ক্লোমা – অনুভা নাথ

বিশ্বরূপ মজুমদার

সাল ২০৩০, ন্যাশানাল জেনেটিক ব্যুরো, নিউ দিল্লি

ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তীর চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে উঠল, হয়তো এই প্রথমবার ন্যাশানাল জেনেটিক ব্যুরোর কর্ণধার, অভিজ্ঞ, বর্ষিয়ান বিজ্ঞানীর চোখে আনন্দাশ্রু দেখা গেল। উনি ছুটে গেলেন ওঁর এয়ার ডিভাইসের কাছে, যন্ত্রটি ওঁর মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত করা আছে, মনে মনে যাকে ফোন করতে চাইছেন তার নাম শুধু ভাবতে হবে, এয়ার ডিভাইস মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ডিভাইসের অপর প্রান্তে একটি ভারী গলা ও স্ক্রিনে ব্যক্তিত্বময় মুখ ভেসে উঠল। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধান ডঃ সৈয়দ মহম্মদ প্রথমেই জিজ্ঞাসু মুখে বলে উঠলেন, “বলো ডক্ এনি নিউজ?” ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তী আবেগতাড়িত কণ্ঠে বললেন, “আজকের তারিখটা মনে রাখো, আমার তৈরি করা এমব্রায়ো থেকে আলট্রা ক্লোন করে মানুষ তৈরি হবে, এবং ওদের প্রত্যেকের মধ্যে দ্যুতির মতো সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকবে, ওরা কোনও যন্ত্রণা বুঝবে না, নামমাত্র খিদে থাকবে, দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে, ওরা হবে অতিমানব, ডক্টর, আমি পেরেছি, এই এমব্রায়োগুলো আমার তপস্যার ফসল।” ডঃ সৈয়দ মহম্মদ আনন্দিত হয়ে বললেন, “আমি হাউসকে বলেছিলাম, পারলে তুমিই পারবে, আমি খুব খুশি, ভারত তোমার জন্য গর্বিত।” এয়ার ডিভাইসে কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডঃ চক্রবর্তী স্বগতোক্তি করলেন, “ওদের মধ্যে দ্যুতির মতোই তীব্র স্বাভিমান বোধ থাকবে, ওরা আমার ব্রেন চাইল্ড, হ্যাঁ স্বাভিমানবোধ যা প্রত্যেক ভারতবাসীর থাকা উচিত।”

|| ২ ||

সাল ২০৫০, ডিসেম্বর, কলকাতা

“দ্যুতি মা, ছেলেটা কখন থেকে দোকানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওকে একটু দেখ কোন বইটা কিনবে”, বাবার কথায় দ্যুতি সামান্য বিরক্ত হয়ে বইয়ের তাক থেকে সরে শুভায়নের দিকে এগিয়ে এল। দ্যুতির ঘন আঁখিপল্লবের ভেতরে টলটল করতে থাকা দু’চোখের দিকে শুভায়ন অপলকে তাকিয়ে ছিল, শুভায়নের খুব ইচ্ছে করছিল, দ্যুতির ফর্সা   কপালের ওপর ইতস্ততভাবে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো নিজের হাতে সরিয়ে দিতে, দ্যুতি বুঝি ওর মনের কথা জানতে পেরে কপালের ওপর থেকে ছোট চুলগুলো সরিয়ে অবহেলার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “বলো, আজ কী বই চাই? নাকি অন্যদিনের মতো আমি যে বইটা পড়ছি সেটাই কিনবে?” এই ডিসেম্বরের সকালেও শুভায়নের বুকের ভেতরটা মোমগলা আগুনের মতো উষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল, ও  মৃদু হেসে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। দ্যুতি নিজের অর্ধেক পড়া বইটা শুভায়নের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মজা করে বলল, “তোমার জন্য কোনও বই-ই পুরোটা পড়তে পারলাম না।” শুভায়ন বেশ খুশি হল, ওর মনে পড়ল ঠিক ছ’মাস পরে ও দ্যুতিকে দেখছে, দ্যুতি ব্যাঙ্গালোরে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানিতে চাকরি করে, ছুটি খুব কম পায়, এবার ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, দিন কয়েক থাকবে, এ খবর শুভায়ন দ্যুতির ভাইয়ের কাছ থেকে জোগাড় করেছে। বইটি নিয়ে দাম মিটিয়ে শুভায়ন চলে গেল। ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেরই দ্যুতির ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ক্ষনিকের জন্য, তারপরই ওর নজর পড়ল মধ্যমায় পরে থাকা আংটির দিকে, আংটির সাদা পাথরের রং ক্রমশ সবুজ হতে শুরু করেছে। দ্যুতি জানে এখন ওকে কী করতে হবে। এটা ন্যাশনাল ফোর্সের সংকেত, দ্যুতির আংটিটা একটি বিশেষ যন্ত্র। যন্ত্রটি সিগন্যাল কমিউনিকেটার হিসাবে কাজ করে, ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সংক্ষেপে এনইএ-র আল্ট্রা সিকিওর আর্থ স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওর কাছে এইরকম সংকেত পাঠানো হয়। ওই আংটি অনেকগুলো রং পরিবর্তন করতে পারে। আংটিটার মাধ্যমে দ্যুতিও প্রয়োজনে কিছু বিশেষ সিগন্যাল এনইএকে পাঠাতে পারে। সবুজ রং হওয়ার মানে দ্যুতির সঙ্গে এনইএ যোগাযোগ করতে চাইছে। দ্যুতি দোকানে বসে সামান্য অনুসন্ধিৎসু নজরে ওর চারিপাশের পরিবেশ লক্ষ করতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব সাধারণ পোশাক পরা একজন বই বিক্রেতা ওর কাছে এসে নির্লিপ্ত মুখে অনেকগুলো বই দিয়ে চলে গেল। দ্যুতি দ্রুত বইগুলো নিয়ে দোকান লাগোয়া পেছনের দিকে ওর বাড়িতে মধ্যে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। বাবাকে চোখের ইশারা করল, বাবা শুধু বললেন, “ঠিক আছে।”

ও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা জানলা বন্ধ করে বইগুলো টেবিলের ওপর রাখল, বেশিরভাগ বই বেশ পুরানো, দ্যুতি জানে ওকে কোন বইটি বাছতে হবে, ওপর থেকে পাঁচ নম্বর বইয়ের পঁচিশ নম্বর পাতার পঁচাত্তর নম্বর শব্দটি দ্যুতি খুঁজে বার করল, শব্দটি হল ‘লখনউ’।

|| ৩ ||

সাল ২০৫০, জানুয়ারি, লখনউ

লখনউ শহরে দ্যুতি এর আগে কখনও আসেনি। তবে রাজা বাদশাহদের শহর নামে বরাবর পরিচিত এ শহরের প্রতি দ্যুতির একটা আলগা টান আছে। লখনউয়ের চৌধুরী চরণ সিং এয়ারপোর্টে দ্যুতি যখন নামল তখন সন্ধ্যা নামছে, শীতের হালকা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে শহরটি, আধো আলোর একটা রহস্যময়তা আছে, কোনও কিছু স্পষ্ট হয় না, অল্প আঁধারের গায়ে যেন লেপটে থাকে কিছু অজানা ভয়।

এয়ারপোর্টের কৃত্রিম ঝাঁ চকচকে আলো থেকে বেরিয়ে অল্প অন্ধকারে দ্যুতি শ্লথ পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সহসা ওর মাথার ওপর দিয়ে কতগুলো পরিযায়ী পাখি কলকল করতে করতে উড়ে গেল, ওর মনে হল পাখিগুলো দিনের শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাচ্ছে আর ও চলেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। মনে মনে ওর এক অদ্ভুত অনূভুতি কাজ করছিল। একঝলক ওর মায়ের মুখটা মনে পড়ল, বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ওকে সজল চোখে বলেছিলেন, “মা, আমি জানি তুই পারবি।” আলগোছে ওর চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়েছিলেন। তারপরই কান্না গোপন করার জন্য দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছিলেন।

ঠিক তখনই দ্যুতির চিন্তার জাল ছিন্ন করে হাফ ইঞ্চি বাই হাফ ইঞ্চির মাল্টিপল  ডিভাইসটা ওর পকেটের মধ্যে একবার ভাইব্রেট করেই থেমে গেল। এই যন্ত্রটি বিভিন্ন সময়ে ভাইব্রেট করে এর ব্যবহারকারীকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ করে, যন্ত্রটির সেন্সরের মাধ্যমে চারপাশের আটশো মিটার ব্যাসের মধ্যের যে কোনও ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের হদিশ দিতে পারবে। আবার লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে এটি পৃথিবীর যে কোনও জায়গার নাম জানিয়ে দেয়। কিন্তু এই মাল্টিপল ডিভাইসটি শুধুমাত্র দ্যুতির হাতেই কাজ করবে, দ্যুতির ডিএনএ-র সঙ্গে ডিভাইসটির কোডিং করা আছে। এছাড়াও দ্যুতির হার্টবিট খুব বেশি বা খুব কম থাকলে যন্ত্রটি কাজ করবে না। অর্থাৎ ওর যে কোনও অস্বাভাবিক শারীরিক পরিস্থিতিতে ডিভাইসটি কাজ করা বন্ধ করে দেবে।   

দ্যুতি আরও একটু এগিয়ে গেল, একটু যাওয়ার পরই একটি সাদা রঙের সেডান গাড়ি দেখতে পেল, যার নম্বরটি আগেই ম্যাগাজিনের মধ্যে থেকে ও জোগাড় করে নিয়েছিল। গাড়ির ড্রাইভার ডিকিতে ওর লাগেজ রাখার পর দ্যুতিকে পেছনের সিটের দরজা খুলে দিল। ও একটু মৃদু হেসে হিন্দিতে বলল, “ম্যায় ফ্রন্ট সিট পে বৈঠুঙ্গি।” ড্রাইভার কোনও কথা বলল না শুধু সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হোটেলের গেটের সামনে চলে এল এরমধ্যে দ্যুতি আবিষ্কার করল ড্রাইভারটি বোবা। সাধারণত এই সমস্ত টাস্কের জন্য ন্যাশনাল ইন্ট্যালিজেন্স এজেন্সি বাড়তি সতর্কতা হিসাবে এরকম ড্রাইভার ব্যবহার করে।

রিশেপশনে ও গিয়ে দাঁড়াতেই রিসেপশনিস্ট ওকে চোস্ত ইংরেজিতে ওয়েলকাম জানাল, তার সঙ্গে একজন পোর্টারকে ডেকে ওর লাগেজ নিয়ে যেতে নির্দেশ দিল এবং কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলে ওকে ওর রুমে যেতে অনুরোধ করল। হোটেলের ঘরে পৌঁছানোর পর প্রথমেই দরজা বন্ধ করে দ্যুতি পকেট থেকে ওর মাল্টিপল ডিভাইসটি বার করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরল, এবং ওর পকেটে রাখা খামের মধ্যে থেকে ওর চুলের একটি টুকরো বার করে ডিভাইসটির নির্দিষ্ট একটি ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিল। ওর চুলের মধ্যে থেকে পাওয়া ডিএনএ-র প্যাটার্নের সঙ্গে যন্ত্রটির কোডিং ম্যাচ হওয়ার পর যন্ত্রটি কাজ করতে শুরু করল, কিছুক্ষণের মধ্যে ডিভাইসটির স্ক্রিনে সাংকেতিক হরফে একটি লেখা ফুটে উঠল যার মানে জায়গাটার নাম লখনউ এবং যন্ত্রটি সবুজ আলো বিকিরণ করতে শুরু করল, একটু পরেই আলোর রং হালকা হয়ে যেতে থাকল। অর্থাৎ দ্যুতির চারপাশে আটশো মিটার ব্যাসের মধ্যে সিসিটিভি বা মাইক্রোফোনের  ফ্রিকোয়েন্সির মতো যন্ত্র থাকলেও ওর পনেরো ফুট ব্যাসের মধ্যে এরকম কোনও যন্ত্র নেই।

দ্যুতি হোটেলের করিডোর দিয়ে আসার সময় দেখেছিল সেখানে সিসিটিভি লাগানো রয়েছে। কিন্তু ওর ঘরে এরকম কোনও যন্ত্র লুকানো নেই। তার মানে এই মুহূর্তে ওর ওপর কোনও গোপন যন্ত্র দিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে না। দ্যুতি নিশ্চিন্ত হল, তারপরই ওর শরীরে যেন রাজ্যের ক্লান্তি এসে জুড়ল, দ্রুত ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় পোশাক ও টয়লেট্রিজ্ বার করে বাথরুমে স্নান করতে গেল, শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল ওর ছোটবেলার একটা ঘটনা।  

|| ৪ ||

সাল ২০২৫, কলকাতা

দ্যুতি তখন খুব ছোট, দু’বছর বয়স, একদিন হঠাৎই ওর বাড়ির দোতালার সিঁড়ি দিয়ে ও আচমকা পড়ে যায়। ওর মা দৌড়ে আসেন, এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন। দ্যুতির মাথা ফেটে গিয়েছে, রক্তে কপাল, চোখ ভেসে যাচ্ছে, দ্যুতির সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, ও নির্বিকার ভাবে উঠে মায়ের দিকে হেঁটে চলে আসছে। ওর মা এই দু’বছরের দ্যুতিকে নিয়ে ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার যখন ওর মাথায় স্টিচ্ করছিলেন তখন ও একদম ভাবলেশহীন মুখে বসে ছিল, ডাক্তার যখন ওকে জিজ্ঞেস করলেন তখন ও বলল ওর নাকি কোনও ব্যথা অনূভুত হচ্ছে না।

তখন ওর মায়ের কাছ থেকে ডাক্তারবাবু জানতে পারলেন, দ্যুতি আর পাঁচজন বাচ্চাদের মতো খেতে চায় না, ওর ঘুমও খুব কম, অথচ সে কম ঘুম বা খাওয়ার জন্য কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ে না। ডাক্তারবাবু আর কালবিলম্ব না করে দ্যুতির এই আপাত অস্বাভাবিকতা তাঁর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাতে জানিয়েছিলেন।               

ওর মনে আছে, এরপর ওকে নিয়ে ওর মা বাবাকে কিছু দিন দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক মানের হসপিটালে কিছুদিনের জন্য থাকতে হয়েছিল। সেইসময় ওর শরীর নিয়ে ডাক্তার, সাইনটিস্টরা প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত ওঁরা জানতে পারেন দ্যুতি, ক্রোমোজোম 6 p নামক একটি জটিল গঠনগত ত্রুটির শীকার। মানুষের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। মাতৃজঠরে থাকাকালীন ক্রমাগত কোষ বিভাজনের সময়ে ক্রোমোজোম 6 এর ‘p arm’-এর বেশিরভাগই দ্যুতির শরীরে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

ক্রোমোজম 6 এর বেশীরভাগ অংশ মানব শরীরে ব্যথা, বেদনা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও অন্যান্য অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাভাবিকভাবেই দ্যুতির শরীরে ক্রোমোজোম 6p-এর বেশিরভাগ অংশই নেই বলে ওর আনুষঙ্গিক অনুভূতিগুলোও নেই।

কিন্তু ওর স্বভিমান বোধ ভীষণ ভাবে রয়েছে। কেউ ওকে অন্যায় কিছু বললে বা করলে দ্যুতি তার শেষ দেখে ছাড়ে।  

এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। ন্যাশনাল জেনেটিক ব্যু্রোর পক্ষ থেকে দ্যুতির মা বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ওখানকার কর্ণধার ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তী নিজে ওর মা বাবার সঙ্গে কথা বলেন, উনি দ্যুতির মতো অপার্থিব ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু মানুষ আলট্রা ক্লোনের মাধ্যমে তৈরি করতে চান বলে জানান। পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পক্ষ থেকেও ওদেরকে জানানো হয় ওনারা দ্যুতির এই আশ্চর্য ক্ষমতাকে দেশের সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত করতে চান। দ্যুতিকে ওঁরা দেশের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চান। এগুলো দ্যুতি এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে যত সহজে ভাবতে পারছে তখন কিন্তু পরিস্থিতি তা ছিল না। এমনও দিন গেছে দ্যুতি পাশের ঘরে মা বাবার উত্তেজিত কথা শুনতে পেয়েছে, মা কান্নায় জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে চলেছেন, “আমার আদরের সোনাকে আমি কিছুতেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারব না।” ওর বাবা স্বান্তনা দিয়েছেন, “আমাদের তো গর্ব হওয়া উচিত, ক’জন মানুষ দ্যুতির মতো হয়?”

শেষ পর্যন্ত এনইএ-র কঠিন ট্রেনিং পাশ করে দ্যুতি এখন দেশের একজন অন্যতম সিক্রেট এজেন্ট। সারা পৃথিবীর পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা, ক্যারাটে, যুযুৎসুর প্যাঁচ পয়জারে ওস্তাদ, বন্দুকের অব্যর্থ টার্গেট করতে পারা, কম্যান্ডো ট্রেনিং নেওয়া, শরীরের অসম্ভব যন্ত্রণা সহ্য করতে পারা, অসামান্যা রূপবতী ও বুদ্ধিমতী দ্যুতিকণা সেন এখন শুধু ওর পরিবারের নয় সমস্ত দেশের গর্ব ও সম্পদ। ওর ডিপার্টমেন্টে ওকে ‘ক্লোমা’ বলে ডাকা হয়। ওর ক্রোমোজোমের প্যাটার্নে মিউটেশন করে হুবহু ওর মতোই ক্ষমতা সম্পন্ন আরও পাঁচটি মানব মানবী তৈরি করা হয়েছে, তারা সকলেই দ্যুতির মতোই সিক্রেট এজেন্ট, সেইজন্য ওকে বলা হয় ‘মাদার ক্লোন’ বা সংক্ষেপে ‘ক্লোমা’।

এরকম সিক্রেট এজেন্টদের একটা ক্যামোফ্লেজ প্রয়োজন হয়। তাই ওকে ব্যাঙ্গালোরের একটি আইটি সেক্টরে চাকরি দেওয়া আছে। সমাজের চোখে দ্যুতিকণা সেন একজন আইটি প্রফেশনালিস্ট।

পুরনো কথার স্মৃতিচারণ করতে করতে দ্যুতি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, সম্বিত ফিরল হোটেলের ইন্টারকমের শব্দে।

|| ৫ ||

সাল ২০৫০, জানুয়ারি, লখনউ

দ্যুতি খুব দ্রুত টাওয়েল জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরোল। ওর সদ্যোস্নাত চুল থেকে বিন্দু বিন্দু জল টুপিয়ে মেঝের দামি টাইলস্-এ পড়ছে, ভিজে শরীরের অনাবৃত অংশের ওপর ঘরের ডিম লাইট পড়ে যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে, সুডৌল স্তন দুটি যেন তার সুযোগ্য বিভাজিকা পেয়ে আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ভেজা চুলের মাদকতা বুঝি মহুয়ার নেশাকেও হার মানিয়ে দেবে, সরু কোমরের মোচড়ে ওর চলন দেখেই বোধহয় বিদ্যাপতি লিখে থাকবেন ‘গেলি কামিনী, গজহু গামিনী, বিহসি পাল্টি নেহারি’।

ওর সৌন্দর্যের অনাবিল উজ্জ্বলতা, দেহ সৌষ্ঠব যে কোনও বলিউড অভিনেত্রীকে মুহূর্তে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

ইন্টারকমে ‘হ্যালো’ বলতেই রিসেপশনিস্ট রাতের ডিনার করার কথা বলল, দ্যুতি ফোনে জানাল, ওর ডিনার যেন ওর ঘরেই দেওয়া হয়, আজ বড় ক্লান্তি আসছে, তাই লাউঞ্জে গিয়ে ডিনার করার কথা নাকচ করল দ্যুতি।

এরপরই দ্যুতি এয়ার ডিভাইসে ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তী ও ডঃ সৈয়দ মহম্মদের সঙ্গে কন্ফারেন্স কল করল। ডঃ সৈয়দ দ্যুতিকে ‘ক্লোমা’ বলেই ডাকেন, ডঃ চক্রবর্তী আবার ওকে ‘মা’ বলে ডাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ওনারা ওকে জানালেন, পরদিন সকালে ট্রেনে করে ওকে দিল্লি যেতে হবে, দুপুর বারোটা নাগাদ এনইএ-র হেডকোয়ার্টারে মিটিং হবে এবং সেখানেই তৈরি হবে দ্যুতিদের সিক্রেট মিশনের ব্লু প্রিন্ট। দ্যুতি কনফারেন্স কল শেষ করার পর বুঝতে পারল যে ওকে ট্রেনে করে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে।

পরের দিন সকালে দ্যুতি হোটেল থেকে চেক আউট করে একটা ক্যাবে উঠে লখনউ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিল, রাস্তায় গোমতি নদী পড়ল, ইউ পি সরকার ২০৪৫ সালে নদীটির মাঝখান দিয়ে ডাবল লেয়ারে গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা বানিয়েছে, নীচের লেয়ারটা পুরোপুরি নদীর মধ্যে ডুবে থাকে, তাতে যাত্রীরা গাড়ি করে যাওয়ার সময় নদীর মধ্যে ডুবে থাকা প্রচুর মাছ, জলজ গাছ দেখতে পান, আর ওপরের লেয়ার দিয়ে গাড়ি যাওয়ার সময় মেঘগুলোকে আইসক্রিমের মতো হাতের মুঠোয় নেওয়া যায়, এককথায় অপূর্ব বললেও কম বলা হয়।

দ্যুতি লখনউ স্টেশনে পৌঁছল, ওর দিল্লি যাওয়ার রিজার্ভেশন আগেই করা ছিল ও লাগেজ কনভেয়র রুমে তুলে দিল, নিজে ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় দরজার পাশে লাগানো সেন্সরে ডানহাত ছড়িয়ে ধরতেই ওর পুরো পরিচয় সমেত ট্রেনের কোচ ও সিট নং ডিসপ্লে হল, ওদিকে ততক্ষণে ওর লাগেজের প্রয়োজনীয় স্ক্যানিং করে কনভেয়রের মাধ্যমে ওর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

দ্যুতি আলট্রা ফাস্ট ট্রেনে চাপলো, ট্রেনটি ৪০০ কিমি প্রতি ঘন্টা বেগে চলে, এত বেশি গতিবেগ হওয়ার কারণে এই ট্রেন থেকে বাইরের দৃশ্য কিছুই দেখা যায় না, অনেকটা আমাদের জীবনের মতো, জীবনও এইভাবেই অবিরাম এগিয়ে চলে, কখনও এত দ্রুত যে কোনও কিছু দেখা বা বোঝা যায় না।

দ্যুতি মোটামুটি দেড় ঘন্টার মধ্যে দিল্লি স্টেশনে নেমে গেল। তখন বেলা দশটা বাজে। স্টেশন লাগোয়া চত্বর ছেড়ে বাইরে আসতেই শীতের নরম রোদ ওর শরীরে এসে পড়ল, তখনই ওর হাতের মধ্যমার আংটিটা সবুজ রং হতে শুরু করল, ও একটু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। পাঁচমিনিট পর ওর সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল, দ্যুতি খেয়াল করল ওর আংটি আবার সাদা হয়ে গিয়েছে। ও আর কালবিলম্ব না করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ল। উঠেই দেখল অ্যাম্বুলেন্সের চালকের আসনে বসে আছে নিলয়। নিলয় হল দ্যুতির ক্রোমোজমের মিউটেশান করে বানানো ক্লোন ম্যান, হুবহু ওর মতো গুণসম্পন্ন। তবে ওর সঙ্গে দ্যুতির একটা জায়গায় পার্থক্য আছে সেটা হল, নিলয় খুব খারাপ পরিস্থিতিতেও মস্করা করতে পারে। অ্যাম্বুলেন্সে উঠতেই নিলয় ওকে ‘হাই বেবস্’ বলে চোখ মটকাল। দ্যুতি ওকে ঘাড় ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করল তখন নিলয় ওকে নির্বিকার মুখে জানাল শত্রুপক্ষ ওকে ট্রেস করে ফেলেছিল তাই প্ল্যান বি।

সারা রাস্তা নিলয় দ্যুতিকে বস্তাপচা জোকস শোনাতে শোনাতে এনইএ-র হেডকোয়ার্টারে নিয়ে পৌঁছাল।

|| ৬ ||

সাল ২০৫০, জানুয়ারি, দিল্লি

এখন ঠিক দুপুর বারোটা বাজে, ওভাল শেপের একটি ঢাউস টেবিলের চারিদিকে দশজন বসে আছে, দ্যুতি আর ওর ক্লোনিং করা পাঁচজন তারা হল নিলয়, শাক্য, শৌর্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণা। এছাড়াও আছেন ডঃ চক্রবর্তী, ডঃ সৈয়দ, ও এনইএ এবং ন্যাশানাল জেনেটিক ব্যুরোর আরও দু’জন আধিকারিক।

প্রজেক্টরে একটার পর একটা ছবি ডিসপ্লে হচ্ছে, কেউ কোনও কথা বলছে না, ডঃ চক্রবর্তী প্রথমে স্পিকারে থমথমে গলায় বলতে শুরু করলেন, “আমাদের কাছে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, ন্যাশনাল জেনেটিক ব্যুরোর (সংক্ষেপে এনজিবি) একজন প্রথম শ্রেণির সাইনটিস্ট হয়ে ডঃ অয়নান্ত রায় এটা কীভাবে করলেন, আর তার সঙ্গে কিছু স্বার্থপর সাইনটিস্ট কীভাবে যুক্ত হলেন? ওনারা একবারও নিজেদের দেশের কথা ভাবলেন না? বাইরের দেশের বায়োলজিকাল ল্যাব থেকে মিউটেড ভাইরাস নিয়ে এলেন যেটা মানুষের পানীয় জলে সামান্য মাত্রায় মিশিয়ে দিলে মানুষের পুরো নার্ভাস সিস্টেম মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে মানুষটির স্পাইনাল কর্ড অকেজো হয়ে পুরো শরীর প্যারালাইস হয়ে যাবে, এবং এটা হবে মানুষটি ওই ভাইরাস মেশানো জল শুধুমাত্র দশ লিটার পান করলে।”

এবার ডঃ সৈয়দ বলে উঠলেন, “ওদের উদ্দেশ্য হল, অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে ইনভ্যালিড করে দেওয়া, তাতে করে সরকারের সমস্ত নীতি ভেঙে পড়বে এবং একশো কোটি জনসংখ্যার দেশের তিরিশ শতাংশের যদি এমন অবস্থা হয় তবে সরকারের একবছরের জিডিপির টাকার থেকেও বেশি টাকা লেগে যাবে এই সমস্ত ইনভ্যালিড মানুষের দেখাশোনা করতে। পৃথিবীর মানচিত্রে ভারত চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যাবে।”          

ডঃ চক্রবর্তী কঠিন মুখে বললেন, “ওদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।”

রাগে দ্যুতির মুখ লাল হয়ে উঠল ও টেবিলের ওপর রাখা পেপারওয়েট এমন জোরে চেপে ধরল যে ওটা ওর হাতের মধ্যেই ভেঙে গেল, সৌভাগ্যক্রমে ওর হাত সামান্য কাটল, কিন্তু সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে দ্যুতি বলে উঠল, “ওরা কেউ বাঁচবে না।” ওর সঙ্গে বাকি ক্লোনড্ পাঁচজনও বলে উঠল, “ওরা শেষ হয়ে যাবে।”

ডঃ সৈয়দ বললেন, “তোমাদেরকে কি করতে হবে সেটা এই মাইক্রো ড্রাইভে আছে, মিঃ মুরারকা তোমাদের গাইড করবে।” এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এনআইএ-র অন্য আধিকারিক, যার নাম মুরারকা তিনি ‘স্যার’ বলে সম্মতি জানালেন।  

দ্যুতি ও পাঁচজন ক্লোনের সারাদিন কেটে গেল অপারেশন ‘ভারত সুরক্ষা’-র ব্লু প্রিন্ট বুঝতে। ছ’দিনের মধ্যে এই মিশন শেষ করতে হবে ওদের, অপারেশনে লিড দেবে দ্যুতি, যে কোনও পরিস্থিতিতেই ওরা এনআইএ-র হেডকোয়ার্টার বা সরকারের কোনও আধিকারিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবে না, যে রাজ্যগুলিতে ওরা যাবে, সেখান এনআইএ-র কিছু অন্য সিক্রেট এজেন্ট নিযুক্ত করা আছে, প্রয়োজনে তারা ওই ছয়জনকে সবরকমভাবে সাহায্য করবে। ওদেরকে সময়ে সময়ে এনইএ প্রয়োজনীয়  নির্দেশ দিতে পারে, এই অপারেশনের কোর মেম্বার ছয়জনকে কিছু বিশেষ অস্ত্র দেওয়া হয়েছে যা পৃথিবীর হাতে গোনা কিছু দেশের কাছে খুব অল্প সংখ্যায় আছে।

|| ৭ ||

সাল ২০৫০, ১৭ই জানুয়ারি

ভোর তিনটে, এনআইএ-র হেডকোয়ার্টারের হেলেপ্যাডের থেকে একটু দূরে ডঃ চক্রবর্তী, ডঃ সৈয়দ, সুদীপ ও এই সিক্রেট অপারেশনের ছয়জন যোদ্ধা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠান্ডা হাওয়াকে তুচ্ছ করে ওই ছয়জনের পরনে কমান্ডো পোশাক, মুখের অভিব্যক্তি কঠিন। ডঃ চক্রবর্তী এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে দ্যুতিকে বললেন, “মা, দু’বছর বয়স থেকে তোমাকে দেখছি, তোমার প্রচুর গুণ আছে, প্রকৃতির এক অভিনব দান তুমি, কিন্তু সে সব কিছুর আগে তোমার স্বভিমান বোধ আমাকে বার বার মুগ্ধ করেছে, চরৈবেতি, মা।” বাকি পাঁচজনের দিকে ঘুরে আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, “তোমরা তো আমার ব্রেন চাইল্ড, আমার সন্তানরা কখনও হারতে শিখিনি।” তারপর দেখা গেল ওরা ছয়জন ও দু’জন বর্ষীয়ান ডঃ একসঙ্গে গোল হয়ে নিজেদের কাঁধে হাত দিয়ে একটা বৃত্ত রচনা করেছে, ওদের সবার চোখে জল।

এরপর খুব দ্রুত দ্যুতি আর শৌর্য একটা হেলিকপ্টারে চাপল, বাকি চারজন অন্যটায়।

দ্যুতি আর শৌর্য যখন হিমাচল প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মালানার থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে ঝারিতে ল্যান্ড করল তখন সূর্য দিগন্ত আলো করে উদয় হয়েছে। তিন ডিগ্রি টেম্পারেচারে দ্যুতি আর শৌর্য হেলিকপ্টারের থেকে নীচে নেমে এল, এত ঠান্ডাতেও দু’জনেই স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে রইল।    

অপরদিকে বাকি চারজন, অর্থাৎ নিলয়, শাক্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণা দু’বার হেলিকপ্টার বদলে এসে পৌঁছাল ভারতের সবচেয়ে জনবহুল শহর হায়দরাবাদ।

হেলিকপ্টার থেকে নেমেই নিলয় বাকি তিনজনকে বলল, “বন্ধুগণ, আকাঙ্ক্ষা নাকি হেব্বি সুন্দরী! আগে ওকে একটু মেপে নেবো।”

সম্পূর্ণা চোখ পাকিয়ে উত্তর দিল, “লয়, দিল্লি অনেক দূর।” ওর কথায় সবাই হেসে উঠল।

আর ঠিক এরপর থেকেই অপারেশন ‘ভারত সুরক্ষা’-র কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেল, আগামী ছয়দিন ওদের পাখির চোখ হবে এই অপারেশনে জয় লাভ করা।

|| ৮ ||

সাল ২০৫০, ১৭ই জানুয়ারি

হেলিকপ্টার থেকে নামার পরের সতেরো কিলোমিটার দ্যুতি আর শৌর্য জিপে করে গিয়ে শেষপর্যন্ত মালানা গ্রামের গিয়ে পৌঁছাল।

গ্রামটির একপাশ থেকে মালানা নদী কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে, মালানার বাসিন্দা মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে ওখানকার স্থানীয় কানাসি ভাষায় গান গাইতে গাইতে। গানটির সুর শুনলে এক অনাবিল আনন্দে মন কানায় কানায় ভরে ওঠে। প্রকৃতি এখানে বছরের পর বছর ধরে একই রকম সৌন্দর্য নিয়ে রয়ে গেছে। হিমাচল প্রদেশের সরকার গত কয়েক বছরে এখানে বেশ কিছু ওষুধ তৈরির কোম্পানিকে কারখানা তৈরি করার ছাড়পত্র দিয়েছে।  

এরকমই একটি কোম্পানির কারখানায় ডঃ অয়নান্ত রায় তার কিছু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে লুকিয়ে রয়েছে, তারা সঠিক সময়ের অপেক্ষায়, তারপরই শুরু করবে ওই মারণ ভাইরাসের হত্যালীলা।   

দ্যুতি আর শৌর্যকে ওদের বাকি চারজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই অপারেশন নির্বাহ করতে হবে, এনআইএ দ্যুতিদের জানিয়ে দিয়েছিল, ১৮ই জানুয়ারির মধ্যে হায়দরাবাদে ওদের চারজনের টিম কাজ শেষ করবে, অতএব দ্যুতিদেরও ওই সমসাময়িক সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে, না হলে অয়নান্ত রায় হায়দরাবাদের খবর জেনে গেলে দ্যুতিদের পক্ষে অপারেশন ‘ভারত সুরক্ষা’ সফল করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

দ্যুতিদের হাতে সময় খুব কম, মাত্র একদিন, তারমধ্যে এরকম পাহাড়ি কুয়াশাঘেরা আবহাওয়া ওদের কাজের পক্ষে বেশ সমস্যা তৈরি করছিল।  

প্রথমেই দ্যুতি শৌর্যকে ওই কম্পানির সাফাইকর্মী হিসাবে কোম্পানির ভেতরে যেতে বলল, শৌর্য নিজের মুখ খুব ভালো করে মাফলার দিয়ে ঢেকে নিল, তারপর সময় বুঝে কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল।  

কিছুক্ষণ পরেই ইচ্ছে করে গেটের কাছে একটা গণ্ডগোল তৈরি করল সিকিউরিটি গার্ডরা ওদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে দ্যুতি সেই ফাঁকে খুব সাবধানে সিসিটিভি এড়িয়ে কোনও রকমে কারখানায় ঢুকে পড়ল। কিন্তু ওরা দু’জনেই কোনও গ্যাজেট বা অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারলো না, সেক্ষেত্রে ডিটেকটরের সাইরেন বেজে উঠত। এইভাবে খালি হাতে আসা আর মৃত্যুকে আহ্বান করা সমান জেনেও ভারতের দুই বেপরোয়া সিক্রেট এজেন্ট এগিয়ে চলল তাদের অপারেশন সফল করতে।

|| ৯ ||

সাল ২০৫০, ১৮ই জানুয়ারি

নিলয়, শাক্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণা এই মুহূর্তে হায়দরাবাদের প্রাণকেন্দ্র ইউনিক সিটির সামনে দাঁড়িয়ে। এটি রামকো ব্রাদার্স এর বানানো একটি অত্যাধুনিক ছোট শহর, মাত্র হাজার একরের ওপর তৈরি এই শহরে আমোদ প্রমোদের কী নেই? ক্যাসিনো, ডিস্কো, বিভিন্নরকম ড্রিংক বার, বিলাস বহুল মোটেল, শপার্স পয়েন্ট, গেম কর্নার, বিশ্বের সমস্ত বড় বড় রেস্তোরাঁর প্রায় সব আউটলেট থেকে শুরু করে এলাহি আয়োজন। এই সিটিতে সকাল আর রাতের পার্থক্য বোঝা যায় না। বর্তমানে এই ইউনিক সিটি বিশ্বের দু’নম্বর লাক্সারি সিটির তকমা পেয়েছে। এখানে সিকিউরিটি যেমন টাইট তেমনই প্রত্যেকটি বিল্ডিং একরকম দেখতে। তাই ওদের চারজন প্রথমেই ঠিক করল সিটিতে গিয়ে আগে ওটার একটা ম্যাপ বানিয়ে নেবে, তারপর আসল অপারেশন শুরু করবে।   

ইউনিক সিটিতে এনআইএ-র অন্য সিক্রেট এজেন্ট আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রয়োজনীয় ফরম্যালিটি করে ওদের সিটির মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে দিয়ে সে বিদায় নিল, বাকি কাজ এবার ওরাই করবে।

সিটির মধ্যের একটা বিল্ডিং থেকে অন্যটায় যাওয়ার জন্য ‘ওয়্যার ওয়ে’র ব্যবস্থা করা আছে। এটা অনেকটা রোপওয়ের মতো। প্রতিটি ঘরের ব্যালকনি থেকে তারের মাধ্যমে অন্য বিল্ডিয়ের যোগাযোগ করা আছে, এটা দেখে অঙ্গদ মাথা নাড়তে নাড়তে ভাঙা বাংলায় বলে উঠল, “আচ্ছা, ইটা আমোদের উড়োন খাটোলার মতো আছে।” শাক্য আবার বরাবরই গম্ভীর, সে উত্তর দিল, “আমাদের যেটা আছে সেটা হল ইনসার্ট এন্ড রান”, অঙ্গদ বলল, “ইকই হল, ভাইয়া।” এরপর ওর দুটো ঘর দু’দিনের জন্য ভাড়ায় নিলো তবে সতর্কতার জন্য একই বিল্ডিংয়ে নিল না। সম্পূর্ণা একটা ঘর, আর বাকি তিনজন আরেকটায়। শাক্য প্রথমেই নিজেদের ঘরে ঢুকে বাথরুমে গিয়ে মাল্টিপল ডিভাইসে নিজের মাথার একটি চুল ছিঁড়ে ওর মধ্যে নির্দিষ্ট ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে দিল, যন্ত্রটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তীব্র সবুজ আলো বিকিরণ করতে শুরু করল, সেন্সর সিসিটিভির ফ্রিকোয়েন্সি ডিটেক্ট করছে তার মানে ওদের ঘরে লুকানো ক্যামেরা লাগালো আছে। শাক্য বুঝতে পারল, এই সিটির সব ঘরেই নজরদারী করার জন্য লুকানো ক্যামেরা লাগানো আছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ও ইশারায় বাকীদের জানিয়ে দিল, ওরা বুঝতে পারল এখানে প্রতি পদক্ষেপ ওদেরকে বুঝে ফেলতে হবে।   

ওইদিন বিকেলে সম্পূর্ণা ইউনিক সিটির সবচেয়ে বিলাসবহুল ক্যাসিনোতে প্রবেশ করল। সম্পূর্ণার গায়ের রং গমের মতো, চোখ মুখ, শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন কেউ পাথর কেটে বানিয়েছে, ওর কালো একঢাল লম্বা চুল চেহারায় এক অদ্ভুত মাদকতার সৃষ্টি করেছে, ওর শরীরের নিখুঁত স্টয়াটিসটিক্স যে কোনও বয়সের পুরুষের মনে ঢেউ তুলে দিতে পারে।     

ক্যাসিনোর অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি তখন সম্পূর্ণার শরীরের ইতিউতি ঘুরছে। তবে ওর এসব এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, ও খুঁজছে একজন বিশেষ নারীকে, মিস্ আকাঙ্ক্ষাকে। একটু পরেই অপরূপ সুন্দরী আকাঙ্ক্ষা ক্যাসিনোয় এসে পৌঁছাল, ক্যাসিনোর সব উজ্জ্বল আলো মুহূর্তের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার সামনে ম্লান হয়ে গেল, একঝলক দেখলে মনে হয় যেন, এ সৌন্দর্য বুঝি পার্থিব নয়, চোখ ঝলসে দেওয়া রূপ নিয়ে মিস্ আকাঙ্ক্ষা ক্যাসিনোর এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরতে লাগল।

|| ১০ ||

সাল ২০৫০, ১৮ই জানুয়ারি

কাল সারারাত দ্যুতি আর শৌর্য কারখানায় একটা টয়লেটে লুকিয়ে ছিল। এখানে চারিদিকে সিসিটিভির নজরদারি রয়েছে। ওদের এরমধ্যেই ডঃ অয়নান্ত রায়কে খুঁজে বের করতে হবে। কারখানার বেসমেন্টে একটা সিক্রেট ফ্লোর আছে। দ্যুতিদের ওখানেই পৌঁছাতে হবে। পরের দিন ভোরের আলো ফোটবার আগেই ওরা সিক্রেট ফ্লোরের দিকে নেমে গেল, এরপর ওরা দুভাগে হয়ে দুদিকে চলে গেল। ফ্লোরের একদম শেষ প্রান্তে জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে দ্যুতি দেখতে পেল একটা বন্ধ দরজার সামনে বন্দুক হাতে একজন বসে। ও বুঝতে পারল শয়তানটা তবে এই ঘরেই লুকিয়ে। বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে ঠিক তখনই দরজা খুলে ডঃ অয়নান্ত রায় বেরিয়ে এলেন, হাতে উদ্যত ভাবে ধরা একটা শক্তিশালী পিস্তল, মুখ বেঁকিয়ে উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে বলছেন, “আয়, ডঃ চক্রবর্তীর সাঙ্গোপাঙ্গ, এ্যাহ্ নিজের ক্ষমতা নেই আসার তাই তোদের পাঠিয়েছে, শেষ করে দেব আমি, সামান্য কিছু ভাইরাস, আর তোদের সাধের দেশ বুঝবে বায়োটেরোরিজম কাকে বলে।”

রাগে দ্যুতি ফেটে পড়তে চাইল, অসম্ভব ক্ষিপ্র গতিতে বাঘিনীর মতো তিনটে ভল্ট দিয়ে প্রথমে সিকিউরিটিকে ধরাশায়ী করল, এরমধ্যেই ডঃ অয়নান্তের বন্দুকের গুলি এসে লেগেছে দ্যুতির কাঁধে, সেদিকে বিন্দু মাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে দ্যুতি ঝাঁপিয়ে পড়ল ডঃ অয়নান্তের ওপর। নিজের পকেটের ভেতর থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে শয়তানটার মুখে গুঁজে দিল। পরবর্তী তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে ডঃ অয়নান্ত সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। ওদিকে ওপরের ফ্লোরের ক্রমবর্ধমান বুটের শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল কারখানার সমস্ত সিকিউরিটি গার্ড ওদের দিকে এগিয়ে আসছে, সময় খুব অল্প, দ্যুতি একটু দূরে তাকাতেই দেখল শৌর্য ওর দিকে দৌড়ে আসছে, আর ঠিক তখনই পাহাড়ের গভীর নৈশব্দ চিরে ওদের কানে এল অনেকগুলো পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ।

কাঁধ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণের জন্য দ্যুতি সংজ্ঞাহীন হতে লাগল ওর চোখে চকিতেই প্রিয়জনদের ছবি একে একে ভেসে আসতে লাগল, বাবা, মা, ওর ছোট ভাই, ডঃ চক্রবর্তীর ছবি, আরও একজনের আবছা ছবি দ্যুতির চোখে ভেসে উঠল সে হল শুভায়ন। দ্যুতি মুচকি হাসল, তারপর পুরোপুরি জ্ঞান হারাল।            

|| ১১ ||

সাল ২০৫০, ১৮ই জানুয়ারি

নিলয়, শাক্য আর অঙ্গদকে প্ল্যান বলাই ছিল। শাক্য আর অঙ্গদ ক্যাসিনো বিল্ডিংয়ের পরের বিল্ডিংয়ে টপ ফ্লোরের একটা গেম কর্নারে অপেক্ষা করছিল। নিলয় এবার সেই ক্যাসিনোয় প্রবেশ করলো,তারপর সম্পূর্ণাকে একটু দূরে দাঁড়াতে বলে মিস্ আকাঙ্ক্ষার সামনে গিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে মুচকি হেসে বলল, “অয়নান্ত রায়”, মুহূর্তেই আকাঙ্ক্ষার মুখের বিগলিত হাসি মিলিয়ে গেল। সরু চোখের ইশারায় ওকে ওর সঙ্গে আসতে বলল, নিলয় আর সম্পূর্ণা নিঃশব্দে আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করল। একটু হেঁটে ক্যাসিনোর পেছনে একটা দশ বাই দশের ঘরে এসে ওরা পৌঁছাল, ঘরটা অপূর্বভাবে সাজানোর সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে প্রচুর কাচ লাগানো, তাতে জোরালো আলো পড়লে যে কারওর চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। ঘরে সেইজন্যই বোধহয় খুব হালকা আলো জ্বলছে। মিস্ আকাঙ্ক্ষা ওদের বললেন, “অয়ন তো দু’জন ছেলে পাঠাবে বলেছিল, তোমরা তো”, ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিলয় ওর স্বভাবজাত ভঙ্গীতে চোখ মটকে বলল, “কেন মিস্? আমাদের পছন্দ হচ্ছে না, আপনার?” তারপরই আকাঙ্ক্ষা কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে দ্রুত ওর হাতে থাকা একটা গ্যাজেটের বোতামে টিপতে গেল, ঠিক তখনই সম্পূর্ণা বিদ্যুৎগতিতে লাফ দিয়ে আকাঙ্ক্ষার হাত থেকে টান মেরে  গ্যাজেটটা ফেলে দিল, আর তখনই নিলয় বলল, “আরে বাঃ, ক্যাট ফাইট যে।” পরের চার সেকেন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণা সুনিপুণ দক্ষতায় আকাঙ্ক্ষাকে পুরো মাটিতে শুইয়ে দিল, শেষে নিলয় এগিয়ে এসে আকাঙ্ক্ষার হাতে পরে থাকা ব্রেসলেটা এক টানে খুলে নিল, সম্পূর্ণা সেদিকে তাকানোর সামান্য অবসরে আকাঙ্ক্ষা ঘরের সব উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে দিল, ঘরের

দেওয়ালে অজস্র আয়না থাকার জন্য ওরা দু’জনে ওই চোখ ধাঁধানো আলোয় পুরো ঘর জুড়ে আকাঙ্ক্ষার অনেক প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিল। তারমধ্যে ওরা আসল আকাঙ্ক্ষাকে খুঁজে পাচ্ছিল না, ওদিকে সময়ও কমে আসছিল, তাই একরকম বাধ্য হয়েই ওরা দৌড়ে ক্যাসিনোর মেন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল, দৌড়াতে দৌড়াতে নিলয়ের কানে এল আকাঙ্ক্ষা চিৎকার করে ইংরেজিতে বলছে, “ক্যাচ দেম নাউ।”

সম্পূর্ণা ক্যাসিনোর লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে ইনসার্ট এন্ড রান যন্ত্রটা বের করল, ক্যাসিনোর দেওয়ালে ওর গান দিয়ে ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে হূকের মতো একটা বস্তু দেওয়ালে গেঁথে গেল, ওই গানটা দিয়ে পরের বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে ফায়ার করল, দুটো বিল্ডিংয়ের মধ্যে সুতোর মতো একটা তার আটকে গেল, ততক্ষণে ক্যাসিনোর সিকিউরিটি অ্যালার্ম অ্যাকটিভ হয়ে গেছে, প্রচুর সংখ্যক সিকিউরিটি রোবোট এগিয়ে আসছে ওদের দিকে, এরমধ্যে একটা রোবটের গুলি এসে লাগল নিলয়ের হাতে। নিলয় ক্রমাগত হিটার গান দিয়ে ফায়ার করে রোবটের বডিগুলো নিমিষে পুড়িয়ে দিচ্ছে, সম্পূর্ণা নিলয়কে ডাকতেই ওরা ওদের কোমরের অ্যাংকর দিয়ে ওই তারের সাথে ঝুলে নিমিষের মধ্যে পৌঁছে গেলো অন্য বিল্ডিংয়ে। সেখানে ইতিমধ্যেই শাক্য আর অঙ্গদ এসে পৌঁছেছে, ওদের চারজনকে তখন ঘিরে ধরেছে প্রায় পঞ্চাশটা রোবোট। আর ঠিক তখনই আকাশের বুক চিরে একটা হেলিকপ্টার দ্রুত বেগে ওদের দিকে এগিয়ে এল।    

|| ১২ ||

সাল ২০৫০, ১৮ জানুয়ারি

হেলিকপ্টারে উঠেই অঙ্গদ নিলয়ের হাতের গুলি লাগা জায়গা মেরামতে মন দিল, নিলয় তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অঙ্গদকে আশ্বস্ত করে বলল, “মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা।” সম্পূর্ণা ওদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই শাক্য বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে নিজের মধ্যমায় পরা আংটিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “টাইমলি, সিগন্যাল কমিউনিকেটর মারফত হেল্প চেয়েছিলাম, ওরাই হেলিকপ্টার পাঠাল।” সম্পূর্ণা আক্ষেপের সুরে বলল “মিস্ আকাঙ্ক্ষা নাকের নীচ দিয়ে পালিয়ে গেল”, নিলয় তখনই গুলি লাগা হাত নিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠল, “সুন্দরীদের মারতে কষ্ট লাগে না? সখি তোমার কি মন নাই?” সম্পূর্ণার হঠাৎ কি মনে পড়তে নিলয়কে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “চুড়িটা কই?” নিলয় হাত নেড়ে গেয়ে উঠল, “চুড়ি নেহি য়ে মেরা দিল হ্যায়”, এবং সবাই দেখল নিলয় নিজের হাতে মিস্ আকাঙ্ক্ষার ব্রেসলেটা পরে রয়েছে। ততক্ষণে ওদের চারজনের চোখে মুখের উচ্ছ্বল আনন্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে ওরা সফল।

|| ১৩ ||

সাল ২০৫০, ২০শে জানুয়ারি

দ্যুতি হিমাচল প্রদেশের একটি হসপিটালের বেডে শুয়ে রয়েছে। ওর শরীর স্থিতিশীল, ডাক্তার বলেছেন কিছুদিনের মধ্যেই ওকে রিলিজ দেবেন। যদিও ও নিজে শরীরে কোনও বেদনা অনুভব করছে না।

ডঃ চক্রবর্তী নিজে এসেছিলেন দ্যুতির সঙ্গে দেখা করতে, উনিই বললেন, মিস্ আকাঙ্ক্ষার হাতের ব্রেসলেটের একটি কনটেনারে মধ্যে লুকানো ছিল ওই মারণ ভাইরাস, ওরা হায়দরাবাদের মতো সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট শহরকে বেছে নিয়েছিল, কারণ ওদের লক্ষ ছিল কম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষকে আক্রান্ত করা, আর ডঃ অয়নান্তের পাশের ঘরে তিনটে লোককে আটকে রেখে জোর করে কনটেইনার সমেত ওদের ওই ভাইরাস গিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ওদের প্ল্যান ছিল সময় সুযোগ বুঝে ওদের পেট থেকে ওই কনটেইনার ভর্তি ভাইরাস বার করবে, ওই তিনজন শৌর্যকে সব কথা বলার পর এনইএ ওদের পেট থেকে কনটেইনারগুলো উদ্ধার করে, এরমধ্যে একজনের পেটে ওই কনটেইনার কোনওভাবে লিক হয়ে যাওয়ার কারণে ওনার শরীরে ভাইরাসের বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, তাই তাকে আর বাঁচানো যায়নি। ডঃ অয়নান্ত ঘটনাস্থলেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।

দ্যুতি ডঃ চক্রবর্তীতে হতাশ স্বরে বলে, “কেন বলুন তো এমন করে মানুষ? কেন এতো ঘৃণা, লোভ?” ডঃ চক্রবর্তী নিজের চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে নার্সিংহোমের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উদাস গলায় বলে ওঠেন, “মা, আজ পর্যন্ত ভালোবাসা দিয়ে কোনও যুদ্ধ জয় করা যায়নি, ঘৃণা খুব তাড়াতাড়ি সংক্রমিত হয়, ভালোবাসায় সংক্রমণের হার খুব কম।” তারপর ওরা দুজনেই চুপ করে বসে থাকে, সময় কেটে যায় নিজস্ব ছন্দে। দ্যুতি বুঝতে পারে জীবনকে কখনও একটা ডায়মেনশনে মাপা যায় না।  

দ্যুতি এখন একটা নিউজ চ্যানেলের সামনে বসে রয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী একশো তিনতম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন। দ্যুতি ওর আইসিইউর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনের কাচের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, দেখলো একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে, সূর্যের নরম আলো ওদের ছুঁয়ে দিচ্ছে, অপূর্ব লাগছে দেখতে, ঠিক যেমনটা ও সেদিন লখনউ শহরে সন্ধ্যার আকাশে দেখেছিল তবে আজ ও জানে, ও শুধু একা নয়, পুরো দেশ ওই পাখিগুলোর মতোই স্বাধীন ও নিরাপদ।          

* পৃথিবীর একমাত্র ‘বায়োনিক চাইল্ড’ (Bionic child) ইংল্যান্ডের অলিভিয়া ফ্রান্সওর্থ-এর জীবনের বিস্ময়কর ক্রোমোজমের বিরল পরিবর্তনের ঘটনাকে নিয়ে গল্পটি লেখা হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা ১৮ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে মেয়েটির সম্পর্কে এই বিরল ঘটনা ছাপা হয়েছিল।

.

অনুভা নাথ

জন্ম বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত শহর নৈহাটিতে। পেশায় সরকারি সংস্থায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। লেখালেখি প্যাশন। “আনন্দমেলা”, “সানন্দা”, “কিশোর ভারতী”, “শুকতারা”, “সংবাদ প্রতিদিন”, “সুখবর”, “কবি সম্মেলন”, “উত্তরের সারাদিন”, “এইসময় ব্লগ”, “জাগোবাংলা”, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রকের ম্যাগাজিন “চিরসবুজ লেখা”, “জয়ঢাক”, “জলফড়িং”, “বাংলা লাইভ”, “অপার বাংলা” সহ প্রচুর পত্র-পত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজ়িন, ওয়েবজিন ও সংবাদপত্রে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা প্রকাশ পেয়েছে। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অমিয়া ভৌমিক স্বর্ণকলম পুরস্কারে’ ভূষিত হয়েছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একটি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন