৭৩. কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

॥ ৭৩ ॥

কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল। রাঙা আকাশ থেকে রক্তের স্রোত মিশছে ব্রহ্মপুত্রের জলে। ভোরবেলার শান্ত সুন্দর শ্ৰী আজ সে অনুভব করতে পারছিল না। আজ বুকের জ্বালা, অক্ষম রাগ আর এক গভীর বেদনায় এমন সুন্দর ভোরবেলাটিকে তার ছাইয়ের মতো বিবর্ণ বোধ হচ্ছিল।

অপঘাতে তার কাকা মারা গিয়েছিল। সেই কাকাকে ভাল করে মনেও নেই তার। কিন্তু সে জানে, এই বংশের মুখোজ্জ্বলকারীদের তিনি ছিলেন একজন। ব্রহ্মচারী, দেশভক্ত সেই মানুষটিকে কে বা কারা খুন করেছিল ব্রহ্মপুত্রের ওপর। সেই মৃত্যুর জন্য এক থম-ধরা শোক আছে কৃষ্ণকান্তর। ফের তার নিরীহ বাবার ওপর এই বর্বর আক্রমণ তাকে উত্তেজিত করছে একটা কিছু করে ফেলতে। একটা মারাত্মক কিছু।

কৃষ্ণকান্ত একা একা অনেকক্ষণ ছাদে ঘোরাফেরা করল। কখনো জোরে, কখনো ধীরে। রাত্রি জাগরণের জন্য তার কোনো ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না। তার ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধও লুপ্ত। মাঝে মাঝে নিজের তপ্ত মাথাটা চেপে ধরছে দুহাতে। বাবা কি বাচবে? বাবা যদি না বাঁচে তবে কৃষ্ণকান্তর মধ্যে একটা বিপুল কিছু ঘটে যাবে। হয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। যদি তা না হয় তবে সে হয়তো হয়ে উঠবে এক সাঙ্ঘাতিক খুনী, গুণ্ডা বা ডাকাত। একটা লণ্ডভণ্ড কিছু সে করবেই।

রোদ বেশ চড়া হয়ে ওঠার পর কৃষ্ণকান্ত, থমথমে মুখে নেমে আসে নীচে। তালা দেওয়া একটা ঘরের সামনে দুদণ্ড দাঁড়ায়। চাবি কোথায় আছে তা সে জানে। একটু দ্বিধা করে সে গিয়ে হেমকান্তর ঘরে ডেস্কের দেরাজ খুলে চাবির গোছা নিয়ে এসে দরজাটা খুলে ঢোকে।

এ ঘর আজকাল খোলা হয় না বলে একটা বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। কৃষ্ণকান্ত দুটো জানালা খুলে দেয়। চার পাঁচটা বন্দুকের বাক্স র‍্যাকের ওপর সাজানো। চেস্ট অফ ডুয়ার্সটা খুলে ভিতরে উঁকি দেয় সে। প্রথম ড্রয়ারে কিছু তেমন নেই। শুধু চারটে টোটার বাক্স। দ্বিতীয় ড্রয়ারটায় বন্দুকের তেল, লোহার লম্বা শিকে লাগানো বুরুশ, যা দিয়ে ব্যারেল পরিষ্কার করা হয়। তিন নম্বর ড্রয়ারে নেপালী কুকরি, জৌনপুরী ছোরা হ্যাণ্টিং নাইফ এবং আরো কয়েকরকম শৌখিন বিলিতি ড্যাগার রয়েছে। পরের ড্রয়ারটা খুলে অভীষ্ট বন্দুকটা পেয়ে যায় কৃষ্ণকান্ত। চার পাঁচ রকমের গুপ্তি, বহু টোটার বাক্স এবং নানাবিধ টুকরো-টাকরা জিনিসের মধ্যে ন্যাকড়ায় জড়ানো চামড়ার খাপে সাবধানে লুকিয়ে রাখা একটা জার্মান মাউজার পিস্তল। জিনিসটা যে আছে এটা সে জানত। কিন্তু কোনোদিন চোখে দেখেনি। হেমকান্ত অস্ত্রশস্ত্র পছন্দ করেন না। এ ঘর তিনি কদাচিৎ খুলেছেন।

কৃষ্ণকান্ত পিস্তলটা জামার তলায় রেখে ড্রয়ারটা বন্ধ করে। দরজায় তালা দিয়ে চাবি যথাস্থানে রেখে সে চলে আসে বারবাড়িতে নিজের ঘরে। তোশকের তলায় খাপসুদ্ধ পিস্তলটা রেখে সে বেরিয়ে আসে।

শচীন হাসপাতাল থেকে এল আটটা নাগাদ। কৃষ্ণকান্ত তখন দালানের সিঁড়িতে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। পিস্তল হাতে এলেও টোটা তার হাতে নেই। সে প্রথম ড্রয়ারটা হাঁটকে দেখেছে। সেখানে শুদ্ধু বন্দুকের টোটা আছে। পিস্তলটা বহুকাল ব্যবহৃত হয়নি।

শচীন এসে সাইকেল থেকে নামতেই কৃষ্ণকান্ত মগ্নতা ভেঙে টান টান উঠে দাঁড়ায়।

শচীনদা, বাবা?

শচীন একটু হেসে বলে, ভয় নেই। ভাল আছেন।

জ্ঞান ফিরেছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ। ইনজুরিটা খুব কম নয়। তবে জ্ঞান আছে। তোমার কথা খুব বলছেন।

আমি যাবো।

যাবে। আমিই নিয়ে যাবো। তবে এবেলাটা থাক।

কেন?

এখনও দুর্বল তো। তোমাকে দেখলে যদি উত্তেজিত হন বা উঠে বসার চেষ্টা করেন তবে ব্লিডিং হবে।

কৃষ্ণকান্ত ম্লানমুখে বলে, তবে থাক।

ডাক্তাররা বলছে, ভিজিটারদের এখন না এলেই ভাল।

বাবা বাঁচবে তো!

বাঁচবেন না কেন? ইনজুরি ফ্যাটাল নয়। নিশ্চিন্ত থাকো।

আপনার সঙ্গে বাবার দেখা হয়েছে?

একবার। এখন আর দেখা করতে দিচ্ছে না। শুনলাম, ঘুমোচ্ছেন। ভাল আছেন। তোমাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন বলো তো! কেমন যেন রেগে আছো!

কৃষ্ণকান্ত জবাব দিল না। একটু হাসবার চেষ্টা করল মাত্র।

শচীন বলল, যাও, স্নান করে কিছু খাও, অত ভাবতে হবে না।

বাবাকে কারা মেরেছে শচীনদা? জানেন?

না। পুলিশ খোঁজ করবে।

পুলিশ করবে জানি। আপনার কিছু সন্দেহ হয় না?

শচীন মাথা নেড়ে বলল, এ তো ভাবনাচিন্তার অতীত। হেমকান্তবাবুর মতো নির্বিরোধী লোক আমি তো অন্তত দেখিনি। ওঁর কেউ শত্রু থাকতে পারে বলে কল্পনাও করা যায় না। আমার মনে হয় কেউ ভুল করে এ কাণ্ড করেছে। হয়তো অন্য কাউকে মারতে চেয়েছিল।

কৃষ্ণকান্ত বলল, তা নয় শচীনদা। আমার ইস্কুলের একটা ছেলে ক’দিন আগেই বলেছিল, আমার বাবাকে নাকি স্বদেশীরা মারবে।

কেন মারবে? তাঁর অপরাধ?

স্বদেশীদের ধারণা বাবা শশীদাকে ধরিয়ে দিয়েছে।

শচীন একটু হতভম্ব হয়ে যায়। তারপর খুব বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, সে কী? এ কথা তো আগেও হয়েছে। আমি নিজে শশিভূষণের সঙ্গে কথা বলেছি। সেও তো এরকম সন্দেহ করে না। এমন কি উনি দারোগা রামকান্তবাবুর অনুরোধেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য কোনো স্টেটমেন্ট দেননি।

কিন্তু লোকে তো বাবাকে ভাল বলে না।

শচীন একটু ভাবে। তারপর বলে, আচ্ছা দেখা যাক। খুনী যদি ধরা পড়ে তবে তার কাছ থেকেও তো কিছু জানা যাবে। তোমার স্কুলের সেই ছেলেটি কে বলো তো!

কেন, তাকে ধরিয়ে দেবেন?

দেওয়াই তো উচিত।

কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলল, তার দরকার নেই। আমি আজ স্কুলে গিয়ে নিজেই ব্যবস্থা করব।

মারপিট করবে নাকি?

কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বলে, দরকার হলে করতেও পারি। তবে আপনি কিছু ভাববেন না।

শচীনকে একটু চিন্তিত দেখাল। সে বলল, আজই স্কুলে যাবে?

যেতেই হবে শচীনদা।

শচীন চিন্তিত মুখে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, তোমার বাবার জন্য তোমার রাগ হতেই পারে। কিন্তু রাগের বশে হুট করে কিছু করে ফেলো না কৃষ্ণ। তোমার বয়স অল্প।

কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলল, আমি তেমন কিছু করব না শচীনদা। শুধু জেনে নেবো, ছেলেটা কোথা থেকে শুনল যে আমার বাবাকে স্বদেশীরা খুন করবে।

তার চেয়ে ছেলেটার নাম আমাকে বলো। আমি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব।

কৃষ্ণকান্ত লাজুক হেসে বলে, সেটা ভাল দেখাবে না। শত হলেও সে আমার স্কুলের বন্ধু। তার নাম আপনাকে বলে দিলে বিট্রে করা হবে। আমিই ওর কাছ থেকে জেনে নেবো।

শচীন খুব ভাল করে কৃষ্ণকান্তর মুখটা দেখল। দেখে তার মনে হল, পাত্রটি খুব সহজ নয়। এইটুকু ছেলে ঠিক এরকম আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কথা বলে না। কৃষ্ণর রকম-সকম একটু আলাদা।

শচীন চিন্তিত মুখেই বলল, ঠিক আছে। তবে মুশকিলে পড়লে আমাকে সব বোলো। মনুদিদি কি ভিতর-বাড়িতে আছে?

হ্যাঁ! দোতলায়। ছোড়দিও আছে। যান না।

কথাটায় কিছু ছিল না, তবু একটু লাল হল শচীন। কম্পিত বুক ও উদ্দীপ্ত এক আনন্দ নিয়ে সে ওপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে লাগল।

বিশাখা ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। সারা রাত কান্নার পর সকালের দিকে অবসন্ন বিশাখা বিছানায় তেড়াবেঁকা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন। রঙ্গময়ী ঘুমোয়নি। তার বুকের জ্বালা তাকে ঘুমোতে দেয়নি। স্নান করে সে দোতলায় ভেজা শাড়ি মেলছিল।

শচীন ওপরে এসে ডাক দিল, মনুদিদি!

কী খবর শচীন?

ভাল। একটু হাসি মুখে টেনে শচীন বলে, ঘুমোচ্ছেন।

আমাদের দেখা করতে দেবে না?

আজ নয়।

তবে কবে? আমার যে হাতে পায়ে বল নেই। অত রক্ত গেল।

অত ঘাবড়াবেন না। হেমকান্তবাবু তো দুর্বল লোক নন। একটু রক্ত গেলেও ক্ষতি কিছু হয়নি। সামলে উঠছেন।

ডাক্তাররা কী বলছে?

এমনিতে ভয় নেই। একমাত্র যদি ক্ষত বিষিয়ে ওঠে বা ধনুষ্টঙ্কার হয়। ওরা সব ব্যবস্থাই করছে।

বিষিয়ে ওঠার লক্ষণ কিছু দেখা গেছে নাকি?

আরে না! আপনিও যদি অত উতলা হন তবে কি করে চলবে? আমি আপনাকে আর একটা কথা বলার জন্য ওপরে এসেছি। কৃষ্ণর দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন।

কেন বলো তো!

একটু ইতস্তত করে শচীন বলে, ও একটু অন্য ধাতের। ইস্কুলে কোন ছেলে নাকি ক’দিন আগে ওকে বলেছে যে, ওর বাবাকে স্বদেশীরা মারবে। ও আজ স্কুলে যাচ্ছে সেই ছেলের সঙ্গে মোকাবিলা করতে। একটা হাঙ্গামা বাধাতে পারে। আপনি বরং বিশ্বাসী কোনো দারোয়ানকে ওকে না জানিয়ে স্কুলে মোতায়েন রাখবেন। গণ্ডগোল হলে গিয়ে যেন ছাড়ায়।

কৃষ্ণ স্কুলে যাবে কী? ওর বাবার এই অবস্থা?

স্কুলে যাবে ক্লাস করতে নয়, ওই ছেলেটাকে ধরতে।

কোন ছেলের কথাটা বলেছে জানো?

না, আমাকে বলেনি।

ঠিক আছে, আমি দেখছি।

আমি তাহলে যাই?

যাবে কেন? মোড়াটায় বোসো। তোমার ধকল গেছে সবচেয়ে বেশী। বেলের পানা করতে বলেছি। একটু মুখে দিয়ে যাও। হাসপাতালে আমাদের কে কে আছে?

ওরে বাবাঃ, সে অনেক লোক। শচীন হেসে বলল, শহর সুদ্ধু ভেঙে পড়েছিল মাঝ রাতে। এখন প্রজারা আছে বেশ কিছু। কর্মচারীও আছে।

ওঁকে সবাই কত ভালবাসে! বলে রঙ্গময়ী উদাস নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ভাল হয়ে ফিরে এলে আর এখানে এক দণ্ড থাকতে দেবো না।

কোথায় যাবেন?

যেখানেই হোক। কলকাতায় পাঠিয়ে দেবো। কনকের কাছে গিয়ে থাকবে। কী বলল, ভাল হবে না?

শচীন একটু হেসে প্রগল্‌ভের মতো বলে ফেলল, আপনি কাছাকাছি না থাকলে ওঁকে দেখবে কে? উনি কি পারবেন আপনাকে ছাড়া?

এ কথায় রঙ্গময়ীর যেমন আপাদমস্তক লজ্জায় শিউরে ওঠা উচিত ছিল তেমন কিছুই হল না। কথাটা যেন লজ্জাজনক বলেই মনে হল না তার কাছে। উদাস চোখে বারান্দার বাইরে দিগন্তের দিকে চেয়ে বলল, দরকার হলে আমিও থাকব। আমার আর কার জন্য বেঁচে থাকা বলো!

শচীন রঙ্গময়ীর এই কথায় চোখ নামিয়ে নিল। আশ্চর্য এই, রঙ্গময়ীকে তার খুব নির্লজ্জ বলে মনে হল না। বহুকাল ধরেই কৃষ্ণকান্ত আর রঙ্গময়ীকে নিয়ে যে গুজব প্রচলিত আছে তা সবই সে জানে। কিন্তু দুজনের কাউকেই তার কখনো অপবিত্র মনে হয়নি। রঙ্গময়ীর এই সত্য ভাষণে তাই সে নির্লজ্জতার কোনো চিহ্ন পেল না।

রঙ্গময়ী ধীর স্বরে বলল, এমন মানুষ তো খুব বেশী পাবে না। কেবল আপন মনে ঘরে বসে ভাবেন, কারো অনিষ্ট চিন্তা করেন না, বিষয় চিন্তা করেন না। যেসব ভাবনা ভাবেন সেগুলোও আধ্যাত্মিক ভাবনা। পৃথিবীতে কী ঘটে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই। এরকম মানুষকে কে মারতে পারে বলো তো! ওদের কি হাত ওঠে?

প্রজাদের কেউ হতে পারে কি মনুদিদি?

রঙ্গময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, না। ওঁর প্রজারা তো কেউ দুঃখে নেই।

তবে কি কৃষ্ণর বন্ধু যা বলেছে তাই সত্যি?

স্বদেশীরা? হতে পারে। শশীকে নিয়ে তো কম গুজব ছড়ায়নি। যেই মারুক তার দশবার ফাঁসি হওয়া উচিত। স্বদেশীরা আসল কাজ ফেলে যদি এসব করতে থাকে তবে আন্দোলনের বারোটা বাজতে দেরী হবে না। বোসো, আমি আসছি।

রঙ্গময়ী চলে গেলে বারান্দায় রাখা হেমকান্তর আরামকেদারায় বসে ফুরফুরে হাওয়ায় ব্রহ্মপুত্রের দিকে চেয়ে থাকে শচীন। পাল তোলা নৌকো রূপোলি জল কেটে মন্থর গতিতে চলেছে। ওপরে ছিন্ন মেঘ ভাসছে ভেলার মতো। বহু দূর পর্যন্ত অবারিত মুক্ত পৃথিবী। দেখতে দেখতে শচীনের তন্দ্রা চলে এল। ক্লান্ত মাথাটা একটু কাত হয়ে গেল ডানদিকে।

ভারী কোমল ও নরম একটা দেহগন্ধ, খুব অস্পষ্ট একটু গয়নার টুংটাং আর শাড়ির খসখস তার চটকা ভাঙিয়ে দেয়। চোখ চাইতেই দুটি অপরূপ চোখে আটকে যায় সে।

বিশাখা খুব কেঁদেছে। চোখের কোল ভারী। মুখখানা থমথমে। তবু একটু রক্তাভ উজ্জ্বলতা দেখতে পায় ওর মুখে শচীন। সে উঠে বসে। বিশাখা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে, উনি ভাল আছেন। কোনো ভয় নেই।

বিশাখা চোখ নত করে বলে, মনুপিসির কাছে শুনলাম।

তোমরা এবার নেয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও। সারা রাত খুব ধকল গেছে তোমাদের।

আপনার তো তারও বেশী।

আমার জন্য ভেবো না। আমি তো প্রায়শ্চিত্ত করছি।

কিসের প্রায়শ্চিত্ত?

তোমার কাছে এবং তোমাদের পরিবারের কাছে আমার অনেক দোষ জমা হয়ে আছে। সাধ্যমত চেষ্টা করছি সেগুলো স্খালন করতে। প্রায়শ্চিত্ত কথাটার মানে জানো?

না। আমাকে তো কেউ কিছু শেখায়নি।

প্রায়শ্চিত্ত কথাটার মানে পুনরায় চিত্তে গমন।

তার মানে কি?

মানুষ যখন কোনো অন্যায় করে তখন যে তার স্বাভাবিক চিত্তবৃত্তি থেকে পতিত হয়ে যায়। সেই পতিত মনটিকে আবার স্বস্থানে স্থাপন করাই প্রায়শ্চিত্ত।

ওসব শক্ত কথা আমি বুঝি না। তবে আপনার কাছেও আমার অনেক দোষ জমা হয়ে আছে। কাটাকাটি করে নিলেই হয়।

হয়? সত্যি বলছো?

একটু রাঙা হয়ে বিশাখা বলে, সত্যি না তো কী? আপনাকে আর কাশী গয়া বৃন্দাবন করে বেড়াতে হবে না।

শচীন একটু হেসে বলে, ওটা তো বেড়াতে যাওয়া, প্রায়শ্চিত্ত করতে নয়। আমি তো ঠিক করেছিলাম তোমাকে আর মুখ দেখাব না।

আমারও মুখ না দেখানোই বোধহয় উচিত ছিল!

কাশী রওনা হওয়ার আগে তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। তুমি তার জবাব না দেওয়ায় মনে বড় কষ্ট হয়েছিল।

আর আমি যে সুফলাকে দিয়ে আপনাকে অত বলে কয়ে ডেকে পাঠালাম আপনি তো গ্রাহ্যও করলেন না!

সুফলাকে দিয়ে? কই সে তো বলেনি আমাকে!

বলেনি! কী পাজি মেয়ে! আমি ওকে ডাকিয়ে এনে বলে পাঠালাম, শচীনবাবুকে বলিস একবার যেন দেখা করে যান। আমি খুব আশা করে থাকব।

শচীন মৃদু হেসে বলে, বোধহয় হিংসেতে বলেনি। মেয়েরা একটু ও রকম হয়। তোমার ওপর সুফলার একটু রাগও থাকতে পারে। যাকগে, তোমার জবাব তাহলে গিয়েছিল, একটু অন্যভাবে।

হ্যাঁ। আপনি রাগ রাখবেন না।

না। কিন্তু সেদিন ডেকে পাঠিয়ে কী বলতে বলো তো!

বলতাম, আপনি কাশী যাবেন না, আমি আপনার ওপর রাগ করিনি।

একটুও করোনি?

না। আমাকে কেউ কখনো শাসন করেনি বলেই নাকি আমি একটু কেমনধারা হয়ে গেছি। কৃষ্ণও বলে।

বলে নাকি?

হ্যাঁ। ওই তো বলেছিল, আমার নাকি মাঝে মাঝে একটু শাসন হওয়া দরকার।

শচীন হেসে ফেলে বলে, দরকার? তাহলে…

তাহলে কি?

শাসনের জন্য একজন লোক তো চাই।

বিশাখা মুখ নত করল। হাসি নেই মুখে, তবে একটু স্মিত ভাব। পর মুহূর্তেই সংযত আর গম্ভীর হয়ে বলে, বাবা সত্যিই ভাল আছেন তো?

সত্যিই ভাল আছেন। অন্তত প্রাণের ভয় নেই।

আমি একটু পুজো দিতে যাবো কালীবাড়িতে।

যাও না।

খুব ধীরে ধীরে বিশাখা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এক দৃষ্টে চেয়ে রইল শচীন। কী অপূর্ব, কী অপার্থিব সৌন্দর্য এই মেয়েটির!

সকল অধ্যায়

১. ১. ১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে
২. ২. টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান
৩. ৩. কিশোরী রঙ্গময়ি
৪. ৪. ধ্রুব
৫. ৫. ধনীর বাড়িতে শোক
৬. ৬. নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই
৭. ৭. ভাই হেমকান্ত
৮. ৮. হানিমুন
৯. ৯. সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার
১০. ১০. রেমি
১১. ১১. পিতার বাৎসরিক কাজ
১২. ১২. সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল
১৩. ১৩. ভাই সচ্চিদানন্দ
১৪. ১৪. ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন
১৫. ১৫. ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর
১৬. ১৬. অচেনা গলা
১৭. ১৭. তরল মন্তব্য
১৮. ১৮. ছন্দাকে নিয়ে আসা হল
১৯. ১৯. নতুন এক আনন্দ
২০. ২০. রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না
২১. ২১. রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন
২২. ২২. কূট সন্দেহ
২৩. ২৩. গভীর রাত্রি পর্যন্ত হেমকান্তর ঘুম হল না
২৪. ২৪. রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে
২৫. ২৫. মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন
২৬. ২৬. আচমকা একদিন দুপুরে
২৭. ২৭. শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল
২৮. ২৮. বেলুন দিয়ে সাজানো একটা জিপগাড়ি
২৯. ২৯. বিশাখা
৩০. ৩০. শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকার
৩১. ৩১. হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন
৩২. ৩২. থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব
৩৩. ৩৩. পুজো আর আম-কাঁঠালের সময়
৩৪. ৩৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল রেমির
৩৫. ৩৫. চপলার বাবা মস্ত শিকারি
৩৬. ৩৬. বিস্ময়টাকে চট করে লুকিয়ে
৩৭. ৩৭. চপলা বাড়িতে পা দেওয়ার পর
৩৮. ৩৮. ঘর-বার করতে করতে
৩৯. ৩৯. এত কলকব্জা কখনও দেখেনি সুবলভাই
৪০. ৪০. অপারেশন থিয়েটারের চোখ-ধাঁধানো আলো
৪১. ৪১. বৈশাখ মাসে কোকাবাবুদের একটা মহাল
৪২. ৪২. রেমি যে মারা যাচ্ছে
৪৩. ৪৩. অনাথ ডাক্তারের মেলা টাকা
৪৪. ৪৪. সেই একটা দিন কেটেছিল
৪৫. ৪৫. কয়েকদিন যাবৎ অনেক ভাবলেন হেমকান্ত
৪৬. ৪৬. ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে
৪৭. ৪৭. মামুদ সাহেব
৪৮. ৪৮. মানুষেরা ভীষণ অবুঝ
৪৯. ৪৯. এক তীব্র, যন্ত্রণাময় অশ্বখুরধ্বনি
৫০. ৫০. এত ভয় রেমি জীবনেও পায়নি
৫১. ৫১. কুঞ্জবনে আর এসো না
৫২. ৫২. খুব নরম খুব সবুজ ঘাস
৫৩. ৫৩. একটা পঙক্তি
৫৪. ৫৪. একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল
৫৫. ৫৫. স্ত্রী চরিত্র কতদূর রহস্যময়
৫৬. ৫৬. হাতে-পায়ে খিল ধরল রেমির
৫৭. ৫৭. এরকম বৃষ্টির রূপ
৫৮. ৫৮. মাথার ঠিক ছিল না রেমির
৫৯. ৫৯. চপলা খুব ধীরে ধীরে
৬০. ৬০. রাজার ফ্ল্যাট
৬১. ৬১. বাবা, আমি কাল যাব না
৬২. ৬২. গায়ে নাড়া দিয়ে
৬৩. ৬৩. ইরফান নামে যে লোকটা
৬৪. ৬৪. আজ আর নেই
৬৫. ৬৫. শশিভূষণের মামলা
৬৬. ৬৬. যে সময়টায় রেমির পেটে ছেলেটা এল
৬৭. ৬৭. আজ শচীনের চেহারার মধ্যে
৬৮. ৬৮. মেয়েটির হাসিটি অদ্ভুত সুন্দর
৬৯. ৬৯. শচীন কাশী রওনা হওয়ার আগের দিন
৭০. ৭০. গাড়ির ব্যাকসিটে বসে ধ্রুব
৭১. ৭১. বরিশালের জেলে সতীন্দ্রনাথ সেনের অনশন
৭২. ৭২. একটি লোকও নার্সিংহোম ছেড়ে যায়নি
৭৩. ৭৩. কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল
৭৪. ৭৪. ধ্রুবর যে একটা কিছু হয়েছে
৭৫. ৭৫. এক সাহেব ডাক্তার আনানো হল
৭৬. ৭৬. ধ্রুব রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে
৭৭. ৭৭. লোকটা কী বলছে
৭৮. ৭৮. একটা হত্যাকাণ্ড এবং মৃত্যু
৭৯. ৭৯. আবার সেই কিশোরী
৮০. ৮০. সে আর সে
৮১. ৮১. প্রদোষের আলো
৮২. ৮২. ধ্রুব, বাপ হয়েছিস শুনলাম
৮৩. ৮৩. সংজ্ঞা যখন ফিরল
৮৪. ৮৪. প্রশান্ত ধ্রুবকে লক্ষ করছিল
৮৫. ৮৫. ফেরার পথে ঘোড়ার গাড়ি
৮৬. ৮৬. নোটন
৮৭. ৮৭. বজ্রনির্ঘোষের মতো কণ্ঠস্বর
৮৮. ৮৮. ধ্রুব আর নোটন
৮৯. ৮৯. রামকান্ত রায় খুন
৯০. ৯০. মরবি কেন
৯১. ৯১. হেমকান্ত একটু সামলে উঠেছেন
৯২. ৯২. বাথরুমের দরজা খুলে
৯৩. ৯৩. প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার তুলতে
৯৪. ৯৪. স্বচ্ছ গোলাপি মশারির মধ্যে
৯৫. ৯৫. ইহা কী হইতে চলিয়াছে
৯৬. ৯৬. কৃষ্ণকান্তকে দেখে জীমূতকান্তি
৯৭. ৯৭. আজ এই দিনপঞ্জীতে যাহা লিখিতেছি
৯৮. ৯৮. কৃষ্ণকান্ত নিজের বাইরের ঘরটায় এসে
৯৯. ৯৯. নীল আকাশের প্রতিবিম্বে নীলাভ জল
১০০. ১০০. ধ্রুব খুবই মনোযোগ দিয়ে
১০১. ১০১. যখন বাড়ি ফিরিলাম
১০২. ১০২. দরজা খুলে বৃদ্ধা
১০৩. ১০৩. বিশাখার বিবাহ
১০৪. ১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে
১০৫. ১০৫. কাশী আসিবার পর
১০৬. ১০৬. বাবা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন