ইলিওনোরা

অ্যাডগার অ্যালান পো

সবাই আমাকে পাগল বলে।

আসলে মাত্রাতিরিক্ত কল্পনা আর আবেগের জন্য সবার কাছে পরিচিত এক বংশে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। যাক গে, সবাই আমাকে পাগল বলেই সম্বোধন করে।

কিন্তু আজ অবধি তো একটা প্রশ্নে মিমাংসা হয়নি, যে, উন্মাদনাই কি মহত্তম বুদ্ধিবৃত্তি? আবার যা-কিছু গৌরবময়, যে সব সুদৃঢ়, সে সবকিছুই ব্যাধিগ্রস্ত চিন্তার মাধ্যমেই সম্ভব কি না, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির বিনিময়ে লাভ করা মনের একটা উদারতম ভাব থেকে সৃষ্ট কি না, এ প্রশ্নের মীমাংসা করা তো আজ অবধি সম্ভব হয়নি।

সমাজের যে সব মানুষ দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাদের পক্ষে এমন বহু কিছু অবগত হওয়া সম্ভব। যা যারা কেবলমাত্র রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাদের ধ্যান-ধারণার বহিভূত রয়ে যায়। দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে তাদের পক্ষে অনন্তের ক্ষণিক দর্শন লাভ করতে সক্ষম হয়।

ঘুম চটে গেছে তাদের অন্তর এ-কথা ভেবে কেঁপে ওঠে যে তারা এক সুমহান গভীর রহস্যের একেবারে কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ না হলেও খুব সামান্য

অংশের জন্য হলেও তারা জ্ঞানের এ-রূপকে কল্যাণময় বলেই উপলব্ধি করেছে। যা। আমরা সচরাচর জ্ঞান বলে দেখে থাকি তার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য। আর তাদের জ্ঞান যতই লাগামছাড়া হোক না কেন তারা কিন্তু এক অনির্বচনীয় অবর্ণনীয় আলোর এক সুবিস্তীর্ণ মহাসাগরে প্রবেশ করেছে।

ঠিক আছে, আমি পাগল এটাই বলা হোক। আমি অন্তত এটুকু স্বীকার করে নিচ্ছি। যে, আমার মনের দু-দুটা পৃথক অবস্থা বর্তমান। একটা পরিষ্কার যুক্তির অবস্থা, যাকে বলব আমার প্রথম-জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনার স্মৃতিগুলো তার সাক্ষ্য বহন করছে, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে অনুমান, সন্দেহ আর ছায়া ছায়া অবস্থা যা বর্তমান আর জীবনের দ্বিতীয় অবস্থা স্মৃতিগুলো। অতএব আমার জীবনের প্রথম অবস্থার কথা যা-কিছু আপনাদের সামনে তুলে ধরব সে সবই কিন্তু বিশ্বাস করবেন। আর দ্বিতীয় অধ্যায় সম্বন্ধে যা-কিছু বলব তাদের যথাযোগ্য প্রাপ্য বিশ্বাসটুকু দিতে কার্পণ্য করবেন না। আর তা যদি না ই সম্ভব হয় তবে সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে সন্দেহের চোখে দেখবেন, আপত্তি নেই। আর যদি তা নিতান্তই সম্ভব না হয় তবে ইডিপাস রহস্যকে নিয়ে খেলায় মেতে থাকবেন, কেমন?

এবার আমার মনের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি–যৌবনে যাকে আমি অন্তরের ভালোবাসা নিঙড়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম, যার কথা ও কাহিনী নিয়ে এ স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি, শান্ত-স্বাভাবিক আর স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করছি, সে আমার বহুদিন আগে পরলোকগতা মাতৃদেবীর একমাত্র বোনের একমাত্র কন্যারত্ন।

সে বোনের নাম ছিল ইলিওনোরা। আর এ নামেই তাকে সবাই সমোধন করে। আমরা প্রায় প্রতিটা মুহূর্ত একসঙ্গে পরস্পরের পাশাপাশি-কাছাকাছি অবস্থান করতাম। তৃণাচ্ছাদিত উপত্যকায় গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্যরশ্মির নিচে আমরা উভয়ে একত্রে কাটিয়েছি। সেটা ছিল এমনই একটা উপত্যাকা যেখানে পথপ্রদর্শক ছাড়া কেউ একা কোনোদিন যায়নি। এরও কারণ আছে যথেষ্টই। কারণ স্থানটা সুউচ্চ একটা পর্বতমালার কেন্দ্রে অবস্থিত। আর তার ভালোলাগা কথাগুলো মর্মরশ্মির প্রবেশাধিকার ছিল না।

আর! মানুষ চলাচলের কোনো পথ সে অঞ্চলটার কাছাকাছি দিয়ে এগিয়ে যায়নি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সে শান্তি-সুখের নীড়ে বনের ঝোঁপ ঝাড় গাছগাছালির কোনোটাকে দু হাতে সরিয়ে, না হয় কোনোটাকে ভেঙে তবেই যাওয়া যেত। আর লক্ষ লক্ষ সুগন্ধ ফুলকে দুপায়ে মাড়াতে হত। এ ভাবেই আমরা প্রতিদিন যাতায়াত করতাম। আমরা বলতে আমি, আমার বোনটা আর তার মায়ের কথা বলছি। আমরা এমনই সমাজ-সংসার থেকে দূরে, বহুদূরে একান্ত নির্জন-নিরালায় বাস করতাম। উপত্যকার বাইরেও সে এক বিশাল জগতের অস্তিত্ব রয়েছে তা আমাদের ধ্যান ধারণার বহির্ভূত ছিল।

আমাদের দেশটার চারদিক ঘিরে রেখেছিল যে পর্বতমালা, তারই শীর্ষদেশের এক স্থান থেকে উদ্ভুত একটা নদী পর্বত আর পার্বত্য বনাঞ্চলের গা-বেয়ে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে ছোট্ট একটা নদী নেমে এসেছিল। আবার ঘুরে গিয়ে পাহাড়ারের কোনো এক অজ্ঞাত অঞ্চলে সেটা হারিয়ে গেছে। একমাত্র ইলিওনোরার চোখের মণি দুটো ছাড়া আর সবকিছুর চেয়ে স্বচ্ছ ছিল তার জলরাশি।

আমরা সে নদীটাকে নিঃশব্দের নদী বলে সম্বোধন করতাম। কেন? কারণ, তার প্রবাহে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করত। আর আমরা যে নুড়ি পাথরগুলোকে খুবই ভালোবাসতাম সেগুলো পর্যন্ত নদীটার স্রোতের এক তিলও পড়ত না। গতিহীনতার জন্য সন্তুষ্ট হয়ে তারা যে, যার জায়গায়ই নিশ্চল-নিথরভাবে পড়ে থেকে ঝকমক করত। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।

আমি আর আমার ভালোলাগা ইলিওনোরা–আমাদের অন্তরে প্রেমের আর্বিভাব ঘটার পনেরোটা বছর আগে আমরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে উপত্যকার সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে এখানে ওখানে কতই না ঘুরে বেরিয়েছি তার হিসেব নেই। তারপর আমার চতুর্থ পঞ্চাব্দ আর আমার তৃতীয় পঞ্চাব্দ যখন শেষ হতে চলেছে ঠিক তখনই আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে, বুকে জড়িয়ে ধরে সর্পিল গাছটার তলায় বসেছিলাম। সেখানে বসে নিঃশব্দের নদীটার পানিতে আমাদের চঞ্চল প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম। সে বহু আকাক্ষিত, মধুর দিনটায় অবশিষ্ট সময় আমরা কেউ-ই কারো সঙ্গে একটা কথাও উচ্চারণ করিনি।

পরের দিনও আমাদের মধ্যে আবেগের গুটিকয়েক কথা হয়েছিল। নদীর ঢেউয়ের এপাড় থেকে আমরা প্রেমের দেবতা এরবসকে তুলে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে স্থান। করে দিয়েছিলাম।

এবার এতদিন পর আমরা উভয়েই উপলব্ধি করেছিলাম প্রেমের দেবতা এরস্‌ আমাদের বুকে পূর্বসূরিদের অগ্নিময় আত্মাকে অত্যুজ্জ্বল দ্যুতিময় করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রায় একশো বছর ধরে সে আবেগ-উচ্ছ্বাস আমাদের বংশের বৈশিষ্ট্যতার সঙ্গে এসে গাঁটছড়া বাঁধল নির্ভেজাল শিল্প না বিলাস, যাতেও আমাদের বংশের নাম ডাক যথেষ্টই ছিল।

একদিন সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল, পুরোপুরি বদলে গেল। কোনোদিন যে সব গাছে ফুল ফোটেনি সে সব গাছে তারার মতো অদ্ভুত উজ্বল ফুল দেখা দিল। সবুজ গালিচার মতো প্রান্তর ক্রমে ঘনতর হতে লাগল। ডেইজি ফুলগুলোর জায়গা দখল করল রক্তিম এসকোডাল। আমাদের জীবন চাঞ্চল্যে ভরে গেল। সে সুবিশাল চক্রবাক পাখি এক সময় চোখেই পড়ত না সেও খুশিতে ডগমগ পাখিদের সঙ্গী করে আমাদের চোখের সামনে পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল। সোনালি আর রূপালি মাছের ঝাঁকে নদীটা ভরে গেল। নদীর বুক থেকে এমন একটা সুর উঠে এসে ঘুম পাড়ানি সুর হয়ে আমার কানে বাজল, যা ইয়োলুস-এর বীণার চেয়ে স্বর্গীয় হয়ে উঠল। কেবলমাত্র ইলিওনোরা-র কণ্ঠস্বর ছাড়া অন্য কোনো সুর এমন মধুর নয়, কিছুতেই নয়। সে মুহূর্তে আমার মনে হল, আমরা বুঝি চিরদিনের জন্য আড়ম্বরপূর্ণ এক যাদুর কারাগারে বন্দিত্ব বরণ করে নিয়েছি।

রূপসি তম্বী যুবতি ইলিওনোরা-র কোমল স্বভাবের তুলনা একমাত্র দেবদূতের সঙ্গেই চলতে পারে। তার অল্পদিনের জীবনটা ফুলের দেশেই কেটেছে বলে সে ছিল সত্যিকারের সহজ-সরলনিষ্কলঙ্ক কুমারি। কোনোরকম ফস্টিনস্টিই তার মনের ভালোবাসাকে ঢেকে রাখতে পারেনি।

বহু বর্ণের ঘাসের গালিচা বিছানো উপত্যকায় বেড়াতে বেড়াতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম, ইদানিং মধুর প্রেম আমাদের দুজনকে কতই না বদলে দিয়েছে। আমরা যেন এখানে নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনো লোকে অবস্থান করেছি।

শেষমেষ একদিন নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় চোখের পানি ঝরাতে ঝরাতে মানুষের জীবনের সর্বশেষ অনিবার্য পরিণতির প্রসঙ্গ উঠল। তারপর সেদিন, সে-মুহূর্ত থেকেই আমাদের যে কোনো প্রসঙ্গের কথাতেই এ বিষয়টা এসে পড়ত।

হায়! সে দেখতে লাগল, তার বুকের ওপর মৃত্যুর নিষ্ঠুর হাতটা তার বুকে চেপে বসেছে। ক্ষণজীবি পতঙ্গের মতো সে সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠেছে, কেবলমাত্র মৃত্যু আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করার জন্য। একটাই উদ্দেশ্য, মৃত্যুর হাতে নিজেকে তুলে দিতেই সে তৈরি হয়ে রয়েছে। মৃত্যুকেও না হয় বুক পেতে নেওয়া যায়, কিন্তু মাটির তলায় আশ্রয় চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া, মানে কবরকে সে খুব ভয় করে।

এক সন্ধ্যায় আলো-আঁধারির মুহূর্তে নিঃশব্দের নদীর তীরে কষ্ট দিচ্ছে যে, সবুজ গালিচা-বিছানো উপত্যকায় তাকে সমাধিস্থ করার পাট চুকিয়েই আমি এ শান্তি সুখের। আবাসস্থল থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেব। আর অন্য কোনো কুমারিকে তার প্রতি । আমার অন্তরের পুঞ্জীভূত প্রেমকে নিবেদন করব।

তার কথাটা শেষ হতে না হতেই আমি ইলিওনোরা-র পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে তার আর পরম-পিতার নামে শপথ করেছিলাম, পৃথিবীর কোনো মেয়েকেই আমি পত্নীরূপে গ্রহন করব না। আমার সে পবিত্র শপথের সাক্ষী রইলেন সর্বশক্তির আধার সে পরম পিতা।

তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে আমি সে মুহূর্তে এও শপথ করেছিলাম, আমি যদি কোনো পরিস্থিতিতে এ শপথ ভঙ্গ করি, তবে যেন পরম পিতার অভিশাপ আমার মাথায় যেন নেমে আসে।

আমার কথায় ইলিওনোরা-র চোখের তারা দুটো অত্যুজ্বল হয়ে উঠল। সে অকস্মাৎ এমন এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মনে হলো তার বুকের ওপর থেকে পাকাপাকিভাবে অতিকায় একটা পাথর নেমে গেল। তার সর্বাঙ্গ থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল, তা সত্ত্বেও আমার শপথবাক্যকে খুশি মনেই বুকে ঠাই দিল। মৃত্যুশয্যাও ক্রমে তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে এলো।

সে ঘটনার মাত্র কয়দিন পরেই শান্ত-স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়ে সে আমাকে বলল, তার তৃপ্তির জন্য সেদিন আমি যা-কিছু বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তার বিনিময়ে কবরে আশ্রয় নেবার পরও সে প্রতিটা মুহূর্ত আমার ওপর দৃষ্টি রেখে চলবে। আর যদি সম্ভব হয় তবে রাতে সে অবয়ব ধারণ করে আমার কাছে উপস্থিত হবে। তবে পরলোকগত আত্মার পক্ষে তা যদি নিতান্ত অসম্ভব হয় তবে সে ইঙ্গিতে মাঝে মধ্যেই তার উপস্থিতির কথা জানাবে। তার দীর্ঘশ্বাস সন্ধ্যার বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে আমার দেহকে স্পর্শ করবে, নতুবা আমার প্রশ্বাসের বাতাস সুগন্ধময় করে তুলবে। এ কথাগুলো উচ্চারণ করতে করতে সেনিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক উৎসর্গ করে দিল।

এভাবেই আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়টার পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। শেষ! সব শেষ!

এ পর্যন্ত আমি যা-কিছু বলেছি সবই বিশ্বস্ততায় ভরপুর, এতটুকুও খাদ নেই।

কিন্তু আমার অন্তরাত্মার মৃত্যু আমার জীবনে যে বিচ্ছেদের প্রাচীর গড়ে তুলেছে তাকে অতিক্রম করে আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রসঙ্গে উত্থাপন করতে গিয়েই আমি অনুমান করছি, আমার মাথার ওপর ঘন কালো একটা ছায়া ঘনিয়ে আসছে আর আমার এ বিবরণীর পূর্ণ সত্যতার ব্যাপারে আমি আস্থাও হারিয়ে ফেলছি।

সে যা-ই হোক না কেন, আমাকে যে মুখবুজে থাকলে চলবে না, আমার যে না বলে উপায় নেই।

আমার আড়ম্বরহীন ক্লান্ত বছরগুলো একটার পর একটা করে পেরিয়ে যেতে লাগল।

আমি তখনও বহু বর্ণের ঘাসের গালিচা বিছানো উপত্যকায় বসবাস করছি। কিন্তু আমার চারদিকের সবকিছুতেই দ্বিতীয় পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেউপত্যকার সবুজ ঘাসের গালিচার রং ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে এসেছে। তারা ফুলগুলো আর ফোটে না, গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। রক্তাভ এসকোডেল ঝরে পড়তে পড়তে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কালো চোখের মতো ভায়োলেট ফুলের থোকা তার স্থান দখল করেছে। অতিকায় ফ্লেমিঙ্গো পাখিটা আর আমার চোখের সামনে দিয়ে লোহিত বর্ণের ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় না। সে উপত্যকাটা ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

আর সেই বীণার সুরের চেয়ে মৃদুমন্দ ইয়োলুসের বাতাস–একমাত্র ইলিওনোরার কণ্ঠস্বর আর যাবতীয় সুরের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি স্বর্গীয়, তা-ও ক্রমে মিলিয়ে যেতে যেতে নিঃশেষ হয়ে গেল।

সব শেষে সে ঘন পুঞ্জীভূত মেঘও এক সময় পাহাড়ের শীর্ষদেশগুলোর আশ্রয় ছেড়ে সন্ধ্যাতারার দেশে পাড়ি জমিয়েছে, আর যাবতীয় রূপ-সৌন্দর্যকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল।

এতকিছু সত্ত্বেও ইলিওনোরা কিন্তু তার শপথ ভুলে যায়নি। উপত্যকার ওপর দিয়ে পবিত্র সুগন্ধে ভরপুর একটা ঢেউ বয়ে চলল। বহু নির্জন ক্ষণে বহু দীর্ঘশ্বাস বাতাসের সঙ্গে ভর করে আমার দুটোকে স্পর্শ করে যায়। শন শন ধ্বনিতে রাতের বাতাসকে ভরিয়ে তোলে। একটা বার, মাত্র একবার হায়! আর মাত্র একবার! তার দুটো অতীন্দ্রিয় ঠোঁট আমার ঠোঁট দুটোকে স্পর্শ করে আমার মৃত্যুর মতো গভীর ঘুমকে চটিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু হায়! আমার বুকের হাহাকার আর হা-হুঁতাশ মিলিয়ে গিয়ে শূন্যতার তাতেও পূর্ণ হলো না। আমাকে এক সময় যে প্রেম ভাসিয়ে এক অচিন দেশে নিয়ে যেত, সে প্রেম ভালোবাসার জন্য আমি চাঞ্চল্য উপলব্ধি করতে লাগলাম।

শেষপর্যন্ত আমার পরিস্থিতি এমন হলো যে, ইলিওনোরা-র স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে উপত্যকার আশ্রয় আমার কাছে বিষাদক্লিষ্ট হয়ে দাঁড়াল।

অনন্যোপায় হয়ে একদিন বিশ্বের অসার বস্তু আর হৈহুল্লোড়মুখর জয়ের সন্ধানে চিরদিনের জন্য সে উপত্যকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এলাম।

দীর্ঘদিনের পরিচিত পাহাড়, জঙ্গল আর উপত্যকার সম্পর্ক ত্যাগ করে বিচিত্র এক । শহরে এসে মাথা গুঁজলাম। সেখানকার কোলাহলমুখর পরিবেশ, চাকচিক্য আর আনন্দ সূৰ্ত্তি হয়তো আমার মধ্য থেকে উপত্যকার স্বপ্নরাজ্যকে নিঃশেষে মুছে দিতে পারত। রাজ-দরবারের জৌলুস নারীদের সম্মোহিনীরূপ সৌন্দৰ্য্য আমার মন-প্রাণ-যাবতীয় সড়াকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলল। তবে আমার মন কিন্তু তখন অবধি তার শপথের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে চলেছে। তখনও রাতের অন্ধকারে, নিস্তব্ধতায় ইলিওনোরার উপস্থিতির ইঙ্গিত অনুভব করে চলেছি।

অকস্মাৎ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। সে জ্বালাময়ী চিন্তা-ভাবনা আর ভয়ঙ্কর প্রলোভন আমাকে চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরল। তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে আমি আতঙ্কে মুষড়ে পড়লাম।

ব দূর, বহু দূরবর্তী এক অজানা অচেনা দেশ থেকে এক রূপসি যুবতি আমার দরজায় উপস্থিত হল। ব্যস, আমার ভীরু মন-প্রাণ সে মুহূর্তেই তার রূপের ডালির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দিলাম।

হ্যাঁ, সত্যি বলছি, ভালোবাসার এক আকুল লঘু ও ঘৃণ্য পূজার আবেগে উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে বিনাসংগ্রামে আমি তার চরণকমলে আত্মনিবেদন করে বসলাম।

হ্যাঁ, আমি তাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধলাম। আমি শপথ ভঙ্গের সে নির্মম অভিসম্পাত নিজে বেঁচে মাথায় পেতে নিয়েছিলাম, তাকেও পরোয়া করলাম না। তবে এও সত্য যে, আমার মাথায় কিন্তু অভিশাপ নেমে আসেনি।

আরও মাত্র একবার–এবার রাতের অন্ধকারে নিঝুম-নিস্তব্ধতায়–আমার জাফরির ফাঁক-ফোকড় দিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো যা আমাকে ভুলেছিল। সে দীর্ঘশ্বাস যেন কণ্ঠস্বরে পরিণত হল। সুপরিচিত মিষ্টি-মধুর স্বরে বলল, ঘুমোও শান্তিতে ঘুমোও। ব্যাপারটা এমন যে প্রেমের দেবতাই রাজ্য চালায়, তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে রাজ্যের প্রতিটা কাজকর্ম চলে। তোমার অন্তরের প্রেমের মধ্যে এই মেগার্ড নামের মেয়েটাকে তুমি আপন করে নিয়েছ, ভালোবেসেছ। তারই মাধ্যমে ইলিওনোরার কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা থেকে তুমি মুক্তি পেয়ে গেছ। কেন! কেন মুক্তি পেয়েছ তা অমরালোকে তোমাকে জানানো হবে, এখানে নয়–এখন নয়।

সকল অধ্যায়

১. দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল
২. ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম (উপন্যাস)
৩. দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ
৪. ফোর বিস্টস্ ইন ওয়ান দ্য হোম–কেমলোপার্ড
৫. বেরোনিস
৬. দ্য পারলয়েন্ড লেটার
৭. দ্য ডেভিল ইন দ্য বেলফ্রাই
৮. দ্য গোল্ড-বাগ
৯. লিজিয়া
১০. দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার
১১. শ্যাডো–এ প্যারাবল
১২. দ্য ডোম্যাইন অব আর্নহিস
১৩. দ্য আর্ট দ্য ম্যান
১৪. ইলিওনোরা
১৫. দ্য ওভাল পর্ট্রেইট
১৬. ভন কেমপেলেন অ্যান্ড হিস ডিসকভারি
১৭. নেভার বেট দ্য ডেভিল ইয়োর হেড
১৮. এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস
১৯. দ্য প্রিম্যাচিওর বেরিয়াল
২০. দ্য কাস্ক অব অ্যামন্টিলাডো
২১. মেজেংগারস্টিন
২২. মাইলেন্সে ফেবল
২৩. থ্রী সানডেস ইন এ উইক
২৪. দ্য ওবলঙ বক্স
২৫. উইলিয়াম উইলসন
২৬. দ্য টেল-ট্যালি হাট
২৭. মেনাস্ক্রিপ্ট সাউন্ড ইন এ বটল
২৮. দ্য অ্যাসাইনমেন্ট
২৯. এ ডিসেন্ট ইন টু দ্য ম্যায়েস্ট্রোম্
৩০. দ্য পাওয়ার অব ওয়ার্ডস
৩১. দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মার্গ
৩২. দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড
৩৩. লিওনাইসিং
৩৪. মোরেল্লা
৩৫. হপ ফ্রগ
৩৬. দ্য স্ফিংস
৩৭. এ টেল অব জেরুজালেম
৩৮. দ্য বেলুন-হোয়্যাক্স
৩৯. সেই বেলুনের কাহিনী
৪০. ডাইরির পাতা থেকে
৪১. ফোর বীস্টস ইন ওয়ান
৪২. দ্য কনভারসেসন অব ইরোজ অ্যান্ড চারমিয়ান
৪৩. দ্য ফ্যাকটস ইন দ্য কেস অব মি. ভালডিমার
৪৪. ইম্প অফ দ্য পারভাস
৪৫. লন্ডস কটেজ
৪৬. ডিডলিং
৪৭. দ্য সিস্টেম অব ডক্টর টার অ্যান্ড প্রফেসর ফেদার
৪৮. লস অব ব্রিদ
৪৯. দ্য স্পেকট্যাকল
৫০. মেসমেরিক রেভেল্যেশন
৫১. দ্য কোয়াকস অব হেলিকন–এ স্যাটায়ার
৫২. ম্যাগাজিন রাইটিং পিটার স্নক
৫৩. দ্য ডিউক ভিলা ওমলেট
৫৪. দ্য ম্যান অব দ্য ক্রাউড
৫৫. সাইলেন্স-এ ফেল
৫৬. দ্য ম্যান দ্যাট ওয়াজ ইউজড আপ
৫৭. ফিলজফি অব ফার্নিচার
৫৮. দ্য লিটারারি লাইফ অব থিংগাস বব এসকোয়ার
৫৯. দ্য আয়ারল্যান্ড অব দ্য কে
৬০. অ্যাসটোরিয়া
৬১. শ্যাডো-এ প্যারেবল
৬২. এ টেল অব জেরুসালেম
৬৩. রিভিউ অব স্টিফেন্স অ্যারেবিয়া ট্রো
৬৪. বিজনেসম্যান
৬৫. বন-বন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন