৬৫. শশিভূষণের মামলা

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

॥ ৬৫ ॥

এমনিতে শশিভূষণের মামলায় জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে তো হেমকান্তর ছিল না। গ্রহদোষই হবে। ছোকরা তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। পুলিস ধরেই নিয়েছে, হেমকান্ত এই বিপজ্জনক খুনীকে পুলিসের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কথাটা সত্য না হলেও বিশ্বাস করবে কে? দারোগা রামকান্ত রায় আর শশিভূষণের ব্যাপারে হেমকান্তর লিখিত বিবৃতির জন্য চাপাচাপি করেনি। এ লক্ষণটাও ভাল নয়। পুলিস চুপচাপ তার মানে তলায় তলায় জল ঘোলা হচ্ছে। শশিভূষণের মামলায় সম্ভবত হেমকান্তকে টানা হবে। আর সেইজন্যই তাঁর বরিশাল যাওয়া। বিচক্ষণ ও করিৎকর্মা শচীন সঙ্গে থাকলে হেমকান্ত অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন। শচীন যদি না যায় তবে সঙ্গে কাকে নেবেন তাও হেমকান্ত স্থির করতে পারছেন না। একা বরিশাল গিয়ে অনভিজ্ঞ তিনি কীই বা করতে পারেন?

এইসব চিন্তা তাঁকে অস্থির করে তুলছিল। পুত্রবধূ এবং শচীনের কুৎসিত সম্পর্কটাও তাঁর এক কঠিন সমস্যা। এ সময়ে সুনয়নীর অভাব তিনি বড় বেশী টের পাচ্ছেন। সে যে খুব বুদ্ধিমতী ছিল এমন নয়, তবে এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। মনু বুদ্ধিমতী ঠিকই, কিন্তু হেমকান্তর অন্দরমহলে তো তার অধিকার নেই। সে কতটুকুই বা করতে পারে?

রাত্রিতে খেতে বসে কিছুই তেমন খেতে পারছিলেন না। ভারী অন্যমনস্ক।

রোজকার মতোই চপলা সামনে বসে আছে। অনেকক্ষণ শ্বশুরের অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, কী নিয়ে এত ভাবছেন বাবা?

ভাবছি কাল বরিশাল যেতে হবে, কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেই।

বরিশাল! কালই কেন? কোনো জরুরী দরকার?

কাল না গেলেও হত। কিন্তু শশিভূষণের মামলা উঠল বলে। বেশী দেরী করা ঠিক হবে না। এখন থেকে উকিল মোক্তারের ব্যবস্থা না করলে বিপদ। পুলিস তো আমাদেরও জড়াবে।

চপলা বিস্মিত হয়ে বলে, উকিল তো আছেই। শুনেছিলাম শচীনবাবুই নাকি কেস নেবেন।

চপলার মুখে শচীনবাবু শুনে হেমকান্ত এক ঝলক চপলার মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন। না, কোনোরকম বৈলক্ষণ্য নেই। হৃদয়গত দুর্বলতা থাকলে এত সহজে নামটা উচ্চারণ করতে পারত না। হৃদয়দৌর্বল্যের ব্যাপারটা হেমকান্ত ভালই বুঝতে পারেন আজকাল। হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, কথা তো ছিল, কিন্তু সে আজ বলে দিয়েছে, যেতে পারবে না। হাতে নাকি অনেক মামলা।

চপলা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, বরিশালে আমার বাবার এক বন্ধু থাকেন। সুধাকাকা। ভাল উকিল। তাঁকে দিয়ে কি হবে?

হেমকান্ত মুখ তুলে বলেন, স্থানীয় লোক পেলে তো সুবিধেই হয়। তবে পরিচয় তো নেই। তাছাড়া শশিভূষণ আমার বাড়িতে ছিল, সুতরাং এখানকার সব ঘটনা না জানলে তো তিনি আমার হয়ে লড়তে পারবেন না।

আপনি কী চান বাবা? শশিভূষণকে বাঁচাতে?

টেররিস্টদের আমি পছন্দ করি না। কিন্তু শশীকে বাঁচানো দরকার আমাদেরই স্বার্থে। হয় প্রমাণ করতে হবে যে আমরা না জেনে তাকে আশ্রয় দিয়েছি, নয় তো সে খুনের জন্য দায়ী নয়।

একটা কাজ করব?

কী করতে চাও?

আমি যদি আপনার সঙ্গে যাই?

তুমি! বলে হেমকান্ত বিস্মিত চোখে তাকালেন। পথি নারী বিবর্জিতা আপ্তবাক্যও তাঁর মনে পড়ে গেল। মেয়েদের নিয়ে চলাফেরার অভ্যাসও তাঁর নেই। তবু চপলার এই প্রস্তাবটা হঠাৎ মন্দ লাগল না।

একটু দোনামোনা করছিলেন দেখে চপলা বলল, সুধাকাকা খুব বড় উকিল। তার চেয়েও বড় কথা উনি একটু স্বদেশী ঘেঁষা। আমরা তাঁর বাড়িতেও উঠতে পারব।

হেমকান্ত ইতস্তত করে বলেন, তাঁর বাড়িতে। সঙ্গে দুজন চাকর যাবে, দুটো বাচ্চা, তুমি আমি সব মিলিয়ে যে মেলা লোক।

চপলা একটু হেসে বলল, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না বাবা। সুধাকাকার বিরাট বাড়ি, খুব বড়লোক। আমরা গেলে খুশিই হবেন।

হেমকান্ত একটু হাসলেন। বললেন, আমি তো ভাবছিলাম সবিতার শ্বশুরকে শেষ অবধি গিয়ে ধরব। তবে মেয়ের বাড়িতে ওঠার ইচ্ছে ছিল না।

ওরা তো ঠিক শহরে থাকে না বাবা; আপনার সুবিধে হত না।

হেমকান্ত একটু নিশ্চিন্তের হাসি হেসে বললেন, তাহলে চলো। ভালই হবে। তবে এ সময়টা খাল নদী সব ভরভরন্ত, বর্ষাটাও জোর গেছে, বরিশালের রাস্তা কি নিরাপদ হবে মা তোমাদের পক্ষে?

অত ভাববেন না। বরিশালের লোকেরা তো যাতায়াত করছে।

তা বটে। তাহলে গোছগাছ করে নাও।

পরদিন প্রায় কাউকেই না জানিয়ে, এক রকম চুপিসারেই হেমকান্ত বরিশাল রওনা হলেন। সঙ্গে চপলা, দুই ছেলেমেয়ে। দুজন শক্তসমর্থ চাকর এবং একজন মুনসী।

বাড়ির আশ্রিত ও কর্মচারীরা সবাই হেমকান্তর এই সদলবলে রওনা হওয়ার দৃশ্যটা দেখল কিন্তু কেউ ভিতরকার ব্যাপারটা জানল না।।

বিনোদচন্দ্র দুপুরবেলায় রঙ্গময়ীকে জিজ্ঞেস করলেন, ওঁরা গেলেন কোথায়?

তার আমি কী জানি!

তোকে বলেনি?

আমাকে বলবে কেন?

বিনোদচন্দ্র মেয়েকে ভয় করেন। রঙ্গময়ী বড় স্পষ্ট কথা বলে। তাছাড়া এই মেয়েটির কাছে তাঁর এক ধরনের অপরাধবোধও আছে। বিয়ে দিতে পারেননি বলে। তাই স্তিমিত স্বরে বললেন, তোকে তো কর্তা সবই জানান।

যদি জানিয়েই থাকে তবে তা রটানোর জন্য নয়।

রটানোর কী আছে?

কিছু আছে বাবা। আপনি সব বিষয়ে মাথা ঘামাবেন না।

বিনোদচন্দ্র ভালই জানেন, রঙ্গময়ীর সঙ্গে হেমকান্তর একটু গোপন সম্পর্ক আছে। তাতে রক্ষা। নইলে এ বাড়ি থেকে এতদিনে উচ্ছেদ হতে হত। মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মতো বললেন, রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপ, রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপ।

কার পাপ?

এ বাড়ির। এই তো শুনছি বাড়ির বউয়ের সঙ্গে নাকি উকিলবাবুর কী একটা কেলেঙ্কারী।

কারা বলছে?

সবাই। কে না জানে! শহরে ছি ছি পড়ে গেছে। সেই ভয়েই ছেলের বউকে নিয়ে কর্তাবাবু পালালেন নাকি?

হতে পারে।

ভাল। খুব ভাল।

রঙ্গময়ী গিয়ে বাড়ির কর্তৃত্ব নিল। এ ব্যাপারে তার অধিকার যে প্রশ্নাতীত তা সবাই জানে। রঙ্গময়ীকে এ বাড়ির দাসদাসী কর্মচারী সবাই মানে এবং যথেষ্ট ভয় খায়। ঘরে ঘরে তালা লাগানো ছিলই। তবু রঙ্গময়ী সব টেনেটুনে দেখল। বিশাখার ঘরে আর একটা চৌকি আনিয়ে নিজের বিছানা করাল।

বিশাখা শুয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল। বলল, কৃষ্ণকে আনাবে নাকি বারবাড়ি থেকে?

হ্যাঁ, ছেলেটা বড্ড পর পর ভাব করছে আজকাল।

তুমিই তো পোকা ঢুকিয়েছো।

তাই হবে। বলে রঙ্গময়ী অভিযোগটা মেনে নিল।

কিন্তু বিশাখার মুখচোখে রাগ বা বিরক্তি নেই। বরং একটু কৌতুক ঝিকমিক করছে। বইটা মুড়ে রেখে সে উঠে বসে বলল, আমার মাথাতেও পোকাটা ঢোকাবে পিসি?

কিসের পোকা! কী যা তা যে বলিস!

ঢং কোরো না পিসি। গোপনে গোপনে তুমি যে স্বদেশীদের দলে তা আমি জানি।

স্বদেশী করতে তুই আবার আমাকে কবে দেখলি? মরণ!

সব জানি পিসি। আমাকেও ওই দলে ঢুকিয়ে দাও।

দলের খোঁজ আমি রাখি না।

মাকালু গদাই ওরা সব তবে ঘুরঘুর করে কেন তোমার কাছে?

ওরে চুপ, চুপ! ওসব উচ্চারণও করতে নেই।

তবে যে বললে খোঁজ রাখো না!

আর জ্বালাসনি। ওরা আসে কে বলল তোকে?

আমি বারান্দার কোণ থেকে দেখতে পাই।

খবরদার, বাপের কানে কথাটা তুলিস না। একে তো শশীর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ায় চিন্তায় অস্থির, এসব শুনলে শয্যা নেবে।

বাবাকে বলব আমি অত বোকা নাকি? কিন্তু তোমারও সাহস কম নয়। এসব করছো কেন বলো তো!

এমনি কি করি? ছেলেগুলো মাঝেমধ্যে দিদি বলে এসে দাঁড়ায়।

কী বলো তুমি ওদের?

কিছু বলি না। এমনি খোঁজ খবর নিই, কোথায় কী হচ্ছে।

ওরা তোমাকে স্বদেশী বলে চিনল কী করে?

ফের স্বদেশী বলছিস মুখপুড়ি?

আচ্ছা বলো, চিনল কী করে?

শশী আসার পর থেকেই। ওরা ধরে নিয়েছে ওদের দলে।

ধরা যখন পড়বে তখন টেরটি পাবে তুমি।

রঙ্গময়ী তার ধারালো মুখে একটু হেসে বলল, আমার আর কিসের ভয় রে!

ওসব করো কেন? করতে ভাল লাগে?

সময়টা তো কাটাতে হবে। বড্ড লম্বা পরমায়ু আমার। সহজে ফুরোবে বলে মনে হয় না।

আমাকেও একটু স্বদেশী করতে দাও না।

কেন, তোর আবার এসব শখের কী হল?

আমারও যে লম্বা পরমায়ু কাটাতে হবে। কিছু করেই সময়টা কাটাই।

তার দরকার নেই। ভাল পাত্র দেখে বাপ বিয়ে দিয়ে দিক।

বিয়ে! ক্ষেপেছো পিসি?

কেন, করবি না?

মাথা নেড়ে বিশাখা বলল, কক্ষনো নয়। তোমার মতো থাকব।

তা কেন? আমার জীবনটা কি খুব সুখের?

খুব সুখের পিসি। বেশ আছো তুমি।

দূর পাগল! রাগ থেকে ওসব বলছিস।

মোটেই নয়। মাঝে মাঝে রাগ করি তোমার ওপর সে অন্য কারণে, কিন্তু তোমাকে ভালবাসি না? বলো!

রঙ্গময়ীর চোখে জল এল এ কথায়। কিন্তু দুর্বলতাটা প্রকাশ হতে দিল না। মুখে হাসি টেনে বলল, তা বাসবি না কেন? কিন্তু বিয়েতে অনিচ্ছেটা তো ভাল কথা নয়।

বিশাখা ঠোঁট উল্টে বলল, যা সব দেখছি তাতে আর বিয়ের কথা ভাবতেও ইচ্ছে করে না।

কী দেখলি আবার?

বৃন্দাবন লীলা, কেন, তুমিও কি দেখছো না? ঢং করো না পিসি।

রঙ্গময়ী কথাটা ঘোরানোর জন্য বলে, স্বদেশী করার কেন শখ হল বল তো!

এমনি। কিছু নিয়ে থাকি।

কিন্তু শশিভূষণকে তো তুই সহ্যই করতে পারতি না। রোগা ভোগা ছেলেটা দু দিন ছিল, তুই খুব রাগ করছিলি তার ওপর।

ভারী আনমনা হয়ে গেল বিশাখা। তারপর বলল, করতাম নাকি? তখন বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম না।

আজ পারিস?

পারি।

ছাই পারিস। এখন থেকে রোজ খবরের কাগজ পড়বি। তাতে দেশের হালচাল কিছু বুঝতে পারবি। দেশকাল সম্পর্কে একটু ধারণা না হলে কি এমনি এমনি স্বদেশী করা যায়?

বেশ তো। পড়ব।

রোজ কিন্তু।

হ্যাঁ গো। এখন একটা গল্প বলো।

ধাড়ি মেয়ে গল্প শুনতে চাস কেন? এখনও কি ছোটো আছিস?

আছি। অন্তত তোমার কাছে।

বলব। রাত্রে। এখন যাই, গিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে আসি।

নিয়ে এসো পিসি। ও কেমন ধারা যেন হয়ে গেল। আগের মতো ঝগড়া করে না, আদর খায় না। কেমন গম্ভীর বয়স্ক বয়স্ক ভাব। ওর দিকে তাকালে আমার কান্না পায়। কী হল বল তো!

কিছু হয়নি। বড় তো হচ্ছে।

ধ্যুৎ। কী যে বলো তার ঠিক নেই। কত আর বয়স হয়েছে? এখনো গাল টিপলে দুধ বেরোয়। চলো ওকে ধরে আনি দুজনে। ক’দিন তিনজনে মিলে এ ঘরে খুব আড্ডা হবে।

রঙ্গময়ী একটা শ্বাস ফেলে বলে, আড্ডা দেওয়ার ছেলেই কিনা। আসতেই চাইবে না হয়তো।

কেন আসবে না?

মেয়েদের সঙ্গ বর্জন করছে যে।

আমরা আবার মেয়ে নাকি। একজন দিদি, অন্যজন পিসি। দাঁড়াও ওর বায়ু আজ ছোটাবো।

না মা, ওসব জোর জবরদস্তি ভাল নয়। ওর মধ্যে একটু আগুন আছে। সেটা নিবিয়ে দিস না। যদি আসতে না চায় তবে জোর করার দরকার নেই।

আমার যে ওর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

হোক। কষ্টটা সহ্য কর। পিঠোপিঠি বড় হয়েছিস কষ্ট তো হবেই। বিয়ে হলেও তো ভাইকে ছেড়ে থাকতে হত!

বিশাখা প্রতিবাদ করল না। চুপ করে বসে রইল।

দুপুরে বিশাখার ঘরে রঙ্গময়ী একটু চোখ বুজেছে। বিশাখা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারবাড়িমুখো হাঁটতে হাঁটতে সে নানা কথা ভাবছিল। তার জীবনটা শুধু দুঃখের নয়। ভারী অপমানেরও। এত অপমান সয়ে সে বেঁচে আছে কী করে? যে লোকটা তাকে বিয়ে করার জন্য আগ্রহী ছিল আজ সে মুখের ওপর জবাব দিচ্ছে! ভারী আশ্চর্য। সেই লোকটাই আবার সাতবুড়ির এক বুড়ি দুই ছেলেমেয়ের মা এক সধবার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এসব ভাবলে পাগল পাগল লাগে ভিতরটা। বিশাখা দিশাহারা হয়ে যায়। তার সমস্যা শুধু এটুকুই নয়। আজও বিশাখা বুঝতে পারছে না কোনো পুরুষের ঘর সে সত্যিই করতে পারবে কিনা। কাউকে তার সত্যিই পছন্দ হবে কিনা কোনোদিন। এক সময়ে হাড় হাভাতে শশীভূষণকে সে দু চোখে দেখতে পারত না। আজকাল তার কথা ভাবতে ভাল লাগে। শচীনকে এক সময়ে সইতে পারত না সে। আজকাল শচীনকে দেখলে বুক দুড় দুড় করে। কোকাবাবুর নাতিকে কি তার সত্যিই পছন্দ ছিল? এখন সে ঠিক করে বলতে পারবে না। বিশাখা মাঝে মাঝে ভাবে, সে বোধহয় সত্যিই পাগল।

ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে সে দেখতে পায়, কৃষ্ণ বিছানায় শিরদাঁড়া সোজা করে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে একটা বই পড়ছে। তাকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলে, ছোড়দি!

কী করছিস শুনি!

গীতাটা পড়ছিলাম।

খুব পড়ুয়া হয়েছো, না!

কৃষ্ণকান্ত ভারী সুন্দর করে হাসল, কী চাস বল তো!

বাবা বরিশাল গেছে জানিস তো!

জানি।

তুই আমার সঙ্গে থাকবি চল।

তোর সঙ্গে? কেন? ভূতের ভয়?

তোর মাথা! ভূতের ভয় তো কী, মনুপিসি আছে না!

তাহলে আবার আমাকে কেন?

এমনি। চল, আর ঝগড়া করব না।

কৃষ্ণকান্ত একটু হাসল, বলল, আমি যে ব্রহ্মচর্য করছি।

তাতে কী? আমাদের সঙ্গে থাকলে কি ব্রহ্মচর্য নষ্ট হবে?

শুধু মা ছাড়া আর কোনো মেয়ের মুখই দেখতে নেই।

এই যে আমার দিকে তাকালি।

তা কী করা যাবে? এসে পড়লি হঠাৎ, তাই।

রোজ যে মনুপিসির কাছে সংস্কৃত পড়িস, তখন মুখ দেখিস না?

মনু পিসি তো মায়ের মতোই। তুই কিন্তু একটু ঝগড়া করছিস।

কখন আবার ঝগড়া করলাম?

এই তো করছিস।

আর করব না। চল।

না রে। আমার একা থাকতেই ভাল লাগে আজকাল।

তুই একটা কী রে? ভূতের ভয়ও পাস না?

না। ভয় কিসের? আমি তো রোজ ওঁদের দেখি।

যাঃ। রাম রাম।

আমি যেখানে থাকব সেখানেই রোজ কাকা দেখা দেবেন, জানিস?

ফের ওসব কথা?

তুই ভীষণ ভীতু।

বিশাখা তার ভাইয়ের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল। মা-মরা ভাই। বলল, রোগা হয়ে গেছিস।

রোগা? কী যে বলিস। ইরফানদাদার কাছে রোজ লাঠি শিখি, মুগুর ঘোরাই, জানিস?

সব জানি। তবু রোগা হয়ে গেছিস।

এটা রোগা ভাব নয়। চর্বি মরলে এ রকম চেহারা হয়।

বাজে বকিস না। হ্যাঁ রে, আমার সঙ্গে আর এক পাতে খাবি না কোনোদিন?

না। এক পাতে খেতে নেই।

কী হয় খেলে?

স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ।

কী যে সব মাথায় ঢুকেছে তোর!

গীতা শুনবি?

আমি সংস্কৃত বুঝি না তো।

না বুঝলেও শুনতে ভাল লাগবে। শোন না।

পড় তাহলে।

বিশাখা শুনল। ভারী সুন্দর উচ্চারণ আর কণ্ঠস্বরে কিছুক্ষণ পড়ল কৃষ্ণকান্ত। বিশাখা কিছু না বুঝলেও মুগ্ধ হয়ে গেল। বলল, বেশ তো পড়িস।

খুব লাজুক হাসি হাসল কৃষ্ণকান্ত। বলল, আমার যখন ফাঁসি হবে তখন গীতার শ্লোক মুখস্থ বলতে বলতে গলায় দড়ি পরবো।

ওমা! বলে চমকে ওঠে বিশাখা, ফাঁসি হবে মানে!

হবেই তো একদিন।

বিশাখা বিবর্ণ মুখে বাক্যহারা হয়ে চেয়ে থাকে ভাইয়ের দিকে। তারপর বলে, ফাঁসি হবে কেন?

স্বদেশী করলে তো হয়।

তুই কি পাগল? ছিঃ ওসব কথা বলতে নেই।

তুই কাঁদবি খুব। না?

কাঁদবো মানে। মরেই যাবো তাহলে।

হি হি। খুব মজা হবে। বাবা কী করবে তখন?

এইসব বুঝি ভাবিস বসে বসে?

খুব ভাবি। আর ভীষণ মজা লাগে। কৃষ্ণকান্তর ফাঁসি হচ্ছে আর তার বাবা কাঁদছে দিদিরা কাঁদছে দাদারা কাঁদছে মনুপিসি কাঁদছে, হি হি হি হি…

থাপ্পড় খাবি এবার। চুপ কর তো।

আমি কিন্তু সাহেব মারবোই।

মারা বের করছি তোমার। ঘরে তালা দিয়ে রাখব।

হঠাৎ জানালা দিয়ে বারবাড়ির মাঠের দিকে চেয়ে কৃষ্ণকান্ত চমকে উঠে বলে, এই ছোড়দি! ওই দেখ, শচীনদা আসছে। উস্কোখুস্কো চুল, রাগী মুখ। কী হয়েছে রে ওঁর?

সকল অধ্যায়

১. ১. ১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে
২. ২. টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান
৩. ৩. কিশোরী রঙ্গময়ি
৪. ৪. ধ্রুব
৫. ৫. ধনীর বাড়িতে শোক
৬. ৬. নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই
৭. ৭. ভাই হেমকান্ত
৮. ৮. হানিমুন
৯. ৯. সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার
১০. ১০. রেমি
১১. ১১. পিতার বাৎসরিক কাজ
১২. ১২. সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল
১৩. ১৩. ভাই সচ্চিদানন্দ
১৪. ১৪. ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন
১৫. ১৫. ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর
১৬. ১৬. অচেনা গলা
১৭. ১৭. তরল মন্তব্য
১৮. ১৮. ছন্দাকে নিয়ে আসা হল
১৯. ১৯. নতুন এক আনন্দ
২০. ২০. রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না
২১. ২১. রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন
২২. ২২. কূট সন্দেহ
২৩. ২৩. গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না
২৪. ২৪. রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে
২৫. ২৫. মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন
২৬. ২৬. আচমকা একদিন দুপুরে
২৭. ২৭. শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল
২৮. ২৮. বেলুন দিয়ে সাজানো একটা জিপগাড়ি
২৯. ২৯. বিশাখা
৩০. ৩০. শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকার
৩১. ৩১. হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন
৩২. ৩২. থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব
৩৩. ৩৩. পুজো আর আম-কাঁঠালের সময়
৩৪. ৩৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল রেমির
৩৫. ৩৫. চপলার বাবা মস্ত শিকারি
৩৬. ৩৬. বিস্ময়টাকে চট করে লুকিয়ে
৩৭. ৩৭. চপলা বাড়িতে পা দেওয়ার পর
৩৮. ৩৮. ঘর-বার করতে করতে
৩৯. ৩৯. এত কলকব্জা কখনও দেখেনি সুবলভাই
৪০. ৪০. অপারেশন থিয়েটারের চোখ-ধাঁধানো আলো
৪১. ৪১. বৈশাখ মাসে কোকাবাবুদের একটা মহাল
৪২. ৪২. রেমি যে মারা যাচ্ছে
৪৩. ৪৩. অনাথ ডাক্তারের মেলা টাকা
৪৪. ৪৪. সেই একটা দিন কেটেছিল
৪৫. ৪৫. কয়েকদিন যাবৎ অনেক ভাবলেন হেমকান্ত
৪৬. ৪৬. ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে
৪৭. ৪৭. মামুদ সাহেব
৪৮. ৪৮. মানুষেরা ভীষণ অবুঝ
৪৯. ৪৯. এক তীব্র, যন্ত্রণাময় অশ্বখুরধ্বনি
৫০. ৫০. এত ভয় রেমি জীবনেও পায়নি
৫১. ৫১. কুঞ্জবনে আর এসো না
৫২. ৫২. খুব নরম খুব সবুজ ঘাস
৫৩. ৫৩. একটা পঙক্তি
৫৪. ৫৪. একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল
৫৫. ৫৫. স্ত্রী চরিত্র কতদূর রহস্যময়
৫৬. ৫৬. হাতে-পায়ে খিল ধরল রেমির
৫৭. ৫৭. এরকম বৃষ্টির রূপ
৫৮. ৫৮. মাথার ঠিক ছিল না রেমির
৫৯. ৫৯. চপলা খুব ধীরে ধীরে
৬০. ৬০. রাজার ফ্ল্যাট
৬১. ৬১. বাবা, আমি কাল যাব না
৬২. ৬২. গায়ে নাড়া দিয়ে
৬৩. ৬৩. ইরফান নামে যে লোকটা
৬৪. ৬৪. আজ আর নেই
৬৫. ৬৫. শশিভূষণের মামলা
৬৬. ৬৬. যে সময়টায় রেমির পেটে ছেলেটা এল
৬৭. ৬৭. আজ শচীনের চেহারার মধ্যে
৬৮. ৬৮. মেয়েটির হাসিটি অদ্ভুত সুন্দর
৬৯. ৬৯. শচীন কাশী রওনা হওয়ার আগের দিন
৭০. ৭০. গাড়ির ব্যাকসিটে বসে ধ্রুব
৭১. ৭১. বরিশালের জেলে সতীন্দ্রনাথ সেনের অনশন
৭২. ৭২. একটি লোকও নার্সিংহোম ছেড়ে যায়নি
৭৩. ৭৩. কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল
৭৪. ৭৪. ধ্রুবর যে একটা কিছু হয়েছে
৭৫. ৭৫. এক সাহেব ডাক্তার আনানো হল
৭৬. ৭৬. ধ্রুব রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে
৭৭. ৭৭. লোকটা কী বলছে
৭৮. ৭৮. একটা হত্যাকাণ্ড এবং মৃত্যু
৭৯. ৭৯. আবার সেই কিশোরী
৮০. ৮০. সে আর সে
৮১. ৮১. প্রদোষের আলো
৮২. ৮২. ধ্রুব, বাপ হয়েছিস শুনলাম
৮৩. ৮৩. সংজ্ঞা যখন ফিরল
৮৪. ৮৪. প্রশান্ত ধ্রুবকে লক্ষ করছিল
৮৫. ৮৫. ফেরার পথে ঘোড়ার গাড়ি
৮৬. ৮৬. নোটন
৮৭. ৮৭. বজ্রনির্ঘোষের মতো কণ্ঠস্বর
৮৮. ৮৮. ধ্রুব আর নোটন
৮৯. ৮৯. রামকান্ত রায় খুন
৯০. ৯০. মরবি কেন
৯১. ৯১. হেমকান্ত একটু সামলে উঠেছেন
৯২. ৯২. বাথরুমের দরজা খুলে
৯৩. ৯৩. প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার তুলতে
৯৪. ৯৪. স্বচ্ছ গোলাপি মশারির মধ্যে
৯৫. ৯৫. ইহা কী হইতে চলিয়াছে
৯৬. ৯৬. কৃষ্ণকান্তকে দেখে জীমূতকান্তি
৯৭. ৯৭. আজ এই দিনপঞ্জীতে যাহা লিখিতেছি
৯৮. ৯৮. কৃষ্ণকান্ত নিজের বাইরের ঘরটায় এসে
৯৯. ৯৯. নীল আকাশের প্রতিবিম্বে নীলাভ জল
১০০. ১০০. ধ্রুব খুবই মনোযোগ দিয়ে
১০১. ১০১. যখন বাড়ি ফিরিলাম
১০২. ১০২. দরজা খুলে বৃদ্ধা
১০৩. ১০৩. বিশাখার বিবাহ
১০৪. ১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে
১০৫. ১০৫. কাশী আসিবার পর
১০৬. ১০৬. বাবা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন