৫০. এত ভয় রেমি জীবনেও পায়নি

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

॥ ৫০ ॥

এত ভয় রেমি জীবনেও পায়নি, মাতাল ধ্রুবকে সে ততটা ভয় পেত না, যতটা পেল এই পাগল ধ্রুবকে। নির্বিকার মুখে যে পুরুষ তার বিয়ে করা বউকে অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘর করার পরামর্শ দেয় এবং মৌলিক সততার দোহাই পাড়ে তার পাগলামী সম্পর্কে সন্দেহ থাকতে পারে না।

সেই রাতে ধ্রুব ঘুমোলো না, কাঠের মত শক্ত হয়ে বসে রইল চেয়ারে। মশার কামড় খেল অনেক। সামনে খোলা একখানা বই। একটা লাইনও পড়ছিল না সে। রেমি বিছানায় পড়ে রইল চুপ করে। রাত দশটা নাগাদ জগা এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল তার। সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়ার জন্য ডাক এসেছিল। তারা দুজন নড়েনি।

খুব ভোরবেলায় ধ্রুব বই বন্ধ করল। হাই তুলে উঠে বাইরে বেরোনোর পোশাক পরল।

রেমি ধড়মড় করে উঠে বলল, কোথায় যাচ্ছো?

একটু জগিং করে আসি। শরীরটা ফিট রাখতে হবে।

তুমি কোথাও চলে যাবে না তো!

গেলেই বা ক্ষতি কী? আজ থেকে আমি তোমার কেউ নই।

কথাটা অনেকবার বলেছে। আর বোলো না।

আচ্ছা বলব না। তুমি ঘুমোও।

তুমি কোথায় যাচ্ছো? পালাবে না তো!

না। আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ঘটকালীর জন্য এখন কিছুদিন কলকাতায় থাকব। তোমাদের ব্যাপারটা হয়ে গেলে কিছুদিনের জন্য উধাও হতে পারি।

রেমি এই পাগলামীর কী জবাব দেবে? ভয়ে চুপ করে রইল।

ধ্রুব জগিং করতে গেল, না আর কোথাও, তা বোঝা যাচ্ছিল না। কারণ দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরও তার ফেরার নাম নেই।

সাধারণত রেমি ধ্রুবর জন্য অপেক্ষা না করেই খেয়ে নেয়। উচ্ছৃংখল পুরুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শক্ত, মানাতে গেলে প্রাণ যায়। তাই রেমি তার সময় মতো ভাত খেয়ে নেয়। ধ্রুব তার সময় মতো ফেরে, কখনো খায়, কখনো খায় না।

কিন্তু রেমি আজ খেল না, অপেক্ষা করতে লাগল।

দুপুরে এবং রাত্রে কৃষ্ণকান্তর খাওয়ার সময়ে রেমি উপস্থিত থাকে। এটা রেওয়াজ। আজ রেমি ওপরে না উঠে নীচের ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল। মাঝেমাঝে কাঁদছে। বুক জ্বলছে জ্বালায়।

জগা এসে দুপুরে দরজায় টোকা দিয়ে বলল, বউদি, ওপরে যাও। বড় কর্তা ডাকছে।

এই একজনের ডাক রেমি কখনো উপেক্ষা করতে পারে না। সম্ভবত কৃষ্ণকান্ত খেতে বসেছেন এবং বউমাকে না দেখে উদ্বিগ্ন।

রেমি যথাসাধ্য নিজের মুখ থেকে অনিদ্রার ক্লান্তি ও কান্নার চিহ্নগুলি মুছে ফেলবার চেষ্টা করল লঘু প্রসাধন দিয়ে। বড় করে সিঁদুরের টিপ পরল, ঘোমটাটা একটু বেশী করে টানল আজ, তারপর ওপরে গেল।

ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাত এবং ফুটন্ত ঘি ছাড়া কৃষ্ণকান্তর চলে না। সেরকমই দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বউমাকে না দেখতে পেয়ে কৃষ্ণকান্ত ভাতে হাত দেননি। ফলে গরম ভাত ঠাণ্ডা হয়েছে, ঘি জুড়িয়ে গেছে।

কৃষ্ণকান্ত উদ্বেগের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মা? শরীরটা কি ভাল নেই?

রেমি ভাতের থালাটা চোখের পলকে জরিপ করে নিয়ে হাত বাড়িয়ে থালাটা তুলে নিয়ে বলল, ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি আবার গরম ভাত নিয়ে আসছি।

কৃষ্ণকান্ত খুশি হয়ে একটা বড় শ্বাস ছাড়লেন।

ফুটন্ত ঘি দিয়ে গরম ভাত মেখে প্রথম গ্রাসটি মুখে তুলে কৃষ্ণকান্ত বললেন, আমার বাবার একবার কী হয়েছিল জানো?

কী বাবা?

মাত্র পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ বছর বয়সে তাঁকে একবার বুড়ো হওয়ার বাতিকে পেয়েছিল। সে সাঙ্ঘাতিক বাতিক। দিন রাত মৃত্যচিন্তা করতেন। কথাটা বললাম কেন জানো?

রেমি স্নিগ্ধ চোখে শ্বশুরের মুখের দিকে একবার দৃষ্টিক্ষেপ করে চোখ নামিয়ে নেয়।

কৃষ্ণকান্ত একটু মজা পাওয়ার হাসি হেসে বললেন, বাবা ছিলেন খুব নিষ্কর্মা লোক। সারাদিন বসে-টসেই থাকতেন আর খুব ভাবতেন, যারা কাজ করে না এবং বৃথা চিন্তা করে তাদের বুডোমিতে পেয়ে বসে খুব অল্প বয়র্সেই। আমার ভয় হচ্ছে আমাকেও না আবার ওই বুড়োমিটা চেপে ধরে।

আপনি তো আর নিষ্কর্মা নন বাবা।

তা নই। আর নই বলেই এই বুড়ো বয়সেও আমাকে বুড়োমিতে পায়নি এতদিন। কিন্তু এবার মন্ত্রিত্ব চলে গেলে মা, একটু নিষ্কর্মার মতোই লাগবে নিজেকে।

মন্ত্রিত্ব ছাড়াও তো আপনি কত কাজ করেন।

করি বৈকি মা। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানো, মন্ত্রী আছি বলেই সেই সুবাদে পাঁচটা কাজ জুটে যায়। গদি গেলে তখন আর কে পোঁছে বলো, কাজকর্ম কমে গেলেই বাজে চিন্তা এসে জোটেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন কৃষ্ণকান্ত।

রেমি একটু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, আপনার কাজ একটু কমাই উচিত বাবা, যা খাটছেন, আমার তো ভয় হয় অসুখ করবে বুঝি।

দূর পাগলী, কাজ করলে কখনো অসুখ করে? শরীরটা ভগবান দিয়েছেন কাজ করার জন্যই, বসে থাকার জন্য নয়। এটাকে নিংড়ে যত পারি কাজ আদায় করে নিলে তবেই শরীর ধারণ করার একটা মানে হয়। নইলে বৃথা শরীর পুষে রেখে লাভ কী?

কৃষ্ণকান্ত খুব সামান্যই খান। কিছুদিন হল মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ঘি-মাখা ভাত শেষ করেই অন্য সব পদ সরিয়ে রেখে দুধ আর কলা দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে একটু হেসে বললেন, তুমি আমার মা বলেই একটা কথা আজ তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে। আমার বাবা হেমকান্ত চৌধুরী সম্পর্কে তুমি কিছু শুনেছো? কোনো গুজব?

রেমি শুনেছে। কিন্তু মুখে তা স্বীকার না করে নিপাট ভাল মানুষের মতো বলল, না তো বাবা।

কৃষ্ণকান্ত মুখটা গম্ভীর করে বললেন, শোনাটাই স্বাভাবিক ছিল। তোমাকে বলেই বলি মা, তাঁর একবার পদস্খলন হয়েছিল।

রেমি সিঁটিয়ে রইল লজ্জায়।

কৃষ্ণকান্ত রেমির দিকে ভ্রূক্ষেপও না করে দূরগত এক চোখে সামনের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেন, পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ বছর বয়সে যে কোন স্বাস্থ্যবান পুরুষেরই পূর্ণ যৌবন থাকে। তিনি নিজেকে বুড়ো ভাবতে শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু সত্যিই তো তা নয়। বিপত্নীক, সুপুরুষ এবং খুব সজ্জন প্রকৃতির এই মানুষটির পদস্খলন ঘটল সেই বয়সে। সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। ছিছিক্কারও পড়ে গিয়েছিল চারদিকে। কিন্তু আমি তাঁর কোনো দোষ দেখতে পাইনি। আজও, এতদিন পরেও অনেক বিচার, অনেক বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে, কাজটা আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যেমনই দেখাক, তাঁর দিক থেকে প্রয়োজন ছিল।

রেমি কিছু বলল না। টেবিলের ওপর আঙুলের দাগ দিতে থাকল। কৃষ্ণকান্ত ধীরে ধীরে বললেন, জীবনে এক-আধবার পদস্খলন অনেকেরই ঘটে কিন্তু তা দিয়ে লোকটার বিচার করে মূর্খরা। বুঝলে মা!

প্রসঙ্গটা কেন উত্থাপন করেছেন কৃষ্ণকান্ত তা যেন আচমকাই বুঝতে পারল রেমি। বুঝে কেঁপে উঠল ভিতরে ভিতরে।

কৃষ্ণকান্ত ভারী মোলায়েম গলায় বললেন, হেমকান্তর নিন্দে যারা করে বেড়াত তাদেরও খবর আমি রাখতাম। তারা কেউই খুব নিষ্কলঙ্ক ছিল না। কিন্তু মানুষের ধর্মই হল, নিজের দোষ টপকে অন্যের দোষ দেখা।

রেমি মৃদুস্বরে শুধু বলল, ঠিকই তো।

কৃষ্ণকান্ত দুধভাতটুকু অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করছিলেন। হঠাৎ নির্বিকার গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সময় কেমন কাটছে মা?

ভালই তো।

খুব ভাল যে নয় সে আমি জানি। আর সেইজন্যই রাজাকে বলেছিলাম তোমাকে একটু গানটান শেখায় যেন। তা রাজা আসে তো!

রেমির ভিতরটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। শরীরে সমস্ত তন্ত্রীতে বয়ে গেল একটা ঝড়। মাথা নীচু রেখে সে প্রাণপণে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, মাঝে মাঝে।

মাঝে মাঝে? কেন সে কি খুব নবাবপুত্তুর হয়েছে নাকি? তাকে আমি বলেছি পারলে রোজ যেন আসে। গান শেখাবে, একটু কম্প্যানিও দেবে। আমাদের দামড়াটা কবে কোথায় যায়, কবে আসে তার তো ঠিক নেই। তোমার সময় কাটে কী করে?

রেমি তার অদ্ভুত চোখ দুখানা তুলে কৃষ্ণকান্তকে একপলক দেখল। বাপের বাড়ি খুব বেশী দূর নয় তার, বিয়েও এমন কিছু বেশী দিন আগে হয়নি, তবু বাপের বাড়ির লোকেরা যে তার পর হয়ে গেছে, দূরত্বটাও বেড়ে গেছে অনেক তার কারণ এই মানুষটি। রেমি জানে লোকটা বড় সোজা নয়। ঝানু কুটনীতিক, দোষে গুণে তৈরি হওয়া মানুষ, কিন্তু এই মানুষটির মধ্যে এক অগাধ গভীর দীঘির মতো আশ্রয় আছে তার। সে এও বোঝে, এ লোকটার “মা” ডাকের মধ্যে কোনো চাতুরী নেই, কৃত্রিমতা নেই। “মা” কীভাবে ডাকতে হয় তা মাতৃহীন এই লোকটা সত্যিই শিখেছিল।

রেমি মৃদু একটু হেসে বলল, রাজা ব্যস্ত মানুষ। ওর অনেক ফাংশন থাকে। রেডিও প্রোগ্রাম থাকে। ফিলমের কাজ থাকে।

জানি। কিন্তু সেসব ওর জন্য করে দিল কে? কার খুঁটির জোরে এখন করে খাচ্ছে তা জানো?

না তো বাবা!

সেটা তো বলবে না, প্রেস্টিজ যাবে যে, তাছাড়া কৃতজ্ঞতার ল্যাঠাও তো আছে। যাকগে, রাজা না পারলে আমি আর কাউকে গানের মাস্টার রেখে দেবো। ভাল করে শেখো। একটা কিছুতে মনপ্রাণ ঢেলে দাও।

আপনি আমার জন্য এত ভাবেন কেন বাবা?

আমি না ভাবলে কে ভাববে বলো! আমার স্বার্থও তো আছে। বুড়ো বয়সে একটি মায়ের মতো মা পেয়েছি। কিন্তু দামড়াটার দোষে বুঝি আমার মা তিষ্ঠোতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পালায়। সেই ভয়েই তো তোমাকে এত বাঁধবার চেষ্টা।

আমি তো পালাতে চাই না বাবা!

চাইবে কেন মা? তুমি চঞ্চলা হলে এ বাড়ির লক্ষ্মীও চঞ্চলা হবেন। আমি জানি একদিন তুমি এক খুঁটোয় বাবা ব্যাটাকে বাঁধতে পারবে। আমি সেই আশাতেই বেঁচে আছি।

রেমি মাথা নীচু করে রইল। দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল অবিরল।

কৃষ্ণকান্ত অন্যমনস্ক ছিলেন বলেই বোধহয় ব্যাপারটা লক্ষ করলেন না। কিংবা লক্ষ করলেও না-লক্ষ্য করার ভান করলেন। ধীর গলায় বললেন, আমার আরো দুটো ছেলে আছে, কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত। বড়জন মিলিটারি, ত্যাজ্যপুত্র, তার কথা ভেবে লাভ নেই। ছোটোটা মোটামুটি নিরাপদ চরিত্রের ছেলে। আমার একমাত্র প্রবলেম তোমার স্বামীটিকে নিয়ে।

জানি বাবা।

তুমি তো জানবেই মা। দামড়াটা আমার যত বড় শত্রুই হোক, এ কথা বলতে হবে যে, ওর মতো স্বচ্ছ বুদ্ধি ও প্রাঞ্জল মন আমার অন্য দুই ছেলের নেই। কিন্তু কেন যেন ব্যালানসড হল না। কোথায় চরিত্রের মধ্যে একটা ভারসাম্যের অভাব রয়ে গেল। তাই না?

হ্যাঁ।

ওকে কি তোমার পাগল বলে মনে হয়? উন্মাদ পাগল না হলেও প্রচ্ছন্ন পাগল?

প্রচ্ছন্ন পাগল কথাটা রেমি এই প্রথম শুনলো। কান্নার মধ্যেও একটু হাসি পেল তার। মাথা নেড়ে শুধু ‘হ্যাঁ’ জানাতে পারল সে। কথা বলতে পারল না।

কৃষ্ণকান্তও একটু ম্লান হেসে বললেন, এই পাগলামীর কোনো চিকিৎসাও তো নেই। এখন ওর সমস্ত রোখটা গিয়ে পড়েছে তোমার ওপর। তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, কষ্ট দিচ্ছে।

রেমি ম্লানমুখে বলল, মেয়েরা তো কষ্ট করার জন্যই জন্মায়। তাতে কিছু নয় বাবা। তবে একটা জিনিস আমি সইতে পারি না।

কৃষ্ণকান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, কী সইতে পারো না? দামড়াটা কি গায়ে হাতটাতও তোলে নাকি? চাবকে আমি ওর—

রেমি আর্তস্বরে বলে, না না, তা নয়।

তাহলে কী?

আপনি দেখবেন বাবা, আমাকে যেন এ বাড়ি থেকে কেউ জোর করে তাড়িয়ে না দেয়।

তোমাকে তাড়াবে? কৃষ্ণকান্ত হতভম্বের মতো বলেন, তোমাকে? কার এত বুকের পাটা?

আপনি অত অস্থির হবেন না।

কে তোমাকে তাড়াতে চেয়েছে? ওই দামড়াটা? রাজু? ওরে রাজু? দেখ তো মেজদাদাবাবু ঘরে আছে কিনা! না থাকলে যেন এলেই আমার সঙ্গে দেখা করে।

রেমি তটস্থ হয়ে বলে, আমি তো বলিনি যে আপনার ছেলে আমাকে তাড়াতে চেয়েছে।

ভদ্রলোকের মেয়েরা কি সব কথা মুখে আনতে পারে! দামড়াটা যে এত ছোটোলোক হয়ে গেছে আমার তা জানা ছিল না। আর যাই করে বেড়াক মনটা চওড়া ছিল।

উনি বলেননি।

তাহলে কে? বলো, তার নাম বলো। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাকে এ বাড়ির পাট গোটাতে হবে।

রেমি এই বিস্ফোরক পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলে।

হাসছো মা? হাসির কারণটা কী?

আপনার অকারণ উতলা হওয়া দেখে।

কেউ কিছু বলেনি তোমাকে?

না। আমি বলছিলাম এমন পরিস্থিতি যাতে না হয় যে, আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়।

সেটা কেন হবে বলো তো!

হতে কি পারে না?

কৃষ্ণকান্ত কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, ঠিক আছে। আমি আজই উকিল ডাকছি। এই বাড়ি তোমার নামে লিখেপড়ে দিই। তারপর আর এ বাড়ি ছাড়ার কোনো প্রশ্নই উঠবে না।

রেমি ভয় পেয়ে বলল, না না তার দরকার নেই।

তুমি আমাকে বারবার নিরস্ত করছো কেন মা?

আপনি তো আছেন বাবা। আমার আর ভয় নেই।

আমি চিরকাল থাকব না। তখন?

আপনি না থাকলে এই ভূতের বাড়িতে কি আমিই থাকতে পারব?

কৃষ্ণকান্তর চোখ ছলছল করে উঠল। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তারপর দুধভাতের শেষ অংশটুকু রেখেই উঠে গেলেন আঁচাতে।

রেমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভালবাসারও দমবন্ধ করা এক আক্রমণ আছে। সে তার শ্বশুরের কাছ থেকে যা পেয়েছে তা আর কারো কাছ থেকেই কখনো পায়নি। এরকম একমুখী গভীর স্নেহের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না বলে তার আজ দমবন্ধ লাগছিল এতক্ষণ।

বেনি দুপুরে এক কাপ কফি খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল নীচের ঘরে। ধ্রুব আসুক একসঙ্গে খাবে।

খিদে, ক্লান্তি, নিদ্রাহীনতায় রেমির শরীর বড় অবশ লাগছিল। কেন যে এই কারাগারে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে এতদিন তা কিছুতেই যুক্তি দিয়ে বোঝে না সে। শ্বশুরের স্নেহ তো গৌণ ব্যাপার। যাকে নিয়ে সম্পর্ক রচিত হয় সেই মূল মানুষটাই যদি আড় হয়ে থাকে, যদি পাগল হয়, স্নেহহীন হয়, তবে এক কোটি মানুষের ভালবাসাও তো মূল্যহীন। তবু রেমি কেন আছে? কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণে?

রেমি ভেবে দেখেছে, যুক্তির পথ দিয়ে সব সময়ে তো হাঁটে না মানুষ। তার মন অনেক সময়েই অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। কিছুতেই তাকে বাগে আনা যায় না।

দুর্বল শরীর জুড়ে কখন নেমে এল ঘুম রেমি টের পায়নি। ধ্রুবই তাকে জাগাল।

ওঠো ওঠো।

ধড়মড় করে উঠে পড়ে রেমি, কী হয়েছে গো?

কিছু হয়নি। মুখ অত শুকনো কেন?

শুকনো? বলে রেমি নিজের মুখে একটু হাত বুলিয়ে বলে, কোথায় শুকনো? তুমি এতক্ষণে এলে?

এইমাত্র।

খাওনি তো?

না।

চলো, খাবে চলো। আমি আজ তোমার জন্য বসে আছি।

আমার জন্য? কেন?

ইচ্ছে হল, তাই; চলো, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।

ধ্রুব একটু হাসল। তারও মুখ শুকনো। হাসিটা ভাল ফুটল না। একটা হাই তুলে বলল, খাবো, তাড়া কিসের?

তোমার নেই। আমার আছে।

চলো, আজ বাইরে কোথাও খাওয়া যাক।

ওমা! কেন?

এখন তিনটে বাজে। এই অবেলায় ঠাকুর চাকরদের উদ্ব্যস্ত করার দরকার কী? ওরা একটু বিশ্রাম নিচ্ছে নিক না।

ওদের উদ্ব্যস্ত করব কেন? আমি বুঝি পারি না!

বাড়ির একঘেয়ে খেতে ভাল লাগে না। চলো, বাইরে যাই।

আমার যে রেস্টুরেন্টে খেতে ঘেন্না করে।

ভাল রেস্টুরেন্টে যাবো। ঘেন্না করবে না।

তোমার অন্য কোনো মতলব নেই তো!

না, কী মতলব থাকবে?

সকালে আমাকে বিশ্রী অপমান করে গেছ। সারা রাত কষ্ট দিয়েছে।

তবু তোমার মন বিদ্রোহী হচ্ছে না?

হচ্ছে না আবার! খুব হচ্ছে।

তার লক্ষণ কোথায়?

কী লক্ষণ দেখতে চাও?

একটা বিস্ফোরণ। মাইরি দেখাবে?

পারব না, যাও।

সকল অধ্যায়

১. ১. ১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে
২. ২. টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান
৩. ৩. কিশোরী রঙ্গময়ি
৪. ৪. ধ্রুব
৫. ৫. ধনীর বাড়িতে শোক
৬. ৬. নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই
৭. ৭. ভাই হেমকান্ত
৮. ৮. হানিমুন
৯. ৯. সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার
১০. ১০. রেমি
১১. ১১. পিতার বাৎসরিক কাজ
১২. ১২. সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল
১৩. ১৩. ভাই সচ্চিদানন্দ
১৪. ১৪. ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন
১৫. ১৫. ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর
১৬. ১৬. অচেনা গলা
১৭. ১৭. তরল মন্তব্য
১৮. ১৮. ছন্দাকে নিয়ে আসা হল
১৯. ১৯. নতুন এক আনন্দ
২০. ২০. রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না
২১. ২১. রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন
২২. ২২. কূট সন্দেহ
২৩. ২৩. গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না
২৪. ২৪. রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে
২৫. ২৫. মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন
২৬. ২৬. আচমকা একদিন দুপুরে
২৭. ২৭. শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল
২৮. ২৮. বেলুন দিয়ে সাজানো একটা জিপগাড়ি
২৯. ২৯. বিশাখা
৩০. ৩০. শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকার
৩১. ৩১. হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন
৩২. ৩২. থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব
৩৩. ৩৩. পুজো আর আম-কাঁঠালের সময়
৩৪. ৩৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল রেমির
৩৫. ৩৫. চপলার বাবা মস্ত শিকারি
৩৬. ৩৬. বিস্ময়টাকে চট করে লুকিয়ে
৩৭. ৩৭. চপলা বাড়িতে পা দেওয়ার পর
৩৮. ৩৮. ঘর-বার করতে করতে
৩৯. ৩৯. এত কলকব্জা কখনও দেখেনি সুবলভাই
৪০. ৪০. অপারেশন থিয়েটারের চোখ-ধাঁধানো আলো
৪১. ৪১. বৈশাখ মাসে কোকাবাবুদের একটা মহাল
৪২. ৪২. রেমি যে মারা যাচ্ছে
৪৩. ৪৩. অনাথ ডাক্তারের মেলা টাকা
৪৪. ৪৪. সেই একটা দিন কেটেছিল
৪৫. ৪৫. কয়েকদিন যাবৎ অনেক ভাবলেন হেমকান্ত
৪৬. ৪৬. ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে
৪৭. ৪৭. মামুদ সাহেব
৪৮. ৪৮. মানুষেরা ভীষণ অবুঝ
৪৯. ৪৯. এক তীব্র, যন্ত্রণাময় অশ্বখুরধ্বনি
৫০. ৫০. এত ভয় রেমি জীবনেও পায়নি
৫১. ৫১. কুঞ্জবনে আর এসো না
৫২. ৫২. খুব নরম খুব সবুজ ঘাস
৫৩. ৫৩. একটা পঙক্তি
৫৪. ৫৪. একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল
৫৫. ৫৫. স্ত্রী চরিত্র কতদূর রহস্যময়
৫৬. ৫৬. হাতে-পায়ে খিল ধরল রেমির
৫৭. ৫৭. এরকম বৃষ্টির রূপ
৫৮. ৫৮. মাথার ঠিক ছিল না রেমির
৫৯. ৫৯. চপলা খুব ধীরে ধীরে
৬০. ৬০. রাজার ফ্ল্যাট
৬১. ৬১. বাবা, আমি কাল যাব না
৬২. ৬২. গায়ে নাড়া দিয়ে
৬৩. ৬৩. ইরফান নামে যে লোকটা
৬৪. ৬৪. আজ আর নেই
৬৫. ৬৫. শশিভূষণের মামলা
৬৬. ৬৬. যে সময়টায় রেমির পেটে ছেলেটা এল
৬৭. ৬৭. আজ শচীনের চেহারার মধ্যে
৬৮. ৬৮. মেয়েটির হাসিটি অদ্ভুত সুন্দর
৬৯. ৬৯. শচীন কাশী রওনা হওয়ার আগের দিন
৭০. ৭০. গাড়ির ব্যাকসিটে বসে ধ্রুব
৭১. ৭১. বরিশালের জেলে সতীন্দ্রনাথ সেনের অনশন
৭২. ৭২. একটি লোকও নার্সিংহোম ছেড়ে যায়নি
৭৩. ৭৩. কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল
৭৪. ৭৪. ধ্রুবর যে একটা কিছু হয়েছে
৭৫. ৭৫. এক সাহেব ডাক্তার আনানো হল
৭৬. ৭৬. ধ্রুব রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে
৭৭. ৭৭. লোকটা কী বলছে
৭৮. ৭৮. একটা হত্যাকাণ্ড এবং মৃত্যু
৭৯. ৭৯. আবার সেই কিশোরী
৮০. ৮০. সে আর সে
৮১. ৮১. প্রদোষের আলো
৮২. ৮২. ধ্রুব, বাপ হয়েছিস শুনলাম
৮৩. ৮৩. সংজ্ঞা যখন ফিরল
৮৪. ৮৪. প্রশান্ত ধ্রুবকে লক্ষ করছিল
৮৫. ৮৫. ফেরার পথে ঘোড়ার গাড়ি
৮৬. ৮৬. নোটন
৮৭. ৮৭. বজ্রনির্ঘোষের মতো কণ্ঠস্বর
৮৮. ৮৮. ধ্রুব আর নোটন
৮৯. ৮৯. রামকান্ত রায় খুন
৯০. ৯০. মরবি কেন
৯১. ৯১. হেমকান্ত একটু সামলে উঠেছেন
৯২. ৯২. বাথরুমের দরজা খুলে
৯৩. ৯৩. প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার তুলতে
৯৪. ৯৪. স্বচ্ছ গোলাপি মশারির মধ্যে
৯৫. ৯৫. ইহা কী হইতে চলিয়াছে
৯৬. ৯৬. কৃষ্ণকান্তকে দেখে জীমূতকান্তি
৯৭. ৯৭. আজ এই দিনপঞ্জীতে যাহা লিখিতেছি
৯৮. ৯৮. কৃষ্ণকান্ত নিজের বাইরের ঘরটায় এসে
৯৯. ৯৯. নীল আকাশের প্রতিবিম্বে নীলাভ জল
১০০. ১০০. ধ্রুব খুবই মনোযোগ দিয়ে
১০১. ১০১. যখন বাড়ি ফিরিলাম
১০২. ১০২. দরজা খুলে বৃদ্ধা
১০৩. ১০৩. বিশাখার বিবাহ
১০৪. ১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে
১০৫. ১০৫. কাশী আসিবার পর
১০৬. ১০৬. বাবা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন