৫৬. হাতে-পায়ে খিল ধরল রেমির

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

॥ ৫৬ ॥

হাতে পায়ে খিল ধরল রেমির। এত দুর্বল লাগছে শরীর যে, রাজা চলে যাওয়ার পর সে আবার শুয়ে পড়ল। অবেলায় খেয়েছে বলেই কি? বুকে বায়ুজনিত একটা চাপ, ব্যথা। একটু জল খেলে হত। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিছু করতে ইচ্ছে করছে না।

কথাটা ধ্রুবকে কি জানাবে? সে যে রাজার সঙ্গে বম্বে চলে যাচ্ছে একথাটা কি জানানো উচিত নয়?

না। তাই কি হয়! একটু আগেই তো সে ভেবেছিল ধ্রুবকে ছেড়ে খুব দূরে কোথাও তার চলে যাওয়া দরকার। তবে জানাবে কেন? তাছাড়া ধ্রুবর তো আর একজন বউ হবে। সে কি খুব সুন্দরী? খুব?

ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। ভারী অদ্ভুত অবস্থা। চোখের পাতা ভারী, হাই উঠছে বারবার। মাথায় ঝিমঝিমুনি, তবু স্নায়ুগুলি এত টান টান স্পর্শকাতর যে সামান্য শব্দে, সামান্য অনুভূতিতে চমকে উঠছে। চটকা ভেঙে যাচ্ছে বারবার। সে কি কারো জন্য অপেক্ষা করছে মনে মনে? কার জন্য? একটু ভেবে দেখল রেমি। না তো! সে কারো অপেক্ষা করছে না। কেউ তো আসার নেই। তবে?

সন্ধের মুখে দরজায় ঠক ঠক। উঠতে ইচ্ছে করল না রেমির। শুধু জিজ্ঞেস করল, কে? কী চাও?

বউদিমণি, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

না। তবে টায়ার্ড লাগছে। কেন?

বড়বাবু জিজ্ঞেস করতে পাঠালেন।

বলো গিয়ে একটু পরে যাবো।

না গেলেও চলবে। বড়বাবু বেরিয়ে যাচ্ছেন। শুধু জানতে পাঠালেন।

আচ্ছা। বোলো আমি টায়ার্ড।

রেমি চুপ করে পড়ে রইল। তার শ্বশুর বড় বেশী বিচক্ষণ। আর বিচক্ষণ বলেই রাজা যখন এই ঘরে ছিল তখন বাইরে মোতায়েন রেখেছিলেন জগাকে। ঘটনাটা ছোটো, কিন্তু মনে থাকবে রেমির। এতটা না করলেও উনি পারতেন। হয়তো রেমির ভালর জন্যই করেন। তবু আজ ব্যাপারটা ভারী দৃষ্টিকটু লেগেছে রেমির। এই পাহারা অনাবশ্যক। এই বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন ছিঁড়বার মুখে।

আস্তে আস্তে উঠল রেমি। উঠে আলমারি খুলল। ধ্রুবর কয়েকটা প্রিয় বোতল লুকোনো থাকে ওপরের তাকে। জামাকাপড়ের পিছনে। কাঠের চেয়ারে উঠে রেমি একটা বোতল নামাল। গায়ে লেখা হুইসকি।

খুব নেশা হবে নাকি? হোক। শরীরের ঝিমুনিটা তো কাটবে। এই ঘর থেকে আজ সে আর বেরোবে না। শ্বশুরমশাই গন্ধ না পেলেই হল।

দরজায় ছিটকিনি দিয়ে এল রেমি। গেলাসে অল্প একটু ঢেলে অনেকখানি জল মেশালো। তারপর চুমুক দিল। এই প্রথম খাচ্ছে না। ধ্রুবর পাল্লায় পড়ে অতীতে তাকে কয়েকবার এক-আধ চুমুক খেতে হয়েছে। স্বাদ তার চেনা। তরলটুকু শেষ করতে খুব একটা বেশী সময় নিল না সে। পরের বার একটু বেশী ঢালল, জল মেশাল কম।

কতটা খেয়েছে তা ঘণ্টা খানেক বাদে হিসেব করতে পারে না আর রেমি। তবে সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার শরীর আর মাথা আর তার নিজের জিম্মায় নেই। কানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। চারদিকটা কেমন যেন অবাস্তব, অবিশ্বাস্য। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে।

চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় বসল রেমি। পাশের টেবিলে অর্ধেক ভরা গেলাসটা রেখে একটু কাত হল। বোঁ করে ঘুরে উঠল মাথা। টলমল করছে শরীর। তার কি আনন্দ হচ্ছে? খুব আনন্দ! না তো!

কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে পড়ে থাকে রেমি। ঘুম আসছে। ভারী রোডরোলারের মতো অতিকায় এক ঘুম তাকে বিছানায় পিষে ফেলছে। এবার সে ঘুমোবে। চ্যাপটা হয়ে, হালকা হয়ে। নিচ্ছিদ্র এক ঘুমের নেই-রাজ্যে হারিয়ে যাবে।

দরজায় সামান্য নাড়া। রেমি উঠল না। চাইল না।

দরজাটা খোলো। ধ্রুবর গলা।

রেমি একটু তাকাল। দরজাটা কি তার খুলে দেওয়া উচিত? ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। সে তো রোজ ধ্রুবর জন্য দরজা খুলে দেয় না। তবে? সে আবার চোখ বোজে।

দরজায় দুম দুম করে দুটো শব্দ হল। রেমি একটু হাসল মাত্র। উঠল না।

শুনছো! ভিতরে কী করছ? দরজাটা খুলে দাও।

রেমি একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরল। মাথার মধ্যে কী অদ্ভুত এক রিমঝিম! সমস্ত শরীরে একটা ভাসন্ত ভাব। যেন ভার নেই তার।

ধ্রুবর, গলার স্বর হঠাৎ আতঙ্কিত একটা আর্তনাদের মতো শোনাল, রেমি! রেমি! সাড়া দাও। কী হয়েছে তোমার?

রেমি আধো ঘুমে খিল খিল করে হাসল। বেশ হয়েছে। খুব হয়েছে। এবার একটু রেমির জন্য কাঁদো তো পাষাণ! একটু কাঁদো। জীবনে অন্তত একবার। মরার আগে দেখে যাই।

ধ্রুব খুব দ্রুত পায়ে সরে গেল দরজার কাছ থেকে। তারপর উত্তেজিত স্বরে ডাকতে লাগল, জগাদা! জগাদা! শিগগির এসো। কুইক।

জগা দৌড়ে এল, টের পেল রেমি।

কী হয়েছে?

দরজা ভাঙতে হবে।

কেন?

মনে হচ্ছে রেমির খুব বিপদ! তাড়াতাড়ি করো।

বুম করে বোমার মতো একটা আওয়াজ হল। দরজার ছিটকিনি ভেঙে পাল্লা দুটো ছিটকে গেল দুদিকে।

বউদিমণি! কী হয়েছে?

এত শব্দে রেমি দুহাতে-কান ঢেকে ফেলেছিল। আস্তে মুখ ঘুরিয়ে জগার দিকে তাকাল সে। মাথা টলমল করছে, তবু বাস্তববুদ্ধি একেবারে হারায়নি। চোখটা বন্ধ করে বলল, তুমি যাও জগাদা। তোমার ছোড়দাকে পাঠিয়ে দাও। দরজাটা ভেজিয়ে যেও।

জগা একটু স্থির চোখে রেমি এবং ঘরের পরিবেশ লক্ষ করল। তারপর বেরিয়ে গিয়ে ধ্রুবকে ডেকে বলল, ডাক্তার ডাকতে হবে না। তুমি ঘরে যাও।

কী হয়েছে?

গিয়ে দেখ। খুব খারাপ কিছু নয়।

ধ্রুব ঘরে আসে। দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে রেমির কাছে এসে সেও সমস্তই লক্ষ করে। রেমি ভেবেছিল, ধ্রুব খুব হাসবে, বিদ্রূপ করবে তাকে।

কিন্তু ধ্রুব সেরকম কিছুই করল না। গেলাসটা তুলে নিয়ে একটু দেখল। তারপর টেবিল থেকে বোতলটাও। রেমি মিটমিট করে চেয়ে দেখছিল।

ধ্রুব গেলাস আর বোতল রেখে রেমির দিকে চেয়ে বলল, উঠতে পারবে?

কেন?

বাথরুমে গিয়ে গলায় আঙুল দাও।

না।

দাও। নইলে কষ্ট পাবে। অনেকটা খেয়েছো।

আমি আরো খাবো।

ধ্রুব আর কথা বলল না। খুব আচমকাই রেমিকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, গলায় আঙুল দাও।

আমি পারব না।

আচ্ছা, দাঁড়াও। বলে ধ্রুব আচমকাই মাথাটা ধরে একটু নাড়া দিল। অমনি টলমল করে উঠল রেমির শরীর। বমি উঠতে লাগল বুক বেয়ে।

গলায় আঙুল দিতে হল না। ভাতসুন্ধু গোটা তরলটা গলগল করে বেরিয়ে যেতে লাগল। সঙ্গে তীব্র অম্বলের টক স্বাদ। রেমি সেই বমির তোড় সহ্য করতে না পেরে পড়েই যেত হয়তো। কিন্তু ধ্রুবর লোহার মতো শক্ত হাত ধরে রইল তাকে।

বমির পর কেমন দিশাহারা লাগছিল রেমির। শরীর শূন্য, মাথা শূন্য। ভারী অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। সে যেন এই জগতের মানুষই নয়।

ধ্রুব তাকে আবার কোলে তুলে ঘরে এনে খাটে শুইয়ে দিল। পাখা ঘুরতে লাগল বনবন করে। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা জল এনে তাকে অনেকখানি খাইয়ে দিল। তারপর অদূরে চেয়ারে বসে রইল চুপ করে।

প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে রেমির। কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না। কী যে হচ্ছে তার শরীরের মধ্যে!

ধ্রুব অনেকক্ষণ অবস্থাটা লক্ষ করে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ঘুম আসছে না তোমার?

না। আমার গলা চিরে গেছে, মাথা ঘুরছে।

তবু ঘুমিয়ে পড়ার কথা। ঘুম আসছে না কেন?

তোমার জন্য। তুমি কেন এভাবে তাকিয়ে আছো আমার দিকে?

আমি বাইরে গেলে ঘুম পাবে?

হ্যাঁ। তুমি যাও।

ধ্রুব নিঃশব্দে উঠে বাইরে গিয়ে দরজাটা টেনে দিল। রেমি এপাশ ওপাশ করতে লাগল। মাথাটা কি লোহার মতো ভারী? না কি বেলুনের মতো হালকা? কী যে হচ্ছে তার ভিতরে।

আচমকা উঠে বসল সে। তারপর ডাকল, শোন! ওগো! এই! শোনো না শিগগির!

ধ্রুব দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। দরজাটা ভেজিয়ে দিল আবার।

ডাকছো কেন?

আমি বম্বে চলে যাচ্ছি, জানো? খুব ব্যাকুলভাবে রেমি বলে।

জানলাম। ধ্রুবর কণ্ঠস্বর ভাবলেশহীন।

কার সঙ্গে জানো?

না তো।

রাজার সঙ্গে।

তাই নাকি?

ভাল হবে না?

ভালই তো।

যেতে দেবে আমাকে?

আমি যেতে দেওয়ার কে? তুমিই তো যাবে।

আঃ, বলোই না যেতে দেবে কি না।

দেবো।

সত্যি বলছ?

বলছি।

তোমার একটুও কষ্ট হবে না আমার জন্য?

এখন ঘুমোও।

ঘুম আসছে না যে।

চেষ্টা করো। আমি বাইরে যাচ্ছি।

তাহলে আমি আবার হুইসকি খাবো।

ধ্রুব সামান্য একটু হাসল। তারপর বলল, ভয় দেখাচ্ছো?

না তো! আমি খাবো।

খাবে তো কী হয়েছে? অনেকেই খায়। মেয়েরা আজকাল খুব টানছে।

আমি কি তাদের মতো?

হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে হয়ে যাবে। তবে একদিনে অত নয়।

বম্বেতে গিয়ে আমরা কী করব জানো?

না।

তুমি যা চেয়েছিলে তাই।

খুব ভালো।

তোমার কিছু যাবে আসবে না?

না। বরং খুশি হবো।

রেমি ধ্রুবর মনোভাব জানে। তবু কেমন যেন এই জবাবে সে অবাক হয়ে গেল। বলল, একটা কথা বলবে?

বলব না কেন?

আমার ওপর তোমার এত ঘেন্না কেন? এত ঘেন্না কি একজন মানুষকে আর একজন করতে পারে?

তোমাকে কখনো ঘেন্না করিনি।

করোনি? তাহলে আমি অন্য একজনের সঙ্গে চলে যাবো জেনেও খুশি হও কী করে?

বলেছি তো, আমি তোমাকে ঘেন্না করি না, কিন্তু তোমার দায়িত্ব চিরকাল বইতেও রাজি নই। বিয়ে করার জন্য পুরুষের এক ধরনের যোগ্যতা লাগে। আমার তা নেই।

তবু বিয়ে তো হয়েছে।

না, হয়নি। এটা বিয়ে নয়। চাপিয়ে দেওয়া।

তুমি আমাকে ঘেন্না করো।

না, করি না। কখনো করিনি।

আমাকে তুমি কখনো একটুও ভালবাসোনি!

তাও বাসিনি। ঠিক কথা। কিন্তু আজ নতুন করে এসব কথা কেন? এখন ঘুমোও।

ঘুম কি আসে! কত চিন্তা।

কিসের চিন্তা? জীবনটাকে খেলা হিসেবে নাও। আয়ু কতদিনেরই বা। সব ঠিক হয়ে যাবে। বম্বে ভাল শহর।

আজ রাজা এসেছিল।

জানি।

কী করে জানলে? তোমরা কি সবসময়ে বাড়ির বউঝিদের পিছনে স্পাই লাগিয়ে রাখো?

আমি রাখি না। তবে তোমার গবুচন্দ্র রাখেন।

কে গবুচন্দ্র?

মন্ত্রী গবু, তোমার শ্বশুর।

উনি তো আর মন্ত্রী নন।

না। তবে শোনা যাচ্ছে উনি সেনট্রাল মিনিস্টার হবেন। ডেপুটি মন্ত্রী-টন্ত্রী বোধহয়। ফেরেববাজ লোকদের পথ এ সমাজে সবসময়ে খোলা।

ফেরববাজ কাকে বলে?

তোমার শ্বশুরের মতো লোকেরাই ফেরেববাজ। অন্য ডেফিনিশনের দরকার কী?

ওঁর ওপর তোমার রাগ বলেই কি আমাকে যন্ত্রণা দাও এত?

হতে পারে। এখন আমি এত কথা বলতে পারছি না রেমি। তুমি ঘুমোও। আমি বরং বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে যাই।

না, না! আঁতকে উঠে রেমি বলে, বাতি নিবিও না। তাহলে আমি ভয়েই মরে যাবো।

বাতি চোখে লাগছে বলেই বোধহয় ঘুম আসছে না।

ঘুম আসবে। তুমি কাছে থাকো।

এই তো একটু আগে আমাকে চলে যেতে বললে।

তখন বুঝতে পারিনি।

কী বুঝতে পারোনি?

তোমাকে যে আমার ভীষণ দরকার।

কিসের দরকার?

আমি একজনকে একবার দেখতে চাই। দেখাবে?

ধ্রুব অবাক হয়ে বলে, কাকে দেখাবো?

তাকে।

সে কে বলবে তো!

যাকে তুমি ভালবাসো। আমি চলে গেলে যাকে বিয়ে করবে। একবার চোখের দেখা দেখব। কিছু বলব না। ভয় নেই।

এ কথায় ধ্রুবর ফর্সা রং টকটকে রাঙা হয়ে গেল। প্রথমটায় সে কিছু বলতে পারল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঘুমোও.

বারবার ঘুমোতে বলছ কেন? বললাম যে ঘুম আসছে না। যদি ঘুম পাড়াতে চাও তবে একটু বিষটিষ কিছু এনে দাও। একেবারে ঘুমিয়ে পড়ি।

তাহলে জেগে শুয়ে থাকো। আমি যাই।

তুমি যেও না। বেশীদিন তো আর নয়। আমি বম্বে চলে যাচ্ছি। একটু থাকো।

তুমি বড্ড বাজে বকছ।

খুব বাজে বকছি? কথাটা সত্যি নয়?

আমি কাউকে বিয়ে করব একথা সত্যি নয়।

তবে কী করবে?

আমি বিয়ে ব্যাপারটাকে বিশ্বাসই করি না।

তবে কিসে করো?

ওটা একটা ছেলেমানুষী প্রথা। মানেই হয় না।

তুমি তাকে বিয়ে করবে না?

না।

তবে একসঙ্গে থাকবে কী করে?

থাকলে দোষ কী? দুনিয়াটা তো বিয়েহীন সমাজের দিকেই এগোচ্ছে।

কী যে বলো!

তোমার বুঝতে একটু সময় লাগবে বেমি। বিয়ে একটা অচলায়তন। ওই প্রথা উঠে গেলেই ভাল।

আমি অত তর্ক করতে পারি না। আমি তাকে একবার দেখব।

এসব তোমাকে কে বলল? রাজা নিশ্চয়ই।

রাজাই।

বলাটা ওর উচিত হয়নি।

কেন, আমি শকড হবো বলে?

হ্যাঁ। তুমি আমার ওপর বড় বেশী নির্ভর করতে চাও।

কিন্তু আমি সামলে গেছি। দেখছে না, কেমন স্বাভাবিক!

স্বাভাবিক হলে অতখানি হুইসকি গিলে বসে থাকতে না।

রেমি মাথা নেড়ে বলে, এসব ভেবে খাইনি। আমার ঘুম আসছিল না, শরীরটা কেমন করছিল, তাই খেয়েছি। আমাকে একবার দেখাতে তোমার ভয় কী?

আমি কাউকে ভয় পাই না।

জানি। মেয়েটা কে বলো তো!

কেউ একজন হবে। অত ভাবছো কেন?

আমার চেয়ে ফর্সা?

জানি না।

জানো। বলতে চাও না। বললে দোষ কী? এই তো বললে ভয় পাও না।

তোমার চেয়ে ফর্সা নয়।

কেমন দেখতে?

এইসব ভেবেই বোধহয় তোমার ঘুম আসছে না?

মেয়েটাকে কবে দেখাবে গো?

দেখলে কি খুশি হবে?

খুশি কি হওয়া যায়?

তাহলে দেখতে চাইছো কেন?

আমার বর কেমন পাত্রী পছন্দ করল, সে আমার চেয়ে কত গুণ সুন্দর এসব জানার কৌতূহল হয় না?

রেমি, ব্যাপারটা খুব সরল অঙ্ক নয়। তুমি বোকা, ঠিক বুঝবেও না। তবে জেনে রেখো, এখনো ধ্রুব চৌধুরী মেয়েবাজ নয়।

তাই কি বলেছি!

তবে অত জেলাস কেন?

জেলাসি বোধহয় আমার একটু হওয়ার কথা!

কেন হবে? তুমিও তো অন্য একজনের সঙ্গে বম্বেতে ঘর বাঁধতে যাচ্ছে।

ঘর ভাঙতেই যাচ্ছি। কিন্তু সে তো তোমার জন্যই। আমি কি যেতে চেয়েছি?

কিন্তু যখন যাচ্ছো তখন সর্বান্তঃকরণেই যাও। পিছুটান রেখো না।

তোমাকেও একটা কথা বলি?

আবার কী কথা?

যাকে নিয়ে থাকবে বলে ঠিক করেছে তাকে একটু ভালবেসো, একটু মূল্য দিও। আমার মতো হেলাফেলা কোরো না।

উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। তবে সে তোমার মতো ছিঁচকাঁদুনে নয়। আমি কেমন সে জানে। তাই সে বেশী একসপেকটও করে না।

লিবারেটেড মহিলা নাকি?

ধরো তাই।

রেমি একটু ভেবে বলে, তোমার সঙ্গে এরকমই কাউকে মানাবে।

ধ্রুব একটু হেসে বলে, তাহলে পাত্রী পছন্দ!

আগে একবার চোখের দেখা দেখি।

ধ্রুব আচমকা কাছে এসে দুহাতে রেমিকে ধরে তুলল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি আমাকে ভালবাসো আমি জানি। একটা কাজ করতে পারো? ফর মাই সেক?

রেমির শরীর এই আকস্মিক স্পর্শে ঝংকার দিয়ে উঠল। ভিতরে ভিতরে মৃদু বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। বিহ্বল হতভম্ব চোখে সে ধ্রুবর মুখের দিকে কিছুক্ষণ বাক্যহারা চেয়ে রইল। তার ভিতরে একটি প্রার্থনা নীরবে মাথা কুটছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরো, ভীষণ জোরে। এত জোরে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাই আমি।

স্খলিত কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, কী গো? তোমার জন্য আমি সব পারি।

আমাকে ডিভোর্স দাও। ক্লিন ডিভোর্স।

তারপর?

কিছুদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থাকো।

তারপর?

তারপর আমি তোমাকে নিয়ে কোথাও একসঙ্গে থাকব। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী হিসেবে নয়।

একটুও না ভেবে রেমি ধ্রুবর বুকের মধ্যে মাথাখানা ক্লান্তভাবে রেখে বলল, যা বলবে করব, যদি তাতে ভাল হয়।

ভালর জন্য নয় রেমি। আমি প্রথা ভাঙতে চাই।

কেন যে তুমি এরকম পাগল!

তুমি বম্বে যেও না রেমি। পারবে না।

কে যেতে চেয়েছে?

গেলেও তুমি সহ্য করতে পারবে না বেশীদিন। আমি তোমাকে জানি।

রেমি মুখ তুলল। ধ্রুব তার সুন্দর টুলটুলে মুখখানার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ! তারপর যা সে কদাচিৎ করে তাই করল আজ। খুব নিবিড়ভাবে চুমু খেল রেমিকে। বিছানায় তারা যখন ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল তখন ধ্রুব বলল, আর হুইসকি খেও না।

রেমি বলল, মেয়েটাকে দেখাবে তো! ঠিক?

সকল অধ্যায়

১. ১. ১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে
২. ২. টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান
৩. ৩. কিশোরী রঙ্গময়ি
৪. ৪. ধ্রুব
৫. ৫. ধনীর বাড়িতে শোক
৬. ৬. নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই
৭. ৭. ভাই হেমকান্ত
৮. ৮. হানিমুন
৯. ৯. সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার
১০. ১০. রেমি
১১. ১১. পিতার বাৎসরিক কাজ
১২. ১২. সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল
১৩. ১৩. ভাই সচ্চিদানন্দ
১৪. ১৪. ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন
১৫. ১৫. ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর
১৬. ১৬. অচেনা গলা
১৭. ১৭. তরল মন্তব্য
১৮. ১৮. ছন্দাকে নিয়ে আসা হল
১৯. ১৯. নতুন এক আনন্দ
২০. ২০. রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না
২১. ২১. রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন
২২. ২২. কূট সন্দেহ
২৩. ২৩. গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না
২৪. ২৪. রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে
২৫. ২৫. মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন
২৬. ২৬. আচমকা একদিন দুপুরে
২৭. ২৭. শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল
২৮. ২৮. বেলুন দিয়ে সাজানো একটা জিপগাড়ি
২৯. ২৯. বিশাখা
৩০. ৩০. শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকার
৩১. ৩১. হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন
৩২. ৩২. থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব
৩৩. ৩৩. পুজো আর আম-কাঁঠালের সময়
৩৪. ৩৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল রেমির
৩৫. ৩৫. চপলার বাবা মস্ত শিকারি
৩৬. ৩৬. বিস্ময়টাকে চট করে লুকিয়ে
৩৭. ৩৭. চপলা বাড়িতে পা দেওয়ার পর
৩৮. ৩৮. ঘর-বার করতে করতে
৩৯. ৩৯. এত কলকব্জা কখনও দেখেনি সুবলভাই
৪০. ৪০. অপারেশন থিয়েটারের চোখ-ধাঁধানো আলো
৪১. ৪১. বৈশাখ মাসে কোকাবাবুদের একটা মহাল
৪২. ৪২. রেমি যে মারা যাচ্ছে
৪৩. ৪৩. অনাথ ডাক্তারের মেলা টাকা
৪৪. ৪৪. সেই একটা দিন কেটেছিল
৪৫. ৪৫. কয়েকদিন যাবৎ অনেক ভাবলেন হেমকান্ত
৪৬. ৪৬. ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে
৪৭. ৪৭. মামুদ সাহেব
৪৮. ৪৮. মানুষেরা ভীষণ অবুঝ
৪৯. ৪৯. এক তীব্র, যন্ত্রণাময় অশ্বখুরধ্বনি
৫০. ৫০. এত ভয় রেমি জীবনেও পায়নি
৫১. ৫১. কুঞ্জবনে আর এসো না
৫২. ৫২. খুব নরম খুব সবুজ ঘাস
৫৩. ৫৩. একটা পঙক্তি
৫৪. ৫৪. একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল
৫৫. ৫৫. স্ত্রী চরিত্র কতদূর রহস্যময়
৫৬. ৫৬. হাতে-পায়ে খিল ধরল রেমির
৫৭. ৫৭. এরকম বৃষ্টির রূপ
৫৮. ৫৮. মাথার ঠিক ছিল না রেমির
৫৯. ৫৯. চপলা খুব ধীরে ধীরে
৬০. ৬০. রাজার ফ্ল্যাট
৬১. ৬১. বাবা, আমি কাল যাব না
৬২. ৬২. গায়ে নাড়া দিয়ে
৬৩. ৬৩. ইরফান নামে যে লোকটা
৬৪. ৬৪. আজ আর নেই
৬৫. ৬৫. শশিভূষণের মামলা
৬৬. ৬৬. যে সময়টায় রেমির পেটে ছেলেটা এল
৬৭. ৬৭. আজ শচীনের চেহারার মধ্যে
৬৮. ৬৮. মেয়েটির হাসিটি অদ্ভুত সুন্দর
৬৯. ৬৯. শচীন কাশী রওনা হওয়ার আগের দিন
৭০. ৭০. গাড়ির ব্যাকসিটে বসে ধ্রুব
৭১. ৭১. বরিশালের জেলে সতীন্দ্রনাথ সেনের অনশন
৭২. ৭২. একটি লোকও নার্সিংহোম ছেড়ে যায়নি
৭৩. ৭৩. কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল
৭৪. ৭৪. ধ্রুবর যে একটা কিছু হয়েছে
৭৫. ৭৫. এক সাহেব ডাক্তার আনানো হল
৭৬. ৭৬. ধ্রুব রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে
৭৭. ৭৭. লোকটা কী বলছে
৭৮. ৭৮. একটা হত্যাকাণ্ড এবং মৃত্যু
৭৯. ৭৯. আবার সেই কিশোরী
৮০. ৮০. সে আর সে
৮১. ৮১. প্রদোষের আলো
৮২. ৮২. ধ্রুব, বাপ হয়েছিস শুনলাম
৮৩. ৮৩. সংজ্ঞা যখন ফিরল
৮৪. ৮৪. প্রশান্ত ধ্রুবকে লক্ষ করছিল
৮৫. ৮৫. ফেরার পথে ঘোড়ার গাড়ি
৮৬. ৮৬. নোটন
৮৭. ৮৭. বজ্রনির্ঘোষের মতো কণ্ঠস্বর
৮৮. ৮৮. ধ্রুব আর নোটন
৮৯. ৮৯. রামকান্ত রায় খুন
৯০. ৯০. মরবি কেন
৯১. ৯১. হেমকান্ত একটু সামলে উঠেছেন
৯২. ৯২. বাথরুমের দরজা খুলে
৯৩. ৯৩. প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার তুলতে
৯৪. ৯৪. স্বচ্ছ গোলাপি মশারির মধ্যে
৯৫. ৯৫. ইহা কী হইতে চলিয়াছে
৯৬. ৯৬. কৃষ্ণকান্তকে দেখে জীমূতকান্তি
৯৭. ৯৭. আজ এই দিনপঞ্জীতে যাহা লিখিতেছি
৯৮. ৯৮. কৃষ্ণকান্ত নিজের বাইরের ঘরটায় এসে
৯৯. ৯৯. নীল আকাশের প্রতিবিম্বে নীলাভ জল
১০০. ১০০. ধ্রুব খুবই মনোযোগ দিয়ে
১০১. ১০১. যখন বাড়ি ফিরিলাম
১০২. ১০২. দরজা খুলে বৃদ্ধা
১০৩. ১০৩. বিশাখার বিবাহ
১০৪. ১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে
১০৫. ১০৫. কাশী আসিবার পর
১০৬. ১০৬. বাবা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন