দ্য কোয়াকস অব হেলিকন–এ স্যাটায়ার

অ্যাডগার অ্যালান পো

সম্প্রতিকালে, বিশেষ করে একজন আমেরিকান-এর কলমের ডগা দিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বেরনো নতুন কিছু, খুবই প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে আটলান্টিক মহাসাগরের অধিবাসীরা অর্থাৎ আমরা যা-কিছু করেছি তার মধ্যে কোনটাই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়–কোন দিক থেকেই গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়।

সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে আমরা নিতান্ত অক্ষম না হলেও বিদ্রুপাত্মক রচনার ব্যাপারে আমাদের দক্ষতা কিছুমাত্র নেই।

আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে যথাযথ বিচার করে মন্তব্য করতে হলে স্বীকার না করে উপায় নেই, ব্যঙ্গ আর রঙ্গ রসিকতার কষাঘাতে সমাজের মানুষকে সোজা করার কায়দা আমাদের জানা নেই।

দ্য কোয়ান্স অব হেলিকন নামক কেতাবটা হাতে পেয়ে আমরা খুশিতে ডগমগ হয়ে পড়েছি। বইটার লেখক মি. উইলসার।

এ দেশের চন্দ্র-সূর্যের তলায় মি. উইলমারের লেখা বইটা যেন নবতম সৃষ্টি। তিনি খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে এর প্রতিটা অক্ষর সাজিয়ে সাজিয়ে যত্নের সঙ্গে বইটাকে লিখেছেন।

সাহিত্য সমালোচনার অবর্ণনীয় দুর্নীতি আর বক্তব্যের অসঙ্গতি আর অবান্তর কথার ফুলঝুড়িতে আমাদের শ্বাস রোধ হয়ে আসার যোগার ব্যাপারটাকে নিছকই একটা দুর্ঘটনা ছারা আর কি-ই বা বলা যেতে পারে? মি. উইলমারের দাবি কিন্তু সাহিত্য জগতে তিনি নতুনতর কিছু আমাদের উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আসলে আমরা, পাঠক-পাঠিকা যে কি পেয়েছি তা-তো নিজেরাই মনে মনে উপলব্ধি করছি।

পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই এক বাক্যে স্বীকার করবেন মি. উইলমারের দ্য কোয়াঅব হেলিকন কবিতা হিসেবে ত্রুটিহীন তো নয়ই বরং ক্রটিতে ভরা।

স্বীকার করতেই হবে কবিবর উইলমার আমাদের বন্ধুজন হলেও তার কবিতার ত্রুটিগুলো উল্লেখ করে আমরা যারপরনাই খুশিই হব। তবে এও অবশ্য স্বীকার্য যে তার কবিতা কেবলমাত্র ত্রুটি পূর্ণই নয়, গুণও আছে অনেকই।

তাঁর কবিতার প্রতিটা ছত্রে অত্যাশ্চর্য সদ্গুণ থাকলে ব্যঙ্গাত্মক কাব্য হিসেবে বর্তমান বইটা লেখার প্রয়াস ও পরিশ্রম দু-ই পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যেত, সন্দেহ নেই। আর সে সম্প্রদায়ের আঘাত হানার জন্য এত সব প্রয়াস সে সম্প্রদায়ই বিদ্রুপে ফেটে পড়ত।

মি. উইলমারের লেখা কাব্যটা অনুকরণ দোষে সবচেয়ে বেশি করে দুষ্টু।

একটা কথা, পোপ আর ড্রাইডেন-এর ব্যঙ্গাত্মক রচনার কৌশল অবলম্বন করে যদি কাব্যগ্রন্থটার প্রথম থেকে শেষ অবধি লেখা হত তবে আমার স্বীকার না করে উপায় থাকত না যে, কাব্যগ্রন্থটার রচনা অবশ্যই উকৃষ্ট হয়েছে।

কিন্তু কাব্যগ্রন্থটা পাঠ করলে তার শব্দরাশি, ছন্দ মেলানোর কৌশল, পরিচ্ছেদ সাজানো আর ব্যঙ্গের মোটামুটি কায়দা-কৌশল প্রভৃতির বিচার করে সহজেই ধরা যাচ্ছে সবই ড্রেনডনের কাব্য অনুকরণ করে রচিত।

সে আমলের ব্যঙ্গ-রসে পরিপূর্ণ রচনা চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু সম্প্রতিকালে কেউ যদি নতুন উদ্যম নিয়ে সে প্রয়াস চালাতে উৎসাহি হয়ে ওঠে তবে তার পতন অবশ্যম্ভাবী। আর মৌলিকতা থেকে সরে না দাঁড়িয়ে তার কোন পথই থাকবে না। অতএব সব মিলিয়ে তার পতন যে অনিবার্য এ বিষয়ে তার। তিলমাত্র সন্দেহও নেই।

নকল করে মি. উইলমার যে লক্ষণীয় একটা নজির সৃষ্টি করেছেন, এ ব্যাপারে তো সবকিছু দেখে বুঝেও-না-বোঝার, আর না দেখার ভান করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়।

একটা কথা কিন্তু খুবই সত্য যে, মানসিক চিত্রগুলো মি. উইলমারের একেবারেই নিজস্ব। সত্যি তিনি কারো ইমেজ নকল করেননি। কিন্তু এই বিষয়গুলোকে তিনি যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে কাব্যের রূপদান করেছেন তা যে তার নিজস্ব নয়–সে রূপ গুলো যে পোপ আর ড্রাইডনের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আর মি. ইউলিমার সে সব। সুকৌশলে চুরি করে নিজের কাব্যে ব্যবহার করেছেন। কেবলমাত্র পোপ আর ড্রাইডনের কথাই বা বলি কেন? চার্চিল আর রোচেস্টারের সম্পদ চুরি করে নিজের বলে চালাতেও তিনি কিছু মাত্র দ্বিধা করেননি। অতএব অনুকরণ প্রিয়তা দোষে মি. উইলমার অবশ্যই দুষ্ট।

মি. উইলমারের সবচেয়ে বড়দোষ অনুকরণ প্রিয়তা। আর এ দোষের জন্যই তিনি তাঁর রচিত কাব্যকেও দোষী করে ফেলেছেন।

অতএব একটা কথা না বলে পারা যাচ্ছে না, মি. উইলমার সুবুদ্ধি ঘটিয়ে অনুকরণ করার কাজ থেকে বিরত থাকলেই ভালো করতেন।

কাব্যটা পাঠ করে যা উপলব্ধি করা যাচ্ছে মি. উইলমার সুন্দর মনে করে যে সব জায়গা নকল করেছেন তা আসলে সুন্দর নয়, ত্রুটিপূর্ণ।

কেন ত্রুটিপূর্ণ বলছি? যেমন ধরা যাক ওয়ার শব্দের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়েছেন ডিক্লেয়ার শব্দটা ব্যবহারের মাধ্যমে। আর তিনি এটা করেছেন কবিবর পোপ-এর অনুকরণে। এ-কাজটা করার সময় তিনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেননি, উভয় শব্দেরই বর্তমানকালের উচ্চারণ তাদের আমলের উচ্চারণের মতো নয়। অতএব এক্ষেত্রে তার ত্রুটি অবশ্যই রয়ে গেছে।

আর একটা কথা আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, মি. উইলমারের লেখা কাব্য দ্য কোয়ার্স অব হেলিকন নোংরামির জন্য সবচেয়ে বেশি কলুষিত হয়েছে, কলঙ্কের কালিমা গায়ে মেখে নিয়েছে।

কিন্তু একটা কথা আমরা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি নোংরামি মি. উইলমারের মনের সহজাত নয়, প্রবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে নেই।

আর একটা ব্যাপার খুব বেশি করে প্রযোজ্য যে, রোচেস্টার আর সুঈফট-এর লেখার কায়দা কৌশলের অন্ধের মতো অনুকরণ করতে গিয়ে, মি. উইলমার নিজের যথেষ্ট সৃষ্টির ক্ষতি করেছেন। এমন একটা কাজের মাধ্যমে তিনি কেলেঙ্কারী করে বসেছেন তা আর কহতব্য নয়।

যা বলা দরকার তা স্পষ্ট আর খোলসা করে বলা যাক। বক্তব্য স্পষ্ট না হলে ধন্ধ তো থেকে যাবেই। তবে যা শোভন নয়, পাঁচজনে যাকে নোংরা আখ্যা দিয়ে থাকে, তাকে যেন কখনই কল্পনায় স্থান দেওয়া না হয়, আর বক্তব্যের মধ্যে টেনে আনা তো অবশ্যই উচিত নয়।

একটা কথা স্বীকার না করলে দ্য কোয়ান্স অব হেলিকন কাব্যের প্রতি অবিচারই করা হবে। কথাটা হচ্ছে, মি. উইলমার অন্যের পথ অনুসরণ করলেও তার কাব্যটির মাধ্যমে বহু অপ্রিয় সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু বর্তমান সমাজে এ রকম কাজ ক্ষতিকর, লেখকের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর তো অবশ্যই। তাই মি. উইলমার প্রথম সৎসাহস আর যোগ্যতার অধিকারী বলেই তো আমরা তাকে উৎসাহ দান করতে গিয়ে বলব–চালিয়ে যান ভাই, লেগে থাকুন।

আমি আবারও বলছি–একবার নয়, হাজারবারও বলতে পারি, মি. উইলমার তার কাব্যে যা-কিছু বলেছেন তার শতকরা একশো ভাগই সত্যি। আর এই যে বলাম, তার প্রতিবাদ কে-ই বা না করবে, বলুন? আমরা? সাহিত্যজীবিরা?

আর ধ্য?! সাহিত্যজীবিদের চরিত্রে কথা আর না-ই বা বললাম। আমরা প্রত্যেকে এক একজন ধান্দাবাজ। আমাদের কথারই ঠিক নেই, কখন যে কি বলি নিজেরাই ভালো জানি না। আমরা এখন এ-কথা বলছি, পরমুহূর্তেই আবার কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলছি।

কেবল কথার মারপ্যাঁচের ব্যাপারটার কথাই বা বলি কেন? সম্প্রদায়, উপ সম্প্রদায় আর গোষ্ঠীর ব্যাপারটা? এ সবের যন্ত্রণায় কে না কাতড়ে মরছে–ভুগছে, বলুন তো?

আর একটা সে সর্বজন বিদিত প্রবঞ্চন, চাতুরি আর এড়ে তর্কের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে উঠে যাওয়া যে অনেক সহজ কাজ। কিন্তু বলুন তো, সাহিত্যিক প্রতিভার সাহায্যে সাহিত্য সৃষ্টি করার চেয়ে এরকম ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করার প্রবণতা কি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে না? বরং বলা চলে, এ দোষ সংক্রামক রোগের মতো কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

আবার এও তো মিথ্যা নয়, সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে বসে রয়েছে। বইয়ের সমালোচকদের কথা বলতে চাচ্ছি। বইয়ের সমালোচনার মধ্যে পুরো দুর্নীতি রয়েছে। বলুন, আমার বক্তব্যকে কেউ নস্যাৎ–অস্বীকার করতে পারবেন?

আমি আরও দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি, প্রকাশক আর সমালোচকদের মধ্যে বর্তমানে এক গোপন ও অশুভ আঁতাত চলেছে। এটা সর্বজন বিদিত আর নোংরামিটাও হয়ে পড়েছে সার্বজনীন।

টাকা! সবই টাকার খেল ভাই! ধাপ্পা দিয়ে টাকা রোজগার করা প্রবৃত্তিটা বর্তমানে যেন মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। ব্ল্যাকমেল করে টাকা কামানোর সময় কি কারো চোখের পাতা কি এতটুকুও কাঁপে, আপনিই বলুন তো ভাই? একে ঘুষ ছাড়া অন্য কোন মানানসই নামে সম্বোধন করা যায় কি?

ব্ল্যাকমেলের মাধ্যমে সর্বনাশ হচ্ছে কাদের? আমি কিন্তু বলব, পাঠক-পাঠিকা, ক্রেতা আর বিক্রেতা–সবার। হ্যাঁ, সবারই সমান ক্ষতি হচ্ছে।

কেউ যদি খুবই বিশ্রিভাবে সত্য এ ঘটনাকে পাত্তা না দেন, তাচ্ছিল্যভরে হেসে উড়িয়ে দিতে চান তবে আমরাই কিন্তু হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাবার যোগার হব। তবে এও সত্য যে, এর মধ্যে কিছু মহৎ ব্যতিক্রম আছেই আছে।

আর একটা কথা মনে রাখবেন, কিছুসংখ্যক সম্পাদক আছেন যারা কারো উমেদার নন, কারো তাবেদারী করার ধার ধারেন না। নিজের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে তাদের কলম এতটুকুও কাপে না। তারাই সত্যিকারের মনে-প্রাণে স্বাধীন।

প্রকাশকদের কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নেওয়া তো দূরের কথা, এমনকি বই পর্যন্ত নেন না। তবে তারা বই নিলেও আগে থেকেই পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দেন, তাহলে সমালোচনা অবশ্যই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হবে।

তবে এও খুবই সত্য যে, এরকম সম্পাদকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে কারা সংখ্যায় বেশি? অসাধু বই প্রকাশক আর যারা ধারে বই পড়তে দেয় এমন বইয়ের দোকানদাররা। তারাই এমন অদ্ভুত কৌশলে মিথ্যা জনমত তৈরি করে ফেলেছেন যার ফলে সত্যি কথা পাত্তা পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সত্যি কথার চেয়ে মিথ্যায় ভরা সমালোচনাই বেশি কদর পেয়ে থাকে।

বহু তিক্ততায় ভরা মনে এরকম ভর্ৎসনা করতে বাধ্য হচ্ছি। অন্তরের অন্তঃস্থল তিক্ত অভিজ্ঞতায় কানায় কানায় ভর্তি। উদাহরণ উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি না। কারণ, যে কোন বই খুলে দু-চার পাতা পড়লেই নিজেই উদাহরণ পেয়ে যাবেন।

ভাষায় অপূর্ব কৌশল আর মিথ্যার ফুলঝুড়ি দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যাপারটা বর্তমানে বাজার ছেয়ে গেছে। কথার কায়দা আর ছাপার কৌশল অবলম্বন করে দিনকে রাত, আর রাতকে একেবারে দিনে পরিণত করে দেওয়া হচ্ছে।

আশা করি খোলসা করে না বললেও চলবে, এরকম মন-ভোলানো বিজ্ঞাপন প্রকাশকরা ছাপছেন।

বর্তমানে বিজ্ঞাপনের আরও একটা পদ্ধতি বাজারে চালু হয়েছে। চোখেও পড়ে প্রচুরই। বেতন ভুক্ত কর্মচারীদের দিয়ে মন্তব্যযুক্ত বিজ্ঞপ্তি বইয়ের পুস্তণিতে সেঁটে অগণিত পত্র-পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর প্রকাশকরা তো বহু আগে থেকেই তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন। আসলে তারা যে প্রকাশকদের দ্বারা উপকৃত। তাই তাদের হয়ে কাজ করতে তো কুণ্ঠিত হবার কথা নয়।

তবে আশার কথা এই যে, কিছু সংখ্যক পত্র-পত্রিকার পাতায় এ অসাধু কাজের প্রতিবাদ করে লেখা ছাপা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, তাদের কলম প্রতিবাদে আরও অনেক বেশি সোচ্চার হয়ে উঠবেন, আরও কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাবেন। তারা যা করছেন বা করবেন সবই সাহিত্যের মঙ্গল কামনা করেই করবেন, সন্দেহ নেই।

যে সব ভদ্রমহোদয় আমাদের পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন, তারা প্রত্যেকেই মনে-প্রাণে সত্য আর সতোর পক্ষাবলম্বন করেই লড়ে যাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্য সুমহান এ বিষয়ে সন্দেহের তিলমাত্রও অবকাশ নেই। অতএব এটুকু আসা অবশ্যই করা যেতে পারে যে, এ লড়াই-এ ফল ভালো হতে বাধ্য।

যেসব প্রতিভাবান সাহিত্য সেবী ও সাহিত্য জীবিরা গোষ্ঠী-ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পড়ে কোরবাণির পশুর মতো জবাই হচ্ছেন তাঁরা ওই সতোর লড়াইয়ের ফলে যে উপকৃত হবেনই, সন্দেহ নেই।

এসব প্রতিভাবান সাহিত্যিকরা ভুগছেন কেন? এর কারণ একটাই, এরা গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে না চলার জন্য যদি তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ-ওঠাবসা করতেন, তাদের মেজাজ মর্জির মূল্য দিয়ে চলতেন তবে মত্তকা যে অবশ্যই লুটতে পারতেন এতে আর সন্দেহ কি?

তবে আর বেশি দূরে নয়, অচিরেই এমন একদিন আসবেই আসবে, যেদিন প্রতিভাবান সাহিত্যসেবী আর সাহিত্যজীবিদের মতামতকে সবার ওপরে স্থান দেওয়া হবে। আর তাদের সে মতামত কলমের জোরেই নিজের স্থান করে নেবে, ভাওতাবাজীর মাধ্যমে অবশ্যই নয়। সম্প্রতিকালেই সে প্রমাণ কম-বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অতএব সে শুভ মুহূর্তকে স্বাগত জানাবার জন্য আমাদের ধৈর্য ধরে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সদ্য প্রকাশিত বইয়ের মামুলি সমালোচনা সমৃদ্ধ বিজ্ঞপ্তি দেখে না হেসে পারা যায় না। এর চেয়ে বেশি হাসির খোরাক অন্য কিছুর মাধ্যমে মিলবে কি? আমি তো বলব, অবশ্যই না।

যিনি সামান্যতমও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি, আবার সামন্যতম বিদ্যা-বুদ্ধিও নেই, ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো তার মস্তিষ্কও তেমন প্রখর নয়, আর সময়ের অভাব যাকে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত করে রাখে, এরকম একজন সম্পাদক জগতের কাছে নিজেকে অক্লেশে জাহির করতে আগ্রহী এভাবে যে, তিনি নাকি প্রতিদিন কাড়িকাড়ি সদ্য প্রকাশিত বইপত্র পড়াশোনা করছেন আসলে যাদের দশভাগের একভাগ টাইটেল পেজও তিনি পড়া তো দূরের ব্যাপার, পাতা উলটে পর্যন্ত দেখেননি, যে সবের চার ভাগের তিন ভাগের বিষয়বস্তু তার কাছে হিরু লেখা পড়ার মতোই দুর্বোধ্য, আর যাদের পুরো আয়তন মাসে দশ বা বড় জোর বারোজন পাঠক পাঠিকা চোখে দেখর সৌভাগ্য লাভ করেন।

তিনি কীভাবে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবটা পূরণ করে নেন, বলতে পারেন? বলছি শুনুন, হীনভাবে অনুগত থেকেই সেটা পূরণ করে নেন। আর সময়ের টানাটানিটা? গরম মেজাজ দেখিয়ে সেটা পূরণ করেন।

পৃথিবীতে যেসব মানুষকে সবচেয়ে সহজে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি, তাদের মাথার ওপরে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন।

নোয়া ওয়েবস্টার-এর পঞ্জিকার মতো ইয়ামোটা অভিধান থেকে শুরু করে টম থাম্ব-এর প্রকাশিত সর্বশেষ ডায়মন্ড সংস্করণ পর্যন্ত তর অন্তরের অন্তঃস্থলে পুলকের সঞ্চার ঘটায় আর তিনি পঞ্চমুখে প্রশংসায় মেতে ওঠেন।

কিন্তু তার অসুবিধা বলতে একটাই। কি সেটা? আনন্দে মশগুল হয়ে পড়লেও সে আনন্দ-উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করার মতো জিহ্বা তার নেই। তাই ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরা ছাড়া অন্য কোন পথই তার সামনে খোলা নেই। তার কাছে প্রত্যেক বই-ই একটা অত্যাশ্চর্য কাণ্ড বিশেষ।

আর বোর্ড-বাঁধাই প্রতিটা বই একটা করে নতুন যুগ হিসেবে গণ্য হয়। আর একারণেই দিন দিন তার কথামালা ফুলেফেঁপে ক্রমে বেড়েই যেতে থাকে।

এতকিছু সত্ত্বেও সাধারণ পাঠক-পাঠিকা এবং বিদেশিরা ঠিক ঠিক তথ্য লাভের প্রত্যাশা নিয়ে হালকা ধরনের সাময়িক পত্রিকায় হাত না দিয়ে ভারি সাময়িক পত্রিকাই হাতে তুলে নেন।

আর ত্রৈমাসিক পত্রিকার অসংলগ্ন যেসব লম্বাচওড়া বক্তিমে ছাপা হয় সে সব যে কতখানি বস্তাপচা তা নিয়ে মিছে কথা বাড়ানোর সামান্যতম ইচ্ছাও আমার নেই। কেবলমাত্র একটা কথাই বলতে চাচ্ছি, প্রবন্ধগুলোর শীর্ষে লেখকের নাম ছাপা হয় না।

এমন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবন্ধগুলোতে লেখকের নাম যখন ছাপা থাকে না তখন সেটা কার লেখা বোঝার উপায় কি? কার নির্দেশেই বা এগুলো লেখা হয়েছে বা হচ্ছে? ব্যক্তিগত আক্রোশ যাদের বুকে জমা রয়েছে বা স্তুতিবাদের মতলবে রচিত এ অপবাদে পূর্ণ বা সুখ্যাতিতে পূর্ণ বিশাল জোরদার ভাষণে নিতান্ত গাধা ছাড়া আর কেউ আস্থা রাখে, নাকি কারো পক্ষে আস্থা রাখা সম্ভব?

এবার বলছি পেশাদার সমালোচকদের কথা–তারা কোনো কাহিনীর ভেতরে ঢোকে না, ঢোকার চেষ্টাও করে না। তারা ওপর ওপর অর্থাৎ মামুলি বক্তব্য লিখতে অভ্যস্থ। সে জন্য তাদের একমাত্র শব্দের ওপরই নির্ভরশীল হতে হয়। শব্দকে বহুভাবে ব্যবহার করে নিজেদের মনের ভাব ব্যক্ত করাই তাদের উদ্দেশ্য।

তাদের নিজস্ব, মৌলিক ধারণার সংখ্যা নিতান্তই কম। খুব বেশি হলেও মাত্র দুটো। তারা সেটুকু গুছিয়ে মনের ভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেলেন। আর তারা সোজা কথাকে স্পষ্টভাবে বলা পছন্দ করে না, পারে না। বরং বলা চলে, এ কাজকে তার দুনীর্তি বলেই মনে করেন। আরও আছে, লিখতে বসে নিষ্ঠার সঙ্গে একের পর এক ধাপ অগ্রসর হওয়ার পন্থা এদের জানা নেই। লিখতে আরম্ভ করেই দুমকরে মাঝখানে চলে যান, নইলে পিছন-দরজা দিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে যান আর তা যদি না-ও করেন তবে বিষয়বস্তুকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরেন।

আর তারা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি আর দক্ষতাকে তুলে ধরতে গেলে জ্ঞানের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে এমন অসহায়ভাবে কাতড়াতে থাকেন যেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথের হদিস পান না।

পাঠক-পাটিকা তাদের লেখা সামনে খুলে বসে, কয়েক পাতা উলটে আদ্যিকালের কায়দা-কৌশল দেখে আতঙ্কে মুষড়ে পড়েন, শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে দুম্ করে বইটা বন্ধ করে দিয়ে যেন দম ফেলে বাঁচেন। পাঠক-পাঠিকা বইটা বন্ধ করে যেন দুর্বিষহ যন্ত্রণার হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেল, এমন ভাব তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যেসব সমালোচনা পত্র-পত্রিকার পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়, সেগুলোকে যদি নির্ভেজাল সত্য বলে ধরে নেই, তবে তো স্বীকার না করে উপায় নেই যে, আমেরিকানদের মতো হিংসা করার উপযুক্ত জাত পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই।

আমাদের দেশের আকাশে-বাতাসে সর্বত্র প্রতিভাবান ব্যক্তিরা ধুকপুক করছেন, আমেরিকানরা সে বাতাসে শ্বাসকার্য চালিয়ে হাইফাই করছে। আমরা সর্বশ্রেষ্ঠের ঝোলায় নিজেদের আবৃত করে রেখেছি।

আমাদের কবিদের মধ্যে সবাই মিলটন আর আমাদের সব লেখকই ক্রিকটন বা তাঁর প্রেতাত্মা।

স্বীকার করছি, নিজেদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে এমন করে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করাটা মোটেই সঙ্গত হচ্ছে না। গ্যাস খেয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠাটা কিন্তু আনন্দ ফুর্তির ব্যাপার নয়। তাতে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। এ অভ্যাসটা যে নিন্দনীয় এতে কিছুমাত্রও আশ্চর্যের নয়। বর্তমানে এটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মনেও চাঙা হয়ে উঠছে। তারা এটাকে মোটেইনিন্দনীয় মনে করছে না বলেই এমন কাজে মেতে উঠতে দ্বিধা করছে না।

যাক, অনেক প্যাচালই তো পাড়া হলো। এবার না হয় ওসব প্রসঙ্গ ধামা চাপা দিয়ে আবার মি. উইলমারের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি।

আমি তো আগেই বলে রেখেছি, ব্যঙ্গাত্মক এ কবিতায় ত্রুটি অনেকই আছে। তবে আগে যা-কিছু বলেছি তার সঙ্গে এখন নতুন কিছু তথ্য যোগ করছি।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মি. উইলমারের লেখা বইয়ের নামটা আরও স্পষ্ট কোনো নাম ব্যবহার করা দরকার ছিল। কিন্তু যে নামটা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে চলে যাবে।

আমেরিকান আনাড়িদের নিয়েই কেবল খুশিতে মশগুল হয়ে থাকেনি, সময়মত তাদের কুপোকাত করতেও ছাড়েনি।

শেষ দুটো ছত্র, শেষের বক্তব্যকে সুদৃঢ় না করে বরং দুর্বলই করেছে।

সত্যি কথা বলতে কি, যদি এ ছত্র দুটো লেখা না হত তবে বক্তব্য কিন্তু খুবই দৃঢ়–জোরদারই হত।

মি. উইলমার অন্যের কবিতা অনুকরণ করতে গিয়েও সর্বনাশের চূড়ান্ত করে ছেড়েছেন। তিনি যেভাবে অস্ত্রোপচার করেছেন তাতে মনে হবে যেন সমালোচক তার বগলদাবায় ধরা রয়েছেন। আসলেও কি তা-ই?

তবে কথাটা কিন্তু মিথ্যা নয়, বিচার-বিবেচনা বোধহীনের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। তবে আমাদের মাথায় তো কিছু না কিছু ঘিলু তো অবশ্যই আছে, মাথায় গোবর পোরা তো আর নয় যে, কাণ্ডজ্ঞান একেবারে হারিয়ে বসেছি। আবার মি. উইলমারের কবিতায় যে ভাব প্রকাশ পেয়েছে–সত্যিকারের শয়তানও নই।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, সভ্যদেশে অসভ্যের মতো হাত-পা ছোঁড়া অবশ্যই সঙ্গত নয়।

মি. মরিম-এর কথা যদি আলোচনা করা যায় তবে স্বীকার করতেই হবে, তিনি ভালোই গান লিখেছেন।

আবার মি. ব্রায়ান সম্পর্কে বলতে গেলে একটা কথা অবশ্যই বলা দরকার তিনি নির্বোধ নন–আহাম্মকের শিরোমণি। তাকে অবশ্যই বলা যাবে না।

মি, উইলিসকে একটা নিরেট আহাম্মক মনে করা যেতে পারে। আর মি. লঙলেখো? তিনি চুরিবিদ্যাটা খুব ভালোই রপ্ত করেছেন। চুরি না করে তার পক্ষে থাকা। কিছুতেই সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, চুরিটুরির কথা তো আমরা আগেই বহুবার, বহুভাবেই শুনেছি।

মি. উইলমারের কাজের বিচার করতে বসে একটা কথা অবশ্যই বলা যেতে পারে, তিনি বেশ কয়েক স্থানে মাত্রাজ্ঞান জলাঞ্জলি দিয়েছেন। বিভেদরেখা সম্বন্ধে হিসাব তাঁর ছিল না বলেই অবলীলাক্রমে সেটা অতিক্রম করে ফেলেছেন। তিনি কলমকে এমনভাবে বেঁকিয়ে ধরেছিলেন যার ফলে সহজ-সরল আর একেবারে স্পষ্ট ছবিটাও বিকৃত হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে আর যাই হোক না কেন, তাঁর ধীশক্তি, তাঁর সাহসিকতা, তার স্পষ্ট কথা খোলাখুলিভাবে বলার প্রবণতা, তর পরও বর্তমান কাব্যগ্রন্থের নিখুঁত ছক-পরিকল্পনার জন্য তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করা যেতে পারে। আর এ প্রশংসা পাবার অবশ্যই তিনি যোগ্য।

সকল অধ্যায়

১. দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল
২. ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম (উপন্যাস)
৩. দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ
৪. ফোর বিস্টস্ ইন ওয়ান দ্য হোম–কেমলোপার্ড
৫. বেরোনিস
৬. দ্য পারলয়েন্ড লেটার
৭. দ্য ডেভিল ইন দ্য বেলফ্রাই
৮. দ্য গোল্ড-বাগ
৯. লিজিয়া
১০. দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার
১১. শ্যাডো–এ প্যারাবল
১২. দ্য ডোম্যাইন অব আর্নহিস
১৩. দ্য আর্ট দ্য ম্যান
১৪. ইলিওনোরা
১৫. দ্য ওভাল পর্ট্রেইট
১৬. ভন কেমপেলেন অ্যান্ড হিস ডিসকভারি
১৭. নেভার বেট দ্য ডেভিল ইয়োর হেড
১৮. এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস
১৯. দ্য প্রিম্যাচিওর বেরিয়াল
২০. দ্য কাস্ক অব অ্যামন্টিলাডো
২১. মেজেংগারস্টিন
২২. মাইলেন্সে ফেবল
২৩. থ্রী সানডেস ইন এ উইক
২৪. দ্য ওবলঙ বক্স
২৫. উইলিয়াম উইলসন
২৬. দ্য টেল-ট্যালি হাট
২৭. মেনাস্ক্রিপ্ট সাউন্ড ইন এ বটল
২৮. দ্য অ্যাসাইনমেন্ট
২৯. এ ডিসেন্ট ইন টু দ্য ম্যায়েস্ট্রোম্
৩০. দ্য পাওয়ার অব ওয়ার্ডস
৩১. দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মার্গ
৩২. দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড
৩৩. লিওনাইসিং
৩৪. মোরেল্লা
৩৫. হপ ফ্রগ
৩৬. দ্য স্ফিংস
৩৭. এ টেল অব জেরুজালেম
৩৮. দ্য বেলুন-হোয়্যাক্স
৩৯. সেই বেলুনের কাহিনী
৪০. ডাইরির পাতা থেকে
৪১. ফোর বীস্টস ইন ওয়ান
৪২. দ্য কনভারসেসন অব ইরোজ অ্যান্ড চারমিয়ান
৪৩. দ্য ফ্যাকটস ইন দ্য কেস অব মি. ভালডিমার
৪৪. ইম্প অফ দ্য পারভাস
৪৫. লন্ডস কটেজ
৪৬. ডিডলিং
৪৭. দ্য সিস্টেম অব ডক্টর টার অ্যান্ড প্রফেসর ফেদার
৪৮. লস অব ব্রিদ
৪৯. দ্য স্পেকট্যাকল
৫০. মেসমেরিক রেভেল্যেশন
৫১. দ্য কোয়াকস অব হেলিকন–এ স্যাটায়ার
৫২. ম্যাগাজিন রাইটিং পিটার স্নক
৫৩. দ্য ডিউক ভিলা ওমলেট
৫৪. দ্য ম্যান অব দ্য ক্রাউড
৫৫. সাইলেন্স-এ ফেল
৫৬. দ্য ম্যান দ্যাট ওয়াজ ইউজড আপ
৫৭. ফিলজফি অব ফার্নিচার
৫৮. দ্য লিটারারি লাইফ অব থিংগাস বব এসকোয়ার
৫৯. দ্য আয়ারল্যান্ড অব দ্য কে
৬০. অ্যাসটোরিয়া
৬১. শ্যাডো-এ প্যারেবল
৬২. এ টেল অব জেরুসালেম
৬৩. রিভিউ অব স্টিফেন্স অ্যারেবিয়া ট্রো
৬৪. বিজনেসম্যান
৬৫. বন-বন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন