থ্রী সানডেস ইন এ উইক

অ্যাডগার অ্যালান পো

তোমার মনটা পাথরের মতো কঠিন।

তোমার মাথায় ঘিলু বলতে রতিও নেই। তুমি একটানিরেট বোকা, হদ্দ বোকা। তুমি একটা গোয়াড়গোবিন্দ, বদমেজাজি, বস্তাপচা তোমার বুদ্ধি বিবেচনা আর সেকেলে একটা বুড়ো হাবড়া! আমার পরম পুজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্তর সামনে ঘুষি বাগিয়ে কল্পনার মাধ্যমে আমি এ-কথাগুলো উচ্চারণ করলাম।

হ্যাঁ, কল্পনা। কল্পনার মাধ্যমেই আমি কথাগুলো বললাম।

আসল ব্যাপারটা হল, আমি যা-কিছু করতাম আর যা-কিছু করতে ইচ্ছা হত উভয়ের মধ্যে সামান্য হেরফের তো থাকতই থাকত।

আমি বৈঠকখানার দরজা খুলেই দেখতে পেলাম, চুল্লির তাকটার ওপরে পা দুটো তুলে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বুড়ো হাবড়াটা বসে রয়েছে। আর তার হাতে মদ-ভর্তি একটা বোতল।

আমি দরজাটা খুলে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। আস্তে আস্তে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম-পূজনীয় কাকা, তুমি এত বেশি মাত্রায় হৃদয়বান, দয়ার অবতার, সুবিচেক।

তিনি প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন–‘হ্যাঁ, বুঝলাম বাছা, তোমার যা বক্তব্য আছে বল।’

আমি আবার মুখ খুললাম–‘কাকা, আমি নিঃসন্দেহ যে, আমার পূজনীয় কাকা, কেটের সঙ্গে আমার মিলনের ব্যাপারে বাধা দেবার মতো কোনোরকম ইচ্ছা তোমার নেই। তুমি যা-কিছু বলছ তা নিছকই একটা রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। আম নিশ্চিত। আমি জানি, আমি এটা খুব ভালোই জানি। সত্যি বলছি, মাঝে মধ্যে তুমি কী সুন্দর মানুষই না হয়ে ওঠ।

ফিক করে হেসে তিনি ছোট্ট করে বললেন–উচ্ছন্নে যাও তুমি।’ তারপর অপেক্ষাকৃত গলা চড়িয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন–‘অবশ্যই! অবশ্যই। ঠিকই বলেছ বাছা।

আর আমি এ ব্যাপারেও নিঃসন্দেহ যে, আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছিলেন। শুনুন কাকা, সম্প্রতি কেট আর আমার একমাত্র ইচ্ছা–আপনার সুচিন্তিত সারগর্ভ পরামর্শ দান করে আমাদের ধন্য করুন। পরামর্শ বলতে আমি সময়টার কথা বলতে চাইছি। কাকা, আপনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি বলতে চাইছি, সংক্ষেপে ব্যাপারটা হল, আমাদের বিয়েটা কবে, কখন সম্পন্ন হলে আপনার পক্ষে সুবিধা হয়, বুঝতেই তো পারছেন, এ-কথাটা জানার জন্যই আমি এমন ধানাই-পানাই করছি।

‘ওরে হতচ্ছাড়া কোথাকার। তুই কি বলতে চাইছিস, আমার মাথায় আসছে না? তার চেয়ে বরং বল কখন সম্পন্ন হয়ে গেল? বল তো?

‘হ্যাঁ! হা! হো! হো! আ! কী ভালল! কী চমৎকার কথা! কী ভালো কাকাটি আমার! কী বুদ্ধিমানের ঢেকি! কী আমার পরম পূজনীয় কাকা, এখন আমার যা-কিছু জানতে ইচ্ছে করছে, মানে জানতে চাইছি।’

‘কি জানতে চাইছিস, খোলাসা করে বল তো?’ মানে কোন্ সময়ে

‘আমার একটা কথাই জানা দরকার, সঠিক সময়টা মানে কোন্ সময়ে আমাকে বলে দাও।

‘উফ! সঠিক সময়? সঠিক সময়টা জানার জন্য খুবই উতলা হয়ে পড়েছিস, তাই না?’

‘হ্যাঁ, কাকা, সঠিক সময়টা–তবে আপনার যদি এ-ব্যাপারে কোনো ওজর আপত্তি না থাকে।

মুহূর্তের জন্য কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ এঁকে বুড়োভামটা বললেন– একটা কথা–’

তাঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম-এর মধ্যে একটা কথার কি থাকতে পারে।

‘আরে পারে, থাকতে পারে বলেই তো–’

‘ঠিক আছে তোমার সে-একটা কথা বলতে কি বলতে চাইছ, খোলসা করেই বল?

‘কথাটা হচ্ছে, আমি যদি এ ব্যাপারটাকে অনেক দূর টেনে নিয়ে যাই, মানে অনেকটা পিছিয়ে দেই, তবে?

‘আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, অনেক পিছিয়ে দিতে চাইছেন?

‘হ্যাঁ। অনেকটা মানে–মনে কর এক বছর-দুবছর বা ওরকম কোনো একটা সময়ের কথা বলছি।

আমি চোখ দুটো কপালে তুলে সবিস্ময়ে বললাম–এক বছর-দু বছর বা তার চেয়েও বেশি?

‘হ্যাঁ! তবে কি কাজটা সঠিক হবে, বল তো?

‘ইয়ে মানে আপনি যদি তা-ই সঠিক জ্ঞান করেন।

‘ভালো কথা। ঠিক আছে ববি, সোনামণি আমার, বাছা আমার, কী ভালো ছেলেই তুমি! সচরাচর এমন ভালো ছেলে চোখেই পড়ে না। ঠিক বলিনি?’

‘কাকা–‘

আমাকে কথাটা বলতে না দিয়ে আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ কাকাই আবার বলতে লাগলেন–শোন বাছাধন আমার, সঠিক সময়টাই যখন আমার কাছে জানতে চাইছ। তখন আমি মাত্র এই একটাবারের জন্য তোমাকে ধন্য করব, বুঝলে কিছু?

‘আদরের কাকা আমার। লক্ষ্মী কাকা আমার।

আমার কণ্ঠস্বরটাকে চাপা দিয়ে, গলা ছেড়ে বুড়োভাম আমার পূজ্যাস্পদ কাকা এবার বলে উঠলেন–‘চুপ কর বাপধন! চুপ কর! আমি এই একবার মাত্র এই একবার তোমাকে ধন্য করব।’

‘আমার লক্ষ্মী কাকা! সোনামণি কাকা আমার!

‘যা বলছি, মন দিয়ে শোন, তোমাকে আমি সম্মতি দেব। আমার ভোজটা–জেনে রাখ, ভোজের কথাটা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখছি, কি করা যায়।

‘উফ! আবারও ভাববেন!

‘হ্যাঁ, ভাবতে তো হবেই বাছাধন। ব্যাপারটা তো কম জটিল নয়। ভাবনাচিন্তা তো অবশ্যই করা দরকার। আমি কণ্ঠস্বরে কিছুটা উন্মা প্রকাশ করে বললাম–‘বেশ আপনি ভাবুন, সারাটা জীবন ধরে আপনি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন।

‘তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন বাপধন।

‘এটা উত্তেজিত হবার মতো কথা নয়, আপনি বলতে চাইছেন?

‘যাক গে, মাথা ঠাণ্ডা করে শোন, আমি কি বলতে চাইছি। যাক এবার বল তো বিয়েটা কবে হতে পারে?

‘আমিই যদি তা ঠিক করব তবে আর আপনাকে মিছে বিরক্ত করতে যাব কেন, বলতে পার? আজ তো রবিবার ঠিক কি না?

‘হ্যাঁ, আজ রবিবারই বটে।

‘তবে কবে তোর বিয়েটা সেরে দেওয়া যেতে পারে–ঠিক কবে সারা যেতে পারে! বাপধন, আমার কথাগুলো তোর কানে ঢুকছে তো? আমার দিকেনিস্তেজ চোখের মণি দুটো মেলে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে নিয়ে তিনিই আবার বলতে আরম্ভ করলেন– কি হে, অমন বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছিস যে বড়! আমি বলছি–কথা দিচ্ছি, কেটকে তুই নিজের করে পাবি।

‘পাব? আপনি বলছেন, কেটকে আমি পাব।’

‘পাবি। অবশ্যই পাবি বাপধন। শুধু পাবিই না, সে সঙ্গে পেটপুরে ভোজও খাবি।

‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু সেটা কবে?

‘কবে? যখন একই সপ্তাহে তিনটি রবিবার পড়বে।

‘একই সপ্তাহে তিন-তিনটি রবিবার!

‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। তার আগে অবশ্যই নয়। হতচ্ছাড়া নচ্ছাড় পাজি কোথাকার–তার আগে অবশ্যই নয়, জেনে রাখ । মাথা খুটে মরলেও তার আগে হবার নয়। হতচ্ছাড়া চরিত্রহীন–জেনে রাখ, তার আগে কিছুতেই নয়।

‘হুম! ‘বাপধন, তুই তো আমাকে ভালোই জানিস–এক কথার মানুষ আমি।’

‘হুম!

‘আমার কথা তো সাফ সাফই তোকে বললাম। এবার আমার সামনে থেকে কেটে পড়।

কথাটা বলেই বুড়ো হাবড়াটা হাতের বোতলের ছিপিটা খুলে ঢক ঢক্‌ করে মদ গিলতে লাগলেন।

আমি রাগে গ গস্ করতে করতে হতাশায় জর্জরিত মন নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। আর আমার পরম পুজ্যাস্পদ কাকা মদের বোতলটা নিয়েই মেতে রইলেন।

আমার কাকা ক্যাবলাকান্ত একজন সভ্য-ভব্য রুচিবান বৃদ্ধ ইংরেজ। আর যথার্থই একজন ভদ্রলোক বলে তার খ্যাতি রয়েছে। তবে এ নামের গানের লোকটার সঙ্গে তার বৈসাদৃশ কিছু না কিছু অবশ্যই রয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, তার কয়েকটা দুর্বল দিক অবশ্যই রয়েছে। সে হচ্ছে, একজন বেঁটেখাটো, ইয়া বড় টাকওয়ালা, রসিক আর প্রেমের পূজারি আর দেহটা প্রায় অর্ধগোলাকৃতি । তিনি এমন একজন পুরুষ যার নাকটা টকটকে লাল, লম্বা একটা টাকার থলে সব সময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে আর নিজের মান সম্মান সম্বন্ধে যারপর নাই সচেতন। কোনো পরিস্থিতিতেই মর্যাদা নষ্ট করতে সে রাজি নয়।

একমাত্র তাঁর এরকম অদ্ভুত চরিত্র, আর এরকম অভাবনীয় চারিত্রিক বৈচিত্র্যের জন্যই বাইরের লোকজন, পরিচিত মহলে সবাই তাকে একজন হাড়কিপ্টে বলেই জানে।

আরও আছে, সমাজের বহু ভালো মানুষের মতোই তিনি আরও একটা বিশেষ গুণের অধিকারী। সেটা হচ্ছে, মানুষকে আশা ভরসা দিয়ে হঠাৎ করে নিরাশ করার গুণের কথা বলতে চাইছি। সত্যি তাঁর এ মনোভাবটা বড়ই অদ্ভুত।

যে কোনো লোক, যে কোনো প্রশ্নই করুক না কেন, তিনি সরাসরি জবাব দিয়ে থাকেন–‘না’।

তবে এও সত্য যে, দু-একবার সামান্য অনুরোধ করলেই নিজের মতো পরিবর্তন করে ফেলেন। আর টাকার থলেটার দিকে কেউ লালসা-মাখানো দৃষ্টিতে তাকায়, হাত বাড়ায় তবে কঠোরভাবে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তবে এও সত্য যে, যদি গো ধরে বসে থাকলে টাকার অঙ্কটা মোটাই হয়ে যেত।

আর দান ধ্যানের বেলায়ও দেখা যায়, তাঁর মতো উদার হৃদয় ব্যক্তি সচরাচর হয় না। তবে এও খুবই সত্য যে, তবে তাকে অকৃপণভাবে কাউকে কিছু দান করতে দেখা যায়নি।

এ বুড়ো লোকটার সঙ্গে কাছাকাছি, পাশাপাশি আমি সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছি। আমার বাবা-মা দুনিয়া ছেড়ে যাবার সময় এক বহুমূল্য উত্তরাধিকাররূপে আমাকে তাঁর জিম্মায় সঁপে দিয়ে গেছেন।

আর যা-ই হোক না কেন, আমি কিন্তু মনে প্রাণে বিশ্বাস করি নচ্ছাড় এ বুড়ো হাবড়াটা আমাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশিই ভালোবাসেন। তবে এও সত্য যে, তিনি আমাকে খুব ভালোবাসলেও কেটকে যতটা ভালোবাসেন ততটা অবশ্যই নয়। আর ভালোবাসলেও তার কবলে পড়ে আমি তো একটা পোষা কুকুরের মতোই জীবন ধারণ করছি।

সত্যি বলছি, প্রথম থেকে পঞ্চাশ বছর অবধি পাঁচ-পাঁচটা বছর তিনি প্রতিদিন আমাকে নিয়মিত বেতের আঘাতের শাসনে ধন্য করেছেন।

পাঁচ থেকে পনের বছর অবধি দীর্ঘ দশ-দশটা বছর তিনি প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় আমাকে শোধনাগারের ভয় দেখিয়ে জড়সড় করে রাখতেন।

তারপর পনেরো থেকে বিশ বছর পর্যন্ত পাঁচটা বছরের মধ্যে এমন একটা দিন যায়নি যেদিন আমাকে মাত্র পাঁচটা শিলিং হাতে গুঁজে দিয়ে তিনি বিদায় করে দেবার ভয় দেখাননি।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি রীতিমত একটা দুঃখি কুকুর। কিন্তু সেটাই তো আমার জীবনের একটা অংশে পরিণত হয়ে উঠেছিল। আমার বিশ্বাসের একটা অংশ ছিল।

অবশ্য কেট ছিল আমার বিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য আর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। এ ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগই বিশ্বাসী ছিলাম।

সত্যি বলছি, মেয়ে হিসেবে কেট বড়ই ভালো। তার ভেতর বাহির সবটাই ভালো। সে আমাকে ভালোবাসে। আর সে ভালোবাসানিখাদ। সে আমাকে কথা দিয়েছে পাকা কথা–ভাঁওতা দিয়ে আমার ক্যাবলাকান্ত কাকাটির মন জয় করতে পারলে, তাকে বিয়েতে রাজি করাতে পারলেই সে আমাকে বিয়ে করবে।

কেট! বেচারি কেট! আমার মন ময়ুরী–আমার প্রিয়তমা কেট। তার বয়স পনেরো বছর। সামান্য অর্থকড়ি যা আছে তা দিয়ে কোনোরকমে দিন গুজরান হয়ে যায়।

আমার মতে পনেরো বছর বয়সে যা-কিছু আছে, একুশ বছরেও তার খুব একটা হেরফের হবে বলে আমি অন্তত মনে করি না।

কিন্তু হায়! এ কী ঝকমারিতেই না পড়া গেল রে বাবা! হাড়গিলে বুড়োটার কাছে গিয়ে বহু বহু তোয়াজ, হা-পিত্যেশ কান্নাকাটি করেছি। কি কাকস্য পরিবেদন। ফলাফল লবডঙ্কা। বার বার হতাশ হয়েই ফিরে আসতে হয়েছে।

কী পাষণ্ড বুড়োট! তার বুকটা সত্যি পাথর দিয়ে তৈরি। দয়া-মায়ার লেশটুকুও নেই। নচ্ছাড়টা আমাদের মতো দুটো ইঁদুরছানাকে নিয়ে এমন নির্মম খেলায় মেতেছে যা দেখে কেবল রক্ত মাংসের মানুষই নয়, স্বয়ং জোভ-এরও ক্রোধে ফেঠে পড়ার কথা। শত তোয়াজ করেও হাড়গিলে বুড়োটার মন জয় করা যাচ্ছে না। এঁটুলির মতো। সর্বদা তার গায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছি তবুও তার পাথর মন এতটুকুও নরম হচ্ছে না।

নচ্ছাড় বুড়োটা মনে-প্রাণে আমাদের বাসনা পূর্ণ করার মতো একটা অজুহাত দাঁড় করাতে পারলেই দুম্ করে দশ হাজার পাউন্ড খসাতে রাজি আছে।

কিন্তু হায়! আমরা এমনই আহাম্মক যে, বিয়ের ব্যাপারটা নিজেরাই ঠিক কেবল নয়, পাকা করে ফেলেছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমরা এতটা এগিয়ে যাওয়ায় বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, অর্থাৎ বিয়েটা তিনি কিছুতেই ঠেকাতে পারবেন না।

আমি তো তাঁর কিছু কিছু দুর্বলতার কথা আগেই বলে রেখেছি। সবকিছু খোলসা করে বললেও তাঁর একগুঁয়েমির কথা তেমন কিছু বলা হয়নি, মানে বলিনি।

আমি তার দুর্বলতার কথা বলেছি সত্য। দুর্বলতা বলতে আমি সে-কথাই বোঝাতে চেয়েছি যে, তিনি একরকম মেয়েলি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আর সে কুসংস্কারগুলো তিনি মনে প্রাণে মেনে চলেন।

আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাতর কুসংস্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্ন আর অমঙ্গল প্রভৃতির ব্যাপারে তার বিশেষ বিশ্বাস।

কুসংস্কার ছাড়া আর যা-কিছু তিনি মেনে চলেন তাদের মধ্যে আর যেগুলোকে তিনি বেশি করে মেনে চলেন তা হচ্ছে, কথা রাখারাখির ব্যাপার আর ঠুনকো মান। সম্মানবোধ। পুরো ব্যাপারটাই তবে খোলসা করেই বলা যাক। ব্যাপারটা কি হল– অদৃষ্টকেই সবকিছুর জন্য দায়ী না করে পারা যাচ্ছে না।

আমার বাগদত্তা কেটের পরিচিত নৌ-বিভাগের দুটো লোক আছে। তারা এক বছর বিদেশে কাটিয়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হয়।

১০ অক্টোবরের কথা। সেদিনটা ছিল রবিবার। পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী সেদিন বিকেলে সেই দুজন লোককে সঙ্গে করে আমি আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্তর সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে হাজির হলাম। আমাদের আশা আকাঙ্খ তছনছ হয়ে যাবে মনে গেঁথে রাখার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক তিন সপ্তাহ পরে সে ঘটনাটা ঘটে।

আমরা তাঁর বাড়ি পা দেবার পর প্রথম আধঘণ্টা মামুলি কথাবার্তার মধ্য দিয়েই কেটে যায়। তারপর খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমরা আলোচনাটাকে মোড় ঘুরিয়ে এভাবে নিয়ে গেলাম–

ক্যাপ্টেন প্যান্ট বললেন–আপনি তো জানেনই যে, তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বুড়ো খুল্লতাত বলে উঠলেন–‘কথা? কি কথা, নির্দিধায় বলে ফেলুন মি. প্র্যান্ট।

‘কথাটা হচ্ছে, আমি এক বছর এখানে ছিলাম না তা-তো আপনি ভালোই জানেন, কী বলেন?’

‘হ্যাঁ, তা জানি বটে।’

‘আজ ঠিক এক বছর পূর্ণ হলে আমি আবার এ দেশের মাটিতে পা দিয়েছি।’

‘হ্যাঁ, তা-তো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, আজ তো দশই অক্টোবর–আজই এক বছর পূর্ণ হল। আশা করি আপনার অবশ্যই মনে আছে মি. ক্যাবলাকান্ত, গত বছর ঠিক এ তারিখটাতেই আপনার বাড়ি এসেছিলাম, বিদায় নেবার জন্য।

‘হ্যাঁ, মনে আছে–অবশ্যই মনে আছে।

‘ভালো কথা, ব্যাপারটা কিন্তু আকস্মিক যোগাযোগই সন্দেহ নেই–আমাদের এ বন্ধু ক্যাপ্টেন স্মিদার্টনও ঠিক এক বছর এখানে ছিলেন না। তিনিও আজই এখানে পৌঁছেছেন।

এবার ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন বললেন–‘হ্যাঁ, এক বছরই বটে। ঠিক এক বছরেরই ব্যাপার। ঠিক এক বছর বিদেশে কাটিয়ে আজই এখানে পৌঁছেছি।’

‘হ্যাঁ–হ্যাঁ, তা বটে। আমার হাড়গিলে খুল্লতাত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন।

‘মি. ক্যাবলাকান্ত, আশা করি আপনার স্মরণ আছে, গত বছর ঠিক যে দিনে, অর্থাৎ দশ অক্টোবর ক্যাপ্টেন এ্যান্টের সঙ্গে আপনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাবার জন্য আমিও এ-বাড়িতে এসেছিলাম।’

‘আছে, অবশ্যই মনে আছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে মনে তো আছেই। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুতই বটে মি. স্মিদার্টন, তাই না?

‘কেন? অদ্ভুত কেন?’

‘অদ্ভুত নয় বলছেন? আপনারা দুজনই ঠিক এক বছর আগে গিয়েছিলেন।

আবার আজ, আবার একই দিনে দেশের মাটিতে ফিরে এসেছেন। অদ্ভুত তো বটেই।

‘এদিক থেকে তো অদ্ভুতই বটে।

‘খুবই আশ্চর্য যোগাযোগ। ডক্টর ডাবু এলো. ডী, যাকে ঘটনার এক অদ্ভুত যোগাযোগ আখ্যা দিয়েছেন। ডক্টর ডাক্ বলেন–‘

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কেট আগ বাড়িয়ে বলে উঠল–‘ব্যাপারটা যে অদ্ভুত এ-কথা তো স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বাবা, ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আর ক্যাপ্টেন প্যান্ট তো ঠিক একই দিকে, মানে একই পথে যাননি। আর আশা করি অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না, সেটাই উভয়ের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য, ঠিক বলিনি?

আমার পূজ্যাস্পদ কাকা বললেন–‘বাছা, আমি অন্য কোনো কথা বুঝি না। কি করেই বা বুঝব, বল? আমার কিন্তু ধারণা, ব্যাপারটা এরই ফলে আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডক্টর ডাবল’।

তাঁকে নামিয়ে দিয়ে কেট আবার সরব হল–না, তা কেন হবে? ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন উত্তমাশা অন্তরীপে গিয়েছিলেন, আর হর্ণ অন্তরীপ ঘুরে গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট।

‘ঠিক! একদম ঠিক কথা বলেছ। একজন গিয়েছিলেন পশ্চিম দিকে, আর দ্বিতীয়জন গিয়েছিলেন পূর্বদিকে, ঠিক কি না?

কেট বলল–‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

‘ভালো কথা, ডক্টর ডাব–‘

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম–‘ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আর ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট, আপনাদের কাছে আমার একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ আছে।

‘অনুরোধ? কি বলছেন, খোলাখুলি বলেই ফেলুন?’ ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন ও ক্যাপ্টেন প্যান্ট সমস্বরেই বলে উঠলেন।

‘আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ আগামীকাল সন্ধ্যায় আপনাদের একবারটি আমার বাড়ি আসতে হবে।

উভয়ে মুচকি হেসে প্রায় সমস্বরেই বলে উঠলেন–সে-না-হয় এলাম, কিন্তু কেন দয়া করে বলবেন কী?

‘আরে ব্যাপার তেমন কিছুই নয়, কিছুক্ষণ একসঙ্গে বসে গল্পসল্প আর পানাহার করে কাটাতে চাচ্ছি, এই আর কি।

উভয়ে হাসতে হাসতে এবার বললেন–‘ব্যাপারটা অবশ্যই খুবই আনন্দের আপত্তির কোনো কারণই থাকতে পারে না।’

‘তবে কথা এই, ক্যাপ্টেন স্মাির্টন আর আপনি ক্যাপ্টেন প্যান্ট–আপনারা আপনাদের সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা গল্পাকারে শোনাবেন, সবাই মিলে আনন্দ করে হুইস্ট খেলব আর গলা অবধি মদ–‘।

ক্যাপ্টেন প্যান্ট তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–‘গলা অবধি যে মদ গিলতে চাচ্ছেন–কিন্তু আগামীকাল যে রবিবার সেটা কি খেয়াল আছে? অবশ্য আমারও এতক্ষণ খেয়াল ছিল না, স্বীকার করে নিচ্ছি।

আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্ত সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বললেন ‘আরে আপনাদের উভয়কে কাছে পেয়ে আমি আনন্দ-উচ্ছ্বাসে এতই অভিভূত হয়ে পড়েছি যে, আগামীকাল কি বার তা-ও আমার হুঁশ নেই!

ক্যাপ্টেন প্যান্ট, মুখের হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই এবার বললেন–‘আপনার নিমন্ত্রণ আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি। তবে আগামীকালের পরিবর্তে বরং অন্য কোনো দিন

কেট এতক্ষণ নীরবে সবকিছু শুনছিল। সে এবার মুখ না খুলে পারল না– আরে ধৎ! আপনারা কী সব যা-তা বকছেন, বুঝছি না তো!

ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট নিতান্ত অপরাধীর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল–কেন? আবার কী হল?

‘আসলে আবেগের বশে আপনারা সবাই সবকিছু গোলমাল করে ফেলছেন দেখছি। আমি ভালোই জানি, রবার্ট এত ভুললামন নন। তবু তিনিও যেন সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন।’

‘সবই মেনে নিচ্ছি, কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী?

‘যে রবিবার নিয়ে আপনারা এত কচলাকচলি করছেন, তা কিন্তু অবশ্যই আগামীকাল নয়–আজই তো রবিবার।

আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্ত মুহূর্তে মিইয়ে গিয়ে জিভ কেটে বললেন–দেখ দেখি কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার, কী লজ্জার ব্যাপার দেখুন তো! সত্যি আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! ঠিক, ঠিক তো! আজই তো রবিবার!

ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট তাদের কথার মধ্যে নাক গলালেন–‘দেখুন, আমি আগেই আপনাদের উভয়ের কাছেই মার্জনা ভিক্ষা করে নিচ্ছি। আমি কিন্তু এখনও দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছি, আমার এত ভুল হয়ই না। তাই আমি এখনও বলছি আজ না, আগামীকালই রবিবার।

কেট কপালের চামড়ায় ভাঁজ এঁকে বললেন–‘কি বললেন? আগামীকাল রবিবার?

‘অবশ্যই! কারণ–

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন সবিস্ময়ে বলে উঠলেন–

‘আপনারা যে কি বলছেন আমার মাথায় যাচ্ছে না। আমি বলতে চাইছি, গতকাল কী রবিবার ছিল না।’

ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন ছাড়া অন্য সবাই সমস্বরেই বলে উঠলেন–‘গতকাল গতকালই বটে। আপনি হেরে গেছেন।

আমার খুল্লতাত বললেন–‘আজ রবিবার, হ্যাঁ, আজই রবিবার। আমি কি এটা জানি না?’ ক্যাপ্টেন প্যান্ট বলে উঠলেন–‘না, আজ কিছুতেই নয়, আগামীকালই রবিবার।

স্মিদার্টন আবার মুখ খুললেন–‘আপনাদের সবারই মাথার দোষ দেখা দিয়েছে। আপনারা সবাই পাগল হয়ে গেছেন দেখছি। এই যে আমি এখানে, এই চেয়ারে বসে রয়েছি এটা যেমন সত্য আর আগামীকাল যে রবিবার ঠিক তেমনই সত্য।

কেট উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে রীতিমত ফুঁসতে লাগল–‘আমি সবই বুঝতে পেরেছি। কাকা এটা কি আপনার বিচার সভা বসেছে নাকি? এখানে কি তোমার জ্ঞান বৃদ্ধির বিচার হচ্ছে?

‘হুম! আমার খুল্লতাত প্রায় অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলেন।

কেট আগের মতোই ফুঁসতে ফুঁসতে এবার বলল–‘কাকা তর্কাতর্কি বাদ দিয়ে ব্যাপারটার নিষ্পত্তির দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দিন। দেখবেন, এক মিনিটের মধ্যেই কেমন অনায়াসেই ফয়সালা করে দিচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা কিন্তু পানির মতোই পরিষ্কার।

‘খুবই সহজ সরল।’

‘অবশ্যই। নিতান্তই সহজ সরল একটা ব্যাপার নিয়ে তোমরা এতগুলো লোক নিজেদের মধ্যে কথা-কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়েছ। এখন আমি কি বলছি সবাই ধৈর্য ধরে শোন–ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন বলছেন গতকাল ছিল রবিবার, ছিলও ঠিক তাই। অর্থাৎ তিনি ঠিকই বলেছেন–ববি, কাকা আর আমার বক্তব্য হচ্ছে, আজই রবিবার তিনিও ঠিক, আবার আমরাও ঠিকই বলছি। আবার ক্যাপ্টেন প্যান্ট এ দুটোর কোনো মতকেই সমর্থন করছেন না। তিনি বলছেন, আগামীকাল রবিবার। তাই হবে, মেনে নিচ্ছি। তিনিও ঠিকই বলেছেন। তবে কার্যত কি দেখা যাচ্ছে, বলুন তো?

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই কেট এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

সবার মুখের ওপর মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে কেট আবার সরব হল– ‘এখন দেখা যাচ্ছে, আসলে আমাদের সবার কথাই ঠিক, অর্থাৎ একটা সপ্তাহে তিনটি রবিবার হয়ে গেছে। আমাদের কারো কথা মিথ্যা নয়, কেউই কারো কাছে হেরে যাইনি, আপনারা কী বলেন?

কেটের কথা শেষ হলে সবাই একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগল।

মুহূর্তের জন্য থেমে স্মিদার্টন এবার মুখ খুললেন–‘ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট, এটা কেমন কথা হল। কেট বাজিমাৎ করে দেবে? আমাদের ওপর দিয়ে টেক্কা মেরে এভাবে নাস্তানাবুদ করবে?

‘হ্যাঁ, কার্যত তা-ই তো দেখছি। বিমর্ষমুখে ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট জবাব দিলেন।

স্মিদার্টন বলে চললেন–‘আমরা কী আহাম্মক! মি. ক্যাবলাকান্ত, এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা এরকম আমরা, সবাই জানি, পৃথিবীর পরিধি চব্বিশ হাজার মাইল তাই না?

‘হ্যাঁ, তা তো আমরা অবশ্যই জানি।

‘এখন কথা হচ্ছে, পৃথিবীটা নিজের অক্ষের ওপরে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে অনবরত চক্কর খেয়ে বেড়ায়। মানে পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে চব্বিশ হাজার মাইল একবার পরিক্রমা করে। এবার আমার পরম পুজ্যাস্পদ খুল্লতাতর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি বললেন–‘মি. ক্যাবলাকান্ত, আশা করি ব্যাপারটা এবার আপনার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে, কি বলেন?

আমার খুল্লতাতটি ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে ঘাড় কাৎ করে তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললেন–‘অবশ্যই অবশ্যই, ডক্টর ডাব–‘

তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন বললেন–ক্যাপ্টেন প্যান্ট, তবে। ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে, এটা ঘণ্টায় এক হাজার মাইল গতিতে চলছে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, হিসেবে তো এরকমই দাঁড়াচ্ছে।

‘এবার মনে করুন, আমি এখান থেকে জাহাজে চেপে এক হাজার মাইল পূর্বদিকে গেলাম। তবে আমি অবশ্যই লন্ডনে এখানে লন্ডনে সূর্যোদয় আশা করব এক ঘণ্টায়। অতএব ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে আপনার এক ঘণ্টা আগে আমি সূর্যের মুখ দেখছি, ঠিক কি না?’

‘যা নির্ভেজাল বাস্তব তাকে তো অস্বীকার না করে উপায় নেই।

‘এবার যদি একই দিকে, অর্থাৎ পূর্ব-দিকেই আর এক হাজার মাইল গেলে, দুঘণ্টা আমি সূর্যোদয় আশা করব। তারপর একই দিকে, একই গতিতে ক্রমাগত চলতে থাকলে আমি সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে চক্কর মেরে আবার একই জায়গায় ফিরে আসব। তখন এক হাজার মাইল পূর্বদিকে অগ্রসর হবার ফলে আমি চব্বিশ ঘণ্টা আগে লন্ডনে সূর্যোদয় দেখতে পাব–এরকম প্রত্যাশা তো করা যাবে না। এবার আশা করি বুঝতে পারছেন, আপনার চেয়ে আমি এক ঘণ্টা এগিয়ে রয়েছি। ক্যাপ্টেন প্যান্ট, আমি কি মনে করতে পারি, ব্যাপারটা আপনাকে বোঝাতে পেরেছি?

ক্যাপ্টেন প্যান্ট নীরবে মুচকি হাসলেন। তিনি মুখ খোলার আগেই আমার খুল্লতাত বলে উঠলেন–সবই তো হল, কিন্তু ডাব এলো ডী’

ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন এবার অপেক্ষাকৃত গলা চড়িয়ে বললেন–এবার ক্যাপ্টেন প্যান্টের কথাটা বিবেচনা করা যাক। কি বলেন?

ক্যাপ্টেন প্যান্ট ঘাড় তুলে তার দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকালেন।

তিনি মুখ খোলার আগেই ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আবার বলতে আরম্ভ করলেন–‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, অন্য দিকে ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট যখন এখান থেকে আমার বিপরীত দিকে, অর্থাৎ ক্রমাগত পশ্চিমদিকে জাহাজ চালিয়ে, এক হাজার মাইল পাড়ি দিলেন তখন হলো এক ঘণ্টা–এভাবে ক্রমাগত জাহাজ চালাতে চালাতে যখন চব্বিশ ঘণ্টা জাহাজ চালানো হবে তখন দেখা যাবে তিনি চব্বিশ হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছেন। অতএব দেখা যাবে লন্ডনের সময় থেকে তিনি পুরো একটা দিন পিছিয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা এবার খোলসা হলো তো?’

আমার বুড়ো হাড় গিলে কাকাটি নিতান্ত বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–‘এবার বুঝলেন তো, এভাবেই আমার কাছে গতকাল রবিবার ছিল। আর ক্যাপ্টেন এ্যান্টের কাছে হিসাব মতো আগামীকাল হবে রবিবার।

আমরা সবাই তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখে সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বলে চললেন–‘মি. ক্যাবলাকান্ত, আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা কি জানেন?

আমার পরম পুজ্যাস্পদ খুল্লতাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আগের মতোই বলে চললেন–‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের বক্তব্যই ঠিক। আর আমাদের একজনের ধারণা অন্যের ধারণার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করার পিছনে কোনো দার্শনিক কারণ অবশ্যই থাকা সম্ভব নয়।

আমার হাড়গিলে বুড়ো খুল্লতাত উল্লসিত হয়ে বললেন–‘আরে বাবা! একী অদ্ভুত কথা শুনলাম! সত্যি আজ আমার চোখ খুলে গেছে! আরে কেট আর ববি, দেখ তো কী অদ্ভুত কাণ্ড! এখন বুঝছি, তোমরা ঠিকই বলেছ।’

কেট আর আমি সচকিত হয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–‘সত্যি, তোমাদের কথাই ঠিক, স্বীকার না করে উপায় নেই। ওই যে, তোমরা একটু আগে বলেছিল, আমার বিচার হচ্ছে, এটাই সত্যি। তবে মনে রেখো, আমি এক কথার মানুষ। আমার কথার নড়চড় হয় না। তোমার যেদিন, যখন খুশি কেটকে গ্রহণ করতে পার। জোভের নামে দিব্যি কেটে বলছি, সবই মিটে গেল। তিনটি রবিবার পর পর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে।

আমি কি করব, কী-ই বলব ভেবে না পেয়ে নীরবে তার পরবর্তী মন্তব্য শোনার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।

তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন–‘আমি এবার যাচ্ছি; এ ব্যাপারে ডাবল এলো. ডী কোন্ মত দেন, আমার জানা দরকার। আমি চললাম। কথা বলতে বলতে তিনি থপ থপ আওয়াজ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সকল অধ্যায়

১. দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল
২. ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম (উপন্যাস)
৩. দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ
৪. ফোর বিস্টস্ ইন ওয়ান দ্য হোম–কেমলোপার্ড
৫. বেরোনিস
৬. দ্য পারলয়েন্ড লেটার
৭. দ্য ডেভিল ইন দ্য বেলফ্রাই
৮. দ্য গোল্ড-বাগ
৯. লিজিয়া
১০. দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার
১১. শ্যাডো–এ প্যারাবল
১২. দ্য ডোম্যাইন অব আর্নহিস
১৩. দ্য আর্ট দ্য ম্যান
১৪. ইলিওনোরা
১৫. দ্য ওভাল পর্ট্রেইট
১৬. ভন কেমপেলেন অ্যান্ড হিস ডিসকভারি
১৭. নেভার বেট দ্য ডেভিল ইয়োর হেড
১৮. এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস
১৯. দ্য প্রিম্যাচিওর বেরিয়াল
২০. দ্য কাস্ক অব অ্যামন্টিলাডো
২১. মেজেংগারস্টিন
২২. মাইলেন্সে ফেবল
২৩. থ্রী সানডেস ইন এ উইক
২৪. দ্য ওবলঙ বক্স
২৫. উইলিয়াম উইলসন
২৬. দ্য টেল-ট্যালি হাট
২৭. মেনাস্ক্রিপ্ট সাউন্ড ইন এ বটল
২৮. দ্য অ্যাসাইনমেন্ট
২৯. এ ডিসেন্ট ইন টু দ্য ম্যায়েস্ট্রোম্
৩০. দ্য পাওয়ার অব ওয়ার্ডস
৩১. দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মার্গ
৩২. দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড
৩৩. লিওনাইসিং
৩৪. মোরেল্লা
৩৫. হপ ফ্রগ
৩৬. দ্য স্ফিংস
৩৭. এ টেল অব জেরুজালেম
৩৮. দ্য বেলুন-হোয়্যাক্স
৩৯. সেই বেলুনের কাহিনী
৪০. ডাইরির পাতা থেকে
৪১. ফোর বীস্টস ইন ওয়ান
৪২. দ্য কনভারসেসন অব ইরোজ অ্যান্ড চারমিয়ান
৪৩. দ্য ফ্যাকটস ইন দ্য কেস অব মি. ভালডিমার
৪৪. ইম্প অফ দ্য পারভাস
৪৫. লন্ডস কটেজ
৪৬. ডিডলিং
৪৭. দ্য সিস্টেম অব ডক্টর টার অ্যান্ড প্রফেসর ফেদার
৪৮. লস অব ব্রিদ
৪৯. দ্য স্পেকট্যাকল
৫০. মেসমেরিক রেভেল্যেশন
৫১. দ্য কোয়াকস অব হেলিকন–এ স্যাটায়ার
৫২. ম্যাগাজিন রাইটিং পিটার স্নক
৫৩. দ্য ডিউক ভিলা ওমলেট
৫৪. দ্য ম্যান অব দ্য ক্রাউড
৫৫. সাইলেন্স-এ ফেল
৫৬. দ্য ম্যান দ্যাট ওয়াজ ইউজড আপ
৫৭. ফিলজফি অব ফার্নিচার
৫৮. দ্য লিটারারি লাইফ অব থিংগাস বব এসকোয়ার
৫৯. দ্য আয়ারল্যান্ড অব দ্য কে
৬০. অ্যাসটোরিয়া
৬১. শ্যাডো-এ প্যারেবল
৬২. এ টেল অব জেরুসালেম
৬৩. রিভিউ অব স্টিফেন্স অ্যারেবিয়া ট্রো
৬৪. বিজনেসম্যান
৬৫. বন-বন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন