লিওনাইসিং

অ্যাডগার অ্যালান পো

আমি?

আমি একজন, মানে আমি ছিলাম, মহামানব।

তবে আমি কিন্তু জুলিয়াস নামক গ্রন্থের রচয়িতা নই, আবার আমি একজন মুখোশধারীও নই। কেন? কারণ এটাই যে, আমার নাম রবাট জোন্স।

আর আমার জন্মস্থল? ফু-ফুজ নগরের কোনো একস্থানে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম। অতএব সে স্থানটাকেই তো আমার জন্মস্থান বলে ধরতে হবে।

আমি জীবনে যত কাজ করেছি তার মধ্যে প্রথম ও সবচেয়ে বড় কাজটার কথা বলছি, সে কাজটা হচ্ছে, নিজের নাকটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে রাখা।

আমার নাক চেপে ধরার কাজ দেখে আমার মা বলতেন, আমি বাস্তবিকই একটা প্রতিভা।

আমার মায়ের কথা তো বললাম, এবার বলছি আমার বাবার কথা। আমাকে সর্বদা দুহাত দিয়ে নাকটা চেপে ধরে রাখতে দেখে আমার বাবা আনন্দ উচ্ছ্বাসে চোখের পানি ঝরাতে ঝরাতে একটা নসলজি বই উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন।

আমার যখন জাঙ্গিয়া পরার বয়স হয়নি তখনই আমি সে বিদ্যা; অভ্যাসও বা চলে আমি রপ্ত করে নেই।

এদিকে বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহতই রইল। আমি কদিনের মধ্যেই নাকের ব্যাপারটা সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে পারলাম। আমি বুঝতে পারলাম, খুব খাড়া আর চোখা একটা নাকের মালিক হলে তার জন্যই কোনো একজন সিংহের মর্যাদায় উন্নীত হয়ে যেতে পারবে, অর্থাৎ পশুরাজের সমান মর্যাদার অধিকারী হতে সক্ষম হবে।

তবে এও খুবই সত্য যে, আমার মনোযোগ কেবলমাত্র বইপত্রের জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না।

আমি অধিবিদ্যাকে কাজে লাগাতে এতটুকুও ত্রুটি রাখিনি। প্রতিদিন সকালে দু-দুবার করে আমার লম্বা নাকের ডগাটাকে আচ্ছা করে টেনে দিতে আরম্ভ করলাম। শুধু কি এই? নাকের ডগাটাকে টানার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি সকালে দু ঢোক করে মদ উদরস্থ করতে লাগলাম।

এভাবে আমার দিন কাটতে লাগল।

বয়স বাড়তে বাড়তে এক সময় বড় হলাম, মানে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হলাম।

আমি বড় হলে একদিন বাবা আমাকে ডাকলেন। আমি তার কাছে যেতেই তিনি আমাকে নিয়ে তার পড়ার ঘরে গেলেন।

আমি তার সঙ্গে পড়ার ঘরে হাজির হলে, উভয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসলাম।

বাবা তার চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, বাছা, তোমার কাছ থেকে একটা কথা শোনার জন্য এখানে নিয়ে এখানে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।

আমি বললাম বলুন–কি জানতে চাইছেন?

তোমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য কী?

আমি তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললাম–নসলজি।

নসলজি?

হ্যাঁ।

নসলজিটা কী রবার্ট?

না, নসলজি, মানে নাসিকা-বিজ্ঞান

আমি আর একটা কথা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছি।

বলুন, আপনার এবারের জিজ্ঞাস্য কী?

বল তো, নাক বলতে কী বোঝায়?

শুনুন বাবা, প্রায় হাজার খানেক লেখক নাকের আলাদা আলাদা সংজ্ঞার অবতারণা করেছেন।

কথা বলতে বলতে আমি কোটের পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলাম এখন দুপুর বা তার কাছাকাছি।

আমার বাবা প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলেন হুম।

আমি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বললাম–এখন প্রায় দুপুর। এখন যদি আমি সব লেখকের সংজ্ঞা এক-এক করে বলতে শুরু করি তবে রাত দুপুর হয়ে যাবে।

হুম।

শুনুন তবে, লেখক বার্থোলিনাস যা বলেছেন তা হচ্ছে, নাক হচ্ছে মুখের সে স্ফীত অংশ, সে আঁব, সে অতিকায় আঁচিল আর সে

আমার বাবা থামিয়ে দিয়ে বললেন–থাক, থাক। রবার্ট, আর বলতে হবে না, ঢের হয়েছে। তোমার জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পেয়ে আমি স্তম্ভিত। মাথায় বাজ পড়ার জোগাড়। আমার বুকের ভেতরে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেছে।

কথা বলতে বলতে তিনি বুকের ওপর হাত দুটো রেখে চোখ দুটো বন্ধ করলেন। তারপর আবার মুখ খুললেন–

এসো, চলে এসো।

পরমুহূর্তেই তিনি খপ করে আমার হাত দুটো চেপে ধরে বললেন–শোন, আমি মনে করছি, তোমার শিক্ষালাভ সমাপ্ত হয়েছে। তোমাকে এবার নিজের রাস্তা বেছে। নিতে হবে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকালাম।

তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলতে লাগলেন–তোমাকে নিজের পথ দেখতে হবে। নাক বরাবর এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তোমার অন্য কোনো গতি নেই।

আমি সবিস্ময়ে তার দিকে তাকালাম। কিছু বলার জন্য সবে মুখ খুলতে যাব, কিন্তু আমাকে সে সুযোগ না দিয়েই তিনিই তোতলাতে আরম্ভ করলেন–তাই, তাই বলছি কী, বলছি কী, কথা বলতে বলতে তিনি আমাকে এক লাথি মেরে সিঁড়ি থেকে একেবারে বাইরে বের করে দিলেন। তিনি তর্জন-গর্জন করতে করতে বললেন অতএব হতচ্ছাড়া! বেরিয়ে যাও; পরম পিতা তোমার সহায় হোন!

আমি এবার লাথির চোটে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারে শেষ ধাপটা অতিক্রম করে তবে নামতে পারলাম।

ঠিক তখনই আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পরমপিতার প্রত্যাদেশ পেলাম।

এ আকস্মিক দুর্ঘটনাটাই আমার কাছে অভিসম্পাত থেকে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে দাঁড়াল।

আমি সিঁড়ির কাছে বসেই মনস্থির করে বসলাম, বাবারনিদের্শ মাথা পেতে নিয়েই কাজ করব। হ্যাঁ, আমি নাক বরাবরই এগিয়ে যাব। সেখানে দাঁড়িয়েই আমি হাত দিয়ে বার দুই নাকটাকে টানলাম।

ব্যস, আর দেরি না করে আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লাম। নাসিকা-বিজ্ঞান সম্বন্ধে একটা বই লিখে ফেললাম।

আমার লিখিত বইটকে নিয়ে সারা ফু-ফুজ নগরে রীতিমত হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড শুরু হয়ে গেল।

খবরের কাগজগুলোও ব্যাপারটাকে নিয়ে মাতামাতি জুড়ে দিল।

কোয়ার্টারলি পত্রিকার পাতায় ছাপা হল–কী আশ্চর্য প্রতিভা।

ওয়েস্ট মিস্টার লিখল–উন্নত মানের শরীরতত্ত্ববিদ।

ফরেনার পত্রিকা লিখল–সাহসি লোক সন্দেহ নেই।

এডিনবরা পত্রিকার পাতায় ছাপা হল–ভালো, ভালো লেখক বটে!

ডাবলিন পত্রিকা লিখল–গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি বটে।

বেস্টলি পত্রিকা মন্তব্য করল মহামানব! মহামানব!

ফ্রেজার পত্রিকার পাতায় ছাপা হলো ঈশ্বরপ্রেরিত মহামানব!

ব্লাউড পত্রিকার পাতা ছাপা হল–আমাদেরই এক ব্যক্তি! মিসেস বাস-ব্লু মন্তব্য করল–কে? কে লোকটি? মিস ব্লাস ব্লু মন্তব্য করল–লোকটির পেশা কী?

আমি কিন্তু এসব মন্তব্যে কর্ণপাতই করলাম না। আমি এ-ব্যাপারে কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে, কোনোরকম মন্তব্য না করেই এক শিল্পীর দোকানে ঢুকে। গেলাম।

শিল্পীর স্টুডিওতে পা দিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, দেশের আত্মসুখ ছাড়া কিছু বোঝে না এমন রাণী নিজের প্রতিকৃতি আঁকাবার জন্য শিল্পীর সামনে একটা চেয়ারে ঠায় বসে রয়েছেন।

আর? আর রাণীরই কাছাকাছি অমুক দেশের জমিদার মশাই একটা চেয়ার দখল করে বসে। তার কোলে বসে রাণীর পোষা প্রিয় কুকুরটা কুঁৎ-কুঁৎ আওয়াজ করছে।

এ দেশ ও দেশের বাবু সাহেবটি তার মুখোমুখি চেয়ারে বসে প্রভাব-প্রতিপত্তির সঙ্গে মৌজ করে গল্প জমিয়েছেন। আর দেশের রাজা মশাই রাণীর চেয়ারের কাছে, তার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

আমি দুপা এগিয়ে শিল্পীর কাছাকাছি, মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তাঁর দিকে নাকটাকে বাড়িয়ে দিলাম।

রাণী আমার নাকটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন–চমৎকার! আহা, কী চমৎকার!

জমিদার মশাই ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন–আহা! আহা!

বাবু সাহেবটি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন–উফ্! ভয়ানক! ভয়ানক!

রাজা মশাইও মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। তিনি মুখ বিকৃত করে উচ্চারণ করলেন–ইস্, ঘেন্নায় বাঁচি না!

শিল্পী ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-এর জন্য কী পরিমাণ অর্থ নেব?

রাণী গলা ছেড়ে বলে উঠলেন–নাক, নাকের জন্য!

আমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। তারপর বললাম—

এক হাজার পাউন্ড, কী বলেন?

চমৎকার! চমৎকার! শিল্পী ভাবালুতকণ্ঠে বলে উঠলেন।

এক হাজার পাউন্ড, কী বলেন? আমি আবারও বললাম। শিল্পী এবার আমার খাড়া ও চোখা নাকটাকে আলোর দিকে ফিরিয়ে ভালোভাবে দেখে নিয়ে বললেন– এক হাজার পাউন্ড? আপনি কথা দিচ্ছেন তো মশাই?

আমি আচ্ছা করে নাকটাকে ঝেড়ে নিয়ে বললাম–হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি এক হাজার পাউন্ড।

শিল্পী নাকটার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। তারপর নাকটার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন–এটা পুরোপুরি আসল তো?

আমি নাকটাকে একদিকে বাঁকিয়ে নিয়ে বলাম–হ্যাঁ।

শিল্পী এবার চোখের সামনে অনুবীক্ষণ যন্ত্রটাকে ধরে, নাকটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিরীক্ষণ করে নিয়ে বলেন–একটা কথা–

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম–বলুন, কী জানতে চাইছেন?

জানতে চাইছি, নাকটার কোনো অনুকৃতি নেই তো?

অনুকৃতি?

হ্যাঁ, কোনো অনুকৃতি নেই তো?

ধুৎ ভাই! কি যে বলেন, একটাও না।

শিল্পী এবার চোখ দুটো কপালে তুলে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন–বাঃ! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!

এক হাজার–এক হাজার পাউন্ড। আমি বললাম।

এক হাজার পাউন্ড? শিল্পী বলল।

হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। এক হাজার পাউন্ড বটে।

এক হাজার পাউন্ড? শিল্পী আবারও বললেন।

হ্যাঁ, পুরোপুরি ঠিক। আমি তার কথার জবাবে বললাম।

বহুৎ আচ্ছা! তা-ই পাবেন। কী আশ্চর্য! কী অভূতপূর্ব বিস্ময়কর কলাকৌশল!

ব্যস, আর এক মুহূর্তও দেরি না করে শিল্পী দেরাজ থেকে একটা চেকবই বের করলেন। একটা পাতায় খসখস করে লিখে ফেললেন। এবার বই থেকে চেকটা ছিঁড়ে আমার হাতে তুলে দিলেন। তারপর ইজেলে সাঁটা ক্যাম্পাসের গায়ে আমার নাকের একটা রেখাচিত্র এঁকে নিলেন।

আমি জেরমিন স্ট্রিটে একটা বাসা ভাড়া করলাম। তারপর নাসিকা-বিজ্ঞান-এর নিরানব্বইতম সংস্করণটাকে লোক মারফৎ রাণীর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। কেবলমাত্র বইটাই নয়, সে সঙ্গে নাকের ডগার একটা প্রতিকৃতি পাঠাতেও ভুললাম না।

ওয়েলসের যুবরাজের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলাম। তিনি বিভিন্নভাবে অনুরোধ করে আমাকে একবারটি তার বাড়িতে যেতে বলেছেন।

আমি যুবরাজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তার বাড়ি হাজির হলাম। তার বৈঠকখানায় পা দিয়ে দেখলাম, বিভিন্ন দিক আর বহু দেশ থেকে মহা মহা পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা তার বৈটকখানায় জড়ো হয়েছেন।

আমি উপস্থিত হবার পর গৃহকর্তা যুবরাজ সাদর অভ্যর্থনা করে আমাকে বসতে দিলেন। উপস্থিত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা নিজ নিজ বিষয়ের ওপর জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী জ্ঞান-গম্ভীর রোমহর্ষক বক্তব্য পেশ করলেন।

আর আমি? আমি নিজের কথা, নিজের কথা, নিজের কথা, আমার নাসিকা বিজ্ঞানে আলোচিত বিষয়ের কথা আমার নিজের মতামত আর বইয়ের বক্তব্য।

তারপর আমার খাড়া ও চোখা নাকটাকে উঁচিয়ে আমি আবারও আমার নিজের বক্তব্যই বহুবার, বহুভাবে ব্যক্ত করলাম।

যুবরাজ উচ্ছ্বসিত আবেগে সঙ্গে বলে উঠলেন–আশ্চর্য পণ্ডিত ও বিচক্ষণ মানুষ বটে।

বাঃ! চমৎকার! চমৎকার! উপস্থিত অতিথি-অভ্যাগতরা সমস্বরে বলে উঠলেন।

নিজের সুখ-ভোগ ছাড়া বোঝেন না এমন চরিত্রের রাণী পরদিন আমার বাসার দরজার এলেন। উদ্দেশ্য, আমার সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলবেন।

আমি সাদর অভ্যর্থনার সঙ্গে রাণীকে বসতে দিলাম। লক্ষ্য করলাম, রানি ভাবাবেগে আপ্লুত।

এক সময় তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার থুতনিতে আলতোভাবে একটা টোকা দিয়ে আবেগ মধুর স্বরে বলে উঠলেন–ওহে সুন্দর যুবা পুরুষ, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন–তুমি কী একবারটি আলমাক-এ যাবে? আমি বললাম–যাব, অবশ্যই যাব।

তিনি উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন– ওগো সুন্দর, যাবে–তুমি যাবে?

যাব, অবশ্যই যাব।

যাবে? ওই নাকটাসহ যাবে তো?

আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম–ঠিক যেমন আছি, সে ভাবেই যাব।

কথা দিচ্ছ?

হ্যাঁ, কথা দিলাম।

তবে এই আমার কার্ড ধর।

আমি হাত বাড়িয়ে তার কাছ থেকে কার্ডটা নিলাম।

রাণী এবার তার আয়ত চোখ দুটো তুলে আমার নাকটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন–ওগো সুন্দর, আমি কি তবে বলতে পারি তুমি যাবে?

মাননীয়া রাণী, আমি কথা দিচ্ছি, আমি সারা অন্তর নিয়ে সেখানে উপস্থিত হব।

আরে না না, সেটি হচ্ছে না।

আমি বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তার মুখের দিকে তাকালাম।

তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বললেন–না সুন্দর, সারা অন্তর নিয়ে গেলে তো চলবে না।

তবে?

তোমাকে যেতে হবে সম্পূর্ণ নাক নিয়ে, বুঝলে সুন্দর?

প্রিয়তমা আমার, কথা দিচ্ছি, নাকের প্রতিটা অংশ নিয়েই আমি সেখানে উপস্থিত হব।

আমি নাকটাকে ধরে দু-একবার মোচড় দিয়েই আমাক-এ রাণী সাহেবের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে তার বাড়ির সদর দরজায় হাজির হয়ে গেলাম।

বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে বৈঠকখানা পর্যন্ত লোক গিজগিজ করছে। কার বাপের সাধ্য বৈঠকখানার দিকে এক পা এগোয়।

বাড়ির সিঁড়ি থেকে একজন আমাকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে বলে উঠল–ওই, ওই যে, তিনি আসছেন। ওই, ওই তো, তিনি এসে গেছেন।

তিনি এসে গেছেন, সিঁড়ির আর এক ধাপ উঠেই অন্য আর একজন গলা ছেড়ে বলে উঠল। তারও ওপরের ধাপ থেকে আর একজন চেঁচিয়ে উঠল–ওই তো তিনি এসে গেছেন। আসছেন নয়? এসেই গেছেন।

এবার ভিড়ের মধ্য থেকে রানির উল্লাস-ধ্বনি শোনা গেল–এসেছে! ওই, ওই তো, আমার ভালোলাগা মানুষটা এসে গেছেন। ওই তো।

রাণীর পরের কথাগুলো আর শোনা গেল না, সমবেত জনতার কণ্ঠস্বরে চাপা পড়ে গেল।

রাণী এবার ভিড় ঠেলে উভ্রান্তের মতো এগিয়ে এসে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে আমার খাড়া চোখা নাকটায় পর পর তিনবার চুমু খেলেন। আমাকে সাধ্যমত দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে নিয়ে আবেগ মধুর স্বরে বলতে লাগলে আমার মনের মানুষ, প্রিয়তম আমার!

ব্যস, এবার হৈ হট্টগোল আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল। এক একজন গলা ছেড়ে নানারকম মন্তব্য করতে লাগল। মন্তব্য বলতে কটুক্তি। পি, পি আর পি না।

শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেল যে, ব্লাডনলারের নির্বাচক পর্যন্ত সংযত থাকতে পারল না। নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় আমাকে গালমন্দ করতেও দ্বিধা করল না।

আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হলো না। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলাম। চিৎকার চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিলাম।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, নিজেকে সামলে রাখাই আমার পক্ষে দায় হয়ে পড়ল। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমি ব্লাডেনাফ-এর নির্বাচকের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম। ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে তর্জন গর্জন শুরু করলাম–দ্যুৎ ভাই! আপনি একটা অপদার্থ! একটা বাঁদর ছাড়া আপনাকে সম্বোধন করা যায় না।

শেষমেশ যা হবার তাই হলো। আমরা উভয়ে পরস্পরের মধ্যে কার্ড বিনিময়। করলাম। কারো পক্ষেই ক্রোধ সম্বরণ করা সম্ভব হলো না। উভয়ের মাথায়ই খুন চেপেই রইল।

স্থির হল, পরের সকালে চক-গোলাবাড়িতে আমরা পরস্পরের মুখোমুখি হব। সেখানেই আমাদের মোকাবেলা হবে। আমরা পরস্পরের প্রতি গায়ের ঝাল মিটিয়ে। ছাড়ব; মোদ্দা কথা, বদলা নেব।

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চক গোলাবাড়িতে হাজির হলাম।

আমি তার মুখোমুখি হওয়ামাত্র এমন মোক্ষম এক ঘুষি মারলাম, যার ফলে তার নাকটা থেঁতলে গেল। উচিত শিক্ষা দেওয়া যাকে বলে।

চক গোলাবাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি বন্ধুদের কাছে হাজির হলাম।

আমাকে দেখেই প্রথম বন্ধু বলে উঠল–আহাম্মক কাঁহাকার।

দ্বিতীয় বন্ধু বলল–বোকা! নিরেট বোকা!

তৃতীয় বন্ধু বলল–একটা আস্ত অপদার্থ!

চতুর্থ বন্ধু বলল–গাধা! গাধা কোথাকার!

পঞ্চম বন্ধু রাগে গম গম করতে করতে বলল–একটা ক্যাবলা!

ষষ্ঠ বন্ধু বলল–মাথায় গোবর ভর্তি!

সপ্তম বন্ধু গর্জে উঠল–দূর হয়ে যা!

বন্ধুদের কথাগুলো শুনে রীতিমত থ বনে গেলাম। মর্মাহতও কম হলাম না। আমি রীতিমত মুষড়ে পড়লাম।

মনমরা হয়ে আমি গুটিগুটি বাবার কাছে হাজির হলাম। আমাকে গোমড়া মুখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবা বেশ নরম সুরেই বললেন–কী বুঝলে বাছা?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে ফ্যা ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমাকে নীরব দেখে তিনি এবার ম্লান হেসে বললেন–শোন বাবা, নাসিকা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা ও জ্ঞানার্জনই এখনও তোমার জীবনের লক্ষ্য।

হুম! আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম।

বাবা এবার একটু বেশ রাগত স্বরেই বললেন–কিন্তু তুমি নির্বাচকের নাকে আঘাতের মাধ্যমে তোমার জীবনের লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে গেছ।

আমি নীরব চাহনি ঠেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তিনি বলে চললেন–আমি স্বীকার করছি, তোমার একটা চমৎকার নাক আছে। কিন্তু ব্লাডেননাফ-এর কথাটা একবার ভেবে দেখ তো, তার তো নাক বলে কোনো বস্তুই নেই। তার নাকটা কী দাঁড়াল? সবাই তোমার কাজের জন্য সমস্বরে ছিঃ! ছিঃ! করল। আর ব্লাডেননাফ দুম করে আজকের নায়ক বনে গেল, ঠিক কি না?

হুম!

তিনি এবার বললেন- বাছা, আমি স্বীকার করছি, ফু-ফুজ নগরে একটা সিংহের শ্রেষ্ঠত্বও মহত্বের বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে তার নাক। অর্থাৎ তার নাকটা কতখানি খাড়া আর চোখা তাই হচ্ছে বিচারের মাপকাঠি,হায় ভগবান!

আমি কি বলব সহসা স্থির করতে না পেরে মুখে কুলুপ এঁটেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাবা পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনে বললেন–শোন বাছা, আমি বলতে চাইছি, যে সিংহের নাকই নেই তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা চলে কী?

আমি তার মুখের দিকে বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

সকল অধ্যায়

১. দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল
২. ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম (উপন্যাস)
৩. দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ
৪. ফোর বিস্টস্ ইন ওয়ান দ্য হোম–কেমলোপার্ড
৫. বেরোনিস
৬. দ্য পারলয়েন্ড লেটার
৭. দ্য ডেভিল ইন দ্য বেলফ্রাই
৮. দ্য গোল্ড-বাগ
৯. লিজিয়া
১০. দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার
১১. শ্যাডো–এ প্যারাবল
১২. দ্য ডোম্যাইন অব আর্নহিস
১৩. দ্য আর্ট দ্য ম্যান
১৪. ইলিওনোরা
১৫. দ্য ওভাল পর্ট্রেইট
১৬. ভন কেমপেলেন অ্যান্ড হিস ডিসকভারি
১৭. নেভার বেট দ্য ডেভিল ইয়োর হেড
১৮. এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস
১৯. দ্য প্রিম্যাচিওর বেরিয়াল
২০. দ্য কাস্ক অব অ্যামন্টিলাডো
২১. মেজেংগারস্টিন
২২. মাইলেন্সে ফেবল
২৩. থ্রী সানডেস ইন এ উইক
২৪. দ্য ওবলঙ বক্স
২৫. উইলিয়াম উইলসন
২৬. দ্য টেল-ট্যালি হাট
২৭. মেনাস্ক্রিপ্ট সাউন্ড ইন এ বটল
২৮. দ্য অ্যাসাইনমেন্ট
২৯. এ ডিসেন্ট ইন টু দ্য ম্যায়েস্ট্রোম্
৩০. দ্য পাওয়ার অব ওয়ার্ডস
৩১. দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মার্গ
৩২. দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড
৩৩. লিওনাইসিং
৩৪. মোরেল্লা
৩৫. হপ ফ্রগ
৩৬. দ্য স্ফিংস
৩৭. এ টেল অব জেরুজালেম
৩৮. দ্য বেলুন-হোয়্যাক্স
৩৯. সেই বেলুনের কাহিনী
৪০. ডাইরির পাতা থেকে
৪১. ফোর বীস্টস ইন ওয়ান
৪২. দ্য কনভারসেসন অব ইরোজ অ্যান্ড চারমিয়ান
৪৩. দ্য ফ্যাকটস ইন দ্য কেস অব মি. ভালডিমার
৪৪. ইম্প অফ দ্য পারভাস
৪৫. লন্ডস কটেজ
৪৬. ডিডলিং
৪৭. দ্য সিস্টেম অব ডক্টর টার অ্যান্ড প্রফেসর ফেদার
৪৮. লস অব ব্রিদ
৪৯. দ্য স্পেকট্যাকল
৫০. মেসমেরিক রেভেল্যেশন
৫১. দ্য কোয়াকস অব হেলিকন–এ স্যাটায়ার
৫২. ম্যাগাজিন রাইটিং পিটার স্নক
৫৩. দ্য ডিউক ভিলা ওমলেট
৫৪. দ্য ম্যান অব দ্য ক্রাউড
৫৫. সাইলেন্স-এ ফেল
৫৬. দ্য ম্যান দ্যাট ওয়াজ ইউজড আপ
৫৭. ফিলজফি অব ফার্নিচার
৫৮. দ্য লিটারারি লাইফ অব থিংগাস বব এসকোয়ার
৫৯. দ্য আয়ারল্যান্ড অব দ্য কে
৬০. অ্যাসটোরিয়া
৬১. শ্যাডো-এ প্যারেবল
৬২. এ টেল অব জেরুসালেম
৬৩. রিভিউ অব স্টিফেন্স অ্যারেবিয়া ট্রো
৬৪. বিজনেসম্যান
৬৫. বন-বন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন