ব— ১৯২৪-২৫-এ সাংহাই ও নানজিং-এ চিনা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও পুলিশদের লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনা। ১৯২৪ সালে সাংহাই গিয়ে রবীন্দ্রনাথও এর প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিলেন। তার পরেও একই ভাবে ব্রিটিশরা শিখ পুলিশদের কাজে লাগিয়ে এসেছে, চিনা বন্দর শহরগুলিতে তখনও বহুসংখ্যক প্রবাসী ভারতীয়ের বাস। ১৯৪৩-এ শাংহাইয়ে সুভাষ অনেক ভলান্টিয়ার (প্রধানত শিখ) পেয়ে গেলেন তাঁর নিজের বাহিনীর জন্য। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা মুশকিল— সুতরাং চিনেই তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হল। তাঁর পরের লক্ষ্য ফিলিপাইনস্-এর রাজধানী ম্যানিলা— অক্টোবরে এই দেশটি স্বাধীনতা লাভ করেছে। ১৯৪২-এর গোড়ায় মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে মানুয়েল কোয়েজন এবং সের্গিও ওসমেনা ফিলিপাইনস্ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, সম্ভ্রান্ত ফিলিপিনো সমাজ ও প্রাদেশিক শাসকদের অনেকেই জাপানি দখলদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। জাপান-স্বীকৃত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হোসে লরেল সুভাষকে ম্যানিলায় স্বাগত জানালেন। সে দেশের ছোট ভারতীয় সমাজের অনেকেই সুভাষের সভায় এলেন, তাঁর সামরিক সরকারের ফান্ডে অর্থসাহায্য করলেন।৫২
১৯৪৩-এর ২৫ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে ফিরে এসে নেতাজি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভারত-অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাভা দ্বীপের জাকার্তা ও সুরাবায়ার ভারতীয়দের সমর্থন জোগানোর আশায় একটা শেষ সফর করলেন ইন্দোনেশিয়ায়। এই সফরের ফলে জাপান-অধিকৃত এশিয়ার প্রায় সমস্ত জায়গার ভারতীয়দের কাছে তাঁর পৌঁছনোর লক্ষ্যটি পূর্ণ হল। কোরিয়া ও চিনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অভিযানের প্রেক্ষিতে উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় জাপান স্পষ্টতই অত্যাচারী ঔপনিবেশিক শক্তি— তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিষয়টি কিন্তু অনেক জটিল। মালয় ও সিঙ্গাপুরে চিনারা জাপানের যুদ্ধকালীন রূঢ়তার ভুক্তভোগী, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বিরাট অঞ্চলে জাপান একটি অন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকাও পালন করেছে সে দিন, পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপরাজেয়তার কিংবদন্তি ভেঙেচুরে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। মালয় ও বর্মায় ব্রিটিশদের, ইন্দোচিনে ফরাসিদের, ইস্ট ইন্ডিজে ডাচদের, ফিলিপাইনস-এ আমেরিকানদের শিক্ষা দিয়েছে। ইন্দোচিনে অবশ্য সেই সময় ভিশি ফরাসিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলাই বুদ্ধির কাজ বলে মনে করেছে জাপানিরা। শেষ পর্যন্ত অনেকটা দেরিতে, ১৯৪৫ নাগাদ, ভিয়েতনামি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত কিন্তু তত দিনে ভিয়েত মিন-এর কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের নেতৃত্ব লাভ করেছেন। অন্যান্য জায়গায় অবশ্য জাপানিরা মোটের উপর এশীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করার সিদ্ধান্তই নিল। ভারতীয়রা, বর্মীরা, ইন্দোনেশীয়রা এবং কিছু মালয় ও ফিলিপিনো তাদের নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জাপানের এই পাশ্চাত্য-বিরোধী অভিযানের সুযোগ কাজে লাগাল। ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ জেল থেকে বহু বছরের বন্দিত্ব থেকে তারা মুক্তি দিল মহম্মদ সুকার্নো ও মহম্মদ হাট্টাকে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে তাঁরা জাপানি সহায়তা নিয়ে নিজেদের অসামরিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করে তুললেন, সামরিক বাহিনী নির্মাণে মন দিলেন। যদিও ১৯৪৫-এর অগস্টের আগে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা এল না, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কারণেই কিন্তু ডাচরা সে দিন ইন্দোনেশিয়া পুনর্দখল করতে অপারগ হল, কিংবা বর্মায় ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ব্যর্থ হল। জাপান চিনে এবং অন্যত্র যা-ই করে থাকুক না কেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে সে দিন জাপানই পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সবচেয়ে উপযুক্ত দাওয়াই, এই কথাটিই সে দিন সুভাষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
এই সমস্ত জায়গায় যে সব ভারতীয়দের বাস, সুভাষের সাময়িক সরকার তাদের সকলকেই এক নিরাপত্তার আচ্ছাদনে নিয়ে আসার চেষ্টায় রত। জাপান আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার দিয়ে দিতে ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তত একটু অংশে বৈধ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে তারা, যদিও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ জাপানি সামরিক কর্তারা মোটেও ছাড়েননি। এই বছরের মধ্যেই ভারতের মাটিতে পা দেওয়ার দুঃসাহসী ঘোষণা মনে করে কথা রাখার জন্যই ২৯ ডিসেম্বর তিন দিনের জন্য পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছে গেলেন সুভাষ। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই এ ক্ষেত্রেও তাঁর সফরের প্রতীকী গুরুত্ব দাঁড়াল বিরাট। আন্দামান দ্বীপের কুখ্যাত সেলুলার জেলে ভারতের বহু বরেণ্য বিপ্লবী বন্দি এবং নির্বাসিত থেকেছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন, ফাঁসি-তে প্রাণ দিয়েছেন। সেই সব বিপ্লবীর উদ্দেশে প্রণাম জানালেন সুভাষ, সেলুলার জেলের গেট খুলে দেওয়ার সঙ্গে বাস্তিলের মুক্তির তুলনা করলেন। পোর্ট ব্লেয়ারের জিমখানা মাঠে ভারতের তেরঙা পতাকা উড়ালেন তিনি, সম্মেলক কণ্ঠে গীত হল জাতীয় সংগীত। চলে আসার আগে আন্দামান দ্বীপের নাম দিলেন শহিদ দ্বীপ, নিকোবরের নাম— স্বরাজ দ্বীপ।৫৩ ক’দিন পর ব্যাঙ্কক যাওয়ার পথে এ ডি লোগানাথনকে এই দ্বীপপুঞ্জের চিফ কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করে গেলেন। হিউ টোয়ে-র মতে তাইল্যান্ডের মানুষ “সুভাষকে উষ্ণ, সহৃদয়, আতিথেয়তাপূর্ণ অভ্যর্থনা দিলেন— এই মানুষটিই যে ভারতের দিকে তাঁর অপ্রতিরোধ্য অভিযানে রওনা হচ্ছেন ক’ দিনের মধ্যে, সে কথা তাঁরা ভাল ভাবেই জানেন।”৫৪
এ দিকে ১৯৪৩ শেষ হওয়ার আগেই নেতাজির গোপন দূতেরা পৌঁছে গিয়েছেন কলকাতায়। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরই বাংলার সঙ্গে অয়্যারলেস সূত্রে যোগ রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন সুভাষ। ভারতে জাপানিদের পাঠানো গুপ্তচররা খুব একটা সাফল্য পায়নি। এ বার সুভাষই স্থির করলেন পেনাং ও রেঙ্গুনের গোয়েন্দা বাহিনীর দায়িত্ব নেবেন তিনি নিজে। আজাদ স্কুল নামে এর পরিচিতি হল, দায়িত্ব দিলেন এন জি স্বামীকে। মার্চে চার জন সুশিক্ষিত গোয়েন্দাকর্মী ভগওয়ান লু, হরবংশ লাল, কানওয়াল সিং এবং কর্তার সিং— ব্লকেড রানার এস এস ওসোর্নো-য় স্বামীর সঙ্গে এসে পৌঁছলেন ইউরোপ থেকে এশিয়া মহাদেশে। ৮ ডিসেম্বর সুভাষ, স্বামী ও হাসান এই চার জনকে পেনাং-এ শিক্ষাপ্রাপ্ত আরও চার জনের সঙ্গে যুক্ত করলেন, এবং এই আট জনকে এস এন চোপরার নেতৃত্বে জাপানি সাবমেরিনে ভারতের দিকে রওনা করিয়ে দিলেন।৫৫
১৯৪৩-এর ২২-২৩ ডিসেম্বর-এর মধ্যেকার রাতে এই দল এসে নামল গুজরাতের কাথিয়াবাড় উপকূলে, হাতে তাদের অস্ত্র, অর্থ ও উন্নত মানের অয়্যারলেস যন্ত্রসম্ভার। চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে তাঁরা যেন বাংলা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, যুক্ত প্রদেশ ও বম্বের দিকে যাত্রা করেন, এই ছিল নির্দেশ। ডিসেম্বরের শেষে ভগওয়ান লু ‘টি কে রাও’ ছদ্মনামে কলকাতায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে সুভাষের ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার বসুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে কিছু সময় জেলে বন্দি থাকার পর শিশিরকে গৃহবন্দি রাখা হয়, কেবল মেডিকেল কলেজে ক্লাস করতে যাওয়ার অনুমতি ছিল তাঁর। পরিবারে তখন নেমে এসেছে শোকের ছায়া: প্রভাবতী দেবী, বাড়ির মাতৃরূপিণী কর্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। বাংলায় লেখা সুভাষের একটি চিঠি শিশিরের হাতে ধরিয়ে দিলেন রাও— চিঠিটি লেখা হয়েছে সিঙ্গাপুরের ৩ চ্যান্সারি লেন-এর ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ-এর লেটারহেড-এ, তারিখ রয়েছে “শ্রীশ্রী কালীপূজা”, ২৯ অক্টোবর ১৯৪৩। শরৎ আর শিশিরকে সুভাষ বলে রেখেছিলেন, বাংলায় তাঁর চিঠি মানেই সত্যি তাঁরই লেখা চিঠি, ইংরেজি চিঠি কিন্তু ব্রিটিশদের বিভ্রান্ত করতে জালও হতে পারে। শিশির ও তাঁর মা দু’জনেই সুভাষের হাতের লেখা চিনতে পারলেন। বাংলার যে সব আন্ডারগ্রাউন্ড ভলান্টিয়াররা তখনও কোনওক্রমে জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে রাও-এর পরিচয় করিয়ে দিলেন শিশির।৫৬
১৯৪৪-এর জানুয়ারি কলকাতা এবং বর্মার মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসুর রেডিয়ো-সংযোগ সফল ভাবে স্থাপিত হল। প্রথম ক’দিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে ভেসে এল একটি মূল্যবান বেতার বার্তা— কোনও গুরুতর সামরিক তথ্য নেই তাতে, আছে কেবল প্রভাবতী দেবীর মৃত্যুসংবাদ। সেই সন্ধেয় দেবনাথ দাস সুভাষকে বলছিলেন “আপনাকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে”। “না, আমি ক্লান্ত নই,” সুভাষের উত্তর, “আজ খবর পেয়েছি আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।”৫৭
১৯৪৪-এর ৭ জানুয়ারি সাময়িক সরকারের পরবর্তী হেডকোয়ার্টার্স সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনে এগিয়ে আনা হল। আই এন এ-র ফার্স্ট ডিভিশনের প্রথম গেরিলা বাহিনী, সুভাষ ব্রিগেড, ১৯৪৩-এর নভেম্বরেই বর্মায় পৌঁছে গিয়েছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ভারতে আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা মঞ্জুর করে টোকিয়ো এ বার ইম্ফল অভিযানের অর্ডার পাঠিয়ে দিল উত্তর বর্মার জাপানি বাহিনীর কম্যান্ডার জেনারেল মুতাগুচি রেনিয়ার কাছে। তবে জাপানি ও ভারতীয়দের স্ট্র্যাটেজির মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট পার্থক্য। জাপানের কাছে, এই অভিযানের লক্ষ্য বর্মা পুনরধিকার করা থেকে ব্রিটিশদের নিরত করা। উল্টো দিকে আই এন এ চায়, এই অভিযানের ফল হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বত্র অসামরিক বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করুক। ইম্ফল ও কোহিমা দখলের ফলে অসমের বাকি অংশে এবং বাংলায় প্রবেশের রাস্তা প্রশস্ত হবে, নায়কোচিত সংবর্ধনায় তাঁদের বরণ করা হবে। “চূড়ান্ত সাফল্যে”র জন্য দরকার “দেশের ভেতরের সক্রিয়তার সঙ্গে দেশের বাইরের সক্রিয়তার যথার্থ সংযোগ”, ১৯৪৪-এর ৮ জানুয়ারি বললেন সুভাষ।৫৮
নেতাজি পৌঁছনোর পর আই এন এ-র তিনটি নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে গোয়েন্দা বাহিনী এবং ফিল্ড প্রোপাগ্যান্ডা বাহিনীকে তিনটি দলে ঢেলে সাজানো হল: শত্রুপক্ষের পিছন থেকে পথ তৈরি করে তাকে ভেদ করার চেষ্টা করবে বাহাদুর দল, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যদের আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে গোয়েন্দা দল (Intelligence Group), এবং ভারতীয় বন্দিরা আই এন এ-তে অংশ নেওয়ার আগে তাদের শেখানো-পড়ানোর কাজটা করবে মজবুতি দল (Reinforcement Group)। ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ইউনিট-প্রতি আড়াইশো সৈন্যের চারটি ইউনিটকে প্রশিক্ষণের জন্য আরাকান ও ইম্ফল অভিযানে অংশগ্রহণকারী জাপানি ডিভিশনের সঙ্গে যুক্ত করা হল। ফার্স্ট ডিভিশনের সুভাষ ব্রিগেডকে কিন্তু একটা সম্পূর্ণ আলাদা ভূমিকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। জানুয়ারিতে বর্মার জাপানি কম্যান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মাসাকাজু কাওয়াবে এই সুভাষ ব্রিগেডটিকেও ফিল্ড প্রোপাগ্যান্ডা বাহিনীর মতো ছোট ছোট দলে ভেঙে নিয়ে জাপানি বাহিনীতে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে সুভাষ সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনটি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে তৈরি হয় একটি রেজিমেন্ট বা ব্রিগেড— সুভাষ জোর গলায় দাবি জানালেন, যাতে নিয়মিত আই এন এ রেজিমেন্টগুলিকে তাদের আলাদা আলাদা সত্তা বজায় রাখতে দেওয়া হয়, এবং ব্যাটেলিয়নের চেয়েও বেশি ছোট ইউনিটে তাদের যেন না ভাঙা হয়। তাঁর কাছে সামরিক লক্ষ্যের চেয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্যের গুরুত্ব কিছু কম নয়। জাপানিদের তুলনায় ভারতীয়দের সংখ্যা যতই কম হোক না কেন, ভারতে প্রবেশের সময়ে যেন আই এন এ-ই সম্মুখভাগে থাকে, এই তাঁর দাবি। “ভারতের মাটিতে প্রথম রক্তের ফোঁটাটি যখন পড়বে, তা যেন আই এন এ-র কোনও সৈন্যের রক্তই হয়।”৫৯
জানুয়ারি মাসে দাবি ও পাল্টা দাবির এই আদানপ্রদানের পর শেষ পর্যন্ত সুভাষ ব্রিগেড-এর একটি ব্যাটেলিয়নকে কালাদান উপত্যকায় ব্রিটিশ ওয়েস্ট আফ্রিকান ডিভিশন-এ সঙ্গে লড়তে পাঠাতে রাজি হলেন, আর অন্য দুই ব্যাটেলিয়নকে চিন পর্বতের গুরুত্বপূর্ণ পথগুলি পাহারা দিতে পাঠালেন। কিছুটা সাফল্য পাওয়ার পর এদের প্রথম ডিভিশনের অন্যান্য ব্রিগেডের সঙ্গে কোহিমা ও ইম্ফল অভিমুখে পাঠানোর পরিকল্পনা তাঁর। আর ইম্ফল জয়ের পরই দ্বিতীয় ডিভিশনকে পাঠাতে চান তিনি। তৃতীয় ডিভিশনটিকে মালয়ের মাটিতে হাতে রাখা হবে। ইম্ফল-কোহিমা অভিযানের পর যে ভারতীয় বন্দিদের পাওয়া যাবে, তাদের থেকে তিনি আরও পাঁচটি আই এন এ ডিভিশন পাওয়ার আশা করছিলেন।৬০
জাপানি মিলিটারি কম্যান্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই সুভাষ গোটা জানুয়ারি মাস ধরে আই এন এ-র জন্য বর্মা থেকে সদস্য সংগ্রহ করতে লাগলেন, সেখানকার সম্পদশালী ভারতীয়দের কাছ থেকে তাঁর যুদ্ধভাণ্ডারের জন্য অনুদান-সংগ্রহে ব্যস্ত রইলেন। বর্মা থেকে বেশ কিছু বাঙালি মহিলা যোগ দিলেন রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট-এ। লক্ষ্মী স্বামীনাথনও বর্মায় এসেছেন তাঁর মহিলাবাহিনীর কয়েকশো সেনা-সহ, সিঙ্গাপুরের হেডকোয়ার্টারের দায়িত্ব নিয়ে থেকে গিয়েছেন এম সত্যবতী থেবর। বর্মার তামিল ও তেলুগু-ভাষী গোষ্ঠীগুলির থেকে বহু মানুষ এসে ভরিয়ে তুলছেন আই এন এ-র কলেবর। বর্মায় নেতাজির সভাগুলিতে দেখা গেল সাধারণ মানুষের বাঁধভাঙা সমর্থন ও উদ্দীপনা, ঠিক যেমনটা ঘটেছিল মালয়ে। নেতাজি কিন্তু প্রায় পুরো সময়টাই সুভাষ ব্রিগেড-এর প্রশিক্ষণ দেখতে ব্যস্ত রইলেন, নানা কথাবার্তা বলে তাদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করলেন। ১৯৪৪-এর ৩ ফেব্রুয়ারি, গোটা রেজিমেন্ট ভিড় করে এল তাদের সুপ্রিম কম্যান্ডারের বক্তব্য শুনতে, যুদ্ধে দুর্জয়তার আশীর্বাণী দিলেন তিনি। রেঙ্গুন থেকে ট্রেনে তাঁর সৈন্যরা মান্দালয় ও প্রোমের দিকে রওনা হয়ে গেলে সুভাষের দু’ গাল বেয়ে ঝরতে লাগল অশ্রুধারা।
এ দিকে মেজর এল এস মিশ্রের নেতৃত্বে আই এন এ-র একটি বাহাদুর দল ইতিমধ্যেই আরাকান ফ্রন্টে রওনা হয়ে গেছে, ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সেখানে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। মিশ্রের সেনাদলের সাহায্যে মায়ু পাহাড়ের পুব দিকে ৫৫তম জাপানি ডিভিশনের কাছে সপ্তম ব্রিটিশ ডিভিশন ১৫তম ব্রিটিশ সামরিক হেডকোয়ার্টার্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরাজয় বরণ করল। জাপানিরা কিন্তু গোড়ার এতখানি সাফল্যের পুরো ফায়দা তুলতে পারল না। তবে এই ঘটনার একটা সুফল হল— আই এন এ-র ইউনিটটির যুদ্ধখ্যাতি ছড়াতে দেরি হল না। এ দিকে আর একটি খুশির খবর— কাথিয়াবাড় উপকূলে যে গোপন দূতরা নেমেছেন, তাঁরা কলকাতা পৌঁছে অয়্যারলেস বার্তা পাঠাতে শুরু করেছেন। মার্চের শেষে মিশ্রকে সামরিক সম্মান-পুরস্কার দিলেন সুভাষ। অন্যান্য অফিসার ও সেনা যাঁরা তখন ইম্ফলের আরও ভয়ানক যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা হচ্ছেন, তাঁদের কাছে শৌর্যের উদাহরণ হিসেবে তাঁকে তুলে ধরলেন। সে বছরই শেষ দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারালেন মিশ্র, তবে তাঁর সুভাষ ব্রিগেড-এর যে ব্যাটেলিয়নটি আরাকান অঞ্চলে গিয়েছিল, মার্চের মধ্যভাগ থেকে ৮১তম ব্রিটিশ ওয়েস্ট আফ্রিকান ডিভিশনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে তারা আবারও কৃতিত্বের পরিচয় দিল। কায়ুকটাও-র ‘বেস’ থেকে মেজর পি এস রাটুরি-র নেৎৃত্বে এই ব্যাটেলিয়ন কালাদান উপত্যকায় পৌঁছে ক্রমে কালাদান, পালেটোয়া, ডালেট্ম্ দখল করে শেষে ইন্দো-বর্মা সীমান্তের ভারতীয় দিকটিতে মাওডক-এ থিতু হয়ে বসল।৬১
আই এন এ-র গাঁধী ব্রিগেড-এর তিনটি ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন ইনায়াত কায়ানি। মালয় থেকে বর্মার দিকে তাঁরা এসে পৌঁছতেই সুভাষ খবর পেলেন পুনায় ব্রিটিশ জেলে মহাত্মার স্ত্রী কস্তুরবার মৃত্যু হয়েছে। রেঙ্গুন থেকে বেতারবার্তায় প্রচারিত হল “ভারতবাসীর মাতৃসমা এই অসাধারণ নারীর” প্রতি সুভাষের হৃদয়স্পর্শী শ্রদ্ধানিবেদন। “মহাত্মা গাঁধী ব্রিটিশকে বলেছিলেন, ভারত ছেড়ে চলে গিয়ে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে ভারতকে বাঁচাতে। ব্রিটিশরা এর উত্তরে যে কোনও সাধারণ অপরাধীর মতো তাঁকেও জেলের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে। তিনি ও তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী জেলেই মৃত্যুবরণ করবেন তবু পরাধীন ভারতের মাটিতে আর পা রাখবেন না।” ভারতীয় সন্তানদের প্রতি তাঁর আহ্বান, মাতা কস্তুরবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সমূলে উত্খাত করো।৬২
১৯৪৪ সালের ৮ মার্চ শুরু হল ইম্ফল আক্রমণ। আই এন এ-র দখলে এল যে সব ভারতীয় অঞ্চল, সুভাষ সেখানকার জন্য বিশদ পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিলেন। সিঙ্গাপুরের রিকনস্ট্রাকশন কলেজ-এ সিভিল সার্ভেন্টদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, যদিও এঁদের কেউই তখনও বর্মায় পৌঁছননি। সুভাষ দ্রুত তাঁর এত দিনের অর্থমন্ত্রী এ সি চ্যাটার্জিকে ডেকে পাঠালেন, এবং ১৬ মার্চে তাঁকে স্বাধীন অঞ্চলগুলির প্রধান প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। তাড়াতাড়ি একটি নগর প্রশাসন গোষ্ঠীও তৈরি করে ফেললেন, নাম দিলেন আজাদ হিন্দ্ দল, ভারতের অভ্যন্তরে শাসনব্যবস্থার ভার দিলেন তাঁদেরই উপর। প্রাথমিক ভাবে সত্তর জন প্রশাসকের এই দল ৮ মার্চ রেঙ্গুন থেকে সীমান্তের দিকে রওনা হল। দুই পর্বে দায়িত্ব পালন করবেন তাঁরা। প্রথম কাজ— জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোটুকু তৈরি করা— উদ্বাস্তুদের ত্রাণ দেওয়া, মুক্তাঞ্চলগুলিতে খাদ্য সরবরাহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং ভারতীয়দের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ। ক্রমে ওই অঞ্চলে যুদ্ধ থেমে গেলে দরকার একটি সাময়িক আঞ্চলিক সরকার তৈরি করা, যে সরকার আজাদ হিন্দ্ সাময়িক সরকারের কাছে রিপোর্ট করতে থাকবে যত দিন না স্বাধীন ভারতের স্থায়ী সরকার তৈরি হয়। সুভাষের ভাষায়, এই পুনর্গঠনের কাজ থেকেই তৈরি হবে “একটি নতুন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা, যার সাহায্যে ভারতের জন্য উন্নততর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।”৬৩
১৮ মার্চ আই এন এ রওনা হল উত্তর-পূর্ব ভারতের ইম্ফল ও কোহিমার দিকে। “চলো দিল্লি” রব তুলে আজাদ হিন্দ্ ফৌজ ইন্দো-বর্মা সীমান্ত পার হল— ভারতের মাটিতে পৌঁছল নেতাজির সশস্ত্র সংগ্রাম। দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে রণসংগীত “কদম কদম বাঢ়ায়ে যা”, সামনে স্বপ্নের লক্ষ্য— এই ভাবেই ক্রমে দিল্লি পৌঁছে এক দিন লাল কেল্লার মাথায় ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে দেবে তারা। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি অবিস্মরণীয় করে রাখল নেতাজির একটি উদাত্ত বার্তা। দেশপ্রেমের আত্মত্যাগ ও অজেয় সংকল্প সেই বার্তায়:
ওই, ওই দূরে, ওই নদী পেরিয়ে, ওই সব জঙ্গল পার হয়ে, ওই পর্বতমালার ওই পারে রয়েছে সেই স্বপ্নের দেশ— যে মাটিতে আমাদের জন্ম— যে মাটিতে আমরা আবার ফিরতে চলেছি। ওই শোনো! ভারতবর্ষ আমাদের ডাকছে— ভারতের রাজধানী দিল্লি ডাকছে— আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ ভারতবাসী ডাকছে। রক্ত রক্তকে ডাকছে। উঠে পড়ো সবাই, হাতে আর সময় নেই। অস্ত্র নাও। ওই, তোমার সামনে সেই পথ, আমাদের পূর্বসূরিরা যে পথ বানিয়ে গিয়েছেন। ওই পথ দিয়ে আমরা চলব। শত্রুপক্ষ ভেদ করে এগিয়ে যাব— আর যদি ঈশ্বর করুণা করেন, তবে শহিদের মৃত্যু বরণ করব। আর আমাদের শেষ নিদ্রায় এই পথকে চুম্বন করে যাব, যে পথ দিয়ে আমাদের সৈন্যবাহিনী এক দিন দিল্লি পৌঁছবে। দিল্লির পথই স্বাধীনতার পথ। চলো দিল্লি!৬৪
ভারতীয় মাটির স্পর্শ পেয়ে আই এন এ সৈন্যরা তখন আবেগে উদ্বেল। ইম্ফল ও কোহিমা কাছে এগিয়ে আসতেই তাদের আনন্দ-উৎসব— এবং পাশাপাশি জাপানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৌহার্দ্যময়তা— দুয়েরই ছবি ধরা রইল জাপানি সাংবাদিকদের বর্ণনায়।
২২ মার্চ ইম্পিরিয়াল ডায়েট-এ তোজোর ঘোষণা: “ভারতের যে অংশের দিকে আজাদ হিন্দ্ ফৌজ চলেছে, তার ভার ফ্রি ইন্ডিয়া প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট-এর হাতেই অর্পণ করা হবে।” টোকিয়োয় সুভাষ কয়েক জন শীর্ষ নেতার সমর্থন লাভ করলেও মধ্যশ্রেণির সামরিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক অত ভাল ছিল না। ২৪ মার্চ রেঙ্গুনে একটি বৈঠকে উভয় পক্ষ আলোচনায় বসল, কী ভাবে যৌথ ভিত্তিতে শ্রম দফতর ও রসদ-সংগ্রহ দফতর চালানো যায়, ভারতের অভ্যন্তরের অঞ্চলগুলির প্রয়োজন মিটানোর চেষ্টা করা যায়। এই সব বোর্ডে কোনও জাপানি চেয়ারম্যান সুভাষ বরদাস্ত করতে রাজি নন। এই পর্বে জাপানি পক্ষের সুভাষকে “বড্ড বেশি জেদি” বলে মনে হতে শুরু করল: আর ভারতীয়দের মনে হল, তাঁদের নেতা যে আত্মবিশ্বাস কিংবা স্পর্ধা নিয়ে জাপানিদের সঙ্গে কথাবার্তা চালালেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। জাপানকে নেতাজি জানিয়ে দিলেন, তাদের ব্যাঙ্ক ভারতের অভ্যন্তরে কাজ করতে পারবে না, আজাদ হিন্দ্ সরকার তার নিজের জাতীয় ব্যাঙ্ক তৈরি করবে। চ্যাটার্জির সঙ্গে তিনি আগামী সরকারি প্রশাসনের প্রতিটি বিষয়ে বিশদ আলোচনা করে নিয়েছেন, কী কী আইন ও হুকুমনামা জারি হবে, সে সবও স্থির করে রেখেছেন, যাঁদের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের দক্ষতা খতিয়ে দেখেছেন। সবচেয়ে দক্ষ প্রশাসকদেরই আঞ্চলিক গভর্নর করা হোক, চাইলেন তিনি। আর চাইলেন, তাঁর সরকারের অধীনে আরও বেশি ভারতীয় অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হোক। জেলা ও গ্রাম স্তরের প্রশাসনের কাঠামোটি স্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত হল, ঠিক হল সরকারের কোন্ কোন্ দফতর কোন্ কাজের জন্য থাকবে।৬৫
৫ এপ্রিল বর্মায় সুভাষ আজাদ হিন্দ্ ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা শুনে অবশ্য বিরক্ত হল জাপানিরা। এ দিকে অর্থভাণ্ডার ক্রমশ বর্ধমান, রেঙ্গুনের ভারতীয় লক্ষপতি আবদুল হাবিব সাহেব তাঁর সব সম্পত্তি দান করে দিলেন— সে কালের হিসেবে প্রায় এক কোটি টাকা। শ্রীমতী বেতাই-ও তা-ই করলেন। সেবক-ই-হিন্দ্ উপাধি দেওয়া হল তাঁদের।৬৬ প্রধানত নেতাজির অসামান্য বাগ্মিতার উপর ভর করেই আজাদ হিন্দ্ ব্যাঙ্ক এ ভাবে মালয় ও বর্মা থেকে প্রায় কুড়ি কোটি টাকা তুলে ফেলল।৬৭ মন্ত্রিসভার একটু অদলবদল দরকার মনে করলেন সুভাষ। চ্যাটার্জিকে মুক্তাঞ্চলগুলির প্রধান প্রশাসক করে দিলেন, এন রাঘবন হলেন অর্থমন্ত্রী। মালয় ও বর্মার বিত্তবান দক্ষিণ ভারতীয় গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে রাঘবন আরও ভাল ভাবে মেশার ক্ষমতা রাখেন, ফলে সরকারের ভাণ্ডারেও ক্রমাগত অর্থপ্রবাহ আসতে থাকল। ইউরোপ থেকে নাম্বিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন, ইন্ডিয়ান লিজিয়নও আই এন এ-র একটি শাখা বলে গণ্য হল। জি আর নাগর এবং হাবিবুর রহমান হলেন সুভাষের সরকারের নতুন সামরিক প্রতিনিধি। আট্টবর ইয়েলাপ্পা ও ইশার সিং উপদেষ্টা থেকে মন্ত্রিত্বে উন্নীত হলেন, রেঙ্গুনের এস এম বশিরকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ে আসা হল। এস সি আলাগাপ্পানকে রসদ-সংগ্রহের মন্ত্রক দেওয়া হল, অভিযান যত এগোবে এর গুরুত্ব ততই বাড়তে থাকবে। ১৯৪৪-এর এপ্রিলের গোড়ার মধ্যে আজাদ হিন্দ্ সরকার মুক্তাঞ্চলে পোস্টাল স্ট্যাম্প বার করল, নোট ছাপাও শুরু হল।৬৮ বাস্তবিক, যুদ্ধনীতি তৈরির থেকেও যুদ্ধ-পরবর্তী ভারতীয় সরকার পুনর্গঠনের পরিকল্পনার দিক দিয়ে সে দিন অনেকটাই বেশি এগিয়ে গিয়েছিলেন নেতাজি।
৭ এপ্রিল ইম্ফল অভিযান চলাকালীন হেডকোয়ার্টারের একটি অতিরিক্ত শাখা আরও উত্তরে সরিয়ে আনলেন সুভাষ, রেঙ্গুন থেকে মান্দালয়ের কাছে একটি ছোট পার্বত্য শহর মেমিয়োতে নিয়ে আসা হল। জাপানি জেনারেল মুতাগুচি সেখানে ছিলেন। জায়গাটা সীমান্তের বেশ কাছে, সুতরাং ঘাঁটি হিসেবে ভাল, এখান থেকে ইম্ফলে দ্রুত অভিযান চালিয়ে প্রশাসনিক ভার গ্রহণ খুবই সম্ভব। আগে আর একটি স্ট্র্যাটেজি-বিষয়ক বৈঠকে নেতাজি মুতাগুচিকে অনুরোধ করেন যাতে ইম্ফল-কোহিমা রাস্তাটি বিযুক্ত করে দেওয়া না হয়, যাতে ব্রিটিশের ফেরার পথটা খোলা থাকে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ইম্ফল থেকে ব্রিটিশরা এক বার পিছন দিকে ফিরতে শুরু করলেই অসম ও বাংলা সমভূমি তাঁর বাহিনীর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এর পরই ব্রিটিশের পরবর্তী প্রতিরোধ— ছোটনাগপুর মালভূমি। তবে এ বছরের শরত্কাল নাগাদ কলকাতায় বিজয়-মিছিল-সহ ঢুকতে পারলে তার পর সেই প্রশ্ন। ইম্ফলের পতনের ফলে এমনকী এও সম্ভব হতে পারে যে, “বাংলা-বিহারে ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে বিরাট আকারে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে”— ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তার চেয়েও অনেক বড় আকারে।৬৯
এ দিকে ভারতের অভ্যন্তরে তখন ব্রিটিশ সরকার কড়া হাতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বিষয়ক সমস্ত খবরাখবর নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। লন্ডনের বেতার-সম্প্রচারে সমানেই সুভাষকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারত অভিমুখে অভিযানের ফলে যেহেতু চিনের সঙ্গে জরুরি সংযোগ-পথটিও তখন আটকে যাওয়ার মুখে, মার্কিন সাংবাদিকজগৎ থেকেও সুভাষ ও তাঁর বাহিনী বিষয়ে নানা প্রকার মন্তব্য শোনা গেল। ১৯৪৪-এর ১১ মার্চ নিউ ইয়র্কের দ্য স্যাটারডে ইভনিং পোস্ট-এ প্রকাশিত হল অ্যালফ্রেড টাইরনয়ের-এর লেখা “ভারতের ভবিষ্যৎ ফুয়েরার”:
জাপানি আনুকূল্যে স্থাপিত সিঙ্গাপুরের “ফ্রি ইন্ডিয়ান” সরকারের প্রধান সুভাষচন্দ্র বসু ক্রমে এশিয়ার যুদ্ধে অক্ষশক্তির সর্ববৃহৎ, সবচেয়ে ভয়ানক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। হিটলারের দালাল ইনি, জাপানিদের হাতের পুতুল। তবে, স্বীকার করতে হবে, অক্ষশক্তির হাতে-তৈরি অন্যান্য পুতুলগুলির তুলনায় অনেক উপরে এঁর স্থান: ইনি এক জন ফুয়েরার, অত্যন্ত ধান্দাবাজ চক্রান্তকারী, নিজেই এক জন বড় মাপের যুদ্ধবাজ। ধুরন্ধর, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, বিলেত-শিক্ষিত, দাম্ভিক, মাত্রাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুভাষ প্রথম জীবনে ছিলেন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী। তার থেকে আজ তাঁর এ ভাবে ফ্যাসিজম-এর প্রবক্তায় রূপান্তরিত হওয়ার পদ্ধতিটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে।
টাইরনয়ের সুভাষকে ফ্যাসিস্ট বলে ধিক্কার দিলেন, সঙ্গে এও বলতে ভুললেন না যে এই ব্যক্তিটি আসলে নাত্সিদের “প্রাচ্য দেশ থেকে অর্জিত সম্পদ”, এবং জনৈক “নর্ডিক (উত্তর ইউরোপীয়) কন্যা”র “অশ্বেতাঙ্গ যোদ্ধা দয়িত”।৭০
দ্য নেশন-এ লিখলেন জন ডবলিউ গার্বার ২২ এপ্রিল, ১৯৪৪-এ। অবশ্য সুভাষের স্ট্র্যাটেজি বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণ তুলনায় ভদ্র। গার্বারের মতে, ১৯৪৩-এর নভেম্বরে সুভাষ ঘোষণা করেন যে তিনি বাংলা ও অসমে তাঁর বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করবেন, এবং সত্যিই যখন তা ঘটবে, চুংকিং থেকে অসম পর্যন্ত নতুন রাস্তার সমস্ত আশা কার্যত ধ্বংস হয়ে যাবে। সুভাষ তাঁর “লক্ষ্য প্রায় পূর্ণ করে ফেলেছেন”, মনে হয়েছিল গার্বারের, এবং সত্যিই পূর্ণ হলে সেটা একটা “বিরাট রাজনৈতিক ও সামরিক জয় হতে চলেছে।” রাষ্ট্রপুঞ্জও তখন সুভাষকে আর অগ্রাহ্য করতে পারছে না, গার্বার বললেন, কেননা তিনি “নিজের কথা কাজে পরিণত করতে শুরু করে দিয়েছেন।”৭১ মিত্রশক্তির কাছে কত বড় বিপদ হয়ে উঠছেন সুভাষ, তার প্রমাণ মিলল ১৭ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিন-এর রিপোর্ট “বিদ্রোহীর প্রতিশোধ”-এ। “চিন্তাশীল মানুষরা আবারও চিন্তায় পড়ে যান, যখন তাঁরা শোনেন যে দেশদ্রোহী শয়তান সুভাষ কিন্তু জাপানের সঙ্গে ইম্ফলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।” ব্রিটিশ সেন্সরশিপের কঠিন বাধা ভেদ করে সুভাষের বাহিনী বিষয়ে গুজব রটতে শুরু করেছে— টাইম-এর মন্তব্য, তিন হাজার থেকে ত্রিশ হাজার সৈন্যের নানা ধরনের বাহিনী তাঁর সঙ্গে। তবে, এই প্রবন্ধের সবচেয়ে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মন্তব্যটি অন্যত্র: বাহিনীর আকারের থেকেও বেশি গুরুতর “বিস্ফোরক তথ্য: এক জন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র ভারতীয় আজ ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁর দেশবাসীকে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জেগে উঠতে আহ্বান জানাচ্ছেন।”৭২
এই সময়ে সুভাষ নিজে কী বলছেন? বলছেন, “সীমান্তে ঠিকঠাক” এগোচ্ছে ঘটনাবলি, “সীমান্ত পেরোনোর আগে” সকলের মনের জোরও তুঙ্গে— ১৬ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী কৈলাসম্-কে এ কথা লিখলেন তিনি। এক বার সীমান্ত পেরোনোর পর অবশ্য কৈলাসম্-এর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে, জানেন না তিনি। আই এন এ সৈন্যদের সঙ্গে সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুনের রিকনস্ট্রাকশন ডিপার্টমেন্ট-এর লোকরাও এগিয়ে গিয়েছে। “আবার আমরা স্বাধীন ভারতে পৌঁছে পরস্পরকে দেখতে পাব,” দীপ্ত আশা সুভাষের কথায়।৭৩
কিন্তু নেতাজির পছন্দের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী না চলে মুতাগুচি ইম্ফল শহরটিকে চার দিক থেকে আবদ্ধ করে দিতে চাইলেন। ইম্ফল-কোহিমা পথটি বিযুক্ত করে দিলেন, ডিমাপুর বা লেডো-র দিকে ব্রিটিশ পশ্চাদপসরণের কোনও সুযোগই রইল না। মুতাগুচি নিজেকে বোঝালেন, বড় মাছ উঠেছে জালে। সুভাষ এ দিকে উপায়ান্তর না দেখে স্থির করলেন বতর্মান পরিস্থিতি থেকেই যথাসম্ভব ফায়দা তুলতে হবে, এবং সে জন্য ইম্ফলে যথাসম্ভব বেশি-সংখ্যক ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা সংগ্রহ করে, যুদ্ধরসদ জোগাড় করে তাঁকে জাপানিদের তুলনায় নিজের বাহিনীর শক্তি বাড়াতে হবে। এপ্রিল মাসে জাপানি বাহিনী এবং আই এন এ যুগ্ম ভাবে কোহিমা ও ইম্ফল দখলের একটা মোক্ষম সুযোগের কাছাকাছি এসে গেলেন। জাপানিদের আশা, ২৯ এপ্রিল তাদের সম্রাট হিরোহিতোকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে ইম্ফলের পতনের সংবাদটি দিতে পারবে তারা। শওকত আলি মালিকের নেতৃত্বে আই এন এ-র বাহাদুর দল বিষেণপুর অঞ্চলে অসাধারণ যুদ্ধ করল সেই সময়ে। এই বিশেষ দক্ষ ও নিবেদিত অফিসারটির প্রতি সুভাষের প্রচুর আস্থা, যিনি আবার মাঝেসাঝে মদ্যপানেও তাঁর বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। নেতাজির তাঁর প্রতি এত আস্থার প্রতি সুবিচার করতে পারলেন মালিক, ইম্ফলের কয়েক মাইল দূরে মোইরাং-এ উড়াতে পারলেন ভারতের তেরঙা পতাকা।৭৪
এত দূরের অভিযানে, এত দুর্গম ও বিপজ্জনক অঞ্চলেও যথাসম্ভব কম জিনিসপত্র নিয়ে যুদ্ধে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে মস্ত ঝুঁকির কাজ করে ফেলেছিল জাপানিরা। তাদের তাই একমাত্র লক্ষ্য তখন যথাসম্ভব দ্রুত যুদ্ধ শেষ করা। যে পাহাড় পেরিয়ে সুভাষ তাঁর স্বপ্নের দেশ দেখতে পাচ্ছেন, তার ভুল দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকে যাতে জাপানি সেনা ও আই এন এ-কে আটকে থাকতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। রেঙ্গুন ও মান্দালয়ের সঙ্গে ফ্রন্টের সংযোগকারী রাস্তাটি একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়, সুতরাং ইম্ফল ও কোহিমায় ঢুকলেই “চার্চিল রেশন” বাজেয়াপ্ত করা যাবে, এই আশায় রয়েছে জাপানিরা। ইম্ফল ও কোহিমার যুদ্ধক্ষেত্রে জাপানি সেনাবাহিনীর ৩১, ৩৩ ও ১৫ তম ডিভিশন এবং বারো হাজার আই এন এ সেনা (যার মধ্যে চার হাজার সেনাই নতুন নিযুক্ত) এসে দাঁড়াল ব্রিটিশ, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ভারতীয়, ব্রিটিশ ওয়েস্ট আফ্রিকান এবং মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সামনে। চার ধারের পালানোর সমস্ত রাস্তা আটকানো, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ইম্ফল যুদ্ধে লড়ে গেল ব্রিটিশরা। পুরো সময়টি জুড়ে— সাড়ে তিন মাস— মার্কিন বিমানে খাদ্য-অস্ত্র-ইত্যাদি সামগ্রী আসতে থাকল তাদের জন্য। উত্তর-পূর্ব ভারত ও বর্মায় মিত্রশক্তি বনাম জাপানিদের বিমানবাহিনীর অনুপাত ১০-১। প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে নিজেদের একটু বেশি রকম ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে যুদ্ধের এই ফ্রন্টে যথেষ্ট বিমান-আবরণ দিতে পারল না জাপানিরা, কিংবা আই এন এ বাহিনী বা নিজেদের জন্য যথেষ্ট সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারল না। গভীর হতাশার সঙ্গে মুতাগুচি দ্রুত বুঝে গেলেন, যে রাঘব বোয়াল তিনি জালে উঠিয়ে ফেলেছেন বলে ভাবছিলেন, সেটি আসলে কুমির বই কিছু নয়!৭৫
আই এন এ-র ফার্স্ট ডিভিশনের কম্যান্ডার মহম্মদ জামান কিয়ানি ১৭ এপ্রিল ইম্ফলের ৩৫ মাইল পূর্বে চামোল-এ ‘বেস’ তৈরি করেছিলেন। এপ্রিলের শেষে কোহিমা ও ইম্ফলের লড়াইয়ে যোগ দিতে চিন পাহাড়-অঞ্চলে অবস্থানরত ‘সুভাষ ব্রিগেডে’র আরও দুটি ব্যাটেলিয়ন চেয়ে পাঠালেন কিয়ানি। হাকা-ফালাম ফ্রন্টে এই রেজিমেন্ট আগে লড়ে এসেছে, এই বাহিনীর এক তরুণ মেজর মেহবুব আহমেদ-এর বেশ কৃতিত্বের কথাও শোনা গিয়েছে। কম্যান্ডার শাহনওয়াজ খান এখন এই ব্রিগেড-এর মূল অংশটিকে খারাসম ও কোহিমা যাওয়ার পথে উখরুল-এর দিকে চালনা করে নিয়ে গেলেন। দুপুরের মধ্যে সুভাষ ব্রিগেড কোহিমার পাহাড়ের মাথায় ভারতের পতাকা উড়িয়ে দিল ঠিকই, কিন্তু কোহিমা পুরোপুরি জিতে নেওয়ার সময় ততক্ষণে পেরিয়ে গিয়েছে। জাপানিরা যদি কোহিমার পাশ দিয়ে ডিমাপুরের রেলরাস্তার দিকে যেত, ব্যাপারটা অন্য রকম হলেও হতে পারত। এক বার মুতাগুচি তেমন একটা নির্দেশ পাঠিয়েছিলেনও বটে, কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন কাওয়াবে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। পরে নিজের স্মৃতিকথায় জেনারেল উইলিয়াম স্লিম কোহিমা অঞ্চলের জাপানি কম্যান্ডার জেনারেল কোতোকু সাতোকে ধন্যবাদ জানান এই পথটি না ধরার জন্য— ধরলে কিন্তু সে দিন ইম্ফলের ব্রিটিশ বাহিনীর বিপর্যয় অনিবার্য ছিল। কোহিমার চারপাশে যে উপজাতীয় নাগাদের বাস, আই এন এ-র প্রতি তাঁরা বেশ সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন— জানান শাহনওয়াজ খান। ব্রিটিশ বা জাপানি, কারও শাসনই তাঁরা মানতে রাজি নন। “আমরা কেবল চাই আমাদের নিজেদের রাজা সুভাষচন্দ্র বসু আসুন এখানে,” শাহনওয়াজকে বলেন তাঁরা। ইম্ফলের মনিপুরীরাও আই এন এ-র সাহায্যে আসেন, তাঁদের কেউ কেউ আবার আই এন এ-র সঙ্গে বর্মা ফিরেও যান।৭৬
ফার্স্ট ডিভিশনের সেকেন্ড রেজিমেন্ট, ইনায়ত ইয়ান কিয়ানি পরিচালিত ‘গাঁধী ব্রিগেড’ ২৮ এপ্রিল খানজোল গ্রামে নিজেদের অবস্থান নেয়। ২ মে, এই রেজিমেন্ট থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে প্রায় তিনশো সৈন্য পালেল-এ ব্রিটিশ বিমান-অবতরণ অঞ্চলের উপর দুঃসাহসী হানা হানেন। মেজর-জেনারেল ইয়ামামোতোর অধীনে জাপানি বাহিনী তাদের উপদেশ দিল— সব রকম ভারী মালপত্র, এমনকী মেশিনগান, গ্রেনেড, সবই কালেওয়াতে রেখে যেতে। বলা হল, প্রতিটি সৈন্যের সঙ্গে থাকবে কেবল একটি রাইফেল, পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি, একটি কম্বল। বাকি সব কিছু ইম্ফলেই পাওয়া যাবে, ইম্ফলের পতন তো কেবল সময়ের অপেক্ষা। ফল হল এই— প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব শেষ পর্যন্ত পরের মাসে এই গাঁধী ব্রিগেড-এর কাছে কালান্তক হয়ে ওঠে। গুলজারা সিংহের নেতৃত্বে ফার্স্ট ডিভিশনের থার্ড রেজিমেন্ট ‘আজাদ ব্রিগেড’ মে-র মাঝামাঝি বর্মা-ভারত সীমান্তে তামু-মোরে অঞ্চলে পৌঁছয়, মোরে-র উত্তরে নারম নামে এক জায়গায় তাদের ‘বেস’ তৈরি করে। তামু-মোরে-পালেল-ইম্ফল রাস্তা জুড়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলে গোটা মে মাস, পাহাড় এবং গ্রাম বার-বার দুই পক্ষের মধ্যে দখল-পুনর্দখল চলে। জাপানি বাহিনীর বাঁ দিকে ‘গাঁধী ব্রিগেড’, ডান দিকে ‘আজাদ ব্রিগেড’ তাল মিলিয়ে যুদ্ধ করে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বাধিক রক্তাক্ত লড়াই-ক্ষেত্রগুলির অন্যতম এই অঞ্চল— কয়েক দশক পর এখানকার বাসিন্দাদের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করবে ভূতের গল্পকাহিনি: রক্তাক্ত অতীত ইতিহাসের স্মৃতি।৭৭
সে বছর বর্ষা এল তাড়াতাড়ি, মে-র তৃতীয় সপ্তাহের শেষে। যুদ্ধের ঠিকঠাক খবর পেতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে ২১ মে সুভাষ মেমিয়ো থেকে রেঙ্গুন ফিরে গেলেন। ইম্ফলের পতন হলে নিজের ছোট বিমান ‘আজাদ হিন্দ্’-এ চড়ে তিনি দ্রুত রেঙ্গুন থেকে সেখানে যেতে পারবেন, সে কথাও মাথায় ছিল। এর মধ্যেই এল এম জে কায়ানি ও শাহনওয়াজ খানের বার্তা— ফ্রন্টে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নিদারুণ অভাব, যাতায়াতেরও কোনও বিকল্প পথ নেই। আই এন এ সৈন্যরা ম্যালেরিয়ায় মারা যাচ্ছেন, ওষুধপত্রেরও ব্যবস্থা নেই। রেঙ্গুনে চট করে ‘সাপ্লাই বোর্ড’ তৈরি করে ফেললেন সুভাষ, নিজের সরবরাহ মন্ত্রী আলাগাপানকে বললেন আই এন এ-র জন্য মান্দালয় থেকে স্থানীয় জিনিসপত্র কিনতে। আলাগাপান, চ্যাটার্জি এবং এ এম সহায়কে তামু পাঠিয়ে দিলেন আই এন এ-র জন্য যা যা সম্ভব কিনে ফেলতে, আর ঠিক কী কী ধরনের বিপদ ঘটছে তার একটা তালিকা তৈরি করতে। রেঙ্গুনে তখনও প্রত্যয়ের মাত্রা অনেকটাই উঁচুতে, ২৯ মে সুভাষ একটি জনসভা করলেন। বেশ সফল হল সেই সভা, উৎসাহী ভারতীয়রা প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী তুলে দিল তাঁর যুদ্ধব্যয় ভাণ্ডারে।৭৮
অঝোর বৃষ্টিধারায় ভেসে যাচ্ছে চতুর্দিক, ইন্দো-বর্মা সীমান্তে সমস্ত রাস্তা তখন সবুজ পঙ্কের নদীতে পরিণত। মে-র ভয়াবহ সংঘর্ষের পর জুন মাসে দুই পক্ষই উদ্বিগ্ন ভাবে নিজের নিজের জমি সামলাতে ব্যস্ত, মুখোমুখি হলেই লড়াই বাধছে। সিঙ্গাপুরে হেডকোয়ার্টারে উড়ে গেলেন নেতাজি। তিনি আসার ফলে আরও অনেক অর্থসহায়তা জোগাড় হল মালয়ে। উত্তর মালয় ক্যাম্পে আই এন এ-র সেকেন্ড ডিভিশন বাহিনীকে ঘুরে দেখে এলেন, বুঝে নিলেন জুলাই-অগস্টে তাদের সামনে এগিয়ে যেতে কোনও অসুবিধে রয়েছে কি না। জোহোরে থার্ড ডিভিশন দেখে আসতেও বাকি রাখলেন না। ফেব্রুয়ারি থেকে রেঙ্গুন ও পেনাং-এর গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের মধ্যে জাপানি হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে পেরেছেন, প্রথম থেকেই সেটা তাঁর অপছন্দ ছিল। পেনাং-এ গোয়েন্দা প্রধান এন জি স্বামী তাঁকে মে মাসে সমুদ্রপথে ভারতে পাঠানো গুপ্তচর-দলটি বিষয়ে খবরাখবর দিলেন। এ বার সুভাষ স্থলপথেও ভারতে গুপ্তচর পাঠানোর কথা ভাবতে পারছেন, ইম্ফলের শত্রুদলের পিছন দিয়েই হয়তো তা এ বার সম্ভব। রেঙ্গুনে ফিরতি পথে স্বামীও সঙ্গে এলেন। তখন জুনের শেষ।৭৯
রেঙ্গুনে তখনও ইম্ফল অভিযান সম্পর্কে সুখবরেরই চালাচালি। আক্রমণ হানার পরিমাণ হয়তো বন্ধ, কিংবা আপাতত বিলম্বিত, কিন্তু আগামী ধ্বংসের কোনও আভাসই তখনও পর্যন্ত নেই। এ এম সহায় সুভাষকে প্রশাসনিক সংকট নিয়ে একটি রিপোর্ট দেখালেন। তবে সব সংকটই তাঁদের মনে হল সমাধানের যোগ্য। জয়ের প্রত্যাশা নিয়েই পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু হল, উত্তর-পূর্ব ভারত এ বার তা হলে আজাদ হিন্দ্ সরকারের অধীন হতে চলেছে। ৪ জুলাইয়েও চার দিকে বেশ একটা আশাময়তা, নেতাজি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম বর্ষপূর্তির উৎসবও পালিত হল। তারই মধ্যে ফার্স্ট ডিভিশনে কিয়ানির নেতৃত্ব বিষয়ে জাপানিদের উচ্চ প্রশংসা, গাঁধী ব্রিগেড-এর জেদ দেখেও তারা বিশেষ ভাবে মুগ্ধ।৮০
মহাত্মার নিজের স্বাস্থ্য সেই সময় বেশ দুর্বল। ভারতে জেল থেকে সবে ছাড়া পেয়েছেন। ১৯৪৪-এ ৬ জুলাই, গাঁধীর প্রতি দীর্ঘ বেতার-বার্তায় সুভাষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তাঁর অভিযান-পরিকল্পনার বিশদ ব্যাখ্যা দিলেন। আরও এক বার ভারত ছাড়ো-র সাহসী প্রস্তাবের জন্য মহাত্মার বহু প্রশংসা করলেন। সর্বশক্তিমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যই যদি ভিক্ষাপাত্র হাতে বিদেশি শক্তির সহায়তা প্রার্থনা করে বেড়াতে পারে, তবে পদানত নিরস্ত্র জাতির পক্ষে বিদেশ থেকে ঋণগ্রহণের তুল্য সহায়তা প্রার্থনা করার মধ্যে কী-ই বা অসুবিধা। সমস্ত জীবন যিনি জাতীয় আত্মসম্মান ও মর্যাদার কথা দৃঢ় ভাবে বলে এসেছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনও বিদেশি শক্তির পায়ের কাছে গিয়ে বসবেন না। তিনি যা কিছু করেছেন এ যাবৎ কাল “ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যটির জন্যই” করেছেন। যে সাময়িক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, ভারত স্বাধীন হলেই তার কাজ শেষ হয়ে যাবে। ভারতীয় জনসাধারণ তখন নিজের পছন্দমতো সরকার তৈরি করে নেবেন, স্থির করবেন কে সেই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা নিজেদের ভারতীয় জনসাধারণের দাস বলে মনে করেন। নিজেদের ত্যাগ ও যন্ত্রণার পুরস্কার হিসেবে বিদেশি শাসকের কবল থেকে মাতৃভূমির মুক্তি ছাড়া আর কিছুই তাঁরা চান না। “এক বার দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে আমাদের মধ্যে অনেকেই চান রাজনীতি-ক্ষেত্র থেকে অবসর নিতে। বাকিরা স্বাধীন ভারতে যে কোনও ধরনের কাজ পেলেই সন্তুষ্ট হবেন, যত ছোট মাপের কাজই হোক না কেন। যে মন্ত্র নিয়ে আমরা আজ চলছি, তা হল, স্বাধীন ভারতে মেথর হওয়াও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে উচ্চতম গোত্রের কাজের থেকে অধিক মূল্যবান।”
“আমাদের জয় হবেই”— সুভাষের গভীর প্রত্যয়ের উচ্চারণ। এই জয় বলতে তিনি কিন্তু অক্ষশক্তি বা জাপানের জয় বোঝান নি। “তাঁর জয় মানে ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোর কাজটি সফল হওয়া,” তাঁর বিরোধী এক ইংরেজ ইনটেলিজেন্স অফিসার পরে লিখেছিলেন, “মি. গাঁধী ও ভারতীয় জনসাধারণের লক্ষ্যের সঙ্গে এখানে তাঁর কোনও পার্থক্য নেই।” জাপানিদের কাছ থেকে তিনি চান কেবল খানিকটা সময়— যাতে ব্রিটিশ শক্তি আবার তাদের এশীয় উপনিবেশগুলি পুনরুদ্ধার করতে ফিরে না আসে। রেডিয়ো স্টুডিয়োতে যখন বক্তৃতার শেষ ছত্রটি বলবেন সুভাষ, এস এ আইয়ার গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে দেখছিলেন তাঁকে। “জাতির পিতা!” আরম্ভ করলেন তিনি, “তাঁর গলা ধরে গেল, কম্পিত হল, গভীর ভাবের ছায়া পড়ল মুখে। তার পর গলা পরিষ্কার করে নিলেন তিনি, স্পষ্ট দৃঢ় উচ্চারণে বলে গেলেন, “ভারতের মুক্তির এই পবিত্র যুদ্ধে”— আবার একটু থেমে গেলেন, স্বরটা নামিয়ে নিলেন, বিনীত অনুরোধের সুর ফুটে উঠল তাঁর কণ্ঠে, “আমরা আপনার আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা প্রার্থনা করি।”৮১
১৯৪৪ সালের ১০ জুলাই জাপানিরা সুভাষকে জানাল তাদের সামরিক পরিস্থিতি ভাল নয়, সুতরাং ইম্ফল থেকে সেনা প্রত্যাহার ছাড়া আর কোনও পথ নেই। নেতাজি ও তাঁর সতীর্থরা আবারও বাহাদুর শাহের সমাধিতে মিলিত হলেন ১১ জুলাই, বাদশাহের মৃত্যুদিবসে। এই বিশেষ দিনটিতে তাঁদের সান্ত্বনার জন্য রইল বাহাদুর শাহের একটি শায়েরি— ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর সৈনিকের ধ্বস্ত বিশ্বাসের উদ্দেশে লেখা— আর রইল লর্ড বায়রনের একটি কবিতা “The Giaour”-এর বহু-জ্ঞাত একটি স্তবক, “Freedom’s battle once begun, bequeathed from bleeding sire to son, tho’ baffled oft, is e’er won.”৮২
জুলাই-এর শুরু। খাবার নেই, ওষুধ নেই, আই এন এ-র ফার্স্ট ডিভিশনের রেজিমেন্টগুলির অবস্থা তখন শোচনীয়। বর্মাবাসী তামিল নাগরিক নাগা সুন্দরম আই এন এ-র ফিল্ড প্রোপাগ্যান্ডা ইউনিটে যোগ দিয়ে ইম্ফলে লড়াই করেছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন, সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আই এন এ-র সৈন্যরা কী ভাবে ঘাস খেয়ে, মশারি দিয়ে নদীর ছোট মাছ ধরে খেয়ে কোনওক্রমে প্রাণ ধারণের চেষ্টা করেন।৮৩ গাঁধী ব্রিগেড ইতিমধ্যে অসমসাহসে স্কটিশ সি-ফোর্থ হাইল্যান্ডার্স-দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও প্রবল পরাজয় স্বীকার করেছে। আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রেজিমেন্ট-এর কম্যান্ডের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী শিখ অফিসার মেজর বি জে এস গারেওয়াল নিজের দিক ছেড়ে ব্রিটিশ বাহিনীতে চলে গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে আই এন এ বাহিনীর অবস্থান-সংক্রান্ত গোপন তথ্যসমূহও চলে গিয়েছে ব্রিটিশের হাতে। ফলে এখন ব্রিগেডকে যে কোনও মুহূর্তে ঘিরে ফেলে বিনাশ করে দিতে পারে শত্রুপক্ষ। গারেওয়াল চলে যেতে সুভাষের সাবমেরিন যাত্রার সঙ্গী আবিদ হাসান ইনায়াত কিয়ানির ডেপুটি হলেন। হাসান এরই মধ্যে কোনওক্রমে সব সেনাদের এক জায়গায় এনে প্রতি-আক্রমণ শানাতে পারলেন, খুবই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে গাঁধী ব্রিগেডকে বার করে আনতে সমর্থ হলেন। পরবর্তী কালে হাসান মনে করেন কী ভাবে অন্যান্য শিখ সৈন্যরা শিখ অফিসার গারেওয়ালের এই কৃতঘ্নতায় হতবাক হয়ে পড়েন সে দিন। যুদ্ধ শেষ হলে লাহোরের রাস্তায় আততায়ীর হাতে নিহত হন এই গারেওয়াল।৮৪
ইম্ফলের প্রবল পরাজয়ের পর বর্মাতেও শুরু হল মর্মান্তিক পশ্চাদপসরণের পালা। ১৮ জুলাই মহম্মদ জামান কিয়ানি ফার্স্ট ডিভিশনের সব রেজিমেন্টকে পিছনে সরতে নির্দেশ দিলেন। জাপানের ইম্ফল অভিযান বন্ধের কথা ঘোষণা করা হল ২৬ জুলাই— যে দিন তোজো সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিলেন, সেই একই দিনে। ইন্দো-বর্মা সীমান্তের এই অঞ্চলটির বর্ণনা মেলে ব্রিটিশ কম্যান্ডার উইলিয়াম স্লিম-এর লেখায়, “পৃথিবীর একেবারে জঘন্যতম কয়েকটি স্থান, পৃথিবীর জঘন্যতম সব অসুখের চারণক্ষেত্র, বছরের অর্ধেক সময় ধরে পৃথিবীর জঘন্যতম আবহাওয়া।”৮৫ কোহিমা ও ইম্ফল দখল করতে জাপানি সশস্ত্র বাহিনী এবং আই এন এ পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা এই দুশো মাইল অঞ্চল সাহসে ভর করে এগিয়ে এসেছে। এ বার ফিরতি পথে খাদ্যাভাব এবং অসুস্থতায় বিরাট ক্ষতি স্বীকার করতে হল এই বাহিনীকে, দিল্লিগামী অভিযানের এই বিপর্যয়ে এমনিতেই তারা প্রবল হতাশ্বাস। অগস্টই নিষ্ঠুরতম মাস, দেখা গেল। তবে এও ঠিক, কর্নেল রাজা মহম্মদ আরশাদ এবং জোরা সিংহ নামক এক অসামরিক ব্যক্তির মোটর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি যদি সে দিন অসুস্থ এবং আহত সৈনিকদের কালেওয়া থেকে ইয়েউ অবধি বহন করে আনার সুষ্ঠুতম ব্যবস্থা না করত, বিপদ আরও অনেক গভীর হত। ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরের মধ্যে মান্দালয়ে ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। সুভাষ ব্রিগেড-এর অবশিষ্ট সৈন্যরা বুদালিনে রইলেন, গাঁধী ব্রিগেড রইল মান্দালয়ে, আজাদ ব্রিগেড চৌঙ্গুতে।৮৬
২১ অগস্ট রেঙ্গুন থেকে বেতারসম্প্রচারে নেতাজি সর্বসমক্ষে ইম্ফল অভিযানের ব্যর্থতা স্বীকার করলেন। দ্রুত বর্ষা নামার কারণেই এই বিপর্যয়, তাঁর মতে। তার সঙ্গে পরিবহণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার বিষয়টি তো ছিলই। বর্ষা শুরু না হওয়া পর্যন্ত আরাকান ও হাকায় আই এন এ শত্রুপক্ষকে যথেষ্ট বেগ দিতে পারে, কালাদান, তিডিম, পালেল ও কোহিমার দিকে অগ্রসর হতেও সমর্থ হয়। সেনা ও অফিসারদের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, এ বার তাঁরা পরবর্তী লড়াই-এর জন্য নতুন ভাবে দল সাজিয়ে প্রস্তুত। সেপ্টেম্বরে প্রত্যাগমনকারী বাহিনীর সঙ্গে দেখা করতে তিনি গেলেন ইয়েউ এবং মান্দালয়— হাসপাতালে ভর্তি করতে হল অনেককেই। রানি ঝাঁসি ব্রিগেড-এর মহিলারা নার্সিং-এর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁরা আহতদের শুশ্রূষার কাজে মন দিলেন।৮৭
সৈন্যদের এমন যন্ত্রণাদীর্ণ দশা দেখে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন সুভাষ, যদিও অনেকেই এত কিছুর মধ্যে নির্বিকার ভাব বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আবিদ হাসানের বর্ণনা অনুসারে, নেতাজি যখন মান্দালয়ে ইম্ফল-ফেরত মানুষদের দেখতে গেলেন, “শিখরা দাড়িতে তেল দিলেন, পঞ্জাবি মুসলিম, ডোগরা এবং রাজপুতরা গোঁফ মুচড়ালেন, আমরা বাকিরা যে যতটা পারি নিজেদের তাজা দেখানোর চেষ্টা করলাম।”৮৮ সব অফিসারের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করলেন সুভাষ, জড়িয়ে ধরলেন তাঁদের। আবিদ হাসানের কাছে অনুনয় করে বললেন, পথে যত যন্ত্রণা-গ্লানির মধ্য দিয়ে তাঁরা এসেছেন, সব কিছু পরিষ্কার ভাবে তাঁকে জানাতে। ছোট্ট উত্তর হাসানের— এক জাপানি অফিসার তাঁকে ফ্রন্টে এক বার একটি শব্দবন্ধ বলেছিলেন, সেটিই উদ্ধৃত করে বললেন, পরিস্থিতি “একটু মন্দই”(“slightly not so very good”)। এ সব সত্ত্বেও, ইম্ফলের বিপর্যয়ের পরও, এই মানুষটি, যিনি অসামরিক জীবন থেকে সামরিক দায়িত্ব নিতে এসেছেন, যিনি জার্মানিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এশিয়ায় এত দূরে এসেছেন তাঁর নেতার সঙ্গে, তাঁর আত্মগৌরববোধ তখনও আশ্চর্য রকম প্রবল:
কী অসাধারণ একটি দল তৈরি করতে পেরেছি আমরা। আমাদের দলের মতো তো আরও কত দল আছে আমাদের এই সামগ্রিক সেনাবাহিনীতে। ভেবে গর্বিত লাগে আমার। আজ যেন আরও বিশেষ করে গর্বিত লাগছে এ কথা মনে করে যে আমি এই বাহিনীরই সদস্য। পাঠান, শিখ, গুজরাতি— এক দিকে সামরিক জাতির মর্যাদাময় মানুষেরা, অন্য দিকে সেই সব মানুষ যাঁরা কোনও কালে সামরিক জাতির তকমা না পেয়েও যুদ্ধে শৌর্য দেখাতে এক পা-ও কম যান না। ভারতের সব অঞ্চলের প্রতিনিধি আছেন এখানে, সব ধর্মের প্রতিনিধি, সব জাতির প্রতিনিধি— কেবল বড় সেনাবাহিনীতে নয়, প্রতিটি দলে, প্রতিটি বিভাগে সবাই মিলেমিশে রয়েছেন। প্রতিটি বিভাগই যেন ভারতের ঐক্যের জ্বলন্ত স্বাক্ষর। আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস আছে, পৃথক ভাষা আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক দিয়ে আমরা সকলেই অবিচ্ছেদ্য, নিশ্চিত, সুগ্রথিত সমগ্রের ধারণায় বিশ্বাসী।৮৯
এই পৃথক আঞ্চলিক কিংবা ধর্মীয় সত্তা তাঁদের নেতা বিসর্জন দিতে বলেননি, বরং একটি বৃহত্তর আদর্শের জন্য তা পেরিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নেতাজির শত্রুরাও কিন্তু স্বীকার করেন, সেপ্টেম্বরে তিনি এসে পৌঁছনোমাত্র সেনারা কেমন ভাবে তাঁকে স্বাগত জানালেন। “এদের সকলের কী শ্রদ্ধা, কী অদ্ভুত আন্তরিক আবেগ তাঁর প্রতি, ভক্তি আর ভালবাসায় উদ্বেলিত সকলে।” এক অফিসার যিনি বন্দি হয়েছিলেন, পরে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়। ইম্ফলে এত যন্ত্রণা ভোগ করে কী পেলেন তিনি, এই প্রশ্নের উত্তরে মানুষটির ছোট্ট জবাব: “নেতাজি আমাকে আলিঙ্গন করেছিলেন।”৯০
ইম্ফল ও কোহিমায় ঠিক কী ঘটেছিল, দুই পক্ষের নানা পরস্পরবিরোধী দাবিতে সেটা ঠিকমতো বোঝা বেশ কঠিন। ব্রিটিশ সামরিক স্মৃতিকথাগুলিতে আই এন এ-র ভূমিকা খুবই নগণ্য করে দেখানো হয়, ইম্ফল দখলের সম্ভাবনা মিলিয়ে যাওয়া মাত্র নাকি এই বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে— ইত্যাদি নানা অতিকথন পাওয়া যায়। আবার, আই এন এ সেনাদের নিজেদের বক্তব্যে মেলে প্রবল প্রতিকূলতার সামনে বীরোচিত সংগ্রামের নানা কাহিনি। পরবর্তী কালের ব্রিটিশ স্মৃতিকথার অনেক গর্বিত বর্ণনার সঙ্গে ১৯৪৪-এর ব্রিটিশ গোয়েন্দা তথ্যের কোনও মিল পাওয়া যায় না। এই সব বর্ণনাকারীদের অধিকাংশই হয়তো সে দিন রণক্ষেত্রের আশেপাশেই ছিলেন না।
এই প্রসঙ্গে ১৯৪৪-এর ২ অক্টোবরের তারিখ-চিহ্নিত একটি গোপন ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স সার্ভে-র উল্লেখ করা যায়। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর, এই ছয় মাসের বিবরণ মেলে এতে। জানা যায়, মার্চে বর্মায় আই এন এ-র বারো হাজার সেনা ছিল, তার মধ্যে চার হাজার সেনা ছিল সম্মুখভাগের যুদ্ধক্ষেত্রে। আরও সাত হাজার তখন মালয় থেকে বর্মার পথে, এবং মালয়ে তখন প্রশিক্ষণরত থার্ড ডিভিশন। মণিপুরে প্রবল ক্ষয়ক্ষতি হয় আই এন এ-র, “এই পরাজয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় অসুখবিসুখ, প্রতিকূল পরিবেশ।” “অনেকেই হাল ছেড়ে দেন, তার মধ্যে আই এন এ-র কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ অফিসারও ছিলেন, তবে তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় সৈন্য বন্দি হন। অবশ্য, আরাকানের মতো এই ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনও দলবদ্ধ পলায়নের চেষ্টা দেখা যায়নি। ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় ৭০০ আই এন এ সৈন্য আমাদের হাতে এল। বাকিরা জাপানি বাহিনীর সঙ্গে ফিরে গেল।” সেপ্টেম্বরে, বর্মায় তখনও আই এন এ সৈন্যের সংখ্যা “যথেষ্ট”। মার্চ মাসের পর মালয় থেকে সেনা-আগমন অনেকাংশে বাড়লও বটে, “সংখ্যাটা দাঁড়াল ২০,০০০-এর কাছাকাছি।” “অন্য কোনও কারণ না থাকলেও কেবল সংখ্যার জন্যই নিরাপত্তার দিক দিয়ে আই এন এ একটা বড় সমস্যা।”৯১ তবে এটা ঠিকই, আই এন এ থেকে পলাতক সৈন্যের সংখ্যা বেশ কম। তা ছাড়া, দুই পক্ষ থেকেই একটা “আসা-যাওয়া”র স্রোত চলে সেই সময়। আরাকানে লড়াইয়ের সময়েই ব্রিটিশ পক্ষ থেকে শ’খানেক সৈন্য এসে আই এন এ-তে যোগ দেয়। রেঙ্গুনে নেতাজি তাঁদের “নতুন কমরেড” বলে সাদরে বরণ করে নেন। প্রাথমিক সাফল্য যদি এই ভাবে ধরে রাখা যেত, যদি আই এন এ অসম থেকে বেরিয়ে আসতে পারত, “স্লিম-এর সিপাহীদের মধ্যে পলাতক সৈন্যের সংখ্যা বেড়ে বন্যার মতো বিশাল হয়ে দাঁড়াত, ১৪ নং বাহিনীকে ধ্বংস করার মতো বিশাল। সুভাষ সেটাই আশা করেছিলেন।”৯২ শাহনওয়াজ খান যখন বলেন জাপানিরা তাঁদের ডুবিয়েছেন, “তাঁরা এমন বিশ্বাসঘাতকতা না করলে ইম্ফল অভিযানের ইতিহাস অন্য রকম হত,” হয়তো তিনি একটু বেশিই কঠোর হন তখন। তবে ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরের যে সব ব্রিটিশ মূল্যায়ন মেলে, তাতেও পড়া যায় যে “জাপানি বাহিনীর জন্যই আই এন এ অকৃতকার্য হয়”, এবং লক্ষ্যসাধনে জাপানিদের ব্যর্থতার কারণেই “আই এন এ যে ভাবে চেয়েছিল ঠিক সেই ভূমিকায় তারা অবতীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়।”৯৩
জাপানি ও আই এন এ বাংলায় না ঢুকতে পারায় তাদের পরিকল্পিত স্ট্র্যাটেজি অর্থাৎ বাইরে থেকে আক্রমণ হানার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ উদ্বুদ্ধ করার স্ট্র্যাটেজিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ক্রমে সাবমেরিনে ভারতের দিকে অগ্রসরমাণ বহু গুপ্তচরকেও ধরে ফেলতে সমর্থ হয়। এস এন চোপড়ার সবচেয়ে দক্ষ, সবচেয়ে প্রযুক্তিশালী দলটিরও দুটি দুর্বল দিক ছিল: স্থানীয় গুজরাতি ইসমাইল চান্নিয়া যিনি কাথিয়াবাড়ের স্থানীয় এলাকা ভাল করে চেনেন-জানেন বলেই দলভুক্ত হয়েছিলেন, ১৯৪৪-এর ৩ জানুয়ারি তিনি ব্রিটিশের হাতে ধরা দেন। দলটির পরিকল্পনা ছিল মাসে এক বার বেনারসে মিলিত হওয়া, সুতরাং অন্যদেরও ব্রিটিশ পুলিশ সহজেই পরের কয়েক মাসে ধরে ফেলল, এঁদের পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিল। তিন জনকে সম্ভবত পাল্টা গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত করা হল।৯৪
দ্বিতীয় দুর্বলতার জায়গাটি ছিল— উত্তরপশ্চিম সীমান্ত, যেখানে ভগত রাম সুভাষের থেকে পাওয়া তথ্যসংবাদ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে সরবরাহ করে চলেছেন, আর সেই পথে ব্রিটিশ সরকারের কাছে খবর আসছে। কাবুলে জার্মান মন্ত্রী পিলগার তাঁর একটি সরকারি নোটে লেখেন, নেতাজির পাঠানো গুপ্তচরদের দাবি, খোদ শরৎ বসুর ছেলে শিশির নিজে নেতাজির পাঠানো বার্তা যে খাঁটি তা যাচাই করেছেন। যথারীতি এই তথ্য কমিউনিস্টদের কাছেও পৌঁছল। ইম্ফলের বিপর্যয়ের সময়েই ব্রিটিশ পুলিশ কলকাতায় বিপ্লবী ঘাঁটি ‘রেড’ করে, সেই বিপ্লবীদের সমর্থন ছিল সুভাষের প্রতি। এঁদের এক জন তল্লাশিতে মারা গেলেন। অন্যান্যদের গ্রেফতার করে লাহোর দুর্গে চালান করে বিচার ছাড়াই আটকে রাখা হল। ১৯৪১-এ রাঙাকাকাবাবুকে দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করেছিলেন শিশির, এ বার তাঁর হাতেও ধরিয়ে দেওয়া হল চার্জশিট: “শিশির বোস, তোমাকে জানানো হচ্ছে যে ব্রিটিশ ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকারক কাজে লিপ্ত থাকার দরুন, এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকার সঙ্গে সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু ও জাপানিদের সাহায্যার্থে কাজ করার দরুন তোমাকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।”৯৫ ভাষাটা হযবরল গোছের হলেও অভিযোগটি একেবারে স্পষ্ট, যথার্থ। শিশিরও বিনা বিচারে বন্দি হলেন। জেলের অভ্যন্তরে বিচার করে অত্যন্ত কড়া শাস্তির ব্যবস্থা হল অনেকের জন্য। হোম ডিপার্টমেন্টের রিচার্ড টটেনহ্যাম গুপ্তচর এবং ভারতীয় বিপ্লবীদের জিজ্ঞাসাবাদে নিযুক্ত ছিলেন, ১৯৪৪-৪৫ সালে সব মিলিয়ে সাতটি “শত্রু-দালাল” বিচারের উল্লেখ করেন তিনি, তিনটি দিল্লিতে, তিনটি মাদ্রাজে, একটি বাংলায়। সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসা তেইশ জন গুপ্তচর মৃত্যুদণ্ড পান, তবে তাঁদের দু’জনের ক্ষেত্রে আবার পরবর্তী কালে শাস্তি বদলিয়ে যাবজ্জীবন কারাবাস নির্ধারিত হয়। এমনই এক জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি আমেরিক সিংহ গিল কলকাতায় স্থানান্তরের সময়ে পুলিশ গার্ডের চোখ এড়িয়ে পলায়ন করেন।৯৬
৯ অক্টোবর। সুভাষ তখনও বর্মায় তাঁর সেনাদের শুশ্রূষায় ব্যস্ত। এমন সময়ে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল কুনিয়াকি কোইসো তাঁকে টোকিয়ো আসার আমন্ত্রণ জানালেন। নেতাজি রেঙ্গুনে ফিরে গেলেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি তাঁর শীর্ষ সামরিক নেতৃবর্গের সঙ্গে আই এন এ-র পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে আলোচনায় বসলেন। ১৮ অক্টোবর রেঙ্গুনের চোদ্দো মাইল দূরে মিংগালাডনে আই এন এ-র প্যারেড দেখার সময় একটি অদ্ভুত ঘটনায় প্রায় মারা পড়ছিলেন তিনি। তখন মিত্রশক্তির বিমান-হানা চলছে ওই অঞ্চলে, অকস্মাৎ কতগুলি কম উচ্চতার বিমান ধেয়ে এল তাঁদের দিকে। একটি পাঁচ ফুট উচ্চতার প্ল্যাটফর্মের উপর তখন দাঁড়িয়ে নেতাজি, সামনে চলছে ঝাঁসি রানি ব্রিগেডের কুচকাওয়াজ। “স্যার, এটা ফ্রন্ট নয়, প্লিজ নেমে আসুন,” সকলকে সরিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করতে ব্যস্ত কিয়ানি অনুরোধ করলেন নেতাজিকে। অ্যাক-অ্যাক বিমান থেকে ন্টিার এসে লাগল এক সৈন্যের মাথায়, সঙ্গে সঙ্গে নিহত হলেন তিনি— সুভাষ তখনও যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে, তার থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে। এস এ আইয়ারের বর্ণনায়, “স্যালুটিং বেস” থেকে ধীরে নেমে এলেন সুভাষ, নির্বিকার ভাবে প্যারেড গ্রাউন্ডের এক পাশে সরে গেলেন, যতক্ষণ অ্যাক-অ্যাক বন্দুক এবং সৈন্যদের দ্বৈরথ চলল, একটি গাছের নীচে বসে রইলেন তিনি।৯৭ সে দিনই খানিক পরে বেতার-বার্তায় সুভাষ বর্মার যুদ্ধ বিষয়ে বললেন, “এক দিকে মানবাত্মা, অন্য দিকে ইস্পাত আর অস্ত্রের ঝনঝনানি: সে কি আশ্চর্য সংঘর্ষ।” বিশ্বের ইতিহাসে কোনও বিদ্রোহেই বিদ্রোহীরা কোনও কালে সংখ্যায় বা অস্ত্রশস্ত্রে অধিকতর জোরালো পক্ষ হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিন্তু বিদ্রোহীরাই বিদেশি শাসন ছুড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটবে।”৯৮ ২১ অক্টোবর তাঁর সরকারের প্রথম জন্মবার্ষিকীতে ইম্ফল ও চট্টগ্রামে নতুন ভাবে আক্রমণ শুরুর আশা প্রকাশ করলেন তিনি।
২৯ অক্টোবর টোকিয়ো রওনা হলেন সুভাষ। সঙ্গে গেলেন এম জেড কিয়ানি, এ সি চ্যাটার্জি, হবিবুর রহমান। নতুন সরকারের শিগেমিতসু বিদেশমন্ত্রী, তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। সম্রাট হিরোহিতোর সঙ্গে দেখা হল। সুভাষ ও তাঁর মন্ত্রীরা ইম্ফল অভিযানের সময়ে আই এন এ-র সঙ্গে সংযোগ রাখার বিষয়ে হিকারি কিকানের ব্যর্থতা নিয়ে অভিযোগ করলেন। আজাদ হিন্দ্ সরকারের সঙ্গে পুরোদস্তুর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এক জন রাষ্ট্রদূত নিয়োগের কথা তুললেন। টোকিয়ো তাঁর প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু তেরুয়ো হাচিয়া যখন যথাযথ পরিচিতি ব্যতিরেকেই হুড়মুড় করে এসে হাজির হলেন, নেতাজি কিন্তু তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হলেন না।৯৯ মালয়ের নিরাপত্তার জন্য সুভাষ আই এন এ-র থার্ড ডিভিশনকে কাজে লাগানোর প্রস্তাবে রাজি হলেন টোকিয়োয় বসে। প্রাথমিক ভাবে ব্যাপারটা জাপানিদের প্রতি ছাড় বলে মনে হলেও আসল ঘটনা অন্য। ভূমি নয়, মানুষই তাঁর ‘সার্বভৌমতা’র ধারণার ভিত্তি, তাই মালয়ে যে দশ লক্ষাধিক ভারতীয় মানুষ আছেন— যাঁদের একটি বিরাট অংশ আবার ইতিমধ্যেই সাময়িক সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেছেন— তাঁদের সুরক্ষার বিষয়টি তখন সুভাষের কাছে অত্যন্ত গুরুতর।
১৯৪৪ সালের নভেম্বরে টোকিয়ো ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক-ছাত্রদের সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হলে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে নেতাজি আর একটি শেষ সুযোগ পেলেন ভারতের মূল সংকট বিষয়ে কিছু বলার জন্য। সে দিন যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তিনি, পরে তার নাম হয়েছে “টোকিয়ো থিসিস”। বললেন, ভারত যে একটি অত্যন্ত সমর্থ জাতি, তার প্রমাণ ভারতের মানুষের সৃষ্টিশক্তিতে, ভারতের মানুষের সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার তীব্র ইচ্ছায়। ভারতের আধুনিকতার কুশলী ব্যাখ্যা রইল এই বক্তৃতায়, রইল মহাত্মা গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুচিন্তিত বিশ্লেষণ। এই বক্তৃতাটির কয়েকটি গুরুতর দুর্বলতাও ছিল। যেমন ভারতের জাতপাতের সমস্যা প্রসঙ্গে সুভাষ বলেন, আধুনিক ভারতে এর কোনও অস্তিত্বই থাকবে না আর! তবে বিদেশি শ্রোতৃমণ্ডলের সামনে আরও এক বার স্পষ্ট ভাবে স্বাধীন ভারতের তিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা বললেন তিনি: জাতীয় প্রতিরক্ষা, দারিদ্র দূরীকরণ, সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা। আঞ্চলিক ভিত্তিতে সহযোগিতার মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। লিগ অব নেশনস-এর ব্যর্থতার উল্লেখ করে বললেন এশীয় আঞ্চলিকতাবাদের প্রধান কর্মকর্তা দেশ হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে জাপানকেই, “স্বার্থচালিত, অদূরদৃষ্টিপ্রসূত নীতি নিয়ে চললে হবে না, একটি দৃঢ় নৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে তাদের।”১০০
দিল্লির দিকে অভিযান আবার নতুন করে শুরু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সুভাষ। ইম্ফলের ব্রিটিশের ম্যাজিনো লাইনে আবার আঘাত হেনে ভেদ করে ফেলা যাবে, এই তাঁর বিশ্বাস, কিন্তু জাপানিদের সঙ্গে কথা বলে আর টোকিয়োয় মার্কিন বোমাবর্ষণের কাণ্ড দেখে ক্রমেই বুঝতে পারছেন তিনি, ও দিক থেকে আর বিশেষ সাহায্য আশা করে লাভ নেই। ফলে ১৯৪৪-এর নভেম্বরে টোকিয়োর সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত জেকব মালিকের মাধ্যমে তাদের দেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমি মিত্রশক্তির মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা টের পাচ্ছেন তিনি, তাই এমন একটি দেশের সঙ্গে তিনি এ বার যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছেন যে দেশ অতীতে তাঁকে ১৯৪১-এ মস্কোর মধ্য দিয়ে যেতে দেওয়া ছাড়া আর কোনও ভাবেই সাহায্য করেনি। সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত সুভাষের বার্তা মস্কোয় পাঠিয়ে দিলেন, কোনও উত্তর এল না।১০১ টোকিয়ো থেকে সুভাষ পর পর কতগুলি বেতারবার্তা পাঠালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। “মার্কিন বন্ধু”দের জানালেন, “এশিয়া বিদ্রোহের পতাকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে”: “আমাদের সাহায্য করতে পারার সুযোগ ছিল তোমাদের, কিন্তু তোমরা করোনি। এখন জাপান আমাদের সাহায্য করতে চায়, আমরাও তাদের সদিচ্ছায় আস্থা না রাখার কোনও কারণ দেখি না। এই কারণেই আমরা তার সঙ্গে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তোমাদের বিরুদ্ধে এবং আমাদের চিরকালের শত্রু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের এই যে যুদ্ধ ঘোষণা, তা জাপানকে সাহায্য করার জন্য নয়, আমাদের নিজেদের সাহায্যের জন্যই, এশিয়ার সাহায্যের জন্যই।”১০২ জাপান যাত্রার সুযোগে যুদ্ধপরবর্তী বিশ্বমানচিত্রের দুই মহাশক্তির মধ্যে একটির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি এবং অন্য দেশটির কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন।
নেতাজির এই সময়কার চিঠিপত্র থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার: টোকিয়োর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরিত তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য এবং ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট-এর কিশোরী-তরুণীদের জন্য তাঁর উৎকণ্ঠা ও দুর্ভাবনা ছিল প্রবল। টোকিয়ো ক্যাডেটদের সঙ্গে সময় কাটানো তাঁর কাছে খুবই জরুরি মনে হয়েছিল। ২৯ নভেম্বরে (তাঁর কন্যার দ্বিতীয় জন্মদিন) তাদের লিখলেন, “প্রিয় বন্ধুরা, নিপ্পনের মাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমি তোমাদের আমার ভালবাসা জানাই, তোমাদের সাফল্য কামনা করে আমার শুভেচ্ছা জানাই। আমার নিজের কোনও পুত্র নেই— তোমরা আমার কাছে পুত্রের চেয়েও বেশি— কারণ আমি যে আদর্শকে জীবনের একমাত্র আদর্শ বলে জেনেছি, ভারতমাতার স্বাধীনতার সেই আদর্শের জন্য তোমরা তোমাদের জীবন উৎসর্গ করেছ।”১০৩ তাইপে, সায়গন, সিঙ্গাপুর হয়ে আবার বর্মায় ফিরে এলেন তিনি, লড়াই-এর হাল তাঁকে ধরতে হবে আবার। “আজ এখান থেকে এক ভদ্রলোক টোকিয়ো যাচ্ছেন,” ১৪ ডিসেম্বর সায়গন থেকে শিক্ষার্থীদের লিখলেন, “তাঁর সঙ্গে তোমাদের জন্য এক বান্ডিল পাঁপড় পাঠালাম। আরও কতগুলি জিনিস পাঠানোর ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এর বেশি ওজন উনি নিতে পারবেন না।”১০৪ এম সাতিয়াবতী থেবরকে লেখা চিঠিগুলিও নানা উৎকণ্ঠায় ভরা, নারীবাহিনীর ছোটখাট বিষয়ে বিশদ ভাবে জানতে চাইতেন, তাদের সঙ্গে সর্বদা সংযুক্ত থাকতে চাইতেন তিনি।১০৫
পিটার ফে এক বার মন্তব্য করেন, “মণিপুর উপত্যকায় বিরাট আশা-সহকারে যুদ্ধের জন্য নয়, বরং ইরাওয়াডি অঞ্চলে কোনও আশা ছাড়াই যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তি বাহিনী শেষ পর্যন্ত তাদের নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছিল।”১০৬ এই যুদ্ধের জন্য ১৯৪৫-এর ১০ জানুয়ারি বর্মায় ফিরে আসেন নেতাজি। এখানে আসার পথে জানুয়ারির গোড়ায় ব্যাঙ্ককে তাইল্যান্ডের সরকার তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল, তারা তখনও তাঁর আন্দোলনের বিষয়ে বন্ধুভাব পোষণ করে।১০৭ চিনের বিরুদ্ধে জাপানের ইচিগো অভিযান সফল হয়েছে তখন, আই এন এ-ও ইরাওয়াডি লাইনে যথেষ্ট সফল ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আগের বছরের সামরিক বিপর্যয়ের ঘটনার পরও রেঙ্গুনে ভারতীয়রা তখন বেশ খুশিমনেই। ২৩ জানুয়ারি সুভাষের আটচল্লিশ বছরের জন্মদিনটি সকলে মিলে পালন করলেন। তাঁর প্রবল অস্বস্তি সত্ত্বেও পুরনো মুঘল ঐতিহ্য অনুযায়ী দাঁড়িপাল্লার এক দিকে সোনা চাপিয়ে তাঁর ওজন মাপা হল, আই এন এ-র জন্য সংগৃহীত হল দুই কোটি ডলার। বহু নরনারী রক্ত দিয়ে প্রতিশ্রুতি লিখলেন: শত্রুর বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম তাঁদের। উদ্দীপনার আড়ালে এন জি স্বামীর সঙ্গে কিছু ইনটেলিজেন্স অপারেশনের পরিকল্পনা করলেন নেতাজি। ওয়্যারলেস সেট দিয়ে শত্রুলাইনের পিছনে কিছু গুপ্তচর পাঠানোর ব্যবস্থা হল। উত্তর বর্মায় মার্কিন পাইপলাইনে অন্তর্ঘাতের জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি হল। আই এন এ-র ফার্স্ট ডিভিশন নেহরু ব্রিগেড ইম্ফলে এতটুকুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তাদের এ বার মালয় থেকে আসা সেকেন্ড ডিভিশনের দুটি রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত করা হল। ইরাওয়াডি নদী অঞ্চলে ব্রিটিশ অগ্রগতি রুখবার ভার পড়ল টগবগে প্রকৃতির শিখ অফিসার গুরবক্স সিংহ ধিলোঁর উপর। নেহরু ব্রিগেডের অসংখ্য তামিল সেনার নেতৃত্ব দিতেন তিনি। নেতাজির মিলিটারি সেক্রেটারি প্রেমকুমার সহগলকে পাঠানো হল মাউন্ট পোপা-র কাছে, আর হাকা-ফালাম সেক্টরে বীরত্ব দেখিয়ে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন যে তরুণ, সেই মেহবুব আহমদ নিলেন সহগলের স্থান, সুভাষের সামরিক সহকারীর স্থান।১০৮
১০ ফেব্রুয়ারি রেঙ্গুনের মাইল-ছয়েক দক্ষিণে মায়াং-এ, আই এন এ হাসপাতালের উপর মার্কিন বি-২৯ বিমান পাঁচ দফায় হানা দিয়ে তাদের আগুনবোমা নিক্ষেপ করে গেল। সম্পূর্ণ হাসপাতাল ঝলসে গেল সে আঘাতে। হাসপাতালটির উপর বেশ বড় করেই রেড ক্রস চিহ্ন দেওয়া ছিল, কিন্তু একটু দূরেই জঙ্গলের মধ্যে জাপানিরা প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ জমিয়ে রেখেছিল বলেই নাকি এই কাণ্ড। উড়ন্ত দুর্গের মতো মার্কিন বম্বারের হানায় বহু অসুস্থ রোগী নিহত হলেন সে দিন, বেঁচে গেলেন যাঁরা, গুরুতর দগ্ধ সেই মানুষগুলিকে দ্রুত পাঠানো হল রেঙ্গুনের জেনারেল হসপিটালে। স্বামী এবং আইয়ার নেতাজির গাড়িতে উঠে ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলেন, অল্পক্ষণের জন্য তাঁরা রক্ষা পেলেন। হানা শেষ হলে দেখা গেল, বোমা পড়ে দশ ফুট বাই ছয় ফুট একটি গর্তের কানায় ঝুলছে সুপ্রিম কম্যান্ডারের গাড়িটি, সম্পূর্ণ উল্টোনো অবস্থায়। আই এন এ-র সেকেন্ড ডিভিশনের কম্যান্ডার আজিজ আহমদ মাথায় দারুণ আঘাত পেলেন, সাময়িক ভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়লেন। পরের সপ্তাহে দিনে দু’-তিন বার করে জেনারেল হসপিটালে দগ্ধ মানুষগুলিকে দেখতে যেতেন নেতাজি, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যবস্থা করতেন যাতে তারা সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা পায়। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতেন বিমর্ষমনে।১০৯
১৮ ফেব্রুয়ারি রেঙ্গুন থেকে রওনা হলেন উত্তরের যুদ্ধফ্রন্টের দিকে। সৈন্যদের বলে দিয়েছেন, যাদের যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, তাদের যুদ্ধে যেতে হবে না। ব্রিটিশ আক্রমণের বিরোধিতার জন্য কেবল যারা সম্পূর্ণত ইচ্ছুক তাদেরই তাঁর চাই। পিনমানায় যে ইম্ফল-ফেরত বাহিনী আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে, তাদের দেখে এলেন এক বার এবং শাহ নওয়াজের সঙ্গে মেকটিলার দিকে এগিয়ে গেলেন। এরই মধ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারি নইয়ঙ্গুতে ব্রিটিশরা ইরাওয়াডি নদী পার হতে গেলে ধিলোঁর নেতৃত্বে নেহরু ব্রিগেড নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে, স্লিমের সাউথ ল্যাঙ্কাশায়ার বাহিনীর বহু সেনা নিধন করে সফল ভাবে প্রতিহত করতে পারল তাদের। পগানেও প্রথম দিকে ব্রিটিশদের আটকানো গিয়েছিল। এই দুর্দান্ত প্রতিঘাতের মুখে স্লিম-এর সপ্তম ব্রিটিশ ভারতীয় ডিভিশনের অগ্রগতি প্রাথমিক ভাবে খানিকটা বিলম্বিত হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত ইরাওয়াডি-র পূর্ব পারে জাপানি ও আই এন এ বাহিনীর উপর নেমে এল তাদের প্রবল আক্রমণ।১১০
১৩ ফেব্রুয়ারি রেঙ্গুনে নেতাজির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উত্তরের দিকে রওনা হলেন প্রেম সহগল। এত দিন যেমন মিলিটারি ভঙ্গিতে বিদায় নিতেন, এ বারও তেমন ভাবেই স্যালুট করতে গিয়ে দেখেন তাঁর সুপ্রিম কম্যান্ডারের গাল বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুধারা। সহগল নেতাজিকে আশ্বাস দিলেন, দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তিনি ঠিকই থাকবেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি মাউন্ট পোপার পশ্চিম ঢালে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিলেন তিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি নেতাজি যখন মেকটিলা পৌঁছলেন, ব্রিটিশরা তখন নাকি নইয়ঙ্গু থেকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, কিন্তু ফ্রন্টে ঠিক কী পরিস্থিতি তা তখনও অস্পষ্ট। নেতাজির নির্দেশে শাহ নওয়াজ ও মেহবুব আহমদ এগিয়ে চললেন পোপার দিকে, যথার্থ খবর সংগ্রহের জন্য। কালাও ও টঙ্গির আই এন এ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন নেতাজি, রেঙ্গুনের কাছে জেয়াওয়াডিতে তাদের স্থানান্তরিত করতে বললেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি শাহনওয়াজ ও মেহবুব আহমদ মেকটিলায় ফিরে নেতাজিকে অনুনয় করলেন— মাউন্ট পোপার দিকে যেন একেবারেই না এগোন। কিন্তু তিনি তখন জেদ ধরে আছেন— সে দিকেই যাবেন। মেজর রাওয়াত নানা ভাবে চেষ্টা করছেন যাতে তাঁর যাত্রা একটু পিছোনো যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে সংবাদ— মেকটিলার দশ মাইল উত্তরে মাহলেং-এ পৌঁছেছে ব্রিটিশরা, মেকটিলা এবং মান্দালয়ের রাস্তা তারা বন্ধ করে দিয়েছে, মেকটিলা থেকে কাউকপাদাং-এর রাস্তাও বন্ধ। অর্থাৎ, আই এন এ-র সুপ্রিম কম্যান্ডার মেকটিলার ফাঁদে আটকা পড়েছেন, কোনও পথই খোলা নেই।১১১
কিন্তু না, নেতাজি ও শাহনওয়াজ ঠিক করলেন, যে করেই হোক বেরোতেই হবে মেকটিলা থেকে, যেতেই হবে দক্ষিণে পিনমানার দিকে। শাহনওয়াজ অবস্থাটা বর্ণনা করেছেন এ ভাবে:
সকলেই বেশ উত্ফুল্ল। একটা কথা ঠিক: শত্রুরা আমাদের কোনওমতেই জীবন্ত ধরতে পারবে না। গাড়িতে উঠে রওনা হওয়ার সময় নেতাজি তাঁর কোলে একটি গুলি-ভরা টমি বন্দুক নিয়ে বসলেন। রাজুর কাছে দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি রইল। জাপানি অফিসারটির হাতে আর একটি টমি বন্দুক, আর আমার হাতে একটা গুলি-ভরা ব্রেন বন্দুক। যে কোনও মুহূর্তে যাতে গুলি ছুড়তে শুরু করতে পারি, তার জন্য আমরা প্রস্তুত। গাড়ির পাদানিতে উঠে দাঁড়ালেন জাপানি অফিসার, যাতে শত্রুপক্ষের কোনও বিমান এলেই দেখতে পান। রাজু ড্রাইভারের পাশে, যাতে শত্রুরা রাস্তা আটকে রাখলে তার চোখ এড়িয়ে না যায়, আর নেতাজি ও আমি পিছনে বসে আছে, রাস্তার দুই পাশে খেয়াল রাখছি।
মেকটিলার কুড়ি মাইল দক্ষিণে ইনডও গ্রামে পৌঁছনো-মাত্র মেশিনগান-সজ্জিত শত্রুবিমান আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ করতে লাগল সেই গ্রামের উপর। দশ ইঞ্চির লম্বা কার্তুজও ছুড়তে দ্বিধা করছে না তারা, যেগুলি সাধারণত বড় ট্যাঙ্ক কিংবা রেল ইঞ্জিন ধ্বংস করতেই ব্যবহার হয়। ফল দাঁড়াল, “মানুষের শরীরের উপর তাণ্ডবলীলা”। ইনডও-র কাছে জঙ্গলে দিনের বেলাটা লুকিয়ে থেকে নেতাজি পিনমানা পোঁছলেন ২৭ ফেব্রুয়ারি।১১২
পিনমানায় পৌঁছনোর পর, ফার্স্ট ডিভিশনে যারা বাকি তখনও তাদের নিয়ে আবার একটি নতুন ব্রিগেড তৈরি করলেন নেতাজি। এর নাম হল “এক্স রেজিমেন্ট”। ঠাকুর সিংকে এর নেতৃত্বে বসালেন, পিনমানার ঠিক উত্তরে ইয়েজিন-এ তাঁকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বললেন। বাকি ডিভিশনের নেতৃত্বে রইলেন রাজা মহম্মদ আরশাদ। অসুস্থ সেনাদের দশ মাইল পিছনে সরিয়ে দেওয়া হল, নির্দেশ দেওয়া হল, ব্রিটিশরা যদি এক্স রেজিমেন্ট-এর প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলে, সে ক্ষেত্রে তারা যেন আত্মসমর্পণ করে দেয়। ১ মার্চ নেতাজি শাহনওয়াজকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানালেন: “পিনমানায় থেমে এ বার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে শেষ লড়াইটা লড়তে হবে।” শাহনওয়াজ কিন্তু তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন: যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্রিটিশরা মেকটিলায় তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারে, এমন লড়াইয়ের সম্ভাবনা কম। বস্তুত গোটা মার্চ মাস ধরেই বর্মার এই ফ্রন্ট একেবারে এক জায়গায় রইল। জেনারেল ফ্র্যাঙ্ক মেসার্ভির নেতৃত্বে একটি ঝটিকা বাহিনী পাঠিয়ে মেকটিলা দখল করতে বলে জেনারেল স্লিম একটু ঝুঁকিই নিয়েছিলেন, এখন এই বাহিনী বাকিদের থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। জেনারেল হাইতারো কিমুরা বর্মায় জাপানি কম্যান্ডার কাওয়াবের স্থান নিয়েছেন এখন, তিনি এ বার নিজেদের সমস্ত সেনাকে একত্র করে মেকটিলায় সপ্তদশ ব্রিটিশ ভারতীয় ডিভিশনকে ঘিরে ফেলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছেন। মার্চ মাস ধরে মেসার্ভির বাহিনী কোনওক্রমে মেকটিলার পূর্ব দিকে একটি গ্রামে এবং বিমান-ঘাঁটিতে টিঁকে থাকার চেষ্টা করে গেল। কিমুরার শেষ চাল যদি সফল হত, স্লিম হয়তো বর্ষা আসার আগেই রেঙ্গুনের বাইরে আটকে যেতেন, দুই পক্ষের কেউই নিশ্চিত জয় পেতেন না।১১৩
২ মার্চ একটি দুঃসংবাদ পেলেন সুভাষ: সেকেন্ড ডিভিশনের পাঁচ অফিসার পোপার কাছে দল ছেড়ে ব্রিটিশ পক্ষে যোগ দিয়েছেন। ৭ মার্চ রেঙ্গুন ছেড়ে পোপা যাচ্ছিলেন শাহনওয়াজ, নেতাজি তাঁকে বললেন, নিজের বিচারবুদ্ধিতে যে সব অফিসারকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করবেন তিনি, তাঁদেরই যেন ফ্রন্টে নিয়ে যান।১১৪ মার্চে বর্মার যুদ্ধে আরও একটা নতুন জটিলতা যোগ হল। যুদ্ধের ভাগ্য পাল্টাতে শুরু করায় অং সান এ বার জাপানিদের বিরুদ্ধে চলে গেলেন, স্লিমকে সহায়তা শুরু করলেন। বর্মার মাটিতে দাঁড়িয়েই বর্মীরা যুদ্ধ করছে তখন। বর্মীদের কাছে জাপানিরা মোটেই প্রিয় নয়, জাপানিদের অসীম স্পর্ধার কারণেই তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক হয়নি। বর্মাবাসী ভারতীয়রা তখনও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, পক্ষ পাল্টাতে তাঁরা অন্তত রাজি নন। তাঁদের লক্ষ্য ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। সাময়িক সরকার মালয়ের বিশাল প্রবাসী ভারতীয় স্বার্থও রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। শেষ অবধি, ভারতীয়দের সঙ্গে বর্মীদের রফা হল, পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। যদিও দুই পক্ষের মধ্যে আগে কিছু জাতিগত সংঘর্ষ হয়েছে, স্বাধীন ভারতের সাময়িক সরকারের তুলনামূলক সম্পন্নতার বিরুদ্ধে বর্মা সরকারের ঈর্ষাকাতরতার ঘটনাও ঘটেছে, তবু সেই অনাক্রমণ চুক্তিই বহাল রইল।১১৫
স্বাধীনতার আদর্শে ভারতীয় সৈন্যরা সম্পূর্ণত উদ্বুদ্ধ কি না, এই বিষয়ে সুভাষচন্দ্র বসু অত্যন্ত সংবেদনশীল। ১৭৫৭ সালে পলাশিতে যে বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে, যার থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত, সে ঘটনা তাঁর মনে সর্বক্ষণ জাগরূক। ১৩ মার্চ সাহসিকতা ও কাপুরুষতার বিষয়ে তাঁর একটি বক্তব্য প্রকাশিত হল, যাতে তিনি “ভীতু ও অকৃতজ্ঞ মাত্রেই গ্রেফতার ও গুলি করে মারার নির্দেশ” দিলেন।১১৬ আই এন এ-র মধ্যে বিশ্বাসভঙ্গ কিংবা কাপুরুষতার ঘটনা ঘটলেও শাহনওয়াজ, সহগল ও ধিলোঁর নেতৃত্বে এপ্রিলে বহু সৈন্য মাউন্ট পোপার দিকে এগিয়ে চললেন দুর্দম সাহসের সঙ্গে। এপ্রিলের গোড়ায় কানওয়াল সিং আর তাঁর সৈন্যরা অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দিলেন লেগির যুদ্ধে। ১০ এপ্রিল কাইউক পাদাং-এ আই এন এ-র হাসপাতালে আবার ব্রিটিশ বোমা— এ বার আশি জন নিহত, ত্রিশ জন আহত। মাউন্ট পোপা ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময়ে আই এন এ-কে কষ্ট করে দক্ষিণমুখী পথটিই ধরতে হল। ২০ এপ্রিল সহগলের রেজিমেন্টের এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ক্যাপটেন বাগরির নেতৃত্বে তাওয়ান্দুইঙ্গির দক্ষিণে শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ির সঙ্গে কেবল হাত গ্রেনেড ও রাইফেল নিয়ে লড়তে গিয়ে সম্পূর্ণত ধ্বংস হয়ে গেল। প্রেম সহগলকে ধরার পর জেনারেল গ্রেসি এক বার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা, তোমরা ঠিক কী ভেবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলে? আমাদের এত অস্ত্র, তোমাদের কিছুই নেই। তবু আত্মসমর্পণ না করে লড়ে চলেছ— পাগলামি ছাড়া কী!” সহগল মেনে নিয়েছিলেন, হ্যাঁ, পাগলামিই বটে, তবে একটা সুচিন্তিত বিপ্লবী পাগলামি।১১৭ সমস্ত রকম অসুবিধের মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার এই জেদ “হালকা ভাবে দেখার বস্তু নয়, দেশপ্রেমের নামে বাহাদুরির চেষ্টাও নয়।” এর মধ্যে ছিল এক “অনমনীয় সংকল্প”, ক্যাম্পে যে রাজনীতি-শিক্ষা পেতেন তাঁরা, হয়তো সামরিক শিক্ষার জায়গাই খানিকটা নিয়ে নিত সেই শিক্ষা, সেই রাজনীতি-বোধের উপর ভিত্তি করে নেওয়া তাঁদের এই সংকল্প।১১৮ ১৯৪৫-এর এপ্রিলে বর্মায় এই ভারতীয়রা তখন অস্ত্রের করাল সম্ভারের মুখোমুখি।
শেষ পর্যন্ত ২৯ এপ্রিল প্রেমকুমার সহগল আলামায়োর কাছে যুদ্ধবন্দি হয়ে ধরা পড়লেন। শাহনওয়াজ খান ও গুরবক্স সিং ধিলোঁ ধরা পড়লেন ১৮ মে, পেগুর কাছে।১১৯ “আমি সব সময়েই বলেছি, ভোরের আগেই আসে সবচেয়ে অন্ধকার সময়,” নেতাজি তাঁদের বলেছিলেন। “আমরা সেই অন্ধকারতম সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এখন। ভোরের আলো নিশ্চয়ই আর বেশি দূরে নয়।”১২০
বর্মা থেকে চলে যাওয়ার আগে নেতাজি তাঁর সৈন্যদের বললেন:
তোমাদের আর একটিমাত্র কথাই আমার বলার আছে। যদি সাময়িক ভাবে তোমাদের হারতেই হয়, তবে জাতীয় তেরঙা পতাকা উঁচু করে ধরে লড়াই করতে করতে হারো, নায়কের মতো হারো, মর্যাদা এবং শৃঙ্খলা নিয়ে হারো। ভারতের আগামী প্রজন্ম, যারা তোমাদেরই এই মহৎ আত্মোৎসর্গের জন্য ক্রীতদাস হয়ে জন্মাবে না, ভারতের স্বাধীন মানুষ হয়ে জন্মাবে, তারা চির দিন তোমাদের মহিমার কথা মনে রাখবে, পৃথিবীর সামনে গর্বভরে বলবে— তোমরা, তাদের পূর্বপুরুষরা কী অসীম সাহসে যুদ্ধ করে গিয়েছ মণিপুর, অসম, বর্মার এই মাটিতে, পরাজিত হয়েছ, কিন্তু সেই সাময়িক পরাজয়ের মধ্য দিয়েই চরম সাফল্য ও গরিমার পথ তোমরা তৈরি করে দিয়েছ।১২১
বর্মার যুদ্ধে হার হল। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষত মালয়ে, যুদ্ধ তখনও শেষ হতে বহু বাকি। সুভাষ ব্রিগেড-এর কিছু ভাল বাহিনীকে তাইল্যান্ড ও মালয়ের পথে মোলমেন পাঠিয়ে দিলেন সুভাষ। রেঙ্গুনে আরও পাঁচ হাজার সেনা রেখে গেলেন এ ডি লোগানাথনের নেতৃত্বে, তাঁকে বললেন ব্রিটিশরা উপস্থিত হলে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে। নেতাজির গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষকর্তা এন জি স্বামীকেও তাঁর নেতার সঙ্গে রেঙ্গুন ছাড়ার আগে কাজে লাগানো হল নানা ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী আন্দোলন চালানোর লক্ষ্যে। আর এম আরশাদ এবং মেহবুব আহমদের যোগ্য সহায়তায় ১৯৪৫-এর ৪ মে ২৬তম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ডিভিশনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে রেঙ্গুন শহরে পূর্ণ শৃঙ্খলা বজায় রাখলেন লোগানাথন।১২২
২৩ এপ্রিল সুভাষ জাপানিদের জানালেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত রানি ঝাঁসি বাহিনীর শ’খানেক মেয়ের নিরাপদে মালয়ে ফেরার ব্যবস্থা না হচ্ছে, তিনি রেঙ্গুন ছাড়বেন না। বর্মায় যে মহিলাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের তত দিনে সযত্নে বিদায় জানিয়ে নিজের নিজের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৪ এপ্রিল রাতে রেঙ্গুন থেকে লঝ্ঝড়ে ট্রাকে চেপে এই মহিলাদের সঙ্গে রওনা হলেন তিনি। এস এ আইয়ার, এ সি চ্যাটার্জি প্রমুখ মন্ত্রীরা, এম জেড কায়ানি এবং জে কে ভোঁসলের মতো সেরা সামরিক কম্যান্ডাররা, গোয়েন্দা প্রধান এন জি স্বামী, হিকারি কিকান লেফটেনান্ট জেনারেল আইসোডা সাবুরো এবং রাষ্ট্রদূত তেরুয়ো হাচিয়া সকলেই চললেন তাঁর সঙ্গে। এই এম জেড কায়ানি, জে কে ভোঁসলে এবং এ সি চ্যাটার্জিকে মেজর-জেনারেল পদে উন্নীত করলেন নেতাজি, শাহনওয়াজ, সহগল এবং ধিলোঁকে কর্নেল করা হল। এপ্রিলের শেষ এবং মে-র গোড়ায় ক্রমাগত শত্রুতাড়িত আই এন এ বাহিনী এবং ঝাঁসির রানি বাহিনীর সঙ্গে বর্মা থেকে তাইল্যান্ডে নেতাজির এই ঐতিহাসিক পশ্চাদপসরণ জনমানসে এক অবিস্মরণীয় ছাপ ফেলে গেল। এই সেই অসমসাহসিক সৈন্যবাহিনী, যাঁরা স্বাধীনতার দাম দিয়েছিলেন তাঁদের অসামান্য আত্মোত্সর্গের মধ্য দিয়ে।
“চার দিকে সমানে আগুন আর বিস্ফোরণের ঝলক, শত্রুপক্ষ কোথায় কেউ কিছু জানে না, কেবল ঝকঝকে চাঁদের আলোয় খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা— এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা,” এস এ আইয়ার লিখেছিলেন। “সেই ঘণ্টাগুলিতে আমরা তখন আক্ষরিক ভাবে জীবনের এক-একটি মুহূর্ত বাঁচছি। পেগুর জ্বলন্ত গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।”১২৩ আকাশ তখন সম্পূর্ণত শত্রুবিমানের দখলে, রাত ছাড়া এই ফিরতি বাহিনী এক পা-ও চলতে পারছে না। “কেবল দিনের আলো নয়, চাঁদের আলোকেও ভয় পেতে শুরু করেছি তখন, হয়তো তুলনায় একটু কম,” আইয়ার স্মরণ করেন। “একেবারে অন্ধকার রাতগুলোতেই নিরাপদ লাগছে। আদিম মানুষের মতো, তাই না? হ্যাঁ, সেই রকমই। অন্যথা, কী করেই বা মানুষ পারে পাগলের মতো মাটির কুড়ি ফুট বা ত্রিশ ফুট নীচের শেল্টারে আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে? কী ভাবেই বা সূর্য এবং চাঁদ তার চোখে ভয়ের বস্তু হয়ে ওঠে?”১২৪ ২৬ এপ্রিল রাত্রে ঝাঁসির রানি বাহিনী ওয়াও নদী পেরিয়ে গেল, স্বামী ও শওকত মালিক তাদের সাহায্য করলেন। সকলে ও পারে চলে না যাওয়া পর্যন্ত সুভাষ নিজে নদী পার হলেন না।
ট্রাকগুলি হয় শত্রুপক্ষের বিমানহানায় ধ্বস্ত হচ্ছে, নয়তো কর্দমাক্ত মাটিতে আটকে যাচ্ছে, এই অবস্থায় নেতাজি ও তাঁর বাহিনী সিটাং নদীর পর শেষ দশ মাইল পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ওই দিনই কিছু আগে, নাজির আহমদ নামে এক তরুণ অফিসারের মৃত্যু হয়েছে বিমানের মেশিন-গান হানায়, নেতাজির ঠিক পাশের ট্রেঞ্চে ছিলেন তিনি। “আমার মেয়েগুলি অসাধারণ,” ডায়রিতে লিখলেন জানকী থেবর। “প্রত্যেকে নিজেদের ব্যাগ নিজেরা বইছে, নিজেদের সব জিনিস তাতে ভরা।” এক-একটি ব্যাগের ওজন প্রায় পঁয়ত্রিশ পাউন্ড, কী না আছে তার মধ্যে, খাবারদাবার, বন্দুক, গোলাগুলি, হাত গ্রেনেড, সব কিছু। “বাহিনীর একেবারে আগে আগে চলেছেন নেতাজি,” বললেন তিনি, “তাঁরও কাঁধে নিজের ব্যাগ।” ওই চাঁদনি রাতেও যে সব রকমের বিপদ এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সিটাং নদী পেরিয়ে গোটা বাহিনী নিরাপদে যেতে পারল, এ এক আশ্চর্য ঘটনাই বটে। সিটাং-এর পূর্ব দিকে আরও তিন রাত এমন ভাবেই হাঁটতে হল। সুভাষ কিছুতেই গাড়ি বা ট্রাকে চড়বেন না, তাঁর সঙ্গীরা যে হাঁটছে! গাছের তলায় বসে মিলিটারি বুটগুলি খুললেন এক বার, জানকী থেবর দেখলেন তাঁর পায়ে “প্রচুর পরিমাণে ফোসকা।”১২৫ আইয়ারের বর্ণনা চলছে, “আমাদের আবার প্রস্তুত হতে বলা হল, এ বার সিটাং থেকে মোলমেন হয়ে ব্যাঙ্কক। মেজর জেনারেল জামান কায়ানি গোটা দলের দায়িত্ব নিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, কী ভাবে গোটা দল, নেতাজি-সুদ্ধ, এগিয়ে যাবে, কী ভাবে বিমানহানার অ্যালার্ম দেওয়া হবে, কিংবা আত্মরক্ষার জন্য ঠিক কী ভাবে রাস্তার দুপাশে তত্ক্ষণাৎ আমাদের সরে যেতে হবে।”১২৬ সুভাষ ব্রিগেডের ‘জানবাজ’ (আত্মঘাতী) ইউনিট এই ফিরতি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিল। নেতাজির সঙ্গে এখন প্রায় হাজার জনের দল। “এই হল সত্যিকারের শৃঙ্খলা,” মহম্মদ জামান কায়ানির বক্তব্য, “গোটা বাহিনীকে ঠিক ভাবে চালনা করার জন্য, সামনে নানা রকম সংকটের মোকাবিলা করার জন্য তিনি (নেতাজি) আমাকে পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে দিলেন, এবং নিজেকেও এই হণ্টন-অভিযানের বাকি সময়টার জন্য সম্পূর্ণ ভাবে আমার নেতৃত্বে সঁপে দিলেন।”১২৭
মোলমেন পৌঁছে রানিদের একটি ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়া হল, এ সি চ্যাটার্জি ও শওকত মালিক দায়িত্বে রইলেন। ট্রেন কেবল রাতেই চলতে পারে, বাকি সময়টা দিনের বেলা সাইডিং-এ লুকোনোর মতো রঙে ঢাকা থাকে। সুভাষ ঠিক করলেন তাঁর এক্স রেজিমেন্ট-এর জন্য অপেক্ষা করবেন, পিনমানা থেকে অবিশ্বাস্য ভাবে রক্ষা পেয়ে তেমন কোনও ক্ষতির মুখে না পড়েই যে দল তখন মোলমেন-এর দিকে আসছে।১২৮ ইম্ফল বাহিনীর বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নেতাজি ব্যাঙ্ককের পথ ধরলেন। মার্শাল ফ্রিডম্যান ফক-কে উদ্ধৃত করে বললেন, “যে সেনাবাহিনী নিজেদের পরাজিত মনে করে তারাই পরাজয় বরণ করে।” তিনি ও তাঁর সৈন্যরা কিন্তু যুদ্ধ থেকে পালাননি, কেবল এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে চলেছেন। ক্লজভিত্স কি বলেননি, যুদ্ধে বিস্ময়ের কোনও অন্ত নেই? এখনও তাই যুদ্ধ করেই যেতে হবে।১২৯
জেনারেল স্লিম যদি সামরিক অর্থে অহঙ্কার করে বলে থাকেন যে তিনি “পরাজয়কে জয়ে পরিণত” করেছেন,১৩০ নেতাজি ভাবছেন কী ভাবে রাজনীতির মঞ্চে এই অহঙ্কারকে উল্টে দেওয়া যায়। ২১ মে তাইল্যান্ডে পৌঁছে তাঁর প্রথম গণবক্তৃতায় নেতাজি তুরস্ক ও আয়ার্ল্যান্ডের ইতিহাস থেকে উদাহরণ এনে ভারতীয়দের উদ্বুদ্ধ করলেন, মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যেতেই হবে। তাঁর “চলো দিল্লি” স্লোগানে যারা অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল, তাদের তিনি এ বার মনে করিয়ে দিলেন, “হয়তো ইম্ফল হয়ে আমাদের দিল্লি যাওয়া হল না,” “কিন্তু দিল্লির পথ তো এক নয়, অনেক,” “রোমের পথের মতোই। আর এই সব পথের কোনও একটি ধরেই আমরা এগিয়ে যাব, শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছব, ভারতের রাজধানীতে পৌঁছব।”১৩১
ব্রিটিশের বর্মা পুনরুদ্ধারে আবারও ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখে সুভাষ স্বভাবতই ভারী হতাশ। তবে একটা নতুন জিনিসও তিনি খেয়াল করলেন, যার থেকে হয়তো এক নতুন ভবিষ্যতের ইশারা মেলে:
আমাদের চার দিকে আজ যে কালো মেঘ, তাতে কিন্তু একটি আলোর রেখা রয়েছে। সেটা হল— আজকের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি কিন্তু সেই পুরনো ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি নয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সৈন্যরা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার বহু সুযোগ পেয়েছে। অনেক সময় আমাদের সৈন্যদের তারা বলেছে যে এরা (আজাদ হিন্দ্ ফৌজ) যদি আরও এগিয়ে যেতে সফল হয়, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সৈন্যরা তবে বেরিয়ে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আসলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির অনেকের মনেই যে আজাদ হিন্দ্ ফৌজের জন্য, তাদের স্বাধীনতার লড়াই-এর জন্য সহানুভূতি রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা এখনও ঝুঁকি নিয়ে বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিতে প্রস্তুত নয়। বিদেশি শাসনের ফলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সৈন্যরা তাদের আত্মপ্রত্যয় হারিয়ে ফেলেছে, ভয়ে-ভয়ে রয়েছে যে ব্রিটিশরাই শেষ পর্যন্ত জিতবে এবং তারা তখন প্রবল সংকটে পড়বে। তা ছাড়া, আজাদ হিন্দ্ ফৌজ আসলে জাপানিদের হাতের পুতুল বলে শত্রুরা যে প্রোপাগ্যান্ডা চালাচ্ছে, তারও হয়তো কিছু প্রভাব পড়েছে এদের উপর। এক বার বর্মায় এলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির চোখ খুলবে। তারা দেখতে পাবে, আজাদ হিন্দ্ সাময়িক সরকার ও আজাদ হিন্দ্ ফৌজ ঠিক কী করেছে, ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কী ভাবে লড়াই করেছে। তারা শুনবে আমাদের ‘জয় হিন্দ্’ ডাক, সমস্ত স্বাধীন ভারতীয়ের উদ্দেশে আমাদের সম্ভাষণ। তারা শুনবে বর্মায় মুক্তি-কামী ভারতীয়ের মুখে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। সব মিলিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি ও ব্রিটিশের সঙ্গে বর্মায় আসা অন্যান্য ভারতীয়দের যে অভিজ্ঞতা হবে, ভবিষ্যতে তার কোনও না কোনও সুফল ফলবেই।১৩২
প্রায় একই কথা তিনি লিখলেন ১৯৪৫-এর ১০ জুন ব্রহ্মচারী কৈলাসম্-এর উদ্দেশে চিঠিটিতে। “যুদ্ধ চলবেই, বর্মায় যা-ই ঘটুক না কেন। আমরা জিতবই। ভারত স্বাধীন হবেই।”১৩৩
ইউরোপে জার্মান পরাজয় বিষয়ে সুভাষের মত— কখনও দুই ফ্রন্টে একসঙ্গে যুদ্ধ চালাতে নেই, বিসমার্কের এই উপদেশ উপেক্ষা করে জার্মান সরকার খুব বড় ভুল করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি জার্মান বিদেশনীতিই জার্মান সবর্নাশের মূল কারণ। “ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অ্যাংলো-আমেরিকানদের শত্রু যদিও একই দেশ, জার্মানি— এদের যুদ্ধের লক্ষ্য কিন্তু একেবারেই আলাদা।” সুভাষ শুনে খুশি যে সানফ্রান্সিসকো কনফারেন্সে মলোটভ অ্যাংলো-আমেরিকানদের দাবি মানতে রাজি হননি, বাস্তবিক, “ব্রিটেন ও আমেরিকার অন্ধ অনুগামী, ভারত ও ফিলিপাইনস-এর প্রতিনিধিদের সকলকেই তিনি চ্যালেঞ্জ জানান।”১৩৪
ব্যাঙ্ককে নেতাজি তাঁর অসামরিক প্রশাসনকে আবার নতুন ভাবে সংগঠিত করলেন। তাঁর অর্থমন্ত্রী রাঘবন সিঙ্গাপুর থেকে অর্থসম্পদ আনলেন, আইয়ার তাইল্যান্ডের সরকারের কাছ থেকে একটি ঋণের বন্দোবস্ত করলেন। সায়গনে চ্যাটার্জিকে, হ্যানয়ে সহায়কে পাঠানো হল যাতে সে সব জায়গার ভারতীয়দের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন। তাইল্যান্ডে আই এন এ-র বন্দুক-বাহিনীর সঙ্গে দেখা করে এবং তাইল্যান্ড সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছে সুভাষ মালয়ে ফিরলেন। এই উপদ্বীপের বিভিন্ন অংশে তখনও থার্ড গেরিলা ডিভিশন মোতায়েন রয়েছে, ফার্স্ট ডিভিশনের ভারী-বন্দুকধারী বাহিনী এবং সাঁজোয়া ট্যাঙ্কবাহিনীও আছে, যাদের বর্মায় পাঠানো হয়নি।১৩৫
ইতিমধ্যে যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক পথ আলোচনা করার জন্য ব্রিটিশ ভাইসরয় আর্চিবল্ড ওয়াভেল ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবৃন্দকে সিমলায় এক কনফারেন্সে আহ্বান করেছেন। মহম্মদ আলি জিন্না প্রশ্ন তুলেছেন, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ কোন অধিকারে কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জিন্নার মুসলিম লিগ এবং জাতীয় কংগ্রেসের মতপার্থক্যে এমনিতেই সিমলা কনফারেন্সে বিশেষ কিছু এগোনোর উপায় ছিল না। এ দিকে ১৯৪৫-এর জুনের শেষে সিঙ্গাপুর থেকে ভেসে আসছে পর পর অনেকগুলি বেতারবার্তা, নেতাজি সেই সব সম্প্রচারে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় আসতে বারণ করছেন। ভারতের মুক্তির লক্ষ্যে এখন ত্রিমুখী লক্ষ্য নিয়ে এগোনো উচিত বলেই তাঁর মত: ভারতের বাইরে চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষ, ভারতের অভ্যন্তরে সমঝোতার বদলে বিরোধিতার নীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ব্যবহার। সর্বশক্তিমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন এ ভাবে নতজানু হয়ে মার্কিন সাহায্য ভিক্ষা করছে, তাঁর মনে হয় একটি পরাধীন নিরস্ত্র জাতির নেতা হিসেবে জাপানের সঙ্গে মিত্রতার চুক্তি করে তিনিও কোনও ভুল করেননি। বক্তৃতায় তাঁর যুক্তি: কিছু পরিমাণে বিদেশি সাহায্য না নিয়ে ইতিহাসে কোনও দেশই স্বাধীন হতে পারেনি— যদিও এখন এই সব যুক্তি কুতর্কের মতো ঠেকতে শুরু করেছে। ওয়াভেলের কাজকর্মের বিশ্লেষণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বরং দেশবাসীর প্রতি তাঁর নিজের উপদেশদানের যোগ্যতা বিষয়ে তিনি নিজে কী মনে করতেন, সেই যুক্তি:
আমি ও আমার সহকর্মীরা এখানে এক ভয়ঙ্কর সংগ্রামে লিপ্ত। ফ্রন্টে আমার সহকর্মীরা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। যাঁরা ফ্রন্টে নেই, তাঁরাও প্রতি মুহূর্তে প্রাণভয়ের মধ্যে। বর্মায় ছিলাম যখন, আমাদের প্রতি মুহূর্তের বিনোদন ছিল বোমা ও মেশিনগান। আমি দেখেছি রেঙ্গুনের আজাদ হিন্দ্ ফৌজের হাসপাতাল কী ভাবে মাটিতে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, অসহায় রোগীদের উপর বোমাবর্ষণের ফলে তাঁরা কী ভাবে আরও আহত, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি ও আমার মতো আরও কিছু মানুষ যে আজ এখনও বেঁচে আছি, সে কেবল ঈশ্বরের কৃপায়। মৃত্যুর মুখে এ ভাবে আমরা বেঁচে আছি, কাজ করে যাচ্ছি, লড়াই করে যাচ্ছি বলেই আমার আপনাদের প্রতি কিছু বার্তা পাঠানোর অধিকার আছে, আপনাদের উপদেশ দেওয়ার অধিকার আছে। আপনারা অনেকেই জানেন না বোমাবর্ষণ কাকে বলে। আপনারা অনেকেই জানেন না মেশিন-গান, লো-ফ্লাইং বম্বার বা ফাইটারের সামনে পড়লে কেমন লাগে। আপনাদের অনেকেরই কোনও অভিজ্ঞতা নেই, ডাইনে বাঁয়ে কানের পাশ দিয়ে বুলেট ছুটে গেলে কেমন বোধ হয়। যারা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, এবং তা সত্ত্বেও তাদের অবিচলিত দৃঢ়তা বজায় রেখেছে, লর্ড ওয়াভেল-এর এই দানের দিকে তারা ফিরেও তাকাবে না।১৩৬
জুলাই মাসের চার তারিখ— মার্কিন স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ্ ফৌজের জন্যও এই দিনটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ৪ জুলাই ১৯৪৩-এ নেতাজি আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে হিন্দুস্থানি ভাষায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন, শ্রোতারা মহোত্সাহে জানাল তাদের সামনে দুটিই পথ: মুক্তি কিংবা মৃত্যু। যে সব আই এন এ শহিদ দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিয়েছেন, নেতাজি তাঁদের উদ্দেশে একটি স্মারকস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ৮ জুলাই। মাসের শেষে উত্তরে সেরেম্বান ও কুয়ালা লামপুরের দিকে যাত্রা করলেন তিনি। এই সময়েও তাঁর মনে বিশ্বাস, পরবর্তী পথ খোঁজার জন্য তাঁর সামনে সময় রয়েছে, হয়তো একটি গোটা বছরই রয়েছে।১৩৭
১৯৪৫-এর অগস্ট মাসের ৬ এবং ৯ তারিখ হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের উপর নিক্ষিপ্ত হল পরমাণু বোমা। পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধও সমাপ্ত হল অকস্মাৎ। ৯ অগস্ট হিরোশিমার ভয়াল ধ্বংসের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল গোটা বিশ্বে। ১০ অগস্ট কুয়ালা লামপুরে ইনায়ত কিয়ানির ফোন এল নেতাজির কাছে— সোভিয়েত ইউনিয়নও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। পরের রাত্রে তিনি খবর পেলেন, জাপান আত্মসমর্পণ করতে চায়। “এখানেই তবে সব শেষ,” শুকনো হেসে বললেন সুভাষ, “এর পর তা হলে কী?” পরের দিন সিঙ্গাপুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। পেনাং থেকে রাঘবন ও স্বামীকে তুলতে আর ইপহ থেকে জন থিভিকে তুলতে দ্রুত গাড়ি পাঠানোর নির্দেশ দিলেন, তাঁরা যেন এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। মালয়ে কয়েকটা কাজ করে যাওয়ার কথা স্বামীর মনে এল, যাতে মিত্রশক্তি পৌঁছনোর পরও স্বাধীনতার পতাকাটি অন্তত উড়তে থাকে। মালয় উপদ্বীপ দিয়ে বারো ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ১২ অগস্ট নেতাজি ও তাঁর সঙ্গীরা সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন যখন, সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে।১৩৮
নেতাজি ও তাঁর মন্ত্রীরা মেয়ার রোডের বাংলোর উপরের তলায় নিয়মিত ভাবে মিলিত হতে থাকলেন। আই এন এ সৈন্য ও সাময়িক সরকারের সঙ্গে যুক্ত অসামরিক ব্যক্তিদের সকলকে পরের ছয় মাস চালানোর মতো টাকাপয়সা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন তাঁরা। নেতাজির সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা ছিল— রানি ঝাঁসি বাহিনীর পাঁচশো জন মহিলা, এবং আর্মি ও এয়ার ফোর্সের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে টোকিয়োতে প্রেরিত পঁয়তাল্লিশ জন সৈন্য। যথেষ্ট পরিমাণ টাকাপয়সা দিয়ে মহিলাদের সকলকে নিরাপদে তাঁদের বাড়ি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। বদলে সেই অফিসার জানালেন, ১৪ অগস্ট নেতাজি যেন অবশ্যই তাদের ক্যাম্পে আসেন, সেখানে রানি লক্ষ্মীবাঈ-এর জীবন অভিনয় করতে চলেছে তাঁর সৈন্যরা। সে দিন সুভাষের একটি দাঁত তোলার ফলে শরীর তেমন ভাল ছিল না। ফলে অনুষ্ঠান কী ভাবে শুরু করতে হবে, তার নির্দেশ পাঠিয়ে দিলেন তিনি, বললেন পরে গিয়ে যোগ দেবেন। “যে সময় বলেছিলেন, তার কিছুটা আগেই নেতাজি এসে প্রবেশ করলেন, কান-পাঠানো চিত্কারে ভরে গেল চতুর্দিক,” স্মরণ করেন আইয়ার। অনুষ্ঠানের শেষে মুক্তমঞ্চে আই এন এ-র তিন হাজার নারীপুরুষ গেয়ে উঠল জাতীয় সঙ্গীত, সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইলেন নেতাজি।১৩৯
অগস্টের ১৩ ও ১৪ তারিখ ক্যাবিনেট বৈঠকের সময় দেখা গেল, অনেকটা সময় কেটে যাচ্ছে নেতাজি কী করবেন তা নিয়ে কথা বলতে বলতেই। তাঁর সম্পর্কে কার কী বলার আছে, মন দিয়ে শুনলেন তিনি, আলোচনায় এমন করে অংশ নিলেন যেন অন্য কারও কথা বলা হচ্ছে। সকলেরই মনে একটিই প্রশ্ন, সিঙ্গাপুরে যদি সুভাষকে বন্দি করে ব্রিটিশরা, তবে তাঁকে নিয়ে তারা ঠিক কী করবে। ব্রিটিশরা নিজেরাও সে সময়ে এর উত্তর জানত না অবশ্য। সেই সময়, এমনকী তার কিছু পরেও, ওয়াভেল ও তাঁর ক্যাবিনেট এ নিয়ে বহু আলোচনা করেছেন, কোনও পথই যথেষ্ট সন্তোষজনক ঠেকেনি তাঁদের কাছে। কোন পদ্ধতিতে সুভাষকে শেষ করে দেওয়া যায়? ইতিমধ্যেই স্পষ্ট, “সব রকম জাতি, জাত, ও সম্প্রদায়ের উপর” তাঁর প্রভাব অত্যন্ত গভীর, মুক্তির সেনাদল তৈরি করেছেন তিনি, ব্রিটিশ ও জাপানি দুই শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। ভারতে যদি তাঁর বিচার হয়, তাঁকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, “তাঁর মুক্তির দাবি হয়ে উঠবে ভয়ানক প্রবল।” তবে কি বর্মা কিংবা মালয়ে তাঁর বিচার হবে? নাকি বিনা বিচারে গোপনে সেচেল্স্-এর মতো কোনও দ্বীপে তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হবে? হয়তো তিনি যেখানে আছেন, আত্মসমর্পণের দাবি না করে সেখানেই তাঁকে থাকতে দেওয়া ভাল। একটা গোটা বিশ্বযুদ্ধ জিতে ফেলার পরও ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে বড় প্রতিস্পর্ধীটির মোকাবিলার জন্য কোনও পথই যেন যথেষ্ট ঠিকঠাক বলে মনে হচ্ছে না সে দিন। নেতাজির মন্ত্রিসভার কাছে পরিষ্কার, ব্রিটিশরা যদি তাঁকে ফাঁসি দেয়, সেই মুহূর্তেই ভারত স্বাধীন হয়ে যাবে। আর যদি তারা সে কাজ না করতে চায়, তা হলে নেতাজি তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সুতরাং দুই পথেই জয় অনিবার্য। মন্ত্রিসভা অবশ্য তাও ভাবতে লাগল, তাদের নেতাকে ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হতে দেওয়া যাবে কি না।১৪০
একটা মস্ত বড় ভুল ঘটে গেল এই বার, এই মুহূর্তটিতে এসে। নেতাজির মন্ত্রিসভা তাঁকে তাঁর নিজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পথ বেছে নিতে বলল। আয়ারের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁকে যেন ব্রিটিশরা বন্দি না করতে পারে, এটাই সে দিনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত, এ দিকে “নেতাজি কিন্তু একাই এই ভাবনার বিরোধিতা করে যাচ্ছেন তখনও।” আয়ারের কথায়, “তাঁর ইচ্ছে, তাঁর মন্ত্রী ও বাহিনীর সঙ্গে সিঙ্গাপুরেই থাকবেন তিনি, ব্রিটিশের মুখোমুখি হবেন। সেই সময়কার মতো তাঁর কথাটিই রইল, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল অন্য রকম।” ১৪ অগস্ট তাঁর অন্যতম উপদেষ্টা এ এন সরকার যখন ব্যাঙ্কক থেকে ফিরলেন, এবং আলোচনায় যোগ দিলেন, দেখা গেল, “সিঙ্গাপুরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়ে আর এক বার ভেবে দেখতে রাজি হচ্ছেন নেতাজি।”১৪১
১৫ অগস্ট সকালে আই এন এ-র অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অফিসার সিরিল জন স্ট্রেসি এবং আর এ মালিক বারান্দায় এসে হাজির, তাঁদের সঙ্গে প্রায় আধ ডজন মডেল, কাগজের রোল— আই এন এ-র শহিদদের জন্য যে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হবে, তার নকশা। সব ক’টি নকশা খুঁটিয়ে দেখলেন নেতাজি, পছন্দও করে দিলেন একটি। “কর্নেল স্ট্রেসি, এই স্মৃতিস্তম্ভ যেন ব্রিটিশরা সিঙ্গাপুরে আসার আগেই সমুদ্রের উপকূলে তৈরি হয়ে যায়। কী মনে হয়, এ কাজ করা সম্ভব আপনার পক্ষে?” জানতে চাইলেন। “নিশ্চয়ই স্যর,” স্ট্রেসির উত্তর, একটা স্মার্ট স্যালুট ঠুকে এবং “জয় হিন্দ্” বলে মার্চ করে বেরিয়ে গেলেন তিনি— রেকর্ড সময়ে তৈরি হল সেই স্মৃতিস্তম্ভ, যার ওপর খোদিত রইল আই এন এ-র মন্ত্র: ইতমদ (বিশ্বাস), ইত্তেফাক (ঐক্য), কুরবানি (ত্যাগ)।১৪২
১৫ অগস্ট বিকেলবেলা রেডিয়োয় শোনা গেল জাপানের আত্মসমর্পণের সরকারি ঘোষণা। নেতাজিও এ বার তাঁর শেষ ঘোষণাটি করলেন, পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের প্রতি তাঁর বিশেষ বার্তা জানালেন। “দিল্লির পথ এক নয়, অনেক,” সৈন্যদের উদ্দেশে বললেন তিনি, “দিল্লিই এখনও আমাদের লক্ষ্য। তোমাদের অমর সহকর্মীদের আর তোমাদের আত্মত্যাগ নিশ্চয়ই সফল হবে।”১৪৩ যে অসংখ্য সাধারণ ভারতীয়ের প্রবল উত্সাহ ছিল তাঁর আই এন এ-র পিছনে, তাদের উদ্দেশে বললেন:
আমার ভাইরা, বোনেরা,
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গৌরবজনক অধ্যায় তবে এ বার শেষ হল। এই অধ্যায়ে অমর স্থান অর্জন করে নিয়েছেন পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পুত্রকন্যারা।
ভারতের এই মুক্তির সংগ্রামে আপনারা যে যে ভাবে পারেন, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, মানুষ দিয়ে সাহায্য করেছেন, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমার “পূর্ণ প্রস্তুতি”র আহ্বানে আপনারা যে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে, যে উদ্দীপনার সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন, তা কখনও ভুলব না। আজাদ হিন্দ্ ফৌজ এবং ঝাঁসির রানি বাহিনীর সৈন্য হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে আপনাদের পুত্র-কন্যারা সমানে এসে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে। আজাদ হিন্দ সাময়িক সরকারের যুদ্ধভাণ্ডারে কত অর্থ, কত সম্পদ আপনারা সমানেই ঢেলে গিয়েছেন। সংক্ষেপে, আপনারা সর্বতো ভাবেই ভারতের সত্য সন্তানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই যন্ত্রণা, এই ত্যাগের প্রত্যক্ষ ফল যে পাওয়া গেল না, তাতে আপনাদের থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার। তবে কিছুই কিন্তু বৃথা যায়নি। আমাদের মাতৃভূমির মুক্তির পথই এতে প্রশস্ত হয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র ভারতীয়দের জন্য মৃত্যুহীন আদর্শ হয়ে থেকে যাবে এই ইতিহাস। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে থাকবে, ভারতের মুক্তির বেদিতে আপনাদের অসামান্য আত্মোত্সর্গের বিষয়ে নিয়ত গর্বিত বোধ করবে।
ভারতের ভাগ্যবিধাতার উপর যেন আস্থা না হারান তাঁরা, এই অনুরোধ করলেন নেতাজি। তাঁর ঘোষণা, “ভারত স্বাধীন হবেই, বেশি দূরে নেই সেই প্রহর।”১৪৪
সে দিন রাত দশটার সময় নৈশাহারের পর সিঙ্গাপুর বাংলোর বারান্দায় আরও এক বার নেতাজির মন্ত্রীরা জড়ো হলেন। পাঁচ ঘণ্টা চলল তাঁদের বৈঠক, ভোর তিনটে পর্যন্ত। আইয়ার লিখেছেন, “বেশিক্ষণ লাগল না, নেতাজিকে আমরা সিঙ্গাপুর থেকে বেরিয়ে যেতে রাজি করে ফেললাম।” কিয়ানির মনে আছে, তাঁর কিন্তু এই পরিকল্পনা পছন্দ হয়নি। আর এক বার তিনি নেতাজিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “রাশিয়ায় যাওয়ার থেকে এখন তাঁর সিঙ্গাপুরে থাকাটাই বেশি কাজের।” সিঙ্গাপুরই এই বিপ্লবী সরকার এবং সৈন্যবাহিনীর হেডকোয়ার্টার। তাঁর মনে হচ্ছিল, বাহিনীর সবাই একত্র থেকে মর্যাদাসহকারে আত্মসমর্পণ করাই ভাল। “এমন কিছুই আমরা করিনি যাতে আমাদের কিংবা আমাদের দেশবাসীর লজ্জাবোধ হতে পারে।” কিয়ানি বললেন, “যুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা শেষ হলে দেশের মানুষও অনেক বেশি করে আমাদের কাজকর্মের বিষয়ে জানতে পারবেন। তখন তাঁরা আমাদের নিয়ে গর্বিত বোধ করবেন, আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন।” নেতাজি যদি সিঙ্গাপুরেই থেকে যান, বন্ধুরা, সমর্থকরা তাঁকে ঘিরে থাকবেন। কিন্তু, না, দেখা গেল অধিকাংশেরই মত, নেতাজির চলে যাওয়াই উচিত। আইয়ারের মতে, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত— নিশ্চিত ভাবে মালয়ের বাইরে, কারও কারও মতে সোজা রাশিয়া, না হলেও অন্তত রুশ অঞ্চলে।” নেতাজিও স্বীকার করলেন, আবার “অজানার অভিযান”-এর পথে চলেছেন তিনি।১৪৫
পরের দিন— ১৯৪৫ সালের ১৬ অগস্ট, আজাদ হিন্দ্ সাময়িক সরকারের প্রধান নেতা সুভাষচন্দ্র বসু একটি অর্ডারে সই করে দিলেন: “সিয়োনান (সিঙ্গাপুর) থেকে আমার অনুপস্থিতিতে মেজর জেনারেল এম জেড কায়ানি আজাদ হিন্দ্ সাময়িক সরকারের প্রধান প্রতিনিধি হবেন।” মালয়ে ভারতীয় সমাজের স্বার্থরক্ষা ও সিঙ্গাপুরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিভিন্ন নির্দেশ দেওয়া হল। আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্কের প্রায় পাঁচ লক্ষ ডলার মূল্যের স্বর্ণমুদ্রা ভাণ্ডার একটি স্ট্রং রুম-এ রাখা হল, একমাত্র আপত্কালীন অবস্থাতেই তার ব্যবহার হবে।১৪৬ সকাল সাড়ে ন’টায় কিয়ানি, আলাগাপ্পান ও অন্যান্যদের বিদায় জানিয়ে স্টিলের সিঁড়ি দিয়ে জাপানি বম্বার প্লেনটিতে চড়লেন নেতাজি। স্বামী, রাঘবন এবং থিভি তখনও পেনাং ও ইপহ্ থেকে এসে পৌঁছননি। নেতাজির সঙ্গে গেলেন আইয়ার, হাবিবুর রহমান এবং প্রীতম সিং নামে আর এক কর্নেল— এক জন হিন্দু, এক জন মুসলিম আর এক জন শিখ— এবং তাঁদের সঙ্গে নেগিশি নামে এক জাপানি সংলাপ-সহায়ক। মাটিতে পাঁচ মিনিট দ্রুতগতিতে ছোটার পর বিমানটিকে আবার যথাস্থানে ফিরে আসতে দেখে সুভাষ জানতে চাইলেন কী হয়েছে। শুনলেন, কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে ব্রেক-এ। সমস্যাটা অবশ্য তাড়াতাড়িই মিটে গেল, বিকেল তিনটের সময় বিমান ব্যাঙ্ককে অবতরণ করল।১৪৭
১৬ অগস্টের সন্ধে থেকে ১৭ অগস্ট ভোর পর্যন্ত নেতাজির কাছে অগণিত অতিথি, সেনা ও সাধারণ মানুষের ঢল। প্রবল ভিড়ে বাড়িতে এক ইঞ্চিও বসার জায়গা নেই। ব্যাঙ্ককে কর্মরত জার্মান গোয়েন্দা অফিসার ওয়াল্টার মেয়ার কিন্তু বারণ করলেন রুশ অঞ্চলের অভিমুখে উড়ে যেতে, বড্ড বেশি ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে। তার বদলে, তাইল্যান্ডে কিছু দিন লুকিয়ে থেকে সব শান্ত হয়ে গেলে আবার পুনরাবির্ভাব ঘটানোই বরং সুভাষের পক্ষে সহজ। সাময়িক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা দেবনাথ দাস এর মধ্যে সুভাষের অনুমতি নিয়েই তাইল্যান্ডে এক রকম রাজনৈতিক অজ্ঞাতবাসের প্রাথমিক প্রস্তুতি সেরে রেখেছেন। জুনে প্রিন্স ওয়ান ওয়াইথায়াকোন সুভাষের সম্মানে একটি চা-পার্টির আয়োজন করেছিলেন। তিনি, তাই সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস এবং তাই-ভারত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রেসিডেন্ট অনুমান রাচোধান সকলে মিলে বলে রেখেছিলেন, যুদ্ধে জাপান হারলে যেন তিনি তাঁদের সাহায্য নেন। অনুমান রাচোধান আবার একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষ বসুর ভক্ত। দেবনাথ দাসের সঙ্গে ওয়াট মহাথাট মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের যোগাযোগ রয়েছে— বুদ্ধ-সদৃশ ভারতীয় নেতাটির আদ্যন্ত ভক্ত সেই পুরোহিত— তাঁর যোগাযোগ রয়েছে তাইল্যান্ডের রাজ-পরিবারের পুরোহিত মাহোয়াং-এর সঙ্গেও। নেতাজি যদি রাজি হন, তাঁরা তাঁকে একটি বৌদ্ধ মঠে লুকিয়ে রাখবেন। তাইল্যান্ডে অসংখ্য দেশপ্রেমী ভারতীয়ের বসবাস, প্রয়োজনমতো আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা জোগাবেন তাঁরা।১৪৮
দুর্ভাগ্যক্রমে, সবচেয়ে ঝুঁকির রাস্তাটিই নেতাজি বেছে নিলেন। ১৭ অগস্ট ভোর আটটায় ব্যাঙ্কক বিমানবন্দর থেকে সায়গনের দিকে উড়ে গেলেন তিনি। ইতিমধ্যে ব্যাঙ্ককে আরও একটি হিন্দু-মুসলিম-শিখ ত্রয়ী তৈরি করেছেন তিনি, দেবনাথ দাস, আবিদ হাসান এবং গুলজারা সিং। দুটি বিমানে ভাগাভাগি করে তাঁরা রওনা হবেন। প্রথমটিতে নেতাজি নিজে, আইয়ার, হবিবুর রহমান, প্রীতম সিং এবং জাপানি সংলাপ-সহায়ক। অন্যটিতে, হিকারি কিকানের প্রধান জেনারেল সাবুরো ইসোডা, আজাদ হিন্দ্ সরকারে উপস্থিত জাপানি রাষ্ট্রদূত তেরুয়ো হাচিয়া, আবিদ হাসান, দেবনাথ দাস এবং গুলজারা সিং। সায়গন এয়ারপোর্টে চন্দ্র মল-এর সঙ্গে মিলিত হলেন তাঁরা, ইনি ইন্দোচিনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের পরিবহণ বিভাগের সেক্রেটারি। সকলকে নিয়ে যাওয়া হল শহরের একটু বাইরে হাউসিং ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি নারায়ণদাসের বাড়ি। সায়গনে পৌঁছে নেতাজি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, তিনি ভুল করে ফেলেছেন, সিঙ্গাপুর ও ব্যাঙ্ককের অনেক বেশি নিরাপদ পরিস্থিতি ছেড়ে বেরিয়ে আসা তাঁর ঠিক হয়নি। এখানে রাস্তায় কোনও মানুষজন নেই, চার দিকে প্রবল গুঞ্জন: যে ভারতীয়রা জাপানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, ফরাসিরা আসছে তাঁদের উপর প্রতিশোধ নিতে।
এর পর সামনে এগোনোর কী ব্যবস্থা হতে পারে, তা খতিয়ে দেখতে ইসোডা এবং হাচিয়া দ্রুত রওনা হয়ে গেলেন দালাতে কাউন্ট তেরাউচির সাদার্ন আর্মি হেডকোয়ার্টার্সের দিকে। বিকেলে ফিরে এলেন তাঁরা, এবং সায়গন থেকে যে জাপানি বম্বার রওনা হতে প্রস্তুত, সেটিতে একটিমাত্র আসনে সুভাষকে উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন। উদ্বেগদীর্ণ বৈঠকে বসলেন ভারতীয়রা, নেতাজিকে একা যেতে দেওয়া কি ঠিক হবে? বহু কথাবার্তার পর জাপানিরা আর একটি দ্বিতীয় আসন দিতে রাজি হল, সুভাষ চাইলেন হাবিবুর রহমানকে নিয়ে যেতে। তাঁর সাবমেরিন-সঙ্গী আবিদ হাসানকেও নিতে পারতেন তিনি, কিন্তু মিলিটারি র্যাঙ্কের দিক থেকে হাবিব এগিয়ে আছেন, সিঙ্গাপুরে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন তিনি। আশা রইল, জাপানিরা আর একটি বিমানের ব্যবস্থা করে দেবেন তাড়াতাড়ি, যাতে বাকিরা গিয়ে তাঁদের নেতার সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য দুটি গাড়ি দ্রুত গতিতে রওনা হল, এ দিকে বিমানবন্দরে জার্মানি ও রাশিয়া-বিশেষজ্ঞ জাপানি অফিসার জেনারেল সুনামাসা শিদেই ঘণ্টা-দুয়েক ধরে তাঁদের জন্য অপেক্ষায়।১৪৯
“ঠিক আছে তা হলে, জয় হিন্দ্, তোমাদের সঙ্গে আবার পরে দেখা হচ্ছে,” বিস্মিত হতচকিত পাঁচ ভারতীয় সঙ্গীকে বললেন সুভাষ। বিদায়কালের সজোর করমর্দন এক রাউন্ড। তার পর চিরপরিচিত সেই রাজকীয় পদক্ষেপে বিমানের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, ছোট্ট সিঁড়িটি দিয়ে উঠে বিমানের অভ্যন্তরে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন।” বিকেল সওয়া পাঁচটা, নেতাজিকে নিয়ে সায়গন বিমানবন্দর ছেড়ে উড়ে গেল জাপানি বম্বার। পাঁচ ভারতীয় তখনও হতচকিত দণ্ডায়মান, স্থিরচক্ষে পলকহীন তাঁরা তাকিয়ে রয়েছেন “যে দিকপানে উড়ে চলল সেই বিমান, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে সুদূর দিগন্তে যেন এক বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল।”১৫০
.
১. ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, এফ. কিকান: জাপানিজ আর্মি ইন্টেলিজেন্স অপারেশনস্ ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া ডিউরিং ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু, আকাশি ইয়োজি [অনূদিত] (হংকং: হেইনেমান এশিয়া, ১৯৮৩), পৃ: ৮৯।
২. “পৃথিবী জুড়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সংযুক্ত করো,” ব্যাঙ্কক অধিবেশনের উদ্দেশ্যে বার্তা, ১৫ জুন, ১৯৪২, সুভাষচন্দ্র বসু, আজাদ হিন্দ: রাইটিংস্ অ্যান্ড স্পিচেস্ ১৯৪১-১৯৪৩, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, একাদশ খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০২), পৃ: ১১৫-১১৬।
৩. দ্রষ্টব্য, সুগত বসু, আ হান্ড্রেড হরাইজনস্: দি ইন্ডিয়ান ওশন ইন দি এজ অব গ্লোবাল এম্পায়ার (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৬)।
৪. আসল নথিপত্র রয়েছে এন আর বি মহাফেজখানায়।
৫. জয়েস লেব্রা, জাঙ্গল অ্যালায়েন্স: জাপান অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (সিঙ্গাপুর: এশিয়া প্যাসিফিক প্রেস, ১৯৭১), পৃ: ১১৪-১১৬; আবিদ হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্” (সাক্ষাত্কারের প্রতিলিপি), দি ওরাকল, ৬, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮৪), ৬১-৬৫; সেইজো আরিসুয়ে, “মাই মেমরিজ অব সুভাষ চন্দ্র বোস,” দি ওরাকল, ১, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৭৯), ১৯-২৪।
৬. ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, এফ. কিকান, পৃ: ৭১-৯১।
৭. তদেব, পৃ: ১৮০-১৮৭; লেব্রা, জাঙ্গল অ্যালায়েন্স, পৃ: ৩৭-৩৮; পিটার ওয়ার্ড ফে, দ্য ফরগটন আর্মি: ইন্ডিয়া’জ আর্মড স্ট্রাগ্ল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স, ১৯৪২-১৯৪৫ (অ্যান আর্বার: ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান প্রেস, ১৯৯৩), পৃ: ৭৩-৮৬।
৮. ৩ নম্বর গ্রন্থ, “দি ইন্সিডেন্স অব ভলান্টিয়ারস্ অ্যান্ড নন-ভলান্টিয়ারস্,” লেফটেনান্ট কর্নেল জি ডি অ্যান্ডারসন এবং তাঁর কর্মচারীদের দ্বারা সংকলিত, মে ১৯৪৬, এল/ডব্লিউ এস/২/৪৫ (আই ও আর, বি এল)।
৯. ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, এফ. কিকান, পৃ: ২০১-২১২; লেব্রা, জাঙ্গল অ্যালায়েন্স, পৃ: ৬৭-৭১।
১০. নাকাজিমা তাকেশি, বোস অব নাকামুরায়া: অ্যান ইন্ডিয়ান রেভলিউশনারি ইন জাপান, প্রেম মোটওয়ানি [অনূদিত] (নয়া দিল্লি: প্রমিলা, ২০০৯)।
১১. লেব্রা, জাঙ্গল অ্যালায়েন্স, পৃ: ৯৮-১০১; ফে, ফরগটন আর্মি, পৃ: ১৩৭-১৫২।
১২. “দ্য ম্যাজিক অব বোস এনচ্যান্টেড তোজো ইমিডিয়েটলি,” লিখেছেন জয়েস লেব্রা, জাপানি ইতিহাসের এক মার্কিন পণ্ডিত। লেব্রা, জাঙ্গল অ্যালায়েন্স, পৃ: ১১৬।
১৩. তদেব; “সুভাষ চন্দ্র বোস অ্যান্ড জাপান,” চতুর্থ বিভাগ, এশিয়ান ব্যুরো, বিদেশমন্ত্রক, জাপান সরকার, অগস্ট ১৯৫৬, ইংরাজি অনুবাদ শিশিরকুমার বসু (সম্পাদিত), নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৭৫), পৃ: ৩৩৬-৩৩৭।
১৪. “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়াজ ফ্রিডম, পৃ: ৩৩৭-৩৩৯; “হোয়াট ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজম মিনস্ ফর ইন্ডিয়া,” সুভাষচন্দ্র বসু, চলো দিল্লি: রাইটিংস্ অ্যান্ড স্পিচেস্, ১৯৪৩-১৯৪৫, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দ্বাদশ খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৭), পৃ: ১৭-১৯।
১৫. “আওয়ার ন্যাশনাল অনার” (টোকিয়ো থেকে সম্প্রচারিত, ২১ জুন, ১৯৪৩); “দ্য ব্লাড অব ফ্রিডম-লাভিং ইন্ডিয়ানস্” (টোকিয়ো থেকে সম্প্রচারিত, জুন, ১৯৪৩); “দ্য ওয়ার অ্যান্ড ইটস্ সিগনিফিক্যান্স” (টোকিয়ো থেকে সম্প্রচারিত, ২৪ জুন, ১৯৪৩); প্রতিটি রয়েছে বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ২০-৩৩।
১৬. অডিয়ো এবং ভিডিয়ো রেকর্ডিং (এন আর বি)।
১৭. “হাঙ্গার, থার্স্ট, প্রাইভেশন, ফোর্সড মার্চেস অ্যান্ড ডেথ” (ইস্ট এশিয়া ডেলিগেটস্ কনফারেন্স-এ সভাপতির ভাষণ, সিঙ্গাপুর, ৪ জুলাই, ১৯৪৩), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৩৯-৪৪।
১৮. “টু দিল্লি, টু দিল্লি!” (সিঙ্গাপুরে আই এন এ-র এক সামরিক পর্যালোচনায় আই এন এ-এর সর্বোচ্চ সেনানায়ক হিসেবে বসুর বক্তৃতা, ৫ জুলাই, ১৯৪৩, খাঁটি হিন্দুস্তানি থেকে অনূদিত), তদেব, পৃ: ৪৫-৪৮।
১৯. “হোয়াই আই লেফট হোম অ্যান্ড হোমল্যান্ড” (সিঙ্গাপুরে এক জনসভায় বক্তৃতা, ৯ জুলাই, ১৯৪৩), তদেব, পৃ: ৫১-৫৪।
২০. লেনার্ড এ গর্ডন, ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ: আ বায়োগ্রাফি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্টস্ শরৎ অ্যান্ড সুভাষ চন্দ্র বোস (নিউ ইয়র্ক: কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯০), পৃ: ৪৯৮; ফে, দ্য ফরগটন আমি, পৃ: ২১৪, ৫২৫-৫২৬।
২১. আবিদ হাসান সাফ্রানি, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” টেপ করে রাখা একটি সাক্ষাত্কারের অনুলিপি, নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর মহাফেজখানা, ১৯৭৬, পঞ্চম পর্ব, মুদ্রিত দি ওরাকল, ৭, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮৫), ২১।
২২. “এম্পায়ার দ্যাট রোজ ইন আ ডে উইল ভ্যানিশ ইন আ নাইট” (ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ, সিঙ্গাপুর শাখা, নারী বিভাগ আয়োজিত ভারতীয় মহিলাদের এক জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা, ১২ জুলাই, ১৯৪৩), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৫৫-৫৯।
২৩. লক্ষ্মী সায়গল, “দ্য রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট,” দি ওরাকল, ১, ২ নম্বর (এপ্রিল ১৯৭৯), ১৫-১৯; লক্ষ্মী সায়গলের (স্বামীনাথন) সঙ্গে কথোপকথন, ২০০১।
২৪. পুয়ান শ্রী দাতিন জানকী আথিনাহাপ্পান, “দ্য রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট,” দি ওরাকল, ২, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮০), ২৯-৩২; জানকী আথিনাহাপ্পানের (থেভর) সঙ্গে কথোপকথন, ২০০৬; মানাবতী আর্যা, দ্য রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট ইন বার্মা, এবং মায়া ব্যানার্জি, মাই লাইফ উইথ দ্য রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট, দুই-ই রয়েছে দি ওরাকল, ২, ২ নম্বর (এপ্রিল ১৯৮০), ১৬-২৪; শান্তি মজুমদার, নেতাজি’স্ রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট, দি ওরাকল, ২, ৩ নম্বর (জুলাই ১৯৮০), ২১-২৬। আরও দ্রষ্টব্য, ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ২১৯-২২১।
২৫. বা ম’, ব্রেকথ্রু ইন বার্মা: মেময়ারস্ অব আ রেভোলিউশন, ১৯৩৯-১৯৪৬ (নিউ হাভেন: ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৮), পৃ: ৩৪৮।
২৬. “ইন্ডিপেন্ডেন্ট বার্মা” (বার্মার স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাফল্য নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি, ১ অগস্ট, ১৯৪৩), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৭০-৭৬।
২৭. বা ম’, ব্রেকথ্রু ইন বার্মা, পৃ: ৩৫২।
২৮. অমর্ত্য সেন, পভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস্: অ্যান এসে অন এন্টাইট্লমেন্ট অ্যান্ড ডেপ্রিভেশন (অক্সফোর্ড: ক্ল্যারেনডন প্রেস, ১৯৮১), পৃ: ৫২-৮৫; সুগত বসু, অ্যাগ্রেরিয়ান বেঙ্গল: ইকনমি, সোশ্যাল স্ট্রাকচার অ্যান্ড পলিটিক্স (কেমব্রিজ: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৬), পৃ: ৮৭-৯৭; সুগত বসু, “স্টারভেশন অ্যামিড্স্ট্ প্লেনটি: দ্য মেকিং অব ফেমিন ইন বেঙ্গল, হোনান অ্যান্ড টনকিন, ১৯৪২-১৯৪৫,” মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ, ২৪, ৪ নম্বর (১৯৯০), ৬৯৯-৭২৭; এম এস ভেঙ্কটরামানি, দ্য বেঙ্গল ফেমিন অব ১৯৪৩: দি আমেরিকান রেসপন্স (দিল্লি: বিকাশ, ১৯৭৩), পৃ: ১৬।
২৯. বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৭৯; ডব্লিউ ও ২০৮/৮০৯, ২০ এবং ২৪ অগস্ট, ১৯৪৩, এবং ডব্লিউ ও ২০৮/৮১৮ (টি এন এ); ফাইল ১১৪/৪৩-পোল. (I), ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩ (আই ও আর, বি এল); কৃষ্ণা বসু, চরণরেখা তব (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৮২), পৃ: ৬৬-৬৭।
৩০. “অ্যাট বাহাদুর শাহ’জ টুম্ব” (বক্তৃতা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৯৭-৯৯।
৩১. “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩৪৭।
৩২. এস এ আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস: দ্য স্টোরি অব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ইন ইস্ট এশিয়া (মুম্বই: থ্যাকার, ১৯৫১), পৃ: ২৪৮।
৩৩. শাহনওয়াজ খান, মাই মেমরিজ অব আই এন এ অ্যান্ড ইটস্ নেতাজি (দিল্লি: রাজকমল, ১৯৪৬), পৃ: ১০০।
৩৪. তদেব, পৃ: ১০০-১০১; মহম্মদ জামান কায়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল অ্যান্ড দ্য গ্রেট আই এন এ (নয়া দিল্লি: রিলায়েন্স, ১৯৯৪), পৃ: ৭২-৮৬।
৩৫. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১১; আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ১৭৪-১৭৬; আই এন এ মিউজিক রেকর্ডিং (এন আর বি); “ন্যাশনাল সঙ্স,” ফাইল ১৫১/আই এন এ; “নিউ সঙ্স ফর র্যালি,” ফাইল ১৫৫/আই এন এ; “ন্যাশনাল সঙ্স,” ফাইল ১৫৬/আই এন এ (এন এ আই)।
৩৬. আবিদ হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ৫৬-৫৭; আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ১৬৮-১৮৩, ২৬৯।
৩৭. প্রোক্ল্যামেশন অব দ্য প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট অব আজাদ হিন্দ, ২১ অক্টোবর, ১৯৪৩, বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১০৮-১২০; এস এ আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ১৬৩-১৬৪।
৩৮. বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১১৭।
৩৯. “হোয়্যার ইজ ইয়োর ব্যাঙ্ক বুক?” (বক্তৃতা, অল মালাই চেট্টিয়ারস্ অ্যান্ড আদার ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস্ কনফারেন্স, ২৫ অক্টোবর, ১৯৪৩), তদেব, পৃ: ১৩৯-১৪৫।
৪০. ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ২১৫। মালয়ের স্থানীয় শাখাগুলিতে যে দান সংগ্রহ করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দ্রষ্টব্য, ইয়ং ইন্ডিয়া, সানডে, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩, নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর মহাফেজখানা, পৃ: ১২-১৩।
৪১. আবিদ হাসান সাফ্রানি, দ্য মেন ফ্রম ইম্ফল (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৭১, ১৯৯৫), পৃ: ১১-১২।
৪২. “ইউনিফিকেশন অব দি ইন্ডিয়ান নেশন” (আজাদ হিন্দ সাময়িক সরকারের মন্ত্রি-পরিষদের বৈঠকে গৃহীত সংকল্প, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৩), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১৬৬-১৬৮।
৪৩. “ইউনিটি অব ইন্ডিয়া, পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট” (আই এন এ বাহিনীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা), নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর মহাফেজখানা; “গাঁধীজি’স পার্ট ইন ইন্ডিয়া’জ ফাইট” (ব্যাঙ্কক থেকে সম্প্রচারিত, ২ অক্টোবর, ১৯৪৩), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১০০-১০৫।
৪৪. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ২১৯-২২০।
৪৫. বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১৩১।
৪৬. ভুলাভাই দেশাই, “অ্যাড্রেস অব কাউন্সেল ফর ডিফেন্স, রেড ফোর্ট ট্রায়াল, দিল্লি, ডিসেম্বর ১, ১৯৪৫,” দি ওরাকল, ১৫, ৪ নম্বর (অক্টোবর ১৯৯৩), ৩৪।
৪৭. “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩৫৮, ৩৬৪। আরও দ্রষ্টব্য, মামোরু শিগেমিত্সু, জাপান অ্যান্ড হার ডেসটিনি (লন্ডন: হাচিনসন, ১৯৫৮), পৃ: ২৯৩-২৯৪।
৪৮. “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩৫৯; কৃষ্ণা বসু, চরণরেখা তব, পৃ: ৫৫-৫৬।
৪৯. “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩৬১-৩৬২।
৫০. তদেব, পৃ: ৩৬৩-৩৬৬; কৃষ্ণা বসু, চরণরেখা তব, পৃ: ৫৭, ৫৮।
৫১. বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৭৯, ১৬১-১৬২; আবিদ হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্” (টেপ করা সাক্ষাত্কার, এন আর বি); কৃষ্ণা বসু, প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৯৩), পৃ: ৪৭।
৫২. “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩৭৩-৩৭৪।
৫৩. “নেতাজি ইন আন্দামান, ডিসেম্বর ২৯-৩১, ১৯৪৩: আ রিপোর্ট,” দি ওরাকল, ১৬, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৯৪), ১১-১৩।
৫৪. হিউ টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার: আ স্টাডি অব সুভাষ চন্দ্র বোস (লন্ডন: কাসেল, ১৯৫৯), পৃ: ১০০।
৫৫. “স্টেটমেন্ট অব কর্তার সিং,” ফাইল ২৭৬/আই এন এ (এন এ আই); টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ৮৭-৮৮; কে কে ঘোষ, দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি: সেকেন্ড ফ্রন্ট অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স মুভমেন্ট (মিরাট: মীনাক্ষী, ১৯৬৯), পৃ: ১৬০-১৬১।
৫৬. শিশিরকুমার বসু, দ্য গ্রেট এসকেপ (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ২০০০), পৃ: ৪৮-৪৯; শান্তিময় গঙ্গোপাধ্যায়, সুধীররঞ্জন বক্সি, ধীরেন সাহারায়, রাতুল রায়চৌধুরী এবং শিশিরকুমার বসু, “নেতাজি’স আন্ডারগ্রাউন্ড ইন ইন্ডিয়া ডিউরিং ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু: অ্যান অ্যাকাউন্ট বাই পারটিসিপ্যান্টস্ ইন আ ডেয়ারিং অ্যান্ড হিস্টোরিক আন্ডারটেকিং,” দি ওরাকল, ১, ২ নম্বর (এপ্রিল ১৯৭৯), ৭-১৪; শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৮৫), পৃ: ১৫৯-১৬৩; “দ্য ল্যান্ডিং অব দ্য ফলোয়িং এইট জাপানিজ এজেন্টস্ ফ্রম আ সাবমেরিন অন দ্য কাথিয়াবার কোস্ট অন দ্য নাইট অব ২২/২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৩”; নয়া দিল্লি থেকে ক্রিমিনেয়ার লিখছেন, কলম্বোয় ওয়ার এমারজেন্সি ডিপার্টমেন্ট-এর ম্যাকডোনাও-এর উদ্দেশ্যে, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪৪; “স্টেটমেন্ট অব কর্তার সিং”; জে সি উইলসন, “ল্যান্ডিং অব জাপানিজ এজেন্টস্”; এ ডব্লিউ ম্যাকডোনাল্ড, “দ্য জে আই এফ ল্যান্ডিং ইন কাথিয়াবার, ডিসেম্বর ১৯৪৩”; ডি স্টিফেন্স, “দ্য ১৯৩৯-১৯৪৫ ওয়ার অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান পুলিস”; প্রতিটি আছে ম্যানাস্ক্রিপ্টস্ ই, ফাইল ২৭৬/ আই এন এ (এন এ আই), উইলসন অনওয়ার্ড, ম্যানাস্ক্রিপ্টস্ ইইউআর. এফ১৬১/৬/৩ (আই ও আর, বি এল); ই ডব্লিউ ওয়েস, “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি” (“ইন্ডিয়ান পুলিস কালেকশন,” ম্যানাস্ক্রিপ্টস্ ইইউআর. এফ১৬১/৬/৩) (আই ও আর, বি এল); রিচার্ড টটেনহ্যাম, “এক্সট্র্যাক্ট ফ্রম হোম ডিপার্টমেন্ট ওয়ার হিস্ট্রিজ” (“ইন্ডিয়ান পুলিস কালেকশন,” ম্যানাস্ক্রিপ্টস্ ইইউআর. এফ১৬১/৪/৪) (আই ও আর, বি এল)।
৫৭. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ১৫৯।
৫৮. ইয়ং ইন্ডিয়া (সিঙ্গাপুর), ৪৬ (১৬ জানুয়ারি, ১৯৪৪), উদ্ধৃত রয়েছে ঘোষ, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, পৃ: ১৭১।
৫৯. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ৯৯-১০০, ১১০।
৬০. তদেব, পৃ: ১০১-১০৪।
৬১. তদেব, পৃ: ১১৪-১২০; ঘোষ, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, পৃ: ১৭৪-১৭৫।
৬২. “হোমেজ টু দ্য মাদার অব দি ইন্ডিয়ান পিপল” (শ্রীমতী কস্তুরবা গাঁধীর মৃত্যুতে দেওয়া বিবৃতি, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১৯০-১৯১।
৬৩. গর্ডন, ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ, পৃ: ৫১১।
৬৪. “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ইন অ্যাকশন” (আই এন এ-র উদ্দেশ্যে নেতাজির বক্তৃতা এবং বিবৃতি, ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস) বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১৭৩-১৮৯।
৬৫. ঘোষ, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, পৃ: ১৭৮; “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩৮৮-৩৯০; এ সি চ্যাটার্জি, ইন্ডিয়া’জ স্ট্রাগ্ল ফর ফ্রিডম (কলকাতা: চক্রবর্তী, ১৯৪৭), পৃ: ১৬৩-১৭৩।
৬৬. গর্ডন, ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ, পৃ: ৫১০।
৬৭. ভুলাভাই দেশাই, “অ্যাড্রেস অব কাউন্সেল ফর ডিফেন্স,” পৃ: ৪২।
৬৮. বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ১৯৭; টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১০৯।
৬৯. এস উডবার্ন কার্বি, দ্য ওয়ার এগেনস্ট জাপান: দ্য ডিসাইসিভ ব্যাট্লস্ (লন্ডন: ইউ কে মিলিটারি সিরিজ থ্রি, ১৯৬১), পৃ: ৪৪৬; টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১০৯।
৭০. আলফ্রেড টিরনয়ার, “ইন্ডিয়া’জ উড-বি ফ্যুয়েরার,” স্যাটারডে ইভনিং পোস্ট, ১১ মার্চ, ১৯৪৪, পৃ: ২২।
৭১. জন ডব্লিউ গার্বার, “ইন্ডিয়া’জ উড-বি কুইসলিং,” দ্য নেশন, ২২ এপ্রিল, ১৯৪৪।
৭২. “রেনিগেড’স রিভেঞ্জ,” টাইম, ১৭ এপ্রিল, ১৯৪৪।
৭৩. সুভাষচন্দ্র বসু, ব্রহ্মচারী কৈলাসম্কে লেখা চিঠি, ১৬ এপ্রিল, ১৯৪৪, বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪১৭।
৭৪. টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১০৯-১১০; খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১১৩-১১৪।
৭৫. ঘোষ, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, পৃ: ১৮১-১৮৪।
৭৬. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৫৫-১৫৬; এম জেড কায়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, পৃ: ১০৭-১১৭।
৭৭. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৪৮-১৪৯।
৭৮. টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১১০-১১১।
৭৯. তদেব, পৃ: ১১৪; “স্বামী: নোটস্ টেক্ন ইন সিঙ্গাপুর, সেপ্ট./অক্ট. ১৯৪৫, হোয়েন স্বামী কেম টু টি” (টি এন এ)।
৮০. টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১১৪।
৮১. “ফাদার অব আওয়ার নেশন” (মহাত্মা গাঁধীর প্রতি বার্তা, ৬ জুলাই সম্প্রচারিত, ১৯৪৪) বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ২১২-২২২; টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১১৭; আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ২৫৬।
৮২. “দ্য গ্রেট পেট্রিয়ট অ্যান্ড লিডার” (বাহাদুর শাহ্-র সমাধিতে বক্তৃতা, ১১ জুলাই, ১৯৪৪), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ২৪৯-২৫৩।
৮৩. কৃষ্ণা বসু, প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র, পৃ: ৭২-৮১; নাগা সুন্দরম্-এর সঙ্গে লেখকের কথোপকথন, ১৯৯৭।
৮৪. আবিদ হাসান, দ্য মেন ফ্রম ইম্ফল (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৭১), পৃ: ১-৬; খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৫১-১৫৭।
৮৫. উইলিয়াম স্লিম, ডিফিট ইনটু ভিক্টরি (লন্ডন: কাসেল, ১৯৫৬), পৃ: ১৫০-১৫১।
৮৬. হাসান, মেন ফ্রম ইম্ফল, পৃ: ১-১২; খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৫৮-১৫৯।
৮৭. “আওয়ার ব্যাপটিজম অব ফায়ার” (সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি, ২১ অগস্ট, ১৯৪৪), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ২৬৪-২৬৫; খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৬২-১৬৩।
৮৮. হাসান, মেন ফ্রম ইম্ফল, পৃ: ৭-৯।
৮৯. তদেব, আরও দ্রষ্টব্য, রাজা মুহাম্মদ আরশাদ, “দ্য রিট্রিট” (রেড ফোর্টে লেখা, অক্টোবর ১৯৪৫), দি ওরাকল, ১৬, ৪ নম্বর (অক্টোবর ১৯৯৪), ১-৫৬।
৯০. হাসান, মেন ফ্রম ইম্ফল, পৃ: ১১; টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১২১; কৃষ্ণা বসু, প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র, পৃ: ৫১।
৯১. “সার্ভে অব ফরেন ইন্টেলিজেন্স অ্যাক্টিভিটিস্ ডাইরেক্টেড এগেনস্ট ইন্ডিয়ান সিকিয়োরিটি, ডেটেড অক্টোবর ২, ১৯৪৪,” ডব্লিউ ও ২০৮/৮২৯ (টি এন এ)।
৯২. ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ২৯৬।
৯৩. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৬১; “উইকলি ইন্টেলিজেন্স সামারি নং ১৫০, সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৪৪,” উদ্ধৃত হয়েছে ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ২৯৮।
৯৪. “দ্য ল্যান্ডিং অব দ্য ফলোয়িং এইট জাপানিজ এজেন্টস্ ফ্রম আ সাবমেরিন অন দ্য কাথিয়াবার কোস্ট অন দ্য নাইট অব ২২/২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৩”; নয়া দিল্লি থেকে ক্রিমিনেয়ার লিখছেন, কলম্বোয় ওয়ার এমারজেন্সি ডিপার্টমেন্টের ম্যাকডোনাও-এর উদ্দেশ্যে, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪৪; “স্টেটমেন্ট অব কর্তার সিং”; ফাইল ২৭৬/আই এন এ (এন এ আই); জে সি উইলসন, “ল্যান্ডিং অব জাপানিজ এজেন্টস্”; এ ডব্লিউ ম্যাকডোনাল্ড, “দ্য জে আই এফ ল্যান্ডিং ইন কাথিয়াবার, ডিসেম্বর ১৯৪৩”; প্রতিটি রয়েছে ম্যানুস্ক্রিপ্টস্ ইইউআর. এফ১৬১, বক্স ৬, ফাইল ৩ (আই ও আর, বি এল), উইলসন থেকে শুরু।
৯৫. শিশিরকুমার বসু, দ্য গ্রেট এসকেপ, পৃ: ৪৯-৫১, ৬৪-৭২; কাবুল থেকে জার্মান মন্ত্রী পিলগার লিখছেন বার্লিনের উদ্দেশ্যে, ৪ মে, ১৯৪৪ (জি এফ ও); ই এইচ লে ব্রক, “বেঙ্গল পুলিস অ্যাট ওয়ার” (“ইন্ডিয়ান পুলিস কালেকশন,” ম্যানুস্ক্রিপ্টস্ ইইউআর. এফ১৬১/৫/৩) (আই ও আর, বি এল)।
৯৬. “সাসপেক্টেড এনিমি অ্যাক্টিভিটিস্: এক্সট্র্যাক্ট ফ্রম হোম ডিপার্টমেন্ট ওয়ার হিস্ট্রিজ, ডেটেড জানুয়ারি ২৩, ১৯৪৫, বাই স্যার রিচার্ড টটেনহ্যাম, অ্যাডিশনাল হোম সেক্রেটারি,” ম্যানাস্ক্রিপ্টস্ ইইউআর. এফ১৬১, বক্স ৯, ফাইল ৩ (আই ও আর, বি এল)।
৯৭. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ২৬৫-২৬৬।
৯৮. “দ্য হিউম্যান স্পিরিট ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান স্টিল অ্যান্ড আর্মার” (“আর্মি ডেতে সম্প্রচারিত,” ১৮ অক্টোবর, ১৯৪৪), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ২৬৯-২৭৫।
৯৯. এম জেড কায়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, পৃ: ১৩৭-১৪৪; এ সি চ্যাটার্জি, ইন্ডিয়া’জ স্ট্রাগ্ল ফর ফ্রিডম, পৃ: ২৫১; আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ১৬; কৃষ্ণা বসু, চরণরেখা তব, পৃ: ৭৯।
১০০. “দ্য ফান্ডামেন্টাল প্রবলেমস্ অব ইন্ডিয়া” (টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ, নভেম্বর ১৯৪৪), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ২৮৫-৩০১।
১০১. এম জেড কায়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, পৃ: ১৪১। কে জি বি মহাফেজখানায় রাখা বসুর বার্তার রুশ অনুবাদ।
১০২. উদ্ধৃত রয়েছে টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১২৯; সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রী রামা মূর্তিকে লেখা চিঠি, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৪৪, বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪৪৩-৪৪৪।
১০৩. সুভাষচন্দ্র বসু, আই এন এ শিক্ষার্থীদের লেখা চিঠি, ২৯ নভেম্বর, ১৯৪৪, বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪৩৭।
১০৪. সুভাষচন্দ্র বসু, আই এন এ শিক্ষার্থীদের লেখা চিঠি, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৪৪, তদেব, পৃ: ৪৪২।
১০৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এম সত্যবতী থেভরকে লেখা চিঠি, ১৪ মে, ১৯৪৪; তদেব, ১৮ জুন, ১৯৪৪; তদেব, ২১ জুন, ১৯৪৪; তদেব, ৪ অগস্ট, ১৯৪৪; তদেব, ১৯ অগস্ট, ১৯৪৪; তদেব, ২১ মে, ১৯৪৫; তদেব, ২২ মে, ১৯৪৫; প্রতিটি তদেব, পৃ: ৪১৮-৪২০, ৪২২-৪২৩, ৪২৮-৪৩২, ৪৪৭-৪৪৯।
১০৬. ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ৫৫৬।
১০৭. “ইন্ডিয়া অ্যান্ড তাইল্যান্ড: স্পিচ বাই প্রাইম মিনিস্টার অব তাইল্যান্ড অ্যাট ডিনার ইন অনর অব নেতাজি,” ১৬ জানুয়ারি, ১৯৪৫, ফাইল ৩২২/আই এন এ (এন এ আই)।
১০৮. ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ৩১৪-৩২৯; “স্বামী: নোটস্ টেক্ন ইন সিঙ্গাপুর, সেপ্ট./অক্ট. ১৯৪৫, হোয়েন স্বামী কেম টু টি” (টি এন এ)।
১০৯. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ২০৩-২০৯।
১১০. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৭৬-১৭৮; গুরবক্স সিং ধিলোঁ, দ্য “নেহরু হোল্ডস্ দি ইরাওয়াডি,” দি ওরাকল, ৫, ৪ নম্বর (অক্টোবর ১৯৯৩), ১-৩০।
১১১. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৭৮-১৮১; ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, আলোচনাও দ্রষ্টব্য, পৃ: ৩৩৩-৩৩৪।
১১২. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৮১-১৮৩।
১১৩. তদেব, পৃ: ১৮৩-১৮৪; ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ৩৩৬-৩৪১।
১১৪. খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ১৮৪।
১১৫. গুরবক্স সিং ধিলোঁ, “দি ইন্দো-বার্মান রিলেশনস্ ডিউরিং ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু,” দি ওরাকল, ৭, ৩ নম্বর (জুলাই ১৯৮৫), ১৫-২২। “অং সান’স্ রিপ্লাই টু দি অ্যাড্রেস অব শরৎ চন্দ্র বোস, ১৯৪৬,” শিশিরকুমার বসু (সম্পাদিত), নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৭৪), পৃ: ৬৯-৭৫।
১১৬. “ব্রেভারি অ্যান্ড কাওয়ার্ডিস” (বিবৃতি, ১৩ মার্চ, ১৯৪৫), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৩১৪-৩১৬।
১১৭. ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ৩৫৪-৩৫৮, ৩৯৯; খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ২১৮-২২০।
১১৮. হাসান, দ্য মেন ফ্রম ইম্ফল। আরও দ্রষ্টব্য, ধিলোঁ, “দ্য নেহরু হোল্ডস্ দি ইরাওয়াডি,” দি ওরাকল, ৫, ৪ নম্বর (অক্টোবর ১৯৯৩), ১-৩০।
১১৯. ফে, দ্য ফরগটন আর্মি, পৃ: ৩৫৯-৩৬০; খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ২২৯-২৩২।
১২০. “এন্ড অব আ ড্রিম’ (রেঙ্গুন থেকে ব্যাঙ্ককের উদ্দেশ্যে নেতাজির যাত্রাকালের বার্তা, ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৫), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৩১৭-৩১৮।
১২১. “দ্য ফিউচার জেনারেশনস্ অব ইন্ডিয়ানস্ উইল ব্লেস ইয়োর নেমস্” (সেই দিনের বিশেষ নির্দেশ, ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৫), তদেব, পৃ: ৩১৯-৩২০।
১২২. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ১৪-১৬; আর এম আরশাদ, “নেতাজি ওরেশন ১৯৯৬,” দি ওরাকল, ২৮, ২ নম্বর (এপ্রিল ১৯৯৬), ৭-১৫; টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১৪৬-১৪৭।
১২৩. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ১৭-১৮।
১২৪. তদেব, পৃ: ২৩।
১২৫. ডায়রি, জানকী থেভর, উদ্ধৃত হয়েছে খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ২৩৯-২৪৪।
১২৬. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ২৫।
১২৭. কিয়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, পৃ: ১৫৪-১৫৬।
১২৮. ডায়রি, জানকী থেভর, উদ্ধৃত হয়েছে খান, মাই মেমরিজ, পৃ: ২৪৫-২৪৬।
১২৯. “উই ফাইট অন” (ব্যাঙ্ককে দেওয়া বক্তৃতা, ২১ মে, ১৯৪৫), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৩২১-৩২২।
১৩০. উইলিয়াম স্লিম, ডিফিট ইনটু ভিক্টরি (লন্ডন: কাসেল, ১৯৫৬)।
১৩১. “উই ফাইট অন,” বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৩২৪।
১৩২. তদেব, পৃ: ৩২৪-৩২৫।
১৩৩. সুভাষচন্দ্র বসু, ব্রহ্মচারী কৈলাসম্কে পাঠানো চিঠি, ১০ জুন, ১৯৪৫, বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪৫০।
১৩৪. “উই ফাইট অন,” তদেব, পৃ: ৩২৬।
১৩৫. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৪২-৪৬; কিয়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, ১৫৭-১৫৯; টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ১৫৫।
১৩৬. “কোঅপারেশন উইথ জাপান,” বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৩৮৫-৩৮৯।
১৩৭. “লিবার্টি অর ডেথ” (সিঙ্গাপুরের বক্তৃতা, ৪ জুলাই, ১৯৪৫), তদেব, পৃ: ৪০৩-৪০৫; আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৪১।
১৩৮. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৪৮-৫৫।
১৩৯. তদেব, পৃ: ৫৫-৫৭।
১৪০. তদেব, পৃ: ৫৮-৫৯; এফ মুডি, ই জেনকিন্সকে লেখা চিঠি, ২৩ অগস্ট, ১৯৪৫, ওয়াভেল পেপারস্, নিকোলাস মানসার্গ (সম্পাদিত), দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ষষ্ঠ খণ্ড (লন্ডন: এইচ এম জি, ১৯৭০-১৯৮৩), ৫৭ নম্বর নথি, পৃ: ১৩৭-১৪০।
১৪১. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৫৯।
১৪২. তদেব, পৃ: ৫৯-৬১; সিরিল জন স্ট্রেসি, “হাও আই কেম টু জয়েন দি আই এন এ,” দি ওরাকল, ৪, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮২), ৫৩-৫৬।
১৪৩. “দ্য রোডস্ টু দিল্লি আর মেনি,” বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪০৭-৪০৮।
১৪৪. “ইন্ডিয়া শ্যাল বি ফ্রি” (মালয়, তাইল্যান্ড, ইন্দো-চিন, জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিয়ো, ফিলিপিন্স, জাপান, এবং পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশের ভারতীয়দের প্রতি বিশেষ বার্তা, ১৫ অগস্ট, ১৯৪৫), বসু, চলো দিল্লি, পৃ: ৪০৯-৪১০।
১৪৫. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৬১-৬২; কিয়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, পৃ: ১৬২-১৬৩।
১৪৬. কিয়ানি, ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল, পৃ: ১৬৩-১৬৪।
১৪৭. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৬৩-৬৪।
১৪৮. তদেব, পৃ: ৬৪-৬৫; কৃষ্ণা বসু, চরণরেখা তব, পৃ: ১৭১-১৭৩।
১৪৯. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৬৬-৭১; আবিদ হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” (টেপ করা সাক্ষাত্কার, এন আর বি); ইসোদা সাবুরো, “নেতাজি অ্যাজ আই নিউ হিম,” দি ওরাকল, ৮, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮৬), ১১-১৫; “বোস অ্যান্ড জাপান,” জাপান বিদেশমন্ত্রক, শিশিরকুমার বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৪১৪-৪১৬; কৃষ্ণা বসু, প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র, পৃ: ৫২-৫৬; কৃষ্ণা বসু, চরণরেখা তব, পৃ: ১৮১-১৮৬।
১৫০. আইয়ার, আনটু হিম আ উইটনেস, পৃ: ৭১-৭২।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন