শিল্পে রূপ ও রস

শিল্পের প্রকাশ রূপ ও রসভিত্তিক । শিল্পীকে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার শুরুতে দু’টি বিষয়ে সজাগ থাকতে হয়; একটি হচ্ছে রূপ বা form এবং অন্যটি বিষয় বা আরাধ্য- content । এ দুয়ের সম্মিলনে শিল্প সৃষ্টি হয়। কিন্তু সৃষ্ট বস্তু যদি গ্রহীতার মনে রসের সঞ্চার করতে না পারে, যদি সে পরিশীলিতভাবে রস পরিবেশন করে গ্রহীতাকে আনন্দ দিতে না পারে তবে শিল্প হিসেবে তার সার্থকতা থাকবে না। দর্শনে রূপ ও অরূপে যে দ্বন্দ্ব আছে, শিল্পেও তেমনি আছে ৷ রূপের ভিতর দিয়ে অরূপের প্রকাশ, কিন্তু সে পর্যায়ে যেতে হলে শিল্পবস্তুকে প্রথমে রূপকে আয়ত্ত করতে হবে, রূপের সফল প্রকাশকে ধারণ করতে হবে । রূপ যে শুধু form তা-ই নয়, রূপ বলতে কাঠামো, সারবত্তা, শৈলী, সামান্যধর্ম, নক্সা, নৈপুণ্য- সবই বোঝায়, আবার সাধারণ অর্থে লাবণ্য ও কমনীয়তাকেও বোঝায় । সৃষ্ট বস্তুতে সৌন্দর্য প্রকাশিত হলে যেমন তা রূপময় হয়েছে বলা যায়, ঐ বস্তুটি কোনো বিশেষ form গ্রহণ করলেও তা শিল্পরূপ অর্জন করেছে একথা বলা চলে । শিল্পীর উদ্দেশ্য রূপসৃষ্টি- মানসজগতের, কল্পনার, আরাধ্য বস্তুর, অরূপের । রূপের সাধনা তাই শুদ্ধ শিল্পের অন্যতম লক্ষণ ।

রূপকে আমরা বস্তুভিত্তিক মনে করি, এবং রূপের বস্তু-বহির্গত কোনো সত্তা আছে একথা সহজে মেনে নিতে পারি না । কিন্তু প্লেটোর মতো দার্শনিক যখন বলেন, রূপের একটি নিজস্ব পরিচয় আছে, যা নির্বস্তুক, বা শুদ্ধ, তখন ধরে নিতে হয় বস্তুর আপাতপ্রকাশিত রূপের আড়ালেও একটি রূপ আছে, যাকে আমরা চূড়ান্ত রূপ বা শুদ্ধ রূপ বলতে পারি । প্লেটো একে বলেছেন archetype, অর্থাৎ যে আদর্শ রূপের অনুকরণে বস্তু ইন্দ্রিয়গোচর পৃথিবীতে দৃশ্যমানতা লাভ করে, অন্যদিকে ক্রোচে বলেছেন, নান্দনিক সত্যটি হলো রূপনির্ভর, এবং শুধুমাত্র রূপনির্ভর । যে কবি বা চিত্রীতে রূপের অভাব আছে, তার সব কিছুরই অভাব; কারণ তিনি নিজেই তখন অপ্রতুল । শুধুমাত্র প্রকাশ, অর্থাৎ রূপ, কবিকে সৃষ্টি করে । এই কথায় বিষয় বা বস্তু (form)-কে অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তা তাঁর অনেক পূর্বসূরীদের মধ্যেও লক্ষণীয়। রূপ সম্বন্ধে ক্রোচের মন্তব্যে অবশ্য স্ববিরোধ দেখা যায়, যেমন তিনি একস্থানে রূপকে ধ্রুব বা constant বলেছেন, অন্যস্থানে বলেছেন রূপ আধ্যাত্মিক প্রকাশ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি রূপকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ১৯২০-এর দশকে রূপদৰ্শনকে ভিত্তি করে যে রূপবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়- যার প্রবক্তা ছিলেন ভিক্টর শক্লোভস্কি, বরিস আইকেনবম,য়্যুরী তিনইয়ানভ প্রমুখ- তাতে শিল্পের সামাজিক দিকটিকে তার নান্দনিক দিকের অধীনস্থ করা হয়; কারণ বিষয় অপেক্ষা রূপের প্রাধান্য ছিলো এই আন্দোলনে অধিক। তাছাড়া কিউবিজম, সুপারমাটিজম, নব্যস্থানুবাদ, ভবিষ্যৎবাদ ইত্যাদি আন্দোলনের যোগসূত্রও ছিলো রূপের একাধিপত্যে। এদের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল শুদ্ধ রূপের শিল্প সৃষ্টি করা।

রূপাম্বেষণে যে প্রধান সমস্যা, সে হলো এই জটিল প্রশ্নটি : বস্তু-বহির্ভূত রূপের স্বরূপ কি? শুদ্ধ রূপ বলতে কি বোঝায় বা শুদ্ধ রূপের অভিজ্ঞতা সম্ভব কিনা। এর উত্তর দেয়া সম্ভব তখনি যখন রূপের একটি চলনসই সংজ্ঞা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করব। আমরা দেখেছি, রূপ বলতে সৃষ্ট বস্তুর আকার বা প্রকাশ অথবা এর essence বা সারধর্ম সবই বোঝায়, কিন্তু তা স্থান, কাল বা পাত্রনির্ভর নয়। শিল্পী যখন সৃষ্টি করেন, তাঁর মনে তাঁর আরাধ্যবস্তুর একটি অন্তঃস্থিত রূপ এবং একটি প্রকাশ-রূপ আপনা থেকেই এসে যায়, এবং তাদের বাজময় করাই তাঁর উদ্দেশ্য। অর্থাৎ শিল্পী একটি চিত্র, একটি ধারণা বা আবছায়া একটি ভাবনাকে মূর্ত করতে গিয়ে যে মূর্তিটি আবিষ্কার করেন তা-ই রূপ। এ মূর্তিটি শিল্পীর অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তুর সবচেয়ে আরাধ্য রূপ, এর বাইরে যাওয়া সম্ভব হলে শিল্পী অবশ্যই যেতেন। কিন্তু এই মূর্তিটি তাঁর আদর্শ কল্পমূর্তির একটি প্রতিরূপ মাত্র। শিল্পী কল্পনার যে বাস্তবতাকে প্রতিস্থাপিত করতে চান তাঁর কাজে, এ তারই একটি অর্জিত রূপ। রূপ বলতে তাই সৃষ্টির দু’টি প্রকাশই বোঝায়-অর্জিত এবং ধ্রুব। ধ্রুব রূপ বা শুদ্ধ রূপকে ভারতীয় দর্শনে অরূপ আখ্যা দেয়া হয়েছে; এবং শিল্পীর আজীবন সাধনা সেই অরূপের সন্ধান। কবির ভাষায় :

রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সৌন্দর্য হচ্ছে রূপের টুথ- রূপের সত্য। সুন্দরের সাধনা তাই অরূপের সাধনা, শুদ্ধ রূপের, রূপের অন্তরালবর্তী সত্যের। কিন্তু নন্দনতত্ত্বে এই শুদ্ধ রূপের অম্বেষণ ইন্দ্ৰিয়জ অনুভূতির মধ্য দিয়ে, ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে, তাকে পাশ কাটিয়ে নয়। এখানেই রসের প্রসঙ্গটি আসে। কারণ রস বিশেষভাবে ইন্দ্রিয়নির্ভর। রস হচ্ছে সুন্দরের appreciation । আবার সৌন্দর্যবোধের জন্য মানুষের রসবৃত্তির স্ফুরণ ঘটে। সংস্কৃত দর্শনের মতে এই রসবৃত্তি মানুষের দৃষ্টি ও চিত্তের পবিত্রতা ও শুদ্ধতা নিশ্চিত করে। ‘সাহিত্য দর্পণে’ এই কথাটি বিশেষ জোরের সাথে উল্লেখ করেছেন বিশ্বনাথ ।

রূপ ও অরূপের দ্বৈত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রূপের দ্বৈতেও প্রকাশ করা যায়। প্রত্যক্ষ রূপ বস্তুভিত্তিক, পরোক্ষ রূপ কল্পনানির্ভর। নন্দনতত্ত্বে প্রত্যক্ষ রূপের প্রভাবই বেশি, যে রূপ আভাসমাত্র, যে রূপ প্রকৃতপক্ষে নৈর্বস্তুক এবং অরূপ, তাকে দর্শনেই চাওয়া হয়েছে বেশি। তাই বলে শিল্পে তার কমতি নেই। প্লেটো কথিত archetype-এর সাথে পরোক্ষ রূপ অথবা শুদ্ধ রূপের কিছুটা প্রভেদ আছে। Archetype-এর সাথে বস্তুর ঘনিষ্ঠ মিল, বলা যায় বস্তু archetype-এর একটি দূরবর্তী কিন্তু সত্যনিষ্ঠ রূপ। কিন্তু শুদ্ধ রূপের সাথে বস্তুর প্রত্যক্ষ রূপের আদৌ কোনো মিল আছে কিনা, শিল্পীও জানেন না। বস্তুর অতীত রূপ কি জিনিস এ নিয়ে গবেষণা চলতে পারে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে কেউ কিছু বলতে পারবে না,কারণ কেউ কোনোদিন তা প্রত্যক্ষ করে নি। আমরা সেই শুদ্ধ রূপকে যতই ধ্রুব বলি, এর যত প্রকাশই আমরা আবিষ্কার করি, একে পরিপূর্ণভাবে চেনা কোনোদিন সম্ভব নয়। তাই এই রূপের একটি ধারণা দেয়া যায় প্রতীকের মাধ্যমে। প্রতীকের একটি সুবিধা আছে এই যে, তা কোনো ধারণা বা বোধের প্রতিভূ হলেও সত্যিকার অর্থে তার সাথে প্রতীকটির আদৌ কোনো সাজুয্য না-ও থাকতে পারে। বিশেষ করে বিমূর্ত ধারণার মূর্ত কোনো প্রতীক একেবারেই আলাদা হতে পারে বিষয় থেকে, তবুও প্রতীকের বৈধতা থাকবে যদি তা গ্রহণযোগ্য হয়, রূপ বা form-ও অনেক সময় প্রতীকধর্মী হয়।

রূপের গুরুত্ব নিয়ে প্লেটো থেকে অনেকেই বলে এসেছেন। বিষয়বস্তুর পরিচয় নির্ভর করে রূপের ওপর। শিল্পের সকল শাখায় এমনটি দেখা গেছে, এমন কি সঙ্গীতেও। কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক অরুণ ভট্টাচার্যের মতে “সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমরা কর্ম বা গঠনশৈলী বলতে প্রাচীনকালে ধ্রুবাগীতি বা প্রবন্ধসঙ্গীত, মধ্যযুগে ধ্রুবপদ বা খেয়াল এবং বর্তমানকালে আরও নানাবিধ রূপ দেখতে পাচ্ছি। ধাতু, বর্ণ, তাল, পদ ইত্যাদি সহযোগে গীতরূপের বর্ণনা প্রাচীনকাল থেকে এ পর্যন্ত চলে আসছে। ধ্ৰুপদের বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমরা যেমন একটি সুষম সংযম-এর বিষয় জানতে পারছি তেমনি সুপ্রাচীনকালে মার্গগীতির রূপেও স্বরতাল পদাশ্রিত গীতির বর্ণনা আমাদের এক নিশ্চিত প্রত্যয়ে নিয়ে যায়।”

রূপাম্বেষণের প্রথম পর্যায়ে কল্পনার একটি বিশেষ অবদান আছে, তেমনি এক পর্যায়ে বিচার বিশ্লেষণও প্রয়োজন। শিল্পী দৃশ্যমান ও অদৃশ্য উভয় জগতের রূপকার, কিন্তু তিনি যেমন দৃশ্যমান জগৎকে শুধু copy বা অনুকরণ করেন না, তেমনি অদৃশ্য জগতের কোনো প্রথানির্ভর রূপ গ্রহণ করে তৃপ্ত থাকেন না। এককালে ইউরোপে নিসর্গ চিত্র যখন খুব চালু ছিলো, সবার ধারণা ছিলো তা যখন natural বা সহজ, অনুকরণ হবে ততই ভালো। কিন্তু শিল্পীর কল্পনা রূপকে নির্ধারিত করে, তাই একই স্কুলের দুজন নিসর্গ-চিত্রীর কাজেও দুরকমের প্রকাশ দেখা যায়; কারণ প্রথা এক হলেও শিল্পীর কল্পনা ভিন্ন; সেই অনুকরণের দিন যখন গেলো, প্রকাশবাদ বা প্রভাববাদের ধারায় যখন নিসর্গ বাইরের আবরণ ফেলে অনুভবের পর্যায়ে চলে গেলো, তখন এর রূপ বদল হলো। অতঃপর বিমূর্তনের যুগে, কিউবিজমের যুগে এর রূপ হয়ে উঠলো শিল্পীর একান্ত অনুধাবনের ব্যাপার। রূপকে প্রথাগতভাবে দেখার প্রচেষ্টা থেকে তার ভাঙচুর পর্যন্ত নানাভাবে রূপচিন্তার বিবর্তন হয়েছে, উত্তরণ ঘটেছে। আধুনিক কবিতায় আমরা এই রূপচিন্তার বিবর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়কে পাই। এলিয়ট যখন প্রুফুকের জীবনকে দেখেন এভাবে:

…as if a magic lantern threw the nerves in patterns on a screen

তিনি আধুনিক কবিতার রূপাম্বেষণকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাও করেন। এই magic lanternটি শিল্পীর কল্পনা, অনুভব, প্রজ্ঞা ও প্রতিভার সম্মিলিত উৎস, যা থেকে রূপনির্দেশক সৃষ্টিধারাটি নেমে আসে।

রূপের মধ্য দিয়ে অরূপের উন্মোচন একটি আধা-শৈল্পিক, আধা-দার্শনিক প্রক্রিয়া; তবে এই সাধনা শিল্পীর হলে তাতে অধ্যাত্ম চিন্তার একটি সুস্পষ্ট ছাপ থাকে। বাউল ও মরমী সঙ্গীতে যে অরূপের সন্ধান করেন শিল্পী, তা অনেক সময় দেহের অর্থাৎ রূপের ভিতর দিয়ে। হাছন রাজার গানে আছে :

রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।

আমার মাঝত বাহির হইয়া, দেখা দিল মোরে ।।

দেখা দিয়া প্রাণ লইয়া, সামাইল ভিতরে।

আদম ছুরত দেখা দিল, ধরিয়া আমারে।।

আয়নার মধ্যে যেমন মুখ দেখা যায়।

সেই মতে আমার রূপে, দেখা দিল আমায়৷

রূপ বলতে যে অরূপের সৌন্দর্যভিত্তিক প্রকাশের কথা বলেছেন হাছন রাজা, তা সকল মরমী কবিতার উদ্দিষ্ট। লক্ষণীয়, কবির প্রত্যাদেশ স্বরূপ-ভিত্তিক; কারণ কল্পনা যা সহজ ও সুলভ তার উপর নির্ভর করে দুরূহ ও দুর্লভের দিকে যাত্রা করে। রূপবাদী আন্দোলনেই হোক, ক্রোচের সৌন্দর্যদর্শনেই হোক, আর হাছন রাজার অধ্যাত্মচিন্তায় হোক, রূপসৃষ্টি ক্ষুদ্রের সঙ্গে বৃহতের সাম্ভের সঙ্গে অনন্তের, একের সঙ্গে বহুর একটি যোগসূত্র রচনা করে। Form বা রূপ যে বিষয়কে ধারণ করে তা-ই নয়, কবির জীবনাদর্শের একটি মূর্ত প্রকাশ ঘটে এর শক্তিশালী ব্যবহারের মাধ্যমে।

একটি শিল্পবস্তু থেকে আমরা কেন আনন্দ পাই? এর উত্তর অবশ্যই এক কথায় দেয়া যাবে না, কারণ এতে শিল্পগ্রহীতার ব্যক্তিত্ব, রুচি, সংস্কৃতি ইত্যাদির ব্যাপার আছে। তবুও মোটামুটিভাবে বলা যায় শিল্প-কর্মে যখন রূপ ও রূপাশ্রয়ী অন্যান্য সম্পর্কসমূহ সমন্বিত হয় তখনি রসের সঞ্চার হয় এবং আমরা নান্দনিক আনন্দ লাভ করি। নান্দনিক আনন্দ ও অভিজ্ঞতার পেছনে শিল্পবস্তুর একটি বিশেষ সাধারণ রূপ কাজ করে, যা সকল দৃশ্যমান শিল্পকর্মের অভিন্ন গুণ। এই রূপটিকে নন্দনতাত্ত্বিক ক্লাইভ বেল বলেছেন Significant form বা অর্থময় রূপ। ক্লাইভ বেলের মতে অর্থময় রূপ বস্তুনির্ভর নয়। অথচ বস্তুকে তা উজ্জীবিত করে। বিভিন্ন শিল্পী নিজস্ব উপায়ে এই রূপের সন্ধান করেন। রোজার ফ্রাই বলেন, এই শুদ্ধরূপের পরিপূর্ণ অনুধাবণ কারো পক্ষের সম্ভব নয়। শিল্পী শুধু তাকে অনুভব করতে পারেন, অবিকলভাবে প্রকাশ করতে পারেন না।

রূপ নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে- প্লেটো থেকে জেন্তিল পর্যন্ত তাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রধান হয়েছে। কিন্তু এই গবেষণার ফলে রূপকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আধুনিক শিল্প প্রবক্তারা এমন কথাও বলেছেন যে রূপই হচ্ছে শিল্পকৌশল, অর্থাৎ শিল্পকৌশলের পরিচয় শিল্পবস্তুর অর্জিত রূপটি। ভারতে হাজার বছরেরও আগে অলংকারবিদ বামন বাব্যকে এই প্রকাশশৈলি বা শিল্পকৌশল দ্বারা চিহ্নিত করেছিলেন, বলেছিলেন “রীতিরাত্মা কাব্যস্য।” রীতি দ্বারা তিনি রূপ সন্ধানের প্রক্রিয়াটি বোঝাতে চাচ্ছিলেন, যার যাত্রা বিষয়ের ভিতর দিয়েও। রূপকে অনেক প্রবক্তা বলেছেন প্রকাশ, দেহশ্ৰয়ী সুন্দর এবং সত্যনির্ভর প্রতীক যেভাবেই দেখা হোক, রূপ শিল্পপ্রক্রিয়ার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। কিন্তু শিল্প শুধু রূপভিত্তিক বা রসসন্ধানী, এমন কথা বললে বিষয়কে নস্যাৎ করে দেয়া হয়। অথচ বিষয়ের একটি মাত্রা তো থাকবেই। শেষ বিচারে একথা নিশ্চয় বলা যায়, রূপ বিষয়াশ্রয়ী না বিষয়- রূপাশ্রয়ী এ দ্বন্দ্ব অপ্রয়োজনীয়। কারণ বস্তুর নিহিত সত্তাটি রূপেই উদ্ভাসিত; রূপ ছাড়া বিষয়কে কল্পনা করা কঠিন। আবার রূপে যে বিষয়ের প্রভাব নেই, তা-ও বলা যায় না। সঙ্গীতের রূপ আর ভাস্কর্যের রূপ কি এক? তবে আমরা যদি বিশুদ্ধ রূপের কথা বলি, যা রোজার ফ্রাইয়ের মতে অনর্জনীয়, তাহলে সেই রূপ যেমন বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে যায়, তেমনি প্রচলিত রূপ-ধারণাকেও অকিঞ্চিৎকর করে ফেলে। আধুনিক কালে উপরোক্ত দুটি মতবাদই চালু– এদের একটি বস্তুনিষ্ঠ সংশ্লেষণের প্রয়োজন। তা না হলে নন্দনতত্ত্বে খট্‌কা লাগানোর মতো অনেক প্রসঙ্গ থেকেই যাবে।

রূপের আলোচনায় আসে রসের কথা। রস কি? শিল্পবস্তু রূপাশ্রয়ী হলেও শিল্পপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলা যায় না, যদি না তা শিল্পগ্রহিতার মনে রসের সঞ্চার করে। রস হচ্ছে গ্রহণের তৃপ্তি, পুলক, ইন্দ্রিয়োপলব্ধি। এই রসভার সুখের অভিজ্ঞতা থেকে হতে পারে, দুঃখের অভিজ্ঞতা থেকেও উৎপন্ন হতে পারে। কথাটিতে যে একটু কুটাভাস আছে তার কারণ সাধারণ অর্থে আমরা রসকে আনন্দানুভূতির সমার্থক মনে করি। কিন্তু যে সূক্ষ্ম নান্দনিক পুলক আমরা রসের সুখময় গ্রহণ থেকে পাই, তা রসের দুঃখময় গ্রহণ থেকেও পাই। রস হচ্ছে ইন্দ্ৰিয়সচেতন মনের একটি অনির্বচনীয় ভাব। করুণ রসের যে ভাব, তার সাথে অ্যারিস্টটল কথিত Cathersis বা আবেগমোক্ষণের মিল আছে; অথবা বলা যায় শুদ্ধ করুণ রসের উৎপত্তি আবেগমোক্ষণ বা বিরেচনের মাধ্যমে। আবেগমোক্ষণ হচ্ছে একটি শুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। ইন্দ্ৰিয়সচেতন মনের একটি স্থিতাবস্থা অর্জনের মাধ্যমে দুঃখবোধের অতীন্দ্রিয়লোকে উত্তরণ ঘটে যে প্রক্রিয়ায়, তাই হল Cathersis । এ একটি শুদ্ধ মানসিক অবস্থা; এ অবস্থায় দুঃখের ইন্দ্রিয়ভিত্তিক প্রকাশ প্রাবল্য হারায় এবং পরিণত হয় এক নির্বিশেষ ভাবানুভূতিতে। ভারতীয় শাস্ত্রে বর্ণিত করুণ রসও রসভোক্তার মনে একটি নির্বিশেষ পুলকবোধের জন্ম দেয়, যার ফলে দুঃখের সারধর্মটি এর যে কোনো বিশেষ বা ইন্দ্রিয়ভিত্তিক প্রকাশ থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায়। যে পুলকের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা ইন্দ্ৰিয়াতীত। ট্রাজিক সমুন্নতি ঘটে যে সব এ চরিত্রে- হ্যামলেট বা করিওলেনাসে- সেখানে এই পুলক তাদের সমুন্নতির পরিপূরক। হ্যামলেটের জাগতিক ট্রাজেডি বড় হয়ে দেখা দেয় না ঐ নাটকে তার সমুন্নতি ও ব্যক্তিক মহিমা বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই সমুন্নতি ও মহিমা তাকে বৃহৎ করে, আবেগমোক্ষণ পরবর্তী রসাস্বাদনে পুলকের সঞ্চার করে।

ভারতীয় শাস্ত্রে একটি প্রাচীন শ্লোক আছে যার অর্থ হলো কাব্যে যে জগৎ উপস্থিত, তা হলো রসময় (অগ্নিপুরাণ)। শুদ্ধ রসাভাস, শুদ্ধ রূপাভাসের মত, কাব্যের এবং বড় অর্থে শিল্পের, অম্বিষ্ট। রস অর্থাৎ গ্রহীতার মনে শিল্পবস্তু আনন্দভাব সঞ্চারের মধ্যে যে ভাব সৃষ্টি করে তা শিল্পের একটি বিশিষ্ট উপাদান। ভারতীয় শাস্ত্রে অনেক প্রকার রসের সন্ধান পাওয়া যায়। আচার্য ভরত যে আটটি রসের কথা বলেছেন শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস এবং অদ্ভুত— তা প্রধানত নাট্যশাস্ত্রভিত্তিক; কিন্তু এদের প্রয়োগ সামগ্রিকভাবে শিল্পের সর্বাঙ্গে। এইসব বিভিন্ন রসের সৃষ্টি হয় বিশেষ বিশেষ ভাব সৃষ্টির মাধ্যমে। শিল্পে শৃঙ্গারের ভাব সঞ্চারিত হলে গ্রহীতার মনে যথামাত্রা ঐ ভাবের উদয় হবে এবং তিনি শিল্পবস্তুর রসাস্বাদন করবেন। কিন্তু প্রকাশিত রস মাত্রই শিল্পে বা শিল্পরসিকের মনে সঞ্চারিত হবে এমন কোনো কথা নেই। এ জন্য প্রয়োজন প্রতিভা, অভিজ্ঞতা, রসাস্বাদনের প্রস্তুতি। অর্থাৎ রূপসৃষ্টির মত রসসৃষ্টি শিল্পের উদ্দেশ্য হলেও রস যেহেতু রূপ অপেক্ষা অধিক মাত্রায় দেহনির্ভর, সেজন্য রসসঞ্চার প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি ব্যক্তিনির্ভর। শিল্পীর পরিমিতিবোধে সামান্য ফাটল দেখা দিলে বা শিল্পরসিকের রুচির সামান্য স্খলন হলে রস সঠিক মাত্রায় পরিবেশিত হতে পারে না। এ জন্য কাব্যে ও নাটকে ট্রাজেডি ও melodrama-র পার্থক্য টানা হয়। ট্রাজেডিতে করুণ রসের আধিক্য হলে আবেগমোক্ষণ প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হয়, ট্রাজেডি পরিণত হয় মেলোড্রামাতে। ড্রাইডেনের ক্লিওপেট্টা-বিষয়ক নাটক All For Love ও শেক্‌সপিয়রের Antony and Cleopetra পাশাপাশি রেখে পড়লে দেখা যাবে শেক্‌সপিয়রের হাতে করুণ রস যেখানে তার ভাবের কাছে বিশ্বস্ত, সেখানে ড্রাইডেনের নাটকে করুণ রস মূল আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন, অযৌক্তিকভাবে বিস্তৃত ও ফলত বিরক্তিকর। একই ভাবে পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ এবং গয়ার ‘মাদ্রিদের নাগরিকদের হত্যা’ চিত্রগুলি দর্শককে আলোড়িত করে যে রসের সঞ্চার করে তার সাথে যুদ্ধের চিত্রের পার্থক্য আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কিছু চিত্র অত্যন্ত মাধ্যমে নয়, তথ্যের ভিত্তিতে। পিকাসো বা গয়ার হাতে বিষয়টি রসসৃষ্টির পর্যায়ে গিয়েছে, করুণ রসের ক্ষণিক উদঘাটনে একটি অনুভূতির চিরায়ত প্রকাশ ঘটেছে। আমরা বিষয়ের সঙ্গে একান্ত হই, বিরেচিত হই, রসের শুদ্ধ রূপটি অম্বেষণ করি।

ভাবের রূপভেদে চারটি বিশেস রসের কথা বলা হয়েছে “ভক্তিরসামৃতসিন্ধু” গ্রন্থে,

যার রচয়িতা শ্রীরূপ গোস্বামী। এগুলো হচ্ছে শান্ত, দাস্য, সখ্য ও বাৎসল্য রস। শান্ত রসের সাথে আনন্দের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, আবার বাৎসাল্য রস একটি তৃপ্তিকর পুলকের বিষয়। লক্ষণীয় যে, রসের এই চতুর্বিভক্তি ভাবভিত্তিক, অর্থাৎ মনের একটি অবস্থাকে আশ্রয় করে একটি রসের সঞ্চার হয় এবং এই রসের প্রকাশ শিল্পে ও শিল্পরসিকের মনে সমান দ্যোতনার সৃষ্টি করতে পারে। ভরতমুনির মতে রস বিষয়টি অর্থের উপর নির্ভরশীল। যে কোনো শিল্পবস্তু অর্থবহ হয় রসের বিচারে। সুধীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে বুঝতে না পারলে বা পল ক্লীর একটি ছবি দেখে বুঝতে না পারলে রসাস্বাদন অপূর্ণ থেকে যাবে। ফৈয়াজ খাঁর খেয়াল শুনে যদি এর গূঢ়ার্থ হৃদয়ঙ্গম করা না যায়, তাহলে ধ্বনি-সামঞ্জস্য ও গলার কারুকাজে কিছুটা নান্দনিক তৃপ্তি হয়তো আসবে, পুরোটা আসবে না। শিল্পকে অর্থবহ করে তুলতে শিল্পীরা নিরন্তর সাধ্য-সাধনা করছেন; কিন্তু অর্থ যে শিল্পবস্তুর বহিরাঙ্গে থাকবে একথা কোনো শিল্পীই বিশ্বাস করবেন না। এজন্য আধুনিক শিল্পের রসাস্বাদনের জন্য অনেক বেশি মাত্রায় শিল্প-অভিজ্ঞ হতে হয়; অর্থ আবিষ্কারের পস্থাটি হয় দুরূহ, কিন্তু একবার শিল্পের গৃঢ়াৰ্থ উপলব্ধি করতে পারলে রসের আস্বাদন হয় তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতার বিষয়।

প্রাচীন সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের একটি অভিমত, যে রসের প্রমাণ হচ্ছে রসভোগে, সকর শিল্পবিচারের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায়। রসের দুই পর্যায় ভট্টনায়ক সনাক্ত করেছেন রসের ভাবনা ও রসের বোধ বলে। রসের ভাবনা বা অনুভব শিল্পচিন্তার সঙ্গে সমান্তরাল। শিল্পচিন্তার ভিত্তি রসনির্ভর ময়, কিন্তু এর প্রকাশ রসাসিক্ত হতে হবে। শিল্পবস্তুতে সঞ্চারিত রস শিল্পগ্রহীতার ভোগের বিষয়। এই ভোগ পরিশীলিত ও উন্নত রুচির গ্রহীতার ক্ষেত্রে নান্দনিক আনন্দের সৃষ্টি করে। এভাবেই প্রাচীন সংস্কৃত আলঙ্কারিকরা রসভাবনা ও রসবোধকে একটি পরস্পর সংযুক্ত সৌন্দর্যক্রিয়া বলে অভিহিত করেছেন।

রস ও রূপের সমবায়ী সম্পর্ক শিল্পসৃষ্টির, বা বড় অর্থে সৃজনশীলতার পরিচায়ক। রূপ রসের বাহন, রস রূপের প্রাণ; একটি ছাড়া অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। যে রস রূপভিত্তিক নয়, তা নান্দনিক হতে পারে না। অনেকে বলে থাকেন, রসে কল্পনার স্থান থাকলেও চিন্তার স্থান নেই, কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। রসের আস্বাদন শুধু ঐন্দ্রয়িক নয়, বৌদ্ধিকও বটে। সকল শিল্পবস্তুর আনুগুণ্য বা পরস্পরা সম্পর্ক সহজেই চোখে পড়ে না; কল্পনা বা চিন্তার সাহায্যে তার সন্ধান মেলে। ধরা যাক মার্ক শাগালের চিত্রকর্ম। শাগালের সম্পূর্ণ পরিচয়, তাঁর কাল, ব্যক্তিক অবস্থান ইত্যাদি না জানলে যে-সব পৌনঃপুনিক প্রতীক তিনি ব্যবহার করেছেন, সব কটির সন্ধান পাওয়া যাবে না। শাগালের অবস্থানকে চিনতে গেলে প্রথমত প্রয়োজন তথ্যের : তাকে তাঁর শিল্পকর্মের প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে প্রয়োজন বুদ্ধির, বিশ্লেষণী মনোভাবের। রসের ভাবনাতে চিন্তার প্রয়োজন, যেমন প্রয়োজন রূপের উপলব্ধিতে ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন