শিল্পে সুন্দর ও অসুন্দর উভয়ের প্রকাশ আছে। সুন্দরের পরিচয়টি কি; এর উত্তর দেয়া যেমন দুরূহ ব্যাপার, অসুন্দর কি, তারও লক্ষণ নির্ণয় সম্ভব নয়। কিন্তু আলো ও অন্ধকারের মতো সুর ও অসুরের মতো বা শুভ ও অশুভের মতো সুন্দর ও অসুন্দরকে আমরা বিপরীতার্থে ব্যবহার করে থাকি। কোনো বস্তু সুন্দর হয় অর্থময় রূপাশ্রয়ী হলে, তেমনি কোনো বস্তু অসুন্দর হয় অর্থময় রূপ গ্রহণে অসামর্থতার জন্য। নান্দনিক বিবেচনায় সুন্দরের যেমন শুদ্ধরূপ ও বস্তুরূপ আছে; অসুন্দরেরও তেমনি। তবে অসুন্দরের রূপ বীভৎস তাতে রসের সঞ্চার হয় না, পুলকের অনুভূতি হয় না। সংস্কৃত শাস্ত্রে যদিও বীভৎস রসের কথা বলা হয়েছে, তা নিছক অসুন্দরের প্রকাশ নয়। অসুন্দরকে যদি সুন্দরের বিপরীত ভাবা হয় বা সৌন্দর্যের অভাব বোঝায়, তাহলে তা নঞর্থক; এক্ষেত্রে শিল্পবস্তুতে রসের সঞ্চার না হলে বা তা শিল্পশুদ্ধ না হলে তাতে অসুন্দরের একটি স্পর্শ আছে ধরে নিতে হবে। সুন্দরের প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুন্দরের লক্ষণসমূহ যথা– সামঞ্জস্য, সুমিতি, সৌষম্য, অখণ্ডতা তথা বস্তুর সামূহিক প্রকাশ যেখানে নেই, সেখানে সুন্দর নেই; এবং সৌন্দর্যের এই অভাববোধকে আমরা বলি অসুন্দর। সুন্দরের কোন নিজস্ব রূপ আছে কিনা, এর সাথে অসুন্দরের কোনো বিশিষ্ট এবং বিশেষাত্মক রূপ আছে কিনা, এ বিবেচনাটিও জড়িত। যে কোনো দার্শনিক বিশিষ্টাৰ্থ দিয়ে, বা স্বকীয় সত্তার পরিচয়ে, অথবা বস্তু বা রূপনির্ভর প্রকাশে। দর্শনের ও নন্দনতত্ত্বের এ একটি কঠিন সমস্যা। এর গুরুভারের জন্যই, আচার্য সুরেন্দ্রনাথের মতে, “কি উপনিষদে কি প্রাচীন দর্শনসাহিত্যে কোথাও সুন্দরের স্বরূপ নির্ণয়ের কোনো চেষ্টা করা হয় নাই।” বক্তব্যটি মনে রাখার মত; এই সমস্যার প্রকৃত গুরুত্বের প্রেক্ষিতেই শুধু নয়, সুন্দর-অসুন্দরের বিভিন্ন ও বিচিত্র সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে আধুনিক নন্দনতত্ত্বে, সর্বত্র সুন্দর-অসুন্দর হচ্ছে ধারণা বা concept-এর ব্যাপার, যার আপেক্ষিকতা অনেকান্ত। এখানে চূড়ান্ত বলে যা বিবেচিত, তা বিশ্বাস মাত্র, সত্যে রূপ নিতে পারেনি। চূড়ান্ত সৌন্দর্য বলে যাকে শিল্পীর আরাধ্য বলা হয়, তার প্রকৃত রূপ কি, না শিল্পী, না দার্শনিক, কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
সৌন্দর্যকে সংজ্ঞার মধ্য দিয়ে সামান্যরূপে দেখা পণ্ডশ্রম মাত্র। সাধারণ মানুষের জন্য কোনো কোনো বস্তু আদর্শ-সুন্দর। বেশিরভাগ বস্তু ব্যক্তির রুচি, প্রবৃত্তি, সংস্কৃতি, অবলোকনের বিশিষ্টতা, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি সাপেক্ষে সুন্দর। আদর্শ সুন্দর বলতে রূপের একটি বিশেষ প্রকাশকে বোঝায় যার দ্বারা ব্যক্তিনির্বিশেষে রসবোধ জাগ্রত হয় এবং একটি শান্ত ভাবের জন্ম হয়। আদর্শ সুন্দর সৌন্দর্যের সকল লক্ষণসমূহের একীভূত প্রকাশ, যেখানে খণ্ডের সাথে খণ্ডের আনুগুণ্যৈ:সুন্দরের অখণ্ড রূপটি প্রতিভাত হয়। তবে এই আদর্শ-সুন্দর ও চূড়ান্ত সুন্দর এক নয়। বলা যায় চূড়ান্ত সুন্দরের একটি কার্যকর অর্জিত রূপ আদর্শ সুন্দর। সাধারণ মানুষ এই আদর্শ সুন্দর পর্যন্ত তাদের নান্দনিক অনুভুতিসমূহকে বিন্যস্ত করতে পারে, এর বাইরে দার্শনিকের জগৎ সৌন্দর্যপিয়াসীর ধ্যানের জগৎ। ট্রয়ের হেলেন, শকুন্তলা, ক্লিওপেট্রা আদর্শ সুন্দরচূড়ান্ত সুন্দর নির্ভর করে এই সুন্দরের দীর্ঘমেয়াদী পরিশোধন প্রক্রিয়ার উপর। এবং তা অর্জন যে কত দুরূহ, বস্তুত অসম্ভব, শিল্পমাত্রই জানেন।
সুন্দরের সাধনায় শিল্পীকে তিনটি স্তর পার হতে হয়। প্রথমত, সৌন্দর্যের আভাসটি উপলব্ধি করা, এর একটি অস্ফুট রূপ কল্পনা করা, অথবা এই রূপের ব্যঞ্জনা অনুভব করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুভূত ব্যঞ্জনটি নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্যানের বস্তুতে পরিণত করে তাকে অভিজ্ঞতার পর্যায়ে নিয়ে আসা; এবং সর্বশেষে তাকে রূপ বা form-এ বিন্যস্ত করা ও রসসিক্ত করা। এ ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় একটি সংশ্লেষণাত্মক মনোভাব সক্রিয় থাকে। সৌন্দর্যবোধ কোনো নিষ্ক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়কারী বোধ নয়, তা সৃষ্টিশীল ও সক্রিয়। জগন্নাথ পণ্ডিত লিখেছেন যে “বস্তু-নিহিত যে বৈশিষ্ট্যের সংস্পর্শে মানবমনের স্বাধীন কর্মশক্তির উদ্বোধন ঘটে ও তদ্দ্বারা মানুষ মনের আনন্দ পায় তাহার নাম সৌন্দর্য।” এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এই হতে পারে যে, সৌন্দর্যের উদ্বোধনী শক্তি একটি সক্রিয়কারী শক্তি, এবং তা যে শুধু সৌন্দর্যের স্বপক্ষে তা-ই নয়, অসুন্দরের বিপক্ষেও। সৌন্দর্যের শক্তিবিচারে অসুন্দর এজন্য এসে পড়ে যে, হেগেলীয় বৈপরীত্যের টানে সুন্দর নিরন্তর অসুন্দরকে নাকচ করে দিচ্ছে, নয়তো প্রতিসংহরণের সংশ্লেষণী ক্রিয়ায় তাকে আত্মস্থ করে মহাসুন্দরের সৃষ্টি করছে। অবনীন্দ্রনাথের একটি কথাও এখানে স্মর্তব্য : “যে শিল্পের ভিতরে রসের সন্ধান করে তাহার কাছে স্বৰ্গও নাই, নরকও নাই, সে দেখে সুন্দরে অসুন্দরে এক মহাসুন্দর বর্তমান।”
শিল্পে সুন্দর ও অসুন্দরের সহাবস্থান সৌন্দর্যের বোধকে জাগ্রত করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুন্দরকেও তা পরিত্যাজ্য করে তোলে, কিন্তু সর্বত্র এই সহজ সমীকরণ প্রযোজ্য নয়। নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে সুন্দর অসুন্দরকে বিচার করলে তা গ্রহণ বর্জনের সাময়িক স্তরটি ছাড়িয়ে অনেক ঊর্ধ্বে উঠে যায়, যেখানে সত্য অনুসন্ধানই চূড়ান্ত হয়ে দেখা দেয়। সুন্দর কি, সুন্দর কেন, এ প্রশ্ন শুধু রূপান্বেষণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, সত্যান্বেষণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; কারণ সত্যান্বেষণের মধ্যেই শিল্পের মহৎ উদ্দেশ্যটি নিহিত। শেক্স্পিয়রে প্রায়শই এই সুন্দর অসুন্দরের পাশাপাশি প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়— ডেসডিমোনা ওথেলো, মিরান্ডা-ক্যালিবান বা টাইটানিয়া-বটম প্রতিস্থাপনগুলি অর্থবহ এজন্য যে এর মাধমে নাট্যকার সৌন্দর্যের ভাব ও অভাবকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি গ্রহণ-বর্জনের সোজা রাস্তায় না গিয়ে এদের স্বরূপ সন্ধান করেছেন। ক্যালিবান কুশ্রী, অসুন্দর; কিন্তু সেও স্বপ্নে দেখে, মেঘের মঞ্জুল দরোজা খুলে গিয়ে অনন্তের বৈভব ধরা দিচ্ছে তার কাছে। সমালোচকরা ক্যালিবানের প্রতি শেক্স্পিয়রের এই আচরণের হিসাব মিলাতে হিমশিম খেয়েছেন, কিন্তু সহজ সত্যটি এই, কুৎসিত বা অসুন্দরকে শেক্স্পিয়র সৌন্দর্যের বিপরীতাৰ্থক বলে দেখেননি, দেখেছেন একই বাস্তবতার দুটি অনুষঙ্গরূপে, অন্তত The Tempest নাটকটিতে। অনেক সময় অসুন্দর তার নিজের সীমারেখা নিজেই টেনে দেয়; স্ববিচারে তা হয়ে দাঁড়ায় পরিত্যাজ্য। রবীন্দ্রনাথ “চিত্রাঙ্গদায়” রূপ বা সৌন্দর্যের দুটি প্রকাশ দেখিয়েছেন চিত্রাঙ্গদার চরিত্রে। সুরূপা ও কুরূপা চিত্রাঙ্গদার অভিন্ন সত্তা, তাদের প্রকাশ বিভিন্ন; সামান্য মানুষ বহিঃসত্তার সাথে ভিতর-সত্তার পার্থক্য ধরতে পারে না; ভাবে কুৎসিৎ তো কুৎসিত, যেমন সুন্দর সুন্দর। অর্জুনের জ্ঞানচক্ষু শেষ পর্যন্ত উন্মীলিত হলো বটে, তবে তা দিব্য দর্শনের পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা নির্মোহ দৃষ্টি লাভ করলো। বহিরাঙ্গের রূপকে সে বলেছে ‘মিথ্যার জাল’ ‘ছলনা’, তার পরিচয় সর্বত্র । মদন দেব বলেছেন চিত্রাঙ্গদাকে :
কেটে যাক রঙিন কুয়াশা
দেখা দিক শুভ্র আলোক ।
মায়া ছেড়ে দিক পথ,
প্রেমের আসুক জয়রথ
রূপের অতীত রূপ
দেখে যেন প্রেমিকের চোখ—
এফ. এইচ. ব্র্যাডলী যাকে চিহ্নিত করেছেন appearance ও reality বলে তাদেরই দ্বন্দ্ব নির্ধারিত হচ্ছে মদনের ভাষ্যে। Reality “চিত্রাঙ্গদার” ভাষায় ‘রূপের অতীত রূপ’। অসুন্দরকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করলে তার ভিতর দিয়ে সুন্দরের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে কিভাবে। নন্দনতত্ত্ববিদ ডব্লিউ. টি. স্টাস বলেছেন, কুশ্রীতা প্রকৃতপক্ষে সুন্দরের একটি প্রজাতি, যদি অসুন্দরকে আমরা নৈতিক অশুভ বলে বিবেচনা করি। সুন্দরের বিপরীত কুশ্রীতা নয়, বরং যা সুন্দর নয় তা-ই, অথবা যা নান্দনিক অর্থে নিস্পৃহ, তা। শিল্পে অসুন্দরের প্রয়োজন অন্য একটি অর্থেও আছে। জনৈক শিল্প সমালোচক বলেছেন, শিল্পে অথবা প্রকৃতিতে অসুন্দর একটি অস্বস্তির, এমনকি বেদনাবোধেরও জন্ম দেয়। আমরা জানি, শিল্প কোনো নির্দিষ্ট প্রকাশে, শৈলীতে বা আঙ্গিকে যেমন আবদ্ধ নয়, তেমনি বহুবিচিত্র বোধ-অনুভূতি, রস বা ভাবের উৎপত্তিও আর্টের বৈশিষ্ট্য। তাহলে যে বেদনাবোধ অসুন্দর থেকে আসে, তারও প্রয়োজনীয়তা আছে। শিল্পে জীবন বিধৃত না হলে তা পরিপূর্ণ হয় না; অথচ জীবন মানেই দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনে দ্বন্দ্ব স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার, এবং এই দ্বন্দ্বে পক্ষ-প্রতিপক্ষ হতে পারে অসংখ্য। শিল্পে যদি এই দ্বন্দ্ব না বিধৃত হয়, তবে তার গঠন আচরণ যতই নির্ভুল হোক, প্রকাশ হোক যতই চমৎকার বা ব্যাকরণসম্মত, তাতে উত্তাপ থাকবে অনুপস্থিত। সুন্দর ও অসুন্দরের সহঅবস্থান, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে নান্দনিক আগ্রহ জন্ম নেয়, জীবনবোধের বিশ্বস্ত প্রকাশ হয়।
সুন্দর ও অসুন্দরের সম্পর্কটি কত নিবিড়, এবং শিল্পে এদের অবস্থান যে পরিপূরক বা সম্পূরক শক্তি হিসেবে, তার একটি নিদর্শন লোকজ-শিল্প। লোকজশিল্পের অন্যতম রূপকথায় সুন্দর ও অসুন্দর অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় চিহ্নিত, বস্তুত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুন্দরের এ রকম প্রকাশ অন্য কোথাও দেখা যাবে না; কিন্তু লক্ষণীয়, সকল দেশের রূপকথায় এই সুন্দরের আবাহনের পাশাপাশি অসুন্দর বা কুশ্রীতাও উপস্থিত। দৈত্য, দানো, ডাইনী, ডাকিনী, ভূত, প্রেত ইত্যাদি ঐ অসুন্দরেরই নানা রূপ। প্রধান চরিত্রের অভিযান প্রায়শঃই এই ভূত-প্রেত বা দৈত্য-দানো আধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে, শেষে রূপের চরম প্রতীক কোনো রাজকন্যাকে উদ্ধারের মধ্য দিয়ে অথবা দৈত্য ইত্যাদির নিপীড়নের মধ্য দিয়ে। এখানে যে একটি মিথের নক্সা কাজ করে, তাতে সুন্দর অসুন্দরের প্রকাশ কখনো সরাসরি, কখনো প্রতীকী। রূপকথার রাজকন্যারা এক ‘আদর্শ সৌন্দর্যের’ প্রতীক, রাজপুত্র সেই সৌন্দর্যের সাধক। রূপকথার কাঠামো ও প্রতীকী যাত্রায় শিল্পীর নিজস্ব যাত্রা ও পরিচয়টি লুকায়িত থাকে। তিনি নিজেও রূপের ভিতর দিয়ে রূপের অতীতকে, অসুন্দরের ভিতর দিয়ে সুন্দরকে আবাহন করেন।
সুন্দরের পাশে অসুন্দর আর্টে কেন প্রয়োজনীয় তার একটি কারণ : অসুন্দরকে বলা হয় সুন্দরের উদ্বোধক। সুন্দর বৈধ ও আকর্ষণীয় অসুন্দরের কারণেই; আঁধার আছে বলেই আলো এত ইন্সিত। দ্বিতীয় কারণটি হলো : সুন্দর যেমন সক্রিয় একটি নীতি (principle), অসুন্দরও তেমন। বলা যায় অসুন্দরকে নঞর্থক বলে ধরে নিলে তার কর্মোদ্দীপক নীতিটি (active principle) হয় অতিরিক্ত। এর ফলে সুন্দরের তুল্যমূল্য বিচারে সক্রিয় উপাদানটি যোগ হয়। ক্রোচে অসুন্দরকে বৈধ বলেছেন এ প্রসঙ্গেই। তাঁর মতে ; যদি অসুন্দরে সুন্দরের কোনো উপকরণ না থাকতো, এবং তা হতো পরিপূর্ণ, তাহলে ঠিক এ কারণেই সে আর অসুন্দর থাকতো না। বিমূল্য (disvalue) হতো অ-মূল্য (non-value); সক্রিয়তা পর্যবেশিত হতো নিক্রিয়তায় । অর্থাৎ অসুন্দরের একটি সক্রিয় চরিত্র আছে। শিল্পের গতিশীলতার (dynamism) জন্য এই সক্রিয়তার প্রয়োজন ক্রোচের মতো অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
সুন্দর বস্তু কেন সুন্দর এর প্রচুর দার্শনিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তবে সৌন্দর্যের কোনো কার্যকারণ নেই– একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। সৌন্দর্যের কোনো উদ্দেশ্য নেই, তা প্রয়োজন-অতিরিক্ত। “নীলনব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে” চিত্রের মধ্যে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, তা কোনো প্রয়োজনসিদ্ধ সৌন্দর্য নয় : কৃষকের কল্যাণ আসে বলে আষাঢ়ের ধারাপাত সুন্দর এমন কথা কেউ বলবে না। যদিও এক পর্যায়ে এমন ধারণা সৌন্দর্যানুভূতিতে যুক্ত হতে পারে বৈকি। যদি হয়, তবে তা হবে বহিরারোপিত। উদ্দেশ্যমূলক সৌন্দর্য সৃষ্টি সফল হলেও সৃষ্টিপ্রক্রিয়াটিই হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; সৃষ্ট বস্তু উদ্দেশ্যনিরপেক্ষই থেকে যায়। জগতের অনেক সুন্দর বস্তুই প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছিলো, কিন্তু সৃজিত বস্তুটি প্রথমে সুন্দর অতঃপর প্রয়োজনীয়। অনেকে সৌন্দর্যসৃষ্টির প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনকে একেবারেই বাদ দিতে চান, অনেকে আবার এ-ও বলেন, সকল সৌন্দর্যই প্রয়োজনে সৃষ্ট হয়। উভয় মতবাদেই অতিরঞ্জন আছে, সত্যটি এদুয়ের মাঝামাঝি কোথাও লুকায়িত। বস্তুত শিল্পবস্তু, যা শিল্প-প্রক্রিয়ার সমাপ্ত উৎপাদ (finished product), তা সব সময়ই স্বয়ম্ভু। তাকে নিজের প্রেক্ষিত ছাড়া অন্য কোনো প্রেক্ষিতে দেখা যায় না। এই শিল্পকর্মের পেছনে জীবনের তাগিদ থাকতে পারে, আবার অত্যন্ত গভীর নান্দনিক বোধ থাকতে পারে, যার উল্লাস শুধু নিছক আনন্দে। কিন্তু শিল্পবস্তুটি তার স্বয়ম্ভু চরিত্রের জন্য এদের বিবেচনার বাইরে। তাই বলে সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য বা উদ্দেশ্য ইত্যাদিকে এখানে নাকচ করা হচ্ছে না। নক্সী কাঁথা দিয়ে শীত নিবারণ করা যায়,তাকে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখাও যায়। উভয় ক্ষেত্রে নক্সী কাঁথাটির সৌন্দর্য একই থেকে যায়। অর্থাৎ ব্যবহার করা হলেও নক্সী কাঁথাটির সম্বন্ধে আমাদের সৌন্দর্যধারণা মোটেই পরিবর্তিত হচ্ছে না। সুন্দরকে প্রয়োজনবাদীরা জাগতিক কল্যাণের জন্য ব্যবহার করে তার প্রকৃতিকে খর্ব করেছেন বলে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কলাকৈবল্যবাদীরা, তার ভিত্তি তত মজবুত নয়। শিল্পবস্তু সৌন্দর্য পরিচয় প্রয়োজনবাদেও যেমন নয়, তেমনই অলংকারবাদেও নয়; এই পরিচয় তার সৌন্দর্যের আত্যন্তিক স্বভাবে। কান্ট তাঁর সৌন্দর্যদর্শনের এই বিতর্কের একটি সমাধান দিয়েছেন এইভাবে যে, নান্দনিক বিচারে সুন্দর বস্তুর পরিচয় হচ্ছে তার উদ্দেশ্যবিহীন উদ্দেশ্যটি; অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যের কোনো লক্ষ্য নেই, বা নিজস্ব চরিত্র সম্বন্ধেও যার কোনো ধারণা নেই। সুন্দরের একটি উদ্দেশ্য অবশ্য আছে, তবে তা উদ্দেশ্যের সাধারণ সংজ্ঞায় পড়ে না। সেটি হলো- সৌন্দর্য। আনন্দের উদ্দেশ্য যেমন আনন্দ, সৌন্দর্যের তেমনি সৌন্দর্য। তবে প্রয়োজনবাদীদের ব্যবহৃত অর্থে উদ্দেশ্য আর কান্টের ‘উদ্দেশ্য’ এক নয়।
সুন্দর উদ্ভাসিত হয় বস্তুর অর্জিত রূপে, সামঞ্জস্যে, আনুগুণ্যে: চিত্রকলার রূপ দেশ বা মাত্রা এবং রঙের পরিপূর্ণ বা আনুপাতিক ব্যবহারে, সঙ্গীতে সুরের সঙ্গতিতে, কাব্যে ভাব, ভাষা, ছন্দ ইত্যাদির সাবলীল প্রয়াসে। তেমনি অসুন্দরের প্রকাশ এদের অনুপস্থিতিতে বা অসঙ্গত ব্যবহারে, বিকৃতিতে। কিন্তু চূড়ান্ত শিল্পবিচারে এটা বাহ্য। সুন্দর-অসুন্দরের প্রসঙ্গটি বস্তুতঃই আপেক্ষিক। জর্জ সান্টায়ানা বলেছেন, যে সামঞ্জস্য শুধু বাহ্যিক মাত্রার উপর ভিত্তি করে অর্পিত, যা নিজ থেকে গতিশীল হতে পারে না, শিল্পবস্তুর অন্যত্র গতি সঞ্চার করতে পারে না, তা আংশিক এবং ক্ষণস্থায়ী, তাকে মায়া বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু একজন শিল্পরসিকের কাছে যা মনে হবে বহিরারোপিত, ক্ষণস্থায়ী, আংশিক, অন্যজনের কাছে তাকে মনে হবে স্বতঃস্ফূর্ত, দীর্ঘমেয়াদী এবং সম্পূর্ণ। আপাত অসুন্দর বস্তুকে কোনো এক মুহুর্তে সুন্দর মনে হতে পারে। গলির পুঁতিগন্ধময় ডাস্টবিনের উপর চাঁদের আলো পড়লে তাকে কুশ্রী মনে হবে না; কালো কুচ্ছিত সেবিকা মেয়েটিকে রোগমুক্তির আনন্দে মনে হবে জগতের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। সৌন্দর্য প্রকৃতপক্ষে একটি মানসিক বোধ, যা জাগ্রত হয় ‘সুন্দরের’ সান্নিধ্যে। এই ‘সুন্দর’ আদর্শ-সুন্দর হতে পারে, আপাত সুন্দর হতে পারে: আবার এই ‘সুন্দর’-এর মধ্যে প্রথাগত সৌন্দর্যের কিছু না-ও থাকতে পারে। মন সুন্দরকে সৃষ্টি করে তাকে বৈধতাও দিতে পারে, জগতের সে দৃষ্টি থাকুক আর না থাকুক, জগৎ তাকে গ্রহণ করুক না করুক। কাজেই অসুন্দরকে পত্রপাঠ নাকচ না করে দেয়া বা উড়িয়ে দেয়া শিল্পবিচারে অবিবেচনার কাজ। ১৯১০ সালে লণ্ডনে উত্তর প্রভাববাদী চিত্রকর্মের যে প্রদর্শনী হয়, প্রি-র্যাফেলাইট আন্দোলন থেকে সদ্য আসা শিল্পরসিকের কেউ কেউ তাকে কুশ্রী বলে গালাগাল দিয়েছেন। বলেছেন, এসব অপ্রয়োজনীয় এবং বিকৃতি। অথচ এক যুগ পার না হতেই অত্যন্ত মেধাবী এবং স্বকীয়তায় ভাস্কর বলে এসব চিত্রকর্মকে ক্লাইষ্ট-এর নাটকগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর গ্যেটে তাকে নিন্দা জানিয়েছিলেন এভাবে যে, তাঁর নাটক লেখা হয়েছে ‘অদৃশ্য মঞ্চের’ জন্য। কিন্তু কিছুকাল পরেই ক্লাইষ্টের থিয়েটার হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি দৃশ্যমান; গ্যেটের প্রশংসাও পেল। সৌন্দর্য অনেক সময় অনুষঙ্গে বিচার হয়, অনেক সময় উপাদান-উপকরণে, তাই বিতর্কের ক্রমাগত সফল দুষ্কর্মের ইতিহাস। তবে সুন্দর-অসুন্দরের বিচারে যে সহজ সত্যটি সহজে বিস্মৃত হন সবাই, তা হলো, সুন্দরের পরিচয় সে সুন্দর বলেই। অসুন্দর যে অসুন্দরের। এর উপর আমরা যতই বাতাবরণ চাপিয়ে দেই না কেন, ঐ সত্যে আমাদের ফিরে আসতেই হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন