হৃদয়ের সঙ্গে যোগ

শিল্পের যে লক্ষণ সর্বযুগে ও সর্বকালে শিল্পী ও শিল্পগ্রহীতা স্বীকার করে নিয়েছেন, তা হলো সুন্দর ও সত্যের অম্বেষা, অজানা ও অচেনাকে হৃদয়ে ধারণ করে জগৎকে তা উপহার দেয়া, মানুষের মহত্ত্বকে, জীবনের মহিমাকে প্রতিষ্ঠিত করা। শিল্পের বিষয়ের দিক আছে, আবার প্রকাশের দিক আছে। যুগের প্রয়োজনে কখনো শিল্প হয়েছে বিষয়নির্ভর, কখনো প্রকাশনির্ভর। কিন্তু শিল্প যেহেতু মানুষের তৈরি, এবং কোনো জীবিকার তাগিদে মানুষ শিল্প সৃষ্টি করে না (এ প্রসঙ্গে আমরা কারু ও চারুশিল্পের তফাৎ নির্ণয় করেছি) তাই শিল্পের উদ্দেশ্য যাই হোক, তা এর সার্বিক চরিত্রের একটি অংশ। এজন্য বিষয় প্রকাশের দ্বন্দ্বে শিল্পের প্রকৃত চরিত্রটি কখনো বদল হয় নি। মানুষ যখন তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীর বস্তুকে বুঝতে শিখলো, বস্তুর আকৃতি, ভর ও উপরিভাগের সাথে তার ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করলো, দেখা গেলো এর রূপটি ধারণ করার জন্য সে একপ্রকার তাগিদ অনুভব করছে। শিল্পী সে, যার রূপায়ণে বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আবেদনটি খর্ব হয় না। বস্তুর রূপের ধ্যানে একটি সুখবোধের সন্ধান মেলে। যে এই সুখবোধটি গ্রহীতাকে দিতে পারলো না, সে শিল্পী হিসেবে সার্থক হলো না। এভাবে শিল্পের জন্ম। বাহ্য পৃথিবীকে চিত্তের পুলক ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনুভব করে শিল্পবস্তুতে রূপদান করা শিল্পীর প্রাথমিক কাজ; আবার বাহ্যিক পৃথিবীর অতীত ভাবের রাজ্য থেকেও এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হতে পারে। ভাবকে ভাষা দেয়া, রূপ দেয়া শিল্পীর ব্রত। বাস্তবতাকে মনের আয়নায় নানাভাবে প্রতিফলিত করে শিল্পবস্তুতে এর একটি সপ্রাণ সারাৎসার তৈরি করাও শিল্পীর উদ্দিষ্ট। যেভাবেই হোক অন্তরের সঙ্গে বাইরের, সময়ের সাথে সময়হীনের, অনন্তের সঙ্গে সান্তের একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয় শিল্পে। এই সম্পর্কটি যে সব সময় সহজবোধ্য তা নয়, অনেক সময় অত্যন্ত রহস্যময় হয়ে ওঠে তা । কিন্তু গ্রহীতার কাছে এই রহস্যটি আত্মিক পুলক দেয়, চিন্তার খোরাক দেয়। রূপ ও সৌন্দর্য, ভাব ও বেদনা, সত্য ও নিত্যকে উপলব্ধি করার সাথে সাথে এই যে আধ্যাত্মিক পুলক-আনন্দ, এর সংমিশ্রণে জন্ম নেয় নান্দনিক তৃপ্তির, জন্ম হয় সার্থক শিল্পের।

নন্দনতত্ত্বে একদিকে যেমন তত্ত্বের একটা স্থান আছে- যতই গৌণ হোক তা অন্যদিকে আছে শিল্পবিচার ও রসগ্রহণের প্রসঙ্গ। তবে এমন কথা কেউ বলবে না যে সৃষ্টিকে কোনো তত্ত্বের অধিগত হতে হবে, মার্ক্সবাদও এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য আরোপ করে নি শিল্পের উপর। নন্দনতত্ত্বে শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা প্রথমেই স্বীকৃত, এবং কোনো বিশেষ শিল্পরীতি বা আন্দোলন অন্য কোনো শিল্পরীতি বা আন্দোলন থেকে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট, এ ধরনের কোনো মূল্যবিচারও তাতে নেই। শিল্পবস্তু তার নিজস্ব আকাঙ্ক্ষায় ও প্রেক্ষিতে কতখানি সফল বা অসফল, এই বিচার চলতে পারে, কিন্তু তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব বিচার ও শাস্ত্রের উপজীব্য নয়।

জৈবিক প্রয়োজনে মানুষ যা সৃষ্টি করে, তার প্রাথমিক রূপটি খুব সরল। গৃহের প্রয়োজন হয় প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য- এর মূল রূপ সর্বত্রই সরল। এই গৃহ যখন জৈবিক প্রয়োজন মিটিয়ে মানুষের সৌন্দর্যবোধ বা রুচিবোধকে পরিতৃপ্ত করতে যায়, এর রূপ হয় ভিন্ন। এই পরিশীলিত রূপসৃষ্টি শিল্পের কাজ- স্থাপত্যকলার এজন্যই উদ্ভব। একবার এই সৌন্দর্য বা রুচির প্রয়োজন মেটানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে এর আর শেষ হয় না- কারণ মানুষের রুচি বা সৌন্দর্যবোধ কোনো নির্ধারিত বস্তু নয়। পৃথিবীতে যত মানুষ তত তার ভিন্ন প্রকাশ। শিল্পের এই বহুবিস্তৃত প্রেক্ষাপট থাকায় এর এক বিশালতা আছে, ব্যাপ্তি-গভীরতা আছে। কোনো বিশেষ আলোচনায় শিল্পের স্বরূপ উদঘাটন অসম্ভব ব্যাপার, কোনো দার্শনিক, শিল্পী চিন্তাবিদ্‌ শিল্প সম্বন্ধে শেষ কথা কোনোদিনই বলতে পারবেন না। এজন্য নন্দনতত্ত্ব প্রাচীন শাস্ত্র হয়েও চিরকালই প্রাসঙ্গিক। মানুষের হৃদয়ের প্রকাশের সাথে এর যোগ, মানুসের সৃষ্টির সাথে এর সম্পর্ক, এবং মানুষের কর্মকাণ্ডেই এর বৈধতা, এসব মিলিয়েই নন্দনতত্ত্ব।

অধ্যায় ৭ / ৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন