০১।৪ প্রথম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক

দিলীপ মুখোপাধ্যায়

চতুর্থ অনুবাক
প্রথম সূক্ত : রুধিরস্রাবনিবৃত্তয়ে ধমনীবন্ধনম
[ঋষি : ব্রহ্মা দেবতা : যোষিত, ধমনী ছন্দ : অনুষ্টুপ, গায়ত্রী ]

প্রথম মন্ত্রঃ অমূর‍ যন্তি ঘোষিত হিরা লোহিতবাসসঃ। অভ্রাতর ইব জাময়স্তিষ্ঠন্তু হতবৰ্চসঃ ॥ ১

বঙ্গানুবাদ –সেবিকাধর্মাবলম্বী (ভগবৎসেবাপরায়ণ) পরিদৃশ্যমান (সর্বজনবিদিত) তেজঃপূর্ণ ও যে প্রসিদ্ধ কর্মশক্তিসমূহ, সহায়হীন (সহযোগীশূন্য) অবস্থায় হততেজস্ক হয়ে আছে; আকাক্ষণীয় সেই কর্মশক্তিসমূহ সহযোগীবিশিষ্ট (সৎসহযুত বল-সমন্বিত) হোক। (অর্থাৎ, যে সকল চিত্তবৃত্তি বা কর্মশক্তি, সৎকর্মের সাধনে সামর্থ্যহীন হয়েছে; তারা সত্ত্বভাবের সহযোগে শক্তিসম্পন্ন হোক। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটি চতুর্থ অনুবাকের প্রথম সূক্তের প্রথম মন্ত্র। এই সূক্তের মন্ত্রগুলিতে শস্ত্রাঘাতজনিত কারণে রুধিরপাত নিবারণের নিমিত্ত এবং বিশেষভাবে স্ত্রীলোকের অতিরিক্ত রজোরক্তস্রাব বন্ধ করবার উদ্দেশে প্রযুক্ত হওয়ার বিধি আছে। আলোচ্য মন্ত্রটি শান্তিকর্মসূচক। তবে এই মন্ত্রে শান্তিকামনার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতমুখে রথ্যাপাংসুসিকতা প্রক্ষেপ করতে হয়। অর্মকপালিকা দ্বারা নাড়ী বন্ধন করতে হয়। শেষোক্ত পদে শুষ্কপঞ্চমৃত্তিকা বা কেদারমৃত্তিকা বোঝায়–এই মাত্র সূক্তের ভাষ্যানুক্রমণিকায় লিখিত আছে। ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের অর্থে প্রকাশ,-স্ত্রীলোকের সম্বন্ধীয় সম্মুখে দৃশ্যমান এই লোহিত বস্ত্র, অথবা লোহিত রক্তের আশ্রয়ভূতা যে শিরায় অর্থাৎ রজোবহনকারী নাড়ীসমূহে ব্যাধিহেতু সর্বদা রক্ত নিঃসরণ করছে, সেই নাড়ীসকল এই ভৈষজ্যাক্রিয়ার দ্বারা তেজোহীনা হোক, অর্থাৎ সেই সকল হতে যেন আর রক্তক্ষরণ না হয়। এ বিষয়ে উদাহরণ; যথা,ভ্রাতৃহীনা ভগিনীর ন্যায়। অর্থাৎ তারা যেমন পিতৃকুলে সন্তানোচিত কর্মের জন্য–পিণ্ডদান ইত্যাদির জন্য–অবস্থিতি করে, সেইরকম।-মন্ত্রে ঐরকম অর্থ যে গ্রহণ করা যায় না, তা আমরা বলি না। তবে আমরা যে দৃষ্টিতে দেখছি, যে পথে অগ্রসর হয়েছি, তাতে সর্বত্র সকল সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়–যদি আমাদের পরিগৃহীত অর্থের বিষয় বিচার করা যায়। আমাদের ব্যাখ্যায় মন্ত্রটিকে আত্মউদ্বোধনমূলক বলে মনে হবে। মন্ত্রোচ্চারণকারী এই মন্ত্রে আপন চিত্তবৃত্তিসমূহকে সত্ত্বভাবের সহযোগে শক্তিসমন্বিত হবার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন।যোষিতঃ পদের সাধারণ অর্থ–স্ত্রীলোক-সম্বন্ধীয়। কিন্তু যোষিৎ শব্দে যে স্ত্রীকে বোঝায়, তার মূলতত্ত্ব কি? যু ধাতু হতে ঐ পদ নিস্পন্ন। তার অর্থ–সেবা, করা। স্ত্রী-পতির সেবাপরায়ণা হন, তাই তার সংজ্ঞা–যোষিৎ। স্ত্রী যেমন পতির সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন, সাধকগণও অনেক সময় সেইরকম পতিভাবে ভগবাকে দর্শন করে তার সেবাপরায়ণ হন। এখানে যোষিতঃ পদে, সেই সেবাধর্মপরায়ণ-জনের ভাব গ্রহণ করা যায়। আবার–অমূঃ লোহিতবাসসঃ পদের ভাব লক্ষ্য করুন। অমূঃ পদের প্রতিবাক্যে আমরা পরিদৃশ্যমানাঃ সর্বজনবিদিতাঃ পদ গ্রহণ করেছি। লোহিতবাসসঃ পদে তেজঃপূর্ণাঃ ভাব পরিগ্রহণ করি। ভগবানের সেবায় যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের তেজঃশক্তি সর্বজনবিদিত। যোষিতঃ অমূঃ লোহিতবাসসঃ বাক্যাংশে এই ভাব পরিব্যক্ত। রক্তই তেজের মূলীভূত; রক্তহীন দেহে তেজঃ আদৌ তিষ্ঠিতে পারে না। তাই লোহিতবাসসঃ পদে তেজঃপূর্ণাঃ অর্থ পরিগ্রহণ করলাম। যাঃ পদে প্রসিদ্ধাঃ এবং হিরাঃ পদে শিরাঃ বা কমর্শক্তয়ঃ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি। রক্তপূর্ণ তেজঃপূর্ণ শিরাই কর্মশক্তির প্রবর্তক। এ থেকেই ঐ ভাব প্রাপ্ত হই। অভ্রাতর ইব পদদুটিতে উপমায় সহায়হীন সহযোগীশূন্য অবস্থা ব্যক্ত করে। সত্ত্বভাবসমূহ মানুষের জন্মসহচর হয়ে আসে। সুতরাং তাদের ভ্রাতার ন্যায় সহায়স্বরূপ মনে করা যেতে পারে। ইত্যাদি। আমরা মনে করি–যে চিত্তবৃত্তিসমূহ বা কর্মশক্তিসমূহ সঙ্কর্মের সাধনে সামর্থ্যহীন হয়েছে, তারা সত্ত্বভাবসহযোগে শক্তিসম্পন্ন হোক-এ পক্ষে সমগ্র মন্ত্রের এটাই মর্ম ॥১॥

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ তিষ্ঠাবরে তিষ্ঠ পর উত ত্বং তিষ্ঠ মধ্যমে। কনিষ্ঠিকা চ তিষ্ঠতি তিষ্ঠাদিদ্ধমনির্মহী ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমার নিকৃষ্টকর্মে আপনি অবস্থান করুন; আমার শ্রেষ্ঠকর্মে আপনি অবস্থান করুন; আমার মধ্যম কর্মে আপনি অবস্থান করুন, (অর্থাৎ, আমার সর্বপ্রকার কর্মের সাথে সত্ত্বভাবের সংশ্রব অক্ষুণ্ণ থাকুক); আর, আমার যে ক্ষুদ্র শক্তিটুকু আছে, তা মহতী (মহৎকার্যের সম্পাদনে সমর্থ) হোক। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যে প্রকাশ, এই মন্ত্রে ধমনীসমূহকে প্রার্থনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে,-হে অবরে অর্থাৎ অধোভাগবর্তিনি শিরে (নাড়ী)! তুমি তিষ্ঠ অর্থাৎ অস্ত্রাঘাতজনিত রক্তস্রাব হতে নিবৃত্ত হও। সেইরকম, হে পরে অর্থাৎ উধ্বাঙ্গবর্তিনি শিরে! তুমিও তিষ্ঠ। অপিচ, হে মধ্যমে অর্থাৎ মধ্যভাগবর্তিনি শিরে! তুমিও তিষ্ঠ (প্রকৃতিস্থ হও)। আর, কনিষ্ঠিকা অর্থাৎ সূক্ষ্মতরা যে নাড়ী এবং মহী অর্থাৎ স্থূলতরা যে নাড়ী, তারাও নিবৃত্তরুধিরস্রাব হয়ে অবস্থিতি করুক। ফলতঃ, পূর্বৰ্মন্ত্রে স্ত্রীলোকের যে,রক্তস্রাবের বিষয় প্রখ্যাপিত হয়েছে, এ মন্ত্রে নাড়ীসকলকে সম্বোধন করে তাদের রক্তস্রাব বন্ধ হোক-তারা প্রকৃতিস্থ হোক, –এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এটাই ভাষ্যের অভিমত।-আমাদের ব্যাখ্যার বিচারের পূর্বে স্মরণ রাখবেন, আমাদের সাধারণ মত এই যে, যে কার্যেই মন্ত্রসকল প্রযুক্ত হোক, সকল মন্ত্রের মধ্যেই আত্মেক বিধায়ক পরমার্থসম্বন্ধবিশিষ্ট ভাব বিদ্যমান রয়েছে। পূর্ব মন্ত্রে অভ্রাতর ইব পদ দুটির ব্যাখ্যায় সত্ত্বভাব-সংশ্রব শূন্যতার ভাব আমনন করেছি। সেই সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ রাখবার আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। সে পক্ষে এখানকার সম্বোধন শুদ্ধসত্ত্ব। মন্ত্রোচ্চারণকারী এখানে শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করে বলছেন,–অধম উত্তম মধ্যম আমার এিবিধ কর্মে যেন শুদ্ধসত্ত্বের সংশ্রব থাকে। অপিচ, আমার যে ক্ষুদ্রশক্তি, তা যেন সত্ত্বসংশ্রবযুত হয়ে মহৎ কার্য-সম্পাদনে সমর্থ হয়। আমরা মনে করি, এটাই এ মন্ত্রের প্রার্থনা। এখানে প্রকারান্তরে নিষ্কাম কর্ম সাধনেরই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ শস্য ধমনীনাং সহস্ৰস্য হিরাণাং। অরিন্মধ্যমা ইমাঃ সামন্তা অরংসত। ৩

বঙ্গানুবাদ –শতসংখ্যক ধমনীর এবং সহস্ৰসংখ্যক হিরার (নাড়ীর) শক্তি, আমার এই ক্ষীণশক্তির মধ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান হোক; আর, সকল শক্তির সাথে আমার এই ক্ষীণশক্তিসকল কর্মশীল হোক; (শুদ্ধসত্ত্বভাবের সাথে সম্মিলিত হয়ে, আমার এই ক্ষুদ্রশক্তি সৎকর্মের সম্পাদনে প্রবলা হোক–এই আকাঙ্ক্ষা) ॥ ৩॥

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –ভাষ্যে এই মন্ত্রের যে অর্থ প্রখ্যাপিত হয়েছে, তার মর্ম এই যে,–শতসংখ্যক প্রধান নাড়ী এবং সহস্ৰসংখ্যক ক্ষুদ্র নাড়ীর মধ্যে এই যে সকল নাড়ী হতে রক্তস্রাব হচ্ছিল, মন্ত্রশক্তি: প্রভাবে তাদের সে রক্তস্রাব নিবৃত্ত হয়েছে। সেই সকল নাড়ীর রক্তস্রাব নিবৃত্ত হওয়ার পর যে সকল নাড়ী অবশিষ্ট ছিল, তারা পূর্বের ন্যায় ক্রিয়াশীল হয়েছে। এখানেও রোগিণীর প্রতি ভাষ্যকারের লক্ষ্য অব্যাহত আছে। তার লক্ষ্য যে অসঙ্গত, মন্ত্রের প্রয়োগবিধি স্মরণ করলে, তা কখনই বলা যায় না। তবে আমরা যে দৃষ্টিতে যে ভাবে মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাষণ করছি, তা-ও যে অযৌক্তিক, বলতে পারা যায় না। মন্ত্ৰান্তৰ্গত ইমাঃ পদের লক্ষ্যস্থল নির্দিষ্ট হলেই আমাদের অর্থের সার্থকতা বোঝা যায়। পূর্বে বলা হয়েছে,-আমার শক্তি ক্ষীণ,আমার শক্তি ক্ষুদ্র। এখন বলা হচ্ছে, আমার এই ক্ষীণ শক্তির মধ্যে সহস্র রকমের শক্তি সন্নিবিষ্ট হোক। ভগবানের কৃপা হলে, ক্ষুদ্রশক্তিই অনন্তশক্তির সাথে মিলিত ও অনন্তসামর্থ্য প্রাপ্ত হয়। এখানে এই ভাবই পরিব্যক্ত। অন্যাঃপদের অর্থে শক্তির শেষ (অবশিষ্ট) অর্থাৎ ক্ষীণশক্তিসমূহঅর্থ গ্রহণ করি। ফলতঃ, এই মন্ত্রের প্রার্থনা বা আকাঙ্ক্ষা এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বভাবের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়ে আমার ক্ষুদ্রশক্তিসকল সৎকর্মের সম্পাদনে প্রবল-সামর্থযুক্ত হোক ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্র: পরি বঃ সিকতাবতী ধবৃহত্য ক্রমীৎ। তিষ্ঠতেলয়তা সু কং ॥ ৪।

বঙ্গানুবাদ –হে কর্মশক্তিসমূহ! শত্রু তোমাদের ব্যেপে আছে; তোমরা মহৎ সত্ত্বভাবে আদ্রীভূত হয়ে অবস্থান করো; আর, আমাদের সুষ্ঠু সুখ প্রেরণ করো। (কর্মসত্ত্বভাবসহযুত হলে, শত্রুর ভয় কখনও তিষ্ঠিতে পারে না–এটাই ভাব) ৪

 মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যে মন্ত্রের যে অর্থ দৃষ্ট হয়, তা তমসাচ্ছন্ন। তার ভাব এই যে,–হে নাড়ীসকল! তোমাদের সিকতাবতী (রজঃস্রাববিশিষ্ট, রজঃসম্বন্ধীয় ব্যাধি উৎপাদক নাড়ী) ও ধনু (ধনুবৎ বক্র, মূত্রাশয়স্থ নাড়ীবিশেষ) সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত করেছে। তার দ্বারা তোমাদের রুধিরপ্রবাহের পথ বন্ধ হয়েছে। এই হেতু হে নাড়ীসকল! তোমরা নিবৃত্তরক্তস্রাব হও। আর এই লোকের সুখ প্রেরণ করো। রক্তস্রাব-নিরোধ হেতু এর সুখ হোক। ভাষ্যের এই ভাব। সূক্তের মন্ত্র-কয়েকটি যে উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত, এখানেও সেই ভাবেই ব্যাখ্যা হয়েছে। আমরা বলি, এ মন্ত্রের সম্বোধন–কর্মশক্তি সমূহ! সেক্ষেত্রে, এখানে আপন কর্মশক্তি-সমূহকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,-শত্রু অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপু তোমাদের চারদিকে ঘিরে আছে। তুমি সত্ত্বভাবকে আশ্রয় করো। সত্ত্বভাব-সহযুত হলে, সে শত্রুরা তোমাকে আক্রমণ করতে পারবে না। অতএব, তুমি সত্ত্বসহযুত হয়ে অবস্থান করো। তার দ্বারা আমরা পরমসুখে সুখী হবো।কর্ম যদি সত্ত্বসহযুত হয়, তাহলে শত্রুর আক্রমণের বিভীষিকা থাকে না; পরন্তু পরম সুখ অধিগত হয়। আমরা মনে করি, আধ্যাত্মিক-পক্ষে এ মন্ত্রের এটাই মর্মার্থ। তবে সাধারণে প্রচলিত এই মন্ত্রের প্রয়োেগ অসঙ্গত বলা যায় না। ৪।

.

দ্বিতীয় সূক্ত : অলক্ষ্মীনাশনম্

[ঋষি : দ্রবিণোদা দেবতা : বিনায়ক, সবিতা, বরুণ, মিত্র, অর্যমা ইত্যাদি ছন্দ : বৃহতী, জগতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ)]

প্রথম মন্ত্রঃ নির্লং ললাম্যং নিররাতিং সুবামসি। অথ যা ভদ্রা নি নঃ প্রজায়া অরাতিং নয়ামসি ॥ ১৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন! আমার ললাটস্থিত অদৃষ্টগত অসৌভাগ্যকর চিহ্নকে সম্পূর্ণরূপে উৎসারণ করুন, (অর্থাৎ, যার দ্বারা আমার কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তার ব্যবস্থা করে দিন); আমার অসৎ-বৃত্তিনিবহকে (অথবা, শত্রুভয়কে, নরক-ভয়কে আপনি বিদূরিত করে দিন। অতঃপর, স্বর্গ ইত্যাদি প্রাপক রূপ যে কল্যাণসমূহ আছে, সেই সমুদায় আমাদের পুত্রপৌত্র ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক সকল লোককে প্রাপ্ত হোক; আর, পূর্বনিঃসারিত অসৌভাগ্যকর চিহ্নসকল আমাদের শত্রুকে প্রদান করুন, (অর্থাৎ, অসৌভাগ্যকর অসৎ-বৃত্তিসমূহকে হৃদয় হতে দূর করে দণ্ডদানের নিমিত্ত নরকে নিক্ষেপ করুন ॥ ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— সামুদ্রিক শাস্ত্রানুসারে হস্ত-পদ-মুখ প্রভৃতি অঙ্গে স্ত্রীলোকের কতকগুলি দুশ্চিহ্ন লক্ষিত হয়। সেই সকল দুশ্চিহ্ন-দূরীকরণের জন্য শাস্ত্রীয় প্রক্রিয়ায় মুখপ্রক্ষালন ও হোম ইত্যাদি কার্যের অনুষ্ঠান আবশ্যক। দুর্লক্ষণ-নিবৃত্তি-বিষয়ক শান্তিকল্পে মহাশান্তির উদ্দেশ্যে এই সূক্তের মন্ত্রগুলি উচ্চারিত হবার বিধি আছে। এই সূক্তটি সেই দুর্লক্ষণ-নিবারক বলে কথিত হয়।–মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী অর্থের লক্ষ্য সাধারণতঃ দুর্লক্ষণ-দূরীকরণ। সেই ভাবেই মন্ত্রের অর্থ অধ্যাহৃত হয়ে এসেছে। মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাষণে আমরা প্রায়ই ভাষ্যের অনুসরণ করেছি। তবে আমাদের ব্যাখ্যার বিশেষত্ব এই যে, প্রার্থনাকারী এখানে আপন জন্মগত কর্মফল-নাশের জন্য ভগবানের নিকট প্রার্থনা জ্ঞাপন করছেন। অসৎ-বৃত্তিসমূহ দূরে অপসৃত হোক, আমার অন্তরে সৎকর্ম সাধনের প্রবৃত্তি জাগ্রত হোক, আর তার ফলে আমার কর্মফল বিধ্বংস হোক, আমি পরমা-গতি লাভ করি। আমাদের মতে, মন্ত্রের এটাই লক্ষ্য ॥ ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ নিররণিং সবিতা সাবিষ পদোর্নিহস্তয়োর্বণণা মিত্রো অর্যমা। নিম্মুভ্যং অনুমতী রাণা প্রেমাং দেবা । অসাবিষুঃ সৌভগায় ॥২৷৷

বঙ্গানুবাদ –জ্ঞানপ্রদাতা সবিতা দেবতা আমাদের দুর্ভাগ্য দূর করুন; অভীষ্টবর্ষণকারী পাপবারক বরুণদেব, মিত্রস্থানীয় মিত্রদেব, অভিমত-ফল-প্রদাতা গতিকারক অর্যমা-দৈব, আমাদের হস্তদ্বারা কৃত ও পদদ্বারা কৃত পাপকে দূর করুন; এবং আমাদের অনুভবযোগ্যা (ধারণার অন্তর্গত) দেবতা, আমাদের দ্বারা সম্পূজিতা হয়ে, আমাদের জন্য, দুষ্কর্মকে দূর করুন। দেবভাবসমূহ, আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, আমাদের ধারণার অন্তর্ভূর্ত দেবতাকে, আমাদের পরমার্থ প্রাপ্তি-রূপ সৌভাগ্য দানের জন্য, প্রেরণ করে থাকেন। (দেবভাবের সাহায্যেই আমরা দেবানুগ্রহ-লাভে সমর্থ হই) ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যের অভিমত এই যে,-হস্তে এবং পদে মানুষের যে সমস্ত দুর্লক্ষণ থাকে, এই মন্ত্রে সেই সকল দুর্লক্ষণ অপসারণ-পক্ষে প্রার্থনা জানানো হয়েছে। সামুদ্রিক শাস্ত্রানুসারে, ললাটের কতকগুলি চিহ্ন যেমন দুর্লক্ষণ প্রকাশ করে; হস্ত-পদের কতকগুলি চিহ্নও সেইরকম দুর্লক্ষণ প্রকাশক। এই মন্ত্রে দুর্লক্ষণ দূর করবার জন্য প্রথমে সাধারণভাবে সবিতা দেবতাকে আহ্বান করা হয়েছে। তার পর, বিশেষভাবে হস্তের ও পদের দুর্লক্ষণ দূর করবার জন্য, বরুণ মিত্র ও অর্যমা দেবতার অনুগ্রহ প্রার্থনা আছে। এটাই মন্ত্রের প্রথম পাদের ভাষ্যানুমোদিত ভাব। মন্ত্রের দ্বিতীয় পদে অনুমতিঃ দেবতার প্রসঙ্গ আছে। ঐ দেবতার স্বরূপ-পরিচয়ে ভাষ্যকার লিখেছেন-সর্বেষাং অনুমন্ত্রী দেবতা। সেই দেবতা আমাদের কর্তৃক স্তুত হয়ে আমাদের সকল শরীরাবয়বের দুর্লক্ষণকে দূর করুন;–এটাই দ্বিতীয় পদের প্রথমাংশের প্রার্থনা। ঐ পাদের দ্বিতীয় অংশের ভাব এই যে, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ ঐ অনুমতি দেবতাকে আমাদের সৌভাগ্যের জন্য প্রেরণ করেন। ফলতঃ, দেহাবয়বের দুশ্চিহ্নসমূহকে দূর করাই এই মন্ত্রের লক্ষ্য। এটাই ভাষ্যের ভাব। মন্ত্রার্থে ভাষ্যের অনুসরণ করলেও আমাদের বক্তব্য এই যে, এ মন্ত্রের স্থলমর্ম–পাপ-সম্বন্ধ-পরিত্যাগের কামনা। মানুষের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যে উপস্থিত হয়, সে কেবল কর্মের ফল মাত্র। কর্মের দ্বারা যে অদৃষ্ট সঞ্চিত হয়, তা-ই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য-রূপে প্রকাশ পায়। এখানে প্রধানতঃ তাই বলা হয়েছে-দেবগণ আমাদের পাপকর্ম হতে নিবৃত্তি দান করুন। আমরা যেন পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে দুর্ভাগ্যের সঞ্চয় না করি।… মানুষ হস্তের দ্বারা, পদের দ্বারা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা নানা অপকর্ম করে থাকে। তাতে নানাভাবে পাপ সঞ্জাত হয়। সেই সকল পাপ দূরীকরণের জন্য, নিজের পরম মঙ্গল কামনা করে, মন্ত্রের উচ্চারণকারী এখানে বলছেন,–হে দেবগণ! আপনারা আমার সবরকম পাপকার্যে আমায় বিরত করুন। আমাদের সন্ধ্যার মন্ত্রে আচমন উপলক্ষে এমন প্রার্থনাই আছে।–উপসংহারে অনুমতিঃ দেবতার বিষয় এবং দেবগণ কর্তৃক আমাদের সৌভাগ্যের জন্য আমাদের নিকট তাকে প্রেরণের বিষয় লিখিত হয়েছে। তার মর্ম কি?…অনেক দেবতাকে আমরা অনুভবে অন্তরে ধারণা করতে পারি। বিবেক-বাণী-রূপে দেবতাগণ অনেক সময়ে আমাদের হৃদয়ে উদ্ভাসিত হন। অনুমতিঃ দেবতায় সেই ভাব প্রকাশ পায়। ভাষ্যের সর্বেষাং অনুমন্ত্রী দেবতা বাক্যেও এই আভাষ প্রাপ্ত হই। সেই দেবতা আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের সৎপথ প্রদর্শন করেন–সকার্য-সাধনে সুমন্ত্রণা দেন–মনে হয়, এই জন্যই তার নাম অনুমতিঃ দেবতা। সেই অনুমতি দেবতা দেবগণ কর্তৃক প্রেরিত হন, এমন বাক্যের মর্ম এই যে,-দেবভাব হতেই অনুমতি দেবতাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, অর্থাৎ বিবেকবাণীরূপা অথবা অনুভবযোগ্যা যে দেবতার কৃপা, দেবভাবসমূহই আমাদের তা প্রদান করেন। দেবতার অনুগ্রহ, আমরা আমাদের সত্ত্বসম্বন্ধযুত কর্মের অর্থাৎ দেবভাব হতেই প্রাপ্ত হই। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যত্ত আত্মনি তন্বং ঘোরং অস্তি যদ্বা। কেশেমু প্রতিচক্ষণে বা। সর্বে তঘাচাপ হন্মো বয়ং দেবা সবিতা সূদয়তু ॥ ৩৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে জীব (আত্ম-উদ্বোধন)! দ্যোতমান জ্ঞানপ্রেরক সবিতাদেব তোমাকে শ্ৰেয়োদান করুন; তাতে, তোমার হৃদয়ে ও দেহে অনুভূয়মান বা পরিদৃশ্যমান যে পাপ (অজ্ঞানতা-রূপ যে ঘোর) বিদ্যমান রয়েছে, অথবা তোমার শিরোভাগে মস্তিষ্কে এবং দৃষ্টিসাধনভূত ১ নেত্রে যে পাপ বিদ্যমান আছে; বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ সেই সকল পাপকে, ভগবৎ-অনুগ্রহ প্রার্থনাকারী আমরা, মন্ত্রশক্তির দ্বারা অপহত করি (দূরীভূত করতে সমর্থ হবো। জ্ঞানপ্রেরক সবিতা দেবতা কৃপাপরায়ণ হলে, মন্ত্রশক্তির প্রভাবে আমরা আমাদের সর্বপ্রকার পাপনাশে সমর্থ, হবো–এটাই ভাবার্থ)। ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের ভাব বড়ই জটিল। মন্ত্রের সম্বোধ্যই বা কে, আর প্রার্থনাই বা কি, ভাষ্য-অনুসারে তা বোধগম্য হওয়া বড়ই কঠিন। ভাষ্যের ভাব এই যে,–এখানে দুলক্ষণাক্রান্ত পুরুষকে সম্বোধন করে মন্ত্ররূপ বাক্য যেন বলছেন–হে দুর্লক্ষণোপেত পুরুষ! তোমার আত্মীয়স্থানীয় শরীরে যে ভয়ঙ্কর দুর্লক্ষণ (দুশ্চিহ্ন) বিদ্যমান আছে, অথবা তোমার শরীরোপহিত পুরুষে যে ভয়ঙ্কর পাপ (চিহ্ন) রয়েছে; অথবা শিরঃস্থিত কেশে বা শিরোরূঢ় যে পাপ (দুশ্চিহ্ন) অথবা তোমার দর্শনসাধনভূত চক্ষুতে যে ঘোর (পাপ–দুশ্চিহ্ন) আছে; সেই আভ্যন্তর ও বাহ্য সবরকম পাপসমূহকে, আমরা প্রয়োগকুশল মন্ত্ররূপ বাক্যের দ্বারা, অপহনন করছি। এই রকমে অনিষ্ট-নিবৃত্তি করে, পরিশেষে ইষ্ট প্রার্থনা করা হচ্ছে, দ্যোমানাত্মক সবিতা (প্রেরক) দেব তোমাকে শ্রেয়োধামে প্রেরণ করুন। দুর্লক্ষণ দূর করে তিনি তোমার সাথে শ্রেয়ের সম্বন্ধ স্থাপিত করে দিন। ভাষ্যে মন্ত্রের এমনই অর্থ প্রকটিত দেখি।আমরা মনে করি, মন্ত্রটি আত্মোদ্বোধনমূলক। এখানে প্রার্থী প্রথমে নিজেকে নিজেই সম্বোধন করে বলছেন,–হে জীব! হে অহং! ভগবানের অনুগ্রহ-প্রার্থনাকারী আমরা, দেবতার পূজাপরায়ণ আমরা, দেবতার অনুগ্রহে, মন্ত্রশক্তির প্রভাবে, সকল প্রকার পাপকে অপসৃত করবো। সে পক্ষে প্রথমে তুমি জ্ঞানপ্রেরক সেই সবিতা-দেবতার দ্বারে অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে দণ্ডায়মান হও; জ্ঞানদাতা সেই দেবতা তোমায় অনুগ্রহ করবেন-তোমার শ্ৰেয়োবিধান করবেন। তার সেই অনুগ্রহের ফলে, জ্ঞানোদয়ের প্রভাবে, তোমার সকল প্রকার পাপ দূরীভূত হবে। তোমার অন্তরে পাপ আছে; তুমি কত রকম কু-কল্পনার দ্বারা কত রকম পাপই সঞ্চয় করছে। সেই যে পাপ, তা-ই তোমার আত্মনি ঘোরঃ (হৃদয়স্থিত পাপ)। তার পর, ভেবে দেখো দেখি–তোমার দেহের দ্বারা তুমি কত রকম পাপই না করছে। সেই পাপই তোমার তন্বং ঘোরং (শরীরকৃত পাপ)। তার এক পাপ অনুভূয়মান; অন্য পাপ পরিদৃশ্যমান। (যৎ পদ সেই ভাবই প্রকাশ করে)। এই যে উভয়বিধ পাপ, অথবা তোমার মস্তিষ্ক যে পাপে ঘিরে আছে, তোমার দর্শনে যে পাপ ওতঃপ্রোতঃ বিদ্যমান রয়েছে, তোমার কলুষচিন্তার ফলে যে পাপ সঞ্জাত হয়েছে, তোমার দর্শনে বা কু-দৃষ্টির দ্বারা যে পাপ সঞ্চয় করছে, তোমার আভ্যন্তর ও বাহ্য সেই সমস্ত রকম পাপই (ঘোর অন্ধতামস) অপসৃত হবে;-দেবতার কৃপালাভে সমর্থ হলে, এই মন্ত্রশক্তির প্রভাবে, আমরাই সকল পাপকে দূর করতে সমর্থ হবো। এমন আত্ম-উদ্বোধনের ভাবই এই মন্ত্রে লক্ষ্য করা যায়। আমরা মনে করি, মন্ত্রে বলা হয়েছে-যদি সবিতা দেবতা কৃপাপরায়ণ হন, যদি জ্ঞানার্জনে সমর্থ হই, মন্ত্রশক্তির দ্বারা আমরা নিজেরাই নিজেদের সকল পাপকে দূরীভূত করতে পারবো।–মন্ত্রের এটাই মর্মার্থ ॥ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ রিশ্যপদীং বৃষদতীং গোষেধাং বিধমামুত। বিলীঢ্যং ললাম্যং তা অস্মন্নাশয়ামসি ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন! আমাদের কর্মশক্তিকে হিংসা দ্বেষ ইত্যাদি কুরকর্মান্বিতা, সৎ-ভাবনাকারিণী, বিপথানুবর্তিনী ও মিথ্যাভাষণশীলা করবেন না; অপিচ, ঐ সকল অসৎ-বৃত্তিকে হয়ে আমাদের নিকট হতে বিদূরিত করুন; আর, আমাদের অদৃষ্টগত কর্মফলতভাগকে (আমাদের কর্মের দ্বারাই) নিঃশেষ করে দিন। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যের অনুসরণে এই মন্ত্রের অর্থ-নিষ্কাশনে বড়ই উদ্বেগ পেতে হলো। ভাষ্যে প্রকাশ,–এই মন্ত্রের লক্ষ্য–দুর্লক্ষণাক্রান্ত স্ত্রীগণ। সেই অনুসারে প্রথম রিশপদীং (পাঠান্তরে ঋশ্যপদীং) পদের অর্থ করা হয়–যে স্ত্রীর পদদ্বয় হরিণের শৃঙ্গের ন্যায় বক্র; এবং ঐ পদে সেইরকম বক্রপদ-বিশিষ্টা স্ত্রীকে বোঝাচ্ছে। দ্বিতীয়–বৃদণ্ডীং। ভাষ্যানুসারে ঐ পদে, বৃষের ন্যায় দন্তবিশিষ্টা–স্থূলদন্তা স্ত্রীকে বোঝায়। তৃতীয়–গোষেধাং। ভাষ্যমতে ঐ পদের অর্থ–গোরুর ন্যায় যে স্ত্রী গমন করে, অথবা যে স্ত্রীর শব্দ বিকৃত, যে স্ত্রী ফুকার ইত্যাদি নানা বিকৃতশব্দকারিণী অর্থাৎ যে স্ত্রী বিকৃতগমনশীলা। তার পর, ভাষ্যকারের ভাব এই যে,-স্ত্রীগণই যেন প্রার্থনা করছেন,-ঐরূপ ঋশ্যপদাদিজনিত যে সকল দুর্লক্ষণ, সেই সমুদায় আমাদের নিকট হতে আমরা নাশ করছি; অর্থাৎ, মন্ত্রশক্তিপ্রভাবে তাদের নিবৃত্ত করছি। তার পর, ললামং পদে ললাটপ্রান্তে উৎপন্ন এবং বিলীঢ্যং পদে কেশসমূহের প্রতিলোম-রূপে ললাটপ্রান্তে বর্তমান যে দুর্লক্ষণ–তাকে বোঝায়। ভাষ্যে এই ভাব প্রকাশমান। রিশপদী প্রভৃতি পদ ব্যবহারহেতু স্ত্রীগণ-সম্পর্কেই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে, এই ভাবই সাধারণতঃ পরিগৃহীত হয়। কিন্তু বিলীঢ্য-রূপ দুর্লক্ষণ স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের সম্বন্ধেই প্রযুক্ত হয়েছে–মনে করা যায়। স্ত্রীগণের পদ ও কেশ, চলন ও বলন প্রভৃতিতে সুলক্ষণ দুর্লক্ষণ বিদ্যমান আছে, আমাদের দেশে এই ভাব আজও পোষিত হয়। বিবাহ-সম্বন্ধ। স্থাপনে ঐ সব লক্ষণের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য দেখা যায়। বোধহয় আলোচ্য মন্ত্রের মতো মন্ত্রগুলির অর্থই ঐরকম পরীক্ষার ভাব মনে জাগরুক করে রেখেছে]। যাই হোক, এ তো ভাষ্যের ভাব। আমরা কিন্তু পূর্ব পূর্ব মন্ত্রের সম্বোধন এবং কর্মশক্তির সাথে সেই সকল মন্ত্রের সম্বন্ধের বিষয়, এই মন্ত্রাৰ্থ-অলোচনার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করা আবশ্যক বলে মনে করি। আমরা বলি,–এই মন্ত্রের সম্বোধন-ভগবানকে। তার নিকট প্রার্থনা জানানো হচ্ছে,–আমাদের কার্যশক্তি যেন বিপথগামিনী না হয়। আমাদের কর্মের দ্বারা আমরা যেন আমাদের ভাগ্যরেখা–ললাট-লিপি–পরিবর্তন করতে সমর্থ হই। যেমন–রিশ্যপদীং। ঐ পদের ভাব বগতিবিশিষ্ট, ক্রুভাবাপন্ন। হিংসা দ্বেষ ইত্যাদির প্রাবল্যে কর্মশক্তিসমূহ রিশ্যপদীং অর্থাৎ বক্ৰগতিবিশিষ্টা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়-বৃদতীং। স্থূল অর্থ–স্থূলদন্তে চর্বণপরায়ণা। বৃষ পদে অভীষ্টবর্ষণের ভাব আসে; সত্ত্বভাবেই অভীষ্ট পূরণ হয়। যে দন্ত সেই অভীষ্টকে চর্বণ করে, অভীষ্টপূরণের পথ রোধ করে, এখানে সেই ভাব আসে। তৃতীয়–গোষেধাং। ঐ পদের ভাব–বিপথে গমনশীলা। গো-শব্দের জ্ঞান অর্থ গ্রহণ করলেও ঐ ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। গো অর্থাৎ জ্ঞান হতে চলে যাওয়ার ভাব (বিধু গত্যাং এই ধাতু-অর্থ অনুসারেই) পাওয়া যায়। জ্ঞান-পথ হতে চলে যাওয়াই বিকৃত গমন। গোষেধাং পদ ঐ ভাব প্রকাশ করে। চতুর্থ–বিধমাং। বিকৃত বা বিরুদ্ধ স্বরই মিথ্যাভাষণ। যা সত্য, তা বিকৃত বা বিরুদ্ধ নয়; মিথ্যাই বিকৃত-স্বর। এ পক্ষে ঐ বিধমাং পদে মিথ্যাভাষণের অর্থই প্রাপ্ত হই। এই সকল ভাব আমাদের কর্মশক্তির সাথে সম্বন্ধযুক্ত না হয়, আমাদের কর্মশক্তিকে তাদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করবেন না; মন্ত্রের প্রথমাংশে এইরকম প্রার্থনা প্রকাশিত হয়েছে।-মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ–তাঃ অস্মৎ নাসয়ামসি। তার নাশয়ামসি ক্রিয়াকে ভাষ্যকার প্রথম পুরুষের বহুবচনের ক্রিয়াপদ গণ্য করছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, ঐ পদ মধ্যমপুরুষের একবচনের ক্রিয়াপদ। তাই ঐ পদের নাশয়ামঃ প্রতিবাক্য-গ্রহণ না করে, আমরা বিনাশয় বিদ্রয় প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি।…এই সব বিষয় বিবেচনা করলে, এখানকার ভাব হয় এই যে,-হে ভগবন্! ঐ সকল অসৎ-সংশ্রবকে আমার কর্মশক্তি হতে দূরে অপসারণ করুন।  মন্ত্রের উপসংহার–ললাম্য বিলীঢ্যং নাশয়।–হে ভগবন্! আমার ললাটলিপি পরিবর্তন করে দিন।…আমার কর্মের দ্বারা আমার অদৃষ্টকে ফিরিয়ে নেবার সামর্থ্য আমাতে আসুক।–সূক্তের শেষে, সকল প্রার্থনার শেষে এই প্রার্থনাই সমীচীন ও সঙ্গত হয় ॥ ৪।

.

তৃতীয় সূক্ত : শত্রুনিবারণম

[ঋষি : ব্রহ্ম দেবতা : ঈশ্বর, (ইন্দ্র, দৈবী, রুদ্র, দেবা) ছন্দ : অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংক্তি]

প্রথম মন্ত্রঃ মা নো বিদন ব্রিব্যাধিনো মো অভিব্যাধিনো বিদ। আরাচ্ছরব্যা অস্মদ্বিধূচীরিন্দ্র পাতয় ॥ ১।

 বঙ্গানুবাদ –বিশেষরূপে অস্ত্রের দ্বারা তাড়নশীল শত্রুগণ (বহির্দেশ হতে আগত পারিপার্শ্বিক শত্রুগণ) আমাদের আক্রমণ করতে যেন সমর্থ না হয়; সন্নিহিত শত্রুগণ (অন্তরস্থিত কামক্রোধ ইত্যাদি রিপু-শত্রুগণ) আমাদের নিকট হতে দূরীভূত হোক। হে পরমেশ্বর্যশালি (ভগব ইন্দ্রদেব)! শত্রুগণ কর্তৃক বহু দিক হতে নিক্ষিপ্ত শরসমূহ (শত্রুগণের সর্বতোমুখী আক্রমণ), নানামুখে গতিশীল হয়ে, আমাদের নিকট হতে দূরদেশে পতিত হোক। (প্রার্থনা,–আমাদের প্রতি শত্রুগণের শর-সন্ধান সর্বৰ্থা ব্যর্থ হোক) ১

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই নতুন সূক্তে আবার নতুনরকমের প্রার্থনা আরম্ভ হলো। সুক্তানুক্রমণিকায় প্রকাশ,–এই সূক্তটি এবং এর পরবর্তী আরও দুটি সূক্ত সংগ্রামে বিজয়-শ্রী লাভের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়। বিঘা শরস্য (১কা-২সূ) প্রভৃতি মন্ত্রের ন্যায় এই সূক্তের মন্ত্র ইত্যাদির বিনিয়োগ-বিধি নির্দিষ্ট আছে। আয়ুধ-ধারণ প্রভৃতি সংক্রান্ত আজহোমে মা নো বিদ্যম্ ইত্যাদি সূক্তের মন্ত্রগুলির বিনিয়োগ হবে। এ বিষয়ের আর আর বিধি, কর্মীর নিকট অবগত হওয়া কর্তব্য। আমাদের ব্যাখ্যা প্রায়ই মন্ত্রের অনুসারী আছে। তবে যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে মন্ত্রের প্রয়োগ আছে–এই মাত্র লক্ষ্য রেখে, মন্ত্রের অর্থে ভাষ্যকার যে দূরস্থ ও নিকটস্থ যোদ্ধা-সৈনিকের শরনিক্ষেপ প্রতিহত করবার উদ্দেশ্যে মন্ত্রটি বিহিত হয়েছে নির্দেশ করেছেন, আমরা সে ভাব সম্পূর্ণ পরিগ্রহ করিনি। আমাদের মত এই যে, এই মন্ত্রে আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক দুরকম সংগ্রাম-ক্ষেত্রের চিত্র চিত্রিত আছে। মন্ত্রে বলা হয়েছে,হে ভগবন্! আমাদের বহিঃশত্রুকে আপনি দূরীভূত করুন; আমাদের অন্তরস্থ শত্রুও আপনার প্রভাবে বিনাশ-প্রাপ্ত হোক। ইন্দ্র-সম্বোধনে এখানে দেবাসুরের যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠতে পারে। আর্যগণের সাথে অনার্যগণের যুদ্ধের বিষয়ও খ্যাপন করা যায়। যে দৃষ্টিতে যিনি দেখবেন, মন্ত্রে সেই ভাবই আমনন করতে পারবেন। তবে আমাদের লক্ষ্য,–সেই। এক। সে পক্ষে প্রার্থনার মর্ম এই যে,–হে ভগবন্! অন্তঃশত্রু বহিঃশত্ৰু উভয় শত্রু আমাদের আক্রমণে নিয়ত শরসন্ধান করে আছে; আপনি তাদের আক্রমণ প্রতিহত করুন,–সেই দুই রকমের শত্রুকে দূরে অপসারণ করে দিন। একদিকে কাম ইত্যাদি রিপুগণের প্রলোভন-রূপ শর, অন্যদিকে অপকর্মের ফলস্বরূপ পারিপার্শ্বিক বিপদ-পরম্পরা-রূপ শর,–দুরকম শত্রুর নিক্ষিপ্ত দুরকমশর,–চারদিক হতে আমাদের আক্রমণ করতে আসছে। হে ভগবন্! সেই সকল শত্রুর আক্রমণ হতে আমাদের রক্ষা করুন। এটাই এখানকার প্রার্থনা ॥ ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ বিম্বঞ্চো অস্মচ্ছরবঃ পতন্তু যে অস্তা যে চাস্যাঃ। দৈবীমনুষ্যেষবো মমামিত্রা বি বিধ্যত ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হিংসাকারী শত্রুগণ! আমাদের নিকট হতে তোমরা বিপরীত পথে গমন করো; (আমাদের পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাও); যে শত্রু আমাদের আক্রমণের জন্য আমাদের অভিমুখে প্রধাবিত হয়েছে, যে শত্রুগণ আমাদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তারা সকলে বিপরীত পথে নিপতিত হোক। দৈবীঃ অর্থাৎ দেব সম্বন্ধীয় অস্ত্র ইত্যাদি (আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব ইত্যাদি) এবং মনুষ্যেষবঃ (অর্থাৎ মনুষ্যসম্বন্ধীয় অস্ত্র ইত্যাদি) অর্থাৎ আমাদের মনুষ্যোচিত কর্মের দ্বারা সঞ্জাত আয়ুধ ইত্যাদি, আমাদের ঐ শত্রুদের সংহার করুক। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— ভাষ্যানুসারে এ মন্ত্রে মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধের বিষয় প্রখ্যাপিত। তা থেকে দেবাসুরের যুদ্ধ অথবা আর্যগণের সাথে অনার্যগণের যুদ্ধ অধ্যাহার করা যায়। ভাষ্যনুসারে মন্ত্রের প্রথম পাদের অর্থ এই যে,-শত্রুর যে শর ধনু হতে বিনিমুক্ত হয়েছে, তারা অন্য পথে গমন করুক; আর যে শর তূণীরে সংগৃহীত আছে, তারাও নিপতিত অর্থাৎ ব্যর্থ হোক। শক্রর শর সম্বন্ধে এমন অভিপ্রায় প্রকাশ করে, পরিশেষে নিজেদের শরের কার্যকারিতা-বিষয়ে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমাদের পক্ষে দৈবীঃ অর্থাৎ আগ্নেয়-বারুণ ইত্যাদিরূপ অস্ত্রসমূহ, আর মনুষ্যেষবঃ এই আমাদের প্রযুক্ত অস্ত্র ইত্যাদি আমাদের শত্রুগণের সংহার সাধন করুন। এখানে মানুষে মানুষে যুদ্ধে এক পক্ষে দেবতাগণের সহায়তা প্রার্থনা করা হচ্ছে, অন্য পক্ষে নিজেদের কৃতিত্বেরও কামনা প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের ভাব ভাষ্যের ভাব হতে একটু স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করি, এ মন্ত্রের মুখ্য সম্বোধন-ভগবাকে। তাঁর অনুগ্রহে আমাদের সকলরকম শত্রু বিনষ্ট হোক,–এটাই প্রার্থনা। শত্রু বা শর বলতে এখানে হৃদয়স্থিত কামক্রোধ ইত্যাদি রিপু-শত্রুকে লক্ষ্য আছে। শর–প্রলোভন ইত্যাদি-রূপ তাদের কর্ম। তাদের যে কর্ম আরম্ভ হয়েছে, অর্থাৎ তারা আমাদের প্রতি যে শর পরিত্যাগ (নিক্ষেপ করেছে, সে শর বা সে কর্ম। অন্যদিকে বিপরীত-পথে গমন করুক;–এইরকম প্রার্থনার মর্ম এই যে,–শত্রুশরের কার্য–হিংসা ইত্যাদি –আমাদের মধ্যে যেন আর কার্যকরী না হয়। এর ভাব এই যে,–শত্রুর প্রলোভন ইত্যাদি যেন আমাদের প্রতি আদৌ কার্যকরী না হয়। আমরা মনে করি, মন্ত্রের প্রথম পাদের এটাই মর্মার্থ। ভাষ্যানুসারে দ্বিতীয় পাদের দৈবীঃ পদের অর্থ আগ্নেয় ইত্যাদি অস্ত্র বলে আমরা মনে করি না। রিপু দমনের পক্ষে দেবতার সত্ত্বভাবই প্রধান অস্ত্র; এখানে তাই প্রখ্যাপিত হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে,–দৈবী অস্ত্র অর্থাৎ আমার হৃদয়াভ্যন্তরস্থিত সত্ত্বভাবসমূহই আমার শত্রুকে বিনাশ করতে সমর্থ হোক। তারপর বলা হয়েছে,-আমার মনুষ্যোচিত কর্ম–আমার সকর্ম-নিবহ–তাদের বিমর্দিত করুক। ফলতঃ, আমি আমার কর্মের দ্বারা যেন আমার সকল অসৎ-ভাবকে দূর করতে সমর্থ হই; হে ভগবন্! আমায় সেই কর্মশক্তি প্রদান করো।–এটাই। এই মন্ত্রের নিগূঢ় তাৎপর্য। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যো নঃ স্বা যো অরণঃ সজাত উত নিষ্ট্যো যো অৰ্ম্ম অভিদাসতি। – রুদ্র শরব্যয়ৈতা মমামিত্ৰান্ বি বিধ্যতু ॥ ৩৷৷

 বঙ্গানুবাদ –যে সকল প্রসিদ্ধ আত্মসম্বন্ধী অন্তঃশত্রু (হৃদয়স্থিত রিপুশত্রু) আমাদের পীড়ন করে; যে সকল প্রসিদ্ধ জন্মসহজাত শত্রু (অসৎ বৃত্তিনিচয়) আমাদের নিপীড়িত করে; যে সকল বহিঃশত্রু আমাদের হিংসা করতে উদ্যত হয়; অপিচ, আর যে সকল নিকৃষ্টবল শত্রু আমাদের পীড়া উৎপাদন করে; সংহর্তা রুদ্রদেব আমাদের সেই সকল শত্রুকে আমাদের সৎকর্ম-রূপ আয়ুধের দ্বারা বিনাশ (সংহার) করুন ৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটির ভাব-পরিগ্রহ করা একটু আয়াস-সাপেক্ষ। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ অধ্যাহার করেছেন, তাতে জ্ঞাতি সজাতি সমবলসম্পন্ন মানুষ-শত্রুর উপদ্রব-নিবারণে এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে বলে বোঝা যায়। ভাষ্যের অর্থে প্রকাশ,আমাদের যে জ্ঞাতিশত্ৰু অধিক বলসম্পন্ন হয়ে, আমাদের ক্ষেত্ৰ-ধন ইত্যাদি অপহরণে আমাদের পীড়ন করছে, হে দেব! আপনি সেই সকল শত্রুর বিনাশ সাধন করুন। আমাদের সম্ভাব্য যে সব শত্রু, আমাদের সমানজন্মা সমবল সজাতি যে সব শত্রু এবং অপরাপর হীনবল যে সব শত্রু আমাদের প্রতি নানারকম উপদ্রব করছে, আমাদের সেই সব শত্রুকে, নানা আয়ুধ-সহকারে নিহত করুন। আমাদের ব্যাখ্যা ভিন্ন পদ অবলম্বন করেছে। যেমন,-মন্ত্রের অন্তর্গত স্বঃ পদের ভাষ্যকার অর্থ করেছেন,–জ্ঞাতিঃ। আমরা অর্থ করেছি,–আত্মসম্বন্ধী অন্তঃশত্রুঃ যদ্বা অস্মাকং হাদিস্থিতঃ রিপুশত্রুঃ। সজাতঃ পদের অর্থে ভাষ্যকার লিখেছেন–সমানজন্মা সমবলঃ জ্ঞাতি অরাতির্বা। আমরা ঐ পদের অর্থ অধ্যাহার করলাম–জন্মসহজাতঃ অসৎ বৃত্তিনিচয়ঃ ভাষ্যকারের অর্থকে অনুসরণ করলে মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্বের–জ্ঞাতি সজাতির সাথে বিবাদ বিসম্বাদের ভাব আসে। কিন্তু, বেদমন্ত্র যে পারিবারিক দ্বন্দ্বকলহের বা জ্ঞাতিনাশের বিষয় বর্ণনা করেননি, তা বেশ উপলব্ধ হয়। বেদমন্ত্রসমূহ উচ্চশিক্ষামূলক; তাতে ইহলৌকিক অনিত্য-সম্বন্ধের বিষয় প্রকটিত হয়নি। ইত্যাদি ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ যঃ সপত্নে যোহসপত্নে যশ্চ দ্বিষপাতি নঃ। দেবাস্তং সর্বে ধূর্বন্তু ব্ৰহ্ম বর্ম মমান্তরং ৪

বঙ্গানুবাদ –আমাদের অন্তরস্থিত যে শত্ৰু, আমাদের কর্মের দ্বারা সঞ্জাত যে শত্রু এবং যে শত্রু আমাদের প্রতি দ্বেষপরায়ণ হয়ে আমাদের অভিসম্পাত করে (বাক্য ইত্যাদির দ্বারা আমাদের অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হয়); সেই সকল শত্রুকে আমাদের দেবভাবসমূহ (পরম ঐশ্বর্যশালী দেবগণ) বিনাশ করুন; আর, আমার প্রযুজ্যমান মন্ত্রজাল ব্যবধায়ক বৰ্মস্বরূপ বিদ্যমান থাকুক। (অর্থাৎ, : মন্ত্ররূপ বর্মের দ্বারা যেন আমরা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হই)। ৪৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— ভাষ্যে এই মন্ত্রের সপত্নঃ পদে জ্ঞাতিরূপ শত্রু এবং অসপত্ন পদে জ্ঞাতিব্যতিরিক্তঃ শত্রু অর্থ গৃহীত হয়েছে। এই দুরকম শত্রু; আর এক রকম শত্রু–যারা হিংসা করে আমাদের গালি দেয়। এই তিন রকম শত্রুকে, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ এসে বধ করুন; আর, আমাদের উচ্চারিত মন্ত্র আমাদের বর্ম-স্বরূপ হয়ে শত্রুর ও আমাদের মধ্যে ব্যবধান রক্ষা করুক। ভাষ্যানুসারে মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত। প্রত্নতত্ত্বের দিক থেকে আবার বলা যায়, আর্যগণ যখন এদেশে আসেন (আমরা অবশ্য তা স্বীকার করি না); তখন এ দেশের লোকের মধ্যে দুটি দল হয়। একদল আর্যগণের পক্ষ অবলম্বন করেন; আর এক দল, তাদের প্রতিযোগী হন। সেই প্রতিযোগী দলের মধ্যে, অনেকে অনেকের জ্ঞাতিশত্রু ছিলেন, অনেকে আবার বাহিরের শত্রু ছিলেন। অনেকে নিকটে এসে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধবিগ্রহে প্রবৃত্ত হতেন না; তারা দূরে থেকেই নিন্দাবাদে অনিষ্ট-সাধনের চেষ্টা পেতেন। এ পক্ষে প্রার্থনার অর্থ এই যে,-সেই ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ এসে, ঐ তিনরকম শত্রুকে বধ করুন; আর মন্ত্র, আমাদের বর্মরূপে রক্ষা করুক। দেবাসুরের সংগ্রাম এবং আর্য-অনার্যের যুদ্ধের সাথে এই মন্ত্রের সংশ্রব রাখতে গেলে, মন্ত্রে এইরকম অর্থই–এইরকম ভাবই নিষ্কাশন করা যায়। কিন্তু সকল মন্ত্রের সাথে এই সূক্তের মন্ত্র-কয়েকটির সামঞ্জস্য রাখতে হলে, এবং আধ্যাত্মিক জগতের সাথে এই সকল মন্ত্রের সম্বন্ধ আছে বুঝতে পারলে আমরা যে পথে যে ভাবে অর্থ নিষ্কাশন করছি, তার যৌক্তিকতা উপলব্ধ হবে। আমরা মনে করি, হৃদয়-ক্ষেত্রে অহরহ যে সংগ্রাম চলেছে, এখানে সেই সংগ্রামের বিষয়ই প্রখ্যাত আছে। কতকগুলি শত্রু আমাদের অন্তরের মধ্যে আমাদের জন্মসহচর হয়ে আছে। আর কতকগুলি শত্রুকে আমরা আমাদের কর্মের দ্বারা আহ্বান করে আনি। সেই দুরকম শত্রুকে সপঃ ও অসপত্নঃ আখ্যায় আখ্যাত করা হয়েছে। একরকম শত্রু সঙ্গে সঙ্গেই থাকে (অন্তঃশত্রু); তাই সপত্নঃ। অন্য শত্রুকে আমরা আমাদের কর্মের দ্বারা আহ্বান করে আনি (বহিঃশত্রু); তাই সে বিপত্নঃ। তা ছাড়া, তৃতীয় যে শত্রুতারা অলক্ষ্যে থাকে; কিন্তু আমাদের অনিষ্ট সাধন করে। সে শত্রুকেও কর্মজ শত্রু বলা যেতে পারে। এমন অনেক অপকর্ম আছে, আমাদের অজ্ঞাতে সাধিত হয়। সে সকল কর্মের ফলাফল আমরা বুঝতে পারি না, বোঝবার চেষ্টাও করি না; অথচ সে সকল কর্ম সম্পাদন করে থাকি। এখানে সেই সকল কর্ম-কৃত শত্রুকে লক্ষ্য করা যায়। উপসংহারে-মন্ত্রে বলা হয়েছে, দেবগণ তিনপ্রকার শত্রুকে নাশ করুন। আমরা মনে করি, এখানকার প্রার্থনার মর্ম এই যে,-হে ভগবন্! আমরা যেন আমাদের দেবভাবসমূহের দ্বারা তিন প্রকারে উৎপন্ন তিন প্রকার শত্রুকে সংহার করতে পারি। দেবভাবে–সত্ত্বভাবে সকল অসৎ-ভাব দূর হয়। আমাতে সেই দেবভাবসমূহ–সত্ত্বভাবসমূহ আসুক, আর তার প্রভাবে শত্রু বিমর্দিত হোক। এটাই প্রার্থনার ভাব।-মন্ত্র আমার বর্ম হোক–এই বাক্যের মর্ম এই যে,-মন্ত্রের অনুধ্যানে আমি যেন নিমগ্ন থাকি। তাহলে অসৎ-ভাব আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মন্ত্রে হৃদয়ে সত্ত্বভাব আনয়ন করে; অসৎ-ভাবকে দূর করে দেয়। তাই মন্ত্রকে বর্মরূপে গ্রহণের কথা বলা হলো। ৪।

.

চতুর্থ সূক্ত : শত্রুনিবারণম

 [ঋষি : অথর্বা দেবতা : সো, মরুত, মিত্রাবরুণ, বরুণ, ইন্দ্র ছন্দ : অনুষ্টুপ, ত্রিষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ অদারদ ভবতু দেব সোমাস্মিন্ যজ্ঞে মরুতে মৃড়তা নঃ।মা নো বিদদভিভা মো অশস্তিমা নো। বিদদ বৃজিনা দ্বেষ্যা যা ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –হে দ্যোতমান শুদ্ধসত্ত্বপোষক দেব! আমাদের শত্রু স্বস্থান-চ্যুত হোক; (আপনার কৃপায় আমাদের হৃদয় হতে অন্তর্হিত হোক)। হে বিবেকরূপী মরুৎ-দেবগণ! আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মে (হৃদয়ের সৎ-বৃত্তির দ্বন্দ্বে) আমাদের ইষ্টফল প্রদান করুন; (জয়যুক্ত করে সুখী করুন); অপিচ, আমাদের অভিমুখে আগমনকারী শত্রুর তেজঃ যেন আমাদের অভিভূত করতে না পারে; আমাদের অকীর্তিরূপ-শত্রু যেন আমাদের প্রাপ্ত না হয়; (অপিচ) হিংসা ইত্যাদি পাপসম্বন্ধযুত আমাদের অভীষ্টফলনাশক যে সকল শত্রু আছে, তারা যেন আমাদের অভিভূত করতে না পারে। (অর্থাৎ, আমরা যেন আমাদের কর্মের দ্বারা সৎ-ভাব-সহযুত হয়ে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হই) ১। 

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সূক্তের মন্ত্রগুলিও শত্রুসমরে বিজয়লাভ-মূলক। শক্তসংগ্রামে বিজয়লাভের জন্য এই সূক্তের মন্ত্র-সমূহে নানা প্রার্থনার দ্যোতনা হয়েছে। মন্ত্রের আমরা যে ব্যাখ্যা করেছি, তা প্রায়ই ভাষ্যের অনুসারী হয়েছে। মন্ত্রটিকে আমরা চার ভাগে ভাগ করেছি। প্রথম অংশে শুদ্ধসত্ত্বের পোষক জ্ঞানদেবতার নিকট হৃদয়ের শত্রুসমূহকে–অজ্ঞানতা ও তার সহচর কামনা-বাসনা ইত্যাদি রিপুশত্রুগুলিকে বিনাশ করবার প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। হৃদয়ের শক্রসমূহই ইহলোকে পরলোকে বিষম অনিষ্টের সূত্রপাত করে।…মন্ত্রের প্রথমাংশে তাই অজ্ঞানতা রূপ শনাশে হৃদয়ের নির্মলতাসাধনের বিষয়ে দেবতার নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে।মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে, সৎকর্মের ফলে সৎস্বরূপের সামীপ্যলাভের প্রার্থনা প্রকটিত। ঐ অংশে দুরকম ভাব উপলব্ধ হয়। বিবেকরূপী মরুৎ-দেবতার নিকট শত্রুসমরে বিজয়-লাভের প্রার্থনা এবং সৎকর্মের ফলে পরাগতি মুক্তিলাভের কামনা প্রকাশ পেয়েছে। হৃদয়ে অহরহ সৎ-অসৎবৃত্তির দ্বন্দ্ব চলেছে। সেই দ্বন্দ্বে জয়লাভের বা অসৎ-বৃত্তি-নাশের প্রার্থনা অথবা সঙ্কর্মের ফলে সৎ-স্বরূপের সামীপ্যলাভের কামনা দ্যোতিত হচ্ছে। মন্ত্রের শেষ তিন অংশে সর্বশত্ৰু-সংহারের প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথম–অভিভাঃ অর্থাৎ, দীপ্তির দ্বারা অভিভবকারী যে শত্রু। পার্থিব সুখ-ঐশ্বর্যের দীপ্তি মোহকর। কামনা বাসনা ইত্যাদিই তার জনয়িতা। পার্থিব ধনরত্নের লাভের আশায় আমরা মোহগ্রস্ত না হই, কামনা-বাসনা ইত্যাদিরূপ শত্রু এসে আমাদের মোহনীয় লোভনীয় সামগ্রীর দীপ্তির দ্বারা অভিভূত না করে, এ স্থলে সেই প্রার্থনা সূচিত হয়েছে। দ্বিতীয়-অকীর্তি-রূপ শত্রু। আমরা যেন এমন কর্মে লিপ্ত না হই, যাতে আমাদের প্রাক্তন নষ্ট না হয়, যাতে আমাদের সৎকার্যের সুযশ লোপ প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ,-আমরা যেন সৎকার্যের শোভন কার্যের অনুষ্ঠানে অনুপ্রাণিত হই। আমরা যেন সৎ-আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, আর সংসার যেন সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। তৃতীয়–পাপ-রূপ শত্রু। পাপ-কর্ম–অসৎ-কর্ম-মানুষের সকল সন্তাপের জনক। পাপেই সংসার ভস্মীভূত হয়;-পাপই মানুষকে নিরয়গামী করে। সেই পাপ-রূপ শত্রুকে বিনাশ করবার জন্য দেবতার নিকট প্রার্থনা জানানো হয়েছে। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্র: যো অদ্য সেন্যো বধোহঘায়ুনামুদীরতে। যুবং তং মিত্রাবরুণাবস্ম্যাবয়তং পরি ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ— ইদানীং (কর্মপ্রারম্ভে) সহচর হিংসা ইত্যাদি পাপশত্রুগণের হননসাধক যে আয়ুধ-জাল আমাদের অভিমুখে নিপতিত হয়, হে সখ্যকারুণ্য-রূপী দেব! আপনারা আমাদের সেই হতে সেই সকল আয়ুধ বিযুক্ত করুন; (শত্রুর আয়ুধ আমাদের যাতে স্পর্শ করতে না পারে, হে দেবদ্বয়! আপনারা তার বিধান করুন)। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রটি শত্ৰু-শর প্রতিষেধক। সাধারণতঃ মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দের বিষয়ই প্রথম দৃষ্টিতে মন্ত্রে উপলব্ধ হয়। যুদ্ধ-জয়-ব্যাপারে মন্ত্রের প্রয়োগ আছে, লক্ষ্য করে, ভাষ্যকার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান ত্রিকালের শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবার উদ্দেশ্যে মন্ত্রের প্রয়োগ সিদ্ধান্ত করেছেন। আমরা সে হিসাবে মন্ত্রের ভাব পরিগ্রহ করিনি। আমাদের মতে, এ মন্ত্রে আধ্যাত্মিক সংগ্রামের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। মন্ত্রে শত্ৰুকৃত বধ নিবারণের প্রার্থনা আছে। এখানে শত্রু বলতে অজ্ঞানতাকে বোঝাচ্ছে। কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অজ্ঞানতার সহচর; হিংসা, পাপ, প্রলোভন এবং কামনা-বাসনা প্রভৃতি তাদের অস্ত্রপর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। শত্রুর অস্ত্র ইত্যাদি অর্থাৎ কামনা-বাসনা ইত্যাদি বা প্রলোভন প্রভৃতি যেন আমাদের স্পর্শ করতে না পারে, তাদের আয়ুধ-প্রহারে আমরা যেন বিচ্ছিন্ন না হই, তাদের ভয়ে আমরা যেন সৎপথ-ভ্রষ্ট না হই। মন্ত্রে এই প্রার্থনার ভাব সূচিত হয়েছে।-হে ভগবন্! আমাদের সকর্মের প্রভাবে আমরা যেন সকল অসৎ-ভাব দূর করতে সমর্থ হই। হে ভগবন! আমাদের সেই কর্ম-শক্তি প্রদান করো; আমাদের সেই জ্ঞান দান করো; তোমার জ্ঞানে তোমার স্বরূপ বুঝে যেন তোমার সাথে সম্মিলিত হই। হে ভগবন! আমাদের সকল সন্তাপ দূরে যাক।-মন্ত্রে এইরকম প্রার্থনার ভাবই প্রকাশ করে। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ ইতশ্চ যদমুতশ্চ যদ বধং বরুণ যাবয়। বি মহচ্ছর্ম যচ্ছ বরীয়ো যাবয়া বধং ॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ –স্নেহকারুণ্যবর্ষণকারী হে বরুণদেব! আমাদের নিকটবর্তী শত্রুর (হৃদয়ে বিদ্যমান অন্তঃশত্রুর) এবং আমাদের দূরবর্তী (কর্মের দ্বারা সঞ্জাত) শত্রুর যে হনন-সাধন আয়ুধ আমাদের প্রাপ্ত হয় (অর্থাৎ আমাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়) সেই সমুদায় আয়ুধকে আপনি আমাদের হতে বিযুক্ত করুন (শত্রুর সেই সকল অস্ত্র যেন আমাদের স্পর্শ করতে না পারে)। অপিচ, হে দেব! আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ সুখ (আশ্রয়) প্রদান করুন; এবং দুস্পরিহর অস্ত্র-শস্ত্রাদি (আমাদের হতে) বিযুক্ত করুন অর্থাৎ দূরে নিক্ষেপ করুন ৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এ মন্ত্রে স্নেহকরুণাধার ভগবানের বরুণরূপী বিভূতির নিকট শত্রুনাশের প্রার্থনা জানানো হয়েছে। লৌকিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রার্থনা জানানো যেতে পারে। যে সকল শত্রু নিকটে বর্তমান অর্থাৎ জ্ঞাতি প্রতিবেশী প্রভৃতির যে শত্রুতাচরণ, আর যে সকল শত্রু দূরে দৃশ্যমান অর্থাৎ ভিন্ন দেশীয় শত্রু–উভয়রকম শত্রুর আক্রমণ হতে নিমূক্ত করবার আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে। এ হিসাবে, ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে কেউ কেউ আর্য-অনার্যের যুদ্ধের সম্বন্ধও খ্যাপন করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। যাই হোক, লৌকিক হিসাবেও মন্ত্রে যে উচ্চভাবের সূচনা হতে পারে, এস্থলে তার বিবৃতি করছি। নিকটে P অবস্থিত এবং দূরে অবস্থিত শত্রুর আক্রমণ হতে বিযুক্ত করবার প্রার্থনায় এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে যে, হে ভগবন্! আমাদের এমন আদর্শ-কর্মী করো, যেন আমাদের প্রতিবেশী বা জ্ঞাতি অথবা ভিন্ন দেশবাসী বা গ্রামবাসী কেউই আমাদের সাথে শত্রুতাচরণে সমর্থ না হয়। অর্থাৎ আমাদের কর্মগুণে যেন আমরা সকলকেই আপন করে নিতে পারি। সকলেই যেন আমাদের ব্যবহারে ও পরিচর্যায় পরিতুষ্ট হয়ে আমাদের মিত্রের মধ্যে পরিগণিত হয়। আমরা যেন এমনই উদারচেতা–এমনই লোকপ্রিয় হই, যেন এ পৃথিবীর সকলকেই স্বজাতি-স্বজন বলে মনে করতে পারি। লৌকিক হিসাবে, এ অর্থও সঙ্গত হতে পারে। আধ্যাত্মিক হিসাবে, সন্নিহিত শত্ৰু-ইতশ্চ পদে, হৃদয়ের অন্তঃশত্রুসমূহকে বুঝিয়ে থাকে; আর দূরবর্তী শত্রু–অমূতঃ পদে, আমাদের কর্মের দ্বারা সঞ্জাত পাপ ইত্যাদি শত্রুকে বোঝায়। সময় সময় আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারে এমন সকল কর্মের অনুষ্ঠান করি, যার দ্বারা পাপ সঞ্চিত হয়ে যায়। কর্ম যদি সত্ত্ব-সহযুত হয়, তাহলে আর সে আশঙ্কা থাকে না। তাহলে অমূতঃ রূপ শত্রুর আক্রমণের বিভীষিকা দূরে পলায়ন করে। শত্রুর আয়ুধ অর্থে প্রলোভন ও কামনা-বাসনা ইত্যাদি-রূপ তাদের অস্ত্র-শস্ত্রাদি। নিকটস্থিত ও দূরস্থিত শত্রুর আয়ুধ আমাদের হতে বিযুক্ত করুন। এই প্রার্থনার মর্ম এই যে,-হিংসা, প্রলোভন, পাপ-কর্ম, কাম, ক্রোধ প্রভৃতি যেন আমাদের মধ্যে কার্যকারী না হয়। অর্থাৎ, আমরা যেন সর্বতোভাবে হিংসা প্রভৃতি পরিশূন্য হই, শত্রুর প্রলোভন ইত্যাদি যেন আমাদের বিপথগামী করতে সমর্থ না হয়, মায়ামোহ-হিংসা-দ্বেষ ইত্যাদি যেন আমাদের অভিভূত করতে না পারে। ফলতঃ, সর্বতোভাবে আমাদের হৃদয় নির্মল হোক, কাম ক্রোধ ইত্যাদি দূরীভূত হোক।-মন্ত্রে শত্রু-সংহারে অনিষ্ট-নিবৃত্তিতে, ইষ্ট অর্থাৎ মোক্ষলাভের প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। দেবতার কাছে প্রার্থনা জানানো হয়েছে–আমাদের শ্রেষ্ঠ সুখ বা আশ্রয় দান করুন। পরমাত্মায় আত্মলীন হওয়া অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সুখ আর কি থাকতে পারে? ভগবানের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আশ্রয়ই বা আর কি আছে?–ভক্ত সাধক কাতরকণ্ঠে ডেকে বলছেন–হে দেব! আপনি সুপ্রসন্ন হোন। শত্রুর আক্রমণে জরজর হচ্ছি; আপনি সে সকল শত্রু নির্মূল করে দিন। আমি আপনার শরণ গ্রহণ করছি–আত্মনিবেদন করছি। ক্ষুদ্র হৃদয়-সিংহাসন পেতে রেখেছি। ভক্তি-পুস্পাঞ্জলী প্রস্তুত রয়েছে। আসুন, গ্রহণ করুন। আমি পরমাশ্রয় প্রাপ্ত হই।–এই তো তাতে আত্মলীন হবার প্রার্থনা ৷ ৩৷

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ শাস ইত্থা মহা অস্যমিত্ৰসাহো অস্তৃতঃ। ন যস্য হন্যতে সখা ন জীয়তে কদাচন। ৪।

বঙ্গানুবাদ –হে দেব! হিংসারহিত আপনি শত্রুগণ কর্তৃক অহিংসিত, শত্রুগণের সংহার-কর্তা, বিশ্বের নিয়ন্তা এবং মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণোপেত সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর্যশালী হন; এই হেতু দেবতার (আপনার) শরণাগত (মিত্রভূত) জনকে শত্রুগণ হিংসা করতে পারে না, এবং শত্রু কর্তৃক কখনও সে জন পরজিত হয় না।, ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –সূক্তের উপসংহারে এই মন্ত্রে অতি উচ্চভাব প্রকটিত। মন্ত্রে ভগবানের শরণ নেওয়ার উপদেশ আছে। নানা গুণ-বিশেষণের অবতারণা করে বলা হয়েছে,–ভগবানের শরণাগত ব্যক্তি কখনও শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয় না ইত্যাদি। এতে সংসারের সকল প্রাণীকেই তার শরণাপন্ন হওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। বক্ষ্যমান মন্ত্রে সাধক আপন মনকে ভগবানের শরণাপন্ন হবার জন্য উদ্বোধিত করছেন। ভগবান বিশ্বনিয়ন্তা; তিনি বিশ্বের হিতে রত। তিনি কেবল বিশ্বপালক নন; তিনি আবার পর শত্রু-সংহারক। অন্তঃশত্রুর ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে মানুষ সর্বদা বিব্রত। ভগবানকে শত্রুনাশক জেনে, শত্রুনাশের কামনায় তার দিকে মানুষের মনকে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা এখানে বিদ্যমান দেখি। সুখশান্তিহারা হয়ে, আধিব্যাধিশোকতাপে জর্জরিত হয়ে, মানুষ যতই আর্তনাদ করছে, করুণার সাগর দয়াল ভগবান্ ততই অভয় দিয়ে ডেকে ডেকে বলছেন,-কেন ভয় পাও; আমার দিকে অগ্রসর হও; মামেকং শরণং ব্রজ। তোমার সকল সন্তাপ দূরে যাবে; তোমার সকল দুঃখ-সকল অশান্তি তিরোহিত হবে।–মন্ত্রে ইন্দ্রদেব অতঃ বলে বিশেষিত হয়েছেন। তিনি অস্তৃতঃ অর্থাৎ হিংসা ইত্যাদি বিরহিত; পরন্তু তিনি শত্রুদেরও অহিংসিত। এর তাৎপর্য এই যে, তাঁকে কেউ রক্ষা করে না; তিনি স্বয়ংই স্বয়ংকে রক্ষা করে থাকেন। পরন্তু তিনি স্থাবর-জঙ্গম-চরাচর সকলই ধারণ করে আছেন ও রক্ষা করছেন। তার ন্যায় শ্রেষ্ঠ আর কে আছে? পার্থিব বন্ধুত্ব জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হয়। কিন্তু মরণের পরও যার সাথে বন্ধুত্ব চিরবিদ্যমান থাকে, তিনিই তো প্রকৃত শ্রেষ্ঠ বন্ধু। ইহলোকের বন্ধুত্ব অবস্থা-বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হয়। কিন্তু সৎস্বরূপের সাথে সখিত্ব মরণের পরও বর্তমান থাকে। তার সাথে সখিত্ব স্থাপনে সমর্থ হলে, তার আর অবসান হয় না। ভাষ্যের ব্যাখ্যায় প্রকাশ–এই মন্ত্রটি ইন্দ্রদেবতার সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে। মন্ত্রের মধ্যে ইন্দ্রের সম্বোধনমূলক কোন পদ দৃষ্ট হয় না। মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার দশম মণ্ডলের ১৫২ সূক্তের প্রথম ঋক। মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, তা এই,-আমি শাস এইভাবে ইন্দ্রকে স্তব করছি।–হে ইন্দ্র! তুমি মহৎ, শভক্ষণকারী ও আশ্চর্য, তোমার সখার মৃত্যু নেই, তার কখনও পরাজয় হয় না। মন্ত্রে শাসঃ পদ আছে। সম্ভবতঃ তা হতেই ব্যাখ্যাকার শাস নামক ব্যক্তিবিশেষের কল্পনা করেছেন। ভাষ্যকার সে অর্থ গ্রহণ করেননি। এমন ব্যখ্যায় মন্ত্রের ভাব-পরিগ্রহ করা সুকঠিন। ভাষ্যেও এমন অর্থ গৃহীত হয়নি। ৪।

.

পঞ্চম সূক্ত : শত্রুনিবারণম

[ঋষি : অথর্বা দেবতা : ইন্দ্র ছন্দ : অনুষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ স্বস্তিদা বিশাং পতিবৃত্ৰহা বিমৃধো বশী। বৃষে পুর এতু নঃ সোমপা অভয়ঙ্করঃ ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –পরমার্থপ্রদাতা (শাশ্বতফলবিধায়ক) নিখিল প্রজাপালক (বিশ্বপালক) বৃহন্তা (অজ্ঞানতানাশক), শত্ৰুবিমর্ক, নিখিল প্রাণিগণের অধিপতি, অভীষ্টবষক, শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণকারী ইন্দ্রদেব (ভগবান), অভয়প্রদ হয়ে, আমাদের পুরোভাগে (হৃদয়ে) আগমন করুন (অধিষ্ঠিত হোন) ১

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সূক্তের মন্ত্র চারটিও শত্রুদমনে সংগ্রাম ইত্যাদি কর্মে বিজয়শ্রী লাভ করবার জন্য প্রযুক্ত বলে সূক্তানুক্রমণিকায় উক্ত হয়েছে। (স্বস্তিদাঃ ইত্যস্য অপরাজিতগণে পাঠাৎ সাংগ্রামিকাদিকর্মসু গণপ্ৰযুক্তো বিনিয়োগ উক্ত৷৷…)। গ্রাম ইত্যাদিতে গমনের সময়ে স্বস্ত্যয়ন ইত্যাদিতে এই সূক্তের মন্ত্র পাঠ করে প্রথমে দক্ষিণ পদক্ষেপণ, শর্করাতৃণপ্রক্ষেপণ এবং ইন্দ্ৰোপস্থান প্রভৃতি করতে হয়। 2 পিশাচ ইত্যাদি নিবারণ কার্যে, উদ্বেগ-বিনাশনে এবং বেদিনির্মাণকার্যে এই সূক্তোক্ত মন্ত্রগুলি জপ করবার বিধি আছে। এই সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় ব্রাহ্মণান্তরে বিবৃত আছে। আলোচ্য মন্ত্রটি–ঋগ্বেদ-সংহিতার দশম মণ্ডলের ১৫২ সূক্তের দ্বিতীয় ঋক। মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা সাধারণতঃ প্রচলিত আছে প্রথমে তার একটি প্রকাশ করছি; যথা,–যিনি কল্যাণ দান করেন, যিনি প্রজাবর্গের অধিপতি, বৃত্রের বিনাশকর্তা, যুদ্ধে বৃত, শত্রুকে বশ করেন, বৃষ্টি বর্ষণ করেন, সোম পান করেন, অভয় দান করেন, সেই ইন্দ্র আমাদের সমক্ষে আগমন করুন।ভাষ্যের ভাব একটু স্বতন্ত্র। আমরা উপরোক্ত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এটুকুই বলতে পারি যে, কেবলমাত্র সাধারণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে অন্য অর্থ গৃহীত হয়। মন্ত্রে ভগবানের যে সকল বিশেষণ পদ দৃষ্ট হয়, তার বিশ্লেষণ করলেই মন্ত্রের ভাব উপলব্ধ হতে পারবে। তাতে বোঝা যাবে–ইন্দ্র নামে সেই অনাদি অনন্তকে লক্ষ্য করা হয়েছে। প্রথম বিশেষণ পদ–স্বস্তিদাঃ। অবিনাশী নাম-সমূহের মধ্যে স্বস্তি পদ উল্লিখিত হয়।–অবিনাশী-শাশ্বত সুখ–মোক্ষ বা মুক্তি ভিন্ন আর কি হতে পারে? আর, এই মোক্ষ বা মুক্তি ভগবান্ ব্যতীত আর কে-ই বা দিতে পারে? ভগবাকে স্বস্তিদাঃ বিশেষণে বিশেষিত করায় তার নিকট পরম সুখ প্রাপ্তির–চিরশান্তি-লাভের প্রার্থনা জানানো হয়েছে। ইন্দ্রদেবের আর একটি বিশেষণ–বৃত্ৰহা। সায়ণের মতে ঐ পদের অর্থ–বৃত্ৰো নাম জলাধার-ভূতো মেঘঃ।… অর্থাৎ বৃষ্টির জন্য জলের আধারভূত বৃত্র নামক মেঘকে হনন করেন বলে তার নাম–বৃহ; অথবা ধৃষ্টার উৎপাদিত বৃত্র নামক অসুরকে হনন করেন বলে তাঁর নাম বৃত্ৰহা। আমরা ঐ পদের অর্থ করেছি–অজ্ঞানতাবিনাশকঃ। বৃত্র পদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেই যত কিছু মতান্তরের সৃষ্টি। নিরুওকার যাস্ক আধ্যাত্নিক ও আধিদৈবিক অর্থ ভেদে তার দুরকম অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন। আধিদৈবিক অর্থে অর্থাৎ ভাষ্যকারের প্রথম অর্থ অনুসারে, ঐ পদের যে অর্থ নিষ্পন্ন হয়, তা এই-ইন্দ্র শব্দে সূর্য বোঝায়। বৃবৃ ধাতু হতে উৎপন্ন। তার অর্থ–আবরণ। সে হিসাবে, বৃত্র অর্থে-সূর্যের আবরক মেঘকে বুঝিয়ে থাকে। সূর্যের রশ্মি-সম্পাতে, উত্তাপে, পৃথিবী নবজীবন লাভ করে; তাতে বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু-সমূহ জীবন প্রাপ্ত হয়। বৃত্র অর্থাৎ মেঘ সূর্যকে আবৃত করলে পৃথিবীতে তার রশ্মির গতিরোধ হয়। এইভাবে, আলোকের জনয়িতা ইন্দ্রের বা সূর্যের সাথে অন্ধকারের উৎপাদক বৃত্রের বা মেঘের দ্বন্দ্ব চলে থাকে। বৃত্র জয়লাভ করলে পৃথিবী অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হয়,–সূর্যদেব (ইন্দ্র) অদৃশ্য হয়ে পড়েন। তাতে সংসারে বিষম অনর্থের সূত্রপাত হয়, কিন্তু ইন্দ্রের পরাক্রম অপরিসীম। ইন্দ্রের প্রখর প্রভাবের নিকট বৃত্র তিষ্ঠিতে পারে না। তখন বৃত্র নিহত হয় অর্থাৎ মেঘ বিগলিত হয়ে জলরূপে ধরাতলে নিপতিত হয়ে থাকে; ইন্দ্রের জ্যোতিঃ পূর্ণরূপে প্রকটিত হয়ে পড়ে। সাধারণ দৃষ্টিতে বৃত্র ও ইন্দ্রের যুদ্ধের বিষয় এই ভাবেই পরিগৃহীত হয়ে থাকে। ইত্যাদি। ভাষ্যকারের নিষ্পন্ন বৃত্রহা পদের দ্বিতীয় অর্থ অনুসারে পৌরাণিক উপাখ্যানের প্রতি লক্ষ্য পড়ে। কিন্তু সে উপাখ্যানেও নানা মতান্তর দেখা যায়। কোনও পুরাণে বৃত্রাসুর ত্বষ্টার পুত্র, কোনও পুরাণে বৃত্রাসুর গয়াসুরের পুত্র–এইরকম উল্লেখ আছে। যাই হোক, দধীচির অস্থি-নির্মিত বজের দ্বারা ইন্দ্র বৃত্রকে নিহত করেন,–এ সম্বন্ধে প্রায়ই মতান্তর নেই।–আমরা বৃত্ৰহা পদের যে অর্থ পরিগ্রহণ করেছি, তা আধ্যাত্মিকতা-মূলক–নিরুক্তকার যাস্কের মতের অনুসারী।–মেঘ যেমন সূর্যরশ্মি আবৃত করে সংসারকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলে, অজ্ঞানতা-রূপ মেঘও তেমনই মানুষের হৃদয়কে সমাচ্ছন্ন করে মানুষকে সৎ-অসৎ-বিচার-বিমূঢ় করে ফেলে। সূর্যের উদয়ে যেমন মেঘ অপসারিত হয়ে অন্ধকার বিদূরিত হয়; সেইরকম হৃদয়াকাশে জ্ঞান-সূর্যের উদয়েও অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার দূরীভূত হয়ে থাকে।…এ হিসাবে মন্ত্রের ইদ্রঃ পদে সেই প্রজ্ঞানরূপী পরমেশ্বর ব্যতীত আর কাকেই বা বোঝাতে পারে? তিনি আলোকদাতা, তিনি জ্ঞানের, সকল ধর্মের, সকল সত্যের আধার স্থানীয়। সঙ্গেপতঃ, তিনি সৎ–তিনি সংস্বরূপ। বৃত্র তাঁর বিরুদ্ধ-প্রকৃতিসম্পন্ন। বৃত্র–মূর্তিমান অজ্ঞানান্ধকার কুকর্মের জনয়িতা। ইত্যাদি।–এই মন্ত্রে ইন্দ্রদেবের আর কয়েকটি বিশেষণ-বিমৃধঃ, বশী, বৃষ এবং সোমপাঃ। …এই সব বিশেষণের লক্ষ্যই সেই l একমেবাদ্বিতীয় পরমেশ্বর-পরমাত্মা। মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে দেব! আপনার শরণ নিলাম। স্বস্তিদাঃ আপনি; আপনি আমাদের নিত্যসুখ পরমশান্তি প্রদান করুন। বিশাং পতি–বিশ্বের অধিপতি বিশ্বেশ্বর আপনি; বশী-বিশ্বের নিয়ন্তা আপনি … আপনি বৃত্ৰহা–বিমৃধঃ। আপনি আমাদের অজ্ঞানতারূপ শত্রুকে বিনাশ করুন।..ইত্যাদি। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্র : বি ন ইন্দ্ৰ মৃধো জহি নীচা যচ্ছ পৃতন্যতঃ। অধমং গময়া তমো যো অল্ম অভিদাসতি ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ –হে পরমেশ্বর্যশালী দেব! আমাদের মঙ্গলের জন্য সংগ্রামকারী শত্রুদের বিনাশ করুন; (হিংসাপ্রলোভন ইত্যাদিরূপ) শত্রুসৈন্যগণকে নীচ (অবনমিত) করে অভিভূত করুন; অপিচ, যে সকল শত্রু আমাদের হিংসা করতে উদ্যত হচ্ছে, তাদের নিকৃষ্ট মরণাত্মক করুন অর্থাৎ তাদের (সর্বথা) বিনষ্ট করুন। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদ-সংহিতার ১০ম মণ্ডলের ১৫২ সূক্তের চতুর্থ ঋক্‌। এখানে এই মন্ত্রে সেই একই ভাব–একই প্রার্থনা প্রকটিত। এখানেও সেই শত্রুনাশের কামনা–এখানেও সেই পরাগতি মুক্তিলাভের বাসনা।-মন্ত্রের যে বঙ্গানুবাদ প্রচলিত আছে, তা এই,-হে ইন্দ্র! আমাদের শত্রদের বধ করো; যুদ্ধাভিলাষী বিপক্ষদের হীনবল করো। যে আমাদের মন্দ করে, তাকে জঘন্য অন্ধকারে নিমগ্ন করো। এ অর্থে মানুষের সাথে মানুষের বিবাদ-বিসম্বাদের বিষয়ই উপলব্ধ হয়। ভাষ্যকারের অর্থও এ অপেক্ষা অধিক দূর অগ্রসর হয়নি। তিনিও ক্ষেত্র-ধন ইত্যাদি অপহরণকারী শত্রুর বিনাশের বিষয় প্রখ্যাপিত করেছেন। মন্ত্রে তমঃ পদ আছে। সম্ভবতঃ তার প্রতি লক্ষ্য করেই সাধারণভাবে মন্দকারী শত্রুদের অন্ধকারে নিক্ষেপের বিষয় ব্যাখ্যাকার উপলব্ধি করেছেন। ভাষ্যকার কিন্তু সে ভাব গ্রহণ করেননি। তিনি ঐ পদের অর্থ করেছেন–মরণাত্মকং। অর্থাৎ ক্ষেত্ৰ-ধন অপহরণকারী শত্রুগণকে আপনি এমনভাবে শাস্তি প্রদান করুন যাতে তারা আর কুকার্যে (ক্ষেত্ৰ-ধন ইত্যাদি অপহরণে) প্রবৃত্ত হতে না পারে; তাদের এমনই হীনবল এবং মরণাত্মক করুন। এ হিসাবে ইন্দ্রদেবকে একজন দৈববলসম্পন্ন যোদ্ধৃপুরুষ বলেই মনে হয়। লৌকিক হিসাবে মন্ত্রের প্রয়োগ যাই হোক, আধ্যাত্মিক হিসাবে মন্ত্র অন্য অর্থ সূচনা করে। হৃদয়ের যজ্ঞাগারে সৎ-অসৎ বৃত্তির দ্বন্দ্ব অহরহ চলেছে। তাতে কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অজ্ঞানতা-সহচর-সৈন্যসামন্ত, হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদি-রূপ আয়ুধ প্রয়োগ করে যজ্ঞভঙ্গ করবার জন্য উদযুক্ত হয়। সেই সব শত্রু যাতে বিধ্বস্ত হয়, হৃদয়-ক্ষেত্র আক্রমণ করতে না পারে, যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়–দেবতার নিকট সেই প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। ইন্দ্রদেব আর কে? তিনি তো ভগবানেরই প্রজ্ঞানরূপী বিভূতি। হৃদয়ে জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞানতা-সহচর অসৎ-বৃত্তিসমূহ নাশ-প্রাপ্ত হয়, এই ভাবই এখানে পরিব্যক্ত। যিনি ঐহিক চিন্তায় নিরত, যিনি বাহ্য-পূজানুষ্ঠানে একান্ত অনুরক্ত, আধিভৌতিক উপদ্রবে মানুষ-শত্রুর আক্রমণে, তাঁর ঐহিক-সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বিঘ্ন ঘটবে মনে করে, তিনি ইন্দ্রদেবের নিকট ঐহিক সেই সকল শত্রুনাশের প্রার্থনা টু জানাতে পারেন। তার এ প্রার্থনা স্বাভাবিক;–তাতে সুফল লাভেরও আশা আছে। কিন্তু যিনি আধ্যাত্মিক পথের পথিক, যিনি অন্তর্যাজ্ঞিক, তাঁর প্রার্থনা অন্যরূপ; তিনি ঐহিক সুখের কামনা করেন না; ঐহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও তাঁর মন আকৃষ্ট নয়। তাই ইহলৌকিক শত্রুর ভয়ে তিনি ভীত নন; তাই তার প্রার্থনা–ঐহিক–পার্থিব শত্রু নাশের জন্যও নয়; তিনি সেজন্য উৎকণ্ঠিতও নন। ইহসংসারে তাঁর শত্রু থাকতে পারে না। তাঁর ঔদার্যে,, তার বিশ্বজনীন প্রীতির ভাবে সকলেই মুগ্ধ;…তাই তার প্রার্থনা–অন্তঃশনাশের জন্য; তার কামনা জ্ঞান-কিরণ লাভের জন্য।–প্রজ্ঞান-স্বরূপ ভগবানের নিকট মন্ত্রে তিন রকম প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। প্রথমতঃ-হে দেব! আমাদের শ্রেয়েলাভের নিমিত্ত আমাদের সমুদায় শত্রুকে বিনাশ করুন। তার পর সেই সকল শত্রুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমতঃ সংগ্রামে উদ্যোগী শত্রু-হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদি এবং আমাদের অভিভবকারী মায়ামোহ প্রভৃতি শত্রুর বিনাশ-সাধন ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ বি রক্ষো বি মৃধো জহি বি বৃত্রস্য হন্ রুজ। বি মমিন্দ্র বৃহন্নমিত্রস্যাভিদাসতঃ ॥ ৩

বঙ্গানুবাদ— শত্রুনাশক পরমেশ্বর্যশালী হে, দেব! আপনি আমাদের সৎ-ভাববিরোধী (কামক্রোধরূপ) শত্রুগণকে বিশেষভাবে নাশ করুন; (হিংসা প্রলোভন ইত্যাদিরূপ) যুদ্ধেচ্ছু শত্রুদের বিদূরিত করুন; অজ্ঞানতা-রূপ (মায়া-মোহ ইত্যাদি রূপ) শত্রুর অনিষ্ট-সাধন-সামর্থ্য নিবারণ করুন; অপিচ, আমাদের বিনাশে উদ্যত অর্থাৎ সৎকর্মের অনুষ্ঠানে বিঘ্ন-উৎপাদনকারী (কামনা-বাসনা-রূপ) শত্রুর ক্রোধরূপ (পাপসম্বন্ধসূচক) আয়ুধকে বিনষ্ট করুন (অর্থাৎ, মায়ামোহের প্রবল আক্রমণ হতে আমাদের সর্বৰ্থা রক্ষা করুন। ৩।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –প্রথমতঃ মন্ত্রের একটি প্রচলিত অর্থ এস্থলে উদ্ধৃত করছি। মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাকার লিখেছেন,–হে বৃত্রসংহারী ইন্দ্র! রাক্ষসকে ও শত্রুদের বধ করো; বৃর্সের দুই হনু ভেঙ্গে দাও। অনিষ্টকারী বিপক্ষের ক্রোধকে নিষ্ফল করো।ভাষ্যের অনুসরণেই এমন ব্যাখ্যার অবতারণা হয়েছে। যেমন, –ভাষ্যকার হনূ পদে কপালৌ অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন। …আমরা ঐ হ পদের অর্থ মরণসাধকান আয়ুধান অর্থ নিষ্পন্ন করেছি। হনোর্থ হন্ ধাতু হতে হন্ পদ নিষ্পন্ন। সেই মতে, যার দ্বারা হনন করা যায়, তা-ই হন্। অস্ত্রশস্ত্র-আয়ুধ ইত্যাদির দ্বারাই হননকার্য সমাহিত হয়ে থাকে।যাই হোক, মন্ত্রটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আমরা মন্ত্রটিকে চার ভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথম অংশে সৎ-ভাবের বিরোধী কাম-ক্রোধ ইত্যাদি শত্রুর নাশের প্রার্থনা বিজ্ঞাপিত হয়েছে।…দ্বিতীয় অংশে সংগ্রামেচ্ছু শত্রুগণের–হিংসা প্রলোভন ইত্যাদির বিনাশের প্রার্থনা সূচিত।…মন্ত্রের তৃতীয় অংশে হিংসা-দ্বেষ ইত্যাদি প্রবল শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ করবার প্রার্থনা দেখতে পাওয়া যায়। পৌরাণিক আখ্যায়িকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এস্থলে অনেকে ইন্দ্র ও বৃত্রের যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনেন।…আমরা কিন্তু বৃত্রস্য পদে অজ্ঞানস্য, মায়ামোহাদিরূপস্য শত্রাঃ অর্থ অধ্যাহার করেছি।…মন্ত্রের শেষাংশে (চতুর্থাংশে) সৎ-অনুষ্ঠানে বিঘ্ন-উৎপাদনকারী কামনা-বাসনা-রূপ অমিত্রের ক্রোধ অর্থাৎ পাপ-সম্বন্ধ বিনাশের প্রার্থনা প্রখ্যাপিত।.মন্ত্রে এইভাবে একে একে সকল শত্রুনাশের প্রার্থনা সূচিত দেখতে পাই। এই মন্ত্রটিও ঋগ্বেদ-সংহিতার ১০ম মণ্ডলের ১৫২ সূক্তের তৃতীয় ঋক্ ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ অপেন্দ্র দ্বিততা মনোহপ জিজ্যাসতো বধং। বি মহচ্ছর্ম যচ্ছ বরীয়ো যাবয়া বধং ॥ ৪৷৷

 বঙ্গানুবাদ –হে পরমেশ্বর্যশালী দ্যোতনাত্মক দেব! শত্রুর হিংসাপূর্ণ ক্রুর মনকে (পরের অনিষ্ট সাধনের প্রবৃত্তিকে) বিনষ্ট করুন; আমাদের হননেচ্ছু শত্রুর হননসাধন আয়ুধকে অপসৃত করুন; হে দেব! আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ সুখ (আশ্রয়) প্রদান করুন; এবং (শত্রুর) দুস্পরিহর আয়ুধসমূহকে (আমাদের হতে) বিযুক্ত করুন; (অর্থাৎ দূরে নিক্ষেপ করুন)। ৪। মন্ত্ৰার্থ-আলোচনা –যেমন সূক্তের সূচনায়, তেমনই সূক্তের উপসংহারে (অর্থাৎ এই সূক্তে এই শেষ বা চতুর্থ মন্ত্রে) সেই শত্রুনাশে ইষ্টলাভের প্রার্থনা সূচিত হয়েছে। কেবল শত্রুনাশ নয়; পরন্তু তাদের অনিষ্ট-সাধনের প্রবৃত্তি-নাশের প্রার্থনাও এস্থলে, প্রকট দেখি….ঐহিক ধনসম্পদ–ভোগ-বিলাস ইত্যাদি, জীবনে সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হয়। কিন্তু যা জীবনের পরও সুখের হেতুভূত হয়ে থাকে, জ্ঞানীজন সেই ইষ্টফল-লাভেরই কামনা করেন। হৃদয়ের অন্তঃশত্রুনাশে মোফলোভের কামনাই তার একমাত্র প্রার্থনা। তিনি ধন-সম্পদ চান না;-মানুষ-শত্রুর অপেক্ষা য়ে প্রবল শত্রু-কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ প্রভৃতি–তিনি তাদেরই নিধনের বাসনা করেন।…মানুষের রিপুশই তার জন্মগতি-রোধের পথ রুদ্ধ করে দেয়।… এখানকার প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে দেব! শত্রুর আক্রমণে প্রপীড়িত হয়ে তোমার শরণাপন্ন হচ্ছি। তুমি আমাদের মানসক্ষেত্রের শত্রুদের সংহার করে আমাদের ইষ্টফল প্রদান করো। প্রজ্ঞানস্বরূপ তুমি; আমাদের হৃদয়ে জ্ঞান-বহ্নি প্রজ্বলিত করে দাও। কামক্রোধ ইত্যাদি ভস্মীভূত হোক; উষালোকে আঁধারের মতো অজ্ঞানতা বিদূরিত হোক। তোমার আলোকে আলোক-লাভ করে, আমরা তোমাতে লীন হয়ে যাই। আমরা মনে করি, মুক্তিকামী জন এ স্থলে এমনই প্রার্থনা করছেন। ঋগ্বেদ-সংহিতা ১০১৫২৫ ॥ ৪৷৷

সকল অধ্যায়

১. ০০. সম্পাদকের নিবেদন / ভূমিকা
২. ০১।১ প্রথম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৩. ০১।২ প্রথম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৪. ০১।৩ প্রথম কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৫. ০১।৪ প্রথম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৬. ০১।৫ প্রথম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৭. ০১।৬ প্রথম কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
৮. ০২।১ দ্বিতীয় কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৯. ০২।২ দ্বিতীয় কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
১০. ০২।৩ দ্বিতীয় কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
১১. ০২।৪ দ্বিতীয় কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
১২. ০২।৫ দ্বিতীয় কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
১৩. ০২।৬ দ্বিতীয় কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
১৪. ০৩।১ তৃতীয় কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
১৫. ০৩।২ তৃতীয় কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
১৬. ০৩।৩ তৃতীয় কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
১৭. ০৩।৪ তৃতীয় কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
১৮. ০৩।৫ তৃতীয় কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
১৯. ০৩।৬ তৃতীয় কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
২০. ০৪।১ চতুর্থ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
২১. ০৪।২ চতুর্থ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
২২. ০৪।৩ চতুর্থ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
২৩. ০৪।৪ চতুর্থ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
২৪. ০৪।৫ চতুর্থ কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
২৫. ০৪।৬ চতুর্থ কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
২৬. ০৪।৭ চতুর্থ কাণ্ড : সপ্তম অনুবাক
২৭. ০৪।৮ চতুর্থ কাণ্ড : অষ্টম অনুবাক
২৮. ০৫।১ পঞ্চম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
২৯. ০৫।২ পঞ্চম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৩০. ০৫।৩ পঞ্চম কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৩১. ০৫।৪ পঞ্চম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৩২. ০৫।৫ পঞ্চম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৩৩. ০৫।৬ পঞ্চম কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
৩৪. ০৬।০১ ষষ্ঠ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৩৫. ০৬।০২ ষষ্ঠ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৩৬. ০৬।০৩ ষষ্ঠ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৩৭. ০৬।০৪ ষষ্ঠ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৩৮. ০৬।০৫ ষষ্ঠ কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৩৯. ০৬।০৬ ষষ্ঠ কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
৪০. ০৬।০৭ ষষ্ঠ কাণ্ড : সপ্তম অনুবাক
৪১. ০৬।০৮ ষষ্ঠ কাণ্ড : অষ্টম অনুবাক
৪২. ০৬।০৯ ষষ্ঠ কাণ্ড : নবম অনুবাক
৪৩. ০৬।১০ ষষ্ঠ কাণ্ড : দশম অনুবাক
৪৪. ০৬।১১ ষষ্ঠ কাণ্ড : একাদশ অনুবাক
৪৫. ০৬।১২ ষষ্ঠ কাণ্ড : দ্বাদশ অনুবাক
৪৬. ০৬।১৩ ষষ্ঠ কাণ্ড : ত্রয়োদশ অনুবাক
৪৭. ০৭।০১ সপ্তম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৪৮. ০৭।০২ সপ্তম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৪৯. ০৭।০৩ সপ্তম কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৫০. ০৭।০৪ সপ্তম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৫১. ০৭।০৫ সপ্তম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৫২. ০৭।০৬ সপ্তম কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
৫৩. ০৭।০৭ সপ্তম কাণ্ড : সপ্তম অনুবাক
৫৪. ০৭।০৮ সপ্তম কাণ্ড : অষ্টম অনুবাক
৫৫. ০৭।০৯ সপ্তম কাণ্ড : নবম অনুবাক
৫৬. ০৭।১০ সপ্তম কাণ্ড : দশম অনুবাক
৫৭. ০৮।১ অষ্টম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৫৮. ০৮।২ অষ্টম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৫৯. ০৮।৩ অষ্টম কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৬০. ০৮।৪ অষ্টম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৬১. ০৮।৫ অষ্টম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৬২. ০৯।১ নবম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৬৩. ০৯।২ নবম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৬৪. ০৯।৩ নবম কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৬৫. ০৯।৪ নবম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৬৬. ০৯।৫ নবম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৬৭. ১০।১ দশম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৬৮. ১০।২ দশম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৬৯. ১০।৩ দশম কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৭০. ১০।৪ দশম কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৭১. ১০।৫ দশম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৭২. ১১।১ একাদশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৭৩. ১১।২ একাদশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৭৪. ১১।৩ একাদশ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৭৫. ১১।৪ একাদশ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৭৬. ১১।৫ একাদশ কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৭৭. ১২।১ দ্বাদশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৭৮. ১২।২ দ্বাদশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৭৯. ১২।৩ দ্বাদশ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৮০. ১২।৪ দ্বাদশ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৮১. ১২।৫ দ্বাদশ কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
৮২. ১৩।১ ত্রয়োদশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৮৩. ১৩।২ ত্রয়োদশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৮৪. ১৩।৩ ত্রয়োদশ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৮৫. ১৩।৪ ত্রয়োদশ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৮৬. ১৪।১ চতুর্দশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৮৭. ১৪।২ চতুর্দশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৮৮. ১৫।১ পঞ্চদশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৮৯. ১৫।২ পঞ্চদশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৯০. ১৬।১ ষোড়শ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৯১. ১৬।২ ষোড়শ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৯২. ১৭।১ সপ্তদশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৯৩. ১৮।১ অষ্টাদশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৯৪. ১৮।২ অষ্টাদশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৯৫. ১৮।৩ অষ্টাদশ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
৯৬. ১৮।৪ অষ্টাদশ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
৯৭. ১৯।১ ঊনবিংশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
৯৮. ১৯।২ ঊনবিংশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
৯৯. ১৯।৩ ঊনবিংশ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
১০০. ১৯।৪ ঊনবিংশ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
১০১. ১৯।৫ ঊনবিংশ কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
১০২. ১৯।৬ ঊনবিংশ কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
১০৩. ১৯।৭ ঊনবিংশ কাণ্ড : সপ্তম অনুবাক
১০৪. ২০।১ বিংশ কাণ্ড : প্রথম অনুবাক
১০৫. ২০।২ বিংশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক
১০৬. ২০।৩ বিংশ কাণ্ড : তৃতীয় অনুবাক
১০৭. ২০।৪ বিংশ কাণ্ড : চতুর্থ অনুবাক
১০৮. ২০।৫ বিংশ কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক
১০৯. ২০।৬ বিংশ কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক
১১০. ২০।৭ বিংশ কাণ্ড : সপ্তম অনুবাক
১১১. ২০।৮ বিংশ কাণ্ড : অষ্টম অনুবাক
১১২. ২০।৯ বিংশ কাণ্ড : নবম অনুবাক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন