শিল্পবিচার নন্দনতত্ত্বের একটি স্বীকৃত বিষয়। শিল্পের বিভিন্ন শাখার- যথা, সাহিত্য, নৃত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি স্বাতন্ত্র্য ও প্রকারভেদে শিল্পবিচারও ভিন্ন হয়ে থাকে, কিন্তু উদ্দেশ্য একই – শিল্পের মূল্যবিচার। শিল্প সমালোচনা শিল্পবিচারের একটি পদ্ধতি, যার আদর্শ চরিত্র বস্তুনির্ভর ও নৈর্ব্যক্তিক। বিচারের ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, শিল্পচিন্তা, দর্শন ইত্যাদি শিল্পবিচারে কোনো চুড়ান্ত প্রভাব ফেলবে না, এবং শিল্পবস্তুর আত্যন্তিক প্রকাশটিকে নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করে এর শিল্পমূল্য সম্বন্ধে তিনি রায় দেবেন, এ হচ্ছে কাঙ্খিত আদর্শ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো শিল্পবিচার নৈর্ব্যক্তিক হতে পারে না। শিল্পীর মনোজগতের একটি অস্ফুট ধারণাকে রূপের সীমায় এনে শিল্পী তাকে মূর্ত করেন, ভাষা দেন; শিল্পপ্রক্রিয়া তাই একান্তভাবেই ব্যক্তিসাক্ষিক। সমালোচক যখন ঐ শিল্পবস্তুটি নিয়ে আলোচনা করেন বা তাকে বিচার করেন, তখন শিল্পবস্তুটি তিনি যেভাবে দেখেন, সেভাবেই তার মূল্যবিচার করেন। শিল্পবস্তুর আদর্শ চরিত্র কি, আদর্শ রূপ বা শিল্পের সর্বোচ্চ সঞ্চারণযোগ্য রস কতটা বা কি মাত্রায় হবে, এর কোনো স্বীকৃত মাপকাঠি না থাকায় শিল্পগ্রহীতার নিজস্ব রুচি, অভিজ্ঞতা ও মনোবৃত্তি এই রসগ্রহণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। শিল্পরসিক তৃপ্ত হলে শিল্পবস্তুটি সফল হয়েছে একথা বলা যায়, আবার তৃপ্তিদানে ব্যর্থ হলে তা যে শিল্পোত্তীর্ণ হয় নি এমন কথাও বলা যায় না। এর কারণ কি? কারণ হলো, শিল্পরসিক নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পকে দেখছেন, কোনো সাধারণ গ্রহণযোগ্য মান (standard) থেকে নয়। তাঁর নিজস্ব বিচার সঠিক হবে একথা যেমন বলা যায় না, তেমনি শিল্পবস্তুকে কোন্ মানে পৌছাতে হবে এমন কোনো ইঙ্গিতও কোনো শিল্পবিচারক দেবেন না। বরং তিনি একটি মান থেকে যাত্রা শুরু করতে পারেন শুধু প্রাথমিক পর্বটিকে অতিক্রম করার জন্য, কোনো চূড়ান্ত বিচারের জন্য নয়। শিল্পবস্তু যদি গ্রহীতার ভালো লাগে, তাহলে তা ব্যক্তিগত কারণেই : কারণ ভালো লাগা না লাগা একজন প্রাকৃতজনের যেমন, একজন শিল্পরসিকের তেমনি নিজস্ব তৃপ্তি-অতৃপ্তির ব্যাপার।
শিল্পবিচারক প্রথমত একজন শিল্পরসিক, অতঃপর বিচারক। শিল্পপ্রক্রিয়া আপাতদৃষ্টিতে সংশ্লেষণ বা সমম্বয়ধর্মী হলেও এর বিশ্লেষণী বৃত্তিই প্রধান বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া। মুহুর্তের অভিজ্ঞতাকে মেধা ও মনন, প্রজ্ঞা ও অর্জিত অভিজ্ঞতা ইত্যাদির আলোকে শিল্পী বিশ্লেষণ করেন। শিল্পীর সৃষ্টিতে শুধুই কল্পনা থাকে না, তাঁর অভিজ্ঞতা ও প্রতিভার স্পর্শ তাতে থাকতেই হবে। শিল্পপ্রক্রিয়া শুধুই সমম্বয়ধর্মী হলে স্থান বা দেশের প্রয়োজন হতো না, রূপও হতো এক এবং অপরিবর্তনীয়। পক্ষান্তরে, বিচারপদ্ধতি বিশ্লেষণধর্মী, তাতে সজ্ঞান অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসা, অর্থ-অম্বেষণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু বিচারকের কাজটি প্রকৃত প্রস্তাবে একটি সমম্বয়ক্রিয়া। বিশ্লেষণের বিস্তৃত (এবং মাঝে মাঝে) বিক্ষিপ্ত রূপটি একটি শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সত্যানুসন্ধানের পর্যায়ে ফেলাই তাঁর কাজ, এবং সত্য যেহেতু পক্ষপাতহীন, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, সেহেতু শিল্পবিচারও তাই হবে, এই প্রত্যাশা শিল্পসেবীমাত্রের। আপাতঃদৃষ্টিতে এতে অসামঞ্জস্যের কিছু নেই। শিল্পগ্রহীতা হিসেবে যে ব্যক্তি সাক্ষিক বিচারবোধের জন্ম নেয়, তা পরবর্তী (বা সমসাময়িকঅনেক ক্ষেত্রেই শিল্পরস গ্রহণ ও শিল্পবিচার সমান্তরাল হয়ে থাকে) পর্যায়ে বিশ্লেষণধর্মী হবে, সত্যনিষ্ঠ ও মূল্য-উদ্দিষ্ট হবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু শিল্পবিচারও বহুলাংশে একটি ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া। এজন্য আমরা প্রাচীন যুগ থেকে এ পর্যন্ত শিল্পবিচারে এতগুলো ধারার (অনেক সময় পরস্পরবিরোধী ধারার) সন্ধান পাই, শিল্পকৈবল্যবাদীদের সাথে বিরোধ প্রয়োজনবাদীদের, রূপবাদীদের সাথে মার্ক্সবাদীদের। তবে শিল্পের দীর্ঘদিনের ইতিহাসে রুচি ও রস, শিল্পবৈশিষ্ট্য ও গুণ ইত্যাদির নিরিখে একটি ন্যূনতম standard আপনা থেকেই নির্ধারিত হয়ে গেছে; তবে তা শিল্পবিচারের সহায়ক হিসেবে, নির্ণায়ক হিসেবে নয়। বিচারক একে কাজে লাগাতে পারেন। যেমন, রোমান্টিক যুগের কোনো কবিকে বিচার করতে হলে সুবিধার জন্য। কিন্তু যখন দেখা যায়, বায়রণ বিদ্রুপ ও ব্যাঙ্গের বিস্তৃত প্রয়োগ করেছেন তাঁর কবিতায়, যা রোমান্টিকতার স্বীকৃত অনুষঙ্গ নয়, তখন কিন্তু কেউ বলবেন না, বায়রণ রোমান্টিক কবি ছিলেন না। এই নিরিখে নয়, তবে অন্য নিরিখে বটেই। কিন্তু কবিকে রোমান্টিক বিশ্লেষণে ভূষিত করাটাও খুব বস্তুনিষ্ঠার পরিচয় নয়। রোমান্টিক কবির রোমান্টিকতা একটি প্রতিপক্ষের- ধ্রুপদী রীতির-তুলনায় কমবেশি নির্ধারিত। একজন কবি আগে একজন কবি, রোমান্টিক তার পর। বলা হয়ে থাকে রোমান্টিকতার পরিচয় এর কল্পনা-প্রাধান্য। কল্পনা তাহলে ধ্রুপদী রীতির কাব্যে ছিলো না? ‘ছিলো বৈকি। তবে রীতির শাসনে বন্দী। কল্পনাকে যেভাবে ব্যবহার করা হোক, কল্পনা ছাড়া সৃষ্টি হয় না। কাজেই কল্পনার বিচারে তাকে ব্যবহারের বৈচিত্র নিয়েই রোমান্টিক সাহিত্য শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু আপেক্ষিক। এ-ও বলা হয়ে থাকে রোমান্টিক কবিরা কাব্যকে রীতিনীতির শাসন থেকে মুক্ত করেছেন। আধুনিক অনেক কবিও তা-ই করেছেন, তাই বলে তাঁদের রোমান্টিক বলা যায় না। এজন্য নির্দিষ্ট কোনো মান নিয়ে শিল্পবিচারে নিযুক্ত হওয়ার বিপদ অনেক। বরং প্রত্যেক শিল্পী ও শিল্পবস্তুকে তাঁর নিজের মানে, অর্থাৎ তিনি কি করতে চেয়েছেন, শিল্পকর্মটি কি তা অর্জনে সফল হয়েছে, শিল্পী তাঁর প্রকরণের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করেছেন কিনা, শিল্পের নানান লক্ষণ, উপাদান ইত্যাদির পরিপূর্ণ ব্যবহার হয়েছে কিনা, এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা বা বিচার করতে পারেন শিল্পবিচারক। অতঃপর শিল্পীর সমকালের বা পূর্বসূরীদের শিল্পকর্মের সাথে তার তুলনামূলক আলোচনা চলতে পারে- মূল্যবিচারে এই তুলনামূলক উৎকর্ষ-অনুৎকর্ষ বিচার প্রয়োজনীয়।
কিন্তু এই প্রক্রিয়ার একটি প্রাক-প্রস্তুতি প্রয়োজন, এবং তা হলো বিচারকের পক্ষে শিল্পের স্বরূপ সন্ধান। আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে শিল্পের বিভিন্ন সংজ্ঞা নির্ণীত হয়েছে শিল্পমানে mimesis বা অনুকরণ (এরিস্টটল প্রমুখ), দৃশ্যমান পৃথিবীর এবং স্বর্গীয় সৌন্দর্যাভাসের প্রকাশ (প্লেটো প্রমুখ), শিল্প আনন্দের প্রকাশমাত্র, লীলাবাদী (শিল্পকৈবল্যবাদী); শিল্প বাহ্যিক কোনো প্রকাশ নয়, মনোজগৎ বা চেতনাজগতের প্রকাশ (প্রকাশবাদী), শিল্প সামাজিক বা জাগতিক প্রয়োজনসিদ্ধির হাতিয়ার (প্রয়োজনবাদী, মার্ক্সবাদী) ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেক পরস্পরবিরোধী ধ্যান-ধারণা বর্তমান; কিন্তু এতে ফল হচ্ছে এই যে, শিল্পবিচারও অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়। শিল্পবিচার শিল্পসংজ্ঞার মতোই সংজ্ঞায়িত হয়েছে, যেমন প্রকাশবাদী শিল্পবিচার, মার্ক্সবাদী শিল্পবিচার, শিল্পকৈবল্যবাদী শিল্পবিচার। শিল্পবিচারে পক্ষপাতিত্ব আসে এইসব পক্ষপাত (bias) থেকে। একজন প্রকাশবাদী সমালোচক প্রভাববাদী চিত্রের কড়া সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু তাতে তাঁর পক্ষপাতটি প্রধান হলে ঐ সমালোচনা বস্তুনিষ্ঠ হবে না। আমাদের মনে রাখা উচিত, শিল্পের প্রকরণ যাই হোক না কেন, মূল্যবিচারে শিল্পবস্তুর চূড়ান্ত রূপটিই বিচার্য এবং এক্ষেত্রে শিল্প-উপকরণগুলো কতটা সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, এই বিবেচনা প্রধান হওয়া উচিত, শিল্পবস্তু কোন্ মতবাদকে কতটা প্রতিফলিত করলো, তা নয়। একজন চিত্রশিল্পী রেখা, রং, রূপ, টোন, স্থান ইত্যাদির কি পরিমাণ প্রয়োগে শিল্পসৃষ্টি করলেন, তার আভ্যন্তরীণ সম্পর্কসমূহের বৈশিষ্ট্য কতটা প্রতিভাত হলো, চিত্রসমালোচনায় সাধারণত এসবই গৌণ। সুন্দর শিল্পবস্তুতে সকল উপাদান আনুগুণ্যে বিশিষ্ট। তারা একত্রে যা সৃষ্টি করে সেই সম্মিলিত প্রকাশটি অবশ্যই শিল্পমূল্যে প্রত্যেক উপাদানের একক প্রকাশ থেকে বড়। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ সাধারণ শব্দ হলেও কবির কাছে সৃষ্টির মুহুর্তে তা-ই যথাশব্দ। কোনো প্রতিশব্দ বা বিকল্প শব্দ ব্যবহার করা সম্ভব হলে কবি হয়তো করতেন; কিন্তু একটি শব্দের যথার্থতা এমনি যে শব্দটিই কবির ব্যবহৃত একমাত্র শব্দ। এভাবে যথাশব্দের ক্রমাগত ব্যবহারে যে কবিতা হয়, তাতে কবির যা বলার তা পরিপূর্ণভাবে বলা না হলেও অন্তত যথাসম্ভব বলা হয়েছে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু কবিতা শুধু শব্দের বিন্যাস নয়, তাতে ছন্দ থাকে, ব্যঞ্জনা থাকে, ভাব-আবেগ-অনুভূতির স্পন্দিত প্রকাশ থাকে; থাকে উপমা, প্রতীক, উৎপ্রেক্ষার মায়াজাল। এসবের মধ্যে ধরা পড়ে কবির প্রধান ভাবটি। কাব্য-সমালোচনা শুধু অংশের সমালোচনা হতে পারে না, হতে হবে সমগ্রের। আমরা একটি কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে শুধু প্রতীক বা চিত্রকল্প বিচার করে কবি বা কবিতার উপর রায় দিতে পারি না। অধুনা কাব্যসমালোচনায় এমন একটি ধারা অবশ্য চোখে পড়ে, কিন্তু তাতে কবির সামগ্রিক সৃষ্টির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়।
শিল্পবিচার শিল্পের অন্বিষ্ট ও শিল্পের প্রকাশ এই দুই প্রেক্ষিতে হতে পারে। শিল্প সত্যসন্ধ, এবং সৌন্দর্যকে তা নিজের মধ্যে ধারণ করতে সচেষ্ট হয়, আমাদের আলোচনায় তা প্রতীয়মান হয়েছে। শিল্পের উদ্দেশ্য কি.প্রশ্নটির ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এর সাথে প্রয়োজনবাদের সম্পর্ক স্থাপন করলে। শিল্পের উদ্দেশ্য কোনো বাহ্যিক প্রয়োজন নয়, এর উদ্দেশ্য সত্য। এই সত্য আবার শিল্প ও শিল্পীভেদে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সত্যের একটি প্রাণময় রূপ আছে যা নীতিশাস্ত্রের ছায়া না মাড়িয়েও সত্যসন্ধ শিল্পী আন্দাজ করতে পারেন। আমরা শিল্পীর সত্যসন্ধান ও শিল্পের সত্যসন্ধানকে একটু ভিন্ন অর্থে দেখবো। শিল্পের সত্য পরিপূর্ণতা। শিল্পসত্য ব্যক্তি ও সময়কে অতিক্রম করে এক আদর্শ সামঞ্জস্য ও সুমিতি প্রকাশের লক্ষ্যে ধাবিত। এই আদর্শ সামঞ্জস্যের জন্ম নেয় শিল্পীর স্বজ্ঞায়। শিল্পী তাঁর সৃষ্টিতে যে সৌন্দর্য ও সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করেন তার সাথে তাঁর নিজস্ব সৌন্দর্য ও সত্যানুসন্ধান সক্রিয়ভাবে জড়িত। দার্শনিক তাঁর সত্যানুসন্ধানে যুক্তিতর্ক ও বুদ্ধির প্রয়োগ করেন, শিল্পী করেন তার শিল্প-মাধ্যমের। যুক্তিতর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ যে ভাষায় সম্ভব তাতে কোনো অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতার অবকাশ নেই। তেমনি শিল্পীর মাধ্যমকে হতে হবে সর্বতোভাবে সুসামঞ্জস। শিল্পবিচারে এই সামঞ্জস্যের সূত্রকে উন্মোচন করতে হবে, জানতে হবে এর পেছনে কোন্ সত্যসন্ধান লুকিয়ে আছে। তাই বলে বিচারক কোনো পূর্বনির্ধারিত সামঞ্জস্যসূত্র এখানে আরোপ করবেন তা নয়। রদাঁর ভাস্কর্য বিচারে একজন পটুয়ার সামঞ্জস্যসূত্র প্রয়োগ করা যাবে না। এলিয়টের কাব্যবিচারে – ছান্দসিক কবির সামঞ্জস্যগুণ খোঁজা অপ্রয়োজনীয়। ভার্জিনিয়া উলফের উপন্যাসে গলস্ওয়ার্দীর সামঞ্জস্যসূত্র আশা করাও বৃথা। শিল্পে সামঞ্জস্য বা আনুগুণ্য শিল্পীর মাধ্যম, তাঁর শিল্পচিন্তা ও চেতনা, তাঁর রুচি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে, তার প্রকরণটি কি তার উপরও নির্ভর করে।
শিল্পের অন্বিষ্ট যে সত্য সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পবিচার করলে আরেকটি জিজ্ঞাসা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তা হলো, এই সত্যের স্বরূপ কি? অনেকে বলেন শিল্পসত্য হচ্ছে শিল্পকর্মের সুসঙ্গতি, সামঞ্জস্য এবং তার অর্জিত পূর্ণ-রূপ। আবার কেউ কেউ বলেন শিল্পসত্য ও জীবনসত্য এক জিনিস : অর্থাৎ শিল্পবিচারে শিল্পবস্তু জীবনকে কতখানি গভীরভাবে প্রকাশ করেছে তাই দেখতে হবে। কীট্সের একটি কবিতা “Ode on a Grecian Urn”-এ দুটি মতের একটি সমন্বিত রূপ দিয়েছে। এই কবিতার প্রধান প্রতীক ভস্মাধারটি একটি চমৎকার শিল্পবস্তু, তার গায়ে নক্সা এঁকে পুরাকালের কোনো শিল্পী একটি জীবনচিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা এখন কবির কাছে কালজয়ী মনে হচ্ছে। দেকা যাচ্ছে, গ্রামের বাইরে কোথাও উৎসব হবে, চলছে পুরোহিত ও তার পেছনে মানুষজন; একটি বাছুরকে বলি দেয়া হবে, চলছে তার আয়োজন। প্রেমিক ও প্রেমিকা নিভৃতে আলিঙ্গনাবদ্ধ। শিল্পী অত্যন্ত দরদ দিয়ে এসব উৎকীর্ণ করেছেন ভস্মাধারের গায়ে; এবং এর মধ্য দিয়ে ভস্মাধারটিকে দিয়েছেন অমরত্ব। ভস্মাধারটি একটি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় সত্যি, কিন্তু সে পরিচয় এখানে প্রধান নয়, ‘গ্রীক’ বিশেষণটি ব্যবহারের মাধ্যমে এর নির্মাণ-উপকরণের, উৎপত্তিস্থল বুঝাচ্ছেন না কবি, বুঝাতে চাচ্ছেন এর প্রধান শিল্পলক্ষণ। ‘গ্রীক’ শিল্পের সাধারণ গুণাবলী এই পাত্রে উপস্থিত নির্মাণ, নক্সা, রূপ ইত্যাদির মাধ্যমে। পাত্রটি একই সাথে কিছু জীবনসত্যকে তুলে ধরেছে, যেখানে গতিশীলতা ধর্মীয় ও লৌকিক আচারে, শান্ত জীবনাচরণে, নিভৃত প্রেমের মহিমায়। এই সুন্দর অনুভূতিটি যে বোধের জন্ম দেয়, কীটস্-এর ভাষায় তাই সত্য। অর্থাৎ শিল্পসত্য ও জীবনসত্য এখানে অভিন্ন। ভস্মাধারটির নক্সা, কারুকাজ, তার অর্জিত রূপ- এসবের মধ্য দিয়ে সত্যটি প্রকাশিত হচ্ছে। কবিতাটির সমালোচনা বা মূল্যবিচারে তিনটি পর্যায় থাকতে পারে: জীবনসত্য-শিল্পীর জীবনসত্য ভস্মাধারটিতে প্রতিফলিত হয়ে থাকলে তা কি, এবং এই সত্যের সাথে কীটস্-এর জীবনসত্য কতখানি সম্পর্কযুক্ত, এবং শিল্পপ্রকাশ-ভস্মাধারটির ‘গ্রীক’ প্রকাশশৈলী কবিতার প্রেক্ষিতে কতখানি অর্থবহ, এবং কবিতাটির প্রকাশভঙ্গীর বিশিষ্টতা অবিশিষ্টতা কি? অনেক সমালোচক বলেন কীটস্ তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে অহেতুক একটি তাত্ত্বিক মাত্রা জুড়েছেন সত্য ও সৌন্দর্যকে অভিন্ন করে দেখায়। কিন্তু এরও প্রয়োজনীয়তা ছিলো। শিল্পের বিচারে সত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটনের যে আয়োজন চলে, এ তারই একটি গূঢ় প্রকাশ। একটি শিল্পবস্তুকে (ভস্মাধার) আরেকটি শিল্পবস্তুর (কবিতা) আধেয় করে যুগপৎ জীবন ও শিল্পের এরূপ সাহসী উচ্চারণ এত অল্প বয়সে আর কোনো কবি করেছেন কিনা বলা যায় না। পরবর্তীকালে এলিয়ট শিল্পের প্রকাশ নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার এক পর্যায়ে Four Quartests-এ লিখেছিলেন :
Words move, music moves
Only in time; but that which is only living
Can only die. Words, after speech, reach
into the silence. only by the form, the pattern.
Can word or music reach
The stillness as a Chinese jar stil
Moves perpetually in its stillness.
কবিতার শব্দ নক্সা বা রূপের মাধ্যমে শব্দ নীরবতায় উত্তীর্ণ হতে পারে, যেমন একটি চীনা জার তার নীরব স্থিতিতে সতত সঞ্চারণশীল। রূপের সংহত প্রকাশে গতি আছে, আছে নীরবতাও । আমরা দেখেছি, সুসান সন্টাগ এই নীরবতাকে নান্দনিক বলে চিহ্নিত করেছেন। এলিয়টের এই কবিতা বা অন্যান্য অনেক কবিতায় শিল্প সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন, তা থেকে বুঝা যায় তিনিও বিশ্বাস করতেন শিল্পের প্রকাশে রূপ ও নক্সার dynamism যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এর সত্যান্বেষণের আগ্রহ। চীনা জারটির অর্জিত রূপ স্থৈর্যের নয়, গতিশীলতার, যদিও এই গতি তার স্থিতির মধ্যেই নিহিত। ‘স্থিতিতে গতি’ এই প্রকাশচিহ্নটিকে সনাক্ত করতে পারলে শিল্পের একটি প্রধান পরিচয়কে আমরা বুঝতে পারবো।
শিল্পবিচারে স্থবিরতা ও গতিশীলতা দুটি দিকচিহ্ন নির্দেশক, শিল্পবস্তুর রূপ যদি গতিশীল (dynamic) না হয়, তবে তার উপাদানসমূহের মধ্যে সম্পর্কটি হবে অসঞ্চারী, স্থবির। শিল্পবস্তু সার্থক হয় যখন তার উপাদানসমূহ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, এবং সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বস্তুতে গতে সঞ্চারিত হয়। মধ্যযুগের একমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক চিত্রকলায় গতি ছিলো না- ব্যাপ্তি ছিলো, বিস্তৃতি ছিলো, কিন্তু গভীরতা ছিলো না। ত্রিমাত্রিক চিত্রকর্মে সে অপূর্ণতা গেলো ঘুচে। এর সাথে শিল্পকর্মে গতি এলো, যার প্রকাশ নিরন্তর চলছে, মার্ক শার্গাল বা অস্কার ক্রকোস্কা অথবা আমাদের জয়নাল আবেদীন যে গতিশীলতার সাক্ষর রেখেছেন তাঁদের চিত্রে, তার পেছনে এই ঐতিহ্যটি আছে। শিল্প-বিচারে যে শিল্পবস্তু গতিশীল নয়, তার প্রকাশ খণ্ডিত, খৰ্বকায়; তার সীমাবদ্ধতা উপাদান-অনুষঙ্গসমূহের একমাত্রিক ব্যবহারের; মেকিত্বের অন্তর্ভুক্তিতে। এমন শিল্প, বলা বাহুল্য, কালজয়ী নয়। কীট্সের ভস্মাধার তার চিরস্থিতিতে একটি জীবনচিত্রকে চিরকালের জন্য ধরে রেখেছে, কিন্তু তার গতি ইতিহাস থেকেও প্রচণ্ড : কারণ শিল্পের অনাদিকালের উৎসধারাটি এই ভস্মাধারে এসে সময়োত্তীর্ণ হয়েছে; যা ইতিহাসের কোনো পক্ষেও অর্জন করা সম্ভব।
শিল্পবিচারে শিল্পবস্তুর উৎকর্ষ বা অনুৎকর্ষ বিচার হয়ে থাকে; একটি শিল্পকর্ম ‘শিল্পোত্তীর্ণ’ হলো কিনা বা হতে অসমর্থ হলো কিনা এ নিয়ে মতামত দেয়া হয়। কিন্তু এই বিচার শুধু শিল্পবস্তুকে কেন্দ্র করে হলে তা খণ্ডিত হবে, শিল্পীর মনে যে সৃষ্টি-প্রক্রিয়া শিল্প-ভাবনা বা ধারণা থেকে শুরু করে রূপার্জন পর্যন্ত বিস্তৃত, তাকেও বিবেচনা করতে হবে। একই শিল্পভাবনা বিভিন্ন মাধ্যমে রূপায়িত হতে পারে। Pieta চিত্রশিল্পে যেমন, ভাস্কর্যেও তেমনি। আবার গীতিকবিতার সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; যে ভাব কবিতায় ছড়িয়ে দেয়া যায় তাকে গানের মধ্যে সংহত করা যায়। কাজেই শিল্পী যে মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ, যে মাধ্যমে তাঁর যত বেশি উল্লাস, তিনি তাকেই ব্যবহার করবেন। এজন্য শিল্পমাধ্যম নির্ধারণটি শিল্পীর যেমন অত্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, ঐ মাধ্যমে তার বিকাশটিও তেমনি ব্যক্তিগত ব্যুৎপত্তির ব্যাপার। স্বভাবতই যখন কোনো শিল্পী একটি শিল্পকর্মে তাঁর ভাবনা-অনুভবকে রূপায়িত করেন, তার রূপটি একান্ত নৈর্ব্যক্তিক হতে পারে না; তাতে শিল্পীর মননশীলতার ও শিল্পপ্রক্রিয়ার ব্যক্তিগত অনুষঙ্গগুলো জড়িত শিল্প-বিচারককে তাই শিল্পবস্তুর সাফল্য অসাফল্যের বিচার করতে হবে এ দুয়ের সম্মিলনে ।
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় যে উত্তমপুরুষটি তার প্রকাণ্ড আমিত্ব নিয়ে উপস্থিত, তার সাথে কবির ব্যক্তিসত্তার প্রবল উন্মোচনের যোগাযোগটি অত্যন্ত নিবিড়, কাজেই শিল্পবিচারে সেই উত্তমপুরুষটি কতখানি যুগের প্রতিভূ, কতখানি কবির নিজের এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাবার নয়। অন্যদিকে একটি পুরোপুরি বিমূর্ত কলায় শিল্পীকে আবিষ্কার দুরূহ ব্যাপার— আধুনিক চিত্রকলায় শিল্পী অনেক সময় নিজেই শিল্পবস্তু থেকে তার দূরত্ব রচনা করেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও বিচার্য, এই দূরত্ব রচনা কেন? যদি দূরত্ব রচিত হয়, সে তো সচেতন ক্রিয়া। তার প্রভাব শিল্পকর্মে কতটা পড়েছে, এবং কিভাবে? শিল্পবস্তু যে রূপ অর্জন করলো, তার সাথে শিল্পীর কাঙ্ক্ষিত রূপটির কতখানি সাদৃশ্য, এর উপর নির্ভর করবে শিল্পবিচার। একটি ভাস্কর্য শুধু পাথরের একটি মূর্তি বা আকৃতি নয়, এর মধ্য দিয়ে শিল্পীর একটি সৃষ্টি-আকুতি ভাষা পেয়েছে- তা না হলে এত পরিশ্রমে একটি অপ্রয়োজনীয় (ব্যবহারিক দিক দিয়ে) বস্তু তিনি তৈরি করতেন না, এতটা কালক্ষেপ করতেন না। কথা হলো, এই আকুতি কতটা বাঙ্ময় হয়েছে, শিল্পীর প্রধান ভাবটি কতটুকু রূপময় হয়েছে। এই হচ্ছে ভাস্কর্যটি সম্বন্ধে বিচারকের জিজ্ঞাসার বিষয়। শিল্পকর্মটির সাফল্য অসাফল্য নির্ভর করবে এই প্রশ্নের কি উত্তর আসে, তার উপর। টলস্টয়-এর মতে, শিল্প-প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিল্পী যা অনুভব করেন, তার রূপটি নিজের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করে গতি, রেখা, রঙ, ধ্বনি বা শব্দ-রূপের সাহায্যে অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত করা। শিল্পবিচারক যখন এই পর্বে শিল্পবস্তুকে বিচার করবেন, তখন টলস্টয়-এর সঞ্চারণতত্ত্বটি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। বিচারক শিল্পের প্রকরণ ও প্রক্রিয়াকেও তলিয়ে দেখবেন । গতি, রেখা, রঙ, ধ্বনি ও শব্দরূপ কিভাবে শিল্পী ব্যবহার করেছেন, তার বিশদ খুঁটিনাটি ধরা পড়বে তাঁর বিচারে। শিল্পবিচার শিল্প থেকে শিল্পীতে, শিল্পী থেকে শিল্পবস্তুতে ক্রমাগত আবর্তিত হতে থাকবে। শিল্পবিচারে সামূহিক বা holistic দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ তাই বিচারকের পক্ষে বাঞ্ছনীয়। শিল্পসৃষ্টিকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই শুধু শিল্পী ও তাঁর কাজের প্রতি সুবিচার করা হবে।
শিল্পবিচারে শেষ কথা বলে কিছু নেই, চূড়ান্ত কোনো রায় নেই। বস্তুমাত্রই যেমন শিল্পবস্তু নয়, তেমনি সৃষ্টি-প্রক্রিয়া মাত্রই শিল্পসৃষ্টি প্রক্রিয়া নয়। বিচারকের দায়িত্ব শিল্পবস্তু কেন প্রথমেই শিল্পবস্তু, এর কারণ অনুসন্ধান করা, এবং কিভাবে তা শিল্পবস্তুতে পরিণত হলো, এর পরিচয় নির্ণয় করা। শিল্পবস্তু কোন্ ভাব বা বিষয়কে রূপায়িত করলো, তা যেমন বিবেচ্য, তার গৃঢ়ার্থ ও সামঞ্জস্যও তেমনি বিচারককে সন্ধান করতে হবে। শিল্পীর ভাব-অনুভাব ইত্যাদি তাঁর শিল্পকর্মে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায় যে, এ দুয়ের প্রভেদ টানা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই শিল্পৰস্তুর বিচারে শিল্পীর মানসিক সৃষ্টি-প্রক্রিয়া, তাঁর ধ্যন-ধারণা ইত্যাদীর প্রসঙ্গও এসে যায়। অনেক আধুনিক ধারার সমালোচক শিল্পবস্তুকে শিল্পীর সমাজচিন্তার মূর্ত রূপ বলে মনে করেন, অনেকে আবার শিল্পীর পরিকল্পনা, তাঁর মনের ইতিহাস জানার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। এ দুই দৃষ্টিভঙ্গিই একপেশে; এর মাঝখানে অর্থাৎ উভয়ের সম্মিলনেই শিল্পসৃষ্টি সফলতা অর্জন করে। শিল্পী কোনো প্রাক-পরিকল্পনা মতে কাজ না করলেও তার সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার একটি নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। শিল্পীমনে অনেক ভাব বা চিত্র ভিড় করে এলেও এদের সাজানোর মধ্যে পারম্পর্য থাকে, ধারাবাহিকতা থাকে। এটা সম্ভব হয় ঐ স্ব-উৎসারিত পরিকল্পনার সাহায্যে। একে চেনা ও বোঝা বিচারকের দায়িত্ব। শিল্পবিচারে সমাজ ও কালের প্রাসঙ্গিকতা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে ব্যক্তির কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গটি।
শিল্পে আপেক্ষিকতা ও পরিবর্তনশীলতা আছে বলে শিল্পবিচারেও এদের প্রয়োগ প্রয়োজন। বিচারক যদি মনে রাখেন যে তাঁর বিচার দেশকালের উর্ধের্ব এবং একটি অপরিবর্তনীয় সত্য, তাহলে একটি স্ব-আরোপিত dogmatism ক্রিয়াশীল হবে, এবং তাঁর বিচারটি একটি মতবাদে রূপ নেবে। শিল্পের উপাদান-অনুষঙ্গ সর্বকালেই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনশীল, শিল্পবিচার এসব উপাদান-অনুষঙ্গের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকলে যুগের পরিবর্তনে তাও পাল্টাতে বাধ্য। আধুনিককালে শিল্পবিচারে যে মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তাতে শিল্পবিচারের একটি প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে- তা হচ্ছে শিল্পকে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণের কাছে বোধগম্য করা। শিল্পী তাঁর ভাবকে বর্ণনার সাহায্যে প্রকাশ করতে অসমর্থ হলে, অথবা তাঁর ভাবের সঠিক প্রকাশের প্রয়োজনে, প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এই প্রতীক যখনি বর্ণনা বা বিবরণের স্থান নেয়, তখনি সাধারণ গ্রহীতার কাছে শিল্প জটিল ও স্থানবিশেষে দুর্বোধ্য হতে শুরু করে। শিল্পবিচারক প্রতীককে আবার বিশ্লেষণের ভাষায় বর্ণনার স্তরে নিয়ে আসতে পারেন, এবং তাতে সাধারণ গ্রহীতার রসবোধ পুনঃজাগ্রত হতে পারে। আধুনিককালে শিল্পবিচার একটি বর্ধিষ্ণু বিষয়, অনেক ক্ষেত্রে তা সৃজনশীলতার পর্যায়েও চলে গেছে। আধুনিক শিল্পকলা যত দুর্বোধ্যই হোক, শিল্পবিচারকদের সূক্ষ ও মনোজ্ঞ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এর প্রকৃতি নির্ণীত হয়েছে প্রতি পদে, এবং শিল্পের রসিক ও গ্রহীতার আগ্রহও জাগ্রত হয়েছে। শিল্পবিচারক শিল্পের প্রচারকও বটে; এবং প্রবর্তক ও প্রচারকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যে প্রচার সম্ভব, তা শিল্পবিচারকে প্রথাবদ্ধতায় (dogma) রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আমাদের কালের একটি লক্ষণীয় বিষয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন