ইউরোপে নির্বাসন

ইউরোপে নির্বাসন

আমার দেশ আমায় ডাকছে— আমার কাজ আমায় ডাকছে— তোমাকে ছেড়ে এ বার আমায় ফিরে যেতে হবে আমার প্রথম প্রেম— আমার দেশের কাছে।

—সুভাষচন্দ্র বসু, বাডগাস্টাইন থেকে এমিলি শেঙ্কলকে লেখা, অস্ট্রিয়া, মার্চ ১৯৩৬

.

ভিয়েনা— এক সময়কার ঝকঝকে মহানগর, বহুসংস্কৃতি-সমৃদ্ধ বিশালকায় অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী। প্রথম মহাযুদ্ধের পর এই শহরের গৌরব বহুলাংশে অস্তমিত। আকারে ছোট, চারদিকে অন্যান্য দেশ দিয়ে ঘেরা, কৃষিভিত্তিক দেশের রাজধানীতে পরিণত তখন সেই শহর। শতাব্দী-শেষের বিপুল গৌরবের শেষ আঁচে ভিয়েনার পুরনো বুর্জোয়া উচ্চ সংস্কৃতির সর্বোত্তম নিদর্শনসমূহ তখন পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করছে তরুণ আভাঁ-গার্দ সংস্কৃতির সঙ্গে। ভিয়েনার দুই বিখ্যাত শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট ও এগোন শিয়েল-এর মৃত্যুর পর ১৯১৮ সাল সেখানে ঘোষণা করছে একটি যুগের অবসান। মনোবিশ্লেষণের পিতৃসম পুরুষ সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর জন্মস্থান ভিয়েনা নিজেই যেন তখন এক রকমের মানস-তাড়নার শিকার, সাম্রাজ্য থেকে জাতিরাষ্ট্রে নিজেকে পরিবর্তিত করার তাড়না— ঔপন্যাসিক রবার্ট ম্যুজিল-এর লেখায় যে ‘ট্রমা’ ধরা পড়েছে অসামান্য ভাবে। দানিয়ুব নদীর ধারে সেই নয়নাভিরাম কিন্তু উৎকণ্ঠিত শহরটিতে সুভাষচন্দ্র এসে পৌঁছলেন ১৯৩৩ সালের মার্চে। এ তাঁর রাজনৈতিক নির্বাসন, উপনিবেশের জেলে থাকার সময়ে তাঁর যে অসুস্থতা শুরু হয়, তার চিকিৎসার সন্ধানে, আর তার সঙ্গে ইউরোপের মাটিতে বসে কোনও ভাবে নিজের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথসন্ধানের নিহিত লক্ষ্যে।

১১ মার্চ ফুর্থ স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি করা হল তাঁকে, এক্স-রে ও অন্যান্য ডাক্তারি পরীক্ষাও হল। মান্দালয় জেলে তাঁকে বেশ গুরুতর ধরনের ব্রঙ্কিয়াল নিউমোনিয়ায় ধরেছিল, ডাক্তাররা সন্দেহ করছিলেন যে কিছু সঙ্গী বন্দির সংস্পর্শে তাঁর যক্ষ্মা সংক্রমণও হয়ে থাকতে পারে। তার উপর সম্প্রতি ভয়ানক পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন, মনে হচ্ছিল গলব্লাডারের পাথর জমার কারণেই সেই ব্যথা। ভিয়েনার চিকিৎসার মান অত্যন্ত ভাল। বুক ও পেটের সংক্রমণ পুরোটা না সারলেও সুভাষ অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলেন, বিশেষ করে বিগত বছরটিতে ক্রমাগত এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত হওয়ার ক্লান্তি ও কষ্ট অনেকটাই দূর হল। তাঁর পাসপোর্টে লেখা ছিল অস্ট্রিয়া, ইতালি, সুইটজারল্যান্ড ও ফ্রান্সে তিনি যেতে পারেন, কিন্তু ব্রিটেন বা জার্মানি যাওয়া চলবে না। ব্রিটিশ দাবি অনুসারে, “কোন্ কোন্ দেশে যাওয়া যাবে না, পাসপোর্টে সেটা লিখে দেওয়ার যথেষ্টই চল ছিল তখন।” কেবলমাত্র স্বাস্থ্যের কারণেই তাঁকে ইউরোপে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কেননা যে কারণে তাঁকে বন্দি করা হয়েছিল, সেই কারণটি তখনও ততটাই জরুরি শাসকদের চোখে— “বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংযোগ।” বিপ্লবীদের প্রতি সুভাষের সহানুভূতিকে অতিরঞ্জিত করে ব্রিটিশরা তখন রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত তাঁর সত্যিকারের ইচ্ছা বা লক্ষ্য বিষয়ে।

অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সুভাষ শীঘ্রই ইউরোপ মহাদেশে এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়িয়ে ভারতের স্বাধীনতার ইচ্ছা প্রচার করতে শুরু করে দিলেন। সব সময়েই তাঁর মনে হত, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভূমিকাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। এ বার তিনি নিজেই সেই ভুল সংশোধনের কাজে নামলেন। স্বাস্থ্য বারংবার বাগড়া দেওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী তিন বছর তিনি ক্লান্তিহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালেন, ভারতীয় ছাত্রদের বাইরে পড়াশোনা করতে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন, নানা রকম সংগঠন তৈরি করে ভারতের সঙ্গে নানা ইউরোপীয় দেশের মিত্রতা তৈরির চেষ্টা করলেন, যেখানে পারলেন সরকারি বেসরকারি নেতৃস্থানীয় মানুষদের সঙ্গে দেখা করলেন, ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালালেন। বিদেশে যে ভারতীয়রা রয়েছেন, তাঁরা যেন তাঁদের ব্রিটিশ-পদাবনত দেশের হয়ে নিজ নিজ উদ্যোগেই দূতের ভূমিকা পালন করেন, চাইতেন সুভাষ। কী ভাবে সে কাজ করা যায়, নিজেই তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তাঁর জন্য এই সময়কালটা জঙ্গি নেতা থেকে ক্রমে এক জন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠার পর্ব।

১৯৩০-এর দশকের ইউরোপে তখন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের, ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কমিউনিজমের পারস্পরিক লড়াই চলছে। সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্রকে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে চলাটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তার জন্য দরকার ছিল অত্যন্ত সতর্ক নৈতিক অবস্থান, এবং ক্ষমতার সংঘর্ষের বাস্তব সম্পর্কে প্রখর বোধ। বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দায় ইউরোপীয় শহরগুলির সমাজে রাজনীতিতে তখন দিকে দিকে জাতিবিদ্বেষের ফুলকি। সংখ্যালঘু সমাজগুলির জন্য বড় ভয়ানক সময়— দেশের যত দুর্দশা, যত হতাশা, সব কিছুর কারণই যেন তাঁরা। জার্মানিতে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শাসন শুরু হয়েছে তখন, অবশ্য গণতান্ত্রিক পথেই এসেছে সেই শাসন। সম্প্রতি শেষ হয়েছে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ, কিন্তু আবারও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অস্ত্রীকরণের প্রতিযোগিতা, আরও অনেক বড় ধ্বংসপর্বের দিকে দৌড়োচ্ছে গোটা ইউরোপ। এই বিশ্বব্যাপী তাণ্ডবের সঙ্গে যে উপনিবেশ দুনিয়ার ভাগ্যও একান্ত ভাবে জড়িত, ইউরোপের প্রজাসমাজগুলি তা ভালই জানত। তাঁদের নিজেদের স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন জড়িয়ে গিয়েছে নানা প্রকারের নানা রঙের কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে। নিজের দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার স্বপ্নে প্রোজ্জ্বল কোনও এশীয় ভাগ্যান্বেষীর কাছে সে দিনের ইউরোপ ছিল সুকঠিন ঠাঁই।

ভারতের বার্তাবহ দূত

১৯৩৩ সালের এপ্রিলে সুভাষ এক বন্ধুকে লিখলেন, “জীবনের একটি অধ্যায় শেষ। আর একটি নতুন অধ্যায় শুরুর চেষ্টায় আছি।” বহুদূরের শহর ভিয়েনায় বসেও সে দিন তাঁর ‘সাধনা’ একটিই, ভারতের মতো একটি “অর্ধজাগ্রত দেশ”কে কী ভাবে স্বাধীন করা যায়, নিজের পায়ে দাঁড় করানো যায়। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য তাঁকে প্রয়োজনে সর্বস্ব ত্যাগ করতে হবে, একাকী জীবন যাপন করতে হবে। তিনি যেন “একাকিত্বের বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে” বিচরণশীল “নিঃসঙ্গ যাত্রী”, গাইছেন “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।” ভিয়েনার হাসপাতালে ভাগ্যক্রমে সুভাষ এক সমব্যথীকে পেলেন, তিনিও তাঁর স্বদেশের জন্য একই রকম উদ্বেল, নিবেদিতপ্রাণ। এঁর নাম বিঠলভাই প্যাটেল। মোতিলাল নেহরু ও সুভাষের গুরু স্বর্গত চিত্তরঞ্জন দাশের প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ পার্টির অন্যতম নেতা এই প্যাটেল। আমেরিকা থেকে সদ্য তিন মাসের সফর শেষ করে ফিরেছেন দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভার এক কালের সভাপতি বিঠলভাই প্যাটেল। মার্কিনি লেখক রেভারেন্ড জে টি সান্ডারল্যান্ডের সঙ্গে পত্রালাপে সুভাষ এই বর্ষীয়ান্ নেতার স্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। প্রসঙ্গত, এই সান্ডারল্যান্ডই ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ বইটির লেখক, যে বই ব্রিটিশ সরকার ভারতে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়। বিঠলভাই-এর ছোট ভাই বল্লভভাই প্যাটেল তখন গুজরাতে গাঁধীর বিশ্বস্ত সেনাপতি, কিন্তু বিঠলভাই-এর মন জয় করে নিল বাংলার এই তরুণটির বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা। ১৯৩৩-এর মে মাসে গাঁধী যখন আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করেছিলেন এঁরা দু’জনেই তাতে অত্যন্ত হতাশ বোধ করলেন, এবং যুগ্ম ভাবে একটি কড়া বক্তব্য লিখে ফেললেন। এরই নাম প্যাটেল-বোস ম্যানিফেস্টো, যার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য নতুন র‌্যাডিক্যাল নেতৃত্বের আহ্বান।

লন্ডনে ১৯৩৩ সালের ১০ জুন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল কনফারেন্স-এর তৃতীয় অধিবেশন, সেখানে সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হল সুভাষচন্দ্রের কাছে। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য লন্ডন শহর ও সেখানকার বিরাট ভারতীয় ছাত্রসমাজের থেকে সুভাষকে দূরে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক সেই সময়, ফলে সুভাষ ধরে নিলেন, ব্রিটেনে যেতে হলে তাঁর বিশেষ অনুমতি দরকার হবে। ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক তেমন ছিল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা হিসেবে তিনি পাসপোর্টের অধিকারী, কোনও ভাবেই তাঁকে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া যায় না। তবে যাতে সুভাষের এই ভুল ভাঙানো না হয়, ব্রিটিশ কর্তারা এই মর্মে সব দূতাবাস ও কনসুলেট-এ নির্দেশ পাঠিয়ে দিলেন। সুতরাং তাঁর ধারণা হল সাম্রাজ্যের রাজধানীতে যাওয়ার অনুমতি তিনি পাননি। আর তাই তাঁর লিখিত বক্তৃতা ‘দি অ্যান্টি-ইমপিরিয়ালিস্ট স্ট্রাগল্ অ্যান্ড সাম্যবাদ’ তাঁর অনুপস্থিতিতেই লন্ডনের সভায় পঠিত হল। এই বক্তৃতায় পাওয়া গেল ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত গাঁধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনসমূহের প্রশংসা ও সমালোচনা, একই সঙ্গে।

১৯২০ সালে যে গাঁধী একেবারে ঠিক পদ্ধতিতেই আন্দোলন শুরু করেন এবং গোটা দেশকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন, এ কথা সুভাষ স্বীকার করলেন। তবে তাঁর মতে, গাঁধীর এই আন্দোলন যথেষ্ট সংগ্রামীও নয়, আবার যথেষ্ট কূটবুদ্ধিচালিতও নয়। ১৯২২ এবং ১৯৩৩, দুই সময়েই গাঁধী একেবারে ভুল সময়ে, ভুল ভাবে আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছেন। সুভাষ নিজস্ব লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেন এখানে— সেই লক্ষ্য হল সাম্যবাদ। সমাজতন্ত্রের পথে ইউরোপের নানা পরীক্ষানিরীক্ষা তাঁকে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করলেও নিজের সমাজতান্ত্রিক ভাবনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজে তিনি প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধধর্মের তুলনা টানতেই পছন্দ করতেন, যেখানে ভারতের নিজস্ব সামাজিক প্রেক্ষিতে এক ধরনের সমাজবাদী আদর্শ রূপ পরিগ্রহ করেছিল, ঐক্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে সাম্যের নীতি তৈরি হয়ে উঠেছিল। “সাম্য কথাটির অর্থ ‘সম-তা’,” এক তরুণ ইউরোপীয় সংলাপ-সহায়ককে বোঝালেন তিনি। “আর সাম্যবাদী-র অর্থ ‘যে সেই সম-তায় বিশ্বাস করে।’ সাম্যের এই ধারণা বহু প্রাচীন ভারতীয় ধারণা, খ্রিস্টের জন্মেরও পাঁচশো বছর আগে বৌদ্ধরা এই ধারণা প্রচার করে। তাই, এখনকার ইউরোপের আধুনিক নামসমূহের বদলে এই নামটিই আমার বেশি পছন্দের।” এই লন্ডন বক্তৃতার শেষে ছিল তাঁর দৃঢ় অনুপ্রেরণাময় বিশ্বাস যে বিশ্ব-ইতিহাসে ভারত এক দিন তার বিশেষ স্থান অর্জন করবেই। ইংল্যান্ডের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা, সপ্তদশ শতকে এখান থেকেই সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল, ফ্রান্সকে কৃতজ্ঞতা তার দুনিয়া-পাল্টানো অষ্টাদশ শতকীয় ধারণা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার জন্য, জার্মানিকে কৃতজ্ঞতা ঊনবিংশ শতকে মার্ক্সীয় দর্শন উপহার দেওয়ার জন্য, রাশিয়াকে কৃতজ্ঞতা শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব ঘটিয়ে বিংশ শতককে পাল্টে দেওয়ার জন্য। “সভ্যতা-সংস্কৃতির জগতে এর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি আসবে ভারত থেকে,” ঘোষণা করলেন তিনি।

এই বক্তৃতা বারো পাতার প্যামফ্লেট হিসেবে ছাপা হল লন্ডনের যে প্রকাশনা থেকে, যথার্থ ভাবেই তার নাম ইউটোপিয়া প্রেস। ‘সি কাস্টমস অ্যাক্ট’-এর ধারা অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই প্যামফ্লেটের কপি ভারতে ঢুকতে দেওয়া হল না। ব্রিটিশ দৃষ্টিতে, “ভারতের ভবিষ্যৎ বিপ্লবের লেনিন হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন সুভাষ।” সাম্যবাদী সঙ্ঘ বলে এক প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা বলেছেন, যার সাহায্যে তিনি নাকি তাঁর সাম্যবাদ-এর বার্তা প্রচার করবেন। এই “নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান” এবং তার “সংগ্রামী বার্তা”কে নিষিদ্ধ করার কথা বলছিলেন অনেক ঔপনিবেশিক কর্তাই, কিন্তু এক জন সুবিবেচক কর্তা মনে করিয়ে দিলেন, “এই বক্তৃতাটির বাইরে এবং সুভাষচন্দ্রের নিজের মস্তিষ্কের বাইরে এমন কোনও সঙ্ঘ যে সত্যিই অস্তিত্বশীল, সেটা প্রমাণ করার মতো কোনও তথ্যই কিন্তু নেই” সরকারের কাছে। সুতরাং এই কাল্পনিক সংগঠন নিষিদ্ধ করার ধারণা বাতিল হল।

পুরনো ও নতুনের মধ্যে সমন্বয়ের বাসনায় সুভাষ ইউরোপের সামাজিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারগুলি থেকে শিক্ষা নিতে উদ্গ্রীব ছিলেন। যেমন, ভিয়েনায় বারো বছরেরও বেশি সময় ধরে পৌর স্তরে যে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি সুষ্ঠু ভাবে প্রযুক্ত হয়ে আসছে, তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ভিয়েনার সমাজবাদী মেয়রের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি, কলকাতার মেয়রকে অনুরোধ জানালেন ভিয়েনার এই মডেল অনুসরণ করতে। গৃহনির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিয়েনার অগ্রগতি লক্ষ করলেন। বিশেষ করে এই সমাজতান্ত্রিক পুরব্যবস্থা যে কোনও ঋণ গ্রহণ না করেই নানাবিধ বিলাসব্যসন ও বিনোদনের উপর কর বসিয়ে প্রায় দুই লক্ষ মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা করতে সক্ষম হয়েছে, তাতে তিনি বিস্মিত বোধ করলেন। শিশু বিদ্যালয়গুলিতে দেখলেন, এমনকী দরিদ্র পরিবারের শিশুদেরও কী ভাবে যত্ন নেওয়া হয়, বাবা-মায়েরা কাজে বেরিয়ে গেলেও তাদের শিক্ষার সব রকম ব্যবস্থা করা হয়। ভিয়েনায় তাঁর বন্ধুত্ব হল নাওমি ভেটারের সঙ্গে। সুভাষের বক্তৃতাগুলি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন নাওমি। তাঁর স্বামী সরকারি অফিসার, দুটি নাট্যগৃহের পরিচালক— তাঁর সঙ্গেও বন্ধুত্ব হল সুভাষের। বন্ধু দিলীপ পরিচয় করিয়ে দিলে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হল হাঙ্গেরীয় গায়িকা হেডি ফুলপ-মিলারের সঙ্গেও, যিনি আবার লেখক রেনে ফুলপ-মিলারের স্ত্রী। এ ছাড়াও ছিলেন মার্কিনি বেটি হারগ্রোভ এবং ভিয়েনার বিভিন্ন নারী-সংগঠনের পরিচালিকা হেলেন আশকানাজি। অস্ট্রিয়ার সমাজ, প্রচারমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বৃত্তের সঙ্গে সুভাষের পরিচিতির ক্ষেত্রে ভীষণ সাহায্য করলেন এই সব বন্ধুরা। ১৯৩৩ সালে অস্ট্রিয়া তখন অতীতের সোশ্যালিজম এবং ভবিষ্যতের ফ্যাসিজমের মধ্যে ত্রিশঙ্কু। ভিয়েনার যা-কিছু সুভাষের মন কেড়েছিল, তার সবই এর পর দ্রুত নাৎসি বন্যায় ভেসে যাবে, প্রতিবেশী দেশ জার্মানি থেকে সেই বন্যা বইয়ে দেবেন এক জন অস্ট্রিয়ান মানুষই।১০

মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে দুটি দেশ সুভাষের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল: চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির জন্য চেকোস্লোভাকিয়া কী ভাবে ব্রিটেন ও রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে চেকোস্লোভাক সেনাবাহিনী গঠন করেছিল, খুঁটিয়ে জানলেন সুভাষ। জানলেন কেমন করে জাপানি সাহায্য নিয়ে পোলিশ বাহিনী রুশ দখল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছিল। কয়েক বছর পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তৈরির সময়ে এই উদাহরণগুলি দেবেন তিনি— কী ভাবে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দুর্বল দেশগুলির দরকারে লাগে শক্তিশালী দেশের সাহায্য। ১৯৩৩ সালের ২৯ জুন ভিয়েনা থেকে বিমানে প্রাগ এলেন। লিখলেন, “প্রাগ শহরটির অদ্ভুত সৌন্দর্য, পুরনো বাড়ি, মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য— তবে ভিয়েনা সত্যিই অতুলনীয়।” জাতীয় সংগ্রামের লক্ষ্যে অবশ্য তাঁর কাছে চেকোস্লোভাকিয়া অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, সন্দেহ নেই।

চেকোস্লোভাকিয়ার বিদেশমন্ত্রী এডুয়ার্ড বেনেস-এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কথোপকথন হল সুভাষের। টমাস মাসারিকের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে এই বেনেস চেকোস্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রাগের মেয়র সুভাষের সঙ্গে দেখা করলেন, শহরের দর্শনীয় স্থানগুলি, সেখানকার শিল্প পরিকাঠামো ঘুরিয়ে দেখানোর বন্দোবস্ত করে দিলেন। শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য মাসারিক হোম-টি খুব মন দিয়ে দেখলেন সুভাষ, দেখলেন প্রাগের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট। সেখানে আবার দেখা হল অধ্যাপক ভি লেসনির সঙ্গে, যিনি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে কিছু সময় কাটিয়ে এসেছেন। বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের জন্য চেকোস্লোভাকিয়ান-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করলেন লেসনি ও সুভাষ। পরের বছর সুভাষ প্রাগে ফিরলেন, তাঁদের এই দ্বিপাক্ষিক মৈত্রীর অ্যাসোসিয়েশনের শুভ সূচনা হল লবকোউইত্জ প্যালেস-এ, ১৯৩৪ সালের ৪ মে। জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র, দু’জনেরই বন্ধু ও সহকর্মী, কেরলের এ সি এন নাম্বিয়ার ১৯৩৩ সালে নাতসি জার্মানি থেকে বিতাড়িত হয়ে সেই সময়ে প্রাগে ছিলেন। চেকোস্লোভাকিয়ায় ভারতীয় ছাত্রদের সংগঠনের কাজে, কিংবা ওখানকার রাজনীতিক ও চিন্তাবিদদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজে তাঁর উপস্থিতি সুভাষের অনেক সাহায্য করল।১১

প্রাগের পোলিশ কনসাল তাঁর দেশে যাওয়ার ভিসা দিলেন সুভাষকে, আর সেখানকার ব্রিটিশ কনসালও অতশত না বুঝে তাঁর পাসপোর্টে পোল্যান্ড এবং ইউরোপীয় কন্টিনেন্টের অন্যান্য দেশ ভ্রমণের অনুমতি-ছাপ দিয়ে দিলেন। ব্রিটিশ কূটনীতির বড় কর্তারা লন্ডনে বসে এ খবর পেয়ে রেগে আগুন, এক জন এত তাবড় বিপ্লবীকে এ রকম স্বাভাবিক পদ্ধতিতে অনুমতি দেওয়ায় সেই কনসালকে ‘স্টুপিড’ গালি দিতে লাগলেন।১২ এ দিকে সুভাষ তো তখন ওয়ারস’-র রাস্তায় পদব্রজে “নতুন জীবনের হৃৎস্পন্দন” অনুভবে ব্যস্ত। পুরকর্তারা তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, মিউনিসিপ্যাল বেকারি ঘুরে দেখালেন যেখানে শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জন্য রুটি বানানো হয়। ওয়ারস’-র ফিজিক্যাল কালচার ইনস্টিটিউট তাঁকে মুগ্ধ করল, ইউরোপে এই ধরনের যা কিছু আছে, এটিই তার মধ্যে সর্ববৃহৎ, নবতম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত। ওয়ারস’-র ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল, বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হল। বিদগ্ধ সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক মিখালস্কির সঙ্গেও পরিচয় হল। পোল্যান্ড সফরে সুভাষ অনুপ্রাণিত বোধ করলেন, দেখতে পেলেন, কী ভাবে “কয়েক শতাব্দীব্যাপী অত্যাচার কাটিয়েও কোনও দেশ জেগে উঠতে পারে।”১৩

চেকোস্লোভাক ও পোলিশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আশ্চর্য করল তাঁকে। বড় বড় শক্তিমান জাতির পদচ্ছায়ায় ছোট জাতিগুলির এই সব সংকট ও স্বপ্নের সঙ্গে তিনি গভীর সমমর্মিতা অনুভব করলেন। শক্তিমান প্রতিবেশীর প্রবল রাজনৈতিক চাপের মুখে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার এই উদাহরণের মধ্যে সদর্থক নঞর্থক দু’রকম দিকই আছে, দেখলেন। দেখলেন, কী ভাবে ১৯১৪-১৯১৮ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এরা স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম তৈরি করেছে। এদের পথ ও প্রকরণ কি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব— ভাবলেন সুভাষ।

চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড সফর যেমন ভাল হল, জার্মানিতে তাঁর প্রথম সফরটি হল ততটাই হতাশাজনক। ১৯৩৩ সালের ১৭ জুলাই ওয়ারস’ থেকে বার্লিনে এলেন ট্রেনে। ইন্দো-জার্মান সোসাইটির তরুণ লিয়াজঁ অফিসার লোথার ফ্র্যাঙ্ক ফ্রিডরিশস্ট্রাসে ট্রেন স্টেশনে তাঁকে নিতে এলেন। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথকে যেখানে রাখা হয়েছিল, জার্মান সরকার সেখানেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে। সুভাষ রাজি হলেন না। নিজের খরচে বার্লিনের শার্লটেনবার্গ অঞ্চলে গ্র্যান্ড হোটেল অ্যাম নি-তে থাকতে মনস্থ করলেন।১৪ বার্লিন তখন প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ভারতের বিপ্লবীরা সেখানে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব তৈরি করে আসছেন। সুভাষ তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসরণে জার্মানির এই বড় শহরটিতেই থাকতে চান। এখন এ শহর অ্যাডলফ হিটলারের থার্ড রাইখ-এর রাজধানীতে পর্যবসিত, যে হিটলার কিন্তু মনে করেন, “অন্য কোনও শক্তির থেকে ব্রিটিশ শক্তির পদানত হিসেবে থাকাই ভারতের পক্ষে ভাল।”১৫

ব্রিটেনের সঙ্গে যতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক, নাত্সি জার্মানির কর্তাব্যক্তিরা ভারতের জন্য সমব্যথী হবেন এমনটা ভাবাই অবাস্তব। হিটলারের চোখে ব্রিটিশরা আরও উচ্চমার্গের জাতি, তবে ভারতের প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্যের কারণ কেবল গভীরপ্রোথিত জাতিবিদ্বেষই নয়। জার্মান ফুয়েরারের মধ্যে এক রকমের নির্দয় যুক্তিবাদিতাও ছিল, তাই তিনি মনে করতেন গোটা বিশ্বের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক দিন ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী আঁতাত প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।১৬ সুতরাং কেন যে সুভাষ জার্মানিতে পৌঁছে অসুখী বোধ করছিলেন, বোঝা কঠিন নয়। বার্লিনের মেয়রের সঙ্গে তাঁর এক বার সাক্ষাত্কারের সুযোগ ঘটল। জার্মান বিদেশ দফতরের কয়েক জন কর্তার সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। কিছুতেই কিছু হল না। মিউনিখের ডয়েশ অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর ফ্রান্জ থিয়েরফেল্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্দো-জার্মান সংযোগ কী ভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আলোচনা করলেন। এই প্রথম বার জার্মানিতে এক মাসেরও বেশি সময় কাটালেন তিনি, তার মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহ কাটল অসহ্য পেটের ব্যথায়, হয়তো গলব্লাডারেরই ব্যথা। ফল দাঁড়াল, কাজকর্মে ততটা সময় দিতে পারলেন না সে যাত্রা।১৭

বার্লিনেই তাঁর বন্ধুত্ব হল চেক ইহুদি তরুণী কিটি কুর্টির সঙ্গে। কিটি কুর্টি হেঁটে আসছিলেন কুরফুরস্টেনডাম ধরে, হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ল উল্টো দিক থেকে এক অদ্ভুত চেহারার মানুষ তাঁর দিকে আসছেন: “ছিপছিপে লম্বা মানুষ, অবশ্যই ভারতীয়। ঘন রঙের স্যুট পরনে, দেখলে কোনও ফাদার বলে ভুল হয়। ঘিয়ে রঙের ছোট গাঁধীটুপি মাথায়, সেটাই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। মুখটি ঘন অলিভ-রঙা, গোলাকার, শিশুসুলভ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত। ধীরপায়ে কিন্তু দৃপ্তভঙ্গিতে হাঁটেন, দেখলেই বোঝা যায় কতখানি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদাবোধ রয়েছে মানুষটির মধ্যে।” এর পর আমেরিকান কালচারাল ক্লাবে কিটি কুর্টি আবার দেখতে পেলেন এই ব্যক্তিকে, তিনি সে দিন সেখানে বক্তা হিসেবে উপস্থিত। যে বক্তৃতা দিলেন তিনি, কিটি কুর্টি আশা করেছিলেন, তার চরিত্র হবে দর্শনভিত্তিক। কিন্তু না, দেখা গেল পুরোদস্তুর রাজনৈতিক বক্তৃতা সেটি। “তবুও যতই তাঁকে লক্ষ করলাম, বুঝতে পারলাম কোনও সাধারণ রাজনীতিক ইনি হতেই পারেন না, ইনি নিশ্চয়ই এক জন সত্যিকারের দার্শনিক। নিজের দেশের জন্য বীরের মতো লড়াই করছেন যে মানুষ, তিনিই আবার মনুষ্যসাধারণের লক্ষ্য ও ভাগ্য নিয়েও নিয়ত চিন্তা করে চলেছেন,” পরে স্মরণ করেছিলেন তিনি। বক্তৃতার পর দুই ব্রিটিশ এজেন্ট এসে এই ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয়টিকে ডাকার জন্য সে দিনের মার্কিন আমন্ত্রণকারীকে খুব এক হাত নিলেন। কিটি অবশ্য মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, স্বামী আলেক্সকে দিয়ে তাঁকে নিজেদের বাড়ি আমন্ত্রণ জানালেন। এই তরুণ দম্পতির বাড়ির উষ্ণ একান্তে তাঁদের ভারতবর্ষ বিষয়ে যাবতীয় কৌতূহলের উত্তর দিলেন সুভাষ। পাশাপাশি, মনোবিশ্লেষণের একনিষ্ঠ ছাত্রী কিটির কাছে ফ্রয়েড ও ইয়ুং বিষয়ে অনেক কিছু জানতেও চাইলেন।১৮ জার্মানির এই অভিজ্ঞতা সত্যিই উপভোগ্য হল, পরে যত বারই এ দেশে এলেন, কুর্টিদের সঙ্গে দেখা করতে ভুললেন না। জার্মানির নতুন শাসনব্যবস্থায় যাঁরা খানিক প্রান্তবাসী, পরে যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে এর শিকার হবেন, সুভাষের আবেগ-অনুভব যেন অবধারিত ভাবেই তাঁদের দিকেই তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল।

জার্মানি ছাড়ার পর ১৯৩৩-এর শরতের গোড়ার দিকটা কেটে গেল ফ্রানজেনসবাড, ভিয়েনা ও জেনিভায় ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও রাজনৈতিক মিত্র অসুস্থ বিঠলভাই প্যাটেল-এর সেবা করে। ২১ সেপ্টেম্বর জেনিভায় ভারতের উপর একটি বড় জনসভায় বক্তৃতা দিলেন সুভাষ, জেনিভায় এই ধরনের এত বড় সভা এই প্রথম। বক্তৃতাটি আয়োজন করল ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ইন্ডিয়া, যারা ফরাসি, জার্মান ও ইংরেজিতে বুলেটিন প্রকাশ করত। তবে উপনিবেশ দেশগুলির বিষয়ে লিগ অব নেশনস-এর বিরূপ মনোভাব দেখে অত্যন্ত তিক্ত হতাশা জাগল সুভাষের মনে। গ্ল্যান্ড-এ যে ‘ক্লিনিক লা লিনেয়ার’-এ বিঠলভাই প্যাটেল বড়সড় হার্ট অ্যাটাক বাধিয়ে ভর্তি ছিলেন, সুভাষও এ বার সেখানে রোগী হিসেবে ঢুকলেন। তাঁর পেটের ব্যথা তীব্র হয়ে উঠল, অপারেশন করাটাই উচিত কাজ হবে কি না সেই চিন্তায় পড়লেন সুভাষ।১৯ অবশ্য নিজের থেকে বিঠলভাই প্যাটেল-এর জন্যই বেশি চিন্তিত তিনি। চিন্তা অকারণ ছিল না: প্যাটেলের অবস্থার অবনতি শুরু হতে হতে ১৯৩৩-এর ২২ অক্টোবর মৃত্যু হল তাঁর। সুভাষকে উইল করে সম্পত্তির একাংশ দিয়ে গেলেন তিনি, যাতে সে অর্থ “ভারতের রাজনৈতিক উন্নতির জন্য, বিশেষত ভারতের বিষয়ে অন্যান্য দেশে জনমত তৈরি করার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।” তবে ছোট ভাই বল্লভভাই-সহ প্যাটেল পরিবার কিন্তু মামলা মোকদ্দমা করে ব্যবস্থা করলেন, যাতে ভারতের বিষয়ে বিদেশে জনমত ছড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট এই অর্থের কানাকড়িও সুভাষ না পান।২০ আর্থিক সহায়তার জন্য সুভাষ সেই দাদা শরতের বন্ধুদের উপরই নির্ভর করতে লাগলেন, যাঁদের ঋণ তাঁর দাদা সেই ১৯৩৬ সালে, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শোধ করতে পারবেন।

তবে বিঠলভাই প্যাটেল-এর অন্য একটি অপ্রত্যক্ষযোগ্য উত্তরাধিকার লাভ করলেন সুভাষ। বিঠলভাই ইন্ডিয়ান-আইরিশ ইনডিপেন্ডেন্স লিগ স্থাপন করেছিলেন। চিরকালই আইরিশ সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি মন দিয়ে লক্ষ করেন সুভাষ। এ বার সেই লিগের প্রেসিডেন্ট, প্রবাদপ্রতিম মড গন ম্যাকব্রাইড-এর (শরৎ ১৯১৪ সালে এক বার যাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন) সঙ্গে, এবং গোষ্ঠীর প্রধান কর্মকর্তা মিসেস ই উডস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি। লিখলেন, “দেশের যে অংশে আমার বাস (বাংলা), সেখানে স্বাধীনতাকামী নরনারী সাম্প্রতিক কালের আইরিশ ইতিহাস মন দিয়ে পড়েন, কিছু আইরিশ নেতাকে তো অনেক বাড়িতে আক্ষরিক ভাবে পুজো করা হয়।” যদিও ১৯৩৬-এর ফেব্রুয়ারির আগে আয়ার্ল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ না হলেও নানা সংযোগ তৈরি হল সে দেশের সঙ্গে, ১৯৩৩ থেকে সংবাদের আদানপ্রদান চলতে থাকল।২১

ইতালির সঙ্গে সংযোগ তৈরি হল কিছুটা আকস্মিক ভাবেই। “পরিষ্কার আকাশ আর ঝকঝকে সূর্যের আলোর” খোঁজে সুভাষ গেলেন নিস-এ, ১৯৩৩-এর ডিসেম্বরে। হঠাৎ সেখানে হাতে এল এক আমন্ত্রণপত্র, রোম-এর ইতালিয়ান ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট থেকে, ২১ ডিসেম্বরের জন্য। মাত্সিনি ও গ্যারিবল্ডির ভক্ত সুভাষ লাফিয়ে উঠে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ফেললেন। ডিসেম্বরের ২২ থেকে ২৮ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন, তার পরই একটি এশিয়ান স্টুডেন্টস কংগ্রেসের আয়োজন। ইউরোপের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ছশো এশীয় ছাত্র জড়ো হলেন রোমে। ইতালীয় রেলওয়ে তাদের বিনা পয়সায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিল, রোমে তাদের এক সপ্তাহ থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা হল। উদ্বোধনের দিন ফ্যাসিস্ট একনায়ক বেনিটো মুসোলিনি কংগ্রেসে বক্তৃতা দিলেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর মুক্তি নির্ভর করছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নৈকট্য বৃদ্ধির উপর। ইল দুচে বললেন, অতীতে রোম ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করলেও এশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক সর্বদাই বন্ধুত্বমূলক, সহযোগিতামূলক। সুভাষ মন্তব্য করলেন, “বক্তা সম্পর্কে আমরা যা-ই ভাবি না কেন, বক্তৃতাটা সত্যিই ভাল।”২২ স্পষ্ট বোঝা গেল মুসোলিনি সম্পর্কে তাঁর মনে কিছুটা দ্বিধার ভাব রয়েছে।

সুভাষের আগেও বরেণ্য ভারতীয়রা মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করেছেন। ১৯২৬ সালে ইতালি এসে এই নেতার সঙ্গে মিলিত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর মনে হয়, “দেহেমনে যেন মিকালাঞ্জেলোর বাটালিতে গড়ে তোলা এক মূর্তি, যার প্রতিটি কাজের মধ্যে আছে ধী আর শক্তির প্রকাশ”। পরে অবশ্য ইতালির সংবাদমাধ্যম তাঁর মন্তব্য ব্যবহার করে, অতিরঞ্জন করে ইতালির ফ্যাসিস্ট রাজত্বের সমর্থন তৈরির চেষ্টা করলে বিরক্ত হয়ে ওঠেন তিনি, এবং নিজের প্রশংসা অংশত ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ১৯৩০-এ মুসোলিনিকে একটি উষ্ণ চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে ইতালি ও ভারতের মধ্যে বিদ্যাচর্চার আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করেন, আশা প্রকাশ করেন যে ১৯২৬ সালের ভুল-বোঝাবুঝি বিস্মৃত হওয়া যাবে।২৩ এ দিকে ১৯৩১-এ গাঁধী ও মুসোলিনির দেখা হলে গাঁধীর মনে হয় মুসোলিনি বড়ই “ধাঁধালো রহস্যময়” ধরনের মানুষ। তাঁর “লৌহকঠিন শাসনে”র সমালোচনা সত্ত্বেও অবশ্য মহাত্মা স্বীকার করেন, “তাঁর অনেক সংস্কারই আমার বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়।” রোম্যাঁ রোল্যাঁকে লেখেন গাঁধী, “মুসোলিনির দৃঢ়তার পিছনে জনগণের সেবার যে প্রয়াস রয়েছে, সেটা আমাকে আকৃষ্ট করে। তাঁর জোরালো বক্তৃতাগুলির মধ্যেও ফুটে ওঠে আন্তরিকতা, দেশবাসীর জন্য তাঁর অদম্য আবেগ। আমার মনে হয়, বেশির ভাগ ইতালীয়ই মুসোলিনির এই লৌহ-শাসনকে আসলে বেশ ভালবাসেন।”২৪ সুভাষের মন্তব্য, “বক্তা সম্পর্কে আমরা যা-ই ভাবি না কেন” বুঝিয়ে দেয় তাঁরও ভিতরে এই ইতালীয় একনায়ক সম্পর্কে অন্ততপক্ষে কিছু পরিমাণ সংশয় ছিলই। অর্থাৎ মুসোলিনির সঙ্গে তাঁর মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ভাববিলাস বা আদর্শগত ঐক্যের কোনও বিষয় ছিল না, ছিল বাস্তব হিসেবনিকেশ, ছিল এই উপলব্ধি যে মুসোলিনি এমন একটি দেশের নেতা যার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের সঙ্গে সংঘাত রয়েছে। এশীয় কংগ্রেসের পাশাপাশি রোমে একটি ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস কনভেনশন হল। সেখানে সিদ্ধান্ত হল, ইউরোপের ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি লন্ডন থেকে ভিয়েনায় স্থানান্তরিত করা হবে: সুভাষ এই সিদ্ধান্তে সমর্থন জানালেন। রোমের কাজ শেষ করে সুভাষ এলেন মিলানে, বিখ্যাত ফিললজিক্যাল সোসাইটি অব মিলানে বক্তৃতা দিতে। বিষয় “ইতালি ও ভারত”। ভারতের সামনে যে চ্যালেঞ্জ, তার উত্তর অনুসন্ধানের পথে ইতালির উনিশ শতকের জাতীয় ঐক্য আন্দোলন কতখানি প্রাসঙ্গিক, সে কথাই আলোচনা করলেন সেখানে।২৫

ভিয়েনাকে কেন্দ্র করে ১৯৩৪ সালের মার্চের শেষ থেকে জুনের গোড়া পর্যন্ত আর একটা বড় সফর করলেন তিনি: জার্মানি, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া এবং ইউগোস্লাভিয়া। দুটি বড় উদ্দেশ্য তাঁর— এক, এর প্রতিটি দেশে যে ভারতীয় ছাত্র এবং তরুণ চাকুরিজীবীরা রয়েছেন, ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের লক্ষ্যে তাঁদের সংগঠিত করা। দুই, ভারতের বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা লাগাতার যে অন্যায় প্রোপাগ্যান্ডা চালায়, তার বিরোধিতা করে এই ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব তৈরি করা, বন্ধুত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রস্তুত করা।

আগের মতোই এ বারও জার্মানি সফর সুখপ্রদ হল না। ইন্দো-জার্মান সম্পর্ক নিয়ে তাঁর বিভিন্ন ক্ষোভের তালিকা তৈরি করে ৫ এপ্রিল, ১৯৩৪-এ সুভাষ জার্মান ফরেন অফিসে একটি মেমোরান্ডাম জমা দিলেন। ভারতের ব্যাপারে জার্মান প্রেস-এর নেতিবাচক মনোভাব, বিভিন্ন জার্মান নেতার অশালীন মন্তব্য, যেমন, গাঁধী সম্পর্কে হারমান গোয়েরিং-এর বিচিত্র উক্তি “বলশেভিক এজেন্ট”— বিষাক্ত জাতিবিদ্বেষী প্রোপাগ্যান্ডা, এই সবের বিরুদ্ধে অভিযোগ রইল সেখানে। মিউনিখের রাস্তায় ‘নিগার’ বলে গালি হজম করতে হয়েছিল সুভাষকে। ভারতীয় ছাত্রদের এমন সব অপমানজনক কথা সেই সময় শুনতেই হত, পাথর ছুড়ে মারা হত তাদের দিকে। ইহুদি ও অন্যান্য কালো বা বাদামি মানুষদের বিরুদ্ধে যে আইনের খসড়া হয়, ভারতীয়রা তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সুভাষ এই ভারতবিদ্বেষী প্রোপাগ্যান্ডা বন্ধ করা ও জাতিবিদ্বেষী আইনটি বাতিল করার দাবি করলেন।২৬ সেই বছরের শেষে যে সব গুণী বা কৃতী ভারতীয়রা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শেষে প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং-এর চেষ্টায় ছিলেন, তাদের জার্মানি থেকে চেকোস্লোভাকিয়ায় সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ সন্ধান শুরু করলেন তিনি।২৭

ভারতের স্বাধীনতার আদর্শ বিস্তারের কাজটিতে আত্মোৎসর্গের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন জায়গা ও মানুষ দেখার আনন্দেও সুভাষ মেতে ছিলেন তখন। বুডাপেস্ট দেখে মনে হয়েছিল, ছবির মতো সুন্দর, অতি মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কে যে জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন দেখা দেয়, তার বিরাট ভক্ত ছিলেন সুভাষ, কেমাল আতাতুর্ককে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। আতাতুর্কের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি ভারতে আধুনিকীকরণ ও ঐক্যসাধনের পদক্ষেপ হিসেবে রোমান হরফ প্রচলনের ব্যাপারে জোর দিতে শুরু করলেন। অবশ্য ইস্তানবুল বিষয়ে তাঁর প্রত্যাশা পূরণ হল না, মনে হল পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই শহর। না আছে তার প্রাচ্যের রোমান্স, না আছে “পাশ্চাত্যের বস্তুতান্ত্রিক উন্নতি”। বলকান দেশগুলি বরং “অনেক কৌতূহলজনক”। এই অঞ্চলের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জনের আন্দোলন তাঁকে আকৃষ্ট করত। ইউগোস্লাভিয়ার প্রধান সংবাদপত্রে তাঁর সাক্ষাত্কার প্রকাশ বন্ধে ব্রিটিশরা সফল হলেও সোফিয়া, বেলগ্রেড এবং জাগ্রেবের মতো জায়গায় গিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন তিনি।২৮

উইশার্ট প্রকাশনা সংস্থা থেকে ১৯২০ সালের পরবর্তী ভারতীয় আন্দোলনের উপর একটি বই লেখার চুক্তি পেয়ে ১৯৩৪ সালের জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সুভাষ ভিয়েনায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করলেন। বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজে এক জন সাহায্যকারীর খোঁজ করতে গিয়ে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল তাঁর, যিনি নাটকীয় ভাবে তাঁর ব্যক্তি-জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবেন। এত দিন পর্যন্ত দেশের কাজে ডুবে থেকেছেন সুভাষ, কোনও নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহই বোধ করেননি। “কত জন তো আমাকে ভালবেসেছেন,” পরবর্তী কালে লিখেছিলেন তিনি, “কারও দিকে ফিরেও তাকাইনি।”২৯ সুভাষের জন্য গাদা গাদা বিবাহপ্রস্তাবে বাড়ির গুরুজনরা, তাঁর রাজনীতি-গুরু চিত্তরঞ্জন দাশ, চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী, সকলেই প্লাবিত হয়ে যেতেন। সুভাষ সবই এককথায় খারিজ করে দিতেন। এক বার তো তিনি বিশেষ বিরক্ত হন— এক ধনী হিতৈষী ব্যক্তি যখন চিত্তরঞ্জনকে এসে বলেন যে চিত্তরঞ্জন যদি সুভাষকে তাঁর কন্যাকে বিবাহ করতে রাজি করাতে পারেন, একমাত্র তবেই তিনি চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক তহবিলে বড়সড় অঙ্কের একটা দান করতে পারেন। আর এক জন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা তো আরও এক পা এগিয়ে। বাসন্তী দেবীর মুখে যখন তিনি শুনলেন যে সুভাষকে হয়তো ফাঁসিই যেতে হবে কোনও দিন, তিনি জানালেন তাঁর মেয়ে কিন্তু সুভাষের গর্বিত বিধবা স্ত্রী হতেই রাজি। সুভাষের সঙ্গে এই সব মহিলাঘটিত আলোচনা করতেন বাসন্তী দেবী, বলতেন, তাঁর পালিত পুত্র সুভাষ তো ঘোষণা করেননি যে তিনি কোনও দিন বিবাহ করবেন না, তিনি কেবল চান দেশের স্বাধীনতার লড়াইটাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে।৩০ সুভাষের একনিষ্ঠ ভক্তরা অবশ্য মনে করতেন সুভাষ ব্রহ্মচর্যের শপথ নিয়েছেন, দেশ স্বাধীনতা না পাওয়া অবধি তিনি ব্রহ্মচারী থাকাই স্থির করেছেন। ইউরোপে এই বার সুভাষ এই সব প্রত্যাশার বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এলেন।

১৯৩৪ সালের ২৪ জুন। এমিলি শেঙ্কল নামে ছোটখাটো সুন্দর চেহারার মেয়েটি এলেন সহকারীর কাজের জন্য ইন্টারভিউ দিতে। এক অস্ট্রীয় ক্যাথলিক পরিবারে ১৯১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর জন্ম তাঁর, ইংরেজি জানেন, শর্টহ্যান্ড ডিকটেশন নিতে পারেন, ভালই টাইপ করেন। মন্দার বাজারে কাজ পাওয়া কঠিন। পশু-চিকিৎসক বাবা প্রথমে মেয়েকে এমন এক অদ্ভুত ভারতীয় পুরুষের কাছে কাজ করতে পাঠাতে খানিক অরাজি থাকলেও ক্রমে বাবা মা বোন, গোটা পরিবারের সঙ্গেই সুভাষের বেশ উষ্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হল। নরম, হাসিমুখ, সহজসরল, উদার মনের মেয়ে এমিলিকে ভারী ভাল লাগল সুভাষের। পরে তাঁর ইচ্ছাশক্তির বহর দেখে সুভাষ মুগ্ধ হয়ে আদরের নাম দিলেন ‘বাঘিনী’। কী ভাবে তাঁদের সম্পর্ক ক্রমে রোম্যান্টিক হয়ে উঠল তা বলতে গিয়ে এমিলির পরিষ্কার কথা, “শুরু করেছিল ও।” ১৯৩৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৩৬-এর মার্চ পর্যন্ত অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লোভাকিয়ায় একসঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন তাঁরা দু’জন।৩১

১৯৩৪-এর গ্রীষ্মে, ভিয়েনার অ্যাপার্টমেন্ট-এ বসে সুভাষ তখন প্রাণপণ কাজ করে যাচ্ছেন পাণ্ডুলিপিটি প্রস্তুত করতে। বই কাগজপত্র কিছুই সহজে মিলবার জো নেই, স্মৃতির উপরই যেটুকু ভরসা। হয় মুখে বলে যান, নয়তো লিখে রাখেন, এমিলি এসে পৃষ্ঠাগুলি টাইপ করে দেন। অগস্টের মাঝামাঝি নাওমি ভেটারকে লেখেন সুভাষ, “কাজটা এগোচ্ছে, কিন্তু যা দাঁড়াচ্ছে তাতে আমি নিজে খুব সন্তুষ্ট হতে পারছি না।”৩২ এখনও সুস্থ নন, বুঝে উঠতে পারছেন না চেকোস্লোভাকিয়ার কার্লসবাড-এ গিয়ে আরও চিকিৎসা করাবেন, নাকি ভিয়েনায় গলব্লাডার অপারেশন-এর চেষ্টা করবেন। সেপ্টেম্বরের গোড়ায় তাঁর অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে কার্লসবাড-এ এসে পৌঁছলেন, এমিলিও এলেন, কুরহউস কনিজিন আলেকজান্দ্রায় রইলেন। প্রকাশক বলে দিয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে হবে, খুব বেশি দেরি নেই, চিন্তায় রয়েছেন সুভাষ। যা হোক, এমিলির সাহায্যে এবং ওই ছোট শহরটির উষ্ণ প্রস্রবণের সহায়তায় সেই লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত পূরণ করা গেল। ১৩৪৯ সালে সম্রাট চতুর্থ চার্লস কার্লসবাড শহরটি স্থাপন করেছিলেন, ষোলোটি উষ্ণ প্রস্রবণের নিরাময়ী গুণের কথা ছড়িয়ে পড়ায় জায়গাটি বিখ্যাত হয়ে যায়। সুভাষের বিশেষ করে ভাল লাগল এখানকার “সুন্দর পায়ে-হাঁটা রাস্তাগুলি, কেমন এ দিক ও দিকে পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত চলে যায়।”৩৩

এ দিকে পাণ্ডুলিপিটি তখন ক্রমে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের একটা গুরুতর ইতিহাস হয়ে উঠছে, যে আন্দোলনে লেখক নিজেই প্রথম সারির নেতাদের অন্যতম। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্পষ্ট বিশ্লেষণ তাতে, সেই ১৯২০-র অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের মেঘ জমা থেকে শুরু করে ১৯৩০-এর গোড়ায় আইন অমান্য এবং বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের ঝড় ওঠা পর্যন্ত। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে রাজনীতির পট-পরিবর্তনের নাটকীয় কাহিনি মহত্তর হয়ে উঠছে সুভাষের নিজের নানা দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্বে, ভারতের ইতিহাসের প্রধান ঘটনাগুলি বিষয়ে তাঁর মতামতের জন্য, কিংবা সেই ইতিহাসে মহাত্মা গাঁধী নামক আশ্চর্য ব্যক্তির প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের জন্য। মহাত্মার “একনিষ্ঠ ভক্তি, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অফুরান পরিশ্রমক্ষমতার” ভূয়সী প্রশংসা করলেন তিনি। তবে গাঁধী বিষয়ে সমালোচনাও ছিল তাঁর: যাদের বিরুদ্ধে লড়াই, তাদের প্রকৃত চরিত্র বোঝার অক্ষমতা, কিংবা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে আন্তর্জাতিক কূটনীতি কাজে না লাগানোর অবিবেচনা। আবার গাঁধী যে ভাবে ধনিক ও শ্রমিক শ্রেণিদের কিংবা জমিদার ও কৃষকদের মেলাতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যেও একটা সমস্যা ছিল। শেষ পর্যন্ত, তাঁর মতে, মহাত্মা গাঁধীকে ব্যর্থই বলা যেতে পারে, কেননা “যে সব স্বার্থ মূলগত ভাবেই পরস্পরবিরোধী তাদের মিথ্যা ঐক্যসাধন থেকে সত্যিকারের শক্তি উৎপন্ন হয় না, বরং রাজনৈতিক লড়াইটাই দুর্বল হয়ে পড়ে।”৩৪

শেষের ঠিক আগের অধ্যায়টির নাম “ভবিষ্যতের এক ঝলক”। সেখানে সুভাষ কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করলেন, পরবর্তী কালে যা নিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক আক্রমণাত্মক সমালোচনা শুনতে হবে তাঁকে। ইউরোপে সে দিন সকলেরই মুখে মুখে প্রশ্ন: “ভারতে কমিউনিজম-এর ভবিষ্যৎ কী?” সেই সূত্র ধরেই এই সব মন্তব্য। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে জওহরলাল নেহরু এর উত্তরে যে ভাবে তাঁর সজোর মত জানিয়েছিলেন, তার চেয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া কিছুটা পৃথক করতে চাইলেন সুভাষ। নেহরুর মনে হয়েছিল পৃথিবীর সামনে স্পষ্টই দুটিমাত্র পথ খোলা, “হয় কমিউনিজম-এর কোনও না কোনও রূপ, নয় ফ্যাসিজম-এর কোনও না কোনও রূপ।” তিনি নিজে “সম্পূর্ণত” কমিউনিজম-এর পক্ষে, তাও বলেছিলেন। “কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম-এর মধ্যে কোনও মাঝামাঝি পথ হয় না,” বললেন তিনি, “সবাইকেই এর একটা যে কোনও দিক বেছে নিতে হবে, আমি বেছে নিয়েছি কমিউনিস্ট আদর্শ।” সুভাষ বললেন, জওহরলালের এই বক্তব্যে “মৌলিক ভুল” রয়েছে, পথ যে “কেবল এই দুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ” এমন ভাবার কোনও কারণ ঘটেনি। বিবর্তনের যে তত্ত্বই মানি না কেন— ডারউইনের কিংবা বার্গসঁ-র— ইতিহাস কিংবা সৃষ্টিশীলতার শেষে এখনও পৌঁছয়নি মানুষ। এর পর হেগেলের দ্বন্দ্ববাদের কিছুটা যান্ত্রিক প্রয়োগের মাধ্যমে সুভাষ ঘোষণা করলেন, তিনি “মনে করেন যে বিশ্ব-ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায়ে কমিউনিজম ও ফ্যাসিজমের এক রকমের সমন্বয় তৈরি হবে। আর সেই সমন্বয় যদি ভারতেই তৈরি হয়, সেটা কি খুব আশ্চর্যের ব্যাপার?” যে সব কারণে তাঁর মনে হচ্ছে “ভারতে কমিউনিজম গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা নেই”, সেগুলি যথেষ্ট সঙ্গতই বলতে হবে, তার একটা গোটা তালিকা বানালেন তিনি। জাতীয়তাবাদের প্রতি কমিউনিজম-এর সহানুভূতির অভাব, সমসাময়িক রাশিয়ার অন্তর্মুখী প্রকৃতি, কমিউনিজমের ধর্মবিরোধী কিংবা নাস্তিক চরিত্র যা ভারতীয়দের স্বভাবতই বিমুখ করে তোলে। সুতরাং এ কথা “জোর দিয়ে বলাই যায় যে ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার নতুন সংস্করণ হয়ে উঠবে না।” “একই রকম জোরের সঙ্গে” এও বলা যায়, “ইউরোপ ও আমেরিকার সব রকম আধুনিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরীক্ষানিরীক্ষার যথেষ্ট প্রভাব ভারতের উপরেও পড়বে।” আর এই “বহিঃ-পৃথিবীর ঘটনাবলি সম্পর্কে” ভবিষ্যতে ভারত ক্রমশই “আরও অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকবে।”৩৫

সবে বই-এর প্রুফ দেখা শেষ করেছেন, এমন সময়ে কলকাতা থেকে মায়ের জরুরি টেলিগ্রাম, বাবা গুরুতর অসুস্থ। ভিয়েনা থেকে তখনই বিমানে উঠলেন সুভাষ, “ভারত পৌঁছনো পর্যন্ত হয়তো তোমায় আর যোগাযোগ করতে পারব না,” ১৯৩৪ সালের ৩০ নভেম্বর রোম থেকে জানালেন এমিলিকে। “চিন্তা কোরো না, যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে আমি চিরকালই খারাপ, তবে মানুষ হিসেবে ততটা খারাপ নই আশা করি।” বিমান যেখানে যেখানে থামল— ভেনিস, আথেন্স, কায়রো, বাগদাদ— সব জায়গা থেকেই অবশ্য এমিলিকে চিঠি পাঠাতে পারলেন তিনি। গ্রিসে কোনওক্রমে অ্যাক্রোপলিস আর অন্যান্য প্রাচীন স্থান দেখে নেওয়ার সময় পেলেন। কায়রোতে নেমে পিরামিড, মসজিদ, সমাধি, বিশেষত তুতানখামেন মিউজিয়াম দেখে খুশি হলেন। “আবার প্রাচ্য সভ্যতার কোলে এসে পড়েছি,” মিশর থেকে প্রফুল্ল সুভাষ জানালেন এমিলিকে। “আথেন্স থেকে আসার সময় ভোরের আকাশের মেঘের উপর অপরূপ সূর্যোদয় দেখতে পেলাম, এমন সূর্যোদয় কেবল প্রাচ্য ভুবন থেকেই দেখা যায়।” বাগদাদে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন প্রায় পাঁচশো বছর আগে তৈরি সোনালি গম্বুজ দেওয়া মসজিদটি দেখে।৩৬ করাচি আর যোধপুরে থামার পর কেএলএম কলকাতায় পৌঁছল ৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টেয়। ২ ডিসেম্বর সুভাষের বাবার মৃত্যু হয়েছে। বিমানবন্দর পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, সুভাষ বিমান থেকে নামতেই তাঁকে গ্রেফতার করে ‘হাউস-অ্যারেস্ট’-এ রাখা হল, যেমন রাখা হয়েছিল তাঁর মেজদাদাকেও। প্রায় দুই বছর পর ৩৮/২ এলগিন রোডের পৈতৃক বাড়ির পোর্টিকোয় আবেগবিহ্বল ভাবে মিলিত হলেন সুভাষ ও শরৎ।৩৭

পরিবারের প্রধান পুরুষটির জন্য এক মাস শোকপালন। এই সময়ে নিজের বাড়িতে বন্দি হয়ে কাটালেন সুভাষ। মাথা ন্যাড়া করে অনেকটা বুদ্ধের মতো চেহারায়, বাকি ছয় ভাই-এর সঙ্গে মহাড়ম্বরে ঐতিহ্যানুসারে পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।৩৮ এমিলিকে ১৯৩৪-এর ২১ ডিসেম্বর লিখলেন যে ইউরোপে ফিরে গিয়ে অপারেশন করানো ছাড়া আর কোনও পথ নেই। ৮ জানুয়ারি, ১৯৩৫ কলকাতা ছেড়ে ইউরোপের দিকে রওনা হলেন তিনি, ১০ জানুয়ারি বম্বে থেকে এম ভি ভিক্টোরিয়া জাহাজে ভেসে পড়লেন। যাত্রাপথে ভয়ানক ব্যথা শুরু হল, তবে পৌঁছনোর পর একটু কমল সেই কষ্ট। ২০ জানুয়ারি নেপলস্ পৌঁছে ঠিক করলেন এক সপ্তাহ ইতালিতে কাটাবেন, যাতে ভিয়েনা ফেরার আগে এক বার মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করে যেতে পারেন। নেপলস্ থেকে সে বার গেলেন পম্পেই, দেখলেন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি সোলফালারা। রোমে লম্বা বৈঠক সারলেন আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাজা আমানুল্লাহ্-র সঙ্গে। রুশ দূতাবাসে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশমন্ত্রী ম্যাক্সিম লিৎভিনভ-এর সঙ্গেও দেখা করলেন।৩৯ ২৫ জানুয়ারি রোম থেকে এমিলিকে ধন্যবাদ জানালেন দু’দিন আগে তাঁর জন্মদিনটি মনে রাখার জন্য, তিনি নিজেই যে তারিখটি মাথায় রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন! এও জানালেন যে, সে দিনই সন্ধেয় মুসোলিনির সাক্ষাত্কার নেবেন তিনি, উপহার হিসেবে ইল দুচের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর নিজের লেখা বইয়ের একটি কপি। তবে বিষয়টা যেন এমিলি “অত্যন্ত গোপন রাখেন”, সেটাও যোগ করে দিতে ভুললেন না।৪০ বইটির ভূমিকায়, যাতে তারিখ দেওয়া ছিল ২৯ নভেম্বর ১৯৩৪ (১৯৪২ সালে যে তারিখেই তাঁদের কন্যা জন্ম নেবেন), এক জনেরই মাত্র নাম উল্লেখ করেছিলেন তিনি, এমিলি। “শেষে, ফ্রলাইন ই শেঙ্কল, যিনি আমার এই বই লেখার কাজে সহায়তা করেছেন, তাঁকে, ও অন্যান্য সকল বন্ধু যাঁরা নানা ভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন, সকলকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।”৪১

লন্ডনের লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট থেকে ১৯৩৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রকাশিত দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল নামের বইটিতে রইল ১৯২০ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে সুভাষচন্দ্রের বিশ্লেষণ। লন্ডনের অনুমতিক্রমে দিল্লির ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রায় রাতারাতি বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতে তার প্রবেশ আটকে দিলেন। হাউস অব কমনস্-এ লেবার এম-পি কর্নেল জে ওয়েজউড-এর প্রশ্নের উত্তরে সেক্রেটারি অব স্টেট স্যামুয়েল হোর ব্যাখ্যা করে বললেন, এই বইয়ে “সাধারণ ভাবে সন্ত্রাসবাদ ও সক্রিয় প্রতিবাদের ধারাকে উত্সাহ দেওয়া হয়েছে” বলেই এই পদক্ষেপ। বইটি বিষয়ে অভিযোগটি বেশ অদ্ভুতই বলতে হবে, কেননা বিপ্লবীদের কী ভাবে সন্ত্রাসবাদের পথ থেকে সরিয়ে এনে অহিংস সংগ্রামের ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনাই বরং মেলে এখানে।

ব্রিটিশ সরকারের আক্রমণাত্মক মনোভাব সত্ত্বেও দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে বেশ ভাল সমালোচনা লাভ করল, ইউরোপের সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বৃত্তে উষ্ণ অভিনন্দন পেল। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস-এর মতো উচ্চ সামাজিক সম্মানবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এক ব্রিটিশ অফিসার জে টি গুয়েন ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান-এ বইটির আলোচনা করলেন এই ভাবে:

ভারতীয় রাজনীতি বিষয়ে কোনও ভারতীয় রাজনীতিকের লেখা হিসেবে এ যাবৎ কাল যা পেয়েছি আমরা, তার মধ্যে এই বইটি সম্ভবত সবচেয়ে মনোগ্রাহী। শেষ চোদ্দো বছরের যে ইতিহাস তিনি লিখেছেন, তা স্পষ্টতই বাম ভাবাদর্শ থেকে লেখা হলেও সেখানে সব দল, সব ব্যক্তি বিষয়ে যথেষ্ট নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা হয়েছে, অন্তত যতটা নিরপেক্ষতা আমরা কোনও সক্রিয় রাজনীতিকের কাছ থেকে আশা করতে পারি। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, সমাজতন্ত্রের প্রসার, এই সব বিষয়েই তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ। সব মিলিয়ে এই বই পড়ে আমাদের মনে মিস্টার বোসকে ভারতের রাজনীতির নেতা হিসেবে দেখার ইচ্ছা তৈরি হয়।

সানডে টাইমস রিভিউ-এ স্যার আলফ্রেড ওয়াটসনের সুর অবশ্য অনেক বেশি সমালোচনামূলক। তবে তাঁরও মনে হল, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল মতামতের আধুনিকতার জন্যে বেশ মূল্যবান বই। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বই লেখা, ব্রিটিশ মানসিকতায় তা ধরতে পারা কঠিন হলেও এই দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের নিখুঁত ভাবে ধরিয়ে দেয় ভারতীয় আন্দোলনের একটি দিক, যা অবজ্ঞা করা অনুচিত। “শান্ত, বোধদীপ্ত, নিরপেক্ষ”, ডেলি হেরাল্ড-এর বিখ্যাত কূটনৈতিক সংবাদদাতা ডবলিউ নরম্যান ইউয়্যার বললেন,

সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাসের এত ভাল লেখা আর পড়িনি। লেখক কোনও মৌলবাদে বিশ্বাস করেন না, বরং তাঁর ক্ষমতাময় মনটি তীক্ষ্ণ চিন্তাশীল, গঠনমূলক। চল্লিশও না পেরোনো এমন এক জন মানুষ অবশ্যই যে-কোনও দেশের রাজনীতির পক্ষে বিরাট সম্পদ, মূল্যবান ভূষণ।

স্পেকটেটর-এ স্যার ফ্রেডরিক হোয়াইট বইটিকে “সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি মূল্যবান দলিল” বলে মনে করলেন। নিউজ ক্রনিক্ল-এর জে স্টুয়ার্ট হজসনের মতে সুভাষের “মাথাটা বিপ্লবীদের তুলনায় অসম্ভব পরিচ্ছন্ন”। এও বললেন, “গাঁধী সম্পর্কে লেখকের যা বক্তব্য, ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে কিন্তু সেটা দারুণ উল্লেখযোগ্য। দৃঢ়, প্রত্যয়ী মতামত। মহাত্মার অসামান্য গুণগুলি সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে তুলে ধরেছেন, কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে তাঁর পর্বতপ্রমাণ ভুলগুলি বিষয়ে এক চুলও রেয়াত করেননি।” ভারতে বইটি নিষিদ্ধ হলে বামমনস্ক ব্রিটিশ রাজনীতিক ও চিন্তাশীল মানুষদের মধ্যে রীতিমতো হইচই পড়ে গেল। জর্জ ল্যানসবেরি বইটি বিষয়ে সুভাষকে ধন্যবাদ জানালেন, বললেন “অনেক কিছু শিখেছেন” এর থেকে।৪২ ইউরোপে যে বই মুক্তভাবে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভারতে সেটিকে আটকে দেওয়ার পদক্ষেপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় উপনিবেশে সে দিন বৈষম্যনীতির ধরনটা কেমন ছিল। “ইংরেজ আইন কি তবে গ্রেট ব্রিটেনের জন্য এক রকম, আর ভারতের জন্য অন্য রকম?” বিরক্ত হয়ে নিউ স্টেটসম্যান অ্যান্ড নেশন -এ ‘সম্পাদকের প্রতি চিঠি’ স্তম্ভে লিখে জানতে চাইলেন সুভাষ।৪৩

ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে সবচেয়ে অন্তর্দৃষ্টিময় মন্তব্যটি এল রোম্যাঁ রোল্যাঁর কাছ থেকে। তাঁর এত ভাল লাগল বইটি যে আরও দুটি কপি অর্ডার দিলেন তাড়াতাড়ি, যাতে স্ত্রী আর বোন দু’জনকেই আলাদা করে দিতে পারেন। “ঐতিহাসিকের সব সুগুণাবলিই এই বইয়ে তুমি দেখিয়েছ,” লেখককে জানালেন, “স্পষ্টতা, পূর্ণ মানসিক স্থৈর্য। সক্রিয় রাজনীতিতে থেকেও নিজের দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে বিচার করতে পারার দুর্লভ ক্ষমতা রয়েছে তোমার।” সুভাষের “দৃঢ় রাজনীতি বোধ”-এর প্রভূত প্রশংসা করলেন তিনি, বললেন, “দুর্ভাগ্য যে ভারতীয় সামাজিক আন্দোলনের সমস্ত নেতারা”, এমনকী সুভাষ ও জওহরলালও তখন হয় বন্দি নয় দেশান্তরে। আয়ার্ল্যান্ডের ইমন ডি ভালেরাও বইটি আগ্রহসহকারে পড়লেন, আশা প্রকাশ করলেন, অদূর ভবিষ্যতেই ভারতীয় জনগণ যেন তাঁদের “স্বাধীনতা ও স্বস্তি” অর্জন করতে পারেন।৪৪

প্রথম প্রেম

ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী এ সি এন নাম্বিয়ার এক বার সুভাষচন্দ্র বসু বিষয়ে বলেছিলেন, তিনি হলেন “এক-আদর্শী পুরুষ: ভারতের স্বাধীনতাই তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।” সঙ্গে যোগ করেছিলেন, “আমার মনে হয়, জীবনে এক বারই এর ব্যতিক্রম ঘটে, যদি অবশ্য আদৌ একে ব্যতিক্রম বলা যায়— মিস শেঙ্কল-এর প্রতি তাঁর প্রেম।” “হ্যাঁ, গভীর প্রেমে পড়েন তিনি। তীব্র, বিপুল সেই ভালবাসা।”৪৫ ১৯৩৫-এ সেই প্রেম বিকশিত হয়ে ওঠে ভিয়েনায়। অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের কার্লসবাড, হফগাস্টাইন, বাডগাস্টাইনের পাহাড় এবং উপত্যকাগুলি সুভাষের জীবনের সেই আবেগজর্জর দিকটির একমাত্র সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল— তাঁর যে দিকটি চিরকালই বাইরের মানুষের কাছে অজানা থেকে যাবে। তবু, তাঁর চরিত্র ও মানসিক জগত্কে যদি ঠিক ভাবে বুঝতে হয়, এই দিকটি নিয়ে না ভেবে উপায় নেই, কী ভাবে ব্যক্তিগত আনন্দ ও সামাজিক কর্তব্যের মধ্যেকার টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি সেটা না জেনে উপায় নেই। ভারতীয় সমাজের দমবন্ধ রক্ষণশীলতার চোটে তাঁর কখনও কোনও নারীসম্পর্ক হয়নি আগে। মহিলাদের কাছে তিনি বরাবরই লাজুক, চুপচাপ— সেটাও ছিল আর একটা বাধা। বাংলার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবীদের সংস্কৃতি-জগতে তখন নারীকে সাধারণত মাতৃমূর্তিতে চিত্রিত করা হত। ফলে নারীর সঙ্গে প্রেম-ভালবাসা মানেই দেশমাতৃকার সাধনা থেকে স্খলন, বিচ্যুতি: এই ছিল ধারণা। ইউরোপের মুক্ত আবহাওয়ায় সুভাষ বিভিন্ন নারীর সঙ্গে সত্যিকারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে উঠতে পারলেন। তাঁদের বেশির ভাগই বিবাহিত, আদতে ইউরোপীয় কিংবা মার্কিনি। দুনিয়া বিষয়ে তাঁদের মুক্ত দৃষ্টি, ভারত বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহল। অল্পবয়সী, অবিবাহিত এমিলি ছিলেন এঁদের চেয়ে আলাদা, ফলে কাজের সম্পর্ক ক্রমে গড়িয়ে গেল ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধনে।

১৯৩৫ বছরটি জুড়ে চলল সুভাষের অসুস্থতা, একটা বড় অপারেশন, দীর্ঘ নিরাময় পর্ব। এর সঙ্গে যোগ হল প্রিয়জনের মৃত্যু ও অসুস্থতা বিষয়ক শোকের ভার। নিজের স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে কিছু করে ওঠার আগেই তাঁকে বিঠলভাই প্যাটেলের স্মরণসভায় যোগ দিতে যেতে হল সুইটজারল্যান্ডের গ্ল্যান্ডে।৪৬ এই সুযোগে রোম্যাঁ রোল্যাঁর সঙ্গেও দেখা সেরে নিলেন ভিলেনভ-এ তাঁর ভিলা এলগায়। অনেক কাল যাবৎ এই ফরাসি পণ্ডিতের ভক্ত তিনি, মডার্ন রিভিউ-এ তাঁদের আড়াই ঘণ্টার কথাবার্তার উপর একটি রিপোর্ট লিখে ফেললেন। কতগুলি প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে— গাঁধীর আদর্শ এবং শ্রমিক অধিকারের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা বিষয়েও প্রশ্ন ছিল তাতে। রোল্যাঁ যে ভাবে তাতে শ্রমিক স্বার্থের প্রতি তাঁর দ্বিধাহীন সমর্থন জানালেন, তা শুনে সুভাষ “বিস্মিত, খুশি”। রোল্যাঁ নিজেকে বিশ্ববাদী বলেন, শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার, অত্যাচারিত জাতিগুলির স্বাধীনতা, নারীর সমান অধিকারে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কথোপকথনের শেষ দিকে সুভাষ বলে উঠলেন: “অত্যাচারিত মানুষ কিংবা জাতির কথাই যদি ধরা হয়, তবে তো যুদ্ধ বস্তুটা পুরোপুরি মন্দ হতে পারে না।” “ইউরোপের জন্য কিন্তু যুদ্ধই ভয়ংকরতম সংকট হয়ে উঠতে চলেছে। এমনকী সভ্যতার শেষও ঘনিয়ে আসতে পারে এর ফলে,” রোল্যাঁর উত্তর।৪৭

যত দিন সম্ভব ঠেকিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ২৪ এপ্রিল সুভাষ গলব্লাডার অপারেশনে রাজি হলেন। ভিয়েনার রুডলফিনারহউস স্যানাটরিয়ামে প্রফেসর রুডলফ ডেমেল অপারেশনটা করলেন। অজ্ঞান করে দেওয়ার আগে সুভাষ একটু কাগজ চাইলেন, তাতে লিখলেন, “আমার যা কিছু সম্পদ তা রইল আমার দেশবাসীর জন্য, আমার যা কিছু দায় আছে, আমি আমার মেজদাদাকে দিয়ে গেলাম।”৪৮ প্রফেসর ডেমেল গলব্লাডারটি বার করে দিলেন, তাতে বেশ বড় আকারের একটি পাথর ছিল। সিস্টার এলভিরার নেতৃত্বে নার্সদের একটি দল সুভাষের দেখাশোনা করতেন, রোজ দেখতে আসতেন এমিলি। তিন সপ্তাহ পর যখন একটু একটু হাঁটতে শুরু করলেন, রুডলফিনারহউস থেকে চলে গেলেন ভিয়েনার একটু বাইরে পুর্কার্সডর্ফে, ওয়েস্টেন্ড স্যানাটরিয়ামে। নিজেই অধৈর্য হয়ে পড়ছেন শরীর সারতে এত সময় নিচ্ছে দেখে, সেপ্টেম্বরেও তাঁকে পরতে হল অ্যাবডমিনাল বেল্ট। শ্রমসাধ্য শরীরচর্চা একেবারে বারণ।

ভিয়েনা ছেড়ে জুনের মাঝামাঝি গেলেন কার্লসবাডে, তিন মাসের জন্য। ভিয়েনা থেকে প্রাগের পথটা তাঁর সঙ্গে গেলেন জওহরলালের স্ত্রী কমলা নেহরু, ফুসফুসে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার জন্য তিনি তখন ইউরোপে, আর তাঁর স্বামী ভারতে বন্দি। বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া গতি নেই দেখে একের পর এক বই পড়া চলল, এইচ জি ওয়েলস্-এর দ্য নিউ আমেরিকা: দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড-ও রইল সেই তালিকায়। সেপ্টেম্বরে ডাক্তারের কথায় হফগাস্টাইনের “নিরাময়”-এর সন্ধানে গেলেন। কার্লসবাড থেকে হফগাস্টাইনের পথে বাডেনওয়েইলার-এ এক বার কমলা নেহরুকে দেখে গেলেন। তাঁর অবস্থা তখন আরও খারাপ হয়েছে, ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির চাপে জওহরলালকে মুক্তি দিয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে থাকার জন্য। ব্ল্যাক ফরেস্ট রিসর্ট-এ সুভাষের সঙ্গে জওহরলালের দেখা হল, একই বোর্ডিংহাউসে দু’জন থাকলেন।৪৯ কমলা নেহরুর অবস্থা একটু ভাল হলে সুভাষ চললেন অস্ট্রিয়া। “তোমার এই বর্তমান সংকটে আমি যদি কিছু করতে পারি, আমাকে জানাতে নিশ্চয়ই তুমি দ্বিধা করবে না,” হফগাস্টাইন থেকে ১৯৩৫-এর ৪ অক্টোবর লিখলেন জওহরকে।৫০ নিজেও অনেকটা স্বস্তি পেলেন কার্লসবাড ও হফগাস্টাইন দুই জায়গাতেই এমিলির সান্নিধ্য পেয়ে।৫১

একটু ভাল বোধ করতে শুরু করায় ২৩ অক্টোবর হফগাস্টাইন ছেড়ে আরও এক বার বাডেনওয়েইলারে নেহরুদের দেখে চলে এলেন ভিয়েনায়। ১৯৩৫-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রস্তুত হতে লাগলেন ভারতের স্বাধীনতার দাবি প্রচার করার জন্য ১৯৩৬-এর গোড়ায় আবার একটা বড় ইউরোপ সফরে বেরোবেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার ভিসা কিন্তু মিলল না। বুঝলেন এ হল “নতুন সোভিয়েত-ব্রিটিশ বোঝাপড়ার” ফল, এই সিদ্ধান্ত “ভারতে সোভিয়েত সরকারের সুনাম অনেকটাই নষ্ট করবে।”৫২ জওহরলাল সোভিয়েত ইউনিয়নে যে সামাজিক বিপ্লব দেখে এসেছেন তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত, স্তালিনের বর্বরতার কথা উল্লেখও করছেন না। অন্য দিকে সুভাষের দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল-এ রাশিয়া বিষয়ে সমালোচনা ছিল, রুশদের এই অমিত্রসুলভ আচরণ তার একটি কারণ হতে পারে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে এই হতাশা সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিল আইরিশ ফ্রি স্টেটে যাওয়ার অনুমতিপত্র। এমিলি তাঁর হয়ে কিছু আইরিশ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সুভাষের মনে এখনও সেই ভ্রান্ত ধারণা— ইংল্যান্ড যাওয়ার অনুমতি তাঁর নেই, তাই তিনি ঠিক করলেন ইউরোপ মহাদেশ থেকেই সোজা আয়ার্ল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছবেন।৫৩

১৯৩৬ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভিয়েনা থেকে ইউরোপ ভ্রমণে বেরোলেন সুভাষ। ভারতে ফেরার নির্ধারিত সময় লখনৌ-এ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের সময়, তার আগে এই তাঁর শেষ ইউরোপ সফর। প্রথম থামলেন প্রাগে। প্রেসিডেন্ট এডুয়ার্ড বেনেস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন ১৩ জানুয়ারি। চেকোস্লোভাকিয়া তখন কূটনৈতিক ব্যস্ততার চরমে, বেনেস-এর সরকারের কাছে বিরাট সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে জার্মানদের সুদেতেনল্যান্ড-এর দাবি। সুভাষ খেয়াল করলেন, প্রেসিডেন্ট বেনেস তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করলেন, এবং তাঁর সঙ্গে বৈঠকের পর অস্ট্রিয়ার দূতের সঙ্গে দেখা করলেন। ইউরোপের এই সংঘর্ষময় পরিস্থিতিই তখন বেনেস-এর সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে, তার মধ্যে সুভাষ ভারতীয় স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় নিয়ে আসার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বার্লিনে রওনা হলেন সেই রাতেই: প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে বৈঠক সারলেন সেখানে, তাঁরা কংগ্রেস-এ বার্ষিকী উৎসব পালন করবেন ভাবছেন। জার্মানি “এই মুহূর্তে অত্যন্ত ব্রিটিশ-ঘেঁষা” বলে মনে হল তাঁর, নাত্সিরা কোনও ভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপারে নাক গলাতে রাজি নয় কেননা তারাও এখন তাদের সাম্রাজ্য তৈরির পরিকল্পনায় ব্যস্ত। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত মন্দ। গোটা হউসফ্রউয়েন শ্রেণি বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে দৈনন্দিন অবশ্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এতই দুর্লভ, অথচ সরকার কিন্তু “এই মহিলাদের সহজে জেলেও পুরতে পারবে না!” বেলজিয়ামে নেহাতই ছুটি কাটানো। বন্ধু কান্তিলাল পারেখ আর নাথালাল জাভেরির সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বেড়ানো কেবল। অবশ্য অ্যান্টওয়ার্প-এর কাগজ ল্য মাত্যাঁ-র জন্য একটা সাক্ষাত্কার দিয়ে ফেললেন এর মধ্যে। তাঁর যাত্রাসূচিতে এর পর রয়েছে প্যারিস। এখানে লেখক আঁদ্রে জিদ-এর সঙ্গে দেখা হল, দেখা হল শান্তিবাদী ফেলিসিয়েঁ শালায়ে এবং মাদাম দ্রেভে কিংবা মাদাম দুকেন-এর মতো নারী আন্দোলনের অন্যান্য নেতার সঙ্গে। ইউরোপ প্রবল সংকটের আবর্তে, কিন্তু তবুও ফরাসি চিন্তাবিদদের (ফরাসি সরকারকে নয়) ভারতের বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী করে তুলতে সফল হলেন তিনি।৫৪

আয়ার্ল্যান্ড নিজেও যেহেতু উপনিবেশের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছে, সেখানে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির লক্ষ্যে ভাগ্যান্বেষী ভারতীয়টির অনেক উত্সাহী অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা। বিরাট উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা নিয়ে সুভাষ ল্য হাভ্র বন্দর থেকে আয়ার্ল্যান্ডের উদ্দেশে এস এস ওয়াশিংটন জাহাজটিতে চড়লেন ১৯৩৬ সালের ৩০ জানুয়ারি। কর্কে নেমে তাঁর প্রথম কাজ, প্রাক্তন মেয়র টেরেন্স ম্যাকসুইনির কবরে পুষ্পস্তবক প্রদান— ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে অনশনে মৃত্যুবরণ করেন এই মানুষটি। সুভাষের মনে হল আয়ার্ল্যান্ডের এই দুই সপ্তাহ তাঁর ইউরোপীয় অভিযানের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সময়। ডাবলিনে পৌঁছতে প্রেসিডেন্ট ইমন ডি ভালেরা উষ্ণ অভিনন্দন জানালেন তাঁকে। ডি ভালেরা তাঁকে মিত্রভাবাপন্ন কোনও দেশের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন নেতার সম্মান দিলেন, তিনটি বৈঠক করলেন তাঁর সঙ্গে: সরকারি দফতরেই একটি বৈঠকে দৃষ্টিভঙ্গির বিনিময় হল, আর একটি ঘরোয়া চায়ের আসর আয়োজন করলেন তাঁর ফিয়ানা ফয়েল পার্টি, আর ডাবলিনের একটু দূরে ডি ভালেরার বাড়িতে হল একান্ত নৈশভোজ। এই বয়োজ্যেষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবীকে সম্মানের চোখে দেখলেন সুভাষ, তাঁর উপদেশ চাইলেন। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে কোনও দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তির সাহায্য নিতে চায়, তার ভাল-মন্দ নিয়ে তাঁদের আলোচনা হল। ডি ভালেরা এ বিষয়ে রীতিমতো অভিজ্ঞ: ইস্টার বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয় মহাদেশ থেকে পাঠানো অস্ত্রশস্ত্রের উপরই নির্ভর করতে মনস্থ করে আয়ার্ল্যান্ড, কিন্তু সেগুলি ঠিক সময়ে না পৌঁছনোয় সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়, রজার কেসমেন্ট-এর ফাঁসি হয়। ডি ভালেরা নিজেও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আয়ার্ল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য সমর্থন চাইতে গিয়েছিলেন, এবং তাঁর সেই অভিজ্ঞতাও অবিমিশ্র সুখকর নয়। ডি ভালেরার সঙ্গে কথাবার্তার পরেই সম্ভবত ভারতে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হল সুভাষের মনে— ব্রিটিশরা সেখানে তাঁর জন্য যে শাস্তিই জমিয়ে রাখুক না কেন।৫৫

ফিয়ানা ফয়েল-এর অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গেও আলাদা আলাদা করে বসে কথা বললেন সুভাষ। তাঁদের প্রত্যেককেই “অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, সহমর্মী, মানবিক” বলে মনে হল তাঁর। “এঁদের অধিকাংশই দেশের জন্য লড়ার অপরাধে পলাতক থেকেছেন, কোথাও ধরা পড়ে গেলে দেখামাত্র গুলি বর্ষিত হয়েছে তাঁদের উপর,” তাঁর মন্তব্য। এঁরা যে ইতিমধ্যেই “কড়া ব্যুরোক্র্যাটিক মন্ত্রী” হয়ে যাননি এবং সরকারি গরিমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েননি, সেটা খুবই প্রশংসার্হ। ভূমিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলেন কী ভাবে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটিয়ে কৃষকদের মধ্যে ভূমি পুনর্বণ্টন করা সম্ভব সে বিষয়ে। কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে বসে খাদ্যশস্য ও বাণিজ্যিক শস্যের মধ্যে কী ভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে মতবিনিময় করলেন। জানালেন কী ভাবে মন্দার সময়ে ভারতে পাট চাষ জোর করে কমিয়ে দাম বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল। শিল্প প্রসারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকা আলোচিত হল শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে। সব মিলিয়ে, ফিয়ানা ফাইল মন্ত্রীদের তাঁর খুব ভাল লাগল, ভারতের ভবিষ্যৎ প্রস্তুতির জন্য অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে তাঁদের সঙ্গে এই সব আলোচনা বেশ মূল্যবান বলে মনে হল। দেখলেন, ডবলিউ টি কসগ্রেভ-এর বিরোধী পার্টিতেও অনেক সুবক্তা আছে, কিন্তু ব্রিটিশ-পন্থী বলে তাঁদের কুখ্যাতির কারণেই ফিয়ানা ফয়েল তাদের লেবার শরিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন লাভ করতে পেরেছে। সিন ফেইন-এর “অনেক কিছুই তাঁর পুরোপুরি পছন্দ নয়”, কিন্তু তবু তিনি তার প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট-এর কয়েক জন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করলেন। ফিয়ানা ফয়েল এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে “আর একটু সুসম্পর্ক থাকলে ভাল হত,” ১৯৩২-এ ডি ভালেরা প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পর যেমন ছিল, সে রকম। যারা স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে, আজ রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করার পর তাদেরই এই পারস্পরিক দূরত্ব— দেখে পীড়িত বোধ করলেন তিনি।৫৬

সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর সংঘাত এবং ভূমি-সংক্রান্ত প্রশ্ন— আয়ার্ল্যান্ড ও ভারত দুই দেশেই এই সমস্যাগুলি গুরুতর আকারে উপস্থিত। তবে আয়ার্ল্যান্ড ও বাংলার বিশেষ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এক সাংবাদিক যখন সুভাষকে বাংলার নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন, সুভাষ সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সংশোধন করে দিতে ভুললেন না। দৃঢ় ভাবে বললেন, তিনি এক জন ভারতীয় নেতা, কোনও প্রদেশের নেতা নন। ডাবলিনের শেলবোর্ন হোটেলের করিডরে অবশ্য আবার তাঁর মনে পড়ে গেল যে আইরিশদের মধ্যে কিন্তু সাম্রাজ্যবিরোধীদের মতো সাম্রাজ্যবাদীও কম নেই: কর্নেল জে এইচ স্মিথের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেলেন তিনি, সেই স্মিথ যাঁকে মান্দালয় জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে চিনতেন এক দিন। আয়ার্ল্যান্ড থেকে চলে আসার আগে, শেলবোর্ন-এ সব আইরিশ বন্ধুদের একসঙ্গে খাওয়ালেন এক দিন, তার মধ্যে মড গন ম্যাকব্রাইড-ও ছিলেন। ডাবলিনের দিনগুলো “যেন স্বপ্নের মতো” কাটল, স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর অন্তরের জমে-থাকা কত কথা কত আবেগ তিনি প্রকাশ করতে পারলেন এমন মানুষদের কাছে যাঁরা সেই বিষয়গুলি সত্যিই বুঝতে পারেন। ইন্ডিয়ান আইরিশ ইনডিপেন্ডেন্স লিগ-এর মিসেস উড্স-এর প্রতি তাঁর সর্বাধিক কৃতজ্ঞতা, গোটা পরিবারটিই অতিথিপরায়ণতায় অসামান্য। “আবার কবে দেখা হবে জানি না,” তাঁকে লিখলেন, “প্রাচীন কবি ভবভূতি লিখেছিলেন ‘কালহ্যয়ং নিরবধি বিপুলা চ পৃথ্বীঃ’, হয়তো আবারও দেখা হবে— শেলবোর্ন হোটেলে যেমন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকেও দেখতে পেয়ে গেলাম, হয়তো সে রকমই হবে কখনও।”৫৭

১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সুভাষ ‘প্রেসিডেন্ট হাডির্ং’ নামের একটি মার্কিনি লাইনারে চেপে ফ্রান্সের উদ্দেশে রওনা হলেন। প্যারিসে আবারও আঁদ্রে জিদ ও আঁদ্রে মালরোর মতো চিন্তাবিদদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেন। কথা হল শিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী এম গের্নাট-এর সঙ্গে, যাঁকে তাঁর “সদয় হলেও একটু বেশি রকম অফিশিয়াল” বলে মনে হল।৫৮ ফরাসি সরকারি কর্তাদের মাথায় যে ভারত বিষয়ক চিন্তার তেমন গুরুত্বই নেই, সেটা তত আশ্চর্য নয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে “লিগ এগেনস্ট ইম্পিরিয়ালিজম” আয়োজিত একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে সুভাষ ভারতীয় আন্দোলনের দুটি দিক বিশ্লেষণ করলেন: জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং নতুন সমাজব্যবস্থা গঠনের প্রয়াস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যেহেতু ভারতের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে, ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন আসলে “সমগ্র মানবতা”রই বিবেচ্য বিষয়। অনেকেরই মনে এখন এশিয়ায় জাপানের সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে উৎকণ্ঠা, বললেন তিনি। তাঁর যুক্তি, “আগামী কাল যদি চিন শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, আগামী কাল যদি ভারত স্বাধীন হয়, তা হলে এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যও নিশ্চিত ভাবে প্রভাবিত হবে, জাপানি সাম্রাজ্যবাদের প্রসারও প্রতিহত করা সম্ভব হবে।” “সামাজিক মুক্তির প্রশ্নটিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উপর জনমতের প্রবল চাপ রয়েছে যাতে কংগ্রেস প্রত্যক্ষ ভাবে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করে।”৫৯

১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সুভাষ প্যারিস থেকে বাডগাস্টাইন যাওয়ার পথে লসানে গেলেন নেহরুকে দেখতে, এবং ভিলনভ-এ গেলেন রোম্যাঁ রোল্যাঁকে দেখতে। লসানে তিনি আটকে গেলেন, কমলা নেহরু তখন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি শেষ নিশ্বাস ফেললেন। সুভাষ শেষ পর্যন্ত জওহরলাল ও তাঁর কন্যা ইন্দিরার সঙ্গে রইলেন, শেষকৃত্যের ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করলেন।৬০ জওহরলালের জীবনের এই শোকের মুহূর্তে আরও ঘনিষ্ঠ রূপ পেল সুভাষ ও জওহরলালের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ছয় সপ্তাহেরও বেশি ঝড়ের মতো ইউরোপ-সফরের পর এই ১৯৩৬ সালের ৩ মার্চ বাডগাস্টাইন-এর কুরহউস হখল্যান্ড-এ পৌঁছে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন সুভাষ। লিখলেন, “অসাধারণ দৃশ্য: একেবারে হিমালয়ের মতো। চার দিক তুষারাবৃত, দৃপ্ত অটল পর্বতরাজি।”৬১ পরের দিন জওহরকে একটি উষ্ণ আন্তরিক চিঠি লিখলেন— জওহর শীঘ্রই ভারত যাচ্ছেন কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে। ভারতীয় রাজনীতির আবর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার আগে ইউরোপে তাঁর বন্ধু আর একটু বিশ্রাম পেলে ভাল হত, মনে হল তাঁর। জওহরলালের নেতৃত্বের উপর তাঁর দৃঢ় আস্থা বেরিয়ে এল সেই বার্তায়:

আজকের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে তুমিই একমাত্র, ভবিষ্যতে যাঁকে কংগ্রেসের নেতা হিসেবে আমরা ভাবতে পারি। তা ছাড়া তোমার অবস্থানেরও একটা বিশেষত্ব আছে। আমার মনে হয় মহাত্মা গাঁধীও অন্য কারও চেয়ে তোমার প্রতি অনেক বেশি সদয় হবেন। আমার আন্তরিক আশা, এই অবস্থানের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার তুমি করতে পারবে, নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। আমার অনুরোধ, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার থেকে নিজের অবস্থানকে কখনও কমিয়ে ভেবো না। গাঁধীজি কখনও এমন কিছু করবেন না যাতে তুমি একা হয়ে পড়ো।

জওহরলাল যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একটি বিদেশি শাখা তৈরি করতে চাইছেন, তাতে ভারী খুশি সুভাষ। তাঁর নিজের ভাবনার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায় এই ভাবনা।৬২

ইউরোপে তিন বছর কাটিয়েছেন, ভারতে ফেরার সময় প্রায় হয়ে এসেছে, ইতালি ও জার্মানি সম্পর্কে নিজের মত একান্তে বা প্রকাশ্যে জানাতে এখন প্রস্তুত সুভাষ। ১৯৩৫-এর শেষ দিকে ইতালি ইথিয়োপিয়ার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরু করতেই ইতালির উপর একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে ফেলেছেন তিনি। ইতালির আগ্রাসন ও ব্রিটিশ ভণ্ডামির তীব্র সমালোচনা রয়েছে তাতে। ইথিয়োপিয়ার ঘটনা থেকে তিনি শিখলেন যে বিংশ শতকে এখন “কোনও জাতি যদি শক্তিমান হয়, একমাত্র তবেই সে স্বাধীন থাকার আশা করতে পারে।”

তার জন্য দরকার আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর দখল। পূর্ব আফ্রিকার দুর্ভাগ্যজনক সব ঘটনা থেকে কোনও ভাবে একটা শুভ অর্থ বার করার চেষ্টা করলেন সুভাষ। “আবিসিনিয়ার পরাজয় হবেই, তবে এও ঠিক যে বিশ্বের বিবেকের কাছে কিন্তু সে একটা আলাদা বার্তা রেখে গেল।” দুই ভাবে এই শুভ অর্থ তৈরি হওয়া সম্ভব: অশ্বেতাঙ্গ মানুষের মধ্যে এক নতুন জাগরণের মাধ্যমে, কিংবা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অভ্যন্তরে সাম্রাজ্যবাদী অভিযানের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে। ইতালীয় সাম্রাজ্যবাদের উত্থান যদি এই দ্বিতীয় ধারাটি শুরু করে দিতে পারে, তা হলে বলতে হবে “আবিসিনিয়ার এত যন্ত্রণা বৃথা যায়নি।”৬৩

ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর কাছে অবশ্য ইতালির অন্যায় অভিযানের থেকেও বেশি উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে জার্মানির নীতি। রবীন্দ্রনাথের প্রাক্তন সহকারী কবি অমিয় চক্রবর্তীকে জার্মানির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অনেক নালিশের কথা লিখলেন তিনি, “ওরা শক্তের ভক্ত— নরমের যম। সুতরাং প্রতিবাদ ছাড়া আমাদের উপায় নাই। ইটালীর বিরুদ্ধে মানবতার দিক থেকে আমাদের অভিযোগ আছে— ভারতের স্বার্থ বা আত্মসম্মানের দিক দিয়া কোনও অভিযোগ নাই। কিন্তু জার্ম্মানীর বিরুদ্ধে ভারতের দিক থেকে আমাদের বহু অভিযোগ আছে।” ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস-কে অনুরোধ করলেন মিউনিখে হিটলারের সাম্প্রতিক বক্তৃতার “তীব্র প্রতিবাদ” করতে, সেখানে ফুয়েরার বলেছেন শ্বেতাঙ্গ জাতিরাই শেষ পর্যন্ত পৃথিবী শাসন করবে, সেটাই নিয়তি। নিজেই জার্মানির সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন ভারতের প্রচারমাধ্যমে। তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন “হিটলারের গভর্নমেন্টের পতনের আশু সম্ভাবনা মোটেই নাই।” দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষটি লিখলেন, “যুদ্ধ যদি কোনও দিন বাধে, এবং যুদ্ধে যদি জার্ম্মানীর অবস্থা কাহিল হয়, তাহা হইলে হয়তো পতন হইতে পারে, নতুবা নয়।”৬৪

এক ভারতীয় বন্ধুর কাছে এই সব কথা লিখছেন, সঙ্গে সঙ্গে একই ভাবে সোজাসুজি তাঁর প্রধান জার্মান সহযোগীকেও নিজের বক্তব্য জানাচ্ছেন, জানাচ্ছেন জেনিভার প্রচারমাধ্যমকেও। ডয়েশ অ্যাকাডেমির ফ্রানজ্ থিয়েরফেল্ডারকে বললেন, তিনি ভারত ফিরছেন এই উপলব্ধি নিয়ে যে “জার্মানির এই নতুন জাতীয়তাবাদ” “কেবল সংকীর্ণ ও স্বার্থপর নয়, অত্যন্ত উদ্ধত।” জার্মান সরকার যে জাপান ও ভারতকে হিটলারের এই আক্রমণাত্মক বক্তৃতার কূটনৈতিক ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে তা তিনি শুনেছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নন যেহেতু ব্রিটিশ বা জার্মান কোনও প্রেসই তা প্রকাশ করেনি। এখনও জার্মানি এবং ভারতের মধ্যে বোঝাপড়ার চেষ্টা করতে প্রস্তুত তিনি, কিন্তু শর্ত একটাই, ভারতের “জাতীয় আত্মসম্মান”কে যোগ্য মর্যাদা দিলেই একমাত্র সেটা সম্ভব। “আমরা যখন বিশ্বের প্রধানতম সাম্রাজ্যটির বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য, নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই চালাচ্ছি, যখন আমরা আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য বিষয়ে নিশ্চিত, অন্য কোনও জাতির কাছ থেকে কোনও অপমান, আমাদের জাতি বা সংস্কৃতি বিষয়ে কোনও আক্রমণ সহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না,” তিনি ঘোষণা করলেন।৬৫ জেনিভার প্রেসের সঙ্গে কথা বলার সময়ে আরও দ্বিধাহীন তিনি। ব্রিটিশদের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য জার্মান ফুয়েরারের এই সব অপমানকর মন্তব্যে তিনি “অসম্ভব বিচলিত।” “জার্মানরা যদি ব্রিটিশদের জুতো চাটতে ইচ্ছা করে, তাতে আমার কোনই আপত্তি নেই,” তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ তাঁর কথায়, “কিন্তু তারা যদি ভাবে ১৯৩৬ সালে ভারতের প্রতি উদ্দিষ্ট কোনও অপমান আমরা চুপচাপ মেনে নেব, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে তাঁরা খুব ভুল ভাবছেন।”৬৬

যে সব ইউরোপীয় বন্ধুরা নাৎসিদের চক্ষুশূল হয়ে উঠতে পারেন, তাঁদের নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না সুভাষের। ১৯৩৫-এর ডিসেম্বরে কিটি কুর্টিকে লিখলেন, “মাঝে মাঝেই ভাবি, কেন তুমি থাকো বার্লিনে?” “এখানকার আবহাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে না তোমার?”৬৭ কুর্টি দম্পতির তখন দুই দিক দিয়ে সংকট: একে তাঁরা চেকোস্লোভাকীয়, তায় ইহুদি। ১৯৩৬-এ বার্লিনে যাওয়ার সময় কিটি কুর্টির সঙ্গে দেখা করলেন সুভাষ, জার্মানি ছাড়ার পরামর্শ দিলেন। শীঘ্রই তাঁরা দেশে ফেরার কথা ভাবছেন জেনে আশ্বস্ত হয়েও সুভাষ মনে করিয়ে দিলেন, “চেকোস্লোভাকিয়া কিন্তু বড্ড কাছে, আর দেশ হিসেবে বড্ড দুর্বল।” সবে প্রাগ থেকে ফিরেছেন তিনি। কিুর্টদের বললেন আমেরিকা যাওয়ার কথা ভাবতে, ভিসা পেলেই সঙ্গে সঙ্গে পাড়ি দিতে। “এত কিছুই বললেন, কিন্তু বললেন তাঁর স্বভাবগত মিতভাষিতার সঙ্গেই,” আমেরিকায় চলে এসে কিটি কুর্টি পরে স্মরণ করেন, “প্রতিটি কথায় লুকিয়ে ছিল তাঁর উদ্বেগ। ভাবলে এখনও আমার কৃতজ্ঞ লাগে। নাত্সিদের প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা দেখে সত্যি খুশি হয়েছিলাম সে দিন, তিনিও মোটেই নিজের মনোভাব লুকোনোর চেষ্টা করেননি আমার কাছে।”৬৮

১৯৩৬ সালের মার্চে ভারতে ফেরার ব্যবস্থাপনা করছেন, এমন সময় ব্রিটিশ বিদেশ সচিবের কাছ থেকে ভিয়েনার রাষ্ট্রদূত মারফত একটা কড়া সাবধানবাণী এসে পৌঁছল: “গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া স্পষ্ট ভাবে জানাতে চায় যে, ফেরত গেলে কিন্তু আপনার মুক্ত ভাবে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”৬৯ কিছু দিন আগেই মহা ঘটা করে ১৯৩৫ সালের নতুন ভারতশাসন আইনের মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত হয়েছে। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার নির্বাচনের পরিকল্পনা। সতর্কবাণী পেয়ে সুভাষ ভাবতে আরম্ভ করলেন, এ কি তা হলে “নতুন সংবিধানের নতুন প্রসারিত অধিকার কেমন হতে চলেছে, তারই পূর্ব-ইঙ্গিত?”৭০ সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে ফিরে যাবেন, এই তাঁর বাসনা, তবে নেহরুর কাছে চিঠিতে এ বিষয়ে উপদেশও চাইলেন: “এমন একটা ব্যাপারে তোমাকে বিরক্ত করার একটাই কারণ, আর কারও কথাই মনে পড়ছে না যাকে তোমার চেয়েও বেশি আস্থাভাজন ভাবতে পারি।”৭১

সরাসরি সাবধানবার্তা পাওয়ার আগেও নানা ইঙ্গিত মিলছিল যে দেশে গেলে তাঁকে জেলেই থাকতে হবে। তবু যেন একটু কিছু সম্ভাবনা ছিল যে হয়তো এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে লখনৌ কংগ্রেস-এ উপস্থিত থাকতে পারবেন, জওহরলাল যেখানে সভাপতিত্ব করতে চলেছেন। এখন সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি বন্ধ হল। সুভাষকে নিজের বোধ-অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে এবং অনন্ত নির্বাসনে নিজেকে নিক্ষেপ না করতে লিখলেন জওহরলাল। কিন্তু তাঁর সেই উত্তর আসার আগেই পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন সুভাষ।৭২ রোম্যাঁ রোল্যাঁ তাঁর “সহানুভূতি ও স্নেহ” পাঠালেন, ফেরার সময়টা একটু পিছোনো যায় কি না ভেবে দেখতে বললেন। সুভাষের উত্তর, এখনই ভারতে ফেরার প্রকৃষ্ট সময়। বললেন, “কারও জীবনের সবচেয়ে ভাল আর সবচেয়ে সৃজনশীল সময়টা যদি জেলে বসে কাটাতে হয়, সেটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু এই পৃথিবীর পরাধীন জাতিকে তো এমন দাম সব সময়েই দিতে হয়েছে, দিয়ে যেতে হবেও বটে।”৭৩

গোটা পৃথিবীর অলক্ষ্যেই থেকে গেল যে কথা— সুভাষের ইউরোপ ছাড়ার মূল সংকটটা আসলে অন্যত্র— ভারতে গিয়ে নিশ্চিত বন্দিত্বের মুখে পড়া নয়, বরং যে নারীটিকে তিনি ভালবেসে ফেলেছেন, তাঁর থেকে বিচ্ছেদ। দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে এমিলিকে যে চিঠিটি লিখলেন, তাতে এ বার সরাসরি স্বীকার করলেন তাঁর অনুভূতি। “সমুদ্রগর্ভের তুষারশৃঙ্গও কখনও কখনও গলে, আমারও এখন সেই অবস্থা।” কিন্তু তিনি তো ইতিমধ্যেই নিজেকে “সঁপে দিয়েছেন” তাঁর “প্রথম প্রেম”— তাঁর দেশ-এর কাছে, তার কাছে ফিরতেই হবে তাঁকে। আবারও অনিশ্চয়ের মধ্যে ঝাঁপ দিতে চলেছেন তিনি:

ভবিষ্যতে কপালে কী আছে জানি না। হয়তো জেলেই আমার অবশিষ্ট জীবন কাটবে, হয়তো-বা গুলিতে মারা যাব, হয়তো ফাঁসিতে। যাই ঘটুক না কেন, তোমার কথা রইবে আমার অন্তরে, আমার জন্য উদ্বেলিত তোমার ভালবাসার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব, নীরবে। হয়তো আর কখনও তোমায় দেখতে পাব না— হয়তো ফিরে গিয়ে আর তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না— কিন্তু বিশ্বাস করো, তুমিই রইবে আমার হৃদয়ে, আমার ভাবনায়, আমার স্বপ্নে। নিয়তি যদি এমন ভাবেই ইহজন্মে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে— তোমাকে যেন পরজন্মে পাই, তার অপেক্ষায় থাকব।

“কখনও ভাবিনি নারীর ভালবাসা এমন ভাবে জড়িয়ে ফেলবে আমায়,” ভাবলেন তিনি,

এই ভালবাসার কি কোনও পার্থিব মূল্য আছে? আমরা দুই জনে দুই আলাদা ভুবনের মানুষ— কোনও কি সাযুজ্য আছে আমাদের জীবনে? আমার দেশ, আমার দেশবাসী, আমার ঐতিহ্য, আমার অভ্যাস, সংস্কার, আমার দেশের পরিবেশ— বাস্তবিক, সব কিছুই এত আলাদা তোমার বাস্তবের থেকে… কিন্তু এই মুহূর্তে দুই দেশের যা কিছু দূরত্ব সব মুছে গিয়েছে আমার মন থেকে। আমি কেবল তোমার ভেতরের নারীটিকে ভালবেসেছি, তোমার আত্মাকে ভালবেসেছি।৭৪

ভারতে রওনা হওয়ার আগের কয়েকটি দিন, ১৯৩৬-এর ১৭ থেকে ২৬ মার্চ সুভাষ এমিলির সঙ্গে বাডগাস্টাইনে কাটালেন। “এক সপ্তাহের জন্য এখানে আসবে, প্লিজ?” ১৫ মার্চ মিনতি করে লেখেন তিনি। “প্লিজ তোমার বাবা-মাকে বলে দেখো তাঁরা যদি সপ্তাহ-খানেকের জন্য তোমাকে বাড়ি ছেড়ে আসতে দেন।”৭৫ ১৮২৫ সালে বাডগাস্টাইন-এর পাহাড় আর উপত্যকা শুবার্ট-এর মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছিল, এখানেই তিনি রচনা করেছিলেন পিয়ানো সোনাটা ‘ডি’, এবং একটি অজানা সিম্ফনি, সম্ভবত তাঁর অসাধারণ সিম্ফনি ‘সি মেজর’। সেই একই পাহাড় এ বার সুভাষকেও জাদু করে ফেলল। যেখানে তাঁরা থাকতেন, সেই কুরহউস হখল্যান্ড থেকে সুভাষ ও এমিলি লম্বা লম্বা পথ ধরে হাঁটতেন, গ্রুনার বম-এ পৌঁছে যেতেন কফি খেতে। দু’জনে উপভোগ করতেন বরফ-ঢাকা বাডগাস্টাইন-এর সৌন্দর্য, উষ্ণ প্রস্রবণের উজ্জীবন, কয়েক মুহূর্তের জন্য দু’জনের সুরে সুর মিশে তৈরি হয়ে উঠত তাঁদেরই একান্ত নিজস্ব সিম্ফনি।৭৬

১৭ মার্চ বাডগাস্টাইন থেকে ভারতে এক তরুণ নববিবাহিত সহকর্মীকে চিঠিতে অভিনন্দন জানান সুভাষ। তাঁর নিজের জীবনদর্শন, জীবনের বিভিন্ন কাজের বিভিন্ন রকম গুরুত্ব, এ সব কথা উঠে এল সেই চিঠিতে। “নিজের ও পরিবারের সুখ বলে আমার কাছে কিছু নেই, যদি-না নিজের ও পরিবারের জীবনই নিবেদিত হয় দেশের মঙ্গলের জন্য। তাই আমার বিশেষ প্রার্থনা, তোমাদের জীবন যেন তোমাদের দেশ ও দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করতে পারো, তাতেই সত্যিকারের সুখ ও পূর্ণতা খুঁজে পাবে।”৭৭ ২৬ মার্চ এমিলি ভিয়েনার ট্রেন ধরলেন, সুভাষ ভারতের পথ ধরলেন। “এখন আমি তীর্থযাত্রী,” সে দিন তাঁর মনে হয়েছিল, “তাই আমার কোনও চিন্তা নেই।”৭৮ ভিলাক ও নেপ্লস থেকে সুভাষ এমিলিকে চিঠি লিখলেন, তার পর ইতালীয় জাহাজ কন্তে ভের্দে উঠে পড়লেন।৭৯

“কত কী তোমায় লিখে জানাতে ইচ্ছে করে,” ২৯ মার্চ সমুদ্রের উপর থেকে লিখলেন, “কিন্তু ছাড়া-ছাড়া ভাবে লিখতে হচ্ছে, তাই একটু মন দিয়ে পোড়ো এই চিঠি।”৮০ এখন থেকে এমিলিকে সুভাষের চিঠির পুরো অর্থ বুঝতে হলে কেবল বাক্যগুলি পড়লেই চলবে না, বাক্যের মধ্যে নিহিত কথাগুলিও পড়তে হবে। ১৯৩৬-এ মার্চের শেষাশেষি জাহাজ থেকেই তিনি তাঁকে পর পর তিন দিন তিনটি চিঠি লিখলেন, আর তার থেকেই শুরু হল তাঁদের প্রায় কুড়ি মাসের ভৌগোলিক বিচ্ছেদ-পর্ব। পোর্ট সাইদে পুলিশ অফিসাররা এসে তল্লাশি চালাল তাঁর খোঁজে, পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করল, কড়া পাহারায় তাঁকে রাখার ব্যবস্থা করল। ১৯৩৫-এর জানুয়ারিতে মিশরের জাতীয় নেতা মুস্তাফা এল নাহাস পাশার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর।৮১ কিন্তু এ বার আর তাঁকে মিশরে নামতে বা কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে না, স্পষ্টতই।

“এই দীর্ঘ চিঠি শেষ করার আগে আর একটি কথা।” ১৯৩৬-এর ৩০ মার্চ ভূমধ্যসাগর ছেড়ে ভারতীয় মহাসাগরে ঢোকার আগে লিখলেন সুভাষ, “জীবনে কখনও কোনও ক্ষুদ্র বস্তু বা ক্ষুদ্র আদর্শের জন্য প্রার্থনা করবে না। সব সময়ে প্রার্থনা করবে মানবতার মঙ্গলের জন্য— প্রার্থনা করবে সর্বকালের মঙ্গলের জন্য— প্রার্থনা করবে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে যা-কিছু মঙ্গলদায়ক, তার জন্য। নিষ্কাম ভাবে প্রার্থনা করবে।”৮২ নিজে যখন সামনের কঠিন সময়ের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছেন, সেই সময় ভালবাসার নারীটির জন্য এই ছিল তাঁর উপহার, গীতা-র আদর্শের উপহার।

অপেক্ষমাণ নেতা

৮ এপ্রিল জাহাজ বম্বের উপকূলে এসে ভিড়তেই পুলিশ এসে সুভাষকে আর্থার রোড জেলে নিয়ে গেল। জনগণ উত্তাল প্রতিবাদ জানালেও সরকার অবিচল। কয়েক দিন পর, পুণার ইয়েরাভদা সেন্ট্রাল জেলে তিনি স্থানান্তরিত হলেন।৮৩ ১৯৩২-এ গাঁধীকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানেই রাখা হল তাঁকে। সরকারের উপর চাপ দিতে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জওহরলাল নেহরু সমগ্র জাতিকে “সারা ভারত সুভাষ দিবস” পালন করতে বললেন ১৯৩৬-এর ১০ মে। “আমরা যাঁরা তাঁকে চিনি, আমরা জানি তাঁর বিরুদ্ধে আনা এই সব অভিযোগ কী অর্থহীন,” নেহরু লিখলেন। “আমার কাছে পরামর্শ চেয়ে আমাকে সম্মানিত করেছিলেন সুভাষ। বিস্মিত, হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম। যে পরামর্শের অর্থ দাঁড়াতে পারে বন্দিত্ব, তেমন পরামর্শ অন্যকে দেওয়া সহজ কাজ নয়। যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছেন সুভাষ বসু, এতটাই যে তাঁর স্বাস্থ্যও ভেঙে গিয়েছে।”৮৪

পশ্চিম ভারতে তাপমান তখন ছুঁয়ে যাচ্ছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট); অসহ্য গরমে কষ্ট পাচ্ছেন সুভাষ। “কল্পনাও করতে পারবে না কী গরম এখানে,” ১১ মে এমিলিকে লিখলেন। “ইউরোপ ছাড়ার সময় বাডগাস্টাইন কেমন ঘন বরফে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, সে কথা ভাবি মাঝে মাঝেই।” আরও দিন-দশেক পর সরকার স্থির করল, উত্তরবাংলার কার্শিয়াং-এ শরৎ বসুর বাংলোয় সুভাষকে ‘ইন্টার্ন’ করে রাখা হবে। সমুদ্রতল থেকে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় দার্জিলিঙের পথে এই জায়গা। “এখানে সুন্দর ঠাণ্ডা,” ২২ মে এমিলিকে জানালেন। “ভিলা থেকে সমতলের সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।”৮৫ ডিসেম্বর অবধি প্রায় একাকী থাকতে হল সেখানে।

চার বছর পর বাংলায় ফিরে এসেছেন সুভাষ, কিন্তু বাংলার রাজনীতি-মঞ্চ থেকে দূরেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে মাঝখানের নির্বাসনকালে। এ দিকে বাংলা ও ভারত থেকে তাঁর অনিচ্ছাকৃত অনুপস্থিতির কারণে জাতীয় রাজনীতিরও ক্ষতি হয়েছে অনেক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী মেজদাদা শরৎও ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত বন্দি ছিলেন। ১৯৩৬ থেকে বাংলা কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন শরৎ, কিন্তু সুভাষকে কোনও ভাবেই ১৯৩৭-এর নির্বাচনের প্রস্তুতিতে অংশ নিতে দেওয়া হল না।

আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় এবং ১৯৩২ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনেই যে কেবল ভ্রাতৃদ্বয়ের সাহসিক নেতৃত্ব দেখা গেল না, তাই নয়, অন্য কোনও নেতার মধ্যেও সেই ঔদার্য বা দৃরদৃষ্টি দেখা গেল না যাঁরা এই সংকট সময়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি আটকাতে পারতেন। ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে তাঁরা ফিরে এসে ঘটনার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা শুরু করার আগেই এই দিকটিতে অনেক বড় বড় অঘটন ঘটে গিয়েছিল। “বাংলার সমস্যাটা কী হচ্ছে আমায় বলতে পারেন?” ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে ভিয়েনা থেকে সুভাষ কলকাতার মেয়রের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। “আবার তো গোড়া থেকে সব কাজ শুরু করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।”৮৬ ১৯৩৫ সালের আইনে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থায় মুসলিমদের বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় ১১৯টি আসন দেওয়া হয়েছিল, হিন্দুদের ৮০টি। সেই ৮০টির মধ্যে ৫০টি সাধারণ আসন, ৩০টি তফশিলিভুক্ত জাতির জন্য সংরক্ষিত। যার সঙ্গে আরও ৩৯টি আসন দেওয়া হয়েছিল ইউরোপীয়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীগুলিকে। মুসলিম সমর্থন কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে তখন কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লিগের সঙ্গে। ১৯৩৭-এ লিখলেন সুভাষ, “বাংলার কৃষক সমাজের মুখপাত্র হিসেবে কংগ্রেস এগিয়ে আসতে পারে কি না, তারই উপর নির্ভর করছে বাংলা কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ।”৮৭ ঠিকই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাবনাকে কাজে পরিণত করার অবস্থায় তিনি সে দিন ছিলেন না।

জুনের প্রথমে শরৎ দুই দিনের জন্য আসতে অনুমতি পাওয়ায় প্রফুল্ল হয়ে উঠলেন সুভাষ। অনেক দিন পর পরিবারের খবরাখবর পাবেন, রাজনৈতিক সংবাদ পাবেন তিনি। সেই মাসেরই শেষে তাঁর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র, শরতের পুত্র অমিয় ও শিশিরকেও দিন-পনেরোর জন্য আসতে দেওয়া হল। সুভাষ খুব খুশি হলেন তাঁদের পেয়ে, ইউরোপীয় আদবকায়দা শেখালেন দু’জনকে। ডিনার টেবিলে যখন তাঁরা স্যুপের বাটি নিজেদের উল্টো দিকে ঘুরিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করলেন, সুভাষ মনে করিয়ে দিলেন এটা কিন্তু ব্রিটিশ রীতি। তিনি বাটিটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ধরলেন, যেমনটা করা হয় ইউরোপের বাকি অংশে— সব বিষয়েই যাতে দেশের ঔপনিবেশিক শাসকদের শিক্ষাটাই বহন না করতে হয়, তারই একটি ছোট্ট শিক্ষা আর কী।৮৮ ভ্রাতুষ্পুত্র দু’জন সমতলে ফিরে এলে সুভাষ আবার নিজের বই আর চিঠিপত্র নিয়ে রইলেন। ১৯৩৬ সালের ৩০ জুন বাংলার সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে লিখে জানালেন যে মহাত্মা গাঁধী তাঁর সঙ্গে “কিছু অরাজনৈতিক বিষয়ে, যেমন খাদি, হরিজন আন্দোলন কিংবা গ্রাম সংস্কার” নিয়ে “যোগাযোগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।” বাংলা সরকার ও ভারত সরকারের কিন্তু মনে হল, এগুলিও “পাবলিক অ্যাফেয়ার্স”-এর মধ্যেই পড়ে, তাই গাঁধী ও সুভাষকে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুমতি দেওয়া হল না।৮৯ ১৯৩৬ সালের ৮ জুলাইয়ে নেহরুর সুভাষকে ইন্ডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন তৈরি বিষয়ে লেখা চিঠি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করল।৯০ বিচার ছাড়াই এই ভাবে তাঁর অবিচ্ছিন্ন বন্দিত্বের মধ্যে এস সত্যমূর্তি কিংবা ভি ভি গিরি-র মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যরা সুভাষের স্বাস্থ্য নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্নের ঝড় তুলে গেলেন। হাউস অব লর্ডস-এ লর্ড কিনুলিনের প্রশ্নের উত্তরে লর্ড জেটল্যান্ড বললেন, “কোনও প্রশাসনের পক্ষে এর থেকে অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ আর হতে পারে না,” কিন্তু “ভারতে এটা এড়ানো গেল না।” “বিরাট ক্ষমতাধর, সম্ভবত জিনিয়াস” বলে সুভাষকে বর্ণনা করে সেক্রেটারি অব স্টেট বললেন, দুঃখের বিষয় যে “ইনি সর্বদা গঠনমূলক কাজের বদলে ধ্বংসাত্মক কাজেই নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন।”৯১

জুলাই থেকে সুভাষকে বাংলোর এক মাইল দূরত্বে পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হল। “এক মাইল অবধি যেতে পারাটা নিশ্চয়ই তেমন কিছুই নয়, তাও কিছুই না পাওয়ার চেয়ে তো এটুকু ভাল,” এমিলির মন্তব্য। ওই দূরত্বের মধ্যেই পড়ে “পাগলা ঝোরা”, তার ছবি তোলার শখ হল তাঁর। একটা গ্রামোফোন জোগাড় করলেন, এমিলির কাছে ইউরোপীয় সঙ্গীতের ভাল কিছু রেকর্ডিং-এর খোঁজ করলেন।৯২ নেহরুর কাছে নানাবিধ রাজনৈতিক লেখাপত্র ও অন্যান্য লেখাপত্রের তালিকা পাঠালেন, যার মধ্যে ছিল গর্ডন ইস্ট-এর অ্যান হিস্টোরিক্যাল জিওগ্রাফি অব ইউরোপ, জর্জ পিট-রিভার্সের দ্য ক্ল্যাশ অব কালচার অ্যান্ড দ্য কনট্যাক্ট অব রেসেস, জে এ স্পেন্ডারের আ শর্ট হিস্টরি অব আওয়ার টাইমস, ডেডলাস, কিংবা জে বি এস হ্যালডেনের সায়েন্স অ্যান্ড দ্য ফিউচার।৯৩ জুলাই-এ পড়লেন ফ্রয়েড-এর ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস, নিজের স্বপ্নের ক্ষেত্রে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন। ইউরোপে থাকার সময়ে কিটি কুর্টির কাছে জেনেছিলেন, ফ্রয়েড-এর তত্ত্বে যৌনচেতনার যে কেন্দ্রীয় প্রাধান্য, তার থেকে সরে গিয়ে ইয়ুং জোর দিতে চান আত্মার উপর। উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুইটজারল্যান্ডে গিয়ে ইয়ুংকে কখনও দেখেছেন কি না, জানতে চেয়েছিলেন ইয়ুং-এর সাম্প্রতিক কাজ সম্পর্কে। ফ্রয়েড ও তাঁর পরিবার বিষয়ে কিটি কী ভাবেন, ভিয়েনায় থাকার সময়ে তাও সুভাষ জানতে চান।৯৪

সুভাষের সব চিঠিই পুলিশের নজরদারির মধ্যে দিয়ে যেত, দার্জিলিঙের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টকে তার উপর স্বীকৃতির ছাপ লাগাতে হত। সুভাষ ও এমিলির চিঠিপত্রে দু’জনেই “ফর্মাল” সম্বোধন ব্যবহার করতেন, লিখতেন “ফ্রলাইন শেঙ্কল” আর “মি. বোস”, তাও তাঁদের মধ্যে বেশ খুঁটিনাটি তথ্যের বিনিময় চলত। তাঁর “জঘন্য দিনগুলোতে” এমিলির এক-একটি দীর্ঘ চিঠির মাধ্যমেই আনন্দের অবকাশ তৈরি হয়ে উঠত, তাঁর “মন কিছু ক্ষণের জন্য পাড়ি দিত ভিয়েনায়”। ১৯৩৬-এর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে যে চিঠিপত্র বিনিময় হয়, কত রকম বিষয়ই ছিল তাতে— অস্ট্রিয়ার রাজনীতি, বই, আধ্যাত্মিকতা, পরস্পরের খারাপ স্বাস্থ্য বিষয়ে উদ্বেগ। যে চিঠিটিকে ‘প্রেমপত্র’ গোত্রের সবচেয়ে কাছাকাছি বলা যায়, সেটিতে তিনি এমিলিকে গ্যোয়টের একটি কবিতার মূল জার্মান বয়ান খুঁজে বার করতে বলেছিলেন। কালিদাসের প্রভাবে লিখিত কবিতাটি তিনি পড়েছেন ইংরেজিতে:

Wouldst thou the young year’s blossoms and the fruits of its decline,

And all whereby the soul is enraptured, feasted, fed;

Wouldst thou the heaven and earth in one sole name combine,

I name thee, oh Shakuntala! And all at once is said.

সুভাষ খেয়াল করলেন, এমিলি ক্রমেই আধ্যাত্মিক বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন। আশ্বাস চাইলেন— পার্থিব জগৎ সম্পূর্ণ ছেড়ে দেবেন না তো তিনি? পেলেন সেই আশ্বাস। একটা মজার স্বপ্ন লিখলেন এমিলি, তিনি যেন হিমালয় পর্বতে এসেছেন, “একেবারে উঁচু চূড়াগুলির কাছাকাছি কোথাও।” সুভাষ তাঁকে জানালেন, গীতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল “কর্মযোগ”-এর উপর দ্বিতীয় অধ্যায়টি, যাতে কর্মের মধ্য দিয়েই ভালবাসার মানুষটির সঙ্গে মিলনের কথা আছে। এমিলির যেন “অস্ট্রিয়ার জন্য ততটা ভালবাসা নেই।” আর সুভাষ মনে-প্রাণে জাতীয়তাবাদী, তিনি স্বপ্ন দেখেই চলেন যে ১৯৩৬-এর অলিম্পিকস-এ ভারত খুব খারাপ করলেও “অন্তত হকিতে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে শেষ পর্যন্ত।” এক বার একটি চিঠির সঙ্গে এমিলি পাঠিয়ে দিলেন “গ্লুকসলি”, চারটি পাতাবিশিষ্ট এক ধরনের গুল্ম, সেটা নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক। সুভাষের উত্তর, ভারতের বাইরে কোথাও কুসংস্কার নেই বলে ভাবতেন তিনি, ভাবতেন “আমরাই তার সবটা নিয়ে নিয়েছি”। ভিয়েনার কাফেগুলিতে আজকাল কী রসিকতা চলছে, এমিলির কাছে জানতে চান তিনি। এমিলি জানান, অস্ট্রিয়ায় নতুন শিলিংগুলি নাকি রাবারের তৈরি, সেগুলিকে টেনে লম্বা করা যায়, “হাত থেকে শিলিং পড়ে গেলেও কোনও শব্দ হয় না।” পরস্পরকে নিজেদের চার পাশের দৃশ্যের ফোটোগ্রাফ পাঠান— তাঁদের ভাষায় “স্ন্যাপস।” স্পষ্ট বোঝা যায়, এমিলি সুভাষের চেয়ে ভাল ফোটোগ্রাফার। হিমালয় পর্বতকে শীত যখন চার দিক থেকে ঢেকে ফেলছে, সেই সময় সুভাষের স্বাস্থ্য আবার খারাপ হতে শুরু করে। “একদম ভাল ছিলাম না আমি, আবহাওয়াও বড্ড খারাপ চলছিল,” ১৫ ডিসেম্বর এমিলিকে লেখেন।৯৫ দুই দিন পর কলকাতার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। বন্দি হিসেবে, অবশ্যই।

কলকাতায় ফিরে খুশি সুভাষ। শীত এখানে আরামদায়ক, বিরাট হাসপাতালটি কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা কলেজ স্ট্রিট আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর উপর। বাস, ট্রাম, হরেক রকমের যানবাহনের ভিড়, জেনারেল ওয়ার্ডে নানা রকম রোগীর নানা কষ্টের হট্টগোল। “অনেক দিনের একাকিত্বের” পর সুভাষ মানুষজনের কাছে থাকতে পেরেই খুশি, “শোরগোল সত্ত্বেও”।৯৬ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নিয়মিত আসার অধিকার ছিল। নিজের হাতের লেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণ করতে পেরে খুব খুশি সুভাষ, কবির নতুন কাব্যসংকলন সঞ্চয়িতার এক কপিও পেলেন সঙ্গে।৯৭ সুভাষ নিজের শহরের পরিচিত পরিবেশে অসুস্থ বন্দি হিসেবেই শুরু করলেন নতুন বছর ১৯৩৭।

এ দিকে নিউ ইয়ার্স ইভ-এ ভিয়েনায় বসে ব্লেগিয়েসেন রীতিতে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ভাবে জানা গেল সেই অস্ট্রিয়ান তরুণীর ভবিষ্যৎ, যাঁর ভাগ্য তত দিনে এমন এক দেশের ভাগ্যের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে, যে দেশকে যিনি কোনও দিন চোখে দেখবেন না। এমিলি সুভাষের কাছে ব্যাপারটা খুলে বললেন। “হঠাৎ ব্লেগিয়েসেন-এর বোকা-বোকা ভাবনাটা আমায় পেয়ে বসল। এটা কী ভাবে করে বলছি। প্রথমে একটা চামচের উপর খানিকটা ধাতব জিনিস নিতে হয়, ধরো সিসা। সেটা পুরো গলে গেলে সেটাকে ঠাণ্ডা জলে মেশাতে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই ওটা আবার কঠিন হয়ে যায়, এবং একটা কোনও আকারও আসে। ওই আকারটাই বলে দেয় যে মানুষটি চামচে এই ধাতু ঢেলেছে তার ভবিষ্যৎ। আমার ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত জিনিস বেরোল, ভারতের মানচিত্রের মতো দেখতে একটা কিছু।”৯৮

এই উপমহাদেশের সঙ্গে এমিলির একমাত্র সংযোগ ভারতীয় সংবাদপত্র, এবং সুভাষের চিঠিপত্র। হেডি ফুলপ-মিলার নামে এক জন ভিয়েনার বন্ধু শরতের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে সেই সময় অতিথি হিসেবে ছিলেন, সুভাষকে দেখতে হাসপাতালেও গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি চিঠি লেখা হল ভিয়েনার নাওমি ভেটারকে: “ভুলে যাওয়ার আগে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি কি। ভারতীয় কাগজে কিছু দিন আগে একটা খবর দেখেছি যে চ্যান্সেলার শুসিং নাকি কয়েক মাস আগে গোপনে মারিয়াজেল-এ বিয়ে করেছেন। নিয়মিত নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে খবরটা আসেনি — তাই সত্যি না গুজব বুঝলাম না। আজকাল বিখ্যাত লোকদের নিয়ে কত রকম গুজবই যে চলে ইউরোপে।”৯৯ আসলে কিন্তু গুজব জানতে চাওয়াটাই এই প্রশ্নের লক্ষ্য নয়। গোপনে বিবাহ করার বিষয়টা তখন সুভাষের নিজেরই মাথায় ভাল রকম ঘুরছে।

১৯৩৭-এর মার্চের গোড়ায় ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে এই অসুস্থ বন্দিকে আটকে রাখাটা ক্রমশই সমস্যাজনক হয়ে উঠছিল। সুভাষের ডাক্তারদের মধ্যে তাঁর অসুখের উৎস নিয়ে নানা মতভেদ, যকৃৎ না কি ফুসফুস, কোথায় গোলমাল বোঝা যাচ্ছে না। প্রধান দায়িত্বে ছিলেন যে ডাক্তার, লেফটেনান্ট কর্নেল ভিয়ার হজের মত, যকৃৎ বড় হয়ে গিয়েই সমস্যার শুরু।১০০ আবার রাজনীতির ক্ষেত্রে, নতুন প্রাদেশিক নির্বাচন হয়ে গিয়েছে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস খুবই ভাল ফল করেছে, এগারো প্রদেশের মধ্যে ছয়টিতে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, আরও দুটিতে সরকার গঠনের অবস্থানে রয়েছে। বাংলায় শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কংগ্রেস প্রায় সব সাধারণ আসন জিতে নিলেও নতুন আইনের কল্যাণে প্রচুর সংখ্যক সংরক্ষিত মুসলিম আসন লাভ করেছে কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লিগ ও নিরপেক্ষ প্রার্থীরা।

নির্বাচনের আগে, জওহরলাল, সুভাষচন্দ্র-সহ কংগ্রেসের চরমবাদীরা প্রদেশে মন্ত্রিসভা গড়তে অসম্মত ছিলেন। নির্বাচনের ভাল ফল দেখে অবশ্য কংগ্রেসের অধিকাংশই এখন নিশ্চিত যে, দল যেখানে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সেখানে সরকার গঠন করা হোক। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটা নিয়ে কংগ্রেস তখনও বিরোধিতায় অনড়, কেননা এই আইনে এমন ভাবে ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা তৈরির কথা বলা হয়েছে যাতে দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের দিয়ে এগারোটি ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুরুত্ব হ্রাস করিয়ে দেওয়া যায়, এই দ্বিতীয় দল যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ না হতে পারেন। ব্রিটিশরা যখন সুভাষকে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে, তাদের অন্যতম দুশ্চিন্তা যে সুভাষ যদি বেরিয়ে এসে মার্চ-এর কংগ্রেস বৈঠকে নেহরুর দল শক্ত করেন! বাংলার মন্ত্রিসভা তৈরির বিষয়েও সুভাষকে কোনও প্রভাব ফেলতে দিতে তাঁদের আপত্তি।১০১ তত্ত্বগত ভাবে যদিও প্রাদেশিক স্তরে মন্ত্রিসভা গঠনে সুভাষ বিরোধিতাই করছিলেন, বসু ভ্রাতৃদ্বয় শিগগিরই এই সিদ্ধান্তে এলেন যে— যে সব প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সেখানে যদি কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করেই, তবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বার্থে, বাংলার মতো প্রদেশগুলিতে শরিকি ভিত্তিতেই সেটা গঠন করা উচিত। যখন বোঝা গেল বাংলায় এই শরিকি মন্ত্রিসভা তৈরি করতে চলেছে কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লিগ, এবং শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধী আসনে বসতে চলেছে, বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসন সুভাষচন্দ্র বসুকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে আর কোনও আপত্তির কারণ দেখলেন না।

১৯৩৭-এর ১৭ মার্চ, রাত দশটার সময় সুভাষকে হঠাৎই মুক্ত করে দেওয়া হল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তিনি বাড়ি এলেন। পরের দিনই চটপট এমিলিকে জানালেন তিনি এই নতুন খবর। “মুক্তির অর্থ— আমি স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে পারি, আমার চিঠিপত্রের উপর আর সরকারি নজরদারি নেই— তবে হ্যাঁ, গোপন নজরদারি সব সময়েই চলে, চলবে।” ২৫ মার্চের চিঠিতে প্রতিশ্রুতি দিলেন, “প্রতি সপ্তাহে অন্তত কয়েক লাইন লিখবই”, এই প্রতিশ্রুতি পরের কয়েক মাস যাবৎ রক্ষা করেছিলেন সুভাষ, কলকাতা, লাহোর, ডালহাউসি, কার্শিয়াং থেকে নিয়মিত এমিলির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররা তাঁকে পাহাড়ে শরীর সারাতে পাঠানোর আগে কলকাতায় একটি সভায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ৫ এপ্রিল লিখলেন সুভাষ: “আগামী কাল আমার জন্য একটা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, বেশ ভিড় হবে মনে হচ্ছে।”১০২

যতটা ভেবেছিলেন, তাকেও ছাপিয়ে গেল ৬ এপ্রিলের ভিড়। শ্রদ্ধানন্দ পার্কে আয়োজিত সেই বিশাল মিটিং-এ ছ’শোটা আলাদা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে মালা পরিয়ে দেওয়া হল, হাতে ফুলের তোড়া দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথের পাঠানো অভিনন্দনবার্তা পাঠ করা হল। সুভাষের নিজেকে মনে হল, “রাজনীতির এক জন সাক্ষাৎ রিপ ভান উইঙ্কল।” সেখানে “দেশের ক্ষুধার্ত অত্যাচারিত লক্ষকোটি মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধীনে” “শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমন্বয়ে একটা বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফ্রন্ট”-এর ভাবনার প্রকাশ করলেন তিনি। সমর্থকদের বললেন, ধৈর্য ধরে খানিকটা অপেক্ষা করতে, “কেননা বিভিন্ন ঘটনার সূত্র খুঁজে, পরিস্থিতি ঠিক মতো বুঝে, সামনের দিকে এগোতে” একটু সময় লাগবে তাঁর।১০৩

এলগিন রোডের বাড়িতে মার্চের শেষে দেখা করতে এলেন বন্ধু দিলীপ, সুভাষ তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, “শিশুর মতো কাঁদলেন।” শ্রীঅরবিন্দের পার্থিবতা থেকে ‘মুক্তি’ নিয়ে তাঁদের দুই জনের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল আগে, এত দিনে তা সরে গিয়েছে। সুভাষের “ক্ষীণ স্বাস্থ্য” দেখে দিলীপ “চমকে উঠলেন”, তবে “আগের চেয়ে অনেক বেশি আধ্যাত্মিকতার ভাব তাঁর মধ্যে, এও ঠিক”।১০৪ সুভাষ ঠিক করলেন, পঞ্জাবের ডালহাউসির পার্বত্য শহরটিতে গিয়ে ডাক্তার ধর্মবীর ও তাঁর স্ত্রী-র কাছে কাটাবেন কয়েক মাস, ইংল্যান্ডে ছাত্রাবস্থায় দিলীপ ও সুভাষ তাঁদের চিনতেন। এপ্রিলের শেষে কলকাতা থেকে ডালহাউসি যাওয়ার পথে সুভাষ মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে এলাহাবাদে গেলেন, আরও দশটি দিন পঞ্জাবের রাজধানী লাহৌরে কাটালেন। ১২ মে-র মধ্যে তিনি পৌঁছে গেলেন ডালহাউসিতে, অনেক বছর আগে ল্যাঙ্কাশায়ারে ধর্মবীরদের সঙ্গে যেমন আরামে কেটেছিল, ঠিক তেমনই কাটল এখানেও।১০৫ তাঁদের কন্যা সীতা ও লীলার প্রতি তিনি অত্যন্ত স্নেহময়, সন্তোষ সেন নামে ডাক্তার বন্ধুটিকে সীতা বিয়ে করতে চায় জেনে তাকে নিজের পুরো সমর্থন জানিয়ে দিলেন। সীতা তখন ডালহাউসিতে নেই, তাকে যে চিঠিগুলি লিখলেন, তাতে তাঁর হালকা রসবোধ আর গভীর মানবিক বোধ, দুই-ই প্রবল ভাবে বেরিয়ে এল। নানা কৌশল করে সীতার মা-বাবাকে বোঝালেন সুভাষ, মেয়ের ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মজীবন দুই দিকেই মেয়ের নিজের স্বপ্নগুলি লালন করতে দেওয়া উচিত।১০৬

হিমালয় পর্বতমালায় সু-উচ্চ শৈলশহর ডালহাউসি স্বভাবতই তাঁকে ভুলতে দিল না অস্ট্রিয়ার আল্পস্-এর কথা। ২৭ মে এমিলিকে অনুরোধ করেছিলেন প্রতি সপ্তাহে তাঁকে একটু করে লেখার জন্য। ইংরেজি চিঠির মধ্যে জার্মান ভাষায় লিখলেন একটি মাত্র লাইন— “আমাকে কি ভুলে গেছ?” “এত কম কেন লেখো আজকাল? তোমার চিঠির আশায় বসে থাকি— জানো না সে কথা?” এমনই এক সময়ে ‘ব্লক-লেটারে’ লিখলেন একটি আবেগ-অভিভূত চিঠি:

কিছু কাল ধরেই এই চিঠি লিখব লিখব ভাবছি— কিন্তু তুমি বুঝবে নিজের অনুভূতির কথা এ ভাবে তোমাকে জানানো আমার পক্ষে কী কঠিন কাজ! আমি তোমাকে বলতে চাই— তুমি যখন আমায় চিনতে তখন আমি যেমন ছিলাম, ঠিক তেমনই আছি। একটি দিনও কাটে না তোমার কথা না ভেবে। সব সময় আমার মন জুড়ে তুমি। আমি বোধহয় এ পৃথিবীতে আর কারও কথা ভাবতেও পারি না… এই কয়েক মাস যে কত একা লেগেছে, কত কষ্ট পেয়েছি, কী করে বলব। একমাত্র একটা জিনিসই এখন আমাকে খুশি করতে পারে— কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব জানি না। যাই হোক, দিনরাত একই কথা ভেবে চলেছি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি ঠিক পথটা আমাকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।

সহজ জার্মানে এমিলিকে উত্তর দিতে বললেন। ১৯৩৭-এর ৩ জুন জার্মানেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রিয়তমা, কী করতে চাও তুমি?” এক সপ্তাহ পর বেশ খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে লিখলেন, আগের দিন চিঠি পেয়েছেন, এবং “সব বুঝতে পেরেছেন।”১০৭

এক কলেজ-বন্ধুর ছোট ভাই তাঁর কাছে পরামর্শ চাইলে ডালহাউসি থেকে তাকে চিঠি লিখলেন: “ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি”, “প্রার্থনাতেও বিশ্বাস করি।” যোগ করলেন, “অবশ্য নিজে খুব একটা করে উঠতে পারি না।” আত্ম-বিশ্বাস, আত্ম-বিশ্লেষণ, আত্ম-নিবেদন— এ সব অভ্যাস করতে শুরু করেছেন কিছু দিন যাবৎ। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস তৈরি পথে নিজের মনকে চিনছেন, তার দুর্বলতার স্থানগুলি সন্ধান করছেন। মন একটা জটিল বস্তু, অনেক সময় নিজেই সে নিজেকে ফাঁকি দেয়, তাই সমানে আত্মবিশ্লেষণ করে চলা দরকার, “প্রাত্যহিক কাজ হিসেবে।” অস্বাভাবিকতার মনস্তত্ত্ব এবং সাইকো-প্যাথলজির চর্চা নিজেকে বিশ্লেষণের কাজে তাঁকে সাহায্য করল। আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের মধ্যে কল্পনা করলেন “স্বর্গীয় শক্তির এক প্রবহমান স্রোত, বার্গসঁ যাকে এলান ভিতাল বলেন, সেই রকম,” সমস্ত অস্তিত্ব যাতে নিমজ্জিত হয়ে যায়: “এই আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে যে স্বর্গীয় স্রোত আমার মধ্যে বইছে তাকে অনুভব করার চেষ্টা করি, বুঝতে পারি আমি কেবল ঈশ্বরের হাতের খেলনা-মাত্র। সচেতন ভাবে কখনও কোনও পার্থিব বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করি না। সংকীর্ণ, ঘৃণ্য সেই আকাঙ্ক্ষা। বরং আত্মনিবেদনের ভাব নিয়ে নিজের মনে বার বার বলি, “তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ”। তাঁর তরুণ বন্ধুকে বলেছিলেন, “সবচেয়ে আনন্দ” “অনিশ্চয়তা আর নতুন অভিজ্ঞতার জীবন বাঁচতে— কোনও আদর্শের জন্য উৎসর্গীকৃত জীবন বাঁচতে।” “সবচেয়ে যন্ত্রণা” এনে দেয় “মানুষের ব্যবহার”, যে বন্ধুরা আর বন্ধু থাকে না, তাঁদের ব্যবহার। দর্শনে তাঁর কৌতূহল, কিন্তু আর তত পড়ার সময় পান না, তবে মনস্তত্ত্ব পড়ে চলেন এখনও। এই মুহূর্তে পড়ছেন “রাজনৈতিক দর্শন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি”।১০৮

১৯৩৭ সালের মে মাসে ডালহাউসিতে পৌঁছনোর পর রবার্ট ব্রিফো’র ইওরোপা আর আলডুস হাক্সলে’র উপন্যাস আইলেস ইন গাজা পড়লেন। দুটি বইতেই কিছু যৌনচেতনাময় অংশ ছিল, তাই পড়ে মন্তব্য করলেন, ইংল্যান্ডে হাক্সলে’র বইয়ের জনপ্রিয়তা বুঝিয়ে দেয়, “ইংরেজরাও আর আগের মতো অতি-শালীন, দ্বিচারী নেই।”১০৯ সুভাষের নিজের অতীত গোঁড়ামির কথা খেয়াল রাখলে ব্রিটিশদের বিষয়ে এই অভিযোগ একটু অদ্ভুতই ঠেকে। উপন্যাস শেষ করে এ বার বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষণ করে নিজের লেখা আর পড়ার পালা— ডালহাউসির অবকাশযাপনের শেষ কয়েকটি মাস। ইউরোপ ও এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে দুটি বেশ বড় প্রবন্ধ লিখলেন। ইউরোপ: টুডে অ্যান্ড টুমরো নামে প্রবন্ধটি শেষ হল ১৯৩৭-এর অগস্টে, মডার্ন রিভিউ-এর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ছাপা হল। তীক্ষ্ণ বাস্তববাদী এই প্রবন্ধে ইউরোপ কন্টিনেন্ট-এর শক্তি-ভারসাম্যের পরিবর্তনের কথা রইল। “যদি যুদ্ধ হয়,” লিখলেন তিনি, “মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে স্ট্যাটাস কুয়ো-র বিরুদ্ধে জার্মান চ্যালেঞ্জের ফলেই সেই যুদ্ধ বাধবে।” “কিন্তু যুদ্ধই কি ভবিতব্য?” তাঁর প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ব্রিটেনেরই কাছে। “জার্মানি ১৯১৪-র ভুল” আর করবে না, যদি জানে যে ব্রিটেন যুদ্ধের পথে চলবেই তা হলে নিজে থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করবে না। তবে, ১৯১৪ সালেও যেমন হয়েছিল, “ব্রিটেন যুদ্ধে নামবে না ভাবতে ভাবতেই” জার্মানি যুদ্ধে “ফেঁসে যেতে” পারে। ওই প্রবন্ধে “রাশিয়ান কলোসাস”-এর ধাঁধা বিষয়ে তাঁর শেষ মন্তব্যটিতে থেকে গেল এক অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী: “ইউরোপের অধীশ্বর হয়েও নেপোলিয়ন রাশিয়াকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। হিটলারও কি তাই হবেন?”১১০

১৯৩৪ সালেই সুভাষ জাপানকে “প্রাচ্যের ব্রিটিশ” বলে বর্ণনা করেছিলেন।১১১ ১৯৩৭ সালে জাপানের চিন আক্রমণ প্রমাণ করল ইউরোপের মতো এশিয়াতেও জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ আগতপ্রায়। মডার্ন রিভিউ-এর ১৯৩৭-এর অক্টোবর সংখ্যায় সুভাষের দীর্ঘ প্রবন্ধ বেরোল, “জাপান’স রোল ইন দ্য ফার ইস্ট।” ২১ সেপ্টেম্বর ডালহাউসিতে শেষ করেছিলেন এই লেখা। পূর্ব এশিয়ার শক্তি-ভারসাম্যের একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ মিলল এতে। প্রবন্ধের শেষে অবশ্য নিজের সহানুভূতি কোন দিকে, তা স্বীকার করতে দ্বিধা করলেন না। তিনি মানেন, “জাপান নিজের জন্য, এবং এশিয়ার জন্য অনেক ভাল কাজ করেছে।” স্মরণ করলেন, কী ভাবে বিশ শতকের গোড়ায় কেমন ভাবে জাপান সমগ্র এশিয়াকে আলো দেখিয়েছে। পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে জাপানের অবস্থানকে অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু প্রশ্নও তুললেন। জাপানের নিজের লক্ষ্যও কি “সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ না করে, চিনা রিপাবলিককে খণ্ডিত না করে, আর একটি গর্বিত সংস্কৃত প্রাচীন সভ্যতাকে অসম্মান না করে পূর্ণ করা যেত না?” “না”, তাঁর উত্তর। “জাপানের প্রতি আমাদের এত শ্রদ্ধা সত্ত্বেও আমাদের হৃদয় কিন্তু চিনের এই সংকটের দিনে চিনেরই প্রতি ধাবিত হয়।” পূর্ব এশিয়ার সংঘর্ষ থেকে ভারতেরও কিছু শেখার আছে। “নতুন যুগের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভারতকে এ বার সর্ব ক্ষেত্রে তার জাতীয় পূর্ণতা লাভ করার দিকে এগোতে হবে— কিন্তু অন্য কোনও জাতির ক্ষতি করে নয়, আত্মসমৃদ্ধি সাধন আর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পথে নয়।”১১২

ইউরোপ ও এশিয়ার ঘটনাবলি বিষয়ে এই দীর্ঘ বক্তব্য প্রকাশ করছেন যিনি, শীঘ্রই তাঁকে দেখা যাবে ভারতের প্রধান জাতীয়তাবাদী সংগঠনের কেন্দ্রে। “পরের বছরের গোড়ায় বোধহয় আমাকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে,” ১৯৩৭-এর ৯ সেপ্টেম্বর আয়ার্ল্যান্ডে মিসেস উড্স-কে লিখলেন সুভাষ। “নির্বাচন (দলের শাখাগুলিতে) হবে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে।”১১৩ এত দিনে গাঁধী এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিয়েছেন। ১৯৩৭-এর গ্রীষ্মে মহাত্মার ইংরেজ শিষ্যা মীরাবেন-এর মাধ্যমে গাঁধীর সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র স্থাপিত হয়, কেননা মীরাবেনও ওই একই সময়ে ধর্মবীরদের অতিথি হিসেবে মাস-দুয়েক ডালহাউসিতে থাকেন।১১৪ অক্টোবরে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা, বসু ভ্রাতৃদ্বয় সেই সময়ে গাঁধী এবং জওহরলাল দুই জনকেই তাঁদের বাড়িতে থাকতে অনুরোধ জানান। সুভাষ ৫ অক্টোবর ডালহাউসি ছেড়ে রওনা হন, কলকাতায় চট করে মা ও অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা সেরে কার্শিয়াং-এ শরতের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান, ভবিষ্যতের কর্মপন্থা স্থির করার জন্য।১১৫ ডালহাউসিতে ধর্মবীরদের সঙ্গে এই পাঁচ মাস কাটানোয় সুভাষের বিরাট উপকার হল। তিনি এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, সব রকম চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে ভাইপো শিশিরকে ডেকে তুলতেন কার্শিয়াং-এ তাঁর সঙ্গে ছয় মাইল প্রাতর্ভ্রমণের জন্য। রাঙাকাকাবাবুর দৃপ্ত পদচারণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োতে পারতেন না সতেরো বছরের শিশির। গিধাপাহাড়ের বাংলো থেকে সোজা হেঁটে যেতেন সুভাষ মহানদী পর্যন্ত, এবং এক মুহূর্তও বিশ্রাম না নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে আবার কার্শিয়াং-এর দিকে হাঁটা লাগাতেন।১১৬

কার্শিয়াং থেকে জওহরলাল ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুভাষের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে বেশ কয়েক বার চিঠির আদানপ্রদান হল, কলকাতা কংগ্রেস বৈঠকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত এই বিষয়টি এ বার আলোচিত হওয়ার কথা। ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেস খুবই ভাল ফল করল, মুসলিম লিগের ফল ভাল হল না। প্রায় একই ম্যানিফেস্টোর ভিত্তিতে দুই দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও কংগ্রেস লিগের সমর্থন ছাড়াই যুক্তপ্রদেশের মতো জায়গায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারল। কংগ্রেসের এই সাফল্যে শক্ত হল প্রেসিডেন্ট জওহরলালের হাত, ফলে তিনি ঘোষণা করলেন, ভারতে দুটিই মাত্র পার্টি— ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস— মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্না অত্যন্ত আহত বোধ করলেন এতে। ব্রিটিশ ভারতের এগারোটি প্রদেশের মধ্যে সাতটিতে কংগ্রেসের হাতে তখন ক্ষমতা, সুতরাং লিগ ধুয়ো তুলল “ইসলাম বিপন্ন।” কংগ্রেস উত্তরে হিন্দু ও মুসলিম মানুষের একই অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও একই স্বার্থের উপর জোর দিল। এই সব বাহ্যিক বিষয় ছাড়াও কতগুলি প্রতীকী বিষয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল সে দিন। এর মধ্যে একটি হল, বন্দে মাতরম্ গান— দেশমাতৃকার উদ্দেশে কংগ্রেস মঞ্চে যে গান তখন যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে গাওয়া হত।

প্রখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৫ সালে তাঁর পত্রিকা বঙ্গদর্শন-এর একটি খালি পৃষ্ঠা ভরানোর জন্য গানখানি রচনা করেছিলেন। বঙ্গদেশের প্রকৃতিসুষমার ধ্বনিমধুর আরাধনা দিয়ে গানটির আরম্ভ, আর তার পর ক্রমে দেশমাতৃকার সঙ্গে একাকার হয়ে যান দেবীমাতৃকা দুর্গা। ১৮৮২ সালে বঙ্কিমের উপন্যাস আনন্দমঠ-এ গানটি ব্যবহার করা হয়, সেই উপন্যাসটি কিন্তু মুসলিম-বিরোধী সংস্কারে আগাগোড়া সমাকীর্ণ। জওহরলাল উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ জোগাড় করলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই আবিষ্কার করলেন যে গানটির প্রেক্ষাপট “মুসলিমদের বিরক্ত করতেই পারে।” আইনসভায় ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়ার মধ্যে যে বিজয়গর্ব প্রচ্ছন্ন, সুভাষ তা দেখতে পেলেন, “কংগ্রেস বিজয়ই প্রকাশ পায় এই গানে”। কিন্তু তবু উনিশ শতকের শেষ থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত এই সমস্যাজনক গানটিও যে ভাবে সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে, নানা আত্মত্যাগের কারণে যে পরিমাণ মান্যতা লাভ করেছে, মুখে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি নিয়ে গাঁধীবাদী বিদ্রোহীরা যে ভাবে লাঠির মার খেয়েছেন, যে ভাবে ফাঁসির আসামিরা মৃত্যু বরণ করেছেন, তাতে সুভাষ জওহরলালের কাছে প্রস্তাব করলেন, কংগ্রেসের বৈঠকে বিষয়টি ওঠার আগেই এক বার এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতামত নেওয়া ভাল।১১৭

সুভাষকে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সর্বজনীন ভাবে সংগত হতেই পারে না। “বাঙালি হিন্দুরা এই আলোচনা নিয়ে চঞ্চল হয়েছেন, কিন্তু ব্যাপারটি একলা হিন্দুর মধ্যে বদ্ধ নয়। উভয় পক্ষেই ক্ষোভ যেখানে প্রবল সেখানে অপক্ষপাত বিচারের প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্রীয় সাধনায় আমাদের শান্তি চাই, ঐক্য চাই, শুভ বুদ্ধি চাই— কোনো এক পক্ষের জিদকে দুর্দম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই নে।” তার পর একটি সতর্করচিত বার্তা প্রচারমাধ্যমে পাঠালেন তিনি, যাতে লিখলেন, গানটির প্রথম স্তবকে যে ভক্তি ও কোমলতার ভাব আছে, ভারতমাতার যে সুন্দর রূপ বর্ণনা করা হয়েছে, তা তাঁর বিশেষ পছন্দ। ওই প্রথম স্তবকটি অবশিষ্ট গান বা বইটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তাঁর কোনও অসুবিধে হয়নি। স্বীকার করলেন, এক সময় “বন্দে মাতরম্” জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়, বহু বিশিষ্ট বন্ধু এই মন্ত্র উচ্চারণ করে অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ করেছেন। কিন্তু এও ঠিক যে সমগ্র গানটি এবং তার সাহিত্যিক প্রেক্ষিতটি যদি মনে রাখা হয়, তাতে মুসলমানদের মনে আঘাত লাগারই কথা। তিনি অবশ্য জোর দিয়ে বললেন, গানটির প্রথম স্তবকটিকে সমগ্র গানটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলে তার মধ্যে একটা অসামান্য উজ্জীবন রয়েছে, এবং কোনও সম্প্রদায়ের কাছে তখন তা বর্জনীয় ঠেকবার কথা নয়।১১৮ কংগ্রেস রবীন্দ্রনাথের এই সুচিন্তিত অবস্থান মেনে নিল, সিদ্ধান্ত হল কেবল মাত্র গানটির প্রথমাংশই এখন থেকে জাতীয় সভাসমিতিতে গাওয়া হবে। বাংলার দুই তারকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষচন্দ্র বসু বাংলার হিন্দু সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বৃত্তে তীব্র ভাবে সমালোচিত হলেন গানটিকে এ ভাবে ছোট করে নেওয়ার জন্য। গাঁধীকে এই বিতর্ক থেকে আড়াল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন সুভাষ, বাঙালি হিন্দু মৌলবাদীর ক্ষোভের আগুন থেকে তাঁকে অনেকাংশে বাঁচাতেও সক্ষম হলেন। “বন্দে মাতরম্” থেকে গেল স্লোগান হিসেবেই, তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কল্পনায় দেশ-মাতৃকা আর দেবী-মাতৃকা যে ভাবে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন, ভারতের প্রধান জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানের মঞ্চে সেই ভাবটির আর স্থান হল না।১১৯

১৯৩৭-এর অক্টোবরে বসু ভ্রাতৃদ্বয়ই সে দিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু, তাঁরাই সে দিন কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত সদস্যদের শীর্ষ নেতা। মায়ের অনুরোধে সুভাষ ৩৮/২ এলগিন রোডে তাঁর বাবার ঘরটিতে থাকছেন তখন, কিন্তু অতিথি আপ্যায়ন যা কিছু, সব শরতের ১ উডবার্ন পার্কের বাড়িতে। সেই তিন তলা বাড়ির এক তলার ঘরটিতে প্রতি বারের মতো জওহরলাল এসে রয়েছেন। তিনি আর শরৎ একেবারে সমসাময়িক, দু’জনের সখ্যও প্রচুর। জওহরলাল যখন ১৯৩৬ ও ’৩৭ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, সেই সময়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে ছিলেন শরৎ, দু’জনে একসঙ্গে ১৯৩৭-এর নির্বাচনের আগে প্রচার করেছেন। জওহরলাল অতিথি হিসেবে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট, যদিও তাঁকে রসিকতা করে বলতে শোনা গিয়েছে, “শরৎ বোসের বাড়ির ডিনার একটা মুশকিলের ব্যাপার, শেষ হয় না কিছুতেই।” অল্প খেতেন তিনি, সেই অল্প খাবারটুকুও আবার বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। বাড়ির উপরের তলাটা পুরোই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মহাত্মা গাঁধী ও তাঁর দলবলের জন্য। মহাত্মার জন্য কলকাতার বাজার থেকে বাছা-বাছা ফল তরিতরকারি আনা হচ্ছে, অনেকগুলি ছাগল জোগাড় করে আনা হয় প্রত্যহ সকালে, তাদের গলায় আবার ঘণ্টি-বাঁধা। গাঁধীর সহকারী এসে বেছে নেন কোন ছাগলটির দুধ সে দিন খাবেন গাঁধী। বিরাট বড় ছাতটি গাঁধীর প্রার্থনার জন্য। কলকাতায় থাকার সময়ে কেবল তাঁর পছন্দের রাম-ধুনই হয় না, আরও নানা রকম গান হয়, দিলীপকুমার রায় এবং বিস্ময়-তরুণী গায়িকা উমা বসুও থাকেন, গাঁধী যাঁর নাম দিয়েছিলেন “ভারতের নাইটিঙ্গেল”। দিলীপ অনেক সময়েই ভক্তিমূলক ও দেশাত্মবোধী গান গেয়েছেন এ বাড়িতে এসে, শুনতে শুনতে সুভাষ ও শরতের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রুধারা। গাঁধীর জন্য এক সন্ধ্যায় তিনি গাইলেন “অ্যাবাইড উইথ মি”, এবং আরও কিছু ইংরেজি প্রার্থনাসঙ্গীত। মহাত্মা আপ্লুত। আর এক সন্ধেয়, ওড়িশার ছৌ নাচের দল এসে নাচ দেখিয়ে গেল গাঁধীকে। স্তূপাকার অটোগ্রাফ খাতায় সই করে গেলেন গাঁধী, প্রতিটি স্বাক্ষরের জন্য পাঁচ টাকা নিলেন তাঁর হরিজন ফান্ডের জন্য। গাঁধী, নেহরু ও সুভাষ সকলকে নিয়ে এই বাড়ি কংগ্রেস বৈঠক চলাকালীন একটি সভাস্থান হয়ে দাঁড়াল, ভিড় উপচে পড়ল রাস্তায় একটি বার যদি বাড়ির ভিতরে তাঁদের প্রিয় নেতাদের এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায়।১২০

‘বন্দে মাতরম্’ গানের প্রতীকী বিষয়টি ছাড়াও কংগ্রেস নেতৃত্বের সামনে আর একটি বিস্ফোরক রাজনৈতিক ইস্যু সে দিন বাংলার রাজবন্দিদের প্রশ্ন। গাঁধীবাদী সত্যাগ্রহের সমর্থকদের যদিও অনেক দিনই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ তখনও তথাকথিত বিপ্লবী কাজকর্মে লিপ্ত থাকার দরুন বন্দি রয়েছেন। বাস্তবিক বাংলা কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে শরিকি সরকার তৈরির আলোচনা মুখ থুবড়ে পড়ল এই বিষয়টির জন্যই— রাজবন্দিদের মুক্তিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, নাকি কৃষকের স্বার্থরক্ষাকারী কৃষি-সংস্কার প্রয়োগের ক্ষেত্রটিতেই আগে মন দেওয়া দরকার, সেই প্রশ্নে। বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলে কৃষক নেতা ফজলুল হক মুসলিম লিগের সঙ্গে মিলিত ভাবে সরকার গঠন করলেন। শরৎ বসুর নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধী আসনে বসল, ক্রমাগত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আইন ও মৌলিক কৃষি সংস্কার দাবি করে চলল। ১৯৩৭-এর অক্টোবরের শেষে সুভাষ কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে একটি বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দিলেন, সঙ্গে সভাপতি হিসেবে রইলেন অল ইন্ডিয়া কিষান সভার এন জি রঙ্গ। কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সুভাষ পূর্ববঙ্গের ত্রিপুরা জেলার নেতা আশরফউদ্দিন আহমদ চৌধুরির সহায়তা পেয়েছিলেন। সব রকমের অত্যাচার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন সুভাষ, সে ব্রিটিশের অত্যাচারই হোক, আর ভারতীয় জমিদারি অত্যাচারই হোক। কলকাতায় একটি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসেও সভাপতিত্ব করলেন তিনি। রাজনৈতিক বন্দিদের বিষয়ে গাঁধী সাহায্যে এগিয়ে এলেন, প্রদেশের গভর্নরের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললেন। বন্দিদের থেকে তিনি আশ্বাস চাইলেন, কোনওমতেই হিংসামূলক কাজকর্মে তাঁরা যাবেন না, সুভাষ তাঁর দেশপ্রেমী বন্ধুদের গাঁধীর এই নির্দেশ মেনে নিতে অনুরোধ জানালেন। এই সব ধকল সামলাতে গিয়ে বেশ অসুস্থই হয়ে পড়লেন গাঁধী, ১ নভেম্বর নাগাদ তাঁর রক্তচাপ এতই বেড়ে গেল যে ডাক্তারদের তাঁকে সুস্থ করতে বেগ পেতে হল। রবীন্দ্রনাথ উদ্বিগ্ন হয়ে দেখতে এলেন। তিনি নিজেই তখন যথেষ্ট অসুস্থ। শরৎ, সুভাষ, জওহরলাল এবং গাঁধীর সহায়ক মহাদেব দেশাই সকলে মিলে তাঁকে চেয়ারে করে তুলে উপরে নিয়ে গেলেন মহাত্মার সঙ্গে দেখা করানোর জন্য।১২১

“গাঁধীজি যখন কলকাতায় তখন আমার পক্ষে নিজের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করা একেবারে অসম্ভব,” লেখেন সুভাষ, “বিশেষত পয়লা নভেম্বর তাঁর ওই অসুস্থতার পর। আমরাই তো ওঁকে ডেকে এনেছি ২০০০ রাজনৈতিক বন্দির ব্যাপারটার মীমাংসার জন্য।” এরই মধ্যে, বল্লভভাই প্যাটেল-সহ অনেক গাঁধীবাদীর আপত্তি সত্ত্বেও গাঁধী নিজে ঠিক করে ফেলেছেন যে জাতীয় কংগ্রেসের পরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী আর কেউ নেই। তবে ১৯৩৮-এর জানুয়ারিতে এই গুরুদায়িত্ব হাতে নেওয়ার আগে এই কাজপাগল মানুষটিকে ইউরোপে কিছু দিন ছুটি কাটিয়ে আসতে উত্সাহ দিলেন গাঁধী।১২২ ১৯৩৭-এর ৪ নভেম্বর সুভাষ এমিলিকে জার্মান ভাষায় চিঠি লিখলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি তিনি হয়তো ইউরোপে যাচ্ছেন সে কথা জানিয়ে। “প্লিজ একটু কুরহউস হখল্যান্ডে জানিয়ে দিয়ো,” নির্দেশ দিলেন তাঁকে, “জেনে নিয়ো আমি (এবং তুমিও) ওখানে থাকতে পারব কি না।” এমিলি যেন এই কথা তাঁর বাবা-মা ছাড়া আর কাউকে না বলেন, যেন উত্তর না দেন, যেন চুপচাপ সুভাষের পরের চিঠি বা টেলিগ্রামের জন্য অপেক্ষা করেন, তাও বললেন। ১৬ নভেম্বর তার পাঠালেন তিনি, “বিমানে যাত্রা করছি বাডগাস্টাইন পৌঁছচ্ছি বাইশে থাকার ব্যবস্থা কোরো স্টেশনে দেখা কোরো।”১২৩

১৯৩৭-এর ১৮ নভেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কলকাতা থেকে ইউরোপের উদ্দেশে কেএলএম-এর ফ্লাইট ধরলেন। নেপলস-এ বিমান থামলে ইতালীয় পুলিশ তাঁকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করল, মালপত্র তল্লাশি চালাল। তিনি অভিযোগ করে ইতালীয় সরকারের কাছ থেকে একটি দুঃখপ্রকাশও লাভ করলেন।১২৪ ২২ নভেম্বর ১৯৩৭ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৩৮, মাস দেড়েক বাডগাস্টাইনে থাকলেন তিনি তাঁর সাধের রিসর্টটিতে, এমিলির সঙ্গে। ৬ ডিসেম্বর মিসেস ধর্মবীরকে জানালেন, “এখন এই জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর, চার দিক বরফে সাদা হয়ে আছে, আর তার সঙ্গে রয়েছে সূর্যের ঝকঝকে আলো। এই শুকনো ঠাণ্ডা কী আরামের। আরাম করে স্নান করছি, এ মাসের শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যাব।”১২৫ ডিসেম্বরের গোড়ায় দশ দিনের মধ্যে নিজের অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীর দশটি অধ্যায় লিখে ফেলেছেন, যার নাম তিনি দিতে চান অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম। সাইকো-অ্যানালিসিস-এর পড়াশোনা করেছেন আগে, তার ছাপ রয়েছে এই অসাধারণ সুলিখিত, আন্তর্বিশ্লেষণে পূর্ণ বইটিতে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে স্বতন্ত্র-করণের প্রয়াস আবশ্যিক ভাবে নিহিত, তার বিশ্লেষণ রয়েছে। সমস্ত রকম পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর চলমান বিদ্রোহের ধারা বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা হয় এই লেখা থেকে। তার সঙ্গে সেবা, আত্মসম্মান ও ত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত যে নীতিবাদের সন্ধান করে এসেছেন তিনি এত কাল, তারও আদল মেলে।১২৬

পাণ্ডুলিপিটি তৈরির জন্য তিনটি নোটবুক ব্যবহার করলেন সুভাষ, পুরোটাই লিখলেন পেনসিলে। জীবনের প্রথম চব্বিশ বছরের কাহিনি ১৯২১ সালের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা আকস্মিক ভাবেই থেমে গেল। এক ব্রিটিশ প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও কাজের চাপে লেখাটা শেষ হল না বলে এই তীর্থযাত্রীর যাত্রাবিবরণ তাঁর জীবদ্দশায় আর প্রকাশিত হতে পারল না। অথচ আসল পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় যে ‘আউটলাইন’ লিখে রেখেছিলেন, তার থেকে বোঝা যায় যে ১৯৩৭ পর্যন্ত জীবনের সবটুকুই লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর।১২৭ অন্তরের যে ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে ঠিক পথটা তাঁকে খুঁজে বার করতে হয়েছিল, নিজের জীবনের লক্ষ্য সন্ধান করতে হয়েছিল, সে সব বিষয়ে খোলাখুলিই নিজের কথা লিখেছিলেন। বয়ঃসন্ধি আর যৌবনকালে যৌনবোধের পীড়া অতিক্রম করতে বেশ কষ্ট হয়েছিল তাঁর। “তার পর যখন আধ্যাত্মিক আদর্শবাদ থেকে সরে এসে সামাজিক সেবার ব্রত খুঁজে পেলাম,” একটি ফুটনোটে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলেন, “যৌনচেতনা বিষয়ে আমার মতামত পাল্টে গেল।”১২৮ অর্থাৎ বোঝা যায়, যে সব আদর্শ বা মূল্যবোধে তিনি জীবনের একেবারে গোড়ার দিকটায় বিশ্বাস রাখতেন, পরবর্তী কালে তার উপর অতিরিক্ত জোর দিয়ে সুভাষের ভক্তরা সুভাষের বৈরাগ্য বিষয়ে রীতিমতো ভ্রান্ত একটা ধারণা তৈরি করে তুলেছেন।

এই সময়ানুক্রমিক জীবনকাহিনি লেখার সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ তিনটি অধ্যায়ে নিজের মূল আদর্শ বা বিশ্বাসের আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। সেই তিনটি অধ্যায় হল, “আমার বিশ্বাস— দার্শনিক মত”, “আমার বিশ্বাস— রাজনৈতিক মত” এবং “আমার বিশ্বাস— অর্থনৈতিক মত”। এইগুলিই তাঁর আত্মজীবনীর শেষ অধ্যায় হওয়ার কথা ছিল। বাডগাস্টাইনে থাকার সময় কেবল এর প্রথমটা শেষ করতে পেরেছিলেন। “আত্মায় বিশ্বাস রাখি কেন?” দর্শনবিশ্বাস সম্পর্কিত অধ্যায়টিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কেননা, তাঁর নিজের জন্য এটা একেবারে বাস্তব প্রয়োজনের স্তরে পড়ে, তাঁর চরিত্র, জীবন ও প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি বিষয়ে তাঁর ধারণা, নিজের জীবনের লক্ষ্য বিষয়ে তাঁর ক্রমান্বিত স্বচ্ছদৃষ্টি, এবং তাঁর অনুভূতি যে তিনি “কেবল পরমাণু-সমূহের সমষ্টিমাত্র নন”, এই সবের থেকেই এসেছিল আত্মায় বিশ্বাস। তাঁর মনে হত, বাস্তব আসলে “পরমাণুসম্ভারের সমষ্টি” থেকে আরও বেশি কিছু। এই বাস্তবের সত্যিকারের রূপেই তাঁর আগ্রহ, কেননা অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া যায়, তা হল সত্তা— যা গ্রহণ করে— এবং পরমসত্তা— যা সব ধারণার মূল উৎস। এই পরমসত্তা— “সত্যিই সত্তার থেকে পৃথক,”— সমস্ত মানব-অভিজ্ঞতায় তা নিহিত থাকে, এবং তার বিষয়ে আমাদের ধারণা নির্ভর করে আমাদের নিজেরা সেই পরমসত্তার কী ধরনে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক মূল্য স্থির করি তার উপর।” বাস্তবজগতের অর্থ অনুধাবন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এমনকী কেউ যদি চরম সত্য অবধি না পৌঁছে কেবল প্রয়োজনভিত্তিক জ্ঞানটুকু পেতে চায়, তা হলেও এ কাজ গুরুত্বপূর্ণ।

সুভাষের কাছে “বাস্তবজগতের মূল ভিত্তি”— “ভালবাসা”। “বিশ্বজগতের মূলেও” রয়েছে তা-ই, আবার “বিশ্বমানবতার মধ্যেও সেই একই আদর্শ”। যুক্তিবাদের পাঠ, অন্তর্বোধ, বাস্তববুদ্ধি, সব দিয়েই তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। লিখলেন, “আমার চার দিকে কেবলই ভালবাসার লীলা। নিজের মধ্যেও সেই একই প্রবৃত্তি। বুঝতে পারি নিজেকে পূর্ণতায় নিয়ে যেতে হলে আমাকে ভালবাসতেই হবে, জীবন গড়ে তুলতে গেলেও আমাকে সেই ভালবাসার উপরই ভর দিতে হবে।” জীবনে ভালবাসার অনেক বিরুদ্ধ শক্তি রয়েছে, কিন্তু তাই দিয়েই তো চলমান, গতিশীল বাস্তবজগৎ প্রত্যহ তৈরি হয়ে ওঠে। “সুতরাং বাস্তবজগৎই আত্মা, যার মূল ভিত্তি হল ভালবাসা, যে ভালবাসা ক্রমে বিকশিত হয়, শক্তির সংঘাত আর সেই সংঘাতের সমাধান তৈরি করে, চিরন্তন লীলায় পরিণতি পায়।”১২৯

অবশ্য ১৯৩৭-এর ওই অপরূপ শীতকালটায় সুভাষ-এমিলি একত্রে বাডগাস্টাইনে যে ছয় সপ্তাহ কাটালেন, সেই সময়টা যে কেবল ভালবাসার আলোচনা দিয়েই কাটল না। বন্ধু ও সহকর্মী এ সি এন নাম্বিয়ার, গায়ক হেডি ফুলপ-মিলার এবং ভ্রাতুষ্পুত্র অমিয় এসে ঘুরে গেলেন তাঁদের কাছে অল্প কয়েক দিনের জন্য। ফোটোগ্রাফার ও চলচ্চিত্রকার এ কে চেট্টিয়ার তখন গাঁধীর উপর প্রথম ডকুমেন্টারি ফিল্মটি বানাচ্ছিলেন, তিনিও এসে বরফ-ঢাকা বাডগাস্টাইনে ক’দিন কাটিয়ে গেলেন, যার ফলে ছবির মাধ্যমে সুভাষের ব্যক্তিগত জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টার কিছু দৃশ্যগত প্রামাণ্য তথ্যও রয়ে গেল। অন্য ভারতীয়দের মতোই চেট্টিয়ারও সুভাষের বিষয়ে ভক্তিবিহ্বল, সুতরাং এত কাছ থেকে এই অসাধারণ নেতাকে দেখার সুযোগ পেয়ে তিনি যেন নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ছবি তুলতে চাইছেন অথচ আঙুলগুলি ঠাণ্ডায় জমে প্রায় অসাড়, এমন অবস্থায় সুভাষ তাঁর যে যত্ন করলেন, তাতে তিনি রীতিমতো বিহ্বল হয়ে গেলেন। চেট্টিয়ারের রোমে ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করতে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে পাশের এক শহরে আসবেন তাঁরা, এমন সময়ে সুভাষ জেদ ধরলেন তিনি পায়ে হেঁটেই ফিরবেন, একা। সঙ্গীরা চিন্তায় পড়লেন। কিন্তু এতই ভক্তি করতেন তাঁকে যে বিশেষ বাধা দিতে পারলেন না। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল, উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই, যত ক্ষণ পর্যন্ত না সুভাষ সুস্থ ভাবে বাডগাস্টাইন ফিরলেন।১৩০

১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর, সুভাষচন্দ্র বসু গোপনে বিয়ে করলেন এমিলি শেঙ্কলকে। একটু কষ্ট হলেও তাঁরা নিজেদের এই সম্পর্ক ও বিয়ের কথাটা গোপন রাখারই সিদ্ধান্ত নিলেন। এমিলি খুব সহজ করে কারণটা ব্যাখ্যা করেন। সুভাষের জন্য “দেশই সবার আগে”, আর এই সময় এই ধরনের কোনও প্রকাশ্য ঘোষণা মানেই অপ্রয়োজনে একটা হইচই বাধানো।১৩১ বাডগাস্টাইন সুভাষের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হয়ে গেল— কেবল তাঁর আত্মজীবনী লেখার স্থান বলেই নয়। এই সেই স্থান যেখানে তিনি এমন একটি সম্পর্ক খুঁজে পেলেন, যে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে দুর্লভ সৌন্দর্য, উচ্চ আদর্শের স্পর্শ, এবং শেষ পর্যন্ত, গভীর ট্র্যাজেডির দুর্নিয়তি। অস্ট্রিয়ার সলজ্বার্গের পর্বতমালার স্বপ্নের রাজ্যে তিনি তাঁর ভালবাসার নারীটির কাছে ভালবাসার চরম অঙ্গীকারটি করলেন, যে অঙ্গীকার তিনি সর্বসমক্ষে আনতে পারেন, যদি দেশ— তাঁর “প্রথম প্রেম”-এর প্রতি তাঁর কর্তব্য শেষ হয়, তবেই। এমিলিও এই সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারলেন তাঁর প্রবল সাহস, তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ, চরম ত্যাগের শক্তির উপর ভর করে। এমিলি ইউরোপীয় বলেই কি এই বিবাহ গোপন রাখা হল? এক বার সুভাষকে প্রাণাধিক বলে ডেকেছিলেন এমিলি, নিঃস্বার্থ ভালবাসার এই উচ্চারণ নিঃসন্দেহে সুভাষই শিখিয়েছিলেন। ইউরোপীয়দের “ঐতিহ্য অন্য রকম”, সুভাষ বলেছিলেন। প্রশ্ন করেছিলেন, “কেনই বা তুমি তোমার প্রাণের চেয়ে আমায় বেশি ভালবাসবে?” তবু, এমিলির মধ্যে যে নারী, যে আত্মার অধিবাস, তাঁকেই ভালবাসার জন্য দেশ সংস্কৃতি ঐতিহ্য, রীতিনীতি, সব বাধা পেরিয়ে গেলেন সুভাষ। কালিদাসের লেখায় শকুন্তলা গীতিকাব্যের অনুবাদ করেছিলেন গ্যোয়টে— সুভাষ তা উদ্ধৃত করেন এমিলির কাছে। বস্তুত তাঁদের ভালবাসার সম্পর্ক দাঁড়িয়েই ছিল অনুবাদের উপর। গ্যোয়টেই একমাত্র জার্মান কবি যিনি “শাশ্বত নারীর” রূপকল্প ও তার অমল মহৎ গুণাবলির কথা বলেন। মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে (পর্ব ৫, দৃশ্য ১) শেক্সপিয়র একটি বিবাহের কথা বলেছিলেন যেখানে কালো-সাদা, দুই সংস্কৃতি, লোরেনজো ও জেসিকা, খ্রিস্টান ও ইহুদি— এই সবের মধ্যে সাফল্যের সন্ধান চলছিল অনুবাদের মাধ্যমেই:

Sit Jessica: look how the floor of heaven

Is thick inlaid with patines of bright gold;

There’s not the smallest orb, which thou beholdst.

But in this motion like an angel sings,

Still quiring to young-eyed cherubins:

Such harmony is in immortal souls;

But whilst this muddy vesture of decay

Doth grossly close it in, we cannot hear it.

কোনও সাহিত্য-গবেষক যদি সে দিন তাঁদের কথোকপকথন শুনতেন, বুঝতে পারতেন এমিলি ও সুভাষ সত্যিই “বিশ্বলোকের বাণী” শুনতে পেয়েছিলেন। “তুমিই প্রথম নারী যাকে আমি ভালবেসেছি,” সুভাষ তাঁকে লিখেছিলেন, “ঈশ্বর করুন যাতে তুমিই শেষ নারী হও। বিদায় প্রেয়সী।” তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন ঈশ্বর।১৩২

১৯৩৮-এর ৮ জানুয়ারি সুভাষ এমিলিকে লিখলেন “মিউনিখ স্টেশনে বসে কয়েক জন ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে কফি খাচ্ছি।” “সব খবর ভাল।” সলজ্‌বার্গ থেকে ট্রেন ধরে মিউনিখে এলেন তিনি, ব্রাসেলস-এর ট্রেন ধরার জন্য বসে রইলেন। ৯ জানুয়ারি অ্যান্টওয়ার্প-এ বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেলেন— আয়ার্ল্যান্ডের উনিশ শতকের শেষ দিকের জাতীয়তাবাদী নেতা চার্লস পার্নেল-এর উপর সিনেমা। ভাল লাগল, তাই পরে এমিলিকেও দেখতে বললেন। বন্ধুরা গাড়ি করে অসটেন্ড-এ নিয়ে গেলেন, সেখান থেকে চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে যেতে হয়।১৩৩ ২৫ নভেম্বর বাডগাস্টাইন থেকে ব্রিটিশ সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড জেটল্যান্ডকে সুভাষ লিখেছিলেন, ইংল্যান্ডে প্রবেশের ব্যাপারে তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নিতে।১৩৪ আইনের দিক থেকে কংগ্রেসের হবু প্রেসিডেন্টের উপর তেমন কোনও নিষেধাজ্ঞার অস্তিত্বই ছিল না মোটে, তবু আপাত ভাবে সেটা সরিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার খুব খানিক দয়া দেখাল। সেই যে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে ব্রিটেনের উপকূল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন এক দিন, তার সাড়ে ষোলো বছর পর আবার ব্রিটেনে ফিরলেন সুভাষ, উষ্ণ উদ্দীপিত অভ্যর্থনার মাঝে। নানা ধরনের ভারতীয় সংগঠন থেকে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হল ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। স্টেশনমাস্টার নিজে গিয়ে তাঁকে ট্রেন থেকে বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়িতে তুলে দিলেন, গাড়িটির মাথায় কংগ্রেসের ত্রিবর্ণ পতাকা। শ’খানেক সাংবাদিক এলেন ওয়েস্ট এন্ড হোটেলের প্রেস কনফারেন্সে। সুভাষ “খুব শান্ত, দক্ষ ভাবে, রসবোধসহকারে” তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।১৩৫

১৯৩৮-এর ১৬ জানুয়ারি। এমিলিকে লিখলেন, “ভয়ঙ্কর রকম ব্যস্ততা যাচ্ছে, তাই লিখতে পারছি না।”১৩৬ প্রতিটি বৈঠকেই সুভাষ ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করে যাচ্ছেন দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে একত্রে ফেডারেশন না গড়তে। নিজস্ব গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির অধিকার নিশ্চয়ই ভারতের আছে। ব্রিটিশরা যদি সেই অনুমতি দেয়, তবে “ব্রিটেন ও ভারতের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব না হওয়ার কোনও কারণ” দেখেন না তিনি। ১১ জানুয়ারি তাঁর সম্মানে সেন্ট প্যাংক্রাস টাউন হলে যে সভা হয়, তাতে তিনি বলেন, “ভারতের নিয়তি” “অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে জড়িত”, কংগ্রেসও উপলব্ধি করছে যে “স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে ভারতের সংগ্রাম বিশ্বময় সংগ্রামেরই একটি অংশমাত্র”। বক্তৃতায় বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলেন চিন, আবিসিনিয়া ও স্পেন-এর কথা, সে সব জায়গায় তখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি।১৩৭ বামপন্থী ভারতীয় চিন্তাবিদ রজনী পাম দত্তকে একটি সাক্ষাত্কারে বললেন, “আজ আমার ব্যক্তিগত মত— জাতীয় কংগ্রেস যথাসম্ভব বড় জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মঞ্চ তৈরি করুক, এবং দুই স্তরে তার লক্ষ্য স্থির করুক, রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।” দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল বইয়ের শেষ অংশে ফ্যাসিজম-এর বিষয়ে মন্তব্য ও কমিউনিজম-এর সমালোচনার প্রসঙ্গ তুলে রজনী পাম দত্ত তাঁর ব্যাখ্যা শুনতে চাইলেন। সুভাষ বললেন, তিনি আসলে যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা হল জাতীয় স্বাধীনতা এক বার লাভ করতে পারলে ভারতের উচিত “সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া।” যে ভাষাটা তিনি ব্যবহার করেছিলেন— “কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম-এর এক রকম সমন্বয়”, সেটা “খুব একটা ভাল ছিল না” ঠিকই— স্বীকার করলেন তিনি। যে সময় তিনি বইটি লিখতে শুরু করেন তখন “ফ্যাসিজম-এর সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ প্রকাশ পায়নি”, এবং “আর ভারতের জন্যও যাঁরা কমিউনিজম গ্রহণ করার কথা বলতেন সেই সময়ে” তাঁদের “তাঁর জাতীয়তাবাদ-বিরোধী” মনে হত। স্পষ্টতই, তিনি দেখছেন, পরিস্থিতি তার পর “পাল্টে গিয়েছে”, তিনি মার্ক্স ও লেনিন-এর লেখা পড়ে বুঝতে পেরেছেন এবং সন্তোষ লাভ করেছেন, তা ছাড়া, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর দলগত বক্তব্যেও তিনি “জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টিতে পূর্ণ সমর্থন” দেখতে পেয়েছেন।১৩৮ কমিউনিস্টরা যদি ইউরোপের সমাজতন্ত্রের ধারাকে সমর্থন করতে রাজি থাকে, উপনিবেশের দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করতে রাজি থাকে, তবে তিনিও তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।

ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট এবং বাংলার প্রাক্তন গভর্নর লর্ড জেটল্যান্ডও তাঁদের একান্ত বৈঠকে কমিউনিজম বিষয়ে সুভাষের দৃষ্টিভঙ্গি খুঁটিয়ে জানলেন। ভারতে কমিউনিস্ট ধরনের সরকার গঠনের প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন সুভাষ, জেটল্যান্ডকে বললেন, “সত্যিকারের কমিউনিস্টদের সংখ্যা ও দেশে বেশ কম।” “নিজে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কিন্তু কমিউনিস্ট হওয়া আর সমাজতন্ত্রী হওয়া একেবারেই আলাদা বস্তু”, জেটল্যান্ডের মন্তব্য। সুভাষের সঙ্গে জেটল্যান্ডের বৈঠক বেশ সৌহার্দ্যময়ই হল, কংগ্রেস নেতা বিষয়ে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর বেশ ভাল ধারণা জন্মাল, তবে কতগুলি বিষয়ে সুভাষের কিছু “অনমনীয় ধারণা” রয়ে গিয়েছে বলে মনে হল জেটল্যান্ডের। সেটাই স্বাভাবিক, সুভাষ যে দৃঢ়তার সঙ্গে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটির বিরোধিতা করছিলেন, রক্ষণশীল দেশীয় রাজন্যবর্গের সমালোচনা করছিলেন, ভারতের প্রতিরক্ষা বিষয়ে ব্রিটেনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আপত্তি তুলছিলেন, তাতে এমন ধারণা হওয়ারই কথা ছিল। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার স্বশাসনের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার ফাঁকি দিয়েছে, বড্ড বেশি পরিমাণে জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতা নিজের হাতে রেখেছে, এই ছিল সুভাষের মত। এবং, অবশ্যই, ব্রিটিশ “ডিভাইড-অ্যান্ড-রুল” নীতির ভয়ানক সমালোচক ছিলেন তিনি।১৩৯

লর্ড জেটল্যান্ডের পর হাউস অব লর্ডস-এর কনজারভেটিভ নেতা লর্ড হ্যালিফ্যাক্সের সঙ্গেও দেখা করলেন সুভাষ। এই লর্ড হ্যালিফ্যাক্সই হলেন লর্ড আরউইন, যিনি আগে ভারতের ভাইসরয় ছিলেন। ক্লিমেন্ট অ্যাটলি, সেই সময়ের হাউস অব কমনস-এ বিরোধী পক্ষ লেবার পার্টির নেতা, এবং অন্যান্য লেবার নেতা যেমন স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, জর্জ ল্যানসবেরি, আর্থার গ্রিনউড— এঁদের সঙ্গেও বৈঠক হল সুভাষের। স্পষ্ট ভাষায় তিনি বললেন, ভারতকে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হবে, কোনও ভবিষ্যৎ লেবার সরকার ভারতকে তা উপহার দেবে, এমনটা হতে পারে না। লন্ডনে আরও কয়েক জন প্রখ্যাত রাজনীতি-দর্শনের পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললেন, যেমন হ্যারল্ড ল্যাস্কি, জে বি এস হ্যালডেন, আইভর জেনিংস। এই সব কথাবার্তায় তিনি বার বার ১৯৩৫ সালের আইনটির অসুবিধার কথা তুলে ধরলেন, ওই আইনের পরিবর্তন করতেই হবে বলে দাবি করলেন। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় কেম্‌ব্রিজ-এ গেলেন এক দিন, সেখানে বিভিন্ন কেম্‌ব্রিজ কলেজের ফেলোদের সঙ্গে চা-কফি খেলেন, শিক্ষক ও ছাত্রদের হল-ভর্তি সভায় বক্তৃতা করলেন। রাজনৈতিক ভুবন এবং বিদ্যাচর্চা-ভুবনের মধ্যে দুই দিকেই ভারসাম্য রাখতে হবে, তাই পরের দিনই গেলেন অক্সফোর্ড, জি ডি এইচ কোল-এর সঙ্গে রাজনীতি দর্শন আলোচনা করলেন, গিলবার্ট মারের সঙ্গে ডিনার খেলেন। অনুরোধ জানালেন ভারতীয় স্বশাসনের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার পথে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী সমর্থকদের একটি বড়সড় দল তৈরির চেষ্টা করতে। ভবিষ্যৎ ঘটনাবলি নিয়ে খুবই কৌশলী ভাবে কথা চালালেন, তবে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি থেকে এক বারও এক চুল নড়লেন না।১৪০

লন্ডনে ফিরে আসতে একটি সংবাদপত্র তাঁকে বর্ণনা করল “ভারতের ডি ভালেরা” বলে।১৪১ বাডগাস্টাইন থেকে মিসেস উড্স-কে সুভাষ জানিয়েছিলেন, ডি ভালেরার সঙ্গে দেখা করতে তিনি লন্ডন থেকে ডাবলিন যেতে চান।১৪২ ঘটনাচক্রে, আইরিশ নেতা সেই সময়ে লন্ডনেই, আইরিশ ফ্রি স্টেট-কে রিপাবলিক অব আয়ারে রূপান্তরের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সারতে। ১৯৩৮-এর ১৫-১৬ জানুয়ারির মধ্যরাত্রে সুভাষ ও ডি ভালেরার দেখা হল। দীর্ঘক্ষণ তাঁদের মধ্যে “ভারত ও আয়ারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হল।”১৪৩ আইরিশ ইতিহাসের নানা ভাল-মন্দ উদাহরণ থেকে সুভাষ শিখতে চেষ্টা করলেন, কখন লড়াই চালাতে হয় আর কখনই-বা কূটনীতি অবলম্বন করতে হয়।

ব্রিটেনের সফর তখন শেষের পথে— এমন সময়ে ১৯৩৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, জেনারেল সেক্রেটারি আচার্য জে বি কৃপালনি ভারতে ঘোষণা করলেন সুভাষচন্দ্র বসু যথাপদ্ধতিতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সুভাষের নিজের তখন কী মনে হচ্ছিল সেটা তাঁর ২১ জানুয়ারি নাওমি ভেটারকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিটি থেকে জানা যায়— মনে হয়েছিল তাঁর সফর “সব দিক থেকে অত্যন্ত সফল এ বার”।১৪৪ যে ব্রিটিশরা প্রায় দেড় দশক যাবৎ তাঁকে এক জন বিপজ্জনক বিপ্লবী হিসেবেই জেনে এসেছে, এ বার সামনাসামনি তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়ে খুবই অবাক হলেন তাঁরা। ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান লিখল, “যে ইংরেজরা বোস-এর সঙ্গে প্রথম বার পরিচিত হলেন, তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গেলেন এক দিকে তাঁর প্রসন্ন শান্ত ভাবে, আর অন্য দিকে ভারতীয় পরিস্থিতি আলোচনার সময় তাঁর অবিচলিত দৃঢ়তায়।”১৪৫

১৯ জানুয়ারি লন্ডন ছেড়ে প্রাগের দিকে রওনা হলেন সুভাষ। সেখানে তাঁর প্রেসিডেন্ট এডুয়ার্ড বেনেস-এর সঙ্গে দেখা করার কথা। “যে স্টিলের হাতঘড়িগুলির বিষয়ে জানতে চেয়েছিলে, প্লিজ সেগুলো এখন কিনে ফেলো,” লন্ডন থেকে ১৬ জানুয়ারি এমিলিকে লিখলেন, “ডিপ্লোম্যাট নং C.K. ১২৪ এবং ডক্টর’স ওয়াচ নং ৬৫১ স্কোয়্যার— দুটোই ওমেগা। মেয়েদেরটা (লনজিনস) অবশ্য ওখানে পাবে না, বুঝতেই পারছি।” এগুলি তাঁদের বিবাহের উপহার, ভারতে ফেরার আগে পরস্পরকে দিয়ে যাবেন তাঁরা। ভিয়েনা বিমানবন্দরে এমিলিকে আসতে বললেন ২০ জানুয়ারি সকালে, প্রাগ থেকে রোমে যাওয়ার পথে যে সামান্য সময়টুকু ছিল, তার মধ্যে। ১৯ জানুয়ারি আবার প্রাগ থেকে তার করলেন, “দুটো ঘড়ি কিনে এরোড্রোমে এসো।” বিমানবন্দরের এই সংক্ষিপ্ত মিলনের পর আবার রোম থেকে ২০ জানুয়ারি চিঠি লিখলেন, জানালেন নিরাপদে পৌঁছেছেন, এখনই নেপলস্ রওনা হচ্ছেন। আবার পর দিন আথেন্স থেকে লিখলেন: “আজ আবার তোমায় লিখছি হাতে একটু সময় আছে বলে। তা ছাড়া এক বার ভারত পৌঁছে গেলে তো আর কোনও সময় পাব না।” ভারত থেকে যদি নিয়মিত লিখতে না পারেন তবে কোনও “কাল্পনিক ব্যাপার” নিয়ে এমিলি যেন মোটেই দুশ্চিন্তা না করেন, এই কথা বলে সুভাষ প্রাচ্যমুখী বিমানে পা রাখলেন।১৪৬

বসরায় রাত কাটিয়ে পৌঁছলেন করাচি। সে দিন ২৩ জানুয়ারি ১৯৩৮, অর্থাৎ তাঁর একচল্লিশতম জন্মদিন। পৌঁছনোর পর কেউ এক জন একটু “অদ্ভুত ভাবেই জিজ্ঞেস করল” তাঁকে— “বিয়ের কথা ভাবছেন কি না”; তাঁর উত্তর, “ও সব ভাবার কোনও সময় নেই।”১৪৭ যোধপুরে আর একটা রাত। এ বার ২৪ জানুয়ারি সকালে— কলকাতা। এসেই এমিলিকে পর পর দুটি টেলিগ্রাম করলেন। একটিতে লেখা “নিরাপদ”, অন্যটিতে “আন্তরিক সমবেদনা”— হঠাৎই মৃত্যু হয়েছে এমিলির বাবার। ২৫ জানুয়ারি লিখলেন, “তোমার বাবার মৃত্যুর দুঃসংবাদ পেয়ে থেকে অসম্ভব মনখারাপের মধ্যে আছি। তাড়াতাড়ি জানাও কী করে এমন হল। এত আকস্মিক! কী ভয়ানক!”১৪৮ ইতিমধ্যে ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির জটিলতায় গ্রস্ত হতে শুরু করেছেন সুভাষ। তাই বহু দূর থেকে এমিলিকে সমবেদনা জানানো ছাড়া তখন আর কিছুই করার নেই তাঁর। দেশের কাজ ডাক দিয়েছে— ব্যক্তিগত আনন্দ বা ব্যক্তিগত শোকের জন্য আর কোনও সময় নেই।

.

১. রবার্ট ম্যুজিল, দ্য ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিস্ (লন্ডন: পিকাডোর, ১৯৭১); কার্ল স্করস্কে, ফ্যাঁ-দ-সিয়েক্ল ভিয়েনা: পলিটিক্স অ্যান্ড কালচার (নিউ ইয়র্ক: ভিনটেজ বুকস্, ১৯৮১)।

২. সুভাষচন্দ্র বসু, কান্তিলাল পারেখকে লেখা চিঠি, ১৫ মার্চ, ১৯৩৩, সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, ১৯৩৩-১৯৩৭, অষ্টম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৪), পৃ: ৬-৭।

৩. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ২২/৩৭/১৯৩৩-পোল। (এন এ আই)।

৪. সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে লেখা চিঠি, ২৮ এপ্রিল, ১৯৩৩, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৮-১০।

৫. সুভাষচন্দ্র বসু, জে টি সান্ডারল্যান্ডকে লেখা চিঠি, ১৮ মে, ১৯৩৩, তদেব, পৃ: ১২।

৬. “প্যাটেল-বোস ম্যানিফেস্টো, মে ১৯৩৩” (এন আর বি)।

৭. এল/পি অ্যান্ড জে/১৭৪/পার্ট ওয়ান/১৯৩৫ (আই ও আর, বি এল); কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৭২), পৃ: ২৫-২৬।

৮. “দি অ্যান্টি-ইম্পিরিয়ালিস্ট স্ট্রাগ্‌ল অ্যান্ড সাম্যবাদ”, ১০ জুন, ১৯৩৩; এবং সুভাষচন্দ্র বসু, কিটি কুর্টিকে লেখা চিঠি, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪; বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৪১-২৬৩, ৫৬-৫৭।

৯. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ৩৫/১১/১৯৩৩-পোল। (এন এ আই)।

১০. সুভাষচন্দ্র বসু, কলকাতার মেয়র সন্তোষকুমার বসুকে লেখা চিঠি, ১১ মে, ১৯৩৩; ২৩ মে, ১৯৩৩; ১৮ জুন, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ৩১ মে, ১৯৩৩; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১০-১৪, ১৬-১৭।

১১. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২৯ জুন, ১৯৩৩; ১০ জুলাই, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, কলকাতার মেয়র সন্তোষকুমার বসুকে লেখা চিঠি, ৯ জুলাই, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, ভি লেসনিকে লেখা চিঠি, ১০ নভেম্বর, ১৯৩৩; তদেব, পৃ: ১৮-২১, ৩৮। কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ৫-৭।

১২. এল/পি অ্যান্ড জে/১৭৪/পার্ট ওয়ান/১৯৩৫ (আই ও আর, বি এল); কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ২৬।

১৩. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ১৫ জুলাই, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, কলকাতার মেয়র সন্তোষকুমার বসুকে লেখা চিঠি, ১৪ মার্চ, ১৯৩৪; “আ ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ইন পোল্যান্ড”; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২২, ৫৭-৬০, ৩৪০-৩৪২।

১৪. শিশিরকুমার বসু, আলেকজান্ডার ওয়ের্থ এবং এস এ আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া (হায়দরাবাদ: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩), পৃ: ৪২।

১৫. অ্যাডল্ফ হিটলার, মাইন কাম্ফ (বস্টন: হুটন মিফলিন, ১৯৪৩), পৃ: ৬৫৭।

১৬. হিটলার-এর যুক্তি ও সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার জন্য দ্রষ্টব্য, অ্যাডাম টুজ, দ্য ওয়েজেস্ অব ডেসট্রাকশন: দ্য মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং অব দ্য নাত্সি ইকনমি (হারমন্ডস্ওয়ার্থ: পেঙ্গুইন, ২০০৬)।

১৭. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২২ জুলাই, ১৯৩৩; তদেব, ৪ অগস্ট, ১৯৩৩; তদেব, ১০ অগস্ট, ১৯৩৩; তদেব, ২৫ অগস্ট, ১৯৩৩; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৩-২৬।

১৮. কিটি কুর্টি, সুভাষ চন্দ্র বোস অ্যাজ আই নিউ হিম (কলকাতা: ফিরমা কে এল মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৬), পৃ: ২-৫, ৮, ৩৮-৪৩।

১৯. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ৩১ অগস্ট, ১৯৩৩; ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, কান্তিলাল পারেখকে লেখা চিঠি, ৩ অক্টোবর, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে লেখা চিঠি, ১৯ অক্টোবর, ১৯৩৩; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৬-২৮, ৩০-৩১, ৩৫-৩৬।

২০. “বিঠলভাই প্যাটেল’স উইল,” অগস্ট ১৯৩৪, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৮৩-২৮৪।

২১. সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ১২ অক্টোবর, ১৯৩৩; তদেব, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৩; দু’টিই রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৩৩-৩৪, ৪০-৪১।

২২. সুভাষচন্দ্র বসু, সুনীলমোহন ঘোষ মৌলিককে লেখা চিঠি, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৩; সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৩; তদেব, ১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৪২, ৪৪-৪৭।

২৩. কৃষ্ণা দত্ত এবং অ্যান্ড্রু রবিনসন (সম্পাদক), সিলেকটেড লেটারস্ অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর (কেমব্রিজ: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ৩৩২-৩৩৭, ৩৯৩-৩৯৪।

২৪. মহাত্মা গাঁধী, কালেকটেড ওয়ার্কস্, আটান্নতম খণ্ড, পৃ: ৪২৯-৪৩০।

২৫. সুভাষচন্দ্র বসু, সুনীলমোহন ঘোষ মৌলিককে লেখা চিঠি, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৫০-৫১।

২৬. সুভাষচন্দ্র বসু, সি আর প্রুফারকে লেখা চিঠি, ৫ এপ্রিল, ১৯৩৪, তদেব, পৃ: ৬১-৬৪।

২৭. সুভাষচন্দ্র বসু, এ সি এন নাম্বিয়ারকে লেখা চিঠি, ১০ জুলাই, ১৯৩৪; সুভাষচন্দ্র বসু, ভি লেসনিকে লেখা চিঠি, ২৫ জুলাই, ১৯৩৪; প্রতিটি তদেব, পৃ: ৭২-৭৫। জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে বসু ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে যে সংগঠন তৈরি করেছিলেন, সে বিষয়ে ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে হলে দ্রষ্টব্য, “ইন্ডিয়ান সোসাইটিজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস্ ইন জার্মানি,” এল/পি অ্যান্ড জে/১২/৪১০ (আই ও আর, বি এল)।

২৮. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ১১ মে, ১৯৩৪; তদেব, ১৮ মে, ১৯৩৪; তদেব, ২১ মে, ১৯৩৪; তদেব, ৩ জুন, ১৯৩৪; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৬৭-৭০।

২৯. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, মার্চ ১৯৩৬, সুভাষচন্দ্র বসু, দি এসেনশিয়াল রাইটিংস্ অব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ১৬০-১৬১।

৩০. কৃষ্ণা বসু, “বাসন্তী দেবীর কাছে শোনা কাহিনি,” প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৯৩), পৃ: ৫৭-৬৪।

৩১. কৃষ্ণা বসু, “ইম্পর্ট্যান্ট উওমেন ইন নেতাজি’স্ লাইফ,” দি ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া (১৩ এবং ২০ অগস্ট, ১৯৭২); কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ১৬-১৭; এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে আমার কথোপকথন, ১৯৯৩।

৩২. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ১৪ অগস্ট, ১৯৩৪; বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৭৭-৭৮।

৩৩. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪; “কার্লসবাড অ্যান্ড আদার ওয়াটারিং প্লেসেস্ অব চেকোস্লোভাকিয়া” (প্রথম প্রকাশিত ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৩৭); দু’টিই রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৮১-৮২, ৪৩৬-৪৪১। কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ১২।

৩৪. সুভাষচন্দ্র বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল, ১৯২০-১৯৪২: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭), পৃ: ৩২৭-৩৩৩।

৩৫. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল, পৃ: ৩৫০-৩৫৩।

৩৬. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৩০ নভেম্বর, ১৯৩৪; তদেব, ১ ডিসেম্বর, ১৯৩৪; তদেব, ২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪; তদেব, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৩৪; প্রতিটি রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসু, লেটারস্ টু এমিলি শেঙ্কল, ১৯৩৪-১৯৪২: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, সপ্তম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ১৯৯৪, ২০০৪), পৃ: ১-৩, ৫-৮।

৩৭. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৮৫), পৃ: ৫৭-৫৮।

৩৮. তদেব, পৃ: ৫৯-৬০; সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৪, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৪-৫।

৩৯. সুভাষচন্দ্র বসু, “ইতালি” (অমৃতবাজার পত্রিকা-কে লেখা চিঠি, ৯ মার্চ, ১৯৩৫), বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৯১; অশোকনাথ বসু, মাই আঙ্কল নেতাজি (মুম্বই: ভারতীয় বিদ্যা ভবন, ১৯৮৯), পৃ: ১০৯।

৪০. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৩৪; তদেব, ৮ জানুয়ারি, ১৯৩৫; তদেব, ২০ জানুয়ারি, ১৯৩৫; তদেব, ২২ জানুয়ারি, ১৯৩৫; তদেব, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৩৫; প্রতিটি আছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৮-১৩।

৪১. বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: xv

৪২. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল, পৃ: ix-x; বিভিন্ন ধরনের পর্যালোচনাগুলি সংকলিত হয়েছে হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ২২/২৯/১৯৩৫-পোল। (এন এ আই)।

৪৩. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ৩৯/১৫/৩৫-পোল। (এন এ আই)।

৪৪. বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্‌ল, পৃ: xi

৪৫. শিশিরকুমার বসু এবং কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে এ সি এন নাম্বিয়ারের সাক্ষাত্কার, সেপ্টেম্বর, ১৯৭১; কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ৮১-৮২; কৃষ্ণা বসু, “ইম্পর্ট্যান্ট উওমেন ইন নেতাজি’স্ লাইফ।”

৪৬. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২৫ মার্চ, ১৯৩৫, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৯৪।

৪৭. “হোয়াট রোম্যাঁ রোল্যাঁ থিংকস্,” বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৩০২-৩০৯।

৪৮. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৬৩।

৪৯. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ১৫ মে, ১৯৩৫; তদেব, ১৬ জুন, ১৯৩৫; তদেব, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫; সুভাষচন্দ্র বসু, অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ২৩ জুলাই, ১৯৩৫; সুভাষচন্দ্র বসু, জে টি সান্ডারল্যান্ডকে লেখা চিঠি, ৬ অগস্ট, ১৯৩৫; বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৯৭-৯৮, ১০০-১০১, ১০৩-১০৬; অশোকনাথ বসু, মাই আঙ্কল নেতাজি, পৃ: ১১৫, ১১৯-১২২।

৫০. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ৪ অক্টোবর, ১৯৩৫, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১০৯-১১০।

৫১. কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ১১-১২; অশোকনাথ বসু, মাই আঙ্কল নেতাজি, পৃ: ১২১; এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে লেখকের কথোপকথন, ১৯৯৩।

৫২. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ১২ অক্টোবর, ১৯৩৫; ২৫ অক্টোবর, ১৯৩৫; ২৯ নভেম্বর, ১৯৩৫; বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১১০-১১১; ১২১-১২২।

৫৩. সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৫, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১২৪-১২৫।

৫৪. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ১৭ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ২০ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ২২ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৩৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৪-১৮; সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৩৬, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৩৮-১৪১।

৫৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৯-২৩; সুভাষচন্দ্র বসু, সন্তোষকুমার সেনকে লেখা চিঠি, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৩৬, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৩৪-১৩৫; আইরিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬; অমিয় চক্রবর্তী, “সুভাষচন্দ্র,” বিশ্বনাথ দে (সম্পাদিত), সুভাষ স্মৃতি (কলকাতা: সাহিত্যম, ১৯৭০), পৃ: ২৬৫।

৫৬. “দ্য ভিজিট টু ডাবলিন” এবং “ইম্প্রেশন্স্ অব আয়ার্ল্যান্ড,” বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৩৪৩-৩৪৫, ৩৫০-৩৫২; কৃষ্ণা বসু, “আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলন: ডি ভালেরা ও নেতাজি,” প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র, পৃ:১০৫-১১০; কেট ও’মালি, আয়ার্ল্যান্ড, ইন্ডিয়া অ্যান্ড এম্পায়ার: ইন্দো-আইরিশ র‌্যাডিক্যাল কানেকশনস্, ১৯১৯-১৯৬৪ (ম্যানচেস্টার: ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮), পৃ: ১০০-১১৩।

৫৭. সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ৫ মার্চ, ১৯৩৬; তদেব, ৩০ মার্চ, ১৯৩৬; দুই-ই আছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৪৮-১৪৯, ১৬৮-১৭০

৫৮. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ১৭ মার্চ, ১৯৩৬; তদেব, পৃ: ১৫৮-১৬০।

৫৯. “দি ইন্ডিয়ান সিচুয়েশন অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড ওপিনিয়ন,” তদেব, পৃ: ৩৪৭-৩৫০।

৬০. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬; তদেব, ৫ মার্চ, ১৯৩৬; সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ৫ মার্চ, ১৯৩৬; প্রতিটি তদেব, পৃ: ১৪২, ১৪৭-১৪৯।

৬১. সুভাষচন্দ্র বসু, সন্তোষকুমার সেনকে লেখা চিঠি, ৩ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৪৩।

৬২. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ৪ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৪৪-১৪৫।

৬৩. “দ্য সিক্রেট অব আবিসিনিয়া অ্যান্ড ইটস্ লেসন,” নভেম্বর ১৯৩৫, তদেব, পৃ: ৩০৯-৩২৬।

৬৪. সুভাষচন্দ্র বসু, অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ১১ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৫১-১৫৩।

৬৫. সুভাষচন্দ্র বসু, ফ্রান্জ থিয়েরফেল্ডারকে লেখা চিঠি, ২৫ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৬৫-১৬৮।

৬৬. “মিটিং দ্য প্রেস: সিচুয়েশন ইন ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া অ্যান্ড জার্মানি, লিগ অব নেশন্‌স্,” জেনিভা, ২ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ৩৪৫-৩৪৭।

৬৭. সুভাষচন্দ্র বসু, কিটি কুর্টিকে লেখা চিঠি, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৫, তদেব, পৃ: ১২৬।

৬৮. কুর্টি, সুভাষ চন্দ্র বোস অ্যাজ আই নিউ হিম, পৃ: ৪৮-৪৯।

৬৯. জে ডব্লিউ টেলর, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১২ মার্চ, ১৯৩৬, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৫৪।

৭০. সুভাষচন্দ্র বসু, অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ১৭ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৫৪-১৫৫।

৭১. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ১৩ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৫৫-১৫৭।

৭২. জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২৬ মার্চ, ১৯৩৬, জওহরলাল নেহরু, সিলেকটেড ওয়ার্কস্, সপ্তম খণ্ড (নয়া দিল্লি: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭২), পৃ: ৪০৭; হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ৪/৬/১৯৩৬-পোল। (এন এ আই)।

৭৩. রোম্যাঁ রোল্যাঁ, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ মার্চ, ১৯৩৬; সুভাষচন্দ্র বসু, রোম্যাঁ রোল্যাঁকে লেখা চিঠি, ২৫ মার্চ, ১৯৩৬; দুই-ই রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৬১, ১৬৩।

৭৪. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, মার্চ ১৯৩৬, বসু, দি এসেনশিয়াল রাইটিংস্ অব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, পৃ: ১৬০-১৬১। এমিলি শেঙ্কল চিঠিটি প্রকাশ করেন ২৪ জুন, ১৯৯৪, সুভাষের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের ষাটতম বার্ষিকী উপলক্ষে অগস্বার্গ-এ অনুষ্ঠিত একটি পারিবারিক সম্মেলনের শেষে। সুভাষচন্দ্রর ভ্রাতুষ্পুত্র-জায়া কৃষ্ণা বসুর হাতে চিঠিটি তুলে দেওয়ার সময় এমিলি জানান, “এটি একটি প্রেমপত্র।” চিঠিটিতে কোনও তারিখের উল্লেখ নেই। কিন্তু যে খামে চিঠিটি পৌঁছয়, তাতে পোস্টমার্ক ছিল ৫ মার্চ, ১৯৩৬। ৪ মার্চ সুভাষ লেখেন, “আমি তোমাকে আর একটা চিঠি লিখব আজ-কালের মধ্যেই। প্লিজ অপেক্ষা কোরো। এই জায়গাটা ভারী সুন্দর, শান্ত। প্রচুর বরফ। কেমন আছো তুমি?” (বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ২৮)। সুভাষ চিঠির তলায় যোগ করেন আরও একটি কথা, ‘পড়ার পর প্লিজ নষ্ট করে ফেলো।” এমিলি যে এই নির্দেশ পালন করেননি, সে জন্য এই ঐতিহাসিক আনন্দিত।

৭৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৫ মার্চ, ১৯৩৬, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৪০-৪১।

৭৬. এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে আমার কথোপকথন, জুন ১৯৯৩ এবং জুন ১৯৯৪। ২০০৮ সালের জুনে কৃষ্ণা বসু, অনিতা পাফ (সুভাষ ও এমিলির কন্যা), মার্টিন পাফ এবং সুমন্ত্র বসুর সঙ্গে বাডগাস্টেন যাওয়ার সময় আমরা কুরহউস েহাখল্যান্ড এবং গ্রুনার বম খুঁজে পেতে সক্ষম হই।

৭৭. সুভাষচন্দ্র বসু, সুনীলমোহন ঘোষ মৌলিককে লেখা চিঠি, ১৭ মার্চ, ১৯৩৬, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৬০-১৬১।

৭৮. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২৬ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৬৮।

৭৯. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ২৬ মার্চ, ১৯৩৫; ২৮ মার্চ, ১৯৩৫; বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৪৪-৪৯। প্রথম চিঠিটির সঙ্গে বলকানদের ওপর লেখা একটি প্রবন্ধের সংশোধিত সংস্করণ ছিল। সুভাষ চেয়েছিলেন এমিলি যেন এই লেখাটি ভারতীয় সংবাদপত্র হিন্দু -তে পাঠিয়ে দেন।

৮০. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ২৯ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ৪৯-৫৩।

৮১. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৩১ মার্চ, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ৫৬-৫৭। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে নাহাস পাশার সঙ্গে বসুর কথোপকথন বিস্তারিত ভাবে জানতে হলে দ্রষ্টব্য “পাসিং থ্রু কায়রো,” বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৯১-২৯৭।

৮২. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৩০ মার্চ, ১৯৩৬, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৫৩-৫৬।

৮৩. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৮ এপ্রিল, ১৯৩৬; তদেব, ১১ মে, ১৯৩৬; দুই-ই তদেব, পৃ: ৫৭-৫৯।

৮৪. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ৪/৬/১৯৩৬-পোল। (এন এ আই); নেহরু, সিলেকটেড ওয়ার্কস্, সপ্তম খণ্ড, পৃ: ৪১৪-৪১৫।

৮৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১১ মে, ১৯৩৬; তদেব, ২২ মে, ১৯৩৬; দুই-ই রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৫৮-৬১।

৮৬. সুভাষচন্দ্র বসু, সন্তোষকুমার বসুকে লেখা চিঠি, ৩ জানুয়ারি, ১৯৩৬, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১২৯-১৩০।

৮৭. সুভাষচন্দ্র বসু, “থ্রু কংগ্রেস আইজ,” তদেব, পৃ: ৩৫৫-৩৫৭।

৮৮. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১১ জুন, ১৯৩৬; তদেব, ২২ জুন, ১৯৩৬; দুই-ই রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৬১-৬৬; শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৬৬।

৮৯. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ৪৪/২৬/১৯৩৬-পোল। (এন এ আই)।

৯০. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ২২/৯২/১৯৩৬-পোল। (এন এ আই)।

৯১. হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ২৭/৪০/১৯৩৬-পোল। (এন এ আই)।

৯২. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৫ জুলাই, ১৯৩৬; এমিলি শেঙ্কল, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৭ অগস্ট, ১৯৩৬; দুই-ই রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৬৬-৬৯, ৭৭-৮০।

৯৩. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ৩০ জুন, ১৯৩৬, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৭৫-১৭৬।

৯৪. সুভাষচন্দ্র বসু, কিটি কুর্টিকে লেখা চিঠি, ২৫ জুলাই, ১৯৩৬, তদেব, পৃ: ১৭৯-১৮১।

৯৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৩০ জুলাই, ১৯৩৬; তদেব, ১২ অগস্ট, ১৯৩৬; তদেব, ২৯ অগস্ট, ১৯৩৬; তদেব, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬; তদেব, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬; তদেব, ৯ নভেম্বর, ১৯৩৬; তদেব, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৬; এমিলি শেঙ্কল, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৩ অগস্ট, ১৯৩৬; তদেব, ১৭ অগস্ট, ১৯৩৬; তদেব, ১৮ অগস্ট, ১৯৩৬; তদেব, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬; তদেব, ৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৬; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৬৯-৯৭।

৯৬. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১০ জানুয়ারি, ১৯৩৭, তদেব, পৃ: ১০০-১০২।

৯৭. সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠি, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৯০।

৯৮. এমিলি শেঙ্কল, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১ জানুয়ারি, ১৯৩৭, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ৯৭-১০০।

৯৯. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৯০-১৯২।

১০০. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৫ মার্চ, ১৯৩৭, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১১৪-১১৫। বসুর মেডিক্যাল রিপোর্টগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে দ্রষ্টব্য, হোম ডিপার্টমেন্ট ফাইল ২২/১১৩/১৯৩৬-পোল। (এন এ আই)।

১০১. গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হোম পলিটিক্যাল ফাইল ৪৪/২৬/৩৬ (এন এ আই)।

১০২. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৮ মার্চ, ১৯৩৭; তদেব, ২৫ মার্চ, ১৯৩৭; তদেব, ৫ এপ্রিল, ১৯৩৭; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১১৭-১১৯, ১২১-১২২।

১০৩. সুভাষচন্দ্র বসু, “ক্যালকাটা” (গণ-অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতা, ৬ এপ্রিল, ১৯৩৭), বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৩৮৯-৩৯৩; ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট, ১০ এপ্রিল, ১৯৩৭।

১০৪. দিলীপকুমার রায়, নেতাজি, দ্য ম্যান: রেমিনিসেন্সেস্ (মুম্বই: ভারতীয় বিদ্যা ভবন, ১৯৬৬), পৃ: ১৩৩।

১০৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ২২ এপ্রিল, ১৯৩৭; তদেব, ১ মে, ১৯৩৭; তদেব, ৬ মে, ১৯৩৭; তদেব, ১১ মে, ১৯৩৭; এমিলি শেঙ্কল, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ মে, ১৯৩৭; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১২৬-১২৮, ১৩০-১৩৩।

১০৬. সুভাষচন্দ্র বসু, সীতা ধর্মবীরকে লেখা চিঠি, ৯ মে, ১৯৩৭; তদেব, ২২ মে, ১৯৩৭; তদেব, ৭ জুলাই, ১৯৩৭; প্রতিটি রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ১৯৬, ১৯৯-২০০।

১০৭. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ২৭ মে, ১৯৩৭; তারিখবিহীন (মে ১৯৩৭); ৩ জুন, ১৯৩৭; ১০ জুন, ১৯৩৭; বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৩৫-১৩৮, ১৪১-১৪৩।

১০৮. সুভাষচন্দ্র বসু, অনিলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, ৮ অগস্ট, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২১৫-২১৭।

১০৯. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২৭ মে, ১৯৩৭, তদেব, পৃ: ২০০-২০৩।

১১০. সুভাষচন্দ্র বসু, “ইউরোপ— টুডে অ্যান্ড টুমরো,” তদেব, পৃ: ৩৯৭-৪১০।

১১১. সুভাষচন্দ্র বসু, কিটি কুর্টিকে লেখা চিঠি, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪, তদেব, পৃ: ৫৬-৫৭।

১১২. সুভাষচন্দ্র বসু, “জাপানস্ রোল ইন দ্য ফার ইস্ট,” তদেব, পৃ: ৪১১-৪২৯।

১১৩. সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭, তদেব, পৃ: ২২৫-২২৬।

১১৪. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১২ অগস্ট, ১৯৩৭; তদেব, ১৯ অগস্ট, ১৯৩৭; তদেব, ২৭ অগস্ট, ১৯৩৭; বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৫৬-১৫৯।

১১৫. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৩ অক্টোবর, ১৯৩৭, তদেব, পৃ: ১৭৩-১৭৪।

১১৬. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৭২।

১১৭. সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি, ১৭ অক্টোবর, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২২৬-২২৭; জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ২০ অক্টোবর, ১৯৩৭ (এন এম এম এল)।

১১৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ১৯ অক্টোবর, ১৯৩৭; ‘বন্দে মাতরম্’ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের বিবৃতি, ৩০ অক্টোবর, ১৯৩৭; উভয়ের উল্লেখ আছে নেপাল মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: সরস্বতী, ১৯৮৭), পৃ: ৫৬-৫৭, ৫৯-৬০।

১১৯. মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র, পৃ: ৬০-৬৬; সুভাষচন্দ্র বসু, সম্পাদককে লেখা চিঠি, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ নভেম্বর, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৪৩৫-৪৩৬।

১২০. শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি, পৃ: ৭২-৭৭।

১২১. তদেব, পৃ: ৭৭-৭৮; সুভাষচন্দ্র বসু, “অন দ্য বেঙ্গল সিচুয়েশন” (সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি, ১৮ নভেম্বর, ১৯৩৭), বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ৪৩৪-৪৩৫।

১২২. সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীমতী জে ধর্মবীরকে লেখা চিঠি, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৩৪-২৩৫।

১২৩. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৪ নভেম্বর, ১৯৩৭; তদেব, ১৬ নভেম্বর, ১৯৩৭; বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৭৪-১৭৬।

১২৪. সুভাষচন্দ্র বসু, ম্যাগিওর র‌্যাপিক্যাভোলিকে লেখা চিঠি, ২৫ নভেম্বর, ১৯৩৭; তদেব, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৩৭; দুই-ই রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৩২-২৩৩, ২৩৮-২৩৯।

১২৫. সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীমতী জে ধর্মবীরকে লেখা চিঠি, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৭, তদেব, পৃ: ২৩৪-২৩৫।

১২৬. সুভাষচন্দ্র বসু, অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, প্রথম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭)।

১২৭. তদেব, পৃ: xii-xiii. আসল পাণ্ডুলিপিটি রক্ষিত আছে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো-র মহাফেজখানায়।

১২৮. তদেব, পৃ: ৫৬।

১২৯. তদেব, পৃ: ১১৮-১২৪।

১৩০. এ কে চেট্টিয়ার, “আই মিট সুভাষ-বাবু,” দি ওরাকল, ২৮, ১ নম্বর (জানুয়ারি ২০০৮)।

১৩১. এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে আমার কথোপকথন, জুন ১৯৯৩। সুভাষচন্দ্র বসু এবং এমিলি শেঙ্কল যে গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন, তার ফলে তাঁদের বিবাহের দিন নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা ছিল, এমনকী পরিবারের মধ্যেও। এমিলি শেঙ্কল স্পষ্ট ভাবে অন্য দুই ঐতিহাসিককে ডিসেম্বর, ১৯৩৭ সালের বিয়ের কথা জানান: এঁদের মধ্যে প্রথম জন ছিলেন, বি আর নন্দ, যিনি ১১ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে নেহরু মিউজিয়ম-এর ওরাল হিস্ট্রি প্রোজেক্ট-এর জন্য তাঁর সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন; দ্বিতীয় জন, লিওনার্ড এ গর্ডন, যিনি ১৪ অক্টোবর, ১৯৭৮ সালে তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। এমিলি নন্দকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর উত্তরটি পাণ্ডুলিপিতে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য, কিন্তু গর্ডন-এর ওপর এ ধরনের কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। দ্রষ্টব্য, লিওনার্ড এ গর্ডন, ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ: আ বায়োগ্রাফি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্টস্ শরৎ অ্যান্ড সুভাষ চন্দ্র বোস (নিউ ইয়র্ক: কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯০), পৃ: ৭০১।

১৩২. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, মার্চ ১৯৩৬, বসু, দি এসেনশিয়াল রাইটিংস্ অব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, পৃ: ১৬০-১৬১। সুভাষ-এমিলির সম্পর্ক নিয়ে শিশিরকুমার বসু এবং পি লালের বক্তব্য এবং ভাব আমি এখানে ব্যবহার করেছি। “রিলিজ সেরিমনি অব নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, ভলিউম ৭: লেটারস্ টু এমিলি শেঙ্কল, ১৯৩৪-১৯৪২,” উপলক্ষে তাঁদের বক্তৃতা দ্রষ্টব্য, দি ওরাকল, ১৬, ৩ নম্বর (জুলাই ১৯৯৪), ৪-১৩।

১৩৩. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৮ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ১০ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ১১ জানুয়ারি, ১৯৩৮; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৭৬-১৭৭।

১৩৪. সুভাষচন্দ্র বসু, জেটল্যান্ড-এর মার্কুইসকে লেখা চিঠি, ২৫ নভেম্বর, ১৯৩৭, বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৩৩-২৩৪।

১৩৫. ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮।

১৩৬. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮, বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৭৭-১৭৮।

১৩৭. ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮।

১৩৮. সুভাষচন্দ্র বসু, “অন কংগ্রেস অ্যান্ড দ্য কনস্টিটিউশন, ফ্যাসিজম অ্যান্ড কমিউনিজম” (রজনী পাম দত্ত-র সঙ্গে সাক্ষাত্কারের একটি রিপোর্ট, প্রকাশিত ডেলি ওয়ার্কার, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৮), সুভাষচন্দ্র বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওর্য়াকস্, নবম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৪), পৃ: ১-৩।

১৩৯. সুভাষচন্দ্র বসু’র সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্কে লর্ড জেটল্যান্ড-এর রিপোর্ট, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, এল/পি ও/৫৭ (আই ও আর, বি এল)।

১৪০. গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, এল/পি ও/৫৭ (আই ও আর, বি এল) এবং ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট, ২২ জানুয়ারি, ১৯৩৮।

১৪১. নিউজ ক্রনিকল, ১১ জানুয়ারি, ১৯৩৮, এল/পি ও/৫৭ (আই ও আর, বি এল)।

১৪২. সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৭; তদেব, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৩৭; দুই-ই রয়েছে বসু, নেতাজি কালেকটেড ওয়ার্কস্, অষ্টম খণ্ড, পৃ: ২৩৬-২৩৮।

১৪৩. সুভাষচন্দ্র বসু, ই উডস্কে লেখা চিঠি, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮, বসু, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, পৃ: ২৫২।

১৪৪. সুভাষচন্দ্র বসু, নাওমি ভেটারকে লেখা চিঠি, ২১ জানুয়ারি, ১৯৩৮, তদেব, পৃ: ২৫৩।

১৪৫. ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান, জানুয়ারি ১৯৩৮, উল্লেখ রয়েছে বসু, ওয়ের্থ, আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া, পৃ: ৭১।

১৪৬. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ২০ জানুয়ারি, ১৯৩৮; ২১ জানুয়ারি, ১৯৩৮; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৭৭-১৭৯।

১৪৭. হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: জ্যোতি প্রকাশালয়, ১৯৪৬), পৃ: ১৫৫।

১৪৮. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮; তদেব, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮; প্রতিটি রয়েছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ১৭৯-১৮২।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন