আমরা দেখেছি যে শিল্পবস্তুর সম্পূর্ণতা নির্ভর করে যথার্থ প্রকাশের উপর। প্রকাশ অর্থ উন্মোচন। শিল্পের অভ্যন্তরে একটি রহস্যের আভাস সব সময় খেলা করে। শিল্পী যা চান তা পরিপূর্ণভাবে পান, তা কেউই বলবে না; অনেক শিল্পী কণামাত্র পেলেই বাধিত হন। চাওয়া ও পাওয়ার তফাৎটুকু যত কম হবে, শিল্পীর নান্দনিক তৃপ্তি তত বাড়বে, কিন্তু যা পেলেন তা একটি ভাবনা মাত্র, আভাস মাত্র। সেই ধ্রুব বস্তুটি কি, যার আভাস মুহুর্তের অভিজ্ঞানে বা দিব্যদর্শনে শিল্পীর কাছে ধরা পড়ে, কি সেই সত্যরূপ যার উন্মোচন শিল্পের অভীষ্ট? এর সঠিক কোনো উত্তর নেই, কারণ সৃষ্টির উৎস যেমন একটি রহস্য, শিল্পের উৎসও তেমনি। সৃষ্টির অভ্যন্তরে যেমন এক রহস্যের খেলা চলে, তেমনি চলে শিল্পের অভ্যন্তরে। এই প্রচ্ছন্ন রহস্যকে কেউ বলেছেন লীলা, কেউ বলেছেন মায়া বা illusion. কিন্তু তাকে শিল্পকর্মের কেন্দ্রে ধরেও শিল্পবস্তুটিকে চক্ষু কৰ্ণ ত্বকের এবং বুদ্ধি ও বোধের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হয়। প্রকাশ হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিল্পী এই উদ্দেশ্যটি সাধন করেন।
প্রকাশ হতে পারে অনেক ধরনের। প্রকাশকে যে প্রক্রিয়া বলা হলো তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে- যেমন সঙ্গীতে, আবার তাৎক্ষণিকও হতে পারে- যেমন একটি নিসর্গ চিত্রে, কিন্তু প্রকাশের স্থায়িত্বকাল যা-ই হোক, এর ক্রিয়া-প্রক্রিয়া মোটেই সংক্ষিপ্ত নয়, এবং এর প্রসঙ্গগুলোও সারল্যে বিধৃত নয়; মোটামুটি বলা যায়, জটিল। শিল্পের প্রকাশ ভাষানির্ভর বললে প্রশ্ন আসবে স্থাপত্যের প্রকাশ কোন ভাষাতে? উত্তর, স্থাপত্যের ভাষাতে, এবং পাল্টা প্রশ্ন করতে হবে, ভাষা কি? যা বলা হয় তা-ই ভাষা, বস্তুর কি ভাষা নেই? শিল্পীমাত্রই জানেন চন্দ্রালোকিত রাতের একটি ভাষা আছে, বর্ষামুখর সায়াহ্ন বেলার একটি ভাষা আছে, যীশু সন্তান কোলে মাতা মেরীর (যা Picta চিত্রকলা শ্রেণীর পরিচিতি) ছবিটির একটি ভাষা আছে। শিল্পবস্তুর রস ভাষাকে নির্ণয় করে। চন্দ্রালোকিত রাতের সুরটি শান্ত, বর্ষা-সায়াহ্নের রূপ বিষন্ন; Picta চিত্রের রূপ পবিত্ৰ-গম্ভীর। কোনো শব্দ ব্যবহার না করেও এই ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পবস্তু যদি শব্দ বা অন্য যে-কোনো প্রকাশ মাধ্যমে সামূহিকভাবে উন্মোচিত হতে পারে, বলা যায় তার প্রকাশ সফল হয়েছে।
‘প্রকাশ’ কথাটি নিয়ে অনেক আলোচনা চলতে পারে, তবে অন্যান্য শিল্প ধারণার মতো এতেও মতদ্বৈততার অবকাশ আছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রকাশের কয়েকটি অর্থ নির্ণয় করেছেন এইভাবে :
“ ‘প্রকাশ’-এর অর্থ
(১) হতে পারে ‘যার প্রকাশ’: হাসিতে খুশির প্রকাশ; ভাষায় ভাবের প্রকাশ। ‘প্রকাশ’-এর অর্থ
(২) হতে পারে ‘যাতে প্রকাশ’: হাসিতে খুশির; ভাষায় ভাবের। প্রকাশ’-এর অর্থ
(৩) হতে পারে প্রকাশ পদ্ধতি’ এবং
(৪) ‘প্রকাশের পরিণাম’ ”
শিল্পবস্তুর প্রকাশ বলতে তাই শিল্পবস্তু, তার প্রকাশ-আধার, প্রকাশের পদ্ধতি এবং প্রকাশের পরিণাম এই চারটি পর্যায় বোঝায়।
কিন্তু এ ছাড়াও প্রকাশ বলতে আধুনিককালে প্রকাশ-উদ্দেশ্যকেও বোঝায়- কিসের জন্য প্রকাশ? সমাজবাদী শিল্পীরা প্রকাশকে সমাজের প্রয়োজনে লাগাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু যেভাবেই দেখা হোক, প্রকাশ হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শিল্পবস্তু ও শিল্পগ্রহীতার সম্পর্কটি স্থাপিত হয়। কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হলো শিল্পীর অনুধাবনের প্রকৃত প্রতিরূপটি অর্জন, যা প্রকাশের মাধ্যমে সম্ভব। জয়নাল আবেদীনের দুর্ভিক্ষের চিত্রগুলোতে প্রকাশের একটি প্রেক্ষিত দর্শকের মনে আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে, প্রকাশ সেখানে তার ধারণার সত্যরূপ অর্জনকে তুরান্বিত করে মাত্র, অন্যদিকে বিমূর্ত চিত্রে দর্শকের রসানুভূতি জাগ্রত করার জন্য প্রকাশ প্রক্রিয়াকে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। শিল্পীর মানসলোকে সত্য ও সুন্দরের যে ভাব উন্মীলিত হয়, সে-ও প্রকাশ, আবার এই ভাব শিল্পবস্তুতে প্রতিফলিত হওয়াও প্রকাশ। শিল্পরসিকের জন্য প্রকাশ হচ্ছে সেই সঞ্চার যা তার বুদ্ধি বা মননের সাথে শিল্পবস্তুকে সম্পর্কিত করে। এভাবে দেখলে প্রকাশের সামূহিক রূপটি ত্ৰিধাবিভক্ত প্রথম পর্যায়ে শিল্পীর মনে সত্য ও সুন্দরের ধারণার প্রকাশ, দ্বিতীয় পর্যায়ে শিল্পীর সত্য ও সুন্দরের ধারণা শিল্পবস্তুতে প্রকাশ, এবং তৃতীয় পর্যায়ে শিল্পরসিকের কাছে শিল্পবস্তুর প্রকাশ। এই তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশ ও প্রকাশ-শৈলী সমার্থক। এবং প্রথম পর্যায়ে তা দিব্যদর্শন, উন্মোচন বা হঠাৎ উপলব্ধির ব্যাপার।
প্রকাশের সবগুলো পর্যায় বিবেচনা করলে এবং শিল্পসৃষ্টির বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিলে দেখা যাবে ভাষা অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হলেও এর স্থান সর্বাগ্রে নয়। ভাষা সৃষ্টির আগেও শিল্পসৃষ্টি হয়েছে, সেই সৃষ্টি রসোত্তীর্ণ হয়েছে। ভাষা বিবর্তনশীল, তার সীমাবদ্ধতাও প্রচুর, এজন্য এ মাধ্যমে সম্ভাবনা যেমন, সংকটও তেমনি। তাছাড়া বৃহৎ অর্থে ভাষা একটি প্রতীক। এবং আমরা জানি প্রকাশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে প্রতীকের প্রয়োজন হয় না। প্রতীক তখনি দরকার, যখন প্রকাশের অসম্পূর্ণতাকে অন্যভাবে মোচন করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য ভাষাও এক অসম্পূর্ণ প্রকাশের অনুষঙ্গকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে ভাষা যদি লিখিতভাবে প্রকাশ-মাধ্যম হয়, অথবা মুদ্রিত আকারে প্রকাশ-মাধ্যম হয় (যার ইতিহাস মাত্র কয়েকশত বছরের) তখন সে হয়ে দাঁড়ায় প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মুদ্রিত পৃষ্ঠার সাদাকালোর মধ্যে কত বর্ণাঢ্য জীবন, মহাজীবন বিধৃত হয়েছে, কত রূপবৈচিত্র্যে জগৎ ও মহাকাল উদ্ভাসিত হয়েছে, কত রহস্য, পুলক, বেদনা, রোমাঞ্চ বাঙ্ময় হয়েছে, হিসেব করলে মানতেই হবে ভাষার শক্তি কি অপরিমেয়। একজন কবি বা একজন ঔপন্যাসিকের নেই চিত্রীর মতো রেখা ও রঙ, ভাস্করের মতো পাথর বা প্লাস্টার, নৃত্যশিল্পীর মতো মুদ্রা, দেহসৌষ্ঠবের বিন্যাসী রূপ। তার আছে শুধু শব্দ, তা-ও এক স্বরগ্রাম। লিখিত ভাষায় কোনো বৈচিত্র্য নেই; কিন্তু একটি আট লাইনের কবিতায় সংঘটিত হতে পারে একটি ভূমিকম্প। একটি দু’লাইনের কবিতায় ঝরে পড়তে পারে অনর্গল অশ্রু। ভাষার এই শক্তির পেছনে আছে কবির বা ঔপন্যাসিকের ভাব ও কল্পনাকে যথেচ্ছ ব্যবহারের পারদর্শিতা। তাছাড়া ভাষা আপাতঃনিরীহ হলেও তাতে যে ক্রমাগত চিত্র অঙ্কিত হতে থাকে, তারা হয় জীবন্ত, চলমান, মর্মস্পশীমানুষের সকল ভাব ও ভাবনার প্রতিফলন পাওয়া যায় এসব চিত্রে। কাজেই ভাষার প্রকাশ প্রক্রিয়া অবশ্যই dynamic– বর্ধিষ্ণু, গতিশীল এবং সক্রিয়। ভাষার মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য বা ইচ্ছাপূরণ সম্ভব যা নন্দনতত্ত্বের সূত্র হিসেবে বিবেচ্য- যেমন সত্য ও সুন্দরের সন্ধান, রূপের ও রসের অনুসন্ধান, শিল্পের প্রকাশকে সর্বতোসঞ্চারী করে তোলা। তাছাড়া ভাষা যেহেতু লিখিতরূপে আত্মস্থ করতে গেলে একটি ন্যূনতম প্রস্তুতির প্রয়োজন— ভাষাকে পড়ার দক্ষতা অন্তত শিল্পরসিকের প্রয়োজন— সেজন্য ভাষার প্রকাশে শিল্পের রসগ্রহণ একটি বিশেষ প্রাক-প্রস্তুতির পর্যায় থেকে শুরু হয়। ক্রোচে এসব বিবেচনা থেকে বলেছিলেন যে ভাষাতত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্বের চরিত্র অনেকাংশে একই। ভাষা তত্ত্বের অন্তর্গত যে জিনিস দর্শনের আওতাভূক্ত করা যায়, ক্রোচের মতে তাই হলো নন্দনতত্ত্ব। ভাষার দর্শন আর শিল্পের দর্শন এক এবং অভিন্ন। ক্রোচে ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে : “ভাষামাত্রই প্রকাশ নয়। যে শব্দরাজি কোনো কিছু প্রকাশ করে না তা ভাষা নয়। ভাষা হচ্ছে শব্দের সুচারু বিন্যাস, যার রূপায়ণের আর সংগঠনের উদ্দেশ্য প্রকাশ।” ক্রোচে ভাষার শক্তি ও নান্দনিক তাৎপর্য (শিল্পদর্শন ও ভাষাদর্শন মূলত এক এবং অভিন্ন) মেনে নিয়েও তাকে কতগুলো শর্তের মধ্যে ফেলেছেন। ভাষার প্রকাশ-উদ্দেশ্য থাকতে হবে, বা বলা যায় তার উদ্দেশ্য থাকতে হবে প্রকাশ; ভাষার শব্দাবলী অর্থহীন ধ্বনি নয়, অর্থময় রূপ। সেখানে বিন্যাস থাকবে, সংগঠন থাকবে। তবে শিল্পের ভাষারূপ ছাড়াও আরো অনেক প্রকাশ থাকে, যদিও সর্বত্র প্রকাশ নির্ভর করবে প্রকাশ প্রক্রিয়ার সাফল্য অসাফল্যের উপর। একজন ভাস্কর যে শিল্পভাবনা নিয়ে শুরু করেন, তাকে ‘ভাষা’ দেন ভাস্কর্যের রূপ, আকৃতি, মাত্রার পরিপূর্ণ ব্যবহারে, তার বিভিন্ন অঙ্গের সামঞ্জস্যে, material-এর গুণ আয়ত্ত করে সেগুলোর প্রয়োগের মাধমে। কিন্তু কৃত শিল্পবস্তু এদের কোনোটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যে রসের সঞ্চার করে না; করে সম্মিলিতভাবে । প্লেটো ও অন্যান্য আদি গ্ৰীক দার্শনিকদের মতো, সৌন্দর্য একটি পূর্ণতার বোধ। সুন্দর বস্তুর সামান্যতম অংশটি সরিয়ে নিলে এর সার্বিক অঙ্গহানি হবে। স্থানুধর্মী শিল্পীদের ক্ষেত্রে এই পূর্ণতাকে রূপ দেয়া একটি প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, যদিও পূর্ণতার উপলব্ধি একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত। শিল্প বস্তুটির প্রকাশও এই পূর্ণতাকে প্রকাশের নামান্তর। রাশিয়ায় বিপ্লবের আগে ‘নিৰ্মাণবাদ’ (constructivism) নামে যে ভাস্কর্য আন্দোলন শুরু হয়, তারও প্রকাশ ঐ পূর্ণতার দিকে, যদিও এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো ভাস্কর্যকলার সাথে প্রকৃতিগত সকল সাদৃশ্যের অবসান ঘটিয়ে ‘শুদ্ধ’ বা ‘চূড়ান্ত’ রূপ অন্বেষণ। এসব ভাস্কর্যে ব্যবহৃত হয় কাচ, প্লাস্টিক, ধাতু এবং অন্যান্য বস্তু, তাদের আকৃতি হয় জ্যামিতিক, এবং যন্ত্র বা যান্ত্রিক হাতিয়ারের সাথে এদের রূপগতি সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু হার্বট রীডের মতে মানববাদী শিল্পী রদাঁও তার ভাস্কর্যে নির্মাণবিদ্দের শিল্প-উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন– ঘন বস্তু, তল, দেশ, ওজন ইত্যাদির সঠিক টানের মাধ্যমে একটি equilibrium সৃষ্টি করে। অর্থাৎ শিল্পীর নির্মাণ-উপকরণ, নির্মাণ-উদ্দেশ্য, শিল্পচেতনা ভিন্ন হলেও প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। টলস্টয়-এর মতে শিল্পী তাঁর অনুভূতিকে প্রকাশ করবেন, এবং একই সাথে তাকে সঞ্চারিত করবেন শিল্পভোক্তার কাছে। কিন্তু টলস্টয়ের শিল্পভোক্তা যে-কোনো মানুষ, গরীব চাষীও হতে পারে সে। হাৰ্বার্ট রীড মনে করেন শিল্পের প্রকৃত কাজ অনুভূতির প্রকাশ এবং understanding-এর সঞ্চারণ। যেভাবেই হোক, প্রকাশ বা সঞ্চারণের মাধ্যমে, শিল্পী তার অনুভূতিকে স্থানান্তরিত করেন শিল্পগ্রহীতার কাছে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শিল্পের গ্রহণযোগ্যতার জন্য অপরিহার্য।
মার্ক্সবাদী শিল্পসমালোচকদের একটি শ্রেণী, ভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে ভাষা সমাজ থেকে আলাদা নয়, সমাজ থেকেই এর উদ্ভব। ভাষা হচ্ছে এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা সামান্য একজন মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেও সকলের জ্ঞাত বস্তুতে পরিণত করতে পারে। এসব সমালোচকদের মতে Ideology বা আদর্শবাদও ভাষাগত সঙ্কেতের সাহায্যে তৈরি একটি ভাষাভিত্তিক রূপ। মিখাইল বখ্তিন, পাভেল মেদ্ভেদেভ ও ভ্যালেন্টিন ভলোসিনোভ এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা। মার্ক্সবাদের dialectics বা দ্বান্দ্বিকতাবাদ যার প্রকাশ সম্পূর্ণ ভাষাভিত্ত্বিক প্রকৃতপক্ষে তা-ই এঁদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। ভলোসিনোভের একটি উক্তি ; শব্দ হচ্ছে দ্বি-মুখী তৎপরতা, যা নির্ধারিত হয় শব্দ ‘কার’ এবং ‘কার জন্য’- এ দুই বিবেচনায়। দেখা যাচ্ছে দ্বান্দ্বিকতার একটি লক্ষণ এখানে নিহিত।
প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ফার্ডিনান্দ সসুর (১৮৫৭-১৯১৩) মনে করতেন যে ভাষাসমূহ আসলে কতগুলো পদ্ধতি, যা arbitrary বা আরোপিত ও differential বা পার্থক্যসূচক এই দুই ধরনের সঙ্কেতের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত। একটি ভাষা-সঙ্কেত দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত ; শব্দ-চিত্র (বা তার লিখিত রূপ) এবং একটি ধারণা, প্রথম উপাদানটির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় signifier বা বোধক পদটি, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে signified বা বোধপ্রাপ্ত পদটি। যেমন ‘গাছ’ শব্দটি signifier : গাছের একটি চিত্রধারণা তা আমাদের উপহার দেয়। আবার যে signified গাছের ধারণা দেয়া হলো, তা ঐ শব্দ বা ধ্বনির সাথে সাথে আমাদের মনে উদয় হয়। এইভাবে অনুষঙ্গাদির মাধ্যমে শব্দ-চিত্র ও ধারণার প্রয়োগে ভাষা নিরন্তর বিকশিত হয়। এজন্য ছাপানো সাহিত্যকর্ম এত সহজে আবেদন রাখতে সক্ষম হয়।
প্রকাশিত সকল বস্তুই কি শিল্প, অথবা সকল শিল্পের কি প্রকাশ সম্ভব? ক্রোচে যদিও সুন্দর ও অসুন্দরের প্রকাশ নিয়ে কোনো বিভক্তি রেখা টানেন নি, এ প্রশ্নটি সহজেই এসে যায়- শিল্পের প্রকাশে যদি সুন্দরই মুখ্য হয়, সেখানে অসুন্দরের কোনো অধিকার আছে কি? অথবা থাকলে কতটা এবং কি পরিমাণে? প্লেটো থেকে নিয়ে কেউ এ পর্যন্ত এই জটিল প্রশ্নটির মীমাংসা করতে পারেন নি। প্রকাশিত সকল বস্তু অবশ্যই শিল্প নয়; আবার সকল শিল্পের প্রকাশ সাধারণ অর্থে সম্ভব নয়, যদিও প্রকাশ-উদ্দেশ্য এর একটি প্রধান উদ্দেশ্য। সাধারণ অর্থে প্রকাশ বা অনুভূতি ইত্যাদির সঞ্চারণ সকল শিল্পে সমানভাবে কার্যকরী হয় না। একটি ধ্রুপদ খেয়ালের প্রকাশ অনেকগুলো পূর্ব-শর্তের উপর নির্ভরশীল, তা না হলে এর প্রকাশ সম্ভব হয় না। তবে শিল্পীর তরফ থেকে প্রকাশ ঠিকই হলো। শিল্প-গ্রহীতা তাকে গ্রহণে অসমর্থ হলো। কিছু কিছু শিল্প-প্রক্রিয়া অত্যন্ত উঁচুদরের রুচির ও রসের গ্রহীতা দাবি করে। তাদের selective art বলতে বাধা নেই; তবে সকল শিল্পই কোনো না কোনোভাবে selective। আবালবৃদ্ধবণিতা নির্বিশেষে সকলের কাছে শিল্প সমানভাবে অনুভূত হয় না বা আবেদন লাভ করে না। শিল্পে এই চয়নের প্রসঙ্গটি একাধিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
লঞ্জাইনাস মনে করতেন শক্তিশালী এবং মোহনীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে যে বস্তু, তা শিল্পপদবাচ্য। যে অসুন্দর নিছক বিকৃতি, কুশ্রীতা ও বিবমিষার জন্ম দেয় তা শিল্প নয়। ঐ অসুন্দর অনুষঙ্গবাদের মাধ্যমে সুন্দরকে উদ্বোধন করলে বা লঞ্জাইনাসের সূত্রানুযায়ী শক্তিশালী বা মোহনীয় ভাব জাগ্রত করলে তা শিল্পের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। প্রকাশের বৈচিত্র্য এসব দ্বৈতকে বৈধতা দেয়, তবে এক্ষেত্রে শিল্পীকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ পরিমিতিবোধের সাক্ষর রাখতে হয়। সামান্য অতিরঞ্জন বা সুমিতির অভাব হলে ট্র্যাজেডি পরিণত হয় মেলোড্রামায়, কমেডি প্রহসনে, এবং অসুন্দর বীভৎসতায়। শিল্পীর প্রকাশ-উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আধুনিক যুগে অবশ্য anti-art বা প্রতি-শিল্প নামে একটি আন্দোলন চালু হয়েছে। প্রতি-শিল্পের স্থান পাবে বাস্তবতার সকল দিক- বীভৎস দিকটি চাপা থাকবে না মেকি সৌন্দর্যের আড়ালে। বরং বীভৎসকে বেশি বীভৎস বলে দেখাতে হবে; সৌন্দর্যকে খর্ব করতে হবে, কারণ জীবনে অখণ্ড বলে কিছু নেই, সৌন্দর্যও নেই। প্রতি-শিল্পের বাস্তবধর্মিতা রূপবাদী শিল্পের বিরুদ্ধাচরণ বা যারা জীবনকে শিল্পে বিশ্বস্ততার সাথে ধরে রাখতে চান না, লুকিয়ে থাকতে চান ভাষার আড়ালে, ভাবের আড়ালে, তাদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ। কিন্তু লক্ষণীয়, প্রতি-শিল্প আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ অবদান যা, তা শিল্পোত্তীর্ণ যে-কোনো বিচারেই। কারণ বাস্তবতা (অনেক সময় অসুন্দর-নির্ভর) শুধু সামাজিক সত্য নয় সে-সব কাজে বরং তা শিল্পসত্যেও পরিণত হয়েছে। মোটরগাড়ির পুরানো যন্ত্রাংশ, জামাকাপড়, কংক্রীটের চৌকো বা নাটবন্টু সন্নিবিষ্ট যে প্রতি-শৈল্পিক ভাস্কর্য প্রথম অনুভূতির আনাগোনা চোখে পড়বে, একটি সত্যকে ভাষাদানের প্রচেষ্টাও অনুভূত হবে, প্রতি-শিল্পের সাধক এই ভাস্কর জীবনের অর্থহীনতাকে তুলে ধরতে চেয়ে সফল হয়েছেন, তার অনুভূতি ‘প্রকাশ’ লাভ করেছে, এ-ই হলো ভাস্কর্যটির পরিচয় এবং সাফল্য। বিষয়বস্তু বা নির্মাণবস্তুর বৈচিত্র্য বা নতুনত্ব (বা তাদের সংগঠন) কোনোকালেই শিল্পের প্রতিবন্ধক হয় নি; হয়েছে সহায়ক।
শিল্পের প্রকাশের ক্ষেত্রে যে কথাটি এখন বলা যায়, তা হলো : প্রত্যেক শিল্পসৃষ্টির একটি লক্ষ্য- প্রকাশের ত্ৰিবিধ ধারাকে, ধারা তিনটিকে প্যারানথিসিসের মধ্যে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংহত করা। যে শিল্পবস্তু যত সহজে শিল্পগ্রহীতার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে, তার আবেদন তত দীর্ঘস্থায়ী। এ বক্তব্যের সাথে হয়তো অনেক আধুনিক শিল্পসমালোচক এক মত হবেন না, কারণ এতে শিল্পবস্তুর গ্রহণযোগ্যতাকে শুধু প্রকাশের উপর নির্ভরশীল হতে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এমন ধারণার কোনো অবকাশ নেই; কারণ শিল্পবস্তুর চূড়ান্ত গ্রহণযোগ্যতা বলে কিছু নেই ব্যক্তি, সমাজ, যুগ, কাল সব কিছুর প্রভাব পড়ে শিল্পরুচিতে- আজকের জনপ্রিয় শিল্প আগামীকাল তার গুণগ্রাহী হারাতে পারে। গ্রহীতার রুচি, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রসগ্রহণ প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয় বলে প্রকাশের বাধা দুস্তর না হলেও অবশ্যই থাকবে, তবে তা চেষ্টার দ্বারা গ্রহণ করতে হবে গ্রহীতাকেই। এক্ষেত্রে এর মাত্রার সামান্য তারতম্য ঘটবে ধরে নেয়া যায়। তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’ বা ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ বা জয়নাল আবেদীনের “গুনটানা” পাঠক দর্শকের মনে সরাসরি আঘাত করে। উক্ত দুটি কবিতায় কোনো জটিলতা নেই, অহেতুক বাতাবরণ নেই; চিত্রটিতে অনুভূতিটাই প্রধান। পাঠক দর্শকের বোধ অনুভূতিতে একটি emotional counterpart বা আবেগী প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে সেখানে বাঙ্ময় হয় তারা। তুলনার সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘বর্ষপঞ্চক’ কবিতাটি বা কাণ্ডিনস্কির Little Circles চিত্রকর্মটির আবেদন সৃষ্টি হতে সময় অনেক বেশি লাগে। খুব সহজেই মনে রাখার মতো নয় এসব কর্ম। এদের আবেদন বরং বুদ্ধিতে। তারা দর্শক পাঠকের মনে তৈরি করে একটি intellectual counterpart বা বৌদ্ধিক প্রতিপক্ষ। সেখানে তারা বাঙ্ময়। লক্ষণীয়, এখানে মূল্যবিচারের কোনো কথা নেই। কোনটি উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম এ বিচার অবশ্যই নিষ্প্রয়োজন। গ্রহীতার সাথে যোগাযোগ সবচেয়ে সরলভাবে, তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব সঙ্গীতে। সঙ্গীতে শ্রোতা ও গাইয়ে বা বাজিয়ের মাঝখানে কোনো যোগাযোগ মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। কবির প্রয়োজন শব্দের, ছাপা মাধ্যমের। তবে চারণ-কবিরা সঙ্গীত সাধকের মতো মাধ্যমবিহীন যোগাযোগে শ্রোতাকে আকর্ষণ করতে পারেন। এজন্য মৌখিক কবিতা বা oral poetry’ র ঐতিহ্য এত দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যারা কবিগান বা কথকতার মাধ্যমে কবিতা-গানকে জনগনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম করেছেন, তারা সকলেই কম বেশি সফল, কারণ এই সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে শিল্পের রস গ্রহণে সক্ষম হন লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাদের ঐ একমাত্র শিল্পেই গ্রহীতা হিসেবে প্রবেশাধিকার আছে। চিত্রীর প্রয়োজন রঙের, ক্যানভাসের। এজন্য শোপেনহাওয়ার বলেছেন, সকল শিল্পই সঙ্গীতের পর্যায়ে পৌছাতে চেষ্টা করে, সঙ্গীতের শর্ত অর্জনে চেষ্টা করে।
প্রকাশবাদী শিল্প-আন্দোলনের যে প্রধান সূত্র, যার মতে শিল্পের পূর্ণতা আভ্যন্তরীণ বা আন্তর প্রকাশে, বাহ্যিক প্রকাশে নয়। বাহ্যিক প্রকাশকে শিল্প-প্রকরণের পর্যায়ে ফেলে অনেকে তা কৌশল ও কারুকাজের ব্যাপার বলেছেন, কিন্তু আন্তর প্রকাশের ক্ষেত্রে শুদ্ধ অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাই চালিকা শক্তি এবং এই প্রকাশের রূপ হয় শুদ্ধ এবং মুক্ত। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যাসিলি ক্যাণ্ডিনস্কির মতে শিল্পী অন্তরের তাগিদ থেকে প্রকাশ করেন। অতএব এই প্রকাশে বাহ্যিক কলাকৌশল বহিরাঙ্গ মাত্র, তার সার হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে প্রকাশকে বলেছেন ‘ঐশ্বর্য’, সেই অর্থে শিল্পীর আন্তর প্রকাশ তার ভাবগুণে বিত্তবান। প্রকাশের আরেক মতবাদের কথা আমরা জেনেছি, যাকে বলা হয় সঞ্চারবাদ (theory of communication) । সে-মত অনুযায়ী প্রকাশের পেছনে সঞ্চারের উদ্দেশ্যও কাজ করে। জর্জ সান্টায়ানা শিল্পের প্রকাশের নান্দনিক দিকটি অস্বীকার না করেও সঞ্চারের দিকটিকে প্রায়োগিক থেকে দেখেছেন। অর্থাৎ শিল্পের নৈতিক মূল্যটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শিল্পের ভাষা নির্ভর প্রকাশ, বা ভাষার অতীত প্রকাশ বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ যাই হোক না কেন, তাতে শিল্পীর প্রকাশের উৎসাহ ও উল্লাসটি অনেকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক শিল্পের একটি ধারা শিল্পকে মেকি বা false ভেবে (দাদাপন্থী শিল্পী জ্যাক ভাসি যেমনটি করেছেন) শিল্পীর উপাদানকে ও হাতিয়ারকে ফাঁদ মনে করেন, তাদের কাছে প্রকাশের বিশেষত্ব নেই। বরং এই শিল্পে উদ্দিষ্ট হচ্ছে নীরবতা। বিশিষ্ট নন্দনতাত্ত্বিক সুসান সন্টাগের ভাষায় এই শৈল্পিক নীরবতাকে বলা যায় নীরবতার নান্দনিক দিক ।
আমরা জানি সমকালীন শিল্পে শিল্পগ্রহীতাকে অখুশি করার বা হতাশ করার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঘাত দেয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বলা যায় অনেক সময় এই শিল্পের উদ্দেশ্য হয় গ্রহীতার কাছে অ-গ্রহণযোগ্য হওয়া। নীৎসে তার “ট্র্যাজেডির জন্ম” বইতে লিখেছেন, আধুনিককালের নাটকের যে অর্থে দর্শক থাকে, গ্রীক নাটকেরও সেরকম ছিলো। নাটক দেখাবার উদ্দেশ্যে রচিত হতো না। আধুনিক শিল্পের কোনো কোনো প্রবক্তা এই দর্শক-শ্রোতা-পাঠককে শিল্পের এলাকা থেকে বহিষ্কার করতে চান। যদি তাই হয়, তবে প্রকাশের দায়-দায়িত্ব থেকে শিল্পী হন মুক্ত। স্যামুয়েল বেকেট একবার বলেছিলেন যে তাঁর শিল্প গর্বিতভাবে দেয়া নেয়ার প্রহসনকে প্রত্যাখ্যান করবে, এ হচ্ছে তাঁর স্বপ্ন। সুসান সন্টাগের মতে, এই প্রকাশ-নিরুৎসাহী শিল্পীরাই নীরবতার নান্দনিক দিকটি গ্রহণ করতে সচেষ্ট। যেহেতু এই মতবাদটি বিতর্কিত, এবং আমাদের কালের শিল্পধারণার একটি দিকনির্দেশক, সুসান সন্টাগ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি প্রয়োজন:
শিল্প এখন স্বীকারোক্তির ব্যাপার না হলেও যে-কোনো সময়ের চাইতে অধিক মাত্রায় মুক্তির ব্যাপার; কঠোর তপশ্চর্যার বিষয়। এর মাধ্যমে শিল্পী নিজে এবং পর্যায়ক্রমে তার শিল্প পরিশুদ্ধ হয়। (শিল্প না হলেও) শিল্প ‘মঙ্গলে’র দিকেই ধাবিত হতে থাকেন। কিন্তু আগে যেখানে শিল্পীর মঙ্গল মানে ছিলো তার শিল্পের কর্তৃত্ব ও পূর্ণতা, এখন শিল্পীর পক্ষে চরম মঙ্গল হচ্ছে সেই অবস্থায় পৌঁছা যেখানে আবেগ বা নীতির দিক থেকে ঐসব চমৎকার লক্ষ্যমাত্রা তার কাছে তুচ্ছ প্রমাণিত হবে। তখন শিল্পীর কাছে শিল্পে একটি কণ্ঠ শুনতে পাওয়ার চাইতেও নীরবতাকে অধিকতর তৃপ্তিদায়ক মনে হবে। এই অর্থে নীরবতার মানে হচ্ছে বিচ্ছেদ, এবং তা চূড়ান্ত একটি মনোভাবের পরিচায়ক যা আত্মসচেতন শিল্পীর প্রথাগত অর্থে নীরবতাকে ব্যবহারের বিপরীত ধর্মী (যা ভ্যালেরী এবং রিল্কে এত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন)। নীরবতা এখানে ধ্যানের বিষয়, আত্মিক পূর্ণতার প্রস্তুতি বা কথা বলার অধিকার আদায়ের মাধ্যমে সমাপ্ত অগ্নিপরীক্ষা।
সন্টাগ যা বলতে চেয়েছেন সোজা কথায় তার অর্থ দাঁড়ায় এই : নীরবতা হচ্ছে শিল্পীর যোগাযোগ-অনীহার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। নীরবতার দ্বারা তিনি পৃথিবীর সাথে সকল সম্পর্কচ্ছেদ করেন। কারণ পৃথিবী কোনো না কোনোভাবে শিল্পের উপর কিছু শর্ত আরোপ করে, যা মেনে চলা শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়। সন্টাগের নীরবতার মতবাদ যদিও সুন্দরভাবে বর্ণিত, তথাপি একটি প্রসঙ্গ এখানে এড়িয়ে যাবার নয়। তিনি নীরবতা বলতে যা বুঝিয়েছেন তাতে শিল্পবস্তুর অন্তর্নিহিত প্রকাশ বা আন্তর প্রকাশটি ঢাকা থাকে কি করে? শিল্পী চাইলেই গ্রহীতা বা রসভোক্তা সম্পর্কচ্ছেদ করে দেবে, শিল্পবস্তু তার প্রকাশ বা সঞ্চারী ধর্মকে পরিত্যাগ করবে, একথা কি করে বলা যায়? যে উদ্দেশ্য নিয়েই শিল্পী সৃষ্টি করেন না কেন, আমরা আগেও দেখেছি, শিল্পবস্তুটি হয় উদ্দেশ্য-নিরপেক্ষ, অনপেক্ষ। তার আন্তর প্রকাশ প্রাণধারণের মতো স্বয়ংক্রিয় ব্যাপার। শিল্পী তাঁর গ্রহীতা-পরিহারের উদ্দেশ্যে অবিচল থাকলে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয় সত্য, যেমন স্যামুয়েল বেকেটের উপন্যাসসমূহে (এই ধারার একটি চমৎকার উদাহরণ জেমস জয়েসের দুরূহ এবং দুর্বোধ্য উপন্যাস “ফিনেগান্স্ ওয়েক”), কিন্তু শেষ বিচারে যখন গ্রহীতা রায় দেয়, শিল্পবস্তুটি রসোত্তীর্ণ হয়েছে, তখন এই জটিলতাটি গৌণ হয়ে পড়ে। বেকেটের নিজের লেখা থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। “ওয়েটিং ফর গডো” নাটকে স্বাভাবিক প্লট, চরিত্রায়ন, ঘটনা সৃষ্টি, ঘটনা-পরম্পরা, বাক্যালাপ ইত্যাদির কোনোটিই নেই, কাজেই নাটকটি একবার পড়লে বা মনোযোগ দিয়ে না দেখলে দুর্বোধ্য ঠেকবে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে নাটকটির ভিতরে প্রবিষ্ট হলে দেখা যাবে নাটকটি যা দিচ্ছে, তা শুধু তুচ্ছতা সবকিছুর উপর অত্যন্ত জোরালো আলো ফেলে খুঁটিয়ে দেখেছেন বেকেট, যা অন্য দশটা সফল প্রথাগত নাটকেরও উপজীব্য। তিনি সফল হয়েছেন জীবনবোধের সততার জন্য, অবলোকনের আগ্রহের জন্য, শৈল্পিক সততার জন্য। তাঁর নাটকের দর্শক থাকবে কি থাকবে না, গ্রহীতার সাথে তাঁর দেয়া-নেয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, এসব বিচার তাঁর শিল্প-প্রক্রিয়ায় কিছুটা প্রভাব ফেললেও শিল্পবস্তুটি, নাটকটি- এসব চিন্তার উর্ধ্বে।
সন্টাগের নীরবতার মতবাদটির একাংশ প্রতিষ্ঠিত- র্যাবোঁ বা দুশাম্প-এর মতো শিল্পীদের নীরবতার উপর ভিত্তি করে রচিত, যারা জীবনের এক পর্যায়ে শিল্পকে বাদ দিয়ে অন্য পেশা বা নেশাকে বেছে নিয়েছেন। এই নীরবতা তাঁর মতে তাঁদের শিল্পকে নাকচ করে না, বরং সময় বিচারে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়। তা সত্ত্বেও, তাদের নীরবতা, যে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ভূত, ক্লাইস্ট বা লত্রেমোঁর উদাহরণ দিয়ে তিনি তা পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন (ক্লাইস্ট ও লত্রেমোঁ আত্মহত্যা করেছিলেন)। কিন্তু কোনো শিল্পী জীবনের কোনো এক সময় স্বেচ্ছানির্বাসন বা নীরবতা বেছে নিলেই শিল্পের প্রকাশ বন্ধ হবে, একথা সন্টাগ নিজেও বলেন নি। আর শিল্পকর্মে নীরবতা সৃষ্টি একটি হেত্বাভাসের কথা। শিল্পী কেইজ বলেছেন, “নীরবতা বলে কিছু নেই, কিছু না কিছু সব সময় ঘটছে, যা শব্দ সৃষ্টি করে।” শুদ্ধ নীরবতা বলে কিছু নেই।
এই বিতর্কের অভ্যন্তরে না গিয়েও আমরা বলতে পারি, শিল্পের নীরবতাও এক ধরনের প্রকাশ। কথায় বলে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। শিল্পের ক্ষেত্রে এই সম্মতি শিল্পের প্রতি, জীবনের প্রতি। শিল্পমাত্রই জীবনের প্রতি কোনো না কোনোভাবে বিশ্বস্ত। তাঁর বিষয়, ভাবনা, চিন্তা, প্রকাশ সব কিছুতে জীবনের স্পর্শ থাকবে; জীবন-বিমুখ বা জীবন-নিরপেক্ষ শিল্পী যদি আদৌ কেউ থাকেন, তিনি এক অত্যাশ্চর্য শূন্যতা বা vacuum-এ বেঁচে থাকেন। তেমন কেউ কি সত্যি আছেন?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন