মুক্তির মূল্য ভয়ঙ্কর
যে কোনও সময়, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই থাকি না কেন— সর্বদা কেবল ভারতের প্রতিই আমার অধীনতা, আমার আনুগত্য। চির দিনই তাই থাকবে।
—সুভাষচন্দ্র বসু, বার্লিন থেকে বেতারে, ১ মে ১৯৪২
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেল, নানা দেশের মধ্যে নানা অদ্ভুত সন্ধি তৈরি হচ্ছে। কট্টর সাম্রাজ্যবাদী উইনস্টন চার্চিল জোসেফ স্তালিনের পাশে এসে দাঁড়ালেন, আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সুভাষচন্দ্র বসু অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে হাত মেলালেন— আরও অনেক অদ্ভুত যোগ-সংযোগ। সুভাষচন্দ্রের ভারত থেকে মহানিষ্ক্রমণের সময় জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরস্পরের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ। ফ্যাসিজম এবং কমিউনিজম-এর মধ্যে তখনও এক ধরনের বিদ্বেষভিত্তিক মিত্রতা বজায় রয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে যেন তাদের আন্তর্জাতিক কার্যকলাপের কোনও সম্পর্ক নেই। ব্রিটেন ও ফ্রান্স, যে দুটি দেশ তখন সর্ববৃহৎ দুটি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, তারাই আবার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে যুদ্ধে যোগ দিল স্বৈরতন্ত্রাধীন দেশ পোল্যান্ডকে রক্ষা করতে। ঔপনিবেশিক প্রজাদের কানে অবশ্যই তাদের মুখে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লক্ষ্যে এ সব স্লোগান সে দিন ভারী ফাঁপা ঠেকল। ১৯৪০ সালের জুনের মধ্যে গোটা ফ্রান্স ছেয়ে ফেলল জার্মান ব্লিত্জক্রিগ। হিটলারের বাহিনীর কাছে নতজানু হল প্যারিস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধানতম শহর লন্ডনের উপর চলতে লাগল জার্মান লুফ্তওয়াফ-এর বিরামহীন বোমাবর্ষণ।
“নাতসি বাহিনী ‘নাখ প্যারিস’ ধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত করতে করতে জার্মান সীমান্ত পেরিয়ে হল্যান্ড ও বেলজিয়ামে প্রবেশ করছে। স্বপ্নেও কেউ ভেবেছিল এত তাড়াতাড়ি তাদের লক্ষ্য পূর্ণ হবে?” ১৯৪০ সালের ১৫ জুন লিখেছিলেন সুভাষ। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ বার জার্মানি আর ইতালির সঙ্গে ঠিক কী ধরনের বোঝাপড়া করবে, তা আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন তিনি। নিশ্চয়ই বলকান অঞ্চলগুলি বাদ দিয়ে ইউরোপ মহাদেশের বাকিটা জার্মানির হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে; ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থাকবে ইতালির দখলে; আর বলকান অঞ্চল ও মধ্য প্রাচ্য জুড়ে বিরাজ করবে রুশ প্রভাববলয়।১ সত্যিই কিন্তু, রুশীরা, এমনকী জার্মান সামরিক প্রধানরাও প্রায় এই ভাবেই ভাবছিলেন, তবে সুভাষের একটা হিসেব সে দিন ভুল ছিল: জার্মান ফুয়েরারের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টায় তিনি তেমন গুরুত্ব দেননি। ঘটনা হল, বলকান অঞ্চল রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হিটলার নিজে কিন্তু একেবারেই রাজি ছিলেন না।
১৯৪০ সালের প্রথম ছয় মাস জার্মান হাইকম্যান্ড-এর প্রধান জেনারেল আলফ্রেড জোড্ল-এর মাথায় ঘুরল আফগানিস্তান ও ভারতে একত্র জার্মান ও সোভিয়েত অভিযানের নানাবিধ পরিকল্পনা। ইতিমধ্যেই ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ইপি ফকিরকে অর্থসহায়তা করে, তাঁর অনুগামীদের উসকানি দিয়ে ওয়াজিরিস্তানে ব্রিটিশদের ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করছিল জার্মানি। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪০, যখন জার্মানি, জাপান ও ইতালি-র ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হল, ধরে নেওয়া হল ভারত আসলে সোভিয়েত প্রভাববলয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য ভারতের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়, বরং পূর্ব ইউরোপ ও বলকান অঞ্চলে নিজের প্রভাবের ঐতিহ্য বজায় রাখতেই সে বেশি চিন্তিত। ১৯৩৯-এ রিবেনট্রপ ও মলোটভ মিলে জার্মান-সোভিয়েত চুক্তি সই করেছেন ঠিকই, কিন্তু সে বছরেরই নভেম্বরে বার্লিন সফরে গিয়ে সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী জানালেন, ইউরোপের ব্যাপারে ছাড় দিতে তাঁরা মোটেই ইচ্ছুক নন। মলোটভ এ ভাবে তাঁর সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে বসেছেন দেখে হিটলার ঠিক করে ফেললেন, এ বার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সময় এসেছে। উল্টো দিকে, জাপানে যাঁরা “উত্তরে হানা”র পক্ষের প্রবক্তা, তাঁরা শেষ পর্যন্ত “দক্ষিণে হানা”-র প্রবক্তাদের কাছে হেরে যাওয়ার ফলে রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক কিন্তু আগের চেয়ে একটু উন্নত হতেই দেখা গেল। মোট কথা, দাঁড়াল এই যে, জাপানের হানা চলবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটেনের বিরুদ্ধে, এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
১৯৪১-এ জানুয়ারিতে সুভাষ যখন ভারত ছেড়ে পালিয়ে আসছেন, পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে তখন জার্মানির যুদ্ধসাফল্যের তুঙ্গমুহূর্ত। সুভাষ স্বভাবতই জানতেন না, জার্মান-সোভিয়েত চুক্তির ভাগ্য কতখানি সরু সুতোয় ঝুলছে। জার্মানি আসার কারণ হিসেবে তিনি তাঁর ভক্ত-অনুচরদের বলতেন— যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির সরাসরি তথ্য পাওয়া আর ব্রিটিশ রাজের উপর শেষ হানা হানতে প্রবাসের যত ভারতীয় সেনা ও নাগরিকদের জড়ো করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আরও একটা উদ্দেশ্য আছে: ব্রিটেন যদি না হেরেও ধ্বস্ত অবস্থায় জার্মানির সঙ্গে আলাদা ভাবে কোনও চুক্তি সই করে, তখন সেই দর-কষাকষির টেবিলে ভারতের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরতে চান তিনি। নতুবা তাঁর ভয়, এই সব নব্য ও সনাতন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পারস্পরিক হানাহানির মধ্যে ভারত নেহাতই একটা দাবার ঘুঁটি হয়ে পড়বে। “ইউরোপে আসার পর প্রথম প্রথম জার্মানির জয় নিয়ে তাঁর মনে সংশয়ের থেকে আতঙ্কই ছিল বেশি,” লিখেছিলেন সুভাষের সহকারী এ সি এন নাম্বিয়ার।২ হিটলারের মনে ব্রিটেনের প্রতি শ্রদ্ধা তখনও অটুট, উপহাস করে তিনি যাঁদের “এশিয়াটিক জাগলার” বলতেন, তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর থেকে “নর্ডিক” জাতিদের নিয়ে ঐক্যস্থাপন তাঁর কাছে অবশ্যই অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত। নাত্সি ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি ইউরোপে যে বীভত্স বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে একাগ্র বিদ্রোহী সুভাষ যেন ভাল করে সে সব খেয়ালই করলেন না। ব্রিটেনের সঙ্গে জার্মানি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাই তিনি চললেন জার্মানি— বরাবরের মতো তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল এক লজ্জাকর কলঙ্ক, যে কলঙ্ক নাৎসিদেরই প্রাপ্য। সাক্ষাৎ শয়তানের সঙ্গে চুক্তি: এই ছিল স্বাধীনতার বড় ভয়ানক মূল্য।
কাবুলে ইতালীয় রাষ্ট্রদূত পিয়েত্রো কুয়ারোনির সঙ্গে ভারতে বিপ্লবের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন সুভাষ। ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল যে দিন তিনি বার্লিন পৌঁছলেন, কুয়ারোনিও সে দিনই সুভাষের ভারত-বিষয়ক প্রস্তাব বিষয়ে একটি সদর্থক রিপোর্ট লিখে পাঠিয়ে দিলেন রোমে। সুভাষের ভাবনা অনুযায়ী “প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপে একটি ‘স্বাধীন ভারত সরকার’ তৈরি করা দরকার, লন্ডনে যে ভাবে অনেক স্বাধীন সরকারই আগে তৈরি হয়েছে।” কুয়ারোনি জানতে চেয়েছিলেন “সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে কী কী ঘটার সম্ভাবনা” রয়েছে। কুয়ারোনির রিপোর্ট অনুযায়ী সুভাষের উত্তর ছিল: “বাংলার সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এবং ভারতের অন্যান্য অংশে এই ধরনের আরও কিছু গোষ্ঠী এখনও অস্তিত্বশীল,” তবে “সেই সন্ত্রাসের ব্যবহারযোগ্যতা বিষয়ে বিশেষ নিশ্চিত নন” তিনি। অবশ্য ব্রিটেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় “বড় গোছের অন্তর্ঘাত” ঘটানোর নির্দেশ পাঠানো যায় কি না, তা নিয়ে ভাবতে তিনি রাজি। সুভাষের সঙ্গে এই সব কথোপকথনের পর কুয়ারোনি “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ” ভারতের ক্ষেত্রে “বিপ্লবের অস্ত্র”টি ব্যবহার করার প্রয়োজনটা বুঝে গেলেন।৩
এক সপ্তাহ পর, ৯ এপ্রিলে সুভাষ জার্মান সরকারের কাছে বিশদ একটি মেমোরান্ডাম পাঠালেন, তাতে একটি ব্যাখ্যামূলক অংশও রইল। ইউরোপ, আফগানিস্তান, এশিয়ার উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চল এবং ভারত— এই পুরোটা মিলিয়ে কী ভাবে এগোনো যায়, বললেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন যে, “ভারত থেকে ব্রিটিশ শক্তিকে হটানোর পরিকল্পনার শেষাংশে জাপানও হাতে-কলমে সাহায্য করতে পারে, তার দূরপ্রাচ্য নীতির মাধ্যমে।” দূরদর্শিতার পরিচয় তাঁর বক্তব্যে: “দূরপ্রাচ্যে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পরাজয় আর সিঙ্গাপুর ঘাঁটির পতন আপনা থেকেই ভারতে ব্রিটিশ সামরিক শক্তি আর সম্মানের মূলে বড় আঘাত হানবে।” তবে আগে থেকেই যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর জাপানের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গেও একটা চুক্তিতে আসা সম্ভব হবে, আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জাপান আরও প্রত্যয়ের সঙ্গে এগোনোর সুযোগ পাবে— তাঁর মনে হল।৪
জার্মান বিদেশমন্ত্রী জোয়াকিম ফন রিবেনট্রপের সঙ্গে বৈঠক হল ১৯৪১ সালের ২৯ এপ্রিল, ভিয়েনার ইম্পিরিয়াল হোটেলে। সুভাষ হতাশ হলেন শুনে যে জার্মান সরকার তাঁর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে এখনও প্রস্তুত নয়। উত্তর আফ্রিকায় ধৃত ভারতের যুদ্ধবন্দিদের একটা বড় অংশকে আবার নতুন ভাবে সংগঠিত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাহিনী তৈরি করা যায় বলে তিনি প্রস্তাব করলেন। রিবেনট্রপ বললেন, এ রকম পদক্ষেপ করার মতো সময় এখনও আসেনি। ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে কোনও প্রকাশ্য মন্তব্য করতেও তিনি রাজি হলেন না। সুভাষ আরও খতিয়ে দেখতে চাইলেন। বললেন, এমনও কিন্তু সম্ভব যে ইউরোপে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েও ব্রিটেন ভারতের সাম্রাজ্য আঁকড়ে থাকতে চাইল। জার্মান বিদেশমন্ত্রীর উত্তর এল— হিটলারের সন্ধিপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটেন ইতিমধ্যেই নিজের সাম্রাজ্যের কবর খুঁড়ে ফেলেছে। জার্মানির প্রতি ভারতের মনোভাব ঠিক কেমন?— জানতে চাইলেন তিনি। সুভাষ “স্পষ্ট কথায় জানালেন, ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ও ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বিরাগ বেশ তীব্র,” কেননা এদের মধ্যে “অন্য জাতিকে দমন করে রাখার প্রবণতা দেখতে পান তাঁরা।” বিদেশমন্ত্রী “বাধা দিয়ে বললেন ন্যাশনাল সোশ্যালিজম কেবল জাতিগত শ্রেষ্ঠতার কথাই বলে, অন্যান্য জাতিকে শাসন করার কথা বলে না।”৫ মোদ্দা কথা, জার্মান মন্ত্রীর সঙ্গে সুভাষের প্রথম মোলাকাত বিশেষ সুখের হল না।
হাল ছাড়বেন না তিনি। ৩ মে আবারও একটা অতিরিক্ত মেমোরান্ডাম জমা দিলেন। এতে ভারত ও আরব দেশগুলির স্বাধীনতা বিষয়ে অক্ষশক্তির স্পষ্ট বক্তব্য জানতে চাওয়া হল। ইরাকে তখন সবে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয়েছে, জার্মানদের তিনি ইরাকি সরকারকে সমর্থন করার অনুরোধ জানালেন। লিখলেন, “নিকট ও দূর প্রাচ্য থেকে ব্রিটিশের শক্তি ও প্রভাব উত্খাতের চেষ্টায় সাফল্য পেতে হলে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কিন্তু ‘স্টেটাস কুয়ো’ বহাল রাখা উচিত।” জার্মানি ও ভারতের মধ্যে আরও চার রকম সম্ভাব্য আদানপ্রদানের পথ আলোচনা করলেন: তার মধ্যে রাশিয়া ও আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে যে পথ, সেটিই তাঁর নিজের বেশি পছন্দ। অতীতের মতোই আবারও যদি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ শানানো যায়, তবে তাঁর মতে, ভারতের মাটিতে অস্ত্রহীন মুক্তিযোদ্ধাদের তা বিপুল ভাবে সাহায্য করবে।৬ অবশ্য কোনও পরিকল্পনা কাজে লাগানোর আগে সুভাষ এই ত্রিশক্তির কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে একটা স্পষ্ট, দ্বিধাহীন ঘোষণা চাইলেন। মে-র দ্বিতীয়ার্ধে এমন একটি ঘোষণাপত্রের খসড়াও তিনি তৈরি করে ফেললেন, এবং জার্মান ও ইতালির সরকারকে দিয়ে এর প্রকাশ্য স্বীকৃতির চেষ্টায় রইলেন।৭ জার্মান আর ইতালীয়রা অবশ্য নানা ছুতোয় সেটা পিছোতেই থাকল। এত সব ছলছুতোর অন্যতম কারণ— এই ত্রিশক্তি আগেই ভেতরে ভেতরে মেনে নিয়েছে যে ভারত আসলে রাশিয়ার প্রভাববলয়ের অন্তর্গত, আর সেই অবস্থান থেকে তারা এখনই সরে আসতে অরাজি।
২২ জুন ১৯৪১— খবর এল, জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছে। খবরটা পৌঁছল যখন, সুভাষ সেই সময় রোমে। চরম হতাশায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বিশ্ব পরিস্থিতি তাঁর কাছে যেন “ধূসর” হয়ে গেল মুহূর্তে।৮ আসলে তাঁর স্ট্র্যাটেজি গুরুতর ভাবে নির্ভর করছিল জার্মান-সোভিয়েত চুক্তির উপর। মনে মনে এমন স্বপ্নও তিনি দেখছিলেন যে, সোভিয়েতের মাধ্যমে হয়তো জাপান আর চিনের মধ্যে সন্ধি স্থাপনও সম্ভব হবে। তাঁর এই সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিল হিটলারের অপারেশন বার্বাডোসা। অথচ এই অপারেশনের প্রস্তুতি কিন্তু তলে তলে চলছিলই, এমনকী সুভাষ যখন মস্কো পার হয়ে আসছিলেন, সেই সময়েও চলছিল। যা হোক, সুভাষ ঠিক করলেন, জার্মানদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে মন খুলে যা বলার বলবেন, সোজাসুজি, নির্ভয়ে বলবেন। জার্মান বিদেশমন্ত্রককে পরিষ্কার জানালেন তিনি যে, “ভারতীয় মানুষ জার্মানিকেই আক্রমণকারী বলে মনে করে।” জার্মানদের মনে হল, জার্মান-রুশ সংঘর্ষের প্রশ্নে সোভিয়েত তত্ত্বের দ্বারাই বড্ড বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন সুভাষ।” তাঁরা তাঁকে বোঝালেন, তাঁরা কিন্তু “দৃঢ় ভাবে” নিজেদের লক্ষ্যের দিকে, অর্থাৎ “স্বাধীন ভারতের ঘোষণার লক্ষ্যের” দিকেই এগোচ্ছেন। কেবল একটা “ঠিকঠাক সময়ের” অপেক্ষা।৯
১৭ জুলাই বার্লিনে ফিরলেন সুভাষ। সে দিন তাঁর জার্মান ভাষাশিক্ষক গেসলার উইর্সিং নজর করলেন, বিশ্ব মানচিত্রের সামনে গম্ভীর মুখে পদ্মাসনে আসীন তিনি। হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বার বারই সরব হয়ে উঠছেন: কত যে খারাপ হবে এর ফল, বলে উঠছেন।১০ ১৫ অগস্ট রিবেনট্রপকে চিঠিতে লিখলেন, “ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে কোনও ঘোষণা ছাড়াই জার্মান সেনা ভারতের যত কাছে এগোবে, ভারতীয় জনসাধারণ কিন্তু জার্মানির প্রতি ততই বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে উঠবে।” “পুবের দিকে জার্মান বাহিনীর অভিযান”কে “বন্ধুত্বের চেয়ে শত্রুতার প্রকাশ হিসেবেই দেখা হবে,” রিবেনট্রপকে সুভাষের সাবধানবাণী।১১
ধৈর্য ধরে ক্রমাগত বিরোধিতা করে যেতে পারাটাও একটি বড় গুণ, এবং সুভাষচন্দ্রের চরিত্রে এই গুণ ছিল একেবারে পুরো মাত্রায়। ২২ জুন যে গভীর বিষণ্ণতাবোধ তাঁকে ছেয়ে ফেলছিল, ক্রমেই তা কাটিয়ে উঠলেন তিনি। ইউরোপের নানা অংশে বহু নির্বাসিত ও প্রবাসী ভারতীয়দের, বিশেষত ছাত্রদের নিয়ে একটি ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার তৈরি করলেন। ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে তৈরি করলেন একটি ভারতীয় বাহিনী। নানা ধরনের প্রতিভাসম্পন্ন তরুণ ভারতীয়দের খুঁজে বার করলেন, যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন আদর্শগত ধারা থেকে এলেও ভারতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে সবাই এককাট্টা। এদের নিয়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন ভারতের একটা আদল তৈরির কাজে মন দিলেন। নানা ধর্ম ও ভাষার ভারতীয়রা রইলেন সেই দলে— এ সি এন নাম্বিয়ার, আবিদ হাসান, এন জি স্বামী, এন জি গানপুলে, কে এম ভাট, এম আর ব্যাস, পি বি শর্মা, প্রমোদ সেনগুপ্ত, জে কে ব্যানার্জি, এ এম সুলতান, হবিবুর রহমান আর গিরিজা মুখার্জি— সুভাষের আকর্ষণের চৌম্বক টানে একে একে তাঁর আন্দোলনে জড়ো হলেন এঁরা সবাই।
“নাম্বিয়ার কোথায়?” ১৯৪১ সালের এপ্রিলে এমিলির সঙ্গে বার্লিনে দেখা হতেই জানতে চাইলেন সুভাষ। তীব্র নাৎসি-বিদ্বেষী, আদতে কেরলবাসী, ক্যান্ডেথ নারায়ণন নাম্বিয়ার ১৯৩৩ থেকে তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৩৩-এ নাত্সি সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে প্রাগে পাঠিয়ে দেয়, সেখানে তিনি সুভাষকে ইন্দো-চেক সংযোগ তৈরিতে সাহায্য করেন। ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তি এবং ১৯৩৯-এর মার্চে জার্মানির চেকোস্লোভাকিয়া দখলের পর তিনি প্রাগ ছেড়ে প্যারিস আসেন। ১৯৪১-এর মাঝামাঝি ফ্রান্সের ফোয়া-য় সুভাষ আবার তাঁকে খুঁজে বার করেন, নাম্বিয়ার সেখানে তাঁর নতুন প্রেমিকা মাদাম দ্য সস্যুর-এর সঙ্গে চুপচাপ বসবাস করছিলেন তখন। অগস্টে আবার প্যারিসে দেখা, নাম্বিয়ার যাতে বার্লিনে তাঁর কাছে আসেন তার চেষ্টা চালালেন সুভাষ। বললেন, যুদ্ধের তিনটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে। সোজাসুজি জার্মান বিজয়ের ভয় তাঁর ছিলই। ইতালির সঙ্গে বোঝাপড়া হলে অন্তত বিজয়ীর দিকে খানিকটা থাকা যাবে, ভারতের জন্য সেটা জরুরি। মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি যদি মারামারি করতে করতে পরস্পরকে একটা যুদ্ধবিরতির দিকে নিয়ে যায়, নেহরুর সঙ্গে একযোগে কাজ করে তিনি ভারতের জন্য কিছু একটা পথ খুঁজে বার করতে পারেন। আর জার্মানি যদি পরাস্ত হয়, সে ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের স্বাধীনতার লড়াইকে অনেকটা পরিচিত করিয়ে দিতে পারবেন তিনি। নাম্বিয়ারের আদর্শগত অস্বস্তি এবং ব্যক্তিগত জীবন এসে এ সবের মাঝে দাঁড়াল, বার্লিনে তাঁকে নিয়ে আসার পথে দুই-ই বেশ বড় বাধা হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত, ১৯৪২-এর জানুয়ারিতে বার্লিনে চলেই এলেন তিনি, ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টারের দায়িত্ব হাতে নিলেন সুভাষের সহকারী হিসেবে।১২
তামিলনাড়ুর এন জি স্বামী এবং হায়দরাবাদের আবিদ হাসান আগেই এসেছিলেন, ১৯৪১-এর অগস্টে। ১৯৩৪ সাল থেকে সুভাষের নজরে পড়েছেন স্বামী, যখন তিনি ভিয়েনায় ভারতীয়দের প্রতি জার্মান সরকারের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন, সেই সময় থেকে। ইহুদিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের অপরাধে তাঁকে এক বার এক জার্মান প্রফেসর ক্লাস থেকে বার করে দেন। ১৯৪১-এ সিমেন্স নামে জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে কাজ করার সময় এক বিখ্যাত ভারতীয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপের জন্য আহূত হন তিনি, বিস্মিত হয়ে দেখেন, দাঁড়িয়ে আছেন সুভাষচন্দ্র বসুর মুখোমুখি। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আর এক ছাত্র, বন্ধু আবিদ হাসানকেও তাড়াতাড়ি নিয়ে আসেন তিনি, দুই জনেই সুভাষের ঘনিষ্ঠ সহকারী হয়ে ওঠেন।১৩ ১৯৪২-এর জানুয়ারিতে নাম্বিয়ারের সঙ্গে ফ্রান্স থেকে আসেন গিরিজা মুখার্জি। এসে দেখেন, গত ছয় মাস যাবৎ বার্লিনের ভারতীয় মাত্রই “সুভাষের চরিত্রের আকর্ষণে নিমজ্জিত”। এম আর ব্যাসের মনে হয়, সুভাষ “প্রকৃতিগত ভাবে অন্তর্মুখী চরিত্রের” মানুষ হলেও এক জন অসম্ভব ভাল শ্রোতা, একই সঙ্গে ধৈর্যশীল, সহনশীল এবং সমঝদার।” যখনই সুভাষকে আক্রমণাত্মক ভাবে জিজ্ঞাসা করা হত, সমাজতন্ত্রী হয়েও কেন তিনি বার্লিনে এসেছেন, “এতটুকুও বিরক্ত হতেন না” তিনি, প্রশ্নকর্তার যুক্তিটি “যেন বুঝতে পারছেন”, এমনকী নিজেও তাই মনে করছেন, এমন একটা ভাব করতেন। ব্যাসকে উত্তর দিয়েছিলেন, “জার্মান কাইজারতন্ত্রের প্রবল বিরোধী হয়েও লেনিন কেমন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জারতন্ত্র— যা তাঁর মতে রাশিয়ার সমস্ত দুর্ভোগের উৎস— তার বিরুদ্ধে জার্মানিকেই নিজের লড়াই-এর মূল জমি হিসেবে কাজে লাগালেন?” কখনওই কিন্তু মনে হত না সুভাষ “পণ্ডিতি করছেন বা বাড়াবাড়ি করছেন।” “বিস্ময় ও শ্রদ্ধা”র সঙ্গে নজর করেছিলেন ব্যাস— আশ্চর্য, এমনকী সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও সুভাষের মধ্যে কখনও “আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি” গোছের ভারিক্কি ভাব দেখা যেত না।১৪
সুভাষের চার দিকে ভারতীয়দের যে বৃত্ত, জার্মান বিদেশ দফতরের স্পেশাল ইন্ডিয়ান ডিভিশনের সঙ্গে তাঁরা সমানেই কথাবার্তা চালাতেন। এই দফতরের মাথায় ছিলেন অক্সফোর্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত অ্যাডাম ফন ট্রট জু সোলজ্ এবং তাঁর সহকারী আলেকজান্ডার ওয়ের্থ। অক্সফোর্ডের রোডস্ স্কলার, উচ্চকুলশীল ট্রট এক জন দক্ষ আন্তর্জাতিক আইনজীবী, বহু দেশে গিয়েছেন, চিন, ব্রিটেন, আমেরিকা। বিদেশ দফতরের যে অংশ সংযোগ রাখত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে, যুদ্ধ শুরু হলে সেই অংশের ভার নিলেন তিনি। এই পদের আড়ালে লুকিয়ে নাত্সি-বিরোধী কার্যক্রম চালাতেন তিনি, পরে ক্লস ফন স্টাউফেনবার্গের ১৯৪৪ সালের জুলাই-এ হিটলার-হত্যার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের অংশী হিসেবে তাঁকে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক বিরোধিতার দায়ে ১৯৩৪ সালে নাৎসিদের হাতে বন্দি হন ওয়ের্থ। পরে ব্রিটেনে চলে যান, সেখানে মিডল্ টেম্প্ল-এর আদালতে আইনজীবীর স্বীকৃতি পান। ১৯৩৯ সালে জার্মানি ফেরার অনুমতি পান, শর্ত ছিল একটাই, সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। ১৯৪০ সালে তাঁকে বিদেশ দফতরে নিয়ে আসা হয় অ্যাংলো-স্যাক্সন দুনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচিতির কারণে। এই কূটনীতিকরাই নাত্সি পার্টির উচ্চকর্তাদের আক্রমণাত্মক মেজাজ থেকে ভারতীয়দের রক্ষা করে চলতেন, এঁদের অনেকেরই রাজনীতি-চেতনা ছিল বাম-ঘেঁষা। ওয়ের্থ মনে করতেন, ট্রট এবং বিদেশ দফতরে ট্রটের অনুগত কর্মীরা না থাকলে সুভাষচন্দ্র “হয়তো বার্লিন ছেড়ে চলে যেতেন।” ১৯৪১-এর বসন্তকাল থেকে সুভাষের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বৈঠকে বসতেন তাঁরা। “তাঁর ইচ্ছাশক্তির জোর, লক্ষ্যের সততা এবং ভারতের জন্য আত্মোৎসর্গের অবিচল প্রতিজ্ঞা” তাঁদের স্পর্শ করতে পেরেছিল।১৫
১৯৪১-এর জুনে সুভাষ নিরাপদে ইউরোপে পৌঁছনোর পর ইস্তানবুলের স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ জানতে চাইল, লন্ডন থেকে সুভাষকে হত্যার জন্য যে মার্চ অর্ডার পাঠানো হয়েছিল তা এখনও মোতায়েন আছে কি না। মে মাসের শেষে দিল্লি থেকে লন্ডনে খবর গেল— তারা ভেবেছিল সুভাষকে “রাশিয়া, ইতালি বা জার্মানির রেডিয়ো প্রোপাগ্যান্ডায় ব্যবহার করা হবে, তবে তেমন কিছু এখনও ঘটেনি।” সুতরাং, তাদের বিশ্বাস, সুভাষ এখনও আফগানিস্তানেই। সে ক্ষেত্রে কি “চলতি রীতি অনুযায়ী আফগান সরকারের কাছে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানানো উচিত?”১৬ ইস্তানবুলের এস ও ই-র ওই মার্চ অর্ডার বিষয়ে খোঁজটি শোনা গেল ১৩ জুন। এস ও ই-র প্রধান স্যার ফ্র্যাঙ্ক নেলসন নাকি “প্রাতঃকালীন বৈঠকের একমাত্র সদস্য যিনি বার বার বলছিলেন যে বিদেশমন্ত্রকেই খোঁজটা নেওয়া দরকার। তিনি নাকি নিশ্চিত যে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট এল এস আমেরি যেহেতু এ বিষয়ে যথেষ্ট উত্সাহী, তুরস্কের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার হিউ ন্যাচবুল-হিউগসেন তুরস্কের মাটিতে সুভাষ-নিধনের ব্যবস্থায় অসম্মত হলে কিন্তু তিনি মোটেও প্রসন্ন হবেন না।”১৭ নিধনের অর্ডারের বিষয়ে নিশ্চিত স্বীকৃতি মিলতেই লন্ডন থেকে ইস্তানবুলের এস ও ই-কে তার করা হল, তাদের কর্মকর্তা গার্ডাইন দ্য চেস্টলেনকে জানানো হল, “বিদেশমন্ত্রক থেকে সুভাষচন্দ্র বসুকে তুরস্কের মাটিতে নিধনের অনুমতি দিয়েছে”, কিন্তু গার্ডাইন দ্য চেস্টলেন যেন কাউকে এ বিষয়ে কিছু না বলেন।১৮
সুভাষ অবশ্য ইতিমধ্যে সম্ভাব্য নিধনকারীদের আওতা থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। ১৯৪১-এর জুলাই-এ রোম ও ভিয়েনা থেকে ফিরে সুভাষ তখন বার্লিনের শার্লটেনবার্গ এলাকার সোফিয়েনস্ট্রাস ৭-এর এক বাড়িতে থাকছেন এমিলির সঙ্গে। এর আগে বাড়িটির বাসিন্দা ছিলেন এক মার্কিন সামরিক দূত। চার দিকে যুদ্ধের দামামা, তারই মধ্যে সুভাষ তখন সাধারণ সংসার জীবন যাপন করছেন, যে জীবন ভারতে তাঁর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন কোনও দিন তাঁকে উপভোগ করতে দেয়নি। তবে যতই তাঁকে ‘স্টেটাস’ দেওয়ার চেষ্টা হোক, যতই তাঁকে “ইয়োর এক্সেলেন্সি” ইত্যাদি বলে ভোলানোর চেষ্টা চলুক, জার্মান আর ইতালীয়দের বিষয়ে হতাশা তাঁর কাটছে না। সেপ্টেম্বরে চলে গেলেন বাডগাস্টাইনে। এ বার তাঁর পরিকল্পনা সফল করার ব্যবস্থা হবে ইত্যাদি নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই তাঁকে আবার বার্লিনে ফেরানো গেল।
ভারতীয় সঙ্গীদের চোখে সুভাষ ছিলেন এক আশ্চর্য শ্রদ্ধেয় মানুষ। ভারতীয় নেতারা সে কালে নানা রকম সাম্মানিক উপাধি পেতেন, গাঁধী যেমন “মহাত্মা”, সুভাষের রাজনৈতিক গুরু চিত্তরঞ্জন দাশ যেমন “দেশবন্ধু”, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ১৯৩৯ সালে সুভাষকে “দেশনায়ক” বলে আহ্বান করেছিলেন। সুভাষের ক্ষেত্রে কিন্তু প্রথমে ইউরোপ ও পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়রা যে সহজ-সরল ডাকটিতে তাঁকে ডাকতেন, সেই “নেতাজি” নামটিই শেষ পর্যন্ত মানুষের মন অধিকার করে নিল। এক সৈন্য এক বার সুভাষকে “হমারে নেতা” বলে অভিহিত করেন, তার থেকেই আসে “নেতাজি”। “ফুয়েরার” শব্দটির মধ্যে ভয়-উদ্রেককারী একটা ভাব আছে। নেতাজি কিন্তু একেবারে ভিন্ন ধরনের ডাক, শ্রদ্ধা ও অনেকখানি ভালবাসা মেশানো ডাক, নিতান্ত ভারতীয় ধরনের একটি অনুভূতি লুকিয়ে রয়েছে এই ডাকের মধ্যে। এত শ্রদ্ধাসহকারে যাঁকে এই নামে ডাকা হচ্ছে, তাঁর অবশ্য মোটেই পছন্দ ছিল না এই নাম। সঙ্গীরা মোটেই সেই আপত্তি মানেননি।১৯
এন জি স্বামী এবং হাসান দুই জনেই আন্দোলনের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চান। যে নব্বই জন তরুণ সে দিন হ্যামবুর্গ-এর কাছে মেসেরিট্জ-এ এলিট কম্যান্ডো ফোর্সের সদস্য হিসেবে উচ্চমানের প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন, স্বামী তাঁদের নেতৃস্থানীয়। ওয়াল্টার হারবিক নামে এক সুদক্ষ জার্মান অফিসার ছিলেন সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কম্যান্ডার। ইউনিটের ভারতীয় সদস্যদের জন্যও ছিল জার্মান স্টাইলের ইউনিফর্ম, বাঁ হাতায় একটি সিল্কের প্রতীকচিহ্ন আঁকা। প্রতীকচিহ্নটি ছিল— ভারতের জাতীয় তেরঙা, আর তার মাঝখানে একটি লম্ফমান বাঘ। অধিকাংশই মাথায় পরতেন জার্মান ফিল্ডক্যাপ বা হেলমেট। শিখ সৈন্যরা সবুজ রঙা কাপড়ের পাগড়িই মাথায় দিতেন। শিখ অফিসারদের আলাদা করার জন্য ছিল আকাশি-নীল সিল্কের পাগড়ি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞ সেনাপতি হারবিক বুঝতে পেরেছিলেন, নানা ধর্মের নানা ভাষার সদস্যদের মিলিয়ে চলার ইচ্ছা সুভাষের, এবং সেই ইচ্ছা বাস্তবায়িত করার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও তাঁর ছিল। ব্রিটিশদের মতো তিনি ধর্মভেদে এদের আলাদা করে দেননি। এমনকী কৌশল-প্রণয়নের যে ক্ষুদ্রতম ইউনিটগুলি, তাতেও সুভাষ ধর্মভেদ তুচ্ছ করে সব রকম ভারতীয়দের একত্র রাখতে চেয়েছিলেন। হারবিক রিপোর্ট করেন, “আমাদের প্রাথমিক নানা সংশয় ভুল প্রমাণ করে বিস্ময়কর রকম ভাল ফল পাওয়া গেল এতে।”২০ জনৈক ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার পরে মেসেরিট্জ সেনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মন্তব্য করেন, “এদের মধ্যে আদর্শ, শৃঙ্খলা এবং ইন্দো-জার্মান সম্পর্ক ছিল দারুণ ভাল”, আর “জার্মান অফিসারদের মান— একেবারে প্রথম সারির”।২১
হাসানের প্রাথমিক ভূমিকা— ড্রেসডেন-এর কাছে আনাবার্গ-এ ১৯৪১-এর গোড়া থেকেই যে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের ক্যাম্পে জড়ো করা হত, তাঁদের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হওয়া, কথাবার্তা বলা। এর পর আসতেন নেতাজি নিজে, ওঁদের এত দিনের আনুগত্য পাল্টে স্বাধীন ভারত গঠনের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। সত্যিকারের নিয়োগের কাজটা শুরু হত আরও পরে, উত্তর আফ্রিকা থেকে ধরে এনে ইতালিতে বন্দি এই সব সৈন্যদের স্থানান্তর করার পর। ভারতীয় বাহিনীতে এঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য লাগল জার্মান ওয়ার অফিসের অনুমোদন। ১৯৪১ সালের শেষে এই অনুমোদন এসে গেলে, দ্বিতীয় ও বৃহত্তর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি হল ফ্র্যাঙ্কেনবার্গ-এ। এই ক্যাম্প পরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্যাক্সনি-র কনিগ্সব্রুক-এ। ফ্র্যাঙ্কেনবার্গ-এর এই বাহিনী ছিল রিজার্ভ ফোর্সের অধীন। সেই রিজার্ভ ফোর্সের প্রধান ছিলেন জেনারেল ফ্রম্। ট্রট-এর মতো ইনিও পরবর্তী কালে ১৯৪৪ সালের হিটলার-হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে নিহত হন।
সৈন্যদের ইচ্ছানুসারেই তাঁদের ভারতীয় বাহিনীতে নিয়োগ করা হত। পুরো কাজটা শুরু হয় ধীরে ধীরে, ১৯৪১-এর ডিসেম্বর ও ১৯৪২-এর জানুয়ারি ধরে। এ দিকে বন্দিদের মধ্যে যে সব অফিসার দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রেণির নন, তাঁরা কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন যাতে সাধারণ সৈন্যরা বাহিনীতে নাম লেখাতে না পারেন। অন্যান্য বাধাও কম নয়: এই সৈন্যরাই আগে ব্রিটিশ প্রভুদের প্রতি আনুগত্যের শপথবাক্য উচ্চারণ করেছেন, তা ছাড়া এদের অনেকেই তখন ভারতে নিজের নিজের পরিবার নিয়ে ভয়ানক উদ্বিগ্ন। এত সব বাধা অতিক্রম করে ভারতের মুক্তিবাহিনীর মূল কেন্দ্রবাহিনীটি তৈরির প্রধান ভরসাই ছিল সুভাষের চারিত্রজাদু।২২ ইউরোপে সাধারণ অসামরিক ভারতীয় মানুষের সংখ্যা কম হওয়ায় উপনিবেশ-বিরোধী রাজনীতি আর সামরিক মানসিকতার মধ্যে একটা বেশ বড় দূরত্ব ছিল। সেই দূরত্ব ঘোচানোর কাজটাও বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াল। শেষ পর্যন্ত জার্মান ও ইতালীয় তত্ত্বাবধানে থাকা প্রায় সতেরো হাজার ভারতীয় যুদ্ধবন্দির মধ্যে ভারতীয় বাহিনীতে যোগ দিতে রাজি হলেন যাঁরা, তাঁদের সংখ্যা হবে মেরেকেটে চার হাজার।২৩
১৯৪১-এর ২ নভেম্বর, বার্লিনের টিয়েরগার্টেন অঞ্চলের লিখটেনস্টাইন অ্যালে ২ ঠিকানায় ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সবুজ, গেরুয়া ও সাদা তেরঙা পতাকা জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হল। মধ্যস্থানে চরকাটি সরিয়ে সেখানে জায়গা দেওয়া হল লম্ফনরত বাঘের ছবিটিকে— আঠারো শতকের ব্রিটিশ-বিরোধী যোদ্ধা মহীশূরের টিপু সুলতানের স্মৃতিতে। পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থাকাকালীন নেতাজি অবশ্য আবার গাঁধীর প্রতীকটিই ফিরিয়ে আনেন। আর স্বাধীনতার পর, চরকা ও বাঘ দুটি প্রতীকই সরে গিয়ে আসে মৌর্য সাম্রাজ্যের স্মৃতিবাহী অশোক চক্র। ভারতের পুণ্য ভবিষ্যৎ অর্জনের বিষয়টি মাথায় রেখে সে দিন জাতীয় সঙ্গীত স্থির হল রবীন্দ্রনাথের “জনগণমন অধিনায়ক জয় হে” গানটি। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা লাভের পর সুভাষের নির্বাচিত এই গানটিই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হবে। আগে ১৯৩৭ সালেও সুভাষ বন্দে মাতরম্ গানটি কেন্দ্র করে বিতর্ক সমাধানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন— এ বার কিন্তু সে গানটি নির্বাচন করলেন না তিনি, কেননা তাঁর কাছে সে দিন মুসলিম সমর্থন পাওয়া ছিল একান্ত জরুরি। সমগ্র বিশ্বের তুলনায় ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের জয়গাথা মহম্মদ ইকবালের “সারে জঁহাসে আচ্ছা” বরং ছিল পছন্দের গান, তবে শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত ভোট গেল রবীন্দ্রনাথেরই পক্ষে। সুভাষ তাঁর অনুচরদের বললেন একটা জাতীয় অভিবাদন পছন্দ করতে, এমন একটা অভিবাদন যার বেশ সুন্দর একটা অর্থ থাকবে, সব ধর্মসম্প্রদায়ের কাছে সেটা সমান গ্রহণযোগ্য হবে। এক দিন আবিদ হাসান শুনলেন কিছু রাজপুত সৈন্য পরস্পরকে “জয় রামজি কি” বলে সম্ভাষণ করছে, বেশ সুন্দর কথাটির ধ্বনি! হাসান সেটিকে পাল্টে করলেন “জয় হিন্দুস্তান কি”। ঠিক হল না যেন। একটু ছোট করে নিয়ে জয় হিন্দ্ করে দেখলেন, একেবারে ঠিকঠাক। নেতাজি মহা-উত্সাহে সেটিকে ভারতের জাতীয় অভিবাদন হিসেবে লুফে নিলেন।২৪ ১৯৪৭ সালে এই শব্দদ্বয়ই ভারতের জাতীয় স্লোগান হবে, আসমুদ্রহিমাচল দেশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে। জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় অভিবাদনের এই সিদ্ধান্তগুলি স্বাধীন ভারতে সুভাষের চিরকালীন উত্তরাধিকার হয়ে থেকে গেল, দেখিয়ে দিল কত প্রখর, কত অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ ছিল তাঁর রাজনৈতিক বোধ।
১৯৪১-এ ভারতে আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য দুই রকম পথ ব্যবহার করতেন সুভাষ। একটি পথ কাবুলের মধ্য দিয়ে, অন্যটি টোকিয়ো হয়ে। ৩১ মার্চ কলকাতার উডবার্ন পার্কে বসে শিশির একটি ‘ভিজিটর্স স্লিপ’ পেলেন যাতে লেখা, “ভগত রাম— সীমান্ত থেকে।” ভগত রাম সুভাষের পাঠানো চিঠি আর অন্যান্য কাগজপত্র ধরিয়ে দিলেন শরৎ ও শিশিরের হাতে, এক তরুণ বাঙালি বিপ্লবী শান্তিময় গাঙ্গুলিকে পেশাওয়ার ও কাবুলে পাঠানোর ব্যবস্থা শুরু হল। অবশ্য ১৯৪১-এর সেপ্টেম্বরে রুশদের কাছে ভগত রাম তাঁর জার্মান ও ইতালীয় বন্ধুদের নাম কবুল করে দিলেন, বহুমুখী গুপ্তচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। এর ফলে কাবুলের যোগসূত্রটিতে সমস্যা দেখা দিল। ইতিমধ্যে অবশ্য জার্মানদের সোভিয়েত আক্রমণের পর যুদ্ধের ধারাই গিয়েছে পাল্টে, কমিউনিস্ট এবং তাঁদের সহধর্মীদের চোখে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ পরিণত হয়েছে “পিপ্লস্ ওয়ার”-এ। ভগত রাম তাঁর যাবতীয় পুরনো ফরওয়ার্ড ব্লক পরিচয় ঝেড়ে ফেলে কীর্তি কিষাণ পার্টি নামে এক স্থানীয় গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে কমিউনিস্ট সরকারি কার্যক্রমে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়লেন। কিছু দিন পরে, ১৯৪২-এর নভেম্বরে বন্দি হলেন তিনি, দ্রুতই আবার ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পেলেন, মুক্তির শর্ত— কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে সুভাষের গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর দিয়ে যাবেন ভগত রাম।২৫
এ দিকে বার্লিন থেকে টোকিয়োতে অয়্যারলেস বার্তা আসতে শুরু করল সেই সময়। সুভাষের সেই সব বার্তা কলকাতার জাপানি কনসুলেট-এর কূটনীতিক কর্তারা শরতের হাতে দিয়ে যেতেন। জাপানি কনসাল-জেনারেল কাতসুয়ো ওকাজাকিকে গাড়ি চালিয়ে বাবার বাগানবাড়িতে নিয়ে গেলেন শিশির। ওকাজাকি চলে গেলে আর এক অফিসার এলেন, তাঁর নাম ওটা। তিনি ও তাঁর শাড়ি-পরিহিত জাপানি স্ত্রী, দুই জনে মিলে রিষড়া আসতেন— সামাজিক অনুষ্ঠানের অজুহাতে। কলকাতার ব্রিটিশ যখন এই সব সংবাদ পেল, অনুমান শুরু হল কী ধরনের কথাবার্তা এঁদের মধ্যে চলতে পারে। টোকিয়োর মাধ্যমে বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে এই বার্তার আদানপ্রদানের গোপনীয়তা অবশ্য বেশি দিন রক্ষা করা গেল না। জাপানি টেলিগ্রাফিক কোড ধরা পড়ে গেল উচ্চ ব্রিটিশ সরকারি স্তরে। টোকিয়োর বিদেশমন্ত্রীর কাছ থেকে বার্লিনে তাঁর রাষ্ট্রদূতের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল ১৯৪১-এর ১ সেপ্টেম্বর— সেটি আসলে সুভাষের প্রতি শরতের একটি বার্তা। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ৫ সেপ্টেম্বর সেই টেলিগ্রাম এসে উপস্থিত উইনস্টন চার্চিলের টেবিলে। প্রধানমন্ত্রীকে কোনওক্রমে আশ্বস্ত করা হল এই বলে যে “ভারত সরকার শরৎ ও তাঁর দলের অন্যান্য প্রধান সদস্যকে গ্রেফতার করার সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।”২৬
শরৎচন্দ্র বসু কিন্তু বছরের শেষে বাংলার প্রাদেশিক রাজনীতিতে একটা বড় মাপের পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লিগের যুগ্ম সরকার পাল্টে একটি নতুন মন্ত্রিসভা তৈরি হতে চলেছে, যাতে কৃষক প্রজা পার্টিকে সমর্থন দিয়েছে বাংলার আইনসভায় উপস্থিত শরতের দলের সমর্থকরা। স্থির হল, শরৎ নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন, পুলিশবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্ব নেবেন। ১৯৪১ সালে ১১ ডিসেম্বর প্রোগ্রেসিভ কোআলিশন পার্টির নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিতে চলেছে, এমন সময়ে জে ভি বি জানভ্রিন উডবার্ন পার্কে উপস্থিত হলেন শরত্কে গ্রেফতার করতে। সুদূর দক্ষিণ ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হল শরত্কে, যুদ্ধ চলাকালীন সেখানেই তিনি বন্দি থাকবেন। তাঁর জাপানি যোগাযোগ-সূত্র যেহেতু নিরাপত্তার দিক দিয়ে “অত্যন্ত বিপজ্জনক”, দিল্লির স্বরাষ্ট্র দফতরের রিচার্ড টটেনহ্যাম স্পষ্ট জানালেন, “শরৎচন্দ্র বসুকে মন্ত্রী হতে দেওয়ার কথা ভাবাও অসম্ভব।” ১০ ডিসেম্বর ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট এল এস আমেরির কাছ থেকে ভাইসরয় লিনলিথগোর কাছে একটি টেলিগ্রাম পৌঁছল, বলা হল, শরৎ বসুকে অ্যারেস্ট করতে হবে, “এখনই”।২৭
এরই মধ্যে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ইতালি থেকে যুদ্ধবন্দিদের জার্মানি নিয়ে যাওয়া এবং তাঁদের নিয়ে ভারতীয় বাহিনী গড়ার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত মিলেছে জার্মানির কাছ থেকে।২৮ তত দিনে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছে অবশ্য। পূর্ব এশিয়ায় ভয়ানক গুরুতর সব কাণ্ড ঘটছে তখন, তার তলায় চাপা পড়ে গেল এই নতুন ঘটনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও— ১৯৪১ সালে ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের প্রবেশ, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তির মোকাবিলায় জাপানি সেনার দ্রুত অভিযান নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল সুভাষচন্দ্র বসুর জন্য। ১৯৪২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, সিঙ্গাপুরের পতনের খবরে সুভাষ স্থির করলেন এ বার তবে তাঁর ছদ্মনাম অর্ল্যান্ডো মাজোটাকে বিদায় জানানোর সময় এসেছে। ভারতে প্রথম স্বনামে তাঁর বেতারবার্তা পৌঁছল ১৯৪২-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। ঘোষণা করলেন, “সিঙ্গাপুরের পতনের অর্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মৃত্যুঘণ্টা, ভারতে তাদের অন্যায় শাসনের ইতি, ভারতের ইতিহাসের নতুন যুগের সূচনা। ভারতের মুক্তির পথেই এশিয়া এবং সমগ্র বিশ্ব এগিয়ে যাবে মানবতার মুক্তির বৃহত্তর লক্ষ্যের দিকে।” ভারত থেকে তাঁর নাটকীয় পলায়নের এক বছরেরও বেশি পর দেশবাসী তাঁর কণ্ঠ শুনতে পেল: “আমি সুভাষচন্দ্র বসু বলছি, আজাদ হিন্দ্ রেডিয়ো।”২৯
আজাদ হিন্দ্ রেডিয়ো-র বেতারবার্তা সাধারণত আরম্ভ হত কয়েকটি কাঁপিয়ে-দেওয়া ইংরেজি পঙ্ক্তি দিয়ে “To arms, to arms,/The heavens ring,/With the clarion call,/To Freedom’s fray”— আর শেষ হত “Our cause is just!”৩০ ব্রিটিশ কবল থেকে জাপানিরা রেঙ্গুন দখল করামাত্র বার্মার স্বাধীনতাকে কুর্নিশ জানালেন সুভাষ। ব্রিটিশ ভাইসরয় আর্চিবল্ড ওয়াভেল-এর সতর্কবাণী শোনা গেল: ভারতেও ঘনিয়ে আসছে শত্রু আক্রমণের ভয়াল ছায়া, ভারতের সীমান্তও তাই এখন আগের চেয়ে বেশি বিস্তৃত— তার এক দিকে সুয়েজ, অন্য দিকে হংকং। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে এখন লড়তে হবে সেই বৃহত্তর সীমান্ত রক্ষার জন্য। সুভাষ এই প্রোপাগ্যান্ডাকে উপহাস করতে ছাড়লেন না, বলতে ভুললেন না যে ভারতের আসলে “এমন কোনও কাল্পনিক ওয়াভেলীয় সীমান্ত নেই”, আছে কেবল “ভাগ্য ও প্রকৃতির নির্ধারণ করে দেওয়া জাতীয় ভৌগোলিক সীমারেখা”। ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে “ভারতকে যুদ্ধে টেনে এনেছিল” ব্রিটিশরা। আর এখন তারা চাইছে “যুদ্ধটাকে ভারতে টেনে আনতে”।৩১
মহাত্মা গাঁধীও ইতিমধ্যে একই কথা বলতে শুরু করেছেন যুদ্ধ বিষয়ে। ১৯৩৯-এ যদিও কিছুতেই গাঁধীকে দিয়ে সুভাষ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ নেওয়াতে পারেননি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের হাতে ব্রিটিশের নাকানিচোবানি দেখে কিন্তু মহাত্মা এ বার ঠিক করে ফেললেন— ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে এ বার চরম বোঝাপড়ার প্রস্তুতিই নিতে হবে। ব্রিটিশ যদি ভারত ছেড়ে যায়, তা হলে ভারতকে আর এই যুদ্ধের ভয়াবহ ফলাফল হজম করতে হবে না। জাপানিদের সঙ্গে যে তিনি একটা সমঝোতা করে ফেলতে পারবেন, নিজের সেই ক্ষমতা নিয়ে তাঁর প্রত্যয়ের অভাব ছিল না। আর, ব্রিটিশরা না থাকলে জাপানিরা কেনই বা ভারতে প্রবেশ করবে। তাঁর মতে, ব্রিটিশ রাজের “নিয়মতান্ত্রিক নৈরাজ্য” “সত্যিকারের নৈরাজ্যে”র চেয়েও ঢের খারাপ। ১৯৪২ সালের বসন্তকালে দেখা গেল, অহিংসার পূজারি এমনকী “হিংসার ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত”, কিন্তু যে ভাবেই হোক, “এই বিপুল দাসত্বপাপ ঘোচাতেই হবে।”৩২
ও দিকে ১৯৪১ সালের অক্টোবর থেকে বার্লিনের জাপানি রাষ্ট্রদূত লেফটেনান্ট জেনারেল ওশিমা হিরোশি আর তাঁর সামরিক সহকারী কর্নেল ইয়ামামোতো বিন সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি সামরিক বিজয় অভিযান, প্রবাসী সুভাষের কার্যকলাপ, গাঁধীর উত্তরোত্তর জঙ্গি মনোভাব— সব মিলিয়ে ব্রিটিশ সামরিক নেতারা তখন প্রবল চাপের মধ্যে। উইনস্টন চার্চিলের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট-এর নির্দেশ আসছে, চাপ আসছে ব্রিটিশ সরকারের ভেতরে তাঁর নিজের সহকর্মীদের কাছ থেকেও— ভারতের জাতীয়তাবাদীদের যে কোনও ভাবে একটু শান্ত করতে হবে। স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স তখন সবে মস্কোয় ব্রিটিশ রাষ্ট্রদৌত্যের কাজ সফল ভাবে সেরে ফিরে এসেছেন, সিঙ্গাপুর পতনের দিন-কয়েক আগে আবার যোগ দিয়েছেন ক্যাবিনেট-এ। ভারতে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো কিন্তু ভারতের কোনও দাবি কানে তুলতেই রাজি নন। জানুয়ারির শেষে তিনি রিপোর্ট করলেন, “বাংলা, অসম, বিহার ও উড়িষ্যায় বিশাল বিপজ্জনক পঞ্চম বাহিনী” তৈরি হয়েছে। “পূর্ব ভারতে এই শত্রুপক্ষীয় সহানুভূতিশীল মানুষের সম্ভাব্য ক্ষমতা” তাঁর মতে “বিরাট”। ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট এল এস আমেরিকে ভাইসরয় বললেন, “শরৎ বসুর ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা পাওয়া উচিত।” লিনলিথগো এই প্রসঙ্গে যে ভাষায় তাঁর উত্তর লিখলেন, মেকলে থাকলে সেটা পড়ে ভারী খুশি হতেন: “ভারত এবং বর্মা— এই দুই দেশের সঙ্গে সাম্রাজ্যের কোনও স্বাভাবিক যোগ নেই, জাতি-পরিচয়, ইতিহাস, ধর্ম, সব কিছুর দিক দিয়ে এরা একেবারে আলাদা, সেই জন্যই এদের কারওই কোনও স্বাভাবিক টান নেই, এরা সাম্রাজ্যের মধ্যে আছে কেবল এদের এক দিন জোর করে দখল করা হয়েছিল বলেই, আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল বলেই, আমাদের আশ্রয়ে থাকাটা এদের স্বার্থের পক্ষে ভাল হয়েছিল বলেই।”৩৩ সিঙ্গাপুরে পরাজিত হয়ে, রেঙ্গুন থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনওয়ালাদের কানে অবশ্য লিনলিথগো-র এই স্পষ্টভাষণ তখন বাড়াবাড়ি জেদের মতো শোনাচ্ছে। অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারতের জন্য একটি মিশনের দায়িত্ব দিয়ে ক্রিপস্কে পাঠাতে বাধ্য হলেন। এতে দুই ধরনের আশার অবকাশ রইল: এক, আটলান্টিক-পারের বন্ধুকে হয়তো এর মাধ্যমে তুষ্ট করা যাবে, এবং দুই, শেষ পর্যন্ত এই মিশন নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবে।
ইতালীয় ছদ্মবেশ ছেড়ে সুভাষ তখন সিঙ্গাপুর-কাণ্ডের সব রকম সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত। ১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিশক্তির কাছে তিনি একটি অতি-উচ্চাশাময় এগারো-দফা পরিকল্পনা পাঠিয়ে দিলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি বার্লিন থেকে তাঁর প্রথম বেতারবার্তা এল, কিন্তু আর সেখানে থাকতে চাইছেন না তিনি। তাঁকে রেঙ্গুনে যেতে হবে, বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন— ক’দিনের মধ্যেই জাপানিরা সেই শহর মুক্ত করবে— এবং সেখানেই ভারতীয় জাতীয় প্রোপাগ্যান্ডার ভিত তৈরি করে ভারতের জাতীয় কর্মযজ্ঞে ঝাঁপ দিতে হবে। জার্মান বিদেশ দফতরে অ্যাডাম ফন ট্রটের মতো বন্ধুরা তাঁর প্রয়াসকে সমর্থন জানালেন, ভারতের মুক্তির লক্ষ্যে এ বার তাঁদের তরফে একটি ঘোষণা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল। ২২ ফেব্রুয়ারি জার্মান বিদেশ দফতর শেষ পর্যন্ত ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করল। সুভাষ যা যা চেয়েছিলেন, সবই রইল সেই খসড়ায়:
জার্মানি, ইতালি এবং জাপান নিশ্চিত যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খল ছিঁড়ে ভারতীয় জাতি বেরিয়ে আসতে চলেছে, নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে জাতীয় জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চলেছে, যার ফলে তারা নিজেদের দেশেরও দীর্ঘকালীন সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করবে, পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণের প্রসারও সম্ভবপর করবে। মুক্তির পর ভারতীয় জনসাধারণ ভবিষ্যতে কী ভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্থান তৈরি করবে, তা নিয়ে ত্রিশক্তির কিছুই বলার নেই। ভারতীয়রা নিজেরাই তাদের নেতাদের সাহায্যে নির্ণয় করবে তাদের দেশের জন্য কী ধরনের সংবিধান তাদের প্রয়োজন, কী ভাবে তা প্রয়োগ করা হবে। ত্রিশক্তি কেবল চায়— সামাজিক ন্যায়ের যুক্তিতে— দুর্দশা ও দারিদ্র থেকে ভারত মুক্তি পাক, ভারতের অত্যাচারিত জনসমাজ ক্রমে উন্নত জীবনযাপন, কর্মসংস্থান ও সমৃদ্ধির পথে পৌঁছতে পারুক।৩৪
জাপান ও জার্মানির মধ্যে বিশ্বাস ও সহযোগিতার অভাবের ফলে অবশ্য হাত থেকে বেরিয়ে গেল এই সুযোগটিও। তবে সুভাষের মাপের এত বড় নেতা যে হেতু জার্মানিরই মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন সে দিন, তার জোরে দেখা গেল, জার্মানি ব্রিটেনের সঙ্গে লড়াইয়েও একটা অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছে, জাপানের সঙ্গে দর-কষাকষিতেও অনেকটা এগিয়ে রয়েছে।
জাপানিরা যুদ্ধে নামার আগে শত্রুপক্ষ কিংবা মিত্রপক্ষ, কাউকেই কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। এশিয়ার ক্ষেত্রে জার্মানির কোনও নির্দেশও তাদের মেনে চলার বিশেষ ইচ্ছে নেই। জাপান কেবল চায়, জার্মানি তার সোভিয়েত ইউনিয়ন বিষয়ে কৌতূহলাধিক্য থেকে বেরিয়ে আসুক, পরিবর্তে বরং সুয়েজ-এ ব্রিটিশ শক্তির মোকাবিলায় নিজের শক্তিকে কাজে লাগাক। জাপান ও জার্মানি দুই পক্ষেরই নৌ-বাহিনীর কম্যান্ডাররা ভারত মহাসাগরের সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছিলেন সেই সময়। যদি সেটা সম্ভব হয়, “যুদ্ধ তা হলে মোটের উপর শেষ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরও সেখানেই সমাপ্তি”। নৌবিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ “দ্রুত ঘটা দরকার, যাতে যুদ্ধেরও দ্রুত সুসমাপ্তি ঘটে”। জাপানিরা তাই চায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জার্মানি একটা আলাদা শান্তি চুক্তি করে নিয়ে এ বার ভূমধ্যসাগরে মনঃ-সংযোগ করুক, এবং ভারতীয় মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে জাপানিদের সঙ্গে হাত মেলাক। কিন্তু হিটলার তো কিছুতেই পূর্ব ফ্রন্টে কোনও সন্ধিচুক্তি করবেন না, বরং সামনের গ্রীষ্মে আবারও “রুশ ভল্লুক”কে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা তাঁর।৩৫ জার্মানি ও জাপানের মধ্যে যখন এত সব গোলমাল, সেই সময়ই সুভাষের এশিয়া-যাত্রার অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন রিবেনট্রপ। আরও এক বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিক্ত মনে সুভাষ বার্লিন ছেড়ে বাডগাস্টাইনে রওনা হলেন কিছু দিন জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। জার্মানরা আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য দূত পাঠাল। সুভাষ প্রত্যাঘাত হানলেন, অভিযোগ তুললেন, ভারতীয় স্বাধীনতার বিষয়টিকে আসলে জার্মানরা কোনও গুরুত্বই দিতে চায় না। আবারও তাঁর প্রস্তাব— তাঁকে এবং ভারতীয় লক্ষ্যকে সম্ভাব্য টোপ হিসেবে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করুক জার্মানরা।৩৬
অবশ্য ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে ভারতের কোনও সমঝোতায় সুভাষচন্দ্রের প্রবল আপত্তি। বার্লিনে ফিরে ক্রিপ্স মিশনের বিরুদ্ধে একটা প্রোপাগ্যান্ডা যুদ্ধ শুরু করলেন তিনি। ইতিমধ্যে অকস্মাৎ— ১৯৪২-এর ২৪ মার্চ ব্রিটিশ নিউজ এজেন্সির খবর— টোকিয়োয় জরুরি বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনায় হত সুভাষচন্দ্র বসু। বিবিসি নিউজে নিজের মৃত্যুসংবাদ শুনে তো সুভাষ অস্থির হয়ে পড়লেন, তাঁর বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের না-জানি কী অবস্থা এ খবর পেয়ে। আজাদ হিন্দ্ রেডিয়োর মাধ্যমে মিথ্যা খবরটি সুভাষ সংশোধন করতে পারার আগেই এ দিকে গাঁধীর সান্ত্বনা-বার্তা পৌঁছে গিয়েছে প্রভাবতীর কাছে: “আপনার সাহসী পুত্রের মৃত্যুতে আপনার সঙ্গে সমস্ত দেশ আজ শোকে জর্জরিত। আমি সম্পূর্ণ ভাবে আপনার শোকের সমব্যথী। ঈশ্বর আপনাকে এই অপ্রত্যাশিত শোক সহ্য করার বল দিন।” সৌভাগ্যক্রমে, প্রভাবতী কিন্তু সন্দেহ করেছিলেন যে তাঁর ছেলের মৃত্যুসংবাদটি সত্য নয়, শিশিরও তাঁকে ও পরিবারের অন্যান্যদের সেই আশ্বাস দিচ্ছিলেন। ২৫ মার্চ শোনা গেল সুভাষের রেডিয়ো বার্তা: “আমার মৃত্যুসংবাদটি আসলে ওদের নিভৃত ইচ্ছা পূরণেরই চেষ্টা।” ব্রিটিশ সরকার যে তাঁকে মৃতই দেখতে চায়, তা তিনি জানেন, তারা তো “তাদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের লক্ষ্যে” ভারতকে পাশে পাওয়ার চেষ্টায় আছে। ব্রিটিশের এই শয়তানি নীতির বিষয়ে সাবধান করলেন দেশবাসীকে— এই নীতি দিয়েই তো তারা আয়ার্ল্যান্ড কিংবা প্যালেস্তাইনের সর্বনাশ করেছে। হাঁফ ছেড়ে আনন্দ প্রকাশ করে গাঁধী আবার প্রভাবতীকে তার করলেন। তবে ভারতে এই মিথ্যা খবরের প্রতিক্রিয়া কিন্তু একটা কথা বুঝিয়ে দিল: ব্রিটিশরা যতই তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করতে হন্যে হয়ে উঠুক, নিজের দেশে তখনও সুভাষের স্থান উচ্চতম শিখরে। ১৯৪২-এ মার্চের শেষে, এপ্রিলের গোড়ায় একের পর এক বেতার-সম্প্রচারে সুভাষ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স-কে সাম্রাজ্যবাদী ধ্বজা বহনের জন্য তুলোধোনা করলেন, ভারতীয় জনতা ও নেতাদের যুদ্ধশেষে ডোমিনিয়ন স্টেটাস-এর প্রস্তাব ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলতে অনুরোধ জানালেন।৩৭
সুভাষ হয়তো অতটা উদ্বিগ্ন না হলেও পারতেন। যে ব্যাঙ্ক স্পষ্টত এমনিতেই উঠে যেতে বসেছে, তার নামে ‘পোস্ট-ডেটেড চেক’ নিতে সে দিন গাঁধীই আর রাজি নন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যদি কংগ্রেসকে দেওয়া হয়, তা হলে নেহরু এবং আজাদ আপসে রাজি হলেও হতে পারেন। কিন্তু ক্রিপস্-এর হাতে এখনই তো দেওয়ার মতো কিছু নেই, তিনি কেবল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিটুকুই দিতে পারেন। চার্চিল ও আমেরির সঙ্গে নিভৃত আলাপে লিনলিথগো নিশ্চিত করলেন যাতে ক্রিপ্স শেষ অবধি গুরুতর কিছু না ছেড়ে দেন। গাঁধী অবশ্য পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতে তখন রাজি নন। দেখেশুনে আবুল কালাম আজাদের মনে হল, “সুভাষের জার্মানিতে পালানোর খবর গাঁধীজির উপর একটা বিরাট প্রভাব ফেলেছে।” “এর আগে সুভাষের অনেক কাজই উনি সমর্থন করেননি,” আজাদের ব্যাখ্যা, “কিন্তু এ বার তাঁর মনোভাবে একটা বদল এসেছে। তাঁর অনেক মন্তব্যেই আমার মনে হচ্ছিল, ভারত ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে সুভাষ বসু যে সাহস ও বুদ্ধির ক্ষমতা দেখিয়েছেন, সেটাকে তিনি সত্যিই সম্মান করছেন। সুভাষ বসুর প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধারই পরোক্ষ প্রভাব পড়ল সামগ্রিক যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিষয়ে তাঁর মূল্যায়নে।”৩৮
ক্রিপ্স প্রস্তাবকে উপহাস করে জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর আশ্বাসবাণীকে স্বাগত জানালেন সুভাষ। “ভারত ভারতীয়দেরই জন্য”, এই ছিল তোজোর বক্তব্য। ১৯৪২ সালের ১১ এপ্রিল ক্রিপস মিশন প্রায় ব্যর্থ হওয়ার মুখে, এমন সময়ে জাপানিরা জার্মানি এবং ইতালিকে একটি খসড়া প্রস্তাব পাঠাল— সেই প্রস্তাবে ভারত এবং আরব দেশগুলির স্বাধীনতার কথাও রয়েছে। জার্মান বিদেশ দফতরের কাছে অবশ্য প্রস্তাবটি “বড্ড বেশি ভাসা-ভাসা”। তারা এর উত্তরে আর একটি সংশোধিত প্রস্তাব তৈরি করল। ১৬ এপ্রিল রিবেনট্রপ হিটলারকে সেটা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন। জার্মান বিদেশমন্ত্রীর মতে, “ব্রিটেনের শান্তিপ্রিয় মানুষ” এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবেন। টোপটা কিন্তু গিললেন না হিটলার। এই সংশোধিত প্রস্তাবও পর দিন নাকচ করে দিলেন। জাপানিরা চাইছে বলেই কোনও প্রস্তাব গ্রহণ করার যৌক্তিকতা দেখলেন না তিনি। আসলে ইতিমধ্যেই এশিয়ায় জাপানিরা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যে অসামান্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ছিলেন হিটলার। ইতালীয়রা জাপানিদের দিকেই ঝুঁকে; কিন্তু ২৯ এপ্রিল সলজবুর্গ-এর কাছে ক্লেসহাইম কাস্ল-এর বৈঠকে হিটলার মুসোলিনিকে বুঝিয়ে ছাড়লেন এই প্রস্তাব গ্রহণ না করতে।৩৯ অনেক পরে, ১৯৪৫ সালের বসন্তে, হিটলার যখন একেবারে ধ্বংসের মধ্যমঞ্চে, সেই সময়ে কিন্তু এশিয়া ও আরব দুনিয়ার ঔপনিবেশিক দেশগুলির লড়াইয়ে সমর্থন না জোগানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুতাপ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।৪০
এই বার দেখা গেল সুভাষের গোঁ। ইতালিকে নিজের দিকে টেনে আনতে পারবেন বলে তাঁর ধারণা, সে দিকে এগোতে শুরু করলেন তিনি। ১৯ এপ্রিল বিখ্যাত ইতালীয় সাংবাদিক লুইজি বারজিনি তাঁর একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশ করলেন ইল পোপোলো ডি’ইতালিয়া-য়। সুভাষকে সেখানে বর্ণনা করা হল এই ভাবে, “সাক্ষাৎ বুদ্ধ, যেমন প্রাণবন্ত তেমন উদ্যমী, অথচ তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে আর ভাবভঙ্গিতে যেন শান্তির স্পর্শ।” “মহাত্মা বিষয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধা” তাঁর কথায় স্পষ্ট। সুভাষের “স্থৈর্য ও আত্মসংযম” দেখে বারজিনির মনে হল, তাঁর মধ্যে একটা “এশীয় ধাঁচের মহত্ত্বের” ছাপ রয়েছে।৪১ সলজ্বুর্গ-এর সিদ্ধান্তটির কেন পরিবর্তন দরকার— নিজের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে মুসোলিনিকে সেটা বোঝাতে হবে, তাই ৫ মে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে রোমে গেলেন সুভাষ। ইতালির বিদেশমন্ত্রী, মুসোলিনির জামাই গালিয়াজো চিয়ানো সে দিনের ঘটনা ধরে রাখলেন ডায়রির পাতায়: “বোস-এর সঙ্গে আমিও গেলাম। দীর্ঘ বৈঠক, নতুন কিছু নয়, কেবল মুসোলিনি সে দিন বসুকে নিজের মতো করে কথা বলে যেতে দিলেন, তাঁকে বোঝাতে দিলেন, কেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশক্তির ঘোষণা এতখানি জরুরি। জার্মানদের টেলিগ্রাফ করলেন তিনি, প্রস্তাব— সলজ্বুর্গ-এর সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে ঘোষণা গৃহীত হোক। অবশ্য হিটলার এতে নিজে থেকে রাজি হবেন বলে আমার মনে হয় না।”৪২ চিয়ানো ঠিকই বলেছিলেন। মুসোলিনির প্রস্তাব আবারও নাকচ করে দিলেন হিটলার।
ভারতীয় সংগ্রামের জন্য ত্রিশক্তির সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ এই আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলির আদর্শ ও লক্ষ্যের থেকে নিজেকে আলাদা রাখারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৪২-এর ১ মে-র বেতার-সম্প্রচারে খোলাখুলি বললেন, “তিনি ত্রিশক্তি অক্ষের সমর্থক নন”, “তারা কী করেছে বা ভবিষ্যতে কী করবে সে সবের সমর্থন” তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে না। একই সঙ্গে অবশ্য “পয়সা-দিয়ে-কেনা ব্রিটেনের প্রোপাগ্যান্ডা-বাজদের” যুক্তিও উড়িয়ে দিলেন তিনি। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে নিজের স্ট্র্যাটেজি ব্যাখ্যা করলেন এই ভাবে:
নিজের দেশের মানুষের জন্য কথা বলার জন্য কোনও অতিরিক্ত পরিচিতি লাগে না আমার। আমার গোটা জীবন, দীর্ঘ জীবন কেটে গিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবিচ্ছিন্ন অবিশ্রান্ত লড়াইয়ে— আমার পরিচয় হিসেবে এটাই যথেষ্ট। ব্রিটিশরা তো কূটনীতি আর রাজনৈতিক ছলাকলায় অতীব সিদ্ধহস্ত, তারাও যদি আমাকে দলে ভিড়াতে কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করাতে কিংবা বিপথে চালাতে না পেরে থাকে, পৃথিবীর কোনও শক্তিই তা পারবে না। সারা জীবন ধরে আমি ভারতবর্ষেরই ভৃত্য, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা-ই থাকব। যে কোনও সময়, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই থাকি না কেন, ভারত— কেবল ভারতের প্রতিই চিরকাল আমার অধীনতা, আমার আনুগত্য। চিরকাল তাই থাকবে।৪৩
বিশ্ব-ইতিহাসের এই বিশেষ মুহূর্তটিতে তাঁর অবস্থান ঠিক কোথায় হওয়া উচিত, এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই তাঁর। “সময় হয়েছে,” ১৯৪২-এর ২২ মে রিবেনট্রপকে লিখলেন তিনি, “ভারতের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য চূড়ান্ত ধাক্কাটি দেওয়ার প্রহর সমাগত। এ জন্যই আমার প্রাচ্য দুনিয়ায় ফিরে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। একমাত্র সেখান থেকেই আমি ঠিক ভাবে এই বিপ্লব চালনা করতে পারব।”৪৪
১৯৪২ সালের ২৯ মে সুভাষচন্দ্র বসু জার্মান ফুয়েরারের সঙ্গে দেখা করতে পারলেন। হিটলারের দোভাষী পল স্মিড্ট-এর সরকারি দলিলপত্রে অবশ্য এই সাক্ষাতের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন ২৭ মে, স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন “ফুয়েরারের সদর দফতর।” তবে ওয়েরমাখ্ট-এর সুপ্রিম কম্যান্ডার, ফুয়েরারের ডায়রি, জার্মান নিউজ ব্যুরো-র রিপোর্ট-এর মতো অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, হিটলারের সঙ্গে সুভাষের এক এবং একমাত্র সাক্ষাত্টি ঘটেছিল ২৯ মে-তেই, বার্লিনের রাইখ চ্যান্সেলরি-তে। কথাবার্তার বিস্তারিত বিবরণ মেলে স্মিড্ট-এর লেখায়। সুভাষ তাঁর “পূর্ব এশিয়া অভিযানের” প্রসঙ্গটি তোলেন, “ভারতের যত কাছাকাছি সম্ভব কোনও স্থানে পৌঁছনোর ইচ্ছা তাঁর, যেখান থেকে ভারতের বিপ্লব পরিচালনা করা যাবে।” সৌভাগ্যক্রমে, ফুয়েরার রাজি হলেন। ইউরোপ থেকে এশিয়ায় সাবমেরিনে সুভাষকে পাঠানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বিমানে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে সুভাষকে সতর্ক করলেন— ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোথাও হয়তো জোর করে তাঁকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে— “এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষায় জীবন বিপন্ন করার পক্ষে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি” সুভাষ। সুতরাং হয় তিনি জাপানি সাবমেরিনে যাত্রা করুন, নয়তো ফুয়েরার “একটি জার্মান সাবমেরিন তাঁর জন্য বরাদ্দ করে দেবেন, সেটা তাঁকে ব্যাঙ্কক অবধি পৌঁছে দিক।” কথাবার্তা চালাতে চালাতে মেইন কাম্প্ফ-এ যে জাতিবিদ্বেষমূলক ভারত-বিরোধী মন্তব্য রয়েছে, ভারতীয় জাতির পক্ষ থেকে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন সুভাষ। হিটলার প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেন, বললেন, তিনি “ভারতীয় ধরনের অহিংস বিরোধিতা রাইখ-এর পক্ষে সুবিধাজনক” বলে মনে করেন না। সাবমেরিন-এর প্রস্তাবটা যে এর পর ফিরিয়ে নেওয়া হল না, এই সুভাষের বিরাট সৌভাগ্য।৪৫
তবে ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে জার্মানির ঘোষণা কিন্তু বার করতে পারলেন না সুভাষ। হিটলার দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে চললেন, বিষয়: রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তববাদের উপকারিতা। মিশরের উদাহরণ দিলেন যেখানে আরউইন রমেল আগের দিনই আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন। তাঁর জেনারেল যদি খানিকটা সাফল্যও ইতিমধ্যে পেয়ে থাকেন, মিশরের স্বাধীনতা নিয়ে কোনও ঘোষণা জারি করা এই মুহূর্তে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। বরং ব্রিটিশ শক্তিকে তুমুলভাবে হারাতে পারলে মিশরীয়দের ব্রিটিশ শাসনজাল ছুড়ে ফেলতে ঠেলা দেওয়ার জায়গায় চলে যাবেন হিটলার। তাঁর বক্তব্য: ভারত জার্মানি থেকে “বহু বহু দূরে”। তুলনায়, জাপান বরং “ভারতের সীমান্তেই পৌঁছে গিয়েছে।” অক্ষশক্তির মধ্যে ভয়ানক যোগাযোগের অভাব, হিটলার স্বীকার করলেন, “জাপান ঠিক কী চায়, তাঁর জানা নেই।” তিনি জানেন না, জাপান কি “চিয়াং কাই শেক-এর হুমকি থেকে নিজেদের বাহিনীকে রক্ষা করতে চায়, নাকি তাঁর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে চায়।” এশিয়ায় ব্রিটেনের সামরিক পরাজয় “সম্ভবত ডেকে আনবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন।” যুদ্ধের এই প্রেক্ষিতে, “সুভাষের উচিত জাপানিদের সঙ্গে আলোচনায় বসা, কেবল নিজের মাতৃভূমির ঘটনাবলিকে প্রভাবিত করতেই নয়, জাপানিদেরও ঠিকমতো উপদেশ দিয়ে কোনও ভুল পদক্ষেপ করার আগেই তাদের নিরস্ত করতে।” ভারতীয় স্বাধীনতা নিয়ে কোনও স্পষ্ট ঘোষণা না করলেও ফুয়েরার “সুভাষকে তাঁর যাত্রা ও পরিকল্পনা নিয়ে অনেক শুভেচ্ছা জানালেন।”৪৬
এই এক বারই দুই জনের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা। সুভাষ হিটলার বিষয়ে কী ভাবলেন এর থেকে? যদিও এশিয়া যাত্রা বিষয়ে হিটলারের সম্মতিই মিলেছিল সে দিন, সুভাষের বেশির ভাগ সঙ্গীরই কিন্তু মনে হয়েছিল সে দিনের সাক্ষাৎ বিশেষ স্বস্তিদায়ক হয়নি। জার্মান বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপ সুভাষকে হিটলারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলেকজান্ডার ওয়ের্থ-এর মতে, হিটলারের বক্তৃতা শুনে বিরক্ত হয়ে যান সুভাষ। অ্যাডাম ফন ট্রট কূটনৈতিক ভাষায় সুভাষের প্রতিক্রিয়া অনুবাদের সময় অনেক বক্তব্যকেই একটু কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। আলোচনার সরকারি তথ্য অবশ্য বলে না যে ট্রট সে দিন সেখানে সুভাষের দোভাষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পল স্মিড্ট-এর মতে, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেবল সেক্রেটারি অব স্টেট উইলহেল্ম কেপলার এবং রাষ্ট্রদূত ওয়ালথার হিউয়েল। গিরিজা মুখার্জি লেখেন— বৈঠকের পর “হতাশ বোধ করেন সুভাষ”, “সেটা নিয়ে আলোচনা করতেও চান না আর।” হিটলার বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে ব্যগ্র ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার-এর সঙ্গীরা, তাঁদের কাছে ফুয়েরার-এর বিবরণ দেন সুভাষ “ইপি-র ফকিরের জার্মান সংস্করণ বলা যেতে পারে”, জোর দিয়ে বললেন “কোনও বিষয়েই তাঁর সঙ্গে কয়েক মিনিটও টানা কথা বলা অসম্ভব।” “একেবারে বদ্ধ পাগল”, সঙ্গীদের বলেন তিনি। তবে আলোচনার নথি যা বলছে, তার থেকে মনে হয় ফুয়েরার সে দিন মোটের উপর যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছিলেন, হয়তো একটু বেশি ক্ষণ ধরে চলেছিল তাঁর মন্তব্য আর বিশ্লেষণ।৪৭
কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছেন, তার চরিত্রের ভয়াবহতাটা কোন স্তরের, সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন সুভাষ, যদিও ঘটনা আরও কত কদর্য দিকে গড়াবে ১৯৪২-এর মে মাসে সেটা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। ১৯৩০-এর দশকে সুভাষের যে নীতিবোধ, সংবেদনশীলতা, যে বন্ধুদের দেখা গিয়েছে, আর ১৯৪০-এর দশকে তিনি যেখান থেকে রাজনৈতিক মিত্র নির্বাচন করছেন— এই দুই দিককে মেলানো দুরূহ কাজ, সন্দেহ নেই। তবে যাদের বন্ধু বলে গ্রহণ করার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না, সেই সব লোকদেরই রাজনৈতিক বা স্ট্র্যাটেজিক মিত্র হিসেবে গ্রহণ করার কাজটা কিন্তু তিনি সে দিন একাই করেননি। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা হতে রুজভেল্ট তাঁকে বলেছিলেন, “আপনার সঙ্গে আলাপে খুশি হলাম।” বাস্তবিক, যে আগ্রাসী রাষ্ট্রবাদী নিজের দেশে গণহত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেন এমন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মোটেই খুশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সে দিন স্ট্যালিন এক জন আবশ্যিক সঙ্গী। ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য সুভাষের আবেগ-প্রসূত দায়বদ্ধতা থেকেই এই সব অপাঙ্ক্তেয় শাসন ও শাসকদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধকালীন মিত্রতার সূচনা। গাঁধী ১৯৩৯-এর ২৩ জুলাই হিটলারকে একটি চিঠিতে “প্রিয় বন্ধু” বলে সম্বোধন করেন। “যে যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে বর্বরতার স্তরে নামিয়ে আনে”, লেখেন মহাত্মা, “স্পষ্টত আপনিই আজকের পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি যিনি সেই যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষমতা রাখেন।”৪৮ যুদ্ধ এবং বর্বরতা শুরু হতে গাঁধী ও সুভাষ দুই জনেই দুই ভিন্ন পথে এগোতে চাইলেন, লক্ষ্য যদিও এক-ভারতের স্বার্থ রক্ষা, কোনও না কোনও ভাবে ভারতের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
হিটলারের সঙ্গে বৈঠকের পরের কয়েক সপ্তাহে অক্ষশক্তির থেকে আদর্শগত দূরত্বের বিষয়টিতে জোর দিতে আরও উদ্যোগী হয়ে উঠতে দেখা গেল সুভাষকে। ১৯৪১-এ জার্মানির সোভিয়েত আক্রমণের সরাসরি সমালোচনা শুরু করলেন তিনি, যদিও জার্মানির অভ্যন্তরীণ নীতি বিষয়ে কিছু বললেন না। বার বার বললেন, এক বার স্বাধীনতা লাভ করার পর “ভারতীয়দেরই দায়িত্ব কী ধরনের সরকার তারা চায়, কে সেই ভবিষ্যতের ভারতীয় রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া।” ১৯৪২ সালের ১৭ জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বেতার-বার্তায় বললেন, “ভারতের ইতিহাসের এই চরম মুহূর্তে কেবল আদর্শগত ধ্যানধারণায় নিজেদের ভাসিয়ে দেওয়াটা ভয়ঙ্কর নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। জার্মানি কিংবা ইতালি কিংবা জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আমাদের কিছু এসে যায় না, ওই সব দেশ নিজেরাই তা নিয়ে মাথা ঘামাক।” ভারতীয়রা যেন “স্বাধীন ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির মধ্যে প্রভেদ করতে পারে,” সাবধান করলেন তিনি। বাইরের জগতে ত্রিশক্তি অক্ষের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেও আমি ভারতের নিজের জাতীয় ক্ষেত্রগুলিতে তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার দাবি করি। স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিতে কোনও বিদেশি হস্তক্ষেপ আমি কোনও দিন সহ্য করব না।” আর্থসামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি “সেই দেশে থাকতে যে রকম যা ছিল, এখনও তা-ই রয়েছে— ত্রিশক্তি অক্ষের সঙ্গে বাহ্যিক সহযোগিতার অর্থ— তাদের শাসন মেনে নেওয়া কিংবা ভারতের মাটিতে তাদের আদর্শ স্বীকার করে নেওয়া— এ কথা যেন কেউ ভুল করেও না ভাবে।” ভারতকে মুক্ত করার কাজ শেষ হলে আবারও মহাত্মা গাঁধীর কাছেই যাবেন তিনি, ১৯৪০-এর জুনে তাঁর সঙ্গে শেষ যে বিদায়-আলোচনা হয়েছিল তাঁর, সেই কথাই রাখবেন।৪৯
১৯৪২-এর বসন্ত ও গ্রীষ্ম জুড়ে— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কী লক্ষ্য হওয়া উচিত, কী ভাবে সেই লক্ষ্য এগোনো উচিত, এ বিষয়ে গাঁধী ও সুভাষ কেবলই পরস্পরের কাছে আসতে লাগলেন। ১৯৪২-এ এপ্রিলের শেষে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির জন্য একটি জঙ্গি গোছের প্রস্তাব তৈরি করলেন গাঁধী, ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে আহ্বান করলেন। “ভারতের সঙ্গে জাপানের কোনও ঝগড়া নেই,” লিখলেন গাঁধী। “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেই তার লড়াই। ভারতীয়দের প্রতিনিধিদের অনুমতি ছাড়াই এই যুদ্ধে ভারতকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণতই ব্রিটিশদের সিদ্ধান্ত। ভারত যদি স্বাধীন হয়, প্রথম পদক্ষেপ হবে জাপানের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা।” মহাত্মা ঔপনিবেশিক শাসকদের বলতে চাইছিলেন, ভারত ছেড়ে চলে যাও, তাতে নৈরাজ্যই আসুক আর ঈশ্বরই আসুন। ভারতকে তার স্বাধীনতার মূল্য ধরে দিতে হয়তো “রক্তের নদী” বওয়াতে হবে, সাংবাদিকদের বললেন তিনি।৫০ নেতাদের মধ্যে যারা একটু বেশি সাবধানী, যেমন নেহরু কিংবা আজাদ, তাঁদের প্রভাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই প্রস্তাবের একটি তরলীকৃত বয়ান তৈরি করল জুলাই-এর দ্বিতীয় সপ্তাহে।
হাজার মাইল দূরে বসেও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির হালচাল বোঝার ব্যাপারে সুভাষের একটি সহজাত ক্ষমতা ছিল। ১৯৪২ সালের ২৩ জুলাই রিবেনট্রপকে বললেন, “ভারতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যা হচ্ছে, তাতে সম্ভব হলে আমি অগস্টের প্রথম সপ্তাহেই দূর প্রাচ্যে পৌঁছতে চাই।”৫১ ৪ অগস্ট অ্যাডাম ফন ট্রট তাঁর এক সহকর্মীকে লিখলেন যে সুভাষের মতে, ৮ অগস্ট অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের পরই একটা ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হবে সে দেশে। ঠিকই ভাবছিলেন তিনি। সেই সন্ধেয়, এ আই সি সি সদস্যরা বম্বের লম্বা চৌপাট্টি বিচে মিলিত হলেন, এবং বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাশ করলেন। গাঁধী সবাইকে আওয়াজ তুলতে বললেন, “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে”, ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়াবার জন্য এটিই চূড়ান্ত গণ-আন্দোলন হতে চলেছে বলে তাঁর ধারণা। ভাইসরয় লিনলিথগো এ দিকে ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন কড়া হাতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমন করবেন, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানকে একেবারে টুঁটি টিপে শেষ করবেন। লন্ডন থেকে গাঁধীকে দেশান্তরে পাঠানোর প্রস্তাব তিনি কানে না তুললেও ব্রিটিশ সরকার গাঁধীকে বন্দি করল। সঙ্গে বন্দি করল নেহরু-সহ কংগ্রেস পার্টির উঁচু পদের সব নেতাদেরই— ৯ অগস্টের কাকডাকা ভোরে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৯৪২ সালের অগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরম্ভ হল। প্রধানত শহরের আন্দোলন— ছাত্ররা, তরুণ সমাজ, শ্রমিকরা রইলেন পুরোভাগে। বম্বে ও কলকাতার মতো মহানগরীগুলিতে পুলিশের গুলি চলল— তাদের নিজেদের মতেই নিহত হলেন হাজারেরও বেশি মানুষ— মাসের শেষের দিকেই প্রধান শহরগুলিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ তারা আবার পুনর্বহাল করতে পারল। সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে কৃষক আন্দোলনের রূপ নিয়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল বিহার, যুক্ত প্রদেশ, বাংলা, উড়িষ্যা ও বম্বে প্রদেশের বেশ কিছু জেলায়। সরকারি ক্ষমতার যাবতীয় প্রতীকের উপর আছড়ে পড়ল জনক্ষোভ। উপড়ে ফেলা হল রেলওয়ে লাইন, লুঠ হল পুলিশ থানা, রেভিনিউ অফিস পোস্ট অফিস জ্বলতে শুরু করল। মাঝারি মাপের নেতাদের সংগঠনের জোরেই ১৯৪২-এর আন্দোলন হয়ে দাঁড়াল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর সর্ববৃহৎ অসামরিক গণ-অভ্যুত্থান। বিভিন্ন শ্রেণি-সংবলিত বৈচিত্র্যপূর্ণ এই অভ্যুত্থানের তুলনাও একমাত্র হতে পারে সেই ১৮৫৭-র সঙ্গেই। যুদ্ধের প্রাথমিক বছরগুলির ধাক্কায় ব্রিটিশ শক্তি যে এখন তুলনায় দুর্বল, বিদ্রোহীদের চোখ এড়াল না সে কথা। তবু অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানিদের আটকানোর জন্য যে সামরিক বাহিনী মজুত করল ব্রিটিশরা, তার আকার হল বিশাল। ব্রিটিশ রাজের অস্ত্রশক্তির সামনে ছারখার হয়ে গেল বিদ্রোহীদের এলোমেলো ভাবে গড়ে তোলা সংগঠন। সরকারি মতে, ষাট হাজারের বেশি মানুষ গ্রেফতার হলেন, আন্দাজ চার হাজার বিদ্রোহী নিহত হলেন: বিপরীতে, কংগ্রেসের দাবি, ভারত ছাড়ো বিদ্রোহী শহিদের সংখ্যা অন্তত পঁচিশ হাজার। ১৯৪৩-এর মার্চের মধ্যে ভেঙে পড়ল আন্দোলনের মেরুদণ্ড।
গাঁধী যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলন আহ্বান করছেন, সুভাষ তাঁর সর্বান্তঃকরণ সমর্থন জানালেন তাতে। বিদ্রোহ শুরু হতে বেতারবার্তার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের জন্য বিস্তারিত উপদেশ পাঠাতে শুরু করলেন, কী ভাবে আন্দোলন জিইয়ে রাখতে হবে, কী ভাবে আরও কার্যকর হয়ে উঠতে হবে। ১৯২১ থেকে কংগ্রেসের সব কয়টি আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪২-এ যে আর নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে পারলেন না সে দিন, তা নিয়ে আক্ষেপের অন্ত ছিল না তাঁর। যখন বলছিলেন, “কিছু দিনের মধ্যেই” তিনি আসছেন তাঁদের পাশে, যেন ইচ্ছা পূরণের আশা ফুটল তাঁর কথায়। ১৯৪২ সালের ১৭ অগস্ট, তিনি দেখালেন কী ভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এ বার তার মৌলিক চরিত্রটিতে ফিরে গিয়েছে, শক্ত অত্যাচারী হাতে সাম্রাজ্যের হাল ধরেছে:
গোটা পৃথিবী সাক্ষী, যে মখমলি দস্তানায় ব্রিটিশরা সাধারণত তাদের হিংস্র নখগুলি লুকিয়ে রাখে, সেই দস্তানা এ বার ওরা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ভারতের উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উলঙ্গ, নির্লজ্জ, হিংস্র পাশবিকতা। গ্যাসের শ্বাসরোধী পর্দার পিছনে, পুলিশের লাঠির সপাট মারের নীচে, বুলেটের নিরন্তর তীক্ষ্ণস্বননে, আহত মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের ক্রুদ্ধ প্রতিরোধে— ভারতের আত্মা আর্তনাদ করে উঠছে— কোথায় আমাদের সেই চার স্বাধীনতা? সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত ভেসে বেড়াচ্ছে সেই আর্ত স্বর। ওয়াশিংটন নিরুত্তর। সামান্য নৈঃশব্দ্যের পর, ভারতাত্মার আবার জিজ্ঞাসা— “কোথায় সেই আটলান্টিক ফরমান, যেখানে প্রতিটি জাতিকে তার নিজের সরকার গড়তে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল?” এ বার ডাউনিং স্ট্রিট এবং হোয়াইট হাউসের একত্র উত্তর— “ভারতের জন্য নয় সে ফরমান!”৫২
সুভাষ তাঁর বেতারবার্তায় মার্কিন সরকার এবং মার্কিন দেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা পার্থক্য করার চেষ্টা করলেন। বললেন, “কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি, মার্কিন নাগরিকদের একটা বিরাট অংশের সহানুভূতি রয়েছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁদের নিজেদের সরকারকে সে কথা বোঝানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। ভারতের প্রতি আমেরিকার সরকারি নীতির কথাই যদি হয়, ব্রিটেনের থেকে এক চুলও কম সাম্রাজ্যবাদী নয় আমেরিকা।”৫৩
গাঁধীকে সমর্থন করলেও সুভাষ কিন্তু জানতেন, ১৯৪২-এর আন্দোলন ভারতের সব ধর্মসম্প্রদায় বা সব অঞ্চলের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। তিনি তাই মুসলিম লিগের “প্রগতিশীল অংশগুলির” প্রতি এবং মাজলিস-ই-আহরার, জামাইয়াত-উল-উলেমা, আজাদ মুসলিম লিগ, অকালি দল, এবং সমধিক গুরুত্ব-সহকারে, বাংলার কৃষক প্রজা পার্টির প্রতি আহ্বান জানালেন যাতে একটি বড় মাপের দেশাত্মবাদী ফ্রন্ট তৈরি সম্ভব হয়। ভারতের নিরস্ত্র বিপ্লবীদের গেরিলা যুদ্ধে কৃষকদের যে একটা বিশেষ ভূমিকা থাকার কথা, তাও মনে করিয়ে দিলেন।৫৪ ১৯৪২-এ নিশ্চয়ই তিনি ভাবছিলেন ১৯৪১-এ জার্মানি যাত্রা করে ভুল করেছিলেন কি না, তবে এও ঠিক, জেলে বন্দি অবস্থায় যুদ্ধের এই সোনার সুযোগ নষ্ট করতে তিনি একেবারেই রাজি ছিলেন না। তা ছাড়া, ভারতীয় মুক্তির সন্ধান যে একটা আন্তর্জাতিক সংগ্রাম হতে চলেছে, তা নিয়েও তো তাঁর সন্দেহ ছিল না। “বিশ্বময় সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কোনও একটি পতাকার তলায় নিয়ে আসার” প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে ১৯৪২-এর জুনে ব্যাঙ্ককে এক সভায় বার্তা পাঠালেন তিনি।
দূর দেশের সহযোদ্ধাদের পাশে থাকার একটিই পথ ছিল তাঁর: বেতার। ১৯৪১ সালের অক্টোবর থেকে আজাদ হিন্দ রেডিয়ো বেতার-বার্তা পাঠাতে শুরু করেছে। আর, ১৯৪২-এর ফেব্রুয়ারি থেকে প্রধানত সুভাষের নিজের গলায়ই ধ্বনিত হতে শুরু করেছে মুক্ত ভারতের আহ্বান। প্রতি দিন, ২৩০ মিনিটের বেতার বার্তা, ইংরেজি এবং সাতটি দক্ষিণ এশীয় ভাষায় প্রচারিত হচ্ছে: হিন্দুস্তানি (হিন্দি ও উর্দুর মিশ্র ভাষা), বাংলা, তামিল, তেলুগু, গুজরাতি, ফার্সি এবং পশতু। নেদারল্যান্ডস-এর হুইজেন থেকে শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ভারতে ভেসে আসছে সেই সব বার্তা, যে দেশে তখন আনুমানিক ১,২০,০০০ রেডিয়ো সেট-এর অস্তিত্ব, এবং তাতে আজাদ হিন্দ্-এর বার্তা শোনা একটি অতি জনপ্রিয় গোপন অভ্যেসে পরিণত। স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স-এর সফরের সময়ে চালু হল আর একটি দ্বিতীয় ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, নাম, ন্যাশনাল কংগ্রেস রেডিয়ো। এর উদ্দেশ্য: দেশের বাইরের ও ভিতরের ঘটনাবলিকে এক সূত্রে বাঁধার প্রয়াস। ভারত ছাড়ো আন্দোলন পুরোদমে শুরু হতে বায়ুতরঙ্গে ভেসে এল তৃতীয় সার্ভিসটি— আজাদ মুসলিম রেডিয়ো— লক্ষ্য: ভারতের মুসলিমদের স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিতে অনুরোধ জানানো। উর্দুভাষায় দক্ষ সংলাপকার ও বক্তা হাবিবুর রহমান ও এ এম সুলতানকে এই চ্যানেলের বার্তা পরিচালনার ভার দেওয়া হল।
‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ গড়ার লক্ষ্যে সৈন্যদের নিয়োগ করার সময়েও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নিয়ে সুভাষের এই প্রয়াসের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। এশিয়ায় চলে আসতে চাইলেও ইউরোপের যুদ্ধবন্দি ক্যাম্প থেকে ভারতীয় সেনাদের ব্রিটিশ-ভক্তি থেকে সরিয়ে আনার ব্যাপারে ঢিলা দিতে রাজি ছিলেন না তিনি। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরের সামান্য সূচনা থেকে শুরু করে এই বাহিনীর বহর ১৯৪২-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ছাড়িয়ে গিয়েছে চার ব্যাটেলিয়ন। অ্যানাবার্গের পি-ও-ডবলিউ ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতের সময়েই দেখলেন, বন্দিদের মধ্যে যে সব অফিসার দায়িত্বপ্রাপ্ত নন, তাঁরা নিয়োগ-পদ্ধতিতে বাধা সৃষ্টি করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। যে সব সৈন্য এখনও মন ঠিক করে উঠতে পারেননি, তাঁদের তুলনায় দৃঢ়চিত্ত সৈন্যরাই সুভাষের কাছে বেশি বাঞ্ছিত; আর, ব্রিটিশ সম্রাটের নামে এক দিন আনুগত্যের শপথ নেওয়া সৈন্যদের টেনে এনে তাদের মনপ্রাণ জিতে নেওয়ার ব্যাপারে সুভাষের সম্পূর্ণ ভরসা তাঁর নিজের বোঝানোর ক্ষমতার উপরই। এন জি গানপুলের বর্ণনায়, “সৈন্যদের সামনে যখন দাঁড়ান তিনি, কোনও সামরিক নেতা তো নয়, লম্বা কালো পোশাকে বরং তাঁকে দেখায় যেন মন্ত্র-উচ্চারণকারী বিশপের মতো।”৫৫ গিরিজা মুখার্জিও ড্রেসডেন-এর কাছে একটি সমাবেশের বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে ১৯৪২ সালের শরতের এক বিকেলে, আদতে-কৃষক বেশ কিছু ভারতীয় সৈন্য সুভাষের কথা শুনতে ভিড় জমালেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে হিন্দুস্তানিতে তাঁদের উদ্দেশে বক্তৃতা করলেন সুভাষ:
একটি বিরাট গাছের ছায়ায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সুভাষ তাঁদের লক্ষ্য করে কথা শুরু করলেন। কথা বললেন হিন্দুস্তানিতে। আমরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আস্তে আস্তে যে-ই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছেন তিনি, আমি দেখছি সকল শ্রোতা কী ভাবে তাঁর কথার টানে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, কী ভাবে তাঁর মুখ-নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। যখন শেষ হল, প্রায় চারশো মানুষের ভিড় যেন নতুন প্রাণ পেয়ে উঠল, নতুন একটা উদ্দীপনা, নতুন উত্তেজনা তাদের মধ্যে, অথচ তারা নিছক কৌতূহলের বশেই এসেছিল সে দিনের সভায়। প্রচুর সংখ্যক জাঠ, শিখ, পাঠান সেখানে— তাদের অনেকেই সীমান্তযুদ্ধের অভিজ্ঞ যোদ্ধা, সকলে ভিড় করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে, তাদের নাম লিখে নিতে বলছে।
গিরিজা মুখার্জির মতে, “সামরিক শৃঙ্খলার জার্মান ধরনটা সুভাষের পছন্দ ছিল, যদিও কোনও কালে তিনি অন্তর থেকে সামরিক ভাবাপন্ন ছিলেন না।”৫৬ এন জি স্বামী এবং আবিদ হাসানকে এই সেনাবাহিনীর নিয়োগ-সংক্রান্ত কাজগুলির দায়িত্ব দিলেন তিনি। যখন এম আর ব্যাসও এঁদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইলেন, সুভাষ মজা করে তাঁর অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন, বললেন, “মহাত্মাজির কাছে এমনিতেই আমার অনেক হিসেব দেওয়ার আছে, তার উপর এক জন গুজরাতিকে হিংসাব্রতে দীক্ষিত করে ফেললে কী কৈফিয়ত দেব তাঁকে?”৫৭
একেবারে অন্তর থেকে সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলতেন সুভাষ। কিন্তু এও চাইতেন যাতে সব ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ সকলেই যেন একটা কোনও মিলনের জায়গা খুঁজে পান। ব্যাস স্মরণ করেন, গাড়িতে অ্যানাবার্গে যেতে যেতে সুভাষ এ এম সুলতানের কাছে “এটা-ওটা নানা হিন্দুস্তানি শব্দ, শব্দবন্ধ” জানতে চাইতেন। আবিদ হাসান যে হিন্দু মুসলিম শিখ সৈন্যদের আলাদা আলাদা খাওয়ার জায়গা না করে সকলকে একসঙ্গে খেতে বসতে বলেন, সেটা তাঁর পছন্দ হয়েছিল। আস্তে আস্তে মুসলিম ও শিখরা তাঁদের হালাল বা ঝটকা নামে আলাদা রকম মাংস পরিবেশনের দাবি ছেড়ে দেন। অত্যুত্সাহী হাসান এমনকী একটি প্রার্থনাও বানিয়ে ফেলেন, যাতে হিন্দুদের ঈশ্বরও নেই, মুসলিমদের আল্লাহ্-ও নেই, আছেন কেবল দুনিয়া-কি-মালিক। সুভাষ অবশ্য তাঁকে এই পরিকল্পনা বাদ দিতে বলেন। তাঁর যুক্তি, ঐক্যের লক্ষ্যে যদি ধর্মের আশ্রয় নেওয়া হয়, তবে একই ভাবে বিচ্ছিন্নতার জন্যও ধর্মের ব্যবহার হওয়ার পথ খুলে যায়।৫৮
ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আলাদা করার চেষ্টাও ছিল পাশাপাশিই। ইতালির বাসিন্দা আর এক ভারতীয় রাজনৈতিক কর্মী ইকবাল শেদাই সে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। শেদাই-র “রেডিয়ো হিমালয়” ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বদলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ-এ পক্ষাবলম্বী। ১৯৪২-এর এপ্রিলে ইতালীয়রা তাঁকে সেন্ত্রো মিলিতারে ইন্ডিয়া গঠনের অনুমতি দিল, বিভিন্ন ক্যাম্পের যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে ৩৫০ সৈন্যের একটি ছোট বাহিনী তৈরির অনুমোদনও দিল। সুভাষকে অনেক ভাবে বিরক্ত করতেন এই শেদাই। নাত্সি জার্মানিতে বসে সুভাষ কমিউনিস্টদের নিয়ে দল পাকাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলতেন। সুভাষ অবশ্য নিশ্চিত ছিলেন— শেদাই-র লক্ষ্য সিদ্ধি হবে না। ঠিকই বুঝেছিলেন তিনি। ১৯৪২-এর নভেম্বরে এক সিপাহি বিদ্রোহের ফলে সেন্ত্রো মিলিতারে ইন্ডিয়া ভেঙে দিতে হল।৫৯
সুভাষের ইন্ডিয়ান লিজিয়ন তখন জার্মানির তত্ত্বাবধানে আকারে-প্রকারে সমানেই বেড়ে চলেছে। প্রথমে তিনি জোর দিচ্ছিলেন যে কেবল ভারতে, অথবা ভারতের কাছাকাছি, ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধেই এদের কাজে লাগানো হবে। এল আলামিন-এর যুদ্ধের প্রাক্কালে মত পরিবর্তন করলেন তিনি, বললেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দখল থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার মুক্তির অভিযানেও অংশ নিতে এদের পাঠানো যেতে পারে। রমেল কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সামরিক ক্ষেত্রকে এক করতে রাজি ছিলেন না, তিনি এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। সুভাষের জেদ, ভারতীয়রা ইস্টার্ন ফ্রন্টে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কখনওই যুদ্ধ করবে না। ইউরোপে যত দিন তিনি ছিলেন, ইন্ডিয়ান লিজিয়ন-এর প্রশিক্ষণই চলল কেবল, কোনও সামরিক অভিযানে তারা অংশ নিল না। সুভাষের প্রস্থানের পর নাম্বিয়ারও পূর্ব দিকে তাঁর বাহিনী না পাঠানোর চেষ্টায় সফল হতে পেরেছিলেন। পরবর্তী কালে ১৯৪৩-এর শেষে এবং ১৯৪৪-এ, ফরাসি উপকূলে এই বাহিনী মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে যায়।৬০
কোথায় কী ভাবে যাত্রা করবেন— পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় সুভাষ। নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠন বিষয়ে ভাবনাচিন্তার মধ্যে। ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার-এ দ্বিভাষিক মাসিক পত্রিকা আজাদ হিন্দ্-এ ১৯৪২-এর অগস্টে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, “ফ্রি ইন্ডিয়া অ্যান্ড হার প্রবলেমস” নামে। তাতে লিখলেন, “ভবিষ্যৎ ভারতীয় রাষ্ট্র নিয়ে এখনই কোনও দৃঢ় মতামত তৈরি করে ফেলা নির্বুদ্ধিতা” হবে। এও বললেন, প্রথমে দরকার “একটি সবল কেন্দ্রীয় সরকার” এবং “একটি সুসংগঠিত শৃঙ্খলাবদ্ধ সর্বভারতীয় পার্টি।” রাষ্ট্র “ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাধ্য” থাকবে। “এই নতুন ব্যবস্থা স্থিতিশীল হলে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে শুরু করলে”, বললেন তিনি, “আস্তে আস্তে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে, প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে অধিক পরিমাণ দায়িত্ব দেওয়া হবে।”৬১ সুভাষের নিজের বক্তৃতা ও প্রবন্ধ ছাড়াও পণ্ডিত কে এ ভট্ট-র সম্পাদিত আজাদ হিন্দ্-এ প্রকাশিত হত ভবিষ্যৎ ভারত বিষয়ে নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক লেখা। লিখতেন সুভাষের চারপাশে জড়ো হওয়া এক রাশ উজ্জ্বল তরুণ। তাঁদের অধিকাংশেরই মতামত বাম-ঘেঁষা, সমাজতন্ত্রী, যদিও সকলেই সেই সময়ে বার্লিনে। সুযোগ হলে, যেমন ১৯৪২-এর ১১ সেপ্টেম্বর হামবুর্গে ইন্দো-জার্মান সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সময়ে— দুই দেশের কাব্য ও দর্শনের সংযোগ বিষয়ে বক্তৃতা করলেন সুভাষ। জার্মান অর্কেস্ট্রায় রবীন্দ্রনাথের গান ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেজে উঠল সেই দিন— প্রথম বার এই ভাবে ব্যবহৃত হল গানটি। গ্যোয়টে, শোপেনহাওয়ার, ফ্রিডরিশ রুকার্ট, এ ডবলিউ শ্লেগেল, ম্যাক্সমুলার, পল ডয়েসেন: এই সব অতীত গৌরব স্মরণের মাধ্যমে হয়তো সমসাময়িক নাত্সি জার্মানির শ্বাসরোধী পরিস্থিতি থেকে পালানোর আশ্রয় খুঁজতেন সুভাষ।৬২
কাব্য ও দর্শনের বাইরেও আর একটি ঘটনা সে দিন তাঁকে ইউরোপীয় অভিযাত্রার ক্লেশ ক্লান্তি সব ভুলিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেত: এমিলির সঙ্গে তাঁর গভীর আবেগের সম্পর্ক। বার্লিনে ১৯৪১-এর এপ্রিল থেকে ১৯৪২-এর জুলাই পর্যন্ত সর্বক্ষণ তিনি সুভাষের পাশে। রোমে বেড়াতে গিয়ে এমিলি নিজের পছন্দের চার্চগুলি দেখাতে নিয়ে গেলেন সুভাষকে, আর বাডগাস্টাইন তো তখনও সেই ১৯৩০-এর দশকের পুরনো দিনগুলির মতোই নিরবচ্ছিন্ন শান্তির আশ্রয়। ইউরোপে যুদ্ধের সময় সুভাষের কিছু অভ্যাস পাল্টে যায় ঠিকই, তবে সব মিলিয়ে তিনি এখনও সেই একই রকম, জীবনের পরম লক্ষ্যের প্রতি একই রকম ঐকান্তিক। আগের কিছু মানসিক বাধা কাটিয়ে উঠেছেন। প্রথম অ্যালকোহল পান করেছেন ভারত থেকে পালিয়ে আসার পর মস্কোয়— ভডকা। এমিলির কাছে স্বীকার করেছেন, “গলাটা যেন জ্বলে গেল।”৬৩ ইউরোপে গিয়ে ওয়াইনও পছন্দ করতে শুরু করলেন, প্রধানত রেড ওয়াইন। গোমাংসও আর এই একনিষ্ঠ হিন্দুর পরিত্যাজ্য নয় এখন। স্নায়ু স্থির করতে এমনকী সিগারেটও খান। সোফিয়েনস্ট্রাস-এর বাড়িতে তিনি ও এমিলি লম্বা সময় জুড়ে একসঙ্গে থাকার সময়েই অন্তঃসত্ত্বা হলেন এমিলি। ১৯৪২-এর জুলাই-এ এমিলি যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, বার্লিন ছেড়ে ভিয়েনায় মা ও বোনের কাছে থাকতে চলে গেলেন তিনি। সুভাষেরও তখন এমনিতেই দেশ ছেড়ে এশিয়ার দিকে যাত্রা করার সময় এসে গিয়েছে, ব্যবস্থাপত্র শেষ হলেই বেরিয়ে পড়বেন তিনি। এমিলি চাইলেন নিজের শহরে তাঁদের সন্তানের জন্ম হোক। আর সুভাষ বেরিয়ে পড়লেন তাঁর পরাধীন দেশকে শত্রুর দখল থেকে মুক্ত করার পরম লক্ষ্য নিয়ে।৬৪
জার্মান আর জাপানিরা এশিয়ার সাবমেরিনের ব্যবস্থাপনা করতে এত দেরি করছে দেখে সুভাষ আবার ইতালীয়দের সহায়তায় বিমানে করে যাওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে শুরু করলেন। রোডস্ থেকে রেঙ্গুন একটি ইতালীয় নন-স্টপ ফ্লাইট সফল হয়েছে জেনে উত্সাহিত হলেন তিনি। এক দিন ১৯৪২-এর অক্টোবরে কনিগ্সব্রুক-এ ইন্ডিয়ান লিজিয়ন পরিদর্শন করছেন সুভাষ, এমন সময় আলেকজান্ডার ওয়ের্থ সুসংবাদ নিয়ে হাজির, রোম থেকে তাঁর ফ্লাইটের সব ব্যবস্থা প্রস্তুত। সুভাষ তাড়াতাড়ি বার্লিনে ফিরলেন বিদায়পর্ব সারতে। ইউক্রেন-এর ফিল্ড হেডকোয়ার্টারে উড়ে গেলেন রিবেনট্রপের সঙ্গে দেখা করতে, ইউরোপে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টারের দায়িত্বে যাঁকে রেখে যাচ্ছেন, সেই নাম্বিয়ারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে অসতর্ক ইতালীয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে খবরটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অক্টোবরের সেই ফ্লাইট শেষে বাতিল করতে হল। ভীষণই হতাশ সুভাষ। ক্রুদ্ধ অতিথিকে শান্ত করতে তড়িঘড়ি তাঁকে আর নাম্বিয়ারকে ১৯৪২-এর অক্টোবরে চেকোস্লোভাকিয়ায় বেড়াতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে দিল জার্মান বিদেশ দফতর। কেপলার ও ট্রট-এর সঙ্গে দুই ভারতসন্তান গেলেন ব্রাতিস্লাভায় স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভজতেক তুকার সঙ্গে দেখা করতে। প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য মন্ত্রীরা তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুভাষ তাঁর বন্ধু প্রফেসর ভি লেসনির বিষয়েও কথা বললেন। ভিয়েনা হয়ে বার্লিনে ফিরে এলেন, ভিয়েনায় এমিলির সঙ্গে দেখা হল।৬৫ ফোনে সর্বক্ষণই যোগাযোগ ছিল তাঁদের, তবে এ বার সুভাষকে আলাদা করে জার্মান বিদেশ দফতরের সাহায্য নিতে হল যাতে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে পারেন।৬৬
অবশেষে ১৯৪২-এর ৬ নভেম্বর সেই এশিয়াগামী বিমান ধরতে রোমে চললেন সুভাষ। কিন্তু আবারও তিক্ত হতাশা। বিমানযাত্রার পথ বিষয়ে ইতালি আর জাপানের মধ্যে মতৈক্য হল না। প্রথম পক্ষ এত দিন সোভিয়েত আকাশপথ ব্যবহার করে এসেছে, কিন্তু জাপানিরা এ যাত্রায় সেই পথ ধরতে চায় না, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তো তাদের কোনও সংঘর্ষ নেই। আবার জাপানের প্রস্তাব অনুসারে দক্ষিণের আকাশপথ ব্যবহারে ইতালির অনিচ্ছা, তাদের মতে বড় বেশি ঝুঁকি সে পথে। রোমে সপ্তাহখানেক জিরিয়ে বিষণ্ণ মন-মরা সুভাষ ফিরে এলেন বার্লিনে।৬৭
ইউরোপ থেকে তাঁর বেরোনোর একটির পর একটি সুযোগ যে এই ভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, তার পিছনে হয়তো নিয়তিরই কারসাজি। রোম থেকে যদি ফ্লাইটটা সত্যিই সে দিন ধরতে পারতেন, ব্যক্তিগত জীবনের এক বিরাট সুখের মুহূর্ত তাঁর যাপন করা হত না। ১৯৪২ সালের ২৯ নভেম্বর সুভাষ ও এমিলির কন্যা অনিতার জন্ম হল ভিয়েনায়। নাম্বিয়ারের বর্ণনা অনুসারে, খবরটা পেয়ে কিন্তু নারী-অধিকারের বিরাট সমর্থক সুভাষ যেন একটু বিমর্ষ হয়ে পড়লেন— পুত্রসন্তান লাভের সৌভাগ্য হল না বলে। অবশ্য ডিসেম্বরে যখন অনিতাকে দেখলেন, সাময়িক সেই বিমর্ষতা কেটে গিয়ে গর্বে, আনন্দে ভরে উঠলেন তিনি। সুভাষ, এমিলি আর অনিতা ভিয়েনায় চুপচাপ কাটালেন সে বারের ক্রিসমাস।৬৮
বিপ্লবীর জীবনে সাংসারিক সুখ মুহূর্তের সুখ বই কিছু নয়। এমিলি ফিরে গেলেন কাজে, সুভাষের বই দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্ল-এর নতুন সংস্করণটির জার্মান ভাষায় অনুবাদের মধ্যে।৬৯ নভেম্বরের মাঝামাঝি রোম থেকে ফিরে ইতিমধ্যেই রিবেনট্রপ ও জার্মান রাষ্ট্রদূত হিরোশি ওশিমার সঙ্গে এশিয়া-যাত্রার বিকল্প পথ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন সুভাষ। মিলিটারি সহকারী কর্নেল ইয়ামামোতো বিন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা সারতে বিমানে তুরস্ক ও সোভিয়েত অঞ্চলের উপর দিয়ে জাপানের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানি কূটনীতিকের জন্য নিজের আকাশপথ ব্যবহার করতে দেওয়ার যে অনুগ্রহ দেখাল, ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবীর জন্য সেই একই অনুগ্রহ দেখাতে তারা রাজি হল না।৭০ “ভারতের আর একটু কাছে কোথাও থাকলে, আমার দেশের জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারতাম,” ১৯৪২-এর ৫ ডিসেম্বর, কন্যার জন্মের ঠিক এক সপ্তাহ পরে রিবেনট্রপকে লিখলেন সুভাষ। অনুরোধ চলতেই লাগল, “ব্যবহারিক ভাবে জার্মান সরকারের পক্ষে আমাকে দূরপ্রাচ্যে যেতে সাহায্য করাটা নিশ্চয়ই সম্ভব— হয় বিমানে, নয় সাবমেরিনে, নয় জাহাজে। কিছুটা ঝুঁকি তাতে আছে ঠিকই, কিন্তু সে তো সব ব্যাপারেই থাকে। আমি আসলে নিজের ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখি, বিশ্বাস করি যে আমার প্রয়াসে আমি সফল হবই।”৭১
১৯৪৩ সালের জানুয়ারির মধ্যভাগে সাবমেরিনে সুভাষের এশিয়া যাত্রার ব্যবস্থা শেষ হল। ২০ জানুয়ারি এমিলি কয়েক দিন একসঙ্গে কাটাতে চলে এলেন বার্লিনে। সোফিয়েনস্ট্রাসের বাড়িতে ২৩ জানুয়ারি সুভাষের ছেচল্লিশতম জন্মদিন পালন হল, ছোট পার্টি হল একটা। অনেক কাজ এখনও বাকি। সুভাষের যাত্রা চলাকালীন তাঁর যে সব বক্তৃতা বেতারে প্রচারিত হবে, সেগুলি রেকর্ড করা হল। একটি বক্তৃতায় বিবিসি-কে “ব্লাফ অ্যান্ড ব্লাস্টার কর্পোরেশন” বলে পরিহাস করা হল, যদিও বিশেষ সুবিধের দাঁড়াল না সেটা, আগের একটি বক্তৃতা থেকে বিরাট একটি অনুচ্ছেদ সেখানে পুনর্ব্যবহৃত হতে দেখা গেল। বেতারে প্রচারের সময় দেখা গেল আরও একটা অপ্রত্যাশিত সমস্যা এসে হাজির: যে সময়ে সুভাষ রওনা হলেন, ঠিক তখনই অনশন শুরু করলেন গাঁধী, অথচ সুভাষের বক্তৃতায় তার কোনও উল্লেখও রাখা গেল না। ১৩ এপ্রিল অমৃতসর হত্যাকাণ্ডের দিনটি মনে করে যে বক্তৃতা তৈরি হল, তাতে অবশ্য সাম্প্রতিক সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির উল্লেখের বিশেষ প্রয়োজন ছিল না।৭২
১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বার্লিনে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের একটি বড় অনুষ্ঠানে শেষ বারের মতো ইউরোপে জনসমক্ষে এসে দাঁড়ালেন সুভাষ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ হল। আজাদ হিন্দ-এর বর্ণনায়, “অত্যন্ত বর্ণময় ও গুরুত্বপূর্ণ” এই সভাটিতে সে দিন উপস্থিত ছিলেন প্রায় ছ’শো অতিথি, তার মধ্যে ছিলেন জেরুজালেম-এর গ্র্যান্ড মুফতি এবং ইরাকের রশিদ আলি এল-গিলানিও। লাল টিউলিপ, সাদা লাইল্যাকে সাজানো সভাস্থলে নেতাজি প্রবেশ করলেন, পরনে কালো শেরওয়ানি, বক্তৃতা দিলেন জার্মানে। বক্তৃতার ইংরেজি অনুবাদ একই সময়ে প্রচারিত হল ভারতে। বিরাট বক্তৃতাটিতে ধরা রইল তাঁর দার্শনিক চিন্তার প্রতিসরণও:
জীবন আমাদের কাছে এক দীর্ঘ অনন্ত তরঙ্গ। সৃষ্টির অসীম বৈচিত্র্যের মধ্যে ঈশ্বরের নিজেরই প্রকাশ। সবই তাঁর লীলা— বিশ্বের নানা শক্তির অনন্ত খেলা। বিশ্বজগতের এই শক্তিলীলার মধ্যে কেবল সূর্যালোকই নেই, অন্ধকারও আছে। কেবল আনন্দই নেই, দুঃখও আছে। কেবল উত্থানই নেই, পতনও আছে। আমরা যদি নিজেদের প্রতি আস্থা না হারাই, নিজেদের ঈশ্বরে আস্থা না হারাই— তবে অন্ধকার, দুঃখ এবং অধঃপতনের মধ্য দিয়েই আমরা এগিয়ে চলব নতুন সূর্যালোক, নতুন আনন্দ, নতুন প্রগতির দিকে।৭৩
সুভাষচন্দ্র বসু এখন প্রস্তুত, তাঁর নিজের ও নিজের দেশের চরম নিয়তির দিকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে এ বার এগোতে চলেছেন তিনি।
সাত বছর আগে ১৯৩৬ সালের মার্চে এমিলিকে ছেড়ে সুভাষ ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর “প্রথম প্রেম”— তাঁর “দেশ”-এর কাছে। আরও এক বার ঘনিয়ে এসেছে বিদায়প্রহর। তবে এখন পৃথিবীর পরিস্থিতি আরও সংঘাতসঙ্কুল, আরও অনেক জটিল। ১৯৪৩-এর ৮ ফেব্রুয়ারি ইউরোপ থেকে এশিয়ায় বিপজ্জনক পাড়ি আরম্ভের ঠিক আগে মেজদাদা শরত্কে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখলেন সুভাষ, বাংলায়। এমিলির হাতে দিয়ে গেলেন সেই চিঠি:
আজ পুনরায় আমি বিপদের পথে রওনা হইতেছি। এ বার কিন্তু ঘরের দিকে। হয়তো পথের শেষ আর দেখিব না। যদি তেমন বিপদ পথের মাঝে উপস্থিত হয়, তাহা হইলে ইহজীবনে আর কোনও সংবাদ দিতে পারিব না। তাই আমি আজ আমার সংবাদ এখানে রাখিয়া যাইতেছি— যথাসময়ে এ সংবাদ তোমার কাছে পৌঁছিবে। আমি এখানে বিবাহ করিয়াছি এবং আমার একটি কন্যা হইয়াছে। আমার অবর্তমানে আমার সহধর্মিণী ও কন্যার প্রতি একটু স্নেহ দেখাইবে— যেমন সারাজীবন আমার প্রতি করিয়াছ।৭৪
বার্লিনের সোফিয়েনস্ট্রাসে আরও ক’টা দিন থেকে গেলেন এমিলি, যাতে কারও মনে কোনও সন্দেহ না জাগে। তার পর ফিরে গেলেন ভিয়েনায়, অনিতার কাছে।
ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন বিষয়ে সর্বদা-সচেতন সুভাষ ভেবেছিলেন, তাঁর এশিয়া যাত্রায় সঙ্গে নেবেন এক জন হিন্দু, এক জন মুসলিম এবং এক জন শিখ সঙ্গীকে। জার্মান নৌ অফিসাররা যখন তাঁকে জানালেন যে মাত্র এক জন সঙ্গীই নেওয়া যাবে, আবিদ হাসানকে বেছে নিলেন তিনি। এন জি স্বামী এবং আরও চার সঙ্গী যাঁরা অয়্যারলেস টেলিগ্রাফি, গোপন যোগাযোগরক্ষা, উন্নত মানের রেডিয়ো ট্রান্সমিশন ইত্যাদিতে উচ্চমানের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা সব আসবেন পিছনের ব্লকেড-রানার-এ, মার্চ মাসে।৭৫ বেশি কিছু জানানো হল না হাসানকে, কেবল বলা হল দীর্ঘ যাত্রা সামনে, ব্যাগ গুছিয়ে নিতে। যাত্রার গন্তব্য বিষয়ে কিছুই জানলেন না তিনি। তাঁর ভয় হল, হজ-এর সময়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নতুন লড়াকুদের খুঁজে বার করার যে পরিকল্পনা আগেই নেওয়া হয়েছিল, তার জন্য বোধহয় তাঁকে মক্কা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লেহ্র্টার ট্রেন স্টেশনে নেতাজিকে দেখে শেষে বুঝলেন, তিনি তাঁর নেতার সঙ্গী হতে চলেছেন। বার্লিন থেকে কিয়েলের দিকে ট্রেন ছুটছে, এমন সময়ে সুভাষ হাসানকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কি তুমি জানো তুমি কোথায় চলেছ?” “ইয়েস স্যার”, হাসানের উত্তর, “আমরা কোথায় চলেছি, জানি।” “কোথায়?” জানতে চাইলেন সুভাষ। “আমরা দুই জনই হজ করতে যাচ্ছি,” ঈষৎ বিরক্ত গলায় বললেন সঙ্গীটি। শুনে হাসিতে ফেটে পড়লেন তাঁর নেতা।৭৬
উত্তর জার্মানির বন্দর শহর কিয়েল-এ পৌঁছলেন সুভাষ এবং হাসান, ১৯৪৩-এর ৮ ফেব্রুয়ারি। ৯ তারিখ ভোর হওয়ারও আগে জার্মান সাবমেরিন ইউ-১৮০-র ক্যাপটেন ওয়ের্নের মুজেনবার্গ তাঁদের স্বাগত জানালেন ডুবোজাহাজে। দুই ভারতীয় ডুবোজাহাজে পা রাখতে না রাখতেই ছেড়ে দিল সেটি। ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার বেইলি এবং টিম হার্পার ১৯৪৩ সালের যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিষয়ে মন্তব্য করেন, “এক দিক দিয়ে ব্রিটিশের তখন ভীত বোধ করার বিশেষ কারণ ছিল। তাদের সবচেয়ে দৃঢ়চেতা, উদ্ভাবন-ক্ষমতায় সবচেয়ে দক্ষ ভারতীয় বিরোধী নেতাটি সেই সময় এগিয়ে চলেছেন।”৭৭ ইতিমধ্যে ১৯৪২-এর ৪ নভেম্বর এল আলামিন-এর যুদ্ধে রমেলকে প্রতিহত করা গিয়েছে, সুভাষ রওনা হওয়ার মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ২ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েতরা জার্মানদের স্তালিনগ্রাদে পরাজিত করেছে, তবুও ব্রিটিশরা সন্ত্রস্ত সে দিন। সুভাষের সাবমেরিন যাত্রার ঐতিহাসিক তাত্পর্য বোঝা যায় আর একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৪৩-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের মাটিতে মহাত্মা গাঁধী অনশন শুরু করলেন, তিন সপ্তাহ ধরে প্রবল উদ্বেগে দীর্ণ হয়ে রইল গোটা ভারত।
ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিল, গাঁধী যদি অনশনই করেন, তবে তাঁকে মৃত্যু বরণ করতে দেওয়াই ভাল। এল আলামিন এবং স্তালিনগ্রাদের জয়ে উত্ফুল্ল চার্চিল স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, “পৃথিবীর সর্বত্র আমরা জয়ী এখন। আমাদের চিরশত্রু ওই জঘন্য বৃদ্ধের সামনে হাতজোড় করার সময় নয় এটা।”৭৮ গাঁধীর মৃত্যু হলে লিনলিথগোর আশা, “ছয় মাস হয়তো অশান্তি থাকবে, ক্রমে কমতে কমতে শেষে তাও আর থাকবে না।”৭৯ প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইসরয়ের সঙ্গে ভারত-বিষয়ক সেক্রেটারি অব স্টেট এল এস আমেরি, সবাই মিলে উঠে-পড়ে লাগলেন গাঁধীকে ‘প্রবঞ্চক’ প্রমাণ করতে। আশায় রইলেন, তিনি যে নির্ঘাৎ জলের সঙ্গে গ্লুকোজ মিশিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন, এমন একটা প্রমাণ হাতে পাওয়া যাবেই। এ দিকে মার্কিনিরা কিন্তু ব্রিটিশ হেফাজতে গাঁধীর মৃত্যুর সম্ভাবনায় ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তাদের সন্ধিস্থাপনের প্রস্তাব ব্রিটিশরা উড়িয়ে দিল তুড়ি মেরে। “দুনিয়ার সবচেয়ে সফল ধাপ্পাবাজ”টির কাছে মাথা না নোয়ানোর সিদ্ধান্তের জন্য চার্চিলকে ধন্যবাদ জানালেন লিনলিথগো। “ব্ল্যাকমেল আর সন্ত্রাস ব্যবহার করে চালাকি” করে গিয়েছেন উনি আজীবন।৮০
ভারত ছাড়ো আন্দোলন তত দিনে সম্পূর্ণ ধ্বস্ত। মহাত্মার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাও আর দেখানোর দরকার নেই ব্রিটিশদের। ঔপনিবেশিক প্রভুদের সঙ্গে লড়াই-এর মঞ্চে তখন সুভাষ একাই। জাপানি ও জার্মান টেলিগ্রাফিক কোড ফাঁস করে মিত্রশক্তি জানতে পেরেছে এই অপ্রতিরোধ্য বিদ্রোহীর খবর— আবারও যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু সমুদ্রের তলায় তাঁকে ঘায়েল করার জন্য যে স্তরের গোয়েন্দা-তথ্য কিংবা সামরিক পদ্ধতি দরকার ছিল, সেটা তখনও তাদের হাতে নেই। ডেনিশ জলরাশির ছোট খাঁড়ি দিয়ে ইউ-১৮০ এগিয়ে চলেছে নরওয়ে উপকূলের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের দিকে, সেখান থেকে উত্তর সাগরে। স্কটল্যান্ডের উত্তরে ও আইসল্যান্ডের দক্ষিণে প্রণালী দিয়ে সফল ভাবে বেরিয়ে গিয়েছে, এ বার আটলান্টিক মহাসাগরে দক্ষিণমুখী যাত্রা। মাঝপথে স্পেনীয় উপকূলে দাঁড়িয়ে নতুন করে তেল ভরে নেওয়াও রয়েছে। ৯-ডি ধরনের এই ইউ-নৌকো ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য রাতের দিকে ভেসে উঠত জলের উপর। জলে ভাসা অবস্থায় তার গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮ নট, আর ডুবন্ত অবস্থায় ঘণ্টায় ৭.৭ নট।৮১
“ডুবোজাহাজে চড়ার নতুন অভিজ্ঞতায় উত্তেজিত ছিলাম,” আবিদ হাসান পরে স্মরণ করেছেন। “কিন্তু ডুবোজাহাজে উঠতেই সব উত্তেজনা উধাও।” ইউ-নৌকোর ভিতরে যেন “দমবন্ধ হয়ে আসে”। বাতাসে, খাবারে, কম্বলে সর্বত্র ডিজেলের ঝাঁঝালো গন্ধ। সুভাষকে প্যাসেজের ওধারে একটি ছোট ঘরে বাঙ্ক দেওয়া হয়েছে, ওই দিকটিই অফিসারদের জায়গা। প্রথম বার যখন খাবার পাওয়া গেল, হতাশায় ভেঙে পড়লেন হাসান— খাবার মানে শক্ত, তেল-জবজবে গোরুর মাংসের টুকরো, সঙ্গে স্যাঁতসেতে রুটি। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে তিনি একটি চালের বস্তা আর খানিক ডাল জোগাড় করলেন। সৌভাগ্যক্রমে, সুভাষের এই রাজনৈতিক-সামরিক সহকারীটি রাঁধতে জানতেন, সুতরাং তাঁর নেতাকে খাওয়ার মতো সহজ কিছু ভারতীয় খাবার বানিয়ে দিতে পারলেন তিনি। মুশকিল একটাই, নিজের খাবারের ভাগ উদার ভাবে জার্মান অফিসারদের বিলি করে দেন সুভাষ— এ দিকে জাহাজে চালের পরিমাণ খুবই সীমিত।৮২
হাসান যদি ভেবে থাকতেন বাঙ্কে শুয়ে বই পড়তে পড়তে বেশ সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে, প্রথমেই বিরাট আঘাত পেতে হত তাঁকে। কারণ কিছু ক্ষণ পরেই সুভাষ তাঁকে টাইপরাইটারটি বার করে এনে কাজে বসে যেতে আদেশ দিলেন। প্রথম কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগ্ল-এর নতুন সংস্করণের জন্য সংশোধনের কাজ করতে করতে। স্পেনের কাছে ইউ-ট্যাঙ্কার তেল নিতে থামার সময় জার্মানিতে সেই পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেওয়া হল। এ বার সুভাষের কাজ, এশিয়ায় পৌঁছে যে সব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন তার জন্য সতর্ক ভাবে প্রস্তুত হওয়া। হাসানকে বললেন, তোজোর ভূমিকায় অভিনয় করে সুভাষকে খুব কঠিন প্রশ্ন করতে। জাপানিদের সঙ্গে ঠিক কোন পথে বোঝাপড়া সারবেন, সেটা ভেবে নিলেন। তার পর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসারদের কী ভাবে দলে টানবেন, তাদের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি-তে যোগ দিতে বলবেন, সেই ভাবনা শুরু করলেন। ভারতের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে বক্তৃতা দেবেন, মুখে মুখে সেগুলি বলতে শুরু করলেন, কিংবা হাতে লিখে ফেললেন, আর টাইপ করে গেলেন হাসান। ১৮৫৭-এর পর থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ইতিহাস এ ভাবে লেখা হল ডুবোজাহাজে বসে— হাসানের মতে, ইতিহাসের পাঠ্যবই হিসেবে তার মূল্য হত অসাধারণ। আই এন এ-র মহিলা বাহিনী নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা করলেন সুভাষ, বিভিন্ন অঞ্চল ও শ্রেণির নারীর মানসিকতা নিয়ে আলোচনা করলেন। মহিলাদের জন্যও ইউনিফর্ম তৈরি করতে হবে, সুভাষের মত। হাসান সংশয়ী— ভারতীয় মহিলাদের দিয়ে যুদ্ধ করানোও সম্ভব হতে পারে, কিন্তু শাড়ি এবং সালোয়ার-কামিজ ছেড়ে প্যান্ট ও বুশ শার্ট পরানো? অসম্ভব। সুভাষ কিন্তু নিশ্চিত, তিনি ভারতীয় মহিলাদের মিলিটারি ইউনিফর্ম পরতে রাজি করতে পারবেনই।৮৩
এই দীর্ঘ সাবমেরিন যাত্রায় হাসান তাঁর নেতার গুণাগুণ বিষয়ে বেশ কিছু নতুন ধারণা লাভ করলেন। তাঁরা যখন জাহাজের ব্রিজ অংশে, সুভাষ যখন মুখে মুখে বক্তৃতা বলে যেতে পারছেন না, সেই সব সময়ে নেতাজিকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন হাসান। জানতে চাইতেন, কোনটাকে তিনি তাঁর চরম দুর্ভাগ্য বলে মনে করেন। এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে সুভাষের উত্তর, “নির্বাসনে থাকা”। ভয়ানক বিপদের মুখেও তাঁর নেতার সাহস ও স্থৈর্য দেখে মুগ্ধ হাসান। ইউ-১৮০-র উপর কঠোর নির্দেশ, জাহাজে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও শত্রু-জাহাজ দেখলেই আক্রমণ করতেই হবে। ১৮ এপ্রিল পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে দক্ষিণ আটলান্টিকে সাবমেরিন থেকে দেখতে পাওয়া গেল ব্রিটিশ বাণিজ্যজাহাজ এস এস করবিস-কে। ইউ-১৮০ টর্পেডো আক্রমণ শুরু করল, জাহাজটি দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে ডুবে গেল। হাসান খেয়াল করলেন, ভারতীয় ও মালয় নাবিকদের তোলা হল পলকা ডিঙিতে, আর একটিমাত্র লাইফবোট ভর্তি হল ইউরোপীয় নাবিকদের দিয়ে। বর্ণবিভেদ যেন বিষুবরেখারই মতো, সর্বত্র বিরাজমান। কয়েক দিন পর, আর একটি মালবাহী জাহাজ নজরে এল, কিন্তু এ বার ইউ-১৮০ ভুল করে ফেলল একটা: নিজেই জলের উপর ভেসে উঠল। ব্রিটিশ জাহাজ সাবমেরিনটিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করতেই ক্যাপটেন আবার ডুবে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এই সব সংকটের মধ্যেই হাসান শুনতে পেলেন সুভাষের গলা: “হাসান, ওই অংশটা আমি দুই বার তোমাকে বলেছি, কিন্তু এখনও তোমার লেখার সময় হল না!” শত্রুর হাত থেকে কোনও ক্রমে বেঁচে সমুদ্রতলে ডুবে ডুবোজাহাজ ধাতস্থ হতে না হতেই ক্যাপটেন মুজেনবার্গ সব নাবিকদের নির্দেশ দিলেন, ভারতীয় নেতা ও তাঁর সেক্রেটারির অবিচলিত স্থৈর্য দেখে শিখতে বিপদের সময় কী ভাবে চলতে হয়।৮৪
আটলান্টিক অভিযান শেষ করে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতীয় মহাসাগরে প্রবেশ করল সাবমেরিন। ইতিমধ্যে ১৯৪৩-এর ২০ এপ্রিল জাপানি সাবমেরিন আই-২৯ ফ্লোটিলা কম্যান্ডার ক্যাপটেন মাসাও তেরাওকাকে নিয়ে পেনাং ছেড়ে ভাসতে শুরু করেছে। সেই জাহাজের নাবিকরা জাহাজের রসদ হিসেবে ভারতীয় খাবারের মালমশলাও কিনছেন দেখে স্থানীয় ভারতীয়রা তো অবাক। ২৬ এপ্রিল জার্মান ও জাপানি ডুবোজাহাজ দুটি পরস্পরকে দেখতে পেল যেখানে, তার অবস্থান মোটামুটি ভাবে— ২৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ ও ৬০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ, ভারতীয় মহাসাগরে ম্যাডাগাস্কার উপকূল থেকে চারশো নটিক্যাল মাইল দূরত্বে। পূর্বনির্ধারিত মিলনস্থানে ভেসে উঠতে নাবিকরা আবিষ্কার করলেন সমুদ্র সেখানে উত্তাল, যাত্রী স্থানান্তর প্রায় অসম্ভব। সুতরাং দুই সাবমেরিন পাশাপাশি চলতে থাকল— কে জানে কতক্ষণ, তেরাওকার মনে হল যেন অনন্ত কাল। ২৭ এপ্রিলের বিকেলের দিকে এক জন জার্মান অফিসার ও সিগন্যালম্যান সাঁতরে চলে গেলেন জাপানি ডুবোজাহাজটিতে। ২৮ এপ্রিলের ভোরে, ঢেউ তখনও বিরাট উঁচু, যাত্রী স্থানান্তর করা হবে স্থির হল, কেননা সমুদ্রের উপরিতল দিয়ে চলা ক্রমেই আরও বেশি ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে উঠছে। দুই জার্মান একটি রাবারের ডিঙি চালিয়ে ফিরে এলেন নিজেদের সাবমেরিনে, সঙ্গে রইল একটা বিরাট মোটা দড়ি। সুভাষচন্দ্র বসু ও আবিদ হাসান ইউ-১৮০ থেকে ডিঙিতে উঠলেন, ফুঁসে-ওঠা মহাসাগরের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে চললেন আই-২৯-এর দিকে। সম্পূর্ণ সিক্ত অবস্থায় ভারতীয় নেতা ও তাঁর সহকারী জাপানি সাবমেরিনে উঠলেন। ওঠার পর খুবই উষ্ণ অভিনন্দন পেলেন তাঁরা। এই যে একটি ঘটনা সে দিন ঘটল, সামরিক দিক দিয়ে তাকে অত্যন্ত দুরূহ, বিস্ময়কর কৃতিত্ব বলতেই হবে— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোটা ইতিহাসে একমাত্র দৃষ্টান্ত যেখানে সাবমেরিন থেকে সাবমেরিনে এ ভাবে যাত্রী স্থানান্তর হল— তাও আবার সেই সমুদ্রে, যেখানে আকাশভাগেই হোক আর জলভাগেই হোক, শত্রুপক্ষই তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। এমনিতেই জার্মান ইউ-নৌকোগুলির ধ্বংসের হার ৮০ শতাংশের বেশি, এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে ঝুঁকিও ছিল বিরাট। যে জার্মান নাবিক ক্যামেরায় এই দুঃসাহসী যাত্রা ও স্থানান্তরের ছবি তুলে রাখেন, পরের অভিযানেই তিনি নিহত হন। ছবিগুলি তিনি তাঁর মায়ের কাছে রেখে যান, বলে যান, ভারত থেকে কেউ কোনওদিন এসে ছবিগুলি চাইবেন।৮৫
জায়গার স্বল্পতা, দুঃসাধ্য অভিযান: তাও জার্মান অফিসাররা ও নাবিকরা তাঁদের ভারতীয় অতিথিদের প্রতি আগাগোড়াই বন্ধুত্বপূর্ণ, সহৃদয়। তা সত্ত্বেও জাপানি সাবমেরিনে উঠে সুভাষ ও হাসানের যেন “বাড়ি ফেরার মতো আরাম” বোধ হল, হাসান পরে স্মরণ করেছেন। “ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এ রকম একটা অনুভূতি হল আমাদের। নেতাজিরও মনে হল একই কথা। অনেক কম আড়ষ্ট পরিবেশ এখানে।” জার্মান সাবমেরিনটির চেয়ে এটায় জায়গাও বেশি। ফ্লোটিলা কম্যান্ডার মাসাও তেরাওকা সুভাষের জন্য নিজের কেবিনটি ছেড়ে দিলেন। সুভাষ ও তাঁর সহকারীকে সফল ভাবে এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে নিয়ে আসার দারুণ কৃতিত্ব উদ্যাপন করতে এবং জাপানি সম্রাটের জন্মদিনে তাঁকে সম্মান জানাতে সাবমেরিনের ক্যাপটেন জুইচি ইজু ২৯ এপ্রিল একটি পার্টিরও আয়োজন করে ফেললেন। ভারতীয়দ্বয়ের মনে হল, “সত্যিই যেন এশিয়ার মাটিতে ফিরে এসেছেন।” জাপানি রাঁধুনিদের পেনাং থেকে আনা ভারতীয় মশলা দিয়ে রান্না-করা খাবার পাওয়া গেল পেনাং-এ, সেই খাবার খেয়ে বেশ তৃপ্তি হল তাঁদের। তবে দিনে চার বার খাওয়া সুভাষের পক্ষে অসম্ভব। “আমাদের কি আবার খেতে হবে, ক্যাপটেন তেরাওকা?” জাপানি আতিথেয়তায় প্লাবিত সুভাষ হাসিমুখে জানতে চাইলেন।৮৬
ভারতের দক্ষিণ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে চলল আই-২৯। ব্রিটিশ নজরদারির সীমানার বাইরে আসতেই পেনাং-এর নির্দেশ— পথ বদলে যাত্রীদের উত্তর সুমাত্রার উপকূলে একটি ছোট্ট দ্বীপ সাবাং-এ নিয়ে যাওয়া হোক। পেনাং-এ ইতিমধ্যে মুখে মুখে রটতে শুরু করেছে সুভাষের আসন্ন আবির্ভাবের খবর। তাই এই পথবদল। ১৯৪৩-এর ৬ মে নিরাপদে সাবাং-এর বন্দরে এসে ভিড়ল আই-২৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে তার যেটুকু অবদান রাখার, তা সুসম্পন্ন। জুইচি ইজু এই অভিযানের পরই অন্য পদে চলে গেলেন, আই-১১-এর ক্যাপটেন হলেন, পরের বছরের শুরুতেই প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যভাগে যেটি নিখোঁজ হয়ে যায়। আর আই-২৯-কে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪-এর জুলাইয়ে ফিলিপিনস-এর কাছে ডুবিয়ে দেয় একটি মার্কিন সাবমেরিন। সাবাং-এ নামার আগে সুভাষ জাপানি ডুবোজাহাজের সব নাবিকদের সঙ্গে মিলে একটি ছবি তোলান, ছবির উপর একটি আন্তরিক বাক্য লিখে স্বাক্ষর করে দেন: “এই ডুবোজাহাজটিতে চড়তে পেরে আমি বিশেষ আনন্দিত। আমার বিশ্বাস, বিজয় ও শান্তির লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম সফল হওয়ার পথে এই যাত্রা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”৮৭
সুভাষের বন্ধু, বার্লিনের প্রাক্তন সামরিক দূত কর্নেল ইয়ামামোতো নিজে এসে সাবাং-এর বন্দরে স্বাগত জানালেন তাঁকে। কয়েক দিন বিশ্রাম নিয়ে সুভাষকে টোকিয়োর উদ্দেশে একটি ছোট জাপানি যুদ্ধবিমানে ওঠানো হল। বিমান চলল পেনাং, সায়গন, ম্যানিলা, তাইপে এবং হামামাতসু-তে থামতে থামতে। শেষে জাপানের রাজধানীতে পৌঁছনো গেল দুপুর নাগাদ। ইম্পিরিয়াল হোটেলে সুভাষের থাকার ব্যবস্থা, মার্কিন স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট সেই হোটেলের স্থাপত্যনকশা করেছেন, ইম্পিরিয়াল প্যালেসের পরিখাটির ঠিক বিপরীত পারে হোটেলের অবস্থান। জাপানি ছদ্মনাম “মাতসুদা” ব্যবহার করে হোটেলে চেক-ইন করলেন সুভাষ। তবে জিয়াউদ্দিন, মাজোটা, মাতসুদা, এত সব হরেক নামের আড়ালে আত্মগোপনের পালা শেষ হতে চলেছে আর ক’দিনের মধ্যেই। এক মাসের মধ্যেই ভারতীয়রা আবার শুনতে পাবেন সেই পরিচিত গলা: “আমি সুভাষচন্দ্র বসু, পূর্ব এশিয়ায় আমার দেশবাসীদের উদ্দেশে কথা বলছি।”৮৮
.
১. সুভাষচন্দ্র বসু, “আফটার প্যারিস,” সুভাষচন্দ্র বসু, দি অলটারনেটিভ লিডারশিপ: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, দশম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৪), পৃ: ১১২-১১৪।
২. এ সি এন নাম্বিয়ার, “ফোরওয়ার্ড,” এন জি গণপুলে, নেতাজি ইন জার্মানি: আ লিটল-নোন চ্যাপ্টার (মুম্বই: ভারতীয় বিদ্যা ভবন, ১৯৫৯), পৃ: viii. আলোচনা দ্রষ্টব্য, এম আর ব্যাস, প্যাসেজ থ্রু আ টার্বুলেন্ট এরা: হিস্টোরিক্যাল রেমিনিসেন্সেস্ অব দ্য ফেটফুল ইয়ারস্, ১৯৩৭-৪৭ (মুম্বই: ইন্দো-ফরেন পাবলিকেশনস্, ১৯৮২), পৃ: ২৬৬-২৭২।
৩. কাবুল থেকে কুয়ারোনির চিঠি, রোমে ইতালীয় বিদেশমন্ত্রকের উদ্দেশ্যে, “প্ল্যান অব ইন্ডিয়ান রেভোলিউশন: রিপোর্ট অব অ্যান ইন্টারভিউ, কাবুল, এপ্রিল ২, ১৯৪১, সাব: সুভাষ চন্দ্র বোস— হিজ প্রোপোজালস্ অ্যাবাউট ইন্ডিয়া, ইন কন্টিনিউয়েশন অব টেলিগ্রাম নম্বর ১২৪,” সুভাষচন্দ্র বসু, আজাদ হিন্দ: রাইটিংস্ অ্যান্ড স্পিচেস্ ১৯৪১-১৯৪৩, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, একাদশ খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ১৯৯৮, ২০০২), পৃ: ৩৪-৩৭।
৪. “সিক্রেট মেমোরান্ডাম টু দ্য জার্মান গভর্নমেন্ট,” বার্লিন, ৯ এপ্রিল, ১৯৪১, তদেব, পৃ: ৩৮-৪৯।
৫. “রেকর্ড অব কনভারসেশনস্ বিটউইন রিবেনট্রপ অ্যান্ড বোস, ১৯৪১-১৯৪২” (জি এফ ও)।
৬. “সাপ্লিমেন্টারি মেমোরান্ডাম টু দ্য জার্মান গভর্নমেন্ট,” বার্লিন, ৩ মে, ১৯৪১, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ৫০-৫২।
৭. “ড্রাফট্ অব দ্য ফ্রি ইন্ডিয়া ডিক্লারেশন বাই মাজোটা,” মে ১৯৪১, এএ-এ/কাল্ট.আর., অষ্টম খণ্ড, ইংল্যান্ড (জি এফ ও), প্রতিরূপ তদেব, পৃ: ৫৭-৫৮।
৮. ও. মাজোটা, ডা. ওরমানকে লেখা চিঠি, ৫ জুলাই, ১৯৪১, তদেব, পৃ: ৫৯।
৯. “রিপোর্ট অব আ কনভারসেশন উইথ দ্য জার্মান ফরেন অফিস,” ওরমান, ১৭ জুলাই, ১৯৪১, তদেব, পৃ: ৬০-৬২।
১০. গেসলার ওয়্যার্সিং, ইন্ডিয়েন-এশিয়েনস্ গেফারলিশ জাহ্র (ডুসেলডর্ফ: ডিয়েড্রিক্স, ১৯৬৮), পৃ: ৮-৯।
১১. সুভাষচন্দ্র বসু, জোয়াকিম ফন রিবেনট্রপকে লেখা চিঠি, ১৫ অগস্ট, ১৯৪১, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ৬৩-৬৫।
১২. এ সি এন নাম্বিয়ার-এর সাক্ষাত্কার, শিশিরকুমার বসু এবং কৃষ্ণা বসু, ১৯৭১ (এন আর বি); কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৭২), পৃ: ৯৯-১০২; “স্টেটমেন্ট অব এ সি এন নাম্বিয়ার,” ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ (টি এন এ), পৃ: ৯-২০; এ সি এন নাম্বিয়ার, “আ মেমরেব্ল মিটিং ইন প্যারিস উইথ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস,” দি ওরাকল, ৪, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮২), ৬১-৬২।
১৩. “স্বামী: নোটস্ টেক্ন ইন সিঙ্গাপুর, সেপ্ট./অক্ট. ১৯৪৫, হোয়েন স্বামী কেম টু টি” (টি এন এ); আবিদ হাসানের সাক্ষাত্কার, শিশিরকুমার বসু, কৃষ্ণা বসু, সুগত বসু এবং রবীন্দ্রকুমার ঘোষ, প্রতিলিপি শর্মিলা বসু, প্রকাশিত হয়েছে, আবিদ হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” দি ওরাকল, ৬, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮৪), ২৪-২৮।
১৪. গিরিজা মুখোপাধ্যায়, দিস ইউরোপ (কলকাতা: সরস্বতী লাইব্রেরি, ১৯৫০), পৃ: ১৩১; ব্যাস, প্যাসেজ থ্রু আ টার্বুলেন্ট এরা, পৃ: ২৭১, ৩১০-৩১১।
১৫. আলেকজান্ডার ওয়ের্থ, “অ্যান আই-উইটনেস অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ান ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল ইন ইউরোপ ডিউরিং ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু,” আলেকজান্ডার ওয়ের্থ এবং ওয়াল্টার হারবিখ, নেতাজি ইন জার্মানি (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৭০), পৃ: ১৪-১৬।
১৬. ভারতের ভাইসরয়, ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটকে লেখা চিঠি, ২৬ মে, ১৯৪১, এল/পি এস/১২/৪৮৭ (আই ও আর, বি এল)।
১৭. এস ও ই (স্পেশাল অপারেশন এগজিকিউটিভ) ওয়ার ডায়রি, ১৬/১৭ জুন ১৯৪১, এইচ এস ৭/২২০। কাবুলের ইতালীয় মিনিস্টার, চিঠি পাঠাচ্ছেন রোমের উদ্দেশ্যে, ২৬ মার্চ, ১৯৪১, এইচ ডব্লিউ ১২/২৬৩ (টি এন এ)।
১৮. এস ও ই ওয়ার ডায়রি, ১৮ জুন, ১৯৪১, এইচ এস ৭/২২০ (টি এন এ)।
১৯. ব্যাস, প্যাসেজ থ্রু আ টার্বুলেন্ট এরা, পৃ: ৩২৪।
২০. ওয়াল্টার হারবিখ, “আ রিপোর্ট অন দি অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ট্রেনিং অব দ্য ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি ইন ইউরোপ, ১৯৪১-৪২,” ওয়ের্থ এবং হারবিখ, নেতাজি ইন জার্মানি, পৃ: ৫৩।
২১. হিউ টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার: আ স্টাডি অব সুভাষ চন্দ্র বোস (লন্ডন: কাসেল, ১৯৫৯), পৃ: ৭০।
২২. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ২৯-৩২।
২৩. গণপুলে, নেতাজি ইন জার্মানি, পৃ: ৯৫।
২৪. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ৪২-৪৪।
২৫. শিশিরকুমার বসু, দ্য গ্রেট এসকেপ (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ২০০০), পৃ: ৪৭-৪৮, ৫৮-৫৯; “ভগত রাম’স্ স্টোরি” (টি এন এ)।
২৬. অত্যন্ত গোপনীয় ফাইল সি/৭৪৮৮, প্রধানমন্ত্রীর জন্য বি. জে. রিপোর্ট নং ০৯৫১৬১, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১, চার্চিলের ‘সি’ আদ্যক্ষরযুক্ত, এইচ ডবলিউ ১/৪৮ (টি এন এ)।
২৭. শিশিরকুমার বসু, রিমেমবারিং মাই ফাদার (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৮৮), পৃ: ১০৯-১১৪; হোম পলিটিক্যাল ফাইল ৯৪/২৬/৪১ (এন এ আই); বাংলা প্রদেশের গভর্নর, ভারতের ভাইসরয়কে লেখা চিঠি, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১; তদেব, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪১; তদেব, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪১; তদেব, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪১; এ কে ফজলুল হক, বাংলা প্রদেশের গভর্নর জন হারবার্টকে লেখা চিঠি, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪১; জে জি লেইথওয়েট, ভাইসরয়’স ক্যাম্প, পটনা থেকে লিখছেন এম ও কার্টারকে, গভর্নর’স্ হাউস, কলকাতা (সঙ্গে সেক্রেটারি অব স্টেট এল এস আমেরির ভাইসরয় লিনলিথগোকে পাঠানো টেলিগ্রাম, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪১), ১১ ডিসেম্বর, ১৯৪১; প্রতিটি রয়েছে আর/৩/২/৩০ (আই ও আর, বি এল)।
২৮. শিশিরকুমার বসু, এস এ আইয়ার এবং আলেকজান্ডার ওয়ের্থ, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া (মুম্বই: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩), পৃ: ১৩৩-১৩৪।
২৯. “দ্য ফল অব সিঙ্গাপুর,” আজাদ হিন্দ রেডিয়োয় সুভাষচন্দ্রের বেতার সম্প্রচার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ৬৭-৬৮।
৩০. কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ৩১।
৩১. “ইন্ডিয়া হ্যাজ নো এনিমি আউটসাইড হার ওন ফ্রন্টিয়ারস্,” ১৯ মার্চ, ১৯৪২, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ৭৫-৭৯।
৩২. মোহনদাস গাঁধী, দ্য কালেকটেড ওয়ার্কস্ অব মহাত্মা গাঁধী, ছিয়াত্তরতম খণ্ড (নয়া দিল্লি: গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া পাবলিকেশনস্ ডিভিশন, ১৯৫৮-১৯৭৮), পৃ: ৮৭, ১০৫, ১১৪, ১২০, ২৪২, ৩৮১।
৩৩. ভারতের ভাইসরয় লিনলিথগো, ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট এল এস আমেরিকে লেখা চিঠি, ২১ জানুয়ারি, ১৯৪২, নিকোলাস মানসার্গ (সম্পাদিত), দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, প্রথম খণ্ড (লন্ডন: এইচ এম জি, ১৯৭০-১৯৮৩), ডকুমেন্ট ২৩।
৩৪. “ড্রাফ্ট ডিক্লারেশন অন ইন্ডিয়া,” ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২, জি এফ ও মহাফেজখানা থেকে যে অবিকল প্রতিরূপটি করা হয়েছে, সেটি রয়েছে শিশিরকুমার বসু (সম্পাদিত), নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৭৫), পৃ: ৩০৬-৩০৯।
৩৫. জার্মান নৌ-সদস্যের স্মারকলিপি, ১২ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২, এবং রেডার-হিটলার নৌ-সম্মেলন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১২ মার্চ, এবং ১৩ এপ্রিল, ১৯৪২, উদ্ধৃত রয়েছে মিলান হওনার, “ইন্ডিয়া অ্যান্ড দি অ্যাক্সিস পাওয়ারস্,” শিশিরকুমার বসু (সম্পাদিত), নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ২৯২।
৩৬. মিলান হাউনার, ইন্ডিয়া ইন অ্যাক্সিস স্ট্র্যাটেজি: জার্মানি, জাপান অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্টস্ ইন দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার (স্টুটগার্ট: ক্লেট-কট্টা, ১৯৮১), পৃ: ৪০২, ৪২৯-৪৩৫।
৩৭. “মাই ডেথ ইজ পারহ্যাপস্ অ্যান ইনস্ট্যান্স অব উইশফুল থিংকিং,” বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ৮০-৮৩; ব্যাস, প্যাসেজ থ্রু আ টার্বুলেন্ট এরা, পৃ: ৩৬৫-৩৬৭; শিশিরকুমার বসু, বসুবাড়ি (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৮৫), পৃ: ১৪৭।
৩৮. আবুল কালাম আজাদ, ইন্ডিয়া উইনস্ ফ্রিডম (হায়দরাবাদ: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৮৮), পৃ: ৪০।
৩৯. হাউনার, ইন্ডিয়া ইন অ্যাক্সিস স্ট্র্যাটেজি, পৃ: ৪৪৬-৪৪৮।
৪০. মার্টিন বরম্যান, হিটলারের স্মৃতিরোমন্থনের বিবরণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫, দ্য টেস্টামেন্ট অব অ্যাডলফ্ হিটলার (বোরিং, ওরেগন: সি পি এ বুক পাবলিশার, ১৯৯০), পৃ: ২১।
৪১. লুইগি বারজিনি, “উইথ চন্দ্র বোস ইন হিজ হোম,” পোপোলো দি’ইতালিয়া, ১৯ এপ্রিল, ১৯৪২।
৪২. গালেজো চিয়ানো, চিয়ানো’স্ ডায়রি, ১৯৩৯-১৯৪৩, ম্যালকম মাগেরিজ [সম্পাদিত] (লন্ডন: উইলিয়ম হেইনমান, ১৯৪৭), পৃ: ৪৬৫।
৪৩. “মাই অ্যালেজিয়ান্স,” বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ৯৪-৯৯।
৪৪. সুভাষচন্দ্র বসু, জোয়াকিম ফন রিবেনট্রপকে লেখা চিঠি, ২২ মে, ১৯৪২, তদেব, পৃ: ১০০-১০১।
৪৫. “বোস-হিটলার ইন্টারভিউ,” জি এফ ও মহাফেজখানায় পল স্মিড্ট্-এর বিবরণের ইংরেজি অনুবাদ, শিশিরকুমার বসু (সম্পাদিত), নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩১০-৩১৫।
৪৬. তদেব।
৪৭. ওয়ের্থ এবং হারবিখ, নেতাজি ইন জার্মানি, পৃ: ৩৬; মুখোপাধ্যায়, দিস ইউরোপ, পৃ: ১৩৪; কৃষ্ণা বসু, ‘হিটলার ও নেতাজি,” প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৯৩), পৃ: ৮৭।
৪৮. রাজমোহন গাঁধী, মোহনদাস: দ্য ম্যান, হিজ পিপ্ল অ্যান্ড দি এম্পায়ার (দিল্লি: পেঙ্গুইন, ২০০৭), পৃ: ৪২১।
৪৯. “ডিফারেনশিয়েট বিটউইন ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটারনাল পলিসি,” ১৭ জুন, ১৯৪২, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ১১৭-১২১।
৫০. গাঁধী, কালেকটেড ওয়ার্কস্, ছিয়াত্তরতম খণ্ড, পৃ: ৮৭, ১০৫, ১১৪, ১২০, ২৪২, ৩৮১।
৫১. উদ্ধৃত আছে, হাউনার, ইন্ডিয়া ইন অ্যাক্সিস স্ট্র্যাটেজি, পৃ: ৪৯৩।
৫২. “দ্য কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট,” ১৭ অগস্ট, ১৯৪২, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ১৩২-১৩৯।
৫৩. “দি ইউ এস এ, ব্রিটেন অ্যান্ড ইন্ডিয়া,” ১৫ অক্টোবর, ১৯৪২, তদেব, পৃ: ১৬২-১৬৯।
৫৪. “দ্য কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট,” ১৭ অগস্ট, ১৯৪২, তদেব, পৃ: ১৩২-১৩৯।
৫৫. গণপুলে, নেতাজি ইন জার্মানি, পৃ: ৮৯।
৫৬. মুখোপাধ্যায়, দিস ইউরোপ, পৃ: ১৩৯, ১৫৩।
৫৭. ব্যাস, প্যাসেজ থ্রু আ টার্বুলেন্ট এরা, পৃ: ৩২৬।
৫৮. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” ৪০-৪১।
৫৯. টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ৬৮-৬৯; হাউনার, “ইন্ডিয়া অ্যান্ড দি অ্যাক্সিস পাওয়ারস্,” বসু, নেতাজি অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ ফ্রিডম, পৃ: ৩০১।
৬০. টোয়ে, দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার, পৃ: ৭৪।
৬১. “ফ্রি ইন্ডিয়া অ্যান্ড হার প্রবলেমস্,” বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ১৪৮-১৫৬।
৬২. “ইন্ডিয়া অ্যান্ড জার্মানি,” তদেব, পৃ: ১৫৭-১৬১।
৬৩. কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ১০২।
৬৪. এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে আমার কথোপকথন, ১৯৯৩।
৬৫. “স্টেটমেন্ট অব এ সি এন নাম্বিয়ার,” ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ (টি এন এ), অনুচ্ছেদ ১৬০-১৭৯; ব্যুরো অব সেক্রেটারি অব স্টেট, ভারত, সিরিয়াল নম্বর ১৯৫, তৃতীয় খণ্ড, ১৩৯৫৫-১৪০০২৬ (জি এফ ও, মাইক্রোফিল্ম, এন আর বি)।
৬৬. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২; তদেব, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২; তদেব, ১ অক্টোবর, ১৯৪২; ৬ অক্টোবর, ১৯৪২; প্রতিটি আছে সুভাষচন্দ্র বসু, লেটারস্ টু এমিলি শেঙ্কল, ১৯৩৪-১৯৪২, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, কালেকটেড ওয়ার্কস্, সপ্তম খণ্ড, শিশিরকুমার বসু এবং সুগত বসু [সম্পাদিত] (কলকাতা: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো; দিল্লি: পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ১৯৯৪, ২০০৪), পৃ: ২১৮-২২০।
৬৭. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, ৫ নভেম্বর, ১৯৪২; তদেব, ৭ নভেম্বর, ১৯৪২; তদেব, ১৬ নভেম্বর, ১৯৪২; তদেব, ১৮ নভেম্বর, ১৯৪২; প্রতিটি তদেব, পৃ: ২২৩-২২৪; “স্টেটমেন্ট অব এ সি এন নাম্বিয়ার,” ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ (টি এন এ), অনুচ্ছেদ ১৭১।
৬৮. কৃষ্ণা বসু, ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ: ১০৪।
৬৯. সুভাষচন্দ্র বসু, এমিলি শেঙ্কলকে লেখা চিঠি, এন.ডি. [ডিসেম্বর ১৯৪২]; তদেব, ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৪২; দুই-ই আছে বসু, লেটারস্ টু এমিলি, পৃ: ২২৫-২২৭।
৭০. “স্টেটমেন্ট অব এ সি এন নাম্বিয়ার,” ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ (টি এন এ), অনুচ্ছেদ ১৭২।
৭১. সুভাষচন্দ্র বসু, রিবেনট্রপকে লেখা চিঠি, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪২, বসু, আজাদ হিন্দ, পৃ: ১৭০-১৭২।
৭২. “দ্য ব্লাফ অ্যান্ড ব্লাস্টার কর্পোরেশন অব ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিস্টস্” এবং “দ্য টোয়েন্টিফোরথ অ্যানিভারসারি অব দ্য ব্লাডবাথ অব অমৃতসর,” তদেব, পৃ: ১৯৩-২০৪।
৭৩. “ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে,” তদেব, পৃ: ১৮২-১৯২।
৭৪. সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠি, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, তদেব, পৃ: ২০৫। এই চিঠিটি শরৎচন্দ্রের কাছে পৌঁছনোর পর তিনি স্ত্রী বিভাবতী এবং তিন সন্তান— শিশির, রমা এবং চিত্রাকে নিয়ে ভিয়েনায় যান এবং সেখানে এমিলি এবং অনিতাকে বসু পরিবারে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
৭৫. “স্টেটমেন্ট অব এ সি এন নাম্বিয়ার,” ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ (টি এন এ), অনুচ্ছেদ ১৭৭; “স্বামী: নোটস্ টেক্ন ইন সিঙ্গাপুর, সেপ্ট./অক্ট. ১৯৪৫, হোয়েন স্বামী কেম টু টি” (টি এন এ)।
৭৬. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ৫২।
৭৭. ক্রিস্টোফার বেইলি এবং টিম হারপার, ফরগট্ন আর্মিজ: দ্য ফল অব ব্রিটিশ এশিয়া, ১৯৪১-১৯৪৫ (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেট্স্: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪), পৃ: ২৭৮।
৭৮. মানসার্গ (সম্পাদিত), ট্রান্সফার অব পাওয়ার, তৃতীয় খণ্ড, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, পৃ: ৬৩২।
৭৯. তদেব, পৃ: ৬৯০।
৮০. তদেব, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, পৃ: ৭৩৭।
৮১. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ৫৩; বসু, ওয়ের্থ এবং আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া, পৃ: ১৬০।
৮২. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ৫৩-৫৬।
৮৩. তদেব, পৃ: ৫৭-৬১।
৮৪. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্” (দ্বিতীয় কিস্তি), দি ওরাকল, ৭, ১ নম্বর (জানুয়ারি ১৯৮৫), ১৯-২০, ২৩।
৮৫. তদেব, পৃ: ২১; বসু, ওয়ের্থ এবং আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া, পৃ: ১৬১-১৬২।
৮৬. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ২২; বসু, ওয়ের্থ এবং আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া, পৃ: ১৬৩।
৮৭. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ২২; বসু, ওয়ের্থ এবং আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া, পৃ: ১৬৩-১৬৪।
৮৮. হাসান, “আ সোলজার রিমেমবারস্,” পৃ: ২২-২৫; বসু, ওয়ের্থ এবং আইয়ার, আ বিকন অ্যাক্রস এশিয়া, পৃ: ১৬৪-১৬৬; ১৯৪৩ সালের জুন মাসে টোকিয়ো থেকে বসুর সম্প্রচারের অডিয়ো রেকর্ডিং (এন আর বি)।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন